২১
বিশ্বরূপের খোঁজে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার নির্ধারিত দিন এগিয়ে আসতে গোরার মনে কষ্ট বাড়ছিল। অনুতাপ জাগছিল মনে। সুলতানি সিন্ধুকীদের তল্লাশি এড়াতে নবদ্বীপ ছেড়ে তাকে যে গা-ঢাকা দিতে হচ্ছে, মা-বউকে তা জানাতে না পেরে সে মরমে মরে যাচ্ছিল। গয়ায় পরিবারের দু’জনের পিণ্ড দিয়ে, বিশ্বরূপের খোঁজে দাক্ষিণাত্যের ভ্রমণসূচি মা’কে শোনালেও সেই সূচির অর্ধেকের অর্ধেক বলেছিল বিষ্ণুপ্রিয়াকে। নবদ্বীপ থেকে গা-ঢাকা দিতে যে দাক্ষিণাত্যে যাচ্ছে, মা-বউকে আঁচ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয়নি। বিষ্ণুপ্রিয়া জেনেছিল, বাবার পিণ্ড দিতে তার স্বামী গয়ায় যাচ্ছে। যাতায়াতে কোনও বিঘ্ন না ঘটলে মাসখানেকের মধ্যে সে বাড়ি ফিরে আসবে।
স্বামীর কথার পিঠে শাশুড়িও সায় দিয়েছিল। গোরাকে আড়ালে ডেকে তার একটা হাত দু’হাতে ধরে করুণ গলায় শচী বলেছিল, তার পিণ্ডটাও যেন গয়ায় গোরা দিয়ে আসে। মৃত্যুর আগে পিণ্ড দেওয়ার বিধি হিন্দুশাস্ত্রে আছে, একথাও গোরাকে শচী জানিয়েছিল। মায়ের অনুরোধে গোরা কষ্ট পাওয়ার সঙ্গে অবাক হলেও তার রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। শচী বলেছিল, তোর হাতের পিণ্ড পেলে পরকালেও এ জীবনের মতো সুখ পাব। ইহকালে মা কত সুখ পেয়েছে, গোরা ভেবে পেল না। সংসারে দুই স্ত্রীলোকে কাছে নবদ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার কারণ গোপন না করে গোরার উপায় ছিল না। সুলতানি গুপ্তচরদের চোখে ধুলো দিতে তাকে বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে শুনলে, মা-বউ দু’জনই মূর্ছা যেত। নবদ্বীপের পাড়া প্রতিবেশীও জেনে গেল, মেসো চন্দ্রশেখরকে নিয়ে বাবার পিণ্ড দিতে গোরা গয়া যাচ্ছে। ম্লেচ্ছ, শূদ্রপাড়াতেও সে খবর জানাজানি হতে সময় লাগল না। কলুপাড়ার ষষ্ঠীধর, মালোপাড়ার নকুড় পর্যন্ত যখন সসম্ভ্রমে তার গয়ায় পিণ্ড দিতে যাওয়ার খবর রটিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন তাদের পাড়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ ‘পিণ্ডিদান’ শব্দের মানে জানত না। মালোপাড়ার নকুড়ের এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশী, চিহ্নিপাদ, যাকে চিনুপা নামে সকলে চেনে, সপরিবারে যে মুসলিম হয়ে পিরল্যা গ্রামে গিয়ে বাস করার কথা ভাবছিল, গয়ায় গোরার পিণ্ডদান করতে যাওয়ার খবর শুনে সে বলল, আমার গুরু, সরোরুহপাদ বলেন, হোম করলে যত পুণ্য হয়, হোমের ধোঁয়া চোখে লেগে তার হাজার গুণ বেশি চোখ খারাপ হয়।
নকুড়ের মুখ থেকে তার আত্মীয় চিনুপার গুরু সরোরুহপাদের মন্তব্য শুনে গোরা চমকে উঠল। প্রথমে তার মনে হয়েছিল চিনুপা পাগল হয়ে আবোল-তাবোল বকছে। তার সুচিকিৎসা দরকার। ব্রাত্মণ্যবাদকে হেয় করতে শূদ্র, ম্লেচ্ছসমাজের পোড়খাওয়া মাতব্বররা এরকম বলে থাকে। চিনুপার গুরুর মন্তব্যের ফয়সালা তখনকার মতো শাস্ত্রী ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যে গোরা খুঁজে পেলেও পরের দিন বিকেলে সেই পাগলের টানে নকুড়ের সঙ্গে মালোপাড়ায় না গিয়ে পারল না। নকুড়কে সঙ্গী করে চিনুপার মাটির কুঁড়েঘরে গোরা পৌঁছে গেল। ঘরের দাওয়ায় চাটাই পেতে সাদরে গোরাকে বসতে দিল চিনু। শূদ্র, ম্লেচ্ছদের সঙ্গে তার মাখামাখি নিয়ে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণসমাজ যতই ঘোঁট পাকাক, অন্ত্যজপাড়ায় তার উল্টোরকম প্রভাব পড়ে। ম্লেচ্ছ, শূদ্রদের মধ্যে বাড়তে থাকে তার প্রতিপত্তি। তাকে সবাই মামা বলে, ঘরের লোক ভাবে, ব্রাক্ষ্মণসমাজের সেরা মানুষ হিসেবে সীমাহীন শ্রদ্ধাভক্তি করে। গোরার সঙ্গে বৌদ্ধ চিনুপার আগে পরিচয় না থাকলেও রামচন্দ্রপুরের এই তেজস্বী ব্রাহ্মণসন্তানকে সে পথে-ঘাটে দেখেছে, পথ ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে তার যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে। বাড়ির দাওয়ায় গোরা এসে দাঁড়াতে তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল চিনু। চিনুর সঙ্গে দু’চার কথার পরে নকুড়কে দেখিয়ে গোরা বলল, এর মুখে আপনার কথা, আপনার গুরু সরোরুহপাদের কিছু বাণী শুনেছি। আরও শুনতে চাই। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি একবার তাঁর সাক্ষাৎ পাই।
গোরার সঙ্গে গুরুর দেখা করাতে চিনুর অরাজি হওয়ার কিছু ছিল না। সে জানাল রাজগৃহবাসী তার গুরুকে মঠছাড়া করেছে সেখানকার পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকরা। কামরূপে আশ্রয় নিয়েছে গুরু সরোরুহপাদ। নবদ্বীপে তিনি এলে গোরার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবে চিনু। সপরিবার সে মুসলিম হয়ে গেলেও গুরু তাকে বর্জন করবে না। সরোরুহপাদের কিছু বাণী গোরা শুনতে চাইলে চিনু জানাল, তার গুরু বলে, গুরুর ধর্ম যাই হোক, সব ধর্মকে বুকে করে আগলে রাখার দায়িত্ব তার। গুরুর হাত ধরে নির্বাণলাভের শেষ দরজা পর্যন্ত পৌঁছোনো যায়। যত উপদেশ, গুরুর মুখ থেকে শুনতে হয়, ধর্মীয় শাস্ত্র পড়ে কোনও লাভ হয় না। চোখ বুজে গুরুবাক্য মেনে চলতে হবে।
গুরু সরোরুহপাদের উদ্দেশে করজোড়ে প্রণতি জানিয়ে, সামান্য ইতস্তত করে চিনু দ্বিতীয়বার গড় হয়ে গোরাকে প্রণাম করল। দু’চোখে জল নিয়ে চিপা বলল, পেটের জ্বালায় অনেক বছর আগে আমার পিতামো হিদু ছেড়ে বুধো ধম্মে গিয়েছিল। জাত খোয়ালো, পেট ভরল না। গুরুর দু’পা আঁকড়ে ধরে এতকাল পড়েছিনু। আর পারছি না। মাগ, ছেলে-মেয়ে সংসার নিয়ে পেটের দায়ে বুধোধম্ম ছেড়ে আল্লাহ্ রসুলের পায়ে ঠাঁই নেওয়ার আগে বোধহয় এই শেষবার গুরুর বাণী বলার সুযোগ পাচ্ছি। তার সব উপদেশ মনে নেই, দু’চার কথা যা মাথায় ধরা আছে, শোনাচ্ছি। গুরু সরোরুহপাদ বলে, বেম্মার মুখ থেকে বামুনরা কবে জন্মেছিল শূদ্দুররা মনে রাখেনি। তারা দেখছে, তাদের মতো মায়ের পেট থেকে বামুন শিশুরা জন্মাচ্ছে। বামুনদের তাই নিজেদের বেম্মার পোলাপান হিসেবে গুমোর করার কিছু নেই। পৈতে নিয়ে, টিকি রেখে কিছু লোক যদি বামুন হয়ে যেতে পারে, তাহলে শূদ্র, অচ্ছুত্রা গলায় পৈতে গলিয়ে লম্বা টিকি রেখে নিজেদের বামুন হিসেবে জাহির করবে না কেন? বামুন হতে গেলে যদি বেদ পড়তে হয়, তবে চামার, চাঁড়ালরা বেদ পড়ে নেবে।
এক মুহূর্ত থেমে চিনু বলল, আমার গুরু, জাতিতে ডোম হয়েও সবগুলো বেদ কণ্ঠস্থ করে তার চামার, চণ্ডাল শিষ্যদের বারবার শুনিয়ে তাদের মগজে ইহকালের মতো পাকাপোক্ত করে পুরে দিয়েছে। আমাকেও দিতে চেয়েছিল। বামুনদের অভিশাপের ভয়ে আমার মাগ আটকে দিল আমাকে। গুরুও বলল, বেদ পরমার্থ নয়, বাজে কথায় বোঝাই।
আমার আফসোস করার কিছু থাকল না।
চিনুপা তখনকার মতো চুপ করলেও গুরুর বাণী নতুন করে কিছু মনে পড়লে গোরাকে শোনাতে উৎসুক হয়ে রইল। পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে, নিমাই পণ্ডিত, যে নিজেও টোল চালায়, সেই বিদ্বান, মহাবলী মানুষ এক শূদ্রের দাওয়ায় বসে বেজাতের এক ধর্মগুরুর বাণী মন দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুনবে, মালোপাড়ার বৌদ্ধ, চিনুপা আশা করেনি। বৌদ্ধগুরু সরোরুহপাদের ঝাঁঝালো অভিমত শুনে গোরার কেমন নেশা ধরে গেল। আরও শুনতে চায় সে। চিনুপার মুখের দিকে সে তাকাতে সংসারের চাকায় নিষ্পেষিত মানুষটার ফের মনে পড়ে গেল কিছু গুরুবাণী। সে বলল, আমার গুরু সরোরুহপাদ বলেছিল, গায়ে ছাই মাখা, মাথায় কুণ্ডলী পাকানো জটা, বেশিরভাগ সন্নেসী যারা ঘরের ঈশান কোণে পরদীপ জ্বেলে, মিটমিটে আলোয় কুশাসনে বসে আধখোলা চোখে তাকিয়ে কান খোঁচায় আর ঘণ্টা বাজায়, তারা ধোঁকাবাজ। ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধাপ্পা দেয়।
চিনুর গুরু, সরোরুহপাদের নাম গোরার অজানা ছিল না। উঁচু মাপের বৌদ্ধ শ্রমণ সে। ঈশ্বরপুরীর সমতুল্য। তার সমান মর্যাদা, দেশের সব বৌদ্ধ বা জৈন গুরু পায় না। সরোরুহপাদ শুধু ধর্মগুরু নয়, সে বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মসাধনা ধারার অন্যতম প্রধান কবি। সহজিয়া সাধকদের লেখা কবিতাগুচ্ছকে সাধারণভাবে ‘চর্যাপদ’ বলা হত। সুরারোপ করে গাওয়া শ্রুতিমধুর সেই গান হাঁড়ি, ডোম, বাগদিপাড়ার কিছু মানুষের গলায় গোরা শুনেছে। প্রকৃতির আলো, জল, বাতাস আর মানুষের জন্মরহস্য থেকে উত্থিত সেই সুর যেমন হৃদয়গ্রাহী, তেমন মৌলিক। চণ্ডাল, হাঁড়ি, ডোম, বাগদি, এককথায় শূদ্র, ম্লেচ্ছপাড়ায় যারা ঝাড়েবংশে যবনধর্ম নিয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে গরীব দু’চার ঘর তখনও বৌদ্ধ আর জৈনধর্ম আঁকড়ে পড়ে থাকলেও নিজেদের ধর্মে তাদের আস্থা প্রায় শুকিয়ে এসেছিল। যবন হওয়ার দিন গুনছিল তারা। প্রায় পরিত্যক্ত ধর্মগুরু, বৌদ্ধ শ্রমণ, জৈন ক্ষপণকদের নিয়ে তারা হাসি-ঠাট্টা করত। জৈন ক্ষপণকদের কঠিন কৃচ্ছ্রসাধন, কড়া আচরণবিধি দেখে তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, উলঙ্গ থেকে, শরীরের চুল একটা একটা করে ছিঁড়ে, মুখে কাপড়ের ফেট্টি বেঁধে, দিনান্তে তিনশো তিয়াত্তরটা চালের একমুঠো ভাত খেয়ে, নানাভাবে নিজের শরীরকে অসহ্য কষ্ট দিয়ে কোন স্বর্গে এর পৌঁছোতে চায়? ভিক্ষু, শ্রমণ, ক্ষপণকদের কাছে এসব প্রশ্ন করতে নিরক্ষর গরিব, সবার ওপরে শূদ্র অনুগামীরা সাহস না পেয়ে, তারা নিজেদের মতো কিছু কথন সাজিয়ে নেয়। বলে ল্যাংটো হয়ে থাকলে যদি মুক্তি আসে, তাহলে সকলের আগে কুকুর বেড়ালের মুক্তি ঘটত। ঘাস, পাতা খেয়ে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ থাকলে হাতি, ঘোড়া কবেই মুক্তি পেয়ে যেত! যেখানে যত বড় শ্রমণ, স্থবির, ক্ষপণক রয়েছে, যাদের কারও দশ, কারও দশহাজার শিষ্য, দু’বগলে চেলাদের নিয়ে শরীরে গেরুয়া জড়িয়ে, লোক ঠকিয়ে তারা খেয়ে বেড়াচ্ছে, টাকা কামাচ্ছে। সহজিয়ারা যেমন সহজপন্থী গুরু আঁকড়ে পড়ে থাকাকে মুক্তির একমাত্র পথ ভাবে, যবনরা তেমন অন্ধের মতো বিশ্বাস করে সকলের ওপরে আল্লাহ্ রসুল, সর্বশক্তিমান আল্লা। সুন্নত করে, কলমা পরে, ধর্মান্তরিত হয়ে আল্লার খাসঠিকায় একবার ঢুকে পড়তে পারলে ইহজীবনের মতো সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে।
অব্রাক্ষ্মণ পাড়ার মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামিশি থেকে গোরা জেনেছিল, অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের যুগ শেষ হয়ে আসছে, টলমল করছে সনাতনব্রাহ্মণ্যবাদের পায়ের তলার মাটি। সহজিয়া গুরু সরোরুহপাদের বাণী শূদ্র, ম্লেচ্ছসমাজের চিন্তা, মুখের বাচনে দ্রুত ঢুকে পড়ছে। শূদ্রসমাজ থেকে উঠে আসতে শুরু করেছে আগামী যুগের ধর্মচিন্তা। প্রান্তিক সমাজ থেকে পাওয়া গোরার এই ধারণা, তার ব্রাহ্মণ্যবিশ্বাসে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্র, ধর্মচিন্তা, বৈদিক কর্মকাণ্ড, লোকাচার কোথাও সে আস্থা রাখতে পারছিল না। প্রচলিত ধর্মের চেয়ে তাকে বেশি আলোড়িত করছিল সরোরুহপাদের মতো সহজিয়া সাধক আর তার অনুগামীদের ধর্মীয় অভিমত, টিকাটিপ্পনি। প্রয়াত বাবা আর স্ত্রীর স্বর্গে যাওয়ার পথ মসৃণ করতে গয়ায় পিণ্ডদানের যথার্থতা নিয়ে তার মনে প্রশ্ন জেগে গেল। জীবিত অবস্থায় মানুষ সৎকাজ করে থাকলে, স্বর্গীয় আইনে নিজের গুণে সে স্বর্গে পৌঁছে যাবে। ন্যায়ত, সেটাই হওয়া উচিত, স্বর্গে যেতে পারিবারের সন্তান-সন্ততির পিণ্ড পাওয়ার জন্যে তার হা-পিত্যেশ করে অপেক্ষা করার কথা নয়। পুণ্যবানকে পিণ্ডের অপেক্ষায় থাকতে হলে পাপীর কী দশা হবে? নরকে প্রেত হয়ে পচে মরা ছাড়া তার উপায় নেই। প্রেতের আবার মৃত্যু নেই, জন্মান্তর নেই। প্রেতের কি পচন আছে? নরককুণ্ডে পচতে পচতে শেষপর্যন্ত তার কী হয়, এ প্রশ্নে শাস্ত্র নীরব।
জাতপাতহীন শূদ্র, ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের মধ্যে চালু ধর্মবিশ্বাস, যা সনাতন আস্তিক্যধর্ম নয়, ফুৎকারে ঈশ্বরকে উড়িয়ে দেওয়া নাস্তিক্যবাদ নয়, হয়তো অজ্ঞাবাদ অথবা অন্যকিছু, ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে মানবিক বোধ, তার সঙ্গে গোরা মনের মিল খুঁজে পাচ্ছিল। গোরা অনুভব করছিল, পঞ্চমবর্গ, প্রীতি বা ভালবাসা জীবনের সারবস্তু। প্রেম, ভালবাসা আয়ত্ত করতে শাস্ত্র পড়ার দরকার হয় না। ধুলোমাটি মাখা, সাদামাঠা, ঘর্মাক্ত মানুষের সঙ্গে মিশলে, ভালবাসার পাঠ শেখা যায়। ধর্মীয় আভিজাত্যাভিমানীকে তাদের মনের কাছাকাছি পৌঁছোতে হবে। গোরা সেখানে পৌঁছেছে কি না নিজে না জানলেও তাকে দেখে শূদ্র, ম্লেচ্ছরা খুশি হয়, নিজের ঘরে ধরে নিয়ে যায়, তাকে ‘মামা’ বলে ডাকে, বিনয়ে নুয়ে পড়ে, তাদের কথোপকথন, আচরণে একফোঁটা ভেজাল নেই, গোরা বুঝতে পারে। সে টের পায়, এর নাম ভালবাসা। মানুষগুলো তাকে ভালো না বাসলে এত সমাদর করত না। ব্রাহ্মণসমাজে অপাংক্তেয়, নবদ্বীপবাসীদের ঘরে ঘরে কীভাবে সে ‘মামা’ হয়ে উঠল, না জেনেও সেই ডাক সে মেনে নিয়েছে। পাড়ার রক্ষণশীল বয়স্করা এই কুটুম্বিতা অপছন্দ করলেও গোরা গ্রাহ্য করে না।
বেলপুকুরিয়ায় মামাবাড়িতে, দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তীর কাছে গয়ায় পিণ্ড দিতে যাওয়ার অনুমতি চাইতে গিয়ে তার মুখে তীর্থভূমি গয়াধামের শাস্ত্রীয় মাহাত্ম্য শুনল গোরা। মালোপাড়ার চিনুপা, ডোমপাড়ার বসিরুদ্দিন, ধর্মান্তরের আগে যার নাম ছিল বাসু, তাদের ব্রাহ্মণ্যধর্ম-বিদ্বেষী ব্যাখ্যার সঙ্গে দাদামশাই-এর শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা গোরা মেলাতে পারে না। নিচুতলার ধর্মবোধের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্মের আপাতদৃষ্টিতে মিল না থাকলেও গোরা অনুভব করে, কোথাও একটা সংযোগ রয়েছে, দুই আলাদা ধর্মগোষ্ঠী নানা আকচাআকচি সত্ত্বেও অজান্তে নিজেদের মধ্যে সংযোগসেতু গড়ে তুলছে। হাজার বছর ধরে জাত-পাত-বর্ণ নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি পর্বে, অন্তর্লীন মহৎ এক সদিচ্ছা, এই প্রক্রিয়া সচল রেখেছে।
গোরাকে গয়াতীর্থের উৎপত্তি বৃত্তান্ত শোনাচ্ছিল নীলাম্বর। ‘গয়’ নামে এক অসুরের সদাশয়তায় গয়া তীর্থক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কাহিনী শুনে গোরার রোমাঞ হল। তার মানে, শুধু দেবভূমিতে তীর্থক্ষেত্র গড়ে ওঠে না, অসুরদের মহিমাতেও সর্বজনশ্রদ্ধেয় পুণ্যভূমি মাথা তুলে দাঁড়ায়, তীর্থক্ষেত্রের মর্যাদা পায়।
পুণ্যভূমি গয়া প্রতিষ্ঠার যে কাহিনী নীলাম্বর শোনাল, তা এরকম। বাবা ত্রিপুরাসুর, মা প্রভাবতীর ছেলে গয় ছিল নিষ্ঠাবান বিষ্ণুভক্ত। দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত ত্রিপুরাসুরের হত্যাকারীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পিতৃভক্ত গয়, তার আরাধ্য ঈশ্বর, বিষ্ণুর বর লাভের আশায় কঠোর তপস্যা শুরু করল। তপস্যায় তার দার্ঢ্য আর আন্তরিকতা দেখে স্থিতাবস্থা ভেঙে পড়ার ভয়ে দেবতারা দল বেঁধে প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হল। দেবতাদের আশ্বস্ত করে তাদের নিয়ে কৈলাশে মহেশ্বর শিবের কাছে গেল ব্রহ্মা। শিবের সঙ্গে ব্রহ্মা আর দেবতারা পরামর্শ করে গয়ের আরাধ্য ঈশ্বর, মহাসমুদ্রে অনন্ত নাগশয্যায় বিশ্রামরত বিষ্ণুর কাছে ধর্না দিল। গয়কে তাড়াতাড়ি একটা বর দিয়ে, তপস্যা থেকে তাকে বিরত করতে তারা সনির্বন্ধ অনুরোধ করল বিষ্ণুকে। অসুররা প্রকৃতিগতভাবে দেবতাদের বিরোধী, প্রবল শত্রু। কে বলতে পারে তপস্যায় বিষ্ণুকে তুষ্ট করে দেবতাদের স্বর্গ থেকে উচ্ছেদ করার বর, গয় চাইবে না? তেমন ঘটলে দেবকুলে বিপর্যয় নেমে আসবে। ভীত, সন্ত্রস্ত দেবতাদের আকুল প্রার্থনায় বিষ্ণু সাড়া দিল। মর্ত্যে তপস্যায় নিবিষ্ট গয়ের কাছে গিয়ে মহাভক্ত সেই অসুরকে বর প্রার্থনা করতে বলল বিষ্ণু। স্বর্গবাসী দেবদেবীদের হেনস্থা করার বর না চেয়ে গয় যে অভাবনীয় বর প্রার্থনা করল, তা হল, পৃথিবীর যাবতীয় পবিত্র বস্তু, তীর্থশিলা, গঙ্গাজল, পূজ্য যত মানুষ ব্রাক্ষ্মণ, দেবতা, মন্ত্র, যোগী, ধর্মী, কর্মী সকলের চেয়ে সে যেন অধিকতর পবিত্র, পবিত্রোত্তম বিবেচিত হয়। তার দেহ দর্শনে সকলে যেন নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ হয়ে স্বর্গে যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে।
গয়াসুরের প্রার্থনা শুনে মৃত্যুর দেবতা যম ভয় পেল। গয়কে শুধু একবার দর্শন করে, পুণ্যাত্মা, পাপী, সবাই মৃত্যুর পরে স্বর্গে থাকার ছাড়পত্র পেলে যমালয়ের হাল কি দাঁড়াবে? যমালয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, বুঝতে যমরাজের অসুবিধে হল না। পৃথিবীর সব পুণ্যাত্মা আর পাপী যদি স্বর্গের বাসিন্দা হওয়ার অধিকার পায়, সব মানুষের জন্যে স্বর্গপ্রাপ্তি বরাদ্দ হয়, তাহলে মনুষ্যসমাজ জাহান্নমে যাবে। তাদের বাগে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে, যমপুরীতে বাতি দেওয়ার কেউ থাকবে না। প্রেতলোক ফাঁকা হয়ে যাবে। প্রবল উৎকণ্ঠায় যম তখনই দেবতাদের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে স্বর্গে হাজির হল। গয়াসুরের প্রার্থিত বরের বৃত্তান্ত শুনে দেবতারা কিছুটা স্বস্তি পেলেও স্বর্গে ব্যাপক জনসমাগমের দুর্ভাবনায় তারা নতুন করে আলোচনায় বসল। একটা বিষয়ে তারা নিশ্চিন্ত হল যে, আর পাঁচটা অসুরের মতো গয়াসুর ক্ষতিকারক নয়। দেবতাদের সঙ্গে সে বিরোধ চায় না। দেবতারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে সদলে গয়াসুরের কাছে গিয়ে তার দেহ ভিক্ষা চাইল। গয়াসুর তখনই নিজের দেহ দান করল দেবতাদের। দৈবাস্ত্র প্রয়োগ করে তাকে মেরে না ফেলে তার বুকের ওপর পাহাড়ের মতো এক বিশাল পাথর রেখে, তার ওপর দেবতারা চেপে বসল। পাহাড় আর দেবতাদের চাপে তখনই রক্তবমি করে গয়াসুরের মরে যাওয়ার কথা। গয়াসুর কিন্তু মরল না। প্রবল চাপে মুমূর্ষু হলেও সে জীবিত, নিশ্চল হয়ে থাকল। তখন বিষ্ণু এসে সেই পাথরের ওপর পা রাখল। দেবতাদের ছলনা বুঝতে পেরে মৃত্যুর আগে তাদের গয়াসুর বলল, দেবতারা তার দেহের বদলে তার প্রাণ ভিক্ষা করলে তখনই সেই প্রার্থনা সে পূরণ করত। দেবতাদের জন্যে এখনও প্রাণভিক্ষা দিতে সে রাজি আছে।
লজ্জিত দেবতারা মৃতপথযাত্রী গয়াসুরকে বর দিতে চাইলে সে বলল, যতদিন আকাশে সূর্য চন্দ্র উঠবে, পৃথিবী স্বস্থানে থাকবে, দেবতারা যেন তার বুকে সংলগ্ন থাকে।
তার প্রার্থনা মেনে নিয়ে দেবতারা ধন্য হল। কচ্ছপ চেহারার সেই পাথরের ওপর দেবতাদের উপস্থিত থাকার মোহর হিসেবে বিষ্ণুর পায়ের চিহ্ন থেকে গেল। গয়াতীর্থ হয়ে গেল মৃতের স্বর্গে ঢোকার সদর দরজা। পাথরে খোদিত বিষ্ণুর পায়ের ওপরে মৃতের উদ্দেশে নিবেদিত পিণ্ড রাখলে লোকান্তরিত সেই মানুষটির স্বর্গবাস সুনিশ্চিত হয়।
নীলাম্বরের মুখে গয়াতীর্থ উৎপত্তির কাহিনী শুনে গোরার মনে বিষ্ণুভক্তির চেয়ে বেশি দাগ কাটল গয়াসুরের মহানুভবতা। পৃথিবীর সব মানুষকে স্বর্গে যাওয়ার ছাড়পত্র দিতে সে কঠোর তপস্যা করেছিল, তার চেয়ে পূতচরিত্রের মানুষ আর কে হতে পারে? পৃথিবীর দুঃখী মানুষের প্রকৃত বন্ধু ছিল সে। দেবতাদের চেয়ে আপনজন ছিল।
দাদামশাই-এর কাহিনীর সূত্র ধরে যে অনুভূতি নিয়ে গোরা গয়া যেতে তৈরি হচ্ছিল, তার দু’দিন পরে ঘরের বাতা থেকে বিশ্বরূপের উধাও হয়ে যাওয়া পুিঁথি বেরিয়ে পড়তে, দুই ঘটনার যোগাযোগের নতুন বার্তা পেল সে। তার মনে হল ঈশ্বরপ্রেরিত এক দৈবী উপহার পেয়েছে সে। পুঁথি থেকে হয়তো হারিয়ে যাওয়া দাদার ঠিকানা, তাকে খোঁজার দিকনির্দেশ মিলতে পারে। দাক্ষিণাত্য পরিভ্রমণ, গয়ায় পিতৃপুরুষের পিণ্ডদান ইত্যাদি সবচেয়ে জরুরি কাজগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল, সতেরোবছর আগে লেখা এক বালকের অনাবিষ্কৃত পুঁথি, যা আগুনে দগ্ধ করতে পারেনি, উইপোকায় খেয়ে ফেলেনি, সময়ের চাপে জীর্ণ হয়নি, তালপাতায় লেখা সেই পুঁথির আহ্বান তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। নবদ্বীপের ঘরে বসে পুঁথি পড়ার অদম্য আগ্রহ সে কোনওমতে ঠেকিয়ে রাখল।
গয়া যাওয়ার পথের রূপরেখা গোরার মেসো চন্দ্রশেখর, নবদ্বীপের প্রবীণ, অভিজ্ঞ মানুষদের সঙ্গে পরামর্শ করে তৈরি রেখেছিল। প্রথমত, পথ হবে নিরাপদ, লোকালয়ের ভেতর দিয়ে, গ্রামগঞ্জের গা-ঘেঁষে যাওয়া সড়ক ধরে যেতে তীর্থযাত্রীরা বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে। পথে একটা নদীর দেখা পেলে, কথা নেই। নদীর তীর ধরে হাঁটার আরাম, তীর্থযাত্রীরা ভালো জানে। নদী না থাকলে দীঘি, সরোবর থাকা একান্ত জরুরি। জলের ঠিকানা না নিয়ে গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, নীলাচলের যাত্রীরা বাড়ি ছেড়ে বেরোয় না। রাত কাটানোর জন্যে বাসযোগ্য চটি, সরাইখানা, ধর্মশালার খোঁজ তীর্থযাত্রীদের জেনে রাখতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ভয়ঙ্কর জন্তুজানোয়ার অধ্যুষিত, অরণ্যভূমি, ডাকাত, ঠ্যাঙাড়ে উপদ্রুত জনহীন মাঠ, প্রান্তর এড়িয়ে পথ হবে সংক্ষিপ্ততম, পায়ে হেঁটে, যে পথ ধরে নির্দিষ্ট ঠিকানায় সকলের আগে পৌঁছোনো যায়। নবদ্বীপ থেকে নৌকোয় কাটোয়া গিয়ে সেখান থেকে চাকতা, আলকোনা, তিলপুর, বৈদ্যনাথধাম, তেলিয়াগড়ি টিলাপথ পেরিয়ে মগধরাজ্যের প্রাচীন রাজধানী রাজগৃহ পৌঁছোলে, সেখান থেকে গয়ার দূরত্ব তেইশ ক্রোশের বেশি নয়। ফল্গু নদীর ধার দিয়ে এই পথে সাধারণত যাত্রীরা গয়ায় পা রাখে। সহজতম এই সড়কের নির্ঘণ্ট, চন্দ্রশেখর ছকে রেখেছিল।
চন্দ্রশেখরের সঙ্গে নির্ধারিত দিনে গয়া রওনা দিল গোরা। নবদ্বীপ থেকে গয়া দীর্ঘ পথ, সওয়া দুশো ক্রোশের কম নয়। লম্বা পথের ঝক্কিঝামেলা সামাল দিতে তখন দলবেঁধে তীর্থযাত্রার রেওয়াজ ছিল। কাশী, বৃন্দাবন, পুরী, গঙ্গাসাগর ইত্যাদি তীর্থভ্রমণের সঙ্গে বৈদিক সংস্কার অনুযায়ী অবশ্যকরণীয়, গয়ায় পিতৃপুরুষের পিণ্ডদান করতেও গ্রামের মানুষ আত্মীয় প্রতিবেশীদের যতটা সম্ভব সঙ্গী হিসেবে জুটিয়ে নিত। গোরা গয়া যাচ্ছে শুনে, তার গ্রাম, রামচন্দ্রপুরের মানুষের সঙ্গে আশপাশের ব্রাহ্মণপাড়ার তীর্থদর্শনে উৎসাহী বেশ কিছু পড়শি সঙ্গী হতে চাইল। কাউকে গোরা ‘না’ বলতে পারল না। গোপীনাথ, মুরারি, মুকুন্দ, বক্রেশ্বর, জগদানন্দের মতো গদাধরও গোরার যাত্রাসঙ্গী হতে চন্দ্রশেখর আচার্য আনন্দের সঙ্গে পুত্রপ্রতিম গদাধরকে সঙ্গে নিতে চাইলে মাধব পণ্ডিত ছেলেকে ছাড়তে অরাজি হল না। গদাধর সঙ্গী হচ্ছে জেনে গোরা খুশি হল। তার গয়া যাওয়ার দিন সকালে কোথা থেকে খবর পেয়ে হরিদাসকে নিয়ে পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ অদ্বৈত আচার্য শান্তিপুর থেকে নবদ্বীপে হাজির হল। জটাজুটধারী, গেরুয়া বসনাবৃত, দু’চোখের গভীরে স্নিগ্ধ মায়াবী দৃষ্টি, গলায় তুলসির মালা, হাতে জপের থলি, রূপবান, দীর্ঘ শরীর, মাঝবয়সী হরিদাস, মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে হরিনাম জপ করে যাচ্ছিল। মানুষের জটলার মধ্যে থেকেও কিছুদিন আগে দেখা, ঈশ্বরপুরীর মতো সদ্য পরিচিত ভক্ত মানুষটা নামজপে ডুবে আছে, এক নজরে গোরা বুঝতে পারল। আত্মপরিচয় দিতে গেরুয়াধারী একটা কথাই বলেছিল, আমি যবন হরিদাস, কৃষ্ণের দাসানুদাস।
ভাবাবেগে তার গলা জড়িয়ে ধরে অদ্বৈত বলেছিল, যবন হরিদাস নয়, ঠাকুর হরিদাস, এ স্বয়ং ব্রহ্মা। পরিচয়পর্ব শেষে গোরাকে আচম্বিতে অদ্বৈত বলল, তোমার গয়াযাত্রায় হরিদাসকে সঙ্গী করে নাও।
গোরা তখনই রাজি হয়ে গেলেও শান্ত হেসে সবিনয়ে হরিদাস বলল, তীর্থদর্শনের সময় আমার এখনও হয়নি। তীর্থের দেবতার ডাক পেতে আমাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
কথাগুলো বলে, নামজপের অকুলপাথারে মুহূর্তের মধ্যে ডুবে গেল ঠাকুর হরিদাস। কৃষ্ণনামে অভিভূত হরিদাসকে দেখে ‘কৃষ্ণলীলামৃত’ পুঁথির লেখক মহাতাপস ঈশ্বরপুরীর প্রগাঢ় সংস্করণ, মনে হল গোরার। সে নিজে বৈষ্ণব না হলেও আত্মীয় জ্ঞাতিগুষ্ঠি, পড়শিদের মধ্যে বিস্তর বৈষ্ণব দেখে, তাদের শ্রদ্ধা করার মতো বিশেষ কিছু পায়নি। বেশিরভাগ গোষ্ঠীমণ্ডুক, ভীতু, চুকলিখোর। বৈষ্ণবদের মেরুদণ্ড যদি একটু শক্ত হত, মাথা উঁচিয়ে প্রতিপক্ষ, স্মার্ত, নৈয়ায়িক আর সুলতানি শাসকদের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারত, তাহলে দলবেঁধে সংকীর্তন করার অধিকার তারা হারাত না। তার জন্মের প্রায় তিনশো বছর আগে কোথাকার এক বিদেশি, বিধর্মী ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি মাত্র সতেরোজন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে গৌড় দখল করে যখন নবদ্বীপকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল, তখনও কেউ প্রতিরোধ করেনি। তাদের চোখের সামনে শৃঙ্খলিত হয়েছিল জননী জন্মভূমি। স্বাধীনতার সূর্য চিরকালের মতো অস্তমিত হলেও স্মার্ত, নৈয়ায়িক, তান্ত্রিক, বৈষ্ণব, সবাই তিনশো বছর ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে। কোনও সম্প্রদায় বলে না আমাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দাও, গান গাওয়ার অধিকার ফিরিয়ে দাও। ব্রাহ্মণ্যবাদী নবদ্বীপবাসীর শাস্ত্রীয় বিতর্ক, বিতণ্ডা, বাহ্যিক ভদ্রতা, শুদ্ধাচার নিয়ে মাতামাতি, সবকিছুর সঙ্গে মিশে আছে তাদের কাপুরুষতা। গোরা চায়, ভদ্রতার সঙ্গে চরিত্রের অন্তর্নিহিত শৌর্য যেন মিশে থাকে। বৈষ্ণবভক্তরা সমাজের নানা স্তরে যদি তাদের প্রেমগীতি, দরাজ গলায়, সাহসের সঙ্গে ছড়িয়ে দিতে পারত, তাহলে সে-ও গলা মেলাত তাদের সঙ্গে। কৃষ্ণাবতারের জন্যে বহু বছর ধরে প্রতীক্ষা করে অদ্বৈত আচার্য মাঝে মাঝে অধৈর্য হয়ে নিজেকে কৃষ্ণের অবতার হিসেবে দাবি করে। গঙ্গার ঘাটে গলা ডুব জলে দাঁড়িয়ে অধর্ম ধ্বংস করতে ‘সংহারিমু, সংহারিমু’বলে হুঙ্কার দিলেও সে ভালোই জানে সে কৃষ্ণাবতার নয়, দুষ্কৃতির বিনাশ করার শক্তি তার নেই। অদ্বৈতের প্রতিবেশী, আত্মীয়, ছাত্র, শিষ্য, যজমানদের তা অজানা নয়। তবু তার হুঙ্কারে সাধারণ মানুষের মনে অবতার আবির্ভাবের আশা ধুনির আগুনের মতো ধিকিধকি জ্বলতে থাকে। তাদের কৃষ্ণনাম জপ করার প্রেরণা দেয়। দেশ আর সমাজকে বাঁচাতে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী প্রকৃত নেতার ভূমিকা পালন করে চলেছে অদ্বৈত আচার্য, তার গুরুভাইরা। মাধবেন্দ্রপুরীর সব শিষ্য, বলা যায়, বৈষ্ণব ভক্তিবাদের আদি প্রবর্তক মধ্বাচার্যের অনুগামী সাধক, শিষ্যদের এটা এক সাধারণ কর্মসূচি। বাইরে থেকে এই বৈষ্ণব ভাবাদর্শকে দেখে ধর্মসংস্থাপনের উদ্যম মনে হলেও তার আড়ালে প্রচ্ছন্ন যে অংশ আছে, তা হল, ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত নির্বিশেষে দেশবাসীকে ভালবাসার সুতোয় গেঁথে বিশাল গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলা, যা পাঁচশো বছরের পরাধীনতা থেকে আপামর জনসাধারণকে মুক্তি দেবে। ধর্মীয় অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেবে সৎ মানবতাবাদী এক রাষ্ট্র, যার পরিচালক হবে বৈষ্ণবসমাজের নেতা। আরব দেশ থেকে উড়ে এসে আর্যাবর্ত দখল করে গদীনসীন হয়েছে বিধর্মী সুলতানি শাসন। তাদের তৈরি ত্রাসের কাছে মেরুদণ্ডহীন, স্তাবক, লোভী ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয়দের একাংশ প্রতিনিয়ত আত্মসমর্পণ করার ফলে গৌড়বঙ্গ পর্যন্ত অপমানে অবসন্ন হয়ে পড়েছে। গৌড়ীয় বঙ্গালদের মাথার ওপর ছাদ কাঁপছে, পায়ের নিচে টলমল করছে মাটি। গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত নেতা খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা। তাদের হাতড়ে বেড়ানো গোরা অনুভব করতে পারে।
সহযাত্রীদের বড়সড় দল নিয়ে গয়ার পথে ইন্দ্রাণী, কাটোয়া ছেড়ে অজয় নদী পেরিয়ে নৈহাটি আলকোনা, তিলপুর, ভাগলপুর, বৈদ্যনাথ, পুনপুন, তেলিয়াগড়ি গিরিখাত ধরে প্রাচীন মগধের রাজধানী রাজগৃহে গোরা যখন পৌঁছল, তার গায়ে ধুম জ্বর। রাজগৃহ থেকে গয়ার দূরত্ব তেইশ ক্লোশ, অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ মাইল। দশ দিনে রাজগৃহে পৌঁছে, সেখানে একরাত কাটিয়ে, পরের আটচল্লিশ ঘণ্টায় গয়া পৌঁছোনোর ছক চন্দ্রশেখর করে রাখলেও গোরার অসুস্থতার কারণে তা পাল্টে গেল। রাজগৃহে এক রাতের বদলে তিনরাত থাকতে যাত্রীরা বাধ্য হল। প্রথম রাত গোরা বেহুঁশের মতো কাটালেও পরের দিন দুপুরে রাজগৃহ ছেড়ে সে গয়া রওনা হতে চাইল। সহযাত্রীদের গয়া পৌঁছোনোয় সে বিঘ্ন ঘটাতে চাইছিল না। তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা, বিশেষ করে গদাধর, কখনও রাগ দেখিয়ে, কড়া কথা বলে, কখনও অভিমানে চোখে জল এনে, আর দু’রাত গোরাকে বিশ্রাম নিতে রাজি করাল। চন্দ্রশেখরও তাই চাইছিল। যাত্রীদের একাংশকে গয়ায় রওনা করিয়ে দিল চন্দ্রশেখর। নবদ্বীপবাসীরা গয়া পৌঁছে, সেখান যাতে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে, তার জন্যে দরকার হলে, একটার জায়গায় দুটো ধর্মশালা, তারা বন্দোবস্ত করে রাখবে। গোরা টের পাচ্ছিল, চাপা উত্তেজনায় হু হু করে তার জ্বর এলেও ভয় পাওয়ার মতো কোনও রোগ হয়নি। ঝোলার ভেতরে সযত্নে রাখা পুঁথির সংস্পর্শে তার দেহের অভ্যন্তর রি রি করে কয়েকদিন ধরে একটানা কেঁপে চলার জন্যে শরীর তেতে উঠে বেদম জ্বর এসে গেছে। গয়ায় পৌঁছে, একান্তে বসে পুঁথিটা পড়ে শেষ করলে জ্বর ছেড়ে যাবে, নীরোগ হবে শরীর। জ্বর এসেছিল কাটোয়া থেকে অজয় নদী পেরিয়ে খেয়াঘাট ছেড়ে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করার পরে। পাকা সোনার মতো তার শরীরে লালচে আভা ফুটে উঠতে দেখে চন্দ্রশেখর বিপদ আঁচ করলেও মুখে কিছু বলেনি। বড় শালি, শচীর এই ছেলেকে নিজের সন্তানতুল্য ভেবে, আজন্ম কোলে কাঁখে তুলে সস্নেহে বড় করেছে। তবু তাকে অনেক সময় দূরের মানুষ মনে হয়। আকাশ থেকে খসে পড়া নক্ষত্র যেন! শচীর আট মেয়ের পরে ছেলে বিশ্বরূপ, পরপর ন’টি সন্তান, তেরোবছরের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দশবছর পরে, আবার সে গর্ভবতী হবে, কেউ ভাবেনি। নবদ্বীপ ছেড়ে স্বামী জগন্নাথের সঙ্গে ছেলে বিশ্বরূপকে নিয়ে কয়েক মাসের জন্যে শ্রীহট্টে শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে, চল্লিশ পেরনো শচী এমন কাণ্ড ঘটাবে, পরিবারের সকলের কাছে অকল্পনীয় ছিল। প্রথম আট সন্তান, আট মেয়ের কেউ বাঁচেনি। নবম সন্তান, ছেলে বিশ্বরূপ কীভাবে বেঁচে গেল, কেউ জানে না। সে এক কুহক! গর্ভধারণ যে প্রকৃতপক্ষে সন্তান হারানোর চরাচরপ্লাবী শোক, শচী জেনে গিয়েছিল। তবু কোন সাহসে দশমবার গর্ভধারণ করল সে? মেয়েমহলে এই নিয়ে কথা উঠেছিল, চন্দ্রশেখরের কানে তা পৌঁছেছে। তার সঙ্গে ঘরণী মনোরমার আড়ালে কথা হলেও শচী এই আনতাবড়ি কাজটা কীভাবে করল, দু’জনের কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। মনের কৌতূহল চেপে রাখলেও শিশু গোরার টানে শচীর বাড়িতে ভগ্নিপতি চন্দ্রশেখরের যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। শচীর পরিবারের সবচেয়ে বড় শুভার্থী হয়ে উঠেছিল চন্দ্রশেখর।
রাজগৃহে, বৌদ্ধ শ্রমণদের অতিথিশালায় জ্বরে বেঁহুশ গোরার মাথার পাশে বসে সারারাত কৃষ্ণনাম জপ করছিল চন্দ্রশেখর। জ্বরের মধ্যে অনর্গল কথা বলছিল গোরা। গোরার জড়ানো গলার প্রলাপ থেকে তার চিকিৎসার কোনও সূত্র মেলে কিনা, তা জানতে কান খাড়া করে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছিল চন্দ্রশেখর। তার প্রলাপের বিশেষ কিছু না বুঝলেও কোনও একটা পুঁথির সে খোঁজ করছে, চন্দ্রশেখর টের পাচ্ছিল। দু চার মুহূর্ত একটানা কথা বলে গোরা বোবা হয়ে যাচ্ছিল। সবটাই করছিল জ্বরের তাড়সে। মাথার নিচে বালিশের মতো যে পুঁটলিটা রেখে গোরা ঘুমোচ্ছিল, তার মধ্যে দৈনন্দিন ব্যবহারের ধুতি, চাদরের সঙ্গে রয়েছে সেই বহুমূল্য পুঁথি। অজয় নদী পেরনোর পরে হু হু করে জ্বর আসছে টের পেয়েও গোরা সেকথা সঙ্গীদের কাউকে, এমনকি গদাধরকেও জানায়নি। মাথার ভেতরটা ভনভন করলেও চুপচাপ হেঁটেছে, যাত্রীদের সঙ্গে সমানে পা মিলিয়ে রাজগৃহ পর্যন্ত এসেছে। পথের মধ্যে তার দু’পা কয়েকবার টলমল করে উঠতে দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল গদাধর। তখনই সে টের পেল জ্বরে গোরার শরীর পুড়ে যাচ্ছে, তেড়ে জ্বর এসেছে। তেলিয়াগড়ির কাছে গোরার কাঁধের ঝোলা প্রায় জোর করে নিজের ঘাড়ে তুলে নিল গদাধর। হাঁটতে যার পা টলছে, সে বোঝা বইবে কীভাবে? সে বইতে চাইলেই হাত গুটিয়ে নেওয়ার পাত্র গদাধর নয়। প্রাণের চেয়ে দামী পুঁথিসমেত ঝোলা বেহাত করতে প্রথমে গোরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। গদাধরের ঝোলা বহনের প্রস্তাব শুনে তার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলেও তাকে বিরত করতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি, গোরার শরীর বইছিল না। শরীরের ভার বহন করতে পারছিল না পা দুটো। ছায়ার মতো অনুগত গদাধরের হাতে ঝোলা তুলে দিয়ে কিছুটা আরাম বোধ করল। রাজগৃহে পৌঁছে প্রথমেই ধর্মশালার নির্ধারিত ঘরে ঢুকে, গদাধরের কাছ থেকে নিজের পুঁটলিটা নিয়ে, সেটা খুলে একটা শতরঞ্জি বার করে মেঝেতে পেতে, পুঁটলিটা ফের কষে বেঁধে, মাথার নিচে বালিশের মতো রেখে শুয়ে পড়েছিল। শতরঞ্জির চেয়ে লম্বা শরীরের পায়ের দিকটা প্রায় দেড় হাত, মেঝেতে বেরিয়ে থাকল। জ্বর বাড়ছিল হু হু করে। কবিরাজ মুরারির পরামর্শে গোরার মাথা ধুয়ে কপালে জলপটি লাগাচ্ছিল গদাধর। গোরার মাথার অন্যপাশে মলিন মুখে চন্দ্রশেখর বসেছিল। গোরাকে শয্যাশায়ী দেখে ভয়ে শুকিয়ে গেল নবদ্বীপবাসী সহযাত্রীদের মুখ। তাকে সুস্থ করে তুলতে তাদের কেউ কেউ নানা অব্যর্থ জড়িবুটি প্রয়োগের নিদান দিলেও বাকিরা শুকনো মুখে ঘোরাঘুরি করছিল। রাতে খেয়ে নিয়ে তাদের ঘুমনোর পরামর্শ দিয়ে গোরার মাথার কাছে প্রদীপ জ্বেলে চন্দ্রশেখর বসেছিল। তার পাশে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সতেরো বছরের তরুণ গদাধর। গোরাকে প্রলাপ বকতে শুনে উদ্বিগ্ন চন্দ্রশেখর ভয় পাচ্ছিল। জগন্নাথ মিশ্র ইহলোক ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে বলা যায়, সে-ই শচীর পরিবারের অভিভাবক। মিশ্র পরিবারের দুই শুভার্থী, শ্রীবাস পণ্ডিত, অদ্বৈত আচার্যের কাছ থেকে দরকারে পরামর্শ নিলেও রামচন্দ্রপুরে বড় শালির সংসারের আনুষ্ঠানিক দেখভাল তাকে করতে হয়। পরিস্থিতি জটিল হলে বেলপুকুরিয়ার শচীর বাপের বাড়ি থেকে তার বাবা নীলাম্বর চক্রবর্তী, দু’ছেলে নিয়ে রামচন্দ্রপুরে এসে যায়। সেরকম পরিস্থিতি খুব অল্প ঘটেছে।
গোরার অভিভাবকত্বের দায় তার ঘাড়ে চাপিয়ে, ছেলের সহযাত্রী করে তাকে গয়ায় পাঠিয়েছে শচী। জ্বরে বেহুঁশ গোরার এই বিদেশ বিভুঁই-এ কিছু হয়ে গেলে শচীকে সে মুখ দেখাতে পারবে না। শুধু শচী কেন, তার স্ত্রী, মনোরমাকে কী কৈফিয়ত দেবে সে? বেলপুকুরিয়ায় শ্বশুরবাড়িতে বাকি জীবনে আর ঢুকতে পারবে না। ঘরে বাইরে সকলে বলবে, গোরার মতো দশাসই শরীর, মজবুত স্বাস্থ্য যে ছেলে, এক দু’বার বায়ুরোগ ছাড়া ছেলেবেলায় আর কোনও ব্যাধিতে কখনও ভোগেনি, মাথায় বিষ্ণুতেল মেখে বহু বছর আগে যে ব্যাধির নিরাময় ঘটেছে, সেই সুস্থ, জোয়ান ছেলে হঠাৎ মারা যায় কীভাবে? গোরার পাশে চন্দ্রশেখর আচার্যর মতো একজন শিক্ষিত, বিচক্ষণ মেসো থাকতে এ দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। সবচেয়ে ভয় শচীকে নিয়ে। পরপর আটটি কন্যাসন্তান হারানোর পরে, দুই ছেলেকে গর্ভে ধারণ করে উন্মাদিনী দশা থেকে যে স্ত্রীলোকটি কিছুটা স্বাভাবিক সংসারজীবনে ফিরে এসেছিল, সে এখন বাঁচবে কী করে? বড় ছেলে বিশ্বরূপ বিবাগী হয়ে চলে যাওয়ার কয়েক বছর পরে স্বামীকে হারিয়েছে সে। সাতবছরের ছেলে গোরাকে আঁকড়ে ধরে দুঃখের সংসারে কোনওরকমে হতভাগিনী ভেসেছিল। বাবার পারলৌকিক কাজ সারতে, গয়ায় এসে গোরা যদি এখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, শচী হয়তো আত্মঘাতী হবে। গোরার সপ্তদশী বধূ, বিষ্ণুপ্রিয়াই বা দাঁড়াবে কোথায়? জগন্নাথ মিশ্রের পরিবারটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। প্রকট দুর্ভাবনার মধ্যেও ঘুমে বুজে আসছিল চন্দ্রশেখরের দু’চোখ। তেল ফুরিয়ে আসা প্রদীপটা মাঝে মাঝে আওয়াজ করে নতুন ইন্ধন যোগানোর সঙ্কেত দিলেও ক্লান্তি আর ঘুমে নেতিয়ে পড়া চন্দ্রশেখরের মগজে তা ঢুকছিল না। গোরার পায়ের কাছে শানবাঁধানো মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে ভোঁস ভোঁস করে গদাধর ঘুমোচ্ছে। দু’চোখ খুলে রাখতে পারছে না চন্দ্রশেখর। তার চোখের পাতায় ভর করে ফৌজি ছাউনির মতো অর্ধবৃত্তাকার ধর্মশালা নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গভীর ঘুমে চন্দ্রশেখর ডুবে যাওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘরের প্রদীপ নিভে গেল। অন্ধকার ঘরে, প্রবল জ্বরে আচ্ছন্নের মতো গোরা পড়ে থাকলেও হঠাৎ সজাগ হয়ে মাথার নিচের পুঁটলিতে হাত বুলিয়ে তার ভেতরে রাখা পুঁথিটা স্পর্শ করছিল। একবার, দু’বার ফের পুঁথিটা ছুয়ে নিশ্চিন্তে সে ঘুমিয়ে পড়ল, ঘাম জমছিল তার কপালে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছিল।
সব দুর্যোগের শেষ হয়। রাজগৃহের ধর্মশালায় সেই ভয়ঙ্কর রাত ফুরনোর আগে ব্রাহ্মমুহূর্তে চন্দ্রশেখর জেগে গেল। দু’চোখ কচলে দেখল অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। ধর্মশালার বাইরে গাছগাছালি থেকে ভেসে আসছে কিছু চেনা, কিছু অচেনা পাখির ডাক। হিমেল বাতাসে ভিজে ঘাসের গন্ধ। মাঝরাত পর্যন্ত জ্বরের ঘোরে গোরা উসখুস করলেও এখন শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘরে যৎসামান্য আলো ঢুকেছে। চন্দ্রশেখর অনুমান করল, গভীর ঘুমে গোরা ডুবে আছে। গদাধর জাগেনি। গোরার কপাল আলগোছে ছুঁয়ে তার শরীরের তাপ অনেক কমে এসেছে, চন্দ্রশেখর বুঝতে পারল। ইষ্টদেবতা কৃষ্ণকে দু’হাত জুড়ে প্রণাম করল সে। ঘুমন্ত গোরার দিকে আর একবার তাকিয়ে ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। সূর্যের আলোতে আকাশ ভেসে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে গোরার ঘুম ভাঙল। নবদ্বীপের যাত্রীরা সূর্যোদয়ের আগে জেগে উঠে প্রাতঃকৃত্য, স্নান সেরে একজন, দু’জন করে গোরার ঘরের দরজায় এসে তাকে দেখে যাচ্ছিল। চন্দ্রশেখর স্নান করতে গিয়েছিল। ঘুম ভেঙে যেতে গোরা দেখল, তার পাশে গদাধর বসে রয়েছে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতে হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়ল গোরার মুখে। বিছানার ওপরে সে উঠে বসতে তাড়াতাড়ি তাকে শুইয়ে দিতে চাইল গদাধর। তার অনুরোধে কান না দিয়ে গোরা জানাল, তার জ্বর ছেড়ে গেছে। সূর্য মাথার ওপর ওঠার আগে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সকলের সঙ্গে সে-ও গয়ার পথে রওনা হতে চায়। তার কথা শুনে গদাধর আঁতকে উঠতে তার হাতটা ধরে নিজের কপালে ঠেকাল গোরা। জ্বর তার শরীর ছেড়ে চলে গেছে, টের পেতে গদাধরের অসুবিধে হল না। গোরার মুখে ছড়িয়ে আছে তার অনবদ্য হাসি। গদাধরের প্রাণ জুড়িয়ে গেল সেই হাসি দেখে। পাকা সোনার বর্ণ গোরার চওড়া কব্জি ধরে তার হাতটা টেনে নিয়ে গদাধর নিজের মাথায় রাখল। সুশ্রী তরুণটির নরম রেশমের মতো চুলে ভর্তি মাথাটা বিশাল পাঞ্জায় সস্নেহে গোরা চেপে ধরল। গোরার হাতের ওপর গদাধর নিজের হাতটা রেখে বলল, তোমার প্রীতি যেন কখনও আমাকে ছেড়ে না যায়। তার মাথাটা আলতো করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গোরা বলল, আমার শরীরের একটা অঙ্গ তুই। তোকে ছেড়ে থাকলে আমি পঙ্গু হয়ে যাব
স্নান সেরে, সূর্য প্রণাম করে ঘরে ঢুকে চন্দ্রশেখর দেখল, গোরার সঙ্গে গদাধর গল্প জুড়ে দিয়েছে। গোরার মুখের রঙ স্বাভাবিক। দু’দিন, দু’রাত জ্বরে ভুগেছে, তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। ধন্য কবিরাজ মুরারি গুপ্ত। ধন্য তার চিকিৎসা! তবু সেইসকালে, গয়া রওনা হওয়ার জন্যে গোরা জেদ করলেও তাকে মধুর বচনে বুঝিয়ে আরও একদিন বিশ্রামের জন্যে রাজগৃহে কাটাতে রাজি করাল চন্দ্রশেখর। বৈদ্য মুরারিও গলা মেলাল চন্দ্রশেখরের সঙ্গে। চব্বিশ ঘণ্টা পরে, সূর্য আকাশে উঁকি দিতে গয়ার পথে সবাই রওনা হল। দু’দিন পরে শেষ বিকেলে গয়ায় পৌঁছে চন্দ্রশেখর দেখল, ফা তীর্থে, অক্ষয়বটের কাছাকাছি গোটা গরুড় ধর্মশালা আগলে তাদের জন্যে প্রথম ঝাঁকের নবদ্বীপবাসী যাত্রীরা অপেক্ষা করছে। দলবল নিয়ে গোরা হাজির হতে তারা আনন্দে উলুধ্বনি দিয়ে উঠল। খুশিতে উচ্ছল যে যাত্রীরা দু’দিন আগে গয়া পৌঁছেছে, তাদের শরীরের ক্লান্তি অনেকটা কমলেও, সদ্য যারা এল, তাদের অনেকে ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়েছিল। অসুস্থ গোরার পরিচর্যার সবচেয়ে বেশি ধকল গেছে চন্দ্রশেখরের। রাতে তার ঘুমনোর জন্যে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হল। ধর্মশালার আর এক ঘরে দুটো খাটিয়ায় গোরার পাশে রাতে থাকবে গদাধর। যাত্রীদের থাকা-খাওয়ার তদারকির দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছিল, সেই মুরারি আর মুকুন্দের আয়োজন ছিল নিখুঁত। গোরার চেয়ে বয়সে মুরারি সাত-আট বছরের বড় হলেও গঙ্গাধর পণ্ডিতের টোলে দু’জন ছিল সহপাঠী। কবিরাজ হিসেবে নবদ্বীপে তার পসার জমে গেলেও গোরার টানে গয়ায় এসেছে। তার ভাতের থালায় এক দুপুরে সাতবছরের গোরা পেচ্ছাপ করে দিয়েছিল। সে ঘটনা মুরারি মনে রাখেনি। উল্টে, বীর বালকের দুঃসাহস দেখে, সে ভবিষ্যতে কত বড় অনর্থ ঘটাতে পারে, অনুমান করে তার হৃৎকম্প হয়েছিল। পারিবারিক সূত্রে, পেশায় বৈদ্য হলেও পনেরো বছর বয়সে নবদ্বীপের সেরা তরুণ মল্লযোদ্ধা হিসেবে মুরারির খ্যাতি রটে গিয়েছিল। ছাপড়া, আরা, ভাগলপুর জেলার কয়েক গণ্ডা ভীমভবানী পালোয়ানকে কুড়ি-বছরে পা দেওয়ার আগে অবলীলায় কুপোকাত করে দিয়ে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের মর্যাদা, সে বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রাহ্মণরা প্রচার করে দিয়েছিল, কলিযুগে মুরারি হল রামভক্ত হনুমানের অবতার। নবদ্বীপের মানুষ এই অবতারতত্ত্ব বিশ্বাস করেছিল। বৈদ্য মুরারির চিকিৎসায় যেমন দ্রুত রোগব্যাধির নিরাময় হত, তার চেয়ে তাকে দেখলে দুষ্কৃতিরা দ্রুততর গা ঢাকা দিত। মুরারির বাহুবলের কাহিনী জেনেও তার ভাতের থালা বালক গোরা নির্ভয়ে পেচ্ছাপ করে ভাসিয়ে দিতে হনুমানের অবতার, মল্লযোদ্ধা বৈদ্যের টনক নড়ে গিয়েছিল। তখন থেকে গোরার কাছাকাছি থাকতে শুরু করে, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে, আরও সুদূরপ্রসারী হয়েছিল মুরারির প্রত্যাশা। রাজগৃহে জ্বরে কাবু হয়ে পড়া গোরার চিকিৎসা সে করেছিল। নিজের ঝুলি থেকে শেকড়বাকড়, তুলসীপাতা, মধু বার করে পাথরের খলে মেড়ে সকাল, দুপুর, সন্ধে গোরাকে খাইয়েছিল। গয়ায় ধর্মশালা জোগাড়ের ভার মুকুন্দকে দিয়ে, রাজগৃহ থেকে প্রথম দল যাত্রীদের সঙ্গে তাকে গয়ায় পাঠিয়েছিল। গোরার চিকিৎসার জন্যে সে নিজে রাজগৃহে থেকে গিয়েছিল। তার চিকিৎসাতে ভোজবাজির মতো কাজ হয়েছে। গোরার সম্পূর্ণ রোগ-নিরাময় ঘটেছে। বাবা আর মৃতা স্ত্রী, লক্ষ্মীর পিণ্ডদানের আগের রাতে গোরা যাতে নিরুপদ্রবে ঘুমোতে পারে, মুরারির পরামর্শে আগেভাগে মুকুন্দ, সদলে গয়া পৌঁছে ধর্মশালায় সে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। পরিবারের দু’জনের পিণ্ড দিতে সারাদিন গোরা গলদঘর্ম হবে। দু’রকম শাস্ত্রীয় নির্দেশ মেনে, দু’জনের দু’দফায় পিণ্ড দিতে দ্বিগুণ সময়, সকালে শুরু করে কাজ শেষ করতে সন্ধে গড়িয়ে যাবে। গোরাকে পুরো সময় নির্জলা উপোস করে থাকতে হবে। রোগ নিরাময় হলেও চট করে গোরার শরীরের দুর্বলতা যাবে না। রাজগৃহ থেকে গয়া আসতে তার কম পরিশ্রম হয়নি। সব দিক বিবেচনা করে গোরার জন্যে আলাদা ঘর রাখা হয়েছিল। তার স্নেহের গদাধরকে রাতের জন্যে একই ঘরে ঘুমনোর ব্যবস্থা করে রেখেছিল মুকুন্দ।
চিঁড়ে দৈ-কলাতে রাতের ফলার সেরে গদাধরকে নিয়ে রাতের মতো নিজেদের ঘরে ঢুকে গোরা কপাট আটকে দিল। প্রদীপের আলোয় দুটো খাটিয়ার ওপরে সতরঞ্জি বিছিয়ে বিছানা পেতে ফেলল গদাধর। গোরা হাত লাগাতে চাইলেও তাকে খাটিয়া থকে উঠতে দিল না গদাধর। খাটিয়ায় শুয়ে গোরার সঙ্গে সে খোশগল্প শুরু করলেও দু’চার কথার পরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। নবদ্বীপ ছাড়ার আগে থেকে গোরা এই সময়টার প্রতীক্ষায় হা-পিত্যেশ করে ছিল। ঘুমন্ত গদাধরকে এক মুহূর্ত দেখে, রাতে সে আর জাগছে না, অনুমান করে খাটিয়া থেকে সে নেমে পড়ল, মাটির ভাঁড় থেকে প্রদীপে কিছুটা রেড়ির তেল নিঃশব্দে ঢেলে নিল। প্রদীপের শিখা উজ্জ্বলতর হয়ে জানিয়ে দিল, মধ্যরাত পর্যন্ত নিষ্কম্প আলো ছড়াবে। নিজের খাটিয়ার গা-ঘেঁষে প্রদীপ রেখে মেঝেতে পুঁটলি খুলে বিশ্বরূপের পুঁথি বার করে সে সামনে রাখল। খাটিয়ায় বসে পুঁথি পড়তে সে অভ্যস্ত নয়। মেরুদণ্ড সোজা করে না বসলে পাঠে সে মনঃসংযোগ করতে পারে না। চতুষ্পাঠীতে এভাবে পাঠ দেওয়া-নেওয়া করা চিরকালের ঐতিহ্য। পুঁথির পাতা খোলার আগে ধুকপুক করছিল গোরার বুক। সে ভাবছিল পৌরাণিক কাল থেকে যে তীর্থে স্বয়ং অযোধ্যাপতি রামচন্দ্র, মহারাজ যুধিষ্ঠির প্রমুখ অতিকায় ক্ষত্রিয় বীরেরা পিতৃপিণ্ড দিয়ে গেছে, এখন মাঝরাতে, নিঃশব্দ নিশীথে সেই জনপদের এক ধর্মশালায় যে পুঁথি সামনে নিয়ে সে বসে রয়েছে, তা কোথায় তাকে নিয়ে যাবে? পুঁথিজড়িত বিষাদাত্মক ঘটনা কম নেই। প্রয়াত জগন্নাথের কথামতো আগুনে সমর্পিত সেই পুঁথি, তার পাঠ করা উচিত হচ্ছে কিনা, এ নিয়ে তার মনে সংশয় জাগল। নতুন জ্বালানি পেয়ে সতেজ হয়ে উঠছে প্রদীপের শিখা। বাড়তি আলো এসে পড়েছে পুঁথির ওপর। খড়ের চালের বাতা থেকে পুঁথিটা বেরিয়ে পড়ার পরে, কুলুঙ্গিতে পুঁথির ভিড়ে সেটা তখনই রেখে দিয়েছিল। নবদ্বীপ ছেড়ে গয়া যাওয়ার আগে পুঁথিটা নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ পায়নি। গয়া যাওয়ার আগে গোছগাছের সময়ে, মা, বউ-এর চোখের আড়ালে পুঁটলিতে নিজের হাতে পুঁথিটা সে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। পুঁথি নিরাপদে রাখতে, গেল এক মাসে যত লুকোছাপা করতে হয়েছে, নবদ্বীপ থেকে অনেক দূরে ফল্গুতীর্থে, ধর্মশালার ঘরে গভীর নিশীথে প্রদীপের আলোয় সব ঘুরে গেল। বিশ্বরূপের পুঁথির একমাত্র অধিকারী হিসেবে এই পুঁথি সে এখন নিশ্চিন্তে পড়তে পারে। ঘুমে অচেতন গদাধরের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে পুঁথির পাতা ওল্টালো গোরা। পুঁথি রচনার নিয়ম মেনে, শ্রীকৃষ্ণবন্দনা দিয়ে পুঁথির মঙ্গলাচরণ শুরু করে, শ্লোকের পর শ্লোক সাজিয়ে দশ-এগারোবছরের বালক, বিশ্বরূপ যে আখ্যান ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে, তা থেকে গোরা চোখ সরাতে পারছে না। অথচ পুঁথিটা একটানা পড়তে তার দম আটকে যাচ্ছে, হাঁপ ধরছে। শরীরে স্বস্তি আনতে পুঁথি থেকে চোখ সরিয়ে লম্বা শ্বাস নিল সে। বিশ্বরূপের পুঁথি লেখার দিনগুলো মনে আনার চেষ্টা করল। তার জন্মের পর থেকে চার-পাঁচবছর ধরে পুঁথিটা বিশ্বরূপ লিখেছে। দশবছরের যে কিশোর, রচনা শুরু করেছিল, পুঁথিতে সে যখন পূর্ণচ্ছেদ টানল, তখন সে চোদ্দ-পনেরোর তরুণ। পুঁথি লেখা বিশ্বরূপ কবে শুরু করেছিল, গোরার জানার সুযোগ না থাকলেও নিজের তিন-চারবছর বয়সের স্মৃতি থেকে, কখনও দাওয়ার এক কোণে, কখনও গোবরে নিকোনো উঠোনে নিমগাছের ছায়ায় বসে পুঁথি লেখাতে নিমগ্ন দাদার মূর্তি খুব আবছা হলেও সে মনে করতে পারে। জগন্নাথ মিশ্র বাড়ির বাইরে থাকলে, তবেই জলে গোলা ভূষোকালিতে ভরা দোয়াত, খাগের কলম, কঞ্চির কলম, পাততাড়ি নিয়ে লিখতে বসত বিশ্বরূপ। দাদা লিখতে বসলে তাকে সে খুব বিরক্ত করত। কালিভর্তি দোয়াত উল্টে দিয়ে, খাগের কলম ভেঙে, পুঁথি ধরে টানাটানি করে, আরও কতভাবে জ্বালাতন করত, হিসেব নেই। দাদা রাগত না। তার গায়ে কখনও হাত তোলা দূরে থাকুক, বরং উপভোগ করত তার দুষ্টুমি। হাসিমুখে তার সব উপদ্রব সহ্য করত। তাকে বিষয়ান্তরে আকৃষ্ট করতে, কখনও দাওয়ায় কাঠকয়লার ছক তৈরি করে বাঘবন্দি, কখনও উঠোনে লম্বা রেখার ঘর এঁকে এক্কাদোক্কা খেলত। খেলার নিয়ম গোরাকে শিখিয়ে নিত বিশ্বরূপ। নিয়মিত তালিম দিত। দু’ভাই-এর খেলা, রান্নাঘর থেকে, দাওয়া, উঠোন থেকে নানা কাজে ব্যস্ততার মধ্যেও সয় চোখে শচী যখন দেখত, গোরার মনে হত, পৃথিবীর সবচেয়ে মনোরম কোনও দৃশ্য মা অবলোকন করছে। ভুষোকালিতে লেখা, লিপিমালার পরমায়ু বাড়াতে আম, সজনে গাছের গুঁড়ি কেটে আঠা বার করে, তা দোয়াতে ফেলে কালির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে বিশ্বরূপকে শিখিয়েছিল জগন্নাথ। কালিতে আঠা মেশালে সে কালির রেখা পাকা হয়। পুঁথি লেখার কালি সকলে তখন এভাবে তৈরি করত। বিশ্বরূপের পুঁথির নাম, ‘সম্ভবামি’। দেবনাগরী হরফে লেখা পুঁথিতে লেখকের নাম নেই।
পুঁথি পড়া শুরু করে দম আটকে আসার যে অস্বস্তি গোরা অনুভব করছিল, তা কেটে যেতে সময় লাগল না। নিস্তব্ধ রাত। কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া নেই। ধর্মশালার পেছনে ফাঁকা ঢিবির মতো এক খণ্ড পতিতজমিতে দুটো শ্যাওড়া গাছের মাথার দিকে প্রায় নিষ্পত্র ডালগুলোতে বিকেলে ঝাঁক বেঁধে যে শকুনদের গোরা বসে থাকতে দেখেছিল, রাতের দ্বিতীয় প্রহরে, তাদের কয়েকটা ডেকে উঠতে মনে হল, এক দঙ্গল মানবশিশু কেঁদে উঠল। নবজাত মানুষের শিশুর কান্নার সঙ্গে শকুনের ডাকের বিশেষ তফাত নেই। শব্দহীন অন্ধকার রাতে বিনিদ্র মানুষকে এই আওয়াজ শিহরিত করতে পারে। গোরা কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হলেও ফের পুঁথিতে মনঃসংযোগ করল। পুঁথির বিষয়ে ডুবে যেতে তার সময় লাগল না। বিস্ময়ে, বিষাদে, বিদ্যুৎচকের মতো অনুভূতিতে তার রক্তের মধ্যে একের পর এক সুবিশাল ঢেউ উঠে বুকের দেওয়ালে লেগে সপ্তর্ষি নক্ষত্রমণ্ডলীর জিজ্ঞাসার মতো সমুখিত হয়ে পরের মুহূর্তে ভেঙে পড়ছিল। ঘূর্ণি হাওয়ার মতো তার চারপাশে বিশ্ব চরাচর ঘুরতে শুরু করল। কান্না পাচ্ছিল তার। আবেগে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল দশদিক। সাময়িক সেই অনুভূতি সরে গেলে নেশাচ্ছন্নের ঝিমুনি তাকে জড়িয়ে ধরছিল। স্বপ্নের মতো মনে হতে থাকল তার এই জন্ম, এই জীবন, আত্মপরিচয়, বেঁচে থাকার ঠিকানা। পুঁথির প্রতি পাতা ওল্টানোর সঙ্গে জন্ম থেকে তৈরি তার জীবনের প্রত্যেকটা অধ্যায় বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকল, লুপ্ত হতে থাকল তার স্থান, কালের চেতনা, নিজেকে কখনও পবনদেবের সন্তান কখনও দশ দিকপালের অন্যতম, জলের দেবতা বরুণের পুত্র, পরের মুহূর্তে শ্রীহট্টের বুরহানউদ্দীন দরগার অলৌকিক ক্ষমতাবান মুজাভিরের আত্মজ মনে হতে থাকল। পদ্মপাতায় এক ফোঁটা জলের মতো টলমল করছে তার অস্তিত্ব। লবণাক্ত মহাসমুদ্রে যে-কোনও মুহূর্তে খসে পড়তে পারে সেই জলবিন্দু। গোরার মনে হল, তার দেশ নেই, জাতি নেই, ধর্ম নেই, দুর্যোগের রাতে আকাশ থেকে খসে পড়া এক উল্কাপিণ্ডের মতো মাতৃগর্ভের অন্ধকারে পৌঁছে গিয়ে, দশমাস সেখানে বাস করেছে। মহাভারতের কর্ণের মতো সে-ও কুন্তির কানীন সন্তান।
বিশ্বরূপের পুঁথিতে পঁচিশবছর আগের বর্ষণমুখর, ঘনঘোর তিন রাতের বিবরণ, গোরার কাছে দিকচিহ্নহীন আকাশের মতো রহস্যময় লাগলেও অনুল্লেখিত, প্রচ্ছন্ন যে কথাটা বুঝতে তার অসুবিধে হল না, তা হচ্ছে, সে এই পৃথিবীর কেউ নয়, সে এক দৈবী পুরুষ, ঈশ্বরের অবতার, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ হওয়াও অসম্ভব নয়। তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। তার জন্যে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর মানুষ। ভালবাসা দিয়ে তাদের জয় করতে হবে। সাহসী মানুষই ভালবাসতে পারে। সাহসী হতে গেলে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হতে হয়। আদর্শবান মানুষ না হলে সন্ন্যাস গ্রহণের অধিকার জন্মে না। জন্মসূত্রে যে দৈবী ঐশ্বর্য গোরা পেয়েছে, তা সাধারণ মানুষে বর্তায় না।
অনুজের অবতারত্ব বারবার বিশ্বরূপ লিখে গেছে। পুঁথির আখ্যানে যুক্তি, কার্যকারণ সাজিয়ে যেভাবে নিজের বিশ্বাসকে সে প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে কোনও ফাঁক নেই। প্রচলিত ধর্ম, জাত-পাত, বর্ণের অনেক ওপরে যে তার অধিষ্ঠান ঘটতে চলেছে, নিপুণ কলমে দেবনাগরী হরফে শ্লোকের ইমারত গেঁথে তা সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলেছে। মেষের ভিড়ে সে সিংহশাবক, এ নিয়ে বিশ্বরূপের তিলমাত্র সন্দেহ নেই। তার আসন্ন আগমনবার্তা, পঁচিশবছর ধরে গুরু অদ্বৈত আচার্য গঙ্গার দু’তীরের মানুষকে শুনিয়ে চলেছে। দেশের নানা প্রান্তের মানুষের কাছে একই বার্তা পাঁচদশক ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে গুরু মাধবেন্দ্রপুরী, তার গুরু লক্ষ্মীপতিপুরী আর পরের প্রজন্মের ঈশ্বরপুরী এবং তার গুরুভাইদের মতো সন্ন্যাসীরা। প্রাণের, গানের, চিন্তার শৃঙ্খলমুক্তির জন্যে যে অবতারের আবির্ভাব সম্পর্কে বিশ্বরূপ নিঃসন্দেহ ছিল, সে যে তার পরিবারে চন্দ্রগ্রহণের রাতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তার লেখা পুঁথির ছত্রে ছত্রে সেই খবর ছড়িয়ে রয়েছে।
বিশ্বরূপের লেখা পুঁথির পাতায় অভিনিবিষ্ট গোরা স্থান-কাল-পাত্রের সঙ্গে নিজের পিতৃপরিচয় ভুলে গেল। মূর্ছাতুর চোখে দেখা পৃথিবীর আড়ালে অন্য এক পৃথিবী, আকাশের ওপরে আর এক আকাশ দেখতে থাকল। আকাশের নিচে এই পৃথিবীতে মানুষ বড় দুঃখী, মানুষের বড় কষ্ট, সৎ মানুষদের সরিয়ে দিয়ে অসাধু দুর্বৃত্তরা বিশ্বসংসার দখল করে নিচ্ছে। তাদের রুখে দিতে হবে। প্রভুত্বের আসন থেকে তাদের হঠিয়ে গড়ে তুলতে হবে সাধুসমাজ যুগে যুগে সুখী, সমৃদ্ধ মানবসমাজ নির্মাণের নেতাকে যে ঈশ্বরের অবতার বলা হয়, ছোটভাই গোরাকে অবতারের আসনে বসিয়ে সেই শাস্ত্রবাক্য বিশ্বরূপ স্মরণ করিয়েছে।
বৈদিকমতে যার পিণ্ড দিতে গোরা গয়ায় এসেছে, সেই জগন্নাথ মিশ্রের পারলৌকিক কাজ করার অধিকার আদৌ তার আছে কি না, এমন এক প্রশ্নের ধাক্কায় তার মন বিকল হল। বিশ্বরূপের পুঁথির ভাষ্য সত্য হলে সে মহাভারতের সূর্যদেবের পুত্র, কর্ণের মতো বরুণ বা পবনদেবতার ছেলে, মিশ্রবংশের কেউ নয়। মিশ্রবংশের রক্ত তার শরীরে বইছে না। পুঁথিতে বিশ্বরূপ এমন আভাসও দিয়েছে যে জলদেবতা বরুণ আর বায়ুদেব পবনের অভিন্ন মানুষমূর্তি হল বুরহানউদ্দীন দরগার মুজাভির। মহাভারতের কাহিনীতে দু’ভাই বলরাম আর কৃষ্ণের পিতৃমাতৃপরিচয় যেমন বাসুদেব, নন্দ, দেবকী, রোহিনী, যশোদা প্রমুখ চরিত্রের সঙ্গে নিগূঢ় ধোঁয়াশা তৈরি করলেও ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণ, এ নিয়ে দ্বিমত নেই, তেমনি চেহারা, চরিত্র, চালচলনে গোরার রক্তে শ্রীহট্টের মিশ্রপরিবারের এক কণা রক্ত না থাকলেও সে যে কৃষ্ণাবতার এ নিয়ে বিশ্বরূপের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। প্রতিটি অবতারের জন্মের সঙ্গে রহস্য জড়িয়ে আছে। সাধারণ মানুষ সে রহস্য নিয়ে মাথা ঘামায় না, সে দেখে, নবরূপধারী উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা, দিব্যরূপ নরোত্তম উদ্ভাসিত করে রয়েছে তার চলার পথ।
পুঁথির পাতা ওল্টানোর সঙ্গে গোরা অন্ধ, বধির হয়ে যাচ্ছিল। তার দু’চোখ থেকে দরদর করে জল ঝরছিল। বিশ্বরূপের পুঁথি পড়ে অসুস্থ জগন্নাথ কেন আরও অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছিল, গোরার বুঝতে অসুবিধে হল না। ছোট ছেলে গোরা যে বংশরক্ষার অধিকারী নয়, জগন্নাথের এ তথ্য ভালোরকম জানা থাকায়, ষোলোবছরের শিক্ষার্থী বিশ্বরূপকে সাততাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে সংসারের চলন্ত ধারাকে অব্যাহত রাখতে চেয়েছিল। শ্বশুর, নীলাম্বর চক্রবর্তীর জ্যোতিষগণনা থেকে জগন্নাথ জেনেছিল, তার দু’ছেলের একজন সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। নীলাম্বরের গণনাতে অন্ধ বিশ্বাস থেকে বিশ্বরূপকে সংসারের জালে তাড়াতাড়ি বেঁধে ফেলতে চেয়েছিল জগন্নাথ। মিশ্রবংশের ব্রাক্ষ্মণ্যধারা বহনে অনধিকারী গোরা সংসারধর্ম পালন করলে পরিবারের মুখে চুনকালি পড়বে। অনন্ত নরকে পচতে হবে জগন্নাথকে। বিশ্বরূপ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কয়েক বছর পরে, অন্তর্জলি যাত্রার সময়ে বড় ছেলের হাতের আগুন পাওয়ার জন্যে জগন্নাথ হা-হুতাশ করেছিল। জগন্নাথের মুখাগ্নি করার সময়ে এগারোবছরের গোরার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মৃত্যুর আগে, মুমূর্ষু বাবা, হতচেতন দশাতেও তার হাতের আগুন পেতে কেন একবারও আগ্রহ দেখাল না?
সতেরোবছর পরে মাঝনিশীথে গয়ায় বিশ্বরূপের পুঁথি খুলে চোখের সামনে রেখে অনেক ভুলে যাওয়া জিজ্ঞাসা, জীবনের নানা সময়ে, মা-বাবার আচরণে, মনে যত ধাঁধা তৈরি হয়েছিল, সে সবের সমাধান গোরা পেয়ে গেল। বিশ্বরূপের অগ্নিদগ্ধ পুঁথি হঠাৎ জ্বলন্ত মশালের মতো হাজির হয়ে তার ঠিকুজি কুলজি সমেত জন্মপত্রিকা পুড়িয়ে ছাই করে দিল। তার পুনর্জন্ম ঘটাল। রাত শেষ হয়ে আসছে, টের পাওয়ার মতো বাহ্যজ্ঞান তার ছিল না। তেইশবছরের জীবনটাকে মনে হচ্ছিল হেমন্ত রাতের কুয়াশাঘেরা স্বপ্ন। ছেলেবেলা থেকে গড়ে তোলা জীবনটা এক ফুৎকারে বাতাসে মিলিয়ে গেল। সে প্রকৃতপক্ষে কে, কী তার পরিচয়, কোথা থেকে এসে কোথায় চলেছে, কিছুই সে বুঝতে পারল না। তার অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই, সামনে পেছনে ধুধু শূন্যতা, ঘাসের ডগায় ভোরের শিশিরবিন্দুর মতো সে লেগে রয়েছে। তার একজন মা থাকলেও বাবা নেই, দেশ নেই, জাতি নেই, নামগোত্রহীন, ঈশ্বর পরিত্যক্ত এক বিশাল নেতির অধম সন্তান সে। তার কুলাচার মিথ্যে, উপবীত মিথ্যে, গায়ত্ৰী মন্ত্র মিথ্যে, স্ত্রী, সংসার, আত্মীয়পরিজন সবই তার অলীক পরিচয় ঘিরে তৈরি এক তাসের প্রাসাদ, যা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আওয়াজ সে শুনতে পেল। সে এই পৃথিবীর কেউ নয়, সে এই সমাজের কেউ নয়, বংশপরিচয়, কুলপরিচয়, ব্রাহ্মণত্ব, নিজের যত পরিচয় এতদিন সে জেনে এসেছে, সব মিথ্যে। তার শাস্ত্র, আচরণবিধি, সংসারের সঙ্গে যত সম্পর্ক এক রাতে সব মুছে গেছে। জীবনটাকে সে আবার কীভাবে শুরু করবে, কোথায় যাবে, কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে দিকচিহ্নহীন শূন্যতার মধ্যে পথ হাতড়াতে থাকল। স্বর্গবাসী দুই দেবতা বরুণ, পবনের কেউ তার জন্মদাতা হলে সে স্বর্গচ্যুত, অভিশপ্ত এক মানুষ, শ্রীহট্টের মুজাভিরের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক থাকলে আর্যাবর্তের সীমানা ছাড়িয়ে দেশান্তরে রয়ে গেছে তার ঠিকানা, আবার বরুণ, পবন, মুজাভির অভিন্ন সত্তা হলে সে নির্বিশেষ, অনাবৃত বিশ্বমানব সমাজের এক সামান্য মানুষ। সামান্য হলেও নতুন আত্মপরিচয়ে বিশাল পৃথিবীর কোলে পুনর্বার ভূমিষ্ঠ হওয়ার রোমাঞ্চ অনুভব করতে থাকল সে। বুকের মধ্যে সুখ-দুঃখের দুর্বোধ্য উচ্ছ্বাসে ক্রমাগত কেঁদে চলল। তেল নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আলোর শিখা, প্রদীপের বুক পর্যন্ত জ্বলে চিড়চিড় আওয়াজ তুলে দপ করে নিভে গেল। হেমন্ত রাতের সুদীর্ঘ অন্ধকার পাতলা হতে থাকলেও গোরা নজর করল না। আসনপিঁড়ি হয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকল। চোখের জলে তার বুক ভেসে যাচ্ছে। জ্বর ছেড়ে গেলেও চোখের জলের উষ্ণতায় রেখে গেছে তার তাপ। খাটিয়ায় কাঠের গুঁড়ির মতো গদাধর ঘুমোচ্ছে। তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ গোরার কানে ঢুকছে না। সে অনুভব করল ছেলেবেলা থেকে সে বড় একা, বিশ্বরূপের পুঁথি পড়ে আরও বেশি একা হয়ে গেল। পরের মুহূর্তে মনে হল, সে একা নয়, শাস্ত্রীয় বন্ধনের একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সে ‘বহু’ হয়ে গেছে। পৃথিবীকে নিষ্পাপ, বাসযোগ্য করার দায়িত্ব চেপেছে তার ওপর। বিশ্বরূপ লিখে গেছে সে কলিযুগে কৃষ্ণের অবতার। সবার আগে এই পুঁথি বিষ্ণুপাদ মন্দিরের উত্তরে প্রবাহিত গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া দরকার। পুঁথির শেষে ছোটভাইকে সেই নির্দেশ, দিয়ে গেছে বিশ্বরূপ। গোরার জন্যে রেখে যাওয়া তার পুঁথি যে অতি গোপনীয় দলিল, সে কথা লিখতে বিশ্বরূপ ভোলেনি।
পুঁথি গুটিয়ে পুঁটলিতে বেঁধে রেখে গোরা অঝোরে কাঁদতে লাগল। গয়ায় যে কাজে সে এসেছে, সেই পিণ্ড দেওয়ার অধিকার তার নেই, মেসো চন্দ্রশেখরকে একথা কীভাবে বলবে সে? পাথরের ওপর বিষ্ণুর পায়ের চিহ্ন ছোঁয়ার অধিকার কি তার আছে? তা-ও নেই। তার পারিবারিক, সামাজিক পরিচয়, ধর্মীয় অধিকারের সীমা-পরিসীমা একরাতের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মাতৃপরিচয় ছাড়া তার বলার মতো কিছু নেই। সত্যি কি নেই?
কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থেকে গোরা মনে হল, আছে, অবশ্যই আছে। মাথার ওপরে আকাশ, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রলোক আছে, পায়ের নিচে আছে পৃথিবীর পবিত্র মাটি, তাকে ঘিরে রয়েছে মহাশক্তি জননী ধরিত্রী, তার সন্তানসন্ততি, সমুদ্র, অরণ্য, পাহাড়, লক্ষ লক্ষ দীনদরিদ্র, মানহীন, আর্ত মানুষ, মানুষের সেই জনযাত্রায় সে-ও একজন মানবসন্তানের পরিচয়ে মিশে যাবে। হতাশার গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ খুঁজে পেয়ে গোরা কিছুটা আশ্বস্ত হল। অন্ধকার ঘরে খাটিয়ায় শুয়ে চোখের জলের মধ্যে তার মনে হল, সদ্যোজাত মানবশিশুর অধিকার, অনধিকারের কোনও সীমা নেই। পৃথিবীতে তারও এটা নবজন্ম, কোলের শিশু ছাড়া সে কিছু নয়, পাপ-পুণ্য কোনওটা তাকে স্পর্শ করবে না।