৩
দুপুরে খাওয়ার সময় হয়েছে।
একতলার খাবার ঘর থেকে ডাক না এলেও তার পাশে, বৈঠকখানা থেকে ভেসে আসা উত্তেজিত গলার কথা কানে যেতে, গোরার মনে হল মাতামাতি করার মতো কেউ সেখানে এসেছে। হাসির গমক উঠল বৈঠকখানাতে। বাড়িতে নতুন কে এল, কান খাড়া করে, কণ্ঠস্বর থেকে গোরা চিনতে চাইল। মায়ের গলা, বাবার কথা, এমনকী ছোটকাকার হাসির আওয়াজ কানে এলেও নতুন অতিথির পরিচয় আঁচ করতে পারল না। কিন্তু অচেনা মানুষটার কথার পিঠে যে মা-বাবা কথা বলছে, ছোটকাকা হেসে উঠছে, বুঝতে পারল। ডাক্তার জ্যাঠা, গুণেন্দ্রনাথ রায়ের গমগমে গলা কানে এলেও মানুষটা কী বলল, স্পষ্ট শুনতে পেল না। ফি রবিবার বিকেলে যার আসার কথা, আজ সে অসময়ে হাজির কেন, হদিশ পেতে গোরা ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। বারান্দার শেষ মাথায় ছোটকাকার ঘর। ছোটকাকিকে সেখানে পেলে, জানা যায়, বৈঠকখানায় কারা রয়েছে। জ্যেঠু কেন সকালে হাজির? নতুন মানুষ কে এল?
ছোটকাকির ঘরের দিকে গোরা পা বাড়াল। জ্যেঠুর গম্ভীর গলার কথা শেষ হতে নতুন অভ্যাগতের নিচু গলার আওয়াজ কানে এলে তার পরিচয় উদ্ধার করতে পারল না। বিস্তর ডালপালা মেলা পরিবারে কে কখন আসে যায়, বাড়িতে থেকেও গোরা খবর রাখে না। জানতে আগ্রহ দেখায় না। কখনও মুখোমুখি হয়ে গেলে জানতে পারে বাইরে থেকে আসা আত্মীয়-অতিথির পরিচয়। কদাচিৎ তেমন ঘটে। একতলার বৈঠকখানায় ছোটকাকা এখন থাকলে, তার ঘরে ছোটকাকিকে একা পাওয়া যেতে পারে। ছোটকাকার ঘরে উঁকি দিয়ে, ফাঁকা ঘর দেখে একতলায় নামল। খাবার ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখে নিল, তার ছোট বোন উশ্রী আর চিঠি খাচ্ছে। ছোটকাকার মেয়ে চিঠি, উশ্রী তার আপন বোন। তাদের খাওয়ার তদারক করতে ছোটকাকি যে একতলায় রয়েছে অনুমান করল। চৌকাঠে গোরাকে দেখে চিঠি ফিক করে হাসল। উশ্রীর ঠোঁটে ছড়িয়ে গেল সেই ছোঁয়াচে হাসি। বাড়ির সবচেয়ে ছোটরা সকলের আগে নেয়ে-খেয়ে নেবে, এটা এ সংসারের নিয়ম। ছোটরা নিয়মটা পছন্দ না করলেও মেনে নিয়েছে। তারা জানে, বেশিদিন এ নিয়ম টিকবে না। তারাও একদিন বড় হবে। তাছাড়া বাড়ির বেশির ভাগ গুরুজনকে ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’ ভেবে, তাদের সান্নিধ্য ছোটরা এড়াতে চায়। উশ্রী নিজের মুখে একথা গোরাকে বলেছে। উশ্রীর কথাতে সায় দিয়েছে চিঠির সঙ্গে সমবয়সী ভাইবোনেরা। গোরাকে তারা কাছের মানুষ ভাবে। তাদের বেশ কয়েকবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, চিড়িয়াখানা, নিকোপার্ক এমনকি মিলেনিয়াম পার্কে গোরা নিয়ে গেছে। বাড়ির গাড়িতে করে নিয়ে গেলেও নিজের পয়সায় হজমোলা, ফুচকা খাইয়েছে। প্রায়ই খাওয়ায়। চৌকাঠ পর্যন্ত এসে তাদের সঙ্গে কথা না বলে গোরা চলে গেলেও ছোট দু’বোন তাই রাগ করল না।
খাওয়ার ঘরের চৌকাঠ ছেড়ে বৈঠকখানায় ঢুকে আমেরিকাবাসী সেজকাকা, নভোবিজ্ঞানী, ড.ত্রিদিবনাথ রায়কে দেখে গোরা অবাক হল। সেজকাকা কলকাতায় আসছে, সে জানত না। ‘থ্রি পিস স্যুটে’ মোড়া, আধাসাহেব, কেতাদুরস্ত যে মানুষটাকে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছে, সেই লোক যে সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি গায়ে, গলায় ধবধবে সাদা উত্তরীয় জড়িয়ে, কপালে চন্দনের তিলক এঁকে হাউস্টন্ ছেড়ে কলকাতার বাড়ির বৈঠকখানাতে বসে থাকবে, সে ভাবতে পারেনি। গলার আওয়াজ পর্যন্ত পাল্টে গিয়ে আগের চেয়ে মিহি হয়েছে। গোরাকে দেখে দাঁড়িয়ে উঠে কয়েক সেকেণ্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে সেজকাকা ডাকল, আয়, এখানে আমার পাশে বোস।
ঘরের সকলের ওপর এক লহমা চোখ বুলিয়ে সেজকাকার পাশে গিয়ে সে বসতে মানুষটা চাপা গলায় জপ করার মতো বিড়বিড় করে যা বলল, তার একাংশ ‘নামে বুক ভরে যায়’। কথাটা কানে গেলেও তার অর্থ, আর উদ্দেশ গোরা উদ্ধার করতে পারল না। তার কাঁধের ওপর হাত রেখে সেজকাকা জিজ্ঞেস করল, কেমন চলছে লেখাপড়া?
বি.কম. পার্ট টু পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট বেরনোর জন্যে অপেক্ষা করছে, গোরা জানাল। তার মুখের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে সেজকাকা কিছু খুঁজছে, সে টের পেল। কী খুঁজছে আমেরিকাবাসী সেজকাকা? সবটাই হেঁয়ালি মনে হল তার। মাঝখান থেকে তার বাবা, প্রমথনাথ বলল, পরীক্ষা শেষ করে মহাফুর্তিতে আছে। বাড়ি ফিরতে প্রায়ই মাঝরাত হয়ে যায়!
বাবার দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে গোরা বলতে চাইল, ‘হাই ইনকাম্ ফ্যামিলি’র ছেলেরা কোন দুঃখে মনমরা হয়ে থাকবে? ফুর্তিতে থাকাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। রাতে যে তারা বাড়ি ফেরে, এটা তাদের বাপের ভাগ্য!
কথাগুলো ঠোঁটে এলেও, সে বলতে পারল না।
বাবাকে আমল না দিয়ে সেজকাকাকে গোরা জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ করে তুমি সন্ন্যাসী হলে কেন?
হা হা করে হেসে সেজকাকা জিজ্ঞেস করল, কে তোকে দিল এ খবর?
বাড়িতেই শুনেছি।
ভুল শুনেছিস, বলব না। যাদের কাছে শুনেছিস, আমি-ই তাদের বোঝাতে পারিনি। আমি ভেক বদলেছি। ভেক বদলালেই সন্ন্যাসী হওয়া যায় না। কোট-প্যান্টালুন ছেড়ে বাঙালির আদি পোশাকে ফিরে গেছি। চাকরির খাতিরে বোষ্টম সেজেছি।
মানে?
অবাক গোরা প্রশ্নটা করতে সেজকাকা বলল, এটাই এখন আমার চাকরি। উত্তেজনায় সারাক্ষণ টানটান হয়ে থাকা হাউস্টনের সহকর্মীদের মন-মেজাজ ফুরফুরে রাখতে, রসদ জোগাড়ের দায়িত্ব চেপেছে আমার ঘাড়ে। সাধু চিন্তার আলো ফেলতে হবে তাদের মগজে ‘ভ্যালু ওরিয়েন্টেশন্’ কোর্সের কর্মসূচি বানাতে আমাকে এক বছরের ছুটি দিয়েছে আমাদের সংস্থা। সহকর্মীদের মুখ চেয়ে মহেশ যোগী, রজনীশ, ভক্তিবেদান্ত স্বামী, এমনকী ‘ম্যানেজমেন্ট গুরু’ দীপক চোপড়ার কাছে আরাম আর শান্তির টোটকা খুঁজতে ধর্না দিয়েছি। কোথাও খোঁজ না মিললেও অস্পষ্ট একটা আলো দেখতে পেয়েছি।
সেজকাকার কথা মন দিয়ে শোনার মধ্যে গোরা জিজ্ঞেস করল, সেটা কী?
সুরের আলো।
মানে?
গান। যে গান থেকে আলো, আরাম, শান্তি ঝরে পড়বে।
ডাক্তার জ্যাঠা জিজ্ঞেস করল, সেরকম গান গাওয়ার মতো কাউকে পেলি?
মনে হয়, পেয়েছি।
গায়কটি কে?
গোরাকে দেখিয়ে সেজকাকা বলল, আমার পাশে বসে রয়েছে, এই শ্রীমান গোরা।
থতমত খেয়ে সেজকাকার মুখের দিকে গোরা তাকাতে মুচকি হেসে মানুষটা বলল, আমার হিসেব মতো, তোর বয়স পাঁচশ আঠারো। তারও আগে রয়েছে পাঁচশ বছর, দুটো মিলিয়ে ধরা যাক, হাজার বছর। এই হাজার বছর খুঁড়ে সেই গান, সেই আলো, আরাম খুঁজে চলেছি। মনে হচ্ছে, এবার পাব।
গোরার চাউনি থেকে কিছু অনুমান করে সেজকাকা বলল, আমি যে গোরার কথা বলছি সে তুইও বটে, আবার তোর পাঁচশ বছর আগে, কিছু কমও হতে পারে, আর এক গোরা জন্মেছিল, সে-ও বটে। সেই গোরার পারিবারিক নাম-বিশ্বম্ভর মিশ্র। সন্ন্যাস নেওয়ার পরে সে হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী। নবদ্বীপের মানুষ, তাদের প্রিয় সেই রূপবান মানুষকে ‘গোরা’ বলে ডাকত।
এক সেকেন্ড থেমে সেজকাকা পাশে বসে থাকা গোরার কাঁধে হাত রেখে বলল, তোর সঙ্গে শুধু নামে নয়, চেহারাতেও পাঁচশ বছর আগের গোরার মিল আছে। বয়সটাও প্ৰায় সমান। তোকে দেখে আমার বড় আনন্দ হচ্ছে, বুক ভরে যাচ্ছে।
সেজকাকার মাথাটা বিগড়ে গেছে, ভেবেও শ্রীচৈতন্য আর ‘গোরা’ যে এক লোক, তার নাম আবার বিশ্বম্ভর মিশ্র, শুনে গোরা অবাক হল। তার ভালো নাম যে স্বয়ম্ভর রায়, কথাটা সেজকাকাকে জানাবে কিনা ঠিক করতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, বিশ্বম্ভরের বাবার নাম কী?
—জগন্নাথ মিশ্র, মা—শচীদেবী।
বিশ্বম্ভরের বাবার নাম যে প্রমথনাথ নয়, জেনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল গোরা। বাবার নাম মিলে গেলে সেজকাকার পাগলামি হয়তো বেড়ে যেত। নিজের ‘স্বয়ম্ভর’ নামটা সেজকাকাকে তাই সে বলল না। মাথা থেকে রাতের খোঁয়াড়ি পুরো কেটে গেলেও তার নামের সঙ্গে অজানা অনেক ঘটনা, প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো কাহিনী মিশে রয়েছে, শুনে রোমা বোধ করল। কাল রাতে মন্ত্রের ‘ডিস্কোথেকে’ রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসটা ঐশী পড়তে বলার পর থেকে পরের পর যে ঘটনা ঘটে চলেছে, আপাত বিচারে সেগুলোকে কাকতালীয় মনে হলেও, ঘটনাস্রোতের মধ্যে কোথায় যেন সংযোগ রয়েছে। রবীন্দ্ররচনাবলী নিয়ে ‘গোরা উপন্যাসটা পড়তে শুরু করে ঘুমিয়ে পড়া, ঘুমের মধ্যে ভাসতে থাকা গানের সুর, ঘুম ভাঙতে টেলিভিশনের পর্দায় মেগা সিরিয়াল, গোরার বিজ্ঞাপন দেখা, তারপর একতলার বৈঠকখানায় এসে হাউস্টনের নভোবিজ্ঞানী সেজকাকার মুখে হাজার বছরের ইতিহাস জুড়ে ছড়ানো ‘গোরা’ নামটা বারবার শোনা, সাধারণভাবে এলোপাথাড়ি ঘটনা মনে হলেও, কোথায় একটা যোগসাজশ রয়েছে। হাউস্টন্ থেকে কলকাতায় এসে সেজকাকা যেন পরিস্থিতি আরও জট পাকিয়ে দিচ্ছে। গোরা অনুভব করল, যে সেজকাকাকে সে চিনত, এ মানুষটা সে নয়। মগজের কলকব্জা ঢিলে হয়ে গেছে, মনে হলেও, বাইরের মানুষটা যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে। ভেতরের মানুষটা পাল্টে গেছে। তিন বছর আগে দেখা সেজকাকার থেকে এ মানুষ একদম আলাদা হলেও ভীষণ চেনা লাগল সেজকাকাকে।
দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজতে গোরার বাবা, আইনজীবী প্রমথনাথ বলল, কী কাণ্ড! দুটো বাজল, খাব কখন?
মা বলল, খেলেই হয়! রান্না তো কখন হয়ে গেছে। গোরা বাদে বাড়ির ছেলেমেয়েরা খেয়ে নিয়েছে।
কথাটা বলেই ভাসুর গুণেন্দ্রনাথকে গোরার মা বিপাশা বলল, চলুন, খেয়ে নিন।
সবাই উঠে দাঁড়াতে সেজকাকা জিজ্ঞেস করল, লাউ-এর পায়েস হয়েছে তো?
মা বলল, হয়েছে। কেমন হয়েছে জানি না। এই প্রথম বানালাম!
লাউ-এর পায়েসের কথা গোরাও এই প্রথম শুনল। লাউ দিয়ে যে পায়েস বানানো যায়, আগে জানত না।
গোরার দিকে তাকিয়ে সেজকাকা বলল, শ্রীচৈতন্য, মানে গোরা লাউ-এর পায়েস খেতে ভালবাসত। আমারও এটা ‘ফেভারিট।’
নভোবিজ্ঞানী কাকাকে গোরা বলল, সকালে টিভিতে দেখলাম, ‘ধ্রুবতারা’ চ্যানেলে ‘গোরা’ মেগাসিরিয়াল, আগামী শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে। আমি ভেবেছি, দেখব।
ঠোঁট টিপে হেসে সেজকাকা বলল, আমিও দেখব। দু’জনে একসঙ্গে দেখা যাবে।
সেজকাকার হাসিটা রহস্যময় ঠেকলেও হাসির কারণটা খাবার টেবিলে বসে গোরা জানতে পারল। টেবিলে গোরার পাশের চেয়ারে বসে সেজকাকা জানাল ‘গোরা’ মেগাসিরিয়ালের চিত্রনাট্য তার তৈরি। পঞ্চাশটা এপিসোড এখনও পর্যন্ত তোলা হয়েছে। আরও পঞ্চাশটা এপিসোডের চিত্রনাট্য তৈরি থাকলেও বিশেষ এক কারণে, তা আটকে গেছে। মনে হচ্ছে, ফের শুরু করতে আর অসুবিধে হবে না। কলকাতায় না এলে এত সহজে মুশকিল আসান করা যেত না।
কাহিনী কোথায় শেষ হবে, এখনও সেজকাকা ভেবে ঠিক করতে পারেনি। মূল্যবোধ এই পৃথিবীতে বিপণনের পণ্য হয়ে উঠলেও হাউটন নভোবিজ্ঞানী কেন্দ্রের কর্তারা, যারা এই ছবির প্রযোজক, মুনাফার জন্যে ছবিটার প্রযোজনা করছে না। সংস্থার বিজ্ঞানী আর কর্মীদের মনে প্রসন্নতা আনাই এই ছবি প্রযোজনার মূল উদ্দেশ্য। বিষয়টা এত নতুন, এমন জীবনদায়ী যে প্রযোজকরা বিষয়ের কূল-কিনারা পাওয়ার আগেই শ্যুটিং-এর কাজ সেজকাকা শেষ করে ফেলতে চায়।
চৈতন্যের জীবনের পুরো বিবরণ তুই জোগাড় করলি কোথা থেকে?
ডাক্তার জ্যেঠার প্রশ্নে সেজকাকা মুচকি হেসে বলল, দু’বছর অক্লান্ত খেটেছি। ভক্তের চোখে চৈতন্য আর ইতিহাসের চৈতন্য, চৈতন্যজীবনের দু’রকম ব্যাখ্যার গভীরে যে অজানা চৈতন্য, যাকে বৈষ্ণব ভক্তরা দেখেনি, ঐতিহাসিকরা এড়িয়ে গেছে, দু’তরফের বিবরণের মাঝখানে যে অন্তর্লীন অচেনা চৈতন্য, তাকেই আমি খোঁজ করেছি। সিরিয়ালের প্রথম ‘এপিসোড’ থেকে তাকে সামনে আনতে চেয়েছি। তোমাদের অজান্তে গত দু’বছরে পাঁচবার নবদ্বীপ থেকে নীলাচল, তার মধ্যে দু’বার বাংলাদেশে, শ্রীহট্টে ঘুরে গেছি। নবদ্বীপ ছেড়ে, গঙ্গা পেরিয়ে কাটোয়া পৌঁছে, যে পথে গোরা নীলাচল গিয়েছিল, দক্ষিণ ভারত ঘুরেছিল, বৃন্দাবন, মথুরা কাশী পরিক্রমা করে ফের নীলাচলে ফিরেছিল, সেই ভ্রমণপথের যতটা সম্ভব নির্ভুল মানচিত্র তৈরি করে, আমি নিজেও দু’বার সেই রাস্তায় চক্কর দিয়েছি। সব দিক থেকে যতটা সম্ভব প্রস্তুত হয়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছি। বিজ্ঞানের জালে জড়িয়ে থেকেও গানের আলো খোঁজার কাজে ফাঁকি দিইনি। আশা করি, দেশের দর্শক আর হাউস্টনে আমার সহকর্মীরা এই ছবি দেখে প্রাণের আরাম পাবে, উদ্দীপ্ত হবে। প্রথম পঞ্চাশটা এপিসোড, কলকাতার ‘ধ্রুবতারা’ চ্যানেলে দেখানোর পাশাপাশি, তার ইংরেজি ডাবিং হাউস্টনে মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্রের চ্যানেলে সেখানকার দর্শকদের জন্যে প্রদর্শিত হবে। ফল কি হল, জানতে এক-দেড় মাস, হয়তো আরও বেশি সময় অপেক্ষা না করে উপায় নেই।
কথার মধ্যে কাচের বাটি থেকে লাউয়ের পায়েস দু’চামচ মুখে তুলে কাকা বলল, অমৃত, ফ্যান্টাটিক্, হাউস্টনে এ পায়েস বানানোর সাধ্যি কারও নেই।
দুপুরে টিভিতে দেখা ‘গোরা’ সিরিয়াল যে সেজকাকার কীর্তি, গোরা কল্পনা করতে পারেনি। খবরটা শুনে অভিভূতের মতো বিজ্ঞানী কাকাকে সে বলল, প্রথম এপিসোডটা তুমি শোনাবে আমাকে?
নিশ্চয়। পুরো গল্পটাই শোনাব, তবে খেপে খেপে, কাহিনীর শেষটা হয়তো তোকে তৈরি করে নিতে হবে। মানে তোর ঘাড়ে চাপবে উপসংহার লেখার দায়িত্ব।
সেজকাকার কথার শেষটা হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলেও হাজার বছরের ঢেউ ভাঙার আওয়াজ গোরা শুনল। ‘গোরা’ মেগা সিরিয়ালের প্রথম ‘এপিসোড’ শোনার আগ্রহে সে, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে তার বাবা বলল, ত্রিদিবের পাল্লায় পড়ে, মনে হচ্ছে, ছেলেটার খ্যাপামি আরও বাড়বে। তা বাড়ুক। ‘খ্যাপামি’ না থাকলে বড় মানুষ হওয়া যায় না।
খাওয়া শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে গোরার সঙ্গে তার ঘরে গিয়ে বসল নভোযান বিজ্ঞানী ত্রিদিবনাথ রায়। দুপুর তখন বিকেলের দিকে গড়িয়ে গেছে। ‘গোরা’ মেগাসিরিয়ালের প্রথম ‘এপিসোড’, ভাইপো গোরাকে শোনাতে শুরু করল, বিজ্ঞানী ত্রিদিবনাথ।
পাঁচশ আঠারো বছর আগে, চোদ্দশ ছিয়াশি সালের সাতাশে ফেব্রুয়ারি যার জন্ম, সেই ‘গোরা’ যার অন্য নাম—বিশ্বম্ভর, নিমাই, আরও কত কি! তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাতদিন আগে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, সকালের গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে যাত্রীবাহী একটা নৌকো শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপ যাচ্ছিল। তখন জলপথে বারেন্দ্রভূমি থেকে রাঢ়, সুম্ম, হরিকেল, সমতট, বাঙ্গালা, গৌড় যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। শ্রীহট্টের সুর্মা নদী থেকে যাত্রা শুরু করে তেমনই এক ছাউনি লাগানো নৌকো যমুনা, মেঘনা পেরিয়ে তিন দিন, তিন রাত পরে, পদ্মার উত্তাল ঢেউ এড়াতে রাতের মতো লখনৌতির ঘাটে যখন ভিড়ল, তখন ছাউনির ভেতরে এক পরিপূর্ণ সন্তানসম্ভবা স্ত্রীলোক ক্ৰমাগত ‘ওয়াক’ তুললেও তার গলা দিয়ে দু-এক ফোঁটা জল ছাড়া কিছু বেরোচ্ছিল না। সুর্মা নদী ছেড়ে প্রথম সন্ধেতে যমুনায় ঢোকার পর থেকে স্ত্রীলোকটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। কয়েকবার বমি করে। রাতের মতো কাছাকাছি এক জনপদের ঘাটে নৌকো লাগিয়ে মাঝিরা যাত্রায় ক্ষান্তি দেয়। পরের দিন ভোররাতে যমুনা ছেড়ে নৌকো মেঘনায় ঢুকলে স্ত্রীলোকটির আবার বমি শুরু হয়। রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ে। সকাল, সন্ধে অন্নগ্রহণ করার মতো রুচি তার ছিল না। ‘অন্ন’ মানে দই, চিঁড়ে, মুড়ি, পাকা কলা, বাতাসার ফলার আর বিশুদ্ধ গঙ্গাজল। নৌকোর আরোহীরা যে নবদ্বীপবাসী সদবিপ্র পরিবার, প্রায় এক বছর মাতৃভূমি শ্রীহট্টে, বৃদ্ধ মা-বাবা উপেন্দ্র মিশ্র, শোভাদেবী আর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে কাটিয়ে ঘরে ফিরছে, তাদের অজানা নয়। ব্রাহ্মণদের আচারবিচার, নৌকোয় রান্না করা এক মুঠো ভাত-তরকারি খাওয়াও যে তাদের নিয়ম-বিরুদ্ধ, মাঝিরা ভালো জানে। নৌকোয় ওঠার পর থেকে গেল ছত্রিশ ঘণ্টায় মুড়ি, চিঁড়ে, নাড়ু, খাজা ছাড়া তারা কিছু খায়নি। শ্রীহট্টের লাউড় ঘাট থেকে নৌকোতে ওঠার সময়ে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাটির বিরাট জালা ভর্তি জলও তারা নিয়েছিল। সব যাত্রী নেয়। জলপথে যাতায়াতের সময়ে খাদ্যের চেয়ে জলের দরকার হয় বেশি। মেঘনা ছেড়ে নৌকো পদ্মা নদীতে ঢোকার পরে স্ত্রীলোকটি এতই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে তার গলা দিয়ে জল পর্যন্ত নামছিল না। নৌকোর তিন মাঝির মধ্যে সাদা দাড়ি, সবচেয়ে বয়স্ক জন, মনে মনে জলপথের রক্ষাকর্তা পাঁচ পীরের নাম জপ করছিল। সন্তানসম্ভবা ব্রাক্ষ্মণীর শরীরের দশা দেখে সে ভয় পেয়েছিল। নৌকোয় কিছু ঘটে গেলে শ্রীহট্টে ফিরে যে সে মুখ দেখাতে পারবে না, এ আতঙ্কও তার মনে জেঁকে বসেছিল।
চব্বিশ ঘণ্টা আগের ঘটনা এটা। তারপর আরও একটা দিন পার করে পদ্মার দামাল স্রোত ঠেলে লখনৌতির ঘাটে পৌঁছে হিসেব কষে সে দেখল, সুর্মা নদীর ঘাট থেকে নৌকো ছাড়ার পরে বাহাত্তর ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। জোয়ারের টান থাকলে নবদ্বীপ পৌঁছোতে আরও দু’দিন লাগবে। পদ্মা পেরিয়ে জলঙ্গী নদী ধরে কাল দুপুরে গঙ্গায় পড়ে গেলে, পরশু দুপুরের মধ্যে নবদ্বীপের ঘাটে নৌকো লাগাতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। সবই পাঁচ পীরের ‘দোয়া’ আর আরোহী ব্রাহ্মণ পরিবারের হাতযশ। ব্রাহ্মণীকে জ্যান্ত অবস্থায় নবদ্বীপে পৌঁছে দিতে পারলে শ্রীহট্টে পৌঁছে বরহানউদ্দিনের মাজারে সে সিন্নি চাপাবে। শীত শেষ হয়ে গেলেও মাঝখানে মাঘের বৃষ্টিতে পদ্মায় ঢেউ-এর দাপাদাপি চলেছে, মাঝি আগে থেকে ভাবতে থাকে। তার দুই সঙ্গী ছেলে আর ছোটভাইও এই পথের হালহদিশ জানে না। মেঘনা পেরিয়ে তারা এই প্রথম সমুদ্রের মতো কুলকিনারাহীন পদ্মার জলরাশি দেখল। ভয় পায়নি তারা। বরং শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত নৌকোয় যাত্রী পৌঁছোনোর বরাত পেয়ে দেশ দেখার খুশিতে তারা মশগুল। সুর্মা থেকে হাল ধরে আর দাঁড় টেনে যমুনা, মেঘনার বাইরে আর কোথাও যায়নি। যেখানেই যাক সকালে গিয়ে সন্ধের মধ্যে পৌঁছে, পরের সকালে রওনা হয়ে শ্রীহট্টে ফিরেছে।
শীত শেষ হলেও কয়েক মাস আগে বর্ষায়, বারেন্দ্রভূম থেকে সমতট পর্যন্ত বন্যায় যে ভেসে গিয়েছিল, তার জের ফাল্গুন মাসেও কাটেনি। পূর্বদেশের নদীসমূহের গতর যেমন জলাভারাক্রান্ত ছিল, তেমনই ছিল তাদের তর্জন-গর্জন। বন্যার দাপটে পূর্বদেশের কত মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছিল, কত সহস্ৰ গবাদি পশু ভেসে গিয়েছিল, ভেঙে পড়েছিল কত ঘরবাড়ি, সে হিসেব যেমন কেউ রাখেনি, তেমনি এই দুর্যোগের জন্যে নিজেদের অদৃষ্ট ছাড়া কাউকে দায়ী করেনি। আক্ষেপে হা-হুতাশ করলেও দোষী সাব্যস্ত করেনি কাউকে। নদী থাকলেই বর্ষায় বন্যা হয়, বাড়ি জমি, ক্ষেত ফসল ভেসে যায়, গাছপালা ভেঙে পড়ে, শ্মশান হয়ে যেতে পারে জনপদ, এটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল। নদীর করাল মূর্তি ধীরে ধীরে শান্ত হয়েছিল। জলে ডুবে থাকা গ্রাম-প্রান্তর, নদীর বুকের ভেতরকার চরভূমি ক্রমে জেগে উঠেছিল। স্বাভাবিক হচ্ছিল মানুষের রোজের জীবনযাত্রা। মাঘ মাসের শেষ দিকে আবার কয়েক পশলা ঝেঁপে অসময়ের বৃষ্টি নামতে, শীতের শেষেও মেঘনা, পদ্মা এমন ভয়ঙ্করী হয়ে থাকবে, পাকা দাড়ি, বয়স্ক মাঝিরও জানা ছিল না। অসমবয়সী দুই সঙ্গীকে নিজের অজ্ঞতা বুঝতে না দিয়ে সাদা দাড়ি মাঝি দু’বার ‘বদর বদর’ উচ্চারণ করে সাহসী গলায় বলল, এ আমাদের শ্রীহট্টের ফেণী, গোমতী নদী নয়, এ হল পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রের দশগুণ খ্যাপা, তবে জোয়ারের এই টান কাল থাকলে সন্ধের আগে জলঙ্গী ধরে নেব।
আশ্বাসের কথা শোনালেও ছাউনির ভেতরে অসুস্থ ব্রাহ্মণীর দশা দেখে তার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছিল। ব্রাক্ষ্মণীর বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের বেশি নয়। মা হওয়ার বয়স এখনও যে পেরোয়নি, তার শরীর জুড়ে মা হওয়ার লক্ষণ ফুটে ওঠা থেকে বোঝা যায়। তবে সঙ্গী দশ বছরের ছেলেটার পরে, এই ব্রাহ্মণী নিশ্চয় দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হয়নি। মাঝখানে আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। তাদের নবদ্বীপে রেখে হয়তো শুধু বড় ছেলেকে নিয়ে ব্রাত্মণ দম্পতি শ্রীখণ্ডে এসেছিল। অল্পবয়সী সন্তানদের নবদ্বীপে রেখে কীভাবে সস্ত্রীক এই বিপ্র শ্রীখণ্ডে প্রায় এক বছর কাটাল, বৃদ্ধ মাঝির মাথায় ঢুকল না। ব্রাহ্মণের অভাব না থাকলেও সে যে ধনীলোক নয়, তার চাল-চলন থেকে মাঝি বুঝে গেছে। শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপ যাওয়ার ভাড়া পাঁচ কার্ষাপণ থেকে পঞ্চাশটা কড়ি কমানোর জন্যে কম ঝুলোঝুলি করেনি। শেষ পর্যন্ত পাঁচ কার্যাপণে রাজি হয়েছে। ভাগ্য ভালো থাকলে, নবদ্বীপে যাত্রী নামিয়ে খালি নৌকো নিয়ে শ্রীহট্টে ফিরতে হবে না। পথে দু’চারজন খুচরো যাত্রী পেলে রাঢ়, সমতট, বঙ্গাল, লখনৌতির কোথাও বাড়তি কিছু কড়ি রোজগার হয়। আপাতত ইনসাল্লাহ্ খোদার দোয়ায় নবদ্বীপে পৌঁছানো দরকার। সুমার ঘাট থেকে নৌকো নিয়ে যমুনা, মেঘনা, পদ্মা পেরিয়ে গঙ্গার ধারে নবদ্বীপে, পঞ্চাশ বছরের মাঝিজীবনে সে একবার এসেছে। তার কমবয়সী দুই সঙ্গীর কেউ, নৌকো নিয়ে একবারও গঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া দূরে থাক, পদ্মাতেও আসেনি। সুর্মা, গোমতী, ফেণী নদী বেশি হলে যমুনা, মেঘনা পর্যন্ত তাদের দৌড়। দু’একবার হয়তো কামরূপের দিকে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে থাকতে পারে। তাও ব্রহ্মপুত্রের খুব গভীরে যায়নি। বুড়ো মাঝি তার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করল, ভাত ফুটল?
তার প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট না শুনলেও ‘ভাত’ শব্দটা কানে যেতে নৌকোর ছই-এর ভেতরে ভারি শরীর নিয়ে বমিতে কাতর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীলোকটি, যার নাম শচী, গেল চব্বিশ ঘণ্টা দাঁতে যে কিছু কাটেনি, অল্প জল খেলেও উগরে দিয়েছে, তার জিভে জল এল। সুক্কুনি দিয়ে কিছুটা গরম ভাত খেলে কিছুটা সুস্থ হতে পারত সে। আর কিছু না হোক; উঠে বসতে পারত। বসতে চেষ্টা করলে মাথা ঘুরে যেত না। ত্রিশ বছর আগে, শ্রীহট্টে যবন আর দিনেমারদের উপদ্রবে ভয় পেয়ে বাবা নীলাম্বর চক্রবর্তী আর পরিবারের সঙ্গে যখন নবদ্বীপে চলে এসেছিল, তখন সে ছ-সাত বছরের বালিকা। বলা যায়, শিশু। তবু শিশু নয়। তাকে শ্বশুরঘরে পাঠানোর জন্যে অভিভাবকরা যোগ্য কুলীন পাত্র খুঁজলেও, শ্রীহট্টে তা পাওয়া সম্ভব ছিল না। দূর দূর দেশ থেকে আসা মহাশক্তিধর, দুর্ধর্ষ যবন আর ম্লেচ্ছদের হাতে ধর্মনাশের ভয়ে শ্রীহট্ট খালি করে দিয়ে ব্রাহ্মণরা সপরিবারে নবদ্বীপে পালাচ্ছিল। নিরুপদ্রবে বসবাস করার জায়গা বলতে তখন শুধু ছিল নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ফুলিয়া আর গঙ্গার দু-তীরের কিছু অঞ্চল। তার মধ্যে জ্ঞান, বিদ্যাচর্চায় নবদ্বীপ ছিল অগ্রণী। ব্রাহ্মণদের মর্যাদা ছিল। শূদ্রদের একাংশ, বৈদ্য আর কায়স্থরা যেমন সচ্ছল ছিল, তেমনই ছিল ব্রাহ্মণদের ওপর শ্রদ্ধাশীল। বৈদ্য, কায়স্থরা শাস্ত্র অধ্যয়ন না করলেও কিছুটা লেখাপড়া জানত। বেদ পড়ার মতো বিদ্যে না থাকলেও পেশাগত কারণে বৈদ্যদের যেমন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পড়তে হত, তেমনি জমি-জমার হিসেব রাখতে বিষয়-আশয় আগলাতে, কায়স্থদের শিখতে হতো আঁকজোক, হস্তলিপি। ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ, স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও নবদ্বীপে ছিল তাদের রমরমা। নিচুস্তরের শূদ্র, অর্থাৎ নবশাকদের ওপর পড়েছিল বৈদ্য, কায়স্থদের প্রভাব। নবশাক সম্প্রদায়ের মধ্যে তিলি, মালাকার, তাঁতি, সদ্গোপ, নাপিত, বারুই, কামার, কুমোর, ময়রাদের এগিয়ে থাকা অংশ, কায়স্থদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাতে উঠতে যজমান হওয়ার প্রার্থনা নিয়ে ব্রাহ্মণদের দরজায় হত্যে দিল। শ্রীহট্ট ছেড়ে নবদ্বীপে না গেলে এত তত্ত্ব শচী জানতে পারত না। নবদ্বীপকে তার মনে হয়েছিল স্বর্গ। জীবনে সেই একবার নৌকোয় চেপে পাঁচটা নদী পেরিয়ে নবদ্বীপে পৌঁছোনোর স্মৃতি, ত্রিশ বছর পরে তার মন থেকে প্রায় মুছে গেলেও, নৌকোয় চেপে এভাবে যে তার মাথা ঘোরেনি, বারবার বমি হয়নি, সে মনে করতে পারে। জগন্নাথ মিশ্রের বাবা উপেন মিশ্রের সঙ্গে তার বাবা নীলাম্বর চক্রবর্তীর পরিচয় থাকলেও জগন্নাথকে সে তখনও দেখেনি। জগন্নাথকে দেখেছিল আরও কয়েক বছর পরে, নবদ্বীপে বিয়ের সন্ধেতে। বারেন্দ্রভূমি বাঙ্গালা, সুম্ম, সমতট জুড়ে তখন চলছিল প্রবল মাৎস্যন্যায়, ব্রাহ্মণ আর শূদ্রে বিভাজিত হিন্দুসমাজ ভেঙে পড়ছিল। গরীব শূদ্ররা ঝাঁক বেঁধে ধর্মান্তরিত হচ্ছিল। যাদের সামান্য সাহস, সম্বল ছিল সেই কায়স্থ, নবশাকভুক্ত ঝেঁটিয়ে দেশান্তরী হচ্ছিল, শ্রীহট্ট ছেড়ে দলে দলে চলে আসছিল নবদ্বীপে। শ্রীহট্ট ছেড়ে নীলাম্বর চক্রবর্তী নবদ্বীপে এসে বাস করতে শুরু করলেও সপরিবারে উপেন্দ্র মিশ্র থেকে গেল শ্রীহট্টে। সাত ছেলের মধ্যে পঞ্চমজন, জগন্নাথকে উচ্চশিক্ষার জন্যে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দিল উপেন্দ্র মিশ্র। শ্রীহট্টের বন্ধু, উপেন্দ্রর ছেলে জগন্নাথকে নবদ্বীপের গঙ্গার ধারে, স্নানের সময় দেখে, তার পরিচয় শুনে আকাশের চাঁদ হাতে পেল নীলাম্বর চক্রবর্তী। শ্রীহট্টে চিঠি চালাচালি করে উপেন্দ্র আর তার স্ত্রী শোভার অনুমতি নিয়ে, জগন্নাথের সঙ্গে শচীর বিয়ে দিয়ে দিল নীলাম্বর চক্রবর্তী। স্ত্রী, পরিবার নিয়ে বরকর্তা উপেন্দ্র হাজির থাকতে না পারলেও তার বকলমা দাঁড়াতে নবদ্বীপবাসী যোগ্য শ্রীহট্টীয় অভিভাবকের অভাব ঘটল না। বিয়ে হয়ে গেল। শচীর বয়স তখন তেরো। জগন্নাথের বাইশ বিয়ের একবছর পরে শচী প্রথম মা হয়। তার একটা মেয়ে হয়, এক মাসের মধ্যে মারা যায় সেই মেয়ে। শুধু একটা নয়, পরপর আটটা মেয়ে, কেউ আঁতুড়ঘরে, কেউ তিন মাস বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। সবচেয়ে বেশি দিন যে বেঁচেছিল, সে তিন বছর। সে বেঁচে থাকতে বিশ্বরূপ ভূমিষ্ঠ হওয়ার দ্বিতীয় মাসে অষ্টম গর্ভের মেয়েটি দুপুরে মায়ের পাশে শুয়ে সেই যে ঘুমলো, আর জাগল না। দু’মাসের ছেলেকে বুকে আঁকড়ে শচীও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছেলের হাত-পা ছোঁড়াতে ঘুম ভেঙে যেতে প্রথমে তাকে আদর করে বাঁ পাশে ঘুমন্ত মেয়ের গায়ে হাত রেখে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল শচীর বুক। মেয়ের শরীর এত ঠাণ্ডা কেন? পাশ ফিরে তার হাতটা ধরে মনে হল হিমে ভেজা কাঠের টুকরো, তিন বছরের মেয়ের হাতটা তার মুঠো থেকে কাঠের টুকরোর মতো খসে পড়েছিল।
পুরনো ঘটনা ভাবতে গিয়ে শচীর শরীরের ভেতরটা আবার গুলিয়ে উঠল। ‘ওয়াক’ তুলল দু’বার। গলা দিয়ে এক ফোঁটা জল না বেরিয়ে প্রাণটা বেরিয়ে আসতে চাইল। পেটের ভেতর যে রয়েছে তার নড়াচড়া টের পেয়ে লম্বা শ্বাস টানল শচী। তার শরীরের ধকলে পেটের বাচ্চাটা যেন কষ্ট না পায়। সে যেন ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারে, গর্ভের অন্ধকারে ঈশ্বরের দয়ায়, পৃথিবীর আলো দেখা পর্যন্ত আরামে থাকে। বিশ্বরূপের জন্মের দশ বছর পরে, নবদ্বীপ থেকে পাঁচ নদী পেরিয়ে শ্রীহট্টের লাউড়ে এসে কীভাবে সে আবার গর্ভধারণ করল, এ প্রশ্ন ঘন কুয়াশার মতো মনে যে প্রশ্ন জাগিয়েছে, তার সদুত্তর সে খুঁজে পাচ্ছে না। স্বামীকে ঠারেঠোরে কয়েকবার প্রশ্নটা করতে সে এমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল, যা দেখে উত্তর শোনার জন্যে শচী আর খোঁচায়নি। মা হতে সে শ্রীহট্টে আসেনি। নবদ্বীপ থেকে পাঁচ দিনের দুর্গম জলপথ ঠেঙিয়ে, বিশ্বরূপের দীর্ঘ জীবন কামনায় বুরহানউদ্দিনের মাজারে সিন্নি চাপাতে এসেছিল। নবদ্বীপে বসেই তারা স্বামী-স্ত্রী এই মানত করে রেখেছিল। সুফি সাধক সেলিম চিস্তির শিষ্য, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার এক ঘনিষ্ঠ অনুগামী, বুরহানউদ্দিন ছিল আরবদেশের বণিক। নিজামুদ্দিনের প্রভাবে বিষয়সংসার ছেড়ে সেও হয়ে গেল দরবেশ, সুফি সাধক। তার নাম হল বুরহানউদ্দিন আউলিয়া। শ্রীহট্টে এসে সেই সুফিসাধক নিজের ধর্মমত প্রচার করতে সেখানে থেকে গেল। সংসার পাতল শ্রীহট্টে। সব ধর্মের মানুষকে বুকে টেনে নিয়ে শোনাল পরম শক্তিমানের বাণী, ধ্যানের মন্ত্র। কথিত আছে খরার সময়ে তার ডাকে বৃষ্টি নামত, ভরা বর্ষায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনার প্লাবন। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভ্রুকুটি করলে নক্ষত্র খসে পড়ত। তার মৃত্যুর পরে শ্রীহট্ট, জয়পুর গ্রামে, তাকে যেখানে সমাধিস্থ করা হয়, সেখানে গড়ে ওঠে নতুন তীর্থক্ষেত্র, পীর বুরহানউদ্দিনের মাজার। পরের দেড়শো বছরে সেই মাজারের মাহাত্ম্য বারেন্দ্রভূম থেকে সুক্ষ্ম, সমতট হয়ে গৌড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বুরহানউদ্দিনের মাজারে সঙ্কল্প করলে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। পাঁচ পুরুষ ধরে মাজার রক্ষণাবেক্ষণ যারা করছে, সেই মুজাভিরদের প্রত্যেকে বুরহানউদ্দিনের বংশধর। মুজাভিরের দায়িত্ব নিতে প্রতি প্রজন্মে পরিবারে একের বেশি মেয়ে জন্মালেও একটাই পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। বুরহানউদ্দিনের মতো সুপুরুষ তারা। বংশপরম্পরায় সুফি সাধনার যে ধারা তারা বহন করে চলেছে তার মূল কথা—সহজ ধর্ম, সহজ জীবন, মানুষে মানুষে সহজ সম্পর্ক, যার নাম প্রেম আর ভালোবাসা। বছরে একদিন, চৈত্র সংক্রান্তিতে সেখানে পীরের মেলায় সারা দেশের ভক্তের ভিড় ভেঙে পড়ে। পরপর আট মেয়ে হারানোর শোকে প্রায় পাগলিনী শচী, বিশ্বরূপকে আঁকড়ে ধরে চেনাজানা যত মন্দির, মাজার, তীর্থস্থান আছে, সকলের কাছে ছেলের পরমায়ু প্রার্থনা করে কত যে ব্রত, সঙ্কল্প, পূজার্চনা দশ বছর ধরে করে চলেছে, হিসেব নেই। অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী, প্রতিপদ—মাসে প্রায় দশ দিন নিরম্বু উপোস করে শচী। সবই করে ছেলের কল্যাণ কামনায়। তার পাশে ছায়ার মতো থাকে জগন্নাথ। বুরহানউদ্দিনের মাজারে যাওয়ার সঙ্কল্পও দু’জনে একসঙ্গে নিয়েছিল। দু’জনের কেউ সেই সঙ্কল্প ভোলেনি। স্ত্রীর সঙ্গে জগন্নাথ, গৌড় থেকে আরম্ভ করে সমতট, সুষ্মের যত তীর্থক্ষেত্র, সব জায়গাতে প্রতিশ্রুতিমতো নৈবেদ্যের ডালি পৌঁছে দিলেও দূরত্বের কারণে বুরহানউদ্দিনের মাজারে যেতে দেরি করেছিল। শ্রীহট্টে যাওয়ার সুযোগ ঘটল, বিশ্বরূপ দশ বছরে পা দিতে। মাজারে সিন্নি আর চাদর চড়ানোর সঙ্গে মাতৃভূমিতে গিয়ে মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে দেখা করার বাসনা জেগেছিল জগন্নাথের। বালক বয়সের দিনগুলো কি সহজে ভোলা যায়? লখনৌতির ঘাটে নৌকোর ছই-এর মধ্যে প্রদীপের আলোতে বসে দশ বছরের বিশ্বরূপকে চল্লিশ বছর আগের বিবরণ শোনাচ্ছিল জগন্নাথ।
মাহমুদশাহী শাসন শেষ হয়ে তখন শুরু হয়েছে ইলিয়াস শাহী শাসন। গৌড়ের প্রবল প্রতাপ সুলতান রুকনুদ্দিন বরবক শাহের দাপটে সাতগাঁ, সোনারগাঁ, লখনৌতি নিয়ে যে বাঙ্গালা, সেখানকার হিন্দু রাজা, ভূস্বামীরা সিংহাসন বাঁচাতে তটস্থ! দুর্ভাবনার ছোঁয়াচ সমতট, সুক্ষ্ম হয়ে নবদ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
জগন্নাথের বিবরণ শোনানোর মধ্যে ফাল্গুন মাসের ঝাপ্টা হাওয়ায় ছই-এর ভেতরে নিভে যাওয়া প্রদীপটা চকমকি ঠুকে আগুন বার করে, এক মাঝি জ্বেলে দিল। দীপের আলো সাত-দশ মিনিটের বেশি থাকছে না। বাতাসে নিভে যাচ্ছে বারবার। সন্ধের পর থেকে সাত-আটবার মাঝিদের জ্বেলে দিতে হয়েছে। জগন্নাথ শোনাচ্ছিল, তার বাবা উপেন্দ্র, মা শোভাদেবী চার দাদা কংসারি, পরমানন্দ, পদ্মনাভ, সর্বেশ্বর আর ছোট দু’ভাই—জনার্দন, ত্রৈলোক্যনাথকে নিয়ে নানা মজার কাহিনী। দু দিদি, ছোট এক বোন ছিল জগন্নাথের। দশ ভাইবোনের খেলা, খুনসুটি, কোঁদলে বাড়ি মেতে থাকত। ভাইবোনেদের মধ্যে যত ঝগড়া, তত ভাব। বারেন্দ্রভূমির আকাশে তখন কালো মেঘ জমছিল। গুরুজনরা নজর করে উদ্বিগ্ন হতে থাকলেও ছেলেমেয়েদের বুঝতে দেয়নি। তারা কি নিজের থেকে বুঝতে পারেনি? পেরেছিল। যবনদের হাতে কাছে-দূরের গ্রামের মানুষের ধর্মনাশ হওয়ার খবর আসত, সুন্দরী মেয়ে-বৌদের তুলে নিয়ে গিয়ে জবরদস্তি কলমা পরিয়ে, নিকা করার সংবাদ আসত, শ’য়ে শ’য়ে মন্দির গুঁড়িয়ে সেখানে মসজিদ তৈরির বৃত্তান্ত লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ত, ছোট ছেলেমেয়েরাও সে বৃত্তান্ত শুনে ভয় পেত। ভয়ে কুঁকড়ে থাকত। দোকানপাটে ঝাঁপ বন্ধ করে দোকানিরা ঘরে লুকিয়ে থাকত। কয়েক দিনের জন্যে ফাঁকা হয়ে যেত রাস্তাঘাট। শূদ্র হিন্দুদের মধ্যে যারা জাতে উঁচু, বিশেষ করে বৈদ্য, কায়স্থরা শ্রীহট্ট ছেড়ে পালানোর মতলব আঁটছিল। ব্রাহ্মণদের উপদেশ নিতে তাদের বাড়ির দরজায় তারা ধর্না দিচ্ছিল। নবশাকদের মধ্যে যারা বিচক্ষণ, তারাও একই কাজ করছিল। শ্রীহট্ট ছেড়ে গঙ্গার ধারে নিরুপদ্রব অঞ্চলে নতুন করে বসতি গড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। পাকাপাকিভাবে শ্রীহট্টের আস্তানা গোটাতে ব্রাহ্মণদের মধ্যেও দ্বিমত ছিল। তারা নিজেদের সুবিধে মতো শূদ্র সম্প্রদায়কে উপদেশ দিচ্ছিল। শূদ্ররা মনঃস্থির করতে পারছিল না, কী করবে। মাতৃভূমি না ছেড়ে শ্রীহট্টে তাদের থেকে যাওয়ার উপদেশ ব্রাহ্মণেরা দিলেও, তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেরা পাততাড়ি গোটানোর যোগাড়যন্ত্র করেছিল। জগন্নাথের বাবা উপেন্দ্র মিশ্র কিন্তু সব স্তরের শূদ্রদের যা পরামর্শ দিয়েছিল, নিজেও সেভাবে কাজ করেছিল। বৈদ্য, কায়স্থ, এমনকি নবশাকদের নিয়ে সভা করে যারা নবদ্বীপে যেতে চায়, সেখানে তাদের পাঠিয়ে, পরিবার নিয়ে নিজে থেকে গেল শ্রীহট্টে। নায়লার নৌকোয় শ্রীহট্ট থেকে যারা একসঙ্গে নবদ্বীপে এল, তারা যে যার বৃত্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাড়ায় বাস করতে শুরু করেছিল। গঙ্গার ধারে, ব্রাহ্মণপাড়া বেলপুকুরিয়ায়, শ্রীবাস আচার্যের বাড়ির কাছে জগন্নাথ বানিয়েছিল নিজের বাড়ি। বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাকরা, যে যার মতো নির্দিষ্ট অঞ্চলে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল।
গল্পের ছলে বিশ্বরূপকে শোনানো স্বামীর কথকতা, ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন শচীর কানেও ঢুকছিল। মাথার মধ্যে একটানা ঝিঁঝি ডেকে চললেও স্বামীর কথিত বিবরণে কিছু ফাঁকফোকর খুঁজে পাচ্ছিল সে। কথা বলার ক্ষমতা ছিল না তার। কথা বলতে সক্ষম হলেও স্বামীর বিবরণের অসঙ্গতি মুখ ফুটে বলা অসম্ভব ছিল। ঘোর বিপদের সময়ে প্রতিবেশি নানা সম্প্রদায়ের মানুষকে অন্ধকারে রেখে শ্রীহট্ট ছেড়ে তার বাবা নীলাম্বর চক্রবর্তী যে পালায়নি, জয়পুর গাঁয়ের সকলে জানে। শচী সমেত তার তিন দিদির ধর্ম বাঁচাতে গাঁয়ের বরিষ্ঠ মানুষদের পরামর্শে তিন পুরুষের ভিটে ছেড়ে সপরিবার নীলাম্বর নবদ্বীপে পাড়ি দিয়েছিল, স্ত্রী, কন্যাদের রক্ষা করার শাস্ত্রানুমোদিত দায়িত্ব পালন করেছিল। শ্রীহট্টের জয়পুর গাঁয়ের জীবিত বয়স্কদের অনেকে তা জানে। আজও তারা সে ঘটনা মনে রেখেছে। আত্মীয়, বন্ধু, পরিজনকে বিপদে ফেলে পালানোর মানুষ যে নীলাম্বর ছিল না, জগন্নাথকে একথা শচী কখনও বলতে পারেনি।
স্বামীর কথায় সায় না দিয়ে আলাদা কিছু বলা, শোনা ঘরণী চিন্তা করতে পারে না। পতি হল দেবতা। সকালে স্বামীর পাদোদক না খেয়ে যে স্ত্রী দিনের কাজ শুরু করে সে পাপীয়সী। অনন্ত নরক ভোগ করতে হয় তাকে। স্বামীর কথা বেদবাক্য, মাথা পেতে স্ত্রীকে তা মেনে নিতে হয়। কুলটা, দুশ্চরিত্রা মেয়েছেলেরা শুধু স্বামীর মুখের ওপর তর্ক করে। তাদের বেশির ভাগ শূদ্র। ন্যায়শাস্ত্রের আলো তাদের সমাজে পৌঁছায়নি। জগন্নাথের কথকতার দু’এক টুকরো কানে যাওয়ার সঙ্গে আধো জ্ঞান, আধো বেহুঁশ অবস্থাতে নিজের জীবনের ঘটনাপরম্পরাকে শচী নিজের মতো সাজাতে চাইছিল। দিদিদের পতিগৃহে যাত্রা, জগন্নাথের সঙ্গে তার বিয়ে, পরপর আট মেয়ের জন্ম আর ধরাধাম ছেড়ে তাদের চলে যাওয়া, তাকে পাগলিনী করে দিয়েছিল। বিশ্বরূপকে বাঁচাতে হেন ব্রত, উপবাস নেই, সে পালন করেনি। কত জ্যোতিষীর কাছে ছেলের ভাগ্যগণনা করিয়েছে বলা মুশকিল। সকলের আগে অবশ্য বিশ্বরূপের কোষ্ঠি, ঠিকুজি তৈরি করেছিল শচীর বাবা জ্যোতিষ শাস্ত্রে সুপণ্ডিত—নীলাম্বর চক্রবর্তী। নাতির ভাগ্যগণনা করে শচীকে অভয় দিয়েছিল নীলাম্বর। নাতি বিশ্বরূপ যে বিদ্বান, দীর্ঘায়ু হবে গণনা করে মাতামহ নীলাম্বর নিঃসন্দেহ হলেও নিজের কনিষ্ঠা মেয়েকে পুরোপুরি আশ্বস্ত করতে পারেনি। সাধু-সন্ন্যাসী পীর দরবেশ দেখলেই তার কাছে বিশ্বরূপকে নিয়ে শচী হাজির হত, জানতে চাইত ছেলের ভবিষ্যৎ। ছেলের সুরক্ষায় যে যেমন নিদান দিত, শচী মেনে নিত, সেভাবে কাজ করত। বিশ্বরূপের মাথায় মুশকিল আসান চামর বুলিয়ে, তার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে, মাজারের গর্ভগৃহে শচীকে একা ডেকে নিয়ে শ্রীহট্টের বুরহানউদ্দিন মাজারের ষষ্ঠ মুজাভির শচীকে এমন কিছু ভবিষ্যৎ বার্তা শুনিয়েছিল, যে তার শরীরে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল। শচী বেহুঁশ হওয়ার আগে তাকে পীর মুজাভির জানিয়েছিল, মাজারে শুধু সিন্নি আর চাদর চাপিয়ে ছেলের সমুদয় ক্ষতি ঠেকানো যাবে না। মাজারের সামনে তিন দিন, তিন রাত শুধু সিন্নি আর ‘আবে জম্জম্’ খেয়ে শচীকে ধর্না দিতে হবে।
গর্ভগৃহে একা শচীকে বসিয়ে গায়ে কাঁটা দেওয়া যেসব কথা পীর শুনিয়েছিল, তার একটা হল—তাকে আরও একবার সন্তানবতী হতে হবে। দ্বিতীয় সন্তান জন্ম না নিলে বিশ্বরূপের পরমায়ু খণ্ডিত হতে পারে। প্রথম সন্তানকে বাঁচাতে দ্বিতীয় সন্তানের আড়াল চাই। আলো-কুয়াশা ঘেরা গর্ভগৃহের মধ্যে বিশাল শরীর, স্বর্ণকান্তি মানুষটি দু’চোখ বুজে দৈববাণীর মতো বিশ্বরূপের ভবিষ্যৎ বলে যাচ্ছিল। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, মাথায় লম্বা সোনালি চুল, রামায়ণ-মহাভারতের পাতা থেকে নেমে আসা দৈবী মহাপুরুষের মতো কলেবর, পীরের মুখ থেকে ‘খণ্ডিত পরমায়ু’শব্দ দুটো শুনে মাজারের ষষ্ঠ পীরের পায়ে লুটিয়ে পড়ে শচী বলেছিল, তিন দিন তিন রাত কেন, দরকার হলে মাজারে এক মাস ধর্না দিতে রাজি আছি। সিন্নি আর ‘আবে জম্জম্’ খেয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব, আমার শুধু একটা প্রার্থনা, আমার ছেলেটা যেন বেঁচে থাকে, দীর্ঘায়ু হয়!
মাজারের ষষ্ঠ পীর বলেছিল, ইনসাল্লাহ্ রহমানে রসুল, তোমার ছেলেকে বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব। কোনও অবস্থাতে তোমার কোল খালি থাকবে না।
গর্ভগৃহের বাইরে এসে শচী দেখল, ছেলের হাত ধরে শুকনো মুখে জগন্নাথ দাঁড়িয়ে রয়েছে। শচীর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে জগন্নাথ কিছু আঁচ করার চেষ্টা করলেও উপেন্দ্ৰ, মিশ্রর বাড়িতে না পৌঁছানো পর্যন্ত শচী মুখ খুলল না। বাড়িতে ফিরে শচীর মুখ থেকে পীরের নির্দেশ শুনে জগন্নাথ বলল, এ এমন কি কঠিন কাজ। বিশ্বরূপের জন্যে আমরা প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি। তিন দিন, তিন রাত উপোস করে ধর্না দিতে আমাদের কোনও কষ্ট হবে না।
ফিসফিস করে শচী জিজ্ঞেস করেছিল, দ্বিতীয় সন্তানের ব্যাপারটা?
নবদ্বীপে ফিরে যাই, তারপর।
লজ্জায় মুখ লাল, মাথা হেঁট করে শচী বসে রয়েছে। জগন্নাথের দিকে সংকোচে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। পরের দিন সকালে শচীকে নিয়ে জগন্নাথ ফের গেল পীরের দর্শনে। দর্শনার্থীর ভিড় কমতে এক ফাঁকে মুজাভিরকে জগন্নাথ জানাল, সাত দিন পরে, বৈশাখি পূর্ণিমার রাতে মাজারে চাদর চাপিয়ে, সিন্নি দিয়ে, সেই মুহূর্ত থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী, তিন রাত তিন দিন, সেখানে ধর্নায় বসবে, মাজার ছেড়ে নড়বে না, সেখানে পড়ে থাকবে। জগন্নাথের প্রস্তাবে মৃদু হেসে পীর বলেছিল, ধর্না দিতে হবে স্ত্রীকে, স্বামীর না থাকলেও চলে। স্বামী থাকতে চাইলে, গর্ভগৃহের বাইরে থাকতে পারে। গর্ভগৃহে স্ত্রী থাকবে আল্লার তদারকিতে।
পীরের নির্দেশ, জগন্নাথ মেনে নিয়েছিল। একমাত্র সন্তানকে বাঁচাতে দরকার হলে নিজের হৃৎপিণ্ড বার করে পীরের পায়ে সে অঞ্জলি দিতে পারত। বলেছিল, আল্লার জিম্মায় থাকবে আমার স্ত্রী, আমার ভয় কি? তাকে আল্লা রক্ষা করবেন। গর্ভগৃহের বাইরে তীর্থের কাকের মতো আমিই বা বসে থাকব কেন? তিন রাত, তিন দিন বাড়িতে বসে আমি গায়ত্রী আর ইষ্টনাম জপ করব।
জগন্নাথের মাথায় মুশকিল আসান চামর বুলিয়ে পীর বলেছিল, এ হল প্রকৃত জ্ঞানীর কথা! কোনও বিপদ তোমাদের স্পর্শ করবে না। বরং তোমার পরিবারের কল্যাণ হবে।
মাথায়, শরীরে চামরের ছোঁয়া পেয়ে জগন্নাথের মন থেকে উদ্বেগ মুছে যাচ্ছিল। ভারি আরাম পাচ্ছিল সে। চামরের ছোঁয়াতে ঘুম নামছিল বিশ্বরূপের দু’চোখে। ভয়ে টানটান করে চোখ দুটো খুলে মায়ের আঁচল ধরে পাথরের মূর্তির মতো সে দাঁড়িয়েছিল। দশ বছরের ছেলেটা কিছুতে ঘুমিয়ে পড়তে চাইছিল না। মাজারে চৈত্র সংক্রান্তির মেলার ভিড় কাটতে আরও সাতদিন লেগে গেল। সংক্রান্তির মেলাতে স্বামী, ছেলে নিয়ে বেড়াতে শচী যেমন আনন্দ পেল, তেমনি সতেরোই বৈশাখ, পূর্ণিমার রাত থেকে তিন দিনের ধর্নায় বসতে চলেছে মনে করে অস্বস্তি অনুভব করছিল। ভয় পাচ্ছিল সে। বুকের ভেতরটা মাঝে মাঝে গুড়গুড় করে উঠলেও পীরের দরগায় করা সঙ্কল্প ভেঙে পালানোর উপায় নেই, জানত। মাথায় এরকম পাপ চিন্তা ঢুকতে দেওয়াও উচিত নয়। ছেলের জন্যে সঙ্কল্প করে, কোনও মা সেখান থেকে পিছু হঠে না। তাহলে সে মা নয়, রাক্ষসী। পীরের একটা কথা, প্রথম সন্তানকে বাঁচাতে তাকে আরও একবার মা হওয়ার ফরমান দিয়ে পীর দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। দশ বছর পরে তা কি সম্ভব? বয়স তার কম হল না। প্রায় আটত্রিশ। পনেরো বছর বয়সে প্রথম মা হওয়ার পর থেকে প্রায় ফি বছর, একটা করে সন্তান প্রসব করেছে এবং অল্প দিনের ব্যবধানে তাদের মৃত্যু দেখেছে। ঈশ্বরের কৃপায় নবম সন্তানটি বেঁচে আছে, এই তার সৌভাগ্য। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় সে। নতুন করে আর একজন সন্তান চায় না। বিশ্বরূপের জন্মের পর থেকে, ‘পুরী’ সম্প্রদায়ের এক সন্ন্যাসীর পরামর্শে জগন্নাথও ব্রহ্মচর্য পালন করছে। নতুন করে সে সন্তানের পিতা হতে রাজি হবে কিনা সন্দেহ। তবে বিশ্বরূপকে বাঁচাতে দরকার হলে সাময়িকভাবে সে ব্রহ্মচর্য ছাড়তে পারে। নবদ্বীপে ফেরার আগে এ নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। দুইপ্তা পরে এসে গেল শুক্লাপঞ্চমীর রাত। মাজারের গর্ভগৃহে তিন রাত তিন দিনের ধর্নায় শচীকে বসিয়ে দিয়ে বিশ্বরূপের হাত ধরে গর্ভগৃহ থেকে বাইরে এসে দাঁড়াল জগন্নাথ। মনে মনে ইষ্টনাম জপ করছিল সে। বিশ্বরূপের দু’চোখে জল। তার জন্যে মায়ের এই ব্রতপালনে দশ বছরের ছেলেটি, নিজেকে অপরাধী ভাবছিল। মায়ের কোল থেকে আট দিদির মতো মৃত্যু যে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না, বয়স বাড়ার সঙ্গে এ বিশ্বাস তার মনে বদ্ধমূল হয়েছিল। মাজারের গর্ভগৃহে মাকে ধর্নায় বসা থেকে ঠেকাতে অনেক চেষ্টা করেও সে পেরে ওঠেনি। খোলা আকাশের নিচে সুফি সাধক বুরহানউদ্দিনের মাজার ঘিরে সারাদিন জনসমাগম লেগেই থাকে। মাজারের চারপাশ ঘিরে ফুলের বাগান, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, তেজপাতা, আরও নানা গাছ, উত্তর পশ্চিমে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ আকাশ ছুঁয়ে রয়েছে। মাজারে এসে দাঁড়ালে ভক্তের মন পবিত্র আনন্দে ভরে যায়। গর্ভগৃহের ভেতরটা আবার অন্যরকম। সাধারণের সেখানে ঢোকা নিষিদ্ধ। পাথরের মেঝে, দেওয়ালের অর্ধেক পাথরে তৈরি, সবুজ কাছি দিয়ে ঘেরা বুরহানউদ্দিনের সমাধিস্থলের দু’পাশে দিন-রাত রেড়ির তেলের দুটো প্ৰদীপ জ্বলছে। গর্ভগৃহের পেছন দিয়ে লম্বা চাতাল অন্দরমহলের দিকে চলে গেছে। সে দিকটা সুনসান ফাঁকা, জনপ্রাণীর সাড়া নেই। মাজারের মুজাভিরের সংসার সেখানে। মুজাভিরের বারো, তেরো বছরের ছেলে, তার মা ছাড়াও সেখানে থাকত মুজাভিরের গর্ভধারিণী। সে আরব দেশের রমণী নয়, দিনেমার স্ত্রীলোক। প্রবীণরা বলত, সে আকাশ থেকে নেমে আসা হুরী-পরী। শ্রীহট্টের মানুষ, এমন রূপসী স্ত্রীলোক, আগে কখনও দেখেনি। মা-বাবার সঙ্গে গর্ভগৃহের চাতালে শচীর ধর্না শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে বিশ্বরূপ একবার গিয়েছিল। ফ্যাকাসে কুয়াশার মতো আলো অন্ধকার সেই ঘরে পা দিয়ে তার গা ছমছম করছিল। বাইরে সাধারণ মাজারের দশ হাত নিচের ঘরে জরির কাজ করা লাল, সবুজ, কালো চাদরে ঢাকা পীরের মূল সমাধির পাশে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বরূপ। আলো, বাতাসহীন ঘরে দুটো প্রদীপের নিষ্কম্প শিখা। বাতাসে মিশে ছিল ফুলের গন্ধ! পীর মুজাভির ফিসফিস করে বলেছিল, আল্লার ইচ্ছেয় তিনটে দিন ভালোভাবে কেটে যাবে। ধর্নার তিন দিন শচীর কতটা ভালো কেটেছিল, বিশ্বরূপ জানে না। গর্ভগৃহ ছেড়ে তিন দিন পরে মা বেরিয়ে আসার পরে শুধু তার দিকে বিশ্বরূপ তাকিয়েছিল। মায়ের সারা শরীর টলমল করছিল। জগন্নাথ ধরে না থাকলে যে কোনও মুহূর্তে মাটিতে সে পড়ে যেত। পুণ্যাত্মা শচীকে দেখতে লাউড়, রাজপুর, প্রতিবেশী গাঁয়ের নানা বয়সী স্ত্রীলোক মাজারে ভিড় করেছিল। শচীর নামে উলুধ্বনি দিয়েছিল অনেক মেয়ে তাদের গলার আওয়াজ শচীর কানে পৌঁছোচ্ছিল না। অন্ধকার গর্ভগৃহে বাহাত্তর ঘণ্টা ধর্নায় আটক থেকে পৃথিবীর আলোতে এসে সে এমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল, যেন দৃষ্টিহীন, কিছু দেখতে পাচ্ছে না, অন্ধ হয়ে গেছে। দু’হাতে শচীর কোমর জড়িয়ে বিশ্বরূপ ‘মা’ বলে ডাকতে গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সে কেঁদে ফেলেছিল। দু’চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে শুরু করলে, শচী আঁচলে মুখ ঢেকেছিল।
মাজার থেকে শ্রীহট্টের শ্বশুরালয়ে ফিরে এসে কয়েকদিন বিছানা ছেড়ে শচী উঠতে পারেনি। তিন দিন একটানা ধর্না দেওয়ার ধকল কম নয়। নিরম্বু উপোস অবশ্য তাকে করতে হয়নি। মৃৎপাত্রে পীরের দেওয়া জল, ‘আবে জম্জম্’ (যা মক্কার কুয়ো থেকে জালা বোঝাই হয়ে এদেশে আসে) আর কলাপাতায় যৎসামান্য সিন্নি খেয়ে কীভাবে যে তিনটে দিন, তিনটে রাত ধর্নায় কেটে গেল শচী খেয়াল করতে পারেনি। কখন রাত, কখন দিন তাই বুঝতে পারত না। অন্ধকার রাতে স্বপ্নের মধ্যে আসত পরমপুরুষ, ঈশ্বর, আশীর্বাদ করত শচীকে, বিশ্বরূপ নীরোগ, দীর্ঘায়ু হবে, এই আশ্বাসবাণী শোনাত, ঈশ্বরের নিঃশ্বাসের আওয়াজ পর্যন্ত শচী শুনতে পেত। বাতাসে ঘন হত ফুলেল সুবাস। ধর্নার দু’মাস পরে শরীরটা আগের মতো নেই জেনেও খুল্লতাতর পরিবারের কাউকে, এমনকি জগন্নাথকেও শচী কিছু বলেনি। নয় সন্তানের জননী হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শচী টের পাচ্ছিল, শরীরের ভেতর কী ঘটছে। অনুমানটা কতটা ঠিক, বুঝতে পারছিল না। বিশেষ মুহূর্তটা সনাক্ত করতে চাইছিল। নবদ্বীপ ফেরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে বারবার তাগাদা দিচ্ছিল স্বামীকে। বিশ্বরূপও আর শ্রীহট্টে থাকতে চাইছিল না। নবদ্বীপের খেলার সাথী, পাঠশালা, গঙ্গার ঘাট, অথৈ জল, মাঠ প্রান্তরের জন্যে তার মন কেমন করছিল। পঞ্জিকা দেখে শুভ যাত্রারম্ভের দিনক্ষণ যতবার জগন্নাথ পাকা করছিল, কোনও একটা বাগড়া এসে হাজির হচ্ছিল। বানচাল হয়ে যাচ্ছিল বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা। তার মধ্যে এসে গেল দুরন্ত বর্ষা। জলে ভেসে গেল বারেন্দ্রভূমি, শুরু হল প্রলয়ঙ্কর বন্যা। ভেসে গেল বারেন্দ্রভূম, সুষ্ম, লখনৌতি, তলিয়ে গেল কত বাড়িঘর, ফসলের ক্ষেত। সব নদীর ঘাট থেকে অদৃশ্য হল কত নৌকো, খেয়া চলাচল বন্ধ হয়ে গেল পক্ষকালের জন্যে। প্রকৃতির উদ্দামতা ঘরে, বাইরে সমান তেজে যে সমানভাবে কাজ করছিল, সুর্মা নদীর জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে শচীর শরীরের পরিবর্তন দেখে বোঝা যাচ্ছিল। ক্রমশঃ বড় হচ্ছিল তার পেটের আয়তন, কালি জমছিল চোখের নিচে, খাবারে অরুচি যত বাড়ছিল, তত বাড়ছিল গা গুলোনো ভাব। ‘ওয়াক’ তুলে বমি না করে উপায় থাকছিল না। পুত্রবধূ যে অন্তঃসত্ত্বা, শাশুড়ি শোভাদেবীর বুঝতে অসুবিধে হল না। মা-বাবার সঙ্গে শ্রীহট্টে দেখা করতে এসে জগন্নাথ যে এমন কাণ্ড ঘটাবে, তাদের কেউ ভাবতে পারেনি। লাউড় আর আশপাশের গাঁয়ের আত্মীয়, পরিজন সকলে জেনে গিয়েছিল ছেলে বিশ্বরূপের মঙ্গলকামনায় সাত বছর আগে সদ্গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়ে জগন্নাথ ব্রহ্মচর্য পালন করছে। তার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখে আত্মীয় প্রতিবেশীরা শুধু অবাক হয়নি, সমীহ করত তাকে, শ্রদ্ধার চোখে তাকিয়ে থাকত। ব্রহ্মচর্য পালনে তার সুগভীর নিষ্ঠা, বিশ্বরূপের বয়স বাড়ার সঙ্গে প্রমাণিত হচ্ছিল। দশ বছরে বিশ্বরূপ পা দিতে জগন্নাথের সঙ্কল্পের সত্যতা নিয়ে আত্মীয় পরিজনদের মনে কোনও সন্দেহ থাকল না। সংসারে জগন্নাথের মতো নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী যে দুর্লভ, এ বিষয়ে সকলে নিঃসংশয় হল। উপেন্দ্র মিশ্র, শোভাদেবীও বড় গলায় প্রচার করেছিল ছেলের স্বভাবের সাধুত্ব। শচীর গর্ভধারণ এবং তার শরীরী লক্ষণ যত প্রকট হচ্ছিল, তত বেশি ভয়ার্ত হচ্ছিল তার শ্বশুর, শাশুড়ি। ছেলের ব্রহ্মচর্য ভাঙার ঘটনা তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ঠেকছিল। পুত্রবধূ শচীকে মনে হচ্ছিল কাণ্ডজ্ঞানহীন! বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখতে এসে যে বধূ সন্তানসম্ভবা হয়, তার গৃহিণীপনা মোটেই প্রশংসনীয় নয়। নবদ্বীপে শচীর আট সন্তান, আট মেয়ে, কেন অকালে মৃত্যুর কোলে ঝরে পড়ল, তার কিছুটা কারণ বৃদ্ধা শোভাদেবী যেন খুঁজে পেল। আট বছর বয়সে নীলাম্বর চক্রবর্তীর যে মেয়েটি মা-বাবার সঙ্গে শ্রীহট্ট ছেড়ে চলে গিয়েছিল, ত্রিশ বছর বাদে প্রথমবার পুত্রবধূরূপে তাকে কাছে পেয়ে যতটা খুশি হওয়ার কথা শোভাদেবী তা হল না। অখুশি হওয়ার কথাটা স্বামীকে জানাতে পঁচাত্তর বছরের সেই বৃদ্ধ চুপ করে থাকল। শুধু শ্বশুর-শাশুড়ি নয়, শচীর ননদ, জায়েরা পর্যন্ত কানাঘুষোয় দশ বছর বাদে পরিবারের প্রায় বিগতযৌবনা এক বধূর আচম্বিতে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু করল। সংসারের পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শচীকে নবদ্বীপে পাঠাতে চাইছিল বাড়ির সবাই। উপেন্দ্ৰ মিশ্রের বাড়িতে শচীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে পরিবারের কেউ যে মুখ দেখাতে পারবে না, এমন এক হাওয়া উঠল গৃহস্থালিতে। ঘটনার এলোমেলো আচরণে জগন্নাথ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বরূপের জন্মের পর থেকে সে কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্য পালন করছে, নিয়মের ব্যতিক্রম কখনও ঘটেনি, একমাত্র সন্তানের শপথ নিয়ে সে বলতে পারে। শচীও তা জানে। সতীসাধ্বী স্ত্রী সে। সীতার মতো সেও একশোবার অগ্নিপরীক্ষায় বসে, অদগ্ধ, অক্ষত শরীরে ফিরে আসতে পারে। তাহলে কী এমন ঘটল, যার জন্যে শচী সন্তানসম্ভবা হল? রামায়ণ-মহাভারতে রয়েছে, যজ্ঞাগ্নি থেকে আবির্ভূত দেবতার দেওয়া পায়েস খেয়ে অযোধ্যার রাজা দশরথের তিন মহিষী গর্ভবতী হয়েছিল। মহাভারতে দ্রুপদ, দ্রৌপদীরও জন্ম হয়েছিল যজ্ঞবেদি থেকে। মাজারের গর্ভগৃহে দৈবপ্রেরিত সিন্নি খেয়ে শচী গর্ভবতী হতে পারে। গর্ভগৃহের জ্বলন্ত প্রদীপের আলো থেকে জীবনের বীজ শচীর গর্ভে নিক্ষিপ্ত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে আজও কত অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলেছে, চিত্রগুপ্ত ছাড়া কে তার হিসেব রাখে? ঈশ্বরের কৃপা থাকলে কি-না হয়! শচীর মতো পুণ্যাত্মা নারীর গর্ভে মানব জন্মের প্রলোভনে, ঈশ্বর যদি ভ্রূণের আকারে আশ্রয় নেয়, কে তাঁকে ঠেকাতে পারে? স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের মতো রূপগুণ সম্পন্ন বুরহানউদ্দিন মাজারের মুজাভিরের দেওয়া ‘আবে জজম্’ আর সিন্নি খেয়ে শচীর গর্ভসঞ্চার হওয়া অসম্ভব নয়। বরং খুবই সম্ভব। দ্বিতীয় এক সন্তানের আসন্ন জন্মের সম্ভাবনার কথা আভাসে ইঙ্গিতে মাজারের পীর আগেই জানিয়েছিল। ধার্মিক মানুষের পাঠানো সঙ্কেত মিথ্যে হয় না। শচীকে নিয়ে আগেই তার নবদ্বীপে রওনা দেওয়া উচিত ছিল। অগ্নিশিখার মতো পুত-পবিত্র তার বধূকে তাহলে শ্রীহট্টের শ্বশুরঘরে সাত-আট মাস ধরে এত হেনস্তা সহ্য করতে হত না।
তবু পুরনো দিনের বৃত্তান্ত বিশ্বরূপকে শোনানোর মধ্যে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল জগন্নাথ। জীবনের অঙ্কে কোথাও ঈষৎ গোঁজামিল থেকে যাচ্ছে, অনুভব করে কথার খেই হারিয়ে ফেলছিল। তার কথকতার তাল কেটে যাচ্ছিল। গল্প শোনাতে অমনোযোগী হয়ে পড়ছিল বিশ্বরূপ। মাকে নিয়ে দাদুর সংসারে যে দমবন্ধ-করা আবহ তৈরি হয়েছিল, তা দশ বছরের বালক বিশ্বরূপের অস্তিত্বের শেকড় পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছিল। বাবার অন্যমনস্কতা খেয়াল করে সে-ও অন্যমনস্ক হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল না।
নৌকোর বাইরে অন্ধকার গলুই-এ বসে দাঁড়িমাঝিরা চাপা গলায় যা আলোচনা করছিল, তার অংশবিশেষ কানে যেতে চুপসে যাচ্ছিল জগন্নাথ।
মাঝিদের একজন বলল, ভরাভরন্ত পোয়াতি বৌকে বিয়োনো পর্যন্ত ঠাকুরমশাই-এর ঘরে রাখা উচিত ছিল।
তার সঙ্গী বলল, বামুন বাড়িতে শুধু বাইরের ভড়ং, নিয়মকানুনের বালাই নেই।
পাকা দাড়ি বুড়ো মাঝি সঙ্গী দু’জনকে ফিসফিস করে বলল, চুপ মার্। ছোট মুখে বড় কথা মানায় না। জিভ খসে পড়বে। ঠাকরুণকে ভালোয় ভালোয় নবদ্বীপে পৌঁছে দিতে হবে। তারপরে যাই ঘটুক, আমাদের কোনও দায় নেই।
তরুণ দুই দাঁড়ি ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল।
মুখে না বললেও তাদের মনের মধ্যে কথা গজগজ করছিল। পূর্ণগর্ভা বধূটিকে সাততাড়াতাড়ি নবদ্বীপে পাঠানোর জন্যে মিশ্র পরিবারে হুড়োহুড়ি পছন্দ হয়নি। দুই দাঁড়ির মধ্যে বয়সে যে বড়, সে গোমড়া মুখে কাঠকয়লার আগুনে তামাক ধরিয়ে জম্পেশ টান দিয়ে বলল, লেখাপড়া জানা মানুষের বুকের ভেতরটা ফাঁপা। কোনও দয়ামায়া নেই। পস্তাতে হবে তাদের।
—কবে?
দিনক্ষণ আমার জানা নেই। তবে দিনটা আসতে বেশি দেরি নেই।
.
সেজকাকা থামতে গোরা জিজ্ঞেস করল, শচীর ওই সন্তানটি কি গোরা?
— হ্যাঁ।
—তার পিতৃপরিচয় কী?
পিতৃপরিচয় দিয়ে কিছু আসে যায় না। কথাটা বলে এক সেকেন্ড থেমে সেজকাকা বলল, মানুষের পিতৃপরিচয়ের চেয়ে বড় হল তার কাজ। ‘জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম হোক ভাল।’ মানুষের পরিচয় তার জন্মে নয়, তার কর্মে।
বিকেল ফুরিয়ে এসেছে। গোরার ঘরের জানলার পাশে ঝাঁকড়া আমগাছের গলিঘুঁজিতে কিচিরমিচির করছে কতিপয় চড়াই পাখি। শেষ বিকেলের আলো, গাছের বাইরে থমকে গেছে, গাছের ভেতরে পাখিদের গেরস্থালি অন্ধকার। সেজকাকাকে গোরা জিজ্ঞেস করল, এটাই কি ‘গোরা’ মেগা সিরিয়ালের প্রথম এপিসোড?
— হ্যাঁ।
—পরেরটা কী?
—সবগুলো এখনই শুনে নিতে চাস নাকি?
—কয়েকটা শুনি। জগন্নাথ মিশ্রের পরপর আটটা মেয়ের সকলে মারা গেল, ঘটনাটা কি অবাক হওয়ার মত নয়?
তোর কি সন্দেহ, মেয়ে ভ্রূণ মেরে ফেলার মত ঘটনা তখনো ছিল?
জানি না। জানতে চাইছি।
কাল সকালে মায়াপুরে সাহেবদের মন্দিরে যাচ্ছি, সেখান থেকে ফিরে এসে বলব।
—আমি যাব তোমার সঙ্গে।
গোরার কথা শুনে তার কাঁধে হাত রেখে সেজকাকা বলল, আমার সঙ্গে মিশে তুই যেন আবার সন্ন্যাসী হয়ে যাসনি। আমাকে তাহলে আস্ত রাখবে না তোর মা-বাবা।
গোরা চুপ। নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে কান খাড়া করে কিছু শুনছে।
—তোর আবার কী হল?
সেজকাকার প্রশ্নে গোরা বলল, পাঁচশো আঠারো বছর আগের সেই নৌকোটার দাঁড় টেনে আসার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
গোরার মুখের দিকে নিমেষহীন চোখে সেজকাকা তাকিয়ে থাকল।