গোরা – ২৬

২৬

সাতবছর আগে গোরার প্রথম বিয়ের সময়ে শ্রীহট্টের কমলাক্ষ ভট্টাচার্য, শান্তিপুর, নবদ্বীপে সকলে একডাকে অদ্বৈত আচার্য নামে যাকে চেনে, তার সঙ্গে নিতাই-এর পরিচয় হলেও সম্প্রতি সে নবদ্বীপে আসার পর থেকে অদ্বৈতের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটেনি। নবদ্বীপে তাকে পাঠিয়েছিল তার মন্ত্রদাতা গুরু, লক্ষ্মীপতি পুরী। লক্ষ্মীপতির শিষ্য মাধবেন্দ্র পুরী, মাধবেন্দ্রর শিষ্য ঈশ্বরপুরী, অদ্বৈত আচার্য, সঙ্কর্ষণ পুরী। মন্ত্র নেওয়ার আগে নিতাই ছিল ‘অপূণ ভক্তাবধূত’ যাদের ‘পরিব্রাট’ বলা হত, তাই। প্রতীচী তীর্থের কাছে লক্ষ্মীপতি পুরীর কাছে দীক্ষা নিয়ে সে ব্রম্মজ্ঞান আয়ত্ত করার সঙ্গে হয়ে উঠল ভক্তিবাদী। যুবক অবধূত, নিতাই-এর মধ্যে অফুরন্ত প্রাণের ভাণ্ডার খুঁজে পেয়েছিল লক্ষ্মীপতি। নবীন শিষ্যটি দেশবাসীকে একসূত্রে গেঁথে ফেলার উপযুক্ত সংগঠক, অনুমান করে তাকে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দিয়েছিল লক্ষ্মীপতি। নবদ্বীপে এক যুগন্ধর বৈষ্ণব নেতার অভ্যুত্থান ঘটতে চলেছে, এখবর ঈশ্বরপুরীর কাছে পেয়েছিল মহাগুরু লক্ষ্মীপতি। গোরাকে সম্ভাব্য কৃষ্ণাবতার নামে চিহ্নিত করে, অদূর ভবিষ্যতে নবদ্বীপ কলিযুগের কুরুক্ষেত্র হতে চলেছে, মহাগুরুর কাছে এই ভাবনার বিস্তার করেছিল ঈশ্বরপুরী। তবে নতুন এই কুরুক্ষেত্র যে দ্বাপরযুগের মতো লোভ, ক্রোধ, হিংসা, হানাহানিতে রক্তস্নাত হওয়ার বদলে সত্যযুগের মতো প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, পুণ্যকর্মের যোগে পৃথিবীতে প্রকৃত ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে, নিজের এই বিশ্বাসের কথা লক্ষ্মীপতিকে জানাতে ঈশ্বরপুরী ভোলেনি। অস্ত্রের বদলে বাঁশি হাতে এই যুগে অবতার আসবে। বাঁশির সুর আর সঙ্কীর্তনে গৌড়বঙ্গে প্রেমের প্লাবন বইয়ে দেবে। অবতারের আবির্ভাবে শান্তিপুর, নবদ্বীপ ভালবাসায় ভেসে যাবে। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যেমন হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ, কুলিন্দ, আনার্ত, শাকলদ্বীপ, কাশ্মীর, লোহিতদেশ, ত্রিগর্ত, সিংহপুর, সুক্ষ্ম, চোল, বাহ্লীক, কম্বোজ, দরদ, পাঞ্চাল, বিদেহ, দশার্ন, কিম্পুরুষ, প্রাগজ্যোতিষপুর, পুলিন্দনগর, পুণ্ড্র, অবন্তী, কুন্তিভোজ প্রভৃতি রাজ্যের পরাক্রান্ত শাসকরা কুরুক্ষেত্রে সমবেত হয়েছিল, তেমনি নবদ্বীপে সত্যযুগের মুনি-ঋষিরা অহিংসা, প্রেমের বাণী নিয়ে গোরার অনুগামী হিসেবে হাজির হবে। মানুষ নাচবে গাইবে, প্রেমের আবেগে কোলাকুলি করে আনন্দে কাঁদবে। তৈরি হবে সাধুসমাজ প্রতিষ্ঠার যথার্থ আবহ, নিষ্কলুষ মাটি। মাটি তৈরির কাজ শুরু হয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে।

ঈশ্বরপুরীর মুখে গোরার বিবরণ শুনে রোমাঞ্চিত লক্ষ্মীপতি, পৃথিবীতে অপ্রকট হওয়ার কয়েকদিন আগে কুবেরকে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দিল। কুবেরই ছিল মহাগুরু লক্ষ্মীপতির শেষ শিষ্য। সাতবছর আগে নবদ্বীপে এসে গোরার বিয়ের আসরে হাজির থেকে, তার কাছাকাছি কয়েকদিন কাটিয়ে, সেই আনন্দের স্মৃতি কুবের ভোলেনি। গোরার চেহারা, চালচলন পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হলেও তাকে এক মুহূর্তের জন্যে ঈশ্বরের অবতার মনে হয়নি কুবেরের। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, উঁচু মাপের একজন মানুষ ছাড়া গোরাকে সে আর কিছু ভাবতে পারেনি। নবদ্বীপ ছেড়ে কাটোয়ায় বৈদ্য মুকুন্দ, তার ভাই নরহরির সঙ্গে দেখা করে খলাপপুরে ফিরে অবধূত গুরুর দর্শনে কুবের ফের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। প্রথম দফায় সাধুসঙ্গে কয়েকবছর কাটিয়ে সংসার থেকে তার মন চলে গিয়েছিল। স্বভাবে ঢুকে গিয়েছিল বাউন্ডুলেপনা। পথের নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল। পথের শেষ কোথায়, প্রশ্ন করলে সে বলত, ‘পথে’। পথই তার মতে ঈশ্বর, গুরু আর শেষ অখণ্ড অনন্ত। গুরুর সঙ্গে দেশের নানা তীর্থে পরমানন্দে ঘুরে বেড়ানোর মতো তৃপ্তি কোনও কাজে নেই, সে অনুভব করছিল। সাতবছরের পরিব্রাজক জীবনে মশগুল হয়ে থাকার সময়ে প্রায়ই গোরাকে তার মনে পড়ত। গোরার জন্যে এমন টান জাগত বুকের ভেতরে, যা তার মতো বাউণ্ডুলে অবধূতের প্রকৃতিগত নয়। গোরার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করত। শচীর মুখ মনে পড়লে খেয়াল হত তার আর এক মা রয়েছে নবদ্বীপে। মাতৃদর্শনের জন্য ব্যাকুল হত সে। গুরুর নির্দেশে নবদ্বীপে এসে কুবের টের পেল ঠিক জায়গায় দীক্ষাদাতা পাঠিয়েছে তাকে। সাতবছর আগে যে গোরার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, দ্বিতীয়বার নবদ্বীপে এসে তাকে নতুন করে দেখল। এক জন্মে একজন মানুষের যে পুনর্জন্ম ঘটতে পারে, গোরাকে দেখে সে বুঝতে পারল। তার শরীরে শিহরন জাগল। অনিন্দ্যসুন্দর, সুদেহী সেদিনের নিমাই পণ্ডিত, সাতবছরে একদম পাল্টে গেছে। গোরার সঙ্গে ইহজীবনের মতো জড়িয়ে গেল কুবের। নতুন নাম পেল সে। গোরা নাম দিল, নিত্যানন্দ, মুখে মুখে যা হয়ে গেল নিতাই।

খলাপপুরের গর্ভধারিণী মায়ের পাশাপাশি সাতবছর আগে যেমন নবদ্বীপে এসে বিশ্বরূপ, গোরার মা, শচীকে নিজের নতুন মা হিসেবে পেয়েছিল, দ্বিতীয়বার এসে তারই সমান স্নেহময়ী আরও এক মা পেল, সে শ্রীবাস পণ্ডিতের বউ মালিনী। সদ্যোজাত সন্তানের মতো শ্রীবাসের সংসারে আশ্রিত আলাভোলা নিতাইকে স্নেহাতুর মালিনী কোলে টেনে নিয়েছিল। মায়ের আদরে বেশি করে শিশুর মতো আচরণে মেতে উঠল নিতাই। তেত্রিশবছরের নিতাই-এর যাবতীয় আবদার তিনবছরের কোলের ছেলের মতো সামলাচ্ছিল মালিনী।

নন্দন আচার্য বাড়িতে অদ্বৈতকে আনতে রামাই যাওয়ার আগে সেই সকালে মালিনীর সংসারে এমন এক কাণ্ড ঘটেছিল, যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল তাকে। গোরাকে বিষ্ণুমন্দিরের খাটে বসিয়ে দিয়ে নিতাই বাইরে দাওয়ায় এসে উঠোনে মুখ চুন করে মালিনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, মা কি হয়েছে তোমার?

নিতাই-এর প্রশ্নে মালিনী জানিয়েছিল, বিষ্ণুপুজোর চন্দনের বাটিটা মেজে দিতে বলে উঠোনে রেখে গিয়েছিল শ্রীবাস। বুকের যন্ত্রণায় ঘরের দরজা বন্ধ করে তখন শুয়েছিল মালিনী। স্বামীর গলা শুনে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েই দেখল, শক্ত চঞ্চুতে চন্দনের বাটি কামড়ে ধরে একটা বেআক্কেলে কাক উঠোন থেকে নিয়ে চলে গেল।

ঘটনাটা বলতে গিয়ে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল মালিনীর মুখ। তার শরীর কষ্টে কাঁপছে, নিতাই-এর নজর এড়ায়নি। ভগবান বিষ্ণুর চন্দনের বাটি বউ-এর চোখের সামনে থেকে কাক নিয়ে পালিয়েছে, শুনলে রগচটা স্বামী শ্রীবাস যে অনর্থ করবে, মালিনী যেন জানত, নিতাই ও বুঝে গিয়েছিল। মালিনীকে শান্ত করতে সে জানিয়েছিল, বিষ্ণুপুজোর বাটি নিয়ে পালানোর উপায় কাকের নেই। কাকবাবাজিকে চন্দনের বাটি এই উঠোনেই ফেরত দিয়ে যেতে হবে।

মালিনীর পিঠে হাত রেখে নিতাই বলেছিল, মা তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো, চন্দনের বাটি ফিরিয়ে আনার দায় আমি নিলাম। তুমি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করো।

নিতাই যে ফাঁকা কথা বলার ছেলে নেয়, তার কথা মিথ্যে হওয়ার নয়, গেল কয়েকমাসে মালিনী বুঝে গেলেও তাকে পুরো বিশ্বাস করতে পারছিল না। অসহ্য কষ্টে টনটন করছিল মালিনীর বুক। বুকের যন্ত্রণা ঠোঁট কামড়ে সে যখন ঘরে ঢুকছে, নিতাই দেখল তার মায়ের বুকের কাপড় দুধে ভিজে উঠেছে। আগেও কয়েকবার এ ঘটনা তার নজরে এসেছে। সে মুখ খোলেনি। সেদিনও চুপচাপ থেকে মালিনীকে আশ্বস্ত করে তখনই বাড়ির সদর দরজার বাইরে, মাঠের শেষে ঝাঁকড়া যে নিমগাছটায় কাকের আড্ডা, সেখান পৌঁছে গেল। খাবারের খোঁজে তামার বাটিটা ভুল করে কাক নিয়ে গেলেও ঠোঁটে বাটির ভার নিয়ে প্রাণীটা বেশি দূর যেতে পারবে না, নিতাই আন্দাজ করেছিল। বড়জোর নিমগাছ পর্যন্ত তার দৌড়। নিমগাছের বাসায় বাটিটা রেখে, শক্ত বাটিটা দু-একবার ঠোঁট দিয়ে ঠুকে বেজার হয়ে নিজের বাসায় রেখে খাবারের খোঁজে অন্য কোথাও উড়ে যাবে। ধাতব বাটিটা বাসা থেকে ফেলেও দিতে পারে মাটিতে। চন্দনের বাটি উদ্ধারে কৃতসঙ্কল্প নিতাই, নিমগাছের তলায় এসে গাছে উঠে কাকের বাসাগুলোয় হানা দেওয়ার আগে গাছতলাটা ভালো করে একবার খুঁজে দেখে নিতে চাইল। খুব বেশি খুঁজতে হল না। রোজ মাজাঘসায় চকচকে তামার বাটিটা নিমগাছের ছায়ায় যেখানে এক চিলতে রোদ লুটিয়ে রয়েছে, তার কাছাকাছি পেয়ে গেল। বাটিটা পেয়ে নিতাই-এর আনন্দ ধরে না। তাড়াতাড়ি মালিনীর হাতে বাটি তুলে দিতে তার ঘরের বন্ধ কপাটের বাইরে সে এসে দাঁড়াল। ঘরের সামনে উঠোন ফাঁকা। প্রথম সকালের আলোয় ঝকঝক করছে ঊষাকালে গোবরজলে নিকোনো পরিচ্ছন্ন উঠোন। যন্ত্রণাকাতর মালিনীর গোঙানি শুনে তার ঘরের বন্ধ কপাটে নিতাই টোকা দিল। দু’তিনবার টোকা দিয়ে ঘরের ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ না পেয়ে নিতাই বলল, মা দরজা খোলো, আমি তোমার নিতাই। চন্দনের বাটি নিয়ে এসেছি।

বিষ্ণুমন্দিরে সকালের পুজো আয়োজনে ব্যস্ত পরিবারের মেয়ে, বউদের কেউ কেউ উঠোন দিয়ে যাতায়াত করলেও মালিনীর বন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিতাই-এর দিকে তাকাল না। ঘরের ছেলে নিতাই, অবধূত সন্ন্যাসী, বালকের মতো স্বভাব। মায়ের কাছে মাঝে মাঝে নতুন আবদার নিয়ে সে ধর্না দেয়, পরিবারের সবাই জেনে গেছে। মালিনীর বানানো ছড়া তেঁতুলের আচার, আমলকির আচার যখন তখন তার ঘরে ঢুকে কড়িকুটো থেকে বার করে সে খায়। মাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করে না। তাকে প্রশ্রয় দেয় মালিনী, তার কাণ্ডকারখানা দেখে হাসে। কাকে নিয়ে যাওয়া চন্দনের বাটি নিতাই উদ্ধার করে এনেছে শুনে প্রবল কষ্টের মধ্যেও চাটাই থেকে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার একটা পাল্লা অর্ধেক খুলে মুখ বার করে দাঁড়াল মালিনী। নিতাই-এর হাতে তামার বাটি দেখে খুশি হলেও যন্ত্রণায় উচ্ছ্বাস প্রকাশের ক্ষমতা নেই। নিতাই দেখল মায়ের বুকের কাপড় দুধে ভিজে সপসপ করছে। অবধূত গুরুর সঙ্গে দেশ-দেশান্তর ঘুরে বেড়ানোর বছরগুলোতে অনেকরকম শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা থেকে নিতাই জেনেছিল, মাতৃস্থানীয়া স্ত্রীজাতির কয়েকজনের শরীরে এমন কিছু ঘটে, যা চরক, শুশ্রুতের আয়ুর্বেদশাস্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। মহামহোপাধ্যায় কবিরাজরা পর্যন্ত নিজেদের সব বিদ্যেবুদ্ধি প্রয়োগ করে যন্ত্রণাকাতর রোগিণীর শারীরিক সমস্যার সুরাহা করতে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। রোগটা বড়রকম কিছু না হলেও রোগের কারণ জানা যায়নি। কিছু কুমারী মেয়ের এমনকি সন্তানধারণের বয়স পেরিয়ে আসা স্ত্রীলোকের বছরে এক, দু’বার বুকের দুধভাণ্ডারে অকারণে জোয়ার আসে। তাদের কোলে দুধের শিশু না থাকায় দুধের ভারে স্তন ফেটে পড়ার দশা হয়। অসহ্য কষ্টে টাটিয়ে ওঠে বুক, সারা শরীর বিষব্যথায় টনটন করে, হতভাগিনী আছাড়-পাছাড় করতে থাকে।

মালিনীরও এরকম হয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে ভাঙা গলায় পশুর মতো সে গোঙাতে থাকে। শরীরে এ ধরনের বিকার দশ হাজার মেয়েমানুষের মধ্যে এক-দু’জনের হয়ে থাকে। পারিবারিক চিকিৎসক, মুরারি গুপ্তের পাঁচন, পুরিয়ায় সামান্য উপকার হলেও মালিনীর এ ব্যাধি যে নিরাময়হীন, পরিবারের বয়স্কদের অজানা নয়। দরজা বন্ধ করে মালিনীর ডুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজ শোনা, সংসারের সকলের গা-সহ্য হয়ে গেছে। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও জেনে গেছে বছরে এক-আধবার মেজোখুড়ির ভোগান্তির ঘটনা। সবচেয়ে ভালো করে অনুভব করে নারায়ণী, মা হওয়ার একমাসের মধ্যে শিশুসন্তানকে হারিয়ে এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল তাকে। পরিবারের বড় মেয়ে, বিধবা নারায়ণীর সেই দুর্ভোগ আজও কাটেনি। স্বামী, ছেলে হারানোর দুঃখের সঙ্গে বুকের দুধভাণ্ডারে তীব্র যন্ত্রণায় বছরখানেক আগেও তার নাভিশ্বাস ওঠার দশা হত। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে প্রথমে বাপের বাড়ি, তারপর কাকাদের সংসারে আসার পর থেকে তার বুকে দুধের চাপ কমে এলেও এখনও হয়। লজ্জায় কাউকে বলে না। সকাল, সন্ধে বুকের কাপড় এখনও দুধে ভিজে যায়। তখন পুকুরঘাটে গিয়ে গলা পর্যন্ত জলে ডুবে গোটা শাড়ি জলে ভিজিয়ে নেয় সে। আকণ্ঠ জলে ডুবে থেকে মনে মনে ভাবে, হায় রে, আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে তার দুধের অভাব হত না। নবদ্বীপে আসার পর বছর দেড়েক তার মাথায় এ চিন্তা যাতায়াত করলেও ক্রমশ তা যখন ফিকে হচ্ছিল, তখনই কোথা থেকে এক অবধূত সন্ন্যাসী হাজির হয়ে বিধবা মেয়েকে ‘পুত্রবতী হও’ আশীর্বাদ করে তার মাথার ভেতরটা গুলিয়ে দিল। মেজোখুড়ির ছেলের মতো, সেই নিতাই এ বাড়িতে থেকে গেলেও তার আশীর্বাদটা সে ফিরিয়ে নেয়নি। নারায়ণীর দিকে সে চোখ তুলে কখনও তাকায়নি। পরিবারের কারও দিকেই তাকায় না। নিজের ভাবে নিজে বুঁদ হয়ে থাকে আর মেজোখুড়ির দেখা পেলে ‘মা’ মা’ করতে থাকে। তার পৃথিবী জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে গোরা গোরার সঙ্গ পেলে তাকে ছেড়ে আর কোথাও যায় না।

গৃহদেবতা বিষ্ণুর পুজোর জোগাড় করতে মন্দির থেকে বাড়ির অন্দরমহলে চন্দনের বাটি আনতে গিয়ে অনেক খুঁজে সেটা না পেয়ে, মন্দিরে ফিরে যাওয়ার পথে দূর থেকে নারায়ণী দেখল, মেজোখুড়ির ঘরের আধখোলা দরজার সামনে তামার বাটি হাতে নিতাই দাঁড়িয়ে কথা বলছে। চন্দনের বাটি দেখে তখনই চিনতে পারল সে। মেজোখুড়ির ঘরের সামনে এসে ঈষৎ ফাঁক করা পাল্লার আড়ালে তার আধখানা মুখের সঙ্গে বুকের সপসপে ভিজে একফালি কাপড়ও নারায়ণী দেখতে পেল। নিতাই-এর দিকে না তাকিয়ে মালিনীকে সে বলল, চন্দনের বাটিটা চাইছে মেজো কাকা।

তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার হাতে চন্দনের বাটিটা নিতাই ধরিয়ে দিতে ফিক করে হেসে নারায়ণী যখন চলে যাচ্ছে, কষ্টে বুজে যাওযা গলায় ভাসুরঝিকে মালিনী বলল, ভালো করে বাটিটা গঙ্গাজলে মেজে নিস রে নারায়ণী।

সাড়া করল না নারায়ণী। মেয়েমানুষের মন, আলোড়ন উঠল সেখানে। ঢেউ-এর মতো পরের পর প্রশ্ন জাগছিল। নিতাই-এর হাতে চন্দনের বাটি কীভাবে গেল, বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিল সে। দরজার পাল্লা ধরে কাঁপছিল মালিনী। দরদর করে তার দু’চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ফ্যাকাসে মুখ। মায়ের দুর্দশা দেখে নিতাই যে কাণ্ডটা করল, বাইরের লোকের চোখে তা নীতিবিগর্হিত, দুঃসাহসী ঠেকলেও মায়ের শুশ্রূষায় বালক সন্তান অনায়াসে তা করতে পারে। মালিনীকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে ঘরের কপাট হা হা খুলে রেখে, তার স্তন্যপান করতে শুরু করল নিতাই। মায়ের পালানে মাথার গুঁতো দিয়ে বাছুর যেভাবে দুধ খায়, সেভাবে এক দণ্ড ধরে দুটো স্তনের দুধ নিঃশেষ করে খেয়ে নিল সে। ধীরে ধীরে কেটে গেল মালিনীর শরীরের যন্ত্রণা। মালিনীর ফ্যাকাসে মুখে রক্তসঞ্চালন শুরু হতে শরীরে আরাম পেল সে। নিতাই বলল, মা যতদিন তোমার এই ছেলে বাড়িতে আছে, বুকের ব্যামোতে তোমাকে আর কষ্ট পেতে হবে না। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে ছেলেরও খিদের নিবৃত্তি ঘটবে।

এক মুহূর্ত থেমে মালিনীকে নিতাই বলল, যাও, চান সেরে পোশাক বদলে মন্দিরে যাও। গৃহদেবতার সঙ্গে তাঁর অবতারও সেখানে তোমার অপেক্ষায় রয়েছে। তুমি না গেলে শ্রীবাস পণ্ডিত পুজো শুরু করতে পারবে না।

মন্দিরে যাওয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে মালিনী বাড়ির ভেতরে ঢুকে যেতে দরদালানে দাঁড়াল নিতাই। নারায়ণীকে দ্রুত উঠোন পেরিয়ে চলে যেতে দেখে সে হাসল। ইতিমধ্যে আরও একবার নারায়ণীকে উঠোন পেরিয়ে সে যেতে দেখেছে। দুধভাণ্ডারের যন্ত্রণা থেকে সে তখন তার মাকে রেহাই দিচ্ছিল। এরকম কিছু দেখার জন্যেই নারায়ণী ঘরবার করছে, তার হাঁটা, তাকানোর ভঙ্গিতে নিতাই বুঝলেও এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ সে নয়। ঘরছাড়া, উদাসীন অবধূত সে। লক্ষ্মীপতির কাছে বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা নিলেও সংসারী মানুষের মানবধর্মকে সে কখনও অবহেলা করেনি। মানুষের ধর্মীয় পরিচয় জানার আগে মানুষ হিসেবে তাকে সম্মান জানিয়েছে। সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে সে বিহবল হয়, তাকে প্রবোধ দেয়, সাধ্যমতো সাহায্য করে। গর্ভধারিণী, মায়ের স্বরূপ, স্ত্রীজাতি সম্পর্কে তার সীমাহীন শ্রদ্ধা। বিশেষ করে ‘মা’ বলে যাকে ডেকেছে, তার জন্যে হাসতে হাসতে সে জীবন দিতে পারে। মালিনীকে বাড়ির ভেতরে পাঠিয়ে বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে এল নিতাই। সেখানে তখন সঙ্কীর্তন জমে উঠেছে। তাকে দু’হাত বাড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে গোরা জিজ্ঞেস করল, কোথায় ছিলে এতক্ষণ বন্ধু?

মন্দিরা, খোল, করতালের সঙ্গে সমবেত কীর্তনের আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল নিতাই-এর কথা। তার জবাব শোনার অবস্থা গোরার ছিল না। উদ্দণ্ড নাচে মেতে উঠেছে সে। হুঁশ ফিরে পেয়ে অদ্বৈত তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। নাচের দলে নিতাইকে দেখে অদ্বৈতের ভাবাবেশ কেটে যেতে থাকল। নবদ্বীপে নিতাই-এর আসার খবর অদ্বৈত আগে থেকে জানলেও সেই মুহূর্তে তার মনে প্রশ্ন জাগল, অবধূত গুরুর চেলা, এ ছোকরা আবার এল কোথা থেকে? কোথায় ডুব মেরে ছিল এতক্ষণ?

সাতবছর আগে গোরার সঙ্গে লক্ষ্মীর বিয়ের সময়ে নিতাইকে সে প্রথম দেখেছিল, তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নিতাই-এর। তারপর সাতবছর বেপাত্তা থেকে পাঁচ, ছ’মাস আগে সে নবদ্বীপে এলেও এ পর্যন্ত তার সঙ্গে অদ্বৈতের দেখা হয়নি। নিতাই-ও দেখেনি অদ্বৈতকে। নবদ্বীপে সে রওনা হওয়ার আগে, তাকে গুরু লক্ষ্মীপতি জানিয়েছিল, সেখানে পৌঁছে শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে সময় করে দেখা করতে। অদ্বৈত যে তার শিষ্য, মাধবেন্দ্রের শিষ্য পরম্পরা বিচারে কুবেরও অদ্বৈতের গুরুস্থানীয়, কুবেরকে জানাতে লক্ষ্মীপতি ভোলেনি। তখনও অবশ্য সে নিত্যানন্দ বা নিতাই হয়নি। তখনও সে হাড়াই পণ্ডিতের ছেলে কুবের। অদ্বৈতের সঙ্গে মাধবেন্দ্রর আর এক শিষ্য ঈশ্বরপুরীও তার গুরুভাই-এর শিষ্য তখনই কুবের জেনেছিল। গুরু-পরম্পরায় অদ্বৈত, ঈশ্বরপুরীর মতো দু’জন পরম ভাগবদকে অনুগামী হিসেবে পেলেও তাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার আগে গোরার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল নিতাই। নবদ্বীপে নিতাই-এর আসার খবর অদ্বৈতের কানে গেলেও সাতবছর আগে দেখা সেই বাউণ্ডুলে অবধূত এখন লক্ষ্মীপতির কাছে কাছে দীক্ষা নিয়ে গুরুর গুরু যাকে বলা যায় মহাগুরু, পরিব্রাট অবধূত থেকে পরম ভক্তে রূপান্তরিত হয়েছে, তার জানা ছিল না। কুবেরই ছিল একশ’ বত্রিশ বছর বয়সী লক্ষ্মীপতির শেষ শিষ্য। কাটোয়ার নরহরি সরকারের সূত্রে শুধু গোরা জানত, লক্ষ্মীপতির কাছে কুবেরের দীক্ষা নেওয়ার ঘটনা। গুরু ঈশ্বর পুরীর গুরু, মাধবেন্দ্র, তার গুরু লক্ষ্মীপতি, সেই লক্ষ্মীপতির শিষ্য কুবের সম্পর্কে সে নবদ্বীপে পা রাখার আগেই গোরার মনে আকাশচুম্বি শ্রদ্ধা আর বিস্ময় তৈরি হয়েছিল। কুবেরকে সে আজ থেকে চেনে না। ছেলেবেলায় চিঠির সূত্রে যোগাযোগ ঘটেছিল। সাতবছর আগে প্রথমা স্ত্রী লক্ষ্মীর সঙ্গে বিয়ের দিনকয়েক আগে কাটোয়া থেকে কুবেরকে ধরে এনে গোরা নিজের বাড়িতে তুলেছিল। নবদ্বীপে তার বাড়িতে তিন, চার দিন থেকে খলাপপুরে ফিরে যাওয়ার আগে কুবের জানিয়েছিল, আবার দেখা হবে। দেখা না হয়ে উপায় নেই।

মহাগুরুর গুরুভাই কুবেরের নবদ্বীপে আসার ঘটনা সেখানকার জনসমাজ জানলেও সে যে ঈশ্বরপুরী, অদ্বৈত আচার্যের গুরু, মাধবেন্দ্র পুরীর গুরুভাই, তা গোরা আর দু’চারজন ছাড়া কেউ জানল না। নিত্যানন্দকে গোরা অভিভাবক হিসেবে মেনে নিল। উল্টোদিকে গোরাকে ঈশ্বরের অবতারের আসন দিয়ে মাথায় তুলে নিল নিতাই। তার সঙ্গ পেয়ে নবদ্বীপে খুশিতে গোরার মাতামাতি করার বিবরণ নানা জনের মুখে শুনে অদ্বৈত বিরক্ত হচ্ছিল। নাম-পরিচয়, কুলশীলহীন, সন্দেহভাজন এক অবধূত বিনা আবাহনে, কীভাবে নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজে ঢুকে পড়ে রাতারাতি তাদের হৃদয় জয় করে নিল, অদ্বৈত ভেবে পেল না। কিছুটা উদ্বিগ্ন হল সে। ভণ্ড সন্ন্যাসী সে কম দেখেনি। সিঁধেল চোরের চেয়ে তারা সাংঘাতিক। যে কোনও অপকর্ম তারা করতে পারে। নবদ্বীপে যাওয়ার আগে থেকে অদ্বৈতের মাথায় এসব দুশ্চিন্তা পাক খাচ্ছিল। যার সম্পর্কে ঘোর অবিশ্বাস নিয়ে নন্দন আচার্যর বাড়ি থেকে শ্রীবাসের বাড়িতে অদ্বৈত রওনা হয়েছিল, সেই নিতাইকে শ্রীবাসের গৃহদেবতার মন্দির চাতালে সঙ্কীর্তনের আসরে না দেখে আশ্বস্ত হল অদ্বৈত। নিতাই তখন মালিনীর যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে সঙ্কীর্তনের দলে সে ঢুকে পড়তে, তাকে দেখে অদ্বৈতের ভির্মি খাওয়ার দশা হল। অদ্বৈতের দিকে নজর ছিল গোরার। অদ্বৈতের মুখের চেহারা দেখে নাচের বেষ্টনীর মধ্যে তাকে ঘিরে নিয়ে তার কানে ফিসফিস করে গোরা জানাল, কুবের আর অবধূত সন্ন্যাসী নয়, সে এখন পরম বৈষ্ণব, মহাসাধক লক্ষ্মীপতির শিষ্য, অদ্বৈতের গুরু, মাধবেন্দ্র পুরীর গুরুভাই, কুবের এখন নিত্যানন্দ। নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজের সে প্রণম্য।

কীর্তন আর নামজপের কলরোলের মধ্যে অদ্বৈতের কানে কথাগুলো ঢোকাতে একাধিকবার বলতে হল গোরাকে। মহাসাধক লক্ষ্মীপতির কাছে নিতাই-এর বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার ঘটনা শুনে আনন্দে রোমাঞ্চিত হল অদ্বৈতের শরীর। মহাভাবের ঢেউ শরীরে জাগতে নিতাই-এর পায়ের কাছে সে লুটিয়ে পড়ার মুহূর্তে তাকে দু’হাতে বুকে ধরে নাচের শরিক করে নিল নিতাই। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুবকের বিক্রমে নাচতে থাকল বৃদ্ধ অদ্বৈত। মাঝদুপুরে চন্দ্রালোকের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল সঙ্কীর্তনের আসরে। শ্রীবাস আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। নাচের দলে ঢুকে অদ্বৈতকে বুকে জড়িয়ে সে-ও নাচতে শুরু করল। পুজোর ডালি সাজাতে বসে অন্যমনস্ক নারায়ণীর হাতে লেগে আতপচালের নৈবেদ্য একবার ভেঙে গেল, সাজি থেকে পুজোর ফুল, কলাপাতায় রাখতে গিয়ে মুঠো আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তার পাশে বসে থাকা পরিবারের বউদের দু’একজন এসব নজর করলেও গুরুত্ব দিল না। অল্পবয়সে বিধবা, ছেলে হারানোর শোকে নারায়ণী গোড়ায় পাথর হয়ে গেলেও শ্রীবাসের সংসারে এসে গৃহদেবতা বিষ্ণুর নিত্যপুজোর দায়িত্ব পেয়ে ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে সে সঁপে দিয়েছে। ধীরে ধীরে এতই ভক্তিমতী হয়ে উঠেছে, গভীর রাত পর্যন্ত দেবতার ধ্যানে মন্দিরের চাতালে কাটিয়ে রাতে সেখানেই শরীরে জড়ানো থানকাপড়ের একচিলতে পেতে ঘুমিয়ে থাকে। ভোরের পাখি ডাকার আগে জেগে যায়। কখনও ঘুম না ভাঙলে খুড়িমা মালিনী এসে তাকে ডেকে তুলে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বেঢপ জায়গায় ঘুমিয়ে থাকার জন্যে বকাঝকা করে। ভালবাসার সেই বকুনি শুনে নারায়ণী মুচকি হেসে বলে, তুমি যতক্ষণ আছো, আমার কোনও বিপদ হবে না।

মা-বাবা, স্বামী-সন্তান, সংসার হারানো নারায়ণীর স্বীকারোক্তিতে কোনও খাদ নেই, প্রকৃতপক্ষে সে যখন সর্বস্ব খুইয়ে অনাথ ভিখারিণীর মতো শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়িতে আশ্রয় পেল, দশভুজা মায়ের মতো মালিনী তখন থেকে আগলে রেখেছে তাকে। শিশুসন্তান হারানোর পরে দিনে একাধিকবার টইটম্বুর দুধভাণ্ডারের চাপে যন্ত্রণায় তার মুখ শুকিয়ে যেত, ভাঁজ পড়ত কপালে, পরিবারের মানুষের নজর এড়াতে নির্জন পুকুরঘাটে গিয়ে বসে থাকত, তখন ভুক্তভোগী মেজোখুড়ি, মালিনীই প্রথম টের পেয়েছিল, অকালবিধবা, সদ্য ছেলে হারানো এই অল্পবয়সি মেয়েটি কী অসহ্য কষ্ট পাচ্ছে। মালিনীই তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল, পুকুরে গলা পর্যন্ত নেমে, জলের তলায় বুকের দুধ বার করে দিয়ে যন্ত্রণা কমাতে। লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে উপশম পাওয়ার এই পরামর্শ মেনে নারায়ণীর লাভ হয়েছিল। সে জেনেছিল, মেজোখুড়ির বুকেও অকারণে দুধ উথলে ওঠার এই ব্যাধি রয়েছে। তার বুকও যখন তখন দুধে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কোলের ছেলে বড় হয়ে গেলেও বুকের মধ্যে ভরা বর্ষার নদীর স্রোতের মতো দুধের ঢল নামে। যন্ত্রণায় সে তখন ছটফট করতে থাকে। তার ব্যাধিটা জটিল। পুকুরের জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে নিজের হাতে দুধ খসানো যায় না। উল্টে যন্ত্রণা বেড়ে যায়। নারায়ণীকে নানা কথার মধ্যে মালিনী একবার বলেছিল, সে প্রায়ই ভাবত, বাচ্চা কোলে নবদ্বীপে কখনও নারায়ণী এলে, মায়ের দুধের অভাব তার ছেলের হবে না। মায়ের সঙ্গে ঠাকুমার বুকের দুধ খেয়ে তরতর করে বড় হয়ে উঠবে সে। স্বামী, সন্তান হারিয়ে পাকাপাকিভাবে নারায়ণীকে নবদ্বীপে কাকার আশ্রয়ে থাকতে হবে, মালিনী কখনও ভাবেনি। নারায়ণী কি ভেবেছিল?

প্রশ্নটা মনে জাগতে তার বুকের দুধভাণ্ডার অসময়ে যন্ত্রণায় টনটন করে উঠল। দুপুরের শুরুতে গৃহদেবতার পুজোর সময়ে আগে কখনও এরকম হয়নি। হপ্তায় এক-দু’দিন সূর্য ওঠার আগে আর শেষ বিকেলে এরকম ঘটলে সে পুকুরঘাটে চলে গিয়ে বুকের ভার হাল্কা করে ঘরে ফিরে আসে। কোনও সকালে একবার ব্যথা হলে পরপর দু’তিন দিন, সে আরামে থাকে। তারপর হপ্তা শেষ হওয়ার আগে আবার একদিন শেষ বিকেলে বুকের যন্ত্রণা উজিয়ে উঠলে পুকুরে আকণ্ঠ ডুবে সে নিরাময়ের ব্যবস্থা করে।

প্রদীপ জ্বেলে পুরোহিত পুজো শুরুর মুহূর্তে বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় কেন কুঁকড়ে গেল, নারায়ণী বুঝতে পারল না। ফুলের থালা তুলে সে যখন পুরোহিতের হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছে, তার পাশে এসে বসল মেজোখুড়ি। স্নান সেরে, শরীরে নিত্যপুজোর লাল পাড় গরদের শাড়ি জড়িয়ে খুড়িমা পাশে এসে বসতে তার শান্ত, মোলায়েম মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা নারায়ণীর মনে পড়ে গেল। হাট করে দরজা খুলে রেখে মেজোখুড়ির ঘরে ঢুকে তার বুকের দুধ নিতাইকে শিশুর মতো দু’চোখ বুজে খেতে দেখে নারায়ণীর শরীর জুড়ে যে শিহরন জেগেছিল, পুজোর আয়োজনে বসে তা কাটেনি। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ায় কাজে ভুল হচ্ছিল। নিতাই-এর দুধ খাওয়ার দৃশ্যটা মন থেকে সে সরাতে পারছিল না। আর কেউ এ ঘটনা দেখেছে কিনা, এ প্রশ্নও তার মনে জাগছিল। খোলা দরজা দিয়ে পরিবারের দু-একজন দেখে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বুকের ব্যথা যে তখনই শুরু হয়েছে, মেজোখুড়ি পাশে এসে বসাতে নারায়ণী টের পেল। তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল, হাত থেকে খসে পড়ল জ্বলন্ত ধুনুচিতে হাওয়া দেওয়ার তালপাতার পাখা। সঙ্কীর্তনের আসরে গোরার সঙ্গে অদ্বৈত এসে নাচ জুড়েছে শুনে নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজের অনেকে এসে হাজির হয়েছে। ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। মালিনীকে নারায়ণী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, খুড়িমা, তোমার বুকের ব্যথা কমেছে?

মালিনী জানে, তাকে প্রায়শই কষ্ট পেতে দেখে বিধবা এই ভাসুরঝি ভারি অস্থির হয়। খুড়িমাকে পাথরের খলে মেড়ে মুরারির দেওয়া ওষুধ খাওয়ানোর সঙ্গে সাধ্যমতো সেবা শুশ্রুষা করে। নিজের পেটের মেয়ের চেয়ে নারায়ণীকে মালিনী কম ভালবাসে না। নিচু গলায় সে বলল, আজ সকাল থেকে আমার যে কি সৌভাগ্য, আমার উপর ভগবানের কী অসীম দয়া, তা বলে বোঝাতে পারব না। চন্দনের বাটি উঠোন থেকে কাক ঠোঁটে তুলে নিয়ে গিয়ে, সে বাটি নিজেই ফেরত দিয়ে গেল। সেইসঙ্গে সেরে গেল আমার বুকের কষ্ট!

পুরোহিতকে পুজোর উপচার ক্রমাগত যুগিয়ে চলেছে নারায়ণী, সঙ্কীর্তনের তোড়ে খুড়িমার কথা তার কানে যে ঢুকছে না, ভাসুরঝিকে এক পলক দেখে মালিনী ধরে ফেলল। কিছু ভেবে নারায়ণীকে প্রশ্ন করল, তোকে এত আনমনা দেখাচ্ছে কেন? শুকনো মুখ, উসকোখুসকো চুল, জ্বরজারি হল না তো? তাড়াতাড়ি নিজেকে নীরোগ সাজাতে মুখে হাসি টেনে নারায়ণী বলল, কিছু হয়নি। ধুনোর ধোঁয়া লেগে মুখটা এরকম দেখাচ্ছে। চুল অগোছালো হয়েছে হাত পাখার হাওয়াতে। জোরকদমে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে মালিনী কথা বাড়াল না। মনে মনে ভাবল, তার এই ভাসুরঝিটা বড় দুঃখী। নবদ্বীপে ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে পরিবারের বড় ছেলে নলিনী পণ্ডিত বউ, মেয়ে নিয়ে গঙ্গার উল্টো তীরে কুলিয়াতে সংসার পেতেছিল। তিনভাই, শ্রীরাম, শ্রীপতি, শ্রীনিধিকে নিয়ে তাদের দাদা শ্রীবাস, সপরিবারে থেকে গিয়েছিল নবদ্বীপে। কুলিয়ায় বাসা করে নলিনী পণ্ডিত বছর দুই, মেয়ে, বউ নিয়ে সংসার করার পরে তার স্ত্রী-বিয়োগ ঘটে। নারায়ণী তখন চারবছরের মেয়ে। কুলিয়া থেকে মাতৃহীন ভাইঝিকে নিজের সংসারে আনতে গিয়েছিল শ্রীবাস। ছোট তিন ভাই-এর একজন, শ্রীপতিকে সঙ্গে নিয়ে নলিনীর বাড়িতে পৌঁছে শ্রীবাস দেখল, নলিনীর বড় বউ মারা গেলেও গৃহিণীর পিঁড়ে খালি পড়ে নেই, কোনও এক কুলীন ব্রাক্ষ্মণ শ্বশুরঘরে রেখে আসা নলিনীর মেজোবউ সংসারের কর্ত্রীত্ব দখল করেছে। কুলীন ব্রাক্ষ্মণ পরিচয়ের অধিকারে তাদের দাদা যে বেশ কয়েকটা বিয়ে করে, মূল সংসারকে পাশ কাটিয়ে বছরের নানা সময়ে বিভিন্ন শ্বশুরালয়ে দর্শন দিয়ে, কিছুকাল আরামে কাটিয়ে, নিজের সংসারে কয়েকদিনের জন্যে ফিরে এসে ফের উধাও হয়ে যায়, এ খবর শ্রীবাস আগেই পেয়েছিল। কুলিয়ায় দাদার জাঁদরেল মেজোগিন্নিকে দেখে শ্রীবাস টের পেল, এই স্ত্রীলোকটি জব্দ করে দেবে নলিনী পণ্ডিতকে। দাদা-বউদির নতুন সংসারে শিশু নারায়ণী কীভাবে বড় হয়ে উঠবে, এই ভেবে শ্রীবাসের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। নারায়ণীকে নবদ্বীপে নিজের সংসারে নিয়ে যাওয়ার কথা সে পাড়তে নলিনী নিমরাজি হলেও দশবছর ধরে কুলীন ব্রাক্ষ্মণ স্বামীকে মরশুমি দস্তুরি দেওয়া তার সহধর্মিণী, মানে নলিনীর মেজোবউ খেঁকিয়ে উঠল। শ্রীবাসকে তার বউদি জানাল, নারায়ণীকে নিয়ে কাকাদের ব্যস্ত হওয়ার কারণ নেই। মেয়ের মা মারা গেলেও বিমাতা আছে। বিমাতাও মা হতে পারে। নারায়ণীর ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে তার বাবা, মা। নারায়ণী দশে পা দিলেই উপযুক্ত কুলীন পাত্র খুঁজে তার বিয়ে দেওয়া হবে। সময়মতো শ্বশুরঘরে চলে যাবে সে।

কাকাদের সংসারে যেতে চারবছরের মেয়েটা আকুলতা প্রকাশ করলেও তাকে ধমক-ধামক দিয়ে জাঁদরেল বিমাতা ঘরে আটকে দিল। হাল ছেড়ে দিয়ে ছোটভাই শ্রীপতির সঙ্গে নবদ্বীপে ফিরে এসেছিল শ্রীবাস।

শ্রীবাসের মুখে শিশু নারায়ণীর দুর্দশার বিবরণ শুনে মালিনী চোখের জল ফেলেছিল। পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে সে তখন ষষ্ঠবার সন্তানসম্ভবা। তারপরে আরও ছ’টি ছেলেমেয়ে হয়েছে তার। এই মুহূর্তে সে গর্ভবতী, এটি তার চতুর্দশ সন্তান। চোদ্দো জনের মধ্যে একজন ছাড়া সকলে বেঁচে আছে। ঈশ্বরের দয়ায় পেটের এই ছেলেটি বাঁচলে, তেরো জন ছেলেমেয়ের মা হবে সে। বাচ্চা খাওয়ানোর চেয়ে বেশি দুধ বুকে জমলেও কয়েক বছর বুকের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবে। দুর্ঘটনা কিছু ঘটলে ঈশ্বর বাঁচাবেন। তার ঘরে, বলতে গেলে তার পাশে ভগবান রয়েছেন, আজ সকালে ভালো করে জেনেছে সে। আর কোনও ভয় নেই। সে চায় সকলের ভালো হোক। বিশেষ করে অভাগী নারায়ণী যেন সুখের মুখ দেখে। শ্রীবাসের সঙ্গে তার বাড়িতে প্রথম দিকে ঢুকে ঘোমটা জড়ানো বিধবা নারায়ণীকে সাধ্বী গৃহবধূ জেনে নিতাই পুত্রবতী হওয়ার আশীর্বাদ করেছিল। নিতাই-এর একপাশে ছিল গোরা, আর একপাশে শ্রীবাস। স্বামীর মুখ থেকে খবরটা একান্তে শুনে মালিনীর কানে তালা লেগে গিয়েছিল। সে ভয় পেয়েছিল এমন নয়। কিছুটা হতভম্ব হলেও ভেবেছিল, নিজের পেটে সদ্য যে মানবশিশুর চারা গজিয়েছে, তাকে নারায়ণীর গর্ভে পাঠানোর উপায় থাকলে, সে চোখ বুজে তা করত। পরের মুহূর্তে ভেবেছিল, তা সম্ভব নয়। নারায়ণীর পেটের সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে নবদ্বীপের সমাজে হাজার প্রশ্নের আলোড়ন উঠবে। শ্রীবাসের পরিবারের নিন্দেতে ঢিঢি পড়ে যাবে। নবদ্বীপ থেকে তাদের তাড়াতে পাষণ্ডীরা কোমর বেঁধে নেমে পড়বে।

পুরনো অনেক ঘটনার সঙ্গে মালিনীর মাথায় অতীতের কিছু ছবি ভেসে উঠছিল। নবদ্বীপে নারায়ণীকে পাঠাতে প্রথম দফায় নলিনীর মেজোগিন্নি আপত্তি করলেও বছর দুই পরে সে নিষেধ আলগা হয়েছিল। বিশেষ করে ফি বছরের বৈশাখ মাসে, অর্থাৎ কুমারী মেয়েদের ত্রিশদিন ধরে দেবাদিদেব শিবের মাথায় জল ঢেলে ব্রতপালনের মাসে মেয়েকে নবদ্বীপে রেখে যেত নলিনী। নবদ্বীপের ঘরে ঘরে প্রায় সব কচি মেয়েরা, মাটির ঘটে গঙ্গার জল ভরে, সাজি বোঝাই ফুল, থালায় নৈবেদ্য সাজিয়ে, নিজের হাতে মাটির শিবলিঙ্গ গড়ে গোটা মাস ধরে শিবপুজো করত। সাতসকালে পুজো শেষ করে, সূর্য মাথার ওপর ওঠার আগে পাড়ার মেয়েরা আপনঘাট, বারকোণাঘাট, নাগরিয়াঘাট, আরও নানা ঘাটে ঝাঁক বেঁধে গিয়ে পুজোর উপকরণ গঙ্গায় ভাসিয়ে দিত। সন্দেশ, খাজা, বাতাসা, কলা, আখ আরও কতরকম ফলফুলুরি মেয়েরা জলে বিসর্জন দিত, তার হিসেব নেই। পাড়ার কিছু দুষ্টু ছেলে গঙ্গার ঘাটগুলোতে এই সময়টাতে ভারি উপদ্রব করে। খাওয়ার মতো ফল মিষ্টি মেয়েদের থালা থেকে তুলে নেয়। অর্ঘ্যের থালা হাতে কোনও মেয়ের কনুই-এ, তার পেছন থেকে আচমকা হাল্কা ধাক্কা মেরে, হাতের থালাটা মাটিতে পড়ে গেলে ‘আহা’ ‘আহা’ করে সান্ত্বনা জানায়। তার স্যাঙাত্রা সেই ফাঁকে মাটি থেকে অর্ঘ্যের চাল, ফুল, বেলপাতা, মাটির শিব তুলে থালায় আগের মতো সাজিয়ে দিলেও খাবারসামগ্রী সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। দুষ্টুদের মধ্যে গোরাও ছিল একজন। সে ছিল রামদুষ্টু। মেয়েদের থালা থেকে খাবার জিনিস প্রায় জোর করে কেড়ে খেত সে। কচি মেয়েদের ভয় ধরিয়ে দিতে বলত, ‘আমিই শিব’, কখনও বলত ‘আমি বিষ্ণু, ব্রহ্মা, সকলের ভগবান’, পাঁচ-সাতবছরের মেয়েদের লজ্জায় অধোবদন করে দিতে জিজ্ঞেস করত, আমায় বিয়ে করবি? নারায়ণীকে কখনও এভাবে বিব্রত না করলেও তার থালা থেকে কলা, খাজা, বাতাসা তুলে গোরা অনেকবার খেয়েছে। পাশের বাড়ির গোরাদাদার দস্যিপনা দেখে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে দু’একদিন নারায়ণী ভয়ে গঙ্গার ঘাটে না গেলেও তারপর আর কামাই করত না। বৈশাখ মাসের সবগুলো সকালে গঙ্গার ঘাটে ব্রতপালন করতে যেত। গোরার উপদ্রবের বিবরণ মেয়েদের মুখে জগন্নাথ মিশ্রের পরিবারের সঙ্গে শ্রীবাসের পরিবারে পৌঁছলেও নারায়ণী কখনও তার গোরাদাদার বিরুদ্ধে বাড়ির অভিভাবকদের কাছে অভিযোগ জানায়নি। গঙ্গার ঘাটে গোরা যতই উৎপাত করুক শ্রীবাসের বাড়িতে এলে আলাদা মানুষ হয়ে যেত সে। শ্রীবাসের বাড়ির আঙিনায় দশবছরের সেই বালক, নেচে গেয়ে মাত করে দিত বাড়ির মেয়েদের মন। লম্বা চওড়া, মজবুত স্বাস্থ্য, অনিন্দসুন্দর সেই বালককে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে মালিনী প্রশ্ন করত, গোরা, বাপ আমার, কোথা থেকে শিখলি এমন প্রাণ জুড়ানো গান, নাচ, ছলাকলার চাউনি?

গোরা জবাব না দিলেও অনাবিল হাসিতে ভরে যেত তার মুখ। নির্নিমেষ চোখে তাকে দেখত নারায়ণী। গোরাকে তার কিছু বলার আছে, ভেবে ছ’সাতবছরের মেয়েটার বুকের ভেতরে বাতাস আটকে যাওয়ার দশা হলেও বলার কথাটা সে ভেবে পেত না। বলার কথার খোঁজে হাঁসফাস করার মধ্যে কুলিয়ায় ফেরার দিন এসে যেত। বাপের ঘরে ফিরে যেতে হবে তাকে। কুলিয়া থেকে সেভাবে কয়েক বছর বাদে একবার নবদ্বীপে এসে নারায়ণী শুনল, গোরার বিয়ে হয়ে গেছে। বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীকে বিয়ে করেছে গোরা। মেজোখুড়ির সঙ্গে এক বিকেলে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ি গিয়ে কিশোরী বধূ লক্ষ্মীর রূপ দেখে নারায়ণীর চোখ ঝলসে গেলেও তার প্রশংসায় শাশুড়ি শচী একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। উল্টে পুত্রবধূ লক্ষ্মীর সামনে আটবছরের নারায়ণীর রূপের এমন প্রশস্তি শচী শুরু করেছিল যে লজ্জায় মাথা হেঁট করে বসেছিল নববধূ। বিড়ম্বনা এড়াতে নারায়ণীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল মালিনী। কুলিয়ায় ফেরার আগে নবদ্বীপে বাকি দিনগুলো নারায়ণী কেন মনমরা হয়ে কাটিয়েছিল, মালিনী আঁচ করলেও নিজেকে বুঝিয়েছিল, কচি মেয়েটার মুখ গোমড়া করে থাকার কারণ গোরার বিয়ে নয়, মা বাবার জন্যে মন কেমন করছে। বছর চার বাদে কুমারহট্টের যক্ষ্মা রোগ আক্রান্ত আধবুড়ো কুলীন ব্রাহ্মণ, বৈকুণ্ঠের সঙ্গে এগারোবছরের নারায়ণীর বিয়ের অনুষ্ঠানে নবদ্বীপ থেকে স্বামী শ্রীবাস, তিন দেওর, দুই জা কয়েকজন ছেলেমেয়ের সঙ্গে সেও গিয়েছিল। নারায়ণীর দুমড়ে যাওয়া রুগ্ণ স্বামীকে দেখে কপালে উঠেছিল মালিনীর চোখ মেয়েমহলে শুরু হয়েছিল কানাকানি। নলিনীর ভাইরা কেশোরুগী খেঁকুরে চেহারার বর দেখে তেলেবেগুনে চটে গেলেও ভাইঝির বিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করেনি। পনেরো বছর বয়স নারায়ণীর ছেলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাতদিনের মধ্যে কঠিন উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে বৈকুণ্ঠ ইহলোক ছেড়ে চলে যায়। পৈতৃক সম্পত্তির দাবিদার, বৈকুণ্ঠের বিধবা আর তার ছেলেকে কুমারহট্ট থেকে তাড়াতে নারায়ণীর শ্বশুর-ভাসুরেরা যখন শলাপরামর্শ শুরু করেছে, তখনই তার একমাসের বাচ্চাটা প্রায় বিনা চিকিৎসায় মায়ের কোল খালি করে চিরদিনের মতো চলে গেল। বাড়ি থেকে নারায়ণীকে দূর করে দিতে পরিবারের কর্তাদের আর অসুবিধে থাকল না। যে বউ সংসারে আসতে পটাপট তার স্বামী, ছেলে মরে যায়, সে যে বিষকন্যা, ডাইনিও হতে পারে, নারায়ণীর নামে এমন একটা অপবাদ, তারা প্রথমে রটিয়ে দিয়ে, তারপর একদিন ভোর রাতে বাড়ি থেকে তাকে এক কাপড়ে তাড়িয়ে দিল। কুমারহট্ট থেকে সারাদিন পায়ে হেঁটে মাঝির কৃপায় খেয়াপার হয়ে কুলিয়ায় বাপের বাড়িতে সন্ধের পরে নারায়ণী যখন পৌঁছল, বাইরের আবছা অন্ধকারের চেয়ে চোখে একশ’ গুণ বেশি অন্ধকার দেখেছিল। খিদেতে নাড়িভুঁড়ি উগরে দেওয়ার মতো বমির হিক্কা উঠছিল। পথে লোপাট হয়ে যাওয়ার ভয়ে সারাক্ষণ থরথর করে কেঁপেছে তার শরীর। পায়ে হেঁটে একা মেয়ে দশ ক্লোশ রাস্তা যেতে পারে, তা সাতপুরুষে কেউ কল্পনা করেনি। বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে বেহুঁশ হয়ে নারায়ণী পড়ে গিয়েছিল। নারায়ণীর স্বামী, ছেলে হারানোর খবর নলিনী পণ্ডিত জানলেও সন্ন্যাস রোগে সে তখন শয্যাশায়ী। তার করার কিছু ছিল না। সে সুস্থ থাকলেও দজ্জাল মেজবউ-এর তাড়নায় রোগাক্রান্ত হওয়ার আগেই জবুথবু মেরে গিয়েছিল। সন্তানহারা বিধবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে তার দু’চোখ দিয়ে অঝোরধারে জল ঝরতে থাকল। বাপের বাড়িতে আসার পর থেকে নতুন করে নারায়ণীর শুরু হল অশেষ দুর্গতি। একবেলা আধপেটা খেয়ে, এক কাপড়ে সংসারের জোয়াল টানতে লাগল। মেজোবউ-এর গর্ভে গেল দশবছরে নলিনীর আরও দুই মেয়ে, এক ছেলে জন্মেছিল। বড়দিদি নারায়ণীকে তারা আবার ভীষণ ভালবাসত। মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়তি কিছু খাবার, পুরনো ছেঁড়া শাড়ি, আধখানা গামছা, মাথার তেল দিদিকে দিত তারা। গরিব ব্রাহ্মণের অভাবে সংসারে এর বেশি তাদের দেওয়ার সুযোগ ছিল না। বাপের বাড়িতে নারায়ণী ফেরার তিন হপ্তার মধ্যে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেল নলিনী পণ্ডিত। নবদ্বীপে নলিনীর মৃত্যুর খবর পৌঁছতে সেখান থেকে গোরাকে সঙ্গী করে দাদার পরিবারকে নবদ্বীপে নিয়ে যেতে এল শ্রীবাস। লোকান্তরিত দাদার গোটা পরিবারকে নবদ্বীপে শ্রীবাস নিতে চাইলেও কুলিয়া ছেড়ে মেজোবউ যেতে চাইল না। বলল, সেরকম ঠেকে গেলে নবদ্বীপে যাওয়া নিয়ে ভাববে। কাকার সঙ্গে নারায়ণী চাইলে নবদ্বীপে যেতে পারে। গোরার অনুরোধেও গোঁ ধরে কুলিয়ায় পড়ে থাকল মেজোবউ। মেজোখুড়োর সঙ্গে নারায়ণী ফিরে এল নবদ্বীপে। সৎমায়ের সংসারে লাথি ঝাঁটা খেয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট এড়ানোর সঙ্গে আরও এক গোপন অভিলাষে সে কুলিয়া ছেড়েছিল। লক্ষ্মী পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে গোরাদাদা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে সংসার পেতেছে জেনেও শুধু রোজ তাকে একবার চোখে দেখার বাসনা নারায়ণীকে প্রলুব্ধ করেছিল। পাশের বাড়ির গোরাদাদাকে বেশ কয়েক বছর বাদে দেখে নারায়ণীর মনে হয়েছিল, মানুষটা একদম বদলে গেছে। মাথার মধ্যে এমন কিছু চিন্তা কাজ করছে, যা আলো করে রেখেছে তার মুখ।

গৃহদেবতার সামনে বসে নারায়ণীর বুকের যন্ত্রণা বাড়তে থাকলেও মুখে তার ছাপ পড়তে দিল না সে। গৃহদেবতার সঙ্গে ভক্তদের খাওয়াতে দুধ, চিঁড়ে, কলার ফলারের আয়োজন করতে নারায়ণীর পাশ থেকে উঠে মালিনী যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকল, ইষ্টদেবতার পুজো তখন শেষ হতে চলেছে। চরম পর্দা থেকে সঙ্কীর্তন ক্রমশ ঢিমে তালে নামছে। ভক্তরাও জানে আনুষ্ঠানিক পুজো শেষ করে পুরুতমশাই এক চ্যাঙাড়ি বাতাসা নিয়ে হরির লুট দেবে। তারপর ভক্তেরা হাঁটু মুড়ে দু’পায়ের পাতা ঢেকে ঘাড় নিচু করে রসলে ছিটোনো হবে শান্তির জল। পুজোর উপচার এগিয়ে দেওয়ার কাজ শেষ হতে গভীর ভক্তিতে দু’চোখ বুজে বিষ্ণুমূর্তির সামনে ধ্যানস্থের মতো নারায়ণী বসে রয়েছে। তার দু’চোখের কোণে টলমল করছে দু’ফোঁটা জল।

গোরার উদ্দণ্ড নৃত্য ক্রমশ মধুর নাচের ভাবাবেশে রূপান্তরিত হচ্ছিল। সঙ্কীর্তনে আসরে গোরার সবচেয়ে প্রিয় গায়ক মুকুন্দর গলাতে সুরেলা ‘তুক’-এর ঢেউ ক্রমশ গরাণহাটি শৈলীর নিচু লয়ের ‘আখর’ ধরতে সেদিকে বয়ে চলেছে। রসকীর্তনের নম্র ‘কথা’ অংশ কানে যেতে মাথার ঘোমটা আরও টেনে দিল নারায়ণী। তখনি সে শুনল, গোরাকে অদ্বৈত বলছে, হে সঙ্কীর্তনের মহাজনক, শুধু শ্রীবাস আর চন্দ্রশেখরের আঙিনায় নেচে গেয়ে ভক্তিতে নবদ্বীপ প্লাবিত করা যাবে না। ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না শান্তিপুর। বজ্রযানি, সহজযানি বৌদ্ধ আর নাথযোগীদের মতো সঙ্কীর্তনকে গুহ্য সাধনা করে তুললে ভক্তিবাদীরাও কূপমণ্ডুক হয়ে উঠবে, ঘর ছেড়ে বাইরে বেরতে চাইবে না। পথে না বেরলে ভক্তিসঙ্কীর্তনের হাটে মানুষ জুটবে কোথা থেকে? আরও একটা প্রশ্ন হল, সঙ্কীর্তনে গলা মেলানোর অধিকার পাবে কারা? হাটে ভক্তি বিকোতে বসে খদ্দেরকে কোনও দোকানি ফিরিয়ে দিতে পারে না।

গোরা বলল, আমরা পথে নামব, ঘরে ঘরে যাব কৃষ্ণনাম নিয়ে, বলব, একবার হরি বলো ভাই, সঙ্কীর্তনে গলা মেলাও। স্ত্রীজাতি থেকে আচণ্ডাল সকলের অধিকার রয়েছে নামসঙ্কীর্তনে। কৃষ্ণ উচ্চারণে সব পাপের শেষ। ধর্ম, জাতপাতের বিভেদ থাকবে না এখানে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ মানুষকে অসম্মান করা চলবে না। সবাইকে সমান মর্যাদা দিতে হবে, তৃণের মতো বিনয়ী, গাছের মতো সহিষ্ণু হতে হবে, আমাদের উপলব্ধি করতে হবে সুন্দরী নারী, কবিতা জন্মজন্মান্তরের চেয়ে বড় সত্য হল প্রেম, ভক্তের অন্তরতম প্রেমাস্পদের সঙ্গে সঙ্কীর্তনকারীর কোনও পার্থক্য নেই। আমি আর সে আলাদা হলেও দু’জনে তুল্যমূল্য, সে আমার মতো সম্মানীয়, তার নাম কৃষ্ণ, বিষ্ণু, হরি, মাধব, নারায়ণ, গোবিন্দ, মুরলী যাই হোক!

গোরা থামতে গভীর আবেগে শ্রীবাস বলল, ‘হরি বলো, হরি বলো’। সবাই গলা মেলাল তার সঙ্গে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *