গোরা – ২০

২০

নবদ্বীপ ছেড়ে ঈশ্বরপুরী দ্বারকা রওনা হওয়ার কয়েকদিন পরে বিশ্বরূপকে খুঁজতে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করল গোরা, ধীরেসুস্থে যে প্রস্তুতি শুরু করেছিল, ঈশ্বরপুরীর হুঁশিয়ারিতে তা কিছুটা গোপনে তড়িঘড়ি শেষ করতে চাইল। সবচেয়ে আগে বসতবাড়ি মেরামতে হাত দিল। জগন্নাথ মিশ্রের মৃত্যুর পর থেকে বিধবা মায়ের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ সংসারে যে হাল হয়েছিল, তখন বাড়ি সারানোর চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। সংসারে দুর্দশা এখন কিছুটা কেটেছে। মুকুন্দসঞ্জয়ের বাড়ির সদর চালা থেকে বুদ্ধিমন্ত খানের বাড়ির চকমেলানো বিশাল বারদেউড়িতে চতুষ্পাঠী স্থানান্তর করেও ছাত্রের ভিড় সামলানো যাচ্ছে না। নিমাই পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে পাঠেছু নবাগত অনেক ছাত্রকে ফিরিয়ে দিতে গোরা বাধ্য হচ্ছে। নিমাই পণ্ডিতের অধ্যাপনার সুখ্যাতি নবদ্বীপের বাইরে গৌড়, মিথিলা, এমনকি রাজগৃহ, কলিঙ্গ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। গোরা টের পাচ্ছিল, নিজের পেশায় তার পাকা আসন গড়ে উঠছে। রাস্তাঘাটে তাকে দেখলে, ব্রাহ্মণপাড়ার বয়স্করাও তাকে আগে যেতে দেওয়ার জন্যে পথ ছেড়ে সবিনয়ে সরে দাঁড়াত। চেনাজানা অভিভাবক প্রতিমদের গোরা দু’হাত জুড়ে নমস্কার করত, ছোটদের দিকে দুষ্টু হাসি নিক্ষেপ করে হনহন করে চতুষ্পাঠী অথবা স্নানঘাটের দিকে গম্ভীর মুখে চলে যেত।

শচীর সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য দেখে, আপাতত সেখানে অভাব অনটন নেই, আত্মীয়-প্রতিবেশী টের পাচ্ছিল। বাবার পিণ্ড দিতে গয়ায় যাওয়ার আগে বাড়ি মেরামতের কাজ সেরে নিতে চাইছিল গোরা। পনেরো বছর আগে, সে যখন ছ’বছরের বালক, বড় ছেলে বিশ্বরূপের বিয়ে পাকা করে খড়ের চারচালা বাড়ির পুরনো দেওয়ালে নতুন করে মাটি লাগিয়ে, চালের খড় পাল্টে সাধ্যমতো ভদ্রাসনের হাল বদলে নিয়েছিল জগন্নাথ মিশ্র। সংসারে বিশ্বরূপকে থিতু করতে তার সব উদ্যম তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লেও কিছুকালের মতো বাড়িটা বাসযোগ্য হয়েছিল। বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে তারপর আর হাত পড়েনি। নববধূ বিষ্ণুপ্রিয়াকে সংসারে আনার দু’ বছর পরে, বাড়ি মেরামতির সুযোগ পেল গোরা। মেরামতির কাজ তদারক করতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এল তার একনিষ্ট সহচর, গদাধর। গৃহভৃত্য ঈশান থাকল গদাধরের পাশে, ফাইফরমাশ খাটতে। নতুন খড়, বেলে মাটি, যথেষ্ট পরিমাণ জোগাড় করে জোলাপাড়া থেকে ছাউনি বানানোর পাকা কারিগর চণ্ডীকে ঈশান ধরে আনল। চণ্ডীর সঙ্গে মেরামতির কাজে সে-ও হাত লাগাল। চতুষ্পাঠী থেকে তখনই এক দুপুরে বাড়িতে খেতে এসে, গদাধরকে ছুটি দিয়ে, ঈশানকে স্নানে পাঠিয়ে চণ্ডীর কাজ দেখছিল গোরা। তার ঘরের চাল তৈরির আগে পুরনো বাঁখারির বাতা খুলে মাটিতে ফেলছিল চণ্ডী। গোরার মাথার ওপর পচা খড়ের চাল ভেঙে পড়ার আশঙ্কায়, তাকে বারবার দরজার বাইরে গিয়ে চণ্ডী দাঁড়াতে বলছিল। দরজার কাছে গিয়ে গোরা দাঁড়ালেও ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। বাতাসে পচা খড়ের গন্ধ। চালাহীন ঘরের মেঝেতে দুপুরের রোদ নেমে এসেছে। অভাবনীয় এক কাণ্ড ঘটল তখন। ছাউনির বাতা সরিয়ে তালপাতায় লেখা জীর্ণ একটা পুঁথি বার করে গোরাকে চণ্ডী বলল, ধরেন মামা। আপনার বাবামশাই বোধহয় এটা রেখে গেছেন।

পুঁথি হাতে নিয়ে গোরার শরীরে এমন কাঁপুনি ধরল যে তার মনে হল, পুরনো বায়ুরোগ বোধহয় ফিরে এসেছে। ঠকঠক করে কাঁপছিল সে। ঘরের চালা থেকে ঝুরঝুরে, কালচে খড়, বাতা সরিয়ে নতুন বাতায় খড় লাগাতে চণ্ডী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মন দিয়ে কাজ করছে। গোরার দিকে তাকানোর সময় তার নেই। পুঁথি হাতে নিয়ে গোরা বুঝে গেল, এ সেই পুঁথি, যা তার পড়ার জন্যে বিশ্বরূপ লিখেছিল। সে তখন দুধের শিশু। শচীর তোরঙ্গ থেকে দশ, বারো বছর বয়সে বিশ্বরূপের লেখা পুঁথি সাত বছর পরে আচমকা জগন্নাথ মিশ্রের হাতে এসে যেতে পুঁথিটা সে পড়ে ফেলেছিল। পুঁথি পড়ে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছিল। গোরা তখন ছ’বছরের বালক, বিশ্বরূপের বয়স ষোলো। মায়ের মুখ থেকে গোরা শুনেছে, তাড়াতাড়ি বিশ্বরূপের বিয়ে পাকা করে, সেই পুঁথি জগন্নাথ পুড়িয়ে ফেলেছিল। প্রচুর পরিশ্রমে নিজের লেখা পুঁথির ছাই হয়ে যাওয়ার খবর শুনে আড়ালে কেঁদেছিল বিশ্বরূপ, অনেক জল ঝরিয়ে ছিল চোখ থেকে। সাত বছর ধরে পুঁথিটা লুকিয়ে রেখে শেষরক্ষা করতে না পেরে হতাশায় ভেঙে পড়েছিল। তার মধ্যে বিয়ের আয়োজনও চলতে দেখে সংসারে বিবাগী হয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল চিরকালের মতো।

পুঁথি পোড়ানোর এই কাহিনী, পনেরো বছর ধরে পরিবারের মধ্যে চালু থাকার পরে, সকলে যখন ভুলতে বসেছে, তখন সেটা ঘরের চালার বাতা থেকে বেরিয়ে পড়তে গোরার মনে তোলপাড় শুরু হল। কী আছে এই পুঁথিতে? শুধু তাকে পড়ানোর জন্যে যে পুঁথি লিখে মায়ের বাতিল জিনিসপত্রের তোরঙ্গে বিশ্বরূপ লুকিয়ে রেখেছিল, সেটা ঘটনাচক্রে জগন্নাথ হাতে পেয়ে, পড়ে কেন ক্ষিপ্ত হয়ে গেল? পুঁথিটা কেন পুড়িয়ে ফেলল? পুঁথির পর পুঁথি সাজিয়ে যে পবিত্র ব্রাহ্মণ্যধর্ম গড়ে উঠেছে, তারই প্রতীক বড় ছেলের লেখা তালপাতার পুঁথি জগন্নাথ মিশ্রের মতো সাত্ত্বিক বিপ্রের পক্ষে পোড়ানো সম্ভব হয়নি। ঘরের চালের পাতায় পুঁথি লুকিয়ে রেখে শচীকে শুনিয়েছিল, পুঁথি পোড়ানোর গল্প।

বিশ্বরূপের খোঁজে, কয়েকদিনের মধ্যে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার আগে তার লেখা পুঁথি পেয়ে গোরার হাত পায়ের সন্ধিতে এমন খিল ধরে গেল, যে সে নড়তে পারল না। খেতে বসার আগে নিরাপদ জায়গায় পুঁথি রাখার চিন্তা মাথায় নিয়ে পাথরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল। তাকে খেতে বসার তাগাদা দিতে ঘরের মধ্যে যে কোনও মুহূর্তে শচী এসে যেতে পারে, বিষ্ণুপ্রিয়ার ডাকতে আসা অসম্ভব নয়, গদাধরও নাকে মুখে চাট্টি ভাত গুঁজে তদারকির কাজে ফিরে আসতে পারে, তাদের কেউ ঘরে ঢুকে জীর্ণ একটা পুঁথি হাতে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে, নানা কৈফিয়ৎ দিতে হবে জেনেও গোরার স্থবিরতা ঘুচল না। তার সারা শরীর ভারি হয়ে আসছে, জল আসছে দু’চোখে। পুঁথির পাতা উল্টে তখনি পড়ার ইচ্ছে জাগলেও সে সংযত করল নিজেকে। যে পুঁথি পড়ে বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছিল, গৃহত্যাগী হয়েছিল বিশ্বরূপ, বহুবার সে বিবরণ মা, দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তীর মুখে শুনে গোরা অনুমান করেছিল, পুঁথিটা নিরীহ নয়। তখনই মাঝদুপুরে, নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে পুঁথি খোলার অদম্য ইচ্ছে সে চেপে রাখল। মা, স্ত্রীকে অপেক্ষায় রেখে তেমন ঝুঁকি নেওয়ার মতো সময় তার ছিল না।

ঈশ্বরপুরীর উপদেশে, দাদার খোঁজে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার এটাই শুভসময় জেনে, শচীর সঙ্গে আড়ালে আলোচনা করে ভ্রমণের আয়োজন করতে শুরু করে দিয়েছিল গোরা। বিষ্ণুপ্রিয়া ভয় পেয়ে যেতে পারে ভেবে তাকে কিছু জানায়নি। তার জন্মের প্রায় একশো বছর আগে প্রয়াত, রাজা গণেশ; সম্ভবত যার আর এক নাম, রাজা দনুজমর্দনদেব, আবার রাজা কাশীশ্বর বা কাস্ হওয়াও অসম্ভব নয়, মহাশক্তিধর সেই রাজপরিবারের উত্তরপুরুষের খোঁজে সুলতান হোসেন শাহের সিন্ধুকীরা ঝাঁক বেঁধে গৌড়বঙ্গ, বিশেষ করে নবদ্বীপে তল্লাশিতে নেমেছে, মা, বউকে এ খবর গোরা শোনায়নি। তারা ভয় পাবে। পা ছড়িয়ে মা হয়তো কাঁদতে বসবে। শাশুড়িকে কাঁদতে দেখে বিষ্ণুপ্রিয়ার দু’চোখ শুকনো থাকবে না। আরও অঝোরে কান্না শুরু হবে তার। বাড়িতে খামোকা ভয়ের পরিবেশ গোরা তৈরি করতে চায় না। শ্বশুরবাড়িতে গেল কয়েক বছরে বিষ্ণুপ্রিয়া ষোড়শী হয়ে উঠলেও যতটা নিবিড়ভাবে স্বামীকে এক নববধূ কাছে পেতে চায়, বিষ্ণুপ্রিয়া টের পাচ্ছিল, তা ঘটছে না। কোথাও একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছে। তার মা হওয়ার ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে যাওয়ায় বিয়ের তিন বছর পরেও তাকে নববধূ সেজে থাকতে হচ্ছে। বিয়ের রাতে ঘরের চৌকাঠে হোঁচট খাওয়ার দরুন, তার দাম্পত্যজীবনে অমঙ্গলের ছায়া পড়ছে ভেবে, মাঝে মাঝে সে ভয় পায়, বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদে। গোরা জানতে পারে না। তাকে জানতে দেয় না বিষ্ণুপ্রিয়া। দেবতার মতো সহৃদয়, সর্বদা সতেজ, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি স্বামীর কাছ থেকে কখনও আঘাত পায়নি সে। স্ত্রীকে এক মুহূর্ত অবহেলা করেনি গোরা। তবুও বিষ্ণুপ্রিয়া মনের মধ্যে কেন এত শূন্যতা অনুভব করে, সে না জানলেও গোরা টের পায়। তার মনের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্যে দরদ থাকলেও তা গভীরে নেমে শেকড় গজায়নি। বাবা বেঁচে থাকতেও মা ছাড়া সংসারে, নবদ্বীপের বিপ্রসমাজের কাউকে তার আপনজন মনে হয়নি। যার সঙ্গে তীব্র নাড়ির যোগ অনুভব করত, তার ছ’বছর বয়সে সেই অগ্রজ, বিশ্বরূপ সংসার ছেড়ে চলে গেছে।

গোরার জন্মের আগে থেকে শচী জেনে গিয়েছিল, সংসারে মা ছাড়া ছোট ছেলেটার কেউ নেই। স্বর্গ থেকে খসে পড়া এই ছেলেকে নিজের সন্তান ভাবতে জগন্নাথ মিশ্রও ভয় পেত। গোরাকে দেখলে কেমন আড়ষ্ট হয়ে যেত। ভাবত, এই ছেলে কি আমার? শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাকপাড়ায় অবসর সময়ে গোরা কেন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, তা-ও শচী অনুমান করতে পারে। জগন্নাথও পারত। মনের মতো মানুষ খুঁজে বেড়ায় গোরা। অচ্ছুৎসমাজে তেমন মানুষ পেলে তাকে বন্ধু মনে করে, পরমাত্মীয়ের মতো নিজের বুকে টেনে নেয়। গোরা জানে, ঘরে কচি বউ থাকলেও সংসারে সে ছাড়া মাকে দেখার কেউ নেই সুলতানি সিন্ধুকীদের নজরদারিতে ছেলে বিপন্ন হতে পারে, শুনলে মা যে ভয়ে বেহুঁশ হয়ে যাবে, গোরার অজানা নয়। স্বামীর বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলে, তার দাক্ষিণাত্য যাওয়া ঠেকাতে বিষ্ণুপ্রিয়া কেঁদে আকুল হবে। বাড়ি ছেড়ে গোরা তখন নড়তে পারবে না। চার বছর আগে, সে শ্রীহট্টে যাওয়ার সময়ে সংসারে বিলাপের যে ঝড় উঠেছিল, তা এখনও তার মনে আছে। সেবারেও শ্রীহট্টে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য লক্ষ্মীকে খোলসা করে সে জানায়নি। লক্ষ্মী শুনেছিল, পৈতৃক সম্পত্তি, টাকা-কড়ি উদ্ধার করতে স্বামী শ্রীহট্টে যাচ্ছে। বিত্তবান হয়ে রাজার মতো ঘরে ফিরবে সে। সব শুনেও শোকে সবচেয়ে বেশি যে ভেঙে পড়েছিল, সেই লক্ষ্মী আজ পৃথিবীতে নেই। লক্ষ্মীকে এ জীবনে সে ভুলতে পারবে না। অগ্নিশিখার মতো তার সেই কিশোরী বউ, স্বামীর অদর্শনে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। আগের ভুল, দ্বিতীয়বার করতে সে রাজি নয়।

দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার পথে গয়ায় প্রথা মেনে বাবার পিণ্ডদান পর্ব গোরাকে সেরে নিতে শচী অনুরোধ করেছিল। গোরা এক কথায় রাজি হয়ে যেতে প্রয়াত স্ত্রী, লক্ষ্মীর পিণ্ডদানের অনুষ্ঠান ফেলে না রেখে, চুকিয়ে নিতে বলল শচী। মায়ের পরামর্শ গোরা মেনে নিল। বিশ্বরূপের লেখা পুঁথি পেয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার চিন্তা তালগোল পাকিয়ে গেলেও ঘরের কুলুঙ্গিতে নানা পুঁথির ভিড়ে সদ্য পাওয়া পুঁথিটা নিশ্চিন্তে রেখে দিল। ঘর থেকে পুঁথি হারানোর ভয় নেই। তার পুঁথিতে হাত দেওয়ার সাহস যেমন সংসারে কারও নেই, তেমনি শচী, বিষ্ণুপ্রিয়া কারও পুঁথি পড়ার মতো বিদ্যে নেই। লেখাপড়ায়, বিশেষ করে সংস্কৃত শাস্ত্র পাঠে মেয়েদের অধিকার নেই। অশুচি শূদ্র আর মেয়েদের শাস্ত্র পাঠে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের দেবনাগরি বর্ণমালা পর্যন্ত চেনানো হয় না। নিমাই পণ্ডিতের ঘরের কুলুঙ্গিতে তার সংগ্রহ করা পুঁথির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে রোজই কিছু পুঁথির যাতায়াত চলে। পুঁথি লেনদেনের কাজ, সে নিজের হাতে সামলায়। পুঁথির কুলুঙ্গিতে শচী, বিষ্ণুপ্রিয়ার হাত দেওয়ার দরকার পড়ে না। দেবনাগরিতে লেখা পুঁথি নাড়াচাড়াতে তাদের উৎসাহ নেই, শিক্ষাও নেই।

কুলুঙ্গিতে পুঁথি রেখে গোরা যখন খেতে বসল, উত্তেজনায় তখন সে ফুটলেও শান্ত রাখল নিজেকে। উত্তেজনার কোনও ছাপ পড়ল না তার মুখে। পুঁথিটা গয়ায় পৌঁছে, পিণ্ডদানের আগে রাতে ধর্মশালায় বসে, রাত জেগে পড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মনের গভীরে উত্তেজনার সঙ্গে জেগে ওঠা অচেনা উদ্ভাস, ছড়িয়ে পড়ছিল তার মুখে। রোজ দুপুরে ভাত খাওয়ার পাতে তার প্রিয় পদ লাউ-এর পায়েস, এক বাটি হাপুস হুপুস করে খেয়ে, সেদিন দ্বিতীয়বার পায়েস নিল। স্বামীর পায়েস খাওয়া দেখে ঘোমটায় মুখ আড়াল করে ঠোঁট টিপে বিষ্ণুপ্রিয়া হাসছিল। ছেলেকে তৃতীয়বার পায়েস দেওয়ার জন্যে, তার ফরমাস শুনতে অধীর আগ্রহে শচী অপেক্ষা করছিল। লাউ-এর পায়েস না হলে ছোটবেলা থেকে গোরা যে ভাত খেতেই বসে না, শচীর চেয়ে ভালো করে কে জানবে? পায়েসের মতো ছেলের আরও এক প্রিয় হল শাকের ঘণ্ট। হেলেঞ্চা, কলমি, পালং, নটে, কুলেখাড়া, ব্রাহ্মী, থানকুনি, বেতো, ঢেঁকি, কুমড়ো, লাউ, ছয় ঋতুতে যখন যতরকম শাক পাওয়া যায়, হাট থেকে গোরা কিনে আনে। শ্রীধরের কাছ থেকে কেনে থোড়, মোচা, কাঁচাকলা, কুমড়ো, লাউ। ছেলে পেটুক না হলেও সে ভোজনরসিক, শচী জানে। ছেলেবেলা থেকে খেতে ভালবাসে। সকাল-সন্ধের জলখাবার দুধ, মুড়ি, চিঁড়ে, কলার মতো দু’বেলার ভাত ডাল তরকারি, পায়েস, সবই তার বেশি বেশি চাই। শরীরটা মাপে বড় হওয়ার জন্যে যে তার খাওয়ার পরিমাণ, পাঁচজন সমবয়সির চেয়ে বেশি, শচীর বুঝতে অসুবিধে হয় না। যা খায়, অল্প সময়ে হজম করে ফেলে। ঘনঘন তার খিদে পায়। মায়ের হেঁসেলে খাবার বাড়ন্ত, জানা থাকায়, খিদের চোটে দু’একদিন অন্তর নবশাক পাড়ায় কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আসে, শূদ্র, ম্লেচ্ছ পাড়াতে যাতায়াত করে। তাদের ঘরে মুড়ি, চিড়ে, দুধ, ক্ষীর, মণ্ডার সেবা নিতে সঙ্কোচ করে না। বাড়ি ফিরে মা, বউকে সবিস্তারে শোনায় ডোম, হাড়ি, বাগদিপাড়ায় আতিথ্য ভিক্ষার বিবরণ। অসংকোচ, মালিন্যহীন সেই বৃত্তান্ত শুনে দুই ব্রাহ্মণীর অজ্ঞান হওয়ার দশা হলেও মুখে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।

শচীর সংসারে এসে, তিন বছরে বিষ্ণুপ্রিয়াও জেনে গেছে কী ধরনের খাবার স্বামীর ভালো লাগে। খাদ্যতালিকা যাই হোক, কোনও খাবারে গোরা ‘না’ বলে না। যা পায়, পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে নেয়। তার থালায় ভাত, তলকারির পরিমাণ দেখে বিষ্ণুপ্রিয়া প্রথম দিকে আঁতকে উঠলেও এখন তা হয় না। বরং খুশি হয়। গড় মানুষের চেহারার তিনগুণ শরীর মানুষটা বেশি তো খাবেই! মুচকি হাসি ঠোঁটে লুকিয়ে স্বামীর খাওয়া দেখে সে। স্বামীকে নিয়ে কখনও পিত্রালয়ে গেলে, রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়ে স্বামীকে খাওয়ানোর এলাহি আয়োজন করে। শচীর সংসারের চেয়ে অনেক বেশি সচ্ছল তার মায়ের সংসার। কোনও অভাব নেই। গোরার পছন্দের ভাত ডাল সমেত বত্রিশ রকমের তেঁতো, পোড়া, সেদ্ধ, তরকারি, ডালনা, ভাজা, দুধ, ক্ষীর, দই, পিঠে, মণ্ডা, মিষ্টির তালিকার সঙ্গে সেগুলোর পরিমাণ, বিশদ করে মাকে জানাতে বিষ্ণুপ্রিয়া ভোলে না। শেষপাতে চাই লাউ-এর পায়েস, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উল্টে গেলেও তার ব্যত্যয় ঘটে না। জামাই খাওয়ানোর নিখুঁত কারিগরি রাজপণ্ডিত গৃহিণীর ভালো জানা আছে। গোরাকে সামনে বসিয়ে খাওয়াতে শাশুড়ি বিপুল আনন্দ পায়। জামাই-এর পাশে শ্বশুর, সনাতন পণ্ডিতও খেতে বসে। পণ্ডিত নিজে পাখির মতো আহার করলেও জামাইকে ভূরিভোজন করাতে ক্রমাগত ঘণ্ট, দম, ডালনা দেওয়ার ফরমাস করে যায়। মনে মনে ভাবে, এই নাহলে জামাই! অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে পারে। ঠোঁটে তখনও লেগে থাকে তৃপ্তির হাসি!

সময় না পেলেও বছরে দু’বার, নববর্ষের শুরু, বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে, আর শারদীয় দুর্গাপুজোর দশমীতে বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে মাল পাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে গোরা হাজির হলে সেখানে মহোৎসব লেগে যায়। সারা বছর সেই মিলনানুষ্ঠান নিয়ে শচীর সঙ্গে গল্পগুজব চলে। দ্বিতীয় দফায় পেতলের জামবাটি ভর্তি লাউ-এর পায়েস চেটেপুটে খেয়ে গোরা আসন ছেড়ে উঠে পড়ল। হাত-মুখ ধুয়ে সে ঘরে এসে বসতে তাকে পান-সুপুরি এনে দিল বিষ্ণুপ্রিয়া। শাশুড়িকে নিয়ে সে এখন স্বামীর থালায় খেতে বসবে। নতুন খড় বিছিয়ে পাশের ঘরে চালা বানানোর কাজ চণ্ডী শুরু করে দিয়েছে। বাতাসে ভাসছে পরিত্যক্ত পুরনো খড়ের ধুলো। নাওয়া-খাওয়া সেরে ঈশান খড় জোগান দিচ্ছে চণ্ডীকে। বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে যে কোনও মুহূর্তে গদাধর ফিরে আসতে পারে। গদাধর এসে গেলে গোরা ফের টোলে রওনা হবে। তার ভাগ্য ভালো, খড়ের চালের বাতা থেকে বিশ্বরূপের পুঁথিটা বের হওয়ার সময়ে গদাধর সেখানে ছিল না। ঈশানও গঞ্জে গিয়েছিল কেনাকাটা সারতে। পান চিবিয়ে কুলুঙ্গির মধ্যে হারানিধি পাওয়ার মতো রহস্যময় পুঁথির দিকে এক লহমা তাকিয়ে, গোরা হাঁক পেড়ে তার চতুষ্পাঠী যাওয়ার খবর মাকে জানিয়ে, অগ্রজপ্রতিম বন্ধু বুদ্ধিমন্ত খানের বাড়ির দিকে রওনা হল। মুকুন্দসঞ্জয়ের বাড়ির চাতাল থেকে বুদ্ধিমন্তের বাড়ির বারমহলে বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিয়ের আগে টোল সরিয়ে নিয়েছিল সে। ছাত্রে গমগম করছে টোল।

নবদ্বীপ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে গয়া রওনা হতে চায়। পুঁথিটা না পড়া পর্যন্ত রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারবে না, সে টের পাচ্ছে। গয়া পৌঁছোনোর পথে, মানে কোনও চটিতে অথবা গয়াতে হাজির হয়ে প্রথম রাতে ধর্মশালায় বসে পুঁথি পড়ে শেষ করতে চায়। দাদার লেখা নিখোঁজ পুঁথি হঠাৎ এভাবে তার হাতে এসে যাবে, গোরা কল্পনা করেনি। জীবনে কত আচমকা কাণ্ড-ই না ঘটে! পুঁথি একবার পড়তে শুরু করলে শেষ পাতা পর্যন্ত না পড়ে ওঠা যাবে না, সে জানে। আগুনে যে পুঁথি ছাই হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা আস্ত, অখণ্ড, গাছ থেকে পাকা ফল খসে পড়ার মতো হাতে এসে যাবে, সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তবে পুঁথিটা একাধিকবার স্বপ্নের মধ্যে নাড়াচাড়া করে মনে হয়েছিল, তার বিদ্যোৎসাহী, সদাবিপ্ৰ বাবা, জগন্নাথ মিশ্রে মতো মানুষ পুঁথি পোড়ানোর মতো অলক্ষুণে কাজ কখনও করতে পারে না। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, নানা শাস্ত্রের হাজার হাজার পুঁথির ঐতিহ্যের প্রবাহ থেকে একটা বেছে নিয়ে দাহ করার মতো নিচু মানের দ্রোহীপুরুষ জগন্নাথ ছিল না। বড় ছেলে, বিশ্বরূপ বলতে বাবা ছিল অজ্ঞান। তার হাতের আগুন পাওয়ার জন্যে অন্তর্জলি যাত্রার সময় থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুমূর্ষু মানুষটা লালায়িত ছিল। বাল্যস্মৃতির কিছু টুকরো গোরা ভোলেনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বালক বয়স পর্যন্ত মায়ের স্নেহের আঁচলে মোড়া ছিল তার জীবন। সংসার ছেড়ে সতেরো বছরের ছেলে বিশ্বরূপ নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে, কোলের ছেলেকে ঘিরে মায়ের স্নেহের বৃত্ত আরও নিশ্ছিদ্র হয়েছিল।

গয়া যাওয়ার জন্যে পাঁজি দেখে যে তিনটে শুভদিন গোরা বেছে রেখেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি তারিখটা, টোলে পৌঁছোনোর আগে গোরা পাকা করে ফেলল। সদ্য পাওয়া পুঁথিটা এখন তার ধ্যানজ্ঞান। পুঁথির চেহারা সে ভুলতে পারছে না। ছোটভাই-এর জন্যে উপদেশমূলক শ্লোকে পুঁথিটা বোঝাই নয়, গোরা জানে। পুঁথিতে রোমাঞ্চকর কিছু না থাকলেও সেটা নীতিশাস্ত্র নয়। পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বরূপের পুঁথি নিয়ে এত ঘটনা ঘটেছে, এত গল্প কানে এসেছে, যা একজন সহজ, সরল বালকের অ-জটিল পুঁথি ঘিরে হওয়ার কথা ছিল না। আগুনে পুড়ে যে পুঁথি চিরকালের মতো চোখের আড়ালে চলে গেছে ভেবে সে বিষণ্ণ হত, অদৃশ্য সেই গ্রন্থ হঠাৎ এসে বাড়িয়ে দিয়েছে পুঁথির মহিমা, তার কৌতূহল।

টোলে ছাত্র পড়ানোর মধ্যে গয়া ভ্রমণের ছক মনের মধ্যে গোরা সাজিয়ে নিচ্ছিল। গয়া পর্যন্ত তার সঙ্গী হতে মেসো চন্দ্রশেখর রাজি হয়েছে। পিণ্ডদান পর্ব চুকিয়ে গোরাকে দাক্ষিণাত্যের পথে রওনা করে চন্দ্রশেখর নবদ্বীপে ফিরে আসবে। গোরার দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার কথা কাকপক্ষীকে সে জানাবে না। শচী, চন্দ্রশেখর ছাড়া নবদ্বীপে তৃতীয় যে মানুষের কাছে এ খবর রাখা থাকবে, সে বেলপুকুরিয়ার নীলাম্বর চক্রবর্তী, গোরার নব্বই বছরের দাদামশাই। পিতৃপুরুষের পিণ্ড দিতে আরও কয়েকজন গোরার সঙ্গে গয়া যেতে চেয়েছে। তারাও যাবে। পিণ্ডদান সেরে তারা ফিরবে নবদ্বীপে। গদাধরকে সঙ্গী করার কথা গোরা ভেবে রেখেছে। সে বললে, গদাধরের বাবা মাধব পণ্ডিত আটকাবে না ছেলেকে। গয়া পর্যন্ত যেতে দিতে রাজি হলেও দাক্ষিণাত্য ঘুরে সুদূর পশ্চিমে পুরুষপুর, তক্ষশিলা পর্যন্ত দীর্ঘ পরিক্রমায় ছেলেকে মাধব পণ্ডিত ছাড়বে কি না, সন্দেহ আছে। আপাতত গয়া পর্যন্ত যাওয়ার ছাড়পত্র নিয়ে, পরের ভ্রমণপর্বের বিষয় পরে ভাববে।

জগন্নাথ মিশ্র আর লক্ষ্মীর পিণ্ডদান সেরে গয়ায় আরও আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটিয়ে সে দাক্ষিণাত্যে রওনা দেবে। বিশ্বরূপের খোঁজে প্রথমে বিজয়নগর রাজ্যে যাবে, সেখান থেকে গোলকুণ্ডা, বিজাপুর, আহমেদনগর, বিদর, বেরার প্রদেশ প্রদক্ষিণ করে, পথে যুদ্ধবিগ্রহ না থাকলে, তুঙ্গভদ্রা নদী পেরিয়ে বরঙ্গল, মাদুরাই নগরে যত মন্দির, নদীঘাট আছে সর্বত্র তন্নতন্ন করে বিশ্বরূপের খোঁজ করে, তাকে না পেলে উজ্জয়িনী ঘুরে পুরুষপুর হয়ে আরও পশ্চিমের দেশগুলোতে বিশ্বরূপকে খুঁজতে যাবে। আর্যাবর্ত চষে ফেলবে। সহজে হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। দরকার হলে ছ’মাস প্রবাসে কাটাবে। তারপর ঘরে না ফিরে উপায় নেই। ঘরে মা, বউ রয়েছে, সংসার অনাথ হয়ে যাবে তার অনুপস্থিতিতে। সবার ওপরে আছে তার চতুষ্পাঠী, কচিকাঁচা ছাত্রের দল, যাদের সে বন্ধুর মতো ভালবাসে। গুরুর ওপরে ছাত্রদেরও অন্ধের মতো অনুরাগ। ছাত্রদের পঠনপাঠন শিকেয় তুলে দিয়ে নবদ্বীপের বাইরে ছ’মাসের বেশি থাকলে, কাজটা অভিভাবকদের কাছে নীতিহীন মনে হতে পারে। ছাত্রদের কথা ভেবে বিকল্প এক ব্যবস্থা সে অবশ্য করেছে। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে নিজের টোলের ছাত্রদের লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। বছর কয়েক আগে শ্রীহট্ট থেকে ফিরে মাতৃদায় উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত গঙ্গাদাসের টোলের ছাত্রদের সে-ও নিজের চতুষ্পাঠীতে ডেকে নিয়েছিল। তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল। গঙ্গাদাস তার গুরু, সে গঙ্গাদাসের প্রিয় ছাত্রদের একজন, নবদ্বীপে এখন গুরুর চেয়ে সে বেশি সমীহ পায়। তাকে দেখলে গঙ্গাদাস শশব্যস্ত হয়ে পড়লেও গুরু-শিষ্যের পুরনো, মধুর সম্পর্ক গোরা আজও ধরে রেখেছে। গুরুর মধ্যে মা জননীও যে অবস্থান করে, পাণ্ডিত্যাভিমানে সে সত্য গোরা ভোলেনি।

বিশ্বরূপকে খুঁজতে যাওয়ার সূত্রে, ঈশ্বরপুরীর পরামর্শে গয়ায় বাবার পিণ্ড দেওয়ার কর্তব্য সেরে ফেলার সুযোগ হয়ে যেতে মনের গভীরে সে স্বস্তি পেয়েছিল। জন্মদাতা বাবার জীবদ্দশায় তার জন্যে কিছু করতে না পারলেও প্রয়াত মানুষটার আত্মার কল্যাণ কামনায় তার পিণ্ডের আয়োজন করতে গয়া যাওয়াও কম কথা নয়। প্রিয়তমা লক্ষ্মীর নামেও সেখানে পিণ্ড উৎসর্গ করবে। লক্ষ্মীকে মনে পড়লে ঘন কুয়াশার মতো শোক, তার বুকের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। কাউকে সে কথা বলতে না পারলেও সতত অনুভব করে, মৃত স্ত্রী লক্ষ্মীকে জীবন্ত বিষ্ণুপ্রিয়ার চেয়ে বেশি ভালবাসে। বিষ্ণুপ্রিয়াকে বধূ করে তার সংসারে আনা ঠিক হয়নি। বিষ্ণুপ্রিয়াকে সে ঠকিয়েছে, এখনও ঠকিয়ে চলেছে। বিয়ের আগে মা, আত্মীয়-বন্ধুদের চাপে না বুঝে যে শঠতা করেছিল, বিয়ের পরে, সব জেনে-বুঝে তিন বছর ধরে বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে সেই কপটতা চালিয়ে যাচ্ছে, ব্রাহ্মণের ঘরে সে কুলাঙ্গার, লম্পট, আড়ালে তাকে যারা ‘নটবর’ বলে ব্যঙ্গ করে, তারা ভুল করে না। সে প্রকৃতই পাকা নটবর! বিষ্ণুপ্রিয়া কি কিছু বোঝে না? নিশ্চয় বোঝে, আঁচ করতে পারে। রাতে বিছানার ধার ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে, তারপর বিছানার কিনারা ঘেঁষে শুয়ে অসহায়ের মতো ঘুমোতে দেখে গোরা বুঝতে পারে, দোজবরে স্বামী পেয়ে আপাতবিচারে বিষ্ণুপ্রিয়া সুখী হলেও তার মনের মধ্যে কোথাও খটকা জেগেছে। অন্ধকার ঘরে, বিষ্ণুপ্রিয়ার পাশে রাতে বিছানায় শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে লক্ষ্মীর নাম ধরে সে ডাকাডাকি না করলেও মনে হয়, তার বুকে মুখ গুঁজে, আর ভেতরে, বুকের অন্তঃপুরে ভালবাসার রত্নহার লক্ষ্মী খুঁজে চলেছে। ঘুমের মধ্যে এই অনুভূতি তীব্র হয়ে উঠলে সে চমকে ওঠে। তার ঘুম ভেঙে যায়। অনেকক্ষণ জেগে কাটে। ভোরের আলো ফুটলে দেখতে পায়, বিষ্ণুপ্রিয়া জেগে উঠে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এমন ঘটনা কয়েকবার ঘটলেও স্বামীর অনিদ্রার হেতু বিষ্ণুপ্রিয়া কখনও জানতে চায়নি। গোরাও বলতে পারেনি, স্বামীপ্রেমবিহবলা লক্ষ্মী এখনও স্বামীর মায়া কাটাতে পারেনি, স্বামীর বুকের মধ্যে মাথা কুটে বেড়াচ্ছে। তার অশনবসন, শয়ন-স্বপনে ছায়ার মতো লক্ষ্মী মিশে রয়েছে। তার হাতের পিণ্ড পেলে লক্ষ্মী হয়তো এবার পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্বর্গলোকে জায়গা করে নেবে। বিষ্ণুপ্রিয়াকে তখন সে ভালবাসতে পারবে, স্পর্শ করতে পারবে। বিয়ের তিন বছর পরে প্রথম বিবাহিত জীবনের স্বাদ পাবে বিষ্ণুপ্রিয়া।

হস্তলিপি অনুশীলনে ব্যস্ত টোলের পড়ুয়াদের মধ্যে বসে গোরার মনে প্রশ্ন জাগল, স্বর্গ কোথাও আছে কি? পৃথিবী থেকে তা কত দূরে? লক্ষ্মী এখন কোথায়? প্রেতলোকে যদি সে আশ্রয় পেয়ে থাকে, তাহলে সেই প্রেতলোকের ঠিকানা কী? লক্ষ্মীকে নিবেদিত তার পিণ্ড কি ঠিক জায়গায় লক্ষ্মীর হাতে পৌঁছোবে? জন্ম, মৃত্যু, জন্মান্তর নিয়ে সবিশেষ শাস্ত্রীয় জ্ঞান তার নেই। বিষয়টা নিয়ে লক্ষ্মীর মৃত্যুর আগে কখনও ভাবেনি। লক্ষ্মীর মৃত্যুতে মনে বড়রকম ধাক্কা খাওয়ার পরে, মৃত্যুর স্বরূপ নিয়ে মাথায় চিন্তা এলেও পরলোকতত্ত্ব আর জন্মান্তর সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সুযোগ ঘটেনি। শাস্ত্রীয় জ্ঞানও তার নেই। এক জন্মের ভালবাসা পরের জন্মে সঞ্চারিত হয় কি না, না জানলেও প্রতি জন্মে ভালবাসাই যে জীবনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, লক্ষ্মী পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে এই গভীর সত্য সে উপলব্ধি করেছে। পতিব্রতা তরুণী বিষ্ণুপ্রিয়া, তার ভার্যা হলেও তার মনের আকাশে লক্ষ্মী এখনও দেদীপ্যমান পূর্ণিমার চাঁদ, পাটরানী। তার মনের গোপন খবর মা কিছুটা টের পেলেও বিষ্ণুপ্রিয়া জানে না। জানবে কী করে? স্ত্রীকে সে-ই বা কেন জানতে দেবে? বিষ্ণুপ্রিয়া তার ধর্মপত্নী, অভিন্নহৃদয় হলেও প্রত্যেক মানুষের এমন কিছু গোপন কথা থাকে, যা সে বলতে পারে না। স্ত্রীর কাছেও লুকিয়ে রাখতে হয়। মৃত সহধর্মিণীর জন্যে বিহ্বলতা জীবিত স্ত্রীর কাছে প্রকাশ করা বিচক্ষণতা নয়, সেটা অধর্ম। স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার বিষ্ণুপ্রিয়ার মন। ভোর রাতে স্বামীকে বিনিদ্র, জেগে থাকতে দেখলেও তার মনে এক কণা ধুলো জমে না। স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হলেও নিজেকে ধন্য মনে করে সে। লক্ষ্মীকে নিয়ে প্রশ্ন করে গোরাকে কখনও বিব্রত করেনি। বিষ্ণুপ্রিয়ার সামনে, বিয়ের পর থেকে গেল তিন বছরে লক্ষ্মীর নাম গোরা কখনও উচ্চারণ না করলেও লোকান্তরিত বধূর জন্যে তার মনের মধ্যে কান্না জমে রয়েছে, তাকে দেখে বোঝা যায় না। বলার মতো কথা এটা নয়। মুখ বুজে অনিত্য সংসারের নিয়ম সে মেনে নিয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়াকে সে কম ভালবাসে না। তাকে বধূ করে ঘরে এনে সে সুখী, পরিতৃপ্ত। বিষ্ণুপ্রিয়ার মধ্যে ভবিষ্যৎ সংসারের মর্যাদামণ্ডিত, জরাযৌবনহীন সব ঋতু আর সব কালের গৃহিণীকে সে দেখতে পায়। জগজ্জননীর কাছে মনে মনে প্রার্থনা করে, হে জগন্মাতা, আমার অপরাধ নিও না, প্রসন্ন হও।

জগন্মাতার কাছে প্রার্থনার পরেও সে টের পায় তার আর বিষ্ণুপ্রিয়ার মাঝখানে কয়েক শ‍ যোজন দূরত্ব তৈরি করে লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে এ জীবনে সে ঘেঁষতে পারবে না। তার বুকের মধ্যে কান্না ছলছল করে। গভীর এক বিরহ সে অনুভব করে। বিরহের সেই পাথারে লক্ষ্মী ছাড়া কাউকে দেখতে পায় না। বিষ্ণুপ্রিয়া ঘরে থাকলেও বিরহের সাগরে সে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *