গোরা – ৩৬

৩৬

দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা নীল জলের দিকে গোরা অভিভূতের মতো তাকিয়েছিল। তার দু’চোখে বিস্ময়, ঝরঝর করে চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এর নাম ‘সমুদ্র’ একে বলে ‘জলধি’। আগে কখনও এত বিশাল জলরাশি, আকাশ ছোঁয়া এই প্রবল ঢেউ, আঁশটে গন্ধমাখা এমন নোনা হাওয়ার ঝড় সে দেখেনি। মাথার ওপর নীলকান্ত মণির মতো দশ দিক ব্যাপ্ত নীল আকাশ আর যতদূর দেখা যায় গাঢ়, ফিকে, আবছা সবুজ, নীলে মেশা বিগলিত জল আর আকাশ হাত ধরাধরি করে কোথায় থেমেছে বোঝা যায় না। মাথার ওপর আর পায়ের নিচে নীলের এই অভূতপূর্ব সমারোহ দেখে গোরা বলল, পুরুষোত্তমপুরে এসে মনে হচ্ছে নীলাচলে দাঁড়িয়ে আছি।

কথাটা শুনে জগদানন্দকে নিতাই বলল, গৌড়ের মানুষের জন্যে পুরুষোত্তমপুরের চমৎকার একটা নামকরণ করে দিল গোরা। আহা নীলাচল! ভাবা যায় না।

গোরা বলল, আমাকে সমুদ্র দেখানো কথা একদিন দিয়েছিলে তুমি। তোমার কথা রাখার জন্যে এই নতুন নামটা তোমায় উৎসর্গ করলাম।

দামোদর বলল, মন ভোলানো নাম দিতে নবদ্বীপে গোরার জুড়ি কেউ ছিল না। শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়ির দাসী, দুখীর নাম পাল্টে করল সুখী। পণ্ডিতের পরিবারের সঙ্গে পাড়ার সকলে এখন তাকে সুখী নামে ডাকে। তার দুখী নাম এখন সবাই প্রায় ভুলে গেছে। রামচন্দ্রপুর আর আশপাশের কত ছেলেমেয়ের নাম গোরা বেছে দিয়েছে, হিসেব নেই।

দামোদরের কথা শুনে সামান্য হেসে গোরা বলল, দুখীকে সবাই সুখী নামে ডাকার পরে সে কি সত্যি সুখী হয়েছে?

কথাটা বলে গোরা তাকাল দামোদরের দিকে। গোরার মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দামোদর সমুদ্র দেখতে থাকল। সমুদ্রের ধার জুড়ে সোনালি বালির স্তূপ, বালিয়াড়ি আর ঝাউবন। দিগন্ত থেকে ছুটে আসা জলস্রোত, তীরের কাছাকাছি এসে ক্রমশ ফুলে উঠে বিশাল ঢেউ-এর চেহারা নিয়ে বালিয়াড়িতে ভেঙে পড়ছে। ডাইনে, বাঁয়ে সমুদ্রের ধারে কোথাও একজন মানুষ নেই। ফাঁকা পথ। পুরুষোত্তমপুরে অঘোষিত আপৎকাল চলছে। আপৎকালের যাবতীয় লক্ষণ, ভয়, আতঙ্ক, প্রাণহীন নৈঃশব্দ্য, পথঘাট, দোকানবাজার, এমনকি দরজা-জানলা বন্ধ গৃহস্থবাড়িগুলো জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রের গর্জন, হাওয়ার সাঁই সাঁই আওয়াজ ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই। বাসুদেব সার্বভৌমের মাসি রসবালার বাড়ি থেকে সূর্যোদয়ের আগে সঙ্গীদের নিয়ে গোরা বেরিয়ে এসে প্রথমে গিয়েছিল গোপীনাথের বাড়িতে। পাশের পাড়াতে গোপীনাথের বাড়ি। দলবল নিয়ে গোরা এসে হাজির হতে গোপীনাথ ভয় পেয়ে গেছে। বিদেশি মানুষের এখন পুরুষোত্তমপুরে ঢোকা, খেয়ালখুশি মতো ঘুরে বেড়ানোতে বিপদ রয়েছে। সুলতানি সেনারা মন্দির লুঠ করে নগরে তাণ্ডব চালিয়ে কটকের দিকে চলে গেলেও ফেরার সবগুলো পথ নিরাপদ রাখতে পুরুষোত্তমপুরে মাঝারি আকারের সেনাঘাঁটি রেখে গেছে। সুলতানি সেনাঘাঁটি থাকলে সেখানে গুপ্তচরদের ডেরা থাকবে। তারা সারাদিন এমনকি রাতেও নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। পুরুষোত্তমপুর খালি করে মধ্যবিত্ত মানুষ পালিয়ে গিয়ে কাছাকাছি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিলেও যারা রয়েছে, তারাও কাফের, ঘোঁট পাকাতে, শয়তানি করতে ওস্তাদ। শহরের ওপর তাই সজাগ নজর রাখছে গৌড়ের গুপ্তচরবাহিনী। বিদেশি কেউ পুরুষোত্তমপুরে ঢুকলে তাকে ধরে ফাটকে পুরছে। সন্দেহভাজন মনে হলে কোতল করছে। সার্বভৌমের পরামর্শে গোরা আর তার সঙ্গীদের কমলপুর ছেড়ে আসার আগে সবরকম বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল গোপীনাথ। গোরাকে দেখলেই সে বিদেশি, সিন্ধুকীদের বুঝতে এক মুহূর্ত সময় লাগবে না। দাক্ষিণাত্যে রওনা হওয়ার আগে শহরের পথে, সমুদ্রের ধারে সঙ্গীদের নিয়ে গোরাকে বেশি ঘোরাফেরা করতে বারণ করেছিল গোপীনাথ। বিশেষ করে বারণ করেছিল গোরাকে। ন্যাড়া মাথা, কৌপীনধারী হলেও শরীরের গড়নে, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য আর চালচলনে গোরা তো আর পাঁচজনের মতো নয়, সে একেবারে অন্যরকম, তাকে দেখলেই আলাদা গ্রহের মানুষ মনে হয়। ভিড়ের মধ্যে অথবা নির্জনে সে কোথাও গিয়ে দাঁড়ালে প্রথমে তাকে চোখে পড়ে। পুরুষোত্তমপুরে বসে নবদ্বীপের গোরার রূপগুণের বিবরণ, বিভিন্ন জনের মুখ থেকে সার্বভৌম এত বেশি শুনেছিল, যে হামলাবিধ্বস্ত নিজের নগরে তাকে নিরাপদে রাখা নিয়ে তার মনে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছিল। শান্তশিষ্ট এই জগন্নাথক্ষেত্রে আগে কখনও এরকম আক্রমণ, প্রাণহানি, লুঠতরাজ হয়নি। নবদ্বীপ ছেড়ে যে দুর্গতির ভয়ে বাসুদেব সার্বভৌম পুরুষোত্তমপুরে এসে বাসা করেছিল, তা যে সেখানেও হানা দেবে সে কল্পনা করেনি। সুলতানি সেনা অভিযানের বীভৎসতা দেখে মহাপণ্ডিত সার্বভৌমের মনে বৈদান্তিক জ্ঞান, যুক্তি, দার্শনিকতার চর্চার ভিত নড়ে গিয়েছিল। মেয়ে ষষ্ঠীর বিয়ের পর থেকে সংসারে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল অশান্তি। হীরের টুকরো ছেলে ভেবে যাজপুরের যে বৈদিক ব্রাহ্মণ সন্তানের সঙ্গে ছ’মাস আগে ষষ্ঠীর বিয়ে দিয়ে তাকে ঘরজামাই করেছিল, সে যে সংসার পাতার যোগ্য মানুষ নয়, একই সঙ্গে মূর্খ আর গেঁজেল অল্প দিনে জেনে গিয়েছিল সার্বভৌম। মেয়েকে পাত্রস্থ করে অগাধ জলে পড়লেও তার কিছু করার ছিল না। নবদ্বীপের অতিথিদের, এমনকি কৌপীন, চাদর জড়ানো গোরাকে নিয়েও জামাই অমোঘ ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে বিব্রত করতে পারে, এ ভয় সার্বভৌম পাচ্ছিল। খানিকটা জামাই-এর ভয়ে গোরা আর তার সঙ্গীদের নিজের বাড়িতে না এনে মাসির আশ্রয়ে পাঠিয়েছিল। সবচেয়ে বড় ভয় পুরুষোত্তমপুরে দুঃসময় নেমেছে। নেশাখোরদের আড্ডায় নবদ্বীপের অতিথিদের সম্পর্কে অমোঘ কটুবাক্য বলতে শুরু করলে তার জের কতটা চলবে বলা মুশকিল। রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের বাবা, রাজা পুরুষোত্তমদেবের মৃত্যুর পর থেকে গজপতি রাজবংশের সে জ্ঞাতিবিরোধ শুরু হয়, ঘুনপোকার মতো সেই কলহ এখনও কুরে কুরে খেয়ে চলেছে উৎকল রাজ্যকে। মারা যাওয়ার আগে রাজ্যের রাজধানী কটকসমেত মূল ভূখণ্ড আঠারোজন ছেলের মধ্যে সকলের বড় প্রতাপরুদ্রকে দিয়ে বাকি সতেরোজনকে ছোট ছোট সতেরোটা অঞ্চলে রাজা বানিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল উৎকলের অধিপতি পুরুষোত্তম। ব্যক্তিত্ব, বীরত্ব, রাজকীয় গুণাবলিতে প্রতাপরুদ্র ছিল বাবার চোখের মণি। অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিল সে। কটকের সিংহাসনে বসে প্রথমে জগন্নাথক্ষেত্রের নাম পাল্টে সে করেছিল পুরুষোত্তমপুর। পরাক্রান্ত বাবার মতো প্রজাদের হৃদয় প্রতাপরুদ্র জয় করে নিলেও সতেরোজন ভাইকে নিজের তাঁবে রাখতে পারেনি। তাদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই-এ না নামলেও ছায়াযুদ্ধ লেগে ছিল। বিজয়নগর রাজপরিবারের সঙ্গে কয়েকজন ভাই-এর বৈবাহিক সম্পর্ক যেমন গড়ে উঠেছিল, কারও কারও তৈরি হয়েছিল সখ্য। চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, চন্দেল্ল, গাঙ্গ রাজপরিবারের সঙ্গে এক-ই নিয়মে তাদের ভগ্নদশা চললেও যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল কিছু ভাই-এর। রাজা প্রতাপরুদ্রের উৎকল রাজ্য যে ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে, সার্বভৌমের বুঝতে অসুবিধে হত না। পৃষ্ঠপোষক রাজাকে কিছুটা কূটনৈতিক সহযোগিতা করতে বিজয়নগরে গোরাকে ভক্তিবাদ প্রচারের সঙ্গে শান্তির দূত হিসেবে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সার্বভৌম। উদ্যোগ শুরু হয়েছিল কুলিয়াবাসী ছোটভাই বিদ্যাবাচস্পতির ঠিকানা থেকে। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে গোরা-ই যে সেরা দূর কুলিয়া থেকে একাধিক চিঠি লিখে পুরুষোত্তমপুরে দাদার মাথায় এই চিন্তা বিদ্যাবাচস্পতি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ছোটভাই-এর শেষ চিঠিতে সার্বভৌম জেনেছিল গোরার জীবন বিপন্ন হতে চলেছে, তাকে গৌড়ের সুলতান আর গোঁড়া ব্রাহ্মণকুল এমনভাবে ঘিরে ফেলেছে, যে তার বাঁচার উপায় নেই। পুরুষোত্তমপুরে দাদার আশ্রয়ে গোরাকে পাঠানোর অনুমতি চেয়েছিল সে। সার্বভৌম রাজি হয়েছিল গোরাকে আশ্রয় দিতে। তাকে আনতে ভগ্নিপতি গোপীনাথকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। গৌড়ের সুলতান যে এত তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনী নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে ঢুকে পড়তে পারে, সার্বভৌম ভাবেনি। পুরুষোত্তমপুরে গোরা ঢোকার পর থেকে তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব গোপীনাথকে দিয়েছিল সার্বভৌম। ভাবাবিষ্ট গোরা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কৃচিন্তায় যখন ডুবে আছে, হন্তদন্ত হয়ে গোপীনাথ সেখানে হাজির হল। ঈশ্বরকে আগলে রাখার সামর্থ্য তার নেই জেনেও নগরের দশা দেখে সে-ও আতঙ্কে ছিল। ফাঁকা সমুদ্রতীর, গোরা আর তার সঙ্গীরা ছাড়া কোথাও মানুষজনের চিহ্ন নেই, দেখে স্বস্তি পেল সে। গোরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গোপীনাথের উত্তেজনা, উদ্বেগ জল হয়ে গেল। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলছিল সে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে, দামোদর মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, তোমার বড় সম্বুন্ধি নিশ্চয় আমাদের খোঁজ নিতে পাঠাল তোমাকে?

গোপীনাথ একটু থতমত খেয়ে বলল, না, তোমাদের খোঁজে আমি নিজেই বেরিয়ে পড়লাম, এখন যা অবস্থা, ঘরে-বাইরে শত্রু, সবসময়ে ভয়ে ভয়ে থাকি। মাসশাশুড়ির বাড়িতে তোমাদের না দেখে এখানে চলে এলাম।

গোরার সঙ্গে সবাই সমুদ্রে নেমে প্রায় একঘণ্টা ধরে চান করে বাসায় ফিরে পোশাক বদল করে বালিসাহীতে সার্বভৌমের বাসায় গেল। তাদের অভ্যর্থনা করে ঘরে এনে বসাল সার্বভৌম। মন্দিরের প্রসাদ পেল সবাই। গোরার সঙ্গে একান্তে কিছু আলাপ আলোচনার ইচ্ছে সার্বভৌম জানাতে তাকে রেখে সঙ্গীরা গোপীনাথের সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তাদের নিয়ে নির্জন রাস্তা ধরে নরেন্দ্রসরোবর দেখাতে চলল গোপীনাথ। সার্বভৌম বলল, কুলিয়ার ভাই-এর কাছ থেকে খবর পেয়েছি তুমি পরম কৃষ্ণভক্ত, সেখানে অনেকে তোমাকে কৃষ্ণাবতার বলে, তোমাকে দেখে আমার ধারণা হয়েছে, তারা ভুল কিছু বলে না। সন্ন্যাস নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে থাকার ইচ্ছে তুমি জানিয়েছ, আমি শুনেছি। পুরুষোত্তমপুরে এখন কিছুটা অরাজকতা চললেও বেশিদিন তা থাকবে না। তুমি শান্তিতে জপতপ করে এখানে যতদিন খুশি কাটাতে পারবে। এই সময়টাতে তুমি অনায়াসে দাক্ষিণাত্যে তীর্থভ্রমণ সেরে আসতে পারো। দাক্ষিণাত্যে গেলে বিজয়নগর রাজ্যের রাজধানীতে একবার অবশ্যই দর্শন দিও। তোমাকে পেলে সে রাজ্যের সভাপণ্ডিত, আমার সুহৃদ চক্রপাণি খুব খুশি হবে। রাজা কৃষ্ণদেব বিষ্ণুভক্ত। তোমার মতো কৃষ্ণভক্ত সন্ন্যাসীর দেখা পেলে রাজা পরম শ্রদ্ধায় পায়ের ধুলো নেবে। সন্ন্যাস নিয়ে তুমি পুরুষোত্তমপুরে রয়েছ জানলে রাজা হয়তো উৎকল রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি চুক্তি করবে। বিষ্ণুভক্ত রাজা সুকবি, প্রজাপালন নিয়ে সংস্কৃত ভাষায় তাঁর লেখা পুঁথির যশোগাথা ইতিমধ্যে রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সমুদ্রপার থেকে ভট্টমারীরা পর্যন্ত সেখানে গির্জা বানানোর সুযোগ পেয়েছে। সংস্কৃত আর তেলেগু ভাষায় তাঁর সমান ব্যুৎপত্তি। সবচেয়ে বড় কথা, বিজয়নগরের তিনি-ই তুলুভ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, বীর যোদ্ধা তিনি, প্রজাবৎসলও। তুলুভ বংশের শেষ রাজা নরসিংহ তুলুভের পতনের দিনে রাজা কৃষ্ণদেবই বিজয়নগরকে বাঁচিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, কৃষ্ণদেবের সঙ্গে তোমার পরিচয় হলে তোমাকে বিজয়নগরে থেকে যেতে রাজা অনেক কাকুতি মিনতি করবে, তুমি কিন্তু আমাদের ছেড়ে সেখানে থেকে যেও না। বিজয়নগরে ঢোকার আগে পথে পড়বে রাজমহেন্দ্রী। সেখানে শাসক রামানন্দ পট্টনায়ক, সবাই বলে, রামানন্দ রায়, রাজকর্মচারী সে, আলালনাথের কাছে বেন্টপুরে তার বাড়ি, সে-ও কৃষ্ণভক্ত, তোমাকে দেখলে সে ভারি খুশি হবে, তার সঙ্গে পারলে একবার দেখা করে যেও।

সার্বভৌমের পরামর্শ গোরা মন দিয়ে শুনছিল। কোনও প্রশ্ন না করলেও সে টের পাচ্ছিল উৎকল আর বিজয়নগরের মধ্যে পরোক্ষে মৈত্রী ঘটানোর দায়িত্ব তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সার্বভৌম। বিষ্ণুভক্ত রাজা কৃষ্ণদেব আর কৃষ্ণভক্ত রাজা রামানন্দকে দেখার আগ্রহ তার মনে উথলে উঠলেও বিষয়ভোগী রাজাদের সান্নিধ্য করা কতটা সঙ্গত হবে, ভাবছিল। সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের থেকে রাজা মহারাজদের ধার্মিকতা অনেক আলাদা, তাদের ধর্মীয় নিষ্ঠা যে মর্কট বৈরাগ্য, ধর্মের নামে ভণ্ডামি, এ নিয়ে তার সন্দেহ ছিল না। তবু প্রেমভক্তির আবেশ আর নামসংকীর্তন দিয়ে ছদ্মধার্মিকদের মনে কৃয়ানুরাগ জাগানোর ব্রত নিয়েছিল সে। প্রেমভক্তি প্রচারের সঙ্গে আরও কিছু কাজ তার করার আছে। মানুষ বড় দুঃখী, বহুকাল ধরে সে কাঁদছে, দুঃখী মানুষকে সে ভুলতে পারে না, তার পাশে সারাজীবন সে দাঁড়াতে চায়। কান্নাভেজা আতুর মানুষের কথা ভাবলে কৃষ্ণের মুখ তার মনে পড়ে। বৃন্দাবনের চিরকিশোর কৃষ্ণের মুখের সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজার হাজার বঞ্চিত মানুষের মুখ। তার চোখে জল এসে যায়। মনে পড়ে যায় দাদা বিশ্বরূপকে। সাংঘাতিক একটা পুঁথি তার জন্যে লিখে রেখে কোথায় উধাও হয়ে গেল মানুষটা? কৃষ্ণকে পাওয়ার আর্তি তার যত বাড়ছে, তাল রেখে তত তীব্র হচ্ছে বিশ্বরূপকে খোঁজার তাগিদ। কৃষ্ণের জন্যে তার চোখ দিয়ে যত জল ঝরে তার অনেকটা মনের নিভৃতে নিরুদ্দেশ দাদার জন্যে লুকোনো শোক, কাউকে তা বলতে পারে না। কৃষ্ণনাম জপ করতে শুরু করলে কতবার ‘দাদা গো দাদা গো’ বলে ডুকরে ওঠে, সে হিসেব তার নিজেরও জানা নেই। মাঝে মাঝে তার বিভ্রম হয়, কৃষ্ণের জন্যে আকুলতা আর ঘর ছাড়া দাদার জন্যে মনের কষ্ট বোধহয় একাকার হয়ে গেছে। তখন তার শরীরে কাঁপুনি ধরে, গায়ে কাঁটা দেয়, বেহুঁশ হয়ে পড়ে সে। ভক্তরা অবাক হয়ে নজর করে তার অষ্টসাত্ত্বিক বিকার, তাকে কৃষ্ণাবতার ভেবে ভক্তিতে গলে গিয়ে কাঁদতে থাকে। সবটাই ভক্তিতে উপচে পড়া চোখের জল নয়, লুকোনো দুঃখ তাদেরও কম নেই। কেঁদে হালকা হয় তারা। তাকে বেশি করে আঁকড়ে ধরে। এই মানুষগুলোকে সে ছাড়তে পারে না। সন্ন্যাস জীবনের কঠোর কৃচ্ছ্র মেনে আদর্শ মানুষ হিসেবে তাদের সামনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে খাড়া থাকতে চায়।

সার্বভৌমের উপদেশের অন্তর্নিহিত নির্দেশ হৃদয়ঙ্গম করার সঙ্গে গোরা মাথার মধ্যে বয়ে যাচ্ছিল নিজের চিন্তাস্রোত। সার্বভৌমের পরামর্শ বিনীতভাবে মেনে নিলেও দাক্ষিণাত্যের তীর্থস্থানগুলোতে দাদার খোঁজ করা সবচেয়ে বড় কাজ, এ সিদ্ধান্ত তার মাথাতে অনড় ছিল। কৃষ্ণপ্রেমিক সে। কৃষ্ণকে যেমন পেতে চায়, তেমনি খুঁজে বার করতে চায় দাদাকে। তার খোঁজার আকুলতার মধ্যে কৃষ্ণ আর বিশ্বরূপ কখনও সখনও অভিন্ন হয়ে যায়। সার্বভৌম বলল, আমার বিশ্বাস তোমার প্রেমভক্তির টানে দু’দেশের রাজার মধ্যে মিলমিশ হয়ে যাবে, চিরকালের মতো তাদের মধ্যে গড়ে উঠবে সৌহার্দ্য।

এক মুহূর্ত থেমে সার্বভৌম বলল, দাক্ষিণাত্যে তুমি রওনা হওয়ার আগে তোমার মুখে একটু শাস্ত্রালোচনা শুনতে চাই।

শাস্ত্র আমি বিশেষ কিছু জানি, না, কৃচিন্তায় পাগল হয়ে সংসার ছেড়েছি।

তুমি শুধু সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসনি, সন্ন্যাস নিয়েছ, তুমি সন্ন্যাসী।

মাথা মুড়িয়ে, কৌপীন জড়িয়ে সন্ন্যাসীর ভেক নিলেও আমাকে সন্ন্যাসী ভাবার কারণ নেই। সংসারধর্ম ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে আমি বোধহয় ধর্মনাশ করেছি।

সার্বভৌমের মনে হল গোরা প্রলাপ বকছে। ছেলেটার মাথার ঠিক নেই। বৈদান্তিক পণ্ডিত শুরু করল গোরাকে বেদান্ত বোঝাতে। নিষ্ঠাবান ছাত্রের মতো সাত দিন ধরে চুপচাপ গোরা শুনল সার্বভৌমের বেদান্ত ব্যাখ্যা। শঙ্করাচার্যের অভিমত মেনে বেদান্ত সূত্রের ব্যাখ্যা শুনলে গোরা একটা শব্দ উচ্চারণ করল না।

গোরার নীরবতায় সার্বভৌম অবাক হওয়ার সঙ্গে কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি যা বলে যাচ্ছি, তুমি বুঝতে পারছ তো? না বুঝলে ফের ব্যাখ্যা করতে পারি।

গোরা বলল, আপনার মতো শাস্ত্র জ্ঞানী আমি নই, সামান্য লেখাপড়া জানি, বেদান্তের সূত্রগুলো আপনি যখন আবৃত্তি করেন, বুঝতে পারি, কিন্তু আপনার ভাষ্য শুনে ধাঁধা লেগে যায়। বেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সব ঐশ্বর্যে পূর্ণ ব্রহ্ম এক বিশাল ব্যাপার, ‘অপানিপাদঃ’। আপনি বলছেন ব্রহ্ম নিরাকার, তার হাত পা নেই, আমার ধারণা ব্রষ্ম থেকে বিশ্বচরাচরের জন্ম, ব্রে তাদের লয়, পুনর্জন্ম, ব্রত্ম অপাদান কারক অধিকরণ কারক, করণ কারক, এত যার কারকতা, সে কীভাবে নুলো, নিরাকার হয়? ব্রহ্মই কৃষ্ণ সর্বশক্তিমান, তাকে নিঃশক্তি, অথর্ব ভাবার কোনও যুক্তি নেই। সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, জন্ম-মৃত্যুর মূলে তারই উপস্থিতি, তাই সে মায়াধীশ, তার তৈরি মায়াতে বিজড়িত মানুষ, তার সংসার, মানুষ হল তার হৃদয়, সে হল সব হৃদয়ের কর্তা, হৃদয়বিধাতা। মানুষের শেষ পরিণাম মৃত্যু মানেই জীবনটা মিথ্যে নয়, ‘ব্রক্ষ্ম সত্য, জগত মিথ্যা’ শঙ্করাচার্যের এই বিবর্তবাদী ভাষ্য তাই কাল্পনিক। বেদের মূল কথা হল শুদ্ধভক্তি, প্রেম, যার পরমেশ্বর হল কৃষ্ণ।

গোরার ব্যাখ্যা পুরো মেনে নিতে না পারলেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় সার্বভৌম অনুভব করল। চুপ করে কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে সার্বভৌম বলল, তুমি ভাবিয়ে তুললে আমাকে। আমি অবশ্যই ভাবব।

গোরা বলল, আমি সামান্য লেখাপড়া জানা মানুষ, কোনও ঔদ্ধত্য দেখিয়ে থাকলে দয়া করে মাপ করবেন আমাকে।

গোরার পিঠে হাত রেখে সার্বভৌম বলল, তুমি জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে, আমার পুত্রতুল্য, আমি টের পাচ্ছি, তোমার কৃষ্ণভক্তিতে ভেজাল নেই, তোমায় একটা প্রশ্ন করি, পাণ্ডিত্য কি মানুষের হৃদয়কে কঠিন, অন্ধকারাচ্ছন্ন করে?

দু’ঠোটে হাসি ছড়িয়ে গোরা বলল, আমি পণ্ডিত নই, আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার অধিকার নেই আমার। শুধু বলতে পারি, মানুষকে ভালবাসতে শিখুন, সব শাস্ত্রের শুরু ভালবাসা থেকে, শেষও সেখানে, আমি মহামূর্খ হয়েও তা বিশ্বাস করি। সরল, সহজ করে সব কিছু বুঝতে চাই। হে পণ্ডিতপ্রবর, আপনাকে শুধু একটা অনুরোধ, আলো ঝলমল আকাশকে ধোঁয়া, ধুলোয় ঢেকে দেবেন না।

সার্বভৌম চুপ করে থাকতে গোরা বলল, খুব তাড়াতাড়ি দাক্ষিণাত্যে রওনা হতে চাই। তার আগে যদি একবার জগন্নাথদেবের দর্শন পেতাম, আমার মন ভরে যেত।

সার্বভৌম তাকাল গোরার দিকে, বলল, চিলিকার যে গোপন গুহায় মহাপ্রভু এখন রয়েছেন, রাজসভার যে কয়েকজন মন্ত্রী, অমাত্য তা জানে, তাদের একজন আমি। চিলিকা হ্রদের পশ্চিমে চড়াইগুহা পর্বতে, তোমাকে নিয়ে যাতায়াতে সাতদিন লেগে যাবে। আমি যা খবর পাচ্ছি, মনে হয় তার আগে মন্দিরে মহাপ্রভু এসে যাবেন। রাজা প্রতাপরুদ্র কটকে ফিরে আসার আগে সে বন্দোবস্ত শেষ করতে গোবিন্দ বিদ্যাধর উঠেপড়ে লেগেছে। আমার ধারণা তুমি দাক্ষিণাত্য রওনা হওয়ার আগে মহাপ্রভুর দর্শন পেয়ে যাবে।

সার্বভৌম যা বলেছিল, তাই ঘটল। সুলতানি সেনাকে তাড়া করে কটকে না থেমে যাজপুর সীমান্তের বাইরে গড়মান্দারণ পর্যন্ত দৌড় করালেও শেষ রক্ষা করতে পারল না উৎকল সৈন্যবাহিনী। গড়মান্দারণ কেল্লার হেপাজত ছিল গোবিন্দ বিদ্যাধরের ওপর। সুলতান হোসেন শাহের নেতৃত্বে তার ফৌজ প্রায় বিনা যুদ্ধে কেল্লা দখল করে নিল। কেল্লারক্ষীদের অর্ধেক মারা পড়ল, গোবিন্দ বিদ্যাধর আর বাকি রক্ষীরা বন্দি হল। কেল্লা দখল করে সুলতান যে চাল দিল, তা পূর্বপরিকল্পিত বুঝেও রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের রফা করা ছাড়া উপায় থাকল না। কেল্লার ফাটকে গোবিন্দ ভোই-এর সঙ্গে বন্দি কয়েকশ’ উৎকল সেনার মুক্তির শর্ত হিসেবে প্রতাপরুদ্রকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে সুলতান বাধ্য করল। গৌড়ের রাজধানী একডালা পর্যন্ত নিরাপদে যাওয়ার জামিন হিসেবে গোবিন্দ বিদ্যাধরকে সঙ্গে নিতে চাইল। প্রতাপরুদ্র বুঝতে পারল, সুলতানি সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে হারালেও কূটনীতিতে কোণঠাসা হয়ে গেছে সে। সুলতানের চাপের চেয়ে বেশি চাপ আসছিল রাজধানী কটক থেকে। রাজার দু’গণ্ডা রানীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়, বসুমতী, দাদা গোবিন্দ বিদ্যাধরকে বাঁচাতে কাকুতি মিনতি করে একের পর এক চিঠি লিখে স্বামীকে আর্জি পাঠাচ্ছিল। সুলতানের শর্ত না মেনে রাজার উপায় ছিল না। রাজ্যের উত্তর দক্ষিণ দু’দিকে দুই শত্রুপক্ষের মধ্যে কে বড় বিপদ, কাকে সামলানো বেশি জরুরি, প্রতাপরুদ্র বুঝে উঠতে পারছিল না। রাজাকে মন্ত্রী পারিষদরা যে পরামর্শ দিচ্ছিল, সেখানে সুযুক্তি, কুযুক্তি মিশে ধাঁধা তৈরি করেছিল। রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আর প্রান্তে সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতাপরুদ্রকে ছুটে বেড়াতে হচ্ছিল। সুলতানের সঙ্গে শ্যালক গোবিন্দকে গৌড় পাঠালে সে আদৌ ফিরবে কিনা এ নিয়ে প্রতাপরুদ্রের মনে সন্দেহ ছিল। গোবিন্দ খুন হয়ে গেলে রানী বসুমতীর কাছে লজ্জার শেষ থাকবে না। সুলতানের সন্ধি প্রস্তাবকে কিছুটা রদবদল করে রাজা যে চুক্তি তৈরি করল, তা মেনে নিতে সুলতানের অসুবিধে হল না। রাজ্যের একাংশ, গড় মান্দারণ সমেত মেদিনীপুর দণ্ডপাটের শাসনকর্তা পদে গোবিন্দকে বসিয়ে তাকে রাজার সমান মর্যাদা দিল প্রতাপরুদ্র। গৌড়ের সুলতানের সঙ্গে উৎকল রাজ্যের অঙ্গচ্ছেদের যে চক্রান্ত গোবিন্দ চালাচ্ছিল, তা কয়েক বছরের চেষ্টায় সফল হল। রাজা প্রতাপরুদ্র ভারাক্রান্ত মনে রাজধানী কটকে ফেরার পথে জেনে গেল চৌত্রিশহাজার সৈন্য আর আটশ’ হাতির বাহিনী নিয়ে নেলোর জেলার উদয়গিরি দুর্গ ঘিরে প্রতিপক্ষের অপেক্ষায় রাজা কৃষ্ণদেব বসে রয়েছে। সুলতানকে নিরাপদে গৌড়ের সীমানায় পৌঁছে দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে গোবিন্দ বিদ্যাধর কটকে হাজির হল। উদয়পুর দুর্গ থেকে আত্মীয়দের মুক্ত করে আনতে দাক্ষিণাত্য অভিযানের আগে ক্লান্ত প্রতাপরুদ্র কয়েকদিনের জন্যে কটকের রাজপ্রাসাদে বিশ্রাম করছিল। সেনাবাহিনীরও একটু বিশ্রামের দরকার। রাজা কৃষ্ণদেবের সেনাবহরের যে ফিরিস্তি ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে এঁটে উঠতে নিজের বাহিনীকে ঢেলে সাজানো ছাড়া উপায় নেই। বিশ্রামের সঙ্গে সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়ানোর কাজে প্রতাপরুদ্র যখন মন্ত্রী, অমাত্যদের সঙ্গে শলাপরামর্শ চালাচ্ছে, তার আগে চিলিকার চড়াই পর্বতের গুহা থেকে মহাপ্রভুর দারুমূর্তি জগন্নাথ মন্দিরে রত্নাসনে পৌঁছে গিয়েছিল। ভক্ত, সেবকদের জন্যে মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার পরের দিন সার্বভৌমের সঙ্গে মহাপ্রভু জগন্নাথ দর্শনে অনুগামীদের নিয়ে গিয়েছিল গোরা। জগন্নাথ মূর্তির আড়ালে বাঁশি হাতে কৃষ্ণকে দেখে প্রবল ভাবাবেশে নিতাই, জগদানন্দ, দামোদর, গদাধরকে নিয়ে মূল দেউলের জয়বিজয় দরজার বাইরে জগমোহন মণ্ডপে এসে উদ্দণ্ড নাচের সঙ্গে মৃদঙ্গ, করতাল বাজিয়ে যে সঙ্কীর্তন শুরু করেছিল, উৎকলের মানুষ আগে তা দেখেনি। সমুদ্রের উথাল পাথাল ঢেউ-এর মতো নাচের মুদ্রায় ভাসছিল বাহ্যজ্ঞান হারানো গোরার শরীর। মন্দিরের জগন্নাথ মূর্তির সঙ্গে জগমোহন মণ্ডপের দিকে তাকিয়ে ভক্তরা দেখছিল গৌড়ের পাঁচ অচেনা ভক্তের নাচ, শুনছিল সুরেলা সঙ্কীর্তন। উৎকলের ভাষার সঙ্গে গৌড়ের ভাষার তফাত থাকলেও বিশুদ্ধ প্রেমভক্তির আকুলতা হৃদয়ঙ্গম করতে স্থানীয় মানুষদের অসুবিধে হচ্ছিল না। গোরার ভক্তির মহিমা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল সার্বভৌম। দাক্ষিণাত্য অভিযান থামিয়ে গৌড়ের বাহিনীকে উৎকলের সীমানা ছাড়া করে রাজা প্রতাপরুদ্রের কটকে ফিরে আসার খবর ইতিমধ্যে সার্বভৌম পেয়ে গেছে। রাজার জয়ধ্বনিতে দেশ ভরে গেলেও গোবিন্দ বিদ্যাধরের চালে সুলতানের সঙ্গে কূটনীতির যুদ্ধে হেরে প্রতাপরুদ্রকে যে রাজ্যের অঙ্গহানি ঘটাতে হয়েছে, কয়েকজন মন্ত্রী, সান্ত্রী ছাড়া কেউ জানে না। তাদের কেউ কেউ এই ঘটনার কার্যকারণ বুঝে আড়ালে গাল পাড়ছে রানী বসুমতীকে। বিজয়নগর যাওয়ার পথে দুই যুযুধান রাজ্যের হানাহানির মধ্যে গোরাকে পড়তে হবে না, এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিল সার্বভৌম। দাক্ষিণাত্যের পথে সরাসরি রওনা করে দিয়েছিল গোরাকে। নিতাই, জগদানন্দ, দামোদর, গদাধর, নবদ্বীপের চার বন্ধুর কাউকে গোরা সঙ্গী নিল না। পুরুষোত্তমপুরে তাদের অপেক্ষা করতে বলে স্থানীয় একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের পথে পা বাড়াল। তীর্থযাত্রীদের মধ্যে গোরাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সার্বভৌম। তারা সার্বভৌমের শিষ্য, ছাত্র, যজমান। মহৎ ব্রত নিয়ে সন্ন্যাসী গোরা দাক্ষিণাত্য পরিক্রমায় যাচ্ছে, তাদের জানিয়েছিল। গোরাকে দেখভাল করার দায় তার সঙ্গীরা স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছিল নিজেদের ঘাড়ে। নবদ্বীপের চার সঙ্গীর কেউ গোরাকে একা দাক্ষিণাত্যে যেতে দিতে রাজি না থাকলেও তার জেদের কাছে সবাইকে হার মানতে হল। পুরুষোত্তমপুর থেকে আলালনাথ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিল চার সঙ্গী। গোপীনাথও জুড়ে গেল সেই দলে। গোরাকে আরও একবার রাজমহেন্দ্রী মণ্ডলমের বিদ্যানগর দণ্ডপাটে রামানন্দ রায়ের সঙ্গে দেখা করার কথা মনে করিয়ে দিল সার্বভৌম। বিজয়নগরের রাজার সভাপণ্ডিত চক্রপাণিও যে তার অপেক্ষায় রয়েছে, তা জানাতে ভুলল না।

সদ্যপরিচিত তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে গোরা চলল দাক্ষিণাত্যের পথে। কৃষ্ণনামে বিভোর গোরা কয়েকদিনের মধ্যে সহযাত্রীদের হৃদয় এমন জয় করে নিল যে, তার সঙ্গে তারাও নেচে গেয়ে ভাবাবেশে আপ্লুত হয়ে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলতে থাকল। ধর্মরাজ্য সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট কোনও ধারণা না থাকলেও বিদ্বেষ বৈষম্যহীন সুখী এক সমাজের আবছা রূপরেখা নিশ্চয় তাদের মাথাতে ছিল। তাদের দু’-একজন বিষ্ণুর উপাসক বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেবের লেখা সুশাসিত রাষ্ট্রনীতির পুঁথির নাম শুনেছে। বিজাপুর, গোলকুণ্ডার শাসকদের যুদ্ধে হারিয়ে নিজের রাজ্যের সঙ্গে নতুন দুটি মণ্ডলম জুড়ে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছে কৃষ্ণদেব, এখবরও তাদের অজানা নয়। তবে তার রাজত্বের ওপর চাপ রয়েছে প্রচণ্ড। আহম্মদনগরের সুলতান, মালিক আহম্মদের শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে বিজয়নগরের বিত্তসম্পদের বাড়বাড়ন্তে। বিজয়নগর আক্রমণের জন্যে শক্তি বাড়াচ্ছে সে। সমুদ্রপার থেকে আসা পর্তুগিজ নাবিকদের সর্দার, আলবুকের্ককে ভাটখালে বাণিজ্যকুঠি বানানোর অনুমতি দিয়েছে কৃষ্ণদেব। কুঠির কাছাকাছি সমুদ্র পেরিয়ে আসা কিছু সন্ন্যাসী মিলে সাধনভজন করতে যে আখড়া খুলেছে, তার নাম ‘গির্জা’। ভাটখালের গির্জাতে যে সন্ন্যাসীরা থাকে তাদের ‘ভট্টমারী’ বলা হয়। ভট্টমারীরা একেশ্বরবাদী। তাদের গুরুর নাম খ্রিস্ট। বিজয়নগরের মানুষের ধারণা বৃন্দাবনের কৃষ্ণের আর এক অবতার খ্রিস্ট। যবনদের মতো তারাও মূর্তিপুজোয় বিশ্বাস করে না। রাজা কৃষ্ণদেবের রাজ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই। রাজা বিষ্ণুপূজক হলেও ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীরা নিজেদের মতো ধর্মচর্চা করতে পারে। রাজ্যের সভাপণ্ডিত চক্রপাণি হলেও দুই বৈদিক পণ্ডিত মাধবাচার্য আর সায়নাচার্য ছিল রাজসভার অতিথি সদস্য। তারা জ্ঞানমার্গে অদ্বৈতবাদী আবার ভক্তি আন্দোলনের সহমর্মী ছিল। অদ্বৈতবাদী চক্রপাণি ছিল আন্তরিক কৃষ্ণভক্ত।

.

আলালনাথ থেকে সঙ্গী তীর্থযাত্রীদের নিয়ে রাজমহেন্দ্রীতে পৌঁছনোর পথে নানা মুখ থেকে দাক্ষিণাত্য সমেত উত্তর-পশ্চিম ভারতের তক্ষশিলা, সোমনাথ পর্যন্ত অঞ্চলের প্রচুর খবর গোরা জেনে গেল। তার উদ্দাম নাচ গান, তীব্র কৃষ্ণভক্তিতে রাজমহেন্দ্রী পৌঁছনোর আগে তার অনুরক্ত হয়ে উঠেছিল সহযাত্রীরা। চব্বিশবছরের অনিন্দ্যসুন্দর এই মানুষটির পূর্বাশ্রমের খবর কেউ জানতে না চাইলেও, সে গৌড়িয়া, সার্বভৌমের মুখ থেকে তারা শুনেছিল। সন্ন্যাসীর সাধনকর্মের অঙ্গ তীর্থপরিব্রাজনে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য (সন্ন্যাসজীবনে গোরার নাম বেরিয়েছে, এ অনুমানও তারা করেছিল। সন্ন্যাসীর যেহেতু কোনও বাড়ি নেই, তাই সে ঠিকানাহীন, কোন তীর্থস্থান থেকে কোথায় যাবে, কোথায় রাত কাটাবে, ক’দিন থাকবে, এ প্রশ্ন কেউ করেনি। বহু বছরের সংস্কার পরম্পরায় সবাই জানত সন্ন্যাসীর সঙ্গে আচার ব্যবহারের নিয়মবিধি। রাজমহেন্দ্রীতে সহযাত্রীদের থেকে গোরা আলাদা হয়ে গেলেও কেউ জানতে চাইল না, তার পরবর্তী গন্তব্য। গৌড়ের শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের সঙ্গে শেষবার খোল, করতাল, বাঁশি, মন্দিরা নিয়ে সঙ্কীর্তনে মেতে উঠল তারা। হেসে কেঁদে, ভাবাবেশে লুটিয়ে পড়ে তার পায়ের তলা থেকে মুঠো মুঠো মাটি তুলে ধুতি, চাদরের খুঁটে বেঁধে নিল। বিজয়নগরের ভেতর দিয়ে তীর্থযাত্রীরা যাবে সেতুবন্ধ রামেশ্বর তীর্থে। গোরাও সেই পথে যাবে। বিদ্যানগরের শাসক রামানন্দ রায়ের সঙ্গে দেখা করে, বিজয়নগরের সভাপণ্ডিত চক্রপাণির সঙ্গে সাক্ষাৎকার সেরে কবে রামেশ্বরে পৌঁছবে, সে নিজেও জানে না। রাজা, জমিদার, শাসকদের পাশ কাটিয়ে চলা সন্ন্যাসীর ধর্ম। দীনাতিদীন, সকলের অধম মানুষজন যেখানে থাকে, সেটাই সন্ন্যাসীর শুচিশুদ্ধ রাতের ছাউনি, চলার পথে বিশ্রামের জায়গা। বিষয়ী মানুষের সঙ্গ তার কাছে বিষের মতো পরিত্যজ্য। রাজমহেন্দ্রীতে গোদাবরী নদীর পাশে পথের ধারে তাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে সহযাত্রীদের অনেকে কাঁদল। চোখের জল লুকোতে নদীতে স্নান করতে নেমে পড়ল কেউ কেউ। স্নানের ঘাট ফাঁকা করে দিতে তখনই উর্দিপরা দুই পাইক সেখানে এসে হাঁকডাক শুরু করে দিল। বিদ্যানগরের রাজা পালকি চেপে চান করতে আসছে শুনে যারা নদীতে ছিল চটপট উঠে পড়ল, স্নানঘাটে ঝাড়ু চালিয়ে সাফাই শুরু করল দুই নোকর। গ্রীষ্মের সকাল। সূর্য মাঝ আকাশে না পৌঁছলেও রোদে ঝকমক করছে নদীর জল। ঘাট ছেড়ে গোরার সহযাত্রীরা উঠে ঘাড়ে বোঁচকা তুলে তাড়াতাড়ি রাজার চোখের আড়ালে সরে পড়তে ব্যস্ত হলেও ঘাটের পাশে ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের ছায়ায় গেরুয়া পোশাক, ন্যাড়া মাথা সন্ন্যাসী নিজের ছোট পুঁটলি কোলে নিয়ে বসল। সহযাত্রীরা তাকে ডাকাডাকি করলেও সে উঠল না। কৃষ্ণপ্রেমে ছন্নছাড়া হয়ে মা, বউ সংসার ভাসিয়ে মনের গভীরে কোথাও অনুতাপ জমলেও কৃষ্ণনামে সে ডুবে গেল। পূর্বাশ্রমে তার এক দাদা ছিল, ষোলোবছর বয়সে ঘর ছেড়ে সে নিরুদ্দেশ হয়েছে, দাদাকে খুঁজতে সে দাক্ষিণাত্যে চলেছে, এত ঘটনা কাউকে সে বলেনি। পারিবারিক জীবনের স্মৃতি সন্ন্যাসীকে ভুলে যেতে হয়। শুধু দাদার খোঁজে তীর্থযাত্রাতে সে বেরোয়নি। আরও কাজ আছে তার। প্রেমভক্তির জোয়ারে উৎকল আর বিজয়নগর রাজ্যের বহু বছরের বৈরিতা ভাসিয়ে দিয়ে দু’দেশের রাজার মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চায় সে। সেখানেই শেষ নয় তার পরিব্রাজন। তাকে ঈশ্বরপুরী শুনিয়ে গেছে, সবরকম সাধনা, মূর্ত বিমূর্তের মধ্যে কৃষ্ণের উপস্থিতি। ধর্মরাজ্যের জন্যে মহামঞ গড়ে তুলতে সকলের সহযোগ, ভক্তি, ভালবাসা একত্র করতে হবে। শৈব নয়নার, বৈষ্ণব অলওয়ার সম্প্রদায়ের সঙ্গে জৈন, বৌদ্ধ, পশ্চিমে নামদেব, শ্রী সম্প্রদায়ের গুরু রামানুজের শিষ্য প্রয়াগের রামানন্দ, তার শিষ্য মুচি রবিদাস, তাঁতি কবীর, নাথপন্থী সাধকগোষ্ঠী, পঞ্চনদের তীরবাসী নানক, পান্ধারপুরের তুকারাম, সাধকদের নামের লম্বা একটা ফর্দ তাকে শুনিয়েছিল ঈশ্বরীপুরী। বিদ্যাবাচস্পতির কাছেও পেয়েছে নানা পথ, মতের সাধকদের হদিশ। সব পথ, সব মতের সত্য একসঙ্গে মিললে যা তৈরি হয়, তার নাম মহাসত্য, সে-ই ঈশ্বর, সে কৃষ্ণ, কেশব, রাম, হরি, সে-ই তার বাপ। গোদাবরী নদীর ধারে এক তেঁতুলগাছের তলায় ভাবাবেশে গোরা যখন প্রায় বেহুঁশ, কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে স্নানের ঘাটে পৌঁছে গেল বিদ্যানগরের রাজা রামানন্দ রায়ের পালকি। রাজার স্নানের ঘাট তখন সুনসান ফাঁকা, সেখানেও কোনও আনকা স্নানার্থী নেই, পালকি থেকে নেমে রামানন্দ প্রথমে সূর্যপ্রণাম করল, গোদাবরী নদীকে প্রণাম সেরে ঘাটের উত্তর দিকে তাকিয়ে গাছতলায় এক অল্পবয়সি সুদর্শন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীকে ভাবাবিষ্ট হয়ে বসে থাকতে দেখে ভাগবদের যে শ্লোকটি উচ্চারণ করল, তা হল, নিজের কাছেও বিস্ময় উদ্রেককারী, সৌন্দর্যসম্পদের পরমাশ্রয়স্বরূপ, এই যে দেহ, যার কোনও অলঙ্কার লাগে না, বরং যে দেহে জায়গা পেলে অলঙ্কার কৃতার্থ হয়, মর্ত্যলীলার উপযোগী সেই অপরূপ দেহ নিয়ে কাকে অনুগ্রহ বর্ষণ করতে যোগমায়ার পূর্ণক্ষমতা ছড়িয়ে এখানে বসে আছেন?’ (‘যন্মর্ত্যলীলৌপয়িকং…ভূষণভূষণাঙ্গম্’)

ঘাট ছেড়ে ধীর পায়ে গাছতলায় গোরার সামনে এসে শ্লোকের শেষাংশ বলে রামানন্দ থামতে তার দিকে তাকিয়ে গোরা জিজ্ঞেস করল, তুমি রামানন্দ?

তখনই তার পায়ের ওপর লুটিয়ে প্রণাম করে রামানন্দ বলল, হ্যাঁ, আমি রামানন্দ, আপনার দাসানুদাস।

রামানন্দকে বুকে টেনে নিল গোরা। বলল, সার্বভৌমের মুখে শুনেছি তোমার গুণপনা, তুমি পরম কৃষ্ণভক্ত, তুমি আমার আত্মার আত্মীয়।

সার্বভৌমের মুখে নবদ্বীপের গোরার নাম, তার প্রেমভক্তি প্রচারের নানা কাহিনী শুনে মানুষটা সম্পর্কে রামানন্দর মনে যে শ্রদ্ধাভক্তি জেগেছিল, সেই মুহূর্তে তা আকাশচুম্বি জলোচ্ছ্বাসের মতো ফুলে ফেঁপে উঠল। পূর্ণিমা রাতের চাঁদের মতো গায়ের রঙ, মেঘহীন শরতের নীল আকাশের মতো গভীর দুটো চোখ, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা দু’হাত, পথের ধুলোতে ধূসর মানুষটার শরীর থেকে যেন পদ্মফুলের সুবাস বেরোচ্ছে। রামানন্দ বলল, হে সন্ন্যাসী, কয়েকদিনের জন্যে আপনি দয়া করে আমার আতিথ্য স্বীকার করলে, এই বিষয়ভোগী মানুষটার পাপের বোঝা খানিকটা হালকা হয়। আপনি না বলবেন না।

গোরা বলল, গোদাবরী নদীর ধারে, এই গাছতলায় আমি তোমার আতিথ্য ভিক্ষা করছি।

বিদ্যানগরে সন্ন্যাসীদের জন্যে অতিথিশালা রয়েছে। আপনার পায়ের ধুলোয় পবিত্র হোক সেই পাতার কুটির।

দুপুরের আকাশের মতো আলো ছড়িয়ে গোরা হাসল। বলল, গাছতলাই হল সন্ন্যাসীর কুটির। তুমি চান সেরে বাড়ি যাও। দুপুরে খাওয়ার পরে একটু বিশ্রাম করে সন্ধের ছায়া নামলে এখানে এসো। তোমার মতো কৃষ্ণভক্তের দেখা পেতে আমি অপেক্ষা করে থাকব।

আপনি খাবেন কী?

গেরুয়া চাদরের খুঁটে বাঁধা একমুঠো চাল দেখিয়ে গোরা বলল, রাজমহেন্দ্রীতে আসার পথে যা ভিক্ষে পেয়েছি, তাই যথেষ্ট, আর এই তেঁতুলগাছের তলায় পেয়েছি পাকা তেঁতুল। ভাত খেতে এর বেশি সন্ন্যাসীর কিছু লাগে না।

গোরার কথা শুনে রামানন্দ হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। সন্ন্যাসীকে অতিথিশালার নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বুঝে গেল। তবু তার বুকের ভেতরটা হু হু করতে থাকল। গোরাকে দ্বিতীয়বার প্রণাম করে রামানন্দ বলল, হে ইচ্ছাময়, আপনি যা চান, তাই হবে। বিকেল শেষ হলে আপনাকে দর্শন করতে আমি চলে আসব।

গাছতলায় বসে কৃচিন্তায় গোরা বিভোর হয়ে গেল। শুধু কি কৃষ্ণচিন্তা? তা কি কখনও হয়? ঈশ্বরের সন্তান অথবা অবতার হিসেবে যাদের পরিচয়, তারাও রোজ, চব্বিশ ঘণ্টা ধরে আমৃত্যু শুধু ঈশ্বরের ধ্যান করে গেছে, এমন ঘটেনি। পৃথিবীতে যাদের মধ্যে তার জন্ম, সেই সমাজ, সংসার, পরিবার, প্রিয়জনও ভাবিত করেছে তাদের। মানুষের জন্যে তাদের কেউ কেউ উৎসর্গ করেছে নিজের জীবন। শিবের ভক্ত দধীচি মুনি, স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের প্রার্থনায় বৃত্রাসুর নিধনের জন্যে স্বেচ্ছায় জীবন দিয়েছিল। শুধু ইন্দ্রের প্রার্থনার জন্যে নয়, পৃথিবীর প্রজাকুলকে শান্তি আর অভয় দিতে আত্মোৎসর্গ করেছিল দধীচি। পৃথিবীর সব ধর্মে মানুষের কল্যাণে প্রাণ দিয়েছে এরকম মহান ধর্মগুরুর অসংখ্য নজির পাওয়া যায়। সংসার বন্ধনহীন সন্ন্যাসীকে আসলে অখণ্ড মানুষের সমাজে জলের মধ্যে মাছ যেভাবে ঘুরে বেড়ায়, সেভাবে মিশে যেতে হয়, গোরা টের পেয়েছিল। কৃষ্ণচিন্তা, কৃষ্ণনাম জপ, সঙ্কীর্তনের আসরে ভাবাবেশে বেহুঁশ হওয়ার মুহূর্তেও তার চোখের সামনে ভাসত হত-দরিদ্র গৌড়ের লাখ লাখ মানুষের মুখ, নবদ্বীপের সমাজ, মা, বউ, সংসারের ছবি, প্রিয়জনদের সে ভুলতে পারত না। অধর্মাচারী, ভ্রষ্ট শাসকদের বিরুদ্ধে মনের মধ্যে ক্রোধের আঁচ জাগত। তার মনে পড়ত সমবয়সী শুশ্রুত রায়, হামীর রায়, পীতাম্বর রায়, আরও কয়েকজন উদ্দীপ্ত রাজপুরুষকে, বিদ্যাবাচস্পতির ঘরে তার সঙ্গে যারা দেখা করেছিল। তাদের সঙ্গে সামান্য সময়ের জন্যে আলাপচারিতায় গোরার ধর্মরাজ্যের ব্যাখ্যা তারা মেনে নিয়েছিল। গোরা বলেছিল, প্রেমভক্তিই ধর্ম, সত্য আর সুন্দরের যোগে জন্ম নেয় প্রেমভক্তি। অসত্য, অসুন্দরের জায়গা নেই সেখানে। সত্য, সুন্দরের আর এক নাম কৃষ্ণ।

গোরার ব্যাখ্যা সর্বান্তঃকরণে মেনে নিয়ে তাকে সত্য আর সুন্দরের জীবন্ত প্রতিমূর্তি ভেবে শ্রদ্ধায় তারা বিগলিত হয়েছিল। গোদাবরীর ঢেউ-এর ছলাৎছল আওয়াজ শোনার সঙ্গে মাটির হাঁড়িতে একমুঠো চালের গরম ভাতে তুলসিমঞ্জুরী ছড়িয়ে, আধপাকা তেঁতুল মেখে দুপুরের খাওয়া তৃপ্তিতে সারল গোরা। গোদাবরী নদীর দিকে তাকিয়ে নবদ্বীপের গঙ্গা, যার আর এক নাম জাহ্নবী, সেই স্মৃতিময় প্রবাহকে সে দেখতে পাচ্ছিল। গঙ্গার পাশে দেখছিল যমুনাকে যমুনার তীরেই তো বন্ধুদের সঙ্গে কৃষ্ণের ছেলেবেলা খুশি আর খেলায় কেটেছিল। বৃন্দাবনের শরীর ছুঁয়ে যমুনা বয়ে গিয়ে প্রয়াগে গঙ্গায় মিশেছে। বৃন্দাবনের নাম মাথায় আসতে সেখানে যাওয়ার আকুলতা ভর করল তাকে। বৃন্দাবন আর মথুরা নিয়ে যে ব্রজভূমিতে বারোটা বন, উপবন, প্রতিবন আর অধিবনে একদা কৃষ্ণের লীলাভূমি ছিল, যা যুদ্ধ আর হানাহানিতে এখন বিধ্বস্ত, পরিত্যক্ত, সেই পবিত্র ভূখণ্ডকে উদ্ধার করে প্রেমভক্তির মহাপীঠ গড়ার স্বপ্ন গয়া থেকে নবদ্বীপে ফিরে সে দেখতে শুরু করেছিল। বৃন্দাবনই তার আসল পিতৃভূমি, কৃষ্ণ তার বাপ! প্রেমভক্তি প্রচারে পুরুষোত্তমপুরের চেয়ে তার বেশি পছন্দের ব্রজভূমি, এ নিয়ে তার মনে সন্দেহ নেই। ব্রজভূমি শুধু কৃয়ের জন্মস্থান, তার পিতৃভূমি নয়, আর্যাবর্তে পৌঁছনোর মূল সড়ক-ও বটে। হাজার হাজার বছর ধরে এই পথে আর্যাবর্তের সঙ্গে গৌড়, উৎকল, পাটলিপুত্র, প্রাগজ্যোতিষপুরের যোগাযোগ, যাতায়াত চলেছে। সাধু, সন্ন্যাসী থেকে পরিব্রাজক, বণিক, সওদাগরেরা এই পথে দেশের পুব-পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আর্যাবর্তকে জানতে বসবাসের সেরা জায়গা ব্রজধাম। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে বৃন্দাবনে থাকার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেললেও মায়ের কাকুতি মিনতিতে পুরুষোত্তমপুরে ডেরা করতে রাজি হয়েছিল সে। সারা বছর ধরে দল বেঁধে নবদ্বীপের যত মানুষ পুরুষোত্তমপুরে তীর্থ করতে যায়, তার এক দশমাংশ ব্রজধামে যায় না। কালের শাসন আর মানুষের উপেক্ষায় ব্রজধামের মহিমা মলিন হয়ে গেছে। বৃন্দাবনকে সংস্কার করে পুরনো মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার চিন্তা করেছিল গোরা। সন্ন্যাস নিলেও মায়ের আবদার সে অমান্য করতে পারেনি। মা চেয়েছিল সংসার ছেড়ে ছেলে চলে গেলেও এমন জায়গায় সে থাকুক, নবদ্বীপের মানুষের যেখানে যাতায়াত আছে। পুরুষোত্তমপুরে ছেলে ডেরা করলে সেখান থেকে নিয়মিত তার খবর পাবে শচী। মায়ের আদেশ মাথা পেতে মেনে নিলেও সে ভোলেনি, তার অনুগামীদের কয়েকজন এখনও বৃন্দাবনে বাস করার ইচ্ছে মনের মধ্যে পুষে রেখেছে। বৃন্দাবনে তাকে যেতেই হবে, সে জানত। দাক্ষিণাত্য পরিব্রাজন শেষ করে পুরুষোত্তমপুরে ফিরে সেখানে ছেড়ে আসা সঙ্গীদের নবদ্বীপে পাঠিয়ে বৃন্দাবনে যাবে সে। অদ্বৈত আচার্য আর বিদ্যাবাচস্পতির কাছে শুনেছে সেখানে বছরের পর বছর প্রায় অজ্ঞাতবাসে জীবন কাটাচ্ছে সুবুদ্ধি রায়। গৌড়ে ধর্মরাজ্য কায়েম করার পরিকল্পনায় তার ছেলে সুশ্রুতের সশস্ত্র অভ্যুত্থানে বাপের পরামর্শ আছে কি না গোরা জানে না। শুধু জানে, ধর্মনাশ হলেও পরম সাত্ত্বিকের মতো সে দিন কাটাচ্ছে।

মাথার মধ্যে, হাজার চিন্তার বুজকুড়ি উঠলেও চোখের সামনে গোদাবরীর স্রোতে, নদীর দু’পাশের গাছপালায়, ঘাসের ডগা, নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়া মাছরাঙা পাখির পাঁচ রঙের ডানায় কৃষ্ণকে দেখে সে ভাবাবেশে আবিষ্ট হচ্ছিল। মনে মনে বলছিল, আমি তোমাকে চাই, তুমি আমার বাপ, আমার সর্বস্ব, প্রেমভক্তি দাও, প্রেমভক্তিতে আমাকে ভাসিয়ে দাও, নিজে ভেসে যাওয়ার সঙ্গে চারপাশের সবাইকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারি। গভীর ভাবাবেশে গোরার দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছিল। নবদ্বীপে ফেলে আসা মা, বউ-এর মুখ মনে পড়তে চোখে জলের স্রোত বেড়ে গেল। নবদ্বীপে সংসারে থেকেও প্রেমভক্তিতে সে ডুবে ছিল। হাজার হাজার অনুগামী জুটেছিল তার। তার জনপ্রিয়তার প্রবলতায় কেঁপে উঠেছিল গৌড়ের সিংহাসন। সুলতানের রোষে তার জীবন বিপন্ন হওয়ার দশা হলেও সংসার, মা, বউ ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে পালিয়ে আসা ঠিক হয়নি। অসহায় বিধবা মা, যুবতী, সুন্দরী বউ-এর ভরণপোষণের দায়িত্ব না নিয়ে তাদের শুকিয়ে মারার ব্যবস্থা করতে সে সন্ন্যাস নিয়েছে। অপরাধ করেছে সে, ঘোরতর পাপ করেছে, বোধবুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ এরকম দুষ্কর্ম করে। কৃষ্ণের জন্যে মতিচ্ছন্ন হয়েছে তার। কী করবে সে? সারাক্ষণ তার আশপাশে কৃষ্ণ শুধু রয়েছে, তাই নয়, তার দেহের গন্ধ, মুখের হাসি, হাতের ছোঁয়া অনবরত সে পাচ্ছে। তাকে নাচাচ্ছে, গাওয়াচ্ছে, আবেশে বেহুঁশ করে দিচ্ছে, তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিজের কথা বলাচ্ছে। তার প্ররোচনাতে সন্ন্যাসী হয়েছে সে। ছেলেকে তার বাপ সন্ন্যাসী হওয়ার ডাক দিলে, ছেলে সাড়া না দিয়ে থাকে কী করে?

গোদাবরীর ধারে তেঁতুলতলায় বসে কৃষ্ণের ধ্যানে গোরা যখন বুঁদ হয়ে আছে, তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে এক ব্রাহ্মণ বলল, দেবতা, আপনি যদি দয়া করে আমার আতিথ্য ভিক্ষা করেন, আমি ধন্য হব।

গোদাবরী নদীর ঘাট থেকে সদ্য স্নান সেরে আসা মানুষটাকে দেখে গোরা খুশি হল। তার আতিথ্য নিতে রাজি হলেও জানালো, বিকেলে রামানন্দ রায় সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

ব্রাক্ষ্মণ বলল, তাকে ধরে আমার নিজের বাড়িতে আমি নিজে নিয়ে আসব। তিনি আমার সুহৃদ, কৃষ্ণভক্ত, একেবারে আলাদারকম ভক্তি তার।

কৃষ্ণের নাম শুনে গোরার গায়ে কাঁটা দিল। কৃষ্ণের শরীরের গন্ধ পেল সে, তার ছোঁয়া পেল। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নাম সঙ্কীর্তনের সঙ্গে নাচ শুরু করল। ব্রাহ্মণ দেখল দুধচন্দনে মেশা গায়ের রং, অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল শরীর, গেরুয়া কৌপীন জড়ানো সন্ন্যাসীর নাচের মুদ্রায় নদীর নির্জন তীরের ডানে, বাঁয়ে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ছে। বিদ্যানগরের ব্রাহ্মণের মনে প্রেরণা জাগল, সে-ও গোরার সঙ্গে সঙ্কীর্তন, নাচে মেতে উঠল। নদীর ধার দিয়ে দু’একজন যারা যাতায়াত করছিল, তারা এক অচেনা সন্ন্যাসীর সঙ্গে মহল্লার চেনা এক ব্রাহ্মণকে পাকা নর্তকের মতো নাচতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নর্তক হেঁজিপেঁজি ব্রাহ্মণ নয়, সে রায় রামানন্দের কুলপুরোহিত, ব্রজনাথ ভট্ট। দু’একজন করে পথচারী মানুষ জমছিল সেখানে। সন্ন্যাসীর নাচ গানের টানে পুতুলের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হল না। গুটিগুটি পায়ে তারা সঙ্কীর্তনে ঢুকে পড়ল। সঙ্কীর্তন, নাচের একটা আখর বা মুদ্রা না জেনে ও তাদের গলার সুরে, নাচের তালে কোনও ভুলচুক ঘটল না। লোকের ভিড় বাড়তে থাকলে, সে খবর পৌঁছে গেল রাজপ্রাসাদে রায় রামানন্দের কাছে। দুপুরে স্নানের ঘাটে বিদ্যুৎঝলকের মতো অত্যাশ্চর্য সুন্দর তরুণ সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তাকে এক মুহূর্তের জন্যে রামানন্দ ভুলতে পারেনি। প্রাসাদে ফিরে মধ্যাহ্নের খাওয়া শেষ করে পালঙ্কে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় এপাশ ওপাশ করলেও চোখে ঘুম আসছিল না। কখন সূর্যাস্ত হবে, ছায়া নামবে পৃথিবীতে, সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করতে যাবে, এই ভেবে উসখুশ করছিল। দুপুর ফুরনোর আগে রামানন্দের কাছে খবর পৌঁছে গেল গোদাবরীর তীরে এক সন্ন্যাসীর টানে সঙ্কীর্তনের এমন এক অলৌকিক আসর জমে উঠেছে, যেখানে বিদ্যানগরের হেটো, মেঠো সব জাতের মানুষ নাচ গানে মেতে উঠেছে।

পুরুষোত্তমপুরের বাসুদেব সার্বভৌমের কাছ থেকে নবদ্বীপের সন্ন্যাসী সম্পর্কে অনেক খবর আগে শুনলেও তার দৈবী মূর্তি আর গুণপণা যে সীমাহীন, দুপুরে কয়েক মুহূর্তের আলাপচারিতায় রামানন্দ চাক্ষুষ করেছে। সন্ন্যাসীর ভাববিহ্বল মুখ গেঁথে গেছে তার বুকের মধ্যে। পুরুষোত্তমপুর থেকে দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পথে বিজয়নগরের রাজধানী বাদামীতে এই সন্ন্যাসী প্রেমভক্তির ঝড় তুলে দু’রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে, এ আভাসও সার্বভৌমের চিঠি থেকে রামানন্দ পেয়েছিল। বিজয়নগরের বিষ্ণুভক্ত রাজা কৃষ্ণদেব রায় যে সন্ন্যাসীকে দেখলে গভীর শ্রদ্ধায় বরণ করে তার শরণাগত হবে, এ নিয়ে রামানন্দর সন্দেহ ছিল না। সার্বভৌমের পরামর্শ মতো গৌড়ের সন্ন্যাসীর সঙ্গে বিজয়নগর রাজসভার তিন পণ্ডিত চক্রপাণি, মাধবাচার্য আর সায়নাচার্যের দেখা করার আয়োজন রামানন্দ করে রেখেছে। উৎকল রাজ্যের সঙ্গে বিজয়নগরের মৈত্রী চায় তারা। উৎকলের বিরুদ্ধে বিজয়নগরের যুদ্ধাভিযান যতই সফল হোক, জয়ের পরেও বিজয়নগর বিশেষ নিরাপদে নেই। অপরাজেয় রাজা কৃষ্ণদেবের রাজত্ব দখল করতে বিজাপুর, গোলকুণ্ডা, আহম্মদনগর, বিদরের শাসকরা জোট বাঁধছে। রাজ্য বাঁচাতে ব্যতিব্যস্ত রাজা কৃষ্ণদেবও উৎকল রাজ্যকে মিত্রশক্তি হিসেবে পেতে চায়। নানা গুজবের সঙ্গে কথাটা রামানন্দর কানে এসেছে। গোরাকে দেখে তার মনে হয়েছে বাতাসে উড়তে থাকা গুজব অবশ্যম্ভাবী সত্যের চেহারা নিতে চলেছে। দুই বৈরী রাজ্যকে এই সন্ন্যাসী মিলিয়ে দেবে।

খুশি আর উত্তেজনায় বিছানায় উঠে বসল রামানন্দ। তার মনে হল গোদাবরীর ধারে তেঁতুলতলায় সঙ্কীর্তনের আসরে এখনই তার যাওয়া দরকার। সঙ্কীর্তন শেষ করে সন্ন্যাসী যদি ভাবাবেগে বিদ্যানগর ছেড়ে রাজমহেন্দ্রী মণ্ডলমের বাইরে চলে যায়, তাকে আর ধরা যাবে না। পালঙ্ক থেকে নেমে তাড়াতাড়ি শরীরে গেরুয়া চাদর জড়িয়ে প্রাসাদের বাইরে এসে দাঁড়াল রামানন্দ। দুই রক্ষী দণ্ডবৎ করে মনিবের আদেশের অপেক্ষা করছে। রামানন্দ ইসারায় তাদের ডেকে নিয়ে ঘাটের পথে পা বাড়াল। গোদাবরীর ধারে রাজা রামানন্দ হাজির হতে আসর ঘিরে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা সসম্ভ্রমে পথ করে দিলেও সঙ্কীর্তনে মেতে থাকা প্রজাদের কেউ তার দিকে তাকাল না। দেশান্তর থেকে আসা সন্ন্যাসীর মধ্যে তারা যেন নতুন রাজা পেয়েছে। তাকে ঘিরে প্রজারা মাতোয়ারা। গোরার সঙ্গে পা মিলিয়ে নাচ গানে তারা আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। গোরার মতো তাদের দু’চোখে জল, মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছিল দু’একজন। সঙ্কীর্তনের স্রোতে কৃষ্ণভক্ত রামানন্দ ভেসে গেল। গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের রাজা পরিচয় ভুলে পাকা নর্তকের মতো নাচ শুরু করল। গানে তালিম নেওয়া সুরেলা গলা তার। সঙ্কীর্তনে সে গলা মেলাতে তাকে নজর করে দু’হাতে বুকে টেনে নিল গোরা। সঙ্কীর্তন থামল না। বিদ্যানগরের রাজা প্রজাকে সঙ্কীর্তনের আসরে গোরা মিলিয়ে দিতে যারা আসর ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল, নাচ গানে তারাও কম নয়, এমন কিছু ভেবে সবাই আসরে ঢুকে পড়ল। সঙ্কীর্তনের ঢেউ উথলে পড়ল গোদাবরীর স্বচ্ছ জলস্রোতে।

মাঝ আকাশ ছেড়ে পশ্চিমে নামছে সূর্য। নদীর দু’ধারে ঘন হচ্ছে গাছপালার ছায়া। ভারী শরীর, মাঝবয়সি রামানন্দ সমান তালে গোরার সঙ্গে নেচে গেয়ে এমন কুদরতি দেখাচ্ছে যা গভীর আবেগ ছাড়া জাগে না। গোরা একসময়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে তাকে কয়েকজন ধরে যত্ন করে মাটিতে শুইয়ে দিল। রামানন্দ নাচ থামাল। রাজা দাঁড়িয়ে যেতে বাকিরা দাঁড়িয়ে গেল। ভক্তিবিহ্বলতা থেকে সন্ন্যাসী বেহুঁশ হয়ে গেছে, রামানন্দর বুঝতে অসুবিধে হল না। কৃষ্ণপ্রেমে সে-ও বেহুঁশ হতে চায়। কখনও তা ঘটে না। কেন এমন হয়? রামানন্দ টের পেল এই সন্ন্যাসীর সঙ্গ তার খুব দরকার। কুলপুরোহিত ব্রজনাথ আর দুই রক্ষীকে রেখে বিদ্যানগরের প্রজাদের ঘরে পাঠিয়ে দিল রামানন্দ। অল্পসময়ের মধ্যে গোরা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল, তার দু’পাশে রামানন্দ আর ব্রজনাথ বসে আছে। গোরা উঠে বসল। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল। গোদাবরীর জলে নেমে সান্ধ্যস্নান সেরে ভিজে অঙ্গবস্ত্র বদল করে ফিরে এল গাছতলাতে। সন্ধে নামার আগে ব্রজনাথের বাড়িতে পৌঁছে গেল সে। দুই রক্ষীকে প্রাসাদে পাঠিয়ে কুলপুরোহিতের বাড়িতে রামানন্দও এসে গেছে। তাকে ডেকে পাশে বসিয়ে গোরা বলল, হে কৃষ্ণপ্রেমী, কৃষ্ণের প্রেমরহস্য ব্যাখ্যাতে তুমি অদ্বিতীয়, এ কথা পুরুষোত্তমপুরে সার্বভৌমের কাছ থেকে জেনেছি। তোমার মুখ থেকে কৃষ্ণপ্রেমের বর্ণনা শুনে আমি জীবন সার্থক করতে চাই।

কী বলছেন প্রভু, আমি মন্দশূদ্র, বিষয়ী মানুষ আপনার দাস। আপনার সামনে মুখ খোলার সাহস আমার নেই।

প্রকৃত ভক্ত তুমি। সাধনার শেষ সীমা কোথায় আমাকে জানাও।

আমি কিছু জানি না, তবে জানি যার যা কাজ, মন দিয়ে তা করাই হল ধর্ম, শাস্ত্রে বলে স্বধর্মপালন।

কথাটা ঠিক, কিন্তু এটা শেষ কথা নয়। আর একটু ভেঙে বলো।

রামানন্দ মুহূর্তের জন্যে চুপ করে থেকে বলল, স্বধর্মপালনের সঙ্গে মানুষে মানুষে সম্পর্কও গভীরভাবে কাজ করে। রাজাকে সেবা করা দাসের কাজ, সেটা তার স্বধর্মপালন। রাজা যদি বন্ধুর মতো দাসের সঙ্গে ব্যবহার করে সেবক তখন সখা হয়ে যায়। সে তখন একই সঙ্গে সেবক আর সখার ভূমিকা পালন করে, রাজা হয়ে ওঠে মনিব এবং বন্ধু। সখ্য বজায় রাখা, তখন স্বধর্মপালন।

বেশ বলেছ রামানন্দ, সংসারী মানুষ যাতে বুঝতে পারে, সেভাবে আর একটু বিশদ করে বলো।

আপনি বলুন।

আমি সংসারভীরু, সংসার থেকে পলাতক, কিছু-ই জানি না। সংসারের মধ্যে ঈশ্বর রয়েছে, আমার চেয়ে তুমি তা ভালো জানো, তুমি-ই বলো।

রামানন্দ বিষয়ী লোক হলেও বুঝতে পারল না, এই সন্ন্যাসী সাংসারিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে প্রেমভক্তির কোন রহস্যময় কিনারায় তাকে নিয়ে যেতে চাইছে। সে বলল, সংসারে মা, ছেলের সম্পর্কের মতো পবিত্র সম্পর্ক আর নেই, ছেলে যেমন ভালবেসে মাকে আঁকড়ে থাকে, তার চেয়ে একশ’গুণ বেশি স্নেহে ছেলেকে মা জড়িয়ে থাকে। মায়ের এই সন্তানস্নেহ, শাস্ত্রে যাকে বাৎসল্য বলা হয়, তা আরও উঁচুমানের ভক্তি। আমি ঈশ্বরের সন্তান হলেও আসলে সে-ই আমার সন্তান, এই ভাবের উচ্ছ্বাস-ই পরম ভক্তি

রামানন্দ টের পেল, তার মুখ থেকে আরও কথা এই সন্ন্যাসী বার করে নেবে, যা আগে সে কখনও ভাবেনি। তাই ঘটল। গোরা বলল, রামানন্দ এখানে থেমো না, আরও বলো, এগিয়ে যাও।

রামানন্দ বলল, বাৎসল্য প্রেমের পরে আর একটা পর্ব বাকি থাকে, তা হল কান্তাপ্রেম। হ্যাঁ, কান্তাপ্রেম-ই ভক্তিমার্গের শেষকথা।

রামানন্দকে বুকে জড়িয়ে গোরা বলল, ধন্য রামানন্দ, ভক্তিসাধনার সর্বোচ্চ স্তরের খোঁজ তুমি দিলে আমাকে। তোমার মতো ভক্তের তুলনা পাওয়া কঠিন। তবু আমার ধারণা প্রেমভক্তির আরও কিছু গভীর কথা, তুমি জানো। দোহাই, প্রাণ খুলে কথা বলো।

গোরার অনুরোধ শুনে কথা সরল না রামানন্দের মুখে। মাথা নিচু করে, চুরির দায়ে যেন ধরা পড়েছে, এমন মুখ করে গুম হয়ে কয়েক মুহূর্ত সে বসে থাকল। ঘরের দরজা ভেজানো। সন্ন্যাসীর রাতের ভিক্ষা জোগাড়ে গিন্নির সঙ্গে ব্রজনাথ নিশ্চয় হাত লাগিয়েছে। ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে রেড়ির তেলের একটা প্রদীপ জ্বেলে কুলুঙ্গিতে সে রেখে গেছে। বাইরে অন্ধকার ঘন হলেও প্রদীপের আলোয় ঘরের মেঝেতে বসে থাকা দুটো মানুষের ছায়া দেওয়ালের গায়ে টলমল করছে। রামানন্দ বলল, প্রভু, তুমি কোথায় নিয়ে চলেছ আমাকে?

কৃষ্ণভক্ত যেখানে খুশি যে কোনও পথে যেতে পারে, কৃষ্ণকে পাওয়ার সেটাই পথ।

গোরার কথা শুনে রামানন্দ বলল, হে দেবতা, আমাকে অকথ্য কথনে তুমি উদ্দীপ্ত করলে, তোমাকে দণ্ডবৎ করি। ভক্তির শেষ সীমা পরকীয়া প্রেম। রাধিকার কৃয়েন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছার মতো কৃষ্ণের জন্যে ভক্তের আকুলতা হল ভক্তিমার্গের শেষ ধাপ। সেখানে সাধ্য আর সাধন, এই দুই বস্তু ছাড়া কিছু নেই, অথচ দুই-এর মধ্যে সকলে আছে। আছে বিশ্বচরাচর, মহাকাল, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রলোক, আলো, অন্ধকার, ঝড়, বৃষ্টি, মেঘ, রোদ আর পঞ্চম মার্গ, যার নাম প্রেম। প্ৰেম-ই শেষ কথা। আত্মপ্রেম নয়, কৃষ্ণপ্রেম।

রামানন্দর ব্যাখা শুনে গোরার দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে।

.

রামানন্দ নিশ্চুপ। সে যা বলল, তা নিজে যেমন বুঝে উঠতে পারছে না, তেমনই ভেবে পাচ্ছে না কীভাবে বলল। গৃহজীবনে সংসারধর্ম পালন করলেও পরকীয়া প্রেমে সে অনভ্যস্ত নয়। বিদ্যানগরের শাসক সে, প্রভূত ক্ষমতার সঙ্গে যথেচ্ছ ভোগবিলাসের অধিকারী। কৃষ্ণভক্ত হলেও পরকীয়া প্রেমের লক্ষণগুলোকে ভক্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যাতে এভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায়, আগে কখনও কল্পনা করেনি। সংসারে দাম্পত্যজীবন যাপন করেও বিশ্বসংসারকে আড়ালে রেখে একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোক মিলে চোখে দেখা পৃথিবীর মধ্যে এক অদেখা, আবেগাতুর প্রেমের পৃথিবীর সুতীব্র স্বাদ পেতে পারে, রামানন্দের অজানা নয়। বৃন্দাবনে আয়ান ঘোষের স্ত্রী রাধিকা আর ষোলোশ’ বিবাহিতা এবং অপরিণীতা গোপিনীর সঙ্গে কৃষ্ণের অলৌকিক প্রেমলীলার ব্যাখ্যায় নিজের লৌকিক জীবনকে জড়িয়ে ফেলে সে বিব্রত বোধ করল।

গোরাকে পরকীয়া প্রেম সম্পর্কে আরও কিছু তার বলার ছিল। পরস্ত্রীর প্রেমিক যদি অবিবাহিত পুরুষ হয়, সেই পরকীয়ার যে স্বাদ, সে বিবাহিত হলে, স্বাদ আরও মধুর পরপুরুষের একই নিয়ম খাটে তার প্রেমিকার ক্ষেত্রে। অনূঢ়া প্রেমিকার বদলে বিবাহিতা প্রেমিকার সঙ্গসুখে তীব্রতা বেশি। দাম্পত্য সম্পর্কের অভিজ্ঞতায় পোক্ত প্রেমিক, প্রেমিকার ভালবাসাতে পুরুষ আর রমণীর ভেদাভেদ মিলিয়ে যায়, কে পুরুষ, কে রমণী, দু’জনের কেউ বুঝে উঠতে পারে না। অলৌকিক মায়ার জগতে তারা বাস করে।

প্রেমভক্তির এই অচিন্ত্যনীয় পর্যায়কে শব্দ জুড়ে জুড়ে না বলে রামানন্দ একটা গান শোনাল গোরাকে। গান শেষ হতে রামানন্দকে জড়িয়ে ধরে গোরা বলল, প্রেমভক্তির এই ব্যাখ্যা মানুষকে এখনই বোঝাতে না পারলেও আপাতত কৃষ্ণনামে তাদের মাতিয়ে তুলতে চাই। কৃষ্ণভক্তি যদি কৃষ্ণপ্রেমে পৌঁছে যায়, প্রেমের আকুতি যদি স্ত্রী, পুরুষ ভেদাভেদমুক্ত চেহারা নেয়, তার চেয়ে আনন্দের সাধনা আর কী হতে পারে?

একমুহূর্ত থেমে গোরা বলল, আমাকে ভক্তিসাধনার নতুন পথ তুমি দেখালে রামানন্দ। তোমার ওপর কৃষ্ণের অফুরন্ত কৃপা বর্ষিত হোক

সবই আপনার কৃপা।

গোরা হাসতে রামানন্দ বলল, বিদ্যানগরে যখন তোমার পায়ের ধুলো পড়েছে, দয়া করে কয়েকদিন এখানে থেকে যাও।

দাক্ষিণাত্য থেকে ফেরার পথে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। কাল সূর্য ওঠার আগে সেতুবন্ধের পথে বিজয়নগরের রাজধানী বাদামী রওনা হব।

আমি জানি প্রভু। আপনার দর্শন পেতে বাদামীতে পণ্ডিত চক্রপাণি, দুই বৈদান্তিক মাধবাচার্য আর সায়নাচার্য পথ চেয়ে অপেক্ষা করছেন। রাজধানীতে আপনার পা পড়লে বিজয়নগরের আকাশ থেকে সব দুর্যোগ কেটে যাবে, এই তাঁদের বিশ্বাস। আমিও বিশ্বাস করি আপনার প্রেমভক্তির জোয়ারে ভেসে যাবে বিজয়নগর। বাহমনি সুলতান থেকে আরও যারা বিজয়নগর রাজ্যকে গিলে নিতে যুদ্ধের ঘুঁটি সাজাচ্ছে, হাওয়ায় তারা উড়ে যাবে।

রামানন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে গোরা হাসল। ব্রজনাথ ঘরে ঢুকে জানালো সন্ন্যাসীর আতিথ্য ভিক্ষার সব আয়োজন তৈরি, দয়া করে তিনি গ্রহণ করলে, গৃহস্থের কল্যাণ হয়।

গোরাকে ছেড়ে রামানন্দর তখনই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে না থাকলেও কুলপুরোহিতের সম্মান রাখতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ব্রজনাথের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে গোরাকে বলল, প্ৰভু আজ বিকেলে তোমার সঙ্গে সঙ্কীর্তন করার আবেগ এখন আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল করছে। সারা সন্ধে আমাকে বসিয়ে আমার মুখ থেকে প্রেমভক্তির যে ব্যাখ্যা তুমি বার করে নিলে, তা আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। তোমাকে ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। তবু যেতে হচ্ছে। সন্ন্যাসীকে কবে কে আটকে রাখতে পেরেছে? কথা দাও, দাক্ষিণাত্য থেকে ফেরার পথে বিদ্যানগরে দর্শন দেবে আমাকে। রামানন্দকে বুকে জড়িয়ে গোরা বলল, ফের দেখা হবে তোমার সঙ্গে।

উৎকলের ভাষা গোরার অনেকটা চেনা হলেও দাক্ষিণাত্যে ঢোকার পর থেকে ভাঙা সংস্কৃতের সঙ্গে কিছুটা মাগধীপ্রাকৃত ভাষা মিলিয়ে কাজ চালাচ্ছিল সে। সন্ন্যাসীর কাজ বলতে নামজপ আর এক মুঠো তণ্ডুল ভিক্ষা, যার নাম মাধুকরী। লম্বা পথ পেরিয়ে বাদামীতে পা রাখার আগে সে জেনে গেছে আলাদা করে সন্ন্যাসীর ভাষা শেখার দরকার হয় না। বৈরাগ্যের মন্ত্র আর সঙ্কীর্তন তার আসল ভাষা। ‘হরেকৃষ্ণ’ নাম সবাই জানে, তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় আত্মভোলা নাচের ছন্দ, গানের সুর। দাক্ষিণাত্যের পথে ভক্তিবাদের নানা ধারা, শ্রী, নয়নার, আলবার সম্প্রদারে সঙ্গে সঙ্কীর্তনে মিশে গিয়ে ভাবাবেশে কতবার সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে হিসেব নেই! মাথার মধ্যে সুর ঢুকলে ক্রমশ সে আত্মহারা হয়ে যায়। তার শরীরের রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে ওঠে, দরদর করে প্রথমে দু’চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে, পরের ধাপে ঘামে ভেসে যায় শরীর, সে অনুভব করে বাতাসে সে ভেসে চলেছে, নক্ষত্রলোকে ঠেকে গেছে তার মাথা, পাতালগঙ্গায় গলা পর্যন্ত ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। পদ্মের গন্ধমাখা সুরের হিল্লোলে এক সময়ে সে বেহুঁশ হয়ে যায়। সঙ্গীসাথীদের অনেকে বলেছিল, তখন তাকে তার বাপ কৃষ্ণের মতো দেখায়, সেই অবস্থায় কখনও তার চার হাত, কখনও ছ’হাত গজায়। এসব গালগল্পে সে বিশ্বাস করে না। কৃষ্ণের ভক্ত সে, কৃষ্ণকে সে ভালবাসে, নিজে কখনও কৃষ্ণ হতে চায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *