গোরা – ৩৫

৩৫

শরৎশেষের দুপুরবেলার রোদ এসে পড়েছে ঘরের বন্ধ জানলার লাল, নীল, সবুজ কাচে। নবদ্বীপের বাড়িতে এই ঘরটা ত্রিদিবনাথের খাস দপ্তর। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ডিভিডি, ভিসিডি, হোম থিয়েটার, একাধিক প্রোজেক্ট, হ্যান্ডিক্যাম, আধুনিকতম যত কারিগরি সব এই ঘরে ত্রিদিবনাথের হাতের গোড়ায় রয়েছে। ঘরের পুবের দেওয়াল ঘেঁষে বইপত্র বোঝাই কাচ লাগানো দুটি আলমারিও আছে। মানুষের সামনে উঁচুমানের কোনও শিল্পকর্ম হাজির করতে হলে কী ব্যাপক গবেষণা আর হাড়ভাঙা মেহনত করতে হয়, সেজকাকাকে দেখে গোরা টের পাচ্ছে। এত পরিশ্রম করেও সেজকাকা ক্লান্ত হয় না, কপালে ভাঁজ পড়ে না, চোয়াল ঝুলে যায় না, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমান চটপটে, তাজা থাকে। সেজকাকাকে দেখে গোরা অবাক হলেও মুখে কিছু না বলে পরিশ্রমে তাকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে। সেজকাকা মজা পায়। গোরার সাহচর্য উপভোগ করে।

সেজকাকার সঙ্গে একমাস কাটিয়ে গোরা টের পায়, সে নিজেও বদলে যাচ্ছে। তার মাথার মধ্যে ক্রমশ আবছা হয়ে যাচ্ছে শোভাবাজারের বাড়ি, মা, বাবা, পরিবারের মানুষের চেনা মুখ, এমনকি লাল কার্পেট মোড়া পার্ক স্ট্রিটের নাইট ক্লাব ‘মন্ত্র’, বৈভব, ঐশী, আলোলিকা, তুন্দ্ৰা, মেঘনা, প্রসিত, কাছে দূরের আরও কত বন্ধুর সঙ্গে যে উদ্দাম সময় কাটিয়েছে, সেই টগবগে স্মৃতিও ক্রমশ ছায়া হয়ে যাচ্ছে। পাঁচশ’ বছর আগের গোরার মতো সে-ও যে সর্বত্যাগী, উদাসীন সন্ন্যাসী হয়ে যাচ্ছে, এমন নয়, সেজকাকার মেগাসিরিয়ালের যোগ্য নায়ক হতে রোজ চোদ্দো, পনেরো ঘণ্টা ঘামঝরানো মহড়ায় ডুবে থেকে নানা প্রশ্ন জেগেছে তার মনে। সেজকাকার কাছে প্রশ্নগুলোর জবাব না চেয়ে নিজে উত্তর খুঁজেছে। চৈতন্যভক্তদের লেখা তিনটে জীবনীর সঙ্গে আধুনিককালের গবেষক লেখকদের একাধিক বই পড়ে, কম্পিউটার থেকে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করে গোরার যে আখ্যান সে গড়ে তুলেছে, তা সেজকাকার কাহিনী থেকে কিছুটা আলাদা। তার মনে যে দুটো প্রশ্ন বেশি করে খোঁচাচ্ছে, তার প্রথমটা হল, পাঁচশ’ বছর আগের একজন মানুষের প্রেমভক্তির ‘মেগাসিরিয়াল’ দেখিয়ে হাউসটনের সহকর্মীদের কতটা উদ্বুদ্ধ করতে পারবে সেজকাকা? দ্বিতীয় প্রশ্নটা হল, সেজকাকার ক্যামেরাবন্দি পঞ্চাশটা ‘এপিসোডে’ কিছু ফাঁকফোকর থেকে গেছে। সেগুলো কি সেজকাকার নজরে আনবে?

গোরার মুখ খোলার জন্যে হ্যান্ডিক্যাম চালিয়ে ত্রিদিবনাথ অপেক্ষা করছে। গোরা বলল, তোমার সঙ্গে থেকে যতটা জেনেছি, তার থেকে বেশি কিছু বলার মুরোদ আমার নেই। আমার বলায় কিছু ভুলচুক হলে তুমি শুধরে দিও।

নরম হাসি মুখে ছড়িয়ে সেজকাকা বলল, আগে শুনি। তারপর ভাবা যাবে।

সেজকাকার কাছ থেকে ভরসা পেয়ে গোরা বলতে শুরু করল, কৃষ্ণপ্রেমে গোরা খেপে গেলেও সমাজ, সংসার সম্পর্কে সে উদাসীন ছিল না। নবদ্বীপের সব জাতের মানুষের সঙ্গে ব্যাপক মেলামেশা থেকে সে জেনেছিল, মানুষ শক্তির উৎস। আধমরা এই সমাজে তারাই সংখ্যায় বেশি। কোণঠাসা, উপোসী এই মানুষগুলোর জন্যে তার কিছু করার আছে। তার চোখের সামনে গৌড় জুড়ে যে অনাচার, মৃত্যু, হাহাকার চলেছে, সে মেনে নিতে পারছিল না। দ্বাপর যুগে স্বয়ং কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে কুরুরাজদের স্বেচ্ছাচারী শাসন মেনে নিতে পারেনি। বিশ্বরূপের পুঁথি পড়ে গোরা জেনেছিল, সে কৃষ্ণের অবতার নাহলেও তার অংশ। কৃষ্ণ তার বাপ। কৃষ্ণের তেজ ছিটেফোঁটা পেয়েছে সে। পাঁচজন বেঁটে বা লম্বা মানুষের মতো সে সাড়ে তিন হাত মানুষ নয়, চার হাত লম্বা সে। হ্যাঁ, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা নিজের হাতের চার হাত। দ্বাপর যুগের কৃষ্ণও ছিল তাই। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় কৃষ্ণের মতো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি সে হতে না পারলেও কৃষ্ণনাম প্রচার আর সঙ্কীর্তনে সমাজের ভোল বদলে দিতে পারে। বিশ্বরূপের পুঁথির নির্দেশ পেয়ে গয়া থেকে নবদ্বীপে ফিরে বারবার ভাগবত পড়েছিল গোরা। যতবার পড়েছে, চোখের জলে ভেসে গেছে। এত প্রেম, এত ভালবাসা আর কোনও শাস্ত্র, দেবতা বা অবতার চরিত্রে নেই। ভাগবত পড়ে গোরা পেয়েছিল প্রেমভক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। তবু তার মনে কিছু খটকা থেকে গিয়েছিল। দেশ জুড়ে অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মসনদের দখল নিয়ে রাজায় রাজায় যখন হানাহানি, কাটাকাটি চলেছে, দুঃস্বপ্নের বিভীষিকার মতো সেইসময়ে শুধু প্রেমভক্তি সম্বল করে মানুষকে কতটা ভরসা সে দিতে পারে? মনে সন্দেহ থাকলেও সে গুটিয়ে যায়নি। সঙ্কীর্তনের আসরে নেচে, গেয়ে, ভাবাবিষ্ট হয়ে নবদ্বীপে বৈষুবসম্প্রদায়ের সঙ্গে নবশাক, শূদ্র, ম্লেচ্ছ সব গোষ্ঠীর মানুষকে মাতিয়ে তুলেছিল। ভাবাবেশের সময়ে তার ওপরে কৃষ্ণের ভর হয়, সে অনুভব করতে পারছিল। তাকে নিয়ে নবদ্বীপে প্রেমভক্তির জোয়ারে মাতামাতির পাশাপাশি চোখের আড়ালে এমন কিছু কাণ্ড ঘটছিল, যা ধর্মীয় কর্মসূচির সঙ্গে খাপ খায় না। গৌড়ের মসনদের দিকে নজর রেখে রাঢ়ের জঙ্গলে অস্ত্র জোগাড় করে যারা তৈরি হচ্ছিল, তাদের একজন সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায় গোরার আশীর্বাদ প্রার্থনা করে গোপনে তার সঙ্গে দেখা করেছিল। কুলিয়ায় নিজের বাড়িতে এক রাতে এই সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেছিল খ্যাতিমান ন্যায়শাস্ত্রবিদ বিদ্যাবাচস্পতি। তার বাড়িতে বসে গোরা জেনেছিল সুশ্রুতের বাহিনীকে নানাভাবে সাহায্য করছে সামন্তভূমির রাজা শঙ্খ রায়ের ছেলে হামীর রায় আর চন্দ্রদ্বীপের রাজকুমার পীতাম্বর রায়। তারা আলাদাভাবে কুলিয়ায় এসে বিদ্যাবাচস্পতির সঙ্গে দেখা করে নবদ্বীপের গোরাকে তাদের সর্বান্তঃকরণ সমর্থন জানিয়ে গেছে। সুশ্রুত রায় আরও এক কাঠি এগিয়ে বিদ্যাবাচস্পতিকে বলে গেছে, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় সকলের আগে গোরাকে নেতা হিসাবে সে বরণ করে নিতে চায়। গ্রীষ্মের এক দুপুরে, আকাশ যখন কালবৈশাখির মেঘে কালো হয়ে গেছে, বৃষ্টি নামেনি, গঙ্গার ধারে এক নির্জন গাছতলায় দাঁড়িয়ে গোরাকে বিদ্যাবাচস্পতি বলেছিল, শুধু সামন্তভূমি আর চন্দ্রদ্বীপের দুই রাজকুমার নয়, গৌড় দরবারের কয়েকজন প্রভাবশালী রাজকর্মচারীও সুশ্রুত, হামীর, পীতাম্বরের জোটকে গোপনে মদত জোগাচ্ছে। গৌড়ের রাজকর্মচারীদের নাম বিদ্যাবাচস্পতি না বললেও তাদের চিনতে পেরেছিল গোরা। কর্ণাটকবাসী যে ব্রাক্ষ্মণ পরিবার একসময়ে নিজেদের দেশ ছেড়ে গৌড়ে বাসা করেছিল, তাদেরই নাতিপুতির দুজন, রাজধানী একডালার দরবারের সাকর মল্লিক আর দবীর খাস, উঁচুপদের রাজকর্মচারী, তারা দু’ভাই যে তার ঘোর অনুরাগী, গোরা জানত। সুলতানি দরবারের প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদীর বিষনজর থেকে গোরা আর নবদ্বীপের বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে এরা আগলে রেখেছে। গোরার জানা দুই রাজকর্মচারীর সঙ্গে তৃতীয় যে নাম চুপিচুপি বিদ্যাবাচস্পতি শুনিয়েছিল, দরবারে সেও কম শক্ত খুঁটি নয়, বরং অনেকের চেয়ে, এমনকী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে সে বেশি ক্ষমতাবান, তার নাম জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির। জ্যোতিষার্ণবও যে গৌড়ের মসনদ দখলের গোপন কূটনীতির সমর্থক, গোরা সেই প্রথম শুনল। বিদ্যাবাচস্পতি বলেছিল, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার অধিনেতা, গোরার পথ চেয়ে জ্যোতিষার্ণবও দিন গুনছে।

