গোরা – ৫

শচী তেরো মাস গর্ভধারণের পরে, তার বাবা জ্যোতিষশাস্ত্রজ্ঞ এবং পণ্ডিত নীলাম্বর চক্রবর্তীর গণনা অনুযায়ী রামচন্দ্রপুর গ্রামে, জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ির উঠোন আগলে দাঁড়ানো, বিশাল নিমগাছের নিচে, খড়ের ছাউনি, মাটির আঁতুড়ঘরে, গোধূলি মুহূর্তে অসাধারণ রূপলাবণ্যমণ্ডিত যে শিশুটি জন্ম নিল, তাকে দেখে আত্মীয়স্বজনের মনে হয়েছিল, সে এক স্বর্গভ্রষ্ট নবজাতক, নক্ষত্রলোক থেকে নেমে এসেছে। গায়েগতরে এমন লম্বা, স্বাস্থ্যবান শিশু আগে কেউ দেখেনি। চেহারায় শুধু বড়সড় নয়, পাকা সোনার মতো তার গায়ের রং। সারা শরীর থেকে দুধ-হলুদ যেন গড়িয়ে পড়ছে। রূপবান এই শিশুটিকে দেখে তারা যেমন অবাক হল, তেমনি ভয় পেল। ব্রাক্ষ্মণ জগন্নাথ মিশ্র অথবা নীলাম্বর চক্রবর্তীর পরিবারে কেউ কুরুপ না হলেও হিন্দুকুশ পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিম থেকে ভারতে আসা কাঞ্চনবর্ণ জনগোষ্ঠীর দেহসৌষ্ঠব, গায়ের বর্ণের সঙ্গে ভারতীয় ব্রাহ্মণদের চেহারায় খুব সামান্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জগন্নাথ মিশ্রের সংসারে এমন এক বিনন্দিত সুন্দর শিশুর জন্মগ্রহণে পাড়াপড়শিদের দু-একজন যেমন নাক সিঁটকালো, তেমনি ধর্মভীরু মানুষের বড় অংশ আনন্দে ভাবাকুল হয়ে বলাবলি করতে থাকল, সুলতান ইলিয়াস শাহের আতঙ্ক, মদ্রদেশীয় সেই মহাপুরুষ, বোধহয় ধর্মস্থাপনে ভূমিষ্ঠ হলেন। স্মার্ত আর নৈয়ায়িকদের চাপে প্রেমের গান গাওয়া নিষিদ্ধ করে সুলতান কুতবুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে জারি করা ফতোয়া, এতদিনে বোধহয় বাতিল হতে

চলেছে।

শিশুটির জন্মের রাতে শুভ লক্ষণসূচক এমন আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যা আপাতবিচারে কাকতালীয় মনে হলেও সেই ঘটনাস্রোতে কার্যকারণের শৃঙ্খলা খুঁজে পেয়েছিল কিছু মানুষ জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে তার কনিষ্ঠ ছেলের জন্মমুহূর্তকে স্বাগত জানাতে পরিবার আর পাড়ার মেয়েরা শাঁখ বাজানোর সঙ্গে যে উলুধ্বনি শুরু করেছিল, আধ ঘণ্টা পরেও তা থামেনি। গোধূলির পরে অন্ধকার যত বাড়ছিল, সন্ধে গড়িয়ে যাচ্ছিল রাতের দিকে, গঙ্গার পূর্ব-পশ্চিমে দু’তীরে নবদ্বীপ, কাটোয়া জুড়ে তত জোরালো হচ্ছিল শাঁখ আর উলুর আওয়াজ। জগন্নাথের বাড়ির একটা প্রদীপের আলো যেন গঙ্গার দু’তীরের হাজার গেরস্থর ঘরে প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছিল। জগন্নাথের ঘরে শাঁখের আওয়াজ থামার আগে তার বাড়ির সবচেয়ে কাছের ঘাটে, গঙ্গায় স্নানার্থীরা যাকে বলে আপন ঘাট, সেখানে শাঁখ বেজে উঠেছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে শুধু আপন ঘাট নয়, যে ন’টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে নবদ্বীপ, সেই অস্তদ্বীপ, সীমন্তদ্বীপ, গোদ্রুমদ্বীপ, মধ্যদ্বীপ, কোলদ্বীপ, ঋতুদ্বীপ, ভাঙ্গুদ্বীপ, মোদক্রমদ্বীপ, রুদ্রদ্বীপ-এর ঘাটগুলো শাঁখের আওয়াজে মুখর হল। আপন ঘাটের কাছাকাছি বারকোণা ঘাট, নাগরিয়া ঘাটও কেঁপে উঠল অসংখ্য শাঁখের আওয়াজে। গঙ্গার পশ্চিম দিক, কাটোয়া থেকে বাতাসে ভেসে আসছিল শঙ্খধ্বনি, অনেক মানুষের গলার আওয়াজ। ফাল্গুনি পূর্ণিমার রাতে ষোলকলায় পরিপূর্ণ সোনার থালার মতো চাঁদ, থেকে থেকে মেঘের প্রলেপে ম্লান হয়ে গেলেও, মেঘ সরে গেলে স্বমহিমায় জেগে উঠছিল। হু হু করে হাওয়া বইলেও লালচে আভা জাগছিল আকাশে। লালের আভা ঢেকে দিচ্ছিল ঘন কালো মেঘ। চন্দ্রগ্রহণের এই রাতে চাঁদকে খাওয়ার জন্যে রাহুর সঙ্গে মেঘের যে ধুন্ধুমার লড়াই বাঁধতে চলেছে, গঙ্গার দু’তীরের অনেক মানুষ অনুমান করতে পারছিল। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের রাত ছিল সেটা। পঞ্জিকা অনুযায়ী, কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রহণ লাগবে, চাঁদকে ধীরে ধীরে গিলতে শুরু করবে রাহু। গ্রহণের সময়ে, তা সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, আংশিক বা সম্পূর্ণ হোক, পৃথিবীর পক্ষে হিতকারী কাল নয়। শাস্ত্রজ্ঞদের মতে এ সময়ে সৃষ্টি রসাতলে যেতে পারে, নেমে আসতে পারে প্রলয়। রাহুর অমিত্রজনোচিত আচরণ থেকে ঈশ্বরের সৃষ্টি, সূর্য, চন্দ্র, বিশ্বচরাচরকে বাঁচাতে গ্রহণের সময়ে মানুষকে তাই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। নিষেধের কড়াকড়ির মধ্যে থাকতে হয় গৃহস্থকে। রান্নার উনুন তখন জ্বলবে না। রান্না করা ভাত-তরকারি ঘরে রাখা চলবে না, এক কণা ভাত, একফোঁটা জল, এমনকি মুখের থুথু গেলাও তখন মহাপাতকের কাজ। গ্রহণ শুরুর আগে যারা স্নান-খাওয়া সেরে, বাসনকোসন মেজে, ইষ্টমন্ত্র জপ করতে বসে যায়, পাপ স্পর্শ করতে পারে না তাদের। গ্রহণকালের পুরো সময় উপোসে কাটিয়ে, গ্রহণ কেটে গেলে সংসারের স্বাভাবিক কাজকর্ম তারা শুরু করতে পারে। প্রকৃত পুণ্যাত্মারা অর্থাৎ ব্রাহ্মণেরা গ্রহণের দিনটা নিরম্বু উপোসে কাটায়। মনু প্রবর্তিত, তাঁর পবিত্র সংহিতার নির্দেশ মেনে, বহুকালের আচরিত সংস্কার থেকে শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাক্ষ্মণ স্মার্ত আর নৈয়ায়িকরা যে বিধি-বিধান তৈরি করেছে, সেখানে পান থেকে চুন খসার উপায় নেই। বিধানভঙ্গকারীর মৃত্যু অনিবার্য। সপরিবারে তাকে রৌরব কুম্ভিপাকে ডুবে মরতে হয়। এর যে ব্যত্যয় নেই, এমন সহস্র সহস্র উদাহরণ গৌড়বঙ্গের পণ্ডিতরা, বিশেষ করে নবদ্বীপের ডাকসাইটে পণ্ডিত, স্মার্ত, নৈয়ায়িকরা শোনাতে পারে।

ফাল্গুনি পূর্ণিমার গোধূলিতে, চন্দ্রগ্রহণ শুরুর কয়েক দণ্ড আগে, জগন্নাথ মিশ্রের যে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হল, তার মুখ দেখে আত্মীয় পরিজন যেমন আনন্দে বিহ্বল হল, তেমনি ভয় পেল। শিশু যে সুলক্ষণযুক্ত, এ নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তে আকাশে আস্ত চাঁদ জেগে উঠেছে, সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে জমাট কালো মেঘের আনাগোনা, আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত চিরে ঘনঘন ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ, ভিজে বাতাস বইতে শুরু করেছিল। দু’বছর ধরে খরায় জ্বলে যাওয়া, দুর্ভিক্ষে হুমড়ি খেয়ে পড়া গৌড়বঙ্গের মাঠ-ঘাট ভাসিয়ে ঝেপে বৃষ্টি নামতে চলেছে, এ নিয়ে জগন্নাথের আত্মীয় পরিজনদের সন্দেহ ছিল না। ঠিক তাই হল। গ্রহণ শুরু হওয়ার অল্পসময় পরে রাহুর গালে থাপ্পড় কষিয়ে গোটা আকাশের দখল নিল কালো ঐরাবতের ঝাঁকের মতো আভূমিলুণ্ঠিত ঘন মেঘ। খরায় পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া গৌড়, সুষ্ম, রাঢ়ের পাথুরে মাটি নরম হয়ে গলতে শুরু করল। চাষের মাটি ফেটে যেখানে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, ধরিত্রীর সেই হাঁ-মুখ দিয়ে তার গর্ভে ছলছল কলকল করে জল ঢুকতে লাগল। শুকনো খটখটে নবদ্বীপের যেসব দিঘি, পুকুরে খাওয়ার জল দুর্লভ হয়ে উঠেছিল, সেখানে ভরে উঠতে থাকল জলের আঁজলা। বিশাল বিশাল সেই বাঁওড়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল তেষ্টায় দড়ি ছিঁড়ে মাঠে-ঘাটে দৌড়ে বেড়ানো ক্ষিপ্ত গৃহপালিত মোষ, বলদ, গাভীন গরু, ছাগল, পথের কুকুর। জলে মুখ ডুবিয়ে তাদের জল খাওয়ার চোঁ চোঁ শব্দ বাতাসের গভীরে মিশে যেতে থাকল। জগন্নাথের ঘরে একটি শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঘটনা, নবদ্বীপবাসীরা সবাই না জানলেও সাড়ম্বর একটানা বৃষ্টির মধ্যে তারা দৈবী আশীর্বাদ খুঁজে পেল। জলের আকাল যে শেষ হতে চলেছে, মৃত চাষ-আবাদের পুনর্জন্ম ঘটতে দেরি নেই, অনুভব করতে তাদের অসুবিধে হল না। গঙ্গার কোমরডুব জলে দাঁড়িয়ে যারা মন্ত্র জপ করছিল, শাস্ত্র আবৃত্তি করছিল, জলের ওপর জল পড়ার শব্দ শুনে আরও তেড়েফুঁড়ে উঠল তাদের কণ্ঠস্বর। বৃষ্টি শুরু হতে গঙ্গার ধার থেকে কিছু মানুষ পালিয়ে গেলেও, যারা থেকে গেল, তাদের শঙ্খের হুঙ্কার প্রচণ্ডতর হল। জগন্নাথের ঘরে সদ্যোজাত শিশুটি সেই মুহূর্তে এত খবর না জানলেও তার জন্মের সঙ্গে দুর্ভিক্ষে জর্জরিত গৌড়ভূমিতে নতুন প্রাণের আশ্বাস জাগল। নবদ্বীপের মানুষ জানল, উপোস করে শুকিয়ে মরার দিন শেষ হতে চলেছে। উত্তর-পূর্বের জনপদ, সোনার গাঁ, সাতগাঁ, লখনৌতি, বাঙ্গালা জুড়ে গত দু’বছর যে প্রবল বন্যা চলেছে, সেখান থেকে যৎকিঞ্চিৎ জল, খরায় পুড়তে থাকা গৌড়, সমতট, সুষ্মের ভূক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন জলের দেবতা বরুণদেব। নবদ্বীপ এ যাত্রা বেঁচে গেল।

ভ্রাতুষ্পুত্র সুলতান-সিকন্দর শাহের হত্যাকারী, সুলতানি মসনদে আসীন, জালালুদ্দিন আবুল মুজফ্‌ফর ফতেহ্ শাহ এখন গদি থেকে উৎখাত হলে গৌড়ের মানুষ স্বস্তি পায়। গত কয়েক বছর ধরে সেই সুদিনের প্রতীক্ষায় রয়েছে গৌড়বঙ্গের মানুষ। লোকমুখে রটনা, শুভক্ষণ আসতে দেরি নেই। চাঁদ সদাগর, সুমন্ত সদাগর, লাউসেন কিংবা নিষাদরাজা কালকেতু হয়তো এই খুনি সুলতানদের শাসন থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে পারে। পারবে কি? স্মার্ত আর নৈয়ায়িকরা কি মেনে নেবে নবশাক সম্প্রদায়ের বণিকদের কর্তৃত্ব? শূদ্র কালকেতুকে কি তারা সিংহাসনে বসতে দেবে?

জগন্নাথ মিশ্র, তার পরিবার, পাড়ার মানুষ ভাবছিল, বিশালাকার, তপ্ত সোনার বর্ণ, সদ্যোজাত এই সন্তান শুধু দুর্ভিক্ষ বিমোচনের বার্তা নিয়ে আসেনি, কায়ক্লেশে কাটানো সংসারে সে আনবে সুখ, সচ্ছলতা। তাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, এই সংসারে, আজ রাতের বৃষ্টির মতো ঝরে পড়বে অফুরন্ত খুশি আর আনন্দ। বর্ষণমুখর সেই রাতে পাশের পাড়ায় শ্রীবাস আচার্যের বাড়ির দাওয়াতে বসেছিল বিষ্ণুভক্তদের গানের আসর। গান মানে, কীর্তন। বাঙালির অতি প্রিয় কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্য থেকে রাধাকৃষ্ণের রাগ-অনুরাগের অংশ, সুর যোজনা করে গাইতে শুরু করে তারা এমনই আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে অনেকের দু’চোখ, মুখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু ঝরছিল। মৃদঙ্গ, খোল, করতাল বাজিয়ে তারা নাচগান করছিল। ঝড়বৃষ্টির শব্দে চারপাশ ডুবে যেতে গলা ছেড়ে, কীর্তনের অনুষঙ্গ চারটে বাদ্যযন্ত্র, ওত, অবনদ্ধ, ঘন, সুষির-এ সোচ্চার বোলবোলাও তুলে তারা গাইছিল,

“ধীর সমীরে যমুনারি তীরে বসতি বনে বনমালী
পীন পয়োধর পরিসর মর্দন চঞ্চল করযুগশালী।”

বাড়ির সদর দরজার হুড়কো আটকে বন্ধ করে নবদ্বীপের জনা দশ ভাবাবিষ্ট বৈষ্ণব যেভাবে আকুল হয়ে কীর্তন করছে, তা দেখলে মনে হত, যাকে নিয়ে এই প্রেমগান চলছে, সে কাছাকাছি কোথাও রয়েছে, ভক্তদের ডাকে এখনি হাজির হয়ে যেতে পারে। কীর্তনে শ্রীবাসের তিন ভাই, শ্রীরাম, শ্রীপতি, শ্রীনিধি ছাড়া হাজির ছিল বাসুদেব দত্ত, মুরারি গুপ্ত, শিবানন্দ সেন, গোবিন্দ ঘোষ, মাধব ঘোষ, বাসুদেব ঘোষ এবং আরও কয়েকজন সুকণ্ঠ গায়ক। গুরুভাই ঈশ্বরপুরীকে নিয়ে শান্তিপুর থেকে অদ্বৈত আচার্যের আসার কথা থাকলেও, সম্ভবত ঝড়বৃষ্টির জন্যে তারা তখনও এসে পৌঁছোয়নি।

গৌড় বাংলায় তখন প্রবলপ্রতাপ সুলতানি আমল। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত মুসলিম শাসকরা কম বেশি পাঁচশো বছর এখানে কাটালেও এ দেশটাকে সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারেনি। কোথাও একটা ভয় ছিল। সন্ন্যাসী আর জাদুকরে বোঝাই প্রজাপুঞ্জ যে কোনও সময়ে মসনদ ছিনিয়ে নিতে পারে, এই ভয় তারা পেত। নানা ফতোয়া জারি করে প্রজাদের বাগে রাখতে চাইত। ফলে যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখে বিষ্ণুভক্তদের গানের আসর আয়োজন করতে হত। গৌড়ের সুলতানের গুপ্তচররা রাজ্য জুড়ে ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতাসম্পন্ন কৃঘ্ন নামের মানুষটাকে তখনও খুঁজে চলেছে। মহাভারতের কাহিনী ওপর ওপর শুনে দেড়শো বছর ধরে প্রায় প্রত্যেকটি সুলতান ভয় পাচ্ছিল যে কৃষ্ণ নামের লোকটা যে কোনও মুহূর্তে তাদের মসনদ উল্টে দিতে পারে। মানুষটা সঙ্গীত ভালোবাসে। সঙ্গীত দিয়ে তাকে আবাহন করলে সে বুঝে নেয়, দুষ্কৃতের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে দেশবাসী তার খোঁজ করছে। সঙ্গীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি না করে তাই সুলতান ইলিয়াস শাহের উপায় ছিল না। কৃষ্ণ আর বিষ্ণু যে এক, তা না জেনেও বৈষ্ণবদের দল বেঁধে গান করা কড়া হাতে সুলতানরা দমন করত। কোথা থেকে কী হয়, কে বলতে পারে! সংস্কৃত মহাভারত, ভালো করে বোঝার জন্যে সেই গ্রন্থের ভাষান্তর করতে সুলতানরা পণ্ডিত নিয়োগ করেছিল। মহাভারত তখনও সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি। অষ্টাদশ পর্বের সেই বিশাল পুঁথি আদ্যন্ত পাঠ করার মতো নগন্য কয়েকজন পণ্ডিত থাকলেও সর্বসাধারণ যে সেই মহাকাব্য শোনার যোগ্য, এটা তারা ভাবত না। বরং সংস্কৃত ভাষার শুদ্ধতা ও শাস্ত্রবাক্যসমূহের পবিত্রতা বজায় রাখতে শূদ্র সম্প্রদায় আর মেয়েদের সংস্কৃত শিক্ষা থেকে তারা দূরে সরিয়ে রেখেছিল। হাতে লেখা মহাভারতের নানা পুঁথির আখ্যানেও বিস্তর প্রভেদ ছিল। পাঁচ স্বামীর সহধর্মিনী দ্রৌপদীকে তারা যেমন কুলটা স্ত্রীলোক বিবেচনা করত, তেমনি মদ্রদেশীয় যদুবংশের রাজা, কুচকুচে কালো কৃষ্ণকে শ্বেতাঙ্গ আর্যসমাজের শত্রু ধরে নিয়ে বহু বছর তাকে ব্রাত্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির অন্দরমহলে ঢুকতে দেয়নি। কৃষ্ণকে তারা ভাবত শূদ্রকুলজাত এক লম্পট, বলবান জাদুকর। নায়কের মর্যাদা দিয়ে যে মহাকাব্য কৃষ্ণকে প্রথম জনসমক্ষে হাজির করেছিল, সুলতানি আমলের শুরুতে শুধু অল্প কয়েকজন সংস্কৃত জানা, মানুষ, সেই গ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত ছিল। ইতিহাসবোধ তাদের প্রখর ছিল না। তারা অনেকে বিশ্বাস করত, নিকট অতীতে দাক্ষিণাত্যে অপ্রতিহত প্রতাপশালী যে রাষ্ট্রকূট রাজবংশ, চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণের হাত থেকে শাসনক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়, সেই রাজবংশের অধিপতি ইন্দ্রের ছেলে কৃষ্ণ, দক্ষিণ-মধ্য-পূর্ব ভারতের একাংশ জুড়ে যে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল, সেই সম্রাট কৃষ্ণ আর ভাগবত এবং মহাভারতে বর্ণিত, ঈশ্বরের দশ অবতারের একজন, ‘কৃষ্ণ’ একই ব্যক্তি। চালুক্যরাজ বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পরে ব্রোচ অঞ্চল আর মালবের গুর্জর প্রতিহার রাজ্য রাষ্ট্রকূটরাজ কৃষ্ণ দখল করে। মধ্যপ্রদেশের পূর্বভাগেও কৃষ্ণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। তার প্রতিপত্তি যত বাড়তে থাকে, তত বেশি করে সেই চরিত্রে পুরাণের দ্বারকারাজ কৃষ্ণের অপার মহিমা আরোপিত হতে শুরু হয়। চালুক্যরাজ কীর্তিবর্মণও দ্বিতীয় দফায় কৃষ্ণের হাতে বিধ্বস্ত হয়। দাক্ষিণাত্য জুড়ে কৃষ্ণের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে কৃষ্ণ দাক্ষিণাত্যের রাজসিংহাসনে সমাসীন হয়। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ইন্দ্র তখন লোকান্তরিত। কৃষ্ণের রাজত্বকালে চালুক্যরা আরও একবার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। কৃষ্ণের বিজয়রথ অপ্রতিহত এগোতে থাকে। নাঙ্গ আর ভেঙ্গির চালুক্যবংশীয় অধিপতিদের উচ্ছেদ করে সমগ্র চালুক্য সাম্রাজ্যের সম্রাট হয় কৃষ্ণ। ইলোরার বিখ্যাত মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতাও কৃষ্ণ। রাজতক্তে বসে কৃয়ের ছেলে ধ্রুব বিন্ধ্য পেরিয়ে উত্তরভারত পর্যন্ত রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য বিস্তার করে। উত্তরভারতে প্রথমে পালরাজ পরে গুর্জর প্রতিহারদের সঙ্গে এক ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সম্রাট ধ্রুব জড়িয়ে পড়ে। প্রতিহার বৎসরাজ আর পালশাসক ধর্মপালকে যুদ্ধে ধ্রুব পর্যুদস্ত করলেও উত্তরভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা ধ্রুবর ছিল না। উত্তরভারত জয় করে প্রচুর বিত্তসম্পদ নিয়ে ধ্রুব দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে উত্তর-মধ্য ভারতের মানুষ তাকে ‘কৃষ্ণ’ নামে অভিহিত করতে থাকে। ধ্রুবর ছোট ছেলে তৃতীয় গোবিন্দ সিংহাসনে বসার পরে তাকেও নবতর এক কৃষ্ণ হিসেবে মানুষ গ্রহণ করে। পুরাণে ‘গোবিন্দ’ আর ‘কৃষ্ণ’, একই ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখিত হওয়ায় সম্ভবত এরকম ঘটেছিল। গোবিন্দের দাপটেও উত্তর ও মধ্যভারত প্রকম্পিত হয়েছিল। মহাভারতের মদ্রদেশীয় জাদুকর কৃষ্ণ-ই যে বহু বছর ধরে বিভিন্ন নামে রাষ্ট্রনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হচ্ছে, এবং অপরাজেয় ক্ষমতা প্ৰদৰ্শন করছে, এমন ধারণা আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মগজে চেপে বসেছিল। চালুক্য, পল্লব, নাঙ্গ, পাণ্ড্য, দাক্ষিণাত্যের প্রায় সব রাজশক্তি এককভাবে এবং জোটবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রকূট অধিপতি তৃতীয় গোবিন্দের সঙ্গে সংঘর্ষে পরাভূত হয় এবং তার অধীনতা মেনে নেয়। উত্তরভারতে প্রতিহাররাজ নাগভট্টকে, পালরাজা ধর্মপাল এবং তার মনোনীত কনৌজের শাসক চক্রায়ুধকে বশ্যতা স্বীকারে গোবিন্দ বাধ্য করে। কনৌজ ছাড়ার আগে এক সভা আহ্বান করে গোবিন্দ নিজেকে গোটা উত্তরভারতের সার্বভৌম অধিপতি হিসেবে অভিষিক্ত করে। তার অধীনতা স্বীকার করতে সেই সভায় যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে ছিল ভোজরাজ, মৎস্যরাজ, মদ্ররাজ, কুরুরাজ, যদুরাজ, যবনরাজ, অবন্তী, গান্ধার প্রভৃতি রাজ্যের অধিপতিরা।

ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজবংশ শাসন চালিয়েছিল। তৃতীয় গোবিন্দের ছেলে অমোঘবর্ষ আর তার ছেলে তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বে রাষ্ট্রকূট শক্তি, ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল। বিদ্যোৎসাহী, সুলেখক, সুগায়ক, বাঁশিবাদক রাষ্ট্রকূট সম্রাট, তৃতীয় কৃষ্ণের বীরত্বের সঙ্গে এমন কিছু সম্মোহনী শক্তি ছিল, যা কিংবদন্তির মতো আর্যাবর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। দুষ্টের যম আর শিষ্টের রক্ষক হিসেবে কৃষ্ণের খ্যাতি, তাকে আরও বেশি করে মহাভারতের কৃষ্ণের মহিমা দিয়েছিল। চোলরাজশক্তিকে উচ্ছেদ করে দক্ষিণে রামেশ্বরম থেকে উজ্জয়িনী, বুন্দেলখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কৃষ্ণের রাজ্য। রাজ্যবিস্তারের চেয়ে তার যুদ্ধাভিযানের বড় উদ্দেশ্য ছিল, সাম্রাজ্য জুড়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন অঞ্চলের অত্যাচারী শাসককে সরিয়ে সেখানে জনহিতৈষী শাসককে ক্ষমতায় বসানো। হিন্দুকুশ পেরিয়ে, খাইবার গিরিপথ ধরে ভাগ্যান্বেষী যবন ঘোড়সওয়ারদের ভারতে ঢোকা তখন শুরু হয়েছে। তারা যেখানে যায়, শুনতে পায় সর্বশক্তিমান কৃষ্ণের বিবরণ, তাকে নিয়ে রচিত নানা কিংবদন্তি। মহাভারত কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র, কৃষ্ণাবতারের সঙ্গে এভাবে মিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় কৃষ্ণ, তার বিদ্যোৎসাহিতা, শিল্পপ্রীতি, প্রেমিকস্বভাব, বিচক্ষণতা, বীরত্ব আর পরাক্রমের কাহিনী। নতুন এক আখ্যান ধীরে ধীরে জন্ম নিতে থাকে। আর একশ বছর পরে গজনীর সুলতান মামুদ যখন বারবার ভারত আক্রমণ আর লুঠ করছে, তখন তার অন্যতম যুদ্ধকৌশল ছিল, দাক্ষিণাত্য অর্থাৎ কৃষ্ণের সাম্রাজ্যের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা উত্তর-পশ্চিম ভারত বিশেষ করে আর্যাবর্ত জুড়ে ঈশ্বরের অবতার, মহাভারতের কৃষ্ণের সঙ্গে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের একাধিক অধীশ্বর, কৃষ্ণ, তৃতীয় গোবিন্দ, তৃতীয় কৃষ্ণকে অভিন্ন কল্পনা করা শুরু হয়ে গেছে। জাদুশক্তির জোরে অমর, কৃষ্ণকে ছলে বলে কৌশলে আটক করা বা খুন করার ছক তৈরি করে ইসলামী শাসকরা। বাছাই করা অঞ্চলগুলোতে গুপ্তচর পাঠানো শুরু করেছে। মহাভারত কাহিনীর ব্যাসকূট রহস্য উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল মুসলমান মৌলানা, মৌলভিরা। অন্ধ দৈববিশ্বাসের যুগ ছিল সেটা। অলৌকিক, অনায়াসে বাস্তব, আর বাস্তব আরও সহজে অলৌকিক হয়ে উঠত। দুটোকেই মানুষ সমানভাবে বিশ্বাস করত। বলায় ভুল হল। বাস্তবের চেয়ে দৈব আর অলৌকিকে হাজার গুণ বেশি বিশ্বাস ছিল মানুষের।

ইতিহাসের সেই ধূসর প্রেক্ষাপটে পাঁচশো বছর পরে নবদ্বীপে চৈতন্যের জন্ম হল। ইন্দ্রপ্রস্থ অর্থাৎ দিল্লিতে আর গৌড়ে জবরদস্তভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও পাঁচশো বছর আগের সংস্কার, নবাব, বাদশা, সুলতানদের মন থেকে কাটেনি। কৃষ্ণভীতি শিথিল হয়নি। কৃষ্ণমহিমা কীর্তন নিষিদ্ধ করে আরোপিত হুকুম যথারীতি বহাল ছিল। অমিতবিক্রম রাষ্ট্রকূট সম্রাট, মৃত কৃষ্ণ যে ইচ্ছে করলে, শ্মশানের ছাই সরিয়ে সশরীরে উঠে দাঁড়াতে পারে, মরা মানুষকে বাঁচিয়ে দিতে পারে, গৌড়ের সুলতানরা, যে যখন ক্ষমতাসীন হত, বিশ্বাস করত। তাদের ধারণা হয়েছিল, কৃষ্ণকে কাফেররা ঈশ্বরের অবতার হিসেবে মানলেও আসলে সে উচ্চমার্গের জাদুকর। ভেল্কির জোরে যা খুশি ঘটাতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে সে অপরাজেয় উত্তর-পশ্চিম, মধ্যভারতের কুড়ি-পঁচিশ জন রাজাকে নিয়ে, তাদের মধ্যে একাধিক যবন রাজা ছিল, পুতুলখেলা খেলেছে সম্রাট কৃষ্ণ। সবচেয়ে বড় কথা, তাকে দেখে অল্পবয়সী স্ত্রীলোকেরা সুস্থির থাকতে পারে না। ভালোবাসায় গলে যায়। তার বাঁশির সুর শুনে রান্নাঘরে চুলোর সামনে তারা সম্মোহিতের মতো বসে থাকে। উনুনে বসানো ভাত, তরকারি পুড়ে গন্ধ ছাড়লেও তাদের সম্বিত ফেরে না। চোখের ইসারায়, কিংবা হাতছানি দিয়ে কোনও মেয়েকে কৃষ্ণ ডাকলে সে যতই অভিজাত, বিত্তবান পরিবারের কন্যা হোক, এমনকি রাজকন্যা হলেও ঘর ছেড়ে সে বেরিয়ে আসে। মানুষটার আবার একশো এক নাম। নাম ভাঁড়িয়ে কখনও সে হরি, কখনও গোবিন্দ, শ্যাম, বাসুদেব, বিষ্ণু, কানাই, নারায়ণ, নন্দলাল, জগন্নাথ, আরও কত নাম, হিসেব নেই। মানুষটার আসল নাম, চেহারা নিয়ে নানা বিবরণ চালু থাকলেও,কোনটা সঠিক, কেউ বলতে পারে না। তার বয়স নিয়েও সুনির্দিষ্ট ধারণা কারও নেই। বয়সের হিসেব রাখার জন্যে মাথাব্যথা তখন কারও ছিল না। কোনও বৃদ্ধ, নিজের বয়স দুশো বা তিনশো বললে, সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করত। সন, তারিখের ব্যবহার রপ্ত ছিল কিছু পণ্ডিতের।

সেখানেও অস্পষ্টতা ছিল যথেষ্ট। মহাভারত নামে স্বল্প পরিচিত এক সংস্কৃত পুঁথির কৃষ্ণের সঙ্গে হাজার বছর পরের রাষ্ট্রকূট বংশের দুই অধীশ্বর কৃষ্ণ ও তৃতীয় কৃষ্ণকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেখতে তাদের অসুবিধে হয়নি। শৌর্যবীর্য, অশেষ কলাবিধিসম্পন্ন, মহাভারতের কৃষ্ণ যে অমর, মরে গিয়েও মরে না, এ বিশ্বাস তাদের মনে চিরকালের মতো বিধৃত হয়ে গিয়েছিল। যদুবংশীয় কৃষ্ণ আর রাষ্ট্রকূট বংশীয় কৃষ্ণকে অভিন্ন ভাবতে তাদের অসুবিধে হয়নি। মহাভারতের হাতে লেখা পুঁথির রকমফের থেকে এমন ঘটেছিল। বহু বছর আগে সিংহাসন নিয়ে কুরু-পাণ্ডবদের মধ্যে বড়রকম যুদ্ধে যে কৃষ্ণ জড়িয়ে পড়েছিল, হাজার বছর পরেও সে রকম অনেকগুলো যুদ্ধে সেই নামের মানুষটা সমান তৎপরতায় অংশ নিতে, সময়ের ব্যবধান মুছে ফেলে কৃষ্ণের যে সর্বকালীন, সর্বজনীন, অভেদ মূর্তি তৈরি হয়, ইতিহাসবোধহীন, কিংবদন্তিপ্রিয় মানুষের কল্পনাকে তা উদ্দীপ্ত করেছিল। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ, কুরুপাঞ্চালের যুদ্ধ, চালুক্য আর রাষ্ট্রকূটদের যুদ্ধ, রাষ্ট্রকূট বনাম কনৌজ বা গুর্জর, প্রতিহার, ভোজ, পল্লব, নাঙ্গ, পাণ্ড্য যে কোনও যুদ্ধ, কৃষ্ণ চরিত্রের সূত্রে পুরাণ, ইতিহাস, কিংবদন্তী জুড়ে ঘটনার যে মালা তৈরি করেছিল, তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করার কেউ ছিল না। প্রশ্ন করার চেয়ে বিশ্বাস করে তখন মানুষ বেশি আরাম, শান্তি পেত। মানুষের মনের গঠন ছিল বিশ্বাসপ্রবণ। ভয়ে অথবা ভক্তিতে কিংবা দুটোর তাড়নায় সত্যি-মিথ্যে (মিথ্যের অংশ বেশি) চট করে বিশ্বাস করে নিত।

পুরাণের কৃষ্ণ আর রাষ্ট্রকূট বংশের কৃষ্ণের একত্ব বিশ্বাস করে নিয়ে তারা জেনে গিয়েছিল যুদ্ধ আর যুদ্ধের ফলাফল, সবই পূর্বনির্ধারিত, কৃষ্ণের তৈরি কর্মসূচি। যুদ্ধে যারা নিশ্চিহ্ন হবে এবং যারা জিতবে, দু’পক্ষের চরম পরিণাম এক, দু’পক্ষকেই অচিরে মহাপ্রস্থানের পথে যেতে হবে। পথ দেখাবে কৃষ্ণ। দু’পক্ষকে যুদ্ধে কৃষ্ণ সমান মদত দিলেও নিজে একবারের জন্যে অস্ত্রধারণ করে না। দুধ, ক্ষীর, সর, মাখন, ননী খেতে মানুষটা ভালোবাসে। ষোলশো প্ৰেমিকা আছে, অসম্ভব সংগীতপ্রেমী। গান শুনলে অস্থির হয়ে গায়কের কাছে ছুটে যায়। সুরের ঝর্নাধারা খুঁজে বেড়ায়। অসাধারণ বাঁশি বাজায় বলে তার নাম বংশীধারী, কেউ বলে বংশীবদন। উত্তর-মধ্য আর্যাবর্তে তার অসংখ্য ভক্ত থাকলেও পূর্বভারতে তার মহিমা সেভাবে তখনও প্রচারিত হয়নি।

চৈতন্যের জন্মের কিছু আগে থেকে গৌড়ের সুলতানদের সূত্রে সমতট, সুম্ম, বাঙ্গালার মানুষের কাছে বেশি করে কৃষ্ণ তখন পরিচিত হচ্ছিল। সুলতানদের কৃষ্ণ-ভীতি থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল কৃষ্ণের প্রচার। যে মানুষটা যবনদের ভয়ের কারণ, স্বাভাবিকভাবে কাফেরদের কাছে সে প্রিয়জন হয়ে উঠছিল। মহাভারতের পুঁথি শোনার জন্যে কথকঠাকুর খুঁজে বেড়াচ্ছিল দেশীয় মানুষ। বাংলায় ভাষান্তরিত মহাভারত পুঁথির সন্ধান না পেয়ে হতাশ হচ্ছিল। রামায়ণের কাহিনী মুখে মুখে যতটা প্রচার পেয়েছিল, মহাভারতের বৃত্তান্ত তার সিকিভাগ ছড়ায়নি। রামায়ণের কথকতা যারা শুনেছে, তারা বলত, রাম নাকি আসলে ছদ্মবেশি কৃষ্ণ। দু’জনেই রাজা, রাজপরিবারের ছেলে। চেহারাতেও অনেক মিল। সত্যি-মিথ্যে জানার সুযোগ গৌড়ের বেশিরভাগ মানুষ এখনও পায়নি। তারা মজে আছে মনসার ভাসান গানে, চণ্ডীমাহাত্ম্য কথকতায়, পঞ্চ ‘ম’-এর মৌতাতে, শিবের গাজনে, যথেচ্ছ ভোগসুখে। তাদের কাছে ধর্ম মানে সমৃদ্ধি। বিলাসব্যসনে ডুবে থাকার সহজ উপায়। ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছি থেকে তাদের তোষামুদি করাই ধর্ম। ছেঁড়া গায়ের চাদরের মতো এক ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণে সাধারণ মানুষের অসুবিধে হয় না। স্বধর্ম আঁকড়ে যারা পড়ে থাকত, সেই ব্রাহ্মণরা শুধু ধর্মনাশের ভয় পায়। সংখ্যায় মুষ্টিমেয় হলেও সমাজরক্ষা আর রাষ্ট্রশাসনে তারা রয়েছে পুরোভাগে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসম্প্রদায়, যাদের শূদ্র অভিহিত করা হয়েছিল, তারা জানত না ধর্ম দিয়ে কী করতে হয়, ধর্ম খায়, না গায়ে মাখে! ধর্মরক্ষার তাগিদ তাদের নেই। যখন যা রাজধৰ্ম, তখন তার পেছনে পুরো গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে যায়। ধর্মরক্ষার পুরো দায়িত্ব ব্রাহ্মণদের, এই বিধান মেনে নিয়ে ব্রাহ্মণদের তারা এড়িয়ে চলত। ব্রাহ্মণদের যত না ভক্তি করত, তার চেয়ে বেশি ভয় পেত। ব্রাষ্মণ রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দিলে সপরিবার ভস্ম হয়ে যেতে পারে, এ বিশ্বাস তাদের হাড়ে মজ্জায় ঢুকে গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি তারা ভয় পায় নৈয়ায়িক, স্মার্ত ব্রাহ্মণদের। তারাই ছিল ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের প্রবক্তা, হর্তাকর্তা-বিধাতা। হিন্দুধর্ম বলতে তারা বুঝত মনুসংহিতা। মনু রচিত ধর্মীয় আচরণ বিধিকে তারা ধর্ম মনে করত। তারা আবার চুকলিখোর। সুলতানি গুপ্তচরদের খবর জোগায়, সুলতানের নেকনজরে থাকতে চায়। ধর্মের মধ্যে কাব্যসাহিত্য, সংগীত, শিল্পসৌন্দর্য, দর্শন, এমনকি প্রেম-ভালোবাসার জন্যে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে তারা রাজি ছিল না। অথচ অভ্যন্তরীণ বিকাশের নিয়মে আর পরিস্থিতির চাপে ধর্মীয় কাঠামোর রূপান্তর ঘটেছিল। দেড় হাজার বছর আগে বৈদিক ধর্মকে যে গৌতম বুদ্ধ বদলে দিয়ে গিয়েছিলেন, একেশ্বরবাদ থেকে নিরীশ্বরবাদ থেকে নির্বাণে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁর প্রচারিত অহিংসা, করুণা, প্রেম, ভালোবাসার সেই বোধি, দেড় হাজার বছর পরেও জাগরূক ছিল।

ভালোবাসার গান সঙ্কীর্তনের অভিযোগে এক রাতে শ্রীবাসের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল সিরাজুদ্দিন কাজির গুপ্তচররা। নবদ্বীপের বিষ্ণুভক্তরা ভয়ে গা-ঢাকা দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *