গোরা – ২

বেলা এগারোটায় ঘুম ভাঙতে গোরা টের পেল, নেশার খোয়ারিতে মাথা ভার হয়ে আছে। আগের রাতে ঠিক কখন বাড়ি ফিরল, ঘড়িতে ক’টা বেজেছিল, সদর দরজা কে খুলল, কীভাবে নিজের ঘর পর্যন্ত পৌঁছল, মনে করতে পারছিল না। একদম পারছে না, এমন নয়। দরজা খুলেছে রামলগন সিং। সদর দরজায় সে চৌকি দেয়, একতলা আগলায়, চল্লিশ বছর ধরে এই কাজ করছে। বয়সের গাছপাথর নেই। ছোটকাকাকে জন্মাতে দেখেছে। রাত দেড়টা, দুটোতে রামলগন ছাড়া কে দরজা খুলবে? দোতলায় যারা থাকে, তারা তো তখন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। তাই স্বাভাবিক। মাঝরাতে তার জন্যে কে জেগে থাকবে? সে তা চায়ও না। বাড়িতে ফেরার বাসি স্মৃতি, ঘন কুয়াশার আস্তরণের মতো মাথায় ছড়িয়ে থাকলেও, কুয়াশার ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু ঘটনা মনে পড়তে থাকল। অ্যালকোহল বেশি টানলে মাথার মধ্যে হঠাৎ নিষ্প্রদীপ, ‘ব্ল্যাকআউট’ হয়ে যায়। তখন চারপাশে শুধু অন্ধকার, স্মৃতির একবিন্দু আলো কোথাও নেই, তখন জৈবিক অভ্যেসে রুটিনমাফিক কাজ মানুষ করে যায়। নেশা কেটে গেলে সেই অন্ধকার সময়ের কোনও ঘটনা মনে রাখতে পারে না। পরে অনুভব করে, কিছু সময়ের জন্যে সে জীবিত ছিল না, মৃত অবস্থায় কাটিয়েছে। বেশ কয়েকবার গোরার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। কাল রাতের নিষ্প্রদীপ সময়ের কিছু ছবি তার মগজে জেগে উঠছে। প্রায় রাত দেড়টায়, নিজের ঘরে ঢুকে যে পোশাক বদলেছে, এখন দেখতে পাচ্ছে। প্যান্ট, শার্ট ছেড়ে পাজামা, হাফহাতা পাঞ্জাবি পরেছিল। এটাই তার রাতের পোশাক। কখন পোশাক ছাড়ল, পাজামা, পাঞ্জাবি পরল, খেয়াল নেই। অথচ, বদল যে হয়েছে, নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে। কে বদলাল, সে, না আর কেউ? তার ভেতরে অন্য আর একজন আছে, সে টের পায়। তার পরিচয়, গোরা জানে না। সে কে?

বৈভবের বাইকের পেছনে বসে রাতের নির্জন, উড়ুক্কু কলকাতার পথ, পার্ক স্ট্রিট থেকে শোভাবাজার, কীভাবে পৌঁছে গেল, মনে করতে গিয়ে মাথার মধ্যে সুবিপুল শূন্যতা ছাড়া কিছু খুঁজে পেল না। কলকাতার রাস্তা উড়ছিল, না তাদের ডানা গজিয়েছিল, এই মুহূর্তে স্মরণ করা মুশকিল। তবে হোটেলের একতলায় এসে নিজের মোটরবাইকে বৈভব উঠতে পারছিল না, তার মনে আছে। দশ সিলিণ্ডারের ভারি বাইকটা সোজা করে ধরতে যে বৈভব টলমল করছিল, সে পেছনে সওয়ারি নিয়ে, কীভাবে দু’চাকার গাড়িটা চালাবে, এ প্রশ্ন মনে জাগলেও গোরা সাড়া করেনি। বৈভবের বাইকে বসে আগেও কয়েকবার গভীর রাতে সে বাড়ি ফিরেছে। নেশায় তখন দু’জনেই চুর হয়ে ছিল। সে জানে, বাইকে একবার বৈভব বসতে পারলে, প্যাডেলে কিক্ করে ইঞ্জিন চালু করতে পারলে, তারপর সে পাকা ড্রাইভার, তার হাত কাঁপে না, বুক কাঁপে না, পৃথিবীর যে কোনও ঠিকানাতে সে অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারে। বাইকে তাকে তুলে শুধু ইঞ্জিনটা চালু হওয়া পর্যন্ত পেছনের সওয়ারিকে অপেক্ষা করতে হয়। তারপর আর ঝামেলা নেই। ‘মন্ত্র’-এর গেটকিপাররা পর্যন্ত জেনে গেছে মাঝরাতে বৈভবের বাইক চালানোর গোপন কেরামতি। বাইক খাড়া রেখে, তার সিটের ওপর প্রায় পাঁজাকোলা করে বৈভবকে তুলে কাল রাতে তারা বসিয়ে দিয়েছিল। বাইকের ইঞ্জিন চালু হতে বৈভবের পেছনে গোরা বসেছিল। মাথার মধ্যে তখন নিষ্প্রদীপ জারি হয়ে গেলেও বাইকে চাপতে কোনও রক্ষির সাহায্য সে নেয়নি, মনে করতে পারল। মুহূর্তে উড়ুক্কু হয়েছিল রাতের ফাঁকা রাস্তা।

বেলা বাড়ার সঙ্গে গোরার খোয়ারি যত কেটে যাচ্ছে, নিষ্প্রদীপে ডুবে কাল রাতে বাড়িতে ফেরার ঘটনাস্রোতে চেতনার কোনও ঘুলঘুলি দিয়ে তত বেশি করে আলো এসে পড়ছে। বাইকে, বৈভবের পেছনে বসে রাত দেড়টায় যার খোঁজে বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর এক চক্কর দিয়ে, পার্ক স্ট্রিট মুখো গড়ানে রাস্তার ডিভাইডারের মাঝ বরাবর কয়েক মিনিটের জন্যে বাইক নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে গেল বছরের শেষ দিনে, একত্রিশে ডিসেম্বর, রাত দুটোয় বাইক দুর্ঘটনায় স্কুলের বন্ধু ঋতবান মারা গিয়েছিল। বছরের শেষ রাতের সেই তুমুল প্রহরে, কলেজের এক বন্ধুকে, পার্ক স্ট্রিট থেকে কোনা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে একশো মাইল বেগে বাইক চালিয়েছিল ঋতবান। মন্ত্রের সদস্য ছিল না সে। আলাদা ঠেক ছিল তার, সন্ধের পরে সেখানে যেত। একত্রিশে ডিসেম্বরের প্রমত্ত রাতে তার রয়াল এনফিল্ড বাইক একশো মাইল বেগে এসে ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে রাস্তা থেকে প্রায় দশ ফুট উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে, ডিভাইডারের দু’পাশে পড়েছিল দু’জন। দুর্ঘটনা চোখে দেখেও বাইকের পেছন থেকে আসা ঝোড়ো গতির লরি ড্রাইভার ঝামেলা এড়াতে দ্বিগুণ বেগে ট্রাক নিয়ে চলে যায়। মালভর্তি ট্রাকের চাকার তলায় গুঁড়িয়ে যায় ঋতবানের মাথা। ঋতবানের বন্ধুকে চলন্ত কোনও গাড়ি স্পর্শ না করলেও বাইক থেকে দশ গজ দূরে ছিটকে পড়ে, পৃথিবী থেকে সে বিদায় নেয়। তার মাথাতে হেলমেট ছিল না। ঋতবানও সম্ভবত মাঝরাতে হেলমেট পরার দরকার বোধ করেনি। ডিভাইডারের গায়ে কাত হয়ে সে পড়ে থাকার একশো গজের মধ্যে কোনও হেলমেট পাওয়া যায়নি। ‘মন্ত্র’ থেকে কাল রাত একটায় বেরিয়ে নিষ্প্রদীপে ভরাডুবি চেতনায়, দু’জনের ইচ্ছে হয়েছিল গেল বছরের একত্রিশে ডিসেম্বর রাতের দুর্ঘটনাস্থলটা একবার দেখার। সেখানে হয়তো রক্তমাখা শরীরে ঋতবান এখনও শুয়ে রয়েছে। অনতিদূরে, মাথার ঘিলু ছিটকে যাওয়া, ঋতবানের বন্ধু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ভাড়া করে দু’জনকে কলকাতার সেরা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করে দেবে। মাথা বোঝাই অন্ধকার নিয়ে গোরা, বৈভব কারও খেয়াল ছিল না জীবিত, মৃতের ফারাক। দুর্ঘটনার সাত মাস পরে তারা আশা করেছিল, অকুস্থলে মৃত আর জীবিত একাকার হয়ে পুনর্জীবন পাওয়ার আশায় শুয়ে আছে। বাইকে বৈভব বসে থাকলেও গোরা নেমে পড়েছিল। একত্রিশে ডিসেম্বর রাতে দুরন্ত গতির ‘রয়াল এনফিল্ডে’র ধাক্কায় কেঁপে ওঠা ডিভাইডারের পাশে দাঁড়িয়ে উথলে ওঠা শোকাবেগে গোরা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল। অবাক হয়ে তাকে দেখলেও বাইক থেকে বৈভব নামতে পারছিল না। বাইক ছেড়ে নেমে পড়লে ফের চালকের আসনে উঠে বসতে পারবে কি না এই নিয়ে তার সন্দেহ ছিল বাইক থামিয়ে সে টের পাচ্ছিল, মাথার ভেতরে টলমল ভাব বেড়ে যাচ্ছে। বাইক নিয়ে উড়ন্ত থাকতে চাইছিল সে। বাইকে বসে ঋতবানের জন্যে কাঁদার চেষ্টা করে, সে টের পেল কাঁদতে ভুলে গেছে। অফিসে, নিজের লকারের চাবিটা পকেটে ঠিকঠাক আছে কিনা, দাবনার ওপরে হাত বুলিয়ে দেখে নিল।

ঋতবানের জন্যে আকুল হয়ে কাঁদার সময়ে গোরা জানল, জীবনে এই প্রথমবার কাঁদছে সে। কাঁদতে ভালো লাগছিল। চোখের জলে মন যে এভাবে ধুয়ে যায়, নিষ্প্রদীপ মগজেও সে অনুভব করছিল। মুগুর, বারবেল নিয়ে রোজ শরীরের কসরৎ করার পাশাপাশি, কিছু সময় রোজ কাঁদার জন্যে আলাদা করে রাখা দরকার। আকাশ থেকে বিদ্যাসাগর সেতুর ডিভাইডার পর্যন্ত আলো-অন্ধকারে মিশে থাকা ঋতবানকে গোরা বলল, তোকে আমি ভুলিনি, ভুলব না। কথা দিলাম, তোকে ভেবে মাঝে মাঝে কাঁদব।

মাঝরাতে বিদ্যাসাগর সেতুতে এক চক্কর মেরে বাড়ি ফেরার ঘটনা মনে পড়তে, গোরার মাথায় তখনই যে চিন্তা জাগল, তা হল, শোভাবাজারের বাড়িতে তাকে নামিয়ে বৈভব ঠিকমতো বাড়ি পৌঁছেছে তো? বৈভব থাকে সল্টলেকের মাঝখানে কোনও একটা ব্লকে। বাড়িটা চিনলেও ঠিকানা মনে রাখেনি গোরা। বৈভবকে ফোন করতে রিসিভার তুলেও গোরা নামিয়ে রাখল। আজ রবিবার। বৈভব অফিসে যাবে না। বাড়িতে ফোন করার কথা ভেবে মনে হল, বাড়িতে বৈভব না পৌঁছোলে তার মা ফোন করত তাকে। বৈভব সম্পর্কে কোনও খবর নিতে হলে, গোরাকে সবার আগে ফোন করতে হয়, বৈভবের পরিবারের সকলেই একথা জানে। তবুও অস্বস্তিতে খচখচ করছে গোরার মন। মাঝরাতে যে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে, সকালে তার খোঁজ নেওয়া উচিত। বৈভবের কাছে সে উপকৃত। উপকার যে নেয়, উপকারকারীকে তার মনে রাখা উচিত। বৈভবের খোঁজ নেওয়ার দায় তার আছে। ফের রিসিভার তুলে বৈভবের বাড়ির টেলিফোন নম্বরের আটটা বোতাম টিপল সে। টেলিফোন বাজতে রিসিভার তুলল বৈভবের মা। গোরার গলা শুনে চিনতে পেরে বলল, বৈভব তো সকাল আটটায় গল্ফ খেলতে টলি ক্লাবে গেছে। বারোটার আগে ফিরবে না। তুমি ফোন করেছ, বলে দেব।

ফি রবিবার সকালে টলি ক্লাবে বৈভবের গল্ফ খেলতে যাওয়া, গোরার অজানা নয়। বৈভবের সঙ্গে কথা বলার জন্যে তাকে গোরা ফোন করেনি। ফোনে তার যা জানার ছিল, জেনে গেছে। কাল রাতে অক্ষত শরীরে বাড়ি পৌঁছে গেছে বৈভব। ব্যস্, এটাই সে জানতে চেয়েছিল এবং জেনে গেছে। তবে যে কথাটা বৈভবকে তার বলার আছে, তা হল—তার বাড়িতে তিন-চারটে গাড়ি থাকতে, রাতে বাইক নিয়ে তার ‘মন্ত্র’-এ আসা ঠিক নয়। বাইকে এলে স্বেচ্ছাচারীর মতো মাল টানা ছাড়তে হবে। মাল খেয়ে ‘হাই’ হয়ে আর একজন মাতালকে লিফ্ট দেওয়া উচিত নয়। ‘মন্ত্র’ থেকে আর কোনও রাতে বৈভবের বাইকে চেপে বাড়িতে না ফেরার কথা এই মুহূর্তে ভাবলেও, গোরা জানে, কাল, পরশু, যে কোনও মাঝরাতে প্রতিজ্ঞা ভাঙবে সে। তার কাছে গাড়ি না থাকলে, বৈভবের সঙ্গে ‘মন্ত্র’ থেকে বেরিয়ে তার বাইকের পেছনে অবলীলায় চেপে বসবে। বাইক চেপে বৈভবকে ‘মন্ত্র’-এ আসতে বারণ করলে, সে কী বলবে, গোরা জানে। একচোট হেসে বৈভব বলবে, মাতালকে বাঁচায় তার ভগবান, সেও মাতাল। তার দিনরাত্তির নেই। সব সময়ে সে জেগে থাকে। আমার বাইকে চাপলে তোর কোনও বিপদ হবে না।

মজা করে কথাগুলো বৈভব বললেও কয়েক সেকেন্ড পরে গম্ভীর মুখে জানায়, দুর্ঘটনায় মৃত্যু তার হবে না। কাশীর জ্যোতিষাচার্যের বানানো তার কুষ্ঠি অনুযায়ী, হেসে খেলে সে আশি বছর, দু’চার বছর বেশিও হতে পারে, বাঁচবে। বৈভব মুখে যাই বলুক, ঈশ্বর আর জ্যোতিষশাস্ত্রে তার অগাধ বিশ্বাস। সকালে দপ্তরে পৌঁছে শ্বেতপাথরের কুলুঙ্গির মধ্যে গণেশ ঠাকুরের গলায় মালা চাপিয়ে সে ব্যবসা শুরু করলেও সন্ধের পরে নাস্তিক বন্ধু গোরার সঙ্গে আড্ডা না মারলে তার পেটের ভাত হজম হয় না।

বিছানায় উঠে বসে গোরা টের পেল, মাথাটা ধরে রয়েছে। বিরক্ত হলেও সে জানে, একটা অ্যাসপিরিন খেয়ে ভালো করে চান করলে মাথাধরা চলে গিয়ে মেজাজ চনমনে হয়ে ওঠে। বিছানা থেকে নেমে সে তাই করল। পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা অ্যাসপিরিন বার করে সেটা মুখে পুরে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেল। রবিবারের সকাল। আজ কারও অফিস কাছারি নেই, সকলে বাড়িতে রয়েছে। সকলে মানে, বাবা, ছোটকাকা, স্কুলে যারা যায়, সেই ভাইবোনেরা। তার ডাক্তার জ্যাঠা, দক্ষিণ কলকাতায় প্রাসাদের মতো বাড়ি বানিয়ে যে থাকে, যত ঝড়বৃষ্টিই হোক, আকাশ ভেঙে পড়ুক, ফি রবিবার বিকেলে শোভাবাজারের বাড়িতে একবার আসবেই। তাই ছোট দু’ভাই, তাদের বউ-ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হৈ চৈ করে আড্ডা মেরে, কলকাতার সবচেয়ে দামি, দুর্লভতম ডাক্তার বিপুল আনন্দ পায়। হপ্তায় এই একটা দিন জ্যাঠার ছুটি। রুগি দেখে না। চোখের সামনে রুগি মরে গেলেও স্টেথো তুলে কানে লাগায় না। রুগির আত্মীয়স্বজন চাইলে, চেনা কোনও ডাক্তার, রবিবারেও যে রুগি দেখে, তেমন একজনকে জুটিয়ে দেয়। ডাক্তারকে ফোন করে রুগি দেখে দিতে অনুরোধ করে। হাজার টাকার ডাক্তারের অনুরোধ, কমদামি উঠতি কোনও ডাক্তার, অমান্য করতে পারে না। জ্যাঠার সঙ্গে গোরার দারুণ দোস্তি। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুধু জ্যাঠার সঙ্গে সে করতে পারে। জ্যাঠাকে সাফসুফ জানিয়ে দিয়েছে, মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার বিমান চালাতে চায় সে।

জ্যাঠা, তাকে ডাক্তার অথবা তার বাবার মাপের আইনজীবী করতে চেয়ে এমন জবাব শুনেছে যে, জ্যাঠার মুখে কথা সরেনি। কলেজে পড়ার আগে জ্যাঠাকে এক বিকেলে বলেছিল, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার দেখে চোখ হেজে গেছে। ওসব ‘মান্ডেন’ পেশায় আমি যেতে চাই না, অন্যরকম হতে চাই আমি।

ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠে জ্যাঠা জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কী হতে চাস?

তার কলেজে পড়ার আগের ঘটনা এটা। সে বলেছিল, শূন্য হতে চাই।

আকাশের দিতে আঙুল তুলে জ্যাঠা জিজ্ঞেস করেছিল, ওইরকম?

হ্যাঁ, তার চেয়ে বেশি।

সেটা কী?

জ্যাঠার প্রশ্নের জবাব সেই মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব না হলেও কয়েক বছর পরে কলেজে পড়ার সময়ে দিয়েছিল। ভারতীয় মেয়ে, কল্পনা চাওলা প্রথমবার সফল মহাকাশ ঘুরে তখন ফিরে এসেছে। কল্পনার চেয়ে বেশিদূর যাওয়ার বাসনায় জ্যাঠাকে তখনই এক রবিবারের বিকেলে বলেছিল, মঙ্গলগ্রহে যাতায়াতের বিমান চালক হতে চায় সে। তার জবাবে জ্যাঠা খুশি হয়েছিল। বলেছিল, খুব ভালো লাইন বেছেছিস তুই। তোর সেজকাকা যখন হাউসটনে নভোবিজ্ঞানী, তখন তোকে ঠেকায় কে? মঙ্গলগ্রহে যাতায়াতের বিমান তুই চালালে, আমি নিশ্চয় সেখান থেকে একবার ঘুরে আসব।

তুমি একা নয়, জ্যেঠিমাও যাবে।

সে তো বটেই। আমাকে ‘থোড়ি’ একা ছাড়বে তোর জ্যেঠিমা? তবে একটাই অসুবিধে।

কী অসুবিধে?

ততদিন বাঁচব তো?

নিজে ডাক্তার হয়ে তুমি কী যে বল?

আরও একবার হা হা করে হেসে জ্যাঠা বলেছিল, তা ঠিক, মানুষ মরণশীল। ডাক্তাররা অমানুষ, তাই তাদের মরণ নেই, তারা যমের অরুচি।

স্কুলজীবন থেকে জ্যাঠার সঙ্গে তার যে কথাচালাচালি শুরু হয়েছিল, তা আজও থামেনি। তবে এখন প্রশ্নোত্তর চলে ঠারেঠোরে। মঙ্গলগ্রহের বিমান চালক হওয়ার আগে তাকে কিছু লেখাপড়া সেরে নেওয়ার পরামর্শ হাউসটন থেকে সেজকাকা দিয়েছিল। ‘গ্র্যাজুয়েশন’ করে ‘ম্যানেজমেন্ট’-এ একটা ডিগ্রি জোগাড় করতে বলেছিল। ম্যানেজমেন্ট পড়ার সুযোগ পেতে প্রতিযোগিতামূলক ‘ক্যাট’ পরীক্ষায় বসে পাশ করতে হয়। ‘ক্যাট’-এ বসার জন্যে গোরার তৈরি হওয়ার খবর জ্যাঠার কানে যাওয়ার কয়েক মাস পরে এক সন্ধেতে ‘ক্যাট’ পরীক্ষার্থী ভাইপোকে জ্যাঠা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বেড়াল’ পোষ মানছে?

মানছে, খুব ধীরে ধীরে।

ইঁদুরের পাশে শুয়ে ঘুমোয়?

জ্যাঠা, ভাইপোর এই কথা বিনিময়ের মানে, তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ হদিশ করতে পারে না। রবিবারের এই সকালে, বাড়িতে এখন টপ্ গ্যাঞ্জাম। একতলা থেকে চেনা, অচেনা নানা জনের গলা ভেসে আসছে। অ্যাসপিরিন খেয়ে বিছানায় বসে, দু’তিনবার আড়মোড়া ভেঙে কলঘরে ঢুকল গোরা। দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে, শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকল। যে ঋতবান পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, তার সঙ্গে কাল গভীর রাতে কেন দেখা করার ইচ্ছে হল, ভেবে পেল না। মাতাল হয়ে গিয়েছিল, অনুমান করে লজ্জা পেল। ‘মন্ত্র’ থেকে ঐশী চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে স্বাভাবিক ছিল। তারপর আরও দু’পেগ রাম খেয়ে লোপাট হয়ে গেল তার কাণ্ডজ্ঞান। মাথার খুপড়ি জুড়ে তখন শুধু অন্ধকার।

খোলা শাওয়ার থেকে একটানা মাথায় জল ঝরে পড়ছে। মুখ, পিঠ, বুক বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঠাণ্ডা জলের স্রোত। ভারি আরাম লাগছে তার। মাথাধরা কমে গেছে। তখনই তার খেয়াল হল, কাল রাতে কী একটা বই ঐশী যেন পড়তে বলেছিল। নামটা বেশ কী?

দু’সেকেন্ডে মনে পড়ে গেল বইটার নাম। হ্যাঁ, ‘গোরা’। তার নামেই উপন্যাসের নাম ন্যাশানাল অ্যানথেমের লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস। ছোটকাকির আলমারিতে বইটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কী আছে সেই বই-এ? বইটা কেন তাকে পড়তে বলল ঐশী? তার সঙ্গে বই-এর গোরার যে মিল ঐশী খুঁজে পেয়েছে, তা কি সত্যি? বই পড়ে সেও কি এই মিল দেখতে পাবে?

স্নান সেরে রাতের পোশাকের বদলে বাড়িতে কাচা আর এক সেট পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছোটকাকির ঘরে গেল সে। ‘গোরা’ উপন্যাসটা চাইতে রবীন্দ্র রচনাবলীর মোটা একটা খণ্ড তার হাতে দিয়ে কাকি বলল, রবীন্দ্র রচনাবলীর এই নবম খণ্ডের প্রথম উপন্যাস, ‘গোরা’। বইটা দিয়ে মুচকি হেসে ছোটকাকি জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ উপন্যাস পড়ার সখ হল কেন? তাও ‘গোরা’?

গোরা জবাব না দিতে ছোটকাকি ফের প্রশ্ন করল, কতদিন পরে বাংলা বই হাতে ধরলি?

উপন্যাসের কিছু পাতা, এলোমেলো উল্টে গোরা জিজ্ঞেস করল, লেখাটা কি খুব শক্ত?

বলব কেন? পড়ে জেনে নাও।

পড়ে বুঝতে পারব?

বলছিস কি? বাঙালি ঘরের ছেলে হয়ে বাংলা বই পড়ে বুঝতে পারবি না?

লজ্জিত মুখে গোরা বলল, বাংলা বই পড়া তো অভ্যেস নেই!

তাতে কিছু আসে যায় না, পড়লেই বুঝতে পারবি।

গোরাকে কিছুটা সাহস জুগিয়ে ছোটকাকি বলল, সকালে লুচি, আলু ফুলকপির তরকারি হয়েছে, খেয়েছিস?

না। এবার খাব।

কত রাতে কাল বাড়ি ফিরেছিস?

সকাল হওয়ার আগে।

বেলা এগারোটা পর্যন্ত তোকে ঘুমোতে দেখে বুঝেছি। তোর বাবা খুব রেগে আছেন। মা-ও। সাবধান!

রোজ-ই আমি বেলা পর্যন্ত ঘুমোই। তাছাড়া কাল সন্ধের পর থেকে কোথায় ছিলাম, মা-বাবা জানে।

তা তো আমি জানি না।

বইটা নিয়ে গোরাকে পাতা উল্টোতে দেখে ছোটকাকি জিজ্ঞেস করল, তোদের ‘মন্ত্র’-এ কবে নিয়ে যাবি আমাকে?

আজ যাবে?

গোরা যে এমন ফাঁদে ফেলবে ছোটকাকি ভাবেনি। ঈষৎ থতমত খেয়ে বলল, এমন হুট করে যাওয়া যায় না।

একটু থেমে, ঈষৎ ভেবে ছোটকাকি বলল, পরশু যাব।

পরশু কেন?

তোর কাকাকে রাজি করাতে অন্তত আটচল্লিশ ঘণ্টা লাগবে।

গোরা কথা না বলে হাসল। ঘর থেকে সে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কাকি বলল, বইটা পড়বি চেয়ার টেবিলে বসে। বিছানায় শুয়ে পড়লে তোর যা ঘুম, টানা দু’তিন পাতা পড়তে পারবি না। পড়ার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বি।

গোরা বলল, বিছানায় শুয়ে বই পড়তে শুরু করে কত রাত না ঘুমিয়ে কাবার করে দিয়েছি, তুমি জানো। বইটা কি, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করে।

কথাটা ভুল নয়, কাকি আবার ঠোঁট টিপে হাসল। নবম খণ্ড, রবীন্দ্র রচনাবলী নিয়ে ছোটকাকির ঘর থেকে বেরিয়ে এক তলায় গিয়ে লুচি, তরকারি, চা খেয়ে দোতলায় নিজের ঘরে ফিরে এসে, রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে গোরা টি.ভি চালিয়ে দিল। টেলিভিশনের পর্দায় যে গায়কের মুখ ভেসে উঠল, তিনি ভীমসেন যোশি। টি.ভি চালিয়েই যে প্রিয় গায়কের গান শুনতে পাবে, গোরা ভাবেনি। গান, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সে ভালোবাসে। শুদ্ধ ইমনকল্যাণ রাগে, ঠাট হিন্দিতে ‘সাঁইয়া মুঝে স্মরণ সে না ছোড়’ লাইনটা ঘুরে ফিরে তিনি গেয়ে চলেছেন। ফি বার গোলাপ কুঁড়ির মতো নতুন পাপড়ি মেলছে সুর, ফুটে উঠছে আস্ত একটা ফুল। টিভির আওয়াজ সামান্য কমিয়ে, রবীন্দ্র রচনাবলীর নবম খণ্ডের প্রথম উপন্যাস ‘গোরা’ খুলে, ছোটকাকির বারণ সত্ত্বেও বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে সে পড়া শুরু করল। প্রথম তিন-চার পাতা তরতর করে পড়ে, তারপর ক্রমাগত হোঁচট খেতে লাগল। যত এগোচ্ছে, তত দুষ্পাঠ্য হয়ে উঠছে উপন্যাস। পরেশবাবু, সুচরিতা, ললিতা, বিনয়, গোরা, কাহিনীর চরিত্রগুলো যেন দম দেওয়া ডলপুতুল। গোরার সঙ্গে নিজের কোনও মিল সে খুঁজে পাচ্ছে না। তার একশো বছর আগে যে গোরা জন্মেছিল, সে এমন ম্যাদামারা হবে, তার ধারণা ছিল না। ঐশী কি তাকে বোকা বানাতে কাল এই বইটা পড়তে বলেছিল? তার নামের সম্মান খেলো করেছে রবীন্দ্রনাথের গোরা।

ঘুমে দু’চোখ বুজে আসতে বিছানার ওপর গোরা ধড়ফড় করে উঠে বসল। গেল রাতের খোয়ারি, না রবিঠাকুরের উপন্যাস, কোন কারণে ঘুমে দু’চোখ জুড়ে আসছে, বুঝতে পারল না। ছোটকাকির কথামতো বিছানায় শরীর এলিয়ে দেওয়ার বদলে উপন্যাসটা বসে পড়া শুরু করল। খাটের বাজুতে ঠেস দিয়ে সোজা হয়ে বসল। বাইশ পাতা পর্যন্ত একটানা পড়ে, তারপর খাবলে খাবলে পড়তে শুরু করল। বিশেষ করে যেসব জায়গায় উপন্যাসের নায়ক ‘গোরা’ রয়েছে, সেই পাতাগুলোতে চোখ বুলোতে থাকল। বাংলা উপন্যাস, আগে সে পড়েনি এমন নয়। স্কুলে থাকতে ‘পথের পাঁচালি’ পড়েছে, পড়েছে ‘পথের দাবী’, সে সব রচনা খারাপ লাগেনি। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’র ‘পথ’ আর বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’র ‘পথ’, দুটো পথ যে আলাদা বুঝতে পেরেছিল। বুঝে আনন্দ পেয়েছিল। ‘গোরা’ পড়তে গিয়ে নায়কের ভাষণবাজির ঠেলায়, প্রতি লাইনে হোঁচট খাচ্ছে। হোঁচটে জর্জরিত গোরার ধারণা হল, রবিঠাকুর বড় কবি হতে পারেন, কিন্তু উঁচুমানের ঔপন্যাসিক নন।

কথাটা মনে হতে লজ্জা পেল সে। রবিঠাকুরের লেখা সম্পর্কে সে কতটা জানে? খুবই কম। তা নিয়ে কথা বলার এক্তিয়ার তার নেই। ছোট মুখে বড় কথা মানায় না। গভীর অভিনিবেশ নিয়ে সে আবার উপন্যাসের পাতায় চোখ রাখল। আধপাতা পড়ে থেমে গেল। বাংলা উপন্যাসের সংলাপ এত বানানো হতে পারে, তার ধারণা ছিল না। সংলাপগুলো আগে ডাইরিতে লিখে নিয়ে, তারপর সেগুলো শোনানোর জন্যে লেখক যেন উপন্যাস লিখতে বসেছিলেন। শুধু কথা আর কথা, বানানো কথার ফুলঝুরি। সোজা হয়ে বসেও তার দু’চোখ বুজে আসতে থাকল। পাতার পর পাতা গোরার সঙ্গে নিজের মিল, তন্নতন্ন করে খুঁজেও হদিশ করতে পারল না। চেহারা আর বয়সে কিছু মিল থাকলেও, স্বভাবে হাজার মাইলের ব্যবধান! রবীন্দ্রনাথের সময়ে কুড়ি-বাইশের পুরুষরা এত ন্যাকা ছিল, ভাবা যায় না। ব্রা আর হিদু, দু’ধর্মের পুরুষরাই ছিল সমান মেয়েলি। মেয়েগুলো ছিল ললিতলবঙ্গলতা, ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়ার মতো তাদের হাবভাব।

গোরার দু’চোখ ঘুমে যখন বুজে আসছে, বিছানায় সোজা হয়ে বসে থাকা অসম্ভব মনে হচ্ছে, দ্রুত পাতা উল্টে উপন্যাসের শেষ দিকে সে হঠাৎ ধাক্কা খেল। যে কৃদয়াল, আনন্দময়ীকে বাবা, মা জেনে হিন্দুধর্মের মহিমা প্রতিষ্ঠায় গোরা হাঁকডাক করে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ সে জানল, তার আসল বাবা-মা কৃষ্ণদয়াল, আনন্দময়ী নয়। মৃত এক আইরিশ দম্পতির ছেলে সে। জন্মের পর থেকে সে অনাথ, আনন্দময়ী কৃষ্ণদয়ালের কাছে সে মানুষ হয়েছে। তারাই তার প্রতিপালক মা-বাবা। কাহিনীর এই অংশ পড়ে গোরা ভ্যাবাচাকা খেলেও, পরের মুহূর্তে মনে হল, ঘটনাটা শুধু নাটুকে নয়, কষ্টকল্পিত। রবীন্দ্রনাথের মতো লেখককেও কষ্টকল্পনার সুযোগ নিতে হয়, গাছে তুলতে হয় গল্পের গরুকে। ভাবা যায়, মহাকবির কল্পনা এত ‘বামন’ হয়ে যেতে পারে! সব সংস্কার ঝেড়ে ফেলে গোরাকে বড় মাপের মানুষ হিসেবে দেখাতে, তাকে আইরিশ বানানো কি খুব দরকার ছিল? ভারতীয় পরিবারে, বাঙালি মা-বাবার কোলে জন্মালে কি সংস্কারমুক্ত, উদার মানুষ হওয়া যায় না!

গান শেষ করে ধ্রুপদী নানা রাগের নমুনা গেয়ে শোনাচ্ছেন যোশিজী। ব্যাখ্যা করছেন ভারতীয় রাগ-রাগিণীর ধ্রুপদী ধারা। টেলিভিশন থেকে চোখ সরিয়ে গোরার পাতাতে সে ফিরে এল। দু’পাতা পড়ার মধ্যে টের পেল যোশিজীর অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। উপন্যাসের শেষ কয়েক পাতা পড়ার আগে খাটের বাজুতে ঠেস দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল। হাত থেকে মেঝেতে খসে পড়ল রবীন্দ্র রচনাবলীর নবম খণ্ড। ঘুমের মধ্যে কানে এল, বাতাসে ভাসন্ত গানের সুর। চেনা গান, চেনা সুর, তবু গানের কথাগুলো কুয়াশার মতো ঝাপসা ঠেকছে। কথা মনে না পড়লেও সুরের জাদুতে আরাম আর আনন্দ পেল সে। খুব বেশি আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট, হাল্কা ঘুমের সঙ্গে স্বপ্নজড়ানো সুরের গভীরে ডুবে থাকল। নিচে কোথাও ভারি কোনও কাঁসার বাসন পড়ে যাওয়ার সুতীব্র ধাতব শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে যেতে খাটের বাজুতে মাথা রেখে আধশোয়া অবস্থায় সে দেখল, টিভির পর্দায় খোল, করতাল, কীর্তনের সঙ্গে নেচে চলেছে গেরুয়াবসন এক সন্ন্যাসী। তার সঙ্গীরা তাকে ঘিরে সমান তালে নাচ গানে বিভোর। সকলের গলায় ফুলের মালা আর গান, সকলের সমান সুরেলা কণ্ঠস্বর। অবাক হয়ে সেই উদ্দণ্ড নৃত্য দেখার মধ্যে পর্দায় ভেসে উঠল গায়ে গায়ে লাগানো দুটো হরফ, ‘গোরা’। বিজ্ঞাপনের শীর্ষে স্থাপিত ‘গোরা’ শব্দটা আকারে ক্রমশ ছোট হয়ে স্ক্রিনের ওপর দিকে উঠে যেতে পর্দার নিচের অংশের বিজ্ঞাপনে যে বয়ান দেখা গেল, তা এরকম। আগামি সাতাশে ফেব্রুয়ারি থেকে ‘ধ্রুবতারা’ চ্যানেলে বাঙালি জাতির প্রথম নবজাগরণের অধিনেতা, শ্রীচৈতন্যের জীবন অবলম্বনে শুরু বাংলা ‘মেগাসিরিয়াল’ গোরা, পাঁচশো বছরের বেশি সময় ধরে যিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাঙালি ব্যক্তিত্ব। আজ থেকে একশো বছর আগে ঊনিশ শতকে এদেশে যাদের নেতৃত্বে ‘নবজাগরণ’ ঘটেছিল, সেই রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দের মতো দশজন মনীষী বাঙালিকে এক শরীরে জুড়লেও বাঙালি জীবনে শ্রীচৈতন্যের তুলনায় তাদের প্রভাব এক দশমাংশের কম। হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ মানুষ—শ্রীচৈতন্য। নবদ্বীপে তিনি গৌরাঙ্গ, গৌর, গোরা নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে মাথাতে রেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাস লিখেছিলেন, চোখ কান খোলা রেখে উপন্যাসটি পড়লে বোঝা যায়।

হাতে ‘গোরা’ উপন্যাস, দূরদর্শনে মেগাসিরিয়ালে দেখানো হতে চলেছে পাঁচশো বছর আগের এক ‘গোরা’র বিবরণ, গভীর অন্ধকার থেকে মেগাসিরিয়ালের টুকরো ছবি, বিজ্ঞাপনের বয়ান ক্রমশ আলোকিত পর্দায় উঠে আসছে, দূরদর্শন থেকে গোরা চোখ সরাতে পারছে না। ধাঁধা লেগে গেছে তার। মনের মধ্যে আরও কিছু ঘটে চলেছে। চাপা উত্তেজনা অনুভব করার সঙ্গে সে টের পাচ্ছে, পৃথিবী দুলছে, ঘরের মেঝে, খাট-বিছানা দুলছে, গভীর রাতে চার-পাঁচ পেগ রাম, অথবা হুইস্কি চাপিয়ে ট্যাঙ্গো, ওয়াল্‌ট্জ বা ফক্সট্রট নাচতে নামলে ‘মন্ত্র’-এর ‘ড্যান্সিং ফ্লোর’ এভাবে দুলতে থাকে। চা, জলখাবার খাওয়ার পরে, দুপুর বারোটায় বিশ্বচরাচরকে এভাবে সে দুলতে দেখেনি। টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল গোরার মুখ, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হাত, দীর্ঘ শরীর, বাবরি চুল, ঘুমজড়ানো অথচ তীক্ষ্ণ দীঘল দুটো চোখ, কপালে অলকাতিলকা, গলায় যুঁই ফুলের মালা, প্রেমের গান গাইছিল সে। গানের অর্থ সে স্পষ্ট না বুঝলেও শব্দগুলো এরকম। ‘সুখের লাগিয়া যে করে পিরিতি/দুখ যায় তার ঠাঞি।’

লাইনটার মানে পুরো না বুঝলেও সহজ শব্দগুলো, ফেলে দেওয়ার মতো নয়, অনুভব করছিল। কানের দু’পাশ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের বিবরণ, সংলাপ যেভাবে বেরিয়ে গেছে, পাঁচশো বছর আগের গানটা শুনে তেমন লাগছে না। গায়কের চেহারার সঙ্গে ‘হেয়ারস্টাইল’ বাদ দিয়ে নিজের চেহারার মিল দেখে সে যেমন অবাক হচ্ছে, তেমনই একটু আগে হালকা ঘুমের মধ্যে এই গান, এই সুর শুনেছে, মনে করতে পারছে। রবীন্দ্রনাথের গোরার চেয়ে সাতাশে ফেব্রুয়ারি থেকে যে মেগাসিরিয়াল শুরু হতে চলেছে, তার নায়ক গোরাকে তার বেশি কাছের মানুষ মনে হচ্ছে। কেন হচ্ছে, সে জানে না। চৈতন্যের নাম শুনলেও তিনি যে হাল আমলের দশজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির যোগফলের তুলনায় আরও বহুগুণ বড় ছিলেন, এমন কথা সে আগে শোনেনি। অনেক কিছু সে জানে না। এক, দেড়শো বছর আগের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের সম্পর্কে সে কতটা জানে? চৈতন্যের নাম শুনলেও তার আর এক নাম গোরা, সে জানত না। পাঁচশো বছর আগের সেই মানুষকে নিয়ে যারা ‘মেগাসিরিয়াল ‘ করতে পারে, তাদের বুকের পাটা আছে। মান্ধাতা আমলের সেই মানুষটা, অসাধারণ কেউ না হলে, তাকে নিয়ে এই হিসেবি যুগের ‘সিরিয়াল’ নির্মাতারা ছবি করত না। পাঁচশো বছর পরে রামমোহন, বিদ্যাসাগর—এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনও চলচ্চিত্র নির্দেশক কি ছবি বানাবে? বিষয়টা নিয়ে তখনি খতিয়ে ভাবতে চাইল না। ঠিক করল, সামনের শনিবার দুপুর দুটোতে ‘ধ্রুবতারা’ চ্যানেলে সিরিয়ালের প্রথম ‘এপিসোড টা দেখবে। হপ্তায় তিন দিন, শনিবার দুপুর দুটোয়, আর মঙ্গল, বৃহস্পতিবার সন্ধে ছ’টায় ‘গোরা’ দেখানো হবে। শনিবার দুপুরে যত কাজ থাকুক, বাড়ি থেকে সে বেরোবে না। টেলিফোনে কেউ ডাকাডাকি না করলে আজ বিকেলেও বাড়িতে থাকবে। কাল রাত ন’টায় ‘মন্ত্র’-এ ঐশীর সঙ্গে দেখা হলে এই মেগাসিরিয়ালটা শুরু থেকে তাকে দেখতে বলবে। ঐশী নিশ্চয় দেখবে। ইংরেজির সঙ্গে বাংলা উপন্যাস-গল্প সে পড়ে বললে, কম বলা হয়। দুটো ভাষাতেই সে তুখোড়। হিন্দি, গুরমুখি, গুজরাটিতেও তার সামনে খাপ খোলা মুশকিল। মা বাঙালি, বাবা পাঞ্জাবি হওয়াতে এবং বদলির চাকরিতে বাবা থাকায় অনেকগুলো ভাষা সে শিখে গেছে। সমান তেজে ইংরেজি, বাংলা আওড়াতে পারে। গুজরাটি, গুরমুখি বললে, সে কোন রাজ্যের মেয়ে, বোঝা মুশকিল। বৈভবকে ‘মেগাসিরিয়াল’ দেখতে বলে লাভ নেই। সিরিয়ালের সময়ে সে তার দপ্তরে বসে কম্পিউটারে ‘ডেবিট-ক্রেডিট’ নিয়ে ডুবে থাকবে, দ্রুততম গতিতে টাকার বান্ডিল গুনবে বৈভব বলে, অলিম্পিকে টাকার নোট গোনার কোনও ‘ইভেন্ট’ থাকলে সে চ্যাম্পিয়ন হতো।

মন্ত্রের ফ্লোরে বন্ধুদের শুনিয়ে বৈভব একবার কথাটা বলতে, গোরা খিস্তি করেছিল তাকে। তারপরেও ‘মন্ত্র’-এর বিল সই করছিল বৈভব। পর্দায় মেগাসিরিয়ালের বিজ্ঞাপিত বিষয়, টুকরো দৃশ্য প্রক্ষেপের সঙ্গে, নবম খণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলীর ‘গোরা’ উপন্যাসে তর্জনী গুঁজে, সেটা হাতে ধরে রেখে, গোরার মনে হচ্ছে পাঁচশো বছর আগের সেই জনপদ, নবদ্বীপে সে পৌঁছে গেছে। গতকাল যেন ঘটে গেছে পাঁচশো বছর আগের ঘটনাগুলো। সময়ের পারাপারে, অন্তর্নিহিত নৌকোচালকের দ্রুততায় পাঁচশো বছর যেন পনেরো মিনিটে কেটে গেছে। তার নেশার খোঁয়ারি ছুটে গেল। বিজ্ঞাপনটা শেষ পর্যন্ত দেখে বিছানা ছেড়ে সে উঠে দাঁড়াল। হাতঘড়িতে তখন দুপুর দেড়টা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *