গোরা – ৩৪

৩৪

নবদ্বীপের স্টুডিওতে, নভোবিজ্ঞানী সেজকাকা ত্রিদিবনাথ রায়ের মেগাসিরিয়ালে গোরা চরিত্রে অভিনয়ের নিবিড় মহড়া শুরু হতে কলকাতাবাসী একুশ শতকের ছেলে গোরা, যার পোশাকি নাম বিশ্বন্তর রায়, ক্রমশ পাল্টে যেতে থাকল। পার্ক স্ট্রিটের ‘ডিস্কোথেক’, মন্ত্রে’ একমাস আগেও বন্ধুদের নিয়ে নেচেকুঁদে, আড্ডা মেরে হপ্তায় চারদিন প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরে ঝোড়োজীবনের আনন্দে যে বিভোর হয়ে থাকত, সেজকাকার শিক্ষানবিশিতে একুশ শতক থেকে পাঁচশ’ বছর পেছিয়ে ষোড়শ শতকের গোরা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় নিজেকে ঢেলে দিল সে। সেজকাকার ক্যামেরাবন্দি করা ‘গোরা’ ছবির প্রথম তিন কিস্তি টেলিভিশনে শনি, মঙ্গল, বৃহস্পতি তিনদিন দেখে, বাকি সাতচল্লিশ কিস্তি দেখে নিল ‘মাদার ক্যাসেটে’। মেগাসিরিয়ালের গোটা আখ্যা, জেনে গেল ‘পাইলট প্রজেক্ট’ থেকে। কাহিনীর সমাপ্তি, তার মানানসই মনে না হলেও সেজকাকাকে বলল না। সেজকাকার মুখের বিবরণ শুনে নবদ্বীপের যে গোরাকে তার ক্যামেরায় বিদ্রোহী মনে হয়েছিল, পুরীতে এসে গোরার সেই ঝাঁজ যেন কেমন ফিকে হয়ে গেছে। সেজকাকার তৈরি ‘পাইলট প্রজেক্টের ক্যাসেট দেখে গোরা তেমন মনে হলেও সেটা যে চূড়ান্ত নয়, ‘নীলাচল পর্বের শ্যুটিং-এ নির্দেশক অনেক অদলবদল ঘটাতে পারে, গোরার বুঝতে অসুবিধে হল না। আমেরিকার হাউসটনে মেগাসিরিয়াল প্রযোজকের কাছে পাঠানো পাইলট প্রজেক্টের জন্যে সেজকাকা নিশ্চয় তাড়াহুড়ো করে এই পর্ব ক্যামেরাবন্দি করেছে। কম্পিউটার থেকে সেজকাকার লেখা, শ্রীচৈতন্য জীবনী’ শিরোনামে মেগাসিরিয়ালের পুরো কাহিনী পড়ে গোরার তাই ধারণা হয়েছিল। নবদ্বীপের গোরা চরিত্রের তেজ, নীলাচল অধ্যায়ে সেজকাকার লেখা কাহিনীতে থাকলেও পালইট প্রজেক্টে নেই। সেজকাকার কম্পিউটার নাড়াচাড়া করার সঙ্গে তার আলমারি ভর্তি চৈতন্য জীবনীর কয়েকটা এবং এ বিষয়ে আরও কিছু বই, গোরা পড়ে ফেলল। সেজকাকার লেখা কাহিনীর পাশাপাশি তার মাথার মধ্যে নিজের তৈরি যে আখ্যান ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকল, তা মুখে সে না বললেও বিজ্ঞানী কাকা কিছুটা আভাস পেল। জিনস্ পরা ছেড়ে না দিলেও সেজকাকার সঙ্গে গোরাও নিরামিষ খেতে শুরু করল। নবদ্বীপের বাড়িতে পা রাখার দু’দিন পর থেকে তার সংস্কৃত শেখা শুরু হয়েছিল। প্ৰথম হপ্তা ফুরনোর আগে শুরু হল কীর্তন শেখা, গানের রাগরাগিণী, বসন্ত, হিন্দোল, গুর্জরী, দেলখ্য, বড়ারি, কৈশিক-এর অনুশীলনের সঙ্গে চলল, নানা ছাঁদের কীর্তনে দখল আনতে যতি, রূপক, একতালি, নিঃসারতালি, অষ্টতাল, সমতাল, আদিতাল ইত্যাদির চর্চা, সকাল-সন্ধে নাচের মহড়া। কীর্তন শেখার সঙ্গে বাউল, ফকিরি, সহজিয়া, কর্তাভজা, বলাহাড়ি এবং নানা উপধর্মীয় লোকগানের কয়েকজন ওস্তাদ গায়ককে ত্রিদিবনাথ জোগাড় করে রেখেছিল। তারা নেচে, গেয়ে গোরাকে তালিম দিতে থাকল। তাদের উদ্দীপনা গোরাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে পুরোদস্তুর মাতিয়ে তুলল। গলায় তুলসির মালা ঝোলানোর সঙ্গে কপালে চন্দন তিলক আঁকা শুরু করল সে। নবদ্বীপের ফাঁকা ভাড়া বাড়িটা দুই অসমবয়সি মানুষের সঙ্গে জাতবৈষ্ণব আর চৈতন্য অনুগামী বিবিধ উপধর্মের মানুষের যাতায়াতে জীবন্ত হয়ে উঠল। খোল, করতাল, মন্দিরার মতো চেনা বাজনার সঙ্গে আনন্দলহরী বা গাবগুবাগুব, একতারা, দোতারা, প্রেমজুড়ি, ঝাঁঝর, সারিন্দা, নাকারা, লাউ, শানী, তুনী, লোকজীবনে চালু আরও কিছু অচেনা বাদ্যযন্ত্র আমদানি হওয়ার সঙ্গে নতুন নতুন আওয়াজ জেগে উঠল। গোরা দেখল অচেনা সেই বাজনাগুলো হাতে নিয়ে কয়েক মিনিট নাড়াচাড়া করে অনায়াসে সুরেলা বোল তুলতে থাকল সেজকাকা। ভাইপো গোরাকে পাশে পেয়ে ‘মেগাসিরিয়াল’ শেষ করার উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে ত্রিদিবনাথ। সিরিয়ালের দ্বিতীয় অধ্যায়ের চিত্রনাট্য লেখার ফাঁকে পাঁচশ’ বছর আগের ইতিহাস, বিশেষ করে বাঙালি জাতি গঠনের রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের বিবরণ ত্রিদিবনাথ শুনিয়ে চলেছে গোরাকে।

পাঁচশ’ বছর আগে নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা চলে যেতে গৌড়, রাঢ়, সমতট, বরেন্দ্রভূম, নদীনালা ঘেরা পূবদেশ, যার নাম বাঙ্গলা জুড়ে যে প্রবল আলোড়ন উঠেছিল, জাতি হিসেবে বাঙালি সেখানে প্রথম নিজের মুখ দেখতে পেল, খুঁজে পেল আত্মপরিচয়। নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ফুলিয়া, কুমারহট্ট, কাটোয়া, ফুলিয়া, খড়দহ, পানিহাটি, সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী, কুলীনগ্রামের হাজার হাজার মানুষ, যারা তখনও নিজেদের বাঙালি হিসেবে চিনে উঠতে পারেনি, তাদের সকলের চোখে জল, মুখে একটাই প্রশ্ন, জানো, তিনি আমাদের ছেড়ে উৎকল রাজ্যে চলে গেছেন?

জানি, আরও জানি, উৎকলের পুরুষোত্তমপুরে তিনি চলে গেলেও আমাদের ছেড়ে যাননি। তিনি আমাদের মধ্যে আছেন, চিরকাল থাকবেন।

নবদ্বীপ, শান্তিপুরের পাশাপাশি কুলীনগ্রাম, গুপ্তিপাড়া, সপ্তগ্রামে চলছিল এরকম নানা কথোপকথন। কুলীনগ্রামের হরনাথ বসু বলল, তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, গ্রাম্য কথা বলবে না, গ্রাম্য কথা শুনবে না। ঘাসের মতো বিনয়ী, গাছের মতো সহিষ্ণু হতে উপদেশ দিয়েছেন বারবার। বলেছেন, ধর্ম জাতপাত নির্বিশেষে সবাই মানী লোক, মানুষকে অপমান করলে ঈশ্বরের অবমাননা হয়।

আর একজন বলল, ধর্মজাতপাতের হিসেব না করে সবাইকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে, ভালবাসতে বলেছেন তিনি। আমাদের মুখে ভাষা দিয়েছেন

প্রকৃত মানুষ হওয়ার পথ দেখিয়েছেন।

ঘরদোর, রাস্তাঘাট, এমনকি শ্মশান পর্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে তিনি নিজেও ঝাড়ু নিয়ে হাত লাগিয়েছিলেন।

তিনিই প্রথম আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার পথ দেখালেন।

তিনিই বুঝিয়ে দিলেন রাজশক্তির চেয়ে মানুষের সঙ্ঘশক্তির জোর অনেক বেশি, ভালবেসে পৃথিবী জয় করা যায়।

হুঁকোর ধোঁয়া ছেড়ে সপ্তগ্রামের ভষণ মল্লিক বলল, সব কিছুর ওপর তিনি রেখেছিলেন প্রেমভক্তিকে। ভালবাসাই তাঁর বিচারে সবচেয়ে বড় শক্তি, ভালবাসার এক নাম প্রেম, আর এক নাম ভক্তি। দুটোই গায়ে গায়ে জুড়ে থাকে। ভালবাসার ক্ষমতাই সেরা ক্ষমতা, মানুষকে প্রেমিক হতে হবে।

গাঙ্গেয় উপত্যকার দু’তীরের গ্রাম, নগরে যারা এভাবে কথা চালাচালি করছিল, তাদের কারও দু’চোখ শুকনো ছিল না। হাহাকার করছিল তারা, ভাবছিল, আমরা কী পেয়েছিলাম, হাতের কাছে মানুষটা যখন ছিল, ভালো করে তাকে বুঝতে পারিনি। নবদ্বীপ ছেড়ে সে চলে যেতে আমাদের বুকের খাঁচা শূন্য হয়ে গেছে, অন্ধকার দেখছি দু’চোখে। খাঁচা ছেড়ে পাখি উড়ে গেলেও তার গান, কথা, ভালবাসায় ভরা দু’চোখে চাহনি, গৌড়, রাঢ়বঙ্গের আকাশে বাতাসে মিশে রয়েছে। আমরা তা ভুলতে পারি না, তার রেখে যাওয়া সবকিছু আমরা আগলে রাখব, কাজে লাগাব।

গোরা যে এক মহান দায়িত্ব তাদের দিয়ে, তা পালন করার মতো অনেকটা উপযুক্ত করে গড়ে দিয়েছে, এই অনুভবও তাদের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলল। তাদের চালচলন, মুখের ভাষা, চারপাশের পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। আবেগ, আন্তরিকতা, সহৃদয়তায় মনের সব রুক্ষতা মুছে গিয়ে বুকের ভেতরটা ক্রমশ নরম হয়ে উঠতে থাকল। পুরুষোত্তমপুর পর্যন্ত সন্ন্যাসী গোরার যারা সঙ্গী হয়েছে, নতুন কিছু নির্দেশ নিয়ে তারা ফিরে এলে নবদ্বীপের মানুষ সঠিক পথের দিশা পেয়ে সব ভয় কাটিয়ে জেগে উঠবে, সেই উদ্দীপনা গৌড়, রাঢ়, সমতট, বাঙ্গালায় ছড়িয়ে পড়বে। গোরার অনুগামীরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে থাকল, আমরা তার মতো হব, তার মতো নাচব, গাইব, সুহৃদয় মানুষের মতো একে অন্যকে বুকে টেনে নিয়ে বলব, আমরা কুচুটে, নিন্দুক, স্বার্থপর গেঁয়ো হয়ে থাকব না। আমাদের সকলের নামের আগে শ্রী’ নামের শেষে ‘দাস’ জুড়ে দিয়ে নতুন পরিচয়পঞ্জি তৈরি করব আমরা।

ভাইপোর পিঠে হাত রেখে সেজকাকা বলল, পঞ্চদশ, ষোড়শ শতাব্দীতে ইটালিতে যে নবজাগরণ ঘটেছিল, যাকে রেনেসাঁস বলা হয়, চিত্রকলা, ভাস্কর্যে, যা গোটা ইউরোপ কাঁপিয়ে দিয়েছিল, এনেছিল নতুন চিন্তা, দর্শন, অভিনব শিল্পবোধ, সৌন্দর্যতত্ত্ব, যার হাত ধরে পরের শতকে শুরু হয়েছিল সমাজসংস্কারের আন্দোলন, ঘটেছিল শিল্পবিপ্লব, নবদ্বীপে গোরা, বলা যায় একা, সেই নবজাগরণের পতাকা তুলে ধরেছিল। মধ্যযুগীয় ব্রাত্মণ্যবাদী অন্ধ কুসংস্কারের সামাজিক কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। জাতপাতের বিচার ভুলে গিয়ে কৃষ্ণভক্তরা যেমন যৌথ জীবনে মিশে গিয়ে পংক্তিভোজনে বসে পড়ছিল, তেমনি অসবর্ণ বিয়ে চালু হয়ে গিয়েছিল। নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা চলে যেতে প্রতিপক্ষের হাতে হেনস্তা হওয়ার ভয়ে সেখানে বৈষ্ণবসমাজ কিছুদিন গুটিয়ে থাকলেও এলাকা ফাঁকা করে পালাল না। নবদ্বীপ থেকে সপ্তগ্রাম, গুপ্তিপাড়া, কুলীনগ্রাম, কুমারহট্টে যে কয়েকটা পরিবার গিয়ে বাসা বাঁধল, তাদের একজন ছিল শ্রীবাস পণ্ডিত। কুমারহট্টে রওনা হওয়ার আগে গোরার পরামর্শে সন্তানসম্ভবা নারায়ণীকে শ্রীহট্টে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল শ্রীবাস।

বৈষ্ণবসমাজে নবজাগরণের ঢেউ বর্ণবিভাজিত জনজীবনের নানা স্তরে শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাক সম্প্রদায়কে প্লাবিত করলেও ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের ওপরতলার ন্যায়শাস্ত্রী, স্মার্ত, শাক্ত, তান্ত্রিক সম্প্রদায়কে বিশেষ নাড়া দিতে পারল না। তাদের অনুগামীর সংখ্যাও শূদ্র, নবশাক সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট ছিল। বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার সূচনাপর্বে তাদের গোষ্ঠীগত এই বিভেদ বাঙালির জাতি চরিত্রকে অনেকটা খেলো করে দিয়েছিল। গোড়া থেকে তারা গড়ে উঠতে থাকল লুব্ধতাপ্রিয়, কুঁদুলে একটা জাতিপরিচয় নিয়ে। “হিন্দু” নামে যেহেতু কোনও ধর্ম এদেশে ছিল না, এখনও নেই, তাই গৌড়, রাঢ়ের জনজাতির বিশেষ কোনও ধর্মপরিচয় ছিল না। সিন্ধু নদীর গা ঘেঁষে উপত্যকার যারা বাসিন্দা ছিল, পারস্য, তুরস্কের লোকেরা তাদের ‘হিন্দু’ বলত। ‘স’ তারা বলতে পারত না। ‘স’-কে বলত ‘হ’। গঙ্গা, পদ্মার দু’ধারে শালা’কে হালা’ ‘হালার পো হালা’ বলে, এরকম মানুষ অনেক আছে। তাদের পূর্বপুরুষদের মুখ থেকে ‘হিন্দু’ ‘ইন্দু’, ইন্ড্রু’ ‘ইন্ডে’ নানা ধরনের উচ্চারণে সিন্ধু উপত্যকাবাসীদের পরিচয় পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। পাশ্চাত্যের মানুষের মুখে এদেশের পরিচয় হয়েছিল ‘ইন্দে’ ‘ইন্ডে’, সেখান থেকে দেশের নাম দাঁড়াল ইন্ডিয়া’। হিন্দু আর ‘ইন্ডিয়া’ এ দুটো শব্দই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার ভাণ্ডারে আগন্তুক, ধর্মীয় ‘হিন্দু’ পরিচয়সূচক শব্দটা দিয়েছে আরব দেশের মানুষ, দেশ পরিচয় ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটা এসেছে পশ্চিম সমুদ্রপারের ভূখণ্ড থেকে। ভারতের মাটিতে মৌলিক নাম পরিচয়ে প্রথম গড়ে উঠেছিল জৈন আর বৌদ্ধ ধর্ম। দুটোই ছিল ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের প্রতিবাদী ধর্মমত। যিশুখ্রিস্টের জন্মের পাঁচশ’ বছর আগে বৌদ্ধ বিহারে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ হাঁক উঠলেও তার আগে, পরে কোনও মন্দিরে ‘হিন্দুং শরণং গচ্ছামি ‘ আওয়াজ শোনা যায়নি। ভারতীয় দর্শন আর জীবনধারা থেকে এদেশে প্রথম সংগঠিত ধর্মমত হিসেবে জনসমাজের কাছে পৌঁছেছিল জৈন ধর্ম, তারপরে বৌদ্ধ ধর্ম। অর্বাচীন হিন্দু পুরাণে গৌতম বুদ্ধকে ভগবানের দশ অবতারের একজন, নবম অবতার বলা হয়েছে। ইতিহাসের এক অধ্যায়ে জনপ্রিয়তার চূড়ায় উঠে ছিল এই ধর্ম, রাজধর্মের স্বীকৃতি পেয়েছিল। কলিঙ্গবিজয়ী সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ‘চণ্ডাশোক’ থেকে ‘ধর্মাশোক’ নামে সমাদৃত হয়েছিল। যুদ্ধ বর্জন করে অহিংসা আর শান্তির বাণী প্রচারকের ভূমিকা নিয়েছিল প্রিয়দর্শী অশোক। একচল্লিশ বছরের শাসনকালের মধ্যে পঁচিশ বছর নীতিধর্ম প্রচারে কেটেছিল সম্রাট অশোকের। তারপর হাজার বছর ধরে কত রাজা, সম্রাট, দখলদার সেনাবাহিনী নিয়ে ভারতে ঢুকেছে, দেশের নানা অঞ্চল দখল করে রাজত্ব করেছে, লুঠপাট করেছে, রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে দেশের মাটি, সেইসব রাজাধিরাজদের কেউ এদেশে থেকে গেছে, কেউ ফিরে গেছে নিজের দেশে। হাজার বছর পরে মধ্য এশিয়া থেকে যে সশস্ত্রবাহিনী ভারতে এল, তাদের হাতে অস্ত্র সঙ্গে পতপত করে উড়ছিল ধর্মের নিশান। দেশদখল, লুঠতরাজের সঙ্গে তারা শুরু করল বিধর্মীদের ধর্ম নাশ করে তাদের ইসলামধর্মে দীক্ষিত করে পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মসম্প্রদায় সংগঠিত করার কাজ। আগন্তুক দেশদখলকারীদের খুব বেশি চেষ্টা করতে হল না। ব্রাহ্মণ্যধর্ম, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে হাজার হাজার মানুষ ছিল, যাদের ধর্ম সম্বন্ধে কিছু আলাদা ধারণা থাকলেও তাদের কোমরে জড়ানো ছেঁড়া কানির চেয়ে তা বেশি ওজনদার ছিল না। তারা ছিল বর্ণবিভক্ত সমাজের তলানি। তলানি-ই ছিল সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ, দুধের সরের মতো ছিল উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। তলানিরও তলানি ছিল। তাদের অনেকে চাইত উচ্চবর্গীয় মানুষের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে সমাজে তাদের সমান কদর পেতে। আত্মপরিচয় জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষমতাবান যবনদের চাটুকারি করে তাদের অনুগ্রহ পেতে তারা যেমন পিছপা হত না, তেমনি ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীদের কাছ থেকে ছিটেফোঁটা কৃপা পেতে তাদেরও সমানভাবে তোষামুদি করত। সমাজের ওপরতলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এ ধরনের লোকেরা ছিল মাতব্বর। ক্ষমতাধর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের আলাদা সম্প্রদায়ভুক্ত করে নাম দিল ‘সৎ শূদ্র’। বৈদ্য, কায়স্থ গোষ্ঠী হল সৎ শূদ্র সম্প্রদায়ের মাথা। টাকাকড়ি, শিক্ষায় নিজেদের প্রভূত সমৃদ্ধ করে তারা ব্রাহ্মণদের কৃপাতে পেল ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ মিলে গৌড়বঙ্গে যে জোট ক্ষমতাবান হল, তাদের প্রতিপত্তিতে যে জীবনধারা গড়ে উঠতে থাকল, তাকে ‘ব্রাবৈকা’ সংস্কৃতি বলা যায়। গোরার নেতৃত্বে এই জোটের চরিত্রে শুরুতে যে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি হল, যার মূল বাণী ছিল, সবার উপরে মানুষ সত্য, সমাজের নিচুতলায়, তলানির তলানি এবং তারও গভীরে, শেকড় পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ল। গোরার জীবনবোধের আলো যাদের মনে পৌঁছল আর যারা সেই আলো থেকে দূরে সরে দাঁড়াল, দু’তরফে বেশ কিছু ধূর্ত, চতুর লোকও ছিল। সদ্য মুকুলিত বাঙালি জাতিচেতনায় তারা বিষ ঢোকাতে থাকল। তারা বলল, ‘সবাই মানুষ নাকি? নিজের মান সম্পর্কে ক’জনের হুঁশ আছে? বেশিরভাগ মানুষই তো ভিখিরি, কুকুর বেড়ালের অধম, মানুষের চেহারায় গোরু, ছাগল। তাদের মানুষ বললে মানব কেন?’ তারা শেখাল, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’, ‘পরের ধনে পোদ্দারি করা বুদ্ধিমানের কাজ’ ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ ‘যে প্রভু মারে সে ঠাকুর, যে মনিব আদর দেয়, সে কুকুর’। আধফোটা জাতির সামনে যারা এই ওঁচা জীবনদর্শন হাজির করল, তাদের তারিফ করতে যথেষ্ট লোক জুটে গেল। তাদের স্বভাবচরিত্র, বলা বাহুল্য ভালো নয়। ছিল না। তারা ছিল ‘খাও, পিও, মস্তি করো’ জনস্রোতের মানুষ। সেই স্রোতের পুরুষরা যেমন বুক ফুলিয়ে চুরি-ডাকাতি করত, মেয়েরা তেমনি অনায়াসে পণ্যের মতো নিজের শরীর বিকোতে লজ্জা পেত না। ভারতের সব জায়গায় লাম্পট্য, দুর্নীতি থাকলেও গৌড়বঙ্গে তা ছিল নজরে পড়ার মতো বেশি।

গা-বাঁচানো জীবনবোধ নিয়ে সমাজে যে গোষ্ঠীর জাতি-চরিত্র অঙ্কুরিত হল, তাদের মধ্যে চুরি, ডাকাতি, দেহব্যবসা করার সাহস যাদের ছিল না, তারা হল পরজীবী, ভিতু, কাপুরুষ, ফোড়ে, নিন্দুক, পরশ্রীকাতর, চুকলিখোর, আপাদমস্তক মিথ্যেবাদী, আয়াস উদ্যমহীন তলানি সম্প্রদায়, তারা মূলত ভিক্ষাজীবী। জাতি গঠনের শুরুতে সমাজের মাথায় ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী, ‘ব্রাবৈকা’ সংস্কৃতির পোষক ধনী, সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়। তাদের টাকার অভাব ছিল না। হীরে, মুক্তো, সোনার অলঙ্কারে পোশাক পরিচ্ছদে, বিলাস আর বাবুগিরিতে জমজমাট ছিল তাদের জীবনযাপন। মদ, মেয়েমানুষ, ব্যভিচার ছিল তাদের কাছে ফলার পাকানোর মতো হেলাফেলার কাজ। গণিকালয়ে যাওয়ার সঙ্গে নিজের বাড়িতে বাঈজি নিয়ে নাচগানের আসরে চলত অবাধ মদ্যপান। বড়লোকি চালের অঙ্গ ছিল বেলেল্লাপনা। সদ্য গজানো- বিত্তবানদের জীবনে যেমন কোথাও নীতির বালাই ছিল না, মধ্যবিত্ত আর নিচুতলার সমাজও তেমনি, কোনও নৈতিকতার ধার ধারতো না। আবার বলছি, সবাই নয়, বিষয়ভোগে মত্ত জায়মান বাঙালি সমাজের একটা অংশ ছিল কুলাঙ্গার। মধ্যযুগের ইতিহাসে বাঙালি সেনাবাহিনীর বীরত্বের যে বিবরণ আছে, সেই বাঙালি ছিল সমাজে সবচেয়ে উপেক্ষিত হাড়ি, ডোম, বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদেরই কয়েকজন সুলতানি সেনাবাহিনীর পাইক, গোরা আর তার চার সঙ্গীকে মন্তেশ্বর নদীর ধারে গৌড়-উৎকলের সীমান্তে পিছলদা গ্রামে একান্তে ডেকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে উৎকল রাজ্যে ঢুকতে বারণ করেছিল। সুলতানি সেনাদল দু’দিন আগে যে পথে পুরুষোত্তমপুরে ঢুকেছে, শুধু জগন্নাথ মন্দির লুঠ করে তারা থামবে না, যাজপুর দখল করে, সেখানে ঘাঁটি গেড়ে যোগ্য শাসক বসিয়ে, গৌড়ের সীমানা বাড়িয়ে, তারপর তারা রাজধানী একডালায় ফিরবে। পাইক, বরকন্দাজ, গুপ্তচরে ছেয়ে থাকা পুরুষোত্তমপুরে যাওয়ার সেই পথে সঙ্গীদের নিয়ে গোরার এখন এগনো ঠিক হবে না। সবচেয়ে ভয়ের যে খবর পাইক, বরকন্দাজরা শুনিয়েছিল, তা হল, রাজা প্রতাপরুদ্রের বিরুদ্ধে খাড়া করতে সুলতানের পছন্দমতো এক উৎকলবাসীকে পাওয়া গেছে। তার নাম গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই, সে উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রদেবের শ্যালক, উঁচু পদের রাজকর্মচারী, রাজার বিশ্বাসী আত্মীয় হিসেবে রাজধানী কটক দুর্গের অধিপতি। দাক্ষিণাত্যে, বিজয়নগর রাজ্যের অধিপতি রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে রাজা প্রতাপরুদ্র ব্যস্ত থাকার সুযোগে সুলতানের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছে গোবিন্দ বিদ্যাধর। উৎকল অভিযানের শেষে রাজা প্রতাপরুদ্রকে হটিয়ে গোবিন্দকে সেই রাজ্যের সিংহাসনে বসানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সুলতান হোসেন শাহ। পাঁচশ’ বছর ধরে মন্দিরের কোষাগারে জমা বিত্তসম্পদের পরিমাণ সুলতানকে জানিয়ে সেখানে তাকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব গোবিন্দ মেনে নিয়েছে। মন্দিরের সম্পদ লুঠ হলেও বিগ্রহের গায়ে আঁচড় পড়বে না, সুলতানের তরফে এ আশ্বাস গোবিন্দকে দেওয়া হলেও তার মন থেকে সন্দেহের মেঘ কাটেনি। মন্দির থেকে জগন্নাথ বিগ্রহ সরিয়ে ফেলার গোপন পরামর্শ নিজের অনুগত পুরোহিত, পাণ্ডাদের সে জানিয়ে দিয়েছে। মন্দিরের যে অংশের নাম বিমান, সেই গর্ভগৃহের ঈশান কোণে, চাতালের কোনও এক অংশে, গজপতি রাজবংশের পরাক্রান্ত অধিপতি কপিলেন্দ্রদেবের ছেলে রাজা পুরুষোত্তমের আমলে মাটির তলা দিয়ে পাশ ব্রোশ লম্বা যে গোপন সুড়ঙ্গপথ তৈরি হয়েছিল, সেই পথে চিলকা হ্রদের দক্ষিণে এক দ্বীপের মধ্যে পবিত্র কোনও গুহায় ইতিমধ্যে বিগ্রহ সরিয়ে ফেলার গুজব পুরুষোত্তমপুরে ছড়িয়ে গেছে। বিজয়নগর রাজ্যের দুর্দিনে, উৎকলরাজ পুরুষোত্তম সেই রাজ্য আক্রমণ করে প্রভূত লুঠপাঠের সঙ্গে সেখান থেকে সাক্ষিগোপালের মূর্তি তুলে এনে রাজধানী কটকে প্রতিষ্ঠা করার পরের পর্বে দু’দেশের মধ্যে যে শত্রুতা তৈরি হয়, তার জেরে রাজায় রাজায় যুদ্ধ লেগেই রয়েছে। সাক্ষিগোপালের রত্নাসনটি পুরুষোত্তমপুরে জগন্নাথের বেদির ওপর রাখা হয়েছিল। রত্নাসনসমেত সাক্ষিগোপাল লুঠ হয়ে যেতে বিজয়নগর রাজপরিবারের সম্মানে যে ঘা লেগেছিল, তার জ্বালা পরের প্রজন্মেও ঘুচল না। বিজয়নগরের নবীন রাজা কৃষ্ণদেব রায় সিংহাসনে বসে নিজের ক্ষমতায় সাবেক প্রতিপত্তি কায়েম করে উৎকল রাজ্যের সঙ্গে যখন যুদ্ধ শুরু করল, উৎকলে তখন রাজা বদল হয়েছে। ক্ষমতায় এসেছে রাজা প্রতাপরুদ্র। গৌড়ের সুলতানের পাশাপাশি রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সেনাবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে প্রতাপরুদ্র নাস্তানাবুদ হচ্ছিল। সেই সুযোগে তার রাজ্যে, রাজধানীর দুর্গরক্ষক, বিশ্বস্ত শ্যালক গোবিন্দ ভোই সিংহাসনের লোভে সিঁধ কাটতে শুরু করেছিল। কটকের দুর্গে নিজে রাজকীয় বিলাসে ডুবে থেকে ভগ্নিপতিকে কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা দিচ্ছিল। কটক দুর্গের সঙ্গে মেদিনীপুর আর হুগলির গড়মন্দারণের মহলপতি ছিল গোবিন্দ। দুটো মহলই তখন ছিল উৎকল রাজ্যের সীমান্ত এলাকা। গড়মন্দারণের ওপর নজর পড়েছিল গৌড়ের সুলতানের। গোবিন্দকে সিংহাসনের টোপ গিলিয়ে গড়মন্দারণ দখলের পথ সুলতান সুগম করেছিল। বেশ কয়েকবছর আগে শ্রীহট্টে তপন মিশ্রের বাড়িতে থাকার সময়ে তার মুখ থেকে গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই-এর যে কুকীর্তির কাহিনী গোরা শুনেছিল, পাইকদের মুখ থেকে একই বিবরণ শুনে সে অবাক হল।

পুরুষোত্তমপুরের পথে গোরা পিছলদা পৌঁছনোর আগে গোবিন্দের সঙ্কেত পেয়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সুলতান হোসেন শাহ ঢুকে পড়েছিল উৎকল রাজ্যে। পুরুষোত্তমপুরের জগন্নাথ মন্দিরের তোশাখানা ছিল তার প্রথম লক্ষ্য। সব হিন্দু রাজ্যের সবচেয়ে বেশি সম্পদ সেখানে বড় মন্দিরগুলোর তোশাখানায় জমা রয়েছে, সুলতানের অজানা ছিল না। পুরুষোত্তমপুরের তোশাখানা ফাঁকা করে দিয়ে কটকের সাক্ষিগোপাল মন্দিরেও হানা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। উৎকল অভিযান শেষ করে ফেরার পথে রণকৌশলের অংশ হিসেবে যাজপুর দখল করে গৌড়ের সীমানা আর সুরক্ষা বাড়িয়ে নিতে চেয়েছিল সুলতান হোসেন শাহ। উৎকল অভিযান কতদিনে শেষ করে সুলতান কোন পথে ফিরবে, যাওয়ার পথে বিভিন্ন ঘাঁটিতে রেখে যাওয়া পাইক বরকন্দাজদের তা জানার কথা নয়। যাজপুর এড়িয়ে আলাদা পথে সঙ্গীদের নিয়ে গোরাকে পুরুষোত্তমপুরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল পিছলদার ঘাঁটি আগলে থাকা বন্ধুমনোভাবাপন্ন তাদেরই কয়েকজন

সেজকাকা ত্রিদিবনাথের মুখ থেকে পাঁচশ’ বছর আগের একজন মানুষের ইতিবৃত্ত শুরু থেকে কিছুদিন চুপচাপ গোরা শুনলেও নবদ্বীপের বাড়িতে কয়েকদিন কাটানোর পর থেকে সে এমন কিছু প্রশ্ন শুরু করল, যা ত্রিদিবনাথকে চমকে দিলেও খুশি করল। পাঁচশ’ কুড়ি বছর আগে যে গোরা নবদ্বীপে জন্মেছিল, যাকে নিয়ে টেলিফিল্মের মেগাসিরিয়ালের পঞ্চাশ এপিসোড সে ক্যামেরাবন্দি করেছে, সেই মানুষটা সম্পর্কে ভাইপো গোরাও অনুসন্ধিৎসু হয়ে কাকার জোগাড় করা বই, তথ্যের দলিল খুঁটিয়ে পড়া শুরু করেছে, ত্রিদিবনাথের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সেও চায়, মেগাসিরিয়ালের নায়ক, একুশ শতকে বেড়ে ওঠা ভাইপোটি নিজের মতো করে চৈতন্যের জীবন যাচাই করে নিক। তার মতামত, ব্যাখ্যাও ত্রিদিবনাথ শুনতে চায়। কাকার আলমারি থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস বার করে মন দিয়ে শেষ পাতার শেষ লাইন পর্যন্ত পড়ে ত্রিদিবনাথকে গোরা বলেছিল, আইরিশ দম্পতির সন্তান গোরার চেহারার সঙ্গে পাঁচশ’ বছর আগের গোরার চেহারার মিল পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তোমার আলমারির রবীন্দ্ররচনাবলীর কয়েকটা খণ্ড উল্টেপাল্টে রবীন্দ্রনাথের কিছু ‘ফটোগ্রাফ’ দেখে আমার মনে হল, নিজের উপন্যাসের নায়ক গোরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চেহারার অনেক মিল আছে। তুমি দেখলেও মিল পাবে। এটা কেমন করে হয়?

ভাইপোর প্রশ্নে মুহূর্তের জন্যে ত্রিদিবনাথের মনে ধাঁধা লাগলেও মাথার মধ্যে এক ঝলক আলো খেলে গিয়েছিল। তার মনে এ প্রশ্ন আগে কখনও জাগেনি। প্রশ্নটা আচমকা গোরা করলেও অবান্তর নয়, ত্রিদিবনাথের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ‘গোরা’ উপন্যাসে বাঙালি মায়ের পালিত আইরিশ দম্পতির অনাথ ছেলে, গোরার সঙ্গে কুলপরিচয়ে পিরালি ব্রাহ্মণবংশের সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁর পূর্বপুরুষের কোনও একজনের নাম ছিল পুরুষোত্তম কুশারি, তাঁর রক্তের যোগ রয়েছে, এ সত্য কে খারিজ করতে পারে? ইতিহাসবিদদের এ নিয়ে দ্বিমত নেই। গৌড়ের দক্ষিণে সুষ্ম অঞ্চলের যশোরে ছিল তার বাড়ি। পুরুষোত্তমের বংশধর পঞ্চাননের নাতি কোন শুভক্ষণে কলকাতায় এসে দক্ষিণের গোবিন্দপুর থেকে শহরের উত্তরে গিয়ে পুজো-আর্চার কাজ করে বেঁচেবর্তে থাকার জন্যে পুরুতঠাকুর থেকে কেন শুধু ‘ঠাকুর’ হয়ে উঠল, তা গবেষকরা জানে। পঞ্চানন ঠাকুরের নাতি নীলমণি ঠাকুর যখন ছোটভাই দর্পনারায়ণকে পাথুরেঘাটার পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দিয়ে জোড়াসাঁকোয় সংসার পাতল, তখন সে মহাবিত্তবান। জোড়াসাঁকোকে তখনও মেছোবাজার বলা হত। বিত্তবান নীলমণির ঠাকুর্দার পদবি যে কুশারি ছিল, বহু শাখা-উপশাখায় ছড়িয়ে পড়া পরিবারের প্রায় সকলে তা ভুলতে বসেছিল। পুরুতের পেশা থেকে পাওয়া ‘ঠাকুর’ পদবিকে তারা কুলপরিচয় হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিল। ‘কুশারি’ পদবির সঙ্গে পিরালি ব্রাহ্মণকুলের জন্ম আর ইতিহাসের এমন কোনও ঘটনা লুকনো ছিল, যা পুরুষোত্তম কুশারির বংশধর নীলমণি, দর্পনারায়ণ আর তাদের জ্ঞাতিরা মেনে নিতে পারেনি। পিরালি বামুনরা যে আসলে নবদ্বীপের সেই পীরল্যা গ্রামের ব্রাক্ষ্মণ, সুলতান হোসেন শাহের আমলে যাদের গায়ের জোরে গোরুর মাংস খাইয়ে রাতারাতি মুসলিম করা হয়েছিল, সেটা ইতিহাসের সত্য। ধর্মান্তরিত সেই মুসলিমদের অনেকে গ্রাম ছেড়ে যশোর, সাতগাঁয় পালিয়ে গিয়ে ব্রাহ্মণ পরিচয়ে বাস করতে শুরু করলেও, নিজেদের পরিচয় বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারেনি। খাঁটি বামুনরা তাদের একঘরে করে রাখলেও বিত্তসম্পদের জোরে প্রায়শ্চিত্ত করে পিরালি বামুন পরিচয়ে আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে তারা টিকে থাকল।

ত্রিদিবনাথ জিজ্ঞেস করল, এ থেকে কী প্রমাণ হয়?

মুচকি হেসে গোরা বলল, তোমার মুখে শোনা গোরার জন্মপরিচয়ের ধোঁয়াশা কিন্তু উনিশ শতকেও কাটেনি। পিরালি বামুন রবীন্দ্রনাথকেও তা জড়িয়ে রয়েছে। তোমার মেগাসিরিয়ালের নায়কের চেহারার সঙ্গে ‘গোরা’ উপন্যাসের আইরিশ মা-বাবার ছেলে গোরার চেহারার যে মিল রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছিলেন, পিরালি ব্রাহ্মণকুলের সন্তান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার উপন্যাসের নায়কের চেহারায় আমি একই মিল পেলে, তোমার কাছে তা নিশ্চয় আমার বোকামি মনে হবে না।

ত্রিদিবনাথ হা হা করে হেসে ভাইপোর পিঠে আলতো চাপড় মেরে বলল, এই হল একুশ শতকের মাথা। তোর ভাবনাটা আমার মাথায় আগে আসেনি, এমন নয়, তবে তা নিয়ে বেশি দূর আমি এগোইনি। আমার মনে হচ্ছে ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক আর লেখককে নিয়ে তুই অনেক ভেবেছিস। সবটা শুনব। তার আগে পিরালি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় সম্পর্কে আলাদা কিছু তথ্য, গল্পও বলা যায় চালু রয়েছে। শুনবি?

গোরা শুনতে চাইলে ত্রিদিবনাথ বলল, ডালপালা ছড়ানো গল্পটা বেশ বড় হলেও আসলে এটা যশোরের নবাব খাঁ জাহান আলি বা খাঞ্জে আলির আমলের কাহিনী। শোনা যায়, চৈতন্যের জন্মের আগে উচ্চাভিলাষী, বুদ্ধিমান এই মানুষটি দিল্লির নবাবের কাছ থেকে সুক্ষ্ম, সমতট, সুন্দরবন এলাকা আবাদ করার সনদ পেয়ে যশোরে হাজির হয়। অল্পদিনের মধ্যে সুজলা সুফলা বিস্তীর্ণ জমিদারির উর্বর ভূমিতে সোনার ফসল ফলিয়ে বিপুল বিত্তসম্পত্তি জমিয়ে ফেলে। টাকাপয়সা বাড়ার সঙ্গে ক্ষমতা বাড়তে থাকে। এলাকার মানুষের মুখে ঘুরতে থাকে নবাব খাঞ্জে খাঁর নাম। যশোরের নিষ্ঠাবান দুই ব্রাক্ষ্মণ, সম্পর্কে যারা সহোদর ভাই, সেই কামদেব আর জয়দেব রায়চৌধুরী ছিল বেঙুটিয়া পরগনার জমিদার। রায়চৌধুরী ভাই দু’জনকে পছন্দ করত নবাব খাঞ্জে খাঁ। নিজের ভূসম্পত্তির একাংশ দেখাশোনার দায়িত্ব দুই ভাইকে দিয়েছিল। কামদেব, জয়দেবের সহযোগিতায় নবাব খাঞ্জে খাঁর প্রজাকল্যাণমূলক কাজ, পুকুর কাটা, রাস্তা বানানো বাগের হাট খুলনা ইত্যাদি অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়েছিল। খাঞ্জে খাঁর সঙ্গে রায়চৌধুরী ভাইদের সুসম্পর্ক সহ্য হচ্ছিল না ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণ সন্তান মহম্মদ তাহেবের। তাহেব ছিল খাঞ্জে খাঁর মন্ত্রণাদাতা, উজির। কেন সে নিজের ধর্ম ছেড়ে মুসলিম হল, জানা না গেলেও হিন্দুদের গোমাংস খাইয়ে মুসলিম বানানো, নেশার মতো পেয়ে বসেছিল তাকে। খাঞ্জে খাঁর জনহিতের কাজে কামদেব, জয়দেব যেমন তার পাশে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি নবাবের রাজ্যে হিন্দুদের বিশেষ করে বামুনদের ধর্মনাশে গোঁড়া মুসলিমের ভূমিকা নিয়েছিল মহম্মদ তায়েব। হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করে সে আনন্দ পেত। সেখানেই সে থামেনি। খাঞ্জে খাঁর নেকনজরে থাকতে তার রাজ্যে তিনশ’ ষাটটা মসজিদ গড়েছিল। রাজ্যের মুসলিমরা “পির আলি’ উপাধিতে সম্মানিত করেছিল তাকে। নবাবের উজির মুসলিমদের চোখে পিরের মর্যাদা পেলেও খাঞ্জে খাঁর সঙ্গে চৌধুরীভাইদের হৃদ্যতা মহম্মদ তায়েব মেনে নিতে পারছিল না। চৌধুরীদের পথে বসানোর চেষ্টাতে লেগে থাকল সে। রোজার উপোসের মাসে খাঞ্জে খাঁর দরবারে, এক দুপুরে নবাব তখন অনুপস্থিত, চৌধুরীভাইরা সেখানে ঢুকে মহম্মদ তায়েবের মুখোমুখি হল। নবাব না থাকলেও দরবার আলো করে সপারিষদ উজির তায়েব বসেছিল। তাকে সৌজন্য জানাতে দু’ভাই কুর্নিশ করে তার হাতে বাগান থেকে সদ্য তুলে আনা একটা ঘৃতকলম্বা লেবু উপহার দিল। টাটকা লেবুর গোড়াতে তখনও দুটো পাতা লেগে ছিল। ঘৃতকলম্বা লেবুর সুগন্ধ সবাই জানে। লেবু হাতে নিয়ে তায়েব নাকের সামনে ধরে গন্ধ শুঁকে তারিফ করল। বলল, আহ্, চমৎকার!

নিষ্ঠাবান হিন্দু দু’ভাই-এর একজন বলল, হুজুর করলেন কী? রোজার উপোসের সময় গন্ধ শুঁকলেন? আমাদের শাস্ত্রে রয়েছে গন্ধে অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়।

মহম্মদ তায়েব ভাবল, তার পুরনো ব্রাহ্মণ পরিচয়কে বিদ্রুপ করতে চৌধুরীভাইরা এভাবে খোঁটা দিল। দু’ভাইকে যথোচিত সাজা দিতে তক্কে তক্কে থাকল তায়েব। সুযোগ মিলতে দেরি হল না। রোজার মাসের শেষ দিকে এক বিকেলে নবাবের আয়োজিত ইফতারে ভোজের জন্য রসুইঘরে গোমাংস সহযোগে যে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছিল তার গন্ধ উজির, মহম্মদ তায়েবের দপ্তরে ঢুকে পড়েছিল। দরবার থেকে বেরিয়ে দুই চৌধুরী বাড়ি ফেরার পথে দপ্তরের সামনে দিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তাদের দেখে ফেলল উজির। নিমেষে তার মাথায় প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে জেগে উঠল। গলায় মধু ঢেলে দু’ভাইকে পরমাত্মীয়ের মতো দপ্তরে ডেকে নিয়ে কিছু খোশগল্পের পরে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে বিরিয়ানির খুসবু?

কামদেব, জয়দেবের নাকে কিছুক্ষণ ধরে যে গন্ধ যাচ্ছিল, তা বিরিয়ানি থেকে আসছে, তারা জানত না। দু’ভাই থতমত খেয়ে নাকে ঢাকা দেওয়ার বদলে গন্ধ পরখ করতে লম্বা শ্বাস টানল। ভয়ে কেঁপে উঠল তাদের বুক। তায়েব জিজ্ঞেস করল, গন্ধটা কেমন লাগল?

মিনমিন করে কামদেব বলল, ভালো।

কামদেবের জবাব শুনে জয়দেবকে একটা প্রশ্ন করল উজির। দাদার মতো জয়দেবও বলল, ভালো।

মুচকি হেসে তায়েব বলল, তোমাদের তাহলে বিরিয়ানির গন্ধে অর্ধেক খাওয়া হল, তাই না?

কামদেব বিড়বিড় করল, হ্যাঁ, হুজুর।

বিরিয়ানিতে গোরুর মাংস আছে, তোমরা কি জানো?

দু’ভাই তখনই নাকে হাত চেপে ধরতে তায়েব উজির বলল, অর্ধেক খেয়ে নাক ঢাকলে কি আর জাত থাকে? থাকে না। বরং ইফতারের আধখানা ভোজ না খেয়ে পুরো ভোজনটা সেরে ফেল। তোমাদের বামুনপাড়ায় এখনই খবরটা পাঠিয়ে দিলে তারাও সেই বিধান দেবে।

উজিরের কথায় দু’ভাই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেও রেহাই পেল না। উজিরের হুকুমে কয়েকজন পাইক তখনই কিছুটা গোমাংস মেশানো বিরিয়ানি দু’জনের মুখে জবরদস্তি ঢুকিয়ে দিল। ঘটনাটা রটে যেতে হিন্দুসমাজে পতিত হল রায়চৌধুরীরা।

এক মুহূর্ত থেমে ত্রিদিবনাথ বলল, দুই বিশ্বস্ত জমিদারের দুর্ভোগ কাটাতে নবাব খাঞ্জে খাঁর নিজে মুসলিম হলেও দুঃখ পেল। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করল। যশোর থেকে পাঁচ ক্লোশ দূরে সিংহিরা গ্রামে তাদের নতুন জমিদারি দিল। দু’জনের নামও বদলে গেল। তারা হল কামালউদ্দিন খাঁ চৌধুরী আর জালালউদ্দীন খাঁ চৌধুরী। তাদের সঙ্গে কিছুকাল পরে এসে মিশল নবদ্বীপের পিরল্যা গ্রামের কয়েক ঘর জাত-হারানো পরিবার। মহম্মদ তায়েবের চক্রান্তে গড়ে ওঠা এই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকল। নিজেদের ধর্মীয় অবস্থান ধরে রাখতে আলাদা বসতি, ভিন্ন সমাজ গড়ে তুলল তারা, নিজেদের সমাজের মধ্যে ছেলে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সঙ্গে নিজেদের পিরালি ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করল। রায়চৌধুরী বংশের এক মেয়েকে বিয়ে করে পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারির ধর্মনাশ হয়। পিরালি ব্রাহ্মণসমাজের একজন, জগন্নাথের উত্তরপুরুষ, পুরুষোত্তম, নিজের গ্রাম পিঠাভোগ ছেড়ে কলকাতার দক্ষিণে গোবিন্দপুরে বসবাস করতে শুরু করে। ‘কুশারি’ পদবিধারীরা যে পিরালি ব্রাক্ষ্মণ, ততদিনে যশোর এলাকায় রটে গেছে। গোবিন্দপুরে পুরুষোত্তম কিছু বছর কাটানোর পরে সেখানেও তার কুলপরিচয় জানাজানি হয়ে গেল। গোবিন্দপুর ছেড়ে পুরুষোত্তমের নাতি পঞ্চানন এসে খাস কলকাতার চিৎপুর এলাকায় সংসার পেতে পুরোহিত বৃত্তি নিল। তার আমলে, অথবা আর কিছু বছর পরে সংসারের হাল কাশীনাথ ধরলে ‘কুশারি’ পদবি খসে গিয়ে ‘ঠাকুর’ পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করল, পিরালি ব্রাষ্মণের এক শাখা। তখন তারা বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ-পুরোহিত। দেশে ইংরেজ শাসন শুরু হয়েছে। ইংরেজ-ঘনিষ্ঠ ঠাকুরদের শাসকরা টেগোর বলতে শুরু করেছে।

পুরুষোত্তমপুরের পথে পিছলদায় সন্ন্যাসী গোরাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভাইপোর সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গের আলোচনায় জড়িয়ে পড়লেও মূল কাহিনীতে ফিরতে ত্রিদিবনাথ ব্যস্ততা দেখাল না। বরং একুশ শতকের ছেলেটিকে খুঁচিয়ে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ন্যানো প্রযুক্তির যুগের তরুণদের মগজের ভেতর পর্যন্ত দেখে নিতে তাকে আরও তাতিয়ে দিতে প্রশ্ন করল, ষোড়শ শতকের গোরা, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের গোরা আর উপন্যাসের লেখকের চেহারার মিল নিয়ে এই গবেষণা তুই শুরু করলি কবে, কেন করলি, কতটা এগিয়েছিস?

সেজকাকার প্রশ্নে আবছা হেসে গোরা বলল, গবেষণা করার মুরোদ আমার নেই। সবই তোমার শেখানো। তোমার মুখ থেকে মেগাসিরিয়ালের কাহিনী শোনার শুরু থেকে মনে নানা প্রশ্ন ভিড় করছিল। মায়াপুর থেকে এই বাড়িতে এসে গত একমাসে এত বই, সিডি, ক্যাসেট, ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করেছি যা ‘ক্যাট’ বা ‘স্যাট’ পরীক্ষার আগেও করিনি। লাভ একটাই হল, যে বিষয় নিয়ে তুমি ছবি তুলছ, তার ইতিহাস, ভূগোল সম্পর্কে কিছু জানলাম। তার চেয়ে অনেক বেশি প্রশ্ন মনের ভেতরে গ্যাঁট হয়ে বসে গেছে। নবদ্বীপ ছেড়ে গোরার পুরী যাওয়ার পর থেকে তার বাকি জীবনের কাহিনী এখন আমি বলে দিতে পারি। তোমার মেগাসিরিয়ালের পরের এপিসোডগুলোর চিত্রনাট্য লিখতে আমার কাহিনী তুমি কাজে লাগাতে পারো।

ত্রিদিবনাথ অবাক হয়ে শুনছে গোরার কথা। গোরা থামতে জিজ্ঞেস করল, সিরিয়ালের বাকি অংশ তুই বলতে পারবি?

হ্যাঁ।

পিছলদায় আটকে থাকা ষোড়শ শতকের সেই মানুষটা সঙ্গীদের নিয়ে কীভাবে পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছল, তারপর কীভাবে কাটল তার বাকি জীবন, তোর মুখ থেকে শুনতে চাই। তুই বল।

সেজকাকার চোখের দিকে তাকিয়ে গোরা বলল, তার আগে ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে লেখকের মিলের বিষয়ে ফয়সালা করে নিতে চাই।

কীরকম?

নিজের পিরালি বামুন পরিচয়ের কারণে রবীন্দ্রনাথের মনে কি কোনও ইফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’ ছিল?

তুই বলতে চাইছিস, পিরালি বামুন হওয়ার দরুণ হীনন্মন্যতা, যাকে ‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’ বলছিস তুই, সেই গ্লানিতে রবীন্দ্রনাথ ভুগতেন?

কিছুটা তাই।

কেন এটা বলছিস?

সারাজীবন বাংলায় নিজের নামের শেষে পদবি লিখলেন ‘ঠাকুর’, ইংরেজিতে লিখলেন ‘টেগোর’, এটা বেশ অদ্ভুত, তাই না?

গোরাকে স্থির চোখে দেখছিল ত্রিদিবনাথ। কাকার মুখের ওপর থেকে নজর না সরিয়ে গোরা বলল, স্কুলে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটা রচনায় পড়েছিলাম, তাঁর বাবাকে কোনও এক আত্মীয়ের ইংরেজিতে লেখা চিঠি, সেটা না পড়ে তখনই চিঠি লিখিয়ের কাছে তিনি ফেরত পাঠিয়েছিলেন। আমার স্কুলের স্যার বলেছিলেন, সেই রচনাটা রবীন্দ্রনাথের ‘অটোবায়োগ্রাফি’ কী যেন নাম, হ্যাঁ, ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে নেওয়া। ইংরেজিতে লেখা চিঠি যে বাড়িতে বাবা পড়ে না, সেখানে ছেলে বাংলা ভাষার সেরা কবি হয়ে কীভাবে ইংরেজদের দেওয়া ‘টেগোর’ পদবি সারাজীবন বয়ে বেড়ালেন? তাঁর মনে কি কোনও সঙ্কোচ জাগেনি? স্কুলের সেই স্যারের মুখে শুনেছি, বিদ্যাসাগর চরিত্রে সাহেবদের মতো তেজ, সাহস, সততা, আরও নানা গুণ দেখে রবীন্দ্রনাথ কোনও একটা রচনায় নাকি তাঁকে কাকের বাসায় কোকিলের ডিমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দেশটা হল ‘কাকের বাসা’, বিদ্যাসাগর হলেন ইংল্যান্ডের সাহেবদের ডিম। বিদ্যাসাগরের ভাগ্য ভালো ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক, সাদা চামড়ার ‘আইরিশ’ ছেলের মতো তিনি সুপুরুষ ছিলেন না, তাঁকে সাহেবদের ডিম হিসেবে দেশের মানুষ মেনে নেয়নি। ঘরের লোক জেনে শ্রদ্ধা করেছে।

সেজকাকা স্থির চোখে তাকিয়ে আছে দেখে গোরা জিক্সে করল, আমি কি ভুল বললাম? সবটা ঠিক নয়। ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়কের বর্ণনায় বৃন্দাবন দাসের শ্রীচৈতন্যভাগবতের চৈতন্যের রূপের বিবরণ থেকে দুটো লাইন,

‘চাঁদের অমিয়া সনে চন্দন বাটিয়া গো / কে মাজিল গোরার দেহখানি।’

উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। গোরা বলল, হ্যাঁ, ‘গোরা’ উপন্যাসটা এখানে এসে পড়েছি। তোমার লেখা চৈতন্যজীবনীতেও এই লাইন দুটো রয়েছে। ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়কের মতো লম্বা, চওড়া, শক্তপোক্ত, টকটকে ফর্সা ছেলে যে বাঙালির ঘরে জন্মায়, পাঠকের মনে এ ধারণা তৈরি করতে তিনি চৈতন্যকে উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন। তিনি হয়তো জানতেন না চৈতন্যও ছিলেন তাঁর মতো পিরালি ব্রাহ্মণ। তবে কিছু একটা অনুমান করেছিলেন। চন্দন বাটা মাখানো চাঁদের আলোর মতো যার গায়ের রং, তার শরীরে শুধু বাঙালি বামুনের রক্ত বইছে কিনা, এ নিয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল।

এক মুহূর্ত থেমে কাকাকে গোরা বলল, তুমি যেভাবে গোরার জন্মপরিচয় জেনেছ, তোমার আগে একই ‘সোর্স’ থেকে সেই ঘটনা বোধহয় রবীন্দ্রনাথ জেনেছিলেন। পাঁচশ’ বছর আগের মানুষটার আদলে বিশ শতকে ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ককে বানাতে গিয়ে তাকে পিরালি বামুনের বদলে ‘আইরিশ’ মা-বাবার ছেলে হিসেবে হাজির করেছেন। নিজের পরিচয়ও কিছুটা মেজেঘষে ঠাকুর থেকে হয়েছেন ‘টেগোর’। বিশ্বনাগরিক হওয়ার তাগিদও তখন তাঁর মনে এসেছে।

তোর ব্যাখ্যা অনেকটা ঠিক। তবু বাঙালি জাতিকে তার শিশু বয়সে আঁতুড়ঘর থেকে কোলে পিঠে তুলে মানুষ করতে পাঁচশ’ বছর আগে যে ব্যক্তি দেশ, ঘর, সংসার ছেড়েছিল, তা ভুলে গেলে চলবে না। সে ছিল ঈশ্বরবিশ্বাসী, উদার, নিজের সময়ের থেকে বেশি আলোকপ্রাপ্ত মানুষ।

সেজকাকার কথা শুনে গোরা বলল, পাঁচশ’ বছর আগের সেই মানুষটা বাঙালি জাতি গড়ার প্রধান কারিগর, সে-কথা ভুলছি না, ভুলব না। শুধু একটা প্রশ্ন আছে, করব?

প্রশ্নটা শুনি।

ত্রিদিবনাথকে গোরা জিজ্ঞেস করল, হাউস্টনে কাজে ডুবে থাকা মনমরা সহকর্মী আর তাদের বউ, ছেলেমেয়েদের আনন্দ দিতে যে মেগাসিরিয়ালের পঞ্চাশটা ‘এপিসোড’ বানালে, সেটি কি শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতি তৈরির ছবি হয়ে দাঁড়াবে?

আদত প্রশ্ন তুলেছিস, ত্রিদিবনাথ বলল, পাঁচশ’ বছর আগের সেই মানুষটাও ছিল আজকে যাকে আমরা বলছি ‘গ্লোবালাইজড ম্যান’ তাই। সত্যিকার বিশ্বনাগরিক ছিল। কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর হলেও তার ভালবাসার দেবতাটি ছ’হাত বা চার হাতওলা পৌরাণিক দেবতা ছিল না। সাধারণ মানুষের মতো সেই কৃষ্ণের ছিল দুটো হাত। দু’হাতে ছিল বাঁশি। নেচে গেয়ে, প্রেম ভালবাসা দিয়ে পৃথিবীতে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল সে, সেই প্রক্রিয়াতে কিছুটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল বাঙালি জাতি। গোরা নিজেও বুঝতে পারেনি গৌড়, রাঢ়, সুক্ষ্ম, সমতট, হরিকেল, বঙ্গালের জনসমাজ এভাবে সংগঠিত হয়ে উঠবে। জীবনের চব্বিশটা বছর নবদ্বীপে কাটিয়ে এমন কিছু মূল্যবোধের বীজ সেখান ছড়িয়ে দিয়েছিল, যা জন্মভূমি ছেড়ে সে চলে যাওয়ার পরে পাতা, ফুল, ফলে মহীরুহের চেহারা নিয়েছিল। বদলে দিয়েছিল নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কুলিয়া, ফুলিয়া আর গঙ্গার দু’পাশের জনচরিত্র, তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল জাতিবৈশিষ্ট্য। নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজে ভদ্রতা, শিষ্টাচারের নতুন বিধি চালু হয়েছিল। দু’হাত জুড়ে একে অন্যকে নমস্কার করার প্রথাও গোরার তৈরি। তার বিরোধীরা বৈষ্ণবসমাজের এই সৌজন্যকে ‘ন্যাকামি’ ভাবত। গোরা সন্ন্যাস নেওয়ার পরে তাকে বলত ‘ন্যাকা চৈতন’। সঙ্কীর্তনের জোয়ারে আগেই আলগা হয়ে গিয়েছিল বর্ণ, জাতপাতের গোঁড়ামি। শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাক সমাজের সঙ্গে বৈষ্ণব ব্রাহ্মণদের মেলামেশা শুরু হয়েছিল। সমবেত লোকজীবনে ফুটে উঠেছিল জাতিচেতনার প্রাথমিক যত লক্ষণ। ষড়ভুজ, চতুর্ভুজ কৃষ্ণের দৈবী মূর্তির বদলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল দু’হাতে বাঁশি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তরুণ কৃষ্ণের মুখ। গোরার মতো সেই কৃষ্ণও ঘরের ছেলে। তাকে দেখে স্বর্গের দেবতা মনে হয় না, উল্টোটা মনে হয়। স্বর্গের দেবতা বোধহয় পথ ভুল করে গৃহস্থ সংসারে ঢুকে পড়েছে। গোরাকে স্বয়ং কৃষ্ণ ভেবে নিতে নবদ্বীপের মানুষের তাই অসুবিধে হয়নি। নিজেকে ঈশ্বরের অবতার বা ঈশ্বর, কখনও গোরা ভাবেনি। বিশ্বরূপের পুঁথি পড়ে তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল সে কৃষ্ণের সন্তান। তার বাপ কৃষ্ণ। ‘কৃষ্ণ’ শব্দ বা নামটা আধুনিক যুগে যাকে ‘ইডিওলজি’, মতাদর্শ বলা হয়, গোরা আঁকড়ে ধরল। পাঁচশ’ বছর আগে গোরা জানত কৃষ্ণই ভগবান, তাকে দেখা যায়, পাওয়া যায়। তার জন্যে চাই প্রেমভক্তি, তাকে পাওয়ার আকুলতা। লক্ষ কোটিবার জপ করতে হবে কৃষ্ণনাম, মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিতে হবে নামের মহিমা। নাম প্রচারের সেরা পথ নাচ, গান, সঙ্কীর্তন। হাজার মুখে, লক্ষ মুখে, কোটি মুখে কৃষ্ণনাম উচ্চারিত হলে নিজের আসন ছেড়ে কৃষ্ণ পৃথিবীতে নেমে আসবে। নামজপকারীদের ঘরে হয়তো জন্ম নেবে কৃষ্ণ, তাকে বলা হবে কৃষ্ণাবতার। তার নেতৃত্বে ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতহীন রাগ, লোভ, হিংসা, যাবতীয় কলুষমুক্ত এক নতুন সমাজ, যার আর এক নাম ধর্মরাজ্য, পৃথিবীতে গড়ে উঠবে।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ত্রিদিবনাথ বলল, পাঁচশ’ বছর আগের সেই মানুষটার ‘ইডিওলজি’ অথবা কৃষ্ণপ্রেম, যা বলিস, সেই প্রেমধর্মকে রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের নায়কের বিশ্বমানবতা তত্ত্ব, এমনকী রবীন্দ্রনাথের ‘নোবেল প্রাইজ’ পাওয়া কাব্য ‘গীতাঞ্জলি’র ঔপনিষদিক দর্শনের চেয়ে পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ অনেক বেশি আদর করে নিজেদের ব্যক্তিজীবনে আত্মসাৎ করেছে। ‘গ্লোবালাইজড’ হয়ে গেছে চৈতন্যের প্রেমভক্তির তত্ত্ব, সঙ্কীর্তন। বিদেশি বৈষ্ণবদের সংখ্যা ভারতীয় বৈষ্ণবদের চেয়ে কম নয়। মানুষের পিতৃপরিচয়, জাত, কুলের ঠিকানা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। ইসকন্’-এর রমরমা দেখে বোঝা যায় ‘কৃষ্ণ’ নামের জনপ্রিয়তা। ‘ইসকন্’-এর মতো আরও অনেক বৈষ্ণববাদী সংগঠন পৃথিবীর নানা দেশ, মহাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। আমার ‘মেগাসিরিয়াল’ আশা করি হাউসটনের সহকর্মীদের সঙ্গে আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার দেশগুলোতে দর্শক পাবে, প্রেমভক্তির ইডিওলজি’ তাদের আনন্দে ভাসিয়ে দেবে। জাতি হিসেবে বাঙালিকে গড়ে তোলা আর বিশ্বমানবিক মতাদর্শ নির্মাণে বিশেষ ফারাক নেই। দুটোরই জন্ম মানুষের সত্তার উপকরণ প্রেমভক্তি থেকে। জন্ম থেকে বাঙালি জাতি প্রেমিক আর বিশ্বমানবিক।

ত্রিদিবনাথ থামল। ভাইপোকে বলল, নবদ্বীপ ছেড়ে কাটোয়ায় কেশবভারতীর কাছে সন্ন্যাস নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে যাওয়ার পথে পিছলদায় দু’দিন আটকে গেলেও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সঙ্গীদের নিয়ে গোরা শেষপর্যন্ত নীলাচলে পৌঁছল।

সেজকাকা থামতে ভাইপো গোরা বলল, তোমার কম্পিউটারে দেখলাম, মাঝখানে কয়েকদিন যাজপুরে কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে গোরা কাটিয়েছিল।

ঠিক-ই দেখেছিস। তবে সেটা শেষ পর্যন্ত চিত্রনাট্যে থাকবে কিনা, এখনও পাকা করিনি। নবদ্বীপ ছেড়ে রাতের অন্ধকারে গোরা নৌকোয় ওঠার পর থেকে যে ‘এপিসোড’, মানে একান্ন নম্বর ‘এপিসোড’ থেকে শুরু হচ্ছে তোর কাজ। সন্ন্যাস নেওয়া থেকে সিরিয়ালের শেষ পর্যন্ত গোরার ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে তোকে। আমি বুঝতে পারছি, তুই তৈরি। অসম্ভব পরিশ্রম করে একমাস ধরে তালিম নিয়েছিস। গোরার চরিত্রে ববের অভিনয়ের এপিসোডগুলোও খুঁটিয়ে দেখেছিস। আমার বিশ্বাস, ববের চেয়ে ভালো অভিনয় করবি তুই।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ত্রিদিবনাথ বলল, সিরিয়ালের একান্ন নম্বর ‘এপিসোড টা তুই বল।

আমি কী জানি?

গোড়া এড়িয়ে যেতে চাইলে ত্রিদিবনাথ বলল, আমার লেখা খুঁটিনাটি ছড়ানো নানা তথ্য, টিকা, টিপ্পনি সমেত ‘চৈতন্য জীবনী’, পঞ্চাশটা এপিসোডের চিত্রনাট্য, আরও পঞ্চাশটার সংক্ষিপ্ত কাঠামো কম্পিউটার থেকে তুই পড়েছিস। আলমারি খুলে কম বই বার করে পড়িসনি। কম্পিউটার খুলে শ্রীচৈতন্য সংক্রান্ত অনেকগুলো ‘ওয়েবসাইট’, প্রচুর সিডি দেখেছিস, গান শুনেছিস, সন্ন্যাসী গোরার বাকি জীবনের বিবরণ শোনাতে তোর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কোথাও তুই ঠেকে গেলে আমি তো রয়েছি।

ষোড়শ শতকের গোরার কাহিনী কাকাকে শোনাতে একুশ শতকের গোরা মুখ খোলার আগে, ত্রিদিবনাথ বলল, একটু সময় দে। তোর মুখের বিবরণ হ্যান্ডিক্যাম’-এ ধরে রাখব সেখান থেকে পরে ‘সিডি’ করে নেব। আলমারি থেকে ‘হ্যান্ডিক্যাম’ বার করে সেটা চালু করতে খুটখুট করে দুটো বোতাম টিপল ত্রিদিবনাথ। গোরাকে বলল, ‘রেডি’, শুরু কর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *