গোরা – ৩৭

৩৭

রাজমহেন্দ্রী থেকে বিজয়নগরের রাজধানী বাদামী হয়ে সেতুবন্ধ রামেশ্বর পর্যন্ত তীর্থযাত্রার শুরুতে পথের খবরাখবর পুরুষোত্তমপুর থেকে গোরা ছকে নিয়েছিল। প্রেমধর্ম প্রচারের সঙ্গে বিশ্বরূপকে খুঁজে বার করার যে প্রতিশ্রুতি মাকে দিয়ে ঘর ছেড়েছে, তা সে ভোলেনি। পাশাপাশি রয়েছে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী গৌড়, রাঢ়, সমতট, সামন্তভূমের কিছু তরুণ পরিবর্তনকামীর প্রার্থনা পূরণের আর্জি। বিদ্যাবাচস্পতির অনুরোধে বিজয়নগর রাজ্যের সঙ্গে উৎকলের মৈত্রী গড়ে তোলার ভার, কিছুটা স্বেচ্ছায় সে নিয়েছে। প্রেমভক্তিতে দুই রাজ্যকে মাতিয়ে তুলে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের গাঁটছড়া বেঁধে দেবে সে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজের চিন্তা কৃষ্ণনামের বিভোরতায় মিশে অহরহ তার মাথায় ঢেউ তুলছে, তা হল দাক্ষিণাত্যের চার বৈষ্ণব গোষ্ঠী, রামানুজের ‘শ্রী’ সম্প্রদায় মধ্বাচার্যের ‘ব্রত্ন’ সম্প্রদায়, বিষ্ণুস্বামীর ‘রুদ্র’ সম্প্রদায়, নিম্বাদিত্যের ‘চতুঃসন’ সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করে বৈষ্ণবভাবনাকে সুসংহত করা। গোরার বিশ্বাস, কাজটা কঠিন হলেও সে পারবে। সে কৃষ্ণের সন্তান, কৃষ্ণ তার বাপ, ‘কৃষ্ণ’ নাম উচ্চারণ করলে তার শরীরের প্রতিটি কোষে, নিঃশ্বাসে, চোখের মণি আর মুখের কথা থেকে নিজের অজান্তে যে সাত্ত্বিক বিকার স্ফূরিত হতে থাকে তা কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্য, কুলিয়ার বিদ্যাবাচস্পতি থেকে পুরুষোত্তমপুরের বাসুদেব সার্বভৌম, বিদ্যানগরের রামানন্দ পট্টনায়ক, সবাই মেনে নিয়েছে তার দৈবী সত্তা। দাক্ষিণাত্যের চার বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে সে বুঝিয়ে দেবে তাদের সাধনার সীমাবদ্ধতা। বর্ণাশ্রমধর্ম নয়, লক্ষ্মীনারায়ণ উপাসনা নয়, বৈকুণ্ঠপ্রাপ্তি নয়, কৃয়ে কর্মার্পণ নয়, কৃষ্ণপ্রেমই হল সাধনার সর্বসাধ্যসার, ভাগবতের এই বাণী চার সম্প্রদায়ের কাছে সে পৌঁছে দেবে। চার বৈষ্ণবসম্প্রদায়কে এক মঞ্চে এনে তাকে আরও কয়েকজন এমন মহাত্মার সঙ্গে দেখা করতে হবে, যারা সব মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়ে কাছে টেনে নেয়, যাদের মনের গভীরে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প আছে। তারা সবাই ভক্তিমার্গের সাধক নয়, তাদের মধ্যে জ্ঞানমার্গ, কর্মমার্গ যুক্তিমার্গের সাধক আছে। থাকতেই পারে, সকলের সঙ্গে সে কথা বলতে চায়। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় যে যার নিজের সাধনপথ ধরে অনায়াসে অংশ নিতে পারে। অসুবিধে একটাই। সেই মহাত্মাদের সবাই দাক্ষিণাত্যে থাকে না। আর্যাবর্তের পশ্চিমে, উত্তরে নানা রাজ্যে তাদের বাস, বর্ষার সময়টা বাদ দিয়ে বছরের বেশিরভাগ ঋতুতে তীর্থভ্রমণে তারা বেরিয়ে পড়ে। বিশেষ পুণ্যতিথিতে প্রয়াগ, হরিদ্বার, বারাণসী, রামেশ্বরে পুণ্যস্নানে যায়। তাদের দর্শন পেতে তবু সে পিছপা নয়। সে সন্ন্যাসী, পরিব্রাজক, পায়ে হেঁটে যতদূর যাওয়া সম্ভব, সে যাবে।

বাদামীর পথে সকাল থেকে সন্ধে, এমনকি রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত কৃষ্ণনাম জপ করে গোরা এগিয়ে চলল। মুখে একই বুলি—

কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! রক্ষ মাম্।
কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! পাহি মাম্‌।

নবদ্বীপ থেকে পুরুষোত্তমপুর রওনা হওয়ার কয়েকদিন পর থেকে কৃষ্ণনাম জপ আর পথ চলার মধ্যে গোরা টের পাচ্ছিল, তার সঙ্গে পথ হাঁটছে, গাছপালা, পুকুর, নদী, আকাশ, বাতাস, জনপদ, আবহমান সময় হেঁটে চলেছে, হাঁটছে মানুষ, হাঁটছে মহাসময়, জীবনপ্রবাহ, সবাই সন্ন্যাসী দেখে দাঁড়িয়ে পড়ছে, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে, আতিথ্যভিক্ষার জন্য তার হাতে পায়ে ধরছে। সেখানেই থামছে না। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে কৃষ্ণনাম জপ করে সঙ্কীর্তনের আসর বসিয়ে নেচে গেয়ে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ছে। বেশ কয়েক জায়গায় গ্রামবাসীদের অনেকে পুরুষোত্তমপুরের পথে কিছুটা এগিয়ে দিচ্ছিল তাকে। নিতাই, গদাধর প্রমুখ সাথীরা গোরাকে তখন ঘিরে ছিল। দাক্ষিণাত্যের পথে গোরা একা রওনা হওয়ার পরে একই ঘটনা ঘটতে থাকল। গেরুয়া অঙ্গবস্ত্র জড়ানো সূর্যের মতো উজ্জ্বল শরীর, পদ্মকুঁড়ির মতো চোখ, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা দুটো সুঠাম হাত এক নবীন সন্ন্যাসীকে দেখতে লোকালয়ের পথে মানুষ সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে পড়তে থাকল। পথের ওপর কেউ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল, কেউ পথের ধুলো তুলে ধুতির খুঁটে বেঁধে রাখল। নাম জপে বিভোর গোরার মনে হচ্ছিল, তার পথের দু’পাশে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারা কৃষ্ণ, সেই কৃষ্ণই তার সঙ্গে হেঁটে চলেছে, মাথার ওপর দিয়ে যে ফিঙে বা খঞ্জনা পাখিটা উড়ে গেল, তার গলাতেও কৃষ্ণের নাম। কানের পাশে হঠাৎ একটা উড়ন্ত মৌমাছি গুনগুন করে উঠলে, তার মনে হচ্ছিল বৃন্দাবনে সখিদের কাছে কৃষ্ণের খোঁজ নিচ্ছে রাধা। পথের দু’পাশে কোথাও কোনও লোকালয়ে মন্দির চোখে পড়লে সেখানে গোরা দাঁড়িয়ে পড়ছিল। মন্দিরে শিব, বিষ্ণু, রাম, কৃষ্ণ যে-কোনও মূর্তি থাকুক, প্রণাম করছিল। তাকে দেখতে প্রায় সব মন্দিরে যারা ভিড় করছিল, তাদের মুখের ভাষা আলাদা হলেও ভাঙা সংস্কৃত আর অচেনা প্রাকৃত ভাষা মিলে দু-এক জায়গায় জমে উঠেছিল সঙ্কীর্তন। সাধারণ কিছু ঘটনা তার কৃষ্ণপ্রেমে আলোড়ন তুলেছিল। বাদামী পৌঁছনোর আগে বিজয়নগর রাজ্যের এক বিষ্ণুমন্দিরে, চাতালের ধার ঘেঁষে অল্পশিক্ষিত এক ব্রাক্ষ্মণ ভুল উচ্চারণে উঁচু গলায় সংস্কৃত গীতা পড়ছিল। বিকৃত উচ্চারণে ব্রাহ্মণের গীতাপাঠের ভঙ্গী দেখে সংস্কৃত জানা বিষ্ণুভক্তদের অনেকে হাসাহাসি করছিল। বিদ্রুপ করছিল কেউ কেউ। ব্রাক্ষ্মণ খেয়াল করছিল না হাসিঠাট্টা। ভাষাজ্ঞানের দীনতা থাকলেও তার পাঠে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। গীতা পড়ার আবেশে জলে ভাসছিল তার দু’চোখ, মুখে হাসি ফুটছিল কখনও, পরের মুহূর্তে আবেগে কেঁপে উঠছিল শরীর। পাঠের তন্ময়তায় তার শরীরে এমন সাত্ত্বিক বিকার ফুটে উঠছিল, যা সহজে দেখা যায় না। ব্রাহ্মণের পাশে গিয়ে দাঁড়াল গোরা। সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার গীতা পড়ার সঙ্গে মূল গীতার শ্লোক, অর্থের বিশেষ মিল না থাকলেও আপনি কীভাবে এত আবিষ্ট হয়ে আছেন?

নবীন সন্ন্যাসীর অপরূপ সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ব্রাহ্মণ জানাল, প্রভু আমি মূর্খ বামুন। গুরুর আদেশে রোজ সকালে গীতা খুলে পড়তে বসি। গীতার কোন পাতায় কী লেখা আছে না জানলেও বই নিয়ে বসলেই দেখতে পাই, অর্জুনের রথের সারথি কৃষ্ণ ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে মহাবীর তৃতীয় পাণ্ডবকে ধর্মযুদ্ধে নামার উপদেশ দিচ্ছেন। নিজের চোখে তাদের দেখি, তাদের গলার আওয়াজ শুনি, আমার শরীর কাঁপতে থাকে, আনন্দে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। যতক্ষণ পড়ি, দুই মহাত্মাকে সশরীরে দেখতে পাই। পড়া শেষ হলে আমাকে ছেড়ে তারা চলে যায়।

ব্রাহ্মণের কথা শুনে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে গোরা বলেছিল, আপনি ভাগ্যবান, গীতা পড়া আপনাকেই মানায়। গীতার সার অর্থ আপনি বুঝেছেন।

আটদিন, সাত রাত লম্বা পথ হেঁটে বিজয়নগরের রাজধানী বাদামীতে পৌঁছল গোরা। গোরাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে বিজয়নগর রাজসভার পণ্ডিত চক্রপাণি; রাজ্যের প্রধান সড়কগুলোতে রাজকর্মচারীদের পাশাপাশি নিজের টোলের ছাত্রদেরও মজুত রেখেছিল। শহরে কোনও সন্ন্যাসী ঢুকলে সে খবর পৌঁছে যাচ্ছিল চক্রপাণির কাছে। তাদের বিবরণ শুনে চক্রপাণি টের পাচ্ছিল, সন্ন্যাসীদের কেউ নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য নয়। চক্রপাণির ছাত্ররাই শেষপর্যন্ত সনাক্ত করল গোরাকে। ন্যাড়া মাথা, গেরুয়া বসন, বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সটান, দীর্ঘ শরীর সন্ন্যাসীকে দেখে এক লহমায় চিনে নিল সে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ছাড়া কেউ নয়। গোরাকে প্ৰণাম করে নিজেদের পরিচয় দিল তারা। সামান্য দূরে কৃষ্ণা নদী। বিশাল চওড়া নদীর টলটলে জলে নীল আকাশের ছায়া পড়েছে। নদীর ধারে ঝাঁকড়া এক অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় গোরা বসতে ছাত্রদের একজন দৌড়ে গুরু চক্রপাণিকে ডাকতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে বৈদান্তিক সায়নাচার্যকে নিয়ে চক্রপাণি হাজির হল সেখানে। গোরাকে দেখতে, তার পায়ের ধুলো নিতে কিছু মানুষ তখন জড়ো হয়ে গেছে। ঈশ্বরের অবতারের মতো দীর্ঘ শরীর, উজ্জ্বল সোনার মতো রং, অল্পবয়সি সেই সন্ন্যাসীর কাছে রাজ্যের দু’জন খ্যাতিমান পণ্ডিত হাজির হতে তারা বুঝে গেল এই গেরুয়াধারী হেলাফেলার মানুষ নয়, উঁচুদরের সাধক। মুখে মুখে রটতে থাকল বাদামীতে এমন এক সন্ন্যাসী এসেছে, যার দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। বিজয়নগর জুড়ে তখন বাহমনী রাজ্যের একাংশ রায়চুর-দোহার, রাজা কৃষ্ণদেব জয় করে নেওয়ার আনন্দোৎসব চলছিল। কৃষ্ণদেবের বাহিনী বাহমনী সেনাদের তাড়িয়ে তাদের রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছে গেলেও নিজের রাজ্যের নিরাপত্তা বজায় রাখতে সুলতানকে মসনদে বহাল রেখেছিল। রাজ্যের পশ্চিম থেকে বাহমনীরা আর বিজয়নগরে হামলা চালাবে না। সুলতান বরং নিজের রাজ্য ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া বিজাপুর, গোলকোণ্ডা, আহমেদনগর, বিদর ও বেরারের শাসকদের ঠেকাতে সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখলে বিজয়নগরের পশ্চিম সীমান্তে শান্তি অটুট থাকবে। রাজ্যের পশ্চিমে রাজা কৃষ্ণদেবের অভিযানের এই সফলতার পাশাপাশি আরও এক সুখবরে বিজয়নগরের মানুষ খুশিতে টগবগ করছিল। নেলোর জেলার উদয়গিরি দুর্গ অবরোধের পরিকল্পনা সাময়িক বাতিল করে বাহমনী সুলতানের বিরুদ্ধে আচমকা যুদ্ধে কৃষ্ণদেব জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেও সে খবর রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের এক সামন্ত সেনাপতির কাছে পৌঁছয়নি। বিজয়নগরের মূল রাজকীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে দুর্গ অবরোধে নিজের বাহিনী নিয়ে সেনা জোগান দিতে সেখানে পৌঁছে শ্রীকুমমের শাসক প্রায় অরক্ষিত উদয়গিরি দুর্গ অধিকার করে নিল। দুর্গের অধিপতি সমেত মুষ্টিমেয় উৎকল সেনা, রাজা প্রতাপরুদ্রের এক স্ত্রী, ছেলে, কয়েকজন রাজপুরুষ, বলা যায় বিনা প্রতিরোধে বন্দী হল। দুর্গ আক্রমণ আর অবরোধের পরে শ্রীকুমমের শাসক টের পেল সে দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। উৎকল সেনাবাহিনী নিয়ে রাজা প্রতাপ রুদ্র যে কোনও মুহূর্তে সেখানে পৌঁছে গেলে তারা খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। রাজা কৃষ্ণদেবের সাহায্য চেয়ে তাড়াতাড়ি বাদামীতে দু’জন ঘোড়সওয়ার পাঠাল শ্রীকুমমের শাসক। পথের দূরত্ব লম্বা হলেও নিজের সেনাদলের অশ্বারোহী, পদাতিক দু’হাজার যোদ্ধাকে নেলোরে পাঠিয়ে দিল কৃষ্ণদেব। রাজ্যের পশ্চিম আর পুবে একসঙ্গে দুটো যুদ্ধে ঢুকে পড়ার ঘটনাতে কৃষ্ণদেব কিছুটা হতচকিত হলেও ভাগ্যদেবীর প্রসন্নতায় দুটোই জিতে নিল।

রাজধানীতে পা রাখার আগে নিজের বিজয়ী দুই সেনাপতিকে তাদের বাহিনী নিয়ে নেলোরের পথে উদয়গিরি দুর্গ অবরোধে পাঠিয়ে দিয়েছিল রাজা কৃষ্ণদেব। রাজধানী কটকেও উৎকল সেনাদের মধ্যে সাজ সাজ রব উঠেছিল। উদয়গিরি দুর্গের পতনের খবর শুনে উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। রাজপরিবারের কয়েকজন বিজয়নগর রাজ্যের বন্দী, এমন সংকট আগে ঘটেনি, এমন যে ঘটতে পারে, রাজার কল্পনাতে ছিল না। রাজাও জেনে গিয়েছিল বাহমনীর সুলতানের সঙ্গে কৃষ্ণদেবের যুদ্ধ চলছে। পাঁজিপুঁথি দেখে উদয়গিরি অভিযানের দিন প্রতাপরুদ্র যখন ঠিক করছে, বিজয়নগরের কৃষ্ণা নদীর ধারে চক্রপাণি আর সায়নাচার্যকে বুকে টেনে নিয়ে গোরা তখন কৃষ্ণমন্ত্র জপ করে দুই সদ্য পরিচিত বৈদান্তিকের মনে প্রেমভক্তির আবেগ জাগিয়ে দিল। পুরুষোত্তমপুরের বৈদান্তিক সার্বভৌমের লেখা চিঠি পড়ে গোরা সম্পর্কে চক্রপাণির মনে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, সেই কৃষ্ণভক্ত সন্ন্যাসীকে দেখে চক্রপাণি অনুভব করল, সে যা চাইছিল, তা ঘটতে চলেছে। দিব্যদ্যুতিসম্পন্ন এই মানুষটি উৎকলের সঙ্গে বিজয়নগরের বন্ধুত্বের পাকা ভিত তৈরি করে দেবে। দুই রাজ্যের মধ্যে পারিবারিক আত্মীয়তা থাকলেও প্রায়ই তারা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে যায়। দু’রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠলে যুদ্ধের সমস্যা মিটে যেতে পারে। আত্মীয়তার চেয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক বেশি দামি, দু’পক্ষকে সমান সহৃদয় করে, কাছাকাছি আনে। নদীর ধারে গাছতলা থেকে তাড়াতাড়ি সন্ন্যাসীকে সরিয়ে না নিলে জনসমাগম বাড়তে থাকবে, চক্রপাণি বুঝতে পারল। নিজের বাড়িতে গোরাকে আতিথ্যভিক্ষা করতে চক্রপাণি অনুরোধ জানাতে সন্ন্যাসী রাজি হল। বেদের মৌলিক ভাষ্য লেখক সায়নাচার্য বলল, বিজয়নগরের রাজারা শৈবদেবতা বিরূপাক্ষের প্রতিনিধি পরিচয়ে রাজ্য শাসন করলেও রাজা কৃষ্ণদেব সোমনাথের ভক্তিবাদী সাধকদের প্রিয় দেবতা বিঠোবার পুজো করে। ভক্তিবাদে কৃষ্ণদেবের আকুতি দেখে দাক্ষিণাত্যে নতুন করে ভক্তিসাধনার ঢেউ উঠেছে। বিরূপাক্ষের পুজোতে শুরু হয়েছে ভক্তিসঙ্কীর্তন। আপনার দর্শন পেলে রাজা কৃতার্থ হবে। বাহমনী রাজ্য থেকে আজই তার ফিরে আসার কথা

গোরাকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের বাড়িতে পৌঁছে গেল চক্রপাণি। সন্ধের আগে ফের আসার কথা দিয়ে বন্ধু বৈদান্তিক পণ্ডিত মাধবাচার্যের বাড়ির দিকে সায়নাচার্য রওনা হল। কথা প্রসঙ্গে তখনই গোরা জানল, মাধবাচার্যের বাড়িতে অতিথি হয়ে রয়েছে ভক্ত সাধক কবীর। দু’দিন আগে কনৌজ থেকে হাজার ক্লোশ হেঁটে সত্তর বছরের এই পরিব্রাজক ভক্ত বাদামীতে এসেছে। বাদামী ছেড়ে কয়েকদিন বাদে রওনা দেবে রামেশ্বর তীর্থের পথে। সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের সঙ্গে দেখা হলে খুব খুশি হবে কবীর। গোড়াতে সেও ছিল বৈষ্ণব, তার গুরু ছিল ‘শ্রী’ সম্প্রদায়ের রামানন্দ। ভক্ত কবীরের নাম শুনে গোরার শরীরে কাঁপুনি জাগল। সায়নদেবকে করজোড়ে সে বলল, সেই মহাত্মাকে দেখার জন্যে আমি ব্যাকুল হয়ে ছিলাম তাকে আমার প্রণাম জানিয়ে বলবে, তার দর্শন পেলে আমার জীবন সার্থক হবে।

সায়নাচার্য চলে যেতে গোরাকে মুখ হাত ধোবার জল দিয়ে চক্রপাণি ভিক্ষার আয়োজন করল। দুপুরে চক্রপাণির সঙ্গে কৃষ্ণা নদীর ঘাটে স্নান সেরে বাড়ি ফিরে বৈদান্তিকের সংসারে ভিক্ষান্ন নিল। রাজধানীতে অনিন্দ্যসুন্দর তরুণ সন্ন্যাসী আসার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। চক্রপাণির অতিথি, গৌড়ের সন্ন্যাসীকে দেখতে পণ্ডিতের বাড়ির আশপাশে লোক জমতে শুরু করেছে। গোরার সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্যে চক্রপাণি জানাল, বাহমনী রাজ্যের সুলতানের সঙ্গে রাজা কৃষ্ণদেবের যুদ্ধ চলার সময়ে, রাজার অজান্তে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। রাজকীয় বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের গোলমালে বিজয়নগরের এক সামন্ত সেনাপতি উদয়গিরি দুর্গ দখল করে রাজা প্রতাপরুদ্রের এক রানী, ছেলে, আত্মীয়পরিজন সমেত অনেক সৈন্যকে বন্দী করে ফেলেছে। দু’রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরির পরিবেশে এ এক নতুন অশান্তি। আমাদের সৌভাগ্য, এই জটিল পরিস্থিতিতে আপনি এসে গেছেন। আপনার করুণাময় ইষ্টদেবতা বোধহয় এখানে পাঠিয়েছেন আপনাকে। আমার বিশ্বাস দুর্যোগ কেটে যাবে।

কৃষ্ণনাম জপ করলেও গোরা শুনছিল চক্রপাণির কথা। জপের থলি থেকে হাত বার করে বরাভয়ের মতো লম্বা দু’হাত মাথার ওপর অর্ধনমিতভাবে তুলে সে হাসল। চক্রপাণির মনে হল মানুষটার হাসি থেকে আলো ঝরে পড়ল, জুড়িয়ে গেল তার মন। দিনের আলো নিভে যাওয়ার আগে কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে বিশাল জাঁকজমকের শোভাযাত্রার মাঝখানে হাতির পিঠে সোনার রাজছত্র লাগানো, কারুকাজ করা মসলিনের হাওদায় বসে রাজা কৃষ্ণদেব বাদামীতে ফিরল। চক্রবাণির বাড়িতে তখন রাজসভার তিন পণ্ডিতের সঙ্গে দুই ভক্তসাধকের প্রেমধর্ম নিয়ে নিবিড় যে আলোচনা চলছিল, বৈদান্তিক পণ্ডিতরা তার আক্ষরিক অর্থ বুঝলেও সংলাপের প্রচ্ছন্ন অংশের রহস্য দুই অতীন্দ্রিয়বাদী সন্ন্যাসী শুধু ধরতে পারছিল। চক্রপাণির ঘরে ঢুকে গোরার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল বৃদ্ধ সাধক কবীর শ্রী ধর্মসম্প্রদায়ের গুরু রামানুজের শিষ্য রামানন্দের কাছে ভক্তিবাদে দীক্ষিত হলেও কবীর এখন একেশ্বরবাদী, মূর্তিপূজা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বিরোধী, সমন্বয়বাদী, এক ধর্ম, এক জাতি, এক প্রাণ তত্ত্বের প্রচারক। উদাত্ত গলায় স্বরচিত যে দোহাটি কবীর উচ্চারণ করল, তা শুনে গোরার দু’চোখে জল এসে গিয়েছিল। দোহাটি এরকম, ‘ঈশ্বর যদি মসজিদে আর রাম যদি পাথরের মূর্তিতে থাকে, তবে বাইরের জগতের খবরাখবর কে রাখবে? হরি আছে পূর্বে, আল্লা আছে পশ্চিমে, তুমি তোমার বুকের ভেতরে খোঁজ নিলে দেখবে করিম (ইসলামে আল্লার অন্য নাম করিম) আর রাম দু’জনই সেখানে রয়েছে, সেই এক পরমেশ্বর আগলে রেখেছে পৃথিবীর সব মেয়ে-পুরুষকে। আল্লা আর রামের সন্তান এই কবীর, দুই-এ মিলে এক, আমার গুরু, আমার পীর।’

ভক্ত কবীরের কথা শুনে ভাবাবেশে স্তব্ধ গোরার মনে পড়ছিল বুরহানউদ্দিন দরগার সুফি পীর মুজাভিরকে। সাতবছর আগে শ্রীহট্টে ঠাকুরদা, ঠাকুমা আর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তপন মিশ্রের বাড়িতে উঠেছিল সে। কবীরের নিজের লেখা দোহার মতো কিছু কথা মুজাভিরও শুনিয়েছিল তাকে। মুজাভিরের কথার মধ্যে ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের মিলনের বিবরণ, প্রেমময় সম্পর্কের কাহিনী। গুরু, পীর, সাঁই, মুর্শেদের পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলার পরামর্শ, গরীব দুঃখী মানুষের সঙ্গে অন্ন, জল ভাগ করে খাওয়া, দরকার হলে শরীরের লজ্জা ঢাকতে পোশাক-আশাক আধাআধি করে কাজ চালাতে হবে। মুজাভিরের মুখের সেই প্রসন্নতা, স্নেহ ছড়িয়ে রয়েছে কবীরের মুখে। গোরা বলল, কৃষ্ণ আমার বাপ, সে-ই রাম, সে-ই রহিম।

কথা শেষ করার আগে তার মগজের মধ্যে নামের বিদ্যুৎ চমকে ওঠায় সে বেহুঁশ হয়ে গেল। গোরার দশা দেখে তিন বৈদান্তিক পণ্ডিত ভ্যাবাচাকা খেল। বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে জলের ঘটি নিয়ে এল চক্রপাণি। বেহুঁশ গোরার মুখে যখন সে জলের ঝাপ্টা দিতে যাচ্ছে তাকে থামিয়ে গোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে কৃষ্ণ, রাম, রহিমের নাম জপ করতে থাকল কবীর। কয়েক মুহূর্তে গোরার জ্ঞান ফিরে এল। ঘরের মেঝেতে সে উঠে বসতে তাকে জড়িয়ে ধরে কবীর বলল, হে সাধু, তোমাকে দেখে নতুন করে বুঝলাম, ঈশ্বর মন্দিরে নেই, মসজিদে, কাবাতে, কৈলাসেও নেই, আচার, অনুষ্ঠান, যোগ, ত্যাগ কোথাও নেই, ঈশ্বর আছে প্রাণে, তোমার বুকের মধ্যে, তাকে এখনই দেখতে পেলাম। কবীরের মুখ দুহাতে ধরে তার দিকে তাকিয়েছিল গোরা। তার দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছিল। কবীর বলল, তোমার দর্শন পেলে আর এক মহাত্মা আনন্দে গলে যাবে। তিনিও উচ্চমার্গের সাধক। তাঁর নাম নানক। সুফী সাধকদের সঙ্গে তিনি মক্কা পর্যন্ত দর্শন করে এসেছেন। তোমাদের রাজ্যেও গঙ্গাসাগর পর্যন্ত গেছেন। চারবছর পরে পূর্ণকুম্ভের যোগে, পৌষ সংক্রান্তিতে শিষ্য তেগবাহাদুরকে নিয়ে তিনি প্রয়াগে সাধুসমাগমে যাবেন, তুমি পারলে সেখানে যেও। তোমার মধ্যে আজ যাকে অনুভব করলাম, সব বিশদ করে তাঁকে আমি বলে রাখব। তোমার দর্শন পেতে তিনি হয়তো প্রয়াগে যাবেন। অনেক বয়স হয়েছে আমার। সুযোগ পেলে সাধুসঙ্গ করতে প্রয়াগে তোমাকে দর্শন করতে আমি যেতে পারি। আমার গুরু রামানন্দর জন্মস্থান প্রয়াগ। তার আর এক শিষ্য রবিদাস, সবাই চেনে রুইদাস নামে, সে এখনও সেখানে থাকে। তার চেলাচামুণ্ডার শেষ নেই। জাতধর্ম নিয়ে তাদের কেউ মাথা ঘামায় না, সবাই ‘শ্রী’। সবাই সুন্দর, ঈশ্বর পরমসুন্দর। সবাইকে মনেপ্রাণে সমান সুন্দর, শ্রীমণ্ডিত হতে হবে, এই তাদের ধর্মের গোড়ার কথা

এক মুহূর্ত থেমে কবীর বলল, হে সাধু, তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি, অনেক বড় কাজ মাথায় নিয়ে তুমি পৃথিবীতে এসেছ, তুমিও এক দেবতা, তোমার পায়ের চিহ্ন ধরে হাজার হাজার মানুষ এগিয়ে যাবে। তীর্থযাত্রার পথে একবার পান্ধারপুরে বিঠোবা মন্দিরে গিয়ে নামদেবের অনুরাগী, একনাথের শিষ্য তুকারামের সঙ্গে তুমি দেখা কোরো। তোমার মতো প্রেমিক সাধুর দর্শন পেলে তুকারামের সঙ্গে পান্ধারপুরের মানুষ প্রেমভক্তিতে ভেসে যাবে। তোমার মতো পুণ্যাত্মার সঙ্গে পান্ধারপুর কিম্বা আশপাশের কোনও মন্দিরে কলিযুগের রাধা, মেবারের যুবরানী, ভক্তিমন্ত্রের সাধিকা মীরাবাঈ-এর দেখা হয়ে যেতে পারে। কৃষ্ণপ্রেমী মীরার ভজন শুনে কেঁদে আকুল হয় মানুষ। আমার মতো বুড়োহাবড়া সন্ন্যাসীও চোখের জল সামলাতে পারেনি। বছরে দশমাস যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে থাকে তার শ্বশুর মেবারের রানা মহাবীর সঙ্গ। তৈমুরলঙের নাতি বাবরকে ঠেকাতে রানা সঙ্গ এখন দিল্লি দখল করতে তৈরি হচ্ছে। মেবারের রাজপ্রাসাদ থেকে বিধবা পুত্রবধূ মীরাকে রাজপরিবারের কয়েকজন হঠিয়ে দিয়েছে। তাদের আরও খারাপ মতলব আছে। রানা সঙ্গ এ খবর পেয়েছে কিনা সন্দেহ। রাজপরিবারের মেয়েদের নাচগান করার সুযোগ নেই। রাজপরিবারের মনোরঞ্জনের জন্যে রাজসভার গায়িকা, নর্তকীরা আছে। প্রাসাদ পরিচালকরা মীরার ভজনগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কৃষ্ণপ্রেমী মীরাকে পর্দার আড়ালে রেখে ঠেকানো যায়নি। তোমাকে দেখেও ভক্তিতে সে ভজন গেয়ে উঠবে। সেই সন্ন্যাসিনীর শরীরে তোমার মতো আলো ছড়িয়ে রয়েছে।

কবীরের প্রশস্তি শুনে দু’হাত জুড়ে তাকে নমস্কার করে গোরা বলল, হে মহাত্মা, আমি শুধু ভক্ত নই, সব ভক্তসাধকের আমি দাস। তার বিনয় দেখে কবীরের সঙ্গে তিন বৈদান্তিক খুশিতে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বলে উঠতে গোরা ভাবাবেশে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাথার ওপর দু’হাত তুলে বিভাস রাগে ভাগবতের একটা শ্লোক, গোরা গেয়ে উঠল—ন দানং ন তপো নেজ্যা ন শৌচং ন ব্রতানি চ। প্রীতয়েহমলয়া ভক্ত্যা হরিরন্যদ্ বিড়ম্বনম।।’ তার নাচ আর গানের টানে তিন বৈদান্তিক আর ভক্ত কবীর দাঁড়িয়ে উঠে গলা মেলাল। দান, ধ্যান, তপস্যার চেয়ে ভক্তি যে বেশি প্রীতিদায়ী, ভাগবতের এই শ্লোক তিন বৈদান্তিক আর কবীরের অজানা নয়। ভাঙা সংস্কৃতে এতক্ষণ কথা বললেও ভাগবতের বিশুদ্ধ সংস্কৃত শ্লোকের টানে বিভাস রাগে প্রাণের স্ফূর্তিতে সঙ্কীর্তনে তারা মেতে উঠল। রাতের প্রথম প্রহর শেষ হয়নি। ভোরের সূর্যের মতো উজ্জ্বল এক অল্পবয়সি সন্ন্যাসীকে দেখতে সন্ধের পর থেকে চক্রপাণির বাড়ির সদরের সামনে কিছু ধর্মভীরু মানুষ জড়ো হয়েছিল। বাড়ির ভেতর থেকে সঙ্কীর্তনের সুর ভেসে আসতে তাদের কেউ কেউ বিভাস রাগে জুড়ে দিল নিজেদের কণ্ঠস্বর। বাড়ির ভেতরে তাদের সুরেলা গলার ঢেউ পৌঁছে যেতে ভাবাবেগে গৃহকর্তাকে না বলে কবীর নিজে গিয়ে বন্ধ সদর দরজা খুলে দিল। কবীরকে দেখে বাইরের জনসমাবেশ আনন্দে মেতে উঠলেও চক্রপাণির বাড়ির ভেতরে কেউ ঢুকল না। কয়েক পা এগিয়ে এসে হাট করে খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তারা দেখল, তাদের চেনা তিন পণ্ডিত আত্মহারা হয়ে এক অনিন্দ্যসুন্দর সন্ন্যাসীর সঙ্গে নাচছে। রাস্তায় দাঁড়ানো ভিড়ের প্রায় সবাই সঙ্কীর্তনে গলা মেলাল। সঙ্কীর্তনের মধ্যে ভাবাবেশে গোরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে তাকে ধরে সযত্নে শুইয়ে দিল চক্রপাণি।

রাতের দ্বিতীয় প্রহর তখন শুরু হয়ে গেছে। সদর দরজার সামনে এসে বাদামীর মানুষদের নিশ্চিন্তে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে কপাট এঁটে দিল চক্রপাণি। গোরাকে জাগানোর উপায় সে আগেই জেনে গিয়েছিল। বেহুঁশ গোরার কানের কাছে মুখ এনে ভাগবতের দুটো শ্লোক সে ধীরে ধীরে আবৃত্তি করতে সমাহিত গোরার শরীর কেঁপে উঠল। চোখ খুলে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সে উঠে বসল। কবীর আর তিন বৈদান্তিকের দিকে তাকিয়ে সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, আপনাদের বোধহয় বিব্রত করলাম। আমার মাথার মধ্যে সঙ্কীর্তনের সুর ঢুকলে আমি বেহুঁশ হয়ে যাই। এটা আমার একটা রোগ। আপনারা আমায় মাপ করবেন।

সঙ্কীর্তনের সময়ে গোরার দু’চোখ দিয়ে যে পরিমাণ জল ঝরেছে, তা তখনও শুকোয়নি। বিস্ময়ভরা চোখে তাকে দেখছে কবীর। কত দেশ দেশান্তরে সে সাধুসঙ্গ করেছে, কোথাও এমন ভক্তিমান সাধক চোখে পড়েনি। ভক্তির সমুদ্রে ব্রত্নকমলের মতো সারাক্ষণ ডুবে রয়েছে এই সন্ন্যাসী শুধু নিজের হৃদয়ের মধ্যে নয়, যেখানে চোখ পড়ছে, সেখানে কৃষ্ণকে দেখছে। তার মুখের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠছে দিব্য আনন্দ! ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার দায় এই সন্ন্যাসীই নিতে পারে, কবীর মেনে নিল। গোরার সহযোগী হয়ে ধর্মরাজ্য গড়ার কাজে অনুগামীদের লাগিয়ে দিতে প্রবল উদ্দীপনায় রাজি হয়ে গেল। শুধু একটা শর্ত রাখল, ধর্মরাজ্যে দীন, অধম, ম্লেচ্ছ, যবন সব মানুষের যেন সমান মর্যাদা থাকে।

গোরা বলল, প্রেমভক্তির পথে ব্রাহ্মণ, শূদ্রে ভেদাভেদ নেই। কলিযুগে সব শূদ্রই ব্রাক্ষ্মণ, ব্রাহ্মণের মতো প্রণম্য।

গোরার কথা শুনে তিন বৈদান্তিক পণ্ডিত চমকে গেলেও তাদের মুখের কথা সরল না। কবীর দু’হাত বাড়িয়ে গোরাকে বুকে টেনে নিল। কবীরকে নিয়ে মাধবাচার্য বাড়ির পথে রওনা হওয়ার পরে আরও দু’দণ্ড গোরার সঙ্গে আলাপচারিতায় চক্রপাণির পাশে সায়নাচার্য থেকে গেল। চক্রপাণির কাছে গোরা শুনল বিজয়নগর রাজ্যের সেনাবাহিনী উদয়পুর দুর্গ দখল করে নিতে রাজা প্রতাপরুদ্রের এক রানী, রাজপুত্র, রাজপরিবারের কয়েকজন বন্দি হয়ে রয়েছে। দু’রাজ্যের মধ্যে এখনই শান্তিচুক্তি না হলে দু’জায়গার হতদরিদ্র প্রজারা নিদারুণ দুর্ভোগে পড়বে। গোরা হাসল, বলল, যুদ্ধ হবে না, প্রেমভক্তির স্রোতে ভেসে যাবে দু’রাজ্যের মানুষ।

গোরার পরামর্শে পরের দিন সন্ধেতে বিরূপাক্ষ মন্দিরের চাতালে যে সঙ্কীর্তনের আসর বসল, সেখানে বাদামীর প্রজাদের সঙ্গে রাজকীয় হর্মের মধ্যে সপরিবারে রাজা কৃষ্ণদেব, আলাদা অলিন্দে পরিবারবর্গ নিয়ে মন্ত্রী, অমাত্যরা হাজির হল। বিরূপাক্ষের সন্ধ্যারতি শেষ হতে সঙ্কীর্তনীয়াদের মৃদঙ্গ, করতাল, মন্দিরা, কাঁশিতে ‘আলাপি আলাপি রাগ মূর্তিমন্ত’ হয়ে উঠল। গুর্জরী রাগে গোরা সঙ্কীর্তন শুরু করার আগে তার গেরুয়াজড়ানো চন্দন-চর্চিত সুদীর্ঘ, সোনালি শরীর ভাবাবেশে বাঁশপাতার মতো কাঁপছিল। হৃদয়মথিত করা প্রেমের আবেসঘন সেই মানুষটার দিকে রাজপরিবারের মেয়ে, বউরা যেমন পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকল, তার চেয়ে বেশি অবাক হল রাজা কৃষ্ণদেব আর তার অমাত্যরা। শ্বেতাঙ্গ, পর্তুগিজ বণিক আলবুকের্ক, যাকে কোঙ্কণে বাণিজ্যকুঠি করার অনুমতি দিয়েছে রাজা, তার চেয়ে গৌড়ের সন্ন্যাসী শুধু লম্বা, চওড়া নয়, তার গায়ের রংও বেশি উজ্জ্বল। চেহারা, গায়ের রং, চালচলন দেখে তাকে দূর সমুদ্রের পারে অচেনা কোনও দেশের মানুষ মনে হয়। পর্তুগিজ আলবুকের্কের উপাসনা গৃহের প্রভুর মূর্তির সঙ্গে গৌড়ের সন্ন্যাসীর এত আশ্চর্য মিল দেখে কৃষ্ণদেব স্তম্ভিত হল। এমন হয় কী করে? আলবুকের্কের কারসাজি নয় তো? আলবুকের্ক শুধু ব্যবসায়ী নয়, পাকা গোলন্দাজ। বাহমনী সুলতান ফিরুজ শাহের সঙ্গে বিজয়নগর সেনাবাহিনীর গোলন্দাজদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল আলবুকের্ক। তার পরামর্শে বিজয়নগরের গোলন্দাজরা গোলাবারুদ বানাতে শিখেছে। ফিরুজকে শায়েস্তা করতে এবার যুদ্ধে গোলন্দাজরা যে মুখ্য ভূমিকা নিতে পেরেছিল তার কারণ আলবুকের্কের প্রশিক্ষণ। আলবুকের্ক ধার্মিকও বটে। রাজার অনুমতি নিয়ে বাদামীতে সে একটা গির্জা বানিয়েছে। বাণিজ্যকুঠির সঙ্গীদের নিয়ে ফি রবিবার সেখানে সে প্রার্থনা করতে যায়। কয়েকজন ধর্মযাজক এনেছে দেশ থেকে। তাদের মধ্যে দু’জন মহিলা যাজক। কুঠিবাড়িতে কিছু পর্তুগিজ বণিক, সস্ত্রীক থাকে। বউ নিয়ে হাজার হাজার ক্রোশ সমুদ্র পার হয়ে যারা ব্যবসা করতে এসেছে, তারা যে বীরের জাতি, এ নিয়ে রাজার সন্দেহ নেই। আলবুকের্কের তৈরি গির্জা রাজা দেখে এসেছে। গির্জার ভেতরে বেদির ওপর কাঁটার মুকুট পরা, শলাকাবিদ্ধ ঈশার রক্তাক্ত মূর্তি রয়েছে। ঈশাকে তারা ঈশ্বরের সন্তান মনে করে। ঈশার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ভজনা করে। ঈশাভক্তদের স্থানীয় মানুষ ‘ভট্টমারি’ বলে। তাদের সংশ্রব যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। রাজাও সাবধানী, তাদের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করেছে।

গোরাকে দেখে রাজার মাথায় যখন নানা চিন্তা তালগোল পাকাচ্ছে, সঙ্কীর্তনের আসর তখন জমে উঠেছে। কীর্তনের ভাষা সবাই না বুঝলেও গোরার ভাবাবিষ্ট নাচ আর রাসলীলা পর্যায়ের কীর্তনের রসে আসর ভেসে যাচ্ছিল। রাসলীলার সমৃদ্ধিমান মিলন পর্যায়ে মাতন জাগতে দেরি নেই। রাজার মাথা থেকে উবে গিয়েছিল যুদ্ধঙ্কা, রাজ্য, সাম্রাজ্য, জয়-পরাজয় চিন্তা। গোরার শরীর থেকে উথলে পড়া আলোতে রাজার দৃষ্টিবিভ্রম ঘটছিল, অলৌকিক নানা ছবি দেখছিল সে। তার চোখের সামনে রাসের মিলন আর মানুষ, দেশকালের প্রবাহ একাকার হয়ে গেল। গৌড়ের সন্ন্যাসীকে রাজার মনে হল দেবদূত। চক্রপাণির মুখে পুরুষোত্তমপুর থেকে মৈত্রীর প্রস্তাব নিয়ে এক সন্ন্যাসী আসছে শুনে কৃষ্ণদেবের মনে হয়েছিল সন্ন্যাসীটি রাজা প্রতাপরুদ্রের একজন ভেকধারী পোষ্য ছাড়া কিছু নয়। গোরাকে দেখে রাজার ভুল ভাঙল, অপরাধী মনে হল নিজেকে, প্রায়শ্চিত্ত করতে সন্ন্যাসীর মার্জনা চাওয়ার আন্তরিক ইচ্ছে জাগল। সঙ্কীর্তনে মুগ্ধ আসর-ভর্তি মানুষ আনন্দে চোখের জলে ভাসছে। আশপাশে পরিবারের মেয়ে-বউদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনল কৃষ্ণদেব। মন্দিরের হর্ম্য ছেড়ে আসরের শ্রোতাদের মধ্যে মিশে যেতে ইচ্ছে করলেও ভাবাবিষ্ট সন্ন্যাসীর তন্ময়তা নষ্ট হওয়ার চিন্তায় রাজা নড়তে পারল না। রাতের তৃতীয় প্রহরের শেষে রাসলীলার শেষে মাথুরলীলার বিলাপ সঙ্কীর্তন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে গোরা বেহুঁশ হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ল। আসরের মেঝেতে সে আছড়ে পড়ার আগে এরকম কিছু ঘটতে পারে অনুমান করে তাকে ঘিরে রেখেছিল চক্রপাণি, মাধবাচার্য, সায়নাচার্য আরও কয়েকজন অনুরাগী মানুষ। গোরার শরীর চাতালে লুটিয়ে পড়ার আগে তাকে ধরে সযত্নে জাজিমের ওপর সঙ্গীরা শুইয়ে দিল। শেষ হল সঙ্কীর্তনের আসর। অচেনা বাংলাভাষায় লেখা কীর্তনের ধুয়ো শ্রোতাদের অজানা নয়। হাজার হাজার বছর ধরে ষোলোটি শব্দে, বত্রিশ অক্ষরের ধুয়ো তারা শুনে এসেছে। সেই ধুয়ো নিচু গলায় অনেকে তখনও গুনগুন করছিল।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।

আপন-মনে যারা নামভজনা করছিল, আর যাদের কানে সেই ধুয়ো ঢুকছিল, তাদের সকলের চোখে জল, মুখে প্রসন্নতা। গৌড়ের সন্ন্যাসী কৃচৈতন্যকে স্বয়ং কৃষ্ণ ভাবছিল কেউ কেউ।

চক্রপাণির আতিথ্যভিক্ষা করে তার বাড়িতে গোরা চারদিন থাকল। আলবুকের্কের তৈরি গির্জা এক সকালে তাকে দেখাতে নিয়ে গেল চক্রপাণি। রঙিন কাচ লাগানো ভট্টমারিদের উপাসনাগৃহ, সেখানে দেওয়ালে ঢালাই করা চৌকো পাথরের ফলকে লোহার নালে আটকানো তাদের প্রভু ঈশার রক্তমাখা শরীরের ভাস্কর্য দেখে প্রেমভক্তিতে গোরা কাঁদতে লাগল। গলায় লাগল সুর, শুরু করল সঙ্কীর্তন। পর্তুগিজ আলবুকের্ক, তার দেশীয় সহকর্মীরা, তাদের পরিবারের মেয়েপুরুষ, এমনকি সমুদ্রপাড়ি দিয়ে আসা ধর্মযাজকরা পর্যন্ত গোরার ভাববিহ্বল নাচগানে সেন্ট জন, সেন্ট পিটারের কণ্ঠধ্বনি আর আকুলতা শুনতে পেল। গোরাকে প্ৰথম দেখেই আলবুকের্ক সমেত পর্তুগিজ মেয়ে-পুরুষ সবাই অভিভূত হয়ে ভাবছিল, ন্যাড়া মাথা, বিশাল শরীর, শ্বেতাঙ্গ, এই মানুষটি কোনও যুক্তিতে ভারতীয় হতে পারে না। নিশ্চয়ই পর্তুগালে এই সন্ন্যাসীর জন্মভূমি। পর্তুগালের বদলে স্পেন, জার্মানি, গ্রিস হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাথায় লম্বা চুল, দাড়ি থাকলে এই সন্ন্যাসীকে অনায়াসে ঈশ্বরের সন্তান জেসাস্ ক্রাইস্ট হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত। রক্তাক্ত ঈশার মুখের দিকে বেদনার্ত চোখে গোরা তাকিয়েছিল। দরদর করে জল ঝরছিল তার দু’চোখ থেকে। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর জন্যে কোনও ভারতীয় সন্ন্যাসীকে আলবুকের্ক এভাবে আগে কাঁদতে দেখেনি। ঈশার পুরো নাম একটা ভূর্জপাতায় সংস্কৃতে চক্রপাণিকে লিখে দিতে বলল গোরা। দেবনাগরী হরফের তখনও জন্ম হয়নি। আলবুকের্ক অল্পস্বল্প সংস্কৃত শিখেছিল, সে লিখে দিল, জেসাস্ ক্রাইস্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *