গোরা – ৩২

৩২

দৈববাণীর মতো গোরার মুখ থেকে এমন সব কথা বেরিয়ে আসছিল, যা আগে কেউ শোনেনি। তার ধর্মব্যাখ্যা শ্রোতারা নিজের মতো করে বুঝলেও পৃথিবীতে পিতৃপরিচয়হীন একটি শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়া যে কৃষ্ণের কৃপা ছাড়া কিছু নয়, সাধারণভাবে সকলে মেনে নিয়েছিল। বিধবা নারায়ণী যে কোনওমতে কুলটা নয়, কৃষ্ণের অনুগ্রহে মা হতে চলেছে, এ বিশ্বাস তাদের মনে চারিয়ে গেল। সিঁদুরবিহীন সিঁথি, নারায়ণীকে প্রথম দেখার দিনে ‘পুত্রবতী হও’ বলে আশীর্বাদ করেছিল নিতাই। সেই দুপুরের স্মৃতি, শ্রীবাসের মনে থাকায়, নারায়ণীর সন্তানসম্ভবা হওয়ার কারণ যে নিতাই-এর ছদ্মবেশে ঈশ্বরের কৃপা, শ্রীবাসের বুঝতে ভুল হয়নি। স্বামীর কথা মেনে নিয়েছিল মালিনী। নিতাই টের পেয়েছিল, তার আশীর্বাদকে ঈশ্বরের নির্দেশ হিসেবে পরিবারের কর্তাগিন্নি মেনে নিলেও গভীর ভাবাবেশে ডুবে থাকা গোরা গত তিন মাসে মুখ ফুটে একটা কথা বলেনি। নারায়ণীর মুখ থেকে মহোৎসবের তিন রাতের তৃতীয় প্রহরে তার অনুভূতির ঘটনা গোরা শুনেও নিতাইকে মনে করায়নি সেই আশীর্বাদের মুহূর্ত। কী বিশুদ্ধ তার সংলেপ, কি নিশ্চুপ তার প্রত্যক্ষতা! নিতাই অনুভব করে এই নীরবতাই হল বন্ধুত্ব, কৃষ্ণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, আত্মীয়তা, ভগবানের সঙ্গে জীবনের যোগাযোগ, মানুষের সম্পর্ক!

অন্ধকার চাতালে বসে আকাশ ভর্তি তারার দিকে তাকিয়ে অনুগামীদের গোরা বলল, তোমরা ভয় পেও না, ভেঙে পড়ে। মা, মানুষকে শেখাও ভদ্র হও, বিনীত আর সহনশীল হও, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করেও কয়নাম ভজনা করা যায়, সংকীর্তন করা যায়। আমি হয়তো কিছুদিন তোমাদের মধ্যে থাকব না। তবে মা, বউ সংসার ছেড়ে যেখানেই যাই, মানুষের মধ্যে থাকব, কৃষ্ণনাম প্রচার কর নামের আঠায় জুড়ে গিয়ে লক্ষ কোটি মানুষ প্রেমভক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে যে সঙ্ঘশক্তি গড়ে গুলবে, সেখানে হিংসা, রক্তপাত, অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা থাকবে না, নতুন যে রাজ্য গড়ে উঠবে, তার ভিত্তি হবে প্রেম। তোমরা শুধু গোপনে নারায়ণীকে নবদ্বীপ থেকে শ্রীহট্টে কোনও বৈষুব প্রিয়জনের কাছে পাঠিয়ে দিও। তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে তাকে এখানে এনো না। কৃষ্ণকে জন্মের মুহূর্তে মেরে ফেলার জন্যে তার মামা কংস যেমন ষড়যন্ত্র করেছিল, নারায়ণীর নবজাত সন্তানকে সেভাবে অঙ্কুরে শেষ করে দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করবে পাষণ্ডীরা। তাদের চক্রান্ত যেন সফল না হয়।

এক মুহূর্ত থেমে গোরা বলল, সন্তান প্রসবের পরে শ্রীহট্টে কতদিন সে থাকতে পারবে, বলা মুশকিল। মাথার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে শ্রীহট্টে মামাবাড়িতে সে গেলেও, সে বিধবা, এখবর সেখানে পৌঁছনো অসম্ভব নয়। স্বামীহারানো মেয়ে, সধবা সেজে পরিচয় ভাঁড়িয়ে মামাবাড়িতে রয়েছে, জানাজানি হয়ে গেলে গ্রামে হুলস্থূল লেগে যাবে। তার কচি ছেলেটা, যে কিনা কৃষ্ণের প্রসাদী ফুলের মতো পবিত্র, তাকে ‘জারজ’, ‘বেজন্মা’ দাগা মেরে খুন করবার চেষ্টা হতে পারে। শ্রীহট্ট ছেড়ে নবদ্বীপে তখন নারায়ণীর ফিরে না এসে উপায় থাকবে না। নবদ্বীপেও সে টিকতে পারবে না। অজানা কোনও গাঁয়ে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। কলিকালে কাছাকাছি কোথাও বাল্মীকি মুনির আশ্রম খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। সামগাছির বাসুদেব দত্তের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তার ঠাকুরবাড়ির লাগোয়া একটা ঘরে সন্তান নিয়ে নারায়ণী থাকবে সামগাছিতে বাসুদেবের আশ্রয়ই নারায়ণীর পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ। নারায়ণীর সন্তানের বাবার পরিচয় জানতে বাসুদেবকে ঘাঁটাতে কেউ সাহস পাবে না।

গোরার কথা সবাই মন দিয়ে শুনলেও সে নবদ্বীপ ছেড়ে কিছু দিনের জন্যে চলে যাবে জেনে অনুগামীদের মাথায় বাজ পড়েছিল। গোরাবিহীন নবদ্বীপের দিনরাতের জীবন তারা ভাবতে পারছিল না। তারা কাঁদছিল, কেউ নিঃশব্দে, কেউ ফুলে ফুলে আওয়াজ করে চোখের জল ফেলছিল। নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা চলে গেলে বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে এখানকার পাট চুকিয়ে পালাতে হবে, এ ভয়ও তারা পাচ্ছিল। নবদ্বীপ ছেড়ে অন্য কোথাও গোরা কেন আপাতত অল্পকার আস্তানা গাড়তে চায়, ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের কারণটা অজানা ছিল না। গোরাকে ধরে গৌড়ের রাজধানী একডালায় নিয়ে যেতে সুলতানি সেনাবাহিনীর নবদ্বীপে হানা দেওয়ার গুজব কয়েক মাস ধরে রটছিল। তা যে সত্যি ঘটতে চলেছে, নানা সূত্রে এ পাকা খবর নবদ্বীপে পৌঁছে গিয়েছিল। তার আগে থেকে পথেঘাটে গোরার খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ঘনিষ্ঠজনেরা সারাক্ষণ ঘিরে রেখেছিল তাকে। নবদ্বীপ ছেড়ে গোরাকে কিছুদিন সরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল অদ্বৈত। শ্রীবাস, হরিদাস, গদাধর, মুরারি, জগদানন্দ প্রমুখ অনুগামীরা তা জানত না। নবদ্বীপে গোরাকে আগলে রাখতে চাইছিল তারা। রাতের শেষ প্রহরে সঙ্কীর্তনের শেষে আকাশবাণীর মতো গোরার কথা শুনে তারা যখন একই সঙ্গে রোমাঞ্চিত, বিহ্বল হচ্ছিল, শ্রীবাসের বাড়ির বন্ধ সদর দরজায় খুটখুট করে টোকা দিচ্ছিল কেউ। দিনেরবেলা সে আওয়াজ কারও কানে পৌঁছনোর কথা নয়। শেষ রাতে অন্ধকার আকাশে শুকতারা যখন জ্বলজ্বল করছে, পৃথিবী নিস্তব্ধ, তখনও সদর দরজায় টোকার শব্দ প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। মহাবেশে সবাই ডুবে থাকলেও সকলের আগে বাড়ির কর্তা শ্রীবাস টের পেল বাড়ির বন্ধ দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। হাঁক ছেড়ে ডাকাডাকি না করে সতর্কভাবে দরজায় সে যখন টোকা দিচ্ছে, তখন সে নবদ্বীপের মানুষ, এখানকার সমস্ত পরিস্থিতির খবর রাখে শ্রীবাসের বুঝতে অসুবিধে হল না। কান খাড়া করে আওয়াজটা আর এক দফা শ্রীবাস শুনে গদাধরকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, শুনছ?

—দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ।

—কে হতে পারে?

—ঘোড়সওয়ারদের কেউ?

—না।

—পাষণ্ডীদের পাঠানো খুনে?

দু’জনে চাপা গলায় যখন কথা বলছে, নিতাইকে গোরা বলল, বন্ধ দরজার বাইরে অতিথি দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেকক্ষণ। তাকে নিয়ে আসছি।

গোরা উঠে দাঁড়াতে মুরারি প্রায় দৌড়ে বন্ধ দরজা খুলতে গেল। মুরারির পাশাপাশি দরজার কাছে গোরা পৌঁছনোর আগে তাকে আড়াল করে দাঁড়াল নিতাই, শ্রীবাস, গদাধর, হরিদাস, জগদানন্দ। গোরাকে ঘিরে থাকল তারা। খাটো ধুতি, মাথায় জড়ানো উড়ুনি, দরজার বাইরে আগন্তুককে দেখে চিনতে পারল। মুরারি আগেই চিনেছে গোপীনাথকে। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মুরারি তখন বাড়ির ভেতরে টেনে নিয়েছে। অন্ধকারে গা ঢেকে, শেষ রাতে যে অতিথি এসে শ্রীবাসের বাড়ির উঠোনে ঢুকল, সে হেঁজিপেজি লোক নয়। নীলাচলবাসী বাসুদেব সার্বভৌমের সে ভগ্নিপতি। বৈদান্তিক, মহাপণ্ডিত বাসুদেব ছিলেন উৎকলের অধিপতি, রাজা প্রতাপ রুদ্রের সভাপণ্ডিত। ন্যায়শাস্ত্রে গোপীনাথেরও কম দখল ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা ছেলেবেলা থেকে সে ছিল গোরার বন্ধু, পরম অনুরাগী। গোরার সংকীর্তনের আসরে হাজির থাকলেও তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত গোপীনাথ। ছেলের মতো তাকে স্নেহ করত শচী। শ্রীবাসের বাড়ির বিষ্ণুমন্দিরের অন্ধকার চাতালে বসে গোরা আর তার ঘনিষ্ঠজনদের সামনে বড় সম্বন্ধী বাসুদেব সার্বভৌমের ভাই, ফুলিয়ার বিদ্যাবাচস্পতির পাঠানো গোপন বার্তা ফিসফিস করে শোনাল গোপীনাথ। সুলতানি সেনাদের হাতে আটক হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে গোরার যে এখনই নবদ্বীপ ছেড়ে অন্তর্ধান করা দরকার, এই পরামর্শ দিয়েছে বিদ্যাবাচস্পতি। বিধবা নারায়ণীর গর্ভসঞ্চারের অভিযোগে গোরাকে একডালায় ধরে নিয়ে গিয়ে মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্তও একরকম পাকা হয়ে গেছে, সুলতানের দরবার থেকে গোপনসূত্রে এ খবরও পৌঁছেছে বিদ্যাবাচস্পতির কাছে। সামনে মহাবিপদ অবহেলা করতে মানা করেছে। একথাও বলেছে, ঘোরতর সংকটও শেষ বিচারে সাময়িক। নবদ্বীপের মানুষের জীবন থেকে কিছুদিন বাদে সংকট সরে গেলে নিজের সংসারে গোরা ফিরে আসতে পারবে। গৌড়ের সিংহাসনে তখন নতুন অধীশ্বরের এসে যাওয়া অসম্ভব নয়। গোরাকে নিয়ে সেই দুপুরে নৌকোয় জলপথে গোপনে পুরী রওনা হওয়ার নির্দেশ গোপীনাথকে দিয়েছে বিদ্যাবাচস্পতি। গোরা রাজি থাকলে সকালের আলো ফেটারা আগে তাকে নিয়ে নবদ্বীপ থেকে ফুলিয়ায় চলে যেতে চায় গোপীনাথ। বারকোণা ঘাটে নৌকা নিয়ে বিশ্বাসী মাঝি বসে আছে। ফুলিয়া থেকে সেই নৌকাতে নবদ্বীপে এসেছিল গোপীনাথ।

বিদ্যাবাচস্পতির বার্তা শুনে বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে বসে থাকা মানুষগুলো অন্ধকারে যেন জমাট বেঁধে গেল। কৃষ্ণ চতুর্দশীর একফালি চাঁদ পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। বিষ্ণুমন্দিরের মাথার ওপর দিয়ে ধবধবে একটা লক্ষ্মীপেঁচা শ্রীবাসের বাস্তবাড়ির দিকে উড়ে গেল। গোপীনাথ বলল, অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে এ বিষয়ে বিদ্যাবাচস্পতির একান্তে কথা হয়ে আছে। আপনাদের অজানা থাকলেও গোরা সে খবর জানে। সুলতান হোসেন শাহ উৎকলরাজ্য দখলের ছক ইতিমধ্যে পাকা করে ফেলেছে। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যে কোনওদিন উৎকল রাজ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কটকের শাসনকর্তা, রাজা প্রতাপ রুদ্রের এক শ্যালক, গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই-এর সঙ্গে গৌড়ের সুলতানের গোপন রফা হয়েছে, উৎকল দখল হলে সেখানে গোবিন্দকে রাজসিংহাসনে বসতে সুলতান সাহায্য করবে। উৎকল রাজ প্রতাপ রুদ্র এই মুহূর্তে দাক্ষিণাত্য বিজয়নগররাজ কৃষ্ণদেবের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধে ব্যস্ত। উৎকলের সেনাবাহিনীর আশি ভাগ সেখানে। প্রায় অরক্ষিত উৎকল রাজ্য ছিনিয়ে নেওয়ার এমন সুযোগ গৌড়ের সুলতান ছাড়বে না। পুরুষোত্তমপুরের জগন্নাথ মন্দির লুঠ করাই সুলতানের মূল লক্ষ্য। জগন্নাথদেবের মন্দিরে গচ্ছিত হীরে মণিমাণিক্য, সোনা দেশের আর কোনও দেবস্থানে নেই। শুধু সোনা আছে একশ’ মণ। বাসুদেব সার্বভৌম সাহায্য করলে গজপতিরাজের গুপ্তচররা গোরাকে নিরাপদ পথে পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছে দিতে পারে।

নিশ্চুপ হয়ে গোরা শুনছিল গোপীনাথের কথা। সুলতানি দণ্ডের খাঁড়া তার মাথার ওপর ঝুলছে, সে জানত। বিদ্যাবাচস্পতি আর অদ্বৈতের কাছ থেকে সতর্কবার্তা সে আগেই পেয়েছিল। সঙ্কীর্তন, মহামিছিল করার অভিযোগের চেয়ে তার চরিত্রে আরও বড়রকম কালিমা লেপন করে তাকে ফাঁসিকাঠে বা শূলে চড়ানো হতে চলেছে, বিশ্বস্ত সূত্রে এ খবর তার কাছে পৌঁছেছিল। রাজধানী একডালাতে পৌঁছনোর আগে নবদ্বীপে স্বজাতীয়দের চক্রান্তে খুন হয়ে যেতে পারে, এ আভাসও পাচ্ছিল। বিপদ অনুমান করেও তার মনে ভয়, চাঞ্চল্য, উত্তেজনা জাগেনি। সুলতানি গুপ্তচর আর নবদ্বীপবাসীর চোখে ধুলো দিয়ে জন্মভূমি ছেড়ে সে পালাতে চাইছিল না। নারায়ণী সন্তানসম্ভবা হওয়ার সঙ্গে তার নামে যে কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা রোজ দুর্বহ হয়ে উঠছে, সেই অপবাদ ধুলে ফেলে নিজেকে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, নির্দোষ প্রমাণ না করে নবদ্বীপ ছেড়ে সে নড়বে না। চব্বিশবছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে, কৌপিন পরে, দণ্ডকমণ্ডলু হাতে সংসার ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গিয়ে প্রমাণ করবে, তাকে নবদ্বীপবাসীদের কেউ কেউ নটবর বললেও সে লম্পট নয়। লক্ষ্মী ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মেয়ে, এমনকী দ্বিতীয় স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিয়ের তিনবছর পরেও একটা চুমু খায়নি সে। গয়া থেকে ফেরার পরে তাকে হয়তো কোনও ব্যাধিতে ধরেছে। স্ত্রী-শরীর সম্পর্কে তার সব আগ্রহ কেটে গেছে। বিশ্বরূপের লেখা পুঁথি পড়ে জেনে গেছে সে পিতৃপরিচয়হীন, সে কৃষ্ণের সন্তান, কৃষ্ণই তার বাবা। পৃথিবীর গোপনতম এই খবর জানে শুধু দু’জন, সে আর তার মা, শচী। আরও একজন যে জানত, সে দাদা বিশ্বরূপ, সংসার ছেড়ে আঠারোবছর আগে সে চলে গেছে। গয়াতে জগন্নাথ মিশ্র আর লক্ষ্মীর পিণ্ড দিয়ে বিশ্বরূপের খোঁজে দাক্ষিণাত্যের মন্দিরে, মঠে, ধর্মীয় নানা আখড়ায় দাদাকে খোঁজার যে প্রতিশ্রুতি নবদ্বীপ ছেড়ে আসার আগে মাকে দিয়েছিল, তা দাদার লেখা পুঁথিপাঠের আবেগে ভেসে গেছে। কথা রাখতে পারেনি সে। সম্পূর্ণ বেসামাল দশায় তখন কেটেছিলে কয়েকদিন। তার চারপাশের বিশ্বচরাচর ওলোটপালোট খেয়ে ঘুরছিল। সন্ন্যাস নিয়ে সমাজের তৈরি অমূলক কলঙ্ক মুছে ফেলার সঙ্গে দাদার খোঁজে চষে ফেলবে গোটা দাক্ষিণাত্যের সব সম্প্রদায়ের মন্দির, মঠ, গুম্ফা সন্ন্যাসীর পথ কেউ অবরোধ করে না। সন্ন্যাসীকে কেউ অপমান করে না। সন্ন্যাস নিয়ে সংসার ছাড়ার সিদ্ধান্ত পাকা করলেও গোরার মন মাঝে মাঝে হু হু করে উঠছিল। সঙ্কীর্তনের আসরে চোখের জলের তোড় বেড়ে গেছে। গঙ্গায় স্নানের ঘাটে একা দাঁড়িয়ে নীল আকাশে দিকে তাকালে জলে ভরে উঠছিল দু’চোখ। মনে যে প্রশ্ন ক্রমাগত খোঁচাচ্ছিল, তা হল বিধবা মাকে দেখবে কে? কোথা থেকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জুটবে তার? শুধু মা কেন, তরুণী বউ বিষ্ণুপ্রিয়া বাঁচবে কী নিয়ে? তার ভরণপোষণের কী ব্যবস্থা হবে? মা, বউ-এর অনুমতি ছাড়া পুরুষমানুষের সন্ন্যাস নেওয়া শাস্ত্রবিরোধী। নবদ্বীপে তার নামে যে কুৎসার ঢেউ উঠেছে, মা আর বিষ্ণুপ্রিয়ার কানে তা পৌঁছেছে। গোরাকে তারা কোনও প্রশ্ন করার সাহস না পেলেও পুরোটা অবিশ্বাস করেছে, তাদের মুখ দেখে এমন মনে হয় না। গোরার নামে অপবাদ শুনে তাদের মনে যতই ধন্ধ জাগুক, সে মৃত্যুর দোরগোড়ায় গৌঁছে গেছে, সুলতানি বিচারে অথবা নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ভাড়াটে খুনির হাতে যে কোনওদিন তার মৃত্যু অনিবার্য, এ নিয়ে বউ-এর মনস্তত্ত্ব তাদের সন্দেহ ছিল না। সব ভুলে গোরাকে তারা প্রাণে বাঁচাতে চাইছিল। মা, বুঝতে গোরার অসুবিধে হয়নি। ফুলিয়া থেকে বিদ্যাবাচস্পতির বার্তা নিয়ে তার দূত গোপীনাথ নবদ্বীপে শ্রীবাসের বাড়িতে আসার কয়েকদিন আগে মাঝরাতে সঙ্কীর্তনের আসর থেকে বাড়ি ফিরে মা, বউকে ঘুম থেকে তুলে গোরা শুনিয়েছিল নবদ্বীপে থাকলে সে প্রাণে বাঁচবে না। নবদ্বীপ ছেড়ে আপাতত পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর জীবন রক্ষার উপায় নেই।

গোরার জীবনে যে চরম বিপদ নেমে এসেছে, যে কোনওদিন সে খুন হয়ে যেতে পারে, শচী, বিষ্ণুপ্রিয়ার কানে এ খবর আগে পৌঁছে গিয়েছিল। গোরার কথা শুনে সেই অন্ধকার রাতে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল শচী। ঘরের ভেতরে বিষ্ণুপ্রিয়ার দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরলেও, তা দেখার কেউ ছিল না। নিঃশব্দে কাঁদছিল সে। নবদ্বীপ ছেড়ে কিছুদিন পুরুষোত্তমপুরে গিয়ে থাকার পরামর্শ ছেলেকে শচী দিলেও মাথায় একটা অপবাদ নিয়ে জন্মভূমি ছেড়ে যেতে গোরা রাজি হল না। নবদ্বীপ ছেড়ে এভাবে পালালে চিরকালের মতো তার নামের সঙ্গে যে কলঙ্ক জুড়ে যাবে, তা সে চায় না। সেই অপবদাকে পুঁজি করে নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজকে অসহনীয় লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে। নবদ্বীপের কয়কশ’ বৈষ্ণব পরিবারকে হয়তো সপরিবারে ঘরবাড়ি ছেড়ে শান্তিপুর, কুমারহট্ট, ফুলিয়া, সপ্তগ্রামে চিরকালের মতো ডেরা বানাতে হবে। অনুগামীদের দুর্ভোগ ঠেকাতে গোরা এমন কিছু করতে চায়, চিরকালের মতো যা শত্রু, মিত্র সকলের মুখ বন্ধ করে দেবে। গোরার নাম শুনে শ্রদ্ধায় আনত হবে মানুষ। গোটা গৌড়, রাঢ়, বঙ্গাল কেঁপে উঠবে সে ঘটনাতে। শুধু নিজের প্রাণ বাঁচাতে নবদ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো কাপুরুষতা সে দেখাতে চায় না। রামচন্দ্রপুরের আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছিল ভোরের শুকতারা। দুরু দুরু বুকে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শচী জিজ্ঞেস করল, কী করতে চাইছিস তুই?

কয়েক মুহূর্ত থেমে গোরা বলল, আমি সন্ন্যাস নেব। গোরার কথা শুনে শচীর চোখের সামনে অন্ধকার আকাশ কেঁপে উঠল, বাড়ি, বনস্থলী বনবন করে ঘুরতে থাকল। দূরে আম কাঁঠালের বাগানে ভোররাতে জেগে উঠে যে পাখিটা ডাকছে, সে ‘নিশিভোর’ বলছে, না ‘গৃহস্থের খোকা হোক’ বলছে, এ নিয়ে গাঁয়ের মানুষের মধ্যে বিতর্ক আছে। শচীর কানে পাখির ডাক পৌঁছল না। অন্ধকার ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে বুকফাটা কান্নার আওয়াজ বিষ্ণুপ্রিয়া লুকোতে চাইছিল। অন্ধকার দাওয়ায় বসে শচীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে গোরা বলল, মা, আমাকে বাঁচাতে নবদ্বীপ ছেড়ে গৌড়ের বাইরে কোনও রাজ্যে কিছুদিনের জন্যে তুমি পাঠাতে চাইছিলে। নবদ্বীপ ছেড়ে যেতে আমি অরাজি নই। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে চোরের মতো যদি সংসার, আত্মীয়, বন্ধু ছেড়ে চুপিচুপি চলে যাই, নবদ্বীপের মানুষের চোখে আমি চিরকালের মতো লম্পট হয়ে থাকব। তোমার ছেলে অপযশ নিয়ে বেঁচে থাকুক, তুমি কি তাই চাও? আরো একটা কাজ আমার করা বাকি আছে। দাদাকে খুঁজে পেতে হবে আমাকে। তাকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে সংসারী করব। তোমার দু’ছেলের একজন থাকবে সংসারে, দায়িত্ব নিলাম আমি।

এক মুহূর্ত থেমে মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে গোরা বলেছিল, মা তুমি আমাকে বাঁচাও। সন্ন্যাস নিতে অনুমতি দাও। আশীর্বাদ করো আমাকে।

ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে শচী বলেছিল, বাবা, তোর নামে লোকে কুকথা বললে আমি সহ্য করতে পারব না। বুক ফেটে মরে যাব। সন্নেস নিলে যদি তোর জীবন বাঁচে, মান বাঁচে, তাহলে তোকে আমি আটকাব না। কোন মা চায়, ছেলের অমঙ্গল হোক, তার নামে দুর্নাম রটুক? কেউ চায় না চাঁদ

মাকে জড়িয়ে ধরে গোরা বসেছিল। সন্ন্যাস নেওয়ার কথা পেড়ে মাকে এত সহজে রাজি করাতে পারবে, গোরার ধারণা ছিল না। ছেলের জীবন বাঁচাতে তার সব ইচ্ছে মা মেনে নেবে গোরা জানত। নিজের সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছেটা এখন বিষ্ণুপ্রিয়াকে গেলাতে পারলে নবদ্বীপ ছেড়ে সসম্মানে চলে যাওয়ার পথে আর বাধা থাকবে না। ষোলোবছরের বউকে কীভাবে বশে আনতে হয়, চব্বিশবছরের স্বামীর অজানা নয়। বিষ্ণুপ্রিয়া শ্রীকৃষ্ণ চায় না, কৃষ্ণাবতার চায় না, রক্তমাংসের স্বামী চায়, ভেসে যেতে চায় স্বামীর ভালবাসাতে। তিনবছর ধরে স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় রাত কাটিয়েও তার আদরের কণামাত্র সে পায়নি। যৌবনের এই তুঙ্গমুহূর্তে এক বুক প্রত্যাশা নিয়ে সে উপোস করে আছে। তাকে ভালবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার অনুমতি আদায় করতে হবে। কাজটা নিষ্ঠুর হলেও এছাড়া উপায় নেই।

শ্রীবাসের বাড়ির বিষ্ণুমন্দিরের অন্ধকার চাতালে বসে গোরার মুখ থেকে কিছু কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিল গোপীনাথ। তাকে হতাশ করল না গোরা। বলল, বিদ্যাবাচ্যস্পতি মশাই-এর পরামর্শ মাথা পেতে মেনে নিলাম। জগন্নাথক্ষেত্র পুরুষোত্তমপুরে পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের আশ্রয়ে থাকতে পেলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না। তবে আজ‍ই পুরুষোত্তমপুরের পথে পা বাড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাড়িতে আমার মা, বউ আছে, নবদ্বীপ, শান্তিপুর জুড়ে আমার যত আত্মীয়, সুহৃদ রয়েছে, তাদের কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ চলে গেলে, সেটা অপরাধ হবে। বিপদে পড়বে তারা। ঘরে, বাইরে তাদের ওপর হামলা হবে। আমার জন্যে তারা যেন দুর্ভোগে না পড়ে, নবদ্বীপ ছাড়ার আগে সে দিকটাও দেখতে হবে আমাকে।

গোপীনাথ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ঢাকঢোল পিটিয়ে নবদ্বীপ ছাড়ার ঘোষণা করে পুরুষোত্তমপুরে তোমার রওনা হওয়াতে কিন্তু বিপদ আছে। বিদ্যাবাচস্পতিও চান, ঘটনাটা গোপন রাখতে। নবদ্বীপ ছেড়ে তোমার সরে থাকার খবর একডালায় সুলতানি দরবারে পৌঁছে গেলে প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদী চুপ করে বসে থাকবে না। উৎকল অভিযানে যে তোড়জোড় সুলতান শুরু করেছে, সেখানে যেমন কটকে শাসক, উৎকলরাজ প্রতাপ রুদ্রের ঘরের লোক গোবিন্দ ভোই গোপনে হাত মিলিয়েছে, তেমনি গৌড় আর রাঢ় বাঙ্গলার কয়েকজন রাজা আর ভূতপূর্ব রাজপুত্র, গৌড়ের সুলতানি শাসন উৎখাত করতে উৎকলরাজের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে চলেছে। বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে উদয়গিরি বাঁচানোর তুমুল যুদ্ধে উৎকলরাজ জড়িয়ে পড়ায় সে রাজ্যে গৌড়ের সেনাবাহিনী ঢোকার পথ একরকম অবাধ হয়ে গেছে। গৌড়ের সুলতান সেই সুযোগ নিচ্ছে। পুরুষোত্তমপুরের জগন্নাথ মন্দিরের সম্পদ লুঠ করে সম্ভবত সুলতান থামবে না। মন্দারণ দুর্গকে নিরাপদ রাখতে উৎকলের যাজপুর পর্যন্ত গৌড়ের অধিকার কায়েম করবে। যুদ্ধের এই ধুন্ধুমারে পুরুষোত্তমপুরের জগন্নাথক্ষেত্র পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছনো বিপদের হয়ে উঠবে। তবে গোরার যাওয়া নির্বিঘ্ন করতে বিদ্যাবাচস্পতি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। গৌড় আর উৎকল রাজ্যের স্থল, জল সীমান্ত পথে রক্ষিদের এমন কিছু চৌকি আছে, যারা মহাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম, তার ভাই বিদ্যাবাচস্পতিকে শুধু নামে চেনে না, দু’জনকে গভীর শ্রদ্ধা করে। নবদ্বীপের গোরার নামও তারা নানা সূত্রে জেনে গেছে। সীমান্ত এলাকা এখন দু’পক্ষের গুপ্তচরে থিকথিক করলেও গোরা একবার সেখানে পৌঁছে গেলে পুরুষোত্তমপুরে ঢুকতে তার অসুবিধে হবে না।

গোপীনাথের কাঁধে হাত রেখে গোরা বলল, ভাই গোপীনাথ, পিতৃতুল্য বিদ্যাবাচস্পতিমশাইকে আমার প্রণাম জানিও। আচার্য বাসুদেব সার্বভৌমকে তিনি যেন জানিয়ে রাখেন, খুব তাড়াতাড়ি আমি জগন্নাথক্ষেত্রে পৌঁছে আচার্যের বাড়িতে আতিথ্য ভিক্ষা করব। আমাকে নিয়ে দুর্ভাবনা করার কারণ নেই।

রাতের অন্ধকার ফুরিয়ে যাওয়ার আগে শ্রীবাসের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল গোপীনাথ সদর দরজা পার হয়ে আসার আগে গোরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার ইচ্ছে সফল হোক। আজই আমি কয়েকজনকে নিয়ে পুরুষোত্তমপুর রওনা হচ্ছি। তুমিও সেখানে অল্পদিনের মধ্যে পৌঁছবে, জামাইবাবুকে জানিয়ে দেব।

তাঁকে আমার অসংখ্য প্রণাম জানিও।

জানাব। সাবধানে থেকো তুমি।

শ্রীবাসের বাড়ি ছেড়ে গোপীনাথ বেরিয়ে যেতে গদাধর ডুকরে কেঁদে উঠল। নবদ্বীপে গোরা থাকবে না, অথচ নবদ্বীপ থাকবে, সে থাকবে নবদ্বীপে, ভেবে সে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। তার পিঠে হাত রেখে গোরা শান্ত করল তাকে, বলল, গদাধর পুরুষোত্তমপুরে যাওয়ার চিন্তা গোপীনাথ বলার আগেই আমার মাথায় এসেছিল। তারও আগে একটা কাজ, যা গোপীনাথ বলেনি, আমাকে সেরে নিতে হবে। নবদ্বীপ ছাড়ার আগে আমি সন্ন্যাস নেব।

গোরার কথায় শ্রীবাসের উঠোনে যেন উল্কা খসে পড়ল। গোপীনাথ আসার আগে ঠারেঠোরে গোরা যা বলছিল, এতক্ষণে সকলের কাছে তা স্পষ্ট হল। গোরা বলল, আমার নামে লাম্পট্যের অভিযোগ তুলে একডালার দরবার পর্যন্ত যারা সেই অভিযোগ রটিয়ে দিয়েছে, তাদের মুখের মতো জবাব দিতে সন্ন্যাস নিয়ে আমি প্রমাণ করব, কৃষ্ণ আমার বাপ, আমি ঈশ্বরের সন্তান, শচীদেবী আর এই মহাধরিত্রী আমার মা, আমি প্রেমের কাঙাল। নারায়ণীর গর্ভে যে ভ্রূণশিশু বড় হচ্ছে, সেও ঈশ্বরের সন্তান। শিশুকে কোনও কলঙ্ক স্পর্শ করে না।

গোরা থামতে ভাবাবেশে নিতাই শিশিরভেজা মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। মন্দিরের চাতাল ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে তার পিঠে হাত রেখে গোরা বলল, বন্ধু, আমাকে তুমি সমুদ্র দেখাবে বলেছিলে, আমি সেই সমুদ্রের ধারে যখন যেতে মনস্থ করেছি, তুমি কেন মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছ?

নিতাই সাড়া করল না। শ্লেষ্মাজড়ানো গলায় শ্রীবাস বলল, আমরা সবাই মিলে কিছুদিন অনায়াসে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে কাটিয়ে আসতে পারি। যাতায়াতে দেড়মাস করে তিনমাস আর সেখানে ছ’মাস থাকলে বছর ঘুরে যাবে, তার মধ্যে তোমার সন্ন্যাস নেওয়ার দরকার কী বাপু? সংসারে থেকেও তো আমরা সন্ন্যাসীর মতো দিন কাটাচ্ছি।

অন্ধকার কেটে গিয়ে আলো ফুটছিল আকাশে। শ্রীবাসের কথাতে মুচকি হেসে গোরা বলল, আমি সন্ন্যাস নিলে লোকসমাজে নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। মানুষ জানবে কৃষ্ণনাম কীর্তন শুধু সংসারী বৈষ্ণবদের ফি সন্ধেতে নাচগানের আসর নয়, সর্বস্ব ছেড়ে সেই নামের কাছে তারা পৌঁছতে চায়। সর্বত্যাগী বৈষ্ণবের কাছে সুলতানের শাসন, কাজির বিচার পৌঁছতে পারে না। জগদানন্দ বলল, ‘আই’-এর অনুমতি না পেলে কোনও গুরু মন্ত্র দেবে না তোমাকে।

নবদ্বীপে বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের মধ্যে শচীকে তখন ‘আই’ বলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আই মানে–মা, সর্বজনীন মা, কচিকাঁচাদের কাছে ‘আই’ হল দিদিমা। জগদানন্দর কথাতে গোরা বলল, মা অনুমতি দিয়েছে।

ছেলেকে শচী সন্ন্যাস নিতে অনুমতি দিয়েছে শুনে সবাই অবাক, তারা কথা হারিয়ে ফেলল। ডুবন্ত মানুষের কুটো আঁকড়ে বাঁচার মতো করে ঢোক দিলে শ্রীবাস বলল, শুধু আই নয়, বধূমা, বিষ্ণুপ্রিয়া সায় না দিলে তার স্বামীকে সন্ন্যাসের মন্ত্র কোনও সাধুপুরুষ দেবে না।

শ্রীবাসকে গোরা বলল, পণ্ডিত তোমার বধূমায়ের মনের খবর তার স্বামীর চেয়ে কে ভালো জানে? বিষ্ণুপ্রিয়া অরাজি হবে না। গোরা যে অনেক ভেবে, আটঘাট বেঁধে সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নেওয়ার সঙ্কল্প করেছে, বুঝতে কারও অসুবিধে হল না। বিষ্ণুমন্দিরের চাতাল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গোরা বলল, আমার সন্ন্যাস নেওয়ার সঙ্কল্প শুধু তোমাদের জানালাম, সন্ন্যাস নেওয়ার তারিখও তোমাদের ঠিক সময়ে জানাব। পাঁচ কান যেন না হয়, দেখ। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে খবরটা রটে গেলে হয়তো এই নশ্বর দেহে আমাকে আর দেখতে পাবে না। কথাটা মনে রেখো। তোমাদের মুঠোতে আমার প্রাণের চাবিকাঠি।

গদাধর নিঃশব্দে যখন কেঁদে চলেছে, ভাবাবিষ্ট হরিদাস নামজপ করছিল। গোরা বলল, চলো সবাই মিলে আজ একসঙ্গে বারকোণা ঘাটে চান করতে যাই। চান সেরে যে যার বাড়ি ফিরব।

নিতাইকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে গোরা বলল, আমাকে সমুদ্র দেখানোর কথা দিয়ে তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে? তোমাকে অনেক পথ আমার সঙ্গে চলতে হবে।

নিতাই-এর গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর বাষ্পে ভরে গেছে। সে বলল, বন্ধু, ঈশ্বর কেন সন্ন্যাস নেবে? ঈশ্বর সন্ন্যাসী হয়ে গেলে তার সৃষ্ট সংসারের ভার কে নেবে? তার ছেলেমেয়েরা অনাথ হয়ে যাবে। সন্ন্যাসী হয়ে লোকশিক্ষা দেওয়ার দরকার তোমার নেই। অদ্বৈত আচার্য জানিয়ে দিয়েছেন তুমি কৃষ্ণাবতার

নিতাই-এর দু’কাঁধে দু’হাত রেখে গোরা বলল, আমি ঈশ্বর নই, কৃষ্ণাবতার নই, আমি ঈশ্বরের সন্তান, কৃষ্ণ আমার বাবা, তোমরাও তাই, অদ্বৈত আচার্য নিজেও সেকথা আমাদের চেয়ে ভালো জানে, কৃষ্ণাবতার আবির্ভাবের যে আখ্যান আচার্য প্রচার করে চলেছে, আসলে তা একটা আদর্শ, আমাদের সময়ের দার্শনিকতা, সকলের আঁকড়ে ধরার মতো নৈতিক বোধ। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আমরা পৌঁছতে চাই। ঈশ্বরের তরফে সেই রাজ্যপাট হয়তো তোমাকে চালাতে হবে। সুখী, সমৃদ্ধ, আনন্দে ভরপুর নৈতিকতা হবে সেই রাজ্যচালনার মূল প্রেরণা।

নিতাই বলল, রাজ্যপাট আমি চাই না, তোমাকে চাই।

আমি তো আছি, তোমার পাশে সবসময়ে থাকব, তারপরেও থেকে যায় ঈশ্বরের নির্দেশ, যা তুমি এড়াতে পার না। কথা চালাচালির মধ্যে সঙ্গীদের নিয়ে বারকোণা ঘাটে পৌঁছে গেল গোরা। কাটোয়া, ফুলিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে একের পর এক নৌকা, বেশির ভাগ বারকোণা ঘাটে, কিছু নৌকা আপনঘাটে, এসে নোঙ্গর করছে। কাটোয়া থেকেও অন্য ঘাটে লাগা দুটো নৌকার যাত্রীদের মুখের ওপর এক লহমা চোখ বুলিয়ে নিল গোরা। ভোর হলেও আকাশের মুখ ভার। পুব আকাশে স্থির হয়ে আছে মোটাসোটা হাতির মতো কালো একখণ্ড মেঘ। বৃষ্টি হতে পারে। ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ।’ গোরার সঙ্গীদের মুখ মেঘলা আকাশের মতো কমবেশি থমথমে। গঙ্গার জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে গোরার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তার যে সঙ্গীরা টুপটুপ করে ডুব দিচ্ছে, তাদের দু’একজনের চোখের জল গঙ্গার স্রোতে মিশে যাচ্ছে। ভিজে মাথা থেকে কপাল বেয়ে যে জল গড়িয়ে পড়ছে, তার সঙ্গে কতটা চোখের জল ঢুকে রয়েছে, বোঝার উপায় নেই। চোখের জল ঢাকতে সবচেয়ে বেশি করে নিজের মুখ, চোখে জল ছিটোচ্ছে গদাধর। চান সেরে বাড়ি ফিরে গোরা দেখল, গঙ্গার ঘাটে নৌকা থেকে যাকে নামতে দেখবে ভাবছিল, শেষ রাতে সে নবদ্বীপে পৌঁছে গেছে। নিজের বাড়ির দাওয়ায় কাটোয়ার খণ্ডগ্রামের নরহরিকে বসে থাকতে দেখল সে। গোরাকে দেখে নরহরি এসে উঠোনে দাঁড়াল। শচীর সংসারে কাঠের উনুন থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। গোরাকে দেখে রান্নাঘর থেকে শচী বেরিয়ে এল। রাতের ভিজে ধুতি, চাদর পাল্টে ঘরে কাচা শুকনো ধুতি, উত্তরীয়, তুষের চাদরে সদ্য চান সেরে, পরিপাটি করে আঁচড়ানো, ঘাড় পর্যন্ত ভিজে লম্বা ঘন কালো চুল জড়ানো, লম্বা চওড়া শরীর, রূপবান ছেলের দিকে তাকিয়ে শচীর চোখে জল এলেও সামলে নিল সে। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে তার সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছেতে সায় দিয়েও শচী ভেবে চলেছে শেষপর্যন্ত তেমন কিছু ঘটবে না। সঙ্কীর্তনে মেতে সংসারে থেকে যাবে গোরা। বিষ্ণুপ্রিয়া ঘরে থাকলেও তার সাড়া নেই। স্বামী সন্ন্যাস নিতে চলেছে, এখবর সে জানে না। জানবে কী করে? শাশুড়ি শচী কিছু বলেনি তাকে। সংসারী মানুষ সন্ন্যাস নিলে, ঠিক কী ঘটে, সে ধারণা তার ছিল না। মানুষের কল্যাণ কামনায় গার্হস্থজীবন, যার আর এক নাম পূর্বাশ্রম, সেই পরিচয় ভুলে মানুষের কল্যাণে বাকি জীবন সন্ন্যাসীকে সংসারের বাইরে কাটাতে হয়, সে শুনেছে। সন্ন্যাস হল, ঈশ্বরের খোঁজে জীবন উৎসর্গের ব্রত। সন্ন্যাসী হল ঈশ্বরের মতো পবিত্র, সন্ন্যাসের আর এক নাম, সত্যনিষ্ঠা, আলোলুপতা, সর্বত্যাগ, অভয়, অদ্রোহ, অহিংসা, অক্রোধ, নাতিমানিতা, নিরহঙ্কার, সত্ত্বসংশুদ্ধি, সংযম। বিষ্ণুপ্রিয়ার পরিবারে কেউ সন্ন্যাস না নিলেও এ বিষয়ে অনেক আলাপ আলোচনা ছেলেবেলা থেকে সে শুনেছে। এক লক্ষে একজন সন্ন্যাসী হয় কি না সন্দেহ। তার আত্মীয়স্বজনের সকলে ধর্মভীরু হলেও কেউ সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছেড়ে চলে যায়নি। সংসার ছেড়ে তার স্বামী চলে যাবে, সে কল্পনা করতে পারে না।

দাওয়ায় চাটাই-এর ওপর বসে নরহরির সঙ্গে নিচুগলায় গোরা কথা বলছিল। কাটোয়ায় নিজের শ্রীপাটে মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য কেশব ভারতী যে গোরাকে আগামী ঊনত্রিশে মাঘ সন্ন্যাসের মন্ত্র দিতে এককথায় রাজি হয়ে গেছে, কথার শুরুতে নরহরি জানিয়ে দিয়েছিল। মাঘের শেষ দিন, শুক্লপক্ষের শুভ মুহূর্তে সন্ন্যাস মন্ত্র নিতে হলে কয়েকদিন আগে গোরার কাটোয়া পৌঁছনো দরকার। সন্ন্যাসের আগে মাথা কামানো থেকে দণ্ড, কমণ্ডলু জোগাড় করা পর্যন্ত কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ আছে, সেগুলো সারতে হবে। ফিসফিস করে কথা বলছিল দু’জনে। দু’দিন হাতে রেখে ছাব্বিশে মাঘ শেষ রাতে বাড়ি ছেড়ে সাতাশে মাঘ সকালে গোরার কাটোয়া যাওয়া পাকা হল। কাটোয়ার ঘাটে ভোর রাতে তাকে নিতে হাজির থাকবে নরহরি। কাটোয়াতে মেসো চন্দ্রশেখর, নিতাই, গঙ্গাধর, মুকুন্দ যাবে গোরার সঙ্গে। নরহরি নিচুগলায় জিজ্ঞেস করল, মা বউঠান সব জানে তো?

মা জানে, বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলব, ছাব্বিশে মাঘ রাতে, সেটাই হবে স্ত্রীর সঙ্গে আমার জীবনে শেষ রাত কাটানো। স্বামীর কাছে দুঃখী বউটার অনেক পাওনা আছে। কিছুই তাকে দিতে পারিনি। তার মুখে সেই রাতে একটু হাসি ফোটাতে চেষ্টা করব।

নিজের দাম্পত্যজীবনের এত কথা নরহরিকে গোরা কখনও বলেনি। তার কথা নরহরি যে পুরোটা বুঝল, এমন নয়। কিন্তু একটা রহস্যের আভাস পেয়ে সে চুপ করে থাকল। কৃয়াবতার গোরার দাম্পত্যজীবনে কোথাও এক শূন্যতা রয়েছে, সে জানত না। জানার দরকারও সে বোধ করল না। যা ঘটছে, যা ঘটবে, সবই যে ঈশ্বরের লীলা, এ নিয়ে তার সন্দেহ নেই, সন্ন্যাসের কর্মসূচি বুঝে নিয়ে বেলা একটু বাড়তে কাটোয়ায় ফিরে গেল নরহরি। গৌড় দরবারে সুলতানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক, দাদা মুকুন্দদাস ঠাকুরের মুখ থেকে রাজধানী একডালার এমন কিছু খবর নরহরি পেয়েছিল, যা গোরার নিরাপত্তা সম্পর্কে তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। একডালার দরবারে গোরার ভক্ত, অনুরাগী কম ছিল না। নানা সূত্রে গোরাকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিল তারা। বিদ্যাবাচস্পতির কাছে চারুমিহির, অমর, সন্তোষের চিঠি পৌঁছনোর আগে নবদ্বীপ থেকে গোরাকে সরিয়ে দেওয়ার বার্তা নরহরিকে পাঠিয়েছিল তার চিকিৎসক দাদা, মুকুন্দদাস। পাঁচজনকে না জানিয়ে গোপনে কাজ উদ্ধার করতে বলেছিল। গৌড়ের সুলতান বিশাল বাহিনী নিয়ে উৎকল আক্রমণ করে পুরুষোত্তম মন্দির লুঠ করতে চলেছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সীমান্ত পেরিয়ে উৎকল রাজ্যে গোরার ঢুকে পড়া উচিত, এ পরামর্শও ভাইকে পাঠিয়েছিল মুকুন্দদাস। নরহরি শুধু গোরার ভক্ত নয়, সে কবি, ভাবুক মানুষ। গোরার জন্যে উদ্বেগে তার চোখ দিয়ে যত জল ঝরেছিল, গোরাকে নিয়ে সেই পরিমাণ পদ্য লিখে ফেলেছিল সে। পদ্যে সুর দিয়ে সংকীর্তনের আসরে ভাবাবেশে মাটিতে লুটিয়ে পড়ত। কাটোয়ায় তাকে ঘিরে গোরার বিরাট ভক্তমণ্ডলী গড়ে উঠেছিল। তার চোখে গোরা বৃন্দাবনের চিরকিশোর প্রেমিক কৃষ্ণ, প্রেমের ঠাকুর। গোরার থেকে কয়েকবছরের বড় হলেও এখনও সে সংসার পাতেনি। গৌড়ে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে, এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। গোরাকে দেখে নরহরির এ বিশ্বাস আরও মজবুত হয়েছে। বিয়ের একাধিক যোগাযোগ সরিয়ে রেখে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার শুভ মুহূর্তটার জন্যে সে অপেক্ষা করছিল। গোরার পরামর্শে তার সন্ন্যাস নেওয়ার বিষয়ে দশনামী ভারতী সম্প্রদায়ের কেশব ভারতীর সঙ্গে দেখা করে দীক্ষার দিনক্ষণ, কয়েকদিন আগে নরহরি ঠিক করে ফেলেছিল। সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছে কেশব ভারতীকে আগে থেকে জানিয়ে রেখেছিল গোরা। শুভকাজে অযথা দেরি করতে চাইছিল না। প্রতিপক্ষের চরম আঘাত মাথায় নেমে আসার আগে নিজের নাম পরিচয়ের সঙ্গে শত্রুর অভেদ্য এক কবচকুণ্ডল জুড়ে নিতে চাইছিল। সন্ন্যাস সেই কবচকুণ্ডল। সন্ন্যাসীর গায়ে কেউ হাত তুলতে সাহস পায় না। প্রজাবিদ্রোহ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় বিধর্মী সুলতানও সন্ন্যাসী গোরাকে নবদ্বীপ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলতে ভরসা পাবে না। নবদ্বীপের শাক্ত, স্মার্ত, নৈয়ায়িকরা অবাক হয়ে দেখবে, তারা যাকে নগরের কুলাঙ্গার ভাবত, মৃত্যুর চেয়ে কঠিন এক ব্রত সেই গোরা বেছে নিয়েছে। ঘরসংসার ছেড়ে, গেরুয়া কৌপিন পরে, দণ্ড কমণ্ডলু হাতে, ভিক্ষান্ন খেয়ে, পথে, ঘাটে, গাছতলায় ঘুমিয়ে সন্ন্যাসীর জীবন কাটাতে চলেছে। আত্মহত্যা করার চেয়ে স্বেচ্ছায় সন্ন্যাসীর জীবন বেছে নেওয়া অনেক শক্ত কাজ, ঘি দুধ খাওয়া ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিতরা তা ভালো জানে। ধর্মের শুদ্ধতা বজায় রাখতে হাজারবছর ধরে তারা তর্ক করতে রাজি থাকলেও সন্ন্যাস নেওয়ার কথা উঠলে উল্টো পথে দৌড় লাগাবে। কৌপিন জড়ানো, নগ্ন শরীর গোরা দিকে তারা চোখ তুলে তাকাতে সাহস পাবে না। অসহনীয় কৃচ্ছ্র সাধনের আর এক নাম সন্ন্যাস, গোরা জানে। পুরোটা জানে, এমন নয়। নানা সুবাদে যতটা জানার সুযোগ পেয়েছে, তাতেই গায়ের লোম আতঙ্কে খাড়া হয়ে ওঠে। দুর্যোগে, মহামারীতে কত সন্ন্যাসী না খেয়ে পথে মরে থেকেছে, এমন গল্প সে শুনেছে। কপট কিছু সন্ন্যাসীর অপরাধে পথেঘাটে জনরোষে নিরীহ, সরল কত সন্ন্যাসীর প্রাণান্ত ঘটেছে, এ তথ্যও তার অজানা নয়। সব জেনেও সন্ন্যাস নিতে সে যে নির্ভয়, তার প্রথম কারণ নিরুদ্দেশ দাদা বিশ্বরূপের পুঁথির প্রেরণাই তার পথনির্দেশ। বিশ্বরূপ জানিয়ে গেছে, সে বরুণদেব আর পবনদেবের সন্তান। আসলে সে কৃষ্ণের সন্তান, রাখে কৃষ্ণ মারে কে? সর্বস্ব ছেড়ে কৃষ্ণের খোঁজে বেরিয়ে পড়লে আজ অথবা কাল কৃষ্ণের দেখা পাবে। মহাভারতকার কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস আর কৃষ্ণ তো স্বরূপে একই! কৃষ্ণ অমর, মৃত্যুর পরেও সে বেঁচে ওঠে। দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটবংশের রাজা কৃষ্ণ, রাজা গোবিন্দ, বিজয়নগররাজ্যের কৃষ্ণদেব রায়, এমনকী উৎকলরাজ প্রতাপ রুদ্রকে পর্যন্ত কৃষ্ণাবতার মনে করে দেশের অনেক জ্ঞানী, পণ্ডিত মানুষ। কেউ কেউ, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিধর্মী শাসকরা মনে করে এরা সবাই ছদ্মবেশী কৃষ্ণ। মহাভারতের কৃষ্ণ, ভাগবদের কৃষ্ণ, একই ব্যক্তি, কেউ মরেনি। গোরা বিশ্বাস করে কৃষ্ণ পুরুষোত্তম, সে অসাধারণ, অজর, অক্ষয়, অমর, তার সঙ্গে নিশ্চয়ই একদিন পুরুষোত্তমের দেখা হবে। সন্ন্যাস একটা পরীক্ষা। সেই কঠিন পরীক্ষায় উৎরে গেলে কৃষ্ণের সঙ্গে তার এই সাক্ষাৎকার ঘটবে। পুরুষোত্তমের দেখা পেতে হলে সংসারজীবন ছেড়ে সবরকম কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করতে হবে। বিশ্বরূপ পুঁথিতে লিখে রেখে গেছে, এরকম ঘটবে, এ ঘটনা অনিবার্য। কৃয়ের সঙ্গে তার দেখা হলে দেশ জুড়ে শুরু হবে সেই ইন্দ্রজাল, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় হাত লাগাবে হাজার হাজার মানুষ। রাজ্যের হাল ধরার যোগ্যতম মানুষও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আকাশ থেকে যেন নেমে এল সেই রাজা, তার নাম নিতাই। শিশুর মতো মন হলেও তার সত্তায় রয়েছে রাজসিকতা। কৃষ্ণের আনন্দ, তার বাঁশি, গান, নিয়ে থাকবে সে। তার সঙ্গে সংকীর্তনে মেতে থাকবে ধর্মরাজ্যের সব মানুষ, স্নেহে, সহৃদয়তায় রাজ্যবাসীকে প্রতিপালন করবে নিতাই

গোরার সঙ্গে সন্ন্যাস নেওয়ার নির্ঘণ্ট সম্পর্কে খুঁটিনাটি যত আলোচনা, সব সেরে ফলার, ডাবের জল খেয়ে নরহরি কাটোয়ায় ফিরে যাওয়ার পরে গোরা ঘরে ঢুকে বিছানায় শুনে অন্য দিনের মতো তখনই ঘুমিয়ে পড়ল না। ছাব্বিশে মাঘের রাতে শেষবার বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমনোর আগে তার কাছ থেকে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার অনুমতি নিতে তাকে কীভাবে বোঝাতে হবে ভাবতে থাকল। শুধু সোহাগে ভাসিয়ে দিয়ে তার অনুমতি আদায় করার মতো দুর্বুদ্ধি তার নেই, এমন হৃদয়হীন মানুষ হওয়ার তার পক্ষে সম্ভব নয়। স্বামীর সন্ন্যাস নেওয়ার পক্ষে ধাতস্থ করতে হবে বিষ্ণুপ্রিয়ার মন। বিষ্ণুপ্রিয়াকে আদর করার সঙ্গে তাকে বোঝাবে, মস্ত একটা কাজের দায়িত্ব পেয়েছে তার স্বামী। বৃন্দাবনের কৃষ্ণ দেখা করতে চায় তার সঙ্গে, তাকে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার মন্ত্র দিতে চায়। কৃষ্ণ নামের সুতোয় সব ধর্ম, জাতপাতের মানুষকে ফুলের মতো গেঁথে দেশজুড়ে একটা মালা পরানোর ভার নিতে হবে তাকে। সে কারণেই এই সন্ন্যাস, যত্ন করে বুঝিয়ে বলতে হবে বিষ্ণুপ্রিয়াকে। সঠিকভাবে বোঝাতে পারলে সে-ও পথ আটকে দাঁড়াবে না। সব জেনেও গোরার মনে সংশয়, সন্দেহ কম নেই সন্ন্যাসজীবনের কষ্ট কি সে সহ্য করতে পারবে? রুপোর চামচ মুখে নিয়ে না জন্মালেও সংসারে স্নেহ, যত্ন সে কম পায়নি। অভাব, অনটনের দিনেও সকাল সন্ধে দু’থালা গরম ভাত, ডাল, শাক তরকারি, লাউয়ের পায়েস খেয়েছে। মায়ের যেটুকু সোনাদানার গয়না ছিল, সবটা ঝেড়ে মুছে ছেলের যত বেখাপ্পা বায়না মেটাতে তার হাতে মাকে তুলে দিতে হয়েছে। বাবা ছিল রগচটা মানুষ। তা সত্ত্বেও বেঁচে থাকতে ছেলের যত্ন-আত্তিতে কখনও অবহেলা করেনি। দাদা, বিশ্বরূপ ছিল ভাই অন্ত প্রাণ। পরিবারের আদুরে, জেদি, একগুঁয়ে, দুষ্টু ছোট ছেলে হিসেবে বাড়তি তোয়াজ সবসময়ে সে পেয়ে গেছে। কঠোর বাস্তবজীবনের কোনও দুঃখ তাকে কখনও স্পর্শ করেনি। কৃষ্ণাবতার হিসেবে প্রচারের পরে তার সাংসারিক সুখ দশগুণ বেড়ে গেছে। অবতারকে বাঁচিয়ে রাখতে তার ভক্ত, অনুগামীরা যে পরিমাণ চাল, ডাল, সব্জি, ফল, তেল, ঘি, দুধ, ক্ষীর, মিঠাই মণ্ডা, এককথায় প্রচুর সিধা রোজ শচীর ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে, তা পরিবারের সকলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের নিয়ে খেয়েও শেষ হয় না। সে ভালোমন্দ খেতে ভালবাসে, তিন-চার জনের খাবার অনায়াসে একা খেয়ে নেয়, রেশম, মসলিনের সৌখিন পোশাকে কন্দর্পের মতো লোকসমাজে নিজে যেমন ঘোরাফেরা করে আনন্দ পায়, তেমনই চায় আত্মীয়, পড়শি, চেনা, অচেনা সবাই পোশাক, চালচলনে হোক ঝকঝকে, চকচকে সৌন্দর্য আর পরিচ্ছন্নতার প্রতিমূর্তি। কিন্তু তা ঘটে না, ঘটা সম্ভব নয়, তার চাওয়া, তার ইচ্ছাপূরণ শেষ কথা নয়। সংসারে অধিকাংশ মানুষ নাঙ্গা, ভুখা, অপুষ্টিতে ধুঁকছে। তাদের সমুজ্জ্বল করার সামর্থ্যও তার যখন নেই, সে নিজেই নাঙ্গা, বুভুক্ষুর বৃত্তি নিয়ে দণ্ড, কমণ্ডলু হাতে সংসার ছেড়ে পথে গিয়ে দাঁড়াবে। সত্যি যদি সে কৃষ্ণের সন্তান হয়, তাহলে সচ্ছলতায় মুড়ে দেবে মানুষের জীবন, ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে কৃষ্ণকে।

স্বামীর প্রাণের আকুতি, বিষ্ণুপ্রিয়া কি জানে না? ভালোই জানে। তার সন্ন্যাস নেওয়ার পথ আটকে বিষ্ণুপ্রিয়া দাঁড়াবে না, সে জানে। তবু তার মনের গভীরে কোথাও এক সংকোচ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তাকে প্রশ্ন করছিল, তিনবছরের বেশি সময় ধরে বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দাম্পত্যজীবন কাটানোর মধ্যে তাকে উপেক্ষা ছাড়া তুমি কী দিয়েছ? কেন তার গর্ভে সন্তান এল না? বাবা হতে তোমার এত ভয় কেন? তুমি ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রেখে তার সঙ্গে শুধু ভালবাসার অভিনয় ছাড়া কিছু করনি। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি যা দায়িত্ব, তা পালন না করে এখন প্রাণ বাঁচাতে সংসার ছেড়ে পালানোর আগে তার কাছ থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার অনুমতি চাইতে তোমার লজ্জা করা উচিত।

নিজের তৈরি প্রশ্নের জবাব না পেয়ে তার মনের ভেতরটা গুটিয়ে যাচ্ছিল। সে অনুভব করছিল, অসহায় বিধবা মা, আরও অসহায় সহায়সম্বলহীন তরুণী স্ত্রীকে নবদ্বীপে রেখে চিরকালের মতো চলে যাওয়া শাস্ত্রসম্মত হচ্ছে না। হৃদয়ের সায় পাচ্ছে না, কাজটা ধর্মবিরোধী হচ্ছে। তবু সুলতানের ক্রোধ থেকে বাঁচতে এ ছাড়া উপায় নেই। সবচেয়ে বড় কথা ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের কাছে সন্ন্যাস নেওয়ার সংকল্প সে কবুল করে ফেলেছে। আরও আগে কেশব ভারতীর সঙ্গে নরহরি দেখা করে তার দীক্ষা নেওয়ার কর্মসূচি ঠিক করে রেখেছে। শিষ্যকে মন্ত্র দেওয়ার জন্যে গুরু তৈরি থাকবে। তার পিছু হঠার পথ নেই। বাড়িতে মা, বউ উপোস করে না খেয়ে মরলেও তাকে সংসার ছেড়ে চলে যেতে হবে। তার সন্দেহ হল, সে কি সত্যি কৃষ্ণাবতার, ধর্মাচারী, না ধর্মভয়হীন, নিষ্ঠুর মানুষ? মা, বউ-এর ভরণপোষণের ব্যবস্থা না করে সংসার ছেড়ে যে পালিয়ে যায়, সে কেমন সন্ন্যাসী? রাতের সংকীর্তন সেরে গঙ্গায় চান সেরে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীরে ঘুমোনোর আগে সমাধানহীন নানা চিন্তায় গোরা হাবুডুবু খেতে লাগল। তার ঘুম ছুটে গেল। আটচল্লিশ ঘণ্টাপরে ছাব্বিশে মাঘের সকাল, সংসারে শেষদিন, শেষ রাত, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাড়ি ছেড়ে সে নড়বে না, সারাদিন মা, বউ-এর পাশে থাকবে, মনস্থ করে ফেলল। শ্রীবাসের বাড়িতে রাতের সংকীর্তন স্বাভাবিকভাবে চললেও ছাব্বিশে সেখানে সে যাবে না। নিতাই, মেসো চন্দ্রশেখর, মুরারিকে সন্ন্যাসের দিনক্ষণ জানিয়ে শেষরাতে নৌকা নিয়ে বারকোণা ঘাটে অপেক্ষা করতে বলবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বারকোণা ঘাটে পৌঁছে যাবে সে। সাতাশে মাঘের ঊষাকালে, সূর্য ওঠার আগে কাটোয়ার ঘাটে লেগে যাবে তাদের নৌকা। বিশ্বাসী একজন মাঝি চাই। নবদ্বীপ থেকে গোরা কোথায় উধাও হল, অন্তত দু’দিন যে চেপে রাখতে পারবে। ঊনত্রিশে মাঘের সকালে সন্ন্যাস মন্ত্র নেওয়ার পরে তার জানাজানি হলে বিশেষ ক্ষতি নেই। তবে জগন্নাথক্ষেত্রে যাওয়ার আগে পথের হালচাল আগেভাগে বুঝে নিতে কয়েকদিন নবদ্বীপের বাইরে, দরকার হলে আরও দক্ষিণে, রাঢ়ের কোনও বন্ধুর বাড়িতে আতিথ্য ভিক্ষা করে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। সুলতানি দরবারের সিন্ধুকী, জাসু, দানিদের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করার চেয়ে কঠিন হল অনুগামীদের ভিড় এড়িয়ে আত্মগোপন করে থাকা। নানা চিন্তার মধ্যে বারবার বিষ্ণুপ্রিয়ার নিষ্পাপ মুখ মনে ভেসে উঠতে গোরার বুকের ভেতরটা আনচান করতে থাকল। বালিশে মুখ গুঁজে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *