গোরা – ১৮

১৮

গোরার জন্মের আগে থেকে গৌড় জুড়ে ধর্মান্তরের যে হিড়িক চলছিল, তার মধ্যে কিছু উল্টোরকম ঘটনাও ছিল। গোরার জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে নবদ্বীপের কাজীর অনুচর, দুই কোটাল জগাই-মাধাইকে নিয়ে পাষণ্ডিরা যখন শ্রীবাস পণ্ডিতের বসতবাড়ি সারারাত প্রেমসঙ্গীতের আড়ম্বর ও আরও নানা অনাচার করার অভিযোগে পুড়িয়ে দিল, তার কিছুকাল পরে রাঢ় অঞ্চল, বনগ্রামের মহলপতি রামচন্দ্র খাঁ এক রাতে এক দেহোপজীবিনী হীরাকে লেলিয়ে দিল পরমবৈষ্ণব হরিদাসকে লালসার জালে জড়িয়ে কলঙ্ক রটাতে। শিরোপা মহলপতি, বড় জমিদার হলেও রামচন্দ্র তখন তল্লাটের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অধিপতি, সুলতান হোসেন শাহের অনুগত আমীর। মুলুকপতির অত্যাচারে জন্মভূমি যশোর জেলার বৃঢ়ন গ্রাম ছেড়ে বনগ্রামের উপান্তে, ভাটকলাগাছি গ্রামে নির্জন জঙ্গলের ধারে তালপাতার ঝুপড়ি বানিয়ে সাধনভজন করত হরিদাস। ভাটকলাগাছিতে তার এসে পৌঁছানো এক ইতিহাস। রায়মঙ্গল নদীর স্রোতে যশোর থেকে তার অচেতন শরীর ভাটকলাগাছির চড়ায় এসে আটকে গিয়েছিল। গাঁয়ের মানুষ অচেনা শবদেহ দেখে কাছে গিয়ে নজর করল, মৃতের ঠোঁট নড়ছে। তারা প্রথমে প্রেত ভেবে ভয় পেয়ে গেলেও সাহস সঞ্চয় করে অচেনা মানুষটার মুখের কাছে একজন কান এনে শুনল ‘কৃষ্ণ’ নাম জপ করে চলেছে সে। তারা অবাক হলেও তাদের চোখের সামনে মানুষটা সোজা হয়ে বসল। ভাটকলাগাছিবাসীদের অনুরোধে সেখানে থেকে গেল হরিদাস। জন্ম থেকে মা-বাপ হারানো অনাথ হরিদাসের প্রতিপালন করেছিল বুঢ়ন গ্রামের এক মুসলিম পরিবার। জন্মসূত্রে হিন্দু দম্পতি উজ্জ্বলা আর মনোহরের সন্তান হলেও সে হয়ে গেল ‘যবন হরিদাস’। হরিদাসের শৈশবে তার বাবা মনোহর মারা যেতে তার সঙ্গে একই চিতায় সহমরণে উজ্জ্বলা পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। চিতার অল্প দূরে ঘুমন্ত শিশুকে মাটিতে রেখে উজ্জ্বলা সহমৃতা হতে এক মুসলিম জননী বুকে তুলে নিয়েছিল অনাথ শিশুকে। হরিদাসের ধর্মান্তর, সেই সঙ্গে নামের বদল হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও শিশুকাল থেকে কোরাণ-হাদিস পড়ার সঙ্গে সে যে হরিভক্ত হয়ে উঠেছিল, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। মা-বাবাকে হারালেও পিতৃমাতৃকুলের কোনও স্নেহশীল আত্মীয় হয়তো হরিদাসকে হরিনাম জপ করতে শিখিয়েছিল। নামজপে বিভোর হয়ে শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে হরিদাস যখন যৌবনে পৌঁছেছে, যশোরের মুলুকপতির কাছে খবর গেল বুঢ়ন গ্রামের এক যবন সন্তান কাফেরদের মতো সাধনভজন করে ইসলামের বদনাম ছড়াচ্ছে। হরিদাসকে যথোচিত শিক্ষা দিতে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাইক, বরকন্দাজ পাঠাল মুলুকপতি। রাজরোষ থেকে হরিদাসকে বাঁচাতে তার পালক মা-বাবা পাইক, বরকন্দাজবাহিনীর পায়ে পড়ে কাকুতি মিনতি করেও ছেলেকে নিজেদের ঘরে রাখতে পারল না। হরিদাসকে পিছমোড়া করে বেঁধে মুলুকপতির সামনে পাইকরা হাজির করে দিল। বন্দি হওয়ার আগে থেকে হরিদাস যেভাবে হরিনাম জপ করছিল, মাঝখানে নানা ঘটনাতেও যা থামেনি, মুলুকপতির দরবারে পৌঁছে তা অব্যাহত ছিল। তার দু’ঠোঁট থেকে স্রোতের মতো বয়ে চলেছিল নামজপ। তাকে থামিয়ে মুলুকপতি জানতে চেয়েছিল, সে কেন বিধর্মীদের মতো আচরণ করছে? তার কি প্রাণের ভয় নেই?

হরিদাস বলেছিল, সে আল্লার বান্দা, সে আল্লার নামই জপ করছে, হরি আর আল্লাতে কোনও ভেদ নেই। দু’জনেই পরমপুরুষ, দু’য়ে মিলে এক।

তার জবাব শুনে মুলুকপতি খুশি হয়ে তাকে মুক্তি দিতে চাইলেও মন্ত্রী গোরাই কাজী, মুলুকের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার কারণ দেখিয়ে হরিদাসকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে চাইল। বাইশটা বাজার ঘুরিয়ে জনসমক্ষে চাবুক মেরে তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইল মন্ত্ৰী। মুলুকপতিকে মন্ত্রী বোঝাল, হরিদাসের মতো কাফের-দেবতার বন্দনাকারীকে বাঁচিয়ে রাখলে আল্লার রাজ্যে সমূহ সর্বনাশ ঘটবে। আমাদের ধর্মের অপমান হবে। মন্ত্রীর যুক্তিতে সায় দিয়ে মুলুকপতি মৃত্যুদণ্ড দিল হরিদাসকে। সাধারণ মানুষের সামনে এই দণ্ডকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরতে জেলার বাইশটি বাজারে লোকসমক্ষে চাবুক মেরে হরিদাসের প্রাণনাশের পরিকল্পনা করা হল। শাস্তির খবর ঢেঁড়া পিটিয়ে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে দেওয়ায় বাজারে লোক জমায়েত হল প্রচুর। তার আগে হরিদাসের সঙ্গে স্বয়ং গোরাই কাজী দেখা করে তাকে শেষবার জানাল, প্রাণে বাঁচতে হলে হরিদাসকে এখনই হরিনাম জপ ছেড়ে কলমা পড়তে হবে। সে রাজি থাকলে প্রাণে বাঁচবে। মুলুকপতির অধীনে সরকারি চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

সবিনয়ে হরিদাস জানাল নামজপ বন্ধ রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। পাইকরা তখনই হরিদাসকে তুলে বাজারে নিয়ে গিয়ে বেত্রাঘাত পর্ব শুরু করল। হরিদাসের পিঠে শুরু হল বেত মারা। রাস্তায় দুর্বৃত্তদের হাতে আক্রান্ত বউ, ছেলে-মেয়েকে বাঁচাতে একজন পুরুষের ওপর যত নির্দয় অত্যাচার হোক, তা যেমন নিঃশব্দে সহ্য করে, প্রাণের চেয়ে প্রিয় নামজপ, যা চিরকুমার হরিদাসের কাছে সংসার, সন্তানের চেয়ে অধিকতর ভালোবাসার সম্পদ, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে সে তা সহ্য করতে লাগল। আঁকড়ে থাকল নামজপ। রক্তে পিঠ ভেসে গেলেও নামজপ থামাল না। একের পর এক বাজারে, অসংখ্য মানুষের সামনে চলতে থাকল নৃশংস প্রহার। হরিদাস ভাবছিল, মুলুকপতির কোটালরা কেন অকারণে তাকে পেটাচ্ছে, কষ্ট দিচ্ছে? সে তো কারও ক্ষতি করেনি, মানুষের ক্ষতি করার চিন্তা মুহূর্তের জন্যেও তার মাথায় আসে না। তবে কেন এত নিষ্ঠুরতা? কোটালরা নিশ্চয় জানে না, তারা অবিচার করছে। অবিচারকারীদের জন্যে তার মনে সহানুভূতির ঢেউ উঠল। নামজপের সঙ্গে শ্রীহরির কাছে প্রহারকারীদের জন্যে মঙ্গল কামনা করল। সরল, নিরপরাধ মানুষগুলোর অপরাধ ঈশ্বর যেন ক্ষমা করেন।

তাকে বিড়বিড় করে কিছু বলতে শুনে এক কোটাল ভাবল, যন্ত্রণায় জল খেতে চাইছে সে। কোটাল খেঁকিয়ে উঠে জানাল, জল দেওয়ার হুকুম নেই। স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠল হরিদাসের মুখে। সে জানাল, তার জলের প্রয়োজন নেই। ঈশ্বরের কাছে তাদের জন্যে মঙ্গল কামনা করছে সে।

কথাটা শুনে প্রহারকারীদের কেউ কেউ চমকে গেলেও মন্ত্রীর হুকুম অমান্য করার উপায় তাদের ছিল না। হরিদাসের মৃত্যু পর্যন্ত নির্যাতনের হুকুম পালন করতে তাকে নিয়ে এক বাজার ছেড়ে অন্য বাজারে তারা ঘুরতে থাকল। হরিদাসের নির্যাতন দেখে ভিড়ের মধ্যে অনেকে কাঁদছিল। দু’একজন সভয়ে রাজকর্মচারীদের কাছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার প্রার্থনা জানাচ্ছিল। রাজ আজ্ঞা পাথরের মতো কঠিন, তা গলে যায় না। অশেষ নির্যাতনের মধ্যেও হরিদাসের নামজপ থামেনি। মাঝে মাঝে ঈশ্বরের কাছে নির্যাতকদের জন্যে সে প্রার্থনা করছিল। অবুঝ আঘাতকারীরা যাতে শ্রীহরির ক্ষমা থেকে বঞ্চিত না হয়, তার জন্যে কাতর গলায় সর্বশক্তিমান ইষ্টদেবতার কাছে ভিক্ষা চাইছিল। তার প্রার্থনার কথাগুলো কোটালবাহিনী আর জনতার কানে পৌঁছোতে তাদের মনে নানা ভাবের আলোড়ন উঠলেও দণ্ডদাতারা গম্ভীর হয়ে রইল। সেটাই নিয়ম। দণ্ডদাতার সঙ্গে দণ্ডিতের নিয়মের তফাত হয়। সাধারণ মানুষের দু’চোখ থেকে যেমন অঝোরে জল পড়ছিল, তেমনি ক্লান্তিতে বেত্রাঘাতকারীদের হাতের মুঠো শিথিল হয়ে বেত খসে পড়ার উপক্রম হল। হরিদাস মানুষ, না অন্য কিছু তারা ভেবে পাচ্ছিল না। ক্রমশ হরিদাসের চেতনা লুপ্ত হচ্ছিল, শ্বাস বন্ধ করে নিজেকে শ্রীহরির কাছে সে সমর্পণ করল। তার নিশ্চেতন, নিস্পন্দ দশা দেখে তাকে মৃত ঘোষণা করে, সর্দার কোটাল রায়মঙ্গল নদীর জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিল। কঠিন শাস্তির মধ্যে ধ্যানস্থ হয়ে প্রাণায়ামের যে সর্বোচ্চ স্তরে হরিদাস পৌঁছে গিয়েছিল, তা বস্তুজগতের ঘটনাক্রম থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এই অবস্থাতে একজন সাধক স্থূল শরীরের জীবন, মৃত্যু পর্যন্ত অগ্রাহ্য করতে পারে। আঘাত, অভিঘাত, এমন কি জীবন আর মৃত্যু, কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। রক্তমাংসের শরীর ঘিরে তৈরি হয় দ্বিতীয় এক শরীর, যা বর্মের কাজ করে। হরিদাসের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। হরিদাস নিজেও জানত না, সাধনার এই সমুন্নত মার্গে সে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ভাটকলাগাছি গ্রামের সহৃদয় মানুষের সাহচর্য পেয়ে সেখানে থেকে গেল সে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে হরিদাস জানল যা শুদ্ধ পবিত্র, তাই ঈশ্বর, তিনি শ্রীহরি, তিনিই তার এবং পালিকা মায়ের পরম শ্রদ্ধেয় আল্লা। শ্রীহরি, আল্লা কোন বেহেস্তে থাকেন, সেই ঠিকানা তার জানা না থাকলেও তাঁদের পবিত্রতা, শুদ্ধতা প্রতিদিনের জীবনে মিশে আছে, মানুষ ইচ্ছে করলে সে সবের অধিকারী হতে পারে, সে অনুভব করল। গাঁয়ের শেষ প্রান্তে, বনাঞ্চলের গা ঘেঁষে যে পর্ণকুটিরে সে বাসা করল, সেখানে মানুষজন বিশেষ আসত না। কুটিরের মধ্যে মাটির বেদি বানিয়ে, সেখানে তুলসীগাছ লাগাল হরিদাস। চন্দনমাটি জোগাড় করে বেদিতে অলকাতিলকা এঁকে নয়নসুখকর করল তুলসীমঞ্চ। তার বয়স তখন ত্রিশ-বত্রিশ, সুপুরুষ ছিল সে। মুসলিম হয়েও সে ‘হরিভজা’, ‘কৃষ্ণ’ নামে পাগল, হরি আর কৃষ্ণের একত্বে বিশ্বাসী। যশোরের সাধারণ মানুষ তার নাম দিয়েছিল ‘যবন হরিদাস’। শূদ্র, ম্লেচ্ছ, হিন্দু, মুসলিম, সব সম্প্রদায়ের মানুষ ভালোবাসত তাকে। ধার্মিক মানুষটার সুযশ মুখে মুখে ছড়িয়ে যশোরের বাইরে বনগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। জন্মভূমি যশোরের বূঢ়ন গ্রাম ছেড়ে ভাটকলাগাছিতে হরিদাস তখন আস্তানা পেতেছে। সকাল, সন্ধে দু’বার তুলসীগাছের গোড়ায় জল ছিটিয়ে তুলসী সেবা করে। রাতে আর দিনে, রোজ তিনলক্ষ বার হরিনাম জপ না করে অন্নজল ছোঁয় না। ক্ষুৎপিপাসা মেটাতে বনের বাইরে ভিক্ষে করতে যায়। সুপুরুষ হলেও সারা দেহে কৃচ্ছ্রের ছাপ, মুখে প্রসন্নতা। তাকে দেখলে গৃহস্থের মন আনন্দে ভরে যায়। দরজায় দরজায় ঘুরে যা ভিক্ষে জোটে, তা দিয়ে সাত, দশ দিন একান্নভোজী সাধকের প্রয়োজন মিটে যায়। যবন হরিদাসের ঝুলিতে ভিক্ষে দিতে হিন্দু, মুসলিম, দু’সম্প্রদায়ের মানুষ হাত বাড়িয়ে থাকে। জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে যায়, সেই কাঠুরে, মধুসংগ্রহকারীরা প্রায়ই ফেরার পথে তাকে চুলো জ্বালানোর কাঠ, মধু দিয়ে যায়। জাতধর্ম নির্বিশেষে সকলের দান কৃতার্থ চিত্তে হরিদাস গ্রহণ করে। বনগ্রাম জুড়ে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়তে, সেখানকার মহলদার রামচন্দ্র খানের কানে খবরটা গেল। তার টনক নড়ল। তার মহলে এমন একজন লোক বাস করে যে একই সঙ্গে ‘যবন’ আর ‘হরিদাস’, লোকের মুখে মুখে ঘুরছে তার গুণগান অথচ সে মহলপতি হয়ে খবর পায়নি, এ কেমন কথা? পরিস্থিতি দেখে রামচন্দ্রের মনে হল, তার চেয়ে মহলের প্রজারা ভিনদেশি সেই ভিখিরিকে বেশি শ্রদ্ধা ভক্তি করে। কুপিত মহলপতি তখনই হরিদাস সম্পর্কে খবর জোগাড় করতে চর লাগিয়ে দিল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চর এসে জানাল সুদর্শন, ধার্মিক সেই মানুষটার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কাহিনী, সত্যমিথ্যে মেশানো তার কীর্তিকলাপ। মাথা গরম হয়ে গেল রামচন্দ্র খানের। হরিদাসকে জব্দ করার নানা উপায় ভাবতে থাকল। সাধক, সন্ন্যাসীর সর্বনাশ করার সবচেয়ে সেরা উপায় হল, জনসমক্ষে তাকে ভণ্ড প্রমাণ করা। হরিদাসকে এমন অপমান করা দরকার, যাতে ভাটকলাগাছি ছেড়ে সে পালাতে বাধ্য হয়, চিরকালের মতো উবে যায় তার হরিভক্তি! গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের কানে মহলপতি রামচন্দ্র খানের এই কৃতিত্বের বৃত্তান্ত, নানা মুখে রূপকথার মতো পল্লবিত হয়ে পৌঁছোলে, সুলতান হয়তো খুশি হয়ে তাকে স্বীকৃতি দিতে ইনাম ঘোষণা করতে পারে। পদোন্নতি ঘটিয়ে তাকে মহলপতি থেকে মুলুকপতি করে দেওয়াও অসম্ভব নয়।

রামচন্দ্র তার মহলের বারবনিতা পল্লী থেকে সবচেয়ে সুন্দরী, যুবতী হীরাকে লাগিয়ে দিল হরিদাসকে প্রলুব্ধ করে তার হরিভক্তির মুখোশ খুলে দিতে। বারবনিতা পল্লীতে রামচন্দ্র খানের নিজের রাজকুঠিতে যে গুটিকয়েক রক্ষিতা ছিল, তাদের মধ্যে মুলুকপতির কাছে হীরার কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। হীরাও ছিল পোষা কুকুরের মতো রাজাবাবুর অনুগত, বিশ্বস্ত। চৌখস ছিল নাচগান, হাস্য, লাস্য, কটাক্ষে। সমর্থ পুরুষ ঘায়েল করতে তার জুড়ি রামচন্দ্রের জেনানামহলে দ্বিতীয় ছিল না। হরিদাসের বৈরাগ্যনাশের দায়িত্ব পেয়ে সে বলল, তিন রাতের মধ্যে যশোরে বৈরাগীর মনোহরণ করবে সে।

মুলুকপতি খুশি হয়ে জানাল, কার্যোদ্ধার করে হীরা ফিরে এলে তার পছন্দের যে কোনও স্বর্ণালঙ্কার, সে উপহার পাবে। হীরার সঙ্গী হওয়ার জন্য মহলের দু’জন পাইক নিয়োগ করল রামচন্দ্র। হীরার রক্ষী হিসেবে ভাটকলাগাছি গিয়ে হরিদাসের কুটিরের কাছে গাছপালার আড়ালে পাইকরা গা ঢাকা দিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করবে। সুন্দরী হীরার শরীরে মদির ডাকে সাড়া দিয়ে কামোন্মত্ত হরিদাস ঝাঁপিয়ে পড়লে সেই মুহূর্তে পাইকদের সংকেত পাঠাবে হীরা। বাতাস চিরে তার শীৎকারের আওয়াজ ভেসে এলে পাইকরা হরিদাসের ঘরে ঢুকে তাকে বন্দি করবে।

রূপের অহঙ্কারে মাটিতে হীরার পা পড়ত না। আকাশ ছোঁয়া ছিল তার আত্মবিশ্বাস। সুলতান হোসেন শাহের সঙ্গে পরিচয় হলে তাকেও কুপোকাত করে দিতে পারে, রামচন্দ্রের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে এমন দেমাকের কথা বেশ কয়েকবার সে শুনিয়েছে। হীরার কথা শুনে সেই মুহূর্তে রামচন্দ্র চটলেও মুখে কিছু বলেনি। বরং মহলপতি থেকে মুলুকপতি হওয়ার উচ্চাভিলাষ হাসিল করতে নিজের তৈরি ছকে হীরাকে জুড়ে দেওয়ার অভিসন্ধি মনের মধ্যে এঁটে রেখেছে। সুলতানের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে তার কাছে ভেট হিসেবে সোনাদানা, দামি নানা সামগ্রীর সঙ্গে হীরাকে পাঠালে, মানুষটা নিশ্চয় আঁচ করতে পারবে যে বনগ্রামের মহল পতির সুন্দরী, যুবতী ভেটবাহিকাও ভেটের অংশ, অফেরৎযোগ্য উপহার, রাঢ়ের সুস্বাদু মিষ্টান্ন সম্ভারের চেয়ে বেশি সুস্বাদু, বহুগুণ উপভোগ্য রক্তমাংসের সন্দেশ।

স্ত্রীসম্ভোগে হরিদাসকে লিপ্ত করে, তার নামে কলঙ্ক ছড়ানোর পরে, বনগ্রাম থেকে তাকে ভাগিয়ে, হাজার মুখে নিজের সুখ্যাতি প্রচার করে, তারপর সুলতানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইবে। সপ্তগ্রামের দুই ইজারাদার, হিরণ্য মজুমদার আর তার ভাই, গোবর্ধন, দু’জনের সঙ্গে রামচন্দ্রের খাতির, বিশেষ করে হিরণ্য স্নেহ করে তাকে। কায়স্থকুলকারিকাতে, মজুমদার পরিবারের সঙ্গে রামচন্দ্রের পরিবারের লতাপাতায় আত্মীয়তার উল্লেখ আছে। গৌড়ের সুলতানের সঙ্গে তাদের অবাধ মেলামেশা। টাকার কুমির দুই মজুমদারের খাতক সুলতান হোসেন শাহ। মজুমদারদের কাছ থেকে বছরে বারো লক্ষ টাকা ইজারাদারীর খাজনা বাবদ, সুলতানের কোষাগারে জমা হয়। সেটা সুলতানের পাওনা। তারপর শুরু হয় ইজারাদারের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা কর্জ করা। ঋণের টাকা অবশ্য থোকে থোকে দুই ইজারাদার ফেরত পায়। তারপরেও ঋণ থেকে যায়। সুলতানের দরবারে তাই দুই মজুমদারের প্রভূত খাতির। রামচন্দ্র অনুরোধ করলে সুলতানের সঙ্গে তার দেখা করার ব্যবস্থা হিরণ্য মজুমদার করে দেবে। তার আগে হরিদাস নামে লোকটাকে রামচন্দ্র বাজিয়ে দেখতে চায়। সে নিজে শাক্ত, সে মেনিমুখো বৈষ্ণবদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না, তার আরাধ্য দেবী, মা কালী। মা কালী ছাড়া কাউকে চেনে না। বনগ্রামে বিদঘুটে বৈশবদের ডেরা করার মতলব অঙ্কুরে সে বিনাশ করতে চায়। নির্ধারিত দিনে বনগ্রাম থেকে ভাটকলাগাছি রওনা হওয়ার আগে রামচন্দ্রকে হীরা জানাল, প্রথম রাতে সে পাইক পাহারা চায় না, তার সঙ্গে আলাপ করে, তাকে রঙ্গরসে মাতিয়ে, তার মনে কামনার আগুন জ্বেলে তাকে উন্মাদ করে তুললেও প্রথম রাতে নিজের দেহ সে ছুঁতে দেবে না হরিদাসকে। বঁড়শি ফেলা মাছের মতো প্রথম রাতে বৈরাগী বাবাজীকে খেলিয়ে, দ্বিতীয় রাতে তাকে ডাঙায় তুলবে। মহলদার যা চাইছে, সেভাবে কাজ হবে। পাইক দরকার দ্বিতীয় রাত থেকে। তার আগে নয়। হীরার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে তার নির্দেশ মেনে চার পাল্কিবেহারা, দুই পাইককে কাজে লাগিয়ে দিল রামচন্দ্র।

সন্ধের আগে ভাটকলাগাছি গ্রামের সদর রাস্তা, লোকালয় ছেড়ে নির্জন মাঠের পায়ে হাঁটা পথ ধরে বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে হরিদাসের কুটিরের কিছু দূরে যখন পাল্কি থামল, জঙ্গলের ভেতরে তখন অন্ধকার নেমেছে। রাত গড়ানোর জন্যে পাল্কির ভেতরে হীরা অপেক্ষা করার সঙ্গে ভাবতে থাকল হরিদাস মানুষটা কেমন, তাকে ফাঁদে ফেলতে কতটা সময় লাগতে পারে! হরিদাস সম্পর্কে যা খবর রাজাবাবুর মুখ থেকে সে শুনেছে, তার কতটা খাঁটি, কতটা গুজব, যাচাই করার সুযোগ লোকটার সঙ্গে পরিচয় না হলে জানা যাবে না। রাত একটু গড়ানোর জন্যে পাল্কির ভেতরে সে বসে থাকল। দরজা বন্ধ পাল্কির ভেতরে বসে সুসজ্জিতা, সুন্দরী গণিকাটি ঘামছিল। সাজগোজ সেরে, পাল্কিতে ওঠার আগে আয়নায় নিজেকে দেখে সে নিজেই মুগ্ধ হয়েছিল। সকলে হয়। তাকে কিশোরী বয়সে, কুষ্ঠি বিচার করে এক জ্যোতিষী বলেছিল, সে ‘রাজরানী’ হবে। পুরো রানী না হলেও কাছাকাছি পৌঁছেছে। মহলপতির উপপত্নীদের একজন হওয়া কম কথা নয়। আজ বিকেলেও রাজাবাবু, অর্থাৎ মহলপতি রামচন্দ্র তার ঘরে ঢুকে, কয়েক মুহূর্ত লোলুপ চোখে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, আহা, রূপের স্রোত বইছে!

মহলপতির কথা শুনে, তার দিকে দু’চোখের তীব্র কটাক্ষ হেনে, পুরুষ হৃদয়বিদারণকারী বাঁকা হাসি ছুঁড়ে দিয়েছিল হীরা। কামেচ্ছায় মুলুকপতির চোখ দুটো টইটম্বুর হয়ে উঠলেও হীরা পাত্তা দেয়নি। শরীর একবার ধ্বস্ত করে, ফের তা সাজিয়ে তুলতে সময়ের অপচয় হত। মহলপতিও তাকে রেহাই দিয়েছিল। পাল্কির মধ্যে ঘামে শরীর ভিজে উঠতে রূপের স্রোত যে কিছুটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে, হীরার অজানা নয়। বেহারাদের একজনকে ডেকে পাল্কির দু’পাশের দরজা খুলে দিতে বলল সে। দরজা খুলতে পাল্কির ভেতরের দমবন্ধ করা কষ্ট, গরম কিছুটা কেটে যেতে সে আরাম পেলেও কয়েক মুহূর্তে সেই অনুভূতি চলে গেল। ছটফট করে উঠল সে। তার শরীর থেকে যতই রূপের বন্যা নেমে আসুক, জঙ্গলের মশারা তাকে রেয়াত করল না। ঝাঁক বেঁধে পাল্কিতে ঢুকে তার শরীরের অনাবৃত অংশ, সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে পোশাকে ঢাকা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হুল ফুটিয়ে শুষতে থাকল মশককুল। কঁকিয়ে উঠে বেহারাদের ডাকল যুবতী গণিকা। মাটির ভাঁড় ভর্তি মশা মারা তেল এনে এক বেহারা ভূতের মতো পাল্কির পাশে দাঁড়াল। তার নেংটি পরা আদুল শরীর থেকে তেলের উৎকট ঝাঁঝ বেরোচ্ছিল। তেলের ভাঁড় না ছুঁয়ে, মশার কামড় থেকে বাঁচতে পাল্কি থেকে নেমে হীরা কিছু সময় বনের আশপাশে হাঁটাহাঁটি করল। বনগ্রামের গণিকাপল্লীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী সে। রূপটানে নিজেকে পরমাসুন্দরী করে তুলতে গণিকাদের মধ্যে সে অদ্বিতীয়। ঈষৎ ঘাম আর মশার কামড়ে সাজগোজ কিঞ্চিৎ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো রসদ তখনও তার দেহজুড়ে টলটল করছিল। নিস্তব্ধ পাড়াগাঁর নির্জনতম বনাঞ্চলে হরিদাসের কুটিরে, ভর সন্ধের আকাশ থেকে মাঝরাতের অন্ধকার, ঝুপ করে নেমে এসেছে। কুটিরের ভেতরে জনপ্রাণীর সাড়া না থাকলেও প্রদীপের মিটমিটে আলো দেখে হীরা বুঝে গেল সেখানে হরিদাস আছে। অদূরে ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ছড়িয়ে থাকা সামান্য আলোয়, বাইরে তুলসীর বেদি দেখতে পেল হীরা। অলকাতিলকা আঁকা বেদির ওপর তরতাজা সবুজ পাতা বোঝাই ঝাঁকড়া তুলসী গাছ। কিছুটা হেঁটে সারা শরীরে ঢেউ তুলে সিক্ত দু’ঠোটে কামজর্জর হাসি ফুটিয়ে, প্রথমে তুলসীতলায় গিয়ে পরম ভক্তিমতীর মতো প্রণাম করল সে। দু’চোখ বুজিয়ে প্রণামের আগে আড়চোখে দেখে নিয়েছে, সে যা চাইছিল, তাই ঘটেছে। তুলসীমণ্ডপের দিকে মুখ করে ঘরের ভেতরে বসে হরিদাস জপ করলেও খুলে রেখেছে দু’চোখ। জপে নিবিষ্ট হরিদাসের দৃষ্টি কাড়তে তিনবার তুলসীমণ্ডপ পরিক্রমা করে তিন দফা প্রণাম করে ঘাড় তুলে হীরা দেখল, তাকে নজর করেও হরিদাস নিস্তব্ধ, তার ঠোঁট নড়ছে, একভাবে নামজপ করে চলেছে সে। হরিদাসকে দু’হাত জুড়ে নমস্কার করে তার ঘরের দরজায় গিয়ে বসার আগে হীরা বুকের কাপড় আলগা করে, উপচে পড়া যৌবন স্পষ্ট করে তুলল। অচেনা এক স্ত্রীলোককে দরজা আটকে আলুথালু হয়ে বসে পড়তে দেখেও হরিদাস নামজপ থামাল না। হীরা বলল, ঠাকুর তোমার মতো দিব্যশক্তি, সুদর্শন যুবককে বৈরাগীর বেশে ভিক্ষে করতে দেখে আমার বুক ফেটে যায়। তোমার এই পরমসুন্দর যৌবনের ছোঁয়া পেতে আমি পাগলিনী হয়ে উঠেছি। বাড়িতে থাকতে না পেরে ছুটে এসেছি তোমার কাছে। তুমি আমায় সুখ দাও, তৃপ্ত করো। তা না হলে এখানেই আমি আত্মঘাতী হব। স্ত্রীবধের পাপ বর্তাবে তোমার ওপর। সঙ্গসুখ প্রার্থনায় আতপ্ত, অচেনা স্ত্রীলোকটির ডাক পেয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হরিদাস বলল, কী নামে তোমায় সম্বোধন করব, জানি, না, তবে তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে। দরজার বাইরে যেখানে বসে আছো, আমার জপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকো। জপ শেষ করে তোমার ইচ্ছে পূরণ করব।

পুরুষ চরিয়ে খাওয়া গণিকাটি বুঝল, শিকার জালে পড়েছে। ঘরের খোলা দরজার বাইরে বসে হরিদাসের চোখের সামনে স্ত্রী শরীরের নানা ছলাকলা দেখাতে থাকলে বৈরাগীর জপের ভড়ং মাথায় উঠবে। তার মুখে কাজের বুলি ফুটবে। হরিদাসের সামনে নিজের জায়গায় বসে হীরা তার সুগঠিত শরীর নিয়ে নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে থাকল। মশার উপদ্রব ঠেকানোর ব্যস্ততায় কখনও তার বুকের কাপড়, নাভির ঢাকা, হাঁটু পর্যন্ত আবরণ সরে যেতে কাঁচুলি বাঁধা শাঁখের মতো স্তন, তলপেট, উজ্জ্বল সোনালি ঊরু পর্যন্ত অনাবৃত হচ্ছিল। পুরুষকে খেপিয়ে দিতে স্ত্রী শরীরের এই হাতছানি যথেষ্ট হলেও হরিদাসের ভাবান্তর হল না। জপে অন্তর্নিবিষ্ট হয়ে দেহের বাইরে সূক্ষ্ম শরীরের রক্ষাকবচ সে গড়ে নিয়েছে। বাইশ বাজারে মহলপতির পাইকদের কয়েকশো বেত্রাঘাত, রক্তাক্ত হয়েও সে নির্বিকারভাবে সহ্য করেছিল। হরিদাস জেনে গিয়েছিল, মানুষ তার আরাধ্যে ডুবে গেলে সুখ, দুঃখ, যন্ত্রণা থেকে অনায়াসে নিজেকে বিযুক্ত করে নিতে পারে। বাইশ বাজার ঘুরিয়ে বেত্রাঘাতে মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়। যশোরের মুলুকপতির পাইকরা মনিবের হুকুমে যে দণ্ডাজ্ঞা পালন করেছিল, তার জন্যে তাদের অপরাধী করেনি হরিদাস। অপরাধবোধ তাদের ছিল না। পেটের দায়ে মনিবের হুকুম তামিল করার সময়ে তারা নিরপরাধ ভেবেছিল নিজেদের। অন্যায় করেছিল নিজের অজ্ঞাতে। মৃত ভেবে নদীর জলে হরিদাসকে যখন তারা ভাসিয়ে দিয়েছিল, জানত না মৃত মানুষটার ভেতরে যে মানুষ, সে জীবিত রয়েছে। হরিদাসও জানত না, তার ধ্যানজগতে তৈরি সূক্ষ্ম শরীর তাকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। অস্তিত্বের অদৃশ্য অথচ অচ্ছেদ্য সত্তাকে সেই প্রথম উপলব্ধি করার সঙ্গে সে প্রার্থনা করেছিল, তার বেঁচে থাকার কারণে বেত্রাঘাতকারী পাইকরা যেন মুলুকপতির রোষানলে না পড়ে। ইষ্টদেবতা শ্রীহরির কাছে মুলুকপতির সুবুদ্ধির জন্যে প্রার্থনা করেছিল। রায়মঙ্গলের স্রোতে ভেসে যাওয়া তার নিশ্চেতন দেহ ভাটকলাগাছির চরে আটকে যেতে সে টের পেল, তার ঠোঁট নড়ছে, নামজপ করছিল সে। জপের মধ্যে তার মনের গভীরে জেগে থাকল, সর্বব্যাপ্ত শুভেচ্ছা, বন্ধু থেকে বিনাশকারী সকলের জন্যে কল্যাণকামনায় তার দু’চোখে জল এসে গেল। নদীর চড়া থেকে ভাটকলাগাছি গ্রামের যে মানুষগুলো উদ্ধার করেছিল তাকে, তাদের কেউ পাশের জনকে বলেছিল, মরার হাত থেকে বেঁচে গিয়ে লোকটা খুশিতে কাঁদছে।

কথাটা শুনে জপে আবিষ্ট হরিদাস অখুশি হয়নি। মনে মনে বলেছিল, বেঁচে থাকার মতো আনন্দ যে হয় না, এ বিষয়ে আমি একমত। তুমি বেঁচে থাকো, আনন্দে থাকো। সবাই আনন্দে বাঁচুক।

জপে মুহ্যমান হরিদাস, রাত কত হল, জানে না। দিন রাতের ঘণ্টা, প্রহর মাপার সময় তার নেই। রোজ তিনলক্ষ বার ইষ্টমন্ত্র জপ করার হিসেব, ভুলচুক না করে নিত্যদিন স্মরণে রাখে। জপে নিমগ্ন হরিদাসের খেয়াল নেই দরজার বাইরে এক সুন্দরী গণিকা, তার সঙ্গ-সুখ পেতে তীর্থের কাকের মতো বসে আছে। রক্তপিপাসু মশার পাল, তাকে ঘিরে ভনভন করে উড়লেও হরিদাসের বৈরাগ্য ধর্ম নষ্ট করতে সে অপেক্ষা করছে। মালিকের আদেশ পালন করতে হবে। মালিক যে সে লোক নয়, বনগ্রামের মহলপতি, তার জান, প্রাণ এমনকী, শরীরী সৌন্দর্যের রক্ষাকর্তা লোকটি বিছানাতে স্ত্রীশরীর ভোগের সময় যেমন উন্মত্ত এবং সহৃদয়, তেমনি রেগে গেলে জহ্লাদ। গণিকা হীরার গলা কেটে তাকে বাঁওড়ের জলে ভাসিয়ে দিতে পারে। হরিদাসের জপ যে কোনও মুহূর্তে শেষ হবে, এই তার ধারণা। মানুষের জপ করার একটা সীমা আছে। শুরু করলে একজন সাধু, খুব বেশি আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, সন্ধে থেকে রাতের প্রথম প্রহর, একটানা তিন ঘণ্টা জপে কাটাতে পারে। সাধুসন্ন্যাসীরও ক্ষিধে তেষ্টা আছে। শুধু জপ করে পেট ভরে না। সুতরাং এই সন্ন্যাসীকে পেটপুজোর আয়োজন করতে কুশাসন ছেড়ে উঠতে হবে। দরজায় বসে থাকা তার মতো সুন্দরী রমণীকে বৈরাগী তখন এড়াতে পারবে না। মানুষটা জানে, সে কেন বসে আছে। খোলাখুলি সে জানিয়েছে, তার রতিসুখাকাঙ্ক্ষা। জপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে যখন মানুষটা বসিয়ে রেখেছে, তখন তা চুকলে বৈরাগী নিশ্চয় কথা রাখবে। রাত গভীর গভীরতর হয়ে, চতুর্থ প্রহর কেটে আকাশে ঊষার আলো জাগলেও হরিদাসের নামজপ থামল না। ক্ষিধে, তেষ্টা, মশার কামড় অগ্রাহ্য করে হরিদাসের প্রতীক্ষায় বসে থেকে, ক্লান্তি আর একঘেয়েমিতে হীরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোরের আলো কপালে এসে পড়তে ধড়ফড় করে জেগে উঠে সে দেখল, ঘরের ভেতরে প্রদীপ নিভে গেলেও হরিদাস জপ করে চলেছে। তার দু’চোখ মুদ্রিত। সকালের হালকা আলোয় ধ্যানস্থ হরিদাসকে দেখে হীরার চোয়াল শক্ত হল। লোকটা নিজেকে ভাবে কি? যত বড় ব্রহ্মচারীই হোক, তাকে ফুসমন্তরে হীরা ঘায়েল করতে পারে, এই বৈরাগী জানে না। হীরা এবার তার ভেল্কি দেখাবে। অপমানের প্রতিশোধ নিতে তার মনের মধ্যে প্রতিহিংসা জেগে উঠল। দাঁতে দাঁতে টিপে আপনমনে বলল, এক মাঘে শীত যায় না। তোমাকে কাত করবই, না পারলে আমার নাম হীরা নয়।

ভোরের আলো ফোটার আগে বনভূমি জুড়ে যত পাখি ডাকতে শুরু করছিল, সকালের আলো স্পষ্ট হতে অসংখ্যের ‘গলা’ মেলানোতে তাদের ডাক হয়ে উঠল কলরব। ভোরের শীতকালীন হাওয়া বইছিল বনাঞ্চল ঘিরে। কাছাকাছি লোকালয় না থাকলেও, হঠাৎ কারও চোখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় হরিদাসের কুটির ছেড়ে হীরা তাড়াতাড়ি পালাতে চাইছিল। গাঁয়ের কেউ এ তল্লাটে তাকে এখন দেখলে, তার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলবে। নিৰ্দোষ হরিদাসকে ফাঁসাতে এসে ব্যর্থ হয়েছে, এই গুজব ছড়িয়ে পড়লে, তার মুখ লুকোনোর জায়গা থাকবে না। তার রক্ষক রাজাবাবু পর্যন্ত মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে। হীরা আর ভাবতে চাইল না। হরিদাসের কুটির ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে এসে পাল্কিতে উঠল। গ্রামের প্রধান সড়ক ছেড়ে মেঠো পথে, যেভাবে হরিদাসের ঘরে এসেছিল, সেই একই পথে বনগ্রামের গণিকাপাড়ায় নিজের ঘরে ফিরে এল। ঘুরপথে অনেক বেশি রাস্তা আসতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছিল। হীরা ফেরার আগে, রাতের ঘটনা জানতে তার ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল মহলপতি, রামচন্দ্র খান। রাতের ঘটনা, নিজের মতো হীরা সাজিয়ে মহলপতিকে বলে, শেষে জানাল, ঠাকুর বলেছে, আজ সে কথা রাখবে, জমিয়ে দেহসম্ভোগ করবে।

হরিদাসের মতো এক ভিখিরির ঝুপড়ির দরজার বাইরে বসে রাত কাবার করে হীরার মতো ডাকসাইটে সুন্দরী গণিকা কার্যোদ্ধার করে ফিরতে না পারায়, মহলপতি চটলেও মুখে কিছু বলল না। দ্বিতীয়রাতে অন্ধকার ঘন হতে, তাকে ফের হরিদাসের ঘরে পাঠাল। হরিদাসের কুটিরের কাছাকাছি বনাঞ্চলের সেই গোপন জায়গায়, আগের রাতে যেখানে পাল্কি রেখেছিল, সেখানে হীরা পৌঁছে গেল। দ্বিতীয় রাতে তার সঙ্গে দু’জন পাইক পাঠিয়ে দিল রামচন্দ্র খাঁ, হীরার সঙ্গে সুরতে রত অবস্থায় হরিদাসকে হাতেনাতে ধরে, তাকে কাছিতে বেঁধে মহলের সেরেস্তায় হাজির করার সঙ্গে হীরাকেও নজরে রাখার নির্দেশ দিল দুই পাইককে। দ্বিতীয় রাতে আরও চটকদার সাজসজ্জা করে, শরীরে কামকামিনীর ভরপুর ছলাকলা নিয়ে হরিদাসের কুটিরে পৌঁছে গেল হীরা। ঘরে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বেলে, তুলসী মণ্ডপের দিকে মুখ করে আগের দিনের মতো চোখ বুজে জপ করে চলেছে হরিদাস। মাঝে কখনও চোখ খুললেও ভাবাবিষ্ট নজর, স্পষ্ট করে কিছু দেখছে কিনা বোঝা যায় না। তবু যা দেখার, হরিদাসের নজর এড়াল না। সে দেখল, আগের রাতের অতিথি, সেই রমণী, সভক্তি তুলসীমঞ্চ পরিক্রমা করে প্রণাম করছে। হরিদাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, টের পেয়ে তার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল হীরা। তার বেশভূষা আজ আরও বেআব্রু, চালচলন, কথাতে সে বেশি প্রগল্ভা। নাকি সুরে, আদূরে কণ্ঠস্বরে অনুযোগ জানাল, কামে জর্জরিত, তার শরীর আছাড়পাছাড় খাচ্ছে, বৈরাগীর কাছ থেকে রমণসুখ না পেলে তাকে বিষ খেয়ে মরতে হবে।

গণিকার অনুযোগ, সবিনয়ে স্বীকার করে নিয়ে হরিদাস বলল, গত রাতে প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার জন্যে সে অনুতপ্ত। তার অপরাধ হীরা যেন ক্ষমা করে দেয়। সেই রাতে নামজপ শেষ করে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অপরাধ সে আর করবে না, অচেনা রমণীর মনস্কামনা পূর্ণ করবে।

হরিদাসের মুখশ্রী, তার গলার মাধুর্য, আন্তরিক বচনে মুগ্ধ হয়ে দরজার বাইরে বসল হীরা। বৈরাগী যে তাকে ভাঁওতা দিচ্ছে না, এটুকু বুঝতে পারল, লোকটা মিথ্যাচারী, ভণ্ড নয়। তাকে ঠকাবে না। হরিদাসের নামজপ, একটানা অস্ফুট হরিধ্বনিতে রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে এমন এক গুঞ্জন হীরা শুনতে পাচ্ছিল, যা আগের রাতের মতো তার একঘেয়ে লাগছে না, অশান্ত করছে না তার মন। গুঞ্জনের ভেতরে সুরের ঢেউ তাকে অধীর করলেও সে অধীরতা বৈরাগীর জপ শেষ হওয়ার প্রতীক্ষাজনিত নয়। বস্ত্রের ভাঁজে ভাঁজে লুকনো তার রূপ যৌবন, যা দু’রাতে বেশ কয়েকবার প্রায় অর্ধেক অনাবৃত করে মানুষটাকে দেখিয়ে তার রমণ আকাঙ্ক্ষা করে, প্রতীক্ষায় থেকে অপমানে চিড়বিড় করে জ্বলেছে, তার চেয়ে অন্যরকম। রাতের তৃতীয় প্রহরের শেষেও হাই উঠছে না, ঘুমে জড়িয়ে আসছে না দু’চোখ। মনের মধ্যে ব্যাকুলতা জাগলেও বৈরাগীর প্রতিশ্রুতি মিথ্যে হবে না, এই ভেবে শান্তি পাচ্ছে। বৈরাগীর নামকীর্তন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকল হীরা। মনটা তার দোলাচল হয়ে উঠল। হরিভজা রক্তমাংসের মানুষটা যে এত নরম, সহৃদয় তার ধারণা ছিল না। তার উদ্দেশ্য জেনেও ‘দূর দূরত করে তাকে তাড়িয়ে না দিয়ে সবিনয়ে আপ্যায়ন করে দরজার বাইরে বসার অনুমতি দিল। মানুষটার মনে রাগ নেই, ঘেন্না নেই, পাপ কি আছে?

প্রশ্নটা মনে জাগতে মুলুকপতির পোষা গণিকা চমকে উঠল। পাপের পথে একজন সাধককে সে কেন টেনে নামাতে চাইছে, তার গা-গতর কাঁপতে থাকল। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা নামজপ তার কানে এখন সুরেলা গানের মতো লাগছে। কোকিলকণ্ঠী গায়িকা সে, নৃত্যে সমান পটীয়সী। শেষ রাতের অন্ধকারে নামজপের গুঞ্জনধ্বনি সঙ্গীত লহরীর মতো কানে বাজতে হীরার বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। কেন এখানে এসেছে, কী যেন করার ছিল, তার স্মৃতি থেকে ক্রমশ যখন মুছে যাচ্ছে, ভোরের পাখিরা ডেকে উঠল। পুব আকাশে তখনও শুকতারা জ্বললেও ভাটকলাগাছি গ্রামের মানুষ জাগতে শুরু করেছে। হাল-লাঙ্গল নিয়ে তারা মাঠে পৌঁছোনোর আগে গণিকাপল্লীতে হীরার ফেরা দরকার। গণিকারও লোকলজ্জা আছে, এ কথা কাকে বলবে সে? বৈরাগীর কুটির ছেড়ে নিজের পল্লীতে হীরা যখন ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে, ঘরে বাইরে এসে কুণ্ঠিত হরিদাস বলল, গেল রাতটাও কীভাবে কাটল, টের পেলাম না। এক মাসে এক কোটি নামজপ করার যে সঙ্কল্প পালন করছি, তার ঊনত্রিশ দিন পূর্ণ হল। আজ রাতের দ্বিতীয় প্রহরে শেষ হবে কোটিবার নামজপ যজ্ঞ, আমার ব্রতপালন শেষ হবে। গেল রাতে এক কোটি নামজপ শেষ করা যাবে, ভেবে তোমায় বসিয়ে রেখেও সারাদিনে সাড়ে তিনলক্ষের বেশি নাম উচ্চারণ করতে পারিনি। অনুমান করি, বাকি আড়াই লক্ষ আজ রাতের দ্বিতীয় প্রহরে শেষ হবে।

এক মুহূর্ত থেমে হরিদাস বলল, আমার অনুমানে ভুল নেই। তোমাকে দেওয়া অঙ্গীকার মেনে কাজ করতে না পেরে আমি লজ্জিত। বড় অপরাধী লাগছে নিজেকে। তুমি মাপ করো। কথা দিচ্ছি, আজ রাতে প্রতিশ্রুতির নড়চড় হবে না। তুমি যা চাইছ, তাই পাবে। আমি তৃপ্ত করব তোমাকে।

বৈরাগীর কথা শুনে হীরার চোখে জল আসছিল। চোখের জল সামলে সেই বারাঙ্গনা নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে অঝোরে কাঁদল। অনেকদিন এরকমভাবে সে কাঁদেনি। কেন কাঁদল, সে নিজেও জানে না।, বেলা গড়াতে রামচন্দ্র এল তার ঘরে। বিগত রাতের অভিজ্ঞতা কিছুটা বানিয়ে নিজের কোলে ঝোল টেনে, মনিবকে শুনিয়ে গাঢ় স্বরে তাকে আশ্বস্ত করল। সেদিন মাঝরাতে বৈরাগীর এক কোটি নামপের ব্রত পালন শেষ হলে, তার যে পালানোর পথ থাকবে না, বিশদ করে হীরা জানিয়ে দিল মহলপতিকে।

কুলটা মেয়েছেলেটার বিবরণে কিছু গাঁজাখুরি আছে, টের পেয়ে তরোয়ালের এক কোপে তার গলাটা রামচন্দ্রের উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলেও সে আত্মসংবরণ করল। হীরাকে শেষবার সুযোগ দিতে, সেই রাতেও তাকে পাল্কিতে তুলে, সঙ্গে দু’জন পাইক দিয়ে হরিদাসের কুটিরে পাঠিয়ে দিল। হীরা যখন হরিদাসের কুটির পৌঁছলো, তার মনে ঝড় উঠেছে। নাচগানে পারঙ্গমা হলেও শিক্ষার ছোঁয়া সে যথেষ্ট পায়নি, গেল দুই সন্ধের মতো হরিদাসের কুটিরে ঢুকে তুলসীমঞ্চ পরিক্রমা সেরে সে হাঁটুগেড়ে স্থির হয়ে বসে প্রণাম করল। হরিদাসের ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে করজোড়ে নমস্কার করল তাকে। নামজপে নিবিষ্ট হরিদাস চোখ তুলে গণিকাসুন্দরীকে দেখে বলল, আজ আমার এক কোটি নামজপ পূর্ণ হবে। তোমার ইচ্ছাপূরণে তখন আর অসুবিধে ঘটবে না। নিজের জায়গায় শান্ত মনে বসে রাতের দ্বিতীয় প্রহর পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

কামোদ্রেককারী বেশভূষার ‘বদলে হীরা তৃতীয় রাতে আটপৌরে পোশাকে এসেছিল। চালচলন, চাউনিতে আগের দু’রাতের মদালসা সম্মোহন ছিল না। আত্মস্থ হয়ে নামজপের সঙ্গে সে রাতে হরিদাস আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কীর্তন করছিল। তার সঙ্কীর্তন শুনে উথালপাথাল হচ্ছিল হীরার বুক। অস্থির ব্যাকুলতার সঙ্গে তার বুকের মধ্যে ভেঙে পড়ছিল উচ্ছ্বাসের ঢেউ। হরিদাসের জপ, নামগানের সঙ্গে উচ্ছ্বাসের তীব্রতায় হীরার ঠোট নড়তে থাকল, মিলে গেল গলা। রাত শেষ হতে দেখা গেল হরিদাসের সঙ্গে সুরেলা গলায় সে নামগান করছে। নামকীর্তনের মধ্যে এক সময়ে হরিদাসের পায়ে সে লুটিয়ে পড়ল। হীরা তখন আর গণিকা নেই। হরিদাসের সংসর্গে তার চোখ খুলে গিয়েছে। ক্লেদাক্ত জীবন থেকে সে মুক্তি পেতে চায়। তার মুখচোখে ফুটে উঠেছে সাধিকা হওয়ার ব্যাকুলতা। হীরা বলল, মুলুকপতির আদেশে তোমাকে নরকের পথে নিয়ে যেতে এসে এ আমি কোথায় পৌঁছে গেলাম! আমি কুলটা, রামচন্দ্র খানের কেনা মেয়েমানুষ। তোমার শোনানো নামজপে সেই আমি মজে গেলাম। আমার এখন কী হবে? আমি তো আর গতর বেচে পেটের ভাত জোগাড় করতে পারব না। তুমি আমার কুলটাজীবন শেষ করে দিয়েছ। তোমার দেওয়া মন্ত্র নেশার মতো আমার মাথায় ঢুকে গেছে। কোন পথে আমার মুক্তি, আমি এখন কোথায় যাব, কী করব, বলে দাও।

সারা মাস ধরে এক কোটি নামজপের অন্তিম পর্বে, উত্তর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরের দরজায় লাস্যময়ী যে সুন্দরীকে শরীরের জাদু ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, তার সম্পর্কে চকিতে হরিদাস যা ধারণা করেছিল, মিলে গেছে। হরিদাস জানত, মিলে যাবে। সালাঙ্কারা, রূপসী গৃহবধূটি কোনও সাধ্বী রমণী নয়, সেই মুহূর্তে হরিদাস টের পেয়ে গেলেও তাকে কুটির থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি। বিপথগামী মানুষকে উদ্ধার করতে সব সময়ে সে তৈরি। আর্তের সেবায় বাড়িয়ে রয়েছে দু’হাত। প্রথম রাতে হীরাকে দেখে সে টের পেয়েছিল আপাতসুখী এই রমণীর মনের গভীরে বড়রকম দুঃখ লুকিয়ে আছে, ভাবজগতে তার পরিত্রাণ দরকার। তিন রাতের প্রথম দু’রাতে হরিদাস যা বুঝে গিয়েছিল সেই উপলব্ধির সূত্রে পঙ্ককুণ্ডের ভেতর থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে তাকে বেঁচে থাকার আলোকবর্তিকা, সে দেখাতে চেয়েছিল। হীরা মুক্তির পথ জানতে চাইলে গভীর সহানুভূতির সঙ্গে হরিদাস বলল, নামসঙ্কীর্তন একমাত্র মুক্তির পথ। যদি পারো, তাই করো। পেশা ছেড়ে দাও।

ঝরঝর করে কাঁদছিল হীরা। তার চোখের জলে মনের যত পাপ, গ্লানি ধুয়ে যাচ্ছিল। বলল, তাই হবে ঠাকুর, তোমার উপদেশ মাথায় তুলে নিলাম। সেই সকালে নিজের রূপ নষ্ট করতে মাথা মুড়িয়ে লম্বা ঘনকালো চুল চিরকালের মতো হীরা বিসর্জন দিল। হরিদাসের দেওয়া গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করে গলায় তুলসীর মালা পরল। নিজের কুটিরে হীরাকে রেখে ভাটকলাগাছি ছেড়ে সেই দুপুরে চলে যাওয়ার আগে হরিদাস বলল, তোমার ছোঁয়ায় এই কুটির পুণ্যতীর্থ হয়ে উঠবে। তোমার কণ্ঠে নামগান শুনতে তোমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে সঙ্কীর্তন করতে কত বৈষ্ণব ভক্ত এখানে আসবে, তার হিসেব থাকবে না। তুমি হয়ে উঠবে মহৎ অন্তঃকরণবতী, ‘পরম মহান্তি’। তোমার দর্শন ভিক্ষায় দূরের দেশ থেকে উচ্চমার্গের সাধু, সন্ন্যাসীরা এখানে ভিড় করবে।

বনগ্রামের ভাটকলাগাছি ছেড়ে হরিদাসের চলে যাওয়ার খবর যেমন রটে গেল, তেমনই ধীরে ধীরে সকলে জানল যবন হরিদাসের কুটিরে এক বৈয়বী আশ্রয় নিয়েছে। ঠাকুর হরিদাসের মতো নামজপে সে-ও প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ডুবে রয়েছে। নামজপ আর সঙ্কীর্তনে বাহ্যজ্ঞানহীন সেই বৈষ্ণবী পেট চালাতে খুদকুঁড়োর খোঁজে মাধুকর করতে বেরোয় না। গাঁয়ের লোক তার দাওয়ায় যৎসামান্য যা ভিক্ষা রেখে যায়, তাই খেয়ে সে দিন কাটায়। সম্পত্তি বলতে তার যা ছিল, গরীব-দুঃখীকে সে দান করে দিয়েছে। হীরার বৈয়বী হওয়ার খবর পেয়ে রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল মহলপতি রামচন্দ্র খাঁ। তার রক্ষিতা, সেই অর্থে তার বারবাড়ির একটা আসবাব ছিল হীরা। আসবাব মানে, মেয়েমানুষ অস্থাবর সম্পত্তি, সেই সম্পত্তিতে তার-ই একচ্ছত্র অধিকার। কে এক যবন হরিদাস এসে তাকে লুটে নেবে, তা হতে পারে না। কুটির ছেড়ে হরিদাসের চলে যাওয়ার খবর তখনও রামচন্দ্র পায়নি। গুপ্তঘাতক লাগিয়ে দু’জনকে গুম-খুন করে দেওয়া রামচন্দ্রের কাছে জলভাত হলেও সেই মুহূর্তে বনগ্রামের মহলপতি বড় এক ঝামেলায় জড়িয়ে ছিল। যথাসময়ে রাজকর দিতে একাধিকবার গাফিলতি করে রামচন্দ্রের বকেয়া করের পরিমাণ এমন অঙ্কে পৌঁছেছিল, যা আদায় করতে হোসেন শাহকে সেনাবাহিনী পাঠাতে হয়। সুলতান হোসেন শাহের এক উজীরের নেতৃত্বে সেনারা রামচন্দ্র খানের বাড়িতে লুঠতরাজ চালিয়ে পরিবারের সকলের ধর্মনাশ করে, মহলপতিকে গৌড়ে ধরে নিয়ে যায়। কারারুদ্ধ করে রামচন্দ্রকে। হরিদাস ততদিনে নবদ্বীপে অদ্বৈত আচার্যের আশ্রয়ে পৌঁছে গেলেও ভাটকলাগাছির কুটির ছেড়ে বৈষ্ণবী হীরা নড়েনি।

প্রচুর খেসারত দিয়ে বন্দিদশা থেকে মুলুকপতি রামচন্দ্র খান বনগ্রামে ফিরলেও তার বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছিল সুলতান হোসেন শাহ। মহলপতির পদ ফিরে পেলেও পুরনো দাপট পুনরুদ্ধার করতে পারল না রামচন্দ্র। সাধক হরিদাসের শরণ নিতে, সেই মানুষটাকে হন্যে হয়ে খুঁজলেও তার নাগাল পেতে মহলপতি রামচন্দ্রের আরও কয়েক বছর লেগেছিল। হীরার কাছে যাওয়ার সাহস তার ছিল না। ‘পরম মহান্তি’ মর্যাদায় হীরা সর্বজনমান্য হয়ে ওঠার পরে রাতের অন্ধকারে, তার কুটিরের অদূরে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে আত্মগোপন করে তার সুললিত সঙ্কীর্তন শুনত রামচন্দ্র। মহলপতি থেকে মুলুকপতি হওয়ার উচ্চাভিলাষ তার মন থেকে মুছে গিয়েছিল।

ভাটকলাগাছি ছেড়ে কিছুকাল সপ্তগ্রামে থেকে নবদ্বীপের পাশের মৌজা শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের বসতবাটিতে হরিদাস হাজির হল। রতনে রতন চেনে। দুই বিষ্ণুভক্তের পূর্ব পরিচয় না থাকলেও তারা একে অন্যের বিশদ খবর রাখত। বয়োজ্যেষ্ঠ অদ্বৈতের মুখোমুখি হয়ে দূরত্ব বাঁচিয়ে তাকে সাষ্টাঙ্গে হরিদাস প্রণাম করার আগেই জ্ঞানবৃদ্ধ মানুষটি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। সঙ্কোচে মুখ ম্লান করে হরিদাস বলল, অস্পৃশ্য যবনকে আপনি ছুঁলেন, এ তার মহাভাগ্য। কিন্তু আমি জানি, কাজটা আমার ঠিক হল না। প্রায়শ্চিত্ত করে আপনার সম্মান উদ্ধার করব আমি।

হরিদাসকে আলিঙ্গনে বেঁধে আবেগরুদ্ধ গলায় অদ্বৈত বলল, ওহে যবন হরিদাস, তোমার জন্মপরিচয়, নাড়ি-নক্ষত্র সব আমার জানা। আমার কাছে তুমি হরিভক্ত বৈষ্ণব, তুমি দ্বিজশ্রেষ্ঠ। তোমাকে আলিঙ্গন করে আমি ধন্য হলাম। আমার মতো অকিনের নামতৃয়া মেটাতে তোমাকে এখানে থাকতে হবে। তোমার পথে কুশের কাঁটা হলাম আমি। বৃদ্ধ অদ্বৈত, তার অর্ধেক বয়সি হরিদাসকে বুকে জড়িয়ে যেমন অজোরে কাঁদছিল, হরিদাসের চোখ থেকেও তেমনি অবিরল গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুজল। অদ্বৈতের গুরুভাই, ঈশ্বরপুরী নাগরিয়াঘাট থেকে স্নান সেরে তখন বাড়ি ফিরছে। শান্তিপুরে অদ্বৈতের বাড়িতে কয়েক দিনের অতিথি হিসেবে সে উঠেছে। অদ্বৈতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ অচেনা একজন মানুষ আর গৃহকর্তাকে সমানে কাঁদতে দেখে, সন্ন্যাসী ঈশ্বরপুরীর দু’চোখ ছলছল করতে থাকল। ভাবাবেশে কৃষ্ণনাম জপ করতে থাকল সে। পুবের আকাশ ছেড়ে সূর্য তখন বেশ খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে। সদরদরজায় তিনজন মানুষের কম্পিত ছায়া পড়ল।

চতুষ্পাঠীতে ছাত্রদের ব্যাকরণের টিকা ব্যাখ্যা করতে শুরু করে গোরার হৃদয় আচমকা আনন্দে কেন উদ্বেল হয়ে উঠল, সে নিজেও বুঝতে পারল না। আরও গভীর অভিনিবেশে ব্যাকরণ শিক্ষাতে সে মন দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *