গোরা – ২৫

২৫

গোরাকে নিয়ে শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের বাড়িতে যাওয়ার দিনক্ষণ একাধিকবার শ্রীবাস পাকা করলেও যাওয়া হয়ে উঠছিল না। শেষ মুহূর্তে কেঁচে যাচ্ছিল শান্তিপুরে যাওয়ার কর্মসূচি। কখনও গোরার নির্দেশে, কখনও শান্তিপুর থেকে অদ্বৈতের বার্তা পেয়ে দুই মহাপুরুষের দেখা করার সূচি ক্রমাগত বাতিল হওয়ার ঘটনাতে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিল শ্রীবাস। শান্তিপুর, নবদ্বীপের মাটির তলা দিয়ে দুই অঞ্চলের দু’জন মানুষের মধ্যে দূরত্বের এক চোরাস্রোত বয়ে চলেছে। কখনও হিমশীতল সেই স্রোত, কখনও মোলায়েম উয়। রহস্যময় এই স্রোতের কার্যকারণ শ্রীবাস বুঝে উঠতে না পারলেও দুজনের দূরত্ব তাড়াতাড়ি ঘুচে যাবে, এ নিয়ে তার সন্দেহ ছিল না।

চোখের সামনে শ্রীবাস যা দেখছিল, তা হল পাকাপাকিভাবে চতুষ্পাঠীতে ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে রোজই প্রায় সারা রাত সঙ্কীর্তনের শেষে সকালের আলো ফোটার আগে গোরা বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি থেকে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে চান সেরে ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত গোরাকে বেশি সময় আগলে রাখতে ঘরের দরজায় বসে থাকে বিষ্ণুপ্রিয়া। হেঁসেল সামলে শচী ফাঁক পেলে ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেকে দেখে যায়। তার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে চাপা গলায় বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দরকারী কথা সেরে নেয়। নবদ্বীপে নিতাই আসার আগে সেখানে ফুলিয়া থেকে পৌঁছে গিয়েছিল হরিদাস। ভক্তিতে ভাসমান নবদ্বীপের বৃত্তান্ত ফুলিয়ায় বসে হেটো মেঠো মানুষের মুখে শুনে গোরাকে দেখার ইচ্ছে হরিদাস সামলাতে পারেনি। ফুলিয়া থেকে শান্তিপুরে গিয়ে অদ্বৈত আচার্যের আশীর্বাদ নিয়ে নবদ্বীপে এসে গোরাকে দেখে সে এমনই ভাবাপ্লুত হল যে সেখান থেকে নড়তে চাইল না। পৃথিবীতে যাকে আনতে তুলসীপাতা, গঙ্গাজলে অর্ঘ্য সাজিয়ে পাঁচ দশক আকুলভাবে গুরু অদ্বৈত আচার্য ডেকে চলেছে, নবদ্বীপের গোরা যে সেই কৃষ্ণাবতার, নিজের এই বিশ্বাস, লোকমুখে সে পাঠিয়ে দিল অদ্বৈতকে। নবদ্বীপে নন্দন আচার্যের বাড়িতে হরিদাসের থাকার আয়োজন করে দিল গোরা। গোরাকে প্রথম দর্শনে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল হরিদাস। রোজ লক্ষবার যার নাম সে জপ করে চলেছে, তাকে এক লহমা দেখে হরিদাস চিনে ফেলেছিল। বেহুঁশ হরিদাসের কানে কৃষ্ণনাম জপ করে তার জ্ঞান-ফিরিয়েছিল শ্রীবাস।

অদ্বৈতের কাছে গোরাকে নিয়ে শ্রীবাস পৌঁছতে না পারলেও তার বাড়িতে রোজ সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত গোরাকে ঘিরে যা ঘটছিল, খুঁটিনাটির সঙ্গে সে বিবরণ শান্তিপুরে অদ্বৈতের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল। অদ্বৈতের মনের মধ্যে বিক্ষেপ চললেও জগন্নাথ মিশ্রের উদ্ধত, অভব্য ছেলেটা যে ভণ্ডামি করছে না, তা বিশ্বাস করতে জ্ঞানমার্গের পথিক, বৃদ্ধ ভক্তবৈষ্ণব সময় নিচ্ছিল। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগে যা সম্ভব ছিল, কলিযুগে ঈশ্বরের সেই আবির্ভাব সম্ভব কিনা, এ নিয়ে দোলাচলতা ছিল তার মনে। জগার ছেলে ঈশ্বরের অবতার হয় কীভাবে? সে তো একটা নচ্ছার, সেদিনের চ্যাংড়া ছোকরা, কীভাবে সে অবতার হতে পারে, এ সন্দেহ তার মনে খোঁচা দিচ্ছিল। নবদ্বীপে তার টোল থেকে পনেরো, ষোলোবছর আগে যে ন্যাংটো ছেলেটা প্রায়ই দুপুরে তার দাদা বিশ্বরূপকে ভাত খেতে যাওয়ার জন্যে বাড়ি থেকে ডাকতে আসত, চেহারা, চালচলনে আর পাঁচটা শিশুর থেকে সে আলাদ হলেও, তাকে দেখে অদ্বৈতের কখনও কৃষ্ণাবতার মনে হয়নি। বরং মেধাবী, স্থিতধী ছাত্র বিশ্বরূপের আচরণে আরাধ্য অবতারের উপকরণ খুঁজে পেত। বিশ্বরূপকে দু’একবার একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কে?

গুরুর প্রশ্ন শুনে কিশোর ছাত্রটি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। অদ্বৈতের প্রশ্নের জবাব, গোরার জন্মবৃত্তান্তের সূত্রে খুঁজে পেতে সে তখন গোপনে পুঁথি লেখা শুরু করেছিল। অদ্বৈতের প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা ছাড়া তার উপায় ছিল না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অদ্বৈত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলত। নবদ্বীপে তখনও অদ্বৈতের টোল চালু ছিল। সেখানে কৃতী ছাত্রদের একজন ছিল বিশ্বরূপ। বিশ্বরূপের তুলনায় তার ছোটভাই ছিল অপোগণ্ড। নবদ্বীপের ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিতদের মুখ থেকে গোরা সম্পর্কে প্রশংসার কথা অদ্বৈত কখনও শোনেনি। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠীতে ন্যায়শাস্ত্রের পাঠ নিলেও সেখান থেকে কোনও উপাধি পাওয়ার আগে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে বাউণ্ডুলের মতো জীবন কাটিয়েছে। তারপর সতেরোবছর বয়সে বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীকে প্রায় গায়ের জোরে বিয়ে করে পেটের ভাত জোগাড়ের তাগিদে চতুষ্পাঠী খুলে বসেছিল। মূর্খ আর স্বল্পশিক্ষিত কয়েকজন ইয়ারবন্ধুকে লাগিয়ে দিল চতুষ্পাঠীর ছাত্র জোগাড়ের কাজে। তারা বলে বেড়াতে থাকল নিমাই পণ্ডিতের মতো অধ্যাপক নবদ্বীপে দ্বিতীয় নেই। নবদ্বীপের পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ সে। বাসুদেব সার্বভৌম, রঘুনাথ শিরোমণির চেয়ে সে বড় মাপের পণ্ডিত। নবদ্বীপ পরিভ্রমণে আসা দেশ বিদেশের কত পণ্ডিতকে গঙ্গার ঘাটে বসিয়ে সে নাস্তানাবুদ করেছে, প্রচারকরা রটিয়ে বেড়াতে থাকল। গয়াতে বাবার পিণ্ড দিতে গিয়ে সেখান থেকে কৃষ্ণাবতার সেজে নবদ্বীপে ফিরে সে নতুন ছলাকলায় আসর জমাতে শুরু করেছে। অদ্বৈত আচার্যকে নবদ্বীপে নিজের সঙ্কীর্তনে হাজির করে বাজিমাত করতে চাইছে সে। নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে নিতে চাইছে। গোরার প্রতারণার ফাঁদে পা দিতে অদ্বৈত রাজি নয়, সে পরম বৈষ্ণব হলেও গোরার চালবাজি অনায়াসে ধরে ফেলবে; ধুরন্ধর সেই নটবরের এটা বোঝা উচিত ছিল। বাপের বয়সী শ্ৰীবাস পণ্ডিত কীভাবে গোরার এই চালাকিতে মজে গেল, অদ্বৈত ভেবে পাচ্ছিল না। গোরার ফাঁদে পা দেওয়ার লোক সে নয়। কৃষ্ণভক্ত হলেও সে চতুর্ভুজ, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী শ্রী বিষ্ণুনারায়ণের সাধক, জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধিতে ঐহিত্যমণ্ডিত নাড়িয়াল বংশের সন্তান, কুবের ভট্টাচার্যের ছেলে, নরসিংহ ভট্টাচার্যের নাতি। নাড়িয়াল গাঁইভুক্ত নরসিংহ হেজিপেঁজি মানুষ ছিল না, রাজা গণেশের মন্ত্রী ছিল নরসিংহ। গৌড়ের মানুষকে তখন গৌড়িয়া, শ্রীহট্টবাসীদের শ্রীহট্টিয়া নামে সবাই এক ডাকে চিনত। তেমনি নাড়িয়াল গাঁইভুক্তদের পরিচিতি ছিল ‘নাড়া’ নামে। অনুজপ্রতিমদের ‘নাড়া’ বলার সুযোগ বয়স্কদের থাকলেও উল্টোটা ঘটত না। নাড়িয়াল বংশোদ্ভূতদের ‘নাড়া’ বলার অধিকার অনুজদের ছিল না। সামাজিক শিষ্টাচার মেনে গুরুজনদের উপযুক্ত সম্মান দেওয়ার প্রথা চালু ছিল।

শ্রীবাসের মুখে গোরার অবতারত্বের বিবরণ, সেই কাহিনীর অনুপুঙ্খের সমর্থনে হরিদাসের পাঠানো একাধিক বার্তা পেয়ে আনন্দে অদ্বৈতের শরীরে কাঁটা দিলেও তার ডাকে পৃথিবীতে কৃষ্ণাবতার হাজিরা দিতে পারে, সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মহাগুরু মধ্বাচার্য থেকে তার গুরু মাধবেন্দ্র পুরী, যখন কয়েক’শ বছর ধরে একই প্রার্থনা করে চলেছে, তখন তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে শান্তিপুরের অদ্বৈতের ডাকে লক্ষ্মীর কোলের অনন্ত শয়ান ছেড়ে ভগবান বিষ্ণু, শ্রীহরি, কৃষ্ণ নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে, গোরার অবয়বে অবতীর্ণ হয়েছে, এই রটনা মেনে নিতে অদ্বৈত সায় পেল না। গালগল্প ছড়াতে ভূভারতে গৌড়িয়ারা সকলের সেরা, অদ্বৈতের চেয়ে এই সত্য বেশি কে জানে? কামরূপ থেকে দ্বারকা পর্যন্ত, সব তীর্থ, যৌবনের নানা সময়ে সে দেখে এসেছে। নানা ভাষার কতরকম তীর্থযাত্রীর সঙ্গে পথ হেঁটেছে, কত বিভিন্ন সাধনধারার সন্ন্যাসীর সঙ্গ করেছে, হিসেব নেই। তাদের কেউ নিজেকে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে জাহির করা দূরের কথা, সর্বশক্তিধর স্রষ্টার বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের ধুলো ভাবতে সাহস পায়নি। গোরা সেখানে কোন সাহসে নিজেকে কৃষ্ণাবতার হিসেবে দাবি করার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে পারল? চতুর্ভুজ নারায়ণের বদলে সে আবার দু’হাতওলা বাঁশিবাদক কৃষ্ণের মহিমা প্রচার করছে। দ্বিভুজ কৃষ্ণকে জগার বেটা জোটালো কোত্থেকে? জগন্নাথ মিশ্রের এই ছেলেটা শিশুকাল থেকে ডানপিটে, গোঁয়ার। বয়স বাড়ার সঙ্গে উদ্ধত, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এ খবর অদ্বৈতের অজানা ছিল না। জগন্নাথ মিশ্র শুধু তার বন্ধু নয়, মিশ্র পরিবারের সে গুরু, শচী, জগন্নাথের দীক্ষাদাতা, মিশ্র পরিবারের কল্যাণার্থী। বিশ্বরূপের সংসার ছাড়ার ঘটনাতে যে তার অধ্যাপক, অদ্বৈতের প্ররোচনা রয়েছে, এমন সন্দেহ শচীর মাথায় গেড়ে বসলেও গুরুকে সে ত্যাগ করেনি। গুরুত্যাগ করা অশাস্ত্রীয়, পাপ কাজ। পাপের ভয়ে দীক্ষাদাতাকে শচী মেনে চললেও আড়ালে যে তার সম্পর্কে ঝাঁঝালো মন্তব্য করে বেড়াচ্ছে এ খবর অদ্বৈতের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। শচীর কটু কথার কিছু নমুনা অদ্বৈতকে তার এক-দু’জন ভক্ত শুনিয়ে গেছে। মৃত বন্ধু, জগন্নাথ মিশ্রের পরিবারের সঙ্গে শান্তিপুরের অদ্বৈতের সম্পর্ক কিছুটা আলগা হয়ে গেলেও জগন্নাথের বাড়ির নানা ক্রিয়াকর্ম, অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলে সে কখনও গরহাজির থাকত না। জগন্নাথ মিশ্রের পিণ্ড দিতে গয়ায় গোরার যাওয়ার আগে হরিদাসকে সঙ্গে নিয়ে নবদ্বীপে যজমানবাড়িতে অদ্বৈত পৌঁছে গিয়েছিল। গুরুর অনাদর করেনি শচী। গোরার শুভযাত্রা কামনা করে বৈদিক স্বস্তিবচন পাঠ করেছিল অদ্বৈত। গোরার সঙ্গে হরিদাসকে একদফা গয়াতীর্থ ঘুরিয়ে এনে শেষবারের মতো তাকে শোধন করে নেওয়ার বাসনা ছিল অদ্বৈতের মনে। জগন্নাথের ছেলেটা গোঁয়ার হলেও পরোপকারী। কারও দরকারে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গোরার সঙ্গে আলাপের পরে হরিদাস অভিভূত হলেও গয়ার পথে গোরার সঙ্গী হতে কেন সে বেঁকে বসল, অদ্বৈত বুঝতে পারেনি। হরিদাস পরে নিজে বলেছিল, আরও দশ কোটিবার হরিনাম জপ করলে, তবে তার তীর্থযাত্রার অধিকার বর্তাবে। তখন সে তীর্থভ্রমণে বেরোবে।

হরিদাসকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদেছিল অদ্বৈত। গোরার সঙ্গে নবদ্বীপে দেখা করতে এসে সেই হরিদাস, গুরু অদ্বৈতকে ছেড়ে সেখানে থেকে যাবে, অদ্বৈত ভাবতে পারেনি। হরিদাসের পাঠানো টুকরো-টাকরা খবর শুনে অদ্বৈতের মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে সেই স্বর্গের ঠিকানা হল নবদ্বীপ। প্রেমভক্তিতে ভেসে যাচ্ছে নবদ্বীপ ভক্তির উৎসমুখ, কৃষ্ণাবতার গোরা।

অদ্বৈতকে নবদ্বীপে যাওয়ার আমন্ত্রণ করতে এসে কিছুদিন আগে শ্রীবাস পণ্ডিত প্রায় এক-ই বৃত্তান্ত শুনিয়েছিল। তার আমন্ত্রণ গ্রহণের বদলে গোরাকে সঙ্গী করে শান্তিপুরে তাকে আমন্ত্রণ ভিক্ষা নিতে অদ্বৈত রাজি করিয়েছিল। গোরাকে নিয়ে শান্তিপুরে নিমন্ত্রণ রাখতে আসার দিনক্ষণ দু’বার পাকা করে নানা অজুহাতে শ্রীবাস তা বাতিল করেছে। গোরার ইচ্ছেতেই নিমন্ত্রণ খারিজ করেছে, অদ্বৈতের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তাকে গোরা উপেক্ষা করছে, অনুমান করে বয়স্ক মানুষটা মনে ব্যথা পেয়েছিল। তার ইজ্জতে ঘা লেগেছিল। নবদ্বীপের উদ্ধত ছোকরাটিকে মন থেকে সে যখন ঝেড়ে ফেলতে চাইছে, তখনই গোরা সম্পর্কে নানা লোমহর্ষক খবর পাঠাতে শুরু করল হরিদাস। মাসখানেক আগে শ্রীবাসের বিবরণ, যত হেলাফেলা করে অদ্বৈত শুনে থাকুক, হরিদাসের পাঠানো বার্তা তত সহজে সে উড়িয়ে দিতে পারল না। ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধের বুকের মধ্যে ভক্তির চোরা প্লাবন বইতে শুরু করল। স্বতোৎসারিত স্ফূর্তিতে মাঝে মাঝে মনে হতে থাকল, এখনই বোধহয় সে হুঁশ হারিয়ে ফেলবে। তার ভক্তির এত জোর সে জানত না। আত্মশক্তিতে ভরপুর হয়ে উঠতে থাকল তার মন। ঈশ্বরকে পৃথিবীতে টেনে আনার হুঙ্কার পাশবছর ধরে রোজ আকণ্ঠ গঙ্গার জলে ডুবে ছাড়লেও বাস্তবে তা ফলবে কিনা, এ নিয়ে তার নিজের মনে সন্দেহ ছিল। আলগা হচ্ছিল পায়ের নিচে বিশ্বাসের মাটি। জগন্নাথের ছোট ছেলেকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসেবে মানতে মন থেকে সে সায় পাচ্ছিল না। ভক্তিবাদে ডুবে থাকলেও সে নৈয়ায়িক, জ্ঞানমার্গী অধ্যাপক। অন্ধ বিশ্বাস, অন্ধ ভক্তি জ্ঞানমার্গের পথিকের ধাতে সয় না। জ্ঞান, যুক্তি অন্ধ নয়। জ্ঞানমার্গের পথিকের যে দশা হয়, অদ্বৈতের তাই ঘটেছিল। তুমুল স্ববিরোধিতায় ব্যবচ্ছিন্ন হচ্ছিল সে। আবেগ আর যুক্তির ক্রমাগত ঠোকাঠুকির ফয়সালা করতে পারছিল না। সে চাইছিল তার আমন্ত্রণ স্বীকার করে আগে শ্রীবাসের সঙ্গে গোরা একবার শান্তিপুরে আসুক, তখন বোঝা যাবে সে কত বড় কৃষ্ণাবতার। গোরা প্রকৃত অবতার হলে ভক্তের আকুলতা, তার অভিমান নিশ্চয় সে টের পাচ্ছে। ভক্তের বাঞ্ছা সে কি পূর্ণ করবে না?

অদ্বৈতের মনে অভিমান জমাট বাঁধছিল। তার ডাকে স্বর্গ ছেড়ে যে ঈশ্বর ধরাধামে অবতীর্ণ হতে পারে, নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুরে আসতে তার এত শৈথিল্য দেখানো উচিত নয়। ভক্তেরও সম্মান আছে। বিশেষ করে, মধ্বাচার্য প্রবর্তিত ভক্তিবাদের ধারায় তার মতো ভক্তের দেখা গত পাঁচশ বছরে ঘটেনি, কৃয়াবতারের তা অজানা নয়। ভক্ত অদ্বৈতের ডাকেই ভগবানের ঘুম ভেঙেছে। পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতে ঈশ্বর বাধ্য হয়েছে।

ভক্তি আর সংশয়ের ঘূর্ণিতে অদ্বৈত যখন পাক খাচ্ছে, গোরা তখন নবদ্বীপ ছেড়ে নড়ে বসার ফুরসৎ পাচ্ছিল না। তাকে ঘিরে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত জনসমাবেশ বাড়ছিল। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছিল নবদ্বীপে কৃষ্ণাবতার উদয়ের খবর। কৃষ্ণাবতার আর কেউ নয়, সকলের চেনা জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে গোরা, যার আর এক পরিচয়, নিমাই পণ্ডিত, জন্মপত্রিকাতে যার নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র। শ্রীবাসের বাড়ির উঠোন সঙ্কীর্তনের আসরে ভক্তদের দাঁড়ানোর জায়গা হচ্ছিল না। কৃয়াবতার গোরাকে একবার চোখে দেখতে বন্ধ সদর দরজার বাইরে ভিড় বাড়ছিল। গোরা অনুভব করছিল, স্থান, কাল, বয়সের সীমানা ভেঙে অনেক এগিয়ে গেছে সে। অস্তিত্ব, অনস্তিত্বের সংজ্ঞা থেকে ঘটনাচক্রে তার মুক্তি ঘটেছে। পায়ের নিচে মাটি, মাথার ওপর আকাশ, দুই প্রত্যন্তকে দু’মুঠোয় ধরে সে এখন ঝুমঝুমির মতো বাজাতে পারে। সঙ্কীর্তন শুনলেই সুরের আবেশে তার এই দশা হয়। সে আত্মপরিচয় গুলিয়ে ফেলে। সঙ্গীদের কথা অনুযায়ী সে ভাবাবিষ্ট হলে, তার শরীর থেকে আলো বেরোয়, সে ঈশ্বর হয়ে যায়। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বিশ্বচরাচর, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রমণ্ডলী। তার প্রতিটা কথা তখন দৈববাণী হয়ে যায়। তাকে দেখতে অন্তরীক্ষে দেবদেবীরা ভিড় করে। তার উঁই আবেশ নবদ্বীপে যারা দেখছিল, তাদের মুখে ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল, নবদ্বীপে ঈশ্বরের অবতীর্ণ হওয়ার কাহিনী। গয়া যাওয়ার কয়েকবছর আগে থেকে রামচন্দ্রপুরের মতো ব্রান্মণপল্লী থেকে সংলগ্ন নবশাক, ম্লেচ্ছ, শূদ্র এলাকায় সে যত নাট্যগীতের দল খুলেছিল, শ্রাবাসের বাড়ির সঙ্কীর্তনের সুর সেখানে পৌঁছে গেল। একটা তারার প্রদীপ থেকে জ্বলে উঠল কয়েক হাজার দীপের শিখা। নাট্যগীতের দল রূপান্তরিত হল সঙ্কীর্তনের আসরে। সম্মিলিত সঙ্কীর্তনের আওয়াজে নবদ্বীপ, কুলিয়া, গঙ্গার পশ্চিমে কাটোয়া পর্যন্ত মেতে উঠবে, গোরা ভাবেনি। প্রেমের সঙ্গে কৃষ্ণভক্তি মিশে ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সঙ্গীত সহস্রধারায় ছড়িয়ে পড়ল। কৃষ্ণ ব্যক্তিটি কে, না জেনেই ভক্তিতে তাকে আঁকড়ে ধরল অন্ত্যজ সমাজের মানুষ! আত্মপরিচয়ের খোঁজে কৃষ্ণকে বাপ বলে মেনে নিয়ে গোরা যেভাবে আতুর হয়ে উঠল, তা দেখে গোরাকেই তারা কৃষ্ণের আসনে বসিয়ে দিল। তারাই প্রচার করতে থাকল নবদ্বীপে স্বয়ং ভগবান জন্ম নিয়েছে। ভগবানকে যেন বহুবার নিজের চোখে দেখেছে, এভাবে গোরার রূপ-গুণের বর্ণনা করছিল তারা। ঘটনার এই এলোপাথাড়ি বিন্যাস গোরা খেয়াল করল না। কৃষ্ণকে বাপ হিসেবে মেনে নিলেও গোরার স্মৃতি থেকে কয়েকবছর আগে শ্রীহট্টের বুরহানউদ্দীন দরগার মুজাভির যে মরমিয়া ধর্মের আভাস দিয়েছিল, তা মুছে যায়নি। বরং সময়ের ব্যবধান বাড়ার সঙ্গে তার মনে উজ্জ্বলতর হয়েছে সেই সুফি সাধকের বাতিদানের আলো। মুজাভির বলেছিল, নির্বিশেষ মানুষের বিগলিত আনন্দপ্রবাহ হল ধর্ম। সবাইকে আল্লাহ্ রসুলের কৃপা প্রার্থনা করতে হবে, কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে পথ চলতে হবে।

গোরা অনুভব করল, মুজাভিরের নির্দেশিত ধর্মচর্চার সেই অস্পষ্ট সলতেতে নিজের অজান্তে সে আগুনের ফুলকি ছুঁড়ে দিয়েছে। মুজাভিরের উপদেশ, ঈশ্বরপুরীর মন্ত্র, বিশ্বরূপের পুঁথির রহস্যে ঘেরা দীপ্যমান আখ্যান মিলেমিশে গিয়ে তাকে নতুন কাঠামো, বহুমাত্রিক আত্মপরিচয় দিয়েছে। জীবনে সমুদ্র না দেখলেও জেগে, ঘুমিয়ে অনুভব করছে অতলান্ত সমুদ্রের গভীরতা, ব্যাপ্তি। সমুদ্র তাকে ডাকছে। জনজোয়ারে ভাসছিল সে। সাধারণ মানুষের ভিড়ে কৃষ্ণকে দেখতে পাচ্ছিল। তাদের কোলাহলের অনুরণনে শুনছিল সঙ্কীর্তনের সুর। নিজের মধ্যে কৃষ্ণের ছায়া দেখতে শুরু করেছিল। কৃষ্ণের কৃপা না হলে তার শরীর থেকে বিকীর্ণ আলো কীভাবে সকলে দেখতে পায়? গয়াতে মন্ত্রদাতা গুরু ঈশ্বরপুরীও তার শরীর জুড়ে আলোর ছটা দেখেছিল। পুরী গোঁসাই-এর দর্শন মিথ্যে হওয়ার নয়। নবদ্বীপে ফিরে তাকে অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে ঈশ্বরপুরী দেখা করতে বললেও শান্তিপুরে যেতে গোরার টালবাহানা করার কারণ ছিল। সে ভাবছিল, অদ্বৈতের প্রার্থনায় স্বর্গ থেকে ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার সময়ে পেলে, সেই অবতারের কাছে তার ভক্ত আসছে না কেন? গোরা জানত অদ্বৈত আসবে, তাকে আসতেই হবে। তার চেয়ে বাহান্নবছরের বড় সেই জ্ঞানবৃদ্ধের মাথায় পা রেখে সে আশীর্বাদ করবে। দৃশ্যটা ভেবে তার বুক কাঁপলেও, ভাবাবেশে থাকলে দেশ, কাল, বয়সের ব্যবধান কিছুই তার খেয়াল থাকে না। সে তখন নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে নয়, নবদ্বীপের বাসিন্দা হয়েও মহাপৃথিবীর সন্তান, মহাভারতের কর্ণের মতো রহস্যময় তার জন্মপরিচয়। তার শরীরের সব অঙ্গ, এমনকি দু’পা থেকে ক্ষরিত হচ্ছে দৈবী দ্যুতি। তার পায়ের ছোঁয়াতেই নবদ্বীপের শ্রীবাস, হরিদাস, মুরারি, গদাধর, জগদানন্দ, শুক্লাম্বরের মতো শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্যও চেতনা হারাবে। অদ্বৈত সামনে এসে দাঁড়ালে সেও বেহুঁশ হয়ে যেতে পারে। সম্ভবত তেমন ঘটবে না। শ্রীবাসের বাড়ির মন্দিরের চাতালে, সকালে ভাগবতপাঠ আর সন্ধেতে সঙ্কীর্তনের আসরে সে ভাবাবেশে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যায়। প্রেমভক্তিতে খাপছাড়া আচরণ করে, এলোমেলো কথা বলে। মৃদঙ্গ, মন্দিরা, খোল, করতালের সঙ্গে গানের সুর কানে ঢুকলেই তার এমন হয়। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রঙের আলোর কুচি চোখের সামনে উড়তে শুরু করে ক্রমশ একাকার হয়ে উজ্জ্বল আলোকশিখায় রূপান্তরিত হয়। তখন সে জ্ঞান হারায়, বেহুঁশ অবস্থাতে যা বলে, নিজেও মনে করতে পারে না। শান্তিপুর থেকে অদ্বৈত যখনই আসুক, সে দেখবে ভাবাবেশে রয়েছে গোরা, নবদ্বীপের ঈশ্বর। অবতার দেখার মানসিক প্রস্তুতি সেরেই সে নবদ্বীপে আসবে, অবতারের দর্শন পেলে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে, মাথায় পদযুগলের ছোঁয়াতে জ্ঞান হারাবে। হুঁশ ফিরলে পৃথিবীতে অবতার আনার আহ্লাদে খলখল করে হাসবে। তার পায়ে তখন গোরা প্রণত হলে অদ্বৈত চমকে যাবে। সন্দেহ জাগবে তার মনে। জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে গোরাকে অবতার ভেবে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার জন্যে লজ্জিত বোধ করবে। তবু জ্ঞানমার্গী এই বৈষ্ণব ভক্তের পৃথিবীতে অবতার আনার অহমিকা ঘুচবে না। নবদ্বীপে পরম বৈষ্ণব ভক্ত হিসেবে সকলের পূজ্য হয়ে উঠলেও শান্তিপুরে, নিজের বাড়িতে পৌঁছে জ্ঞানব্রতীর ভূমিকা নেবে। এটাই অদ্বৈতের স্বভাব। শাস্ত্রাধ্যয়নে তার জ্ঞান যত বেড়েছে, প্রায় সমপরিমাণ মূর্খতাও বেড়েছে। মহাপণ্ডিত অদ্বৈতের জ্ঞান আর নির্বুদ্ধিতার মধ্যে খুব বেশি এক চুলের তফাত। গোরার আশা অদ্বৈতের এই আত্মদ্বন্দ্ব ঘুচতে বেশি সময় লাগবে না।

নবদ্বীপে অদ্বৈত হাজিরা না দেওয়ায় তার সম্পর্কে গোরা যখন সাতপাঁচ ভেবে চলেছে, শান্তিপুরে তখন অদ্বৈতকে নিয়ে ধুন্দুমার কাণ্ড শুরু হয়েছিল। গোরাকে ঘিরে নবদ্বীপে ভিড় যত বাড়ছিল, তত রটছিল কৃষ্ণাবতারে নাটের গুরু শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্যের নাম। নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর এমন কিছু দূর নয়, খুব বেশি সাত ক্লোশ। নবদ্বীপে ভক্তদের ভিড়ের একাংশ শান্তিপুর থেকে এলেও ঘরে ফেরার সময়ে জনতা তিনগুণ হয়ে ফিরছিল। অদ্বৈত দর্শনে কৌতূহলী একঝাঁক ভক্ত শান্তিপুরের ভক্তদের সঙ্গী হচ্ছিল। শান্তিপুরের বাবলা গ্রামে অদ্বৈতের ভিটের সামনে ভিড় জমাচ্ছিল বৈষ্ণব ভক্তরা।

ঈশ্বরের অভিভাবকের আসনে অদ্বৈতকে বসিয়ে তার কৃপা চাইছিল, তার প্রসাদ ভিক্ষা করছিল। বাবলা গ্রামে অদ্বৈতের বাড়ির সামনে সমাজের নানা বর্গের ভিড় যত বাড়ছিল, তত অস্থির হচ্ছিল অদ্বৈত। খোল, করতাল, মৃদঙ্গ বাজিয়ে নবশাক, ম্লেচ্ছ, শূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ এত শৃঙ্খলার সঙ্গে সমবেত গলায় কীর্তন করতে পারে, অদ্বৈতের ধারণা ছিল না। অদ্বৈতের কানে গোরার প্রথম কীর্তন, ‘সারঙ্গধর তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে’, এই ধুয়ো পৌঁছতে নবদ্বীপে রওনা হওয়ার জন্যে সে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। কখনও শুনছিল,

‘হরি বোল মুগধা গোবিন্দা বোল রে
যাহা হৈতে নাহি হয় শমন ভয় রে।’

হাজারবছর ধরে ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষকে এই বাণী, সুর নিদারুণ সাহসী করে তুলবে, তাদের মন থেকে মৃত্যুভয় মুছে দেবে, অদ্বৈত অনুভব করছিল। মৃত্যুভয় কেটে গেলে মানুষের হারানোর কিছু থাকে না। সাধুসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে তখন সে জীবন দিতে পারে। চাই সঙ্গীত, চাই সংঘ, বৈষ্ণবসমাজে এর নাম বোলচাল। যথার্থ বোলচাল দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায়। গোরার অনুগামীদের কীর্তন শুনে কল্পান্তের সংকেত পেল অদ্বৈত। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল, যার অবতীর্ণ হওয়ার প্রত্যাশায় এতবছর মাথা ঠুকে সে কেঁদেছে, নবদ্বীপে বোধহয় সে বাস্তবিক এসে গেছে। সে কৃষ্ণাবতার, স্বয়ং ঈশ্বর। সে পরীক্ষা করছে ভক্ত আহ্বানকর্তা, অদ্বৈতকে। ভক্তের অস্মিতাকে কৌতুক করতে সে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে নবদ্বীপে। দূরত্ব তৈরি করে মজা দেখার সঙ্গে প্রেমের জোয়ারে ভক্তকে ভাসিয়ে দিতে চাইছে। অদ্বৈতের বাড়ির সামনে ভক্তদের পাঠিয়ে দিয়ে কীর্তনের লহর তুলেছে। কৃষ্ণাবতারের কারণ, অদ্বৈতের মহিমা নবদ্বীপ থেকে স্বয়ং ঈশ্বর প্রচার না করলে শান্তিপুরে ভক্তদের এত ভিড় হত না। বাবলা গ্রামে, বাড়ির সামনে নাচ, গানে মাতোয়ারা গোরার ভক্তকীর্তনীয়াদের দেখে অদ্বৈতের মনে হচ্ছিল, তারা অন্য মানুষ হয়ে গেছে। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাক সম্প্রদায়ের মিলনে যেন নতুন জনগোষ্ঠী জন্ম নিয়েছে। তাদের হাবভাব, চালচলনের সঙ্গে রগচটা, দুর্বিনীত, দুর্মুখ গৌড়িয়াদের কোনও মিল নেই, শিক্ষাদীক্ষাহীন গ্রাম, অসভ্য, রূঢ়, কর্কশ মেজাজের মানুষগুলো হঠাৎ কোন জাদুমন্ত্রে এই অল্প সময়ে এত বিনয়ী, ভদ্র, সহিষু হয়ে উঠল? অদ্বৈতকে দেখে শ্রদ্ধায় তারা যেমন মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল, তেমনি ধর্মবর্ণ জাতপাত নির্বিশেষে একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরছিল, কখনও দু’হাত জুড়ে, কখনও পা ছুঁয়ে প্রণাম করছিল। জ্ঞানব্রতীর অহমিকা আর ভাগবদবেত্তায় ধর্মীয় আবেগের টানাপোড়েনে উন্মত্তের মতো অদ্বৈতকে আচরণ করতে দেখে, তাকে নবদ্বীপে নিয়ে গিয়ে ধাতস্থ করতে চাইল সহধর্মিণী সীতা দেবী। মায়ের ইচ্ছেতে বড় আর মেজো ছেলে অচ্যুতানন্দ, কৃষ্ণ সায় দিলেও সেজো আর ছোট ছেলে বলরাম, জগদীশ আড়ালে গাঁইগুঁই করতে থাকল। তারা আবার গোরাকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয়। তারা বিশ্বাস করত, তাদের জন্মদাতা, বাবা অদ্বৈত আচার্যই স্বয়ং ঈশ্বর। অদ্বৈতের কাছে গোরাকে আসতে হবে। তারা যাই ভাবুক, নবদ্বীপে অদ্বৈতের যাওয়ার ইচ্ছে ঠেকানোর সাহস তাদের ছিল না। বাবাকে যারা ঈশ্বর হিসেবে মেনে নিয়েছে, সেই ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াবে কীভাবে?

শান্তিপুরের ভক্তদের কাছ থেকে নবদ্বীপে সস্ত্রীক অদ্বৈতের আসার তারিখ জেনে গেলেও তাকে অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজন গোরা করল না। গোরা টের পেয়েছিল অদ্বৈত নবদ্বীপে আসছে, তাকে পরীক্ষা করতে। নিজের কৃষ্ণভক্তির গভীরতাকেও অদ্বৈত সম্ভবত মাপতে চায়। শ্রীবাসের আঙিনায় সঙ্কীর্তনের আসরে সরাসরি না এসে, তার বাড়ির বিষ্ণুমন্দিরে দুপুরের পারিবারিক নিত্য পূজার্চনার সময়ে হাজির হতে বেশি পছন্দ করবে। সহধর্মিণীকে নিয়ে দরজা বন্ধ পাল্কি চেপে, সকলের নজর এড়িয়ে সে সোজা নন্দন আচার্যের বাড়িতে পৌঁছে যাবে। অদ্বৈত আচার্যের মতো নবদ্বীপের নন্দ আচার্যও শ্রীহট্টের নাড়িয়ালগাঁই-এর মানুষ। দু’জনের মধ্যে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে বেশি রয়েছে পারস্পরিক বন্ধুতা। সস্ত্রীক নবদ্বীপে এলে নন্দন আচার্যের বাড়িতে অতিথি হয়ে, গৃহস্বামীর একান্ত অনুরোধে, কখনও রাতটাও তার আশ্রয়ে কাটিয়ে দেয়। তবে সেরকম ঘটতে খুব বেশি গোরা দেখেনি। নবদ্বীপে অদ্বৈতের মন্ত্রশিষ্য কম নেই। গোরার জন্মের আগে তার বাবা জগন্নাথ মিশ্র, মা শচীকে চতুরাক্ষর গৌরগোপাল মন্ত্রে অদ্বৈত দীক্ষা দিয়েছিল। ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী গুরুমন্ত্রে দীক্ষিত স্ত্রী, পুরুষকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালনের বিধিনিয়ম মেনে চলতে হয়। তাদের আর ছেলেমেয়ে হওয়ার কথা নয়। শ্রীহট্ট থেকে শচীর সন্তানসম্ভবা হয়ে ফেরার খবর পেয়ে অদ্বৈত রুষ্ট হলেও জগন্নাথের ওপর চটেনি। গুরুমন্ত্র লঙ্ঘনজনিত অপরাধের পুরো দায় চেপেছিল শচীর ঘাড়ে। বেশ কিছুদিন তার মুখদর্শন করেনি অদ্বৈত। গুরুর হাতে পায়ে ধরে তাকে সন্তুষ্ট করেছিল জগন্নাথ। অদ্বৈত নরম হয়েছিল। প্রিয় ছাত্র, বিশ্বরূপকে নিজে চতুষ্পাঠীতে ঢোকার অনুমতি দিয়েছিল। সংসার ছেড়ে বিশ্বরূপ চলে যাওয়ার পরে জগন্নাথ আর শচী যত ভেঙে পড়েছিল, তেমনি অদ্বৈতও কম শোকাচ্ছন্ন হয়নি। সংসারত্যাগী ছেলের জন্যে দুর্ভাবনায় শয্যাশায়ী মুমূর্ষু জগন্নাথের সঙ্গে কাতর শচীকে সান্ত্বনা দিতে তাদের বাড়িতে এসেছিল অদ্বৈত। অদ্বৈতকে সন্তানহারা শচী প্ৰণাম করলেও গুরুর মুখের দিকে তাকায়নি। বিশ্বরূপকে সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নেওয়ার জন্যে অদ্বৈত ফুঁসলেছে, শচীর মনে এ ধারণা ঢুকে গিয়েছিল। আতিথ্যভিক্ষাকারী গুরুকে নিজের বাড়িতে ষোড়শোপচারে সেবা করা দূরে থাকুক, তাকে শচী উপেক্ষা করেছিল।

পুরনো এসব কাহিনী গোরার জানা থাকলেও, ফেলে আসা জীবনটাকে তার মনে হচ্ছিল গত জন্মের বৃত্তান্ত। অস্পষ্ট স্মৃতির মতো সেই ঘটনা মনে পড়লেও বর্তমান জীবনের সঙ্গে তার কোনও সংশ্রব নেই। তার মা, তার গর্ভধারিণী শচী ছাড়া আর কারও এই নতুন জীবনে তার সঙ্গে জন্মান্তর ঘটেনি। সহধর্মিণী বিষ্ণুপ্রিয়া, দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তী আর ঠাকুর্দা উপেন্দ্র মিশ্রের পরিবারের যত আত্মীয় পরিজন, বন্ধু, পড়শি রয়েছে, সবাই তার আপনজন হলেও সম্পর্কের সুতোয় কারও সঙ্গে তার বন্ধন নেই। বিশ্বরূপের পুঁথি পড়ে সে জেনেছে, সে এক নিঃসঙ্গ মানুষ তার কোনও পার্থিব উৎস নেই, মোহনা নেই। পৃথিবীর মাটি থেকে আকাশের নক্ষত্রলোক পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে তার বিচরণভূমি। ভাবাবিষ্ট হওয়ার আগে আর পরে, বিশেষ করে বিষ্ণুপ্রিয়ার সামনে এলে তার প্রায়ই মনে হয়, বড় ছেলে বিশ্বরূপের লেখা পুঁথিটা জগন্নাথ মিশ্র পুড়িয়ে ফেললে তার ছোট ছেলেটা হয়তো বেঁচে যেত। আরও ভালো হত, তাকে আকাট মূর্খ করে রাখতে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলের সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার কাজে জগন্নাথ সফল হলে, বিশ্বরূপের পুঁথি ইহজীবনে সে পড়ে উঠতে পারত না। তা হয়নি, গঙ্গাদাসের টোলে তার যাওয়া বন্ধ করে দিতে সেই শিশুবয়সে সে যে শূদ্র, ম্লেচ্ছপাড়ায় যাতায়াত শুরু করবে, আচার আচরণে ক্রমশ ইতর হয়ে উঠবে, জগন্নাথ ভাবতে পারেনি। আত্মীয়, প্রতিবেশি, বিশেষ করে শচীর চাপে গোরাকে ফের গঙ্গাদাসের টোলে পাঠাতে জগন্নাথ বাধ্য হয়েছিল। গোরাকে লেখাপড়া শেখাতে জগন্নাথের ঘোর অনিচ্ছার কারণ, বিশ্বরূপের পুঁথি পড়ে গোরা টের পেয়েছিল। তাকে ব্রাক্ষ্মণসন্তান হিসেবে নিজের জীবদ্দশায় জগন্নাথ মেনে নিতে পারেনি। বিশ্বরূপের হাতের আগুন পাওয়ার জন্যে মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত জগন্নাথ হাহাকার করেছিল।

বেলা গড়ানোর আগে শ্রীবাসের বাড়ির বিষ্ণুমন্দিরে গোরা পৌঁছে গিয়ে ভগবান বিষ্ণুর জন্যে তৈরি শয্যায় বসেছিল। শ্রীবাসের আঙিনায় গোরাকে দেখতে শুরু হয়েছিল ভক্তের ভিড়। মল্লার রাগে বাসু ঘোষ আর দোহাররা সঙ্কীর্তন শুরু করতে ভাবাবিষ্ট হচ্ছিল গোরা। তার স্নায়ু, শিরা, রক্তস্রোতের মধ্যে দিয়ে গানের সুর মগজে পৌঁছে যেতে পুরনো স্মৃতিচারণ থেকে নতুন আত্মপরিচয়ে সে জেগে উঠছিল। সকালের সেবার জন্যে বিষ্ণুমূর্তি তখন খাটের ওপর থেকে ঘরের আর এক পাশে বেদির ওপর রাখা হয়েছে। রোজই তাই হয়। দুপুর পর্যন্ত ষোড়শোপচারে পূজার পর দিবানিদ্রার জন্যে বেদি থেকে বিষ্ণুকে তুলে আবার খাটের ওপরে তার শয্যায় শুইয়ে দেওয়া হয়। মাসে কয়েকটা দিন বাদ দিয়ে বিষ্ণুসেবার পুরো দায়িত্ব পালন করে শ্রীবাসের বিধবা তরুণী ভাইঝি নারায়ণী। ইষ্টদেবতার পূজার্চনা নিখুঁত করার কাজ তদারক করে শ্রীবাসের বউ মালিনী। ভগবান বিষ্ণুর বিছানায় বসে গোরা ক্রমশ ভাবাবিষ্ট হচ্ছিল। নিজের ছেলেবেলা, তরুণ বয়স, সংসার, পারিবারিক পরিচয়, অতীতের সব ঘটনা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। নন্দন আচার্যের বাড়ি থেকে অদ্বৈত আচার্যকে আনতে একটু আগে শ্রীবাসের ছোটভাই শ্রীরাম, যাকে আত্মীয় বন্ধুরা রামাই নামে ডাকে, তাকে পাঠিয়েছে, শুধু এইটুকুই গোরা মনে করতে পারছিল। শ্রীবাসের ধারণা ছিল, গোরার সঙ্গে দেখা করতে সোজা তার বাড়িতে অদ্বৈত আসবে। গোরাকে সেকথা বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল। মুখ খুলতে সাহস পায়নি। গোরাকে সে বৃাবতার হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। প্রতিদিন বাড়ছিল তার বিশ্বাস। গোরার প্রতিটা কথা ফলে যায়, মিলে যায় সত্যের সঙ্গে। সত্য যে এত সহজ, সরল, এত সুন্দর গোরার পাশাপাশি না থাকলে শ্রীবাস অনুভব করতে পারত না। গোরাকে দেখলে, তার কথা শুনলে বিহ্বল শ্রীবাসের দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। তবু নন্দন আচার্যের বাড়ি থেকে অদ্বৈত আচার্যকে আনতে রামাই রওয়ানা হওয়ার আগে তাকে শ্রীবাস জানিয়েছিল, সেখান থেকে ছোটভাইকে একা ফিরতে হবে। শ্রীবাস বলেছিল, আমার কাছে খবর আছে, শান্তিপুর থেকে অদ্বৈত আচার্য এখনও রওনা দেননি। শান্তিপুর থেকে আচার্যদেব নবদ্বীপে এলে প্রথমে আমাদের বাড়িতে পদধূলি দেন। এটাই প্রথা। এবারেও তাই ঘটবে।

ভাই-এর সঙ্গে বসতবাড়ির দাওয়ায় শ্রীবাসের কথোপকথন শুনে তামার তৈরি চন্দনের একটা ছোট বাটি হাতে নিতাই মুচকি হাসল। নিতাই-এর হাসি, শ্রীবাসের চোখ এড়াল না। ঘরের ভেতর থেকে তখন ভেসে আসছিল মালিনীর কান্নার আওয়াজ, যন্ত্রণা কাতরাচ্ছিল সে। খিল আটকানো ঘরের কপাট। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে মায়া মমতায় ছলছল করছিল নিতাই-এর দু’চোখ। মালিনীর শারীরিক যন্ত্রণার কারণ তার অজানা নয়। যন্ত্রণা উপশমের ব্যবস্থাও সে করতে পারে। মায়ের কষ্ট কোনও ছেলে দিনের পর দিন দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারে না। শ্রীবাসের আশ্রয়ে গত কয়েক মাসে সে শুধু পরিবারের একজন হয়ে যায়নি, সংসারের কর্ত্রী মালিনীকে মা মেনেছিল। গোরার মা শচীর মতো মালিনীও তার আর এক মা। দুই মাকে দেখলে তার যেমন নিজেকে শিশু মনে হয়, তেমনি তাকে দেখে শচী, মালিনীর হৃদয়ে সন্তানস্নেহ উথলে ওঠে। মালিনীর শরীরের যন্ত্রণা লাঘব করতে তার ঘরের বন্ধ কপাটে নিতাই যখন টোকা দিল, দাওয়ায় তখন শ্রীবাস, রামাই দু’ভাই-এর কেউ নেই। অদ্বৈতকে আনতে রামাই চলে যেতে গোরার কাছে ফিরে গেছে শ্রীবাস।

নন্দন আচার্যের বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাঁদিকের দাওয়ায় গৃহকর্তার মুখোমুখি অদ্বৈত আচার্যকে দেখে রামাই চমকে গেল। দাদা শ্রীবাসের মতো রামাই-ও বিশ্বাস করত, নন্দন আচার্যের সঙ্গে অদ্বৈতের পারিবারিক সম্পর্ক থাকলেও নবদ্বীপে এলে শ্রীবাসের বাড়িতে উঁকি না দিয়ে সে অন্য কোথাও যাবে না। কদাপি রাত কাটাতে হলে শ্রীবাসের আস্তানা অদ্বৈতের প্রথম পছন্দ। সেটাই স্বাভাবিক। শান্তিপুরে বৈষ্ণবসমাজে অদ্বৈত যেমন শিরোমণি, তেমনি নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের মুখ শ্রীবাস পণ্ডিত। পাশাপাশি দুই এলাকার দুটো বৈষ্ণব ঘাঁটি আগলে বসে রয়েছে অদ্বৈত আর শ্রীবাস। গৌড় বাঙ্গালার পণ্ডিতকুলের কাছে এই দু’টি মানুষের সৌহার্দ্যের কাহিনী অজানা নয়। অদ্বৈতকে নন্দনের বাড়ির দাওয়ায় দেখে রামাই ভ্যাবাচাকা খেলেও মুখে কিছু না বলে আচার্যযুগলের সামনে এসে সাষ্টাঙ্গে তাদের প্রণাম করল। রামাই-এর আসার কারণ আঁচ করে অদ্বৈতের বুকের মধ্যে খুশির ঝড় উঠলেও বিকারহীন মুখে সে তাকাল নন্দনের দিকে। রামাইকে তার আসার হেতু নন্দন জিজ্ঞেস করতে সে বলল, গুরু অদ্বৈত আচার্যকে নিয়ে যেতে আমাকে তিনি পাঠালেন।

বাঁকা গলায় অদ্বৈত প্রশ্ন করল, তিনিটা আবার কে?

আমতা আমতা করে রামাই বলল, মহাপ্রভু!

সর্বনাশ! গুরু নয়, প্রভু নয়, মহাপ্রভু! তা মহাপ্রভুটির নাম কি? তিনি এলেন কোথা থেকে? অদ্বৈতের প্রশ্ন করার ধরনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল নন্দন। গোরা যে যাবতীয় তাচ্ছিল্যের অনেক ঊর্ধ্বে, নন্দন জেনে গিয়েছিল। মাথায় হাঁটুর বয়সি গোরার পায়ের স্পর্শ পেলে ধন্য মনে করত নিজেকে। অদ্বৈতের কথা বলার ভঙ্গিতে শ্লেষ মিশে থাকলেও আবেগে তার আত্মহারা হওয়ার দশা হল। দাওয়ার পাশের ঘর থেকে অদ্বৈতের বউ সীতাদেবী তখন সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। শ্রীবাসের ভাই রামাইকে সীতাদেবী বিলক্ষণ চেনে। অদ্বৈত কিছু বলার আগে তাকে সীতাদেবী বলল, দেখো, তুমি যা চেয়েছিলে, তাই ঘটল। নন্দন আচার্যের বাড়িতে তুমি লুকিয়ে থাকলেও যার জানার কথা, তিনি জেনে গেছেন। ঈশ্বরের অবতারকে পরীক্ষা করতে গিয়ে তার কাছে তুমি ধরা পড়ে গেছ!

নন্দন আচার্যের মুখের ওপর দু’চোখ রেখে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আনন্দে অট্টহাসি হাসছিল অদ্বৈত। হাসির দমকে জলে ভরে উঠছিল দু’চোখ। হাসির তোড় কমলে সীতাদেবীর দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল অদ্বৈত। তার শরীর কাঁপছিল, টলমল করছিল দু’পা। বৃদ্ধ মানুষটাকে আগলাতে তার গা ঘেঁষে নন্দন দাঁড়াতে অন্য পাশে রামাই দাঁড়িয়ে গেল। নবদ্বীপে এসে বুড়ো মানুষটা বেঘোরে মরলে গোরার অপবাদের শেষ থাকবে না। শরীর কাঁপলে ও মানুষটা সামলে নিল নিজেকে। আচম্বিতে বেচাল হওয়ার জন্যে সামান্য লজ্জিত বোধ করল। শ্রীবাসের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে অল্পসময়ে তৈরি হয়ে নিল অদ্বৈত, সীতাদেবী। নন্দন আচার্যও সঙ্গী হল তাদের। নন্দনের বাড়িতে আগের দিন সন্ধের পরে হাজির হয়েছিল অদ্বৈত। নবদ্বীপের মানুষের নজর এড়াতে শেষ বিকেলে শান্তিপুর থেকে পাল্কিতে উঠে পাল্কির দরজা সেই যে বন্ধ করেছিল, নন্দনের বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছনোর আগে তা খোলেনি। কাকপক্ষিকে জানতে দেয়নি তাদের নবদ্বীপে আসার খবর। হরিদাসকেও জানায়নি। গোরার টানে নন্দন আচার্যের বাড়ি ছেড়ে ঠাকুর হরিদাস শ্রীবাসের বারবাড়ির অদূরে ঝুপড়ি বানিয়ে সেখানে বাস করছে, এ খবর অদ্বৈতের কানে গিয়েছিল। হরিদাসের সঙ্গে সেখানে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। নন্দনও জানত না তার বাড়িতে অদ্বৈতের আসার অভিপ্রায়, সদর দরজায় রাতের শুরুতে সস্ত্রীক তাকে আচমকা দেখে নন্দন অবাক হয়েছিল। আনন্দও কম হয়নি। পিতৃপ্রতিম, পরমভাগবত শান্তিপুরের অদ্বৈত যে তার বাড়িতে এক রাতের আতিথ্য ভিক্ষা করবে, সে কল্পনা করতে পারেনি। যার ডাকে স্বর্গ ছেড়ে ঈশ্বরকে পৃথিবীতে নেমে আসতে হয়, তাকে অতিথি হিসেবে নিজের ভদ্রাসনে পাওয়া কম সৌভাগ্য নয়। তার শরীরে রোমাঞ্চ জাগল। জল এসে গেল দু’চোখে। হাউহাউ করে কেঁদে উঠে, তখনই কান্নার দমক সামলে, অতিথিকে পাদ্যার্ঘ্য দিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত শুনিয়েছিল গোরার অসংখ্যা ভাবসমাধির কাহিনী। অদ্বৈতের মতো অতিথিকে আপ্যায়ন করতে গেল রাতে শ্রীবাসের বাড়িতে সঙ্কীর্তনের আসরে নন্দন যেতে পারেনি। অদ্বৈত আচার্যের সান্নিধ্যে প্রাণের মধ্যে গভীর আরাম পেয়েছিল। শ্রীবাসের বাড়িতে যাওয়ার পথে অদ্বৈতের বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করছিল। দূরত্ব যত কমছিল, তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। হাঁপ ধরার সঙ্গে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস পড়ছিল। ঝাপসা দেখছিল চোখে, মনে হচ্ছিল যে কোনও মুহূর্তে বেহুঁশ হয়ে রাস্তায় পড়ে যাবে। স্বামীর বিভোর অবস্থা টের পেয়ে গলা পর্যন্ত ঘোমটা টেনেও অদ্বৈতের বাঁ হাতটা চেপে ধরে থাকল সীতাদেবী। স্ত্রীর গায়ের ওপর থেকে থেকে ঢলে পড়ছিল অদ্বৈত। সম্বিত পেতে মনে প্রশ্ন জাগছিল, গোরার সামনে গিয়ে কীভাবে দাঁড়াবে, কী বলবে তাকে? গোরাই বা তাকে কী সম্ভাষণ করবে? পথ শেষ হল। শ্রীবাসের বাড়িতে ঢুকে রামাই-এর হাত ধরে বিষ্ণুমন্দিরের সিঁড়ি ভেঙে দাওয়ায় উঠে চলচ্ছক্তিহীন অদ্বৈত ঘরে ঢোকার আগে ফের টলমল করতে থাকল। অদ্বৈতকে দেখে ঘরের দরজা ছেড়ে বাড়ির মেয়ে-বউরা সরে দাঁড়িয়েছে। শ্রীবাস, গদাধর, মুরারি, মুকুন্দ সারি দিয়ে পরপর প্রণাম করল অদ্বৈতকে। দরজার মুখে কুয়াশার মতো উড়ছে ধুনোর ধোঁয়া। অদ্বৈতকে দেখে আহ্লাদে সঙ্কীর্তনের গায়করা আরও সুরেলা হয়েছে, সপ্তমে পৌঁছে গেছে কীর্তনের লহর। অর্ধচেতন, বিমোহিত অদ্বৈত ঘরে ঢুকে ভগবান বিষ্ণুর রাতের শয্যায় দু’পা ঝুলিয়ে বসে থাকা গোরাকে দেখে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। অদ্বৈত দেখল বিষ্ণুখট্টায় বিছানার ওপর সূর্যের মতো দেদীপ্যমান বসে রয়েছে ঈশ্বর। হ্যাঁ, ঈশ্বর ছাড়া সে কেউ নয়। অদ্বৈতের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে সেই জ্যোতির্ময় পরমপুরুষ প্রসন্ন হাসি ছড়িয়ে বরাভয় দিচ্ছে। বিষ্ণুখট্টায় সমাসীন সেই মূর্তি থেকে বিচ্ছুরিত আলো, ঘরে যারা বসে রয়েছে তাদের দেহ থেকেও বিকীর্ণ হচ্ছে। ঘরের মধ্যে একঝাঁক ভক্তের সঙ্গে আরও অনেক দেবতা, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগের মহর্ষি, সাধু, যোগীদেরও অদ্বৈত দেখতে পাচ্ছিল। গোরার রূপের এই ঐশ্বর্য দেখে অদ্বৈতের মনে প্রশ্ন জাগল, খুব বেশি দু’দশক আগে ধুলোমাটি মাখা যে উলঙ্গ শিশুকে সে দেখেছে, সেই শিশু কীভাবে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী মহিমামণ্ডিত ঈশ্বরে রূপান্তরিত হল? অদ্বৈত অনুভব করল, এই রূপেই অবতারকে সে দেখতে চেয়েছিল। তার বাঞ্ছা পূরণ করতে ঈশ্বর ষড়ৈশ্বর্য ছড়িয়ে বসে আছে। ঈশ্বরের এই ঐশ্বর্যমণ্ডিত রূপ বেশিক্ষণ দেখার লালসা অদ্বৈতের ছিল না। সে টের পেল ঐশ্বর্যের আড়াল ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করছে পরম সুন্দর, নবীন এক পুরুষ। তার মুখে অনুরাগ জড়ানো মধুর হাসি। কৃষ্ণাবতারের এই চেনা রূপ দেখার জন্যে যে হৃদয় ব্যাকুল হয়েছিল, অদ্বৈত অনুভব করল। সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। আভূমি লুটিয়ে গোরার পায়ে মাথা ঠেকাতে তার মাথার ওপর সন্তর্পণে গোরা পা রাখল। অদ্বৈতের শরীর জুড়ে বসন্ত ঋতুর বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে জ্ঞান হারাল। তার পাশে গোরার পায়ের স্পর্শ বাঁচিয়ে সাষ্টাঙ্গে গড় হয়ে লুটিয়ে ছিল স্ত্রী, সীতাদেবী। জগন্নাথ মিশ্রের দুরন্ত ছেলেটা যে ছদ্মবেশী ভগবান, এ নিয়ে তার সন্দেহ ছিল না। ভাবসমাধিস্থ গুরু অদ্বৈতের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল তার শিষ্য ঠাকুর হরিদাস। আশপাশে নিতাইকে না দেখে, শ্রীবাস নিজেই অচেতন অদ্বৈতের কানের কাছে মুখ নিয়ে ভাগবতের শ্লোক গুনগুন করে জপ করতে বৃদ্ধ মানুষটা জেগে গেল। জ্ঞান ফিরতে দিশেহারার মতো প্রথমে শ্রীবাস, তারপর চেনাজানাদের দিকে তাকিয়ে অদ্বৈত ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তখনই বিষ্ণুখট্টা থেকে নেমে অদ্বৈতের পায়ে প্রণত হল গোরা। অদ্বৈত ভয় পেয়ে দু’পা পেছিয়ে গেলেও গোরার আজানুলম্বা দু’হাতের স্পর্শ এড়াতে পারল না। অদ্বৈতের অস্বস্তি হচ্ছিল, সন্দেহ জাগছিল মনে। ঈশ্বর কি কখনও ভক্তের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে? গোরাকে ঈশ্বরের অবতার ভেবে সকলের সামনে প্রণাম করা বোধহয় ছেলেমানুষী হয়ে গেল। পায়ের ওপর থেকে দু’হাতে গোরাকে ধরে দাঁড় করিয়ে অদ্বৈত দেখল, সামনে অনিন্দ্যসুন্দর মানুষটা জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে বিশ্বম্ভর ছাড়া কেউ নয়। অর্ধশিক্ষিত, অপোগণ্ড জগন্নাথের ছেলেকে ঈশ্বর ভেবে প্রণাম করে বেহুঁশ হওয়ার ঘটনাতে অদ্বৈত লজ্জা পেল। তখনই ঘরে ঢুকল নিতাই। খুশিতে উজ্জ্বল তার মুখ। গোরাকে বিমুখট্টায় বসিয়ে সে প্রণাম করতে গোরার ভাবসমাধি ঘটল। তার চাউনি বদলে গেল। লালাভ সোনার মতো দ্যুতিসম্পন্ন হয়ে উঠল তার শরীর। সারা দেহ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকল। সাপুড়ের বাঁশির সুরে তার ঝাঁপি থেকে যেভাবে ফণা উঁচু করে সাপ খাড়া হয়ে যায়, কীর্তনের সুরে তেমনই ভাবাচ্ছন্ন গোরা দাঁড়িয়ে নাচ শুরু করল। বিলম্বিত লয়ে পা ফেলতে শুরু করে ক্রমশ উদ্দণ্ড হল তার নাচ। নন্দির প্রাঙ্গণে তুমুল সঙ্কীর্তন চলছে। সমাধিস্থ গোরা নাচতে শুরু করতে তাকে ঘিরে নিতাই, গদাধর, মুকুন্দ, মুরারি একটা বৃত্ত রচনা করে ফেলল। নাটের আবেশে ঘরের মেঝেতে গোরার পড়ে যাওয়া ঠেকাতে এই সতর্কতা। নৃত্যরত গোরার দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরে গেল অদ্বৈতের। সে আবার দেখল ঈশ্বরের রূপের ঐশ্বর্য, তার নাচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পৃথিবী, আকাশ, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, জন্মমৃত্যু, মহাকাল নেচে চলেছে। দু’হাত আকাশের দিকে তুলে অদ্বৈতও নাচতে শুরু করল, সঙ্কীর্তনে গলা মেলাল। নিজের প্রার্থিত অবতারের সঙ্গে বৃদ্ধ অদ্বৈতের উন্মত্ত নাচন দেখতে ঘরের দরজায় ভিড় জমে গেল। ভাবাবিষ্ট গোরার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুবকের মতো নাচলেও অদ্বৈত তখনও নিতাইকে দেখেনি। গোরার সঙ্গে অদ্বৈতকে নাচতে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল শ্রীবাস। গত কয়েকমাস ধরে এই দৃশ্যটা দেখার অপেক্ষায় সে দিন গুনছিল। সঙ্কীর্তন মণ্ডলীতে নাচের মধ্যে অদ্বৈত ফের বেহুঁশ হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *