৪২
পুরুষোত্তমপুরের ভক্ত, অনুরাগীদের জন্যে গোরার মনে দুশ্চিন্তা থাকলেও তাকে ছাপিয়ে উঠেছিল, বারাণসী, প্রয়াগে সর্বজনপূজ্য সাধু, মহাত্মাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কয়েকদিন মেলামেশা, সাধনভজন করার স্মৃতি। সুদূর মক্কামদিনা পর্যন্ত তীর্থ পরিব্রাজন করে আসা ভক্তিবাদী সাধক নানক একেশ্বরবাদের বদলে গুরুবাদে বিশ্বাসী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী, গুরুবাণীতে সবসময়ে বিভোর হয়ে রয়েছে। তার মুখে একই মন্ত্রের জপ, ‘ওয়াহে গুরুজি কি খালসা, ওয়াহে গুরুজি কি ফতে।’ সুফী সাধকদের সঙ্গে মক্কায় গিয়েছিল। ভক্ত কবীরের মতো নানকের ধর্মেও সুফী মতের প্রভাব পড়েছে। নানকের শিষ্য অঙ্গদকে দেখে গোরার মনে পড়েছিল নিতাইকে। নানকের জন্মভূমি, তালওয়ান্দি গ্রামে জন্মেছিল অঙ্গদ, পেশায় ছিল ফৌজি। নানকের ওপর ভক্তিতে সেনাবাহিনী ছেড়ে তার শিষ্য, সেইসঙ্গে দেহরক্ষী হয়ে যায়। ধর্মপ্রচারে ভক্তি ভালবাসা, প্রেম, গুরুবাণীর সঙ্গে ধর্মীয় সেনাবাহিনী দরকার, এমন এক প্ৰচ্ছন্ন ভাবনা সে মাথায় নিয়ে ঘুরছে। তার সঙ্গে কথা বলে প্রেমভক্তির প্রচারক গোরা শিউরে উঠে কৃষ্ণনাম জপে ডুবে গিয়েছিল। নির্গুণ ঈশ্বরপ্রেমে দীপ্যমান নানকের অবশ্য কখনও অস্ত্রে ঝঞ্ঝনার আভাস পায়নি। ভক্তির আবেশে তাকে সবচেয়ে বেশি মাতিয়ে রেখেছিল ‘অভঙ্গ’ গীতসঙ্কলনের কবি, ভক্তিতে ডুবুডুবু পান্ধারপুরের তুকারাম। গৌড়ের সন্ন্যাসী, গোরার সঙ্কীর্তনের সঙ্গে অভঙ্গে সঙ্কলিত তুকারামের নিজের লেখা গানের কলি, সুর মিশে গিয়ে মেলার মাঠে, রাতের খোলা আকাশের নিচে যে ঝঙ্কার তুলেছিল, সেখানে গলা মিলিয়েছিল অতিবৃদ্ধ ভক্ত কবীর, তামিল ভক্তিসাধক বল্লভাচার্য, এমনকি শিষ্য অঙ্গদকে নিয়ে গুরু নানক তুকারামের গানের কলি, ‘যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, মানুষকে ভালবাসে, তার জাতের খোঁজ ক’রো না’, এর তাল লয়ের সঙ্গে সুরেলা গলায় নিজের লেখা দোঁহা ইসলাম আর হিদু একই গাছের দুই শাখা, পক্ষিমাতার দুটো পাখা’ কবীর এমন অনায়াসে জুড়ে দিল যে কথা, সুরে কোনও ভেদাভেদ থাকল না।
গোরাকে দেখে নানক বহুপরিচিতের মতো সস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছিল, ভালবাসার তাপ নীলাচলে ফেরার পরেও গোরার শরীরে ছড়িয়ে আছে। তাকে নানক প্রশ্ন করেছিল, হে সন্ন্যাসী, তুমি কি সুফী সাধক? মক্কা থেকে ফিরে তুমি কি সদ্য দাড়ি-গোঁফ কামিয়েছ?
এ প্রশ্ন করছেন কেন?
গোরা জানতে চাইলে নানক বলেছিল, মনে পড়ছে, মক্কার পবিত্র কাবার পাশে কয়েকবার দেখেছি তোমাকে।
গোরা বলেছিল, হে মহাত্মা, আমি কৃষ্ণভক্ত, কৃষ্ণ আমার বাপ। তার ডাকে পাগল হয়ে আমি ঘর ছেড়েছি। প্রকৃত সন্ন্যাসী আমি নই। আমি চাই প্রেমভক্তি। মক্কা-মদিনা দেখার সৌভাগ্য আমার ঘটেনি।
কৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করলে গোরার শরীরে যে সাত্ত্বিক ভাববিকারের লক্ষণ ফুটে উঠত, তা দেখে মেলার কল্পদ্বীপে পাতার ছাউনিতে থাকা প্রবীণ সন্ন্যাসীরা অবাক হওয়ার সঙ্গে সম্ভ্রমে তার আরও কাছাকাছি পৌঁছে যেত। তাকে ঘিরে থাকা সন্ন্যাসীদের আসর ভক্তিতে ক্রমশ ধ্যানস্থ হয়ে পড়ত। রাত বাড়লে শুরু হয়ে যেত সঙ্কীর্তন; গুরুবাণী কীর্তন, কবীরের দোঁহা, তুকারামের ‘অভঙ্গ’ গীতি, গোরার উদ্দণ্ড নাচের সঙ্গে তার গলা থেকে গৌড়ের বৈষ্ণবদের প্রিয় গানের কলি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’, পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়ত।
নীলাচলে ফিরে এসে ভক্ত, অনুরাগীদের ভিড়ে তার ধ্যানের মুহূর্তগুলোতে আচমকা কিছু বেনিয়ম এসে ঢুকছিল। ঘটে গেছে এবং ঘটমান এমন কিছু কাণ্ডে চমকে উঠলেও প্রয়াগের অলৌকিক দিনরাতগুলো ভুলতে পারছিল না। স্বর্গ থেকে যেন নেমে এসেছিল সেই একপক্ষকাল। সারাক্ষণ চারপাশে দেখছিল কৃষ্ণকে। তার শরীরের সুগন্ধ, নাচে আসছিল, পায়ের নুপূর আর বাঁশির সুর ভেসে বেড়াচ্ছিল কল্পদ্বীপের বাতাসে। পৃথিবীতে ধর্মরাজ্য নেমে এসেছে, এমন এক অনুভূতি, থেকে থেকে গোরার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। সব মহাত্মার সাধনার পথ এক না হলেও সকলের ধ্যানে নিজের নিজের মতো স্বপ্নরাজ্যের চিন্তা রয়েছে সে টের পাচ্ছিল। ধর্মরাজ্য নিয়ে কি কিছু কথা হয়নি? তা-ও হয়েছিল। পান্ধারপুরে বিঠঠলনাথের মন্দিরে মেবারের শিশোদিয়া রাজকুলের বিধবা বধূ, কৃষ্ণভক্ত মীরাবাই-এর ভজন গান আর তার ভাবাবেশের সঙ্গে সঙ্কীর্তনের আসরে প্রেমভক্তিতে গোরা বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাতে হুবহু মিল খুঁজে পেয়ে কেঁদে ফেলেছিল তুকারাম। স্বামী ভোজরাজ মারা যাওয়ার পরে মীরার দেওর, রাজা বিক্রমজিতের কত নির্যাতন মীরাকে সহ্য করতে হয়েছে, কতবার ইষ্টদেবতা কৃষ্ণ, যাকে মীরা নিজের স্বামী ছাড়া আর কিছু ভাবে না, তাকে বাঁচিয়েছে, সেই কাহিনী কিছু কিছু তুকারাম শুনিয়েছিল গোরাকে। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর সঙ্গমে নির্জন গাছতলায় একরাতে তারায় ভরা আকাশের নিচে নানা কথার মধ্যে তুকারাম জানিয়েছিল, মীরার কৃষ্ণভক্তির আকুতি, সুরের মধু ঝরানো ভজন শুনে মেবারের মানুষ, এমনকি পান্ধারপুরের ভক্তেরা পর্যন্ত সেই ভক্তিমতী সাধিকাকে স্বয়ং রাধা ভাবে।
তুকারাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেও থামল না। বিনয়ে গলা নামিয়ে বলল, হে মহাত্মা, তুমি সবই জান, মীরার মতো তুমিও কৃষ্ণভক্তিতে ডুবে আছ। মীরা যদি রাধা হয়, তুমি তাহলে কৃষ্ণ, তোমার মধ্যে আমার কৃষ্ণদর্শন হচ্ছে। তুমিই বলতে পারো মীরার আসল পরিচয়।
তুকারামের পিঠে আলগোছে হাতের পাতা রেখে গোরা বলেছিল, কৃষ্ণ তো রাধার স্বামী নয়, তার চেয়ে বেশি, কৃষ্ণ হল রসরাজ, মহাভাব।
গলা আরও নামিয়ে তুকারাম বলেছিল, তুমি-ই সেই রসরাজ, মহাভাব কৃষ্ণ, তোমাকে চিনতে আমার ভুল হয়নি।
গোরা বলেছিল, না, আমি কৃষ্ণ নই, আমি কৃয়ের এক ভক্ত, তোমার মুখে তাঁর বিবরণ শুনে মনে হচ্ছে, মীরাবাই আমার চেয়ে বড় ভক্ত, উঁচু মানের সাধিকা, তিনি কৃষ্ণের আনন্দময়ী সত্তা, হ্লাদিনী শক্তি, আমার প্রণম্য।
জন্মভূমি নবদ্বীপ থেকে রামকেলি ছুঁয়ে বারাণসী, প্রয়াগে তীর্থস্নান সেরে প্রেমভক্তিতে গোরার মন ভরে গেলেও ধর্মরাজ্য গড়ার চিন্তা তার মাথা থেকে কখনও সরে যায়নি। প্রয়াগের সাধুশ্রেষ্ঠরা তার ধর্মরাজ্য গড়ার ভাবনায় সকলে যে সায় দিয়েছে, তার কারণ এ ভাবনা তাদেরও মাথায়, কারো আবছা, কারো স্পষ্টভাবে, ঘোরাফেরা করছিল। যুগনির্মাণের উপকরণ নিয়ে ভাবনা সকলের সমান না হলেও মানুষের মঙ্গল আর ঈশ্বরে বিশ্বাস অবিভাজ্য এই অখণ্ড সত্যে কারও সন্দেহ ছিল না। প্রয়াগ থেকে ফেরার পথে সনাতন, রূপ, স্বরূপের সঙ্গে গোরা কথা বলে পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে বৃন্দাবনে পাকাপাকি থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। বৃন্দাবন, কৃষ্ণের সেই ব্রজধাম এখন আগের মতো নেই, পুরানো দিনের ধ্বংসাবশেষ, মানুষের বসবাসের অযোগ্য। পরিত্যক্ত জনপদ, জঙ্গলে ঢেকে গেছে ব্রজবাসীদের সেই লীলাভূমি। অনুগামী ভক্তদের নিয়ে সেখানে ডেরা করলে শুরুতে কিছু অসুবিধে হলেও তা বেশিদিন থাকবে না, কেটে যাবে। বৃন্দাবনের পুনরুদ্ধার না করলে ব্রজের মালিক, বাপ কৃষ্ণের ঋণ এ জীবনে সে শোধ করতে পারবে না। যার ডাকে ধর্মরাজ্যের তৈরিতে সাড়া দিয়ে মাথা মুড়িয়ে, পৈতে ফেলে দিয়ে ঘর-সংসার ছেড়ে কৌপীন পরে সন্ন্যাসী সেজেছে, তার দেওয়া দায়িত্ব পালন না করে তার মরার ফুরসত নেই। প্রয়াগে গিয়ে গুরু নানকের দুই শিষ্য অঙ্গদ আর অমরদাসের কথা থেকে জানল, শুধু ঈশ্বর আর মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, ধর্মরাজ্য গড়তে আর তা বাঁচিয়ে রাখতে গুরুর অধীনে সশস্ত্র সেনাবাহিনী থাকা দরকার। গুরু নানকের উত্তরাধিকার যার ওপর বর্তাবে, সেই দ্বিতীয় গুরু অঙ্গদ আর তার সবেচেয়ে কাছের মানুষ অমরদাস বলে, সত্যই ঈশ্বর। এক তরুণ শিখ সন্ত, নাম তেগবাহাদুর তাদের ধ্যানের বাণীকে শ্রদ্ধা করলেও ধর্মীয় সমন্বয়ের সঙ্গে সংঘর্ষ মিশে আছে, এ ধারণা সে ছাড়েনি। তেগবাহাদুর সে কাজে হাত লাগিয়ে যোগ্য সেনাপতি গুরু গোবিন্দসিংকে খুঁজে পেয়েছে। ঢেউ এর পরে ঢেউ তুলে পঞ্চনদীর জনপদে শিখধর্ম ছড়িয়ে পড়তে দেরি নেই। তাপ্তী নদীর তীরে দেবগিরি, অজন্তা, ইলোরা, এমনকি পান্ধারপুরের ভক্তিবাদীদের অনেকে ধর্মীয় বাহিনী বানাতে আড়ালে আবডালে আলোচনা করছে, তুকারামের কথা থেকে গোরা আভাস পেয়েছিল। তার প্রেমভক্তি সর্বস্ব নাম প্রচারে ধর্মরাজ্য তৈরির স্বপ্ন চিরকাল অলীক থেকে যাবে, প্রয়াগের সাধু, মহাত্মাদের কেউ এ কথা না বললেও দেবলোকেও যুদ্ধবিগ্রহ হয়, সেখান্যে ঈশ্বরের আসন অনড় রাখতে রক্তপাত ঘটে, শাস্ত্রের কাহিনী উদ্ধার করে কেউ কেউ শুনিয়েছিল। নানা মতের সাধুসন্তেরা নিজেদের ঈশ্বর বিশ্বাস আর সাধনমার্গ নিয়ে টুকরো টুকরো অভিমত জানালেও প্রেমভক্তিতে ভাবাবিষ্ট গোরার সাধনাকে কেউ অবহেলা করতে পারেনি। কল্পদ্বীপে সেই হয়ে উঠেছিল সাধুসমাজের মধ্যমণি। পরিব্রাজন, তীথযাত্রার পথে, জনপদে, মন্দিরে, দরগা, মাজারে নানা মানুষ, কত সাধু, সন্ন্যাসী, দরবেশ, ফকির, মৌলবীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, সময় কেটেছে, হিসেব নেই। নিজের অতলান্ত প্রেমভক্তির সঙ্গে মিশেছে পথের সাথীদের কাছ থেকে পাওয়া পুরশ্চরণের আলো। সেই আলোয় নিজের অনুগামী ভক্ত বৈষ্ণবদের সম্প্রদায় হিসেবে দেখার সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের দোষগুণ সমেত দেখতে হবে, সে বুঝতে পারছিল। নবদ্বীপে যাওয়ার আগে থেকেই টের পাচ্ছিল, সঙ্কীর্তনের আসরে, ভক্তদের ভিড়ে কৃষ্ণপ্রেমে যে ব্যাকুল, ভক্তের সমাগম থেকে বেরিয়ে সে একা হয়ে গেলে তার আচরণ বদলে যায়। সন্ন্যাসীর ভেক খসে গিয়ে মর্কট বৈরাগী বেরিয়ে পড়ে। তাকে ঘিরে মর্কট বৈরাগী কম নেই, শুদ্ধাচারী সেজে লুকিয়ে বিস্তর অকাজ কুকাজ তারা করে চলেছে। নবদ্বীপেও এদের অনেকে রয়েছে। সৎ, শুদ্ধচরিত্র ভক্তরাই সংখ্যায় বেশি। তাদের সকলে খারাপ মানুষ অপরাধপ্রবণ এমন নয়। তার অনুগত ভক্তদের মধ্যে মুরারি গুপ্ত একজন। গোরাকে রোজ একবার না দেখলে তার চোখের সামনে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। মুরারির ইষ্টদেবতা রাম। কৃষ্ণপ্রেমী গোরার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকলেও ইষ্টমন্ত্র রামনাম জপ সে ছাড়তে পারেনি। গোরার সামনে প্রচুর চোখের জল ফেলে নিজে এ কথা জানিয়েছে। গোরা খুশি হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। প্রয়াগে গোরা পৌঁছানোর কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে প্রথমে রূপ, পরে সনাতন হাজির হয়ে গিয়েছিল। একডালার ভূঞাবাড়িতে বসে এই সাক্ষাৎকার গোরা ঠিক করে দিয়েছিল। রূপ সুস্থ শরীরে প্রয়াগে পৌঁছালেও সনাতন যখন কল্পদ্বীপে এল, ঘোর অসুস্থ দেখাচ্ছিল তাকে। খোস, পাঁচড়ায় ভরে গিয়েছিল তার শরীর। সে ধুঁকছিল। সনাতনের ছোটভাই যার নাম অনুপম, নামটা গোরার দেওয়া, সে-ও রামভক্ত। কৃষ্ণভক্ত দুই দাদা, সনাতন আর রূপের অনুরোধে কৃষ্ণনাম জপ করতে শুরু করেও রামনাম ছাড়তে পারেনি। দুই দাদার কাছে চোখের জলে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে সে নিজের ইষ্টমন্ত্র জপ করার প্রার্থনা করেছে। ছোট ভাই-এর তাত রামভক্তি সাদরে মেনে নিয়েছে সনাতন, রূপ সনাতনের মুখে এ কাহিনী শুনেছে গোরা। তার কাছে ইষ্টদেবতার চেয়ে বড় হল ভক্তের আন্তরিক প্রেম, ভালবাসা। প্রেমভক্তির সাধক হলেও সাধনার সব ধারাকে সে উদারতার সঙ্গে মেনে নিয়েছে। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে ইষ্টদেবতা নিয়ে সামান্য কিছু ভুল বোঝাবুঝি থাকলেও তা সহজে মিটিয়ে দিতে তার অসুবিধে হয়নি। প্রয়াগ থেকে পুরুষোত্তমপুরে ফিরে গোরা শুনল, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় মতভেদের সমস্যা আগের মতো সহজ নেই। পুরানো কোঁদল আরও জটিল হয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ধর্মাচরণের সঙ্গে উৎকলের মানুষ মেলাতে পারছে না তাদের জগন্নাথ মহাপ্রভুর পুজোর রীতিপদ্ধতি। গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের উৎকল আক্রমণ, পুরুষোত্তমপুরে জগন্নাথ মন্দির লুঠ, অসংখ্য উৎকলবাসীর প্রাণহানি, অত্যাচার, নির্যাতনের ঘটনা গত দু’বছরে রাজ্যের মানুষ ভুলতে পারেনি। উৎকলের মানুষের মনে রক্তেভেজা সেই দুঃসময়ের স্মৃতি এত ঘৃণা তৈরি করেছে, যে গৌড়ের মানুষকে তারা দু’চোখে দেখতে পারছে না। বিশ্বাস করতে পারছে না তাদের চালচলন, প্রেমভক্তির সাধনা। পায়ে পা লাগিয়ে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে, যা দাঙ্গার চেহারা নিতে পারে। সবাই যে সমান মারমুখী এমন নয়। গোরা ভক্ত-অনুরাগী অনেক আছে। তারা ভদ্র, কলহ কোলাহলে থাকে না। উল্টোপক্ষের সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ হল, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের জাতপাতের ঠিক নেই। কে ব্রাহ্মণ, কে শূদ্র, কে চাঁড়াল, বৈদ্য, কায়স্থ, বাইরে থেকে দেখে বোঝা মুশকিল। বৈষ্ণবদের মধ্যে কয়েকজন যবন ঢুকে পড়েছে এ সন্দেহ পুরুষোত্তমপুরের কিছু মানুষের মনে ঢুকে গেছে। নিজেদের কুঁড়ে থেকে তারা বেরোয় না। জগন্নাথ দর্শনে মন্দিরে ঢোকা দূরের কথা, মন্দিরের রাস্তা পর্যন্ত তারা মাড়ায় না। এত বেশি বিনয়ী, যে আপাত নজরে মনে হয়, বড়ো কোনো অপরাধ করে বসে আছে। বেশিরভাগ গৌড়ীয়কে গৌড়ের সুলতানের গুপ্তচর ভাবতে শুরু করেছে পুরুষোত্তমপুরের কিছু লোক। প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠী আড়াল থেকে বেশ গুছিয়ে এই গুজব ছড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে রাজা প্রতাপরুদ্রের পরিবারের কেউ না থাকলেও রাজপরিবারের দু’একজন মানুষ, পাত্র, মিত্র, অমাত্য, মন্দিরের কিছু পরিছা হাত মিলিয়েছে। এ খবর নবদ্বীপ যাওয়ার আগে রামানন্দ রায়ের কাছ থেকে গোরা পেয়েছিল। বাসুদেব সার্বভৌমও ঠারেঠোরে এরকম কিছু ঘটছে, জানিয়েছিল। কৃষ্ণপ্রেমে আবিষ্ট থেকেও গোরা নজর করছিল, পুরুষোত্তমপুরে দু’রাজ্যের মানুষের মধ্যে যে প্রীতিমধুর সম্পর্ক গড়ে উঠছিল, তা খানিক থমকে গেছে। তার কানে এমন কিছু ঘটনা পৌঁছোল, শুনে আতঙ্কে গুটিয়ে গেল সে। মনে হল, ইষ্টমন্ত্র ভুলে যাবে, তাকে ছেড়ে চলে যাবে বাপ কৃষ্ণ।
নবদ্বীপ সে যাওয়ার আগে মাসখানেক তার জন্যে ওড়িয়া ভক্ত শিখি মাহিতির বৃদ্ধা দিদি মাধবীর কাছ থেকে রোজ দুপুরে ভিক্ষের চাল আনতে যেত ছোট হরিদাস। নবদ্বীপের কাছে কাঞ্চনপল্লীতে থাকত সে। গোরার চেয়ে বয়সে কয়েকবছরের ছোট ছিল। নবদ্বীপে গোরা থাকার সময়ে তার অন্ধভক্ত হয়ে গিয়েছিল হরিদাস। বৃদ্ধ ঠাকুর হরিদাসের সঙ্গে নামের মিল এড়াতে বৈষ্ণবরা তাকে বলত ছোট হরিদাস। দাক্ষিণাত্য থেকে পুরুষোত্তমপুরে গোরা ফিরে আসার তিন বছর পরে রথযাত্রার সময়ে নবদ্বীপের তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে নীলাচলে এসে সে আর ঘরে ফেরেনি। গোরার হাতে- পায়ে ধরে পুরুষোত্তমপুরে থাকার অনুমতি আদায় করেছিল। ছোট হরিদাসের মতো গুণী কীর্তনগায়ককে গোরা ফিরিয়ে দিতে পারেনি। মাধুকরী ব্রত নিয়েছিল সে। কোনোদিন গোরা, কোনোদিন দামোদর বা অন্য কারো জন্যে একমুঠো চাল ভিক্ষে করতে বেরত। যার জন্যে ভিক্ষেতে বেরত, দুপুরে তার সঙ্গে খেত। নিখুঁত, পরিপাটি করে সারত মাধুকরী ব্রত। তার সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল তার গলার সুর। তার কীর্তন শুনে গোরা প্রায়ই ভাবাবেশে বেহুঁশ হয়ে যেত। ঘনামল্লসাহির কাছে ছোট হরিদাসের থাকার জন্যে একটু কুঁড়ে তৈরি করে দিয়েছিল কাশী মিশ্র। সেখানে থাকত সে। গদাধর, জগদানন্দ, ঠাকুর হরিদাস, দামোদরের কুঁড়েতে যাতায়াত ছিল তার। গোপীনাথের সেবক গদাধরের কাছে দীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছে জানাতে কিছুদিন তাকে অপেক্ষা করতে বলেছিল গদাধর। মাধবীর ঘরের মুষ্ঠিভিক্ষা পৌঁছাত গোরার কাছে, কালীমিশ্রের বাগানে, গম্ভীরাতে। ভিক্ষের চাল ফুটিয়ে যে ফেনাভাত হত, গোরা তা চোখে দেখে চিনতে পারত, খেতে পছন্দ করত। নবদ্বীপে যাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে সে নজর করল, ভিক্ষের চালের চেহারা, উঁচু মানের, দামি, সুগন্ধি, ভাতের রং, গন্ধ, স্বাদ আলাদা। শিখি মাহিতির ঘরের চাল এটা নয়, আলাদা ভাঁড়ারের চাল, বুঝতে পারছিল। জন্মভূমি নবদ্বীপ দেখতে যাওয়ার আগে ভক্ত, অনুগামীদের ভিড় সামলে তাদের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনমত কথা বলে, পরামর্শ দিতে সে এত ব্যস্ত ছিল যে, একাহারি সন্ন্যাসী গোরা ছোট হরিদাসের আনা ভিক্ষের চাল দেখে, মনে প্রশ্ন জাগলেও তা নিয়ে খোঁজ করার সময় পায়নি। কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে থাকা তাকে বেখেয়াল করে রেখেছিল। ভক্তদের নৈতিক কোনো স্খলন না ঘটলে তাদের রোজকার জীবনের আচরণ খুঁটিনাটি ঘটনা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। বৈষ্ণভক্তরা সবাই কৃষ্ণনাম জপছে, সদিচ্ছা, শুভবুদ্ধি নিয়ে সাধকের জীবন কাটাচ্ছে, এই ভেবে আনন্দে ডুবে ছিল। কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করত না, প্রশ্ন করা পছন্দ করত না। পুরুষোত্তমপুরে আসার পর থেকে ঠাকুর হরিদাস কখনো জগন্নাথ দর্শন করতে যায়নি। মন্দিরের সামনের পথে সম্ভবত কখনও তাকে হাঁটতে দেখেনি কেউ। নিজের দীনতায় হিন্দুর মন্দির, সেই তীর্থস্থান, হিন্দুদের বহুকালের সংস্কারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়ে নিজে দূরে থেকেছে। কৃষ্ণের নাম জপ করার অধিকার তার আছে। কিন্তু হিন্দুমন্দিরে তার ঢোকার অধিকার নেই, গোরা কি কখনও তাকে নিজে সঙ্গে করে মন্দিরে নিয়ে যেতে চায়নি? চেয়েছে। দু’তিনবার একান্তে ডেকে জগন্নাথদর্শনে নিয়ে যেতে চাইলেও হরিদাস যায়নি। বলেছে, স্বয়ং কৃষ্ণ আমার কুঁড়েঘরে, অসীম তাঁর কৃপা, আমাকে তুমি আর কত পরীক্ষা করবে হে দেবতা?
গোরা কথা বাড়ায়নি। বিশুদ্ধ কৃষ্ণভক্তিতে তাকে হরিদাস ছাড়িয়ে গেছে অনুভব করে সে চুপ করে থাকত। হরিদাসের কুঁড়েতে গেলে প্রথমে বুকে জড়িয়ে ধরে তাকে। যে দীনতায় মন্দিরে সে ঢোকে না, সেই একই কারণে নিজের ইষ্টদেবতা গোরাকে কৃষ্ণের অবতার জেনে তাকে ছোঁয়া পাপ ভাবে। গোরার স্পর্শে তার শরীরে আনন্দের ঢেউ জাগলেও মনে মনে বলে, হে প্রভু, জন্মজন্মান্তরে যেন তোমার আশ্রয় পাই।
ঠাকুর হরিদাসের কুলপরিচয় যারা জানে, গোরা এমন কিছু ভক্ত এখনও যবন- স্পর্শদোষ ঘটার ভয়ে তাকে এড়িয়ে চলে। কৃষ্ণভক্তিতে তাদের কেউ কেউ হরিদাসের নখের যোগ্য না হলেও গোরা এ নিয়ে একটা কথা বলে না। ঠাকুর হরিদাসের সঙ্গে দেখা হলে সকলের সামনে, সবার আগে তাকে বুকে টেনে নেয়। সে জানে, ঠাকুর হরিদাস জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকলে, তার যবন পরিচয় ফাঁস হয়ে যেতে পারে। গৌড়ের বৈষ্ণবরা জাতপাতের ভেদাভেদ না মানলেও ব্রাত্মণ্যবাদী পুরানো সংস্কারে সুড়সুড়ি এখনো সবাই কাটাতে পারেনি। নবশাক অথবা কায়স্থ বৈষ্ণবগুরুর কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিতে গোরার বেশকিছু ব্রাহ্মণ ভক্ত এখনও গড়িমসি করে। ব্রাক্ষ্মণ কুলপরিচয়ের অহমিকা তারা ভুলতে পারে না। ঠাকুর হরিদাসের সঙ্গে কোলাকুলিতে যারা আগ্রহ দেখায় না, তাদের গোরা চিনলেও মুখে কিছু বলে না। কৃষ্ণপ্রেমে সবসময়ে বিভোর সে, মনের সেই বিভোরতা থেকে সে জেনে যায়, তার কি করা উচিত, করা উচিত নয়। উচ্ছ্বসিত ঝর্নার মতো বেরিয়ে আসে তার প্রেম ও ভালবাসার অভিব্যক্তি। জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে ঠাকুর হরিদাস ঢুকলে তা নিয়ে গণ্ডগোল লেগে যেতে পারে, এমন ভয় গোরার নেই। মন্দিরের মধ্যে যবন ভক্তের ঢোকাতে কোনও নিষেধ আছে কিনা, গোরা জানে না। জানার চেষ্টাও করেনি। তবে মূল মন্দিরের পেছনে শূদ্র শবর সেবকদের পুজো করার আলাদা গোপন চাতাল, যার নাম ‘অনসরপিণ্ডি’ সেখানে জৈষ্ঠ্যমাসের পূর্ণিমা থেকে আষাড়ে অমাবস্যা পর্যন্ত শবরোৎসবে গোরা ফি বছর হাজির থেকে নেচে- গেয়ে রাতের আসর মাতিয়ে রাখে। শবরসম্প্রদায়ের নাচগানের সঙ্গে কিভাবে বৈষ্ণব প্রেমভক্তির সঙ্কীর্তন মিশে যায়, গায়ক, শ্রোতারা বুঝতে পারে। নবদ্বীপে থাকার সময়ে শবরদের মেলা, নানা পুজো-অনুষ্ঠান কিশোর বয়স থেকে সে দেখেছে। ব্রাহ্মণ পরিবারের কোনও ছেলে সেখানে না গেলেও গোরা যেত। মেলা দেখতে গিয়ে ভিন্ন সম্প্রদায়ের নাচ, গানের আসরে নিজে মিশে যেত। তাকে পেয়ে যারা আসর জমাত, খুশি হত। গোরা শুনেছে জগন্নাথ মন্দির তৈরির আগে থেকে অনসরপিড়িতে শবরদের পুজো অনুষ্ঠান চালু হয়েছিল। জগন্নাথের মূর্তি প্রতিষ্ঠার পরেও সে প্রথা বাতিল হয়নি। শুধু ঠাকুর হরিদাস কেন, পুরুষোত্তমপুরে এসে গত তিন মাসে সনাতন আর রূপ, দু’জনের কেউ মন্দিরে ঢোকেনি, জগন্নাথ দর্শন করেনি। সম্ভবত গৌড়ের দরবারে অনেক বছর চাকরি করে, যবন সহকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশাতে এমন কিছু রফা দু’ভাইকে করতে হয়েছে, যা থেকে তাদের মনের গভীরে কোথাও পাপবোধ তৈরি হয়েছিল। মন্দিরে তারা ঢুকলে সেই পবিত্র তীর্থস্থান কলুষিত হবে, এ ভয় তারা পাচ্ছে। তারা শুধু মন্দির দর্শন বন্ধ রাখেনি, ভক্তরা যে পথে মন্দিরে যাতায়াত করত, সে রাস্তা পর্যন্ত মাড়াত না। সনাতনের সঙ্গে দু’এক কথায় গোরা জেনে গিয়েছিল দু’ভাই-এর মনের কথা। গোরা এ প্রসঙ্গ দ্বিতীয়বার তাদের কাছে তোলেনি। কাশী মিশ্রের বাগানে নিজের ঘরের কাছে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল। দু’ভাই-এর জন্যে একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে দিয়েছিল কাশী মিশ্র। সুলতানের কয়েদখানা থেকে এক কাপড়ে ভিখিরির মতো পালিয়ে এসেছিল সনাতন। কত দিন উপোস করে কেটেছে, হিসেব নেই। রাতের পর রাত জঙ্গলে, ভাঙা আটচালায় না নেয়ে, খেয়ে, জেগে কাটিয়ে সারা শরীরে এমন ঘা হয়ে গেছে, আচমকা দেখলে কুষ্ঠরোগী মনে হয়। সুলতানের হেপাজত থেকে সনাতন, রূপ একরাতে একসঙ্গে পালালেও দু’জনে আলাদা পথে বারাণসীর দিকে রওনা হয়েছিল। তাদের শরীর থেকে সাকর মল্লিক আর দবীর খাস নামের তকমা খসে পড়েছিল। চিরকালের মতো তারা হয়ে গেল রূপ, সনাতন। প্রয়াগে খোস পাঁচড়ায় জর্জরিত শরীর সনাতনকে দেখে খুশিতে তাকে গোরা জড়িয়ে ধরতে গেলে দু’হাত দূরে সে পেছিয়ে গিয়ে বলেছিল, প্রভু, আমার কুষ্ঠ হয়েছে, আমাকে ছোঁবেন না। তাছাড়া আমি মহাপাতক, আপনাকে ছোঁয়ার অধিকার আমার নেই।
অসুস্থ দাদা সনাতনকে দেখে রূপও ভয় পেয়েছিল। একডালায় কয়েদ থেকে পালানোর সময়ে যে দাদা পুরো সুস্থ ছিল, তার শরীর এত অল্প সময়ে কিভাবে এমন ভেঙে যায়, সে বুঝতে পারল না। পুঁজ, রক্ত মাখা দাদাকে গোরা বুকে টেনে নিলে, সেও ব্যাধিগ্রস্ত হতে পারে, এইভেবে রূপ বলল, প্রভু, দাদাকে সেবার কাজ আমাকে দিন, তাকে আমি সুস্থ করে তুলব।
হাসিমুখে রূপের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে সনাতনকে বুকে টেনে নিয়ে গোরা বলেছিল, কৃষ্ণভক্ত সনাতন আমার সম্পদ, ওর সেবা, শুশ্রূষা যা করার আমি করব।
নিজের গায়ের পুঁজরক্ত গোরার শরীরে লাগতে সনাতন ‘হায় হায়’ করছিল। পাশাপাশি খুশিতে তার দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল। গোরা যা বলেছিল, তাই করল। প্রয়াগে থাকার দিনগুলোতে, সেখান থেকে নীলাচলে ফেরার পথে, নীলাচলে ফিরেও সনাতনের শরীরে রোজ নিজের হাতে ভেষজ লাগানোর কাজ সে করে চলেছে। তখনও ডুবে থাকছে কৃষ্ণ নামের গভীরে। প্রয়াগ থেকে গোরার সঙ্গে সনাতন, রূপ, স্বরূপ, দামোদর, পুরুষোত্তমপুরে এসে যাওয়ায় সেখানে গৌড়ের বৈষ্ণবদের প্রায় সকলের মনের জোর বাড়লেও কেউ কেউ অখুশি হয়েছিল। গোরাকে নিজের হাতে সনাতনের খোসপাঁচড়ায় ভেষজ লাগাতে দেখে রীতিমতো বিরক্ত হচ্ছিল জগদানন্দ। তার বিরক্তিতে তাল দিচ্ছিল নবদ্বীপের অনুগত ভক্ত দামোদর। গোরার শরীরে সনাতনের রোগ সংক্রমণ হতে পারে, এই ভয় তারা পাচ্ছিল। একডালার সুলতানী দরবারের যবনদের শরীর থেকে কোন্ দুষ্ট রোগের জীবাণু সাকর মল্লিক পুরুষোত্তমপুর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এল, এ নিয়ে জগদানন্দ, দামোদর ফিসফিস করে আলোচনা করত। সনাতন, রূপের আসল পরিচয়, তারা পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছানোর আগে, এই দু’জন পেয়েছিল। গৌড়ের দরবারের দুই পদস্থ কর্মচারীর পরিচয় পুরুষোত্তমপুরে গোপন রাখতে হবে, বুঝে যেতে তাদের অসুবিধে হয়নি। গৌড়ের লুঠেরা সুলতানের দুই মন্ত্রীর পরিচয় জানাজানি হয়ে গেলে তাদের শূলে চাপিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, তাদের অজানা ছিল না। নবদ্বীপের পুরুষোত্তম আচার্যকে আগে থেকে দু’জনে চিনত। বারাণসীতে লেখাপড়া করতে গিয়ে সে যোগওপট্টহীন সন্ন্যাস নিয়ে স্বরূপ দামোদর নাম পেয়েছে, জানত না। সন্ন্যাস নেওয়ার সঙ্গে নানা বিষয়ে পাণ্ডিত্য আর বুৎপত্তি অর্জন করেছে, গোরা নিজের মুখে তা জানিয়ে বলল, ‘সঙ্গীতে গন্ধর্বসম, শাস্ত্রে বৃহস্পতি।’
পুরানো প্রতিবেশী প্রকাশানন্দকে পেয়ে জগদানন্দ, দামোদর খুশি হলেও নিজের নামধারী আর একজন পাশাপাশি এসে যাওয়াতে দামোদর কিছুটা বিব্রত হল। গোরাকে দামোদর কৃষ্ণের অবতার হিসেবে মানলেও পুরুষোত্তমপুরে নিজেকে সেই অবতারের অভিভাবক ভাবে। গোরাকে যথেষ্ট ভক্তি করার সঙ্গে সযত্নে আগলে রাখে। জ্ঞানে, গুণে তার চেয়ে বড়মাপের দ্বিতীয় এক দামোদর এসে যাওয়াতে গুরুত্বে সে খাটো হয়ে যাবে, এমন এক দুশ্চিন্তা পেয়ে বসল তাকে। সে ঠিক করল গোরার মতো স্বরূপ দামোদরকে শুধু স্বরূপ নামে সে-ও ডাকবে। গোরাকে নীরোগ রাখতে পুরুষোত্তমপুর থেকে সনাতনকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিতে চাইছিল জগদানন্দ। পরামর্শ চাইল দামোদরের কাছে। দামোদর সায় দিল, বলল, বৃন্দাবন সংস্কারের চিন্তা যখন আমাদের গোরার মাথায় আছে, তখন সনাতন, রূপ দু’জনকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া ভাল। ছোটভাই সঙ্গী হলে দাদার সেবা করতে পারবে। আমাদের গোরার দেবশরীরে ব্যাধি ধরার ভয় থাকবে না।
সমুদ্রের ধারে নির্জন ঝাউবনে এক দুপুরে অসুস্থ সনাতনকে ডেকে নিয়ে গেল জগদানন্দ। সঙ্গী করল দামোদরকে। আলাদা করে ডেকে তাকে জগদানন্দ কি বলতে চায় সনাতন আন্দাজ করেছিল। সে যা আঁচ করেছিল, তাই ঘটল। গোরাকে রোগব্যাধি থেকে বাঁচাতে ভাইকে নিয়ে তাকে বৃন্দাবনে চলে যেতে বলল জগদানন্দ। জগদানন্দের পরামর্শ সনাতনকে মেনে নিতে বলল দামোদর। গোরার সঙ্গ আর যত্নে সনাতন তখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ হয়ে উঠলেও অপরাধবোধের জ্বালায় সে ভুগছিল। জগদানন্দের পরামর্শে তার দু’চোখ জলে ভরে গেল। বলল, আমি মহাপাতক, কি পাপ যে করছি, তা জানি। আর নয়, এবার শেষ করে দেব এই অভিশপ্ত জীবন। সামনে রথযাত্রার উৎসব। চলন্ত রথের চাকার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দেব। ছোটভাই রূপকে জানিয়ে রেখেছি আমার গোপন ইচ্ছের কথা। শুধু সে-ই জানে, আমি কি করতে চলেছি। তোমাদেরও জানালাম, দেখ, পাঁচকান না হয়!
সনাতনের কথা শুনে জগদানন্দ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, স্নানযাত্রার এখনও দু’মাস দেরি। তার মধ্যে যদি কিছু অঘটন ঘটে যায়!
দামোদর চুপ। সমুদ্রে ভরা জোয়ার, জোরালো বাতাসে ঝাউপাতায় বিলি কাটার সাঁইসাঁই (–?)। শুকনো বালি উড়ছে মাঝেমাঝে। সনাতন বলল, নবদ্বীপের দেবতার পাশে দাঁড়িয়ে সুবোত্তমপুরে রথযাত্রা উৎসব জন্মের মতো একবার দেখার ইচ্ছে ছিল। মহাপ্রভুর রথের চাকায় জীবন আহুতি দেওয়ার মতো পুণ্য করার সুযোগও তো আর পাব না।
রথের চাকার নিচে সনাতনের জীবন দেওয়ার ইচ্ছেকে জগদানন্দ সাধুবাদ জানালেও গোরাকে নীরোগ রাখা বেশি জরুরি। আরও দু’মাস অপেক্ষা করতে সে রাজি নয়। তার মনের ইচ্ছেটা বুঝতে সনাতনের দেরি হল না। সাত দিনের মধ্যে বৃন্দাবনে চলে যেতে সে রাজি হয়ে গেল। তার সঙ্গী হবে ছোটভাই রূপ। দু’ভাই-এর বৃন্দাবন যাওয়া শেষপর্যন্ত হল না। সনাতনের প্রায় শুকিয়ে আসা খোসপাঁচড়ায় এক সকালে ভেষজ লাগাতে বসে গোরা বলল, সনাতন, তুমি নিজেকে আমার প্রেমভক্তি প্রচারে দান করেছ, তুমি এখন আমার, রথের চাকার তলায় নিজের একার ইচ্ছেতে তুমি জীবন দিতে পারো না। এটা কেমন কৃষ্ণভজনা?
সনাতন বলল, ক্লেদ, পুঁজ, রক্ত মাখা আমাকে আপনি যখন আলিঙ্গন করেন, ক্ষতে ভেষজ লাগান, আমার ভীষণ লজ্জা করে। মনে হয় মহাপাপ করছি। অপবিত্র করছি আমার দেবতাকে।
সনাতনের পিঠে হাত রেখে গোরা বলল, আমি সন্ন্যাসী, চন্দন আর পাঁক, দুটো আমার কাছে সমান, ঘৃণাবুদ্ধি ধর্মে নেই, তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চন্দনের গন্ধে জুড়িয়ে যায় আমার বুক, আমি ভারী সুখ পাই।
এক মুহূর্ত থেমে গোরা বলল, জগন্নাথদেবের রথের চাকার তলায় তোমাকে প্রাণ দিতে হবে না, এই মুহূর্তে বৃন্দাবনেও যেতে হবে না তোমাদের দু’ভাইকে। আমার ভালর জন্যে তোমাদের যারা এ পরামর্শ দিচ্ছে, তারাও আমার ভক্ত, প্রিয়জন, আমাকে না দেখলে তারা মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে। আপাতত তারা পুরুষোত্তমপুর থেকে তোমাদের সরানো নিয়ে উচ্চবাচ্য করবে না। তোমাদের আমি সময়মতো বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দেব। আমিও যাব সেখানে, থাকব, ব্রজধর্মকে নতুন করে সাজাব। নবদ্বীপ ছেড়ে আসার সময়ে মাকে কথা দিয়েছিলাম পুরুষোত্তমপুরে জগন্নাথদেবের শ্রীচরণ আঁকড়ে পড়ে থাকব। নবদ্বীপের সঙ্গে নীলাচলের নিয়মিত যোগাযোগ, যাতায়াত রয়েছে। সন্ন্যাসী ছেলের খবর নবদ্বীপে মা যেমন পাবে, তেমনি পুরুষোত্তমপুরে ডেরা করলে নবদ্বীপে মা আর তার সংসারের হালচাল জানতে আমার অসুবিধে হবে না। তবে নবদ্বীপে থাকতেই হারিয়ে যাওয়া ব্রজভূমি পুনরুদ্ধারের ইচ্ছে আমার মনে জেগেছিল। ব্রজভূমি আমার পিতৃভূমি, আমার বাপ কৃষ্ণের লীলাভূমি। ধর্মরাজ্যের রাজধানী হিসেবে আদর্শ জায়গা হতে পারে বৃন্দাবন। আমাকে সেখানে যেতেই হবে। নবদ্বীপে জগদানন্দকে পাঠিয়ে খবরটা মাকে শুধু জানিয়ে দিতে হবে।
গোরা থামলেও তার আরও কিছু বলার আছে, বুঝতে পেরে সনাতন দু’হাত জুড়ে বিনীত ভঙ্গিতে চুপ করে বসে থাকল। গোরার মুখে ফুটে উঠছে ভাবাবেশ, স্নিগ্ধ হাসি, পদ্মের কুঁড়ির মতো দু’চোখে আকাশের রহস্যময়তা। গলার স্বর গভীর হয়েছে। গোরা বলল, পুরুষোত্তমপুরের অনেক মানুষ প্রেমভক্তি, সঙ্কীর্তনে আমার পাশে এসে, আমাকে ভালবেসে গলা মেলালেও জন্মভূমি নবদ্বীপ থেকে ফিরে টের পাচ্ছি, উৎকলবাসীদের একাংশ গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পছন্দ করছে না। গৌড়ীয় সবাইকে তারা যবন ভাবছে, সুলতান হোসেন শাহের গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ করছে। গৌড়ের সেনারা তাদের তীর্থস্থান তছনছ করে জগন্নাথদেবের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে গেছে, হাজার হাজার নিরীহ উৎকলবাসী মারা পড়েছে, এ শোক তারা ভুলতে পারছে না। গৌড় শব্দটা তাদের মনে ভয়, ঘৃণা জাগিয়ে তুলছে।
এক মুহূর্ত থেমে গোরা বলল, সনাতন, তোমাকে একটা কথা একান্তে বলে রাখা দরকার, আমার ভক্ত বৈষ্ণবরা সকলে সমান শুদ্ধাচারী নয়। তারা মুখে আমাকে কৃষ্ণাবতার বললেও সবাই বিশ্বাস করে না। ব্রহ্মচর্য পালন করার নাম করে সুন্দরী বিধবার হাত থেকে নিয়মিত ভিক্ষে নেয়, কৃষ্ণপক্ষের রাতে সমুদ্রের ধারে অন্ধকার ঝাউবনে তার সঙ্গে দেখা করে, লোক জানাজানি হয়ে গেছে অনেক ঘটনা। গৌড় থেকে প্রতিবছর যারা জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা দেখতে আসছে, তাদের অনেকে এমন কাণ্ড করে যে জগদানন্দ, দামোদর, গদাধর, গোপীনাথের মতো সাধকভক্তদের মুখ লজ্জায় কালো হয়ে যায়। স্নানযাত্রায় যে তীর্থযাত্রীর ভীড় হয়, সবাই যে গৌড়ীয়, নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কুলীনগ্রাম, শ্রীখণ্ড, ফুলিয়া, কুলিয়া, নবদ্বীপের বাসিন্দা এমন নয়, শৈব, শাক্ত, রামভক্ত তীর্থযাত্রীরাও আসে। আমার কাছেও তারা ভিড় করে। লম্বা রাস্তা পার হয়ে কষ্ট করে তীর্থ করতে এলেও তাদের স্বভাব বদলায় না। তাদের জন্যে গৌড়ের মানুষের নামে কুৎসা, অপবাদ রটে। কৃষ্ণনামে আমি ডুবে থাকলেও এসব খবর আমার কানে আসে। আমার ভাবাবেশ কেটে যায়। রামানন্দ রায় আর বাসুদেব সার্বভৌম না ঠেকালে আমি দু’বছর আগে বৃন্দাবনে চলে যেতাম। আমার স্বপ্নের সেই ব্রজধাম এখন জঙ্গলে ভরে গেছে, জনমানবহীন ভুতুড়ে শহর, তীর্থযাত্রীদের ভীড় নেই, সেখানে যারা আমার সঙ্গী হবে, তারা নিশ্চয় প্রেমভক্তিতে ভেসে গিয়ে বলবে,
ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি।।
(হে জগদীশ্বর আমি ধন, জন, সুন্দরী বা কবিতা কামনা করি না, যেন জন্মে জন্মে তোমার শ্রীচরণে আমার অহৈতুকী ভক্তি থাকে।)
দীপ্যমান আলোর ঢেউ বইছিল গোরার শরীরে। ভাগবত আর প্রেমভক্তি নিয়ে গোরার কাছ থেকে গত কয়েক মাসে সনাতন, রূপ নানা ব্যাখ্যা শুনলেও একান্তে বলবে, সনাতন ভাবেনি। গোরা বলল, আমায় সবচেয়ে বড়ো আঘাত দিয়েছে আমার পরম স্নেহের ছোট হরিদাস। শিখি মাহিতির বাড়ি থেকে রোজ একমুঠো চাল আনার বদলে সে পালঙ্কপোখরের পাশে এক বাড়ির তরুণী বিধবার কাছ থেকে সবচেয়ে ভালো জাতের ভিক্ষান্ন, যা থেকে ধবধবে সাদা যুঁইফুলের মতো ভাত হয়, খাওয়াত আমাকে, নিজেও খেত। ভাত দেখে আমার সন্দেহ হলেও খেয়ে নিতাম। কয়েকদিন পর থেকে আমার শরীরে জ্বালা শুরু হল। শরীরের চামড়া, মাংস যেন খসে পড়ছে, রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে। দামোদরকে ঘটনাটা বলতে সে আসল খবরটা নিয়ে এল। ছোট হরিদাসের মুখ দেখা বন্ধ করে দিলাম। সঙ্কীর্তনের আসরে তাকে আর ঢুকতে দেওয়া হয় না। ছোট হরিদাস একা কেন, মাধুকরী ব্রতধারী আরও কয়েকজন বৈষ্ণব ব্রক্ষ্মচারীর চালচলনে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের দুর্নাম রটছে। বৈষ্ণব প্রেমভক্তির গায়ে কলঙ্ক লাগছে। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে আমার বাপ কৃষ্ণ। আমার ধর্মরাজ্যের স্বপ্ন কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে? আর কিছু ঘটনা আছে। রাজপরিবারে কেউ কেউ পুরুষোত্তমপুর থেকে বৌদ্ধদের সঙ্গে বৈষুবদের ভাগাতে তুচ্ছ ঘটনাকে সাতকাহন করে উৎকলবাসীদের কাছে প্রচার করছে। গৌড়ীয়দের গায়ে তারা সুলতানী গুপ্তচরের মোহর লাগিয়ে দিয়েছে।
পুরুষোত্তমপুরের ইষ্টদেব জগন্নাথের কাছাকাছি থেকেও প্রেমভক্তিতে গোরা ডুবে নেই, তার কথা শুনে সনাতন টের পাচ্ছিল। ঈশ্বরপ্রতিম মানুষটার মনে অশান্তি জমতে কষ্ট পাচ্ছিল সনাতন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেল, যখন শুনল গোরার পাঁচ ওড়িয়া ভক্ত অনন্ত, অচ্যুত, যশোবন্ত, বলরাম, জগন্নাথ, পুরুষোত্তমপুরে যাদের সকলে গোরার ‘পঞ্চসখা’ নামে চেনে, গোরার প্রতিপক্ষ তাদের দলে টানার চেষ্টা করছে। পাঁচ সখার মধ্যে গোরা সবচেয়ে অন্তরঙ্গ, পরমভাগবত জগন্নাথ দাসকে গোরার চেয়ে বড়ো কৃষ্ণভক্ত প্রচার করে তারা প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় তারা নামাতে চায়। কিছুটা সফল হয়েছে তারা। গোরার সঙ্গে জগন্নাথের দূরত্ব তৈরি করতে এমন এক কূট চাল চেলেছিল, যা গোরার কানে যাওয়ার পরে জগন্নাথের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করে দিয়েছিল। রাজপ্রাসাদের মেয়েদের ভাগবদ শোনাতে জগন্নাথকে মেয়ে সাজিয়ে প্রাসাদের অন্দরমহলে যারা পাঠাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল রাণী বসুমতী আর গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই। রাজপ্রাসাদের নানা মহলে বারো মাস, তিনশো পঁয়ষটি দিন কিছু না কিছু চক্রান্ত চলে। অল্প কয়েকটা জানা যায়, বেশিটা চাপা থাকে। মেয়েবেশী জগন্নাথের পরিচয় গোপন থাকেনি। তাকে ছদ্মবেশে যারা পাঠিয়েছিল, সম্ভবত তারা ফাঁস করে দিয়েছিল তার পরিচয়। তাদের মতলব ছিল, ঘটনাটা নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে হৈহৈ হোক, জগন্নাথ দাসের লাম্পট্যের খবর গোরার কানে পৌঁছোক। তারা যা চেয়েছিল, তাই ঘটল। যে পাঁচ সখাকে উৎকলের বৈষ্ণবকুলের ‘অতিবড়’ সম্প্রদায় নামে গোরা শিরোপা দিয়েছিল, তাদের প্রধান, জগন্নাথ যে স্ত্রীসঙ্গলোভী, নকল ভাগবত, এই তথ্য জেনে গোরা মর্মাহত হয়েছিল। তাদের সঙ্গে গোরা দূরত্ব তৈরি করলেও তার ওপর জগন্নাথ সমেত পাঁচজনের ভক্তি অবিচল ছিল। গোরার দেওয়া ‘অতিবড়’ বিশেষণের জোরে তারা নীলাচল জুড়ে যে মর্যাদা পেয়েছে, সেজন্যে তারা শুধু কৃতজ্ঞ নয়, আমৃত্যু গৌড়ের সন্ন্যাসীর কাছে ঋণী ভাবত নিজেদের। তাছাড়া ভাগবতপাঠক জগন্নাথ বৈষ্ণব হলেও, ব্যক্তিজীবনে সে ছিল সংসারী, গৃহী। তাদের কেউ সাধক, ব্রষ্মচারী ছিল না। রাজবাড়ির মেয়েমহলে মেয়ে সেজে ভাগবত পাঠ শোনাতে যাওয়া অপরাধ, এমন চিন্তা জগন্নাথ দাসের মাথায় আসেনি। রামানন্দ রায়ের লেখা নাটকে একাধিকবার স্ত্রীচরিত্রে সে অভিনয় করেছে। রাজবাড়ির মেয়েরা অভিভূত হয়েছে তার অভিনয় দেখে। সরল, নিরীহ জগন্নাথ স্বপ্নেও ভাবেনি, তাকে এক চক্রান্তে জড়ানো হয়েছে। গোরা দেখা না করায় সে ভেঙে পড়েছিল। জগন্নাথের ভাগবতপাঠের মুগ্ধ শ্রোতা ছিল গোরা। তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে যেতে গোরাও কেঁদেছিল। নানাভাবে গোরার অনুকম্পা ভিক্ষে করছিল জগন্নাথ গোরার ঘরের দরজা তার জন্যে বন্ধ হয়ে গেলেও ‘অতিবড়’ সম্প্রদায়ের অন্য চারজন, অনন্ত, অচ্যুত, যশোবন্ত, বলরাম যে নির্দোষ, তারা কোনও অপরাধ করেনি, তারা যেন শাস্তি না পায়, এমন আবেদন দামোদর, জগদানন্দের সূত্রে বারবার গোরার কাছে তারা পাঠাচ্ছিল। গোরা সাড়া দেয়নি। ছোট হরিদাসকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা তার মনে পড়েছিল। সে এখন কোথায়, কি করছে, প্রশ্নটা মনে জাগতে কৃষ্ণনামে গোরা ডুবে যেতে চাইল। ছোট হরিদাসকে তার কৃতকর্মের জন্যে যখন প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে, তখন ‘অতিবড়দের কাছে টেনে নিলে সন্ন্যাসব্রত ভঙ্গ করা হয়। একই অপরাধের জন্যে দু’ধরনের দণ্ড দেওয়া যায় না। জগন্নাথের জন্যে তার নির্দোষ চার সঙ্গীকে দূরে ঠেলে দেওয়া সুবিচার নয়, এটাও সে অনুভব করতে পারছে। তারা কোনও অপরাধ করেনি। গৃহী হয়েও তারা ভক্ত বৈষ্ণব, খোল, করতাল, মন্দিরা, মৃদঙ্গ বাজানোয় যেমন ওস্তাদ, কীর্তনের গলাও তেমন সুরেলা। তাদের কেন দূরে ঠেলে রাখবে? জগন্নাথের চার সঙ্গীর জন্যে গম্ভীরার দরজা খুলে দিলে কিছুদিন পরে জগন্নাথকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্যে তারা তদ্বির করবে। ছোট হরিদাসের অপরাধ মাপ করে দেওয়ার জন্যে জগদানন্দ, দামোদর, গদাধর, এমনকি পরমানন্দ পুরী পর্যন্ত তার কাছে ধরনা দিয়েছিল। তাদের অনুরোধ রাখতে না পেরে পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে সে আলালনাথে গিয়ে থাকার তোড়জোড় শুরু করেছিল। পরমানন্দ পুরী আটকেছিল তাকে।
পুরুষোত্তমপুর থেকে গৌড়ীয় হঠানোর আওয়াজ যখন সশব্দে আর নীরবে ওড়িয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আরও এক জিগির কিছু রাজকর্মচারীর উদ্যোগে সাধারণ মানুষের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। গৌড়ের সন্ন্যাসী, গোরার চেয়ে উৎকলের পরমভাগবত জগন্নাথ যে উঁচু মাপের সাধক, এ প্রচার তারা শুরু করে দিয়েছিল। উৎকলের সিংহাসন নিয়ে তখন শুরু হয়েছে জটিল কূটনীতি। গোরার ভক্ত, ছিল স্বয়ং রাজা প্রতাপরুদ্র, রাজকর্মচারী রামানন্দ রায়, আরো কয়েকজন রাজার বিশ্বস্ত মন্ত্রী, অমাত্য। গোরা আর তার ভক্তদের তারা ছিল শুভাকাঙ্ক্ষী। পাশাপাশি রাজসভাতে গোরার প্রতিপক্ষ ভোইপরিবারের প্রভাবের বলয় বাড়ছিল। রাজকীয় প্রশাসনে ক্ষমতার কাছাকাছি চলে আসছিল তারা। সিংহাসনে প্রতাপরুদ্র থাকলেও তার রাজসিক প্রভাবের তেজ কমছিল। রাজশক্তির প্রভাবশালী অংশকে বশে এনে ক্ষমতার বৃত্ত শক্ত করে সিংহাসনে থাবা বসাতে গোবিন্দ বিদ্যাধরভোই সব আয়োজন প্ৰায় সেরে ফেলেছিল। উৎকলের রাজপ্রাসাদে যেমন কলহ, চক্রান্ত লেগেছিল, প্রাসাদের বাইরে যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি সাময়িক থামলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। বিজয়নগর রাজ্যের সঙ্গে উৎকলের বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরির পরে প্রথম দু’বছর দু’রাজবংশের মধ্যে যে প্রীতি আর শান্তি বজায় ছিল, কোণ্ডবীড়ু দণ্ডপাটের অধীশ্বর, উৎকলের রাজপুত্র বীরভদ্রের রহস্যময় মৃত্যুতে সেখানে চিড় ধরল। বীরভদ্র শুধু রাজা প্রতাপরুদ্রের ছেলে নয়, সে ছিল বিজয়নগর রাজ্যের জামাই, প্রতাপরুদ্রের পছন্দ করা উৎকলের ভাবী অধিপতি। বিজয়নগরের রাজা, কৃষ্ণদেব রায়, নিজের মেয়ে চন্দ্রাবলীর সঙ্গে বীরভদ্রের বিয়ে দিয়ে তাকে কোণ্ডবীড়ু দণ্ডপাট যৌতুক দিয়েছিল, বীরভদ্রকে ঘরজামাই করে রাখলেও সে উৎকল রাজ্যের অধীশ্বর হতে চলেছে, কৃষ্ণদেব জানত। উদয়গিরি দুর্গ সমেত কোণ্ডবীডু দণ্ডপাট ছিল উৎকল রাজ্যে অংশ। রাজা কৃষ্ণদেব দখল করেছিল সেই জনপদ। কিছুকালের জন্যে দু’রাজ্যের মধ্যে হানাহানি, রক্তপাত থামলেও তা বেশিদিন বজায় থাকল না। কটকের রাজপ্রাসাদের চক্রান্তে জামাই বীরভদ্রের দেহান্ত ঘটেছে, এই অভিযোগ এনে বিধবা রাজকন্যা চন্দ্রাবলীকে কোণ্ডবীডু থেকে বাদামীর রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেল কৃষ্ণদেব। কোণ্ডবীডু দণ্ডপাটেরও দখল নিল। কটক রাজপ্রাসাদের চক্রান্তে প্রিয় সন্তান বীরভদ্রের জীবন গেছে, রাজা কৃষ্ণদেবের এই অভিযোগ কাল্পনিক নয়, উৎকল অধিপতি প্রতাপরুদ্র তা ভাল জানত। চক্রীদের চিনতে তার অসুবিধে হয়নি। তবু গজপতি রাজবংশের বিধবা বধূকে, তার শ্বশুর, শাশুড়ির সঙ্গে কথা না বলে, যথাযথ লৌকিকতা না করে তার বাবা, রাজা কৃষ্ণদেব একতরফাভাবে নিজের ইচ্ছেতে বাদামী নিয়ে যাওয়ায় প্রতাপরুদ্রের আত্মমর্যাদায় ঘা লাগল। সবচেয়ে বেশি প্রতাপরুদ্র অপমানিত হল, রাজা কৃষ্ণদেবের ফৌজি আগ্রাসনে। উৎকলের অবিচ্ছেদ্য অংশ কোণ্ডবীডু দখল করে নিজের রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে নিল কৃষ্ণদেব। কোণ্ডবীড়ু উদ্ধার করে নিজের মর্যাদা বাঁচানোর যুদ্ধে প্রতাপরুদ্র জড়িয়ে পড়েছিল। নিষ্ফল যুদ্ধ চলছিল। কোণ্ডবীডু উদ্ধারের চেয়ে রাজপরিবারে শান্তি বাঁচাতে প্রতাপরুদ্রের কালঘাম ছুটে যাচ্ছিল। সাতাশ জন ছেলের বাবা হওয়ায় প্রতাপরুদ্রের সিংহাসনের দিকে সাতাশ জোড়া চোখ নজর করছিল। উৎকলের যোগ্য শাসক হিসেবে যে বীরভদ্রকে প্রতাপরুদ্র গড়েপিটে সামনে এনেছিল, পৃথিবী ছেড়ে অকালে সে চলে যেতে উৎকল রাজ্যের ভবিষ্যৎ ভেবে রাজা দিশেহারা হয়ে গেল। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে ছাব্বিশটা ছেলের মধ্যে খুনোখুনি লেগে যাবে, প্রতাপরুদ্রের অজানা ছিল না। ছাব্বিশ জোড়া চোখের চেয়ে খরতর আরও এক জোড়া চোখের দৃষ্টি, যা কিনা শকুনের নজরের চেয়ে বেশি তীক্ষ্ণ, ধারালো ঠোঁটে ছাব্বিশ জোড়া চোখ খুবলে নিতে পারে, সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সে গোবিন্দ বিদ্যাধর, ওৎ পেতে বসে আছে সে, মোক্ষম সময়ের জন্যে অপেক্ষা করছে, ভাল করে জানে উৎকল অধিপতি প্রতাপরুদ্র নিজে। সম্পর্কে সে শ্যালক, রাজসভার মন্ত্রী, সেখানে শেষ নয়। গৌড়ের সুলতানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতে গোবিন্দ বিদ্যাধরকে গড়মান্দারণ সমেত মেদিনীপুর মহলের শাসনকর্তা করতে প্রতাপরুদ্র বাধ্য হয়েছে। গোবিন্দর বাড়বাড়ন্তের উৎস উৎকল রাজপ্রাসাদের রাজার সবচেয়ে প্রিয় মহিষী বসুমতী, যার কোনও সন্তান নেই, মাঝত্রিশে পৌঁছেও যে শুধু অষ্টাদশীর মতো শরীরী বৈভবে রূপবতী নয়, নাচ, গান, হাস্য লাস্য কটাক্ষে মন্দিরের বড়শৃঙ্গারের সেরা ‘ভিতরগায়নী’ দেবদাসী, যে মাঝরাতে জগন্নাথের বিছানায় গিয়ে তাকে শৃঙ্গার রসের গান শোনায়, যার শরীরের অনাবৃত ওপরের অংশ কুঙ্কুম, চন্দনে অলঙ্কৃত, কোমরে জড়ানো থাকে গীতগোবিন্দ কাব্যের মধুর রসের শ্লোক লেখা একটুকরো বসন, তাকেও রানী বসুমতী টেক্কা দিতে পারে। বসুমতীর ওপর রাজার দুর্বলতার অগাধ সুযোগ নিয়ে রাজপ্রশাসনের দণ্ডমুণ্ডের অর্ধেক কর্তা হয়ে উঠেছে গোবিন্দ ভোই। তাকে দেখলে উৎকলরাজের মাঝেমাঝে গা ছমছম করে। বীরভদ্রকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে আড়াল থেকে বিদ্যাধর কলকাঠি নেড়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সিংহাসন দখল করতে জীবিত ছাব্বিশজনকে সে অনায়াসে কচুকাটা করতে পারে। তখনও দাদার পাশে থাকবে সন্তানহীন রানী বসুমতী। দাদা, বোন মিলে গৌড়ের সন্ন্যাসী, যাকে সবাই গোরা বলে, তাকে পুরুষোত্তমপুর থেকে তাড়াতে চাইছে। গোরার ভক্তদের চোর, বাটপাড়, যবন, ম্লেচ্ছ, বারাঙ্গনাগামী অপবাদ দিয়ে তলে তলে এমন প্রচার শুরু করেছে যে, উৎকলের কিছু মানুষ তারিয়ে তারিয়ে সেই অপযশ উপভোগ করছে। খেপে উঠছে অনেকে।
অতিবড় সম্প্রদায়ের পাঁচবন্ধুর সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক চুকে যেতে গোরা কতটা কষ্ট পেয়েছে, সনাতনের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কৃষ্ণপ্রেমী এই মানুষটা সব কৃষ্ণপ্রেমীকে কৃষ্ণ ভেবে বুকে টেনে নেয়, সত্যযুগ গড়ার কারিগরের মর্যাদা দিয়ে বিনয়ে অবনত হয়ে পড়ে। তাদের কারো চালচলনে সন্ন্যাসধর্মে আঘাত লাগলে চরম যন্ত্রণায় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। দু’চোখে জল নিয়ে তখন শুধু নামজপ, ভাগবদপাঠ আর সঙ্কীর্তনে ডুবে থাকে। সনাতনের শরীরে ভেষজ লাগানোর সঙ্গে অতিবড় সম্প্রদায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার বৃত্তান্ত শুনিয়ে গোরা থেমে গিয়েছিল। উৎকলের রাজা প্রতাপরুদ্র, তার রাজপ্রাসাদের কোঁদল, জটিলতা, রাজকুমার বীরভদ্রের মৃত্যু, বিজয়নগর রাজ্যের সঙ্গে উৎকলের সম্পর্কের তিক্ততা, যুদ্ধবিগ্রহ প্রসঙ্গে একটা শব্দ গোরা উচ্চারণ করেনি। রাজা, রাজপরিবার, বৈষয়িক কোনকিছুতে তার আগ্রহ না থাকলেও রাজসরকারে চাকরি করে যেসব ভক্ত, যেমন রামানন্দ রায়, কাশী মিশ্র, শিখি মাহিতি, কানাই খুন্তিয়া, সবার ওপরে বাসুদেব সার্বভৌম, তারা কৃষ্ণপ্রেমী হলেও মাঝেমাঝে রাজ্যপাট, বিষয়-আশয়, সাংসারিক প্রসঙ্গে কথা বললে গোরাকে শুনতে হত। কানে আঙুল গুঁজে সবসময়ে সে নামজপ করত না। ভাবাবেশে দিনে, রাতে সারাক্ষণ বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাবার মানুষ সে ছিল না। ধুলোমাটি থেকে উঠে আসা চোখ-কান খোলা সজাগ সন্ন্যাসী ছিল সে। বীরভদ্রের মৃত্যুতে রাজপরিবারে, অশান্তির ঝড় বইছে, কাশী মিশ্রের কথা থেকে টের পেয়েছিল। দাক্ষিণাত্য পরিব্রাজনের সময়ে দুই রাজপরিবারের মধ্যে সৌহার্দ্যের সেতু গড়তে যে সহযোগিতা সে করেছিল, তা যে এভাবে ভেঙে পড়তে পারে সে কল্পনা করেনি। দু’বার বিয়ে করে সংসারে থাকলেও প্রকৃত বৈষয়িক গৃহী সে হতে পারেনি, হওয়ার চিন্তা মাথায় আসেনি। সন্তানহারা প্রতাপরুদ্রের জন্যে মনের মধ্যে নিশ্চুপ করুণা নিয়ে শুধু ভেবেছে দুই রাজপরিবারের মধ্যে দৌত্যের কাজ করা সন্ন্যাসীর মানায় না। ব্রতভঙ্গ হয় কি? রাজপুরুষদের সঙ্গে মেলামেশায় ভবিষ্যতে সাবধান হবে। বীরভদ্রকে হারিয়ে প্রতাপরুদ্র ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল। রাজদর্শনকে সন্ন্যাসধর্মের বিরোধী বিবেচনা করে প্রতাপরুদ্রর সঙ্গে যে গোরা আগে কখনও দেখা করেনি, পৃথিবী ছেড়ে বীরভদ্র চলে যাওয়ার পরে প্রথম তার মুখোমুখি হল। ছেলের শোকে কাতর হলেও সে প্রসঙ্গে গোরাকে রাজা একটা কথা বলেনি, গোরার সাধনভজনে কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা, কিভাবে তাকে রাজা সাহায্য করতে পারে, জানতে চেয়েছিল। গোরা হেসেছিল, বলেছিল কৃষ্ণনাম জপ, বৈষ্ণব-সেবা করলে আমি কৃতার্থ হব।
গোরার দুটো নির্দেশ রাজা মেনে নিয়েছিল। গম্ভীরায় রাজার সঙ্গে এসেছিল রামানন্দ রায়, কাশী মিশ্র। গোরাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে মাঝেমাঝে তার কাছে আসার অনুমতি চেয়েছিল রাজা। গোরা ‘না’ করেনি। সে অনুভব করছিল, রাজকাজে, বৈষয়িক জীবনে রাজার দুর্ভোগ যত বাড়বে, তত তার কাছে ঘনঘন যাতায়াত করবে রাজা। বাস্তবে তাই ঘটল। গোরার কাছে রাজার খাতায়াত বাড়তে কটকের রাজপুরীতে চঞ্চলতা বাড়ল। পুরুষোত্তমপুরের মানুষের এ ঘটনা নজর এড়াল না। রাজা ভাবছিল উৎকল রাজ্যকে ছাব্বিশ দণ্ডপাটে ভাগ করে ছাব্বিশজন ছেলেকে উত্তরাধিকার দিয়ে লিখিত দানপত্র রেখে যাবে। রামানন্দ রায় ছাড়া এই ইচ্ছেটা রাজা কাউকে না জানালেও রামানন্দর কথাতে গোরা এরকম আভাস পেয়েছিল। কৃষ্ণপ্রেমে মেতে থাকলেও উৎকল, বিজয়নগর, আর্যাবর্তের যুদ্ধবিগ্রহ, রাজা, নবাবদের কূটনীতির নানা খবর কি তার কানে যেত না? যেত। কিছু শুনত, সব শুনত না। মাথার মধ্যে ঘুরে-ফিরে আসত জন্মভূমি নবদ্বীপ, সেই সব স্নানের ঘাট, গঙ্গার দু’তীরের মানুষ, যাদের সে ভোলেনি। তাদের কাছে তার কিছু দায় আছে। সন্ন্যাস নেওয়ার রাতে বিদ্যাবাচস্পতির ঘরে যে রাজপুরুষদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সত্যযুগ প্রতিষ্ঠায় তাকে যারা অধিনেতাপদে বরণ করতে চেয়েছিল, তাদের কিভাবে সে ভুলতে পারে? নিজের বদলে নিতাইকে তাদের সামনে এগিয়ে দিয়েছিল।.. সসম্মানে নিতাইকে সর্বাধিনায়ক মেনে নিয়েছিল তারা। প্রেমভক্তি প্রচারে গঙ্গার দু’ধারে জনজোয়ার তুলেছে নিতাই। পাশাপাশি সেই রাজপুরুষরা সত্যযুগ গড়ার কাজে নিতাই-এর সঙ্গে কতটা এগিয়েছে সে জানে না। নিতাই-এর প্রচারের সঙ্গে রাজপুরুষদের সেনাবাহিনী কোন যৌথ কর্মসূচি নিতে পারে? শিখপন্থায় গুরু নানক যে কর্মসূচি নিয়েছে, নিতাই সে পথে হাঁটতে রাজি হবে না। তাহলে? গোরার ভাবনা এরকম এক বদ্ধতায় এসে ঠেকলে নামজপে সে ডুবে যায়। ‘হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ দেখা দাও, পথ দেখাও’ বলে নিঃশব্দে গোঙাতে থাকে। তখন পাশে কেউ থাকে না। গম্ভীরার দরজায় বাইরে কাছাকাছি কোথাও গোবিন্দ থাকে। গোরার ওপর নজর রাখে, তার দরকার-অদরকার চোখে দেখে টের পায়, ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়, গোরা কখনও তাকে ডেকে ফরমাস করে না। দরজার পাশে এসে সে বসলে তার সঙ্গে গোরা গল্প করে। জাতে গোবিন্দ শূদ্র। দশবছর ঈশ্বরপুরীর সেবা করেছে। ঈশ্বরপুরীর সেবা করে শিখে গেছে বৈষ্ণব আচরণ কাকে বলে, বৈষুব অপরাধই বা কি? সরল, নিরীহ মানুষ গোবিন্দ। কম কথা বলে। গোরার সামনে মুখ খুললে প্রাণের কথা উজাড় করে দেয়। বৈষ্ণব তবু প্রেমধর্মের বিষয়ে সে বিশেষ কিছু না জানলেও সহজ, সাধারণ মানুষের জীবনের কাহিনী তার স্মৃতির ভাঁড়ারে কম নেই। তার জীবনের নানা বৃত্তান্ত শুনে গোরার মনে হয়, এমন একজন ভুয়োদর্শী সেবক পাওয়া ভাগ্যের কথা। তার সঙ্গে যেমন খোশমেজাজে গল্প করা যায়, তেমনি নামজপে ডুবে যেতে অসুবিধে হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে সামান্য শব্দ করে না। গোবিন্দকে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে হয়, মনে হয়, সে-ও এক সন্ন্যাসী, প্রাণ খুলে তার সঙ্গে কথা বলা যায়। ওড়িয়া ভাষাতে দু’জন যখন কথা বলে, দু’জনকে ওড়িয়া মনে হয়। দু’জনের কেউ আজও কারো জাতি পরিচয় জানতে চায়নি।
উৎকলের পুবদক্ষিণে যারা থাকে, সবাই গৌড়ীয়, সুলতানী শাসনে তারা জাতধর্ম খুইয়ে সবাই যবন হয়ে গেছে, উৎকলের মানুষের মনে এমন ধারণা গেঁথে গেছে। গোরা আর তার ভক্তদের দেখে সে ধারণা অনেকটা পাল্টে গেলেও কিছুদিনের জন্যে সে পুরুষোত্তমপুরের বাইরে থাকায় সম্পর্কের জল আবার ঘোলা হয়েছে। ছোট হরিদাস আর তার মতো কয়েকজনের স্ত্রীলুব্ধতা এর একমাত্র কারণ নয়, গৌড়ীয়দের অনেকে বৈষ্ণব হলেও গৌড়ের মানুষ হিসেবে মনে চাপা গুমোর নিয়ে ওড়িয়াদের সঙ্গে মেলামেশা করে। কীসের গুমোর? গৌড় হল এমন একটা বীর জাতির দেশ, যারা অনায়াসে উৎকল জয় করে নিতে পারে, ইচ্ছে করলেই লুট করে নিয়ে যেতে পারে উৎকলের সোনাদানা সম্পদ। নিজেদের গৌড়ীয় পরিচয় দিয়ে জাত্যভিমানের যে সুখ তাদের মুখ, চোখে ভেসে ওঠে সাধারণ, সরল ওড়িয়াদের গায়ে তা জ্বালা ধরায়। গৌড়ের যে মানুষ কখনও রাজধানী একডালায় যায়নি, সে যখন নিজের রাজ্যের রাজধানীর বিশালতা, সাজসজ্জা, জাঁকজমকের বিবরণ একজন ওড়িয়াকে শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়ে বলে, গৌড়ের মতো দেশ, একডালার মতো রাজধানী, ভূভারতে কোথাও নেই, তখন শ্রোতা প্ররোচিত হয়। গৌড়ের মানুষের গুমোর ভাঙতে নিজেরা জোট বাঁধে। গৌড়ীয় পরিচয় যে ক্রমশ ঘাড়ের ওপর চেপেবসা দমবন্ধ করা পাহাড়ের চেহারা নিচ্ছে, গোরা বুঝতে পারে। গৌড়ীয়র বদলে নতুন এক আত্মপরিচয় তৈরি না করলে শুধু উৎকল কেন, নবদ্বীপ ছেড়ে প্রেমধর্মের গান বেশি দূর এগোতে পারবে না। সত্যযুগ প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্পও নবদ্বীপ, সুক্ষ্ম, সমতট, বরেন্দ্র, সপ্তগ্রাম, হরিকেলে আটকে থাকবে। খুব বেশি চন্দ্রদ্বীপ, মল্লভূমি মেনে নিতে পারে সত্যযুগের ডাক। গৌড়ের মানুষ না হয়েও নিজের দেশের বাইরে তাদের পরিচয় গৌড়ীয়। বজ্রভূমি, তাম্রলিপ্ত, জ্যোতিষপুরের সাধারণ মানুষ জানে না কোথায় গৌড় আর কোথায় পদ্মাপারে হরিকেল শ্রীহট্ট, যাকে অনেকে ‘বঙ্গাল’ বলে। নিজের গ্রামের নামের বাইরে আর কিছু জানা দরকার, তারা মনে করে না। নিজেদের গৌড়ীয় পরিচয় দিতে অভিজাত, ধনীরা গর্ববোধ করে। গৌড় দেশই ছোটখাটো এলাকা নয়, বহুবছর ধরে রাজাদের হাতে গড়া শহর। সেখানে সবকিছু রাজকীয়, উঁচু মাপের, মামুলি লোকের সেখানে থাকার যোগ্য নয়। গৌড়ের পাশে ছিল লক্ষ্মণাবতী শহর, সেন রাজাদের রাজধানী, গৌড়ের চেয়ে সেখানে আরও বেশি ছিল নজরকাড়া জাঁকজমক। বিত্তবান মানুষরা তখন বলত আমরা কোথায় থাকি জানো? সে নগরের নাম লক্ষ্মণাবতী। সেখানের ঠাটবাট দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। বড় ধাম, ভারী নাম উচ্চারণ করতে মুখ্যুদের দাঁত ভেঙে যায়, তারা বলে লখনৌতি।
সেখানে সুলতানী আক্রমণের পরে তাদের যাওয়া আসা কমেছে। গোরার টানে নবদ্বীপ আর গঙ্গার দু’তীরের গাঁয়ের সাধারণ তীর্থযাত্রীদের ভিড় বেড়েছে। তাদের বেশিরভাগ সুভদ্র হলেও বাগাড়ম্বরে ওস্তাদ এমন কিছু মানুষও সেই ভিড়ে আছে। পুরুষোত্তমপুরের দোকান বাজারে, গৌড়ীয়দের পাড়া, বালীশাহি, ঘনামল্লশাহিতে ভেসে বেড়ানো গৌড়ীয়দের গর্বিত ফুৎকার গোটা নীলাচলের সঙ্গে জাজপুর, কটকে যা আগে কখনও সখনও শোনা যেত, এখন তা চব্বিশ ঘণ্টা শোনা যায়। এক দঙ্গল পাল্কি, ডুলি সাজিয়ে আগে যেসব মহলদার, জমিদাররা গুরুষোত্তমপুরে তীর্থ করতে আসত, তাদের তৈরি গল্পগুলো এখন ছাপোষা তীর্থযাত্রী বলতে শুরু করেছে। গোরার জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে, তার ভক্ত, অনুগামী সেজে গৌড়ের দেড়-দু’শো মাইল দক্ষিণ, পুব থেকে যারা পুরুষোত্তমপুরে আসে, তারাও নিজেদের গৌড়ীয় হিসেবে পরিচয় দেয়।
বৈষ্ণবসমাজ থেকে ছোট হরিদাসকে যত সহজে গোরা সরিয়ে দিতে পেরেছিল, অতিবড় সম্প্রদায়ের পাঁচবন্ধুকে সেভাবে এড়াতে পারল না। মেয়ে সেজে রাজপরিবারের রাজকন্যা, মহিষীদের ভাগবত পড়ে শোনোনোয় গোবিন্দ বিদ্যাধরের অনুগত ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী কোনও খুঁত খুঁজে পেল না। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা গৃহজীবনের নিয়মের চেয়ে সন্ন্যাসীর বিধিনিষেধ অনেক কঠিন জেনেও তারা গোরাকে ভণ্ড, অহংকারী গৌড়ীয় সন্ন্যাসী হিসেবে প্রচার শুরু করল। জগন্নাথকে গম্ভীরায় গোবিন্দ ঢুকতে না দিলেও অন্য চার বন্ধু বলরাম, অচ্যুতানন্দ, যশোবন্ত, অনন্তকে ঠেকাতে পারল না। গোরাকে ভক্তিতে ভাসিয়ে দেওয়ার সঙ্গে তাকে তারা ভালবেসে ফেলেছিল। জগন্নাথও গোরার কম অনুরাগী ছিল না। তার মুখ গোরা দেখতে চায় না জেনেও বুদ্ধের অবতার গোরার ওপর ভক্তি তার এক তিল কমেনি। অতিবড় সম্প্রদায়ের পাঁচজনই বৌদ্ধ থেকে হিন্দুধর্মে ফিরে এসে জগন্নাথকে বুদ্ধের অবতার ভেবে পুজো করত। পরে তারা গোরার শরণাগত হয়, তাকে বুদ্ধের সঙ্গে জগন্নাথের অবতার হিসেবে সমান মর্যাদায় পূজ্য করে তোলে। রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের ধারে ঝাউবনে, যেখানে প্রায়ই গোরা জপে বসত, সেখানে কাছাকাছি কোথাও গা ঢেকে ছোট হরিদাস যেভাবে তাকে কীর্তন শোনাত, সেভাবে ভোররাতে গম্ভীরার অন্ধকার বাগানে নিজেকে লুকিয়ে রেখে বুদ্ধের অবতারকে ভাগবত পড়ে শোনাত জগন্নাথ। দুই ভক্তের কীর্তন, কান্না শুনে হুহু করত গোরার বুক, চোখে জল আসত। দু’জনকে কাছে ডেকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সন্ন্যাসের কঠোর ব্রত মেনে আবেগ সামলে রাখত। গোরার ভক্ত জগন্নাথ লজ্জায় দূরে সরে থাকলেও তাকে গোরার চেয়ে বড়ো সাধক প্রমাণ করতে বিদ্যাধর-অনুগামীরা নতুন একটা ফাঁদ পাততে শুরু করল। গোপনে, অত্যন্ত সন্তর্পণে শুরু করল সেই কাজ। বিজাপুর, আহম্মদনগর, গোলকুণ্ডা আর বিদরে মিলিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়নগরের রাজা হেরে গিয়ে তখন জঙ্গলে পালিয়েছে। উদয়পুর দুর্গ সমেত উৎকল কোণ্ডবীড়ু মণ্ডল এই সুযোগে নতুন করে দখল নেওয়ায় প্রতাপরুদ্র যে সেনা সাজাচ্ছে, গোবিন্দ বিদ্যাধর তখন সেই ছক পাল্টে দিতে গোপনে রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করল। জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকলেও কৃষ্ণদেব জানত উৎকলের ভাবী অধিপতি হতে চলেছে গোবিন্দ বিদ্যাধর। ভোই বংশ উৎকলে গজপতি রাজবংশের চেয়ে কম শক্তিধর নয়। বিদ্যাধরের সঙ্গে মৈত্রী ঘটলে হারানো রাজ্য উদ্ধারে বেশি সুবিধে হবে, কৃষ্ণদেব জানত। গজপতি বংশের মতো ভোই বংশের সঙ্গে কৃষ্ণদেবের পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। কৃষ্ণদেবের দুর্দিনে তার পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে গোবিন্দ বিদ্যাধর দাঁড়াতে দু’জনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। উদয়গিরি কোণ্ডবীডু দুর্গ দখলে রাজা প্রতাপরুদ্রকে ঠুটো জগন্নাথ করার দায়িত্ব যে শুধু গোবিন্দ বিদ্যাধর নিল, তাই নয়, রাজধানী বাদামী উদ্ধারে উৎকল সেনাবাহিনীকে বিজয়নগরের সেনাদলের পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। রাজ্যের সীমান্ত বাড়ানোর মতলবে সুলতান হোসেন শাহের পরামর্শও গোবিন্দ বিদ্যাধরকে চাঙ্গা করেছিল। জট পাকাচ্ছিল, বেশ বড়রকম জট যা পুরুষোত্তমপুর থেকে গৌড়ীয়দের তাড়াতে তুমুল ঝড় তুলতে চলেছে। ঝড়ের উপকরণ জড়ো হচ্ছিল। গৌড়ীয়দের সম্পর্কে ঘৃণা, বিদ্বেষ বাড়ার সঙ্গে উৎকলে তাজা বারুদের মতো যে খবর কয়েকজন গুপ্তজচর এনে হাজির করেছিল, তা হল গৌড় দরবারের দু’জন মন্ত্ৰী, পুরুষোত্তমপুরে নাম ভাঁড়িয়ে লুকিয়ে আছে। উত্তেজনা ছড়াল এই গুজব, প্রচার হতে থাকল আর এক দফা উৎকল আক্রমণ, মন্দির লুঠপাট করার আগে রাজ্যের কোষাগার আর সেনাদলের খবরাখবর জোগাড় করতে দুই মন্ত্রীকে পাঠিয়েছে সুলতান। খবরটা পুরুষোত্তমপুরের রটলেও গোরার কানে পৌঁছোতে কয়েকদিন লাগল। স্বরূপের সঙ্গে গৌড়ীয়দের জন্যে আলাদা পরিচয় খুঁজতে গোরা তখন ব্যস্ত হয়েছিল। গৌড়ের সুলতানের প্রজা হলেও তারা গৌড়ীয় নয়। তাদের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় আছে। গৌড় থেকে উত্তরে জ্যোতিষপুর, দক্ষিণে সমতট, পশ্চিমে মল্লভূম, পুবে বঙ্গাল, হরিকেল পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য একটা জাতিপরিচয় চাই, যা সবাই মেনে নেবে। স্বরূপ বহুদর্শী লোক, পণ্ডিত, গুণী, গায়ক, আঁতিপাতি করে ঘুরেছে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য, পুরাণে লেখা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুক্ষ্ম, পুণ্ড্র, পরে তৈরি গৌড়, বারেন্দ্র, সমতট, হরিকেল, বঙ্গাল নামের এলাকাগুলো। ঐতরেয় আরণ্যক, মহাভারত, বৌধায়ন ধর্মসূত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি বই-এর দেশ অর্থে ‘বঙ্গ’ আর সেখানের বাসিন্দা “বঙ্গজনাঃ” শব্দের ব্যবহার আছে। কোল, ভীল, সাঁওতাল, মুণ্ডারীদের দেবতার নাম বোঙ্গা। গঙ্গ (গঙ্গা) বেঙ্গা (বঙ্গ) শব্দদুটো আদিবাসী সমাজে বহু পুরানো আর পরিচিত।
স্বরূপের সঙ্গে কথা মধ্যে গোরা জানাল, নবদ্বীপে সঙ্কীর্তনে বটমঞ্জরী, রবাড়ী, মল্লার, মালসী, বঙ্গালী রাগরাগিনী আমরা অনেক গেয়েছি, এখনও গাই।
গোরার কথা মেনে নিয়ে স্বরূপ বলল, অদ্বয় জ্ঞানকে শাস্ত্রে ‘বঙ্গাল’ বলা হয়েছে। ধ্যানপরিপাক অবস্থায় সুপ্রতিষ্ঠিত থেকে তুমি আজ ‘বঙ্গালী’ হয়েছ। বঙ্গাল বা অদ্বয়জ্ঞান আছে যার সেই অর্থে অদ্বয়জ্ঞানধারী, ভেদাভেদমুক্ত মানুষ।
গোরা বলল, শ্রীহট্টে বুরহানউদ্দীন দরগার মুজাভিরের ঘরে এক কবির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তার নাম শেখ আলঅল হক বাঙ্গালী।
স্বরূপ বলল, সাধ করে নিজেকে বোকা প্রমাণ করতে শেখ আলঅল হক নিজের নামের সঙ্গে ‘বাঙ্গালী’ শব্দটা জুড়ে দিলেন। তিনি শুধু কবি নন, সাধকও ছিলেন। তাঁর বাবার নাম ছিল শেখ আসাদ আলি লাহোরি। পদ্মাপারের মিঞা, ঘোর মুসলমান সবাইকে একসময়ে বাঙ্গাল বলা হত। বাঙ্গাল মানে বোকা। অতি চালাক হিন্দুরা ছাড়া এই কদর্থ সবাই করত না। চর্যাপদের কবি ভুসুকুপাদ লিখেছে,
“আজ ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী।
নিজ ঘরণী চণ্ডালী লেনী।।”
অন্যার্থ, বঙ্গালে এসে চণ্ডালী রমণী বিয়ে করে আজ ভুসুকু বঙ্গালী হল। স্বরূপের উদাহরণের তারিফ করে গোরা বলল, বাহ, সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডারীর দেবতা বোঙ্গার সঙ্গে পদ্মাপারের মুসলমান, বৌদ্ধ ভুসুকুপাদের অদ্বয়জ্ঞান মিলিয়ে তুমি যা গড়ে তুলছ, গৌড়ীয়র বিকল্প আত্মপরিচয় পেতে মনে হচ্ছে আর দেরি হবে না।
স্বরূপ হাসল, বলল, তুমি চাইলে আরও দু’একটা ঘটনা শোনাতে পারি তোমাকে।
গোরা বলল, বেশ লাগছে শুনতে, তোমার ভাঁড়ার অফুরন্ত। আজেবাজে ভাঁড়ার নয়, শুনলে আনন্দ পাওয়া যায়। তুমি বলো, আমি শুনি।
স্বরূপ শুরু করার আগে গোরা দুটো পক্তি শোনাল,
“গ্রাম্য কবির কাব্য শুনিতে হয় দুঃখ।
বিদগ্ধ আত্মীয় বাক্য শুনিতে হয় সুখ।।”
স্বরূপ বলল, তোমার পছন্দ আমার জানা হয়ে গেছে। তোমাকে কি শোনাতে হবে আমি জানি। ভুসুকপাদ নামে আর একজন বৌদ্ধ পণ্ডিতের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি চর্যাপদের সহজিয়া বৌদ্ধ ভুসুকু নন, তিনি ছিলেন রাজপুত্র, তাঁর নাম ছিল শান্তিদেব। বৌদ্ধ শ্রমণ মঞ্জুবজ্রের শিষ্য ছিলেন তিনি। মগধের রাজার তিনি সেনাপতি বা ‘রাউত’ হন। রাউত পদ ছেড়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে শেষজীবনে তিনি নালন্দায় এসে বাস করেন। ধীর, স্থির, শান্ত সেই মানুষটিকে লোকে শান্তিদেব বলত। উজ্জ্বল চেহারার জন্যে তিনি ভুসুকু নামে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। দীপঙ্কর অতীশ শ্রীজ্ঞানের পাঁচ প্রধান শিষ্যের একজন ছিলেন ভুসুকু। শান্তিদেব ভুসুকু আর চর্যার কবি ভুসুকু দু’জন আলাদা মানুষ। তবে দুই ভুসুকুই বঙ্গাল দেশের লোক। শান্তিদেব ভূসুকুর গুরু অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন বঙ্গালের কাছাকাছি বিক্রমপুরের বৌদ্ধ মঠের প্রধান আচার্য।
গোরা বলল, আহা! বিক্রমপুরে যদি একবার যেতে পারতাম।
স্বরূপ হাসল, বলল, তোমাকে সদুক্তি কর্ণামৃতের একটা শ্লোক শোনালে তুমি যা খুঁজছ, হয়তো পেয়ে যাবে।
“ঘনরাসময়ী গভীরা বঙ্কিমসুভগোপজীবিতা কবিভিঃ
অবগাড়া চ পুনীতে গঙ্গা বঙ্গালবাণী চ।।”
গোরা বলল, পেয়ে গেছি। মাটি, ঘা, কাদা মাখা হতদরিদ্র মানুষের দেবতা, সহজ সরল বোকা মুসলমান থেকে, সদুক্তি বোঙ্গা, কর্ণামৃতের কবি শ্রীধর দাস পর্যন্ত, সবাই মিলে যে জাতিপরিচয় গড়ে তুলেছে, তা হল বাঙ্গালী। গৌড়ীয় থেকে আজ আমরা বাঙ্গালী হয়ে গেলাম।
বাঙ্গালা আর বাঙ্গালী শব্দ দুটো বাঙ্গালী স্বরূপের পছন্দ হলেও সে জিজ্ঞেস করল, নবদ্বীপ, শান্তিপুর, শ্রীখণ্ডের মানুষ শব্দ দুটো মেনে নিলেও বঙ্গ, পুণ্ড্র, বজ্রভূমি, প্রাকজ্যোতিষপুর, বরেন্দ্র সমতট, হরিকেল, তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রদ্বীপের মানুষ, বিশেষ করে গৌড়ের নাকউঁচু বামুনেরা ‘বাঙ্গালা’ শব্দের কদর্থ করবে না তো?
করবে। করলে কিছু এসে যায় না। প্রেমভক্তির জোয়ারে ভেসে যাবে সারা বাঙ্গলা। তাড়াতাড়ি হয়তো সেরকম ঘটবে না। দেশপরিচয়, জাতিপরিচয় গড়ে তুলতে কয়েকশো বছর লেগে যেতে পারে, তা লাগুক, শুধু একটা নাম ভাই। নাম পেয়েছি। আমার বাপ কৃষ্ণের বদলে পাঁচশো বছর পরে হয়তো সামনে এসে দাঁড়াবে নতুন নাম। কৃষ্ণের বদলে আরাধ্য দেবতা হয়ে উঠতে পারে, ম্লেচ্ছ কালু মালো। বুক ঠুকে কালু মালো, নিজেকে বাঙ্গালী বলতে গর্ববোধ করবে, লজ্জা পাবে না, সময়ের উত্থানপতনে সে এমন এক ধর্মমত গড়ে তুলবে, যা শুধু বাঙ্গালীর নয়। সে বলবে, “ভূমৈব সুখম্, নাল্পে সুখমস্তি বলবে, “বসুধৈব, কুটুম্বকম্”, ভূমা পৃথিবীর জন্যে নতুন কালের প্রেমধর্ম প্রচারক হবে সে, বাঁধবে নতুন সঙ্কীর্তন। বর্ণহিন্দু, অন্ত্যজ হিন্দু, বৌদ্ধ, আলরাফ আর আলতাফ মুসলমান, সবাই মিলে এমন এক সমাজ বানাবে, যেখানে সব ভূমিপুত্রের পরিচয় হবে ভূমাপুত্ৰ।
কৃষ্ণনামে তদ্গত গোরার মুখ থেকে আবেশঘন গলায় ভবিষ্যতের বার্তা স্বরূপ আগে শোনেনি। সে বলল, তোমার স্বপ্ন সফল হবে। নগরাধিরাজ হিমালয় থেকে সমতট পর্যন্ত বাঙ্গলা নামে পরিচিত হবে, বাঙ্গালী, বঙ্গজনকে বলা হবে বাঙ্গালী। বাঙ্গালী হলেও তাদের মনে উজ্জ্বল থাকবে ভূমাবোধ