(জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে)
১
শ্যাওলা-শোভিত পাঁচিলের ধার ঘেঁষে
হলদে পাখিটা স্বপ্নে উঠলো ডেকে।
তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম স্নেহে,
দিলো সে আমাকে সুশ্রী পালকে ঢেকে।
পাখিটা চকিতে আমার গলায়, গালে
চঞ্চুর ঘায়ে করলো অনেক ক্ষত-
মনে পড়ে গেল বাল্যসখীর ঠোঁট,
বাগানে ভ্রমণ, তন্বী গোলাপ কতো।
স্বপ্ন মোটেই নয়কো আজ্ঞাবহ,
তাই মাঝ-পথে আচম্কা পড়ে যতি।
স্বপ্ন হারিয়ে শিশুর মতোই আজো
বুকে পুষে রাখি বেলুন-হারানো ক্ষতি।
উঠোনের কিছু বিনীত চারায় দেখি
কলি পেতে চায় ফুলের সার্থকতা।
পাতার শব্দে, ডালের আন্দোলনে
বেজে ওঠে প্রাণে স্বপ্ন-জাগানো কথা।
দেয়ালের হুকে আটকানো পাজামায়,
শার্টের ভাঁজে, পাৎলুনে পড়ে রোদ।
লেখার টেবিলে চড়ুই রটায় ফের
আনন্দ-ঘন নতুন বস্তুবোধ।
সূর্যের লাল মুখের ওপর আজ
অসাধ্য বটে দরজা বন্ধ করা।
পাঁচিলে, উঠোনে দিনারের ঝকমকি,
কানায় কানায় ভরে নিতে হবে ঘড়া!
আজ সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ফুঁকবো কি শুধু শস্তা চুরুটগুলি?
নিজেকে প্রবোধ দেয়ার খেয়ালে মেতে
আঙুলে নাচাবো অলীক মড়ার খুলি?
ভাববো কি ফের তীব্র আর্সেনিকে
কার সে সজীব গোলাপ হয়েছে ছাই?
অথবা শূন্য দেয়ালের দিকে চেয়ে
বলবো কি মরজগতের শেষ চাই?
২
গুমোট রাত্রির পর হতশ্রী কপাট খুলে দেখি
(জয়তু ঘুমের বড়ি, নিদ্রা দিয়েছেন কোল রাতে)
পদ্মার ইলিশ হয়ে সকাল কাঁপছে চতুর্দিকে।
বারান্দায় খয়েরী চেয়ারে বসে পিতা
ভরা অবসরে
ঝিমোচ্ছেন, সকালের কাগজটা হেডলাইনের জমকালো
বর্ণচ্ছটা নিয়ে
পড়ে আছে এক পাশে। চেয়ারে ঠেকানো ঘাড়, প্রায় স্তব্ধ মুখের ভিতর
নকল দাঁতের অবাস্তব শুভ্রতায় চাঁপা-রঙ আলোকণা
হরিণশিশুর মতো শব্দহীন খেলায় মাতাল!
‘দূর দূর’ শব্দ শুনে চম্কে তাকাই, গেল, গেল, বিড়ালটা
কী নিয়ে পালালো দূরে। ট্যুথব্রাশ কই? নিঃশেষিত টিউবকে
অযথা পীড়ণ করি, বস্তুত মাসান্তে কয়লাই ভরসা হে!
জীবন বলোতো তুমি কতো চতুরালি জানো? আলী আকবর
পঁচিশ নিমিট ধরে বাজাচ্ছেন আশাবরী। রান্নাঘর থেকে
মা এলেন বারান্দায়, কপালে ঘামের ফোঁটা, হাতে
চায়ের সামান্য সরঞ্জাম ছেলেমেয়ে ক’টি তা-থৈ হর্ষোল্লাসে
পড়ার ঘরকে দিব্যি বানিয়ে ক্রুশোর দ্বীপ খোঁজে
সোনার হরিণ বনে। আমার টেবিল পড়ে থাকে আধপোড়া
সিগারেট, গমের রুটির টুকরো, শূন্য চা-র বাটি। এইসব দৃশ্যাবলি
প্রচুর দেখেও সুখ, ইচ্ছে হয় উঠোনের গাঁদার চারাটা
ঠিক করে দিই আর পাঁচিলের কাকটার কুশল শুধাই।
এইসব দৃশ্যাবলি চোখ ভরে দেখে দেখে দেখে
শূন্য গলিপথ ছেড়ে পা-দুটো বাড়াই
পৌরপথে, রাজপথে বড়ো ভিড়; মনে হয়, সমস্ত শহর
রঙিন বেলুনের গেছে ছেয়ে।
শার্টের কলার ঠিক করে কেউ হেঁটে যায় দ্রুত, হাসিমুখে
কেউবা সেলুনে ঢোকে, কেউ
পুরোনো জুতোর কাদা ঝেড়ে ঝেড়ে আড়চোখে দ্যাখে
সিনেমার বর্ণাঢ্য পোষ্টার।
কেউবা ছেলের হাত ধরে
দাঁড়ায় রাস্তার মোড়ে,ধাবমান ট্রাকের শক্রতা
থেকে গা বাঁচায় আবশ্যিক ক্ষিপ্রতায়।
দেখি কেউ, বুড়ো সুড়ো একজন, পান
চিবুতে চিবুতে হাল্কা রসিকতা করে
পড়শীর সঙ্গে আর অবহেলে কেউ
অশ্লীল গানের কলি ভেঁজে
লক্কড় গাড়িতে জোতে ডানা-কাটা হাড় জিরজিরে পক্ষীরাজ।
এ শহরে
কেউবা হাপর টানে, অক্লান্ত পেটায় লোহা কেউ;
কেউবা ঘুরিয়ে চাকা গড়ে নানা ছাঁদে
নানান পুতুল, কেউ রঙচটা ষ্টেজে প্রাণপণে
আওড়ায় পার্ট, কেউ কবিতার প্রতিটি অক্ষরে
নক্ষত্রের দীপ্তি চেয়ে ক্লান্ত হয় দুরাশার ভীষণ চত্বরে।
যতই অসহ্য হোক ক্লান্তি আর যতই দুরূহ
হোক পথ, বুড়ো পিকাসোর পরাক্রান্ত
ভীবনতৃষার মতো তৃষ্ণা এই আমাদের স্বতই চালায়
শিল্পের জটিল পথে। নানান রঙের ছবি দেখে
আমরাও হয়ে যাই অভিজ্ঞ সমজদার, মাথা নাড়ি সূক্ষ্ম
ঠারে ঠোরে, দৃষ্টি রাখি রুচি পরিবর্তনের ঋতুতে ঋতুতে,
নিবিষ্ট অধ্যবসায়ে মুক্তো তুলি কখনো-সখনো
মজা খাল সেঁচে আর
সমাজসমস্ত প্রেমে আত্মোদ্ধার খুঁজে
অপ্রেমের বুড়ি ছুঁই, কানামাছি খেলি বারবার!
যৌবনের অপব্যয়ে সম্প্রতি শোকার্ত আমি, নিরুপায়, দেখি
স্বাচ্ছন্দ্যের গোধূলিতে চিরাগত বংশবৃদ্ধি চলে
প্রমত্ত কামের পাঁকে। পঙ্কজের স্বপ্ন ধূলিসাৎ, চতুঃসীমা
কর্কশ কণ্টকাবৃত, আগাছার জয়জয়কার। মাঝে-মাঝে
স্বৈরিণীর আলিঙ্গনে বড়ো দ্রুত গলে যায় মর্যাদা, বিবেক
নামক সুচারু স্তম্ভগুলি। নিয়মিত বাচস্পতি জীবনের
চাটুবাক্য শুনে-শুনে অকূলের ভেলায় বেশতো কাটে কাল!
৩
দান্তের মতো ঘুরি জনপদে একা;
সাঁকো আছে ঠিক, জলও বয়ে যায় নিচে।
এখানে ওখানে ব্যাকুল দৃষ্টি রাখি,
কিন্তু কোথায় আমার বিয়াত্রিচে?
সূর্যের মুখ আকাশের দর্পণে
ভেসে উঠলেই বলি নেপথ্যে, প্রিয়
আর কতোকাল কাটবো গ্লানির ছড়া?
ফ্যাকাশে জীবনে কিছুটা পালিশ দিও।
যৎকিঞ্চিৎ সুখ, তা-ও ক্ষণজীবী।
আমার শিরায় দৈববিধান ক্রমে
পিতৃপুরুষ কী ব্যাধি গেছেন রেখে,
রজ্জু দেখেই পালাই সর্পভ্রমে।
জীবন তো জানি সাবানের বল, জলে
প্রতি মুহূর্তে যাচ্ছে ভীষণ ক্ষয়ে।
পুরোনো বাড়ির ছায়ায় লালিত আমি,
মুখে বংশের বিষাদ বেড়াই বয়ে।
অন্তে তলাবো চিরলুপ্তির খাদে,
ভূত-ভবিষ্য মিলাবে শূন্যতায়।
এসব জেনেও বাঁচার ব্যাকুল তৃষা-
মানব জন্মে এই তো আমার দায়।