বিদ্যাবাচস্পতির কথা শুনে গোরার মাথা ঘুরে যায়নি। সে ডুবে ছিল কৃষ্মনাম, সঙ্কীর্তনে, প্রেমভক্তির আবেশে। মসনদ নিয়ে হিংসা, রক্তারক্তির সঙ্গে কলিযুগে তার বাপ, বাঁশি হাতে কৃষ্ণের সম্পর্ক নেই, প্রেমভক্তি বিলি করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সে পৃথিবীতে এসেছে, এই গভীর বিশ্বাসে পৌঁছে গিয়েছিল সে। ধর্মরাজ্যে যদি কোনও অধিপতির দরকার হয়, সে দায় নেবে নিতাই, জনসমাজকে প্রেমভক্তিতে ভাসিয়ে দিয়ে, আদর্শ মানুষ হিসেবে তাদের সামনে রেখে ধর্মরাজ্য চালানোর ঠিকা শুধু নিতাই নিতে পারে। নিতাই-ও কম ওজনদার মানুষ নয়। সে দ্বাপর যুগে বলরাম, করুণার সমুদ্র সে, তেমনিই প্রখর তার ন্যায়ধর্ম।

গোরা সন্ন্যাস নিয়ে ফুলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির ঘরে শেষবার দেখা করার সময়ে তাকে একান্তে ডেকে সেই বৈদান্তিক পণ্ডিত অনুরোধ করেছিল, পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছে সে যেন রাজা প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে রাজা কৃষ্ণদেবের সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়। উৎকল আর বিজয়নগর রাজ্যের মধ্যে মহাযুদ্ধ শুরুর যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে সন্ধি প্রতিষ্ঠায় সে উদ্যোগ নিলে ধর্মরাজ্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। কঠিন এই দায়িত্ব কৃষ্ণাবতার গোরা অনায়াসে উতরে দিতে পারে। বিদ্যাবাচস্পতির অনুরোধ গোরা মেনে নিয়েছিল। বিশ্বরূপের খোঁজে দাক্ষিণাত্য সফরের পথে সবগুলো তীর্থক্ষেত্রে তন্নতন্ন করে দাদার খোঁজ করবে। মায়ের কাছে সন্ন্যাস নেওয়ার অনুমতি পেতে তাকেও বলে এসেছে দাদাকে সংসারে ফিরিয়ে দেবে সে। মায়ের পাশে দু’ছেলের একজন গার্হস্থ্য জীবনে থাকবে। মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে তাকে। দাদাকে সংসারী করতে না পারলে তাকে নবদ্বীপে ফিরে গৃহীর জীবন কাটাতে হবে। তা হওয়ার নয়। সন্ন্যাসীর ব্রতভঙ্গ করার কলঙ্ক মাথায় নিয়ে সে বাঁচতে চায় না। আত্মহত্যার চেয়ে সেটা বড় পাপ। তার গায়ে পাপের কলঙ্ক বিশ্বরূপ লাগতে দেবে না। ছোট ভাই যে কৃষ্ণের অংশ, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, বিশ্বরূপ নিজে পুঁথি লিখে তা জানিয়ে গেছে। কৃষ্ণের সন্তানের মহান ভূমিকাকে কিছুতে সে খাটো হতে দেবে না। নবদ্বীপের সংসারের স্বেচ্ছায় ফিরে এসে মা আর ভ্রাতৃবধূর দায়িত্ব নেবে।

.

সেজকাকাকে গোরা বলল, সন্ন্যাস নেওয়ার পরে তিন, চারদিন কৃষ্ণের খোঁজে সেই মানুষটার বিভ্রান্তের মতো এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর যে কাহিনী ভক্তদের লেখা চৈতন্যজীবনীতে পাওয়া যায়, তার সবটা ঠিক নয়। শুধু কৃষ্ণপ্রেমের পাগল হয়ে সে সন্ন্যাস নেয়নি। নানাভাবে শত্রুপক্ষ তাকে এমন ঘিরে ফেলেছিল, যে কোনওদিন সে খুন হয়ে যেতে পারত। শ্রীবাস পণ্ডিতের বিধবা ভাইঝি নারায়ণীর সন্তানসম্ভবা হওয়ার ঘটনাতে তাকে জড়িয়ে যে কুৎসিত প্রচার শুরু হয়েছিল, অজুহাত হিসেবে তা খাড়া করে গৌড়ের সুলতানের কারাগারে তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিল নবদ্বীপের গোঁড়া বামুনেরা। সুলতানের ফাটকে গোরাকে একবার ঢোকাতে পারলে তার মৃত্যুদণ্ড যে অবধারিত এ আভাসও তারা পেয়েছিল। গোরাকে শূলে চড়াতে প্রধানমন্ত্রী সুলতানাবাদী তক্কে তক্কে রয়েছে, কানাঘুষোয় জানাজানি হয়ে গিয়েছিল এ খবর। মানুষের ভক্তি, সম্ভ্রম, ভালবাসা পেতে সন্ন্যাস নেওয়াই সেরা পথ, গোরা জানত। নবদ্বীপে স্মার্ত, ন্যায়শাস্ত্রী, শাক্ত, তান্ত্রিক পণ্ডিতদের মধ্যে সাধুপুরুষ অনেক থাকলেও তারা সবাই ছিল গৃহী, সংসারী মানুষ, সন্ন্যাস নেওয়ার মতো বুকের পাটা কারও ছিল না। সন্ন্যাস নিয়ে গোরা প্রমাণ করল, নবদ্বীপের আত্মাভিমানী পণ্ডিত বামুনদের থেকে সে আলাদা। কৃষ্ণপ্রেমে আত্মহারা হলেও চোখ কান খোলা রেখে সে বড় হয়েছে। মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে সে বাঁচতে চায়। সন্ন্যাসমন্ত্র গ্রহণের পরে বৃন্দাবনে যাওয়ার নাম করে সঙ্গীদের নিয়ে গোরা কলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির বাড়িতে এসে উঠেছিল। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে থেকে এ সাক্ষাৎকার ঠিক করে রাখা হয়েছিল। তখন প্রায় মাঝরাত তবু বিদ্যাবাচস্পতির বাড়ির ভেতরে একটা ঘরে সেজবাতি জ্বলছিল। গোরা আর তার সঙ্গীদের জন্যে বিদ্যাবাচস্পতি অপেক্ষা করছিল। বিদ্যাবাচস্পতির বাড়িতে সেই সন্ধেতে নানা সময়ে এমন কয়েকজন অতিথি এসেছিল, সুলতানি শাসনের ঘোষিত শত্রু হিসেবে একডালার দরবার থেকে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল। গোরার পথ চেয়ে ভেতরের ঘরে সাধারণ পোশাকে বসেছিল তারা। তাদের মধ্যে ছিল সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায়, বাঁকুড়ার সামন্তভূমের রাজকুমার হামীর রায়, চন্দ্রদ্বীপের রাজপুত্র পীতাম্বর রায়, আরও কয়েকজন রাজপুরুষ, বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে পুরুষানুক্রমে নবদ্বীপের বিদ্বজ্জনসমাজের যারা পৃষ্ঠপোষক ছিল। গৌড় থেকে সুলতানি শাসন উৎখাত করতে গোপনে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছিল তারা। নবদ্বীপের কৃষ্ণাবতার গোরার আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্ব আর সাহসের বিবরণ মানুষের মুখে মুখে তাদের কানে পৌঁছনোর পরে কুলগুরু বিদ্যাবাচস্পতির সঙ্গে আলাদাভাবে তারা যোগাযোগ করেছিল। প্রেমভক্তিতে গোরার ভাবাবেশ আর সঙ্গীদের নিয়ে সঙ্কীর্তনে নবদ্বীপে গণজাগরণ ঘটে গেছে, সমাজের সব স্তরের মানুষ ভালবাসার জোয়ারে ভাসছে, বিদ্যাবাচস্পতির মুখে এ খবর পেয়ে বিভিন্ন সময়ে এই তিন অতিথি ছদ্মবেশে নবদ্বীপে গিয়ে দেখে এসেছিল বিশাল শরীর, অনন্যসুন্দর একজন মানুষের জনমোহিনী শক্তি। গোরার মধ্যে গৌড়ের ভবিষ্যতের অধিপতিকে তারা খুঁজে পেয়েছিল। গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার সঙ্কল্প আগেভাগে বিদ্যাবাচস্পতির কাছ থেকে জেনে, তারই গোপন নির্দেশে তারা ঝড়ের গতিতে কলিয়ায় বাচস্পতির বাড়িতে ছুটে এসেছিল। সন্ন্যাস নেওয়ার পরে সে রাতে বিদ্যাবাচস্পতির ঘরে গোরা আসবে, সুশ্রুত ছাড়া কেউ জানত না। পুরো ছকটা ছিল বাচস্পতির তৈরি। বাচস্পতি জানত, গৌড়ের সিংহাসন দেখিয়ে নবদ্বীপে গোরাকে আটকে রাখা যাবে না। নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কুলিয়া, কাটোয়া, কলিয়ায় তার যেমন অসংখ্য ভক্ত, অনুরাগী আছে, শত্রুও কম নেই। সবচেয়ে বড় শত্রু গৌড়ের সুলতানি দরবার। গোরাকে নিকেশ করতে তারা নবদ্বীপে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে পারে। রক্তারক্তির মধ্যে থাকার মানুষ গোরা নয়। গয়া থেকে ফিরে তার বাড়িতে এসে গোরা তদ্‌গত হয়ে একাধিকবার গোটা ভাগবতের পাঠ নিয়েছিল। যতবার পড়েছে, চোখের জলে ভেসে গেছে তার মুখ, চিবুক, গলা। সঙ্কীর্তনের আসরে নেচে, গেয়ে ভাবাবিষ্ট হয়ে নবদ্বীপে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন, দু’জন করে হরিদাসের মতো যবন, শ্রীধর, ষষ্ঠীপদ, নকুড়ের মতো নবশাক, ম্লেচ্ছ, শূদ্রকে জায়গা করে দিয়ে প্রেমভক্তির ঝড় তুলে সে যখন ধর্ম, জাত, পাত নিরপেক্ষ নতুন এক সমাজের ভিত গড়ে তুলছিল, যা ধর্মীয় কর্মসূচির সঙ্গে খাপ খায় না। গৌড়ের মসনদের দিকে নজর রেখে রাঢ়, সুক্ষ্ম, সমতট, বঙ্গালের জঙ্গলে, দুর্গম গুহায় যারা অস্ত্র জোগাড় করে, সেনাবাহিনী গড়ে বড় এক যুদ্ধের প্রস্তুতি চালাচ্ছে, তার কিছু কিছু খবর বিদ্যাবাচস্পতির কানে এসে পৌঁছনোর সঙ্গে গোরাও জানছিল, মুখ ফুটে কাউকে বলেনি। গোরাকে ভাগবত পড়ানোর সঙ্গে সে বিবরণ অল্পস্বল্প বিদ্যাবাচস্পতি শোনাত। সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায় যে সেই কাহিনীর একাংশের প্রধান সেনাপতি, এ তথ্যও গোরা জেনেছিল। সুশ্রুতের পাশে গোপনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সামন্তভূমির রাজা শঙ্খ রায়ের ছেলে হামীর রায়, আবার হামীরের যোগাযোগে চন্দ্রদ্বীপের রাজকুমার পীতাম্বর রায় এসে সুশ্রুতের পাশে দাঁড়িয়েছে এরকম নানা গুহ্য সংবাদ, বাচস্পতির কাছ থেকে গোরা পাচ্ছিল। বিদ্যাবাচস্পতি যেদিন বলল, এই সেনাধ্যক্ষরা নানা সময়ে আলাদা ভাবে তার কাছে এসে নবদ্বীপের গোরাকে শুধু সমর্থন করেনি, সশ্রদ্ধ প্রণতি জানিয়ে গেছে, গোরার মনে হয়েছিল, মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পটভূমি তৈরি হচ্ছে। কুরুপাণ্ডবরা নানা নামে, পোশাকে যুদ্ধের মাঠে এসে হাজিরে হচ্ছে। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের সারথি ছিল স্বয়ং কৃষ্ণ। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় অর্জুনের রথের সারথি হলে ও আঠারোদিনের যুদ্ধে কৃষ্ণ কখনও হাতে অস্ত্র ধরেনি। গোরার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, তাকেও কি দ্বাপর যুগের কৃষ্ণের ভূমিকা নিতে কলিকালে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে? তার দাদার পুঁথিতে তেমন ইঙ্গিত বারবার সে পেয়েছে। বিদ্যাবাচস্পতির মুখে সুশ্রুত আর তার সহযোগীদের যুদ্ধপ্রস্তুতির খবর শুনে গোরা মুখে কিছু না বললেও ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্পের সঙ্গে নিজের হৃদয়ের সংযোগ খুঁজে পেয়েছিল। গোরাকে ভাগবতের ব্যাখ্যা শোনানোর ফাঁকে ফাঁকে কখনও মেঘলা দুপুরে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে, কখনও গ্রীষ্মের খররোদে গঙ্গায় ফাঁকা নৌকোর ছই-এর তলায় বসে জ্ঞানমার্গী পণ্ডিত বিদ্যাবাচস্পতি শোনাত ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে শুধু একদল তরুণ যুদ্ধবিশারদ রাজপুরুষ নয়, একডালার সুলতানি দরবারের কয়েকজন জাতকুল হারানো উঁচুপদের রাজকর্মচারী গোপনে হাত মিলিয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষরা একসময়ে ছিল কর্ণাটকের ব্রাক্ষ্মণ রাজবংশের সন্তান, পারিবারিক ঝগড়ায় দেশ ছেড়ে গৌড়ে এসে বাস করেছিল।

বিদ্যাবাচস্পতি যে সুলতানি দরবারের দবীর খাস, সাকর মল্লিকের বংশপরিচয় জানাচ্ছে, গোরা বুঝতে পেরেও মুখ খোলেনি। সুলতান হোসেন শাহের দরবারের এই দুই মন্ত্রী, যারা দু’ভাই, তারা ইতিমধ্যে গোরার সঙ্গে চিঠি লিখে যোগাযোগ করেছে, বিদ্যাবাচস্পতি জানত না। গোরার ঘনিষ্ঠ অনুগামী নিতাই, শ্রীবাস পণ্ডিত, গদাধর, মুরারিরও এ তথ্য অজানা ছিল। গোরা যা জানত না, তা হল তাকে আর নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজকে সবচেয়ে বেশি যে আগলে রেখেছে, সে হল কালীপুজোর প্রবর্তক, ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থের লেখক কৃয়ানন্দ আগমবাগীশের সহাধ্যায়ী বন্ধু, সুলতানের বিশ্বস্ত সহচর, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির। গোরার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ একডালার দরবারের পুরনো বন্ধু জ্যোতিষার্ণবের কাছে যে পাঠিয়েছে সে এই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দের মতো শাক্তমতের সমর্থক হয়েও চারুমিহির কেন হাত গুটিয়ে বসে থাকল, আর কেউ না জানলেও তার শিক্ষাগুরু বিদ্যাবাচস্পতি জানত। আড়াইশ’ বছর ধরে রাজ্যের মসনদ নিয়ে গৌড়ে যে রক্তগঙ্গা বয়ে চলেছে, চারুমিহির তা বরদাস্ত করতে পারছিল না। সে চাইছিল এমন একজন গৌড়ের সিংহাসনে বসুক, যে মসনদের দখল নিয়ে খুনোখুনি বন্ধ করবে এবং গৌড়ের সেই নয়া শাসক তার মুঠোয় থাকবে। কৃষ্ণপ্রেমে পাগল গোরার বিবরণ শুনে তাকে পছন্দ হয়েছিল চারুমিহিরের। গোরাকে বিদ্যাবাচস্পতি বলেছিল, গৌড়ের সিংহাসনে তোমাকে বসাতে চারুমিহির দিন গুনছে।

বিদ্যাবাচস্পতির কথা শুনে গোরার মাথা ঘুরে যায়নি। সে ডুবে ছিল প্রেমভক্তিতে, কৃষ্ণনাম সঙ্কীর্তনে, জনসমাজের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার নিবিড় আবেশে। তবে সে এই প্রথম জানল, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের স্নেহভাজন সে। গৌড়ে ধর্মরাজ্য কায়েম করার চিন্তা চারুমিহিরের মাথাতেও ঘুরছে। প্রেমভক্তি বিলিয়ে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে তার আসার যে বৃত্তান্ত বিশ্বরূপের পুঁথি থেকে গোরা জেনেছিল, সেখানে অবিচল ছিল সে। রক্তে ভেজা পথ মাড়িয়ে ধর্মরাজ্যের অধিপতি হতে সে চায় না। সে দায় নিতে পারে নিতাই। গৌড়ের মসনদ দখলের যুদ্ধকে ভ্রূক্ষেপ না করে জনসমাজকে প্রেমভক্তিতে ভাসিয়ে, আদর্শ মানুষ হিসেবে তাদের সামনে রেখে ধর্মরাজ্য চালানোর ঠিকা শুধু নিতাই নিতে পারে। নিতাইও কম ওজনদার মানুষ নয়, করুণার সমুদ্র সে, তেমনি প্রখর তার ন্যায়ধর্ম। সন্ন্যাস নিয়ে গোরা পুরুষোত্তমপুরে চলে গেলেও নিতাই গৌড়ে থেকে যাবে। প্রেমভক্তি প্রচার করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় সে এমন এক সেনাপতি হবে যার মূল মন্ত্র হবে শান্তি, যাকে সুশ্রুত রায়, হামীর রায়, পীতাম্বর রায়ের মতো মহাযোদ্ধারা গৌড়ের অধিপতি হিসেবে মেনে নেবে।

কলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির বাড়িতে গভীর রাতে তিন রাজপুরুষের সামনে অল্প কথায় গোরা বুঝিয়ে দিয়েছিল, কৃষ্ণপ্রেমে সে সন্ন্যাস নিলেও মা, বউ, নিজের সংসার আর হতদরিদ্র, অপমানিত দেশবাসীকে ভুলে থাকার সাধ্য তার নই। প্রেমভক্তি প্রসারের সঙ্গে সে এমন কিছু কাজ করবে, যা কুরুক্ষেত্রের মঞ্চের মতো গৌড়ের মাটিতে কোটি কোটি মানুষকে হাজির করে দেবে। বিদ্যাবাচস্পতিকে মুখপাত্র খাড়া করে তার তিন অতিথি যে রণকৌশল গোরার-সামনে হাজির করল, তাকে এক কথায় যুদ্ধবিরতি, শান্তির কর্মসূচি ছাড়া আলাদা কিছু ভাবার উপায় ছিল না। তাদের তরফে বিদ্যাবাচস্পতি সেই রাতে গোরাকে অনুরোধ করেছিল, পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছে সে যেন উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে বিজনয়গরের অধিপতি কৃষ্ণদেব রায়ের সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়। উৎকল আর বিজয়নগর রাজ্যের মধ্যে থেকে থেকে যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে যাচ্ছে, তা ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। দুই রাজ্যের দুই বীর রাজা যে মহাযুদ্ধে এই মুহূর্তে জড়িয়ে পড়েছে, সেখান থেকে ফিরে এসে বৈরিতা ভুলে তারা সন্ধি করলে সারা দেশের মানুষের কাছে, মিলনমঞ্চ গড়ে তোলার ডাক পৌঁছে যাবে, তাকে কেউ দমাতে পারবে না। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার হবে। কঠিন এই দায়িত্ব গোরাই পারে উতরে দিতে। বিদ্যাবাচস্পতির অনুরোধ গোরা মেনে নিতে তার সদ্যপরিচিত রাজপুরুষদের মুখ চোখে খুশি উপচে পড়েছিল। উৎকল আর বিজয়নগরের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতু তৈরির কাজের সঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ একটা যোগাযোগ গড়ে তুলতে গোরাকে উদ্যোগ নিতে বলেছিল বিদ্যাবাচস্পতি। দুই রাজ্যের অধিপতিদের শান্তিচুক্তির সঙ্গে দেশবাসীর মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে না উঠলে মহৎ কোনও পরিকল্পনা সফল হয় না। ভালবাসার সুতোয় দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বেঁধে ধর্মরাজ্য কায়েম করতে হলে তাদের যারা পথপ্রদর্শক, সেই মানুষগুলোর কাছে গোরাকে পৌঁছতে হবে। তারাও গোরার মতো উঁচু মাপের মানুষ। তাদের নাম কয়েকবছর আগে ঈশ্বরপুরীর কাছ থেকে গোরা শুনেছিল। বিদ্যাবাচস্পতি সেই নামগুলো গোরাকে ফের শুনিয়ে দিল। দক্ষিণ ভারতের ভক্তিবাদী সাধক রামানুজের ‘শ্রী’ সম্প্রদায়, তার অনুগামী কনৌজিয়া বেদান্তবিদ রামানন্দ, যে ছিল দাক্ষিণাত্য আর উত্তরের রাজ্যগুলিকে ভক্তিধর্মে মেলানোর সেতু, তাদের বিষয়ে অনেক খবর ঈশ্বরপুরীর কাছ থেকে আগেই ‘জেনেছিল গোরা। নিতাই-এর কাছ থেকেও পরে পেয়েছিল শ্রী সম্প্রদায়ের ভক্তিবাদী সাধনার নানা খবর। ধর্মের মধ্যে যদি ‘শ্রী ‘সৌন্দর্য’ না থাকে, তাহলে তা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছয় না।, ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত নির্বিশেষে সব মানুষের বুকের মধ্যে যে শ্রী’ সুপ্ত আছে, তাকে ঈশ্বরের মর্যাদা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল রামানুজ। নিজের অনুগামী শিষ্যদের বলত, তোমরা ঈশ্বরের মতো সুন্দর, ঈশ্বরকে তোমরা যখন খুঁজে বেড়াও, তখন তোমার পাশেই ঈশ্বর থাকে। সত্যিকারের কৃষ্ণভক্ত তাকে দেখতে পায়। শ্রী শব্দের ব্যাখ্যা অনুগামীদের বোঝাতে রামানন্দ বলত, শ্রী শব্দের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে সত্য, শিব, সুন্দরের প্রশস্তি। যা সত্য, তা-ই শিব, অর্থাৎ নিষ্পাপ প্রশান্তি এবং সুন্দর, সৌন্দর্যের আলোকিত প্রবাহ। প্রাণিজগৎ, প্রকৃতি, বিশ্বচরাচর, অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে রয়েছে সেই আলোর প্রবাহ, তাই তারা শ্রীমণ্ডিত।

রামানুজের শিষ্য রামানন্দ আর তার অনুগামীরা উত্তর ভারতে ভক্তিধর্ম প্রচারে যে প্লাবন আনল, সেই স্রোতে একেশ্বরবাদী, প্রেমময় কৃষ্ণবিশ্বাসী তেলেগু ব্রাক্ষ্মণ, বল্লভাচার্য জন্মভূমি ছেড়ে প্রথমে বারাণসী, তারপর বৃন্দাবনে শ্রীনাথ মন্দিরে এসে ভক্তিধর্মের শিবির বানাল। কয়েক বছর আগে গয়াযাত্রী গোরাকে বল্লভাচার্যের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিয়েছিল ঈশ্বরপুরী। গৌড়বাসীর নামের সঙ্গে ‘শ্রী’ যোগ করার ইচ্ছেটা তখনই গোরার মাথাতে গেঁথে গিয়েছিল। সে ইচ্ছে অনেকটাই মিটেছে। নবদ্বীপের মানুষ কাটোয়ার খণ্ডগ্রামকে এখন ‘শ্রীখণ্ড’ বলে, বেলকে বলে ‘শ্রীফল’, স্ত্রী-পুরুষের নামের আগে ‘শ্রীমতী’ ‘শ্রী’ বলা শুরু হয়েছে। বৃন্দাবনবাসী রামানন্দের শিষ্য, বল্লভাচার্যের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে গোরার মাথায় ঈশ্বরপুরী ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বিদ্যাবাচস্পতি সেই মানুষটার সঙ্গে গোরার যোগাযোগ করার অনুরোধ করতে সে তখনই রাজি হয়ে গেল। বল্লভাচার্যের নাম বলে বিদ্যাবাচস্পতি থামল না। ভক্ত কবীর, দাদুদয়াল, নানক এমনকি পশ্চিমে প্রয়াত নামদেব, জীবিত তুকারাম, যাদের অসংখ্য অনুগামী রয়েছে, যাদের ঘিরে এক ডাকে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের জমায়েত হয়, তাদের সঙ্গে গোরার দেখা করার পরামর্শ দিল বিদ্যাবাচস্পতি। বলল, সেনাবাহিনীর চেয়ে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় এই মহাপুরুষদের ডাক অনেক বড় ভূমিকা নেবে। গোরা জানাল, এই সব মহাপুরুষদের দেখা পেতে সে লালায়িত হয়ে আছে। গোরার ভাবাবিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে বিদ্যাবাচস্পতি বলেছিল, আমি জানি, তুমি ইচ্ছাময়, আবার তুমি-ই ইচ্ছাপূরক, তুমি যা চাইছ, তা ঘটবে।

বিশ্বরূপের লেখা পুঁথির বিষয়টা বিদ্যাবাচস্পতির জানা না থাকলেও সে বলেছিল, বিশ্বরূপকে তুমি খুঁজে পাবে, বৃন্দাবনবাসী সাধক বল্লভাচার্যের অনুগত, বিজয়নগররাজ কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তোমার দেখা হবে। তোমার পায়ে পুজোর অর্ঘ্য দিয়ে রাজা বরণ করে নেবে তোমাকে। রাজা কৃষ্ণদেব শুধু বিজয়নগরের অধিপতি নয়, হৃদয়বান পণ্ডিত মানুষ। রাজ্যশাসন, প্রজাপালন নিয়ে তার লেখা পুঁথি এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে সেরা গ্রন্থ। দেশের সব রাজা যদি এই গ্রন্থ মেনে চলত, তাহলে প্রজাদের এত দুর্গতি ঘটত না। মানুষের অশেষ কল্যাণ হত।

সাতবছর আগে শ্রীহট্টে তপন মিশ্রের বাড়িতে বসে তার কাছ থেকে এই পুঁথির বিবরণ গোরা শুনেছিল। কৃষ্ণদেবের লেখা পুঁথির নাম তপন শুনেছিল সন্ন্যাসী শঙ্করারণ্যের কাছ থেকে, পূর্বাশ্রমে যে ছিল গোরার দাদা বিশ্বরূপ। পুঁথিটা হাতে পেতে গোরা তখনই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তার চেয়ে বেশি আশ্বস্ত হয়েছিল দাদার খবর পেয়ে। দাদাকে খুঁজে বার করার নতুন উদ্যম পেয়েছিল। মাঝরাতে এক ঝাঁক রাজপুরুষের সঙ্গে নবদ্বীপের রত্ন গোরাকে পেয়ে বিদ্যাবাচস্পতি শোনাচ্ছিল দাক্ষিণাত্যের দুই রাজপরিবারের যুদ্ধ, সংঘর্ষ, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার কাহিনী। উৎকলরাজ্যের সঙ্গে কয়েক পুরুষ ধরে বিজয়নগরের রাজ্যের যুদ্ধ চললেও দুই রাজবংশের মধ্যে বিয়ের সুবাদে আত্মীয়তা রয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা দুটো পরিবারে নানা সময়ে বধূ, জামাই সম্পর্কে ঢুকে পড়ে প্রভূত আদর পেয়েছে। সে ধারা আজও বজায় রয়েছে। পরের প্রজন্মের সন্তানসন্ততিরা দুই রাজপরিবারের বংশধারায় মিশে যাওয়ার পরেও তাদের মধ্যে যুদ্ধ, সংঘর্ষ থামেনি। গৌড়ের সুলতানের পুরুষোত্তমপুর অভিযানের পরে হয়তো দু’পক্ষের চোখ খুলবে। গৌড়ের সুলতানি সেনা উৎকল দখল করে নিলে বিজয়নগর শান্তিতে থাকতে পারবে না। রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের রাজ্য অস্থির হয়ে উঠতে পারে। সেই অঘটনের আগে দু’রাজ্য বন্ধুত্বের হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়ালে প্রেমভক্তি প্রতিষ্ঠার নতুন দরজা খুলে যাবে। গোরার মতো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী এই মহান কাজে মধ্যস্থের ভূমিকা নিলে তার মাথাতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ঝরে পড়বে।

বিদ্যাবাচস্পতি আর তার তিন অতিথির আলাপ শুনে গোরা বুঝেছিল পুরুষোত্তমপুরে সর্বজনশ্রদ্ধেয় পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমও দুই রাজ্যের মধ্যে সখ্য গড়ে তুলতে গভীরভাবে আগ্রহী। বাসুদেবের ধারণা দুই রাজপরিবারের ভেতরকার অহমিকা থেকে তাদের যতরকম বৈরিতা, মনোমালিন্যের জন্ম। বিজয়নগর রাজ্যের দুর্দিনে, সেই রাজ্য আক্রমণ করে অবাধ লুঠতরাজ চালিয়েছিল উৎকলরাজ কপিলেন্দ্রদেব, যার আর এক নাম ভ্রমর। তার ছেলে রাজা পুরুষোত্তমদেবও একাধিকবার বিজয়নগরের বিত্তসম্পদ লুঠের সঙ্গে সেই রাজ্যের ইষ্টদেবতা, সাক্ষিগোপালের মূর্তি, রত্নাসনসমেত তুলে এনেছিল। কটকে সাক্ষিগোপাল মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হলেও তার রত্নাসনে বসানো হয়েছিল পুরুষোত্তমপুরের জগন্নাথ মূর্তিকে। রত্নাসনসমের ইষ্টদেবতা সাক্ষিগোপালের মূর্তি উদ্ধারের শপথ করেছিল বিজয়নগর রাজ্যে নতুন প্রজন্মের পরাক্রান্ত অধীশ্বর রাজা কৃষ্ণদেব রায়। সাক্ষিগোপালের রত্নাসনে পুরুষোত্তমপুরের জগন্নাথবিগ্রহ বসানো হয়েছে জেনে কৃদেব হকচকিয়ে গিয়েছিল। সে নিজে জগন্নাথদেবের ভক্ত। আরাধ্য দেবতার আসন কেড়ে আনার চিন্তা করতে ভয় পায়। পুরুষোত্তমপুরের দেবতাকে বিজয়নগরের কুলদেবতা সাক্ষিগোপালের রত্নাসনটি অর্ঘ্য হিসেবে দিয়ে শুধু বিজয়নগরের ইষ্টদেবতা সাক্ষিগোপালকে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক দৌত্যে রাজসভার মন্ত্রী, অমাত্যদের সায় আছে কিনা, কৃষ্ণদেব জানতে চেষ্টা করেছিল। রাজসভার পারিষদেরা কৃষ্ণদেবের সাধু উদ্দেশ্য মুখে মেনে নিলেও রাজ্যের প্রজারা, বিশেষ করে ব্রাত্মণসম্প্রদায় কতটা খুশি হবে, এ বিষয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। বিজয়নগরের মানুষের মানমর্যাদার প্রশ্ন তুলে শাস্ত্রবচন আওড়ে তারা রাজাকে কিছুটা দ্বিধায় ফেলে দিল।

দুই রাজ্যের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে বিজয়নগর রাজসভার পণ্ডিত চক্রপাণির সূত্রে সাক্ষিগোপাল মূর্তি উদ্ধার নিয়ে রাজসভায় আলোচনার সারাংশ পৌঁছেছিল পুরুষোত্তমপুরে প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের কানে। দুই রাজ্যের দু’জন বৈদান্তিক সভাপণ্ডিতের মধ্যে শুধু যোগাযোগ নয়, যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। দু’জনেই চাইছিল যুদ্ধের শেষ হোক। বিজয়নগর রাজ্যের সম্মান বাঁচাতে বাসুদেব সার্বভৌম পরামর্শ দিয়েছিল, সাক্ষিগোপালের আর এক রূপ বালগোপালের যে মূর্তি উৎকলের উদয়গিরি মন্দিরে রয়েছে, সেই মূর্তিকে রাজা কৃষ্ণদেব অনায়াসে বিজয়নগরের নিয়ে গিয়ে সাক্ষিগোপালের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। উৎকল রাজ্যের নেলোর জেলার উদয়গিরি দুর্গ আক্রমণ করে কৃষ্ণদেব তখন অবরোধ করে রেখেছিল। যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পিছু হটে গিয়েছিল উৎকল সেনারা। বালগোপাল মূর্তি সরিয়ে নিতে রাজা কৃষ্ণদেবের কোনও অসুবিধে ছিল না। রাজা প্রতাপরুদ্র সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে বিজয়নগর অধিপতির কাছে দূত পাঠিয়েছিল। রাজসভার পরামর্শে উৎকলরাজের সন্ধির আবেদন শর্তসাপেক্ষে রাজা কৃষ্ণদেব মেনে নিতে রাজি হল। কড়া কোনও শর্ত নয়। বালগোপালের মূর্তির সঙ্গে বিজয়নগর থেকে উৎকলরাজ পুরুষোত্তমের লুঠ করে নিয়ে যাওয়া রত্নাসনসমেত বিজয়নগরের ইষ্টদেবতা সাক্ষিগোপাল মূর্তি ফেরত দিতে হবে উৎকল অধিপতিকে। উৎকলের রাজধানী, কটকে প্রতাপরুদ্রের বাবা, রাজা পুরুষোত্তমের সাক্ষিগোপাল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পঁচিশ বছর ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। রাজধানী কটকের জনপ্রিয় দেবতা হিসেবে ভক্তজনের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছে বিজয়নগরের দেববিগ্রহ। দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে নিজের হাতে সেই মূর্তি উচ্ছেদ করে বিজয়ী রাজার হাতে তুলে দেওয়ার মতো মহাপাপ করতে রাজা প্রতাপরুদ্র রাজি ছিল না। রাজা কৃষ্ণদেবকে তার দখল করা নেলোর জেলা ছেড়ে দিল। জেলার মধ্যে উদয়গিরিকে বালগোপাল মূর্তির অধিকার, বলা যায়, পরোক্ষে প্রতিবেশী রাজ্যের কাছে কবুল করার সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে রাজা পুরুষোত্তমের লুঠ করে আনা রত্নাসনের সমান মূল্যের একটা আসন, বিগ্রহের জন্যে বিজয়নগরে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতাপরুদ্র শান্তিচুক্তি করেছিল।

বিদ্যাবাচস্পতির স্মৃতির ঝুলিতে এরকম অনেক পুরনো কাহিনীর সঙ্গে যা কখনও পুরনো হয় না, সেই চলমান অতীতের গর্ভ থেকে উঠে আসা সাম্প্রতিক ঘটনা কম নেই। সাম্প্রতিকের গুরুত্ব বোঝাতে অতীতের কাহিনী ফেঁদে ফের ঘটমান বর্তমানে ফিরে এল। বিদ্যাবাচস্পতি বলল, দুই রাজ্য শর্ত মেনে বিগ্রহ বদল করে শান্তিচুক্তি করলেও তা বেশিদিন বজায় থাকেনি। বিজয়নগরে পাঠানো উৎকলরাজের রত্নসিংহাসন দেখে নাক সিঁটকেছিল রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের রাজসভার প্রতিপত্তিশালী পারিষদরা। উৎকল রাজ্যের বিরুদ্ধে আরও একটা যুদ্ধ শুরু করতে কৃষ্ণদেবকে উসকে দিয়েছিল। তিন পুরুষ ধরে উৎকলের গজপতি রাজবংশের রাজারা বিজয়নগর রাজ্যে অভিযান চালিয়ে যেভাবে ছারখার করেছে, কিছুদিনের মধ্যে আরও একবার সম্ভবত সেটা ঘটতে চলেছে। উৎকল রাজ্যের দক্ষিণ অংশ, কৃস্নানদীর দু’ধারের সব দুর্গ দখল করে কৌণ্ডবীড়ু দণ্ডপাট পর্যন্ত, বিজয়নগর রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে নিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছে কৃষ্ণদেব। গৌড়ের সেনাবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে ব্যস্ত রাজা প্রতাপরুদ্রের পক্ষে কৃষ্ণদেবের অভিযান থামানো সম্ভব নয়। উৎকল রাজ্য পাঁকে পড়লে গৌড়ের মানুষও বিপন্ন হবে, এ নিয়ে বিদ্যাবাচস্পতির সন্দেহ নেই। পুরুষোত্তমপুর থেকে তারা দাদা, বাসুদেব সার্বভৌমও একই উদ্বেগজড়ানো চিঠি লিখে জানিয়েছে, দু’দেশের মধে শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো উপযুক্ত একজন মধ্যস্থ মিললে সর্বনেশে এই যুদ্ধ থেকে হতভাগ্য প্রজারা রেহাই পেত। খেয়ে, পরে শান্তিতে বাঁচার মতো উপকরণ না পেলেও উলুখাগড়ার মতো তাদের মরতে হত না।

পুরুষোত্তমপুরে গোরা পৌঁছলে সে হয়তো এই মধ্যস্থের ভূমিকা নিতে পারবে। দেশের মানুষ এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস করে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীকে। ভগবানের পরে সন্ন্যাসীর আসন। গোরা আবার শুধু সন্ন্যাসী নয়, সে কৃয়াবতার। প্রেমভক্তির প্রবাহে দুই যুযুধান রাজাকে ভাসিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে পাকাপোক্ত আপনজনের সম্পর্ক সে গড়ে তুলতে পারবে। সহযোগী দুই রাজার পক্ষে গৌড়, রাঢ়ের সশস্ত্র বিদ্রোহীরা এই যৌথবাহিনী গড়ে ওঠার অপেক্ষায় দিন গুনছে। গোরাই যে একাজে যোগ্যতম ব্যক্তি, এ নিয়ে বিদ্যাবাচস্পতির সন্দেহ না থাকলেও সে মুখ খুলল না। গোরাকে সে শুধু জানালো, তার পুরুষোত্তমপুরে যাওয়ার খবর গোপীনাথের কাছ থেকে সার্বভৌম পেয়ে গেছে। পুরুষোত্তমপুরে গোরা আর তার সঙ্গীদের থাকার ব্যবস্থা করে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে সার্বভৌম। ফৌজ নিয়ে গৌড়ের সুলতান আসছে জেনে পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে সম্পন্ন মানুষরা পালাতে শুরু করেছে। ভিটে ছেড়ে হতদরিদ্রদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তারা ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকলেও শহরমুখো হচ্ছে না। পুরুষোত্তমপুরের হাটবাজার প্রায় খালি, বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। মাছ ধরা যাদের পেশা, শুধু তাদের কয়েকটা নৌকো দূর সমুদ্রে স্থির বিন্দুর মতো জেগে রয়েছে। মন্দিরে জগন্নাথসেবার পুরো অধিকার কব্জা করে নিয়েছে গোবিন্দ ভোই-এর অনুগত রাজকর্মচারীরা, যাদের ‘পরিছা’ বলা হয়।

বিদ্যাবাচস্পতির কাছ থেকে এত খবর জেনে সঙ্গীদের নিয়ে গোরা পুরুষোত্তমপুরে রওনা হয়নি। কমলপুর থেকে পুরুষোত্তমপুরে আসার পথে গোপীনাথের মুখ থেকে শুনল নগরের দুর্দশার বিবরণ, পুরুষোত্তমপুর থেকে তিন ক্রোশ দূরে কমলপুরে ঢোকার সদর রাস্তার ওপর, গোপীনাথ প্রায় এক সপ্তাহ একজন সঙ্গী নিয়ে গোরার অপেক্ষায় বসে রয়েছে। বিদ্যাবাচস্পতির চিঠি থেকে পুরুষোত্তমপুরে গোরার পৌঁছনোর নির্ধারিত তারিখ জানার উপায় না থাকলেও বাসুদেব সার্বভৌম আন্দাজ মতো এক বিশ্বাসী ছাত্রের সঙ্গে ভগ্নিপতি গোপীনাথকে কমলপুর পাঠিয়ে দিয়েছিল। পুরুষোত্তমপুরের ওপর দিয়ে ইতিমধ্যে অত্যাচার, লুণ্ঠনের ঝড় বয়ে গেছে, পথঘাটে ঘাপটি মেরে রয়েছে খুনে, ডাকাত, লুঠেরা। জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদরজা অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ, চিলকার দ্বীপে সরিয়ে ফেলা হয়েছে জগন্নাথ বিগ্রহ, এ খবর গোরার জানার কথা নয়। কৃষ্ণপ্রেমে পাগল নবদ্বীপের সেই ভক্ত যদি নগরে ঢুকে গোড়াতে জগন্নাথ বিগ্রহ দর্শনে মন্দিরে চলে যায়, তার বিপদ হতে পারে। গোরাকে নিরাপদে নিজের আশ্রয়ে আনতে সার্বভৌম তাই সতর্ক। নবদ্বীপ থেকে পুরুষোত্তমপুরে নিয়মিত নিজের পরিবারের যারা আসে, তাদের মুখ থেকে গোরা সম্পর্ক অনেক খবর সার্বভৌম পেয়েছিল। তার প্রিয় নবদ্বীপ শহরের মানুষ যে গোরাকে কৃষ্ণের অবতার ভেবে নিয়ে ভক্তিতে মাতোয়ারা, এ তথ্যও গৌড় থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে তার কানে পৌঁছচ্ছিল। ছোটভাই, বিদ্যাবাচস্পতির প্রায় সব চিঠিতে গোরাকে নিয়ে দু’চার পংক্তি উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি পড়ে মানুষটা সম্পর্কে বৈদান্তিক পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের মনে যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল, তার পুরোটা তাচ্ছিল্য করার মতো নয়। কৃষ্ণকে নিয়ে গোরার মাতামাতি, তাকে ভক্তি অথবা খ্যাপামো, যাই বলা হোক, গৌড়ের মানুষের জীবনে নতুন আবেগ জাগিয়েছে, সুদূর পুরুষোত্তমপুরে বিদ্যাচর্চায় ব্যস্ত সার্বভৌম তা অনুভব করেছিল। গোরাকে স্বাগত জানাতে তৈরি ছিল সে। গোরার থাকার ব্যবস্থা করেছিল নিজের মাসির বাড়িতে। নবদ্বীপ থেকে পুরুষোত্তমপুরে হাঁটা পথে কেউ একা আসে না। গোরার সঙ্গে কয়েকজন সমবয়সী আত্মীয়, বন্ধু থাকবে, আন্দাজ করে নিয়ে অতিথি একজনের বেশি, মাসিকে বলে রেখেছিল। পুরুষোত্তমপুরে গোরার আতিথ্য ভিক্ষার নিখুঁত আয়োজন সার্বভৌম করে রাখলেও সে আসার আগে থেকে কয়েকদিন ধরে একাধিকবার ভগ্নিপতি গোপীনাথের মুখে ‘গোরা, স্বয়ং ভগবান’ কথাটা শুনে বিরক্ত সার্বভৌম বলেছিল, তোমাদের গোরা যে ভগবান কীভাবে জানা গেল?

ভগবানের সব লক্ষণ তার মধ্যে আছে।

যেমন?

তিনি নিজের হাতের মাপে চার হাত লম্বা।

শুধু এই প্ৰমাণ?

তা কেন, ভাগবতে ‘ত্বিষাকৃ’ শব্দের ব্যাখ্যায় ‘হেমাঙ্গ’ সোনার মতো গায়ের রং একজন অবতারের কথা বলা হয়েছে। মুণ্ডকোপনিষদে ‘রুক্মবর্ণ’ ব্রষ্মযোনি, স্বর্ণবর্ণ যে পুরুষের বিবরণ রয়েছে, ভগবানের মতো যে ক্ষমতাবান, তার সঙ্গে গোরার কোনও অমিল নেই। তার হাতে, পায়ে ধ্বজ, বজ্র, শঙ্খ, চক্র, মীন আঁকা রয়েছে। সাধারণ মানুষের শরীরের এসব লক্ষণ থাকে না। চার হাত লম্বা মানুষও নিজের হাতের মাপে সাড়ে তিন হাতের বেশি হয় না। অথচ গোরা তাই। তার চেয়ে বেশি। শরীরের দু’পাশে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালে তার বাঁ হাতের মধ্য আঙুলের ডগা থেকে ডান হাতের মধ্যমার ডগা পর্যন্ত মাপলেও হয় চার হাত। তার মানে, আড়ে বহরে গোরার মাপ চার হাত। ন্যায়শাস্ত্রী সার্বভৌমের এসব যুক্তি অজানা নয়। মানুষের ওপর ঈশ্বরত্ব আরোপের অনুমানভিত্তিক আলোচনার কানাকড়ি দাম দিতে সে রাজি নয়। বলল, শুধু অনুমানে ঈশ্বরের স্বরূপ বোঝা যায় না।

গোপীনাথ বলল, ঠিক তাই। ঈশ্বরের কৃপা না পেলে ঈশ্বরকে চেনা যায় না।

সেই কৃপা তুমি পেয়েছ?

বড় কুটুমের প্রশ্নে সামান্য থতমত খেয়ে গোপীনাথ বলল, ভট্টাচার্য, তুমি বিরাট পণ্ডিত! তোমার সঙ্গে তর্কে আমি পারব না। আশা করি, তোমার তাড়াতাড়ি ভগবান দর্শন হোক!

কুলীন ভগ্নিপত্নিকে খুশি করতে তর্কের চাপানউতোর থেকে বেরিয়ে এসে স্নেহজড়ানো গলায় সার্বভৌম বলল, তোমার নবদ্বীপের গোরা যে পরমভাগবত, কৃষ্ণভক্ত আমি জানি, নবদ্বীপ থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের মুখ থেকে তাকে নিয়ে অনেক কাহিনী শুনেছি। সে বড় মাপের শুদ্ধ মানুষ আমার সন্দেহ নেই। তাকে দেখার আগ্রহ আমার কম নয়।

ত্রিদিবনাথ স্তব্ধ হয়ে শুনছে তার তৈরি মেগাসিরিয়ালের পঞ্চাশটা এপিসোডের কাহিনীতে যত অনুক্ত প্রসঙ্গ, ফাঁক রয়েছে, পাঁচশ’ বছর আগের ইতিহাসের ঘটনাবলী, বিশেষ করে সেইসময়, তখনকার জনজীবনকে সেখানে স্থাপন করে তার বাইশ বছরের ভাইপো গড়ে তুলছে এক বিকল্প ভরাট আখ্যান। আধুনিক, যুক্তিসিদ্ধ সেই আখ্যানকে এক কথায় ছেঁটে ফেলা যায় না।

সেজকাকার মুখে দিকে তাকিয়ে গোরা প্রশ্ন করল, আমি কি আবোল তাবোল বকছি?

গোরার কাঁধে হাত রেখে ত্রিদিবনাথ বলল, তুই একুশ শতকের ছেলে, অনেক বেশি মেধা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিস। তোর এই কাকা এসেছিল গত শতকের মাঝামাঝি। তার থেকে তুই যে কয়েক কদম এগিয়ে আরও খোলা চোখে ইতিহাসকে দেখতে পাবি, এটাই স্বাভাবিক। পাঁচশ’ বছর আগের গোরাকে তার সর্বস্ব জুড়ে তুই যেভাবে দেখছিস, তা বুঝতে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। মেগাসিরিয়ালের বাকি আখ্যান তোর মুখ থেকে আমি শুনতে চাই। সেভাবে পরের এপিসোডগুলো সাজিয়ে আমি ক্যামেরাবন্দি করব।

গোরা হাসল, বলল, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি ভাবছিলাম, আমার এলোমেলো কথা শুনে তুমি ‘বোর’ হবে।

নাহ্, একেবারে নয়, আমার চিন্তাকে তুই খানিকটা উসকে দিলি।

সেজকাকার কাছ থেকে ভরসা পেয়ে গোরা বলল, মানুষ তো মাটির ঢেলা নয়, একমেটে মূর্তি-ও নয় সে। পাঁচশ’ বছর আগের সেই মানুষটা কৃষ্ণপ্রেমে মাঝে মাঝে বেহুঁশ হয়ে গেলেও সন্ন্যাস নেওয়ার পরে শুধু প্রেমভক্তি প্রচারের কাজে দায়বদ্ধ ছিল না। ভাবাবেশ কেটে গেলে সে দেখতে পেত অনাচারে ভরে গেছে চারপাশ। ধর্ম, জাতপাতের পাঁকে পড়ে বেশিরভাগ মানুষ গুমরোচ্ছে, দুর্ভিক্ষ, রোগ, মহামারিতে শুকনো পাতার মতো ঝরে যাচ্ছে হাজার লক্ষ মানুষ। মানুষ বড় কাঁদছে। এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। প্রেমভক্তি আঁকড়ে পড়ে থাকার সঙ্গে সমাজ আর মানুষের দুর্দশা নিয়েও সে ভাবত। বিধবা মা, অসহায় বউ, ছেড়ে আসা সংসারের জন্যে দুশ্চিন্তাও সবসময়ে তার মাথায় জেগে থাকত। মা, বউ-এর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করার সঙ্গে তাদের কথা ভেবে আকুল হত, কাঁদত। কৃষ্ণের জন্যে চোখের জল ফেলার সঙ্গে দেশ, সংসার ছেড়ে পালিয়ে আসার অনুতাপে মিশে থাকত তার গোপন মনের কান্না। সার্বভৌমের সঙ্গে পরিচয়ের পরের দিন তাকে গোরা বলেছিল, আমি ঠিক সন্ন্যাসী নই, কৃষ্ণপ্রেমে মাথাটা আমার খারাপ হয়ে যেতে ঘর সংসার ছেড়ে চলে এসেছি। সংসার ছেড়ে এসে এখন মনে হচ্ছে ঘরে বসেও প্রেমভক্তি প্রচার করা যায়। সার্বভৌমের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে, কমলপুরে গোপীনাথের কাছ থেকে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোরা শুনেছিল পুরুষোত্তমপুরে গৌড়ের সেনাদলের তাণ্ডব, মন্দির লুঠের বিবরণ। পুরুষোত্তমপুরের মন্দির থেকে বিগ্রহ সরিয়ে ফেলা হয়েছে, শুনে গোরা কেঁদে ফেলেছিল, ফেটে পড়েছিল বুকভাঙা হাহাকারে নিতাই, জগদানন্দরা অনেক কষ্টে সামলেছিল তাকে। চিলকার গোপন গুহা খুঁজে বিগ্রহ দেখানোর জন্যে তখনই গোপীনাথকে ধরে ঝুলোঝুলি করেছিল। তার ভাবাবেশ দেখে গোপীনাথ শুধু দিশেহারা হয়নি, ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে সুলতানি সেনারা কটকের দিকে চলে গেলেও বিধ্বস্ত শহরে গোবিন্দ বিদ্যাধরের অনুগত রাজকর্মচারী, গুপ্তচররা মন্দিরে শুধু নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করে থামেনি, শহরে কারা ঢুকছে, বেরোচ্ছে, কতরকম কী ঘটছে, সেদিকে নজর রেখেছিল। তাদের দৃষ্টি থেকে গোরার মতো বিশাল শরীর, ভাবাবিষ্ট, কৌপীনধারী অচেনা এক সন্ন্যাসীকে কিছুদিন সরিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল গোপীনাথ। সার্বভৌমের মাসি, মানে তার মাসশাশুড়ির বাড়িতে গোরা আর তার চার সঙ্গীকে রাখার ব্যবস্থা হলেও তাদের নিয়ে সে প্রথমে সার্বভৌমের বাড়িতে এল। পুরুষোত্তমপুরে তখন অন্ধকার ঘন হয়েছে। গুপ্তচরদের নজর এড়াতে কমলপুরের বাসা থেকে সন্ধের পরে বেরিয়েছিল গোপীনাথ। কিছু পথ যাওয়ার পরে চাঁদ উঠেছিল আকাশে। লম্বা, চওড়া, সোনার মতো গ্রীবা, ন্যাড়া মাথা যুবক সন্ন্যাসীকে দেখে সার্বভৌম চমকে গেল। নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে এমন দশাসই মানুষ এল কোথা থেকে? গোরা আর তার সঙ্গীদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল সার্বভৌম। গোপীনাথের কথামতো গোরাকে ঈশ্বরের অবতার না ভাবলেও মানুষটার দেবোপম চেহারা দেখে পাঁচজনের চেয়ে সে আলাদা, অনুমান করতে তার অসুবিধে হল না। গোরার সঙ্গে দু’-চার কথা বলে টের পেল, সে অসম্ভব বিনয়ী, আবেগপ্রবণ, সন্ন্যাস নিলেও বৈদিকশাস্ত্রের বিশেষ কিছু জানে না। সার্বভৌমকে দু’হাত জুড়ে নমস্কার করে গোরা বলল, আপনার মতো মহাপণ্ডিতের আশ্রয় পেলে আমি কৃতার্থ হব।

তুমি এই বয়সে সন্ন্যাসী হলে কেন?

সার্বভৌমের প্রশ্নে গোরা বলল, কৃষ্বপ্রেমে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। প্রকৃত সন্ন্যাসী হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও ঘরসংসার ছেড়ে চলে এলাম। আশা করি, আপনার কৃপা থেকে বঞ্চিত হব না।

গোরার কথায় খুশি হল সার্বভৌম। মনে মনে ঠিক করল, শাস্ত্র শিক্ষা দিয়ে এই নবীন সন্ন্যাসীকে যোগ্য শিষ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে উৎকলরাজ্যের সভাপণ্ডিতের বিদ্যাবত্তার খ্যাতি শুধু বাড়বে না, রাজা প্রতাপরুদ্রকেও তাক লাগিয়ে দেওয়া যাবে। সবার আগে গোপন একটা কাজ দিয়ে এই সন্ন্যাসীকে বিজয়নগর রাজ্যে পাঠানো দরকার। বিজয়নগর রাজসভার পণ্ডিত চক্রপাণির সঙ্গে এ নিয়ে কিছু শলাপরামর্শ ইতিমধ্যে সেরে রেখেছিল সার্বভৌম। গোরাকে আগে না দেখলেও বিজয়নগরে পাঠানোর যোগ্য দূত বেছে নিতে ভাই-এর ভুল হয়নি, সার্বভৌম বুঝে গেল। কুলিয়া থেকে পাঠানো চিঠিপত্রে গোরা সম্পর্কে ছোটভাই বিদ্যাবাচস্পতি যা লিখত, তা যেমন নির্ভুল, তেমনই গোরাকে ভগ্নীপতি গোপীনাথ কৃষ্ণাবতার ভাবলে, তা অমূলক ধরে নিয়ে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার কারণ নেই। চব্বিশ বছরের এই তরুণ সন্ন্যাসীকে ভালো করে যাচিয়ে নেওয়ার দরকার অনুভব করল সার্বভৌম। গৌড়ের সুলতান মন্দির লুঠ করে চলে যাওয়ার পরে পুরুষোত্তমপুর জুড়ে ডামাডোল চলেছে। পুরুষোত্তমপুর শাসনের ক্ষমতা চলে গেছে মন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধরের হাতে। মন্দিরের পুরোহিত, পরিছাদের মুঠোয় পুরে ফেলেছে সে। গুপ্তচর আর পরিছাদের দাপটে নগরে কায়েম হয়েছে অরাজকতা। রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের সভাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমকে আপামর নগরবাসী গভীর শ্রদ্ধা করলেও শিক্ষাদীক্ষার যারা ধার ধারে না, সেই লুঠেরা পামররা কখন কী ঝামেলা লাগিয়ে দেবে, কেউ জানে না। ভয়ে দমবন্ধ হয়ে থাকা নগরে দলবল নিয়ে গোরা এসে হাজির হতে বাসুদেব সার্বভৌমের মতো উঁচুমাপের রাজন্য একটু ঘাবড়ে গেল। আসলে সময়ের হিসেবে তার কিছু ভুলচুক হয়ে গেছে। সুলতানের বাহিনী যে এত তড়িঘড়ি উৎকল অভিযান শুরু করবে, রাজার গুপ্তচররা সে খবর দিতে পারেনি। রাজার হিসেবের বাইরে ছিল সুলতান হোসেন শাহের পরিকল্পনা। ছ’মাস আগে ঘোর বর্ষায় এরকম এক বেহিসেবি ঘটনা ঘটে গেছে। প্রতাপরুদ্রের কাছে সে ঘটনাও ছিল অকল্পনীয়। প্রবল বর্ষার মধ্যে উৎকল রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্ত শ্ৰীকুকর্ম পর্যন্ত বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব দখল করে নিতে পারে, পরাক্রান্ত যোদ্ধা হয়েও প্রতাপরুদ্রর চিন্তাতে ছিল না। বর্ষাকালে যুদ্ধবিরতি বজায় থাকে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ সাধারণভাবে শুরু হয় শরৎকাল কেটে গেলে, হেমন্তের মাঝামাঝি। মাঠ-ঘাট, নদী-নালা তখন শুকনো থাকে। রাজ্য, সাম্রাজ্যের খিদে মেটাতে রাজাদের মধ্যে ধুন্দুমার যুদ্ধ লেগে যায়। বর্ষার চার মাস শেষ হতে নেলোর উদয়গিরি দুর্গ উদ্ধার করতে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হারানো রাজ্য উদ্ধারে প্রতাপরুদ্র ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রতাপরুদ্রের এক কাকা, গজপতি রাজবংশের সন্তান, রানীকে এবং রাজপরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে উদয়গিরি দুর্গে বন্দি হয়ে গিয়েছিল। উদয়গিরি দুর্গ দখল করলেও তাদের রাজকীয় সম্ভ্রম দিতে রাজা কৃষ্ণদেব কার্পণ্য করেনি। তাদের মুক্তিও দেয়নি। গজপতি বংশের রাজপুরুষদের অতিথির মর্যাদা দিয়ে সসম্মানে বন্দি করে রেখেছিল কৃষ্ণদেব।

নেলোর জেলার দখল নেওয়ার চেয়ে উদয়পুর দুর্গ থেকে রাজপরিবারের আপনজনদের মুক্ত করে আনা প্রতাপরুদ্রের কাছে সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে তার কাকা-কাকির সঙ্গে একজন রাজকন্যা, লবঙ্গলতা আছে। বিবাহযোগ্যা লবঙ্গ, রাজার পাটরানী বা প্রিয়তমা রানীর মেয়ে না হলেও এক রাজমহিষীর পেটের মেয়ে তো বটে। তাদের জন্যে দুশ্চিন্তায় পুরো বর্ষাকাল রাজার দারুণ অশান্তিতে কেটেছে। হেমন্তের শুরুতে তাই উৎকল রাজ্যের দক্ষিণ সীমানা পুনর্দখল করার সঙ্গে অবরুদ্ধ উদয়পুর দুর্গে ঢুকে রাজপরিবারের আত্মীয়দের কটকের প্রাসাদে ফিরিয়ে আনতে দাক্ষিণাত্য অভিযানে প্রতাপরুদ্র বেরিয়ে পড়েছিল। রাজধানী কটক ছেড়ে গোদাবরী নদীর কাছাকাছি এলে প্রতাপরুদ্র খবর পেল গৌড়ের সেনাবাহিনী পুরুষোত্তম মন্দির লুটপাট করে ঝড়ের গতিতে রাজধানী কটকের পথে এগিয়ে আসছে। খবর শুনে রাজা ধন্দে পড়ে গেল। শীতের শেষে উৎকল আক্রমণের জন্যে গৌড়ের সুলতান তৈরি হচ্ছে, এরকম খবর ছিল রাজার কাছে। রাজাও রটিয়ে দিয়েছিল শীতের মাঝামাঝি বাহিনী নিয়ে দাক্ষিণাত্যে ঢুকছে সে। তার কৌশল কাজে লাগেনি, আগেভাগে ফাঁস হয়ে গেছে। এর নাম ভবিতব্য! দাক্ষিণাত্য অভিযান থামিয়ে রাজধানী বাঁচাতে রাজাকে বাহিনী নিয়ে ফের নিজের রাজ্যে ফিরতে হল।

কটকে রাজা ঢোকার কয়েকঘণ্টা আগে ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে সুলতান যাজপুর পেরিয়ে গড়মান্দারণের দিকে রওনা দিয়েছে। ঘোড়ার ক্ষুরের ধুলো তখনও রাজধানীর বাতাসে ভেসে রয়েছে। সুলতানের পাইক বরকন্দাজ বাহিনী মাঝরাতে কটক ছেড়ে সেই পথে গিয়েছিল। রাতের মতো তাঁবু গেড়ে কটক লুঠের ছক কষে সকালে সিন্ধুকীদের কাছ থেকে সেনাদল নিয়ে প্রতাপরুদ্র আসছে শুনে রাজধানী ছেড়ে তখনকার মতো ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে সুলতান সরে পড়েছিল। উৎকলের বাহিনী নিয়ে তাকে তাড়া করে রাজা প্রতাপরুদ্র কোথায় থামবে, সার্বভৌম জানে না। গড়মান্দারণে সুলতান একবার ঢুকে পড়লে, তাকে যুদ্ধে হারানো প্রতাপরুদ্রের পক্ষে সম্ভব নয়। গড়মান্দারণ দুর্গ এখন সামলাচ্ছে গোবিন্দ বিদ্যাধর, রাজার প্রিয়তমা রানী, বসুমতীর দাদা, অতি ধূর্ত সে, চালাকিতে ওস্তাদ।

গোরাকে এত বিশদে সবকিছু বলার উপযুক্ত সময় এখনও হয়নি। কটকে উৎকলরাজ ফেরার আগে বিজয়নগরে গোরাকে পাঠাতে পারলে, প্রতিবেশী দু’রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ ঠেকানো যায়। প্রথম দফায় উদয়পুর দুর্গে প্রায় ছ’মাস আটক থাকা কটকের রাজপুরুষেরা মুক্তি পেলে যুদ্ধের ডঙ্কা বাজার সম্ভাবনা খানিকটা কমতে পারে। কুলিয়ার বিদ্যাবাচস্পতি, নিশ্চয় এই দৌত্য করার সামান্য আভাস গোরাকে দিয়ে রেখেছে। গোরাকে কয়েকদিন নগরবাসীর চোখের আড়ালে রেখে বৈদিক শাস্ত্র অনুশীলনে কাটাতে পারলে চব্বিশ বছরের এই নবীন সন্ন্যাসীর জ্ঞানের বহর টের পাওয়া যাবে। বিজয়নগরের রাজার সভাপণ্ডিত বৈদান্তিক চক্রপাণির সঙ্গে পত্রালাপ করে শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজ সার্বভৌম অনেকটা এগিয়ে রেখেছে। পণ্ডিত চক্রপাণির সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার আলোচনায় এই কৃষ্ণভক্তকে বসানোর আগে স্মৃতি, শ্রুতি নিয়ে কিছু জ্ঞান দেওয়া দরকার।

গোপীনাথের সঙ্গে গোরা আর তার সঙ্গীদের সেই রাতের মত মার্কণ্ডেয় সরোবরে মাসীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিল সার্বভৌম। মাসীর বাড়ি থেকে গোপীনাথের বাড়ি বেশি দূরে নয়। অতিথিদের সুবিধে অসুবিধের দিকে গোপীনাথকে খেয়াল রাখতে বলল সার্বভৌম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *