গোরা – ১৫

১৫

বাড়িতে মা, সুন্দরী বউ, বাইরে নাটগীত, অভিনয়, রমরমা চতুষ্পাঠী নিয়ে গোরার যখন নাওয়া খাওয়ার সময় ছিল না, নবদ্বীপে তখন গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের এক সিপাহসালারের নেতৃত্বে একদল সিন্ধুকী (সুলতানী গুপ্তচর) ব্রাহ্মণপাড়ায় পুরাণকথিত অমিতবিক্রম যোদ্ধা কূটনীতিক, জাদুকর, ছদ্মবেশী শিশু, কৃষ্ণকে খোঁজার সঙ্গে আরও একজনকে খুঁজছিল। তার নাম, ঠিকানা, পরিচয় সিন্ধুকীদের জানা না থাকলেও সে দুশো আশি বছর আগে নবদ্বীপ ছেড়ে পলাতক, রাজা লক্ষ্মণ সেনের কোনও এক বৈধ বা অবৈধ উত্তরপুরুষ, অবশ্যই পুত্রসন্তান, রাজরক্ত বইছে তার শরীরে। লক্ষ্মণ সেন, তার তিন ছেলে মাধব সেন, বিশ্বরূপ সেন, কেশব সেন ছাড়াও একাধিক জ্ঞাত, অজ্ঞাত ছেলে এবং তাদের গর্ভধারিণীকে নিয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে পূর্ববঙ্গে পালানোর সময়ে নৌকোয় জায়গার অভাবে সন্তানসন্ততি সমেত কয়েকজন মাঝবয়সি কুলাঙ্গনাকে নদীয়া আর লক্ষ্মণাবতীতে ফেলে যেতে বাধ্য হয়। তাদেরই সাত বা অষ্টম পুরুষের কেউ অনতিদূর ভবিষ্যতে গৌড়ের মসনদের দখল নিতে চলেছে, এমন এক সঙ্কেত পেয়েছিল হোসেন শাহের মুসলিম গণৎকার, ইমাম আব্দুল রব্বানি। হোসেন শাহের প্রধান কূটনীতি উপদেষ্টা এবং মুখ্য জ্যোতিষী, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির, সুলতানী দরবার সসম্মানে অলঙ্কৃত করে থাকলেও দরবারে আরও কয়েকজন দরবেশ, ফকির গণৎকার ছিল। তাদের বলা হত, সুলতানের ‘অন্তরঙ্গ’। জৌনপুরের প্রবল ক্ষমতাবান দরবেশ, আসরফ সিমনানির অনুগামী এবং সম্পর্কে চাচাতো ভাই, ইমাম রব্বানি ছিল তাদের একজন। সুলতানকে একান্তে গোপন মন্ত্রণা দেওয়ার সুযোগ ছিল তার। সুযোগটা দরকার মতো কাজে লাগাত। লক্ষ্মণ সেনের বংশধরদের কেউ ক্ষমতা দখল করতে পারে, এমন এক ভাগ্যচক্রের ছক রব্বানি তৈরি করে দেয় সুলতানকে। রব্বানির ছকের সারাংশ চারুমিহির না জানলেও সুলতানের কাছে তার কদর যে রব্বানির চেয়ে অনেক বেশি, এই বিশ্বাসে সে অটল ছিল। ভুল ছিল না চারুমিহিরের বিশ্বাসে। হোসেন শাহ সুলতানী মসনদ দখল করার আগে থেকে তার বিশ্বস্ততম অন্তরঙ্গ ছিল চারুমিহির। চারুমিহিরের পরামর্শে রাজা সুহুঙ্গ মুঙ্গ শাসিত অহোম রাজ্য হোসেন জয় করলেও কয়েক পক্ষের মধ্যে এমন এক ঘটনা ঘটল, যা সুলতানকে সাময়িকভাবে ক্ষিপ্ত করে দিল। জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের ওপর তার বিশ্বস নড়বড়ে হয়ে গেল। আঠারো জন ছেলের সর্বাগ্রজ, যুদ্ধে নিপুণ, অসম্ভব কূটকৌশলী, শাহজাদা দানিয়েলকে অহোমের মসনদে বসিয়ে গৌড়ে ফেরার পথে সুলতানের কাছে খবর এল, অহোমের সদ্যনিযুক্ত সুবেদার, দানিয়েল খুন হয়েছে। ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে প্রতিহিংসায় অন্ধ সুলতান, সেনাবাহিনী নিয়ে নবদ্বীপ সংলগ্ন ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত পীরল্যা গ্রামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অকথ্য অত্যাচার চালাল। গাঁয়ের অনেক বাসিন্দার প্রাণহানির সঙ্গে যারা বাঁচল, তারা মরে থাকল। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে গোটা পীরল্যা গ্রামের ধর্মনাশ হল। ব্রাহ্মণদের গ্রাম পুরো মুসলমান গ্রামে রূপান্তরিত হল। অহোম রাজ্য জয়ের পরামর্শ দেওয়ার অপরাধে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরকে কোতল করার সঙ্কল্প করল সুলতান। অহোম অভিযান যে পুত্রশোকের বিভীষিকা বয়ে আনবে, যে জ্যোতিষী আগে থেকে অনুমান করতে পারে না, সুলতানের দরবারে আসন পাওয়ার সে অযোগ্য। পৃথিবী থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে সরিয়ে ফেলাই উপযুক্ত প্রতিবিধান। চারুমিহিরকে নিকেশ করার আগের মুহূর্তে তার বাসনা জাগল, নবদ্বীপে হিঁদুয়ানির প্রভাব ঠেকাতে সেই এলাকার সমূহ বাসিন্দাদের ধর্মনাশ করা অতীব জরুরি। ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণদের মৌলবী, মোল্লা পদে নিযুক্ত করলে ইসলামের বাড়বাড়ন্ত হবে। ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণদের হাজার হাজার যজমান দ্রুত মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করবে। শিক্ষিত, চালাক, চতুর ব্রাহ্মণদের ইসলামের প্রচারক হিসেবে প্রশিক্ষণ দিতে বেশি সময় লাগবে না।

শাহজাদা দানিয়েলের মৃত্যুজনিত করাল জিঘাংসায় সুলতান তখন ফুঁসছে। নবদ্বীপবাসী সকলের ধর্মান্তর ঘটাতে পারলে, জ্যোতিষী রব্বানির ভবিষ্যৎ বাণীর দফারফা করে ফেলা যায়। প্রায় তিনশো বছর আগে নবদ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়া রাজা লক্ষ্মণ সেনের রক্তের এক ফোঁটাও যদি কারও শরীরে তাকে, মুসলিম শাহের সুলতানি মসনদ ছিনিয়ে নেওয়ার মতো একজন হিঁদুও থাকবে না নবদ্বীপে। সুলতানী শাসন উৎখাত করার ষড়যন্ত্র মাঠে মারা যাবে। পরামর্শটা তার মাথায় রাজধানী একডালা ছাড়ার আগে ইমাম রব্বানি গুঁজে দিয়েছিল।

পীরল্যা গ্রামের ধর্মান্তর পর্ব চুকিয়ে, সেখানের গোলা মুসলিমদের নমাজ পড়ানোর জন্যে মৌলবী নিয়োগ করে, মসজিদ বানানোর দায়িত্ব তাকে দিয়ে, সসৈন্য নবদ্বীপের পথে রওনা হওয়ার আগে অহোম রাজ্য থেকে সুলতানের কাছে নতুন বার্তা পৌঁছল। বার্তা নিয়ে এল এক হাজার ঘোড়সওয়ার বাহিনীর এক সেনাপতি, পদমর্যাদায় ‘মালিক’ জান মহম্মদ সেখ। সুলতানকে যথোচিত ‘সালাম আলেকুম’ করে তার সাক্ষাৎ ভিক্ষা করল। হোসেন শাহ ডেকে নিল তাকে। মশালের আলোয় পীরল্যা গ্রামের ফাঁকা মাঠে সুলতানের ছাউনিতে বসে সে শোনাল এক অত্যাশ্চর্য কাহিনী, যা অহোম রাজা সুহুঙ্গ মুঙ্গ-এর সেনাবাহিনীর হাতে দানিয়েল আর তার দেহরক্ষীদের ঘটেছিল।

তিনপক্ষ কাল আগে সুলতানী ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে পরাজিত সুহুঙ্গ মুঙ্গ আর তার সেনাদলের জীবিত যে কয়েকজন সৈনিক ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তর-পূর্বে পাহাড়ি জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা যে হঠাৎ হাজার হাজার নৌসেনার বিশাল বহর নিয়ে মাঝরাতে সুবেদার দানিয়েলের ফৌজি শিবিরে হানা দেবে, সেনাবাহিনীর পাকা মাথা কর্তারা, খান, মালিক, আমীর, সিপাহসলার কেউ ভাবেনি। সুলতানী নৌবহরের অধিনায়ক, পদমর্যাদায় যে ‘মীরবহর’, তার কাছেও অহোম রাজ্যের নৌসেনাবাহিনী সম্পর্কে সাবধান হওয়ার মতো খবর ছিল না। ফৌজি সিন্ধুকীরা পর্যন্ত জানত না এই তথ্য। ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে, শাহজাদা দানিয়েলের প্রাসাদ ঘিরে তৈরি অস্থায়ী ফৌজি ছাউনিতে সেই মধ্যরাতে হঠাৎ হৈচৈ শুরু হয়ে যেতে রাতের চৌকিদাররা নজর করল, অহোম সিপাই বোঝাই কয়েকশো নৌকো ব্রহ্মপুত্রের অন্ধকার বুক চির আগুনের গোলার মতো ছুটে আসছে। নিকষ অন্ধকারে সে এক সাংঘাতিক বুক কাঁপানো দৃশ্য! সুলতানী ফৌজ এত ভয় পেল যে তাদের ছাউনিগুলোতে ‘পালা পালা’ আওয়াজ উঠল। তিনপক্ষ আগে, প্রায় সর্বস্ব খুইয়ে লড়াই-এর ময়দান ছেড়ে যে রাজা একদল সৈন্য নিয়ে পাহাড়ি জঙ্গলে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিল, অল্পদিনের মধ্যে সে এমন নৌবহর নিয়ে মাঝরাতে সুলতানী ফৌজের মোকাবিলায় এলে ভিনদেশি সমতলভূমির সেনা ছাউনিতে ত্রাসের সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। তাই ঘটেছিল। অহোম রাজ্য জয়ের টাটকা উল্লাস পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা বিদেশ বিভুঁই-এর অন্ধকারে ভয়ার্ত কোলাহলের চেহারা নিয়েছিল। অহোম জলসেনার বহর দেখে, শিবির ছেড়ে দলে দলে সুলতানী ফৌজ পালাতে লাগল। অস্ত্র হাতে খান, মালিক, সিপাহসলার, নানা মাপের সব সেনাপতি, তাদের ঠেকাতে ব্যর্থ হল। ফৌজি ছাউনি ঘিরে তৈরি হয়েছিল গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। তার মধ্যে এক সিন্ধুকী এসে সুবেদার দানিয়েলের খুন হওয়ার খবর শোনাতে ছত্রখান হয়ে গেল সুলতানী সেনাশিবির। নানা মাপের সেনাপতিদের কর্তৃত্ব মাটিতে মিশে গেল। কর্তৃত্ব ফলানোর বিশেষ চেষ্টাও তারা করল না। তারাও মানুষ, প্রাণের ভয় তাদেরও কম নয়। মনে মনে তারা অহোমরাজ সুহুঙ্গ মুঙ্গ-এর সাহস আর রণনৈতিক বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না। চিরকালই গৌড়ের সেনাবাহিনীর জলযুদ্ধে নৈপুণ্য কম। জলযুদ্ধ এড়াতে বর্ষায় তারা বঙ্গাল, লখনৌতি, উত্তর-পূর্ব ভারতে অভিযান যতটা সম্ভব বন্ধ রাখত। নদ-নদী ঘেরা কামরূপ থেকে দক্ষিণ বাংলা পর্যন্ত সুলতানী শাসন তাই কখনও পাকাপোক্ত প্রতিষ্ঠা পায়নি। গৌড় আর রাঢ় অঞ্চলে তারা সীমাবদ্ধ ছিল। নবদ্বীপ থেকে উৎখাত হওয়ার পরে আরও সত্তর বছর পূর্ববঙ্গে সেনরাজবংশের শাসন বহাল থাকার কারণে সে অঞ্চলের দুর্গমতা। অশ্বারোহী মুসলিম সেনাবাহিনী যত দুর্ধর্ষ হোক, ঘোড়ায় চেপে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র নদী পেরনো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সুলতানী ফৌজের এ দুর্বলতা অহোমরাজা ভালোরকম জানত। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল সে। অহোমরাজের নৌবাহিনী দেখে সেই রাতে গৌড়ের পাইক, বরকন্দাজরা ভয়ে পালাবে, রাজা সুহুঙ্গ মুঙ্গ আন্দাজ করেছিল। রাজসেনাপতিরা সুপরিকল্পিত ছকে ভয়ের ফাঁদ পাততে মাথা ঘামিয়েছিল। পাহাড়ের উত্তর-পূর্ব কোলের গভীর জঙ্গল থেকে ব্রষ্মপুত্র নদীতে হাজার হাজার কলার ভেলায় শক্ত বেতে বানানো কাকতাড়ুয়া খাড়া করে, ভেলার আর এক দিকে রেড়ির তেলের মাঝারি আকারের প্রদীপ জ্বেলে জোয়ারের সময় হিসেব করে ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দিল। অন্ধকার রাতে ব্রষ্মপুত্রের টলটলে কালো জলে সচল সংখ্যাহীন আলোর বিন্দু থেকে যে বিশাল নৌবহর দামামা বাজিয়ে নিঃশব্দে ‘যুদ্ধং দেহি’ হুঙ্কার দিয়ে ফৌজি ছাউনির দিকে ছুটে আসতে থাকল, তা সৈন্যদের বুকের কলিজা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। তারা পালাতে শুরু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অহোম সেনারা ফৌজি শিবিরগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে হারানো রাজ্য দখল করে নিল। সবটা যেন ভোজবাজি! পলাতক সুলতানী সেনাদের বেশিরভাগ জানল না, তারা কত বড় ধোঁকা খেয়েছে, কত সহজে তাদের বোকা বানিয়েছে প্রতিপক্ষ!

সেনাবাহিনীর উঁচু পদাধিকারী এক হাজার ঘোড়সওয়ারের মনসবদার, মালিক’ জান মহম্মদকে বেশ কড়া গলায় সুলতান জিজ্ঞেস করতে, সে তখন কী করছিল, মুখ চুন করে মালিক জান মহম্মদ যে কৈফিয়ত দিল, সুলতানের তা পছন্দ না হওয়ায় বার্তাবাহককে তখনই ফৌজি বন্দিশালায় পাঠানো হল। নবদ্বীপ শায়েস্তা করার ছক তখনকার মতো বাতিল হয়ে গেলেও পুত্রশোকে জর্জরিত হোসেন শাহর মনে পড়ল, অহোম অভিযান শুরুর আগে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির যে পরামর্শ দিয়েছিল, তার সার কথাটা যথাযথ মানা হয়নি। তাই এই দুর্ভোগ! মাথার ওপর বজ্রপাতের মতো নেমে এসেছে। দানিয়েলের মৃত্যুসংবাদ। চারুমিহিরের শাস্ত্রে ভুল নেই। জ্যোতিষার্ণব নিরপরাধ। চারুমিহিরের পরামর্শ ছিল সুহুঙ্গ মুঙ্গকে রাজততে রেখে অহোমরাজ্যকে ‘ইক্‌লিম’ যার অর্থ, করদাতা স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া-ই সুবিবেচনার কাজ হবে। সে বিষয়ে কিছু গাফিলতি ঘটে গেছে। নিজের রাজ্যকে গৌড়ের ইক্‌লিম করার সর্ত মেনে অহোমরাজা কর দিতে রাজি থাকলেও শাহজাদা দানিয়েলকে মাথার ওপর সুবেদার হিসেবে রাখতে রাজি হয়নি। লড়াই হওয়ার মূল কারণও তাই। ‘অন্তরঙ্গ’ চারুমিহিরের ওপর সুলতানের ক্রোধ প্রশমিত হলেও লক্ষ্মণ সেনের উত্তরপুরুষ নিয়ে রব্বানির গণনার আশঙ্কাজনক হিসেবটা মাথায় বিঁধে থাকল। তাকে বধ করার জন্যে দেহে রাজরক্ত বহনকারী কেউ নবদ্বীপে প্রতিপালিত হচ্ছে, এমন এক অস্বস্তিকর ভবিষ্যৎবাণী মাথায় ঢুকলে সুলতানের পক্ষে স্বস্তিতে থাকা সম্ভব নয়। তাড়াতাড়ি অস্বস্তিকর বিষয়টার ফয়সালা করতে দরবারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত আমীরের সঙ্গে একান্তে শলা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরের দিন সকালে নিজের বাহিনী নিয়ে রাজধানী একডালার পথে রওনা হল সুলতান।

দেশজুড়ে নিরবচ্ছিন্ন অস্ত্রের ঝনঝনার সঙ্গে রক্তস্রোত বইতে থাকলেও নবদ্বীপের পুরজীবনে তার ছায়া সরাসরি পড়েনি। গোরার চতুষ্পাঠীতে পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়ে চলার সঙ্গে তার সংসারে সচ্ছলতা এল। বাড়িতে তার চোখের সামনে সুন্দরী তরুণী বউ, নোটন পায়রার মতো ঘুরতে ফিরতে থাকলেও প্রকৃত বিষয়ী যাকে বলা হয়, গোরা কিন্তু তা হল না। দীর্ঘ শরীর আরও দীর্ঘ, মজবুত হল, বহুগুণ বেড়ে গেল রূপ, পৌরুষ, ব্যক্তিত্ব। শাস্ত্রানুমোদিত জীবনযাপনকে অগ্রাহ্য করার সাহসের সঙ্গে শাণিত হতে থাকল যুক্তি, বুদ্ধি ভালোমন্দ বিচারবোধ। নবদ্বীপের মানুষ এক ডাকে নিমাই পণ্ডিতকে শুধু তার পাণ্ডিত্যের জন্য চিনল না, চণ্ডাল থেকে ব্রাহ্মণ তরুণ সম্প্রদায় পর্যন্ত তাকে নিজেদের স্বাভাবিক নেতা, তারও বেশি, অভিভাবক হিসেবে মেনে নিল। নবদ্বীপের মানুষকে সবচেয়ে বেশি করে টানত তার সরস আলাপচারিতা, চরিত্রের মাধুর্য। কথাবার্তা, চালচলনে পুরোপুরি গ্রাম্যতাবর্জিত, পরিশীলিত চেতনার মানুষ হয়ে উঠেছিল সে। যা কিছু অলৌকিক, ধোঁয়াটে, রহস্যময়, তার ভেতর পর্যন্ত দেখতে ব্যগ্র হয়ে উঠত। বন্ধুদের বলত ‘গ্রাম্য কথা কহিও না, গ্রাম্য কথা শুনিও না।’ নক্ষত্রলোক থেকে খসে পড়া দেবদূতের মতো এই তরুণকে নবদ্বীপের অভিজাত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজ আবার বিশেষ পছন্দ করত না। তারা হালকা চরিত্রের নাটুয়া ভাবত গোরাকে।

চতুষ্পাঠী আর সংসারের কাজের বাইরে নাচ, গান, নাটগীতের অনুষ্ঠান জমাতে গোরা চৌখস হতে থাকল। সুলতানী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যত্রতত্র নাটগীতের আসর বসিয়ে দিত। বৈষ্ণব সমাজে গোরা নাম না লেখালেও শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহাঙ্গনে, মেসো চন্দ্রশেখর আচার্যর উঠোনে অহরহ লেগে থাকত তার অনুষ্ঠান। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গানের সঙ্গে এমন নৃত্যকলা সে পরিবেশন করত, পাড়াপড়শি যা দেখে অবাক হত। গোরা কবে থেকে এত নৃত্যপটু হল, কে তার গুরু, তারা বুঝতে পারত না। নবদ্বীপ আর আশপাশে ছত্রিশ জাতের আসরে মাসের পনেরো দিন এইসব অনুষ্ঠানের মহড়া দিত সে। শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাকদের নিয়ে নাটগীতের একাধিক দল তৈরির পাশাপাশি বামুনপাড়ার ছেলে, বুড়োদের নিয়ে ভক্তিরসের নাটগীত অভিনয় করত। ব্রাত্মণপাড়ার বেশির ভাগ নাটগীত অনুষ্ঠিত হত মেসো চন্দ্রশেখরের বাড়ির গোয়ালঘর সংলগ্ন দাওয়াতে। গোবরে নিকনো উঠোন জুড়ে বসত দর্শকরা। উঠোন থেকে দাওয়া কিছুটা উঁচু হওয়ার জন্যে তা মঞ্চের কাজ করত। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, ভাগবতের নানা কাহিনী, পুরুষানুক্রমে যা মুখে মুখে মানুষ শুনে এসেছে, চোখের সামনে সেই সব বিবরণের জীবন্ত, মোহময় দৃশ্য দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ত। পাঁচালি গান, পুতুলনাচ, মঙ্গলগীত, শবরোৎসবের অমার্জিত অনুষ্ঠান দেখে অভ্যস্ত নবদ্বীপবাসীকে প্রথম উঁচুমানের মঞ্চাভিনয় কলার সঙ্গে পরিচয় করাল গোরা।

রাজা হরিশচন্দ্রের যে কাহিনী, ছেলে থেকে বয়স্ক দর্শকরা তাদের মা, ঠাকুমার মুখে শুনেছে, সেই রাজাকে শ্মশানে চণ্ডালের বেশে মৃত ছেলে কোলে, স্ত্রী শৈব্যার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা কেঁদে অস্থির হল। রানী শৈব্যার ভূমিকায় মলিন পোশাক, চোখের জলে বুক ভেসে যাওয়া রমণীটি যে জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে গোরা, দর্শকদের চিনতে অসুবিধে না হলেও সেই মুহূর্তে সন্তানহারানো মা ছাড়া তাকে আলাদা কিছু ভাবতে পারত না। পুরাণের আরও কাহিনী, যেমন যমরাজের সামনে মৃত স্বামী, সত্যবানের মাথা কোলের ওপর রেখে তার প্রাণ ভিক্ষা চাইছে সাবিত্রী। মৃতকে পুনর্জীবন দেওয়া যে ঈশ্বরের পক্ষে সম্ভব নয, সাবিত্রীকে সস্নেহে এই কথা বুঝিয়ে যমরাজা যখন অন্য বর চাইতে বলছে, তখন নানা কথার ফাঁকে শত পুত্রের জননী’ হওয়ার বর প্রার্থনা করে যমরাজের মুখ থেকে ‘তথাস্তু’, তাই হোক, কথাটা বার করে নিয়ে তাকে হতভম্ব করে দিল সাবিত্রী। তার দু’চোখ দিয়ে যখন আনন্দাশ্রু ঝরছে, ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল সত্যবান। সাবিত্রীর ভূমিকায় গোরার অভিনয় দেখে যারা ব্যাকুল হয় কাঁদল, বিভ্রান্ত যমরাজের মুখের চেহারা দেখে তারা শব্দ করে হাসতে থাকল। চিকের আড়াল থেকে মহিলা দর্শকরা গোরাকে চিনতে পেরেও তাকে সতী সাবত্রী ধরে নিয়ে মাটিতে মাথা ঠুকে ঢিপঢিপ করে প্রণাম করতে থাকল। বিবাহিতারা, নিজেদের সিঁথির সিঁদূর অক্ষয় রাখার আশীর্বাদ প্রার্থনা করল।

‘লক্ষ্মীকাচ’ যার আর এক নাম ‘গোপিকানৃত্য’, সেই নাটগীতি লক্ষ্মীর ভূমিকায় এক রাতে গোরা অভিনয় করে, শ্রীবাসের বাড়ির আঙ্গিনায় উপস্থিত দর্শকদের হৃদয় মাত করে দিল। ‘লক্ষ্মীকাচ’ নাটগীতিকে গোরা নতুন করে সাজিয়ে নানা অঙ্কে ভাগ করে নিয়েছিল। ধুয়া, কথা, দিশা ও ঠাঠ, চারটি বিশিষ্ট ভাবজগৎ তৈরি করে, নাটকের গঠনশৈলিতে অভিনবত্ব আনা হয়েছিল। লক্ষ্মীর ভূমিকায় শাঁখা, পলা, অলঙ্কার, কাঁচুলি, রেশমের শাড়িতে সুসজ্জিত গোরা মাটির দাওয়ায় (সেটাই মঞ্জু) আসতে শরতের মেঘমুক্ত পূর্ণিমা রাতের আকাশে একশো চাঁদের উদয় হল। চিকের আড়ালে বসে দেবী লক্ষ্মীকে শচী চিনতে না পারলেও তার পুত্রবধূর অজানা ছিল না অভিনেতার পরিচয়। আগের রাতে নিজের ঘরে, বউকে সামনে রেখে এই রূপসজ্জার মহড়া দিয়েছে গোরা। বন্ধ ঘরে ওই একজনই দর্শক ছিল। গোরাকে শাড়ি, গয়না পরতে সাহায্য করার সময়ে লক্ষ্মী খিলখিল করে হাসছিল। গোরার নাটগীত দলে রূপসজ্জা, আবহ, এক কথায় নেপথ্য রচনাকার বাসুদেব আচার্য থাকলেও উৎকর্ষে বিশ্বাসী গোরা নিজেও রূপসজ্জা নিয়ে ভাবত, নজর রাখত সেদিকে। নাটগীত জমে উঠতে দু’হাত জুড়ে দেবী লক্ষ্মীকে গড় করে পুত্রবধূর কানে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে শচী জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা কে গা বউমা? রূপ যেন ফেটে পড়ছে!

ফিক করে হেসে লক্ষ্মী বলল, মা, ইনি আপনার ছেলে।

শচীর মুখে কথা সরল না। দেবী লক্ষ্মীর বেশে গোরার নাচ শুরু হতে মুগ্ধ চোখে শচী তাকিয়ে থাকল। দর্শকরাও বিমোহিত। শ্রীবাসের দাওয়ায় গোরার তৈরি মঞ্চে এক এক করে ঢুকতে থাকল বড়াই, সখী, পাত্র, কোটাল এবং অন্যরা। বড়াই-এর ভূমিকায় শ্রীবাস পণ্ডিত। পুরাণের কাহিনী হলেও গোরার মাজা-ঘষায় পাঁচ অঙ্ক, চার ভাববিভঙ্গে সাজানো নাটক আগাগোড়া মজায় মোড়া। বড়াই আর কোটালের সাজপোশাক, চালচলন দেখে দর্শকরা যত হাসছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি অভিভূত হচ্ছিল লক্ষ্মীর নাচ দেখে। শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে তারা লক্ষ্মীর কৃপা প্রার্থনা করতে থাকল। নাট্যাভিনয়ের শেষে এমন এক ঘটনা ঘটল যে আনন্দ অনুষ্ঠানের সুর কিছুটা তেতো হয়ে গেল। ভেতরের একটা ঘর থেকে শ্রীবাসের বুড়ি শাশুড়ির কান্না, গোঙানি ভেসে এল। দর্শকরা তখন চলে গেলেও শচী, লক্ষ্মীকে নিয়ে গোরা বাড়ি ফিরতে পা তুলেছে। কান্নার আওয়াজ শুনে সে দাঁড়িয়ে গেল। শ্রীবাস পণ্ডিতের পরিবারে বউ, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়, অতিথি কম নেই। একান্নবর্তী পরিবারে সহোদর তিন ভাই শ্রীরাম, শ্রীপতি, শ্রীনিধি, তাদের সহধর্মিণী, ছেলে, মেয়ে, দুই ঘরজামাই, এমন কি শ্রীবাসের শাশুড়ি থাকত। নাটক শেষ হতে বড়াই-এর রূপসজ্জা না ছেড়ে শ্রীবাস চিকের পাশের ঘরে ঢুকে যায়। ঘরটায় পরিবারের কচি মেয়েদের নিয়ে থাকত শ্রীবাসের শাশুড়ি। অন্ধকার ঘরে শ্রীবাস যখন ঢুকল, শাশুড়ি সেখানে একা। কোনওরকম ভূমিকা না শাশুড়িকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেছিল শ্রীবাস। তার রাগের কারণ বাড়ির সবাই জানলেও জামাই-এর হাতে প্রহৃত শাশুড়িকে উদ্ধার করতে কেউ ঘরে ঢুকল না। গোরা কিছু অনুমান করে, শ্রীবাসকে প্রায় চ্যাংচোলা করে ঘরের ভেতর থেকে দাওয়ায় এনে বসাল। গোরার বয়স তখন আঠারো, শ্রীবাস আটষট্টি। শাশুড়ির সামনে বড়াই-এর ভূমিকায় অভিনয় করতে সঙ্কুচিত শ্রীবাস, চিকের আড়ালে দর্শকদের মধ্যে সেই বৃদ্ধাকে বসতে বারণ করেছিল। শাশুড়ি ঠাকরুণ জামাই-এর নির্দেশ মেনে নিয়েও অন্ধকার ঘরের চৌকাঠের পাশ থেকে লক্ষ্মীকাচ নাটক দেখছে, বড়াই-এর ভূমিকাভিনেতা শ্রীবাসের নজর এড়ায়নি। অভিনয়ের মধ্যে শাশুড়িকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার ছক কষে নিয়েছিল। নাটক ভাঙতে শ্রীবাস তখনই ঘরে ঢুকে শাশুড়িকে ঠেঙাতে শুরু করেছিল। শ্রীবাসের এই বিসদৃশ কাণ্ডটা গোরার অপছন্দ হলেও তখনই প্রকাশ করেনি। স্ত্রীনির্যাতনকারী বৈয়বের সম্পর্কে বিরূপতায় ভারাক্রান্ত হয়ে মা, বউ নিয়ে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এসেছিল।

নিজের দৈনন্দিন কাজ আর ভাবজগৎ নিয়ে গোরা যখন ডুবে আছে, নবদ্বীপের আকাশে দুর্যোগ ঘনাচ্ছে, সে টের পায়নি। ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত পীরল্যা গ্রাম পুরো মুসলিম হয়েছিল, তার জানতে তিন মাস লেগে গেল। পীরল্যার খবর একটু একটু করে নবদ্বীপে পৌঁছোতে ভয়ে সেখানকার মানুষের হাত-পা পেটে সেঁধিয়ে গেল। নবদ্বীপের ব্রাক্ষ্মণ সমাজে হাহাকার উঠলেও গোরা ছিল বেপরোয়া, সে ভয় পায়নি। অভিনয় করে, নেচে, গেয়ে সে মাতিয়ে রেখেছিল উত্তর নবদ্বীপের বাগোয়ান পরগণা থেকে উগরা, কুবাজপুর, দক্ষিণে সাতসৈকা পরগণা। গঙ্গানগর, সিমুলিয়া, গাদীগাছা, মাজিদা, পারডাঙায় নাটগীতের দল গড়েছিল। নবদ্বীপে আরও এক গোপন অভিযান তখন শুরু হয়ে গেছে। সেন রাজবংশের রক্ত শরীরে বইছে, এরকম একজন (একাধিকও হতে পারে) যুবকের খোঁজে সিন্ধুকীরা ঘোরাফেরা শুরু করেছে। সুলতানী দরবারের হুকুমে এই গোপন অভিযানের ঘটনা পাঁচ কান না হলেও শ্রীখণ্ডের নরহরি এসে গোরাকে সাবধানে থাকতে বলেছিল। গৌড় দরবারের কর্মচারী, তার বাবা নারায়ণদাস সরকার, দাদা, মুকুন্দদাস মিলে সম্ভবত নরহরিকে পাঠিয়েছিল গোরার কাছে। বাবা, দাদার নির্দেশমতো বিপদের গুরুত্বটা নরহরি গুছিয়ে বলেছিল তাকে। পীরল্যা গ্রামের ধর্মনাশের সঙ্গে যে এই সতর্কবার্তার সংযোগ আছে, গোরা টের পেয়েছিল। নবদ্বীপের পাষণ্ডীদের সুনজরে নেই সে। স্মার্ত, নৈয়ায়িক, তন্ত্রাচারী হাঁকডাকসম্পন্ন ব্রাক্ষ্মণেরা তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগপত্র গৌড়ের সুলতানের কাছে পাঠিয়েছে, সে খবরও নরহরি জেনেছিল। দুই বন্ধুতে এ নিয়ে ভাগীরথীর ধারে নির্জন গাছতলায় বসে কথাবার্তা বলার সময়ে নরহরি কিছুদিনের জন্যে নবদ্বীপের বাইরে কোথাও জ্ঞাতিবাড়িতে বন্ধুকে থেকে আসতে বললে গোরার খেয়াল হল, এমন একটা কথা বাড়িতে কিছুদিন আগে মা বলেছে তাকে। শচী বলেছিল অন্য প্রসঙ্গে। কথাটা পাড়ার ইচ্ছে বেশ কিছুদিন মনের মধ্যে পুষে রাখলেও নববিবাহিত ছেলেকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। লক্ষ্মীর সামনে ছেলেকে বলার মতো কথা সেটা নয়। গোরাকে একা, আলাদা বসিয়ে কথাটা শোনানোর সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। দু’একবার সে সুযোগ এলেও খেয়ালি ছেলের মেজাজ কেমন আছে, হদিশ করতে সময় চলে গেছে। মুখ খোলার আগের মুহূর্তে পুত্রবধূ এসে যাওয়ায় শচী চুপ করে থেকেছে। মা কিছু বলতে চায়, আঁচ করেও গোরা জিজ্ঞেস করেনি। কোন প্রসঙ্গ মা পাড়বে, বুঝতে তার বাকি ছিল না। বিয়ের আগে থেকে, কুবেরের সঙ্গে মায়ের একাধিকবার আলাপচারিতার সূত্র ধরে তার মাথার মধ্যে বিষয়টা ঘোরাফেরা করলেও সে এড়িয়ে থাকতে চাইছিল। লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে মনের মধ্যে এমন আলোড়ন হচ্ছিল যে তাকে ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার কথা ভাবতে পারছিল না। মায়ের মুখ থেকে কথাটা না শোনার জন্যে তাকে পাশ কাটাতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত ধরা দিতে হয়েছিল। তাকে একান্তে পেয়ে মা মনে করিয়ে দিয়েছিল তার প্রতিশ্রুতির কথা। শচী বলেছিল, কুবেরকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। তার বিশ্বাস, বিশ্বরূপ খলাপপুর ছেড়ে শ্রীহট্টে, বুরহানউদ্দিন দরগার মুজাভিরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। কুবেরের কাছে সেই ইচ্ছে জানিয়েছিল তোর দাদা।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গোরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, দাদার খোঁজে শ্রীহট্টে যাবি নাকি একবার? গোরা জবাব দেওয়ার আগে তাকে শচী মনে করিয়ে দিয়েছিল, নানা সময়ে বেশ কয়েকবার দাদাকে খুঁজে আনার কথা সে-ই বলেছিল।

সব মনে আছে গোরার। দুঃখী মাকে একবার নয়, বেশ কয়েকবার, তার সাত বছর বয়স থেকে দাদাকে খুঁজে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দু’চোখে আশার আলো নিয়ে মা শুনেছে তার কথা। বিশ্বাস ঘনিয়ে উঠেছে মায়ের মনে। সে সব দিনের স্মৃতি গোরা কিছুই ভোলেনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্রীহট্টে যাওয়ার আশ্বাস মাকে শুনিয়েছিল সে। ফাঁকা আশ্বাস নয়। শ্রীহট্টে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পাকা মীমাংসা নিজেই করে ফেলেছিল। নরহরির সূত্রে শ্রীখণ্ড থেকে নারায়ণদাস, মুকুন্দদাসের পরামর্শও তার কাছে ফেলনা ছিল না। নবদ্বীপের বাইরে কিছুদিন কাটাতে হলে শ্রীহট্টে যাওয়া-ই ভালো। শ্রীখণ্ডের দুই বয়োজ্যেষ্ঠের অনুরোধ রাখার সঙ্গে মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও পালন করা হবে। বারো বছর আগে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ দাদাকে শ্রীহট্টে যদি খুঁজে পায়, কী করবে সে? কথাটা ভেবে গায়ে কাঁটা দিতে তার মনে হল, বাবা, ঠাকুর্দার জন্মভূমি দর্শন করাও কম পুণ্যের কাজ নয়।

.

শ্রীহট্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিজের মনে পাকা করলেও নরহরির মুখ থেকে নবদ্বীপের বাইরে, কোথাও জ্ঞাতি আত্মীয়ের বাড়িতে কিছুকাল আত্মগোপন করে থাকার পরামর্শ শুনে গোরার প্রথম প্রশ্ন জাগল, রাজা লক্ষ্মণ সেনের প্রপৌত্রের প্রপৌত্র, তার বংশলতিকার একজন উত্তরপুরুষ হিসেবে সুলতানের সিন্ধুকীরা আসল মানুষকে ছেড়ে কেন তাকে ধরতে যাবে? সে ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান, বৈদ্য লক্ষ্মণ সেনের রক্ত তার শরীরে থাকতে পারে না। গোরার প্রশ্ন শুনে নরহরির চিন্তিত মুখে ম্লান হাসি জেগেছিল। গোরার শরীরের গঠন, তার রূপ যে রূপবান রাজপুরুষের চেয়ে বহুগুণ রাজকীয়, স্পষ্ট ভাষায় গোরাকে তা জানিয়ে প্রশ্ন করেছিল, গোরা কি নিজের মুখ কখনও দর্পণে দেখেনি?

সব রাজা-মহারাজা সুলতান যে রূপবান হয় না, নরহরিকে এ খবর জানিয়ে গোরা বলেছিল, লোকশ্রুতি আছে, গৌড়ের রাজাকে যে সুলতান দেশছাড়া করেছিল, সেই ইখতিয়ারউদ্দীন মহম্মদ বখতিয়ার খিলজী কুদর্শন বামন ছিল। গোরার কথায় সায় দিয়ে নরহরি জানাল, বেঁটে বামন, কদাকার বখতিয়ার খিলজীর বিবরণ ঠাকুর্দা, ঠাকুমার মুখে সেও শুনেছে। তারা শুনেছিল, তাদের বাপপিতামোর কাছ থেকে। তবে কান্যকুব্জ থেকে আসা সেন রাজারা যে বয়সকালে যথেষ্ট সুপুরুষ ছিল, তার অনেক প্রমাণ আছে। রূপবান গোরার নখের যোগ্য না হলেও তারা কুৎসিত দর্শন ছিল না, কথাটা গোরাকে জানাতে নরহরি ভুলল না। আঠারো বছরের অমিতদ্যুতিসম্পন্ন রূপবান মানুষটির মুখে ভয়ডরের কোনও চিহ্ন না থাকলেও, সে কিছু চিন্তা করছে, নরহরি বুঝেছিল। চিন্তার কারণটা জানার আগ্রহ না দেখিয়ে গোরাকে নরহরি বলেছিল, যে, লক্ষ্মণ সেনের বংশধর তল্লাশিতে নেমে সুলতানী সিন্ধুকীরা যে গোরাকে চিহ্নিত করেছে, এমন খবর নারায়ণদাস, মুকুন্দদাস পাঠায়নি। তারা শুধু গোরাকে সজাগ থাকতে বলেছে।

গঙ্গার ঘাট থেকে নৌকো ধরে নরহরি শ্রীখণ্ডে চলে যেতে গোরা মনস্থির করল, শ্রীখণ্ড থেকে পাঠানো বার্তার বিষয়টা মা, বউকে জানাবে না। পীরল্যা গ্রামের মতো নবদ্বীপের মানুষের ধর্মনাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এই অনুভূতি মনের গভীরে নড়াচড়া করতে থাকল। অমঙ্গলের আশঙ্কায় গোটা নবদ্বীপ তটস্থ হয়ে রয়েছে। পীরল্যা গ্রামের সর্বনাশের কাহিনী বাড়িতে গোরা না বললেও নানা মুখ থেকে শচী শুনেছে। লক্ষ্মীর কানেও গেছে। শচীর চেয়ে ভয়ে বেশি কাঁপছে লক্ষ্মী। নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা এখন চলে গেলে লক্ষ্মী আরও ভয় পেয়ে যাবে। উল্টোটাও ঘটতে পারে। শ্রীহট্টে তার স্বামী নিরাপদে থাকবে, ধরে নিয়ে উদ্বেগ কাটিয়ে উঠতে পারে। বিশ্বরূপের খোঁজে গোরাকে শ্রীহট্টে পাঠানোর জন্যে মায়ের ব্যাকুলতার ঘটনাও কয়েকদিন ধরে তাকে খোঁচাচ্ছে। কুবেরের মুখ গোরার মনে পড়ল। তার বিয়ের দিনগুলোতে, সে-ও প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল, কুবেরের সঙ্গে কয়েকদিন মহানন্দে কাটিয়েছিল। নানা গল্পে সময় কাটানোর সুখস্মৃতি অক্ষয় ছাপ রেখে গেছে তার মনে। বাড়ির দাওয়ায় গল্পের আসরে মা-ও থাকত। বিশ্বরূপের প্রসঙ্গ উঠলেই জল আসত মায়ের চোখে। তার সঙ্গে কথোপকথন শুরু হলে মাকে ডেকে নিত কুবের। তার কথা শুনে মায়ের ধারণা হয়েছিল, শ্রীহট্টে মুজাভিরের দরগায় কুবেরের থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। মায়ের মনে এ ধারণা কীভাবে শেকড় গাড়ল, তার ব্যাখ্যা গোরা খুঁজে না পেলেও মায়ের তাগিদে তার শ্রীহট্ট যাওয়ার ইচ্ছেটা বেড়ে গেল। রাজা লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর দুশো বছর পরে তার কোনও বংশধর নবদ্বীপে রয়ে গেছে শুনে অবাক না হলেও তার খোঁজ করার উপায় ভেবে পেল না। শ্রীবাস পণ্ডিত, অদ্বৈত আচাৰ্য, এমন কি দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তীকে বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করা কতটা সমীচীন হবে, এ প্রশ্নও মনে জাগল। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অশীতিপর দাদামশাই, নীলাম্বরের বেলপুকুরিয়ার বাড়িতে এক দুপুরে গোরা হাজির হল। কানে কম শুনলেও চোখে প্রখর দৃষ্টি, অটুট স্মৃতি নীলাম্বর খুশি হল গোরাকে পেয়ে। নিস্তব্ধ দুপুরে মামুলি দু’চার কথা দিয়ে শুরু করে লক্ষ্মণ সেনের প্রসঙ্গটা গোরা তুলল। খুব উঁচুতে গোরা কণ্ঠস্বর না তুললেও তার প্রশ্ন শুনতে পেল নীলাম্বর। জলচৌকির ওপর পুঁথি, পোড়ামাটির দোওয়াতে তরল ভুষো কালি, খাগের কলম সাজিয়ে বসে থাকা দাদামশাই-এর মুখে হাসি ফুটল। দাদামশাই-এর বত্রিশটা দাঁতের বেশির ভাগ কর্মক্ষম, যথাস্থানে রয়েছে, মাথায় সামান্য টাক পড়লেও চুল যা রয়েছে, সব কালো। গোরার কাঁধে হাত রেখে নীলাম্বর বলল, অশ্বপতি-গজপতি-নরপতি-রাজত্রয়া-ধিপতি বিবিধবিদ্যা বিচার বাচস্পতি সেনকুল কমলবিকাশভাস্কর, সোমবংশপ্রদীপ প্রতিপন্নকর্ণ সত্যব্রত-গাঙ্গেয় শরণাগত বজ্রপঞ্জর পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণ সেন তখন যুদ্ধব্যবসা ভুলে গিয়েছিল। তার তিন কুলাঙ্গার পুত্র আত্মদ্রোহে লিপ্ত থেকে স্বধর্ম, স্বদেশ ও স্বজনের সর্বনাশের পথ তৈরি করছিল। নবদ্বীপ লুঠ করে বক্তিয়ার গৌড়ের লক্ষ্মণাবতীতে ফিরে গিয়ে সেখানে রাজধানী বানিয়ে বসল। পাঁচ, সাত বছর ছিল তার রাজত্বকাল। লক্ষ্মণ সেনের সঙ্গে গৌড় ছেড়ে পলাতক তার তিন ছেলে তার বংশধররা পূর্ববঙ্গে তাদের অধিকার আরও পঞ্চাশ ষাট বছর বজায় রেখেছিল। লক্ষ্মণ সেনের তৃতীয় পুত্র বিশ্বরূপ সেনের ছেলে লক্ষ্মণনারায়ণ, তার ছেলে মধু সেন ছ’শো নব্বই, একানব্বই হিজরা অব্দ পর্যন্ত বঙ্গাল, সোনারগাঁ, লখনৌতির অধীশ্বর ছিল। লক্ষ্মণ সেনের আর এক বংশধর, কোনও মহিষী, উপপত্নীর ছেলে, রাজবংশের কারিকা গ্রন্থ থেকে জানা যায় না, নাম সুরসেন, গৌড় থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রয়াগে সে আশ্রয় নিয়েছিল। সুরসেনের ছেলে রূপসেন, শুনেছি, তার বাবা মারা যাওয়ার পরে পঞ্চনদের তীরে এক ভূখণ্ডে রূপর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সিংহাসনে বসেছিল। রূপরের কাছাকাছি আরও কয়েকটি অঞ্চলে সেনবংশের উত্তরসূরীরা এখনও রাজত্ব করে শুনেছি। প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে শোনা কথা মিলবে কিনা, বলতে পারছি না। নবদ্বীপে যদি এখনও সেনবংশের এক, দু’জন উত্তরপুরুষ নিজেদের বংশপরিচয় জাহির না করে, সাদামাঠা সংসারীর জীবন কাটায়, তা অস্বাভাবিক নয়।

রাজা লক্ষ্মণ সেনের উত্তরপুরুষ সম্পর্কে গোরার জানার আগ্রহ কেন জেগেছে, প্রশ্ন করে, নাতির মুখে এক চিলতে হাসি ছাড়া নীলাম্বর কিছু দেখল না। হাসিতে রহস্যের আভাস পেয়ে গোরাকে নীলাম্বর বলল, সেনরাজবংশের কুলপঞ্জির পাতা ঘেঁটে লাভ নেই। কেঁচো খুঁড়তে কোথায় সাপ বেরিয়ে পড়বে, কে বলতে পারে! অকারণ ঝামেলায় তোমার না জড়ানোই ভালো। তোমার চতুষ্পাঠীর সমৃদ্ধির খবর পাই। তোমার অধ্যাপনার প্রশংসা কানে আসে। আমার বুক ভরে যায়। গোরার জন্মপত্রিকা, কোষ্ঠি তৈরী করেছিল নীলাম্বর। জ্যোতিষশাস্ত্রচর্চার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে সিংহ রাশি, সিংহ লগ্ন, জন্ম মুহূর্তে শুভ গ্রহ নক্ষত্রের সমাবেশ, গোরার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এমন কিছু সংকেত নীলাম্বর পেয়েছিল, যা প্রকাশ্যে বলা যায় না। আদরের এই নাতি, অপঘাতে মারা না গেলে, গৌড়েশ্বর কিম্বা তার চেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি হতে পারে।

জ্ঞানবৃদ্ধ দাদামশাই-এর সঙ্গে কথা বলে গোরা এত আরাম পেল, যে প্রশ্নটা মনে চেপে রাখতে চেয়েছিল, সেটা করে ফেলল। রাজা লক্ষ্মণ সেনের নবদ্বীপবাসী কোনও বংশধরের খবর দাদামশাই রাখে কিনা জানতে চাইল। সদালাপী বৃদ্ধ জানাল, পঞ্চাশ বছর আগে এক নবজাতের কোষ্ঠি বানাতে তার কাছে সেনবংশীয় এক ভদ্র সন্তান এসেছিল। রাজা লক্ষ্মণ সেনের পরিবারের সঙ্গে সে সম্পর্কিত, এটুকু শুধু বলেছিল। আত্মপরিচয় বিশেষ দেয়নি। সেন রাজবংশের কারিকা গ্রন্থ পাশে রেখে সেই নবজাতের জন্মছক তৈরি করতে বসে গ্রহনক্ষত্রের যোগাযোগ বিচার করে রাজবংশের পরম্পরা পেয়েছিলাম। আমার তৈরি ছক নিয়ে সেই ভদ্র সন্তান চলে যাওয়ার পরে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ ঘটেনি।

নীলাম্বরের পাশ থেকে ওঠার আগে তাকে গোরা জানিয়েছিল শারদীয়া দুর্গাপূজার ছুটিতে চতুষ্পাঠী বন্ধ হলে, শ্রীহট্টে যাচ্ছে সে। নীলাম্বরের জন্মভূমিও শ্রীহট্ট। যৌবনের পড়ন্ত বেলাতে সপরিবারে নবদ্বীপে চলে এসেছিল। স্বেচ্ছায় আসেনি। মগের মুলুক হয়ে উঠছিল শ্রীহট্ট। পাশাপাশি ধর্মনাশ, কর্মনাশ, কুলনাশের ভয়, প্রবলরকম বাড়ছিল। নবদ্বীপে শ্রীহট্টবাসী উপেন্দ্র মিশ্রর ছেলে জগন্নাথের সঙ্গে শচীর বিয়ে হয়। ন্যায়শাস্ত্র পড়তে জগন্নাথ নবদ্বীপে এলেও বাকি ছয় ছেলে,কংসারি, পরমানন্দ, পদ্মনাভ, সর্বেশ্বর, জনার্দন, ত্রৈলোক্যনাথ আর স্ত্রী শোভাদেবীসমেত বিশাল সংসার নিয়ে শ্রীহট্টে থেকে গেল উপেন্দ্র মিশ্র। উপেন্দ্রর সঙ্গে নীলাম্বরের ছিল গভীর সৌহার্দ্য। মা, বাবার জন্মভূমি দেখতে গোরা শ্রীহট্টে যাচ্ছে জেনে নীলাম্বর খুশি হওয়ার সঙ্গে ঈষৎ অস্থির হল। শ্রীহট্টে কতদিন গোরার থাকার ইচ্ছে, প্রশ্ন করে, কোথায় গিয়ে সে উঠছে, জানতে চাইল। উপেন্দ্র মিশ্রের মৃত্যুর পরে তার একান্নবর্তী সংসারের হালচাল সম্পর্কে নীলাম্বর যা খবর পেয়েছিল, তা সুখের নয়। জমি, বাড়ি, সম্পত্তি নিয়ে উপেন্দ্রর ছয় ছেলের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে, সংসারে শান্তি নেই, বৃদ্ধা শোভাদেবী তখন অসুস্থ ছিল। এই মুহূর্তে সে জীবিত, না পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, নীলাম্বর জানে না। নবদ্বীপে জগন্নাথের পরিবারের সঙ্গে তার ছয় ভাই, তাদের পরিবারের যাওয়া আসা নেই, বললে কম বলা হয়, চিঠি লেনদেনও হয় না। জগন্নাথ বেঁচে থাকতে তার মুখ থেকে এসব তথ্য নানা সময়ে নীলাম্বর শুনেছিল। জগন্নাথের মনে এ জন্যে ক্ষোভ ছিল, আক্ষেপ জমেছিল। শ্রীহট্টে শচীকে নিয়ে জগন্নাথ শেষবার যাওয়া পর থেকে এক সংসারের দুই অংশের সম্পর্কে যে চিড় ধরেছিল, নীলাম্বর অনুমান করতে পারলেও জগন্নাথকে কখনও জিজ্ঞেস করেনি। জগন্নাথও এগিয়ে এসে শ্বশুরকে কিছু বলেনি। বাড়িতে নিজের স্ত্রী, মেয়ে, জামাই, আরও কিছু ঘনিষ্ঠজনের নানা টুকরো কথা জুড়ে নীলাম্বর বুঝেছে, বউ, ছেলে নিয়ে জগন্নাথ অল্পদিনের জন্যে শ্রীহট্টে মা, বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পরে শচীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়াটা পরিবারের কেউ ভালো চোখে দেখেনি। সম্ভবত তাদের কল্পনাতে ছিল না, এমন ঘটতে পারে। শচী নিজেও হয়তো জানত না, তার পেটে সন্তান এসেছে। সন্তানসম্ভবা হওয়ার তিন মাস পরে শাশুড়িকে ঘটনাটা জানিয়েছিল। শাশুড়ি শুনে প্রথমে খুশি হলেও চব্বিশ ঘণ্টা পর থেকে তার মূর্তি গম্ভীর হতে থাকল। শচীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনা থেকে যে এই পরিবারের মধ্যে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, শ্রীহট্টবাসীরা নবদ্বীপের আত্মীয়দের ছায়া মাড়াতে চায় না, নীলাম্বর চক্রবর্তী আঁচ করেছিল। জগন্নাথ, শচীকে এ নিয়ে নীলাম্বর প্রশ্ন করেনি। পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো শরীর, স্বাস্থ্য আঠারো বছরের গোরা, শ্রীহট্টে তার পিতৃপিতামহের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে সমাদর তো পাবেই না, তাকে পিতৃব্যদের কটু কথা শুনতে হতে পারে। জেঠি, কাকিরা হয়তো টেরাবাঁকা এমন কিছু মন্তব্য করতে পারে, যা শুনে অপমানে ফুলের মতো নরম মন, রগচটা ছেলেটার খেপে ওঠা অসম্ভব নয়। গোরাকে খুঁচিয়ে, শ্রীহট্টে কোথায় সে থাকার চিন্তা করছে জিজ্ঞেস করে, নীলাম্বর যখন শুনল, উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়িতে জ্যাঠা-কাকাদের নিবাসে ওঠার কথা সে ভেবে রেখেছে, অশীতিপর মানুষটা তখন সামান্য বিপাকে পড়ল। উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়িতে না উঠে অন্য এক ঠিকানায় তপন মিশ্রর আশ্রয়ে থাকতে বলল। জীবনে প্রথম শ্রীখণ্ডে যাচ্ছে গোরা। জ্যাঠা-কাকা, আত্মীয়দের কাউকে চেনে না। সকলে অপরিচিত। তপন মিশ্রের বাড়িতে তার পরিবারের সঙ্গে বাস করা আর জ্যাঠা-কাকার বাড়িতে থাকা যে একই ব্যাপার, গোরা জানে। বৃদ্ধ দাদামশাই-এর প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে গেল। সবশেষে শ্রীহট্টে গোরার যাওয়ার কারণ নীলাম্বর জানতে চাইলে গোরা বলল, পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধারে যাচ্ছি না।

নাতির রসিকতায় হাসিতে উজ্জ্বল হল দাদামশাইয়ের মুখ। বলল, তা জানি, তুমি সে পাত্র নও।

গোরা বলল, আমার যাওয়ার কারণটা তুমি আন্দাজ করো।

মুচকি হেসে নীলাম্বর বলল, মায়ের তাগাদায়, দাদাকে খুঁজতে।

দাদামশাই-এর পায়ের ধুলো নিল গোরা। নাতির চিবুক ধরে নীলাম্বর জিজ্ঞেস করল, বউ-এর জন্যে মন কেমন করলে, কী করবি?

তোমার বউ-এর কথা ভাবব।

গোরাকে বুকে জড়িয়ে ধরল বৃদ্ধ নীলাম্বর। নাতিকে আদরের পাট শেষ করে শ্রীহট্টের তপন মিশ্রের নামে নীলাম্বর যে হাতচিঠি করে দিল, তার বিষয় গোরা, স্নেহের নাতি গোরা যাচ্ছে, মা, বাবার জন্মভূমি শ্রীহট্ট দর্শনে, তপন মিশ্রের বাড়িতে আশ্রয়ের সঙ্গে সে যেন যত্নআত্তি পায়।

নীলাম্বর জানে, তার এ চিঠি পেয়ে খুশিতে আপ্লুত হবে নাতির বয়সি তপন। তপনের বাবা, হৃদয় মিশ্র ছিল শ্রীহট্টে নীলাম্বরের চতুষ্পাঠীর ছাত্র, তপনের ঠাকুর্দা প্রাণনাথ মিশ্র ছিল ক্ষুদিরাম আগমবাগীশের চতুষ্পাঠীতে তার সহাধ্যায়ী, পরম সুহৃদ। হৃদয়ের স্ত্রী মন্ত্রদীক্ষা নিয়েছিল নীলাম্বরের কাছে। শিক্ষাগুরু সবসময় বাবার সমান। ‘পিতৃমধ্যে স্থিতো গুরুঃ’ সে হিসেবে সন্তান তুল্য ছাত্র হৃদয়ের সহধর্মিনীরও বাবা হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে নীলাম্বর। পুরুষানুক্রমে দুই পরিবারের সম্পর্কের জের, নীলাম্বরের মনে হল, আরও অনেকদিন চলবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *