গোরা – ৪

বৈষ্ণবোচিত জীবনযাপন আর আচরণে দুরস্ত হয়ে ওঠা আমেরিকাবাসী নভোবিজ্ঞানী সেজকাকা ডঃ ত্রিদিবনাথ রায়ের সঙ্গে পরের দিন দুপুরের আগে মায়াপুরে সাহেব বৈষ্ণবদের ‘কৃষ্ণচেতনা মন্দিরে গোরা পৌঁছে গেল। পাতলা খদ্দরের পাঞ্জাবি, পাজামা, গলায় হাঁসের পালকের মতো শ্বেতশুভ্র উত্তরীয় জড়ানো মানুষটাকে পেয়ে মন্দিরের সাদা, কালো বাসিন্দা নির্বিশেষে আনন্দে হৈ হৈ করে উঠেছিল। সেজকাকা যে মন্দিরের সকলের প্রিয় মানুষ, গোরার বুঝতে অসুবিধে হয়নি। মন্দিরের পেছনে ঝকঝকে সাদা রঙের অতিথিনিবাসের দোতলায় যে ঘরে সেজকাকা জায়গা পেল, তা যে হেঁজিপেজিদের জন্যে নয়, এক নজরে গোরা বুঝে গেছে। দু’জনের শোয়ার দুটো আলাদা খাট, ঘরটা আসলে দেড় কামরার অ্যাপার্টমেন্ট, পাঁচতারা হোটেলে যাকে বলা হয় স্যুইট, তাই দুটো সিঙ্গল খাটে বিছানা ছাড়া দুটো চেয়ার একটা টেরিল, টেবিলের ওপর সাদা পাথরের ফুলদানিতে ছোট একগোছা ফুল, তিন জনের বসার মতো লম্বা সোফা ঘরে রয়েছে। দরকার পড়লে সোফাতে একজন মানুষ আরাম করে ঘুমোতে পারে। বিলাসের উপকরণ না থাকলেও ছিমছাম, পরিষ্কার ঘরের ভেতরে নিরঙ্কুশ আতিথ্য ছড়িয়ে রয়েছে। ঘরের পশ্চিম দেওয়ালে রাধাকৃষ্ণের বাঁধানো ছবি

গেট পেরিয়ে মন্দিরচত্বরে ঢুকে এক নজরে পাঁচিলে ঘেরা বিশাল মন্দিরপ্রাঙ্গণ দেখে গোরার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। মনে হল, স্বর্গোদ্যানে ঢুকে পড়েছে। কোন ছেলেবেলায় মায়ের মুখে শোনা, দেবরাজ ইন্দ্রের নন্দনকাননের বিবরণ তার মনে পড়ছিল। তাজ্জব বনে গিয়েছিল সে। গেট থেকে পিচের যে লম্বা রাস্তা মন্দিরে পৌঁছেছে, তার দু’পাশে বড় বড় গাছের সারি, মরশুমি ফুলের বাগান, গোলাপ বাগিচা রয়েছে, ঝর্না, পাথর বাঁধানো নয়ানজুলি, বসার জন্যে কংক্রিটের ছাতার নিচে চাতাল। মূল রাস্তা থেকে বেরনো একাধিক পিচরাস্তা, মন্দিরের নানা অংশ ছুঁয়ে ঘাসের সবুজ গালিচার মতো পেছনের পাঁচিল পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। আসল মন্দির তৈরি হচ্ছে পশ্চিমে, অদূরে থাকবে বিমান নামার রানওয়ে আর হ্যাঙ্গার সেজকাকা বলেছিল, কোথায় আমাদের নদীয়ার গোরা আর কোথায় সাদা কৃষ্ণভক্তদের এই মাতামাতি!

সেজকাকার মন্তব্যের সঙ্গে তাল রেখে প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা, বি.কম পাশ চব্বিশ বছরের গোরা, কী বলবে ভেবে পায়নি। পাঁচশো বছরের বেশি আগে নদীয়ায় যে গোরা জন্মেছিল, তার সম্পর্কে যেমন সে বিশেষ জানে না, তেমনি কৃষ্ণকে নিয়ে সাহেব ভক্তদের কার্যকলাপের যৎসামান্য তার কানে এলেও বাড়তি জানার আগ্রহ সে কখনও অনুভব করেনি। অথচ সেদিন প্রায় মাঝ রাতে, পায়ের তলায় তন্ত্রের ‘ড্যান্সিং ফ্লোর’ যখন টলমল করছে, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসটা ঐশী পড়তে বলার পর থেকে ঘটনার স্রোত এমন বইতে শুরু করল যে ‘গোরা’ শব্দটা মাথার ব্রহ্মতালুতে দৈত্যের মতো ক্রমাগত জেঁকে বসতে থাকল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সুদূর আমেরিকা থেকে হঠাৎ সেজকাকা এসে নতুন যে কাহিনী কাল সারা দুপুর ধরে শোনাল, তার ঝাপটায় শ্রীহট্ট থেকে ব্রষ্মপুত্র, পদ্মা, জলঙ্গী, গঙ্গা দিয়ে ভেসে আসা একটা নৌকোর দাঁড় টানার ছপছপ আওয়াজে গত রাতে ভালো করে সে ঘুমোতে পারেনি। দাঁড় টানার শব্দে অনেকবার ঘুম ভেঙে গেছে। সকালে বাতানুকূল লাক্সারি বাসে কলকাতা থেকে তড়িঘড়ি মায়াপুরে পৌঁছোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেজকাকার নির্দেশনায় তৈরি ‘গোরা’ মেগাসিরিয়ালের পুরো কাহিনীটা শোনার জন্যে তার বুকের ভেতর উথালপাথাল শুরু হয়েছে। কেন এমন হল, সে জানে না। কলেজ স্ট্রিট কফিহাউস থেকে ‘নাইটক্লাব’ তন্ত্ৰ পৰ্যন্ত, তার যাতায়াত। এসপ্ল্যানেড এলাকার কোন গলিতে ড্রাগের ঠেক আছে, কোন খালিকুঠিতে মেয়েদের গুলতানি, বেআইনি ‘আর্মস’ মেট্রো গলি থেকে খিদিরপুর ফ্যান্সি মার্কেটেও কারা কেনাবেচা করে, এ সবের সঙ্গে সে নিজে না থেকেও জানে। দরকার হলে ‘এ.কে.-৪৭ রাইফেল’, জোগাড় করাও তার পক্ষে অসম্ভব নয়। মা, বাবার সঙ্গে এই বয়সে তার দু’বার ইউরোপ, আমেরিকা ঘোরা হয়ে গেছে। মজা মারতে ঘোড়দৌড়ের মাঠে গেছে কয়েকবার। সে আস্তিক না নাস্তিক, ঈশ্বর বিশ্বাসী না নিরীশ্বরবাদী, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, আন্দোলন, প্রতিবাদ, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব, সব তার কাছে ‘বকওয়াশ’ গাঁজাখুরি ‘ডায়ালগ’, গোলি মারো! কারও ক্ষতি না করে ‘খাও পিও জিও’ এই তার জীবনের ‘গাইডলাইন’, ন্যাকাচৈতন, ক্যাবলাকান্তদের সে অপছন্দ করে বললে, কম বলা হয়, তাদের সে ঘেন্না করে। সপ্রতিভ, স্বাভাবিক, বুদ্ধিদীপ্ত তার বন্ধুদের সকলের বাড়িতে কম্পিউটার আছে, ইন্টারনেট কানেকশান আছে, গোছা গোছা ব্লু ফিল্মের সি ডি আছে, চেনা-অচেনা অনেক মেয়ের ই-মেল অ্যাড্রেসের সঙ্গে ড্রয়ারে কদাচিৎ কনডোম থাকে, দু’একজনের জিম্মায় কালোবাজার থেকে কেনা রিভলভর, পিস্তল থাকা অস্বাভাবিক নয়। ই-মেলে অচেনা কোনও মেয়ের সঙ্গে কয়েকবার ‘চ্যাট’ করার পরে তার সঙ্গে ডেটিং করলে পকেটে কনডোমের দু-একটা প্যাকেটের সঙ্গে রিভলভর বা পিস্তল নিয়ে বেরোয়। আধুনিকতার ঝলকানি আর গাঢ় অন্ধকার, গ্লাস গ্লাস খেয়ে যখন তার একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে, তখনই তার নামের ‘দুই’ গোরাকে ঐশী আর সেজকাকা এনে হাজির করে দিতে, কোথা থেকে যেন কী ঘটে গেল! পুরনো দিনের একজোড়া গোরার সঙ্গে নিজের যোগসাজশ খোঁজার তাগিদ বোধ করল। সবচেয়ে বেশি তাকে উসকে দিল ‘গোরা’ মেগাসিরিয়ালের প্রথম এপিসোডের কাহিনী। মেগাসিরিয়ালের না দেখা প্রথম এপিসোডের গভীর থেকে নৌকোর জলকাটার ছপছপ আওয়াজ তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।

সেজকাকা টের পাচ্ছিল, তার নির্দেশিত ‘গোরা’ সিরিয়ালের পুরো কাহিনী শোনার জন্যে ভাইপোটি মুখে না বললেও ছটফট করছে। দুপুরের খাওয়া শেষ হতে, হেমন্তের পড়ন্ত বেলার রোদ চৌকো গোলাপ বাগানে যখন এসে পড়েছে, চারপাশে জড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ প্ৰশান্তি, তখন সবুজ ঘাসের গালিচা ঢাকা মাঠ পেরিয়ে গোলাপবাগিচার পাশে একটা কংক্রিটের ছাতার তলায় গোরাকে পাশে নিয়ে ত্রিদিবনাথ বসল। পাঁচশো বছর আগে ভরা জোয়ারে পদ্মার বুক থেকে যাত্রীবাহী সেই নৌকোর দাঁড় টানার শব্দ শুনতে পেল গোরা। তার চোখের সামনে থেকে দৃশ্যমান পৃথিবীর বিলয় ঘটে গেল। সে অনুভব করল, মায়ের অন্ধকার জঠরে ভ্ৰূণাবস্থায় পৌঁছে গেছে সে। উৎকর্ণ হয়ে শুনছে মেগাসিরিয়ালের দ্বিতীয় এপিসোডের কাহিনী। সেজকাকা বলছে, বন্যায় ভেসে যাওয়া পাঁচ নদনদী পেরিয়ে, দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বৌ, ছেলে নিয়ে নিরাপদে জগন্নাথ নবদ্বীপে পৌঁছনোর পরে আরও দু’মাস কেটে গেলেও শচীর গর্ভের সন্তান তখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি। নিদারুণ উদ্বেগে জগন্নাথ দিন কাটাচ্ছে। জালার মতো পেট নিয়ে সবসময় কষ্টে হাঁসফাঁস করছে শচী, ভয়ে শুকিয়ে গেছে তার মুখ সন্তানপ্রসবের সময় আড়াই মাস আগে চলে গেলেও জঠরের শিশুটি অন্ধকার মাতৃগর্ভ ছেড়ে পৃথিবীতে নামেনি, সূর্যের আলো দেখেনি। সে মৃত নয়, রীতিমতো জীবন্ত, ঘনঘন জানান দিচ্ছে মায়ের পেটে হাত-পা ছুঁড়লেও ভূমিষ্ঠ হতে তার যেন কোনও তাড়া নেই। পাড়া-পড়শি, বিশেষ করে পাঁচজন বৌ, মেয়ে একসঙ্গে হলে এমন সব কথা বলছে, যা অলক্ষুণে আর লজ্জার। কিন্তু কথা শচীর কানে আসে। গা জ্বালানো মন্তব্য করতে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ওস্তাদ, ফুলিয়া গাঁয়ের সেই স্মার্ত আর নৈয়ায়িকদের দু-একজনে খোঁচা দেওয়া যে সব কথা বলে বেড়াচ্ছে, তাও শচীর অজানা নয়। শুধু ফুলিয়া কেন, শচীর নামে অকথা, কুকথা বলে বেড়াচ্ছে আশপাশের গ্রাম, খানচৌড়া, বড়গাছি, দোগাছিয়ার কয়েকজন ব্রাক্ষ্মণ পুরুষও। তাদের পরিবারের দু-একজন মেয়ে-বউকে যবনদের হাতে জমা করে শ্রীহট্ট ছেড়ে নবদ্বীপে যাওয়ার হুকুম পেয়েছিল তারা। যবনদের কৃপায় নবদ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে শ্রীহট্টে যারা টিকে আছে তাদের কেউ কেউ সাংসারিক কাজে ফুলিয়া, খানচৌড়ায় কয়েকদিনের জন্যে এসে শচীর গর্ভধারণ নিয়ে এমন সব গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে, যা থেকে গুজবের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ছে। গুজবের মধ্যে যশ, অপযশ, দু’রকমের উপকরণ আছে। শচীকে যারা পুণ্যবতী, সাধ্বী বিবেচনা করেছিল তারা শোনাচ্ছিল পীর বুরহানউদ্দিনের দরগায় তিন রাত, তিন দিন ধরে তার ধর্না দিয়ে পড়ে থাকার কাহিনী। পীরের নিজের হাতে বানানো যৎসামান্য সিন্নি খাওয়া ছাড়া দাঁতে কুটো কাটেনি, তৃয়ায় বুক শুকিয়ে গেলে মক্কা থেকে আনা দু’এক চুমুক পবিত্র আবে জজম্ (স্বর্গীয় জল) খেয়ে গলা ভিজিয়েছে। ধর্নার প্রথম রাত নির্বিঘ্নে কাটলেও শেষ দুটো রাত ঝড়তুফানে প্রলয়ের চেহারা নিয়েছিল। তুমুল বৃষ্টির সঙ্গে এমন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, আকাশ ফেটে বাজ পড়ছিল যে বুঝতে অসুবিধে হয়নি, মাজারের দরজায় স্বর্গ থেকে বরুণদেব আর পবনদেব হাত ধরাধরি করে এসে দাঁড়িয়েছে। দরগার চুড়ো থেকে বৈদুর্যমণির আলো ঠিকরে পড়তে দেখেছে গাঁয়ের অনেক মানুষ। দরগার অন্দরমহলে অন্ধকার মাজারে ধর্নায় লুটিয়ে থাকা শচীর কাছে পবনদেবের পৌঁছানোর পথে আলো ধরেছিল বরুণদেব। যোগাবিষ্ট শচীর শরীরে এক ঝলক বাতাস বুলিয়ে দিয়ে তাকে আশীর্বাদ করে মাজারের অন্দর থেকে পবন চলে যায়। সেই বাতাস থেকে শচীর গর্ভসঞ্চার হয়েছে। শচীর যে সন্তান জন্ম নিতে চলেছে, সে হেঁজিপেজি মানুষ নয়।

নীলাম্বরের ভিটেতে বসে তার শ্রীহট্টবাসী কোনও আত্মীয় যখন শচীর মহিমা শোনাচ্ছে, তখনই পাশের গাঁয়ে নৈয়ায়িক রামভদ্র ভট্টাচার্যের দূর সম্পর্কের এক নাতি, শ্রীহট্ট থেকে এসে উল্টো বিবরণ দিচ্ছে। মাজারের পীরকে নিয়ে কুকথা বলার সাহস অনেক আগেই হারিয়ে ফেলে, সে শোনাচ্ছে, জগন্নাথ মিশ্রের ব্রহ্মচর্য ভাঙা নিয়ে গাঁয়ে ঢিঢিক্কার পড়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত। পূর্ণগর্ভা সহধর্মিণীকে বগলদাবা করে বাবা উপেন মিশ্রের বাড়ি থেকে গভীর রাতে, গোপনে পালিয়ে আসা ছাড়া জগন্নাথের যে উপায় ছিল না, তার রসালো ব্যাখ্যা। শচীকে নিয়ে গালগল্পের বেশিটা তাকে শুনিয়ে যাচ্ছিল গাঁয়ের বুড়ি দাই, সনকা। শাঁখারিপাড়ায় তার বাড়ি ষাট ছুইছুই বিধবা সনকা, পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে নবদ্বীপের কয়েক হাজার প্রসূতির সন্তান বিয়োনোর কাজে হাত লাগিয়েছে। মায়ের কাছ থেকে ধাত্রীবিদ্যা শিখেছিল। তার মা শিখেছিল আবার নিজের মায়ের কাছ থেকে। পাকা হাত সনকার। তার দিদিমা ব্রাহ্মণ প্রসূতি ছাড়া আর কোনও জাতের আঁতুড়ঘরে ঢুকত না। শূদ্র সম্প্রদায়ের সন্তানসম্ভবাদের প্রসবের কাজে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠা ঠাকুমা, পিসিমা হাত লাগাত। সমাজের সেটাই ছিল কড়া নির্দেশ। সমাজ মানে, গৌড় থেকে সমতট, সুম্ম, লখনৌতি, সাতগাঁ, বাঙ্গলা, হরিকেল পর্যন্ত ব্রাহ্মণ আর শূদ্র সম্প্রদায়কেই বোঝাত। ব্রাহ্মণ ছিল হাতে গোনা কয়েকজন, বাকিরা শূদ্র। যবনদের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যেতে বৈদ্য, কায়স্থদের পদোন্নতি ঘটাল সমাজ। সমাজের চোখে তারা হয়ে গেল সৎ শূদ্র। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কাছাকাছি, অথচ কিছুটা দূরত্ব রেখে তাদের অবস্থান চিহ্নিত হওয়ার কিছুকালের মধ্যে বণিক আর বিভিন্ন পেশার কারুশিল্পীদের নিয়ে জমাট বাঁধতে থাকল নবশাক সম্প্রদায়। তারা জল অচল হলেও অন্ত্যজ শূদ্র নয়। সুলতানি শাসনের বজ্রআঁটুনি গৌড় আর রাঢ় বঙ্গে চেপে বসার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের বিন্যাসে নড়াচড়া শুরু হয়ে গেল। সমাজকর্তাদের নির্দেশে সনকা দাই-এর দিদিমা, শুধু বামুনবাড়ির পোয়াতি বৌদের খালাস করার বাঁধা কাজে আটক থাকলেও তার মেয়ে, মানে সনকার মায়ের আমল থেকে বিধিনিষেধের ফাঁস আলগা হতে থাকে। বৈদ্য, কায়স্থ প্রসূতিদের খালাস করার অনুমতি, শেষ জীবনে পেয়েছিল সনকার মা অম্বালিকা। সনকা তখন এই পেশায় এসে গেছে। সে-ও দু’ছেলের মা। তার দু’ছেলেই দিদিমার হাত ধরে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। দু’ছেলের মা হওয়ার পরে তাকে দাই-এর কাজে হাতেখড়ি দিয়েছে অম্বালিকা। দেশজুড়ে তখন হাবশিদের তাণ্ডব। সুলতান রুকনুদ্দিনের নুন খেয়ে তার উত্তরাধিকারীদের গুপ্তহত্যায় নেমে পড়েছিল হাবশি সেনাবাহিনী। দেশজুড়ে মাৎস্যন্যায়, মোল্লা-কাজিদের দৌরাত্ম্য। হিন্দুদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব। বিশেষ করে ব্রাহ্মণরা ভয়ে তটস্থ। কুর্শির হাতবদল ঘটলেই ভদ্রাসন ছেড়ে পালানোর জন্যে লোটাকম্বল বেঁধে তারা তৈরি থাকে। যবন সুলতান আর তাদের পোষা মোল্লা-মৌলবি, কাজিরা ছিল সাংঘাতিক। শূদ্রদের নিয়ে তারা মাথা ঘামাত না। হিন্দু বলতে তারা ব্রাহ্মণদের বুঝত এবং গায়ের জোরে তাদের জাত মারত, অর্থাৎ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হতে বাধ্য করত। দু’চার জন ব্রাক্ষ্মণকে ধর্মান্তরিত করতে পারলে হাজার হাজার শূদ্র, স্বেচ্ছায় মুসলমান হতে মৌলবিদের কাছে হাজির হয়ে যেত। সনকার চোখের সামনে যে কত সুলতান এল আর গেল, হিসেব নেই। পঞ্চাশ বছর আগে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে শূদ্রসমাজের অন্তর্ভুক্ত বৈদ্য, কায়স্থদের মাখামাখি বাড়তে যেমন সে দেখেছে, তেমনই এখন দেখছে বৈদ্য, কায়স্থদের সঙ্গে পয়সাওলা নবশাকদের মেলামেশা, গলাগলি।

মাঝ দুপুরে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ির দাওয়ায় বসে গাঁয়ের কেচ্ছাকাহিনীর সঙ্গে ফেলে আসা সময়ের নানা ঘটনা শোনাচ্ছিল সনকা। শচীকে সে ভালোবাসে, মান্য করে। দশ বছর পরে শচী আবার গর্ভধারণ করবে, সে কল্পনা করেনি। ধাঁধায় পড়ে গেছে সে। মুখে না বললেও শচীর গর্ভাবস্থা নিয়ে তার চাপা উদ্বেগ আছে। শচীকে সে বলল, মা, এত বছর ধরে দাই-এর কাজ করে কম দেখিনি। পেটে বাচ্চা নিয়ে দশ মাসের বেশি সময় পার করতে আরও কয়েকজন পোয়াতিকে দেখেছি। এগারো মাসের দু’জন, বারোমাসের একজন পোয়াতিকে নির্ঝঞ্ঝাটে খালাস করে দিয়েছি। আপনার বাছাটিকেও ভালোয় ভালোয় ছুঁয়ে এনে দেব।

কথাটা বলে শচীর পেটের কাপড় সরিয়ে, সেখানে হাতের পাতা আলতো করে ছড়িয়ে রেখে সনকা কিছু অনুভব করল। নিস্তব্ধ দুপুর। ফাঁকা বাড়িতে শচী, সনকা ছাড়া মানুষ নেই। ঝকঝকে করে নিকোনো উঠোনের শেষমাথায়, যেখানে আঁতুড়ঘর, তার পাশে ঝাঁকড়া বিশাল নিমগাছের ছায়ায় বসে বিশ্বরূপ কিছু লিখছিল। জগন্নাথ গেছে এক ধনী বৈদ্য যজমানের বাড়িতে শান্তি স্বস্ত্যয়ন করতে। বিত্তবান বেশ কয়েকজন বৈদ্য, কায়স্থ যজমান জগন্নাথের রয়েছে। নবশাকদের মধ্যে ধনীর সংখ্যা কিছুকাল ধরে বাড়লেও তাদের ভিটেতে গিয়ে যজমানি সে করে না। ব্রাহ্মণদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। জগন্নাথ মানে। নিয়মের ব্যত্যয় সে ঘটতে দেয় না।

শচীকে দাই বলছিল, ভারি দস্যি ছেলে হবে গো মা, আপনার। পেটের মধ্যে তার হাত-পা ছোঁড়ার বহর থেকে টের পাচ্ছি।

তার সব কথা শচীর কানে ঢুকছিল না। সে ভাবছিল শ্রীহট্টে বুরহানউদ্দিন দরগার অন্ধকার মাজারে বাহাত্তর ঘণ্টা ধর্না দিয়ে পড়ে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত। অসম্ভব এক ঘোরের মধ্যে ছিল সে। কখন দিন, দিন ফুরিয়ে কখন রাত নামল অগোচরে, সত্যিই সে বিস্মৃত হয়েছিল। মাঝে মাঝে অনুভব করছিল শরীরের ওপরে পীর মুজাভিরের চামরের ছোঁয়া, ঝড়ের দস্যিপনায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বেশবাস, অবিন্যস্ত দশা সামলানোর আগেই সে ফের ঘুমিয়ে পড়ছিল। বিদ্যুতের আলোয় পবনদেবকে সম্ভবত একবার সামনে দেখেছিল। শরীরের মধ্যে সুতীব্র বাতাস ঢুকে পড়ার অনুভূতিও চকিতের জন্যে বেপথু করেছিল তাকে। ধর্নার দিন, রাতগুলো এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। উঠোনের দিকে নজর পড়তে শচী দেখল, গুরু অদ্বৈত আচার্যর ঘর থেকে এসে নিমগাছের তলায়, বিশ্বরূপ যে পুঁথি লিখতে বসেছিল, দু-ঘণ্টা পরেও সমান অভিনিবেশ দিয়ে তা লিখে চলেছে। এত মন দিয়ে দশ বছরের ছেলেটা কী লিখে যাচ্ছে, শচী জানে না। পুঁথি পড়ার মতো বিদ্যে তার নেই। শ্রীহট্ট থেকে ফেরার পর শুরু হয়েছে তার পুঁথি রচনা। বাবা জগন্নাথ মিশ্রের সামনে সে লেখে না। পুঁথিটা সে কোথায় রাখে, তাও শচী জানে না। শান্ত, ধীর বিশ্বরূপ কিছুদিন ধরে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছে। কথা কমে গেছে। মাঝে মাঝে মায়ের পাশে এসে বসে, মাকে খুঁটিয়ে দেখে, মায়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কষ্ট হচ্ছে মা?

ছেলের পিঠে হাত রেখে নরম হেসে শচী বলে, দুর পাগল, কষ্ট হবে কেন?

মা, আমার ভাই হবে, না বোন হবে?

তুই বল না!

ভাই হবে।

আমারও তাই মনে হয়।

বিশ্বরূপের দিকে তাকিয়ে নানা চিন্তায় শচীর দু’চোখের পাতা যখন ঘুমে ভারি হয়ে আসছে, তখনই বাইরের রাস্তায় চিৎকার শুরু হল, পালাও, পালাও ছেলেধরা আসছে। কয়েক জোড়া পায়ের দৌড়ের আওয়াজ শুনল শচী।

সনকা বলল, আহ্, মরণ! কবে কোন জ্যোতিষ সুলতানকে কী বলেছে, তা নিয়ে বছরের

৫৮

গো রা

পর বছর ধরে গেরস্থের হেনস্থার শেষ নেই! সুলতানের কাজি, কোটাল, গুপ্তচররা খুঁজে চলেছে, কোথায় কার ঘরে বড় হচ্ছে সুলতানি মসনদ কেড়ে নেওয়ার কালাপাহাড়!

শচী বলল মহাভারতের গল্প শোনার পর থেকে সুলতানরা এই ভয় পেতে শুরু করেছে পাষণ্ড সব!

চুপ, চুপ।

বাড়ির বাইরে কোলাহল শুনে সনকা থামিয়ে দিল শচীকে। ‘পালাও! পালাও’ ভয়ার্ত ধ্বনির সঙ্গে দুপুরের নির্জন রাস্তায় দৌড়ঝাঁপ শুরু হতে সামান্য দূরে শ্রীবাসের বাড়িতে সকাল থেকে কৃষ্ণপ্রেমের যে সংকীর্তন শুরু হয়েছিল, তা থেমে গেছে। প্রেমের গান গেয়ে সমাজকে ব্যভিচারী করার অভিযোগে, ন্যায়শাস্ত্রী আর স্মার্তদের পরামর্শে সুলতান কুতবুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমল থেকে, প্রায় দশ বছর ধরে অনুরাগ, মান, অভিমান, এক কথায় মিলনলীলার গান গাওয়াতে নিষেধ জারি হয়েছে। খোল করতাল নিয়ে রাতে নিজের বাড়িতে সংকীর্তন করার অপরাধে কৃষ্ণভক্ত কয়েকজনের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শচীর বাড়ির কাছে বারকোণা ঘাট থেকে সন্ত্রস্ত মানুষের হৈ চৈ ভেসে আসছিল। সুলতানের সৈন্য বোঝাই নৌকো যে গঙ্গায় দেখা গেছে, শচীর বুঝতে অসুবিধে হল না।

ভয় পেয়ে শচী ঘরে আসতে ডাক দিল বিশ্বরূপকে। পুঁথি লেখায় নিমগ্ন দশ বছরের বালক, বিশ্বরূপের কানে গেল না মায়ের ডাক। ভয় পেয়ে সনকা হেঁকে উঠল, ও বাবাঠাকুর লুকিয়ে পড়ুন, ছেলেধরা আসছে।

সনকার দিকে তাকিয়ে বিশ্বরূপ বলল, আমি কেন লুকবো? ওরা আসছে কৃষ্ণকে ধরতে। আমি কৃষ্ণ নই।

তবু লুকিয়ে পড়ুন বাবা, ওরা কেষ্টবিষ্টু চেনে না। কোথা থেকে কী হয়, কে বলতে পারে! পুঁথি লেখা থামালেও নিজের জায়গা ছেড়ে বিশ্বরূপ নড়ল না। সংকীর্তন বন্ধ রেখে পড়শি, বৃদ্ধ শ্রীবাস, শচীর আবার গুরু সে, উঠোনে এসে বলল, গানের আসরটা মাটি হয়ে গেল। কী কুক্ষণে যে সংস্কৃত মহাভারতের কাহিনী, সুলতান আলাউদ্দীন আলী শাহের ঘাতক, তার-ই ভাই, সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহকে তার সভাপণ্ডিত শোনাতে গিয়েছিল, তা ঈশ্বর জানেন। দুষ্টকে ধর্মকথা শোনানোর গুণাগার দিতে হচ্ছে আমাদের। ইলিয়াস শাহের ধারণা হয়েছিল, মদ্রদেশীয় কৃষ্ণবর্ণ সেই সুপুরুষ বিষ্ণুর অবতার সাংঘাতিক লোক। সে ঐন্দ্রজালিক। বিধর্মীদের বিনাশে যে কোনও সময়ে তিনি হাজির হতে পারেন। ইলিয়াস শাহের এই আতঙ্ক থেকে তার পরের সুলতানরা মুক্তি পায়নি। যারাই সুলতান হয়েছে, কৃষ্ণের ভয়ে কাঁপছে। কৃষ্ণকে পাকড়াও করতে মাকড়সার জালের মতো দেশ জুড়ে পাহারা বসিয়ে রেখেছে। জালালউদ্দিন, সুলতান শাহজাদা সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ, কুতবুদ্দিন মাহমুদ শাহ, সুলতান মাহমুদ শাহ, সকলেই গেল দেড়শো বছর ধরে, যে যখন মসনদে চেপেছে, কৃষ্ণের ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছে। কৃষ্ণকে বন্দি করার জন্য গৌড়, রাঢ়, সুষ্ম, সমতট, হরিকেল দ্বীপ পর্যন্ত নজরদার বহাল করেছে, কৃষ্ণের ভয়ে তাঁর স্বরূপ বিষ্ণুর ভক্ত, বৈষ্ণবদের গান করা পর্যন্ত নানা সময়ে ফরমাণ জারি করে থামিয়ে দিয়েছে। বোকার হদ্দ এই যবনগুলো জানে না যে, স্বেচ্ছায় তিনি ধরা না দিলে তাঁকে ধরার চেষ্টা বাতুলতা মাত্ৰ।

শ্রীবাস পণ্ডিত মানুষ, ন্যায়শাস্ত্রবিদ হলেও ভাবাকুল বৈষ্ণব। তাঁর কাছ থেকে মন্ত্র নিয়েছে শচী। অবনত মাথায় শচী যখন শ্রীবাসের কথা, পুরোটা না বুঝেও শুনে যাচ্ছে, শূদ্ররমণী, সনকা তখন উঠোনের এক কোণে সকুণ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ব্রাহ্মণের বাড়িতে ঢোকা দূরে থাক, তাদের সদর দরজায় পা রাখার অধিকার শূদ্রের নেই। শুধু পেশার কারণে সনকা সে অধিকার পেয়েছে। শচীর মৃত আট মেয়ের জন্মের মুহূর্তে সে ধাত্রীর কাজ করেছে। তার হাত ধরে যারা পৃথিবীর আলো দেখেছিল, সুস্থ ছিল, কয়েক মাসের মধ্যে তারা কেন মারা গেল, সে জানে না। মৃত কন্যাসন্তান শচী প্রসব করেছিল দু’বার। আঁতুড়ঘরে শচীর মা-ও তখন ছিল। শচীর পেটের সন্তান যে মৃত, তা আগে টের পেয়ে তার মাকে আঁতুড়ঘরে ধরে রেখেছিল সনকা

বাইরে কোলাহল থেমে যেতে আড়চোখে সনকাকে একবার দেখে, শচীকে শ্রীবাস বলল, মনে হয়, নদীপথে সুলতানি সেনাদের নৌকো অন্যদিকে চলে গেছে। আমি ঘরে ফিরব। বিশ্বরূপকে এখন বাইরে যেতে দিও না।

দুপুর শেষ হয়ে রোদের তেজ কমে গেছে। উঠোনের নিমগাছে এসে বসল এক ঝাঁক হরিয়াল। পাশে তাকিয়ে শ্রীবাস দেখল, নিঃশব্দে বিশ্বরূপ কখন সরে পড়েছে। খানিকটা অবাক হয়ে শ্রীবাস জিজ্ঞাসা করল, ছেলেটা গেল কোথায়?

নিচু গলায় শচী বলল, খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

শ্রীহট্ট থেকে ফেরার পরে ছেলেটিকে দেখে কিছুটা অন্যমনস্ক মনে হয়। কী ভাবে ও সবসময়?

শচী কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকতে শ্রীবাস বলল, সাবধানে থেক। পাষণ্ডিরা আমাদের ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আমাদের নামে অপবাদপত্র লিখে, দস্তখৎ করে পাঠিয়েছে সুলতানের কাছে। সংকীর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারি হল বলে।

মাটির দাওয়ায় কাঁথা পেতে শুয়ে শচীর দু’চোখ যখন ঘুমে বুজে আসছে, তখনই শ্রীবাস এসে যেতে কাঁথার ওপর শচী উঠে বসেছিল। শ্রীবাসের সঙ্গে কথা বললেও দু’চোখের ঘুম যায়নি। শ্রীবাস চলে যেতে শচী ফের শুয়ে পড়ল। বিশ্বরূপের মুখের দিকে তাকিয়ে সে যে অন্যমনস্ক, কিছু ভাবছে, আচার্য শ্রীবাসও তা টের পেয়েছেন জেনে গলায় কাঁটা বেঁধার যন্ত্রণা বোধ করল শচী। শুধু বিশ্বরূপ কেন, স্বামীকে অন্যমনস্ক দেখলেও শচীর এরকম হচ্ছে। একটা বছর শ্রীহট্টে কাটিয়ে আসার পর থেকে জীবন অনেক বদলে গেছে। নানা গণ্ডগোল ঢুকে পড়েছে সংসারে। বিশ্বরূপের দীর্ঘায়ু কামনায় শ্রীহট্টের দরগাতে চাদর চড়াতে যাওয়ার সঙ্গে জগন্নাথের মনে আরও যে কিছু প্রত্যাশা ছিল, শচী তা জানে। শুধু তারই জানার কথা। পৈতৃক ভূসম্পত্তির কিয়দংশ, কয়েক সহস্র কার্যাপণ, সংগ্রহের বাসনাও জগন্নাথের শ্রীহট্ট দর্শনের সঙ্গে জড়িত ছিল। বাবা, ভাই-এর সঙ্গে এ নিয়ে একাধিকবার কথা বলেও বিশেষ সুফল পায়নি। খালি হাতে জগন্নাথকে ফিরতে হয়েছিল শ্রীহট্ট থেকে। জীবনে আর হয়তো শ্রীহট্টে তার যাওয়া হবে না, পৈতৃক সম্পত্তির অংশ পাওয়ার চিন্তা ক্রমশ মুছে ফেলতে হবে মন থেকে। তার মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে উদ্বেগে মানুষটা কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। শ্রীহট্ট থেকে শচী ফেরার পর থেকে তার বাবা, মা কয়েকবার দেখা করে গেছে। জগন্নাথের বাড়ি থেকে বেলপুকুরিয়ায় নীলাম্বরের বাড়ির দূরত্ব এক ক্লোশের বেশি নয়। অন্তঃসত্বা মেয়েকে দেখে মহাপণ্ডিত, প্রাজ্ঞ নীলাম্বর প্রথমে থতমত খেলেও গভীর নিরীক্ষণ পৰ্ব শেষ করে বলেছিল, ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যে করেন। প্রসবের সময় পেরিয়ে গেলেও শচীর গর্ভের সন্তান সুস্থ আছে। শচী আর তার গর্ভের শিশুকে পরিচর্যার জন্যে ধাত্রী সনকাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

সনকা শূদ্র হলেও ধাত্রীর পেশাতে তার যোগ্যতা নিয়ে নীলাম্বরের সন্দেহ ছিল না। সনকাকে পরের দিন জগন্নাথের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে শচীর গর্ভস্থ সন্তানের কুষ্ঠিবিচারে নীলাম্বর বসে গিয়েছিল।

সবার আগে নির্ধারণ করতে চেয়েছিল, আসন্নপ্রসবা শচীর সন্তানটির লিঙ্গ পরিচয়। সে পুত্র, না কন্যা জানতে ব্যস্ত হয়েছিল। আঁকজোক কেটে, আঙ্কিক যোগ-বিয়োগ কষে এক দুপুরে নীলাম্বর যখন ঘর্মাক্ত, বেলপুখুরিয়াতে তার বাড়িতে এসেছিল বিশ্বরূপ। ভবিষ্যৎ গণনায় নিমগ্ন নীলাম্বর টের পায়নি, তার আদরের নাতি পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ হাঁচির আওয়াজে পেছনে তাকিয়ে বিশ্বরূপকে দেখে অবাক হওয়ার সঙ্গে স্নেহে বিগলিত নীলাম্বর জিজ্ঞেস করল, তুমি কখন এলে দাদুভাই? বাড়ির সব কুশল তো?

দাদামশাই-এর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিশ্বরূপ জিজ্ঞেস করল, আপনি কি গণনা করছেন দাদু?

সামনে রাখা আঁকিবুকি কাটা তালপাতার দিকে তাকিয়ে কী জবাব দেবে, নীলাম্বর যখন চিন্তা করছে, বিশ্বরূপ বলল, আমার ভাই হবে।

তার কথা শুনে নীলাম্বর চমকে গেল। গণনা করে যখন সে কূলকিনারা পাচ্ছে না, তখন এই বালক কীভাবে বলল তার মা পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছে? নীলাম্বরের মনে হল তার এই নাতি বাকসিদ্ধ, বিশ্বরূপের কথা মিলে যাবে।

ঈশ্বর ও দৈবে বিশ্বাসী নীলাম্বর জানতে চাইল না, কোথা থেকে বিশ্বরূপ পেল এই ক্ষমতা! দাদামশাইকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে বিশ্বরূপ নিজেই মুখ খুলল। বলল, শ্রীহট্টের দরগার পীর বলেছে, আমার ভাই হবে।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সে ফের বলল, আমার পরমায়ু বন্ধন করতে সংসারে যে আর একজন পুত্রসন্তান দরকার, পীর এই কথা বলে মা-বাবার মাথায় ‘মুস্কিল আসান’ চামর বুলিয়ে দিয়েছিলেন। মাকে ধর্নার তিন দিন ধরে সিন্নি আর ‘আবে জমজম’ খাইয়েছে।

নীলাম্বর এত তত্ত্ব জানত না। মুখে হাসি টেনে সে জিজ্ঞেস করল, ভাই পেলে তুমি খুশি হবে তো?

হ্যাঁ, খুব খুশি হব। আমার পরমায়ু বেড়ে যাবে। আমি মরে গেলেও সংসারে একজন পুত্রসন্তান থেকে যাবে।

দশ বছরের বালকের কথা শুনে বৃদ্ধ নীলাম্বরের মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা হল। অশুভ কথা বিনিময় থামাতে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, ভাই পেয়ে এই দাদুটাকে ভুলে যাবে না তো?

দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে বিশ্বরূপ বলল, আপনাকে ভোলার সাধ্য কি?

প্রথম দিন জগন্নাথের বাড়িতে অন্তঃসত্ত্বা শচীকে দেখতে গিয়ে স্নেহের নাতির সঙ্গে দু’চার কথা বলে নীলাম্বরের মনে হয়েছিল, মা, বাবার সঙ্গে এক বছর আগে যে বালক নৌকোয় চেপে শ্রীহট্টে গিয়েছিল, আর নবদ্বীপে যে ফিরে এসেছে, তাদের মধ্যে ব্যবধান ঘটে গেছে। আগের বিশ্বরূপের সঙ্গে এই বিশ্বরূপের বিশেষ মিল নেই। সরল, নিরীহ, হাসিখুশি সেই দৌহিত্র বড় বেশি গম্ভীর, স্মিতবাক, পরিপক্ব হয়ে উঠেছে। শুধু সময়ের ব্যবধানে যে এমন ঘটে না, সেদিন না বুঝলেও কয়েকদিন পরে সেই নিস্তব্ধ দুপুরে সাজানো পুঁজিপাতি সামনে রেখে টের পেল, জীবন বড় রহস্যময়। এক জন্মে এই রহস্যের থৈ পাওয়া যায় না। মেধাবী এই নাতিকে আর ঘাঁটাতে চাইল না নীলাম্বর। মাতুলালয় ছেড়ে বাড়ি ফেরার পথে বিশ্বরূপের মাথার মধ্যে আলোড়িত হচ্ছিল শ্রীহট্টের স্মৃতি। দাদামশাইকে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, তার মুখ থেকে শুনতে চাইছিল অনেক প্রশ্নের জবাব।

বুরহানউদ্দিন দর্গাতে ধর্নার তৃতীয় রাতে মাজারের গর্ভগৃহে মায়ের সঙ্গে যে বিশ্বরূপ ছিল, শ্রীহট্টে ঠাকুরদার পরিবারের সকলে জানলেও নবদ্বীপের কেউ জানে না। জগন্নাথ বলেনি। তার কাছ থেকে বিশদ জানতে চায়নি নবদ্বীপের আত্মীয় পরিজন। দর্গায় বিশ্বরূপের রাত কাটানোর ঘটনা, জগন্নাথ কাউকে না বলার জন্যে বিশ্বরূপও মুখ খোলেনি। গর্ভগৃহে তার রাত্রিযাপনের ঘটনাটা জগন্নাথের মতো তুচ্ছ ভেবে চুপ করে থেকেছে। ঘটনার ভেতরে যে ঘটনা ছিল, সেটাও গিলে নিয়েছে। জগন্নাথকেও জানায়নি। জানাতে সাহস পায়নি। অভিভাবকদের সামনে দাঁড়িয়ে তার বয়সী বালকেরা এ বিবরণ শোনাতে ভয় পায়। মানুষের বাল্যস্মৃতির মধ্যে তাই অনেক গোপন কাহিনী চিরকালের মতো অবরুদ্ধ থেকে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সময়ের ধুলোতে তা সমাধিস্থ হলে, মানুষ ভুলতে শুরু করে সেই সব কাহিনী। বিশ্বরূপ যে কাহিনী বলতে চাইছিল, অথচ প্রকাশ করে পারছিল না, দাদামশাইকে বলা যেতে পারে ভেবে মাতুলালয়ে এসেও সঙ্কোচে নীরব থেকেছিল, তা হল ধর্নার তৃতীয় রাতের কাহিনী। দুর্যোগের রাত ছিল সেটা। ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাতের সঙ্গে ছুটিয়া পুটিয়া নদীর জল বাড়ছিল আগের রাত থেকে। বন্যার জন্যে বিখ্যাত সেই নদীর জল উপচে পড়ল পরের দিন বিকেলে। সন্ধের আগে কয়েক ঘণ্টায় দরগার সামনের সড়ক জলে ডুবে গিয়েছিল। দরগার চাতালে দাঁড়িয়ে দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে কীভাবে বাড়ি ফিরবে ভেবে, জগন্নাথ যখন চিন্তিত, দেবদূতের চেয়ে সুপুরুষ দরগার পীর মুজাভির এসে বলেছিল, ছেলেকে রাতের মতো এখানে রেখে আপনি বাড়ি ফিরে যান, কাল সকালে নিয়ে যাবেন। এর সব দায়িত্ব আজ রাতের মতো আমার।

দর্গায় ধর্নার শেষ রাতটা মায়ের পাশে থাকার সুযোগ পেয়ে বিশ্বরূপ এত খুশি হয়েছিল যে তার চোখে চোখ রেখে জগন্নাথ জেনে গিয়েছিল তার মনের খবর। মুজাভিরের কথা মতো তার জিম্মায় বিশ্বরূপকে রেখে প্রায় সাঁতার কেটে জগন্নাথ বাড়ি ফিরেছিল। মাজারের গর্ভগৃহের কোণে এক অন্ধকার কুঠুরিতে রাতে তার ঘুমনোর ব্যবস্থা হয়েছিল। সাঁঝবাতির আলোয় সেখানেই খেয়েছিল রাতের খাবার সিন্নি আর পাকা পেঁপে। খেয়ে আরাম পেলেও রাতে অন্ধকার কুঠুরিতে থাকার ব্যবস্থা তার পছন্দ হয়নি। মায়ের পাশে থাকার সুযোগ না পেয়ে মন খারাপের সঙ্গে জল আসছিল দু’চোখে। কিছু করার ছিল না তার। গর্ভগৃহের চাতালের পাশ দিয়ে সুড়ঙ্গের মতো পথে ঢোকার আগে এক পলক মাকে দেখেছিল। পাথরের মেঝেতে খড়ের বিছানায় মুখ গুঁজে শচী শুয়েছিল। মা ঘুমোচ্ছে, না জেগে আছে, বিশ্বরূপ বুঝতে না পারলেও শুয়ে থাকার ভঙ্গি দেখে বিশ্বরূপ কষ্ট পেয়েছিল। খাওয়া শেষ করে মাকে একবার দেখার জন্যে মাদুরে শুয়ে ছটফট করছিল। বাইরে প্রকৃতির তাণ্ডব চলছে। বিদ্যুতের তলানি আলো ঢুকে পড়ছিল গর্ভগৃহে।

বাজ পড়ার গুড়গুড় আওয়াজ কানে আসার সঙ্গে দেখার উসখুসুনি বাড়ছিল। রাতে কখনও একা ঘুমোয়নি। ভয় করছিল তার। ভূত, পেত্নির সঙ্গে আরও কত অশুভ শক্তি অদৃশ্যভাবে ঘুরছে, তার হিসেব নেই। শান্তি স্বস্ত্যয়ন, যাগযজ্ঞ করেও তাদের তাড়ানো যায় না। তার আট দিদিকে তাদের গ্রাস থেকে বাঁচানো যায়নি। মায়ের কাছে যাওয়ার বাসনা নিয়ে সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না। গভীর রাতে বাজ পড়ার বিকট শব্দে জেগে উঠে প্রথমেই মনে পড়ল মাকে। যে বাসনা নিয়ে মানুষ ঘুমোয়, আচমকা জেগে উঠলে, প্রথমেই তার মনে জেগে ওঠে সেই বাসনার ছবি। বিশ্বরূপেরও তাই হল। নিস্তব্ধ মাজারের ভেতর সবাই যে ঘুমোয়নি, চাপা গলার আওয়াজ শুনে টের পেল। সে আওয়াজ, মানুষের কণ্ঠস্বর, না বাতাসের হিসহিস, বুঝতে পারল না। কান খাড়া করে শুনে মনে হল জড়ানো গলায় কেউ দুর্বোধ্য মন্ত্রপাঠ করছে। মাকে দেখার ইচ্ছে এত তীব্র হল যে বিছানায় উঠে বসল বিশ্বরূপ মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে কারা যেন কথা বলছিল। বিছানা থেকে উঠে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে পা টিপে টিপে গর্ভগৃহে এসে প্রদীপের মিটমিটে আলোয় দেখল, খড়ের শয্যায় মা নেই। তার বুকটা ধড়াস করে ওঠার সঙ্গে জোরালো হাওয়ায় প্রদীপ নিভে গেল। অন্ধকার গর্ভগৃহে অন্ধের মতো কয়েক সেকেন্ডের বেশি বিশ্বরূপকে দাঁড়াতে হয়নি। বিদ্যুতের আবছা আলোয় মুহূর্তের জন্যে খালি শয্যায় সে আবার দেখতে পেল তালগোল পাকানো মায়ের শরীর। ভালো করে মায়ের দিকে নজর করার আগে গভীরতর অন্ধকারে ডুবে গেল গর্ভগৃহ। কাছাকাছি কোথাও আকাশ কাঁপানো আওয়াজ তুলে বাজ পড়তে ভয়ে বিশ্বরূপের হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা হয়েছে। অন্ধকার হাতড়ে, কোনমতে নিজের কুঠরিতে ফিরল সে। সেখানে ঢোকার আগে টের পেল, গর্ভগৃহের প্রদীপ জ্বেলে দিল কেউ। খড়ের বিছানায় মাকে দেখেছে না দেখেনি—এই বিভ্রমে কাঁপতে থাকল। মাদুরে শুয়ে বহু সময় হাঁসফাঁস করে কখন ঘুমিয়ে পড়ল জানতে পারেনি। ঘুম ভাঙল শেষ রাতে আজানের হাঁক শুনে। প্রার্থনার সময় হল। ব্যস্ত পায়ের চলাফেরা শুনল সে। জেগে উঠে প্রথমে মাকে দেখতে পাবে কি না, এই ভেবে তার গায়ে কাঁটা দিল।

ঘণ্টাখানেক বাদে, নমাজের পরে গর্ভগৃহে খড়ের শয্যায় মাকে দেখে নিশ্চিন্ত হলেও তার মনে কোথাও একটা খটকা থেকে গেল। নবদ্বীপে ফিরে এসেও তা যায়নি। গর্ভগৃহে রাত কাটানোর পরের সকালে বিশ্বরূপকে তার বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, সুনিদ্রা হয়েছে তো?

ঘাড় নেড়ে বিশ্বরূপ জানিয়েছিল, হয়েছে।

গর্ভগৃহে রাত কাটানোর বিবরণ বাবাকে সে বলতে পারেনি। মাকেও শোনায়নি সেই বৃত্তান্ত। অকথিত বিবরণ সে এখন তালপাতায় লিখে পুঁথিবদ্ধ করছে। পুঁথিটা পড়বে একজন, তার আদরের ছোটভাই, হ্যাঁ, শুধুই সে। তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্যে উৎকণ্ঠ হয়ে দিন গুনছিল দশ বছরের বিশ্বরূপ।

সেজকাকা থামতে গোরা বলল, পরের ‘এপিসোড’, মানে তিন নম্বরটা শুরু করে দাও। থেমো না।

—ভালো লাগছে?

—ঝিম ধরছে।

—সেটা কেমন?

নেশা করলে শুরুতে যেমন হয় আর কি! চারপাশে আলো কমে আসে, অথচ বেশি স্পষ্ট করে সবকিছু দেখা যায়।

নেশা করে কিছু দেখা কিন্তু ভালো নয়।

—জানি।

কথাটা বলে চাপা গলায় গোরা বলল, আমি যে নেশার কথা বলছি, তা কী বস্তু তুমি ভালোই জানো।

হাউস্টনের নভোবিজ্ঞানী মুচকি হেসে বলল, জানি, ভালোবাসার নেশা।

গোরা বলল, তিন নম্বরটা শুরু করো, শুনতে দাও আমাকে, শেষ পর্যন্ত আমি শুনতে চাই।

অনেক দূর যেতে হবে কিন্তু।

—যাব।

কাকা-ভাইপোর কথার তর্জা যখন থামল, সবুজমাঠ ছায়ায় ঢেকে গেছে। মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক টিয়াপাখি উড়ে যেতে দেখে গোরার মনে হল, পাঁচশো বছর ধরে ওরা উড়ছে। উড়তে উড়তে আসছে শ্রীহট্ট থেকে, উড়ে চলেছে পরের পাঁচশো বছরের দিকে।

সেজকাকা শুরু করল, নীলাম্বরের বাড়ি থেকে সেই দুপুরে বিশ্বরূপ ফিরে আসার সাতদিনের মধ্যে চোদ্দশো সাত শকে গঙ্গা নদীর তীরে বিদ্বজ্জনশোভিত নবদ্বীপ নগরে, বসন্তের বাতাসে উচ্ছ্বসিত ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে জগন্নাথ মিশ্রের বসতবাড়ির উঠোনে, নিমগাছের তলায় আঁতুড়ঘরে গোরা ভূমিষ্ঠ হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *