গোরা – ১৩

১৩

নববধূ লক্ষ্মীকে পেয়ে অনেক বছর পরে রামচন্দ্রপুরে শচীর সংসারে আনন্দের ঢেউ উঠল। বাড়ির ভেতরে ন্যাড়া উঠোনের তিন ধার ঘেঁষে শিউলি, যুঁই, গাঁদা, জবা, বেলফুলের চারা পুঁতে লক্ষ্মী এমন সযত্ন পরিচর্যা শুরু করল, যে বর্ষার শুরুতে তরতর করে বেড়ে উঠতে থাকল গাছশিশুরা। নিজের হাতে পোঁতা বেলফুলের গাছে কুঁড়ি আসতে গর্ভধারণের আনন্দগরিমা ছড়িয়ে পড়ল লক্ষ্মীর মুখে। আহ্লাদে হাততালি দিয়ে বাড়ির উঠোনে সে নাচতে শুরু করলে, ধিঙ্গি মেয়ের কাণ্ড দেখে শচী বিরক্ত হলেও স্বামী সোহাগিনী পুত্রবধূকে ধমক দিতে সাহস পেল না। বউ নিয়ে গোরা মজেছে, টের পেয়ে ঈর্ষাতুরা শচী অনুভব করছিল তার কাছ থেকে ছেলে দূরে সরে যাচ্ছে। তবু মৃত আট মেয়ের স্মৃতিকাতরতা থেকে পুত্রবধূকে ভালবেসে শচী বুকে টেনে নিল। বাড়ির উঠোনে যে বউ পদ্মপাতার মতো পায়ের ছাপ এঁকে ফুল ফোটাতে পারে, সে প্রকৃত কল্যাণী গৃহবধূ, এ নিয়ে শচীর সন্দেহ থাকল না। লক্ষ্মী ঘরে আসতে গোরার চতুষ্পাঠীতে এত ছাত্র ভিড় করতে থাকল যে মুকুন্দ সঞ্জয়ের বৈঠকখানায় তাদের জায়গা দেওয়া কঠিন হল। গোরার চতুষ্পাঠীর অর্ধবর্ষ পূর্তিতে ন্যায়শাস্ত্রের সেরা পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি, এক দুপুরে মুকুন্দ সঞ্জয়ের বাড়ির সেই শিক্ষায়তনে পায়ের ধুলো দিতে, নবদ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল গোরার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি। হেঁজিপেজি পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে রঘুনাথ শিরোমণির মতো দেশবরেণ্য নৈয়ায়িক সচরাচর পা দেওয়ার পাত্র নন। সদ্য অধ্যাপনা শুরু করা গোরার অখ্যাত চতুষ্পাঠী দেখতে রঘুনাথের আসার খবর নবদ্বীপের বিদ্বজ্জন মহলে রাষ্ট্র হয়ে গেল। কারণ জানা না গেলেও গোরার চতুষ্পাঠীতে ছেলেদের ঢোকাতে অভিভাবকদের মধ্যে লেগে গেল প্রতিযোগিতা। শচীর সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরতে শাশুড়ির কাছে সৌভাগ্যবহনকারিণী পুত্রবধূ লক্ষ্মীর আদর বেড়ে গেল। গোরার বিয়ে উপলক্ষে আরও একটা ঘটনা ঘটল, যা সেই মুহূর্তে নজর না কাড়লেও কয়েক বছর বাদে নবদ্বীপের ইতিহাসে চিরকালের মতো ঢুকে গেল।

গোরার বিয়েতে গৌড়ের একচাকা খলাপপুর থেকে বিনা নিমন্ত্রণে বাড়ির সেবককে নিয়ে কুবের নামে বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের যে অতিথি এসে হাজির হল, নামে তাকে গোরা চিনলেও সশরীরের আগে দেখেনি। বিশ্বরূপের সমবয়সী, তার-ই মতো চেহারা, হাবভাব, জীবনে প্রথম কুবেরকে দেখে গোরা যেমন অবাক হল, তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হল। মানুষটার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও মনে হল জন্মান্তরের সংযোগ রয়েছে। আনন্দের সাগরে ভাসতে থাকল সে। তার এগারো বছরের জন্মদিনে খলাপপুর থেকে গৃহসেবক শুভাই-এর হাতে কিছু উপহারের সঙ্গে একটা চিঠি লিখে পাঠিয়েছিল কুবের। গৌড় থেকে অচেনা বাহকের হাতে পাঠানো উপহার পেয়ে গোরা চমকে গেলেও চিঠি পড়ে অভিভূত হয়েছিল, রোমাঞ্চে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। দুলে উঠেছিল পায়ের তলার মাটি। চিঠি লিখেছিল কুবের। কে এই কুবের, তার ঠিকানা, পিতৃপরিচয় চিঠি থেকে বিশদভাবে গোরা জেনেছিল। কুবের চিঠিতে লিখেছিল, সে চেনে গোরাকে। কীভাবে চিনল, কুবের তাও লিখেছিল চিঠিতে। সেই একবার-ই চিঠি লিখেছিল। তারপর থেকে কুবেরের সঙ্গে গোরার আর যোগাযোগ ঘটেনি। উনিশ বছর বয়সে খলাপপুরের বাড়ি, মা, বাবার সংসার ছেড়ে এক অবধূত সন্ন্যাসীর সঙ্গে কিছুকালের জন্যে পরিব্রাজনে যাওয়ার আগে উপহারসমেত নিজের লেখা চিঠি গোরাকে পৌঁছানোর ভার পুরনো গৃহসেবক শুভাইকে দিয়েছিল কুবের। শুভাই দায়িত্ব পালন করার সঙ্গে এমন কিছু খবর গোরাকে দিয়েছিল যে এগারো বছরের বালক তখনই খলাপপুরে কুবেরের বাড়িতে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মা শচী, কান্নাকাটি করে তখনকার মতো আটকেছিল তাকে। শুভাই-এর কাছ থেকে গোরা জেনেছিল, পাঁচ বছর আগে খলাপপুরে কুবেরের বাবা, যার আসল নাম মুকুন্দ বন্দোপাধ্যায়, এলাকায় পরিচিত হাড়াই পণ্ডিত নামে, মা পদ্মাবতীর সংসারে তিন রাত কাটিয়ে বিশ্বরূপ হঠাৎ সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। অল্প কয়েকদিনে, কাছাকাছি বয়স, কুবেরের সঙ্গে তার এমন বন্ধুত্ব হয়ে যায়, যা দেখে দু’জনকে যমজ সন্তান ভাবতে শুরু করেছিল পদ্মাবতী। তার বুকের মধ্যে অপত্যস্নেহের জোয়ার উঠেছিল। বিশ্বরূপের সঙ্গী হয়ে কুবের সারাদিন, মাঝরাত পর্যন্ত আলোচনা, গল্পে এমন মেতে থাকত, যে গৃহভৃত্য শুভাই আশপাশে থাকলেও তাদের কথা চালাচালির মাথামুণ্ডু বুঝতে পারত না। দু’জনের চাপা গলার কথাবিনিময় কিছুটা কানে গেলেও শুভাই-এর কাছে তা ছিল দুর্বোধ্য। হাড়াই পণ্ডিতের বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে বিশ্বরূপ নিঃশব্দে চলে গেলেও কুবেরকে একেবারে ফাঁকি দেয়নি। নিজের আত্মপরিচয় জানানোর সঙ্গে নবদ্বীপের রামচন্দ্রপুর গ্রামে ছোট ভাই গোরার বিবরণ শুনিয়ে বলেছিল, তার সঙ্গে ভবিষ্যতে কুবের যেন যোগাযোগ করে। গোরাকে নিয়ে তার লেখা পুঁথি আগুনে পুড়ে ছাই না হলে, তা পাঠ করে কুবের উপকৃত হত, এ কথা বলতে বিশ্বরূপ ভোলেনি। তার বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে পুঁথি দাহ করেছে, এ ঘটনা কুবেরের কাছে বিশ্বরূপ চেপে গিয়েছিল। গোরার বয়স বাড়লে তার সঙ্গে কুবেরকে দেখা করতে একাধিকবার মনে করিয়ে দিয়েছিল বিশ্বরূপ। দুই বন্ধুর এত শলাপরামর্শ হাড়াই পণ্ডিত, পদ্মাবতী জানত না। শুভাই-এর কানে এসেছিল দু’চার কথা। সে বিশেষ আমল দেয়নি। খলাপপুর ছেড়ে বিশ্বরূপ চলে যেতে কুবের খুব কেঁদেছিল। ভারি নরম মনের ছেলে ছিল কুবের। কোথাও প্রীতি পেলে সেখানে মাটি পর্যন্ত চেটে খেতে পারত।

শুভাই-এর বিবরণ অনুযায়ী, হাড়াই পণ্ডিতের বাড়ি ছেড়ে বিশ্বরূপ চলে যাওয়ার পাঁচ বছর. পরে এক অবধূত সন্ন্যাসী তিন রাতের জন্যে সেই বাড়িতে আতিথ্য ভিক্ষা নিয়েছিল। গৃহস্থবাড়িতে সন্ন্যাসী আতিথ্য চাইলে গৃহী সৌভাগ্যবান ভাবত নিজেকে। অবধূত সন্ন্যাসীকে সসম্মানে, সস্ত্রীক হাড়াই পণ্ডিত নিজেদের ভদ্রাসনের সেরা ঘরটি ছেড়ে দিয়ে ষোড়শোপচারে আতিথ্য জুগিয়ে কৃতার্থ বোধ করল। সন্ন্যাসী যাওয়ার আগে তাকে হাড়াই পণ্ডিত সবিনয়ে কিছু বিদায়দক্ষিণা দিতে চাইলে, অবধূত সন্ন্যাসী মৃদু হেসে পরিবারের ছেলেটিকে, অর্থাৎ, হাড়াই আর পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান, উনিশ বছরের কুবেরকে দক্ষিণা চাইল। অবধূত সন্ন্যাসী এমন এক মহাভিক্ষা চেয়ে বসতে পারে, হাড়াই-পদ্মাবতী কল্পনা করেনি। তাদের মাথায় বাজ পড়ল।

শুকিয়ে গেল হাড়াই পণ্ডিতের মুখ। নয়নের মণি কুবেরকে হারানোর আশঙ্কায় কম্পিত শরীরে ঘরে ঢুকে বেহুঁশ হয়ে গেল পদ্মাবতী। হাড়াই পণ্ডিত জানত, দক্ষিণা দেওয়ার অভিলাষ জানিয়ে প্রতিশ্রুতি ভাঙলে, প্রতিশ্রুতিভঙ্গকারীর চোদ্দ পুরুষকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। সমাজে বেঁচে থাকলে, মুখে চুনকালি পড়ে। হাজারবার ধুলেও মুখ থেকে সে দাগ ওঠে না। কুবেরের বয়স তখন উনিশ। প্রাণবন্ত, উদার হৃদয় যুবক সে। তার বিয়ে দিয়ে ঘরে পুত্রবধূ এনে ছেলেকে সংসারি করার আয়োজন আরম্ভ করেছিল পদ্মাবতী, হাড়াই পণ্ডিত। বিপন্ন মা, বাবার দুর্দশা দেখে সন্ন্যাসীর সঙ্গে যাওয়ার জন্যে কুবের নিজে এগিয়ে এল। প্রাণ থাকতে মা, বাবাকে সত্যের পথ থেকে সে বিচ্যুত হতে দেবে না। উপযুক্ত মেয়ে নির্বাচন করে এক মাস পরে তার বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়ে গিয়েছিল। সমান তোড়জোড় চলছিল দু’বাড়িতে। দুই পরিবারের মধ্যে চুক্তিভঙ্গের পাপ হাড়াই পণ্ডিতের ওপরে বর্তালেও সন্ন্যাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করা আরও গুরুতর পাপ। কুবের জানে তার হবু শ্বশুর যথেষ্ট ধর্মভীরু এবং শাস্ত্রজ্ঞ। মেয়ে অরক্ষণীয়া থাকার জন্যে শ্বশুরমশাই নিশ্চয় হাড়াই পণ্ডিতের নামে অপযশ রটাবে না। শোকাতুর মা বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে, তাদের পুণ্যার্জনের পথ নির্বিঘ্ন করতে, কুবের স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করল নিজেকে। নবদ্বীপের বিশ্বরূপকে তখনও সে ভোলেনি। প্রায় রোজ, অন্তত একবার তাকে মনে পড়ে। সেই সঙ্গে মনে পড়ে যায়, তার ভাই গোরাকে, যার সম্পর্কে বলতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত বিশ্বরূপের দু’চোখ ভিজে উঠত। সন্ন্যাসীর সঙ্গে বাড়ি ছাড়ার আগে গোরার এগারো বছরের জন্মদিনে পাঠিয়েছিল শুভেচ্ছাবার্তার সঙ্গে কিছু উপহার। গোরা তখন হৃষ্টপুষ্ট কিশোর। শুভাই-এর সঙ্গে তখনই খলাপপুরে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কুবের সেখানে নেই জেনে নিজেকে নিবৃত্ত করেছিল।

কুবেরকে নিয়ে যাওয়ার সময়ে, তাকে আবার সংসারে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সন্ন্যাসী বলেছিল, কুবের সন্ন্যাস নিক, অথবা না নিক, সংসারধর্ম পালন করা তার ভবিতব্য। তা খণ্ডন করার ক্ষমতা ঈশ্বর ছাড়া কারও নেই। ঈশ্বরই তাকে সংসারী করবেন। তবে আলাদা রকম সংসারী হবে সে। সংসারের মধ্যে সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসের মধ্যে সংসার, অভিন্ন আকার নেবে।

অবধূত বিশদ করে আর কিছু না বলে এখানে থেমেছিল। প্রবীণ সেই অবধূত, পাঁচ বছর পরে খলাপপুরে হাড়াই পণ্ডিতের সংসারে ফিরিয়ে দিয়ে গেল কুবেরকে। ছেলেকে পেয়ে মা-বাবার আনন্দ ধরে না। চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে যত্নে, আদরে কুবেরকে ভাসিয়ে দিল মা পদ্মাবতী। মা-বাবাকে কুবের শোনাল তার পরিব্রাজনের বিবরণ। পাঁচ বছরের দিনপঞ্জি এক দিনে বলা যায় না। অবধূত বর্গের সন্ন্যাস মন্ত্রে সে-ও দীক্ষা নিয়েছিল। গুরুর সঙ্গে দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর ভারত হয়ে কামরূপ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে ঘুরলেও গৌড়বঙ্গের মাটি একবারও মাড়ায়নি। রামানুজ আর তার ভক্ত রামানন্দর সঙ্গে নিজের গুরুর ধর্মালোচনার সময়ে সে-ও ছিল একজন শ্রোতা। দুই পণ্ডিতশ্রেষ্ঠের ধর্মীয় অভিমত পুরো না বুঝলেও তারা নিজেদের কেন ‘শ্রী’ সম্প্রদায়ভুক্ত ঘোষণা করে হৃদয়ঙ্গম করতে কুবেরের অসুবিধে হয়নি। প্রকৃতি, পৃথিবী, প্রাণের মহিমামণ্ডিত অন্তর্বস্তু হল শ্রী। পার্থিব জগৎ আর মনুষ্যত্বের পটভূমিতে যা কিছু শ্রীহীন, তা-ই মানবসত্তার পক্ষে অবমাননাকর। সব ধর্মসম্প্রদায়ের মূল কাজ হল পৃথিবী আর মানবজীবনকে সুশ্রী, শ্রীময়ী করে তোলা। গুরুর কৃপায় তাঁর-ই সঙ্গী হয়ে সুফি সাধক, কবিরের স্নেহের ছায়ায় বসতে কুবের সুযোগ পেয়েছে। সমবেত কণ্ঠের সমন্বয় সঙ্গীতই যে ধর্ম, প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছে মহান ধর্মনেতা, পরম ভক্ত কবির। পশ্চিম ভারত পরিক্রমাতে পঞ্চনদ পরিবৃত অমৃতশহরে মহান শিখগুরু নানকের সঙ্গ করার সুযোগ পেয়েছিল কুবের। সব সময়েই তার পাশে ছিল নিজের অবধূত গুরু। গুরু নানক শুনিয়েছিল ধর্মের এক মনোগ্রাহী ব্যাখ্যা। ঈশ্বরের স্বরূপ নির্ধারণ করতে গিয়ে নানক বলেছিল, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর আর এক নাম প্রেম, সব জীবের জন্যে ভালবাসা। মানুষ, প্রাণীজগৎ জড়পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে ভালবাসার গভীর আবহ। সেই আবহে মানুষ ডুব দিতে পারলে পরম একের সান্নিধ্য পাবে। “ওয়াহে গুরুজি কা খালসা, ওয়াহে গুরুজি কি ফতেহ্।”

কুবেরকে যে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল, সে সাধকোত্তম, অতিমানব, সচল সন্ন্যাসী পরিচয়ে দেশবিদিত, মাধবেন্দ্র পুরী। মাধবেন্দ্র শোনাল কৃষ্ণনাম জপ-ই কলিযুগে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। নাম, শুধু একটা নাম, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে দিতে পারে। কোটি কোটি মানুষ রোজ যদি কয়েক হাজারবার সেই নাম একা আর সম্মিলিতভাবে উচ্চারণ করে, তাহলে পৃথিবী জুড়ে প্রেম, ভালবাসা, শান্তি, সচ্ছলতার সুবাতাস বইতে থাকবে, মানুষের সুষুপ্ত সাধুতা আলিঙ্গন করবে বিশ্বচরাচর, তার শ্রী সৌন্দর্য সহস্রধারায় উৎসারিত হতে থাকবে। পাশাপাশি দুরাত্মা, পাপী, নির্যাতনকারীরা ভূত দেখবে, বিনাশের ভয়ে কাঁপুনি ধরবে তাদের। নাম চাই, নাম, মানুষের জিভের ডগায় সেই ‘কৃষ্ণ’ নাম বিরাজ করুক।

কৃষ্ণ নামের মহিমা ব্যাখ্যার সঙ্গে সচল সন্ন্যাসী ক্রমাগত পঞ্চনদের তীরভূমি বেষ্টিত একটি বৃত্তের মধ্যে পায়চারি করার সঙ্গে কৃষ্ণনাম জপ করছিল। কৃষ্ণ শব্দের অর্থ যে ব্ৰহ্মাণ্ড, ধূলিকণা, সৃষ্টি, স্থিতি, বিলয়, শ্রী, সৌন্দর্য, প্রেম, পুরুষ, নারী, বৃক্ষ, তরুলতা, সমুদ্র, পাহাড়, পরিত্রাণ, বিনাশ, অশ্রু, হাসি, সুরসঙ্গীত, এরকম কয়েক’শ গোচর, অগোচর, নীরব, বাঙ্ময় মন্ত্রগুপ্তি আর অভিব্যক্তি চলমান অবস্থাতে বিশদ আলোচনার মধ্যে গৌড়ের পথে সন্ন্যাসী রওনা দিল। মাধবেন্দ্র-ই জানাল, গৌড় ছুঁয়ে সে নবদ্বীপ যাবে, সেখান থেকে কামরূপ হয়ে রেমুনা, ছত্রভোগ, নীলাচলের পথে দক্ষিণ ভারতে ঢুকবে। নবদ্বীপে তার প্রিয় শিষ্যদের মধ্যে আছে অদ্বৈত আচার্য। নাম, অদ্বৈত হলে কী হবে, সে পরমভাগবত, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। গয়ায় আছে ঈশ্বরপুরী। সেও এক জায়গায় স্থির থাকার মতো শিষ্য নয়, কৃষ্ণ নাম বিতরণে গুরু মাধবেন্দ্রর মতো সেও সচল সাধক। বহু সহস্র ক্লোশের পথপরিক্রমায় কয়েক কোটি বার কৃষ্ণ নাম উচ্চারণের সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের জিহ্বাগ্রে এই নাম মাধবেন্দ্র পৌঁছে দেবে। নামের গুণে মুক্ত, শুদ্ধ, কল্যাণময় হয়ে উঠবে এই দুঃখী দেশ।

সচল সন্ন্যাসী মাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্গে অবধূত গুরু আর তার অনুগামী কুবের কয়েকশ যোজন পথ দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে হেঁটে চলেছে। মাধবেন্দ্র কখনও নিশ্চুপ, কখনও বলে গেছে ধর্মতত্ত্ব। কৃষ্ণ শব্দের অসংখ্য অর্থের সঙ্গে কৃষ্ণের স্বরূপ ব্যাখ্যাতে যে আখ্যান শুনিয়েছে, অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শনের চেয়ে সেই আখ্যান কম রোমাঞ্চকর নয়। সুর যেমন সঙ্গীতের স্রষ্টা, আবার সঙ্গীত থেকে সুরের জন্ম, তেমনি স্রষ্টা কৃষ্ণ, স্বয়ং নিজের সৃষ্টি। পিতার সন্তানই ফের সন্তানের পিতা। আঠারোটি পুরাণের মধ্যে যে ন’টি পুরাণে কৃষ্ণের লীলা আর সুযশ কীর্তিত হয়েছে, ব্রহ্মপুরাণ, পদ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বামনপুরাণ, কূর্ম্মপুরাণ–সেই কীর্তনের ধুয়ো হল, সংসারধর্ম আর মানবধর্ম পালনে দিব্যোন্মাদ হও। দিব্যোন্মাদ হতে হলে চতুর্বর্গ, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ-র সঙ্গে চাই পঞ্চমবর্গের জন্যে গভীর আকৃতি। পঞ্চম বর্গ হল–প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা। পঞ্চম বর্গের প্রশস্তিতে বিমুগ্ধ মাধবেন্দ্র বিভিন্ন পুরাণ, প্রধানত হরিবংশ, ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ থেকে শ্লোকের পর শ্লোক আবৃত্তি করে ছেলের বয়সি অবধূত সন্ন্যাসীকে শোনাচ্ছিল। সংস্কৃত শ্লোক, অবধূত কতটা বুঝতে পারছিল কুবের অনুমান করতে না পারলেও তার মাথাতে বিন্দুবিসর্গ ঢুকছিল না। সংস্কৃত ভাষায় তার হাতেখড়ি হলেও শাস্ত্র বোঝার জ্ঞান অধিগত হয়নি। তবু মাধবেন্দ্রর মুখে শ্লোকসমূহের আবৃত্তি শুনতে ভালো লাগছিল। সংস্কৃতের বেড়া ভেঙে বাংলায় যখন মাধবেন্দ্র ব্যাখ্যা করছিল, কুবেরের মনে হচ্ছিল, ভাবুকতার স্রোতস্বিনী বয়ে যাচ্ছে। দিব্যোন্মাদ সচল সন্ন্যাসীর চোখ থেকে কখনও গড়িয়ে পড়ছিল জল, দু’চোখের মণি কখনও স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছিল। কৃষ্ণের ইতিহাস বিস্তৃত করে মাধবেন্দ্র বলেছিল, ঋগ্বেদ সংহিতায় যে কৃষ্ণকে আর্যকুলোদ্ভব ব্রাহ্মণ তপস্বী পরিচয়ে প্রতিষ্টা করা হয়েছে, সেখানেই রয়েছে তিনি আসলে অনার্য নরপতি, অংশু নদীর তীরে তার প্রাসাদ। তিনি অসুর কৃষ্ণকেশীর নিধনকারী, তিনি-ই বেদবিভাজনকর্তা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি, মহাজ্ঞানী, মহাযোগী, সর্বশাস্ত্রবিশারদ অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন লোকোত্তর মানুষ। সাতপুরুষ ধরে কুরুবংশীয়দের মধ্যে তিনি যেমন মহামুনি পরাশর আর মৎস্যরাজকন্যা সত্যবতীর অসিদ্ধ সন্তান, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন পরিচয়ে উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনই যযাতির ছেলে যদুর পুত্রসন্তান কৃষ্ণ হিসেবেও পূজিত হয়েছেন। কুরুবংশ, ইক্ষ্বাকুবংশ, সূর্যবংশ, চন্দ্রবংশ—সব বংশধারাতে তিনি বিরাজমান, তিনি-ই সূত্রধর। কিংবদন্তি অনুযায়ী বহুরূপী কৃষ্ণই হাজার বছর পরে মনু নাম নিয়ে হাজির হয়েছেন। কৃষ্ণের মতো মনুরও হরেক নাম। কখনও তিনি বৈবস্বত মনু, কখনও স্বায়ম্ভব, সংহিতা রচয়িতা, ঋগ্বেদের মনু, পুরাণের মনু, স্বারোচিষ মনু, উত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ মনু। বৈবস্বত মুনিকে আর্য জাতির জনক বলা হয়, প্রজাপতি ব্রহ্মা থেকে স্বায়ম্ভব মনুর জন্ম হলেও ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্তা অখিলেশ্বর কৃষ্ণ। ব্রহ্মার গর্ভধারিণীর নাম ত্রিকালিনী অর্থাৎ সময়। মনুর লেখা সংহিতা ও রচনাবলী পাঠের অধিকার ও প্রচার করার অধিকার যেমন পুরাকালে ভৃগুমুনিকে দেওয়া হয়, তেমনই পরবর্তীকালে সেই অধিকার বর্তায় মাধবেন্দ্র পুরীর ওপর। মাধবেন্দ্র যখন নবীন তাপস, তখন দাক্ষিণাত্য থেকে মধ্যভারত জুড়ে বীরকেশরী শাক্যকূট বংশের রাজা তৃতীয় কৃষ্ণের দোর্দণ্ড প্রতাপ শাসন কায়েম ছিল। শাক্যকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দর মধ্যেও মাধবেন্দ্র জগৎসংসারের স্রষ্টা, বেদবন্দি, বেদবিভাজক কৃষ্ণকে দেখলেও তাদের কেউ সাধুসমাজকে অর্থাৎ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষকে দুষ্কৃতী, দুর্বৃত্তদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে পারবে, প্রকৃত পরিত্রাতার ভূমিকা নেবে, এ নিয়ে সচল সন্ন্যাসীর মনে সংশয় জেগেছিল। কৃষ্ণের ধারাবাহিকতা মেনে নিলেও প্রকৃত কৃষ্ণাবতারের প্রতীক্ষায় ক্রমাগত নাম জপ করার সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের কাছে গিয়ে করজোড়ে কৃষ্ণকে ডাকার প্রার্থনা জানাচ্ছিল। ভাবোন্মত্ত সন্ন্যাসীর ডাকে সাড়া না দিলেও পৃথিবীতে একজন মহামানবের অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনায় তাদের মনে বিশ্বাস ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। হাজার লক্ষ মানুষ একটা নাম ধরে প্রগাঢ় ভালবাসায় ক্রমাগত ডাকাডাকি করলে অবয়ববিহীন সেই নামের মানুষটা স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ফুঁড়ে মানুষের চেহারায় আবির্ভূত হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অবধূত গুরুকে যথোচিত মর্যাদায় মাথায় করে রাখলেও মাধবেন্দ্র পুরীর ভাবোন্মত্ততা কুবেরের বুকের মধ্যে ঢেউ তুলেছিল। হৃদয় ভাসানো আবেগের সঙ্গে প্রকৃত আলোকিত পথের খোঁজ পেয়েছিল কুবের। অবধূতের শিষত্ব নেওয়ার সেটা ছিল চতুর্থ বছর।

গোরার বিয়ের সাতদিন আগে, গঙ্গার পশ্চিম তীরে বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ডে কবিরাজ মুকুন্দদাসের বাড়িতে এসে কুবের উঠেছিল। সেখানে বসে পরের দিন দুপুরে গোরাকে কুবের শোনাচ্ছিল, বাড়ি ছেড়ে তার চলে যাওয়ার পর থেকে পাঁচ বছর ধরে পরিব্রাজন, তীর্থদর্শন আর বহুরকম সাধুসঙ্গের কাহিনী। নিজের সম্পর্কে বলার আগে অনেকক্ষণ ধরে বিশ্বরূপের বিবরণ শুনিয়েছে। গোরা কোনও প্রশ্ন না করে স্তব্ধ হয়ে শুনেছে সেই বৃত্তান্ত। মাঝে মাঝে ধুতির খুঁটে চোখের জল মুছছিল। সামনে, কয়েকদিন বাদে তার শুভপরিণয়। পারিবারিক এই আনন্দ অনুষ্ঠানে দাদা অনুপস্থিত, বাবা লোকান্তরে, ভেবে শোকাচ্ছন্ন হলেও কুবেরকে কাছে পেয়ে মনের শূন্যতা অনেক ভরে উঠেছে, অনুভব করছিল। কুবেরকে প্রথম দর্শনে, চমকে গিয়ে মনে হয়েছিল এ-ই বিশ্বরূপ, তার অগ্রজ দাদা। চমক কাটতে সময় না লাগলেও প্রায় বারো বছর আগে গভীর রাতে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া বিশ্বরূপকে স্মৃতির মধ্যে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিল। সচল সন্ন্যাসী মাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্গে হয়তো বিশ্বরূপের দেখা হয়েছে। সে-ও হয়তো কৃষ্ণনাম জপ করছে। ধর্ম নিয়ে গোরার বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও অবধূত সন্ন্যাসী, কুবেরের ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনে আনন্দ পাচ্ছিল।

সুলতান হুসেন শাহের চিকিৎসকমণ্ডলীর অন্যতম শ্রীখণ্ডবাসী, মুকুন্দদাস ছিল হাড়াই পণ্ডিতের মাতৃকুল সম্পর্কে আত্মীয়, দু’জনে মামাতো পিসতুতো ভাই। সেই সুবাদে কুবেরের পিতৃব্য, মুকুন্দদাস। কুবের, গোরার কথার মধ্যে মুকুন্দদাস দু’একবার ঘরের দরজা থেকে উঁকি দিয়ে দুই তরুণকে দেখে গেলেও তাদের কথার মধ্যে নাক গলাচ্ছিল না। নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্রের সঙ্গে মুকুন্দদাসের বিলক্ষণ পরিচয় ছিল। তার ছোট ছেলে, নবদ্বীপে নিমাই পণ্ডিত নামে যাকে একডাকে সকলে চেনে, সে এমন দেবদুর্লভ সৌন্দর্যের অধিকারী, মুকুন্দদাস জানত না। সেই সৌন্দর্যের টানে গোরাকে দেখতে থেকে থেকে দরজায় এসে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দু’চারটে সৌজন্যের কথা বলে সে চলে যাচ্ছিল। দিকপাল আয়ুর্বেদজ্ঞ, ব্যস্ত চিকিৎসক সে। বাড়িতে যেমন রোগীর ভিড়, তেমনই গুরুতর অসুস্থ রোগী দেখতে দূর-দূরান্তরে তাকে যেতে হয়।

গোরার বিয়ে সমাসন্ন না জেনেই তাকে একবার দেখার জন্যে কুবের নিজেও জানে না, কেন তার মন ব্যাকুল হয়েছিল। খলাপপুর থেকে সরাসরি নবদ্বীপে না গিয়ে, গোরাকে বাজিয়ে দেখার জন্যে অর্থাৎ পাঁচ বছর বাদে নবদ্বীপের সেই এগারো বছরের বালক তাকে মনে রেখেছে কিনা যাচাই করে নিতে মুকুন্দদাসের বাড়িতে উঠেছিল। শ্রীখণ্ডে প্রথম রাত কাটতে পরের দিন ভোরে গঙ্গার উল্টোদিকে নবদ্বীপে গোরার কাছে শুভাইকে পাঠিয়ে দিয়েছিল কুবের। নিজের আত্মপরিচয় লিখে, সময় করে শ্রীখণ্ডে গোরাকে দর্শন দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল শুভাই-এর হাতে। নবদ্বীপে আগে একবার গোরার কাছে এসে শহরের পথঘাট, রামচন্দ্রপুরে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ি, শুভাই চিনে গিয়েছিল। নৌকোয় উঠে সাতসকালে গোরার বাড়িতে এসে তার হাতে কুবেরের চিঠি দিল শুভাই। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তাকে দেখলেও গোরা তখনই চিনতে পেরে শুভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। কুবেরের চিঠি পড়ে, সাতদিন পরে যার বিয়ে, সেই গোরা, আবেগ, উত্তেজনা, খুশিতে, সেদিনের মতো চতুষ্পাঠী ছুটি করে দিয়ে তড়িঘড়ি শুভাই-এর সঙ্গে শ্রীখণ্ডে পৌঁছে গেল। গোরাকে দেখে আনন্দে অভিভূত কুবেরের শরীরে এমন শিহরন জাগল যে কয়েক মুহূর্ত তার মুখ দিয়ে কথা বেরলো না। পাঁচ বছর দাক্ষিণাত্য থেকে কামরূপ পর্যন্ত বহু জনপদ, তীর্থস্থান ঘুরে কোথাও এমন নিখুঁত অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ তার চোখে পড়েনি। মর্ত্যভূমিতে যে এমন দীর্ঘদেহী দেবকল্প মানুষ থাকতে পারে তার জানা ছিল না। কুবেরকে দেখে গোরার দশাও তথৈবচ। তার মনে হল সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্বরূপ। অপলক চোখে কয়েক মুহূর্ত কুবেরের দিকে তাকিয়ে থেকে গোরা প্রথমে জড়িয়ে ধরল, পরিচিত অথচ অদর্শিত, খলাপপুরের বাসিন্দা, পরম শুভাকাঙ্ক্ষী, অগ্রজতুল্য কুবেরকে। কুবেরও তাই করল। সৰ্বার্থে বৃহৎ ছোটভাইকে স্নেহাদরে বুকে টেনে নিয়ে ব্রহ্মকমলের সুবাস পেল। শুরু হল তাদের গল্প কথার বেশিটা বলছিল কুবের, শ্রোতা গোরা। কড়া ধর্মীয় বিধিনিষেধকে অবধূত সন্ন্যাসীরা অনেক আলগা করে দিয়েছে, কথা প্রসঙ্গে তা জানাল কুবের। মাধবেন্দ্র পুরীর কৃষ্ণনাম জপের সহজ ধর্মাচরণ, তার মনে পাকা দাগ রেখে গেছে, এ কথা বলতে ভুলল না। ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ—চতুর্বর্গের এই সাধনার সর্বোচ্চ ধাপ, বলা যায় পঞ্চম বর্গ, তা যে প্রীতি, মাধবেন্দ্ৰ পুরীর এই অভিনব ব্যাখা কুবের আগে শোনেনি। চতুর্বর্গকে শেষ কথা ভাবত সে। মোক্ষের পরে আর কিছু হয় না, এই ছিল তার অভ্রান্ত বিশ্বাস। স্বর্গেও প্রীতির অভাব ঘটতে পারে, এ ধারণা তার ছিল না। তার মন্ত্রদাতা, অবধূত সন্ন্যাসীও চতুর্বর্গের পরে সাধনার আর এক ধারা, পঞ্চম বর্গ, যার নাম, প্রীতি, থাকতে পারে আগে কখনও শোনেনি। মাধবেন্দ্রর মুখে পঞ্চম বর্গের ব্যাখ্যা শুনে কুবেরের মতো গুরুও সমান হতবিহ্বল হয়েছিল। কৃষ্ণনাম আর প্রীতির মিলন ঘটিয়ে কলিযুগের অবসান ঘটানো যায়, কুবেরের মাথাতে এ চিন্তা মাধবেন্দ্র ঢুকিয়ে দিয়েছে। গোরার জন্যে বিশ্বরূপের লেখা পুঁথিটা অপঠিত থেকে যাওয়াতে কুবের হাহুতাশ করতে গোরা জানিয়েছিল, তার ধারণা, পুঁথিটা কোথাও রাখা আছে। পুঁথির মতো পবিত্ৰ এক সম্পদ, জগন্নাথ পোড়াতে পারে না, তার বিবেক এ কাজে তাকে নিশ্চয় বিরত রেখেছিল।

গোরা বিয়ে করছে শুনে আহ্লাদে আটখানা কুবের বিয়ের আমন্ত্রণ মেনে নিয়েছিল। শ্রীখণ্ড ছেড়ে সেই বিকেলে গোরার সঙ্গে নবদ্বীপে চলে এসেছিল। শুভাই ছিল তাদের পাশে। তাকেও সমাদরে আমন্ত্রণ জানাতে গোরা কসুর করেনি। তার চরিত্রে এমন এক স্বচ্ছতা ছিল, যা মনিব কুবের আর তার সেবক শুভাই-এর অবস্থাগত ফারাক, প্রাকৃতিক নিয়মে সূর্যের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মতো করে ঘুচিয়ে দিয়েছিল। শিশুকাল থেকে এটা তার স্বভাব–ব্রাক্ষ্মণ, শূদ্র, শুচি, অশুচি, স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য ভেদাভেদবোধ তার ছিল না। জন্ম থেকে এমন মুক্তমনা, উদার দৃষ্টি সে কীভাবে পেল তার ব্যাখ্যা খোঁজার বদলে, চরিত্রের এই স্বাতন্ত্র্য মেনে নেওয়াই ভালো। বাড়ির সেবক ঈশানের সম্মান তার কাছে মাতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তীর চেয়ে কম ছিল না। দু’জনকেই ‘দাদা’ বলার সঙ্গে তাদের যেমন সমীহ করত, তেমনই তাদের ওপর সমান উপদ্রব করত।

শেষে বিকেলে কুবেরকে নিয়ে সদর দরজা টপকে দু’জনে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দাওয়া থেকে গোরার সঙ্গীকে দেখে শচীর অন্তরাত্মা থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল, এখনই সে বেহুঁশ হয়ে যাবে। এই তো তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে বিশ্বরূপ! উঠোনের এক ধারে জ্বালানি কাঠের টুকরো সাজানোর মধ্যে সদর দরজার দিকে চোখ পড়তে একইকম বিভ্রান্তিতে ঈশান চেঁচিয়ে উঠল, বড়ঠাকুর!

দাওয়ায় বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শচীর সামনে কুবেরকে এনে গোরা যখন বলল, মা দ্যাখো, আমার বিয়ের আগে আসল বরকর্তা, আমার দাদাকে ধরে এনেছি।

কথাটা কানে যাওয়ার আগেই কুবেরের মুখ ভালো করে না দেখে তাকে বুকে টেনে নিয়ে ভাবাবেগে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে শচী বলল, আমাদের ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলি বাবা? কেন এত কষ্ট দিলি? তোর জন্যে শোকে বুক ফেটে মরে গেল তোর বাবা। অনাথিনী আমি। তুই না ঘরে থাকলে আমার জন্যে দু’মুঠো ভাত কে ব্যবস্থা করে দেবে? বছরে এক জোড়া থান কে জোগাবে?

শোকের ভারে শচীর গলা বুজে আসতে তার পিঠে আলতো করে সান্ত্বনার হাত রেখে কুবের বলল, মা এখন থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমার। সারাজীবন তোমার পাশে থাকব।

কুবেরের কথার মাঝখানে তার আসল পরিচয় শচীকে শুনিয়ে গোরা বলল, ছ’বছর আগে আমার জন্মদিনে খলাপপুর থেকে এই কুবেরদাদা উপহার পাঠিয়েছিল আমাকে। সঙ্গে ছিল একটা চিঠি, তোমার নিশ্চয় মনে আছে?

শচীর আবেগের তোড় সামান্য ধীর হয়ে এলেও গোরার সব কথা তার কানে ঢুকছিল না। মাকে সজাগ করতে গোরা বলল, দাদা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পথে খলাপপুরে এদের বাড়িতে তিন রাত ছিল। দাদার কাছ থেকে আমাদের বাড়িঘরের খবর, এমন কি আমার জন্মদিন, জানতে পেরেছিল কুবেরদাদা।

হাতের বাঁধন আলগা করে কুবেরের মুখের দিকে শচী তাকানোর আগে ‘মা’ ‘মা’ বলে ডেকে, তাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল কুবের। শচীর দু’পা ধরে উপুড় হয়ে দাওয়ার ওপর নিঝুম পড়ে থাকল। সাদা কামিজ, গেরুয়া বসন, ঝাঁকড়া চুল, মুখভর্তি দাড়ি, বিশ্বরূপের মতো মাঝারি চেহারার যুবকটা বিশ্বরূপ নয়, বিশ্বাস করতে শচীর কষ্ট হচ্ছিল। বুকের মধ্যে কুবেরকে টেনে নেওয়ার সময়ে তার গা থেকে বিশ্বরূপের গন্ধ পেয়েছে। সেও কি মনের ভুল? পায়ের সামনে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা কুবেরকে মাটি থেকে তুলে সামনে দাঁড় করিয়ে তার মুখের দিকে নির্নিমেষ নজর রেখে শচী বলল, তুমি খলাপপুরের হাড়াই পণ্ডিতের ছেলে হও আর যে-ই হও, আজ থেকে তুমি আমারও ছেলে, তোমার গা থেকে আমি বিশ্বরূপের গন্ধ পেয়েছি, আমি তোমার মা, গোরা তোমার ছোটভাই, এই ঘরদোর, সংসারে, গোরার সমান অধিকার তোমার, মনে রেখ।

শচীর গলা জড়িয়ে ধরে কুবের বলল, মা তোমার হুকুম অন্যথা করার মতো মতিভ্রম আমার যেন না হয়। তবে তোমার কাছে কিছু সময়ের জন্যে দু’টি প্রার্থনা করি। খলাপপুরে আমার মা, বাবা আছে, পরিব্রাজক এক অবধূত গুরু আছেন। যিনি নিজে থেকে এসে হাজির না হলে, কোথায় রয়েছেন জানার উপায় নেই। আমিও অবধূত, মা-বাবার সংসারে থাকলেও ব্রহ্মচর্যের কিছু নিয়ম আমাকে মেনে চলতে হয়। তোমার কাছে পাকাপাকি থিতু হওয়ার আগে মা, বাবা, গুরুর অনুমতি নেওয়া উচিত। আমার বিশ্বাস, আমাকে নবদ্বীপে বাস করার অনুমতি তাঁরা দেবেন। বাড়ি ছেড়ে, মা-বাবাকে ছেড়ে গুরুর সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্যে দেশান্তরী হওয়ার আগে যত কেঁদেছিলাম, পাঁচ বছর পরে গুরু আমাকে সংসারে ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে তার দশগুণ বেশি কেঁদেছি। তাঁর অনুমতি না নিলে অপরাধ হবে। সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলাম, তিন রাতের বন্ধু বিশ্বরূপ চলে যেতে। ঠিকানা না রেখে সে উধাও হয়ে যেতে ঘরের মাটির মেঝেতে মাথা ঠুকে আমি এত কেঁদেছিলাম, কাদা হয়ে গিয়েছিল ঘরের মেঝে।

শচীর মুখের দিকে তাকিয়ে কুবের বলেছিল, যার জন্যে কেঁদে ঘরের মেঝে ভাসিয়ে ছিলাম, তার সংসারে, তার মায়ের পদতলে আশ্রয় পেলে তা ছেড়ে কোথাও যাবার কথা আর ভাবতে পারবে না। আমার ইষ্টমন্ত্র যাইহোক, আমি জেনে গেছি, ধৰ্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের চেয়ে পঞ্চম বর্গ, প্রীতি-ই জীবনের বীজমন্ত্র। মা, প্রেম চাই, ভালবাসা চাই, তোমার কাছে আমার না এসে উপায় নেই। মুখে এক টুকরো হাসি নিয়ে মা আর কুবেরের কথা চালাচালি শুনছিল গোরা। শুভাই দাঁড়িয়েছিল দাওয়ার পাশে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় শেষ বিকেলের হালকা গোলাপি আলো কাঁপছিল উঠোনের নিমগাছের ডালপাতা ছুঁয়ে। নিমগাছের তলায় যে আঁতুড়ঘরে গোরা জন্মেছিল, সতেরো বছর ধরে ব্যবহার না হওয়ায় সেই ঘরের খড়ের চালাজুড়ে কালো রং ছড়িয়ে রয়েছে। খড়ে পচন ধরার এটা লক্ষণ। অযত্নের সেই ঘরে এখন উনুনের জ্বালানি কাঠকুটো রাখা হয়।

কুবের ও শুভাইকে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুক্লাচার্যের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিল গোরা। রামচন্দ্রপুরে জগন্নাথ মিশ্রের ঘনিষ্ঠ শ্রীবাস আচার্য, শুক্লাচার্য প্রমুখ প্রবীণেরা থাকলেও কুবেরকে বরকর্তা নির্বাচন করে বিয়ের আসরে গোরা নিয়ে গেল খলাপপুর থেকে বিয়েবাড়িতে দু’জন অতিথি আসার খবর ক’দিনের মধ্যে পাড়ায় রটে গেলেও বরযাত্রীদের সঙ্গে তাদের দেখার আগ্রহ বল্লভাচার্যের পরিবারে কম ছিল না। বয়স্ক পুরষেরা যখন কুবের, শুভাই-এর সঙ্গে আলাপ জমাতে শুরু করেছে, রূপবান বরকে দেখার জন্যে মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছিল। কারো পা কাঁপছিল। পাল্কি থেকে তাকে হাত ধরে তুলতে গিয়ে পাশের বাড়ির এয়োস্ত্রীর অসাড় হল শরীর। গোরার দু’পায়ে জল ঢেলে তার পা ধুতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার আগে নিজেকে সামলে নিল এক তরুণী। লক্ষ্মীর রূপবান বর দেখে হিংসুটে এক তরুণী পাশের শশিকে বলল, বাইরে থেকে দেখতে যত সুন্দর হোক, গোরা মোটেই ভাল মানুষ নয়। জাতপাতের বালাই নেই। ম্লেচ্ছদের সঙ্গে ওঠাবসা, তাদের হাতের জল পর্যন্ত খায়। আর কী করে, কে জানে।

গোরাকে ঘিরে মেয়েদের বেপথুভাব কুবের উপভোগ করছিল। ঠোঁট টিপে হাসছিল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *