গোরা – ৪৫

৪৫

বিদ্যাধরের হিসেব মিলে গেল। আকাশভাঙা মেঘ, বৃষ্টি, ঝড় নিয়ে এসে গেল চৈতন্য নিধনের নির্ধারিত শ্রাবণের কৃস্নাপঞ্চমীর রাত। সমুদ্র ফুঁসছিল। দৈত্যের মতো জলস্তম্ভ এসে ভেঙে পড়ছিল বালিয়াড়িতে। এই দুর্যোগেও ধীবর সম্প্রদায়ের যারা মাছ ধরতে নৌকো নিয়ে আগের রাতে তীর ছেড়ে অনেক দূরে, যেখানে সমুদ্র কিছুটা শান্ত, চলে গেছে তাদের ক’জন ঘরে ফিরতে পারবে কেউ জানে না। তাদের বৌ-ছেলে-মেয়ে দঙ্গল বেঁধে তুমুল বৃষ্টি মাথায় করে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে ভিজে চলেছে। মাথা বাঁচাতে হোগলার টুপি পরেছে কয়েকজন। ঝড়ে টুপি সামলাতে নাজেহাল হচ্ছে তারা। চৈতন্যহত্যার চক্রান্তকারীরা যা চেয়েছিল, সেভাবে এল শ্রাবণের কৃস্নাপঞ্চমীর রাত। দুর্যোগ চলল সারাদিন, ঝড় বৃষ্টি কামাই নেই। শেষ বিকেলের আগে অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। বালিয়াড়ির ঝাউবনে ভূতুড়ে হাওয়ার দাপাদাপিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে কয়েকটা ঝাউগাছ। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নামছে পুরুষোত্তমপুরে। ঘরদোর ছেড়ে মানুষ বেরতে পারছে না। পথে কুকুর, বেড়াল পর্যন্ত নেই। সমুদ্রে ধারে যেখানে মাছের খোঁজে সকাল থেকে সন্ধে কাকের দল কা কা করে ডেকে উড়তে থাকে, সেখানে একটা কাক নেই। অন্ধকার নামলে ঝাউগাছের ডাল থেকে ডালে পাখার ঝাপট তুলে যে পেঁচাগুলো ওড়াওড়ি করে, তারা নিঃশব্দ। গম্ভীরায় নিজের ঘরে বসে গোরা খবর পেয়েছে বালিশাহি, ঘনামল্লশাহি, যেখানে গদাধর, জগদানন্দ, স্বরূপ আরও একঝাঁক বৈষ্ণব কুঁড়ে বেঁধে রয়েছে, সেই পাড়াগুলো ঢেউ-এর জলে ভেসে গেছে। গম্ভীরায় তার ঘরের চৌকাঠে এসে ঠেকছে ঢেউভাঙা জলের ফেনা। জগদানন্দ, গদাধর, বাকিরা কোথায় মাথা গুঁজে পড়ে আছে, সে ভেবে পেল না। সারাদিন খারাপ হয়েছিল তার মন। বৃষ্টিতে ভেজা মাঝদুপুরে তার ঘরে হঠাৎ হাজির হয়েছিল বলভদ্র ভট্টাচার্য, যাকে গৌড়ের মানুষ চিনত সুবুদ্ধি রায় নামে। দাক্ষিণাত্যে মীনাক্ষী দেবীর চাতালে এই প্রবীণ মানুষটা ‘ওঁ নমো নারায়ণায়’ উচ্চারণ করে প্রণাম করেছিল তাকে। তার অনুমতি নিয়ে বলভদ্রকে গম্ভীরায় ঢুকতে দিয়েছিল গোবিন্দ। গোরাকে প্রণাম করে সে এমন কিছু কথা বলল, যা শুনে তার মন আরও ভার হয়ে গেছে। মানুষের নজর এড়াতে সম্ভবত গম্ভীরা থেকে তার বেরিয়ে যাওয়ার তাড়া ছিল। বলল, হে দেবতা আজ সন্ধেতে মন্দিরে ‘অতিবড়ী’ জগন্নাথ দাশ আর তোমাকে নিয়ে পাশা খেলা হবে। মাপা হবে অলৌকিক শক্তি কার বেশি। জগন্নাথ দাশ তোমার ভক্ত, সে-ই উল্টে দেবে যারা জিততে চায়, তাদের ঘুঁটি। তোমার আর এক ভক্ত গচ্ছিকার বংশের প্রতিহারী অনন্ত, যে হাতির দু’দাঁত ধরে বশে এনে ‘মত্তগজ প্রতিহারী’ উপাধি পেয়েছে, সে থাকবে তোমার পাশে।

এক মুহূর্ত থেমে গোরাকে বলভদ্র জিজ্ঞেস করল, অনন্তকে আপনার মনে পড়ে? জগন্নাথদেবের সিংহাসন থেকে এক সন্ধেতে তুমি ফুলের মালা আনতে গেলে যে ঠেকাতে চেয়েছিল, তোমার হাতের ছোঁয়ায় ছিটকে গিয়ে অনসরপিণ্ডিতে শবরদের গুণ্ডপীঠে পড়েছিল, এ সেই অনন্ত প্রতিহারী।

অনন্তকে গোরা ভালরকম চেনে, বলল না। তাকে নিয়ে রাজসিংহাসনের দাবিদারদের মধ্যে পাশাখেলা শুরু হয়েছে সে জানে। পাশাখেলার রাত এত তাড়াতাড়ি আসবে সে ভাবেনি। দুপুর থেকে মন আনচান করলেও বলভদ্রের চাপা গলার কথা শুনে চুপ করেছিল। কথা সে কম বলে, ভাবের ঘোরে থাকে। বলভদ্রের কথাতে ভাবের সঙ্গে মিশে গেল মনের ভার। বলভদ্র যা বলে গিয়েছিল, সন্ধের পর থেকে তা ঘটতে শুরু করল। দুর্যোগের রাতে কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে পারছিল না। মন্দিরে দর্শনার্থীর ভিড় কম। জগন্নাথদেবের পাকশালা থেকে প্রদীপ জ্বেলে নিয়ে এসে মন্দিরে মঙ্গল আরতি হওয়ার নিয়ম। প্রবল ঝড়ে সে প্রদীপ জ্বেলে আনা যাচ্ছে না। মন্দিরের চাতালে রাখা প্রদীপগুলো নিভে গিয়ে মন্দিরচত্বর ঘুটঘুটে অন্ধকার। চাতালের বাইরে অন্ধকারে পাঁচসাতজন জোয়ান শরীরের মানুষ মুখ থুবড়ে চিত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে, না জেগে আছে, বোঝা মুশকিল। বিদ্যাধরের চক্রান্ত হাসিল করার জন্যে মাঝদুপুরে তাদের পাঠানো হয়েছিল মন্দিরে। অনসরপিণ্ডির শেষমাথাতে গোরার কবর খুঁড়ে ক্লান্ত হয়ে সুরা খেয়েছিল তারা। রাজা প্রতাপরুদ্রের রক্ষীদের জন্যে যে কয়েক কলসী সুরা বিদ্যাধর পাঠিয়েছিল, তার অনুচরেরা প্রায় সব খেয়ে ফেলেছিল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে, মন্দিরে কে, কোন্ পক্ষের লোক বোঝার উপায় নেই। মঙ্গল আরতি দেওয়ার সময় চলে যাচ্ছিল। অন্ধকারে ভক্তরা দুটো প্রদীপ সাজিয়ে হতাশ হয়ে বসেছিল। তখনই মঙ্গল আরতি দেখতে মন্দিরে ঢুকল গোরা, পাশে জগন্নাথ দাশ। অনন্ত প্রতিহারীর এক সহকারী গোরাকে বলল, ঠাকুর, ঝোড়ো বাতাসে প্রদীপ জ্বালা যাচ্ছে না। বলো এখন কী করব?

গোরা নিজের হাতে একটা প্রদীপ তুলে নিতে জগন্নাথও তাই করল। পাকশালার চুল্লির কাছে গিয়ে দু’জনে দাঁড়াতে গোরার পা ধরে জগন্নাথ বলল, প্রভু, আমি তোমার দাস। আমার কাছে তুমি মহাপ্রভু জগন্নাথ। এই ঝড়ে প্রদীপ জ্বালানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তা চাই না, আরও কিছু সময় অন্ধকার থাকুক। মূল মন্দিরের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো এক ছায়ামূর্তিকে দেখিয়ে জগন্নাথ বলল, তোমার জন্য অনন্ত প্রতিহারী দাঁড়িয়ে আছে। প্রভু যা করার তুমিই করবে, অনন্ত শুধু কার্যকারণ হয়ে থাকবে। গোরার ওপর নজর রাখছিল অনন্ত। গোরাকে কাছে পেয়ে বলল, আমার সঙ্গে এসো। গোরাকে নিয়ে অনসরপিণ্ডি ঈশান কোণে এসে ঘন অন্ধকারে পাথর বাঁধানো চাতালের এক বিশাল পাথর মত্তগজ উপাধি পাওয়া অনন্ত দুটো সবল হাতে তুলে ফেলল। চাপা গলায় গোরাকে বলল, মহাপ্রভু, দশটা ধাপ নেমে তুমি একটা সুড়ঙ্গ পাবে। কুড়ি ক্রোশের সেই সুড়ঙ্গপথের অর্ধেকের বেশি যেতে হবে তোমাকে। সুড়ঙ্গটা মাঝখানে দুভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গেছে। তুমি যাবে ডানদিক ধরে। প্রথম তিনটে দরওয়াজা ছেড়ে চতুর্থ দরওয়াজার খিলান খুললে তুমি গভীর জঙ্গলের কাছে গিয়ে পৌঁছোবে। তোমাকে নিতে সেখানে একজন অপেক্ষা করবে।

অন্ধকার সিঁড়ির ধাপ ধরে গোরা নামতে শুরু করলে অনন্ত জিজ্ঞেস করল, স্নানযাত্রার শোভাযাত্রাতে ইটের ঠোক্কর খেয়ে তোমার পা থেকে যে রক্ত ঝরছিল, সেই আঘাত এখনও কি কষ্ট দিচ্ছে?

অনন্তর দিকে তাকিয়ে গোরা হাসল। নিকষ অন্ধকারেও সেই হাসি দেখতে পেল অনন্ত। দশধাপ নেমে সুড়ঙ্গে পৌঁছে গোরা শুনতে পেল গজপতিরাজ পুরুষোত্তমদেবের তৈরি গোপন পথে বিশাল পাথর বন্ধ করছে অনন্ত। মন্দির আক্রান্ত হলে জগন্নাথদেবের মূর্তি এইপথে চিলকায় তার গোপন গুহামন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। কৃষ্ণনাম জপ করছিল গোরা। ভাবছিল বিষয়-আশয়ে আসক্ত মানুষ আর রাজশক্তির কাছ থেকে তার দূরে থাকা উচিত ছিল। সন্ন্যাসী হলেও সে ভুল করেছে। এ ভুল সে আর করবে না। সুড়ঙ্গের পথ পিছল। মাঝে মাঝে জল, কোথাও কাদা। ডানপায়ের নীচে ইটে কাটার ক্ষত, ব্যথা আছে সেখানে। তবু সে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে। তাকে যেতে হবে কুড়ি ক্রোশের অর্ধেকের বেশি পথ চতুর্থ দরওয়াজা পর্যন্ত। অন্ধকার বিশাল সুড়ঙ্গপথে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে প্রশ্ন জাগল, পরম ভাগবত জগন্নাথদাসকে দিয়ে সে মন্দিরে ঢোকার পরের মুহূর্তে তাড়াতাড়ি সদরদরজা বন্ধ করে দেওয়া হল কেন? তার ছায়াসঙ্গী গোবিন্দ, ভক্তবৈষ্ণব জগদানন্দ, স্বরূপ, গদাধর কি মন্দিরে ঢুকতে পেরেছে? বোধহয় পারেনি। তাদের কি দশা হল? মন্দিরের ভেতর বাইরের অন্ধকার দেখে তার জন্য কাতরতায় তারা কি ভেঙে পড়েছে? রোদজলে পোড় খাওয়া তার শরীর, শক্ত কাঠামো, তীর্থভ্রমণে কয়েক হাজার ক্রোশ হেঁটেছে, সে সচল সন্ন্যাসী, থামার মানুষ নয়। নিজের মনে সে বলল, বাপ কৃয়া, পথ দেখাও।

নামজপে গোরা যখন ডুবে যাচ্ছে, মন্দিরে মঙ্গল আরতির প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপ জ্বালাল কে? প্রদীপের শলতেতে আগুন দিয়ে জ্বলন্ত প্রদীপ জগন্নাথ দাসের হাতে তুলে দিয়েছিল গোরা। প্রদীপ নিয়ে এসে জগন্নাথ রটিয়ে দিল, মহাপ্রভুর দারুব্রহ্ণের শরীরে এক টুকরো আলোর মতো সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্যপুরীকে মিশে যেতে দেখেছে সে। গোরার জন্য খুঁড়ে রাখা কবর ততক্ষণে রাজা প্রতাপরুদ্রের অনুচরেরা মাটি ভরে পাথর লাগিয়ে মন্দিরের চাতালের সঙ্গে সমতল করে দিয়েছে। বাইরে থেকে দেখে কোথায় কবর আছে ধরার উপায় নেই। দারুব্রহ্মের গোরা মিলিয়ে যাওয়ার ঘটনা জগন্নাথ শোনালেও তাকে খোঁজাখুজি শুরু হয়ে গেল। কেউ বলল, তাকে সিংহাসনের দিকে যেতে দেখেছে, কেউ গেল গুণ্ডিচামণ্ডপের বাগানে, ইন্দ্রদ্যুম্নসরোবরের পথে, নৃসিংহবল্লভ আইটোটায়। সমুদ্রের ধারে বসে গোবিন্দ, জগদানন্দ গদাধর চোখের জল ফেলতে লাগল। বৃষ্টির জলে মিশে গেল চোখের জল। উত্তাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে থাকল স্বরূপ।

অন্ধকার সুড়ঙ্গে কিছুটা হেঁটে গোরার মনে হল পথটা তার চেনা, প্রথম দরওয়াজা দ্বিতীয় দরওয়াজা অচেনা নয়। অন্ধকারে দরওয়াজার খিলানগুলো পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে গোপন পথের দেয়ালে গীতগোবিন্দের কৃষ্ণকাহিনী নিয়ে আঁকা ছবি, নানা রঙে আঁকা আলপনা, অন্ধকারে তার অগোচর নয়। এই পথে যেন কয়েকবার সে যাতায়াত করেছে। কতপথ যেতে হবে, কতক্ষণে চতুর্থ দরওয়াজায় পৌঁছোবে, এ নিয়ে তার চিন্তা ছিল না। Fতুর্থ দরওয়াজা সামনে নিজে থেকে দাঁড়িয়ে যাবে টের পাচ্ছিল। ডানপায়ের নীচে ছোট একটা ঘা হয়ে থাকলেও হনহন করে সে হাঁটছিল। অনন্ত প্রতিহারীর কথা শুনে সে জেনেছে খিলান খুলে চতুর্থ দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে সে দেখবে তার জন্য অপেক্ষা করছে একজন। সে কে? গোরা অনুমান করতে পারে তাদের কারও কাছ থেকে সন, তারিখসমেত গোরা নিধনের খবর আগে কানে গিয়েছিল বৃন্দাবনবাসী সেই মানুষটার নাম বীরভদ্র ভট্টাচার্য। বহুবছর বৃন্দাবনে বাস করছে। পুরুষোত্তমপুরে নিয়মিত যাতায়াত থাকায় সেখানে নানা মহলে এমনকী রাজপরিবারের অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিদ্যাধরের ঘনিষ্ঠ অনুচরদের কয়েকজন তার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। কথাটা ভেবে আনন্দে ভরে যায় গোরার মন। এ সেই ব্রজধাম কৃষ্ণের লীলাভূমি, যেখানে থাকার জন্যে সে সন্ন্যাস নিয়েছিল। পুরুষোত্তমপুরে বছরের পর বছর আটকেছিল। মহাপ্রভু জগন্নাথের টানে শুধু সেখানে পড়ে থাকেনি, তার বৃন্দাবনবাসী হওয়ার ইচ্ছে কিছু মানুষ বারবার যেন থামিয়ে দিচ্ছিল। অর্ধলুপ্ত ব্রজধামকে নতুন করে সে সাজিয়ে তুলবে। প্রায় ভোররাতে পনের ক্রোশ পথ হেঁটে চতুর্থ দরওয়াজার সামনে গোরা দাঁড়িয়ে গেল। অন্ধকার থিকথিক করলেও দরওয়াজা খিলান চিনতে ভুল করল না। খিলান খুলে দরওয়াজার কপাট বন্ধ করে সে বাইরে এসে দাঁড়াতে বাইরে গাছের মোটা গুঁড়ির আড়াল থেকে তার সামনে এসে দাঁড়াল বীরভদ্র ভট্টাচার্য। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে কাদা হয়ে আছে তার শরীর। গোরাকে দেখে প্রণাম করল সে। গেরুয়া রঙের একটা টুপি গোরাকে দিয়ে বলল, দেবতা, মাথায় এটা পরে নাও। কত মানুষ চেনে তোমাকে তার শেষ নেই। টুপিটা একটু আড়াল করবে তোমাকে।

নিজের হাতে গোরা টুপি মাথায় লাগিয়ে নিল। বীরভদ্র বলল, দেবতা তোমাকে নিয়ে বৃন্দাবন যাব। চেনা পথ ধরে নয়। দারুব্রহ্মে তোমার বিলীন হয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত পুরুষোত্তমপুরে ছড়ালেও সেখানের ক্ষমতাধর মহল তা কতটা বিশ্বাস করবে সন্দেহ। তোমাকে তারা খুঁজে বেড়াবে। গৌড়ের সুলতানের সিন্ধুকীরা তোমার পিছু ছাড়বে না। এই ঝাড়িখণ্ড জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বৃন্দাবনে যেতে হবে আমাদের। জঙ্গলে মানুষখেকো কিছু পশু আছে, সাপ আছে। তারা হয়তো তোমাকে ছোঁবে না। তোমার সঙ্গী হিসেবে আমাকেও ছেড়ে দিতে পারে। তবু সাবধানী হতে হবে আমাদের। এপথে আমার যাতায়াত আছে। সাত, আটদিনে বৃন্দাবনে পৌঁছে যাব।

গোরা নিঃশব্দে হাঁটলেও বীরভদ্র কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল। গোরার কানে কথাগুলো ঢুকছে না। মৃত্যুর গহ্বর থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা গোরা বৃন্দাবন দর্শনের আনন্দে তন্ময়। আপন মনে বলে চলেছে, কোথায় আমার বেহুলাবন, ভাণ্ডীরবন, কোথায় আমার মধুবন, কোথায় যমুনা, গোবর্ধন পর্বত, সুদাম, শ্রীদাম, নন্দ, যশোদা? রাধা, কৃষ্ণের নাম মুখে আসার আগে ভাবাবেশে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার দশা হল। মাটিতে সে পড়ে যাওয়ার আগে তাকে দু’হাতে ধরে সামলালো বীরভদ্র। তার বকুনি থেমে গেল। হিংস্র পশু ভরা ঝাড়িখণ্ডের যে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তার দেবতা বৃন্দাবন চলেছে, সেখানে পদে পদে বিপদ, এ খেয়াল তার নেই। কৃষ্ণের অবতার এসব নিয়ে কেন ভাববে, ভয় পাবে? গোরার পাশাপাশি হাঁটতে দুর্গম পথের ভয় বীরভদ্রের কেটে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল কিছু মানুষ আছে, যাদের দেখলে মনে হয় অন্ধকার ঘরে প্রদীপের মতো আলো ছড়িয়ে বসে আছে, কাঠফাটা গরমের দুপুরে ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়া ছড়াচ্ছে, হাজার রকম পাগলামি করলেও যাদের উন্মাদ মনে হয় না, যা বলে নিস্তব্ধ হয়ে অনন্তকাল শুনে যেতে ইচ্ছে করে। সব লৌকিক, অলৌকিক চিরদিনের সত্যি মনে হয়, তেমন একজন মানুষকে বৃন্দাবনে নিয়ে চলেছে সে। না, সে মানুষ নয়, সে দেবতা। দেবতার বৃন্দাবন দর্শনে তার সঙ্গী হয়েছে সে। দেবতা নিয়ে যাচ্ছে তাকে বৃন্দাবনে। ঝারিখণ্ডে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সপ্তম দিনে মথুরা পৌঁছে আনন্দে উন্মত্ত হয়ে গেল গোরা মাটিতে গড়াগড়ি খেল বারবার বলতে থাকল হরিবোল। গাছের ডালে বসে থাকা ময়ূর দেখে বলতে থাকল, ঐ কৃষ্ণ, গাছের পাতা দেখে বলতে থাকল, ঐ কৃষ্ণ। যতকিছু সবুজ ছড়িয়ে রয়েছে এমনকী, ঘাসে ভরা মাটিতে কৃষ্ণকে দেখতে পেল সে। আনন্দে, নেচে গেয়ে যমুনার জলে কৃষ্ণকে দেখে ঝাঁপ দিল সেখানে। অষ্টম দিন সে যখন বৃন্দাবনে পৌঁছোলো, তার আগে তার ছয় পার্ষদ সনাতন, রঘুনাথ দাস, গোপাল ভট্ট সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। সকলে গোরার ভক্ত, শাস্ত্রজ্ঞানী পণ্ডিত। রাধাকুণ্ডের আশপাশে কুঁড়ে বেঁধে বৈষ্ণবতত্ত্বের চর্চায় তারা ডুবে আছে। সেই তত্ত্বের কেন্দ্রে রয়েছে গোরা। নবদ্বীপের শচীর ছেলে কৃষ্ণের অবতার গোরার স্বরূপ নিয়ে ব্যাখ্যা, আলোচনা, লেখালেখি চলেছে। গোরা দেখল বৃন্দাবনে তার পাঁচ ভক্ত আসার আগে সেখানে ভাঙা দেব দেউল, মন্দির জঙ্গলের মধ্যে জমির অনেক অংশ বাসযোগ্য করে গুছিয়ে রেখেছে বীরভদ্র ভট্টাচার্য। রাধাকুণ্ডের কাছাকাছি জলের নতুন কুয়ো তৈরি করেছে। ফুলের বাগান ঘেরা এক টুকরো জমিতে গোপীনাথের মন্দির। মন্দিরের সামনে মঞ্জুরীতে ভারাক্রান্ত সবুজ তুলসী মণ্ডপ। সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ে নিজের জোগাড় করা মূল্যবান পুঁথিতে বানিয়ে রেখেছে পুঁথি সংগ্রহশালা। রাধাকুণ্ডের পাশে গোরা গিয়ে দাঁড়াতেই তার পরিকরেরা যে যার কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে এসে দণ্ডবৎ হয়ে তাকে প্রণাম করল। কুয়ো থেকে জল তুলে তার পা ধুয়ে দিল সনাতন। গামছায় হাত-পা মুছে দিল রূপ। সাক্ষাৎ মৃত্যুর কবল থেকে গোরা বেরিয়ে এসেছে, সে খবর তখনও বৃন্দাবনে পৌঁছোয়নি। মাথাতে গেরুয়া টুপি পরা গোরাকে তার ভক্তরা আগে থেকে দেখেনি। অবাক হল না তারা, ভাবল, সবই কৃষ্ণের ইচ্ছে। গোরার জন্যে নিজের কুঁড়েঘর ধুয়েমুছে প্রদীপ আর ধূপ জ্বেলে পরিষ্কার করল সনাতন। সে গিয়ে উঠল ছোটভাই রূপের কুঁড়েতে। রূপ তখন চৈতন্য তত্ত্ব নিয়ে পঞ্চম স্তবকগুচ্ছ লিখে ফেলেছে—

“রাধাকৃষ্ণ প্রণয়বিকৃতিহলাদিনী শক্তিরস্মাদোত্মানাবপি
ভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ।
চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা তদ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং
রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্।।”

(রাধা, কৃষ্ণের প্রণয়-পরিণতি আনন্দময়ী শক্তি। অতএব তাঁরা এক আত্মা হয়েও ভিন্ন দেহ নিয়েছিলেন একদা পৃথিবীতে। সেই দুটি (রূপ) এখন এক হয়ে চৈতন্য নামে প্রকট হয়েছেন। রাধার ভাব ও অঙ্গকান্তিযুক্ত কৃষ্ণস্বরূপ তাঁকে নমস্কার করি।)

গোরার কুঁড়েতে এক সকালে এই শ্লোক রূপ যখন তাকে পড়ে শোনাচ্ছে, তখন বাইরে থেকে ভেসে এল মধুর, সুরেলা গলার গান, কৃষ্ণভজনার গান গাইছে কোনও স্ত্রীলোক। ভজন শুনে গোরা নড়েচড়ে বসল। রূপের পাশে ছিল সনাতন। সে বলল, দ্বারকার রণছোড়জির মন্দির থেকে বৃন্দাবনে তীর্থ করতে এসেছে কৃষ্বময়ী মীরাবাই। দু’একদিন ছাড়া সকাল অথবা সন্ধেতে গোপীনাথের মন্দিরে এসে ভজন গায়। তার গান শুনলে প্রেমভক্তিতে ভেসে যায় আমাদের মন। আমরা যে যার কুঁড়েতে বসে তার গান শুনি।

কোথায় আছে ভক্তিমতী মীরাবাই?

বৃন্দাবনের ভাঙাচোরা মন্দিরে, কখনও গাছতলায়, গোবর্ধন পর্বতে উঠে পাথরের ওপর শুয়ে কয়েক রাত কাটিয়েছে। যেখানে থাকুক, তাকে ঘিরে ভক্তের ভিড়, সে গান শুরু করলে ভিড় বেড়ে যায়, কৃষ্ণের জন্যে তার আর্তি শুনে অনেকে চোখের জল ফেলে।

কৃষ্ণভক্ত মীরার বিবরণ শুনে গোরার চোখে জল এল। গোপীনাথ মন্দিরের চাতাল থেকে ভেসে আসছে মীরার ভজনের কলি।

“সুনী হো মৈ হরি আয়ন কী অয়াজ।
মহল চড়চড় জোঁউ মেরী সজনী
কব আয়ৈ মহারাজ।”

(শুনি আমি হরি আগমনের আওয়াজ। মহলের ওপর চড়ে সজনী আমি খুঁজি কখন আসে মহারাজ।)

গান শেষ করে নিঃশব্দে মন্দির ছেড়ে মীরাবাই চলে যেতে গোরাকে সনাতন বলল, প্ৰভু, মীরাবাই জেনে গেছে তুমি এখানে এসেছো। গোপীনাথ মন্দিরের পূজারী, চতুর্বেদীকে সে তোমাকে দর্শনের ইচ্ছে জানিয়েছে।

মীরার ইচ্ছে শুনে গোরা শিউরে উঠল। বলল, স্ত্রীমুখ দেখা সন্ন্যাসীর নিষিদ্ধ, তার ব্রতভঙ্গ হয়। ভক্তিমতী মীরা যেন আমাকে ক্ষমা করে

শ্রাবণ মাস শেষ হয়েছে। ভরা বর্ষার পরে শরতের ঝলমলে রোদে আকাশ ভেসে গেলেও মাঝেমাঝে মেঘ জমে কয়েক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির জলে চান করে বেশি করে চিকন সবুজ হয়েছে গাছের পাতা, ঘাস, লতাগুল্ম। থোকা থোকা বুনোফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে নানারঙের প্রজাপতি। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে ফুলের রেণু, এক ফুল থেকে আর এক ফুলে ছড়িয়ে পড়ছে। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে গোরা অনুভব করল, প্রেমভক্তি শুধু বাঙ্গালা, গৌড় এমনকী বৃন্দাবনে প্রচার করে থেমে গেলে চলবে না, সারা আর্যাবর্ত, আরও পশ্চিমে শতদ্রু, সিন্ধুনদী পেরিয়ে কৃষ্ণের নামে প্রেমভক্তির জোয়ার তুলতে হবে। দু’দিন পরে এক সকালে গোপীনাথ মন্দিরের চাতালে বসে মীরা যখন ভজন শুরু করেছে, গোরার পায়ের ইঁটের ক্ষতে ভেষজ লতাপাতার রস লাগিয়ে পরিচর্যা করছিল সনাতন। বৃন্দাবনে গোরা পৌঁছোনোর প্রথম দিনে তার পা ধোয়ানোর সময়ে পায়ের এই ক্ষত সনাতন দেখেছিল। এ নিয়ে গোরাকে প্রশ্ন করেনি। পুরুষোত্তমপুরের মন্দিরে যা ঘটনা, এমনকি গোরাকে খুন করার চক্রান্তের বিবরণ সনাতনকে একান্তে শুনিয়ে পাঁচকান করতে বারণ করেছিল। মীরা গান শেষ করতে গোরার কুঁড়ের দরজায় এসে দাঁড়াল পুরোহিত চতুর্বেদী। তাকে দেখে সনাতন কুঁড়ের বাইরে এল। তাকে দেখে নিচু গলায় চতুর্বেদী বলল, মীরামায়ি একবার মহাপ্রভুর দর্শন প্রার্থনা করছেন।

গোরা রাজি হল না। সন্ন্যাসীর স্ত্রীমুখ দেখার নিয়ম নেই জানিয়ে দিল। সনাতনকে বলল, তুমি সেই ভক্তিমতীকে বলো, আমি মার্জনা ভিক্ষা করছি।

সনাতনের মুখে গোরার পাঠানো বার্তা শুনে মীরা স্পষ্ট ভাষায় বলল, সে কি কথা, প্ৰভু কি জানেন না, বৈষ্ণবদের নমস্য গ্রন্থ, ভাগবতের বাণী, “বাসুদেব পুমানেকঃ স্ত্রীয়ময়ুস্মিতরজুৎ” বাসুদেব কৃষ্ণ-ই একমাত্র পুরুষ, বিশ্বচরাচরে আর যা আছে, সব প্রকৃতি। বৃন্দাবনে পরমপুরুষ শ্যামল কিশোর, বাঁশিবাদক কৃষ্ণ, আর সবাই প্রকৃতি।

সনাতনের মুখ থেকে মীরার জবাব শুনে গোরা স্থির হয়ে গেল। কৃষ্ণসাধিকা মীরা ভাগবত উদ্ধৃত করে তাকে শিক্ষা দেবে সে কল্পনা করেনি। মীরার অনুরোধ মেনে নিয়ে সনাতনকে হাসিমুখে সে বলল, যাও, সেই সাধিকাকে নিয়ে এসো এখানে।

পাশের ঘরে গোরার অবতার স্বরূপের মহিমায় আপ্লুত রূপ তখন লিখছে নতুন শ্লোক।

শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কো কীদৃশো বানয়ৈবা
স্বাদ্যো যেনাদ্ভুতমধুরিমা কীদৃশো বা মদীয়ঃ।
সৌখ্যং চাস্যা মদনুভবতঃ কীদৃশং বেতি লোভাৎ
তদ্ভাবাঢ্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ।।

(শ্রীরাধার প্রণয়ের মহত্ব কেমন, কেমনই বা আমার অদ্ভুত মাধুর্য যা তিনি আস্বাদন করেন, আর আমাকে অনুভব করবার কালে কেমন সুখ অনুভব হয় তাঁর, এইটুকু জানবার লোভে রাধাভাবে পরিপূর্ণ হরি যেন চাঁদ হয়ে শচীদেবীর গর্ভে উদিত হলেন।)

গোরার কুঁড়েতে তখন তার মুখোমুখি বসেছে মীরাবাঈ। তাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করেছে গোরা। ঘরে ঢুকে প্রথমে প্রেমভক্তিতে ডুবে থাকা সন্ন্যাসীকে না ছুঁয়ে মীরা গড় করেছিল বাইরে থেকে দু’জনকে সহজ স্বাভাবিক দেখালেও দু’জনের মনের মধ্যে চলছে উথাল-পাথাল। গোরার মনে প্রশ্ন জেগেছে, মীরাই কি ব্রজের প্রেমের সর্বসাধ্যসার ব্রজভূমির ঈশ্বরী রাধা? মীরা ভাবছে, তার মুখোমুখি আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে মাথায় গেরুয়া টুপি কৌপীনধারী যে সন্ন্যাসী ভাবাবশে দু’একটা কথা বলছে, সে স্বয়ং কৃষ্ণ, হ্যাঁ, কৃষ্ণ ছাড়া কেউ নয়। দুজনের মনে এক ধরনের অনুভূতি জাগলেও কেউ মুখ খুলতে পারছে না। অনেক বছর পরে গোরার মনে পড়ল লক্ষ্মী প্রতিমার মতো সুন্দরী প্রথম স্ত্রী মৃত লক্ষ্মীকে। মনে পড়ল নবদ্বীপে ছেড়ে আসা সহধর্মিনী বিষ্ণুপ্রিয়াকে, এক ভরপুর সংসারের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে হু হু করে উঠল তার বুক। প্রেমভক্তি নিয়ে মীরার সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত কথা বলে তাকে বিদায় দেওয়ার আগে গোরা বলল, হে ভক্তিমতি, তোমাকে দেখে ধন্য হলাম, তোমার কৃষ্ণ প্রাপ্তি ঘটেছে, কৃষ্ণ ঘিরে রয়েছে তোমাকে, আমি দেখতে পাচ্ছি।

ঘর ছেড়ে যাবার আগে গোরাকে মীরা বলল, তুমি স্বয়ং কৃষ্ণ, আমার কৃষ্ণ দর্শন হল। গোরা কথা বলল না, তার মুখে ছড়িয়ে পড়ল, ভুবন ভোলানো হাসি। গোরাকে দেখার বিহ্বলতা নিয়ে গান বেঁধে পরের দিন সকালে গোপীনাথের মন্দিরে যে ভজন সে গাইল, রাধাকুণ্ডের চারপাশে কুঁড়েঘরের বাসিন্দারা সেই সুরেলা ভজনে চিনে নিল তাদের প্রভুকে। প্রেমভক্তিতেই আবিষ্ট হয়ে তারা শুনতে থাকল সেই গান।

অব তো হরি নাম নাম লৌ লাগি
সব জগ কো য়হ মাখন চোরা,
নাম ধরন্যো বৈরাগী।
কিত ছোড়ী য়হ মোহন মুরলী
কহঁ ছোড়ী সব গোপী
মুড়মুড়াই ডোরি কটি বাঁধি
মাথে মোহন টৌপী।
মাত-জসোমতি মাখন কারণ
বাংধে জাকো পায়।
শ্যাম কিশোর ভয়ো নব গোরা
চৈতন্য জাকো নায়।
পীতাম্বর ভাব দিখায়ৈ
কটি কৌপীন কসৈ
গৌর-কৃষ্ণকী দাসী মীরা
রসনা কৃষ্ণ বসৈ।।

(এমন হরি নামের প্রেমে হয়েছিল বিভোর, সব জায়গায় তিন মাখন চোরা, তার হেথায় নিয়েছেন বৈরাগীর বেশ। মোহন মুরলী আর গোপীদের ছেড়ে মুড়িয়েছেন মাথা, বেঁধেছেন ডোর কৌপীন পরেছেন শিরে মোহন টুপি। মাখন চুরির কারণে মাতা যশোমতী ক্রোধের ছলে বেঁধেছিলেন যার পা, সেই শ্যামল কিশোর নব গৌরাঙ্গ হয়ে নাম ধরেছেন এবার চৈতন্য। পীতাম্বরের ভাব দেখাতে গিয়ে কটিতে বেঁধেছেন কৌপীন। গৌরকৃষ্ণের দাসী মীরা তাঁর রসনাতে সদা জপ করেছেন কৃষ্ণনাম।)

কুঁড়েতে বসে গোরা শুনল সেই গান, অনুভব করল নিজের সন্ন্যাস জীবন কেমন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সে নামজপ করতে শুরু করল। বেদনা জড়ানো গলায় বলল, বাপ কৃষ্ণ, বাঁচাও কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করে ভাবাবিষ্ট হল সে।

বৃন্দাবন ছেড়ে তিনদিন পরে গোরা উধাও হল। উধাও হল মানে পালিয়ে গেল না, সনাতন, রূপ, দুই রঘুনাথকে জানিয়ে গেল প্রেমভক্তি প্রচারে আর্যাবর্ত থেকে আরও পশ্চিমে তক্ষশীলা গান্ধার হয়ে মহেঞ্জোদরো হরপ্পা নগরের ধ্বংসাবশেষের ওপর দিয়ে আরো পশ্চিমে পারস্য উপসাগরের ধারে পৌঁছে যাবে। পৃথিবী তাকে ডাকছে। রাধাকুণ্ডের বাসিন্দারা মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম করল গোরাকে। কারো চোখে জল, কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। গোরার দুচোখেও টলমল করছে জল। কান্না চেপে সনাতন জিজ্ঞেস করল, প্রভু আপনার সঙ্গে কি আবার দেখা হবে?

গোরা চুপ করে থাকল। তারপর মাথায় গেরুয়া টুপি লাগিয়ে ধীর পায়ে রাধাকুণ্ডের ভক্তদের ছেড়ে পথের দিকে পা বাড়াল। পাঁচটা বসন্ত পার করে ষষ্ঠ বসন্তে গোরা মক্কা-মদিনা ঘুরে পারস্য উপসাগরের ধারে এসে যখন দাঁড়ালো, বিকেল শুরু হয়েছে। গোরা ভাবছিল, এখন কোথায় যাবে? কয়েক হাজার মাইল পথ পরিক্রমায় সে জেনেছে মানুষই সবচেয়ে বড় বন্ধু মানুষের। সবাই ভালবাসে সন্ন্যাসীকে। সে যেখানেই গেছে সেখানে দুহাত পেতে তার কাছ থেকে অসংখ্য মানুষ ছিটেফোঁটা প্রেমভক্তি চেয়েছে। মুসা বন্দরে কোথাও সারি বেঁধে কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড়-ছোট নীলা মাপের জলপোত। কয়েকটা জলপোতের মাথায় দেখা যাচ্ছে কামানের নল। ঘটনাচক্রে অথবা কোন অলৌকিক কারণে এক পোর্তুগিজ জলপোত থেকে বলিষ্ঠ চেহারা দাড়িগোঁফে বোঝাই মুখ যে মানুষটি নেমে এল, তাকে একবার দেখে চিনে ফেলল গোরা, এ সেই আলবুকের্ক, বিজয়নগর রাজ্যের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের গোলন্দাজ বাহিনীর প্রশিক্ষক। গোরাকে দেখে নিজের জলপোত ছেড়ে বন্দরের মাটিতে নেমে এসে সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানালো বিদেশি মানুষটা। জিজ্ঞেস করল, কোথায় চলেছ মহাত্মা? প্রাকৃত মেশানো ওড়িয়া ভাষায় কথা বলছিল আলবুকের্ক, গোরাও জলের মতো ভাষাটা বলতে পারে। সে জানালো, আরও দূর জনপদের মানুষের কাছে গিয়ে প্রেম ভক্তির ভাঁড়ার সে খুলে দিতে চায়। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় আলবুকের্ক বলল, চলুন আমার সঙ্গে আমার দেশে। হাজার হাজার মানুষ প্রেমভক্তির কাঙাল। আপনার কাছাকাছি এলে তারা নতুন জীবন পাবে। পশ্চিমের অন্য কোন দেশে আপনি যদি যেতে চান পৌঁছে দেবে আমাদের জলপোত। নিজের দেশে আপনি আসতে চাইলে কোন অসুবিধে নেই। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের পোত হামেশাই যাচ্ছে সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী বন্দরে। আপনার পছন্দের বন্দরে তখন নেমে যেতে পারেন।

প্রসন্ন হাসি মুখে নিয়ে গোরা তাকাল আলবুকের্কের দিকে। বলল, আমি সন্ন্যাসী। আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে আমাকে। আরব দেশে মক্কা-মদিনা দর্শন করে সেখান থেকে যাব নতুন তীর্থে, মহাত্মাদের জন্মস্থানে প্রণাম জানাতে। সেই পথের মধ্যে কোন সময়েই তোমার দেশেও পৌঁছে যেতে পারি। শুভম্ ভবতু—তোমার শুভ হোক।

শ্রদ্ধার ঘাড় নাড়াল আলবুকের্ক, হাঁটা দিল নিজের জলপোতের দিকে। দিনশেষের আলোয় উপমহাসাগরের জল তখন রঙ বদলাচ্ছে, উপমহাসাগরের নীল জলে সূর্যাস্তের ছায়া পড়ে সবুজের আভা ফুটেছে, ধবধবে সাদা একঝাঁক শঙ্খচিল উড়ছে কিনার ঘেঁষে। নিজের মনে গোরা বলল, বাপ কৃষ্ণ, পথ দেখাও, আর পাগল কোরো না আমাকে।

.

গোরা মেগাসিরিয়ালের দ্বিতীয় পর্বের বাকি পঞ্চাশটির কাহিনী ভাইপো গোরার মুখ থেকে চারদিন কয়েক ঘণ্টা রেকর্ড করল কাকা ত্রিদিবনাথ। তৃপ্তি ছড়িয়ে থাকল ত্রিদিবনাথের মুখে। গোরা জিজ্ঞেস করল, যা বললাম, ঠিক আছে তো?

স্নেহের হাসি ছড়িয়ে পড়ল ত্রিদিবনাথের মুখে।

গোরা আবার জিজ্ঞেস করল, বাচালতা করলাম না তো?

গোরার কাঁধে, আলগোছে হাত রেখে কাকা বলল, তুই আমার চেয়ে বেশি আধুনিক। পাঁচশো বছরের ইতিহাস আর গোরার মনের টানাপোড়েনের বিবরণ তুই যেভাবে বললি, আমি পারতাম না। কথাটা বলে ভাইপোকে কাকা জিজ্ঞেস করল, তুই খুশি?

হ্যাঁ, ভীষণ খুশি।

কাকাকে ভাইপো জিজ্ঞেস করল, তুমি খুশি?

অবশ্য, কাকা ভাইপোর কাহিনী ধ্রুবতারা চ্যানেলে বাকি পঞ্চাশটা এপিসোড জমজমাট হয়ে উঠবে। গোরা হাসল। সামনে টাঙানো বড় আয়নায় মুখটা দেখে বলল, মাথার এই লম্বা চুল আর মুখের এই দাড়িগোঁফ কাল কামিয়ে ফেলতে হবে।

ব্যস, সাতদিনের মধ্যে তাহলে সবাইকে যোগাযোগ করে ‘শুট’ শুরু করে দেব।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে গোরা বলল, আপাতত একাজ আমি করতে পারছি না।

কেন? কী হল?

তুমি আমাকে এমন একটা রাস্তা দেখিয়েছ, যা পোর্তুগিজ গোলন্দাজ আলবুকের্ককের হাত ধরে সমুদ্র পেরিয়ে পৃথিবীর পশ্চিমে দেশে মহাদেশে ছড়িয়ে গেছে। পাঁচশো বছর আগে গোরাকে সেখানে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আলবুকের্ক। সন্ন্যাসী গোরা জানত, প্রেম আর ভক্তি দুটোই হল মানুষের প্রতি ভালবাসা। মানুষকে ভাল না বাসলে গায়ের জোরে তাকে প্রেমভক্তি দেখানো যায় না। প্রেম যেখানে নেই, সেখানে ভক্তি নেই। উল্টোদিক থেকেও কথাটা ঠিক। মেগাসিরিয়ালের বাকি পঞ্চাশটা শুট করার আগে পৃথিবীটা আমি এক চক্কর ঘুরে দেখে আসতে চাই।

কোথায় যাবি?

আমার এক বন্ধু ঐশী এখন রয়েছে পশ্চিম এশিয়াতে দুর্গত মানুষের ত্রাণের কাজে। রেডক্রস সংস্থার সে স্বেচ্ছাসেবী। ই-মেলে তার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে আমার। আমি চাইলে তার মতো স্বেচ্ছাসেবী হতে পারি। পৃথিবী জুড়ে যে লণ্ডভণ্ড চলেছে, কোটি কোটি মানুষ দুর্গত, রেডক্রসের তরফে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি। সব ব্যবস্থা ঐশী করে দেবে।

সেজকাকাকে নিস্তব্ধ দেখে গোরা বলল, হাউস্টনে তোমার পছন্দের প্রথম গোরা তোমার বন্ধুর ছেলে ববের ই-মেলের ঠিকানাও পেয়ে গেছি। সে রয়েছে সুনামিতে ভেসে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের সেবাকাজে। সেও চায় মেগাসিরিয়াল শেষ হোক। দরকার হলে সে এসে দাঁড়াবে তোমার পাশে। আমিও কথা দিলাম, ফিরব।

ত্রিদিবনাথ বলল, তাই হোক।

শরতের মাঝদুপুরের নীল আকাশে ছড়িয়ে রয়েছে জলে ধোয়া তাজা আলো, আশপাশের গাছে নানা পাখির ডাক, গঙ্গার ছলাৎছল জলের শব্দ ভেসে আসছে ঘরে। খোলা জানলা দিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ত্রিদিবনাথ দেখল, পাঁচশো বছর আগের গোরার সঙ্গে কাল থেকে কালান্তরে হেঁটে চলেছে আরো অনেক গোরা, গোরার মিছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *