গোরা – ৪১

৪১

গৌড়ের সীমানা পেরিয়ে উৎকলের পথে না গিয়ে বারাণসীর পথ ধরল গোরা। বারাণসী পর্যন্ত নিতাই সঙ্গে থাকতে চাইলেও অনেক অনুরোধ করে তাকে নবদ্বীপে ফিরে যেতে রাজি করাল। সাধক, সন্ন্যাসীর একাকিত্ব তার ধ্যানের জগৎ গড়ে তোলে। অধিক সন্ন্যাসী আর ভক্তের ভিড়ে সাধকের ভাবাবেশ কেটে যায়। বারাণসী হয়ে পৌষসংক্রান্তির আগে প্রয়াগে পৌঁছোতে হবে। প্রয়াগে গুরু নানক আর যে সব সাধু মহাত্মা আসবে, তাদের সঙ্গ পেলে সে ধন্য হয়ে যাবে। গৌড়ে নামপ্রচারের দায়িত্বও রয়েছে নিতাই-এর। তার পথ চেয়ে অনেক মানুষ সেখানে অপেক্ষা করছে। কানাই নাটশালায় গোরাকে ছেড়ে গৌড়ের পথে রওনা হল নিতাই কানাই নাটশালা ছাড়ার আগের রাতে দু’জনের মধ্যে অনেক বিষয়ে আলোচনা হল। রাঢ়, মল্লভূমের রাজপুরুষরা সপ্তগ্রামের ভক্ত বণিকদের সূত্রে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, গোরাকে এ খবরও নিতাই দিয়েছিল। আরও জানিয়েছিল, প্রেমভক্তিতে রাজপুরুষদের অনুরাগ থাকলেও অস্ত্রের ঝঞ্ঝনায় তারা বেশি নির্ভর করে। সুলতানী সেনাবাহিনীতে রাঢ়ের যে গোলন্দাজরা বেশি খাতির পায়, তারা কর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষ, পাকা গোলন্দাজ, আবার নিজেদের কামারশালায় কামান বানাতে সমান ওস্তাদ। সুলতানের বাহিনী ছেড়ে তাদের কয়েকজন সুশ্রুত রায়, হামীর রায়দের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। মল্লভূমের গভীর জঙ্গলে চলেছে তাদের কামারশালা। রাঢ়, সমতট, লম্মভূ, চন্দ্রদ্বীপের হাজার হাজার মানুষ পাইক, বরকন্দাজেরা খাতায় নাম লিখিয়ে লড়াই করার মহড়া দিচ্ছে। এই রাজপুরুষরা রাজপোশাকে আমাকে দেখতে চায়। সোনার মুকুট, সোনার চন্দ্রহার, সোনার তাগা এমনকি সোনার খঞ্জনি পর্যন্ত উপহার পাঠাচ্ছে। দামী রেশমের যে সব পোশাক পাঠাচ্ছে, বাপের জন্মে আমি তা দেখিনি। তারা এখনই আমাকে গৌড়ের রাজা সাজাতে চায়, সপ্তগ্রামের উদ্ধারণ দত্ত আর বাকি বণিকদের মতো শ’য়ে শ’য়ে মানুষও আমাকে এই বেশে দেখতে চায়। ‘জপ গৌরাঙ্গ, ভজ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’ এই গান ছাড়া আর কিছু শুনতে চায় না। বিশেষকরে নবশাক আর শূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ, যাদের অনেকে চোখে দেখেনি তোমাকে, তারা বারবার বলতে থাকে, আমাদের গোরাকে ফিরিয়ে দাও। তারা কাঁদতে থাকে, আমিও চোখের জল সামলাতে পারি না। রাজপোশাক পরে আমাকে গৌরাঙ্গ ভজনা করতে শুনে, তাদের ধারণা হয়েছে একমাত্র আমি পারি পুরুষোত্তমপুর থেকে নবদ্বীপে তোমাকে ফিরিয়ে আনতে। আসল রাজা তুমি! আমি শুধু সঙ্কীর্তন গায়ক, চারণকবি, তোমার দূত! আমার চালচলন শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্যের পছন্দ হচ্ছে না। অদ্বৈত বলে, যার ভক্তির চাল বেচাল কথা, সঙ্কীর্তনের নামে সে বিলাসব্যসনে ডুবে আছে। অদ্বৈত ভুল বলেনি। গৌড়ের মসনদ নিয়ে রাজপুরুষদের যুদ্ধ, রক্তপাত, নরহত্যা আমি সামলাতে পারব না। প্রেমভক্তির প্রচারক হয়ে গৌড়ের রাজপুরুষরা ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। এই সংকটের মীমাংসা কি?

গোরা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ভেবেছ?

আমি বলেছি, তোমরা সবাই মিলে গৌরাঙ্গ ভজনা করো, মনপ্রাণ দিয়ে তাকে ডাকলে ‘ সে নিশ্চয় ফিরে আসবে। গানের স্রোতে গৌড় থেকে রাঢ় সমতট, বারেন্দ্রভূমি পর্যন্ত তোমরা ভাসিয়ে দাও। গান মানেই ভালবাসা, প্রেম, সৌন্দর্যের আরাধনা, গৌরাঙ্গে আবাহন। তার অঙ্গুলি হেলনে ধসে পড়বে গৌড়ের মসনদ।

গোরা হাসল, বলল, গৌরাঙ্গ ভজনার বদলে সবাইকে কৃষ্ণনাম জপ করতে বলো। সবার মুখে কৃষ্ণনাম উঠলে তবে আমি ফিরব। মানুষের চরিত্র তুমি ভাল জানো। তোমার কাজে কোনও ত্রুটি নেই।

কানাই নাটশালা থেকে নবদ্বীপে নিতাই ফিরে যাওয়ার আগের রাতের কথোপকথন এসব বারাণসীর পথে গোরা হেঁটে চলেছে। রামকেলির মাঠে ভক্তদের ফেলে আসার জন্যে কষ্ট পাচ্ছিল সে। কৃষ্ণমন্ত্র জপের সঙ্গে তাদের কল্যাণ কামনা করছিল। শুধু ভক্তদের কেন, দুঃখী, তাপিত সব মানুষের জন্যে কল্যাণ চাইছিল। তীর্থদর্শনের পাশাপাশি তার মনে পড়ছিল শ্রীহট্টের তপন মিশ্রকে। জন্মভূমি শ্রীহট্টের পাট তুলে দিয়ে সে যখন নিরাপদ কোনো দেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছে, তাকে বারাণসীতে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল সে বারাণসীতে নিশ্চয় তার দেখা পাবে। বারাণসী হয়ে পৌষসংক্রান্তির আগে তাকে প্ৰয়াগে পৌঁছোতে হবে। সনাতন, রূপ, অনুপমকেও সেখানে দেখা করতে বলেছে। নবদ্বীপের পুরুষোত্তমের সঙ্গে দেখা তো হবেই। বন্ধু, পুরুষোত্তম আচার্য, কৃষ্ণভক্ত হয়েও গুরু আদেশে বেদান্ত পড়তে বারাণসী চলে গিয়েছিল। গোরা শুনেছে সে সন্ন্যাস নিলেও পুরী, গিরি, ভারতী অরণ্য ইত্যাদি দশনামী সম্প্রদায়ের কোনো যোগপট্ট নামের আগে লাগায়নি। সন্ন্যাস জীবনে তার নাম হয়েছে স্বরূপ দামোদর। প্রেমভক্তির সাধক সে। বারাণসীতে অন্য হাটে চাল কিনতে যাওয়ার মানুষ নয়। গন্ধর্বের মতো তারে গানের গলা, বৃহস্পতির মতো পণ্ডিত সে। তার গলায় জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাসের কত গান যে গোরা শুনেছে। তার গান শুনলেই গোরার মাথার ভেতরে সুরের ঢেউ উঠত, সে বাহ্যজ্ঞান হারাত। ছেলেবেলায় নানা দুষ্টুমির মধ্যে মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমপাড়ানি গান শুনে যেমন ঘুমিয়ে পড়ত, বয়স বাড়লেও সে ঘোর থেকে গেছে। সঙ্কীর্তনের আসরে কৃষ্ণনাম, রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বিরহের গান শুনলে বেহুঁশ হয়ে যায়। কানাই নাটশালা থেকে বারাণসী কম পথ নয়। ঝাড়িখন্ডের গভীর জঙ্গল, উঁচু, নীচু পাহাড়, টিলা পেরিয়ে একুশ দিনে বারাণসী পৌঁছোল সে। পথের দূরত্ব গায়ে মাখছিল না। গাছে পাতায়, ঘাসে, গভীর জঙ্গল আর পাহাড়ি পথে সকালের আলো, দুপুরের রোদ, গোধূলিবেলায় কৃষ্ণকে দেখছিল, কখনো সামনে, কখনো পেছনে, পাশে কৃষ্ণের উপস্থিতি অনুভব করছিল। দীর্ঘপথের মাঝেমাঝে অরণ্যবাসী মানুষের গ্রাম, পাহাড়ি এলাকায় কত মানুষের সেবা, ভালবাসা পেল, হিসেব নেই। ভাষার মিল না থাকলেও শাল, হিজল, অশোক ফুলের রঙ সেখানে। শরীর, ভালবাসা মেশানো পদ্মফুলের মতো চোখ, এমন সন্ন্যাসী পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা প্রান্তবাসী মানুষেরা আগে দেখেনি। তাদের অনেককে গোরা কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করতে শেখাল। ভোরের সূর্য ওঠা দেখিয়ে বলল, ‘কৃষ্ণ’, রাতের আকাশ, চাঁদ, তারা দেখিয়ে বলল ‘কৃষ্ণ’, নিজের বিশাল বুকে হিজলগাছ জড়িয়ে ধরে, মাঠের গরু, ছাগল, ঘরের দাওয়ায় বসে থাকা পোষা বেড়াল, গাঁয়ের পথে লেজ নাড়তে থাকা কুকুর, পাখি, প্রজাপতি সবের দিকে আঙুল তুলে বলল, কৃষ্ণ বলো, হরি বলো।

গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষ সম্মোহিতের মতো কৃষ্ণ, হরি উচ্চারণ করল। বেশকিছু গ্রামের মানুষকে নিয়ে গোরা সঙ্কীর্তন করল। গোরার সঙ্গে কৃষ্ণ ভজনায় তারা গলা মেলাতে না পারলেও নাচের তালে পা মেলাল। তাদের অনেকে ঘরের চাল, মুড়ি, খৈ, দুধ ভিক্ষে দিল তাকে। শূদ্রের দেওয়া ভিক্ষান্ন নিতে সে দ্বিধা করল না। দুহাত পেতে ভিক্ষা নিল, কমণ্ডলু ভরে নিল দুধ।

গোরা যখন বারাণসী পৌঁছোল পথের কষ্ট, ক্লান্তি কোনো ছাপ লাগেনি তার মুখে। অঘ্রাণের শেষে শীতের হালকা হাওয়া ছেড়েছে হিমালয়। দূর থেকে অন্নপূর্ণার রাজত্বে বিশ্বনাথের মন্দিরচূড়া দেখে ভাবে বিহ্বল গোরার মনে হল কি মহিমামণ্ডিত এই পুণ্যভূমি, কি অপরূপ এই দেশ, মানুষের সমাজ। সকাল ফুরিয়ে মাঝ আকাশের কাছাকাছি এসে গেছে সূর্য। চোখের সামনে গঙ্গা, মণিকর্ণিকা ঘাট। এ সেই ঘাট, রাজা হরিশ্চন্দ্র একদা যেখানে চণ্ডালের ভূমিকায় শবদাহের কাজ করে গেছে। গঙ্গায় চান করতে ঘাটের চত্বরে এসে আচমকা তপন মিশ্রের মুখোমুখি হয়ে গেল সে। চান সেরে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে উঠছিল তপন। সে-ই প্রথম দেখতে পেল গোরাকে। আনন্দে কাঁটা দিয়ে উঠল তার শরীর। নবদ্বীপের পুণ্যার্থীদের মুখ থেকে গোরার নানা খবর সে পাচ্ছিল। সন্ন্যাস নেওয়ার পরে সে পুরুষোত্তমপুরে রয়েছে, এ খবরও তার কানে এসেছিল। মণিকর্ণিকা ঘাটে সেই গোরার মুখোমুখি হয়ে সে বলল, আমি শ্রীহট্টের তপন। তোমার অপেক্ষাতে বারাণসীতে বসে আছি।

তপনকে বুকে টেনে নিল গোরা। তপন বলল, হে সন্ন্যাসী, আমার বাসাতে কৃপা করে তুমি আতিথ্য ভিক্ষা নাও। বারাণসীতে যে ক’দিন থাকবে, তোমাকে যেন ভিক্ষান্ন দিতে পারি।

গোরা জিজ্ঞেস করল, তোমার যে শিশুসন্তানকে দেখে এসেছিলাম, সে ছেলে কত বড়ো হল?

আঠারো পেরিয়ে ঊনিশে পা দিয়েছে। ব্যাকরণ শেষ করে শাস্ত্রকাব্য পড়ছে। গোরা বলল, বেশ।

গোরার চান শেষ হতে তাকে নিয়ে তপন প্রথমে বিশ্বনাথ মন্দিরে গেল। বিশ্বেশ্বর ভোলানাথের মাথায় গঙ্গাজল ঢেলে বেলপাতা চাপিয়ে, অন্নপূর্ণা মূর্তি দেখে প্রণাম করল। প্রার্থনা জানাল, মা, সব উপোসী মানুষ যেন ভাত-কাপড় পায়।

তপন মিশ্রের বাড়িতে গোরার আতিথ্য ভিক্ষার খবর রটে যেতে সময় লাগল না। সকলের আগে তার কাছে এল সন্ন্যাসী স্বরূপ দামোদর, নবদ্বীপের মানুষ যাকে চিনত পুরুষোত্তম আচাৰ্য নামে, বারাণসী মানুষের কাছে সে শুধু স্বরূপ। তাকে পেয়ে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরল গোরা। কতদিন পরে দেখা, দু’জনের চোখে জল এসে গেল। স্বরূপ শুরুতেই গোরাকে বলে রাখল, তার সঙ্গে সে-ও পুরুষোত্তমপুরে যাবে। বিকেলের আগে কৃষ্ণভক্ত চন্দ্রশেখর এসে প্রণাম করল গোরাকে। কিছুক্ষণ পরে যে দু’জন বৈষ্ণব ভক্ত হাজির হল, তাদের নাম লোকনাথ গোস্বামী, বৃন্দাবন গোস্বামী, দুজনেই বৃন্দাবনবাসী। তারা বিশ্বনাথ দর্শন করতে বারাণসীতে এসেছে, মকর সংক্রান্তিতে প্রয়াগে পুণ্যস্নান করে বৃন্দাবন ফিরবে। তাদের দেখে গোরা কৃষ্ণপ্রেম উথলে উঠল। বলল, তোমাদের সঙ্গে আমি বৃন্দাবন যাব।

‘বৃন্দাবন’ শব্দটা উচ্চারণ করে তার শরীরে যে কাঁপুনি জাগল, কপালে ঘাম, চোখে জল জমল, তা চিনতে স্বরূপের অসুবিধে হল না। বলল, তোমার সঙ্গে আমিও যাব। আমাদের জন্যে কৃষ্ণ সেখানে অপেক্ষা করছে।

স্বরূপের কথাতে কিছুটা স্বাভাবিক হল গোরা, জিজ্ঞেস করল, তুমি যা বললে তা কি সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

লম্বা শ্বাস ফেলে গোরা বলল, আমার কি সৌভাগ্য। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে থেকে আমি যা ভাবছি, আজ তোমার মুখ থেকে তা শুনলাম। স্বরূপ, এখন থেকে সব নামের আগে ‘শ্ৰী’ বসাও, বল, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবৃন্দাবন, শ্রীব্রজধাম, শ্রীমতী রাধা, শ্রীমতী ললিতা, শ্রীমতী বিশাখা, শ্রীধাম বারাণসী। আমাদের নরহরির ‘খণ্ড’গ্রাম কি দোষ করল? সে গ্রামের নাম হোক “শ্রীখণ্ড’।

নবদ্বীপে সকলে কি মেনে নিয়েছে এই প্রস্তাব?

বলে এসেছি। মেনে নিয়েছে কিনা জানি না।

বিগলিত হয়ে স্বরূপ বলল, প্রাণ জুড়িয়ে গেল। ‘শ্রী’ না থাকলে ধর্মে, কর্মে, জীবনে রইল কি? আজ থেকে আমিও হলাম শ্রীস্বরূপ দামোদর।

গোরার পাশে তপনের সতেরো বছরের ছেলে, রঘুনাথের কাঁধে হাত রেখে গোরা বলল, তুমিও শ্রীরঘুনাথ। তোমার বন্ধুদেরও নামের আগে শ্রী বসিয়ে দিও।

গোরার হাতের ছোঁয়ায় সম্মোহিত হয়ে গেল রঘুনাথ, জিজ্ঞেস করল, তোমার সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাবে?

কোথায়?

তুমি যেখানে যাবে।

সময় হলেই ডেকে নেব তোমাকে।

কথাটা বলে নিজের গলার গুঞ্জাফুলের মালা খুলে রঘুনাথের গলায় পরিয়ে দিল গোরা। আনন্দে আত্মহারা রঘুনাথ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল গোরাকে। তপনের বাড়ির দাওয়ায় প্রদীপ জ্বলে উঠতে স্বরূপকে গোরা বলল, সঙ্কীর্তন শুরু করতে পারি এখন।

দ্বিতীয়বার বলতে হল না। দাওয়া থেকে নেমে দু’হাত মাথার ওপর তুলে সুরেলা গলায় চোখ বুজে স্বরূপ গান ধরল,

হরিহরায় নম, কৃষ্ণ যাদবায় নম,
যাদবায় মাধবায় গোবিন্দায় নম।

কৃষ্ণভজনা কানে যেতে দাওয়া থেকে গোরা আঙিনায় নেমে পড়ে স্বরূপের সঙ্গে গলা মেলাল। সেই সঙ্গে শুরু হল তার উদ্দণ্ড নাচ। তপনের ইঙ্গিতে ঘরের ভেতর থেকে খোল-করতাল নিয়ে এল রঘুনাথ। বাবা, ছেলে খোল-করতাল নিয়ে সঙ্কীর্তনে ঢোকার আগে সে দুটো চেয়ে নিল বৃন্দাবনের দুই গোস্বামী।

বেশ রাত পর্যন্ত সঙ্কীর্তন চলল। দশদিন বারাণসীতে থেকে গোরা চলল প্রয়াগের পথে। এ যাত্রায় সে একা নয়। তার সঙ্গী স্বরূপ আর বৃন্দাবনের দুই সন্ন্যাসী। গোরা যখন প্রয়াগের পথে, গৌড় আর পুরুষোত্তমপুরে ঘটনাস্রোত তখন ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করেছে। গোরার সঙ্গী হতে দরবারের চাকরি থেকে মুক্তি পেতে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের কাছে প্রায় ধরনা দিয়ে পড়েছে দবীর খাস, সাকর মল্লিক, তাদের ছোটভাই বল্লভ। দরবারের চাকরিতে তাদের নিয়ে এসেছিল চারুমিহির। সুলতান হোসেন শাহের সে ডান হাত। সে চেষ্টা করলে চাকরি থেকে তিন ভাইকে রেহাই দিতে পারে। তিন ভাই-এর নাম, এরমধ্যে সনাতন, রূপ, অনুপম করে দিয়ে গেছে গোরা, গোপন এই খবর, চারুমিহির ছাড়া কেউ জানে না। নাম বদলের এই খেলা তাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে সুবুদ্ধি রায়। বৃন্দাবনে সে পরিচিত বল্লভদ্র ভট্টাচার্য নামে প্রতিকূল পরিবেশে আত্মরক্ষার জন্যে নাম পাল্টানো ছাড়া উপায় নেই। গোরার প্রেমভক্তির প্রচারক হয়ে চাকরি জীবনের সব পাপ তারা ধুয়ে ফেলতে চায়। শিক্ষিত, সজ্জন, সবচেয়ে বড়ো কথা বিশ্বস্ত তিন কর্মচারীকে সুলতান সহজে নিস্তার দেবে না, চারুমিহির জানত। প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদীর জোগাড় করা তিন ভাই-এর বংশপরিচয়ের ভিত্তিতে তারা যে সুলতানী মসনদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে, এ খবর, খান-এ-জাহান নানাভাবে সুলতানের কানে তুলে দিল। কয়েক হাজার বছর ধরে স্মৃতি, শ্রুতিতে প্রচলিত কৃষ্ণাবতারের জাদু কাহিনীর মিলমিশ ঘটে নবদ্বীপের কৃষ্ণাবতার, ব্রাহ্মণসন্তান গোরাকে সুলতান যেমন ভয় পেল, তেমনই ব্রাহ্মণ রাজবংশের দুই ছেলে, দরবারের কর্মচারী সাকর মল্লিক, দবীর খাস সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। সুলতানের মর্জি বদলাচ্ছে, ঘটনার চাকা ঘুরছে, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির বেশকিছুদিন আগে থেকে টের পাচ্ছিল। সুলতান হওয়ার আগে থেকে যখন সে সুলতান আবুল মুজফ্‌ফর শাহের দরবারে আমীর ছিল, তখন থেকে তাকে চেনে। সুলতান মুজফ্‌ফরকে খুন করে শাহি হোসেন গৌড়ের মসনদে আসীন হওয়ার আগে তার কুষ্ঠি, ছক তৈরি করে, সে সুলতান হতে চলেছে, চারুমিহির জানিয়েছিল। তার গণনা মিলে গিয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে গৌড়ের মসনদে বসে শাহ হোসেন হয়েছিল, সৈয়দ হোসেন আলা আল দুনিয়া ওয়াল দীন সুলতান হোসেন শাহ। চারুমিহিরের মতো সাধারণ এক জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎবাণী মিলে যেতে তার ওপর সুলতানের শুধু অগাধ বিশ্বাস জন্মালো না, তাকে জ্যোতিষার্ণব খেতাব দিয়ে সসম্মানে দরবারে আমীর-প্রধানদের মধ্যে জায়গা করে দিল। সুলতানের পরামর্শদাতাদের একজন হয়ে উঠল চারুমিহির। রাজা হওয়ার চেয়ে রাজা বানানোর মজা অনেক বেশি, এ ধারণা বদ্ধমূল হল তার মনে। পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে সুলতানের দরবারে একাধিপত্য করলেও নতুন নতুন রাজা বানানোর শখ তার কাটেনি। গদীতে বসে প্রথম পাঁচ, সাত বছর সুলতান যত অনুগত ছিল, তারপর তেমন নেই। জ্যোতিষার্ণবের মতো বিশ্বাসী আমীরকে সুলতান এখন মাঝেমাঝে চোখ রাঙায়, ধমক দেয়। সুলতানের আচরণে কিছুটা আতঙ্কিত জ্যোতিষার্ণবের রাজা বানানোর লুকোনো শখ তাই ফের চাগাড় দিয়ে উঠছে। গৌড়ের মসনদে এমন একজন বিনয়ী, বাধ্য মানুষকে অধীশ্বর হিসেবে সে বসাতে চায়, যে তাকে মেনে চলবে। সে উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। একডালার দরবারে বসে সে খুঁজে চলেছিল তার ভাবী অধীশ্বরকে। অনেক হিসেব করে রামকেলি থেকে দুই পুরানো সহপাঠী অমর, সন্তোষকে দরবারে সাকর মল্লিক, দবীর খাস পদে বসিয়েছিল। শরীরে রাজপরিবারের রক্ত থাকলেও দু’বন্ধুর একজনও গৌড়ের অধিপতি হওয়ার যোগ্য নয়, বুঝে গিয়েছিল। উড়িষ্যার সীমান্ত অঞ্চলের শাসক রামচন্দ্র খান, ওমরাহ গৌড়াই মল্লিক, প্রাসাদরক্ষীদের সেনাপতি কেশব ছত্রী, কেউই গৌড়ের অধীশ্বর হওয়ার যোগ্য নয়, জ্যোতিষার্ণব বুঝে গিয়েছিল। সাধারণ গণকঠাকুর থেকে সুলতানের দরবারে প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিল সে। মানুষ চরিয়ে মানুষের চরিত্র, মনস্তত্ত্ব বুঝে গিয়েছিল। সুলতানী দরবারে নিজের অনুগত আমীর, ওমরাহদের কেউ গৌড়ের মসনদে বসার কল্পনা পর্যন্ত করতে পারে না, এমন স্বপ্ন দেখার মতো সাহস তাদের কারও নেই, টের পেয়ে সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায়কে নিজের ইচ্ছাপূরণের কাজে লাগাতে চেয়েছিল। জ্যোতিষার্ণবের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে সুশ্রুতও তেড়েফুঁড়ে দল ভারি করছিল। একডালার ক্ষমতা বদলে ইতিহাসের সেই গোপন প্রস্তুতি পর্ব নবদ্বীপের মানুষ তাদের মধ্যে কৃষ্ণাবতার গোরাকে আবিষ্কার করল। গোরাকে ঘিরে প্রেমভক্তির যে প্লাবন উঠল তা রূপকথার মতো গঙ্গার দু’পাশের কাটোয়া, ইন্দ্রঘাট, ফুলিয়া, গুপ্তিপাড়া, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম, কুমারহট্ট, কুলিয়া, ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া, মুলাজোড়, গাড়ুলিয়া, চাপদানী, ভদ্রেশ্বর, ইছাপুর, মহেশ, খড়দহ, সুখচর, পানিহাটি, ধুসড়ি পর্যন্ত ভাসিয়ে দিল। জ্যোতিষার্ণব আন্দাজ করল এতদিনে গৌড়ের অধীশ্বর বানানোর মতো যোগ্য মানুষের খোঁজ মিলেছে। প্রাক্তন শিক্ষক, কুলিয়ার পণ্ডিত বিদ্যাবাচস্পতির সঙ্গে পুরানো যোগাযোগ বজায় রেখে গোরার খবরাখবর রাখতে শুরু করল সে। সুলতানী শাসনের চোখে প্রেমভক্তির প্রচারক গোরা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে তাকে নিরাপদ রাখতে জ্যোতিষার্ণব গোপনে কিছু তৎপরতা চালালেও তা কার্যকর হবে না, সে জেনে গিয়েছিল। নবদ্বীপ ছেড়ে গোরাকে পালানোর খবর সরাসরি না জানালেও বিদ্যাবাচস্পতির কাছে পৌঁছোনোর ব্যবস্থা করেছিল। রাজা তৈরির এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে জ্যোতিষার্ণবের মনে কিছুটা হতাশা জমলেও সে আশা ছাড়ল না। সুলতানকে পরামর্শ দেওয়ার সঙ্গে যোগ্য নতুন সুলতানের খোঁজে দরবারের ভেতরে, বাইরে নজর রাখল। সুলতানী সেনাবাহিনীর এক সাহসী সেনাপতি, ইসমাইল গাজীকে তখনই কোনও সময়ে তার চোখে পড়ল। ইসমাইল শুধু সাহসী সেনাপতি নয়, সে সুফী দরবেশও বটে। জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের ভবিষ্যৎ গণনার ওপর তার যেমন অগাধ বিশ্বাস তেমনই দরবারের এই জ্যোতিষীকে সে দেবতার মতো শ্রদ্ধা করে। সুলতানের উৎকল অভিযানের সময়ে সেনাপতির ভূমিকায় সে পরাক্রম দেখালেও জগন্নাথ মন্দির লুঠতরাজে হাত লাগায়নি। ঈশ্বরের একত্বে সে বিশ্বাসী। সব মানুষের মনের ভেতরে যে মানুষ সে এক, সে-ই ঈশ্বর, তার এই বিশিষ্ট ঈশ্বরভাবনায় কোনও ফাঁকি নেই। সে একজন পাকা বাস্তুকার। সেতু তৈরি, নদীর প্লাবন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণের কারিগরিতে সে সিদ্ধহস্ত। মেদিনীপুর থেকে গড়মান্দারণ পর্যন্ত এলাকার সার্বভৌম শাসনক্ষমতা গোবিন্দ বিদ্যাধরের হাতে যাওয়ার পর থেকে, তাকে দেখভাল করার ভার, সুলতানের তরফে দেওয়া হয়েছে ইসমাইল গাজীকে। রাজা প্রতাপরুদ্র করদ রাজ্যের অধীশ্বর হয়েও গৌড়ের সুলতানকে গোবিন্দ বিদ্যাধর নিয়মিত কর দিয়ে চলেছে। সুলতান চাইলে গড়মান্দারণ কেল্লা ব্যবহারের জন্যে ছেড়ে দিচ্ছে গৌড়ের বাহিনীকে। গৌড়ের বাহিনীর একাংশের সেনাপতি ইসমাইল গাজীর গুণপনায় গোবিন্দ বিদ্যাধর মুগ্ধ। সে জানে ইসমাইল গাজীর অনুগত সেনারা মন্দারণ কেল্লায় সাময়িকভাবে থাকলেও দু’ধর্মের সেনাদের মধ্যে খুনোখুনি লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সুলতান কখনও গড়মান্দারণ সমেত মেদিনীপুর দখল করবে না।

উৎকল অভিযান চুকিয়ে বিজয়ী সুলতানী সেনারা একডালায় ফেরার পর থেকে ইসমাইল গাজীর সঙ্গে জ্যোতিষার্ণবের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করে। চারুমিহিরের কাছে হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র শেখার ইচ্ছে জানিয়েছিল গাজী। আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছিল চারুমিহির। পাঁচ বছর আগের ঘটনা এসব। গাজীর মতো সেনাপতিকে যে আগ্রহ নিয়ে চারুমিহির ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ শেখাতে শুরু করেছিল, সেখানে বিশুদ্ধ গুরুশিষ্যের সম্পর্ক ছাড়া কিছু ছিল না। তৃতীয় বছরের পর থেকে যখন সুশ্রুত রায় আর তার সঙ্গী রাজপুরুষদের ওপর আস্থা কমতে থাকল চারুমিহিরের তখন নজরে পড়েছিল নবদ্বীপের গোরার ওপরে। জ্বলন্ত মশাল হাতে অসংখ্য মানুষ নিয়ে শোভাযাত্রা করে সুলতানী দরবারের মনোনীত কাজীর বাড়ির দরজায় যে ধরনা দিতে পারে, সে কম সাহসী মানুষ নয়। ধরনা দেওয়ার কারণটাও সাতজন্মে কেউ শোনেনি। ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত নির্বিশেষে সব মানুষের একসঙ্গে গান গাওয়ার অধিকার চেয়েছিল সে। বাড়ি ছেড়ে কাজী পালিয়ে গেলেও তার পরিবারের ওপর গোরা সামান্য উপদ্রব করেনি। উল্টে যথেষ্ট সৌজন্য দেখিয়েছিল। গোরার নাম আগে শুনলেও শোভাযাত্রার ঘটনার পরে তার মহিমা চারুমিহির বুঝতে পেরেছিল। গ্রহ, নক্ষত্র মিলিয়ে গোরার জন্মকুণ্ডলী তৈরি করে সে গৌড়ের অধিপতি হতে চলেছে, আভাস পেয়েছিল। ঠারেঠোরে গুরু বিদ্যাবাচস্পতিকে তা জানিয়েছিল। পুরানো ছাত্রের গণনায় বিদ্যাবাচস্পতির কিছুটা ধাঁধা লাগলেও পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারেনি। ছাত্র থাকার সময়ে তার দু’একটা গণনা বিদ্যাবাচস্পতি মিলে যেতে দেখেছে। জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে গোরা যে অনেক দূর যাবে, এ নিয়ে তার সন্দেহ ছিল না। কয়েকজন রাজপুরুষকে নিয়ে সুশ্রুত রায়ের বিদ্রোহী জোট দানা বাঁধছে, এখবরও তার কাছে নিয়মিত আসছিল। সুলতানের মন্ত্রণাদাতা চারুমিহির যে গৌড়ের নতুন অধিপতি খুঁজতে নেমেছে, বিদ্যাবাচস্পতি টের পেয়ে উৎসাহ বোধ করেছিল। বৃদ্ধ গুরু সাংকেতিক শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিল প্রবীণ শিষ্যকে। সন্ন্যাস নিয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা পুরুষোত্তমপুরে চলে যেতে চারুমিহিরের গণনার ছকে অদৃষ্ট জল ঢেলে দিল। কিন্তু দমে যাওয়ার লোক নয় চারুমিহির। হাতের কাছে জ্যোতিষশাস্ত্রের ছাত্র ইসমাইল গাজীকে পেয়ে গিয়ে তার মনে হল, এ সেই মানুষ, সুলতানী মসনদে বসাতে যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। চারুমিহিরের কাছে তিন বছর জ্যোতিষচর্চায় শিক্ষানবিশি করে গাজী তখন গুরুর বেশ ন্যাওটা হয়ে গেছে। জ্যোতিষশাস্ত্র অভ্রান্ত, এ বিশ্বাস তার মনের গভীরে শেকড় চারিয়ে দিয়েছে। গাজীর এক জন্মকুণ্ডলী তৈরি করে, সেটা অসমাপ্ত রেখে তার হাতে দিয়ে চারুমিহির বলল, নিজের বাড়িতে একটু আড়ালে বসে, এই জন্মকুণ্ডলীর ফাঁকফোকর ভরে, উপসংহার লিখে চেনা কারো কুণ্ডলীর সঙ্গে মেলে কি না, একবার গুনেগেঁথে দেখ তো।

গুরুর শিক্ষায় গ্রহনক্ষত্র মিলিয়ে জন্মকুণ্ডলী বানাতে ততদিনে গাজী শিখে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে একান্তে বসে গুরুর তৈরি অসম্পূর্ণ জন্মকুণ্ডলীর অলেখা অংশ নিজে ভরাট করে যেখানে যা রহস্য ছিল সমাধান করে উপসংহারে পৌঁছে সে তাজ্জব বনে গেল। জন্মকুণ্ডলীর নির্দেশ পড়ে তার গায়ে কাঁটা দিল। জ্যোতিষার্ণবের তৈরি হেঁয়ালির মতো জন্মকুণ্ডলী যে আসলে তার জন্মকুণ্ডলী বুঝতে পারার সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক অস্পষ্ট ইঙ্গিত পেল। অদূর ভবিষ্যতে সে যদি গৌড়ের সুলতান হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পরের দিন সাতসকালে জ্যোতিষার্ণবের বাড়িতে হাজির হল গাজী। তার হাতে সেই জন্মকুণ্ডলীর কাগজ। জ্যোতিষার্ণবের বাড়িতে কিছুটা দরবারি ঠাট-ঠমক থাকলেও ভেতরমহলে স্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই। গাজীকে নিয়ে একটা ফাঁকা ঘরে গিয়ে বসে চারুমিহির জিজ্ঞেস করল, এমন অসময়ে, কী খবর?

গাজী ফিসফিস করে বলল, জ্যোতিষার্ণব, আপনি রহস্য করে যে খাপছাড়া জন্মকুণ্ডলী, আমাকে গ্রহনক্ষত্র মেনে ভরতে দিয়েছিলেন, সেটা যে আমার ছক, গোড়ায় বুঝতে পারিনি। ছক ভরে বুঝতে পারলাম, সাংঘাতিক কাণ্ড, যে কোনো মুহূর্তে আমার গর্দান চলে যেতে পারে।

গাজী থামতে তার হাত থেকে ছকটা চেয়ে নিয়ে কুটিকুটি করে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলল চারুমিহির। আঁতকে উঠে গাজী জিজ্ঞেস করল, ছকটা ছিঁড়ে ফেললেন কেন?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চারুমিহির বলল, তুমি ঠিকই ধরেছো, ছকটা তোমার।

কথাটা বলে লম্বা শ্বাস ফেলে চারুমিহির ফের বলল, আমার আধা তৈরি ছকের ফাঁকফাঁকি পূরণ করে তুমি যে ধারণায় পৌঁছেছ, তা কখনও মিলে গেলে আমি নিজের হাতে তোমার জন্মকুণ্ডলী বানিয়ে দেব।

গাজী চুপ। চাপা গলায় চারুমিহির বলল, এই ছক নিয়ে কোথাও মুখ ফসকে একটা কথা ব’লো না।

যে আজ্ঞে।

ভবিষ্যতের জন্যে মনে মনে শুধু তৈরি হও।

বিনয়ে অবনত গাজী ফের বলল, যে আজ্ঞে।

কাজী জানত, দরবারের একজন সাধারণ কর্মী থেকে হোসেন শাহ আমীর, ওমরাহ বনে যাওয়ার পরে তার জন্মকুণ্ডলী তৈরি করে জ্যোতিষার্ণব জানিয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে সে গৌড়ের সুলতান হতে চলেছে। জ্যোতিষার্ণবের গণনা বছর ঘোরার আগে মিলে গিয়েছিল। অসাধারণ ক্ষমতাবান এই জ্যোতিষশাস্ত্রীর গণনা ভুল হয় না, এই অটল বিশ্বাসে চারুমিহিরের আরও বেশি অনুগত হয়ে গেল গাজী। নিজের জন্মকুণ্ডলী নিয়ে সে যেমন মুখ খুলল না, চারুমিহিরও মুখে কুলুপ এঁটে থাকল। জ্যোতিষাশাস্ত্র শিখতে হপ্তায় একদিন চারুমিহিরের বাড়ি সে যেতে থাকল। একের পর এক ঘটনার চমকে একডালা তখন টালমাটাল হয়ে উঠেছে। রামকেলি থেকে রাতারাতি গোরার উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাতে রাগে অগ্নিশর্মা সুলতান গোপনে খোঁজখবর করে জেনে গেছে, নবদ্বীপের সন্ন্যাসীর কানে তাকে কয়েদ করার খবর পৌঁছে দিয়েছিল সাকর মল্লিক আর দবীর খাস। কীভাবে জানল? হেমন্তের সেই রাতে ধুতি, চাদর জড়ানো যে দু’জন লোককে রামকেলির ভূঞাবাড়িতে এক সিন্ধুকী ঢুকতে দেখে সেই মুহূর্তে সাকর মল্লিক, দবীর খাস হিসেবে তাদের চিনতে না পারলেও কোতোয়াল-প্রধান আসগর খাঁকে ঘটনাটা সে জানাতে ভোলেনি। রামকেলি থেকে গোরা অদৃশ্য হতে হেটোমেঠো চেহারার যে লোক দু’জন ভূঞাবাড়িতে ঢুকেছিল, তারা সাকর মল্লিক, দবীর খাস হতে পারে, এ সন্দেহ আসগরের মনে জেগেছিল। সন্দেহ চেপে না রেখে খান-ই-জাহান ইসলামাবাদীকে বলেছিল। সুলতানের কানে তা পৌঁছে যেতে সময় লাগেনি। চোয়াল শক্ত হয়েছিল সুলতানের। সন্তোষ, অমর দু’ভাইকে কয়েদখানায় পুরে ইসলামাবাদীকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব দিয়েছিল সুলতান। দু’দাদা কয়েদখানায় ঢুকে যেতে বাস্তুভিটের সদরদরজাতে তালা লাগিয়ে মাধাইপুর ছেড়ে সপরিবারে পালিয়ে গেল ছোট ভাই বল্লভ, যার নাম ‘অনুপম’ রেখেছিল গোরা। সুলতানী দরবারের দুই মন্ত্রী, সাকর মল্লিক, দবীর খাসের কয়েদ হতে আমীর ওমরাহদের অনেকে মুখে কিছু না বললেও খুশি হল। থমথমে হল দরবারের পরিবেশ। কামতাপুরের বেআদব রাজাকে শায়েস্তা করতে একডালায় তখন যুদ্ধপ্রস্তুতি চলেছে। গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান গণনা করে কামতাপুর অভিযানে সুলতানের জয় অবশ্যম্ভাবী, চারুমিহির জানিয়ে দিয়েছিল। সে টের পাচ্ছিল কামতাপুরে যুদ্ধ শেষ করে সুলতান একডালায় ফিরলে লুঠের টাকায় যখন কয়েকদিন বিজয়োৎসব আনন্দের ফোয়ারা চলবে তার মধ্যে সন্তোষ অমরের সঙ্গে দরবারের আরো কয়েকজনের মাথা ধুলোয় গড়াগড়ি যাবে। পরিস্থিতি ঘোরতর জট পাকিয়ে গেছে বুঝে গিয়ে নতুন সুলতান তৈরি করে গৌড়ের মসনদে বসাতে নিঃশব্দে কাজে নেমে পড়ল চারুমিহির। সেনাবাহিনী নিয়ে কামতাপুর অভিযান শেষ করে সুলতানের একডালায় ফিরতে কমবেশি তিনমাস লেগে যাবে। রাজধানীতে সুলতানের অবর্তমানে গৌড়ের ক্ষমতাবদলের কাজ যতটা কম রক্ত ঝরিয়ে সেরে ফেলতে হবে। গাজীর সঙ্গে চারুমিহিরের গোপন দেখাসাক্ষাৎ বেড়ে গেল। গৌড়ের সুলতানের সঙ্গে উৎকল রাজ্যের সংরক্ষিত গোবিন্দ বিদ্যাধরের শাসিত মন্দারণের মূল কেল্লার কাছাকাছি গৌড়ের দু’হাজার সেনার পাকাপোক্ত ছাউনিতে যারা ছিল, তারা সবাই যে গাজীর হুকুমে জীবন দিতে পারে, চারুমিহির জেনে গিয়েছিল। গাজী শুধু তাদের সেনাপ্রধান ছিল না, কাজীকে তারা সুফী গুরু, বন্ধু ভাবত। শুধু গৌড়ের সেনারা কেন, গোবিন্দ বিদ্যাধরের বাহিনীও নিজেদের সেনাধ্যক্ষের চেয়ে গাজীকে বেশি পছন্দ করত। দরকারে, গড়মন্দারণের উৎকল সেনারা অস্ত্র নিয়ে গাজীর পাশে দাঁড়িয়ে যাবে, এ খবর শুধু চারুমিহির কেন, স্বয়ং সুলতানও জানত। গোবিন্দ বিদ্যাধরের চেয়ে উৎকলের সেনারা গাজীকে বেশি সমীহ করত। মেদিনীপুর থেকে গড়মান্দারণ পর্যন্ত মহকুমার সার্বভৌম অধিপতি গোবিন্দও জানত গাজী ইচ্ছে করলে যখন-তখন তার রাজত্ব দখল করে নিতে পারে। গড়মন্দারণসমেত মেদিনীপুর মহল গাজীকে ঠেকানোর ক্ষমতা তার নেই। গৌড়ের সুলতানের মর্জি হলে যে কোনও দিন এমন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। গাজী সংকেত না পাঠালে সুলতান এমন ফরমান জারি করবে না, এ ধারণাও গোবিন্দর ছিল। গাজীকে খুশি রাখতে তার প্রায় তাঁবেদার হয়ে গিয়েছিল গোবিন্দ। গৌড়ের মসনদে ইসমাইল গাজীকে বসাতে কয়েকটা অনড় খুঁটি পুঁতে নিতে চাইছিল চারুমিহির একডালার প্রাসাদের রক্ষিদের প্রধান কেশব ছত্রীকে পাশে পেলে নতুন সুলতান তৈরির কাজ কতটা সহজ হবে, হিসেবে পাচ্ছিল না চারুমিহির। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাসাদ রক্ষী একসময়ে হিন্দু থাকলেও সুলতানের বাহিনীতে চাকরি পেয়ে মুসলমান বনে গেছে। বলা ভাল, জাতধর্ম নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। হিন্দুত্বের কণামাত্র যেমন তারা বুঝত না, মুসলমানের ধর্মেও তাদের কোনও আগ্রহ নেই। রক্ষীদের মধ্যে যারা হাবসি, পাঠান আর খোজা রয়েছে তাদের অনেকে নমাজ পড়লেও বাকিরা সেদিকে ফিরে তাকায় না। কেশব ছত্রীর অন্ধ অনুগত সেখানে ক’জন রয়েছে, তা নিয়ে চারুমিহিরের সন্দেহ আছে। সে হিসেব রাখতে কেশবের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। ছত্রধর হিসেবে সুলতানের চাকরিকে সে দিনগত পাপক্ষয়ের বেশি ভাবে না। চারুমিহিরের মুখে সুলতান বদলের পরিকল্পনা শুনলে সে হয়তো বেহুঁশ হয়ে যাবে। সাকর মল্লিক, দবীর খাসের কয়েদ হওয়ার পর থেকে সে অবশ্য মন খারাপ করে আছে। দু’জনই তার বন্ধু, ভালবাসার মানুষ। কয়েদ থেকে তাদের খালাস করতে কেশব হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারে। সুলতানী কয়েদখানার প্রধান, হাজি ইলিয়াস, যে কিনা কেশব ছত্রীর খাতিরের লোক, সে যে গোপনে কেশবকে তার কয়েদবাসী দুই বন্ধুর খবরাখবর দিচ্ছে, চারুমিহির জেনেছিল। হাজি ইলিয়াস আবার ইসমাইল গাজীর সম্বন্ধী। গাজীকে প্রায় পয়গমের মতো ভক্তি করে ইলিয়াস। হাজি ইলিয়াস ইচ্ছে করলে সুলতানের রক্ষীবাহিনীর বড় একটা অংশকে মুঠোয় পুরে ফেলতে পারে। ইলিয়াসের কৃপাতে বেশকিছু কয়েদী সাজা খাটা শেষ করে, তালিম নিয়ে রক্ষীর চাকরি পেয়েছে। গাজী চাইলে কয়েদখানা থেকে সাকর মল্লিক, দবীর খাসকে পালাতে সাহায্য করতে পারে ইলিয়াস। দুই বন্ধুকে পালাতে কয়েদখানার দরজা ইলিয়াস খুলে দেওয়ার আগে আড়াল থেকে সে কাজে পরামর্শ দিতে কেশব নারাজ হবে না। গাজীর অনুরোধ সে ফেলতে পারবে না। কয়েদখানা থেকে দুই নামকরা বন্দি পালালে দরবারে তুফান উঠবে, চারুমিহির জানে। সব দোষ চাপবে কারাপ্রধান কাজি ইলিয়াসের ঘাড়ে। তাকে হয়তো শূলে চাপিয়ে দেবে সুলতান। ইলিয়াসের পাশে গাজী থাকলে সেরকম না-ও ঘটতে পারে, সম্বন্ধীকে বাঁচানোর একটা বুদ্ধি গাজী বানিয়ে নেবে। ইলিয়াসের জামিন হিসেবে কেশব ছত্রীকে গাজী দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। ইলিয়াসের পাশে কেশব ছত্রী দাঁড়িয়ে গেলে প্রাসাদরক্ষীদের বড় অংশ তাদের অনুগত হবে। কামতাপুর থেকে হোসেন শাহ ফেরার আগে একডালার গদিতে ইসমাইল গাজীকে বসিয়ে দিতে পারলে অনেক সহজে প্রাসাদে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেওয়া যায়। কামতাপুর থেকে সেনাদের নিয়ে সুলতান ফেরার আগে ঝটিকাবাহিনী পাঠিয়ে মাঝপথে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া কঠিন কাজ হবে না। বিশ্বাসী লোকজনকে এক সুতোয় বেঁধে কার্যোদ্ধারের চিন্তায় মশগুল চারুমিহির নিখুঁতভাবে এগোচ্ছিল। প্রভূত বিত্ত, ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আমীর, ওমরাহকে অভ্যুত্থানে শামিল হতে রাজি করিয়েছিল। চারুমিহিরের পরিকল্পনার প্রথম অংশটা অবলীলায় হয়ে গেল। একডালার মানুষ এক সকালে উঠে জানল, কয়েদখানা থেকে রাতের অন্ধকারে সাকর মল্লিক, দবীর খাস পালিয়েছে। কারারক্ষীপ্রধান হাজি ইলিয়াসকে ঘুমের সালসা খাইয়ে, প্রায় বেহুঁশ করে, তার সহকারী মূর্তজা মকসুদ এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে মূর্তজা-ও উধাও। মোটা টাকার ঘুষ লেনদেন না হলে ফাটক থেকে কয়েদী পালাতে পারে না।

কয়েদখানা থেকে পালানো সাকর মল্লিক, দবীর খাসকে ধরতে কোতোয়াল-প্রধান আসগর খাঁ তার অনুচরদের চিরুনি তল্লাশিতে নামিয়ে দিল। একডালা থেকে নবদ্বীপ, উৎকল, বারাণসী যাওয়ার পথে ছড়িয়ে পড়ল আসগরের পাইক, বরকন্দাজ, সাদা পোশাকের সিন্ধুকী, জাসু, দানীরা। দরবারের দুই কর্মচারীর হদিশ তারা না পেলেও উৎকলের পথে এক গেঁয়ো লোক বলল, সাকর মল্লিকের মতো বড় মানুষের দেখা পাইনি। তবে সনাতন নামে একজন হেটো লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।

বারাণসী যাওয়ার পথের ধারে গাঁয়ের এক চাষী জানাল, দবীর খাসকে আমি চিনি। মস্ত মানুষ। ইদিকে বড় একটা তিনি আসেন না। ভোরের দিকে একদল তীর্থযাত্রীকে দেখলাম। আলাপ হল তাদের সঙ্গে। সকলের নাম মনে নেই। একজনের নাম রূপ। আগে শুনিনি এমন নাম, তাই মনে রয়েছে।

গেঁয়ো লোকটার বকবকানিতে বিরক্ত হয়ে আসগরের সিন্ধুকী সেখানে আর দাঁড়াল না, সহকারী জাসু, দানীদের নিয়ে নিজের পথে হাঁটা দিল। বেশ কয়েকদিন খোঁজাখুঁজি করে সাকর মল্লিক, দবীর খাসের পাত্তা পাওয়া গেল না। গৌড়ের মসনদ বেহাল হওয়ার আগে, কামতাপুর বিধ্বস্ত করে, সেখানে সিংহাসনে নিজের পছন্দের রাজপরিবারের একজনকে বসিয়ে দশ ঘড়া সোনা আরও নানা সম্পদ নিয়ে জগঝম্প বাজিয়ে একডালায় সুলতান ফিরে এল। রাজধানীতে ফেরার নির্ধারিত তারিখের কয়েকদিন আগে সুলতান ফিরে আসতে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির টের পেল, কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। সুলতানের যে কোনো যাত্রারম্ভ আর প্রাসাদে ফেরার দিন পাঁজিপুঁথি দেখে সে পাকা করে দেয়। কুড়ি বছর সেই নিয়ম সুলতান চোখবুজে মেনে চলেছে। নিয়ম ভেঙে সুলতান হঠাৎ তড়িঘড়ি একডালাতে ফিরল কেন? তার গণনায় রাজার বিশ্বাস কি উবে গেল? দরবারে সুলতানের সবচেয়ে কাছের আসনে বসে, সুলতানের মুখের দিকে আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়ে কিছু বুঝতে পারল না। সুলতানের মুখে রাগ বিরক্তি, প্রতিহিংসার কোনও অভিব্যক্তি না দেখে চারুমিহির বুঝল, তার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেছে। সুলতানের পাশাপাশি কুড়ি বছর কাটিয়ে তার মনের ভেতর পর্যন্ত কিছুটা চারুমিহির দেখতে পায়। দরবারের বেশ কয়েকজন কোতল হবে, সে আঁচ করতে পারছিল। গৌড়ের মসনদ দখলে তার পরিকল্পনা নিশ্চয় ফাঁস হয়ে গেছে। কে ফাঁস করল? যে আমীর, ওমরাহদের গৌড়ের মসনদের লোভ দেখিয়ে জুটিয়েছিল, তারা সবাই তার যজমান, ভক্তি-গদগদ হয়ে তার গণনা শোনার জন্যে অপেক্ষা করে, তাদের কেউ, দু’ বা তিনজনও বেইমানি করতে পারে। কামতাপুরে নিজেদের পোষ্য ঘোড়সওয়ারকে দূত হিসেবে পাঠিয়ে সুলতানকে তার বিপদের কথা জানিয়ে দিয়েছে। সুলতান ঠিক কতটা জানে, আন্দাজ করতে না পারলেও চারুমিহির অনুভব করছিল, তার পরমায়ু ফুরিয়ে আসছে। দরবারের কয়েকজনের সঙ্গে তার মুণ্ডুও একডালার রাস্তায় গড়াগড়ি যাবে।

একডালাতে সুলতান ফেরার পরে দরবারে, দরবারের আশপাশে গাজীর সঙ্গে চারুমিহিরের কয়েকবার দেখা হলেও বিশেষ কথা হয়নি। সে সুযোগ ছিল না। গৌড়ের মসনদ দখলের জন্যে একজন সাহসী সেনাপতির যা করা দরকার, রণকৌশল মেনে গাজী ইসমাইল তা করে ফেলেছিল। উৎকল রাজ্যকে পশ্চাৎভূমিতে রেখে গড়মান্দারণ কেল্লায় ঘাঁটি সাজিয়েছিল। কটক থেকে গোবিন্দ বিদ্যাধরকে আমন্ত্রণ করে গড়মান্দারণে এনে উৎকল বাহিনীর মাথার ওপর বসিয়ে রাখলেও কারণ জানায়নি। জ্যোতিষার্ণবের অনুরোধে তার দুই বন্ধু সাকর মল্লিক, দবীর খাসকে কয়েদখানা থেকে পালাতে নিজের আত্মীয় কারাপ্রধান ইলিয়াসকে কাজে লাগাতে দ্বিধা করেনি। ইলিয়াসের যোগাযোগে কেশব ছত্রীকে অংশ নিতে অনেকটা রাজি করিয়ে ফেলেছিল। অভ্যুত্থানের ছক, তার দিক থেকে খুঁটিনাটি সমেত গুছিয়ে জ্যোতিষার্ণবের কাছ থেকে চূড়ান্ত সংকেত পেতে সে যখন অপেক্ষা করছে, তখনই সেনাবাহিনী নিয়ে একডালায় সুলতান ফিরে এল। এটা কি করে সম্ভব, গাজী বুঝে উঠতে পারল না। কারণটা তাকে জানানোর সুযোগ পেল না চারুমিহির। তখনই এক ঝড়বৃষ্টির রাতে, প্রিয় সেনাপতি ইসমাইল গাজীকে দরবারের ভেতরের ঘরে ডেকে, তার কাঁধে হাত রেখে ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে জরুরী কাজে গড়মান্দারণের পথে রওনা করে দিল সুলতান। সুলতানের আদেশ নিয়ে নিজের তুর্কি ঘোড়ায় চেপে গড়মান্দারণের পথে দৌড় লাগাল গাজী। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, তুমুল বৃষ্টির সঙ্গে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছিল আকাশে, বাজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠছিল চারপাশ। তার মধ্যে আদরের ঘোড়ার পিঠে চেপে মাথার শিরোস্ত্রাণটা মুখের ওপর কখনও সামান্য নামিয়ে, কখনও ঈষৎ তুলে, একহাতে লাগাম ধরে, অন্যহাতে চোখের জল মুছে এগিয়ে যাচ্ছিল গাজী। যুদ্ধের তালিম দেওয়া সেনাপতির তুর্কী ঘোড়া মনিবের ওজনের সঙ্গে তার পছন্দের গতিও জানে। যুদ্ধের মাঠে, গ্রামগঞ্জ, জঙ্গলের পথে দৌড়ের পাল্লা বাহন নিজে ঠিক করে নেয়। লাগাম ধরে পিঠের ওপর বসে থাকা মনিবের দু’চোখ কখন ঘুমে বুজে আসছে, সে টের পায়। পিঠে ঝাঁকুনি দিয়ে মনিবকে সজাগ রাখে। বাহনের নির্দেশ গাজী টের পায়। কত যুদ্ধের মাঠে এই ঘোড়া তাকে নিয়ে গিয়ে অক্ষত ফিরে এসেছে, গাজী কখনও হিসেব করেনি। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাজীকে নিয়ে ছুটে চলেছে তার ঘোড়া। রাজধানী একডালার বাইরে মেঠোপথের দু’পাশে জলাজমি, পুকুর, ডোবা, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। জলাভূমির নানা জায়গায় ব্যাঙ ডাকছে। কোথাও সাপের কামড়ে আটক ব্যাঙের আর্তনাদ! রাস্তার দু’পাশে বহুকালের পুরানো পাথরের নিশ্চল গম্বুজের মতো বিশাল যে গাছগুলো ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বৃষ্টি আর প্রবল বাতাসের সাঁইসাঁই আওয়াজে শেকড় ছিঁড়ে যে কোনও মুহূর্তে তারা আকাশের দিকে উড়ে যেতে পারে। দুঃসাহসী, মুশাফির স্বভাবের ইসমাইল গাজী অন্য সময়ে যতটা নিশ্চিন্তে ঘোড়ায় চেপে দূরদূরান্তে পাড়ি দেয়, সেই দুর্যোগের রাতে তত শান্ত ছিল না তার মন। থেকে থেকে মনের ভেতর খচখচ করছিল। যে জ্যোতিষার্ণবের গণনায় তার অটল বিশ্বাস যার ভবিষ্যৎবাণী অনিবার্যভাবে মিলে যায়, এ দফায় তা কেন ফলল না, গাজী বুঝতে পারছে না। জ্যোতিষার্ণবের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কথা বলার সুযোগ পায়নি। জ্যোতিষার্ণবও যেন শুকনো-মুখে তাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। জলকাদায় পথে ছপছপ করে ছুটে চলেছে গাজীর ঘোড়া। ঘোড়াটা হঠাৎ উসখুস করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চিঁহিচিঁহি করে ডেকে উঠতে, তার পিঠের ওপর আলতো চাপড় মেরে গাজী জিজ্ঞেস করল, অন্ধকার দেখে ভয় পেলি নাকি?

মনিবের সংকেত পেয়ে কাদাজলের রাস্তায় ঘোড়া ফের ছপছপ করে দৌড় লাগাল। আলকাতরার চেয়ে কালো অন্ধকার পথের মধ্যে হঠাৎ এক সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটল। রাস্তার ওপর নেমে আসা ঝাঁকড়া এক গাছের ডাল থেকে ধারালো এক কাতান এসে পড়ল গাজীর ঘাড়ের ওপর। ঘাড় থেকে গাজীর কণ্ঠনালী পর্যন্ত নিমেষে কেটে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকলেও কাঁধের ওপর মুণ্ডুটা লেগে থাকল। মালিকের শরীর মুহূর্তের জন্যে কেঁপে উঠতে তুর্কি ঘোড়াটা গতি কমালেও দাঁড়িয়ে গেল না। গাজীর হাতের মুঠোয় আগের মতো শক্ত করে ধরা রয়েছে লাগাম। ঘাড়ের ওপর থেকে মুণ্ডু আলগা হয়ে গেলেও শিথিল হয়নি হাতের মুঠি। বৃষ্টির জলের সঙ্গে তার রক্ত মিশে ঘোড়ার শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে। জলের শীতলতা কমে গিয়ে গরম স্রোত নামছে টের পেলেও গাজীর বাহন থামল না। মালিকের হুকুম না পেলে দাঁড়ানো যায় না, গাজীর আস্তাবলে ঢোকার পর থেকে ঘোড়াটা জেনে গেছে। একডালা থেকে গড়মন্দারণের পথে এতবার এই প্রাণীটা যাতায়াত করেছে, পায়ের খুরের নিচে গোটা সড়কটা তার চেনা। ঝড়বাদলের রাতে ঘোর অন্ধকারে বাতাসের গন্ধ শুঁকে সে টের পাচ্ছে, গড়মান্দারণ বেশি দূরে নয়। পিঠে সওয়ার, মনিবের কোনও সাড়াশব্দ সে পাচ্ছে না। বৃষ্টির ঠাণ্ডা জলের ধারা হঠাৎ একটা তাপ ছড়াচ্ছে তার শরীরে। আলাদা কিছু ঘটছে অনুভব করলেও চতুস্পদ জীবটি অনুমান করতে পারছে না, তার মনিবের মুণ্ডু ঘাড় থেকে প্রায় খসে যাওয়ার অবস্থায় এখনও দু’কাঁধের মাঝখানে লেগে রয়েছে। সুলতানী দরবারের কূটনীতি ঘোড়ার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। গাজীর বাহন জানে না, ইতিমধ্যে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের সঙ্গে সেনাপতি ইসমাইল গাজীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গৌড়ের মসনদ দখলের চক্রান্ত সুলতানের কানে পৌঁছে গেছে। চক্রান্ত ঠেকাতে কামতাপুর থেকে তাড়াতাড়ি একডালা ফিরে এসে কারাপ্রধান হাজী ইলিয়াসের সহকারী মূর্তজা মকসুদকে খুঁজে বার করে প্রাসাদ অভ্যুত্থানের পুরো পরিকল্পনা, এর সঙ্গে জড়িত দরবারের আমীর ওমরাহ, কর্মচারীদের নাম পর্যন্ত সুলতান পেয়ে গিয়েছিল। কোতোয়াল-প্রধান আসগর খাঁও যে ক্ষমতা দখলের এই ছকে জড়িয়ে গিয়ে সাকর মল্লিক, দবীর খাসের খোঁজে তেমন গা করেনি, মূর্তজার জবানবন্দি থেকে সুলতান জেনেছিল। সাকর, দবীরের ছোটভাই বল্লভকে মাধাইপুরের বাড়ি থেকে সপরিবারে পালাতে মোটা টাকা ঘুষ খেয়ে সাহায্য করেছিল আসগর খাঁ। গদী উল্টে দেওয়ার ছক, পাকা মাথার যে লোকটা করেছে, তার নাম আমীর, ওমরাহ দরবারের কোনও কর্মীর মুখ থেকে না শুনলেও তাকে শনাক্ত করতে সুলতানের অসুবিধে হয়নি। সুফী, দরবেশ থেকে যে লোকটা সুলতানের সবেচেয় বিশ্বস্ত সেনাপতি হয়ে উঠেছিল, তার মাথাতে মসনদে বসার উচ্চাভিলাষ ঢুকিয়ে দিতে পারে শুধু একজন, সে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির ছাড়া আর কেউ নয়। দরবারকে ঢেলে সাজাতে একডালা পৌঁছোনোর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে সুলতান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। ঝড়বৃষ্টি রাতে গড়মান্দারণে ইসমাইল গাজীকে খতম করে দেওয়ার কাজে দুই হাবসি গুপ্তঘাতককে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। সুলতানের আদেশ পালনে সামান্য খুঁত থেকে গিয়েছিল তাদের। ইসমাইল গাজীর মুণ্ডুটা শরীরের সামনে, গলা থেকে ধারালো কাতানের একটানে নামিয়ে দেওয়ার বদলে ঘন অন্ধকারে তা করে উঠতে পারেনি। ঘোড়াটা এক কদম এগিয়ে যেতে গাছের ডাল থেকে প্রথম হাবসি ঘাতক নাগালের মধ্যে গাজীর গলাটা পায়নি। দ্বিতীয়জন কাতানের কোপটা গলার বদলে ঘাড়ের ওপর বসিয়ে দিয়েছিল। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে গাজীর অর্ধছিন্ন মুণ্ডু সমেত ধড়টা মাঝরাতে গড়মান্দারণের কেল্লায় পৌঁছোনোর বদলে ঘটনাটা ভিন্নরকম ঘটল। গাজীর ঘাড়ে কাতানের কোপ পড়ায় মুণ্ডুটা আলগা হয়ে থাকল ঘাড়ে। গড়মান্দারণে সুলতানী ফৌজের কেল্লার সদরদরজায় ঘোড়া যখন পৌঁছোল, তখনও জিনের নিচে দুটো লোহার রেকাবে গাজীর দু’পা আটকে থাকলেও বুকের ওপর মুণ্ডু কিছুটা ঝুলে পড়েছে। রক্তে ভিজে জবজব করছে ফৌজি উর্দি। বিদ্যুতের দমকা আলোয় সেনাপতির দশা দেখে ঘোড়া থেকে তাকে নামাতে অনুগত প্রহরীরা হৈহৈ করে এগিয়ে গেল। সে সুযোগ তারা পেল না। তারা হাত লাগানোর আগে থেকে মাটিতে পড়ে গেল গাজীর প্রাণহীন শরীর।

একডালা থেকে সেই দুর্যোগের রাতে ঘোড়ায় চেপে গড়মান্দারণের পথে গাজী রওনা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মূল দরবারের অলিন্দের শেষে মন্ত্রণালয়ে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরকে ডেকে নিয়েছিল সুলতান। মন্ত্রণালয়ের একটু দূরে জেনানামহলে ঢোকার দরজায় চারজন বিকট চেহারার হাবসী প্রহরী চব্বিশ ঘণ্টা খাড়া থাকে। জেনানামহলের পাহারাদাররা সবাই খোজা। শরীরের পুংঅঙ্গ বাদ হয়ে যাওয়ার জন্যে তাদের চেহারা যেমন দশাসই, চোখমুখের অভিব্যক্তি তেমন নিষ্ঠুর। আবিসিনিয়া থেকে নৌকো বোঝাই করে দেশান্তরে পাঠানো এই হাবসী খোজারা আর্যাবর্তে এসে অনেক ঐতিহাসিক, কাণ্ডকারখানা ঘটিয়েছে। গৌড়ের সুলতানও হয়েছে তাদের কেউকেউ। মন্ত্রণালয়ে সুলতান হেসে হেসে কথা বললেও চরম মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করছিল চারুমিহির। কামতাপুর থেকে আনা একটা অচেনা ফল তাকে খেতে দিল সুলতান। অচেনা ফলটা চাদরের খুঁটে বেধে নিল চারুমিহির। সুলতান বলল, এখনই এটা খেয়ে নাও জ্যোতিষার্ণব।

কথাটা বলে সুলতান দু’হাতে করে দুই তালি বাজাতে অন্দরমহলে ঢোকার দরজার সামনে থেকে দুই হাবসী পাহারাদার এমনভাবে ছুটে এল, যা দেখে বোঝা যায় সুলতানের তালি শুনতে তৈরি ছিল তারা। সুলতান বলল, জ্যোতিষার্ণবকে একটা ফল উপহার দিয়েছিল। তোমরা পরিষ্কার করে ফলটা কেটে থালায় সাজিয়ে জ্যোতিষার্ণবকে দাও।

সুলতান কথা শেষ করার মুহূর্তের মধ্যে লম্বা কালো একটা বোরখা মাছ ধরার জালের মতো চারুমিহিরের মাথার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে তাকে ঢেকে ফেলল এক খোজা। মস্ত বস্তার দুগুণ বড়ো কালো বোরখাটা ভাঁজ করে নিয়ে এসেছিল সে। চারুমিহির কিছু বোঝার আগে তাকে চ্যাংদোলা করে দুই প্রহরী অন্দরমহলের যে অংশ খিড়কির দরজার দিকে গেছে, সেদিকে নিয়ে গেল। সেই সন্ধের পরে একডালাতে চারুমিহিরকে কেউ দেখেনি। গৌড়ের মাটি থেকে কর্পূরের মতো রাজা তৈরির কারিগর, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির উবে গেলেও সুলতানী দরবারে কেউ টু শব্দ করল না। লোকটা গেল কোথায়, কেউ জানতে চাইল না। এটা জানতে চাওয়ার ঘটনা নয়। দরবারের কিছু তালেবর লোককে মাঝেমাঝে উধাও হয়ে যেতে দেখাতে তারা অভ্যস্ত! রক্তস্রোত আর বীভৎসতায় দুঃস্বপ্নের রাতের মতো ভাসমান ইতিহাসের পাশাপাশি তপন মিশ্রের বাড়িতে অনুগামীদের নিয়ে দশদিন প্রেমভক্তির সঙ্কীর্তনে মাতামাতি করে স্বরূপ আর বৃন্দাবনের দুই গোঁসাইকে নিয়ে গোরা চলেছে প্রয়াগের পথে। একডালার ঘটনাবলী সে যেমন জানে না, তেমনই পুরুষোত্তমপুরে ওড়িয়া আর গৌড়িয়াদের মধ্যে মন কষাকষি থেকে যে দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, তাও তার জানার কথা নয়। তবু সে টের পাচ্ছিল, উৎকলে, বিশেষ করে নীলাচলে গৌড়ের ভক্ত বৈষ্ণবরা শান্তিতে নেই। বৌদ্ধদের সঙ্গে বৈষ্ণবদের মাখামাখি ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অনেকে মেনে নিতে পারছে না, পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে আসার আগে সে টের পেয়েছিল। আরো কিছু অশুভ লক্ষণ নজর করলেও কৃষ্ণপ্রেমে আত্মহারা হয়ে বাকি সব ভুলেছিল। গৌড় থেকে কয়েক বছর ধরে গোরা ভক্ত বৈষ্ণবদের যারা রথের অনুষ্ঠানে পুরুষোত্তমপুরে আসছিল, তাদের বড় একটা অংশ প্রায় দু’মাস সেখানে থেকে ঘরে ফিরলেও বেশকিছু বৈষ্ণবভক্ত পাকাপাকি পুরুষোত্তমপুর আর কাছাকাছি এলাকা, আঠারোনালা, আলালনাথ, রাজমহেন্দ্রী, যাজপুর, এমনকি কটকে গিয়ে আস্তানা গাড়ছিল। রথযাত্রা ছাড়া যে কোনো পালাপার্বণে পুরুষোত্তমপুরে এসে তারা জড়ো হচ্ছিল। বৈষ্ণব হলেও অনেকে গোরা ভক্ত ছিল না। লোকদেখানো ভক্তিতে গোরার সামনে গিয়ে বিনয়ে ধরাশায়ী হলেও আড়ালে এমন কিছু নষ্টামি করত, যা পুরুষোত্তমপুর বা আশপাশের ওড়িয়াদের ক্ষিপ্ত করে তুলত। তাদের দেশে এসে গৌড়িয়ারা বেচাল করলে কেন তারা মেনে নেবে? খটাখটি প্রায় লেগে থাকত। পুরুষোত্তমপুরে গোরা থাকলে দু’পক্ষের কাজিয়া বেশিদূর গড়াত না। গোরা আর তার ওড়িয়া ভক্তরা, সংখ্যায় তারা কম নয়, কলহ-বিবাদ সামলে নিত। পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে পঞ্চম বছরের মাঝামাঝি মাতৃভূমি দর্শনে গোরা নবদ্বীপ চলে যেতে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে থাকল, যা পুরুষোত্তমপুর থেকে গৌড়িয়াদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মতো উত্তপ্ত করে তুলল পরিবেশ। ওড়িয়া, গৌড়িয়াদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে আড়াল থেকে তৃতীয় কোনও শক্তিধর পক্ষ কলকাঠি নাড়ছে, জগদানন্দ, দামোদর, গদাধর টের পাচ্ছিল। পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে গোরা নবদ্বীপে রওনা হওয়ার দশদিনের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল, যা উৎকল আর বিজয়নগরের সৌহার্দ্যে শুধু চিড় ধরায়নি, নতুন করে শত্রুতার পরিবেশ তৈরি করল। বিজয়নগরের রাজা, কৃষ্ণদেব রায়ের মেয়ে চন্দ্রাবলীর সঙ্গে উৎকল অধিপতি রাজা প্রতাপরুদ্রের ছেলে বীরভদ্রের শুভপরিণয়ে দু’রাজ্যের মধ্যে তিন বছর ধরে ধীরে ধীরে যে সদ্ভাব গড়ে উঠছিল, রাজা কৃষ্ণদেবও স্বেচ্ছায় গজপতি রাজবংশের এক রাজকুমারীকে বিয়ে করে উৎকল রাজপরিবারের জামাই হয়েছিল, আচমকা সেই সৌহার্দ্যের খুঁটি সাংঘাতিক নড়ে গেল। উৎকল রাজ্যের অংশ কোণ্ডবীড়ু দণ্ডপাট অধিকার করে সেখানে উদয়গিরি দুর্গে বন্দী উৎকলের রাজপুত্র বীরভদ্রকে ঘরজামাই করতে নিজের দখল করা দণ্ডপাট তাকে দিয়েছিল রাজা কৃষ্ণদেব। কোণ্ডবীড়ু দণ্ডপাট আগের মতো উৎকলের অংশ হয়ে গেলেও সেখানে বিজয়নগরের একটা পাকা সেনাছাউনি থেকে গেল। কোণ্ডবীড়ুতে দু’রাজ্যের সেনাবাহিনী মজুত থাকলেও দুই রাজপরিবারের মধ্যে সখ্য নিবিড় হতে থাকল। চন্দ্রাবলী, বীরভদ্রের সংসারে এল ফুলের মতো এক মেয়েসন্তান। কোণ্ডবীড়ুতে যখন সবকিছু শান্ত, স্বাভাবিক তখন এক রাতে বিষ প্রয়োগে খুন করা হল বীরভদ্রকে। দুর্গের মধ্যে তার খাবারে কে বিষ মেশাল ধরা গেল না। শুধু জানা গেল রাতে একই খাবার খেয়ে উৎকল রাজবধূ চন্দ্রাবলী সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। দুই রাজপরিবারে গভীর শোকের মধ্যেও পারস্পরিক সন্দেহ ঘনীভূত হল। নানা গুজবের সঙ্গে পুরুষোত্তমপুরের কিছু সাধারণ মানুষ এমন কথাও বলতে থাকল, যা গোরা ভক্তদের মনে আঘাত দিয়েছিল। সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের মহিমাকে খাটো করতে তারা বেশ জোট বেঁধে নেমে পড়েছিল। বীরভদ্রের মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে গোরা প্রধানভক্ত, বাসুদেব সার্বভৌম, বিদ্যানগরের রাজা রায় রামানন্দ, কানাই খনিয়া, গোপীনাথের নাম জড়িয়ে দিতে তারা দ্বিধা করল না। গৌড়ের বেশকিছু ভক্ত, যারা মহাপ্রভু জগন্নাথের মতো গোরাকেও মহাপ্রভু বলতে শুরু করেছিল, তাদের মন্দিরে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিল গোবিন্দ বিদ্যাধরের অনুগত মন্দিরের কর্তা পরিছারা; যাদের বলা হয় মন্দির পরিচালক সমিতি, তারা হুকুম দিল পুরুষোত্তমপুরে একজন-ই মহাপ্রভু, তিনি জগন্নাথ, আর কাউকে মহাপ্রভু বলা চলবে না। জগদানন্দ, গদাধর, দামোদর পর্যন্ত বাসুদেব সার্বভৌম পাশে না থাকলে মন্দিরে ঢুকতে ভয় পেতে থাকল। পুরুষোত্তমপুরে গোরা না ফিরলে এই দুর্ভোগ কাটবে না, তারা বুঝে গিয়েছিল। তাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেছিল বাসুদেব সার্বভৌম। অপরাধমূলক কিছু ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিল গোরার কয়েকজন অনুগামী। সাধারণ অপরাধ নয়, এর নাম বৈষ্ণব অপরাধ। সংসার ছেড়ে আসা বৈষ্ণব ভক্তের স্ত্রী-সংসর্গ করা ছিল অমার্জনীয় অপরাধ। বউ, ছেলেমেয়ে আত্মীয় নিয়ে গৃহী বৈষ্ণবদের সংসার করার প্রথা চালু থাকলেও গোরার ভক্তদের বড় একটা অংশ সন্ন্যাস না নিলেও ছিল ঘরছাড়া বৈষ্ণব সাধক। ব্রহ্মচর্য ছিল তাদের ধ্যানজ্ঞান। মেয়েদের মুখের দিকে তাকানো দূরের কথা, তাদের ছায়া মাড়াত না। কঠিন, কঠোর সংযমের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল গোরা। নবদ্বীপে জন্মভূমি দেখতে সে চলে যাওয়ার পরে পুরুষোত্তমপুরে কিছু বৈয়বের চালচনে আলগাভাব দেখা দিল। পুরুষোত্তমপুরে এই সময়ে আরও একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটল। চুরি হয়ে গেল রাজপ্রাসাদে। পুরুষোত্তমপুরে রাজপ্রাসাদে চুরির ঘটনাতে নীলাচলে যে শোরগোল উঠল, সেই জেরে আরো কোণঠাসা হয়ে গেল গৌড়ীয়রা। পুরুষোত্তমপুরের ব্রাহ্মণদের বড় একটা অংশ চুরির দায় চাপাল গৌড়ের কিছু বৈষ্ণবভক্তের ওপর। তারা দোষী ছিল এমন নয়। গোরার অনুরক্ত ভক্ত ছিল তারা। প্রেমভক্তি প্রচারে পুরুষোত্তমপুরের অবহেলিত বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের তারা ধীরে ধীরে নিজেদের সম্প্রদায়ে ঠাঁই করে দিচ্ছিল। ঘটনা দেখে চটে উঠছিল মন্দিরের পুরোহিত, পরিছারা। মন্দিরের জগন্নাথ মূর্তিকে বৌদ্ধরা ভাবত ঈশ্বরের অবতার নররূপী গৌতম বুদ্ধ। মন্দিরে ঢুকে তারা ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি’ আওয়াজ তুলত, ত্রিপিটকের শ্লোক উচ্চারণ করত, জগন্নাথের গোঁড়া ভক্তরা এসব সহ্য করতে পারত না। উৎকলবাসীরা জগন্নাথকে বসিয়েছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আসনে, অবতার হলেও শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ঈশ্বর। তাদের চোখে গৌতম বুদ্ধ অবতার হলেও ভগবান নয়। উৎকলে অনেক বছর ধরে মহাযানী বৌদ্ধদের যে প্রতিষ্ঠা আর মর্যাদা ছিল দশাবতারের মধ্যে, বুদ্ধের বদলে সেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পরামর্শে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণা জগন্নাথ অধিষ্ঠিত হয়ে যেতে সামাজিক আর ধর্মীয় জীবন থেকে বৌদ্ধরা খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সবরকমভাবে কোণঠাসা হয়ে গিয়ে বেঁচেবর্তে থাকা দায় হয়ে উঠতে ছোটখাটো অপরাধে জড়িয়ে পড়ল কেউ কেউ। নতুন ধর্মের খোঁজ করছিল অনেকে। নতুন এক ধর্মীয় স্রোতের জন্যে বহুবছর ধরে তারা যখন অপেক্ষা করছে, তখন তাদের ভাসিয়ে দিল গোরার প্ৰেমধৰ্ম।

রাজবাড়িতে চুরির ঘটনার পরে তস্করদের ধরার জন্যে কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে ডাকা হল। চোরাই মাল উদ্ধারে শুধু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আমন্ত্রণ জানানো আবার রাজার প্রিয়তমা রাণী বসুমতীর একপেশে মনে হতে সে ডেকে পাঠাল ব্রাক্ষ্মণ জ্যোতিষীদের। সবচেয়ে বেশি গয়না খোয়া গিয়েছিল বসুমতীর। চোর ধরতে দু’ধর্মসম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ব্রাত্মণরা হেরে গেল। বামালসমেত চোরের হদিশ দিল বৌদ্ধ শ্রমণরা। বৌদ্ধদের সফলতার চেয়ে বেশি করে ছড়িয়ে পড়ল গৌড়ের বৈষ্ণবদের অলৌকিক ক্ষমতার বৃত্তান্ত। তাদের সংস্পর্শে এসে কোণঠাসা বৌদ্ধরা ফের জাতে উঠছে, এমন ধারণা উৎকলের মানুষের মনে ছড়াতে থাকল। বৌদ্ধদের কাছে হিন্দু জ্যোতিষীরা হেরে যেতে চটে লাল হল রানী বসুমতী। দু’সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের নতুন করে পরীক্ষা করতে রাজাকে প্রায় বাধ্য করল রানী। বৌদ্ধদের ওপর রাজার আস্থা না কমলেও রানীর অনুরোধ প্রতাপরুদ্র ফেলতে পারল না। ফের পরীক্ষা হল। মন্ত্রী, পাত্র, মিত্র, অমাত্য নিয়ে রাজবাড়ির রানীমহলে বসল পরীক্ষার আসর।

গোবিন্দ বিদ্যাধরের মতো তার বোন রানী বসুমতীও ছিল অসম্ভব চতুরা। সে এমন এক পরীক্ষার আয়োজন করল, যার প্রায় বেশিটা ছিল ভেল্কি। চাকা লাগানো হাঁড়ির ভেতরে একটা বিষধর সাপ এনে প্রথমে বৌদ্ধদের জিজ্ঞেস করা হল, হাঁড়িতে কী আছে?

প্রধান শ্রমণ বলল, সাপ আছে, হাঁড়িতে।

ব্রাক্ষ্মণ সন্ন্যাসী বলল, হাঁড়িতে ছাই আছে, ছাই।

হাঁড়িতে কী রয়েছে রাজা প্রতাপরুদ্র, রানী বসুমতী আর অন্দরমহলের বিশ্বস্ত দু’একজন ছাড়া কেউ জানত না। দুই ধর্মসম্প্রদায়ের অলৌকিক ক্ষমতার মহড়া দেখতে রানীমহলে যারা এসেছিল, তাদের একজনও জানত না হাঁড়িতে কী আছে। সাপ অথবা ছাই, কিছু একটা দেখার জন্যে তারা ছটফট করছিল। রাজপরিবারের জ্যোতিষী এসে হাঁড়ির ঢাকা খুলে উত্তেজনা কমাল। সবাই দেখল, হাঁড়িতে সাপ নেই, রয়েছে এক মুঠো ছাই। বৌদ্ধদের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেল। বসুমতীর আবদারে দেশ থেকে বৌদ্ধদের তাড়িয়ে দেওয়ার রাজকীয় হুকুম জারি হল। দেশছাড়া বৌদ্ধদের সঙ্গে তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী প্রেমভক্তি প্রচারক গৌড়ের বৈষ্ণব বন্ধুরা পুরুষোত্তমপুর থেকে গলাধাক্কা খেতে চলেছে, এমন রটনাও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। রাজবাড়ির রানীমহলে অলৌকিক শক্তি দেখানোর আসরে বৌদ্ধদের হেরে যাওয়া, শুধু তাদের পরাজয় নয়, সে ঘটনা আসলে যে ধর্মজাতপাত পরিচয়হীন, কিছু বাউন্ডুলে বৈষ্ণবদের মুখে ঝামা ঘসে দিয়েছে, মন্দিরে, হাটে সমুদ্রে বালিয়াড়ি ঝাউবনে মানুষ আলোচনা করতে থাকল পুরুষোত্তমপুর থেকে বৈষ্ণবদের তাড়াতে রাজশক্তির একাংশ গোপনে কলকাঠি নাড়ছে, তাদের ক্ষমতা রাজা প্রতাপরুদ্রের চেয়ে কম নয়, জগদানন্দ, দামোদর, গদাধর আর তাদের অনুগামীরা বুঝলেও তারা মুখবুজে থাকল। গোরার ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করছিল তারা। অপেক্ষা করছিল বললে কম বলা হয়। তারা প্রবলভাবে বিশ্বাস করছিল, গোরা যেখানেই থাকুক, উৎকলের সব ঘটনা সে দেখতে পাচ্ছে। যে বিশ্বরূপ দেখাতে পারে, ভক্তজনের দুঃখ তার অগোচর থাকার কথা নয়, তারা যা ভাবছিল, তাই ঘটল। বারাণসী, প্রয়াগ ঘুরে তিন অচেনা মুখ, নতুন ভক্ত স্বরূপ, সনাতন আর রূপকে নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে গোরা ফিরে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *