৮
অর্ধসহস্র বছর আগের গোরার জীবনকাহিনী উপস্থাপনাতে ত্রিদিবনাথ যখন বিরতি টানল, মায়াপুরের কৃষ্ণচেতনা মন্দিরে সন্ধ্যারতি তখন শেষ হয়েছে। অনেক আগে অন্ধকার নেমেছে পৃথিবীতে। মন্দির চৌহদ্দির খোপে খোপে অন্ধকার থাকলেও ফ্লুরোসেন্ট আলোর সমারোহে মূল চত্বরে অন্ধকার ঘেঁষতে পারেনি। ভাইপো গোরাকে নিয়ে ত্রিদিবনাথ বসেছে মন্দিরের উদ্যানে, গোলাপের বাগানে। আলো অন্ধকারে দশআনা, ছ ‘আনা মিশেলে সেখানে ঊষাকাল অথবা গোধূলির বিনির্মিত স্বচ্ছতা। সেই আবহে গোরার মুখের দিকে তাকাল ত্রিদিবনাথ মেজদা, প্রমথনাথের ছেলেকে মনে হল, ইতিহাসের সেই গোরা পাঁচশো বছর পার হয়ে তার সামনে ভাইপোর পরিচয়ে বসে আছে। কাকার তৈরি মেগাসিরিয়ালের পরপর পাঁচটা ‘এপিসোড’ শোনার ঘোর গোরার তখনও কাটেনি। তার নিস্তব্ধতার মধ্যে মন্দিরে যে ‘ইলেকট্রিক বেল’ স্বল্পসময়ের বিরতি দিয়ে তিনবার বেজে উঠল, তা যে অতিথিদের খেতে যাওয়ার ডাক, ত্রিদিবনাথ জানাল গোরাকে। বলল, সন্ধ্যারতির প্রসাদ নেওয়ার তলব, মানে ‘ডিনার’-এর ডাক এসেছে।
সেজকাকার কথকতায় বিমুগ্ধ গোরা খেয়াল করেনি দিন-শেষের আলো কখন সরে গিয়ে রাত নেমেছে, শব্দহীন ঢেউ তুলে এগিয়ে চলেছে অন্ধকার গভীর রাতের দিকে। রাত আটটা বেজেছে। সেজকাকার পরিচালনায় নির্মিত ‘গোরা’ মেগা-সিরিয়ালের বৃত্তান্ত, এমন আঠার মতো তাকে জড়িয়ে ধরেছে যে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। উঠতে পারছে না কংক্রিটের ছাতার তলা ছেড়ে। ফ্লুরোসেন্ট আলো পড়ে, সামনে গোলাপ বাগানে ফুটন্ত ফুলের সংসার জুড়ে জমাট বাঁধছে সুগন্ধি আতিথেয়তার বিভা। নবদ্বীপের উল্টোদিকে গঙ্গার ধারে, মায়াপুরে চোখ জুড়োনো এমন একটা মন্দির আছে, দু’একবার শুনলেও সেজকাকা কলকাতায় না এলে তার দেখা হত না। ঘরের কাছে দর্শনীয় এই জায়গা, তার অগোচরে থেকে যেত। অথচ আমেরিকাবাসী সেজকাকার কাছে নিজের বাড়ির মতো চেনাজানা এই মন্দিরের ঘর, বারান্দা, আনাচ-কানাচ, মন্দিরবাসীদের সঙ্গে পরমাত্মীয়ের সম্পর্ক। সেজকাকার নিয়মিত যাতায়াত আছে এখানে, গোরা বুঝে গেছে। কলকাতায় থাকলে, আজ সন্ধেতে সে ‘মন্ত্রে’ যেত। ঐশী, বৈভব, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ডিসকোথেকে কানের পর্দা ফাটানো গান-বাজনা, নাচানাচির মধ্যে বেশ কয়েকবার জাঁক করে হাউসটনবাসী নভোবিজ্ঞানী সেজকাকার প্রসঙ্গ পাড়লেও সেই ধুমধাড়াক্কার মধ্যে তার কথা বেশির ভাগ বন্ধু শুনতে পায়নি। শোনা সম্ভব নয়। ‘অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট’ ত্রিদিবনাথ রায় সম্পর্কে দু’চার কথা শুনে, তার সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ ঐশী দেখালেও বৈভব জিজ্ঞেস করেছিল, তোর কাকা কি তোর চেয়ে টলার’ মানে বেশি লম্বা, আরও ‘হুইটিশ কমপ্লেকসন’, ফর্সা?
গোরা জবাব দেয়নি। সেজকাকার সঙ্গে দু’জনই অবশ্য আলাপ করতে চেয়েছিল। সেজকাকা কলকাতায় এসেছে জানলে ঐশী, বৈভবের সঙ্গে আরও এক-দু’জন হয়তো দেখা করতে আসত। ঐশী, বৈভবকে মোবাইল ফোনে জানালে মায়াপুরে তারা চলে আসতে পারে। ‘সুইচ’ বন্ধ রাখা, পকেটের মোবাইল ফোনে হাত বুলিয়ে, তাদের এখানে ডাকার আগে সেজকাকার সঙ্গে গোরা কথা বলে নিতে চায়। সকাল থেকে অনেক বন্ধু নিশ্চয় মোবাইল ফোনে তাকে ধরতে চেষ্টা করে, না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। সেজকাকাকে দেখার পর থেকে হাঁপ ধরানো হুল্লোড়ে জীবনে অভ্যস্ত গোরা, অন্যরকম এক জীবনের গন্ধ পাচ্ছে। নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানী, স্বভাবে আমোদপ্রিয়, সেজকাকা কয়েক বছরে অনেক বদলে গেছে। সদাপ্রসন্ন মুখ, দু’চোখে ভাবুকতা, ভাবনাটা যে বড়মাপের, কাকার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা একান্তে কাটিয়ে গোরা টের পেয়েছে। সেজকাকাও তাকে পাশে চায়, অনুভব করেছে।
ছাতার তলা থেকে বেরিয়ে এসে গোরাকে ত্রিদিবনাথ জিজ্ঞেস করল, নিরামিষ খাবার তোর মুখে রুচবে তো?
— হ্যাঁ।
ত্রিদিবনাথ বলল, এখানে রাতের ভোগ গাওয়া ঘিয়ে ভাজা গরম লুচি, ছোলার ডাল, ধোঁকার ডালনা, শেষপাতে পায়েস খেয়ে মাছ-মাংস থেকে আমার রুচি চলে গেছে।
—লুচি, ছোলার ডাল আমারও ভালো লাগে।
কথাটা বলে গোরা জিজ্ঞেস করল, পায়েস কি লাউ-এর?
—না, গোবিন্দভোগ চালের, দুর্দান্ত স্বাদ।
খাওয়ার আলোচনার মধ্যে গলা নামিয়ে ত্রিদিবনাথ হঠাৎ বলল, তোকে কিছু কথা বলব, খাওয়ার পরে, ঘরে বসে।
অবাক চোখে গোরা তাকাতে সেজকাকা বলল, একটু সময় নিয়ে বলতে হবে।
কথাটা কি জানার ইচ্ছে থাকলেও গোরা চুপ করে থাকল। চাপাস্বভাবের ছেলে সে। জীবন সম্পর্কে আসক্তির সঙ্গে চোরা উদাসীনতা তার চরিত্রে মিশে আছে। বন্ধুদের সঙ্গে রাতে ‘মন্ত্রে’ মাতামাতি করলেও যে কোনওদিন সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। কোনও বিষয়ে গায়ে পড়ে কৌতূহল দেখায় না। সেজকাকার কথা, সে যখন নিজে বলতে চায়, তখন আগ বাড়িয়ে গোরা কেন জিজ্ঞেস করবে? পরের কথাটা আগে শুনতে চাওয়া, একধরনের হ্যাংলামি, সে জানে। পারিবারিক জীবনের পরিবেশ থেকে এ শিক্ষা সে পেয়েছে।
মন্দিরের অতিথিশালার দোতলার লম্বা বারান্দায় শ্বেতপাথরের মেঝেতে মুখোমুখি দু’লাইনে সারি দিয়ে খেজুরপাতার আসন পেতে অতিথিদের খেতে বসার জায়গা হয়েছে। নিখুঁত চতুষ্কোণ ঝকঝকে আসনগুলো দেখে গোরার মনে হল সদ্য সেগুলোতে পালিশ পড়েছে। প্রতিটা আসনের সামনে প্রায় সমান মাপের সবুজ কলাপাতা। ভালো করে জলে ধুয়ে, সাদা তোয়ালেতে সযত্নে প্রতিটা পাতা মোছা হয়েছে, ত্রিদিবনাথ সে খবর শোনাল গোরাকে। পাথরের মেঝে, খেজুরপাতার আসন, সবুজ কলাপাতা, কোথাও এক কণা ধুলো নেই। জোরালো আলো জ্বলছে অনেকগুলো, ফ্যান ঘুরছে মাথার ওপর। গাওয়া ঘিয়ের গন্ধে ভারী হয়ে আছে বারান্দার বাতাস। মুখে শ্রীকৃয়ের ভোগ বললেও, এ যে রীতিমতো ভূরিভোজন, গরম লুচি ছিঁড়ে ছানার ডালনা দিয়ে খাওয়ার সময়ে গোরা বুঝতে পারল। গোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে ত্রিদিবনাথ বলল, ধোঁকার ডালনার সঙ্গে আজ বাড়তি ‘আইটেম’ ছানার ডালনা রয়েছে।
তার সম্মানে যে আজ সব অতিথিকে ছানার ডালনা পরিবেশন করা হচ্ছে এ খবর আগে থেকে ত্রিদিবনাথের জানা থাকলেও ভাইপোর কাছে ফাঁস করল না। গোরা ভাবছে, এমন নিরামিষ খাবার পেলে অনায়াসে মাংস, মাছ, ডিম খাওয়া ছেড়ে দেওয়া যায়। মিষ্টি সে খায় না, তা দোকানের সন্দেশ, রসগোল্লা হোক, আর বাড়িতে তৈরি পিঠে, পায়েস, মালপো হোক, দাঁতে কাটে না। অতিথিভবনের রাতের খাওয়ার শেষ ‘আইটেম’ ছোট এলাচ ছিঁড়ে মেশানো গোবিন্দভোগ চালের পায়েস মুখে দিয়ে সে বিমোহিত হল। পায়েস এমন সুখাদ্য, সে জানত না। বাড়িতে মা, কাকিরা পায়েস বানালে কদাচিৎ এক-আধ চামচ নাক সিঁটকে মুখে পুরে একঢোকে সেটা গিলে রান্নাঘরের চত্বর ছেড়ে পালায়। জন্মদিনে তবু মা পায়েস বানায়। গোরা খায় না। জন্মদিন নিয়ে হৈচৈ করা তার স্বভাববিরুদ্ধ। আর পাঁচটা দিনের মতো কাটায়। বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েরা সাড়ম্বরে জন্মদিন পালন করতে জন্মদিনের পরের দিন থেকে দিন গুনতে শুরু করে। তারা ঘোরতর পায়েস-বিরোধী। মা-কাকিদের পায়েস তৈরির উৎসাহ কমে যাচ্ছে, গোরা জানে। বাড়িতে কারও জন্মদিনে এখন নামি কনফেক্শনারের দোকান থেকে বড় সাইজের কেক আসে। কেকের সঙ্গে দোকানি পাঁচ, সাত, দশ, ‘বার্থ ডে বেবি’ যার যেমন বয়স, সেই অনুযায়ী রঙচঙে কাঠির মতো রোগা, আর খুদে কয়েকটা মোমবাতি দেয়। সমবেত গলায় নানা সুরে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু য়্যু’ গানের সঙ্গে বাতি জ্বেলে, কেক কেটে জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠান জমে ওঠে। ক্যাটারার-এর জোগানো খাদ্য তালিকায় পায়েস থাকে না। বাসি পায়েস ঝি-চাকরে খায়।
শেষপাতে গোবিন্দভোগ চালের পায়েস চেটেপুটে খেয়ে গোরাকে ত্রিদিবনাথ জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগল পায়েস?
—দারুণ।
—আর একটু নিবি?
—না।
—আমি কিন্তু নেব।
সেজকাকা চাওয়ার আগে ঝকঝকে পেতলের বালতিতে পায়েস নিয়ে তার সামনে পরিবেশনকারী দাঁড়িয়ে গেল। সেজকাকার যে আর একটু পায়েস খাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে, গোরা আঁচ করল। তাই ঘটল। আরও দু’হাতা পায়েস নিল ত্রিদিবনাথ। পরিবেশনকারী আরও দু’হাতা দিতে ব্যস্ততা দেখালে, তাকে ঠেকাল ত্রিদিবনাথ। কলাপাতার ওপর দু’হাত উল্টে মেলে ধরল। দু’সারিতে বসা অতিথিদের কেউ না বুঝলেও সেজকাকা যে ‘ভি.আই.পি’ অতিথির খাতির পাচ্ছে, গোরা টের পাচ্ছিল। খাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘরে গিয়ে সেজকাকার মুখোমুখি বসতে চায় সে। সেজকাকার কি বলার আছে, শুনতে চায়।
কলকাতার বাড়িতে তার ঘরে বসে নানা কথার মধ্যে কাল থেকে সেজকাকা কিছু বলতে চেয়ে থেমে গেছে। কথাটা যে গুরুত্বপূর্ণ আর গুহ্য, সেজকাকার হাবভাব থেকে ধরতে পেরেছে। গোলাপ বাগান ছেড়ে আসার পথে সেই জরুরি কথাটা বলার প্রসঙ্গ সেজকাকা পাড়তে গোরার শরীরে রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে গেছে। ইতিহাসের গোরার কাহিনী, বিকেল থেকে সেজকাকার মুখে শুনে সে এমন মুহ্যমান হয়ে আছে, যে তার রেশ কাটিয়ে আলাদা কোনও বৃত্তান্ত মাথায় ঢুকবে কিনা, এ নিয়ে তার সন্দেহ হচ্ছে। গোরার কাহিনী পুরোটা না শুনে অন্য প্রসঙ্গে সে যেতে চায় না। জটপাকানো জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্যে অব্যাহতি পেতে সেজকাকার ছায়ায় থাকতে চায়। ঐশী, বৈভবকে ফোন করে এখানে ডেকে নিতে ইচ্ছে করলেও তা চেপে রেখেছে। সকাল থেকে পকেটের মোবাইল ফোন পর্যন্ত চালু করেনি। অর্ধসহস্র বছর আগে, নবদ্বীপে যে মানুষটা জন্মেছিল, তার কাহিনী রামায়ণ, মহাভারতের গল্পের মতো তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মেগা-সিরিয়ালের সেই নায়কের জীবনকাহিনীর মাঝখানে, অন্য বিষয় নিয়ে সেজকাকা কথা শুরু করলে, মূল গল্প শোনার আমেজ কেটে যেতে পারে। গোরার তা পছন্দ নয়। কিন্তু সেজকাকা নিজে থেকে অন্য কথা পাড়তে চাইলে, তার গুরুত্ব যে কম নয়, বরং মূল কাহিনীর সমান, গোরা আন্দাজ করতে পারে। আপাদমস্তক কৌতূহল চেপে রেখে সে ‘ডিনার’ খেয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে ফিরে সেজকাকার মুখোমুখি বসতে চাইছিল। দশ মিনিট বাদে দেখা গেল অতিথিনিবাসের তিনতলার ঘরে, বারান্দার দিকে মুখ করে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে কাকা-ভাইপো বসে রয়েছে। দক্ষিণের বারান্দার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে তারপর নিজের দুটো চোখ, গোরার অক্ষিগোলকের ওপর রেখে এমন কিছু কথা ত্রিদিবনাথ বলতে থাকল, যা শুনে থেকে থেকে গোরা চমকে উঠলেও মুখে প্রকাশ করল না। চেয়ারে বসে নড়াচড়া করতে ভুলে গেল। ত্রিদিবনাথ বলল, হাউসটন থেকে আসার আগে পর্যন্ত তার ধারণা ছিল, পঞ্চাশটা ‘এপিসোড’ শ্যুট করার পরে আকস্মিক এক কারণে, মাঝখানে আটকে যাওয়া ‘গোরা’ মেগাসিরিয়াল শেষ করা যাবে না। গোরার ভূমিকায় যে অভিনয় করছিল, আমেরিকান সেই ছেলেটা, নাম রবার্ট টুমান—গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার আগের ‘এপিসোড’ পর্যন্ত ছবির কাজ করে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছে। ঠিক নিরুদ্দেশ নয়, ত্রিদিবনাথকে না জানিয়ে একতরফা নিজের ইচ্ছেতে চলে গেছে। হাউস্টনে মা-বাবাকে জানিয়ে গেলেও নবদ্বীপে, যেখানে তার শ্যুটিং চলছিল, সেখানে ত্রিদিবনাথকে কিছু জানায়নি। খবর দিয়েছিল, কয়েকদিন পরে ই-মেলে।
গোরাকে বিশদে ত্রিদিবনাথ যে বিবরণ শোনাল, তা এরকম। শ্যুটিং-এ কয়েকদিন বিরতি দিয়েও নবদ্বীপে থেকে গিয়েছিল ত্রিদিবনাথ। রোজ সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত জেগে, চৈতন্যজীবনীর আকর গ্রন্থগুলো থেকে চিত্রনাট্যের উপযোগী তথ্য জোগাড় করে, ‘ল্যাপটপে’ ভরে নিচ্ছিল। পোড়খাওয়া গবেষক সে। মগজটা জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেও গাধার মতো খাটতে পারে। দলবল নিয়ে টানা দেড় মাস কাজ করে পনেরো দিনের জন্যে শ্যুটিং-এ বিরতি ঘটাতে ত্রিদিবনাথ বাধ্য হয়েছিল। গোটা টিম, অভিনেতা থেকে কলাকুশলী, ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়েছিল। কয়েকদিনের ছুটি চাইছিল তারা। ঘর-সংসারের জন্যে কাতর হয়েছিল কেউ কেউ বেশিরভাগ কলকাতার মানুষ। নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নবদ্বীপ আর কাটোয়ার মতো মফঃস্বল শহরে দেড় মাস কাটিয়ে, আত্মীয়স্বজনের জন্যে তাদের মন কেমন করছিল। পনেরো দিনের ‘ব্রেক’ না দিয়ে ত্রিদিবনাথের উপায় ছিল না। নামভূমিকায় মানে গোরা চরিত্রের অভিনেতা রবার্ট, যাকে ‘বব্’ বলে ত্রিদিবনাথ উল্লেখ করছে, সেই ‘বব্’ ঠিক করেছিল পনেরো দিনের ছুটিতে সে নবদ্বীপ থেকে গোরার নীলাচল যাওয়া পর্যন্ত রাস্তাটা সরেজমিনে ঘুরে দেখবে। আত্মপরিচয় ভুলে নিজের ভূমিকায় অভিনয় করার সঙ্গে বিষয়টা আত্মস্থ করতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছিল সে। তাকে উৎসাহ জোগাচ্ছিল ত্রিদিবনাথ। নবদ্বীপ থেকে নীলাচল যাওয়ার পথপরিক্রমা মুলতুবি রেখে হঠাৎ সে কেন হাউস্টনে চলে গেল, ত্রিদিবনাথ জানে না। তারও হয়তো পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে ইচ্ছে জেগেছিল। অন্য কারণ থাকলে, ত্রিদিবনাথের জানা নেই।
ববের বাবা ডক্টর উইলফ্রেড্ ট্রুমান, যাকে ত্রিদিবনাথ ডাকে ‘বিলি’ নামে। সেও প্রখ্যাত মহাকাশবিজ্ঞানী। ইউ.এফ্.ও. বা ‘আনোন্ ফ্লাইং অবজেক্ট’ চর্চায় সে বিশেষজ্ঞ। মহাকাশের ওপারে যে মহাকাশ, সেখানে জীবতত্ত্বের প্রামাণ্য উন্মোচনে দু’দশকের বেশি কাজ করছে উইলফ্রেড্। বলা যায়, ‘বায়োস্পেস্-ফিজিসিস্ট’ সে। হাউস্টনে একই গবেষণাকেন্দ্রে ত্রিদিবনাথের সহকর্মী।
নভোবিজ্ঞানী কেন্দ্রের বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানকর্মী, তাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজনকে আত্মহত্যা, অবসাদ, বিষণ্ণতার স্যাঁতসেঁতে আবহ থেকে বার করে এনে, বেঁচে থাকার আনন্দে উদ্দীপ্ত করার দাওয়াই যখন খুঁজছে ত্রিদিবনাথ, তখনই এক সন্ধেতে বিলির বাড়িতে ববকে দেখে ‘গোরা’ ছবি তৈরির চিন্তা এসেছিল তার মাথাতে। ম্যাসাচুসেট্স্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে হাউস্টনে মা-বাবার কাছে সদ্য কয়েকদিন বব্ ফিরেছে। তার ছেলেবেলা থেকে তাকে দেখেছে ত্রিদিবনাথ। ববের সঙ্গে কথার সূত্রে জানতে পারল স্নাতক পর্যায়ে তার প্রধান বিষয় পদার্থবিজ্ঞান হলেও পাঠক্রমে নিজের পছন্দমতো আর যে দুটো বিষয় সে নিয়েছিল, তার একটা জীবাণু অস্ত্র সংরক্ষণ বিজ্ঞান, দ্বিতীয়টা ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য। ত্রিদিবনাথের বাড়িতে একাধিকবার ভারতীয় মার্গসংগীতের সিডি আর ক্যাসেট শুনে, ডিভিডিতে শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা দেখে এমন মজে গিয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য, একটা বিষয় হিসেবে রয়েছে দেখে, সেটাই নির্বাচন করে। হাসিমুখে বাব জানিয়েছিল, নতুন এই বিষয় নিয়ে চর্চার প্রেরণা সে পেয়েছিল ত্রিদিবনাথের সাহচর্যে। জীবাণু অস্ত্র সংরক্ষণ বিষয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল না করলেও নৃত্যকলার পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল। তার কত্থক নাচ দেখে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাচের অধ্যাপক, পরীক্ষকও বটে, সদাশিব নাইডু মুগ্ধ হয়। ওড়িশি নাচে তার নৈপুণ্য দেখে, তাকে সঙ্গী নিয়ে নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্র উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরের সবচেয়ে বড় প্রেক্ষাগৃহে যে যুগলবন্দি ‘কন্সার্ট’ করেছিল, সেখানে একটা দর্শক আসন খালি ছিল না। রবার্ট ট্রুমানের মতো একজন উঁচুমানের নৃত্যশিল্পী, তার ওপর আমেরিকার, তাকে খুঁজে পাদপ্রদীপের আলোয় হাজির করার জন্যে ভুবনেশ্বরের দর্শকরা ধন্য ধন্য করেছিল নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্রকে। শাস্ত্রীয় নৃত্যে ববের পারদর্শিতার খবর পেয়ে ত্রিদিবনাথের বুকের মধ্যে খুশির আলোড়ন জাগে। হাউস্টন নভোবিজ্ঞান কেন্দ্রের কর্মীদের আত্মবিধ্বংসী মনস্তত্ত্বের চিকিৎসায় স্নায়ুবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ থেকে আরও যত পন্থা, ধ্যান, যোগচর্চা, ভোজবাজি, মানসিক আরাম দেওয়ার বহুরকম নিদান কাজে লাগিয়ে, ব্যর্থ হয়ে ত্রিদিবনাথ নিজেও হতাশ হয়ে পড়েছিল। সেই অবস্থায় শেষ চেষ্টা হিসেবে আনন্দের জীবন্ত উদাহরণ খুঁজে বার করে সহকর্মীদের চাঙ্গা করার পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল। ববের সঙ্গে কথা বলে ত্রিদিবনাথের মাথায় নতুন চিন্তার ফুলকি ঠিকরে উঠল। আনন্দ থেকে পৃথিবী, বিশ্বচরাচরের জন্ম, আনন্দের মধ্যে প্রতিপালিত, আনন্দেই সব কিছুর অবসান। মহাসময়ের মন্দিরার তালে তাল মিলিয়ে জন্ম, মৃত্যু, দু’হাতে তালি বাজিয়ে মহা আনন্দে তাতা থৈথৈ নেচে চলেছে। অবসাদ, আত্মহত্যা প্রবণতা থেকে মুক্তি দিতে পারে আনন্দ, তার জন্যে চাই নাচ, চাই গান, সুরের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার উপকরণ চাই। বকে দেখে ত্রিদিবনাথের চোখের সামনে থেকে অন্ধকার পর্দাটা সরে গিয়েছিল। তার আগে মানুষ-জন্তুর হুহুঙ্কারে প্রকম্পিত পৃথিবীর জন্যে শান্তি, বিশেষ করে হাউস্টনের মহাকাশজিগীষু কর্মসূচিতে, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অংশ নিতে অনিচ্ছুক সহকর্মীদের জন্যে সমদর্শিতা, আনন্দের উৎস খুঁজতে কত জায়গায় ঘুরেছে, হিসেব নেই। গেছে ক্যালিফোর্নিয়ায় মহেশ যোগীর আশ্রমে, নিভেডা প্রদেশে রজনীশের যোগমন্দিরে, নিউইয়র্কে ভক্তিবেদান্ত স্বামীর কৃষ্ণচেতনা শিবিরে, বিখ্যাত গ্রন্থাগারগুলো ঘুরে আর ইন্টারনেটে খুঁজেছে আর্ত মানবতার দুঃখমোচনে, যুগে যুগে মহামানবদের রচিত কর্মসূচি, অভিলষিত আনন্দের তত্ত্ব, তাদের নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতি, শেষ পর্যন্ত ত্রিদিবনাথের নজর কাড়ল এমন একজন মানুষ, যার জন্ম ১৪৮৬ সালে পূর্বভারতের বাংলায়, নবদ্বীপ নামে এক আধা গ্রাম, আধা শহরে, যার নাম—গোরা, রাজকীয় নিষেধাজ্ঞা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে রূপকথার বাঁশিবাদকের মতো সাংগীতিক গণঅভ্যুত্থান যে ঘটিয়েছিল, প্রতিষ্ঠা করেছিল স্ত্রী-পুরুষের প্রেমকে যাবতীয় সম্পর্কের ‘মডেল’ হিসেবে। জলে-স্থলে, পাহাড়ে, অরণ্যে, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গে এমনকি রাস্তার ধূলিকণায় প্রেমের বাঁশি বাজতে শুনেছিল সে।
ইতিহাসের কোলাহল থেকে ‘গোরা’কে আবিষ্কারের অনবদ্য মুহূর্তের বিবরণ ভাইপোকে শুনিয়েছিল ত্রিদিবনাথ। নিউইয়র্কে, এ.সি ভক্তিবেদান্তস্বামীর কৃষ্ণচেতনা মন্দিরে কয়েকবার যাতায়াতের পরে এক গোধূলিতে মন্দিরের ভেতরে টেরাকোটা শৈলীতে বানানো এক ম্যুরাল, দেওয়ালচিত্রে ত্রিদিবনাথের চোখ আটকে যায়। শেষ বিকেলের আলো পড়ছিল দেওয়ালের টেরাকোটা স্থাপত্যে। স্থির দেওয়ালচিত্রে, সপারিষদ নৃত্যকীর্তনে রত গোরার মুখের মৃদু হাসি, দু’চোখের দৃষ্টি থেকে গড়িয়ে পড়া করুণা, হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে। স্তব্ধ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ত্রিদিবনাথ। সে ভক্তবৈষ্ণব নয়, বিগত যুগের তথ্যসন্ধানী ঐতিহাসিক নয়, সে নভোবিজ্ঞানী, পৃথিবীর মাটি আর মহাকাশবিশ্বকে নির্ভুল নিয়মসূত্রে বাঁধতে চায়, তার মনে হয়েছিল, ভক্তি, যুক্তি, ইতিহাস, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, নিয়মের মধ্যে আকাশের নক্ষত্রখচিত আলোকরেখার মতো পৃথিবীর মানুষের জন্যেও প্রেমে, ভালোবাসায় দেদীপ্যমান এক পথ রয়েছে, পাঁচশো বছর আগের এক মানুষ, সপারিষদ সেই পথে নেচে চলেছে, গানের প্লাবন বইয়ে দিয়েছে পথের দু’ধারে। বিজ্ঞানী উইলিফ্রেড্ ট্রুমানের ছেলে ববের দিকে তাকিয়ে মধ্যযুগের সেই মানুষটার মুখের অবিকল প্রতিমূর্তি দেখেছিল ত্রিদিবনাথ। রাতে বাড়ি ফিরে ইন্টারনেট থেকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠের মূল দপ্তরের ওয়েবসাইটে ঢুকে, সেখান থেকে নানা সূত্রে তন্নতন্ন করে খুঁজে জগন্নাথ মিশ্রের ছোট ছেলে, বিশ্বম্ভর মিশ্র ওরফে নিমাই ওরফে গৌরাঙ্গ ওরফে গোরার যে জীবনপঞ্জি তৈরি করল, সেখান থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দুটো তথ্য পেল, তার প্রথম হল, বকে ইতিহাসের গোরার যমজ ভাই বললে অবিশ্বাস করবে না কেউ। দু’নম্বর তথ্য হল, গোরা ছিল প্রধানত ভালো নর্তক, গায়ক, অভিনেতা। তখন ‘কানু ছাড়া গীত’ না থাকার জন্যে সে কৃষ্ণলীলার নানা গান, বিশেষ করে রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বিরহ, মান, অভিমান, মিলনের গান গাইত। তার কাছে কৃষ্ণ তখন ছিল সুর আর গানের প্রতীক, যাত্রাপালার নায়ক, দুঃশাসক সুলতানদের ভয় দেখানোর মাধ্যম।
মধ্যযুগের ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে গোরা চরিত্রকে উদ্ধার করে, আজকের আঙ্গিকে পুনরুজ্জীবিত করতে নভোবিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রেক্ষাগৃহে ত্রিদিবনাথ যে নৃত্যনাট্যের আয়োজন করল, তার বিষয় ছিল, স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের ষড়যন্ত্রে জলপ্লাবনে বৃন্দাবন ভেসে গেলে গিরিগোবর্ধনে আশ্রয়গ্রহণকারী বৃন্দাবনবাসীকে কৃষ্ণ কীভাবে বাঁচিয়েছিল সেই কাহিনী। জলের নিচে বৃন্দাবন তলিয়ে যাওয়ার পরে গোবর্ধন পর্বত যখন ডুবতে চলেছে, কৃষ্ণ তখন মাটি থেকে পাহাড়কে উপড়ে দুটো সবল হাতে মাথার ওপর তুলে এক পক্ষকাল দাঁড়িয়ে থাকে।
ষড়যন্ত্রকারী ইন্দ্র, পরাজয় মেনে নিয়ে কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়। কাহিনীর ভেতরকার প্রতীকধর্মী মানবিক সত্যকে শাস্ত্রীয় নৃত্যকলায় পারঙ্গম বব্, মঞ্চে হাজির করেছিল। ববের নাচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মার্গসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, দক্ষিণ ভারতীয় রাংসংগীতে অংশ নিয়েছিল হাউস্টনের ভারতীয় ছেলেমেয়েরা। শুধু ভারতীয় কেন, গলা মিলিয়েছিল আমেরিকান আর বিভিন্ন দেশের গানপাগল তরুণ-তরুণী। সে ছিল এক এলাহি আনন্দসন্ধ্যা। সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল ববের ‘পারফরমেন্স্’, মঞ্চে তার উপস্থাপনা। গর্বোদ্ধত দেবরাজ ইন্দ্রের ভীতিপ্রদর্শনকে কৃষ্ণের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ বৃন্দাবনের মানুষের প্রতিরোধ, দুন্দুভির সঙ্গে নটরাজ কৃষ্ণের জেহাদ নৃত্য, তার জের টেনে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মূল সূত্র, ই=এম.সি.স্কোয়ার (e=mc2)-এর শতবর্ষ স্মরণ, মহাবিশ্বের পটভূমিকায় আইনস্টাইন উদ্ভাবিত সমীকরণ, জাগতিক, পরাজাগতিকের দ্বৈত নৃত্যনাট্য, মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে বিজ্ঞানী উইলফ্রেড্কৃত কবিতা, গান শেখানো, সেই সমীকরণের প্রাঞ্জল ধারাবিবরণী, তারই কণ্ঠস্বরে মাইকে বাজছিল। সভ্যতার বহুস্বরকে শুনতে পাচ্ছিল ত্রিদিবনাথ। জীবন, জড়পদার্থ, আলোর কণা মিলে যে পরাজাগতিক চিত্রপট মঞ্চে তৈরি হয়েছিল, দর্শক-শ্রোতাদের তা অভিভূত করে। স্থানকালের অনেকমাত্রিক অবয়বে পৃথিবীর চেয়ে অধিকতর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিসম্পন্ন সূর্যের টানে আলোর গতি যে নৃত্যরত জ্বলন্ত ফুলঝুরির বিভঙ্গে অকল্পনীয় চিত্রকলা রচনা করতে পারে, ববের প্রতিটা পদক্ষেপে, হাতের মুদ্রায়, চোখের অভিব্যক্তিতে তা উছলে উঠছিল। মনে হচ্ছিল প্রবল গতির আলোর ঘূর্ণি নাচছে মঞ জুড়ে। ববের উচ্চতা, শরীরের গঠন, মুখ, চোখ, নাক, চিবুকের সঙ্গে ইতিহাসের গোরার মিল, সম্ন চোখে ত্রিদিবনাথ নজর করছিল। তার মনে হচ্ছিল, পাঁচশো বছর পার হয়ে নবদ্বীপের মাটি ছেড়ে হাউস্টনের প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চে নাচছে সেই গোরা। নাচগানের ঢেউ যে মগজের মধ্যে ঢুকে গিয়ে মানুষকে অতিমানুষ বানিয়ে দিতে পারে, ভাবাবেগে বিহ্বল ববকে দেখে ত্রিদিবনাথ উপলব্ধি করেছে। নিজের ধারণা সঠিক কিনা তা জানতে বিখ্যাত স্নায়ু বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করেছে, তাদের অভিমত জেনেছে। প্রথিতযশা স্নায়ুবিশারদ, অলিভার স্যাক্স, যাঁর লেখা সমাদৃত গ্রন্থ ‘সিউজিকোফিলিয়াটেল্স অব মিউজিক অ্যাণ্ড দ্য ব্রেন’ আর ‘অ্যাওয়েকেনিংস’ ছত্রে ছত্রে রয়েছে মগজের স্নায়ুমণ্ডলীতে সুর, সংগীত, নৃত্যের যে প্রভাবের বিবরণ আলোচিত হয়েছে, মানুষকে তা অতীন্দ্রিয় প্রভাবে আবিষ্ট করে। নিজের আত্মপরিচয় সে ভুলে যায়। নিজেকে সে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করে এবং সেই উচ্চতায় পৌঁছে যায়।
.
অতিথিনিবাসের বারান্দার বাইরে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ত্রিদিবনাথ থামল। মেগাসিরিয়ালের গোরা, হাউস্টনের ববের সঙ্গে নিজে জড়িয়ে যাচ্ছে অনুভব করেও চুপ করে থাকল গোরা। শান্ত মন্দিরচত্বর নিস্তব্ধ। অতিথিনিবাসের সামনের চাতাল আলোকিত, গোলাপ বাগানের সব আলো নিভে গেছে। মন্দিরের ভেতরে রাস্তার কিছু আলো শুধু জ্বলছে। ত্রিদিবনাথ বলল, বব্ আর তার বাবা, মানে আমার সহকর্মী বিলিকে, তাদের ‘লিভিংরুমে’ .পাশাপাশি বসিয়ে এক সন্ধেতে শোনালাম গোরাকে নিয়ে আমার ‘মেগাসিরিয়াল’ তৈরির প্রকল্প। নবদ্বীপের গোরা সম্পর্কে কিংবদন্তি আর বাস্তব মেশানো কিছু কাহিনী, দু’জনকে কিছুদিন ধরে সুযোগ পেলে শুনিয়ে তাদের মনে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি করেছিলাম। হাউস্টন নভোবিজ্ঞান কেন্দ্রের উদ্যোগে সেই গোরাকে নিয়ে আমার মেগাসিরিয়াল তৈরির পরিকল্পনা শুনে বিল নড়েচড়ে বসলেও ববের ভাবান্তর হল না। কথা না বাড়িয়ে বকে বললাম, গোরার ভূমিকায় তোমাকে অভিনয় করতে হবে।
আমি কি পারব?
ববের প্রশ্নের জবাবে বললাম, পারবে, তুমিই পারবে। তোমাকে কিছুটা সংস্কৃত আর বাংলা ভাষা শিখতে হবে। দুটোই আমি শেখাব। মিথিলার সংগীতবিশারদ জ্যোতিরীশ্বর কবিশেখরাচার্যের গ্রন্থ ‘বর্ণরত্নাকরে’ যে ছেচল্লিশটা রাগ-রাগিণীর উল্লেখ আছে, তার মধ্যে যেগুলো প্রধান, সপারিষদ সেই রাগ-রাগিণীতে গোরা যত কীর্তন করত, তার কিঞ্চিৎ তালিম নিতে হবে তোমাকে। একশো আট তালের গরাণহাটি কীর্তন আর চুয়ান্ন তালবিশিষ্ট খেয়ালাঙ্গ মনোহরশাহী কীর্তন কয়েকটা শেখা দরকার। সিডি-তে বা ক্যাসেটে শুনে তোমার পক্ষে গলায় তুলে নেওয়া কঠিন হবে না। ডিভিডি, ইন্টারনেটেও এসে গেছে দেখার মতো অনেক ফিল্ম, শোনার জন্যে গান, জানার মতো প্রচুর তথ্য। এ ঠিক লেখাপড়ার বিষয় নয়, এর সঙ্গে রয়েছে আনন্দিত হওয়ার উপকরণ, মুক্তি আর স্বাধীনতার সঙ্গে পরিচয়। ‘হাউস্টন স্পেস্ রিসার্চ” সেন্টারের দমবন্ধ করা আবহ, সুর গান আর খুশিতে আমরা ভাসিয়ে দেব। চোখের সামনে থেকে, অপটু হাতে রঙ করা, সাজানো পৃথিবী, তার আড়ালে যে দুঃখী পৃথিবী আছে, সেখানে পৌঁছে যাবে এই আনন্দের ঢেউ। মৃত্যু, অবসাদ থেকে মুক্তি পাবে মানুষ। আমাদের চোখের সামনে নতুন এক জীবনবোধ গড়ে উঠবে।
নিশ্চুপ গোরাকে এক মুহূর্ত দেখে ত্রিদিবনাথ বলল, আমার বন্ধু বিলি তাকিয়েছিল ছেলের দিকে। বিলি আন্দাজ করতে চাইছিল, গুরুভার এ দায়িত্ব, ছেলে বব্ কতটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে। বব্ নিজেও হয়তো তেমন কিছু ভাবছিল। সে তরতাজা আমেরিকান ছেলে। যে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা নিজেদের বিশ্ববিজয়ী, মহানুভব সম্রাট ভাবে, সেখানের তরুণদের মনের কাঠামো দু’চারজনের যথেষ্ট যুক্তিবাদী, মানবিক হলেও, তার মধ্যে স্পর্ধিত অহং থেকে যায়। বয়সের ধর্মও সাধারণভাবে এই স্পর্ধার কারণ। জন্মসূত্রে বব্ পেয়েছে প্রবলপ্রতাপ আত্মবিশ্বাস। মানুষ, সব পারে। ‘অসম্ভব’ বলে পৃথিবীতে কিছু নেই, এ তার দার্ঢ্য ধারণা। সে জানে ভাষা শেখা, রাগ-রাগিণীতে তালিম নেওয়ার যাবতীয় উপকরণ, আধুনিক প্রযুক্তির জোরে হাউস্টনে বসে জোগাড় করে ফেলা সম্ভব। পাঁচশো বছর আগে ‘গোরা’ নামে যে সন্ন্যাসী নবদ্বীপে জন্মেছিল, তার নাড়িনক্ষত্রের খবর ইন্টারনেটে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলা যায়। রাজি হওয়ার আগে বিষয়টা ভালো করে বুঝে নিতে ‘গোরা’ আর ‘বৈষ্ণবধর্ম’ সম্পর্কে যত ‘ওয়েবসাইট’, ই-মেল’ ঠিকানা আছে আমার কাছ থেকে জেনে সে নিজের কম্পিউটারে জমা করেছিল।
বারান্দার দরজা দিয়ে হেমন্তের ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। হাওয়ায় উড়ছে ত্রিদিবনাথের মাথার অগোছালো লম্বা চুল। গোরার চুলে ‘ক্রু-কাট’, কদম্বফুলের রোঁয়ার মতো সেই চুলে চিরুনি না পড়লেও এলোমেলো হয় না। ত্রিদিবনাথের বিবরণের শেষাংশ এরকম
সাতদিন পরে বব্ জানিয়েছিল ত্রিদিবনাথের প্রস্তাবে সে রাজি। গোরার ভূমিকায় সে অভিনয় করবে। ত্রিদিবনাথের কাছ থেকে নিতে শুরু করল বাংলা আর সংস্কৃতভাষা শেখার তালিম। বিজ্ঞানের ছাত্র ত্রিদিবনাথ সংস্কৃত শিখেছিল কলকাতার হাতিবাগান এলাকার এক পণ্ডিতের টোলে। মেঘদূতের পূর্বমেঘ, উত্তরমেঘের অনেক পংক্তি গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারত। গীতার কিছু অধ্যায় কণ্ঠস্থ ছিল। প্রখর ছিল সংস্কৃত ব্যাকরণ জ্ঞান। মন ঠিক করতে, বব্ যে সাতদিন সময় নিয়েছিল, তার মধ্যে ইন্টারনেট খুলে গোরা আর কীর্তন সম্পর্কে রাতের পর রাত জেগে যে প্রভূত তথ্য সংগ্রহ করল, তা শুনে ত্রিদিবনাথ টের পেল তার তথ্যের ঝুলির কাছে পৌঁছে গেছে ববের ভাণ্ডার। যোগ্য ছাত্র বাছাই করে পুলকিত হয়েছিল ত্রিদিবনাথ বেটো-বোম্বেটে আমেরিকান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে অসংখ্য সংবেদনী, মেধাবী, পড়ুয়া ছেলে আছে, বব্ তাদের একজন। প্রথম মাসের চেষ্টাতে সে প্রায় ছুঁয়ে ফেলল ‘মেগাসিরিয়ালের প্রকল্পক ত্রিদিবনাথের জ্ঞানভাণ্ডার। তিন মাসের মধ্যে তার প্রস্তুতি অবাক করে দিল ত্রিদিবনাথকে। ভাঙা বাংলায় কথা বলতে শুরু করল। দেবনাগরী হরফে লেখা নীতিমূলক বই পড়তে শিখল। জীবনযাপনেও সে বদলে ফেলছিল নিজেকে। ত্রিদিবনাথের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার পরের মাস থেকে সে শাকাহারী হয়ে গিয়েছিল। মাসে একবার যে চুল কাটত, সে সেলুনে যাওয়া বন্ধ করল। ঘাড় ছুঁইছুঁই লম্বা হল তার তামাটে চুল। হাউস্টন আর কাছাকাছি শহরগুলিতে ভারতীয় নানা সংস্থায় যোগাভ্যাস, ধ্যান, ধর্মাচরণশৈলী অনুশীলন করতে লাগল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কান্না ‘প্র্যাকটিস’ করতে কিছুদিন চেষ্টা চালানোর পরে অনুভব করল, পৃথিবীর দীনদুঃখী মানুষের কথা ভাবলে তাদের জন্যে করুণায় দু’চোখ ছাপিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। কীর্তনের চালু বাদ্য, আশাবরি, আহিরি, কেদার, কোশবা, গুর্জরি, ধনচি বা ধানেশ্রী, নট, বসন্ত, বিভাস, বরাড়ি, মালব, মলারি, ললিত, সারঙ্গ রাগে গাওয়া গানের সিডি ক্যাসেটে ভরে উঠতে থাকল তার ঘরের মিউজিক সিস্টেমের আলমারি। ত্রিদিবনাথের কাছে বাংলাভাষা শিখতে এসে এক সকালে শুনিয়ে দিল বিভাস রাগে নির্মিত, নবদ্বীপের গোরার প্রিয় গান অবশ্যই কীর্তন—
—তুয়া চরণে মন লাগহুঁরে।
সারঙ্গধর। তুয়া চরণে মন লাগহুঁরে।
ভোরের আলোর মতো মধুর হাসি মুখে ছড়িয়ে কীর্তনের প্রথম লাইন বব্ গেয়ে উঠতে ত্রিদিবনাথ তার দিকে তাকিয়ে অনুমান করল, গোরার মুখে এই হাসি সবসময়ে লেগে থাকত ভাইপো গোরার মুখে তার গাম্ভীর্যের মধ্যে একরকম হাসি, সেই মুহূর্তে ত্রিদিবনাথ দেখতে পেল। গোরার চরিত্রাভিনেতা হিসেবে ববের নির্বাচনে ভুল হয়নি। মৃদঙ্গ, খোল, করতাল বাজানোতে অল্পদিনে সে হাত পাকিয়ে ফেলল। পিয়ানো যে বাজাতে জানে, যে কোনও বাদ্যযন্ত্র রপ্ত করতে তার বেশি সময় লাগে না। স্কুলে পড়ার সময় থেকে, তার অন্যতম পাঠ্য বিষয় পিয়ানোতে বব্ হাত পাকিয়েছিল। প্যান্ট, শার্ট ছেড়ে সে তখন গাত্রাবাস করেছে গেরুয়া পাঞ্জাবি, সবুজ শেরওয়ানি। গলায় ধবধবে সাদা উত্তরীয়। আপাতবিচারে পোশাকটা অদ্ভুত হলেও বব্কে ভারি স্নিগ্ধ দেখাত। মাঝে মাঝে কপালে আঁকছিল চন্দনের তিলক। চন্দনকাঠ, কাঠ ঘষার শিল থেকে পোশাক-আশাক সে জোগাড় করেছিল নিউইয়র্কে ভক্তিবেদান্তস্বামীর মন্দির থেকে।
তিনি মাসের মধ্যে প্রথম পঞ্চাশটা ‘এপিসোড’ ক্যামেরাবন্দি করতে, অভিনেতা-অভিনেত্রী বাছাই থেকে কলাকুশলী সংগঠিত করার কাজ, ত্রিদিবনাথ শেষ করেছিল। নানা সূত্র থেকে তথ্য জোগাড় করে ‘গোরা’ চরিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে টের পেল চৈতন্যভক্তদের রচিত জীবনী আর ঐতিহাসিকের নৈর্ব্যক্তিক অভিমতের মধ্যে বিস্তর বানানো কাহিনী আর বিচ্যুতি রয়েছে। ভক্তের রচিত জীবনীগ্রন্থে প্রচুর আজগুবি বিবরণের আড়ালে যেমন যথার্থ বাস্তব উপকরণ আছে, তেমনই ঐতিহাসিক বৃত্তান্তে বাদ পড়ে গেছে ইতিহাসের অচিহ্নিত বহু উপাদান। ইতিহাসের অলক্ষ্য প্রান্ত, যা গোপনে, নিঃশব্দে কাজ করে যায়, দু’পক্ষের কেউ-ই তা ছুঁতে পারেনি। গবেষক, বিজ্ঞানী ত্রিদিবনাথ জানে সত্য অনুসন্ধানের পদ্ধতি। নিজের পদ্ধতিতে পাঁচশো একুশ বছর আগে যে মানুষটি জন্মেছিল, তার সাতচল্লিশ বছরের জীবন, পুনরাবিষ্কারের চেষ্টা করে চলেছে ত্রিদিবনাথ
পঞ্চাশটা ‘এপিসোড’ তৈরির পরে ইরাকের মাটিতে মার্কিন সেনাবাহিনী বোমারু বিমানবহর নিয়ে ঢুকে পড়তে উটকো বিপত্তি হাজির হল। হাউস্টনে পনেরো দিন ছুটি কাটাতে নবদ্বীপ ছেড়ে বব্ রওনা হওয়ার আটচল্লিশ ঘণ্টায় ইরাক আক্রমণ করল আমেরিকা। গোপনে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ইরাক মজুত করেছে, এই অভিযোগ তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তার বন্ধু দেশগুলো কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় হৈচৈ করছিল। যুদ্ধের তোড়জোড় চলছিল বছরখানেক ধরে। পৃথিবী কাঁপানো হুঙ্কার ছাড়ছিল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। এত হাঁকডাকের পরে, যুদ্ধ না করে আমেরিকার উপায় ছিল না। মার্কিনী বোমারু বিমানের ক্ষেপণাস্ত্রে ইরাক যখন বিধ্বস্ত হচ্ছে, আমেরিকা সমেত দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ যখন প্রতিবাদে মুখর, তখন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে ত্রাণকর্মী হিসেবে কাজ করতে বর্ ইরাকে চলে গেছে। দেশ ছাড়ার আগে ই-মেলে’ ত্রিদিবনাথের কাছে ক্ষমা চেয়ে বব্ সবিনয়ে জানাল, নিজের দেশের রাষ্ট্রশাসকদের এই পাপ, হাজার হাজার নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার এই ঘটনা সে সহ্য করতে পারছে না। অভিশপ্ত মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে। মুখ থুবড়ে পড়েছে তার বিবেক। ত্রিদিবনাথকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে না পেরে সে অনুতপ্ত। গোরার চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে সেই চরিত্রের সঙ্গে সে এত একাত্ম হয়ে গেছে যে তার মনে হচ্ছে, গোরা আজ বেঁচে থাকলে সে-ও এই ত্রাণকাজে শামিল হত। সে অনুভব করছে, গোরার কাছে সে দায়বদ্ধ। ত্রিদিবনাথ চাইলে, মেগাসিরিয়ালের বাকি কাজ, সে রক্তস্নাত ইরাকের মাটিতে করতে পারে। গোরা চরিত্র অভিনয়ের সূত্রে সে-ও গোরার মতো আর্ত-মানবতার পাশে দাঁড়াতে চায়, মানবধর্ম সংস্থাপনের জন্যে গেয়ে বেড়াতে চায় স্বাধীনতার গান।
আক্রান্ত মানুষের সেবায় ইরাকে না গিয়ে তার উপায় নেই। টিভিতে পঞ্চাশটা ‘এপিসোড’ দেখানো শেষ হওয়ার আগে সে ফিরে এসে বাকি কাজ তুলে দেবে।
মা, বাবার অনুমতি নিয়ে বব্ ইরাকে গেছে। যেকোনও দুর্ঘটনায় বব্ সেখানে মারা যেতে পারে, জেনেও বিজ্ঞানী উইলফ্রেড্ ট্রুমান আটকায়নি ছেলেকে। ববের মা, মিসেস্ ট্রুমান নিমরাজি থাকলেও মুখে আপত্তি করেনি।
ববের ইরাকে চলে যাওয়ার খবর ই-মেলে’ জেনে ত্রিদিবনাথ হতভম্ব হলেও হতাশায় ভেঙে পড়েনি। সিরিয়ালের অনেকটা কাজ বব্ এগিয়ে দিয়ে গেছে। গোরার ‘আদিলীলা’ অর্থাৎ চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস নেওয়ার আগে পর্যন্ত শ্যুটিং’-এর সঙ্গে ছিল। সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে ‘মধ্যলীলা’ আর ‘অন্তলীলা’ আরও কমবেশি ষাট-সত্তরটা ‘এপিসোড’ ক্যামেরাবন্দি করতে হবে। বলা যায়, মেগাসিরিয়ালের ষাট শতাংশ এখনও ‘শ্যুট’ করা বাকি। কাহিনীর উপসংহার নিয়ে ত্রিদিবনাথ এখনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারেনি। পৃথিবী থেকে গোরার অপ্রকট হওয়ার কোনও বৃত্তান্ত, তার গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। সেই অংশ ক্যামেরাবন্দি করতে যথেষ্ট দেরি থাকলেও তা নিয়ে ত্রিদিবনাথ ভেবে চলেছে। গাঁজাখুরি গল্প সে শোনাবে না। সকলের আগে দরকার ববের মতো চৌখস একজন অভিনেতা খুঁজে বার করা, যার চেহারাও হবে ববের মতো। পঞ্চাশটা ‘এপিসোড’ সম্প্রচারের মধ্যে অনেকটা সময় রয়েছে জেনেও ববের বিকল্প খুঁজে বার করা সহজ নয়, সে জানত। সেই সঙ্গে বিশ্বাস করত, কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। পৃথিবীতে যোগ্যতমের চেয়েও যোগ্য মানুষ সব সময়ে কোথাও থেকে যায়। তার খোঁজ পাওয়া আর পরশপাথর খুঁজে পাওয়া প্রায় সমান শক্ত কাজ
দায়িত্বমুক্ত হয়ে ইরাক থেকে ববের ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি ঠুনকো নয় জেনেও ত্রিদিবনাথ ঝুঁকি নিতে চাইছে না। ইরাকের মতো ভয়ংকর এক রণক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা শুধু ববের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। কোনও পক্ষের বোমা, গুলিতে যদি সে মারা যায়, নিদেনপক্ষে পঙ্গু হয়ে যায়, তাহলে বাকি ‘এপিসোড’গুলো কফিনে ঢুকে যাবে। বিকল্প খুঁজতে স্বদেশে এসে, সেই বিকল্পকে কলকাতায় পৈতৃক বাড়িতে পেয়ে যাবে, সে কল্পনা করেনি। বিকল্পটি তার ভাইপো, তার সহোদর মেজদা, প্রমথনাথের ছেলে, বয়স চব্বিশ, সবগুলো কাকতালীয়ভাবে মিলে যেতে পারে, এ তার ধারণায় ছিল না। বিজ্ঞানের কোনও নিয়ম দিয়ে ঘটনার এই সমাপতন ব্যাখ্যা করতে পারছিল না ত্রিদিবনাথ। কাল দুপুরে গোরাকে দেখার পর থেকে তার মনে যে আলোড়ন জেগেছে, তার প্রকৃত কারণ সে ছাড়া কারও জানা সম্ভব নয়। তারা দেখছে পরিবারের বিদেশবাসী মানুষটি বাড়িতে ঢুকে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে থাকলেও হঠাৎ প্রাণবন্ত, চনমনে হয়ে উঠল। বদলে গেল দু’চোখের দৃষ্টি, দু’চোখের তারা থেকে আলো ঠিকরোতে থাকল। সত্যি তাই। কাল দুপুরে, বসার ঘরে গোরাকে ঢুকতে দেখে তার বুকের রক্ত চলকে উঠেছিল। মনে হয়েছিল বব্ ঢুকেছে ঘরে। ইরাক থেকে নবদ্বীপে, তার ‘ল্যাপটপে’ ই-মেল পাঠিয়ে কলকাতার বাড়িতে সশরীরে হাজির হয়েছে। ববের সঙ্গে কিছু তফাত থাকলেও পাঁচশো বছর আগে নবদ্বীপে ভূমিষ্ঠ গোরার সঙ্গে ‘ভাইপো’ গোরার অভ্রান্ত মিল দেখে, মহান বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের মতো ‘ইউরেকা’ (পেয়েছি) বলে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করলেও, সে কথা হারিয়ে ফেলেছিল। তখনই অনুভব করেছিল, তার রক্তের মধ্যে আনন্দের প্রবাহ বইতে শুরু করেছে। পনেরো দিন আগে নবদ্বীপে ববের ই-মেল’ পেয়ে সেখানে কাজ বন্ধ রেখে পুরো খবর জানতে ত্রিদিবনাথ হাউস্টনে চলে যায়। বন্ধু বিলি, মিসেস ট্রুমানের সঙ্গে কথা বলে খুঁটিনাটি সব জেনে কয়েকদিন মনমরা হয়ে কাটিয়েছিল ত্রিদিবনাথ। বিকল্প খোঁজার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা খুঁজতে বারো হাজার মাইল দূরত্ব ঠেঙিয়ে কলকাতায় নিজের বাড়িতে ববের জুড়িকে দেখে স্বর্গে আর মর্ত্যে আজও যে অনেক অলৌকিক কাণ্ড ঘটে চলেছে, এই ধারণা তার দৃঢ় হয়েছে। সুদুর্লভ অনুভূতিতে মন ভরে গেছে। ত্রিদিবনাথ তখন-ই মুখ খোলেনি। ববের বিকল্প পেয়ে গিয়ে স্বস্তি অনুভব করেছিল। অসম্পূর্ণ মেগাসিরিয়াল তৈরির কাজ অসমাপ্ত থাকবে না, তদ্দণ্ডে হৃদয়ঙ্গম করেছে। ঘরের দরজায় দাঁড়ানো গোরাকে দেখে, কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে, যেমনটি খুঁজছে, এ নিখুঁত তাই, বুঝে গিয়ে তাকে ডেকে পাশে বসিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক গোরার যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন, গায়ের রঙ কিছু উগ্ররকমের সাদা, হলুদের আভা মেশানো, ছ’ফুট দু-তিন ইঞি লম্বা, চওড়া হাড়, দুহাতের মুঠো যেন বাঘের দুই থাবা, চমকে দেওয়ার মতো মোটা, গম্ভীর গলার স্বর, মজবুত চোয়াল, ঠোঁটদুটো পাতলা আর চাপা, খাঁড়ার মতো নাক, ভাসাভাসা চোখে তীক্ষ্ণ, গভীর দৃষ্টি, সব মিলে ভাইপোটি হুবহু তাই, চোখে পড়ার মতো, না তাকিয়ে উপায় নেই
কৃষ্ণচেতনা মন্দিরে গোরাকে নিয়ে ত্রিদিবনাথ ঢোকার পর থেকে এখানে যারা অতিথি, যারা দর্শনার্থী, কেউ সরাসরি, কেউ আড়চোখে দেখছিল গোরাকে। গোরা খেয়াল না করলেও ত্রিদিবনাথের নজর এড়ায়নি।
চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছে ত্রিদিবনাথ। গোরা বসেছে তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে, চেয়ারে। দুপুর থেকে আবিষ্ট হয়ে সেজকাকার মুখে ইতিহাসের বৃত্তান্ত শুনলেও তার দু’চোখে এই মুহূর্তে সে আবেশ নেই। ববের কাহিনী শুনতে শিরদাঁড়া সোজা করে সে বসে রয়েছে। চকচক করছে তার দু’চোখের মণি। ববের অসীম সাহস তাতিয়ে তুলেছে তাকে। তীক্ষ্ণ, গভীর চোখদুটো থেকে যেন তাপ বেরোচ্ছে।
কিছু সময় চুপ করে থেকে, বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গোরার কাঁধে আলতো করে দু’হাত রেখে ত্রিদিবনাথ বলল, সিরিয়ালে ববের বাকি কাজটা তোকে করতে হবে। গোরার গৃহত্যাগ থেকে পরের ‘এপিসোড’গুলো তোকে নিয়ে শ্যুট’ করব। এখন তুই অ্যাডভোকেট প্রমথনাথ রায়ের ছেলে গোরা এবং ইতিহাসের ‘গোরা’। মাথা মুড়িয়ে গোরা সন্ন্যাস নেবে, এখান থেকে শুরু হবে পরের ‘এপিসোড’। সামনে দু-তিন মাস চুল কাটবি না। চুল যত লম্বা হয়, তত ভালো। ঘরে ঘরে ‘কৃষ্ণ’ শব্দটা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে গোরা সন্ন্যাস নিয়েছিল। নেচে গেয়ে ‘কৃষ্ণ’ নামে মানুষকে মাতোয়ারা করে দিয়ে সামাজিক সমতা আনতে চেয়েছিল। গ্লানিমুক্ত করতে চেয়েছিল মানুষের মন। মানবিক ধর্ম, যার নাম ভালবাসা, প্রীতি, প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চতুর্বর্গ লাভের সঙ্গে পঞ্চম বর্গ, প্রীতি, ভালবাসা অন্বেষণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পঞ্চমবর্গের পঞ্চমটা যে অন্য চারবর্গের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এই বার্তা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। এই পঞ্চম বর্গটির নাম যে কৃষ্ণ, নিজের আচরণে দেশবাসীর সামনে তা হাজির করেছিল।
সেজকাকার অভিসন্ধি শুনে পাথরের মূর্তির মতো গোরা বসে থাকল। অতিথিনিবাসের বাইরে ডেকে উঠল রাতচরা পাখি। এ ডাক গোরা আগে শোনেনি। কাকের ডাক আর চড়াই পাখির কিচিরমিচির ছাড়া কলকাতায় কোনও পাখির ডাক শোনা যায় না। স্নেহজড়ানো চোখে তার মুখের দিকে সেজকাকা তাকিয়ে আছে টের পেয়েও জানলার বাইরে অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে সে বসে থাকল। সেজকাকার সঙ্গে চোখাচোখি হলে তাকে কিছু বলতে হবে। কী বলবে, সে ভেবে পাচ্ছে না। পকেট থেকে ‘মোবাইল ফোন’ বার করে ঐশীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করলেও, তা করল না। ঐশীকে ফোন করতে হলে বলার কথাটা আগে ঠিক করে নেওয়া ভালো। কী বলবে ঐশীকে? মন্দিরে ঢোকার আগে মোবাইল ফোন ‘সুইচ অফ’ করে সেই যে পকেটে রেখেছে, আর বার করেনি। পাঁচশো বছর আগের যে পৃথিবীতে সেজকাকার সঙ্গে সে পরিক্রমা করছিল, সেখানে মোবাইল ফোনের কোনও ভূমিকা নেই। তার মুখের ওপর থেকে নজর সরিয়ে নিয়ে সেজকাকা বলল, সিরিয়ালে ববের চেয়ে তোর কাজ খারাপ হবে না। আমার মন বলছে, তুই আরও ভালো করবি। তোকে দিয়ে আমি করিয়ে নেব। মন্দির ছেড়ে কাল সকালে যাব নবদ্বীপের ডেরায়, শ্যুটিং-এর কাজ চালাতে যে বাড়িটা ভাড়া করেছি সেখানে। আরও ছ’মাস সেটা আমার দখলে থাকবে। বাড়িটা আমার ‘টেন্ট অফিস’। শিল্পী-কলাকুশলীরা কাজের দিনগুলোতে ওখানে ছিল। বাড়ি এখন ফাঁকা, সকলে ছুটিতে। খালি বাড়িতে বসে তোকে কাহিনীর পরের অংশ শুনিয়ে ঘুরতে বেরবো আমরা। গোরা যে পথে নীলাচল গিয়েছিল, একাধিক পথের কথা ইতিহাসে আছে, তার মধ্যে দুটো প্রধান রাস্তা দেখিয়ে আনব তোকে। দু’দফায় নীলাচল পর্যন্ত গিয়ে সমুদ্রে স্নান করব। বাঙালিকে নীলাচল, মানে পুরী চিনিয়েছিল গোরা। সমুদ্র চিনিয়েছিল। পুরীর নাম দিয়েছিল শ্রীক্ষেত্র।
গোরা জিজ্ঞেস করল, আমি কি পারব?
পারবি। আমি তো আছি।
কথাটা বলে গোরাকে ত্রিদিবনাথ যখন শুয়ে পড়তে বলল, গোরা দেখল, তার হাতঘড়িতে রাত প্রায় বারোটা।