গোরা – ১৭

১৭

পৃথিবীতে লক্ষ্মী নেই, মায়ের মুখে এ খবর শুনে গোরা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে থেকে তার শরীর পাথরের মতো নিস্পন্দ দেখালেও তুমুল কান্নায় ভিজে যাচ্ছিল তার অন্তর্জগৎ। লক্ষ্মীকে এত গভীরভাবে সে ভালোবাসত, স্বামী-স্ত্রীর আলাদা অস্তিত্ব, দুই নদীর স্রোতের মতো মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, আগে সে এমন করে বুঝতে পারেনি। গৃহাঙ্গনের সব জায়গায় আলোর মতো ছড়িয়ে থেকে, কোথায় সে আছে, আগে যেমন বুঝতে দিত না, এখন তা উল্টো হয়ে গেছে। কোথাও না থেকে বাস্তুর মাটি, জল, আলো, হাওয়া, সব জায়গায় সে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজেকে। পায়ের নিচে অশেষ মাটি, মাথার ওপর দিগন্তে লীন আকাশের আলিঙ্গন, চরাচর ব্যাপ্ত ঝিনুকের মতো সেই আধারে, শ্রীহট্টে যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিজেদের তারা ভাবত অনন্তকালের যাত্রী। লক্ষ্মী এত গুছিয়ে না ভাবলেও গোরা ভাবত। লক্ষ্মীর মৃত্যুসংবাদে কাচের ঘরের মতো গোরার সেই স্বপ্নাতুর ভূমণ্ডল ভেঙে পড়ল, জীবন এত অনিত্য, ভালোবাসার বাঁধন এত অচিরস্থায়ী, ভঙ্গুর, টের পেয়ে গোরা বরফ হয়ে গেল। বল্লভাচার্যের মেয়ে, লক্ষ্মীকে গঙ্গার স্নানঘাট থেকে প্রায় জোর করে মায়ের সংসারে সে তুলে এনেছিল। ‘জোর’ মানে গায়ের জোর নয়, টান-ভালোবাসার জোর। কিশোরী এক বালিকাকে ভালোবাসায় জড়াতে এক সুদর্শন তরুণ পুরুষের অদৃশ্য কত যে অস্ত্র থাকে, তার হিসেব নেই। গোরারও কম অস্ত্র ছিল না। তার চোখে, চাহনিতে, ঠোঁটের হাসি, ইঙ্গিতে, ভঙ্গিতে জড়ো হয়ে থাকা সেই অস্ত্রসম্ভারের সুমধুর স্পর্শ লক্ষ্মী পেয়েছিল। সে পেয়েছিল দু’চোখ জুড়ে লুকানো কৌতূহল থেকে। কোনও তরুণ সম্পর্কে একজন কিশোরীর মনের গভীরে মৃদু ঢেউ জাগলে, তবেই সে দ্বিতীয়বার পুরুষটির দিকে তাকায়। দ্বিতীয়বার দেখে তার আশ মেটে না। সে তৃতীয়বার, চতুর্থবার, বারবার তাকায়, তার নেশা ধরে যায়। তার চোখ, মুখ, শরীরের নানা বাঁকে এসে ভিড় করে নিজের সংগৃহীত হাস্য, লাস্য, ধারালো কটাক্ষ, রসের ঢেউ। বালিকার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে প্রেমিকা।

স্মৃতির জলে ভাসতে থাকা সেই অপরূপ মুহূর্তগুলো মনে পড়তে গোরার দশ দিক, অন্তরীক্ষ জুড়ে শোকের তুমুল বর্ষণ নেমে এল। গোরা নিঃশব্দে শুধু ভেবে যেতে থাকল সংসারের অনিত্যতা, পদ্মপাতায় জলের বিন্দুর মতো তাৎক্ষণিক এই জীবন, এখন আছে, পরের মুহূর্তে থাকবে কিনা, কেউ জানে না। সবুজ পাতার ওপর জলের ফোঁটার মতো টলমল করছে যে জীবন, সেখান থেকে চোখের নিমেষে লক্ষ্মী মিলিয়ে গেল। গোরা এখন একা। মা থাকলেও বুকের মধ্যে যে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে, তা শোনার কেউ নেই। লক্ষ্মীকে হারানোর শোক হাজারবার কেঁদেও সে ভুলতে পারবে না। পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়ে লক্ষ্মী যে শিক্ষা তাকে দিয়ে গেল, তা কান্নার চেয়ে সমধিক গুরুভার। সংসারে কেউ চিরকালের জন্যে আসে না। পরিবারের সবচেয়ে আপনজন, প্রেমের মানুষকে ভালোবাসার ভূমি ছেড়ে একদিন চলে যেতে হয়। গর্ভধারিণী মা আর তার সন্তান, যজ্ঞাগ্নি সাক্ষী করে নির্মিত স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবন, কালের চক্রে পৃথক হয়ে যায়। সময় বড় বলবান, কাউকে রেয়াত করে না।

গোরা অনুভব করল, লক্ষ্মীর মৃত্যুতে তার মনের গভীরে সুদূর প্রজ্ঞার আলো জ্বলে উঠেছে। তাকে জ্ঞানবান করে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে লক্ষ্মী। জ্ঞানের এই আলোতে যা নিত্য, চিরন্তন, তাকে খুঁজে বার করতে হবে। প্রেম-ই নিত্য, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি সবচেয়ে বড় শক্তি, এমন এক সত্যের আভাস পেল সে। লক্ষ্মীর মৃতুকে আত্মসাৎ করে নিতে পেরে গোরার মন শান্ত হল, স্বচ্ছ হল তার চেতনা। মুকুন্দসঞ্জয়ের বাড়িতে নিজের টোলে ছাত্র পড়ানোতে আরও বেশি অভিনিবেশ দিল সে। অল্পদিন পরে, ছাত্রের ভিড়ে মুকুন্দসঞ্জয়ের দরদালানে স্থানাভাব ঘটতে থাকায়, স্থানীয় বন্ধু, পারিবারিকভাবে জগন্নাথ মিশ্রের যজমান, জমিদার বুদ্ধিমন্ত খানের বাড়িতে চকমেলানো দেউড়িতে গোরা চতুষ্পাঠী তুলে আনল। পদ্মাপারে বাঙলার শ্রীহট্ট আর সংলগ্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন টোলের কিছু পণ্ডিতের হাতে নিজের রচিত ব্যাকরণের যে গুটিকয় পাণ্ডুলিপি গোরা তুলে দিয়ে এসেছিল, ছাত্রদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিত, ঘরের মানুষ যাকে গোরা নামে চেনে, ছাত্ররাও চিনতে শুরু করেছিল তাকে। নবদ্বীপে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তাদের শ্রীহট্টবাসী পরিবারের লোকজন, অনেকে পণ্ডিত আর ছাত্র, দেখা করতে এসে, কিছুদিন থেকে গেলে, অনেক সময় কথায় কথায় নিমাই পণ্ডিতের ব্যাকরণ পুঁথির প্রসঙ্গ উঠত। গোরার পুঁথির প্রশংসা করত সকলে। প্রশংসার কথা গোরার কানে যেত, শচী শুনত সাগ্রহে। গর্বে শচীর বুক ফুলে উঠলেও গোরার ভাবান্তর হত না। লক্ষ্মীর জন্যে শোককাতরতা গোরা কাটিয়ে উঠলেও সেই দিনগুলোতে মায়ের ভারি ন্যাওটা হয়ে থাকল গোরা। টোলে অধ্যাপনার কাজ সেরে মায়ের সঙ্গে ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকত। তার মুখ থেকে শ্রীহট্ট ভ্রমণের বৃত্তান্ত, খুঁটিনাটিসহ শুনতে শচী যেমন তাকে খোঁচাত, তেমনি মায়ের কাছে তপন মিশ্রের পরিবার, চারপাশের মানুষজন, মেঘনা, সূর্মা, ব্রহ্মপুত্র নদীর বিবরণ বলতে শুরু করে গোরা টের পেয়ে গেল, কাহিনীর কোন অংশ শুনতে মা বেশি আগ্রহী। শ্বশুর উপেন মিশ্রের পরিবারে, শাশুড়ি শোভাদেবীর মারা যাওয়ার খবর গোরার মুখে শুনে শচী যতটা ব্যথিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছে ঢাকা, দক্ষিণ গ্রামে পৈতৃক বাড়ির রাস্তায় এক চক্কর ঘুরে, সে বাড়িতে না ঢুকে গোরার ফিরে আসাতে। জ্যাঠা, কাকাদের সঙ্গে তার দেখা করা উচিত ছিল, জেঠি, কাকি, তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দু’চার দিন না কাটিয়ে শ্রীহট্ট ছেড়ে গোরার ফিরে আসা খুশি মনে শচী মেনে নিতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি সে চমকে গেছে বুরহানউদ্দিন দরগার মুজাভিরের সঙ্গে গোরার দেখা করার খবরে। কেন সে মুজাভিরের সঙ্গে দেখা করল, তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, কুড়ি বছর আগে সেখানে শচীর হত্যে দিয়ে তিন দিন তিন রাত পড়ে থাকার বিষয়ে মুজাভির মুখ খুলেছিল কি না, জানতে মায়ের প্রবল আগ্রহে গোরা প্রথমে থতমত খেলেও সংক্ষেপে জানিয়েছিল সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণ।

দু’জনে মুখোমুখি বসে এ নিয়ে বেশ কয়েকবার কথা বলেছিল। মূলত গোরা ছিল বক্তা, শচী শুনত। বিশ্বরূপকে খোঁজাখুঁজির কাজ সন্তর্পণে করলেও তার অনুসন্ধানে কোনও গাফিলতি ছিল না। দাদাকে ধরে ঘরে আনতে না পারলেও দশনামী সম্প্রদায়ের মন্ত্রে দীক্ষিত স্বামী শঙ্করারণ্য নামে এক নবীন সন্ন্যাসী, পূর্বাশ্রমে যার পরিচয় ছিল বিশ্বরূপ মিশ্র, সে দাক্ষিণাত্যের পথে গেছে এবং আরও পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর পেরিয়ে যবনরাজ্যের বাইরে পরিব্রাজকের জীবন যাপন করবে, এ তথ্য গোরা জোগাড় করেছে। দাদার হদিশ করতে, ঘরে ফিরে, ফের আর এক অভিযানে বেরনোর সিদ্ধান্ত, তপন মিশ্রের বাড়িতে বসে নিয়েছিল। সংসারে এত বড় অঘটন ঘটে গেছে শ্রীহট্টে বসে তার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। প্রিয়তমা বউ, পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও, সেই শোক কাটিয়ে দাদাকে খুঁজে আনতে সে তখনও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, গোরা জানিয়েছিল মাকে। দাক্ষিণাত্যে দাদার যাওয়ার খবর পাওয়ার আগে তার খোঁজে শ্রীহট্ট, হরিকেল, লখণৌতি, কাছাকাছি যত দ্বীপ, জনবসতি চষে ফেলেছিল সে। সবশেষে বুরহানউদ্দিন দরগার মুজাভিরের শরণাপন্ন হয়েছিল। দরজার ভেতরে ঢুকে মাজারের পাশে, ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকা মুজাভিরের মুখ, বাতির মিটমিটে শিখার আলো অন্ধকারে মুজাভিরকে প্রথম দেখে গোরা চমকে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, মুজাভির নয়, মাজারের পাশে সে বসে আছে। সত্তর বছর বয়স হলে তাকে কেমন দেখতে হবে, মুজাভিরকে এক ঝলক দেখে সে বুঝে গিয়েছিল। দশাসই, দেবদর্শন মানুষটিকে আগে কোথায় দেখেছে, আঁচ করতে গিয়ে প্রথমে খেয়াল করতে না পারলেও কয়েক মুহূর্তে জেনে গিয়েছিল, বয়স্ক মানুষটা তারই প্রতিমূর্তি অথবা সে-ই দরগার মুজাভিরের তরুণ সংস্করণ।

গোরার মুখে মুজাভিরের বিবরণ শুনে শচীর বুকের ভেতরে ভূমিকম্পের কাঁপন জেগেছিল। দমবন্ধ হয়ে তখনই মরে যেতে পারে জেনে ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছিল তার মুখ, তবু গোরার পাশ থেকে সে নড়তে পারছিল না। অলোকদ্যুতিসম্পন্ন সৌম্যদর্শন, ধ্যান মানুষটি দু’চোখ খুলে তাকিয়েছিল গোরার দিকে। নিষ্পলক হয়েছিল তার দৃষ্টি। বাচালের মতো গোরা জিজ্ঞেস করেছিল, আমার চেহারায় আপনি কি নিজের যুব বয়স খুঁজে পাচ্ছেন?

শান্ত গলায় মানুষটা বলেছিল, ইন্‌সাল্লাহ্। এ সব খুদার মেহেরবানি, ঠিক কথাই বলেছ তুমি, সত্তরোর্ধ্ব আমার সামনে তরুণ আমি বসে আছি। আমার আঁতের কথা তুমি যখন টের পেয়েছে, তখন জেনে রাখ, বিশবছর ধরে তোমার প্রতীক্ষা করছি, তোমার জন্যে বসে আছি। আমার পরমায়ু শেষ হতে চলেছে। আমি কবরে চলে গেলে এই দরগার মুজাভির হবে তুমি। এর নাম নিয়তি। খুব বেশি নেই সেদিন আসতে। সবই আল্লার দোয়া! গোরার বিবরণ শুনে গোড়ায় শচীর মনে যে আলোড়ন উঠেছিল, ক্রমশ তা শান্ত হল। একাধিক দফায় চলল গোরার কথকতা।

মুজাভির সম্পর্কে গোরার বিবরণে কান রেখে, সেই মানুষটার আবেগদীপ্ত কণ্ঠস্বর, কুড়ি বছর পরে শচী যেমন শুনতে পাচ্ছিল, তেমনই ছেলের শরীরের কাঁপুনিও মা নজর করল। শচীর মনে হল, ছ’মাস আগে মুজাভিরের কথার প্রতিধ্বনি নবদ্বীপে নিজের বাড়ির দাওয়াতে বসে গোরা শুনতে পেয়ে অস্থির হচ্ছে। তাকে ঘিরে রয়েছে বুরহানউদ্দিন দরগার মুজাভির। শচী যে কথাটা ভেবে শান্তি পেল, তা হল, গোরা জেদি, ডানপিটে ছেলে হলেও মুজাভিরের আচরণে, কথায় অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পায়নি। বুরহানউদ্দিন দরগার মুজাভির হওয়ার প্রস্তাব গোরাকে দিয়ে দীর্ঘদেহী মানুষটা থামতে গোরা বলেছিল, আমি হিন্দু, বৈদিক ব্রাষ্মণ; এত বড় দরগার মুজাভির হওয়ার এলেম আমার নেই। দয়া করে আমাকে মাপ করুন।

মুজাভির বলেছিল, আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে চৌখস করে গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। অল্পসময়ে তুমি উপযুক্ত হয়ে উঠবে।

মুজাভিরের সঙ্গে গোরার কথোপকথনের কাহিনী শচী যত শুনছিল, তত বাড়ছিল তার মাথার রক্তচাপ। বোবা হয়ে গিয়েছিল সে। কুড়িবছর আগে তিন রাত দরগায় কাটানোর স্মৃতি ফিকে হয়ে যাওয়া চাঁপাফুলের সুবাসের মতো বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। গোরাকে চুপ করাতে চাইলেও তার বিবরণ শেষপর্যন্ত শুনতে তৃষিত চাতকের মতো অপেক্ষা করছিল। শচীর মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। অজানা কোনও অমঙ্গলের আশঙ্কায় দুড়দুড় করছিল তার বুক। চেহারায় প্রায় অভিন্ন, একরকম দেখতে দু’জন পুরুষ, একে অন্যের মুখোমুখি বসে, পৃথিবীর কোনও গূঢ় সত্য নিশ্চয় আবিষ্কার করেনি। তেমন কিছু করলে ভুল করেছে, বিরাট ভুল। পবিত্র দরগার মাজারভূমি থেকে সত্যের মোড়ক জড়ানো কোনও অসত্য জেগে উঠতে পারে না।

গোরার মুখের দিকে সেই মুহূর্তে শচী তাকাতে পারছিল না। ছেলের চোখে চোখ পড়লে নজর সরিয়ে নিচ্ছিল। গোরা শোনাচ্ছিল, শ্রীহট্ট আর তার সংলগ্ন এলাকায় নানাভাবে বিশ্বরূপকে খুঁজে ব্যর্থ হওয়ার পরে দাদা কোথায় যেতে পারে, সে হদিশ মুজাভিরই দিয়েছিল। শ্রীহট্ট ছেড়ে যাওয়ার আগে বিশ্বরূপ বলে গিয়েছিল মুজাভিরকে। দাক্ষিণাত্য পরিক্রমা শেষ করে সেখান থেকে আরও পশ্চিমে সমুদ্র টপকে, মরুভূমি পেরিয়ে সন্ন্যাসী শঙ্করারণ্য পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে চলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গোরার মুখ থেকে মুজাভিরের অভিমত শুনে তপন মিশ্র সায় দিয়েছিল। মুজাভিরের অনুমানে তপন সায় দিতে গোরা ঠিক করেছিল, বিশ্বরূপকে খুঁজে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত সে যাবে। যাওয়ার পথে দাক্ষিণাত্য থেকে রাজা কৃষ্ণদেবের লেখা রাষ্ট্রশাসনতত্ত্বের বিখ্যাত গ্রন্থটি সংগ্রহ করার চেষ্টা করবে। বইটা সম্পর্কে তপনের কাছে বিশ্বরূপ যখন উচ্চপ্রশংসা করেছে, তখন সেটা যে ব্যবহারিক জীবনে অবশ্য সংগ্রহযোগ্য, মহার্ঘ্য গ্রন্থ, এ নিয়ে গোরার সন্দেহ নেই।

মুজাভিরের সঙ্গে গোরার আলাপচারিতার বিবরণ শুনে প্রথমে শচী সন্দেহ করল, গোরা ধর্মান্তরিত, মুসলিম হয়ে গেছে। যবনদের ধর্ম সে গ্রহণ না করলে কেন তাকে নিজের আসনে মুজাভির বসাতে চাইবে? ভয়ে শচীর মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। ধড়ফড় করছিল বুক। গোরার চেহারায়, মুখের আদলে নিজের কাঠামো মুজাভির কি দেখতে পেয়েছে? নিশ্চয় পেয়েছে। মানুষটা যতটা উচ্চমার্গের সাধক, তার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। ঝড়ের দেবতা পবন, বৃষ্টির দেবতা বরুণের কৃপা পেয়েছে মুজাভির। প্রার্থনা করলেই এইসব দেবতার দেখা পায় সে। অনেক অলৌকিক কাণ্ড মুজাভির তখন ঘটাতে পারে, শচীর অজানা নয়। সেই অলৌকিক দৈবী স্পর্শ তিন রাত সে পেয়েছে। গোরা ফেরার আগে থেকে ধুতি ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো করে সে কেন পরতে শুরু করল, শচীর মনে এ প্রশ্ন জাগলেও ছেলের সামনে এ নিয়ে মুখ খোলার সাহস পায়নি। শূদ্র, ম্লেচ্ছদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কি গোরার মতিভ্রম হল? নানা আশঙ্কায় শচীর বুক কাঁপলেও সে জানে, গোরার পেটের কথা, সে না বললে, জানা সম্ভব নয়। গোরাকে অনর্গল কথা বলাতে পারলে কোনও এক অন্যমনস্ক মুহূর্তে বুরহানউদ্দিন দরগার মুজাভিরের সঙ্গে আলাপচারিতার কিছু অংশ, চেপে রাখা কিছু ঘটনা, সে বলে ফেলতে পারে। সে রাস্তা না মাড়িয়ে, শ্রীহট্টে তার কাজের বিবরণ নানা দফায় মাকে শোনাতে থাকল গোরা। মুজাভির প্রসঙ্গে পারতপক্ষে সে না গেলেও তার ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনে শচীর সাধ মিটত না। আরও শুনতে চাইত। গোরার কথকতার ভাণ্ডার ছিল তেমনি অফুরন্ত, কথা তার শেষ হত না।

পৃথিবী ছেড়ে লক্ষ্মী চলে যাওয়ার খবর শুনে গোরার মনে যে প্রগাঢ় বিষাদ জমেছিল, বিষাদের সেই অন্ধকার থেকে জ্ঞানের মৃদু আলো বিকিরণ শুরু হতে নিজের টোলে ব্যাকরণ, কলাপ, স্মৃতি, ন্যায়শাস্ত্রের সঙ্গে কাব্যনাটকের পঠনপাঠন অন্তর্ভুক্ত করল। প্রস্তরকঠিন শাস্ত্রীয় পাঠ্যসূচির সঙ্গে কাব্যরসের নির্ঝর মিশতে টোলে ফিরে এল তরুণবয়সের কৌতুক, চাঞ্চল্য, আনন্দ। দিনে টোলে পড়ানোর পাশাপাশি সন্ধেতে চলল নাটগীতির অভিনয়। সঙ্গীসাথী জোগাড় করতে শুরু করল গোরা। পুরোনো অভিনেতাদের সঙ্গে গদাধর, দামোদর, জগদানন্দ, শ্রীধর, মুকুন্দ, মুরারি আরও অনেকে জুটে গেল। নবশাকপাড়ায় আগের মতো গোরা যাতায়াত শুরু করল। তার মনের শোক ক্রমশ নিস্তেজ হতে থাকল। তাম্বুলির ঘরের দাওয়ায় বসে তার সেজে দেওয়া পান খেয়ে যেমন পরিতৃপ্ত হত, তেমনি তাঁতিপাড়ায় তাঁতিদের দেওয়া সুচিক্কণ বস্ত্র উপহার পেয়ে আনন্দের সঙ্গে তা নিলেও মনের গভীরে সঙ্কোচ বোধ করত। গোয়ালপাড়ায় গেলে সেখানে দুধ, ক্ষীর, ছানা খেতে আটকাত না। শূদ্র, ম্লেচ্ছ-অধ্যুষিত যেসব পল্লীর ছায়া ব্রাহ্মণরা সচরাচর মাড়াত না, সেই সম্প্রদায়ের অন্ত্যজ গৃহস্থরা এক ব্রাহ্মণসন্তানকে পাশে পেয়ে নিজেদের ভাগ্যবান ভাবত, ঈশ্বরের সমতুল্য সেই অতিথিকে আপ্যায়ন করতে নিজেদের তৈরি সেরা জিনিসটা উপহার দিত তাকে। ব্রাক্ষ্মণকে তুষ্ট করে পুণ্যার্জন করত। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি থেকে চিরনির্বাসিত ম্লেচ্ছ, অস্পৃশ্য, অজ্ঞাতকুলশীল হিন্দু সমাজে যাতায়াত করার সূত্রে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে গোরা অনেক বেশি করে বাঙালি জীবনের শৌর্য, সাহস, নিষ্ঠা, সম্প্রীতিকে খুঁজে পাচ্ছিল। বাঙালির মুখের ভাষায় অল্পবিস্তর তফাত থাকলেও শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপ, গৌড়, রাঢ় বাংলার ভাষাতে মিলের পরিমাণ, ব্যাকরণগত ঐক্য রয়েছে, তা বৈসাদৃশ্যের চেয়ে অনেক বেশি, সুস্পষ্টভাবে খুঁজে পেয়ে, ধর্মের আড়ালে বাঙালি জাতি গঠনের প্রক্রিয়া, গোরা অনুভব করল। নানাস্তরে বিন্যস্ত বাঙালি সমাজের অভ্যন্তরে বিশাল শক্তি জন্ম নিচ্ছে, সদ্যলব্ধ সেই অনুভব থেকে গোরার চেতনায় জন্ম নিল জাতিপরিচয়বোধ সে টের পেল, তার নবদ্বীপবাসী, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী পরিচয়ের চেয়ে অনেক বড় তার জাতিপরিচয়। শ্রীহট্ট এবং সংলগ্ন অঞ্চলগুলো ঘুরে এই সত্য সে প্রথম পেয়েছিল। শ্রীহট্টের ভাষার সঙ্গে নবদ্বীপের ভাষার বিস্তর তফাত থাকলেও লিপিগতভাবে তা অভিন্ন। গৌড়, বঙ্গাল, সমতট, লখণৌতি, সুক্ষ্ম সব জনপদের মানুষ একই ভাষায় কথা বলে, লিখিত পুঁথির হরফে অল্পবিস্তর তফাত ঘটলেও এ ভাষার গর্ভধারিণী যে দেবনাগরি বর্ণমালা, এ নিয়ে মতভেদ নেই। উচ্চারণের পার্থক্য কাটিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য কথ্যভাষা ভাণ্ডার, সামাজিক শিষ্টাচার অনুশীলনের চিন্তা গোরার মাথায় এল। জগন্নাথ বেঁচে থাকতে তার সঙ্গে খাঁটি হট্টিয়াতে (শ্রীহট্টের ভাষা) ঘরসংসারের যত কথা শচী বলত, তা শুনে তাদের দুই ছেলে, বিশ্বরূপ, বিশ্বম্ভর, অনায়াসে সেই মাতৃভাষা রপ্ত করেছিল। বাড়িতে হট্টিয়া ভাষায় কথা বললেও বাড়ির বাইরে গিয়ে অগোছালো শিষ্ট কথ্যবাংলা ব্যবহার করত। বিশ্বরূপ সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছুকাল পরে, জগন্নাথের ইহলীলা সংবরণের আগে থেকে বাড়িতে হট্টিয়া ভাষার চল কমে এসেছিল। পৃথিবী ছেড়ে জগন্নাথ চলে যেতে সেই ভাষাতে শচী শুধু পাড়ার গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলত। পাঁচ মাস শ্রীহট্টে কাটিয়ে সেখানকার ভাষায় নতুন করে তালিম পেয়ে, নবদ্বীপে ফিরে লক্ষ্মীর মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠে গোরার মুখে হট্টিয়া ভাষার ফোয়ারা ছুটতে থাকল। ভাষা নিয়ে তার রঙ্গব্যঙ্গের খেলায় গদাধর, মুরারি, দামোদর, জগদানন্দ প্রমুখ অতিষ্ঠ হয়ে দূর থেকে তাকে দেখলে পালিয়ে বাঁচত। জগন্নাথ মিশ্রের মতো ভক্তিপরায়ণ, পণ্ডিত, সজ্জন মানুষের পরিবারে, গোরার মতো নাস্তিক ব্যাকরণবিদ কীভাবে জন্মাল, শ্রীবাস পণ্ডিত, শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারীর মতো বয়স্ক বৈষ্ণবরা ভেবে পেত না। লক্ষ্মীর মৃত্যুতে তার চরিত্রে একটা পরিবর্তন ঘনিষ্ঠজনেরা নজর করেছিল। গোরা আগের চেয়ে নম্র, বিনয়ী হয়ে গিয়েছিল। তার ঔদ্ধত্য, খোঁচা মেরে কথা বলে তর্কজুড়ে দেওয়ার স্বভাবের রূপান্তর ঘটেছিল। অমায়িক হয়ে উঠেছিল সে। পথে, হাটবাজারে, গঙ্গার ঘাটে পিতৃপ্রতিম শ্রীবাস পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা হলে, সশ্রদ্ধভাবে প্রণাম করত তাকে। পথ ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে তাকে আগে যাওয়ার সুযোগ করে দিত। তখনও ঠোঁটে লেগে থাকত মুচকি হাসি। তার মতো পণ্ডিত, বুদ্ধিমান মানুষের বৈষ্ণব হওয়ার সারবত্তা নিয়ে শ্রীবাস উপদেশ দিলে নকল গাম্ভীর্যে গোরা বলত, আরও একটু বয়স বাড়লে, একজন প্রকৃত বৈষ্ণব গুরু খুঁজে বার করে সে দীক্ষা নেবে।

কথাটা গোরা বলার সময়ে তার ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি শ্রীবাসের চোখ এড়াত না। ভালো লোককে ব্যর্থ সদুপদেশ শুনিয়ে অযথা সময় নষ্ট না করে শ্রীবাস বিদায় নিত। নবশাকপাড়ায়, তেলি, কামার, তাম্বুলি, নাপিত, মোদক, জেলে, কিরাত, কোল, সিউলীরা, পাটনি, কামিলা, কেরলা, ছেত্রী, রাজপুতপাড়ায় ভবঘুরের মতো গোরার যখন তখন যাতায়াতের খবর শ্রীবাসের কানে এসেছিল। কামিলা, কেরলা সম্প্রদায়ের পুরুষেরা নিজেদের বউকে ভাড়া খাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, নবদ্বীপের সবাই জানত। এই দুই সম্প্রদায়কে ‘জায়াজীব’ বলা হত। এসব পাড়া গোরার মাড়ানো উচিত নয়। ঝোঁকের মাথায় গোরাকে এক সকালে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার পথে নিজের অভিমত শ্রীবাস স্নেহভরে শুনিয়ে বলেছিল, দেব, ব্রাহ্মণে যার শ্রদ্ধা ভক্তি আছে, শাস্ত্রবিরোধী এরকম গর্হিত আচরণ সে করতে পারে না। গোরা সরলগলায় বলেছিল, অদ্বৈতবাদী ‘সোহহং’ মন্ত্রে বিশ্বাসী সে। ঈশ্বর আর ঈশ্বরের ভক্ত অভিন্ন, তিনি আর সে, অর্থাৎ গোরা মিশ্র আর ঈশ্বরে তফাত নেই। যেখানেই সে যাক, সে ঈশ্বর, যাদের সঙ্গে মেলামেশা করে তারাও তাই, তারাও ঈশ্বর। তাহলে আস্তিক, নাস্তিক ভেদাভেদের দরকার কী? নিজেকে মেনে চলাই তখন আস্তিক্য। ঈশ্বর যদি বলেন, যে মানুষটি ‘ঈশ্বর আছে কিনা’ ভাবছে, সে-ও ঈশ্বর, তাহলে সেই মানুষটির ঈশ্বরত্ব মেনে নিলে অসুবিধে কী? ঈশ্বরের মেনে নেওয়া সেই ঈশ্বর যদি বলে, ‘ঈশ্বর নেই’, তাহলে সে কথা গ্রাহ্য হবে না কেন?

গোরার জবাব শুনে তার ধর্মবুদ্ধি একেবারে গোল্লায় গেছে, সিদ্ধান্ত করে শ্রীবাস দ্রুত স্নানঘাটের দিকে চলে যেত। ইতর লোকসমাজে মিশে সরহপাদের দোহাকোষের কিছু জনশ্রুতি, নিশ্চয় গোরার কানের ভেতর দিয়ে মগজে পৌঁছে গেছে। সরপাদই বলেছিল, ‘বেদ তো আর পরমার্থ নয়, বেদ কেবল বাজে কথা।’ পথঘাটে শূদ্র, নবশাকদের মুখে এসব জনশ্রুতি শোনা যায়। গোরাকে নাস্তিক্যের কবল থেকে বাঁচাতে, ফের তার বিয়ে দেওয়া দরকার। শচীর কানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথাটা তুলে দিতে শ্রীবাস মনস্থ করল। শচীর সংসারের খবরাখবর অদ্বৈত আচার্য রাখলেও পাণ্ডিত্যভিমানী গোরাকে পাশ কাটিয়ে চলত আচাৰ্য। গোরা সম্পর্কে অদ্বৈতের মনে বিন্দুমাত্র বিরাগ ছিল না। বরং তাকে স্নেহ করত, তার মঙ্গল কামনা করত। অদ্বৈত আচার্যের সূত্রে প্রস্তাবটা যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারলে ভালো হত। তা হওয়ার নয়। সংসার ছেড়ে বিশ্বরূপ চলে যাওয়ার পরে, অদ্বৈত আচার্যকে সে ঘটনার জন্যে দায়ী করে তার ছায়া মাড়াত না শচী। ঘর-ভাঙানো গুরুর কাছে গোরাকে ঘেঁষতে দেয় না। গুরু অদ্বৈত আচার্য সম্বন্ধে শচীর মনে ভয় ঢুকে গেছে। গুরুকে পরিত্যাগ করলে, শাস্ত্রবচন অনুযায়ী, রৌরব কুম্ভীপাকে ডুবে থেকে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করার কাহিনী জানা থাকায় অদ্বৈতকে ঘাঁটাতে শচী সাহস পায় না। অদ্বৈতের সংসর্গ থেকে গোরাকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে চেষ্টা করে। গুরুত্যাগিনী না হয়েও অদ্বৈত আচার্যের চেয়ে পড়শি শ্রীবাস পণ্ডিতের ওপর শচীর বিশ্বাস, আস্থা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। শ্রীবাসের পরামর্শ মেনে কাজ করত। শ্রীবাসও জানত, বন্ধু জগন্নাথের বিধবা বউকে তার ছেলে, গোরার দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ, সে দিলে, শচী ফেলতে পারবে না। ছেলের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যাবে। কোনও মা চায় না তার ছেলে বিবাগী হয়ে যাক। একাধিক বউ থাকতে যে দেশে বউ-এর অভাব হয় না, সেখানে তরুন বিপত্নীকের বধূ পেতে যে অসুবিধে হবে না, সবাই জানে। গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার পথে গোরাকে দ্বিতীয়বার সংসারী করার যে চিন্তা শ্রীবাসের মাথায় এসেছিল, তা কার্যকর করতে সেদিন বিকেলে শচীর সঙ্গে সে দেখা করল।

দু’জনের মধ্যে কথা হল। গোরার প্রথম বিয়েতে যে ঘটকালি করেছিল, সেই বনমালিকে ডেকে পাঠানোর কথা শ্রীবাস বলতে প্রথমে শচী রাজি হলেও পরের মুহূর্তে কী ভেবে পেছিয়ে গেল। গোরার প্রথম বিয়ের ঘটকালি করেছিল বনমালি। সে বিয়ে টিকল না। সাপের কামড়ে মারা গেল বউ লক্ষ্মী। ঘটক বনমালি পুণ্যবান হলে এমন ঘটত না। অকালে স্ত্রী হারানোর কষ্ট বয়ে বেড়াতে হত না গোরাকে। গোরার যোগ্য বধূ খুঁজতে ঘটক, কাশীনাথ পণ্ডিতকে খবর করে অনতিবিলম্বে ডেকে আনার সিদ্ধান্ত হল। উঁচুদরের ঘটক কাশীনাথ। অনেক উচ্চকুলশীল, সুখ্যাত বংশ, পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ। গোরার জন্যে অশেষ গুণবতী পাত্রী খুঁজে বার করতে তার অসুবিধে হবে না। যা ভাবা হয়েছিল, সেভাবে শুরু হল কাজ গোরার জন্যে পাত্রী খুঁজতে কাশীনাথ নেমে পড়তে কিছুটা হালকা হল শচীর মন।

নবদ্বীপের অল্পবয়সী জমিদার বুদ্ধিমন্ত খানের বহিবাড়ির আটচালায় গোরার টোল জমে উঠলেও কিছুদিন ধরে ছেলের মুখের দিকে শচী তাকাতে পারছিল না। সারাদিন কাজের শেষে বাড়িতে ঢুকলে থমথমে হয়ে যেত গোরার মুখ। ক্লান্তিতে এমন নুইয়ে পড়ত যে মায়ের সব কথা তার কানে যেত না। শচী টের পাচ্ছিল, বাইরে থেকে গোরাকে দেখে হাসিখুশি মনে হলেও ছেলের ভেতরটা বিকল হয়ে আছে। অধ্যাপনা, বন্ধুদের আড্ডা, ছত্রিশজাতের সঙ্গে মেলামেশা, নাটগীতির মহড়ায় ছেলে মেতে থাকলেও মাঝে মাঝে তার অন্যমনস্ক চাহনি দেখে মায়ের মন যা বোঝার, বুঝে যেত। ছেলের মনের বিষাদ কাটেনি। নতুন করে সংসারে বেঁধে দিতে হবে তাকে। গোরার জন্যে দুশ্চিন্তায় শচীর মন অশান্ত হয়ে থাকত। গঙ্গার ঘাটে স্নানের সময়ে, আত্মীয়, প্রতিবেশীর নিমন্ত্রণ রাখতে তাদের বাড়িতে গিয়ে চেনা, অচেনা পছন্দসই কোনও মেয়ে পেলে তাকে পুত্রবধূর আসনে বসিয়ে, গোরার সঙ্গে কেমন মানাবে, আন্দাজ করত। অচেনা তরুণী হলে তার গাঁইগোত্র, পারিবারিক পরিচয় জেনে নিত। তাদের একজন, রাজপণ্ডিত, সনাতন মিশ্রের মেয়ে, বিন্নুপ্রিয়াকে বিশেষ করে শচীর মনে ধরেছিল। স্নানের ঘাটে তার সঙ্গে পরিচয়ের পরে এখনও প্রায়ই শচীর দেখা হয়। চাঁদের কলার মতো স্নিগ্ধ, সুন্দরী এই চতুর্দশীকে পছন্দ হলেও, মুখ খুলে কথাটা কাউকে বলতে শচী সাহস করেনি। যতই হোক মান্যগণ্য রাজপণ্ডিতের মেয়ে। সম্পন্ন সংসার থেকে নিজের ভাঙাচোরা, অসচ্ছল পরিবারে এই মেয়েকে বধূ করে আনার চিন্তা বাতুলতা, পাঁচজনের কাছে অসমীচীন মনে হতে পারে। ইচ্ছে তবু মরে না। মনের মধ্যে ইচ্ছেটা শচী যে পুষে রেখেছিল, তার কারণ বিষ্ণুপ্রিয়ার চালচলন, স্বভাব। গঙ্গার ঘাটে দেখা হলে ভিজে শাড়িতেও শচীকে সে প্রণাম করে। একদিন নয়, যতবার দেখা হয়েছে, প্রণাম করেছে। গোড়ায় তার নাম, ধাম না জানলেও তার পরিচয় পাওয়ার পরে সঙ্কুচিত হয়ে থাকত শচী। বিষ্ণুপ্রিয়ার সভক্তি প্রণাম শচীর পা ছাড়িয়ে হৃদয় পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলেছিল। তার বাবা, নবদ্বীপের অভিজাত সম্প্রদায়ের একজন মাথা, রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্র, গোড়ায় শচী জানত না। বিষ্ণুপ্রিয়া নিজে থেকে তার পিতৃপরিচয় কখনও জানায়নি। তার এক সঙ্গিনী বলেছিল।

বিষ্ণুপ্রিয়াকে গোরা আগে না দেখলেও তার পিতৃপরিচয়, তার অজানা ছিল না। জীবনযাপনে আগের মতো তার্কিক, বহির্মুখী, ‘বিচারমল্ল’ স্বভাব গোরার চরিত্রে নতুন করে ফিরে আসতে থাকলেও দ্বিতীয়বার বিয়ে করার চিন্তা তার মন থেকে মুছে গিয়েছিল। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রসঙ্গ আলোচনায় উঠলে সে যেমন ফুৎকারে উড়িয়ে দিত, বিয়ের কথা তুললে তেমনই নিশ্চুপ হয়ে যেত। গোরার নিভৃত মনের ব্যথা গর্ভধারিণী মা অনুভব করত। শ্রীবাস ও জানত, স্ত্রী লক্ষ্মীর মৃত্যুতে সংসারে গোরার যে বিতৃয়া জেগেছে, তা সহজে কাটবে না। কিছুটা শচী বলেছিল শ্রীবাসকে। কাশীনাথকে গোরার পাত্রীর খোঁজে লাগিয়ে দিলেও বিয়েতে ছেলেকে রাজি করানোর সাধ্য তার নেই, শচী জানত। শ্রীবাসও এই গুরুদায়িত্ব নিজে না নিয়ে, গোরার দুই বন্ধু, বুদ্ধিমন্ত খান আর মুকুন্দসঞ্জয় যে এই সংকটমোচনে সবচেয়ে উপযুক্ত, বিয়েতে গোরাকে রাজি করাতে তাদের সাহায্য নেই বুদ্ধিমানের কাজ, এ অভিমত শচীকে জানাল। গোরার চোখের আড়ালে তার দুই শুভার্থীকে গোপনে শচীর বাড়িতে হাজির করে দিল শ্রীবাস। গোরাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর দায় স্বীকার করে তারা আশ্বস্ত করল শচীকে বিয়ের যাবতীয় খরচ, স্বেচ্ছায় দুই বন্ধু বহন করার অঙ্গীকার করল। শচী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বড় ছেলে বিশ্বরূপের সমবয়সী, তার-ই সহাধ্যায়ী, দুই বন্ধু, বুদ্ধিমত্ত, মুকুন্দসঞ্জয়কে অজস্র আশীর্বাদ করল। হাজার হোক, তারাও পেটের ছেলের মতো, পরিবারের দুঃখসুখের সাথী থেকে এখন গোরার সুহৃদ। পরের দিন সকালে ঈশানকে পাঠিয়ে বাড়িতে ঘটক, কাশী মিশ্রকে ডেকে, পছন্দের বধূ হিসেবে যে নাম শচীর মনের মধ্যে গুন্ গুন্ করছিল, সেই বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবা, সনাতন পণ্ডিতের কাছে ঘটককে পাঠাল। শচীর পাঠানো ঘটককে আপ্যায়ন করে বৈঠকখানা ঘরে বসাল সনাতন। গোরার গুণপনার বিবরণ শুনিয়ে, সনাতনের সঙ্গে শচী’ বৈবাহিক সম্পর্ক গড়তে ইচ্ছুক, কাশী মিশ্র জানাতে সে প্রস্তাব সনাতন লুফে নিল। মনের ভেতরের কথাটা সেই মুহূর্তে চেপে রাখলেও আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখ। ব্রাক্ষ্মণ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ের শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ, প্রথা, আচরণ, রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের অজানা ছিল না। কুলীন সমাজে সাত বছরের মধ্যে কন্যাসন্তানকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর প্রথা তখন কিছুটা শিথিল হলেও দশের মধ্যে তাকে স্বামীর সংসারে পৌঁছে দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। উপযুক্ত কুলীন, ব্রাক্ষ্মণ পাত্রের অভাবে, বহুবিবাহিত বুড়ো বরের সঙ্গে একই ছাদনাতলায় সাত থেকে সাঁইত্রিশ এক ঝাঁক আইবুড়ো কুলীন কন্যাকে, পারিবারিক সম্পর্কে যারা পিসি, ভাইঝি, যজ্ঞাগ্নি জ্বেলে, মন্ত্রপাঠ করে ইহকালের মতো দাম্পত্যবন্ধনে তাদের জড়িয়ে দেওয়ার প্রথা ছিল। ছাদনাতলায় অচেনা এক পুরুষের সঙ্গে মালাবদলের ঘটনাকে কুলীন ব্রাহ্মণ মেয়ের পতিগৃহে যাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হত। কত যে নববধূ হা-পিত্যেশ করে সারা জীবন স্বামীর প্রতীক্ষায় কাটাত, হিসেব নেই। স্বামীর বদলে, অনেক সময়ে পেত শাঁখা, সিঁদুর ছেড়ে থান কাপড় পরার খবর।

রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের ঝুলিতে এরকম কত তথ্য যে ছিল, তার ইয়ত্তা নেই। গোরার সঙ্গে মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে মনে উল্লাস জাগলেও সাবধানে, রেখেঢেকে কথা শুর করল সনাতন। দশ পেরনো মেয়েকে সংসারে রাখা শাস্ত্রমতে অমঙ্গলজনক হওয়াতে গোড়া বেঁধে চোদ্দো বছরের বিষ্ণুপ্রিয়ার বয়সের হিসেব দশে ঠেকিয়ে রেখেছিল সনাতনের গৃহিণী। বিষ্ণুপ্রিয়া সাত পেরনোর পর থেকে কোনও এক কারিকাগ্রন্থের সূত্রানুসারে প্রতি দু’বছরে তার বয়স এক বছর করে বাড়ছিল। চোদ্দো বছরে দশে থেকে গেল বিষ্ণুপ্রিয়া। অনূঢ়া মেয়েকে নিজের সংসারে রেখে তার উপযুক্ত পাত্র খুঁজে বার করতে এছাড়া সনাতন মিশ্রের উপায় ছিল না। হিসেবে গোঁজামিল দিয়ে কুলমান বাঁচাতে রাজপণ্ডিত যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, তখন-ই তার বাড়িতে এক সকালে কাশী মিশ্র পৌঁছে গেল। তাকে ভালোমত ফলারের ব্যবস্থা করে দিয়ে, তার সামনে ছেলে, গগনকে বসিয়ে বাড়ির ভেতরে সহধর্মিণীর সঙ্গে সনাতন পরামর্শ করতে গেল। স্বামীর মুখ পুরো বিবরণ শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল সনাতনের গৃহিণী। জগন্নাথ মিশ্রের সংসারে বিত্ত না থাকলেও জ্ঞান, বৈদগ্ধ্য, ন্যায়পরায়ণতার জন্যে তাদের চিনত নবদ্বীপের মানুষ। বিপত্নীক গোরার সুখ্যাতিও পৌঁছেছিল তাদের ঘরে। অসমবয়সী এক কুলীন বরের সংসারে একাধিক সতীন নিয়ে বিষ্ণুপ্রয়াকে ঘর করতে পাঠানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না সনাতন মিশ্রের গৃহিণীর। সনাতনের মনোভাবও ছিল তাই। মায়ের পাশে বসে কান খাড়া করে বিষ্ণুপ্রিয়াও শুনছিল বাবার কথা। গোরাকে সে না চিনলেও নিমাই পণ্ডিতের নাম, তার রূপ, গুণ, তার চতুষ্পাঠীর নানা বৃত্তান্ত তার কানে আসত। গোরা যে নিমাই পণ্ডিতের ডাকনাম, এ তথ্যও তার অজানা ছিল না। রামচন্দ্রপুর থেকে গোরার মা, শচীদেবীর পাঠানো প্রস্তাবের বয়ান শুনে বিষ্ণুপ্রিয়ার দু’গাল অনুরাগের আবিরে রাঙা হল, কাঁটা দিল শরীরে। রাজপণ্ডিতের নিজের পরিবারে একজন পুত্রসন্তান থাকলেও স্থাবর, অস্থাবর যত বিত্তসম্পত্তির উত্তরাধিকার, মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়াকে দানপত্র করে দিয়ে যাওয়া মনস্থ করল সনাতন মিশ্র। গোরাকে জামাতা করার অনুমোদন গৃহিণীর কাছ থেকে পেয়ে সনাতন যখন বৈঠকখানায় এল, কাঁসার জামবাটি বোঝাই দুধ, কলা, মুড়কি, বাতাসা মেখে ফলার নিঃশেষ করে কাশীনাথ হাত ধুয়ে পরিতৃপ্ত মুখে অপেক্ষা করছে। বিয়ের প্রাথমিক চুক্তি পাকা করে, ফলারের শেষে, ট্যাকে দক্ষিণার নগদনারায়ণ গুঁজে নিয়ে কাশীনাথ ফিরে এল। সনাতনের বাড়ি থেকে কাশী মিশ্র, সন্ধের আগেই শচীর বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে ফেলেছে, জানিয়ে দিল। সনাতন পণ্ডিতের বার্তার প্রতিটা শব্দ কাশীনাথকে খুঁচিয়ে শুনে নিল শচী। সনাতন বলেছে, গোরার মতো গুণবান, রূপবান, সর্বশ্রীমণ্ডিত জামাই পেলে সে নিজেকে অশেষ সৌভাগ্যবান মনে করবে। মর্যাদা বাড়বে তার পরিবারের। শচীর অনুকম্পা পেতে তার সঙ্গে সে কথা বলতে চায়। পাকা কথা বলার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করবে।

সাত দিনের মধ্যে সে সুযোগ ঘটে গেল। শচীর তরফে তার বোনাই, চন্দ্রশেখর আচার্য, অভিভাবকসদৃশ শ্রীবাস পণ্ডিত দেখা করল সনাতনের সঙ্গে, তার বাড়িতে। তাদের সঙ্গে থাকল কাশীনাথ। বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হল। দু’দিন পরে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে সনাতন গিয়ে চন্দ্রশেখর, শ্রীবাসের সামনে শচীর সঙ্গে আর এক দফা কথা বলল। সনাতনের পাশে ছিল ঘটক, কাশী মিশ্র। দু’পক্ষের কুশল বিনিময়ের পরে, বৈবাহিক সম্পর্ক আলোচনার সূচনায়, মুখ্য বিষয়, যৌতুক নিয়ে কথা উঠতে, পাত্রপক্ষের তরফে শচী জানিয়ে দিল, বিয়েতে কন্যাপণ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বুদ্ধিমন্ত খান, মুকুন্দসঞ্জয়ের মতো দু’জন বিত্তবান মানুষ, গোরার বিয়ের পুরো খরচ দিতে রাজি থাকলেও শচী সাফ বলে দিল কন্যাপণ দেওয়ার সামর্থ্য তার মতো বিধবার নেই। তখন ছেলের বিয়ে দিতে হলে, তার বাবাকে সম্ভাব্য বেয়াইকে কন্যাপণ দিতে হত। সেটা ছিল সে সময়ের রেওয়াজ। বিধবা শচীর সংসারে অনটন থাকলেও তার আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রখর। গোরার বন্ধুদের টাকায় ছেলের বিয়ের কন্যাপণ দেওয়ার চিন্তা মুহূর্তের জন্যে সরল মায়ের মনে আসেনি। শচী দ্বিতীয়বার কথাটা বলার আগে রাজপণ্ডিত সনাতন সঙ্কোচে জিভ কেটে, দু’হাতের আঙুল, দু’কানের লতিতে ছুঁয়ে বলল, বেয়ান আমার কন্যা যাচ্ছে নিজের সংসার পাততে, এক মায়ের ঘর থেকে আর এক মায়ের আশ্রয়ে, কন্যাপণের কোনও প্রশ্নই সেখানে উঠতে পারে না।

ছেলের ভাবী শ্বশুরের বিনয়, ভদ্রতা দেখে মুগ্ধ শচী বিয়ের লগ্ন নির্ধারণ করতে তাকে বৃদ্ধ নীলাম্বর চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করল। তখনি রাজি হয়ে গেল সনাতন। শচীর বাবা নীলাম্বর চক্রবর্তীর চতুষ্পাঠীর একদা ছাত্র ছিল সনাতন। সেই সুবাদে সনাতনের গুরু নীলাম্বর। সনাতনের চোখে সে পরম শ্রদ্ধাস্পদ মানুষ। বড় জামাই জগন্নাথ মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়ে শচীর সংসারের সে-ই প্রকৃত অভিভাবক, সনাতন জানে। নীলাম্বরের সঙ্গে অনতিবিলম্বে দেখা করতে চন্দ্রশেখরকে সঙ্গী পেতে চাইল সনাতন। শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রীকে বাদ দিয়ে একা, অনাহূত যাওয়া লোকাচারসম্মত না হলেও সনাতনের ডাকে চন্দ্রশেখর রাজি হয়ে গেল। নিশ্চিত হল সনাতন।

নীলাম্বরের সঙ্গে পঞ্জিকা ঘেঁটে রাজপণ্ডিত যখন মেয়ের বিয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ খুঁজছে, গোরা তখনও জানে না তাকে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে। তার দুই ধনাঢ্য বন্ধু বিয়ের আয়োজনে মেতে উঠলেও গোরাকে তারা কিছু বলেনি। গোরার সঙ্গে কিঞ্চিৎ রঙ্গ করতে চাইছিল। নীলাম্বর চক্রবর্তীর পরামর্শে বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়ে যাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সেই অঘটন ঘটল। পরের সকালে, গঙ্গার ঘাটে স্নান সেরে চতুষ্পাঠীর রাস্তায় গোরাকে একা পেয়ে কাশী মিশ্র ঈষৎ মজা করে জিজ্ঞেস করল, বিয়ের দিনক্ষণ তাহলে ঠিক হয়ে গেল?

কাশীনাথের প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে গোরা বিষয়টা জানতে চাইলে ঘটক সবিস্তারে জানাল। সব শুনে গোরা আকাশ থেকে পড়ল। গম্ভীর হল তার মুখ। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ঘটক কাশীনাথ ভয় পাওয়ার সঙ্গে যা বোঝার বুঝে গেল। তার কাছ থেকে এই প্রথম নিজের বিয়ের খবর শুনে গোরা রীতিমত ক্রুদ্ধ হল। সে চটেছে, তার কপালের রেখা, চোখের চাহনি, শক্ত চিবুক দেখে অনুমান করল কাশীনাথ। গোরা বিয়েতে অরাজি হলে তাকে কেউ টলাতে পারবে না। পাকা ঘুঁটি এভাবে কেঁচে যেতে দেখে আতান্তরে পড়ে গেল কাশীনাথ। কার সঙ্গে কথা বললে সমস্যার সুরাহা হবে, রাজপণ্ডিত সনাতন, না ছেলের মা শচী, কার সঙ্গে প্রথমে কথা বলবে, চট করে ভেবে না পেয়ে স্নানসিক্ত বসনে বাড়ি পৌঁছল। ভিজেধুতি, চাদর ছেড়ে শুকনো পোশাক পরে, ইষ্টমন্ত্র জপ করে মাথার ভেতরটা একটু সাব্যস্ত হতে তার মনে হল গোড়ায় শচীর কাছে যাওয়ার চেয়ে সনাতন মিশ্রের বাড়িতে গিয়ে কথা বলা দরকার। মেয়ের বাবা সে। গোরার সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়ার বিয়ের শুভসংবাদ, রাজপণ্ডিত আর তার গৃহিণী মিলে পাঁচ কান করে দেওয়ার আগে তাদের থামানো, এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। পাকা কথা হওয়ার পরে সে বিয়ে ভেঙে গেলে, পৌনর্ভবা কন্যার বিয়ে হয় না। রম্ভাশ্রমী থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ বর পর্যন্ত, পাত্রী পৌনর্ভবা শুনলে, বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যায়। ভবিষ্যতে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজপণ্ডিত কোনও ঝামেলায় না পড়ে, সেই ব্যবস্থা করতে সনাতনের বাড়িতে হাজির হল কাশীনাথ। বিয়ে করতে গোরা রাজি নয় শুনে সনাতনের মাথায় বাজ পড়ল। ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখ। গোরার অরাজি হওয়ার কারণ জানতে না চেয়ে কাশীনাথকে বৈঠকখানায় বসিয়ে দ্রুত অন্দরমহলে চলে গেল। মধ্যযুগে, বৈরী মনোভাবাপন্ন কিছু আত্মীয়, পড়শি মিলে নিকট জনের পরিবারের মেয়ের বিয়ে মাঝে মাঝে ভণ্ডুল করে দিত। বিয়েতে ভাঙচির ভয়ে মেয়ের পরিবারে গৃহকর্তা, অভিভাবকরা গুজব রটনাকারী আত্মীয়দের শুভানুষ্ঠানের অল্প কয়েকদিন আগে, যখন কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই, আমন্ত্রণ জানাত। বিষ্ণুপ্রিয়ার বিয়ের লগ্ন পাকা হওয়ার খবর, সতর্ক সনাতন তাই তখনও বাড়ির বাইরে যেতে দেয়নি। শচী, চন্দ্রশেখর, শ্রীবাস কোনও একজনরে কাছ থেকে সরাসরি বিয়ে বাতিলের বার্তা সনাতন না পেলেও সে বুঝে গিয়েছিল বিয়েতে গোরার অনিচ্ছাপ্রকাশ, এমন এক অলঙ্ঘনীয় পাঁচিল, যা টপকে যাওয়া তার মা, স্বজন, সুহৃদদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার খবর শুনে সনাতনের গৃহিণীর মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। বিষ্ণুপ্রিয়াকে কাছাকাছি কোথাও দেখা গেল না। সনাতন পণ্ডিতের পরিবারে যখন বিষণ্ণতা নেমেছে, তখন প্রায় মাঝদুপুরে, চতুষ্পাঠী ছেড়ে গম্ভীর মুখে গোরা বাড়ি ফিরল। রোজ দুপুরে ভাত খেয়ে চতুষ্পাঠী ছেড়ে গোরা এমন প্রসন্নমুখে বাড়ি ফেরে, যা দেখে শচীর মনে হয় বড় কোনও আনন্দের হাট থেকে ছেলে ঘরে এল। গোরার মুখ দেখে শচী ঘাবড়ে গেলেও তার মনে স্ফূর্তি আনতে বলল, ঠিক সাতদিন পরে তোর বিয়ে, অর্থাৎ সামনে শুক্রবার গোধূলিলগ্নে। রাত আটটা পর্যন্ত বিয়ের লগ্ন।

মায়ের কথার মাঝখানে গোরা বলল, খেতে দাও, তাড়াতাড়ি টোলে ফিরতে হবে। গোরার হাবভাব দেখে শচীর বুক কাঁপতে লাগল। পনেরো বছর আগে বড় ছেলে বিশ্বরূপ, ঠিক এরকম পাথরের মতো মুখ করে তার বাবার মুখ থেকে বিয়ের নির্দেশ শুনেছিল। প্রথমে মুখে ‘রা’ না কাড়লেও বিয়ের পনেরো দিন আগে, সংসার করার গুরুদায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্ৰাৰ্থনা করেছিল। ক্রুদ্ধ জগন্নাথ কড়াকথায় থামিয়ে দিয়েছিল তাকে। নীতিশাস্ত্রের অনেক শ্লোক শুনিয়েছিল। বাবার সদুপদেশ চুপ করে শুনলেও অধিকতর নীরবে সেই রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চিরকালের মতো বিশ্বরূপ চলে গেল। গোরার দিকে তাকাতে শচী ভয় পাচ্ছিল। খোলা সদরদরজা দিয়ে মুকুন্দসঞ্জয়, বুদ্ধিমন্তকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে শচী হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। গোবরে নিকোনো উঠোনে বাঁশের চারপায়ার ওপর বাঁখারি পেতে, বসার জায়গা। মহামান্য দুই অতিথিকে দেখে, ঈশান তাড়াতাড়ি বাঁখারির ওপর তালপাতার চাটাই পেতে, সেটা চাদরে ঢেকে দিতে মুকুন্দসঞ্জয় সেখানে বসলেও দাওয়ায় শচীর পাশে বুদ্ধিমন্ত বসে প্রথম গোরাকে যে কথা বলল, তা হল, আগামী শুক্রবার, গোধূলি লগ্নে তোমার বিয়ে। বিয়ের সব আয়োজন মুকুন্দের সঙ্গে মিলে করেছি। বন্ধুদের আমল না দিয়ে থালার দিকে তাকিয়ে গোরা ভাত খেয়ে যাচ্ছে। মুকুন্দসঞ্জয় বলল, বাড়িতে একজন বধূ, ঘরদালান আলো করে ঘুরে না বেড়ালে, বাড়িটা প্রকৃত গৃহ হয় না। গৃহে বধূ না থাকলেও গৃহ মানায় না, রূপ খোলে না গৃহ আর গৃহস্থের। শেষপাতে জামবাটি ভরে লাউ-এর পায়েস খাচ্ছিল গোরা। খাদ্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় পায়েস, পেতলের কুশিতে তুলে চুকচুক করে গলাধঃকরণ করার সময়ে পরিতৃপ্তিতে ভরে যাচ্ছিল তার মুখ। শচীর মুখে বিয়ে করার কথা শুনে তার কপালে বিরক্তির যে রেখা জেগেছিল পায়েসের মহিমায় তা মুছে যাচ্ছে। শক্ত চোয়াল নমনীয় হয়ে উঠছে। বিয়েতে গোরা অরাজি শুনে, পেটের মধ্যে শচীর হাত-পা সেঁধিয়ে গেলেও বুদ্ধিমন্ত, মুকুন্দসঞ্জয় ভালোরকম জানে গোরাকে। তার চরিত্রের কোথায় ঔদ্ধত্য, কোন জায়গাটা নরম, তাকে সামলানোর কলাকৌশল, ভালোরকম রপ্ত করেছে তার দুই বন্ধু। গভীরভাবে মাতৃভক্ত গোরাকে নতুন দাম্পত্যজীবনে ঢোকাতে কী ধরনের মায়াজড়ানো, পরিতোষের বাক্য বলা উচিত, বুদ্ধিমন্ত আগেই ভেবে রেখেছিল। বলল, তোমার অভাগিনী মায়ের দিকে তাকাও। বড় দুঃখে কাটিয়েছেন সারাজীবন। কতটুকু সুখশান্তি পেয়েছেন দেবীর মতো তোমার এই মা? কতদিন আর তিনি বাঁচবেন? ছেলের বউ নিয়ে আনন্দে কিছুকাল ঘর করার আশায় তিনি যদি রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের মেয়েকে পুত্রবধূ করে সংসারে আনতে চান, তাঁর অপরাধ কোথায়? তোমার কাছে তিনি এমন কিছু চাননি, যা দেওয়া তোমার সাধ্যের বাইরে।

একমুহূর্ত থেমে বুদ্ধিমন্ত বলল, মা যখন এ পৃথিবীতে থাকবেন না, তখন টের পাবে তোমার কত বড় উপকার তিনি করে গেছেন।

বুদ্ধিমন্তের শেষবাক্য শক্তিশেলের মতো গোরার বুকে বিঁধতে সে কাত হয়ে গেল। মুখে কিছু না বলে গুম হয়ে সে যখন বসে আছে, তখন দাওয়া ঘেঁষেদাঁড়ানো বাড়িন পুরনো, প্রবীণ ভৃত্য ঈশান হঠাৎ প্রবল আবেগাপ্লুত হয়ে গোরার পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দু’হাত জুড়ে গড় করে কান্নাজড়ানো গলায় বলল, দোহাই দাদাঠাকুর তোমার পায়ে পড়ি, বিয়ে যখন ঠিক হয়ে গেছে, ‘না’ কোরো না। চল্লিশবছর আছি এ সংসারে। কত দেখলুম। আমার চোখের সামনে মা-ঠাকরুণের আট মেয়ে জন্মাল, কেউ বাঁচল না। তাদের বুকে তুলে আমি-ই নিয়ে গেছি শ্মশানঘাটে। বুক ফেটে গেলেও বোবা হয়ে থেকেছি। সংসারে বিবাগী হয়ে ষোলো বছরের বড়-দাদাঠাকুর বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, তারপর গেলেন আমার অন্নদাতা বাবাঠাকুর, কচি বউটা পর্যন্ত সাপের কামড়ে শেষ হয়ে গেল। মা-ঠাকরুণের ওপর দিয়ে যে ঝড় গেছে, তা সামলে তিনি যে সংসারে রয়েছেন, তাও ছোট দাদাঠাকুরের টানে।

একমুহূর্ত থেমে গোরার দিকে তাকিয়ে ঈশান বলল, তোমাদের টানে আমিও এ বাড়িতে পড়ে আছি। যাদের নুন খেয়েছি, তাদের সঙ্গে বেইমানি করব না। আমারো বয়স হয়েছে, কবে আছি কবে নেই, কে জানে? হয়তো এই উঠোনে একদিন মরে পড়ে থাকব।

ঈশানখুড়োকে কখনও একটানা, এভাবে এতক্ষণ ধরে কথা বলতে গোরা শোনেনি। সংসারে চিরদুখী শচীকে নিয়ে বুদ্ধিমত্ত, ঈশানের কথাগুলো মাতৃভক্ত গোরার মনের ভেতরে ঢেউ-এর মতো আছড়ে পড়তে থাকল। মন খারাপ করা বিষাদের ঢেউ। গোরা তাকাল শচীর মুখের দিকে। সারাজীবন যে দুঃখকষ্টের মধ্যে মা জীবন কাটিয়েছে, এ তথ্য তার অজানা নয়। মিশ্রপরিবারের সন্তান সে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অনেকগুলো বছর নিজের চোখে সব দেখেছে। সে-ও কম জ্বালায়নি মাকে। শৈশবে ইট মেরে মায়ের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে নিজের হাতে রক্তাক্ত করেছে মায়ের শরীর। তাকে বিয়ে করার জন্যে মায়ের আকুল অনুরোধের সঙ্গে ঈশানখুড়োর স্নেহজড়ানো আবেদন তার মনের ভেতরটা আর্দ্র করে দিল। বাবার আমলের লোক ঈশানখুড়ো। তার জন্মের পর থেকে তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। তাদের সংসারের একজন হয়ে গেছে অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষটি।

গোরা যখন স্তব্ধ হয়ে এত সব ভেবে চলেছে, মুকুন্দসঞ্জয় বলল, গোরা, এ বিয়েতে না কোরো না। বুদ্ধমত্ত আর আমি তোমার বন্ধু। তোমার মা, ঈশানখুড়োর মতো আমরাও তোমার ঘরের লোক, শুভাকাঙ্ক্ষী। আমরা সবাই তোমাকে যেমন সংসারী দেখতে চাই, তোমার মা তার চেয়ে একটু বেশি করে চাইবেন, এটা-ই স্বাভাবিক। তাঁর বয়স হয়েছে, বড় একা তিনি। সংসারে একজন পুত্রবধূ এলে জীবনের বাকি দিনগুলো নিশ্চিন্তে কাটাতে পারেন।

ঈশান আবার বলল, এই বুড়োটার কথা রাখো ছোটঠাকুর। রাজি হও।

শচী বলল, রাজপণ্ডিতকে আমি কথা দিয়েছি, তার মেয়েকে পুত্রবধূ করে ঘরে আনব। তার আত্মীয়স্বজনের কাছে সুখবরটা পণ্ডিত নিশ্চয় এর মধ্যে পৌঁছে দিয়েছে। তুই এখন বিয়ে থেকে পেছিয়ে গেলে ফুলের মতো মেয়েটা পৌনর্ভবা হয়ে চিরদিন কুমারী সেজে বাপের সংসারে পড়ে থাকবে। বাক্দত্তা মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলে কে তাকে ঘরের বউ করে নিয়ে যাবে? পনেরো বছর আগে বিশ্বরূপের বিয়ে পাকা করে একটা মেয়ের এ সর্বনাশ আমরা করেছি। ফের সে কাজ করলে মহাপাতক হতে হবে আমাদের। নরকবাস করবে সাতপুরুষ। তুই-ই পারিস আমার নরকবাস ঠেকাতে।

মায়ের কথা, ঈশানের আকুল আবেদন, গোরা ঠেলতে পারল না। দুর্দিনের দুই বন্ধু, বুদ্ধিমন্ত, মুকুন্দসঞ্জয়ের অনুরোধ উড়িয়ে দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভবই ছিল। গোরা বলল, তোমাদের ইচ্ছে মেনে নিলাম। তোমরা যা চাইছ, তাই হোক।

গোরার কথার মধ্যে ঘটক, কাশীনাথ মিশ্র এসে জানাল, গোরা যে বিয়ে করতে রাজি নয়, সাত-সকালে সনাতন মিশ্রকে জানিয়ে এসেছে। কান্নাকাটি পড়ে গেছে রাজপণ্ডিতের পরিবারে। আমি লজ্জায় পড়ে গেলেও কিছু করার ছিল না। যার বিয়ে, সেই যখন বিয়েতে রাজি নয়, তখন ঘটনাটা জানাজানি হওয়ার আগে কন্যাপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া ভালো। গঙ্গার ঘাট থেকে স্নান সেরে তাই প্রথমে চলে গেলাম রাজপণ্ডিতের বাড়িতে।

মাথা গরম মুকুন্দসঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, বিয়েতে গোরার মত নেই, কে একথা বলল আপনাকে?

মুকুন্দসঞ্জয়ের মেজাজ দেখে ভয়ে কাশী মিশ্র থতমত খেল। সে মুখ খোলার আগে গোরা বলল, আমি-ই বলেছিলাম। আমার বিয়ের খবর আমি জানতাম না। বিয়ে করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই, তা জানিয়েছিলাম কাশী মিশ্রকে।

ঘটনাটা যথেষ্ট জট পাকিয়ে গেছে টের পেয়ে তখনই ঘটকঠাকুরকে সনাতন মিশ্রের বাড়িতে বুদ্ধিমন্ত রওনা করে দিল। পৃথিবী উল্টে গেলেও এ বিয়ে আটকাবে না, এমন এক জোরালো আশ্বাস শচীর পরিবারের পক্ষ থেকে সনাতনকে পাঠানো হল। নবদ্বীপের সবচেয়ে প্রবীণ ঘটক, বিয়েতে মধ্যস্থের ভূমিকা ত্রুটিহীনভাবে পালন করার সুনাম যার আছে, সেই কাশী মিশ্র, বিষাদসিন্ধুতে হাবুডুবু খেতে-থাকা সনাতন মিশ্র আর তার পরিবারকে উদ্ধার করে নিরাপদ ডাঙায় পৌঁছে দিল। গোরার সঙ্গে শুভপরিণয় বন্ধনে বিষ্ণুপ্রিয়ার আবদ্ধ হওয়া অনিবার্য, এ নিয়ে রাজপণ্ডিতের মনে ছিটেফোঁটা সংশয় থাকল না। আর এক প্রস্থ দক্ষিণা ট্যাকে গুঁজে আহ্লাদে আটখানা হয়ে কাশী মিশ্র বাড়ি ফিরে এল।

বিয়ের সুখবর নির্বিঘ্নে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। শচীর সংসার, আরও একবার আনন্দের কলধ্বনিতে ভরে গেল। কোমর বেঁধে বুদ্ধিমত্ত, মুকুন্দসঞ্জয় বিয়ের প্রস্তুতিতে নেমে দেদার টাকা জুগিয়ে যেতে থাকল। খরচের পরিসর সমানভাবে ভাগ করে নিয়ে, দু’জনে ঠিক করেছিল রাজকীয় আড়ম্বরে গোরার বিয়ে হবে। গোরার সহাধ্যায়ী আর ছাত্রবাহিনীকে কাজে নামিয়ে দিল তারা। তেরো বছরের লক্ষ্মীর সঙ্গে সতেরো বছরের গোরার প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান যতটা জৌলুসহীন ছিল, তার ঠিক উল্টোরকম জাঁকজমকের ব্যবস্থা হল দ্বিতীয় বিয়েতে। নবদ্বীপের সব ব্রাক্ষ্মণ, বৈষ্ণব, নবশাক সম্প্রদায়ের মাতব্বর, নানা গোষ্ঠীপ্রধানরা বউভাতে, বেশি ঘনিষ্ঠরা বরযাত্রায় আমন্ত্রিত হল। জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ি চাঁদোয়া, নানা বর্ণের নিশান, ঘট, কলাগাছ, আমপাতার শিকল বেষ্টন করে সাজানো হল। আত্মীয়, প্রতিবেশী মেয়েরা মাটির বাড়ির ভেতর-বাইরের নিকোনো দেওয়াল, মেঝে দৃষ্টিনন্দন আলপনার চিত্রিত করল। বউভাতের দিনে শাস্ত্রানুযায়ী আমিষ খাওয়ার বিধান থাকায় ব্রাহ্মণসমেত নানা সম্প্রদায়ের অতিথির জন্যে ভারে ভারে আসতে থাকল রুই, কাতলা, মৃগেল, মহাশোল, পাবদা মাছের সঙ্গে খাসি, হরিণ, ভেড়ার মাংস। পোলাও রান্নার জন্যে এল জালাবোঝাই সোনালি সুগন্ধি ঘি, বস্তা বস্তা বাসমতী চাল। পায়েস রান্নার জন্যে এল গোবিন্দভোগ চাল। ধামাবোঝাই বড়া, বড়ি, ঝোড়াভর্তি সাতরকম শাক, মোচা, থোড়, কুমড়োর পাশাপাশি ঝাঁকাভর্তি পটল, লাউ, মিষ্টি বানানোর জন্যে শতাধিক জালাভর্তি গোরুর দুধ। পঞ্জিকা ঘেঁটে দেখা গেল শচী, সনাতনের দু’পরিবার তখন অশৌচদোষমুক্ত। বিষ্ণুপ্রিয়ার যথাসময়ে রজোদর্শন হয়ে যেতে, তার বয়সের হিসেব নিয়ে আত্মীয়স্বজন মনের খুঁতখুঁতুনি চেপে রেখে আনন্দে উলুধ্বনি করল। বিয়ের আনন্দে ভেসে গেল রাজপণ্ডিতের ভদ্রাসন।

গোরার বিয়ের খরচ জোগাতে দিলদরিয়া বুদ্ধিমন্ত, তার বন্ধু মুকুন্দসঞ্জয়, নবদ্বীপের বিশিষ্ট নগরীয়াদের বাড়িতে দু’হাত খুলে উপহার, নমস্কারী, দক্ষিণা পাঠাতে লাগল। বাঁকে ভরে যেতে থাকল দামী তসর, রেশমের চাদর, শাড়ি, মনোহরণ মিষ্টান্নসম্ভার। নান্দীমুখ, অধিবাস করতে শচীর বাড়িতে সনাতন যেমন তার ছেলেকে পাঠাল, তেমনি সনাতনের বাড়িতে শচী পাঠাল তার বোনপো জয়ন্তকে। চন্দ্রশেখর আচার্যর ছেলে জয়ন্ত, গোরার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়, শুকনো ঘাস দাঁতে ধরে সারাদিন নির্জলা উপোস করে পরম সাত্ত্বিকের মতো নান্দীমুখ করল। নবদ্বীপে এত ধুমধামের বিয়ে আগে কেউ দেখেনি। নিজের বাড়িতে মেয়েদের জল সওয়া, ষষ্ঠীপুজো ইত্যাদি লোকাচার শচী দাঁড়িয়ে থেকে করাল। বাড়িতে আত্মীয় পড়শি বন্ধুদের ভিড়। দুপুরের আগে গৃহাঙ্গনের একপাশে, নিমগাছের তলায় সদ্য কেনা জলের একাধিক নতুন মেজলায় জল ভরে গোরা স্নান করতে বসেছে। গঙ্গায় রোজ একাধিকবার স্নান করা যার অভ্যেস, গোরুর জাবনা খাওয়ার মেজলায়, তা সে যত নতুন হোক, জল ভরে স্নান করতে তার অস্বস্তি হওয়া স্বাভাবিক। গোরারও হচ্ছিল। তার মধ্যে এক ঝাঁক এয়ো তাকে ঘিরে, তার শরীরে তেল-হলুদ মাখিয়ে, সেই তেল-হলুদ সনাতন মিশ্রের বাড়িতে মেয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে পাঠাতে, সে ভাবল, এবার রেহাই পাবে। বাস্তবে তা ঘটল না। ছেলের গায়ে হলুদের পরে তাকে স্নান করানোর দায়িত্ব এয়োদের। এটা লোকাচার। স্নানের পিঁড়ি ছেড়ে গোরার পালানোর উপায় ছিল না। ধুঁধুলের জালিতে, ক্ষার, এবন্ডক বীজ দিয়ে এয়োস্ত্রীরা তার শরীর মাজাঘষা শুরু করেছিল। গোরার পায়ের দুটো পাতা, হাঁটু, নখ-সমেত দু’হাত, কনুই পরিষ্কার করে তেল, হলুদ-আমলকি মাখিয়ে দ্বিতীয়বার ধৌতি করছিল। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গোরাকে ঘিরে দাঁড়ানো মেয়েরা তার স্নানের দৃশ্য দেখে পুলকে শিউরে উঠল। তাদের কেউ আগে এমন একজন সুপুরুষের গায়ে হলুদ, স্নানের অনুষ্ঠান দেখেনি। গোরাকে তেল-হলুদ মাখিয়ে মাজাঘসার কাজে হাত লাগাতে দু’একজন এয়োর ইচ্ছে জাগলেও সম্পর্কের বিচারে তা লোকাচারবিরুদ্ধ হওয়ায় তারা অনেক চেষ্টায় নিজেদের গুটিয়ে রাখল। আনন্দের উদ্ভাস জেগে থাকল তাদের মুখে। গোরার ঠোঁটে আলতো হাসি। নান্দীমুখ, যার আর এক নাম বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ, বিয়ের আগের দিন, সেই অনুষ্ঠানের সূচনা হলেও গায়ে হলুদের সকালে শুভকাজের আমোদ তুঙ্গে ওঠে। গোরার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বসে গেল গানবাজনার আসর। শাঁখের আওয়াজের সঙ্গে শোনা যেতে থাকল উলুধ্বনি। শুভানুষ্ঠানের কৃত্য হিসেবে মেয়েরা কখনও একা, কখনও দল বেঁধে হাঁচছিল। হাঁচির বিকল্প হল ‘ফুত’ আওয়াজ করা। তা-ও চলছিল। বিয়ের যাবতীয় উপচার, এমনকী মেয়ের বাড়ির জন্যে দরকারি উপচার, জম্বুমালিকা বা মুখচন্দ্রিকা মালা পাঠিয়ে দিয়েছিল মুকুন্দসঞ্জয়। নববধূ নিয়ে গোরা বাড়ি ফিরলে লোকাচারের প্রয়োজনীয় উপকরণ, ফর্দ মিলিয়ে সে কিনে রাখল। নবদম্পতির তিন রাত ব্রষ্মচর্য পালন, অঙ্গারলবণ অনুষ্ঠানের জন্যে গোরুর দুধ, ক্ষীর, ঘি, মুদ্র, তিল, যব, সামুদ্র, সন্ধব লবণ, যা যা দরকার গোরার বাড়িতে মুকুন্দসঞ্জয় পৌঁছে দিল। মেয়ের বাড়ির উপকরণ কেনার দায়িত্ব তার অভিভাবকদের হলেও মুকুন্দসঞ্জয় কোথাও ফাঁক রাখতে চাইছিল না। অকৃপণভাবে বুদ্ধিমন্ত, মুকুন্দসঞ্জয় খরচ মেটাচ্ছিল। কোথাও কোনও গাফিলতি হওয়ার উপায় ছিল না। বিয়ের আসরে পুরোহিতকে বরের দক্ষিণা দেওয়ার জন্যে দানের গাভী, কন্যাকর্তারা কিনে রাখার বিধি থাকলেও কনৌজ থেকে সেই গাভী কিনে আনিয়েছিল মুকুন্দসঞ্জয়। রাজপণ্ডিত সনাতনকে বুদ্ধিমন্ত, মুকুন্দসঞ্জয় বোঝাতে চাইছিল, বন্ধুর বিয়ের রাতে তার শ্বশুরের মনিব না হলেও তারাই নবদ্বীপের রাজা! সুলতানের নিযুক্ত রাজার চেয়ে কোনও অংশে তারা কম নয়। টাকা খরচ করার সঙ্গে, বিয়ের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে শাস্ত্রীয় আচার আচরণ মেনে চলার বিষয়েও সজাগ ছিল তারা।

শুভকাজের প্রথম ধাপ ব্রতপালন। তার আগে সঙ্কল্প। উপবাস থেকে সঙ্কল্পের শুরু। নান্দীমুখ বা বৃদ্ধি অনুষ্ঠান, প্রকৃতপক্ষে শুভকাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপোস করে থাকার সঙ্কল্প, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।’ দাম্পত্য সম্পর্কে যারা যুক্ত হতে চলেছে, বিয়ের দিন, ভোররাত থেকে তারা উপোস শুরু করবে। রাতে বিয়ের অনুষ্ঠান চুকলে নবদম্পতি অঙ্গারলবণ খাদ্য, অর্থাৎ গোরুর দুধে মুড়ি, তিল, যবের ফলার খাবে। মুখ পাল্টাতে মুড়িতে গাওয়া ঘি, সন্ধব নুন মেখে খেয়ে অনশনব্রত ভাঙবে। পরের তিনদিন, তিন রাত চলবে এই আহার, পরস্পরকে না ছুঁয়ে ঘরের মেঝেতে ঘুমিয়ে এই তিন রাত তাদের কাটাতে হবে। বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরালয়ে ঢুকে প্রথম রাতে নববধূ অভুক্ত থাকবে। বিবাহিত মেয়ের পুত্রসন্তান না হওয়া পর্যন্ত তার শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের বাবা কখনও গেলে, পাতা পেতে ভাত খাবে না। গোরার পরিবারের অভিভাবক, বৈষ্ণব শ্রীবাস পণ্ডিতকে লোকাচার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে না দেখে তাকে একটু খোঁচা দিতে মুকুন্দসঞ্জয় বলল, বিধি-বিধান পালনে কিছু ভুলত্রুটি হলে জানাবেন। লোকাচার অমান্য করলে বিয়ে কিন্তু অসিদ্ধ হয়ে যায়।

শ্রীবাসকে খোঁচা দিতে কথাগুলো বললেও পারিবারিক প্রভাবে ছেলেবেলা থেকে শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন মেনে চলা মুকুন্দসঞ্জয়ের রক্তে মিশে গেছে। বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূর্য, গণপতি—এই পাঁচ দেবতাকে ‘পঞ্চদেবতাভ্যো নমঃ’ বলে ফুল, গঙ্গাজল দিয়ে রোজ দিন শুরু করে সে। নৈষ্য ব্রাক্ষ্মণ হয়েও ধর্মে উদাসীন, গোরার ওপর তার কেন এত স্নেহ, ভালোবাসা, সে নিজেও জানে না।

গায়ে-হলুদ পর্ব চুকলে দুপুরে কিছুক্ষণ গোরা বিশ্রাম করল। বিকেলের আগে তার সমবয়সি বন্ধুরা, দামোদর, মুরারি, জগদানন্দ, মুকুন্দ (মুকুন্দসঞ্জয় নয়, সহপাঠী মুকুন্দ), গদাধর প্রমুখ কয়েকজন বরযাত্রীর সাজপোশাক সেরে এসে গেল। বিয়েবাড়ির কাজকর্ম দেখাশোনা করার সঙ্গে আসর জমাতে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে তারা একটু আগেভাগে হাজির হয়েছিল। গোরার অনুরাগ, নবশাক, ম্লেচ্ছ, শূদ্রপাড়ার আমন্ত্রিত বন্ধুরা এক এক করে আসতে শুরু করলেও তারা ঘরে না ঢুকে, বাড়ির উঠোনে, সদরদরজার বাইরে জটলা করছিল। তাদের মধ্যে সোনার বেনে, গন্ধ বেনে, তিলি, তাঁতি, মালাকার, মোদক, গোয়ালা, তাম্বুলীদের সঙ্গে ছিল আগুড়ি, কামার, কুমোর, যুজি, চাষাধোপা, বাগদি, হাড়ি, ডোম, চাঁড়াল, কৈবর্ত। রাজীকর, পটুয়া, ভাঁড় নর্তকরাও আমন্ত্রণ পেয়েছিল। পাঁচ দিন আগে গোরার তৈরি নিমন্ত্রিতের তালিকা দেখে বুদ্ধিমন্ত আর মুকুন্দসঞ্জয়ের চোখ কপালে উঠেছিল। তাদের মুখ চাওয়াচাউয়ি করতে দেখে গোরা সবিনয়ে জানিয়েছিল, নবশাক, শূদ্রপাড়ার আমন্ত্রিত বন্ধুরা তার বরযাত্রিদলে না থাকলে সম্ভবত এ বিয়ে হবে না। তাকে বিষয়টা নতুন করে ভাবতে হবে।

নরমগলায় গোরা কথাগুলো বললেও, তার কণ্ঠস্বরের অন্তর্নিহিত দার্ঢ্যে মুকুন্দসঞ্জয় চমকে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী, কায়স্থকুলের সন্তান, বুদ্ধিমন্ত শাস্ত্রীয় আচার মেনে চললেও তার বংশপরিচয়ের শেকড় ধরে টানাটানি করলে, সে-ও যে একদা অনার্য, শূদ্র জনজাতিধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল, এ তথ্য তার জানা থাকার জন্যে দৈনন্দর দিনযাপনে জাত-বেজাত নিয়ে সে মাথা ঘামাত না। ছত্রিশ-জাতের উৎসবে, মেহফিলে তার যাতায়াত ছিল। গোরার আমন্ত্রিতের তালিকা সে মেনে নেওয়ায় মুকুন্দসঞ্জয়ও আর মুখ খোলার সাহস পায়নি। বাড়ির সদরদরজার সামনে আমন্ত্রিতের সমাগম বাড়ছে। গোরার নাটগীতের সঙ্গীরা এসেছে জয়ঢাক, বীরঢাক, মৃদঙ্গ, কাহাল, দামামা, দগড় বাঁশি, করতাল, শিঙ্গা, পাখোয়াজ এবং আরও নানা বাদ্যযন্ত্ৰ নিয়ে। খোলাবেচা, অগ্রদানী বামুন, শ্রীধরের গানের সঙ্গে মাদল আর বাঁশি বাজিয়ে নাচছে কলুপাড়ার ষষ্ঠীধর, মালোপাড়ার নকুড়, তাদের সঙ্গে হাতে তালি বাজিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে তাদের বন্ধু, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, ভোলানাথ আরও কেউ কেউ। বিকেলের শুরুতে শ্রীবাস পণ্ডিতের বউ মালিনীর তত্ত্বাবধানে গোরাকে পিঁড়িতে বসিয়ে বরসাজানো যখন শুরু হল, বুদ্ধিমন্তের আটবেহারা বহনাকারী; ফুল, আমপাতা, চন্দন, চাঁদমালাতে সাজানো বিশাল পাল্কি এসে পৌঁছে গেল জগন্নাথের বাড়ির সদরদরজাতে। ময়ূরপঙ্খীর মতো আকৃতি, জমিদার বুদ্ধিমন্তের একাধিক পাল্কি আর চতুর্দোলার মধ্যে এটা সবেচেয়ে সৌখিন পাল্কি। অভিজাত মহলে আমন্ত্রণ রাখতে সাধারণত এ পাল্কি সে ব্যবহার করে। বুদ্ধিমন্ত আর তার বউ, ছেলেমেয়ে ছাড়া, এ পাল্কিতে কারও ওঠার অধিকার নেই। গোরার কপালে অর্ধচন্দ্রাকারে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে তার মাঝখানে কস্তুরী মৃগনাভি থেকে তৈরি সুগন্ধি টিপ লাগান হল। পাকা সোনার বর্ণ, মুখের দু’পাশে শ্বেতচন্দনে অলকাতিলকা এঁকে, দু’চোখে কাজল টেনে, গলায় মোতির মালার ওপরে বেল, যুঁই-মিশ্রিত বড় আকারের গোড়ের মালা পরানো হল। গোরাকে সাজানো দেখতে ঘরের বাইরে দরজার দু’পাশে ভিড় জমে গেছে। গোরাকে দেখতে এসে তার রূপের ছটায় ধাঁধিয়ে গেল মুকুন্দসঞ্জয়ের চোখ। বলিষ্ঠ শরীর, কোনও পুরুষ যে এত রূপবান হতে পারে, মুকুন্দসঞ্জয়ের ধারণা ছিল না। সহাধ্যায়ী বিশ্বরূপের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর শুনে, তার মা, বাবার সঙ্গে বুদ্ধিমন্তকে নিয়ে মুকুন্দসঞ্জয় দেখা করতে এসে জগন্নাথ মিশ্রের পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। বরবেশী, বন্ধু গোরাকে দেখে তার মনে হল, সেদিন শিশু গোরার টানে এই সংসারে সে আর বুদ্ধিমন্ত আটকে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল তার বন্ধু। সেটা ঘটেছিল গোরার উপবীত-গ্রহণের পরে। বিশ্বরূপের গৃহত্যাগের দেড় বছর পরে, গোরা উপবীত-গ্রহণ অনুষ্ঠানে বড় ছেলের দু’বন্ধু বুদ্ধিমন্ত, মুকুন্দসঞ্জয়কে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিল জগন্নাথ মিশ্র। ছেলের অভাব মেটাতে তার দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে জগন্নাথ কাছে টেনে নিয়েছিল। তার পরম স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিল তারা। বিশ্বরূপের উপনয়নেও তার দুই সহাধ্যায়ী হাজির ছিল। সহাধ্যায়ীদের আমন্ত্রণ তখন বিশ্বরূপ নিজে করেছিল। বড় ছেলের উপনয়ন আর ছোটছেলে গোরার চূড়াকরণ, একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চোখের সামনে নাপিতের ক্ষুরে গোরার মাথাভর্তি ঘন চুল কামানো হয়ে গিয়ে লম্বা একটা টিকি অবশিষ্ট ছিল। এর নাম চূড়াকরণ, ব্রাক্ষ্মণ সন্তানদের অবশ্য পালনীয় কৃত্য। গোরাকে অবশ্য তার চূড়াকরণের আগে থেকে বিশ্বরূপের বন্ধুরা চিনত। পথেঘাটে খেলতে দেখেছে তাকে। বিশ্বরূপের অবর্তমানে তার মা, বাবা, ভাই-এর সঙ্গে বুদ্ধিমত্ত, মুকুন্দসঞ্জয় যোগাযোগ রাখত। সেই যোগাযোগের সূত্রে গোরার সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব এবং ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। জগন্নাথ মিশ্রের পরিবারের ক্রমশ সুহৃদ হয়ে উঠল তারা।

গোরাকে বরের বেশে সাজাতে মালিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তার মাসি, চন্দ্রশেখরের বউ মনোরমা। গোরাকে পরাতে রেশমের থলি বোঝাই করে নিজের ব্যবহার করার যত অলঙ্কার বুদ্ধিমন্ত এনেছিল, মাসির হাতে তুলে দিল। মনোরমা থলি নিয়ে দু’আঙুলে গোরার চিবুক ঈষৎ তুলে ধরে বুদ্ধিমন্তকে প্রশ্ন করল, কেমন দেখাচ্ছে বন্ধুকে?

মুচকি হেসে বুদ্ধিমন্ত বলল, দেবরাজ ইন্দ্রের সিংহাসন টলে যাবে।

বুদ্ধিমন্তের কথাতে ঠোঁট টিপে গোরা হাসল। রেশমের থলি খুলে একগাদা অলঙ্কার বার করে সযত্নে সাজিয়ে রাখল মাসি। অলঙ্কারসম্ভার দেখে চকচক করতে থাকল মেয়েদের চোখ। নিজেদের মধ্যে তারা গা-টেপাটেপি করতে থাকল। গোরার দু’বাহুতে রত্নবাজু, কানে হিরে বসানো সোনার কুণ্ডল পরিয়ে, গলার হারের দিকে মাসি হাত বাড়াতে তাকে ঠেকাতে চাইল গোরা। মণিমাণিক্যখচিত সোনার হারের বদলে বেল, যুঁইফুলের টানাপোড়েনে গাঁথা, শুধু গোড়ের মালা, গোরা গলায় রাখতে চাইলেও মাসির চাপে দুটো মালা-ই ধারণ করতে বাধ্য হল। মুগ্ধ চোখে শচী দেখছে ছেলেকে। গোরার সৌন্দর্যে ঘরের ভেতরে, বাইরে দাঁড়ানো মেয়েরা বিহ্বলপ্রায়। শরীরের ওপর অলঙ্কারের বোঝা এড়াতে গোরা হঠাৎ পাশে রাখা পীতবস্ত্রের ভাঁজ খুলতে শুরু করলে, সে পোশাক বদলাতে চায় অনুমান করে, মেয়েদের নিয়ে শচী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরে ঢুকল মুকুন্দসঞ্জয়, গদাধর, ভোলানাথ। দরজার বাইরে কুণ্ঠিতভাবে দাঁড়ানো শ্রীধরকে ঘরে ডেকে নিল গোরা। কোমরে কসি বেঁধে গরদের ধুতি পরে, গায়ে গরদের অঙ্গবস্ত্র জড়াল। পোশাক পরা শেষ হলে জরির কারুকাজ করা শোলার মাঙ্গলিক মুকুট তার মাথায় চাপিয়ে দিল মুকুন্দসঞ্জয়। গোরার ইশারায় ঘরের ভেজানো দরজা শ্রীধর খুলে দিতে বরের বেশে সুসজ্জিত গোরাকে দেখে মেয়েরা আকাশ কাঁপিয়ে উলুধ্বনি দিতে থাকল। শেষ বিকেলের বিলীয়মান, মেদুর আলোয় জেগে উঠল শঙ্খধ্বনি। শাঁখের আওয়াজ শুনে লক্ষ্মীকে গোরার মনে পড়ল। রোজ সন্ধেতে শাঁখের মুখে দুটো লালচে, নরম ঠোঁট ঠেকিয়ে গাল ফুলিয়ে শঙ্খধ্বনি ছড়িয়ে সভক্তি সে সন্ধে দিত। শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে ফিরে বেশ কয়েক মাস পরে গোরা বাড়িতে আবার শঙ্খধ্বনি শুনল। বাড়িতে ফিরে, লক্ষ্মীর মৃত্যুর খবর শুনে মাকে বলা নিজের কিছু কথা, বিশেষ করে ‘এই সংসার অনিত্য’ তার মাথার মধ্যে গুঞ্জন করতে থাকল। খুব কাছের মানুষ যেখানে কয়েক মুহূর্তে চিরকালের মতো চোখের আড়ালে চলে যায়, সেখানে দ্বিতীয়বার সে বিয়ে করতে চলেছে। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলেও পুরোনো গৃহভৃত্য ঈশান ঘরে ঢুকতে গোরা সামলে নিল নিজেকে। সে ভেবেছিল খলাপপুর থেকে কুবেরকে নিয়ে ঈশান ফিরল। ঈশানের পেছনে কুবের রয়েছে। এখনই সে ঘরে ঢুকবে। কুবের ঢুকল না। ঈশানের মুখ থেকে গোরা শুনল কুবেরের খবর। দু’মাস আগে কুবেরকে খলাপপুরের বাড়িতে তার গুরু এসে, তাকে নিয়ে দ্বিতীয়বার পরিব্রাজনে বেরিয়েছে, ঈশানের মুখে এ খবর শুনে গোরা মুষড়ে পড়ল। বিয়ের কথা পাকা হয়ে যাওয়ার পরে খলাপপুর থেকে কুবেরকে আনতে শচী পাঠিয়েছিল ঈশানকে। গোরার সঙ্গে পরামর্শ করে, তাকে দিয়ে আমন্ত্রণপত্র লিখিয়েছিল। গোরাও বিয়ের অনুষ্ঠানে আন্তরিকভাবে কুবেরকে পাশে চাইছিল। ঈশান একা ফিরতে গোরা হতাশ হলেও তার লেখা আমন্ত্রণপত্র কুবেরের বাড়িতে পৌঁছেছে, এই ভেবে সান্ত্বনা পেল। বাড়িতে কুবের যতদিন পরেই ফিরে আসুক, চিঠিটা পাবে। বাজনার আওয়াজ, মানুষের হৈচৈ, কথা, আহ্লাদে ফুটছে সারা বাড়ি। কুবেরের মা-বাবার কাছ থেকে কত স্নেহ যত্ন ঈশান পেয়েছে, গোরাকে তা সে বিশদে শোনালেও বাজনার শব্দে তার গলা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। গোরা চেষ্টা করেও ঈশানের সব কথা শুনতে পাচ্ছিল না। পাঁজিপুঁথি অনুযায়ী যাত্রারম্ভের শুভক্ষণ এসে যেতে পুরোহিত প্রায় জোর করে গোরাকে ধরে নিয়ে গেল। সুসজ্জিত পাল্কির পাশে দাঁড়িয়েছিল গোরার বন্ধুরা। মাকে প্রণাম করে পাল্কির দিকে গোরাপা বাড়াতে উলুধ্বনি আর শাঁখের আওয়াজ, রামচন্দ্রপুরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। পাল্কির পাশে দাঁড়িয়ে বেহারাদের সর্দারকে পথনির্দেশ বোঝাচ্ছে বুদ্ধিমন্ত খান। মখমলের গদি, তাকিয়া পাতা পাল্কির মধ্যে গোরা উঠে বসতে পাল্কি ঘিরে ভাটেরা স্তুতিপাঠ করতে থাকল। আমন্ত্রিত বরযাত্রীদের কপালে মুকুন্দসঞ্জয়, শ্রীধর, গদাধর চন্দন লেপে, বেল, যুঁই, রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিল। দফায় দফায় পান-সুপুরির অর্ঘ্য দেওয়া হতে থাকল অতিথিদের। দু’তিন বার অর্ঘ্য আদায় করল কেউ কেউ। স্তুতিপাঠ শেষ হতে নাচওয়ালারা নাচতে শুরু করে দিল, কাচুকরা আরম্ভ করল কাচকাচুয়া। কেউ সেজেছে শিব, কেউ তম্বুরা হাতে নারদ, কারও হনুমানের বেশ, তারা নেচেকুঁদে, অভিনয় করে আসন নাটওয়ালাদের কোণঠাসা করে দিল। পাল্কিতে বসে আমন্ত্রিতদের সঙ্গে প্রচুর অনাহূত জুটে রঙ্গব্যঙ্গের যে হাট বসিয়েছে, তা দেখে খুশিতে গোরা হাসছিল।

গোধূলি লগ্নে পাল্কি চলল প্রথমে পবিত্র সুরধুনী প্রণামে, গঙ্গার তীরে। বুদ্ধিমন্ত খাঁর রক্ষীবাহিনী পাল্কি ঘিরে এগোতে থাকল। পাল্কির আগে, পেছনে জায়গা করে নিয়েছে প্রবীণ, নবীন বরযাত্রীরা। সকলের আগে মৃদঙ্গ, মাদল, জয়ঢাক, বীরঢাকবাদকের দল। পাল্কির সামনে বরযাত্রীদের প্রথম সারিতে রয়েছে সত্তর ছুইছুই প্রবীণ অদ্বৈত আচার্য, শ্রীবাস পণ্ডিত, চন্দ্রশেখর আচার্য, শুক্লাম্বর ব্রত্নচারী, গোরার দুই মামা যজ্ঞেশ্বর, রত্নগর্ভ, নরহরি সরকার প্রমুখ। পাল্কির পেছনে গদাধর, মুরারি, অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে রয়েছে গোরার নানা কাজের ডানপিটে সঙ্গীরা। ভিন্ন পাড়ার অব্রাক্ষ্মণ বন্ধু কম নেই। বারকোণাঘাট, আপনঘাট, নাগরিয়াঘাটে কয়েক মুহূর্ত থেমে, গঙ্গাপ্রণাম চুকিয়ে, গোরার পাল্কি ধরল নবদ্বীপে মালঞ্চপাড়ায় সনাতন পণ্ডিতের বাড়ির পথ। বরের পাল্কি আসার খবর আগাম পেয়ে, একমাত্র ছেলে গগন আর কয়েকজন নিকট আত্মীয় নিয়ে বাড়ির সদরদরজার বাইরে বর আপ্যায়নের জন্যে তটস্থ হয়ে সনাতন অপেক্ষা করতে থাকল। পথ অন্ধকার হলেও হাতে হাতে দীপাধারে জ্বলছে আলো। সনাতনের বাড়ি হাজার পিদিমের আলোয় উদ্ভাসিত। পথের দু’ধারে গুটিকয় জ্বলন্ত মশাল বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বাজনদাররা সমানে বাজিয়ে চলেছে ঢাক, মাদল, মৃদঙ্গ, বাঁশি, করতাল। ব্রাক্ষ্মণকন্যার শুভবিবাহে ভোজের সঙ্গে পুণ্যার্জনের লোভে বাজনদাররা স্বেচ্ছায় হাজির হয়ে গেছে। বর নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে পাল্কি এসে দাঁড়াল। বরযাত্রীদের সাদর আপ্যায়ন করে পাল্কির ভেতর থেকে গোরাকে কোলে তুলে নামাতে গিয়ে তাকে একচুল নড়াতে পারল না শ্বশুর সনাতন। অনিন্দ্যসুন্দর, দীর্ঘশরীর জামাতাকে কোলে তুলে বরাসনে তাকে পৌঁছানো তার পক্ষে অসম্ভর টের পেয়ে কয়েকজন সাজোয়ান আত্মীয়কে ‘আয় আয়, ইদিকে আয়’ বলে ডেকে নিল সনাতন। বেহারারা তখন কাঁধের পাল্কি সদর দরজার সামনে মাটিতে নামিয়ে রেখেছে। গোরার হাত ধরে তাকে পাল্কি থেকে নামিয়ে সনাতন পিঁড়িতে বসাতে, পাঁচজন শক্তসমর্থ তরুণ বরাসন তুলে ছাদনাতলায় নিয়ে গেল। উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজে ছাদনাতলা মেতে উঠেছে। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে সুসজ্জিতা মেয়েরা। বর দেখে তাদের দু’চোখ এমন বিস্ফারিত, তারা দৃষ্টি সরাতে পারছে না। এত রূপবান যুবক আগে তারা দেখেনি, পৃথিবীতে থাকতে পারে, তাদের কল্পনায় ছিল না। যারা উলু দিচ্ছিল, শাঁখ বাজাচ্ছিল, তাদের কেউ কেউ নিজেদের কাজ ভুলে গিয়ে বরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

যজ্ঞাগ্নি জ্বেলে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু করে দিল দু’পক্ষের দুই পুরোহিত। মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে নবদম্পতির মাথার ওপর টানটান করে মেলে শুভদৃষ্টির পর্ব আসতে মেয়েদের ভিড় জমাট বেঁধে গেল। শুভদৃষ্টির আগে বিষ্ণুপ্রিয়াকে পিঁড়িসুদ্ধ মাটি থেকে তুলে নিল তার দুই পিতৃব্য, দুই দাদা। গোরার পক্ষের নাপিত হেঁকে উঠল, ‘বর বড়, না বউ বড়?’ তরুণ বরযাত্রীরা গলা ছেড়ে বলল, বর বড়।

মেয়েপক্ষের নাপিত ফুঁসে উঠে বলল, বউ বড়।

তাকে গাল পাড়ল বরের নাপিত। মেয়েপক্ষের নাপিত সেই গালের পাল্টা ফিরিয়ে দিল। তারপর মদনদেবকে সন্তুষ্ট রাখতে নাপিতদ্বয় নিজেদের মধ্যে আপোসে যা খিস্তিখেউড় শুরু করল, পুরুষরা কান খাড়া করে তা শোনার চেষ্টা করলেও উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজে অনেকটা ঢাকা পড়ে গেল। পিঁড়িতে বসে থাকা বিষ্ণুপ্রিয়াকে শুভদৃষ্টির মুহূর্তে চোখ খুলে তাকাতে মেয়েদের অনেকে বারবার বললেও লজ্জায় অভিভূত মেয়েটি মাথা নিচু করে থাকল। বয়স্কাদের দু’একজন যখন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘শুভদৃষ্টি না হলে বিয়ে সিদ্ধ হয় না’, তখন বিষ্ণুপ্রিয়া চোখ খুলল। তার চোখের দিকে বিয়ের পিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গোরা তাকিয়েছিল। দু’জোড়া চোখের দৃষ্টি মিলে গেল। দেবোপম সুন্দর মুখ মানুষটা তার স্বামী, ভেবে বিষ্ণুপ্রিয়ার গায়ে কাঁটা দিল। চোখ নামিয়ে পরের মুহূর্তে আবার দেখল স্বামীকে। ভুবনভোলানোহাসি নিয়ে স্বামীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জাবনত বিষ্ণুপ্রিয়ার ঠোঁটে আবছা হাসি জাগল। সামনে দাঁড়ানো অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ, তার স্বামী, শুধু তার, তার একার, বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে হল, স্বপ্ন দেখছে সে।

ছাদনাতলায় পিঁড়িশুদ্ধ বিষ্ণুপ্রিয়াকে নামানোর পরে, অন্যান্য মাঙ্গলিক কর্ম, মালাবদল, ফুল ফেলাফেলি সমাপনের ফাঁকে ঘোমটার আড়াল থেকে সলজ্জ নয়নে চতুর্দশী বিষ্ণুপ্রিয়া স্বামীকে দেখছিল। দেখে তার আশ মিটছিল না। যত বার তাকাচ্ছে স্বামীর কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে। গোরা দেখে ফেলছে তার আড়চোখে তাকানো। পাশাপাশি বসে থাকা স্বামীর মৃদু উম্ন শরীরের তাপ বিষ্ণুপ্রিয়া টের পাচ্ছে। স্বামীর গায়ে গা ঠেকে গেলে তার দেহজুড়ে সুখ ছড়িয়ে পড়ছে। সারা জীবন এই সুখ থাকবে কিনা ভেবে বুকের ভেতরটা ভয়ে দুরদুর করে উঠলে, অমঙ্গল চিন্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে। চোখে জল এলে ঘোমটায় ঢেকে নিচ্ছে নিজের মুখ।

বিবাহ অনুষ্ঠান চুকলে বাসরজাগানিরা বর-কনে নিয়ে বাসরঘরে ঢুকল। হাসি, মস্করা, গা টেপাটেপি, চোখের ইঙ্গিতে মেয়েরা যা বলা উচিত আর যা বলা উচিত নয়, সব-ই জানিয়ে দিচ্ছিল। সকাল থেকে নির্জলা উপোসের সঙ্গে গায়ে হলুদ সমতে নানা লোকাচার পালনে বিষ্ণুপ্রিয়ার চলার শক্তি ছিল না। ক্লান্তিতে শিথিল হয়ে যাচ্ছিল হাত, পা। ছাদনাতলা ছেড়ে ঘরের দরজায় এসে হঠাৎ চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে স্বামীর গায়ের ওপর বিষ্ণুপ্রিয়া প্রায় ছিটকে পড়ল। দু’হাতে সস্নেহে তাকে গোরা আগলে ধরলেও তার হাত থেকে কাজললতা মেঝেতে খসে পড়ল। বিষ্ণুপ্রিয়ার ডান পায়ের নখ উড়ে গিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরছিল। রক্তক্ষরণ ঠেকাতে গোরা নিজের বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে সন্তর্পণে সযত্নে চেপে রাখল বিষ্ণুপ্রিয়ার ক্ষতস্থান, কয়েক সেকেন্ডে থেমে গেল রক্তক্ষরণ। গোরা শুশ্রূষাজড়ানো স্পর্শে সুগভীর আরাম পেল বিষ্ণুপ্রিয়া। তার যন্ত্রণা কমে গেল। নববধূর কানের কাছে মুখ এনে গোরা বলল, ভয় পেও না, এখনই রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে। আমি তো আছি।

হোঁচট খেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে অমঙ্গলের যে ভয় জমছিল, পাশে দাঁড়ানো স্বামীর ‘আমি তো আছি’ এই একটা কথায় তা কেটে গিয়ে আনন্দের ঢেউ জাগল। তার ধারণা হল, এমন স্বামী পেলে হোঁচট-খাওয়া মেয়েদের জীবনে শুভফলও নিয়ে আসতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *