গোরা – ৭

যথাবিধি জগন্নাথের উপবীত সংস্কারের শুভানুষ্ঠান সেই সন্ধেতে তার শ্বশুর নীলাম্বর চক্রবর্তী সম্পন্ন করেছিল। আকাশে শুকতারা ওঠার এক দণ্ড, সাত পল, পাঁচ বিপল, তিন অনুপল গতে, নতুন উপবীত ধারণ করার আগে পর্যন্ত ঘরের ভেতরে লুকিয়েছিল জগন্নাথ। উপবীত খোয়ানোর ঘটনা যাতে পাঁচকান না হয়, তার জন্যে এই সতর্কতা। গৃহভৃত্য ঈশানকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল, ঘটনাটা একেবারে চেপে যেতে। উপবীত ছিন্ন হওয়ার বিবরণ জানাজানি হলে, নানা মুখে তা কী চেহারা নেবে, ভেবে ভয় পেয়েছিল জগন্নাথ। ন্যায়শাস্ত্রীরা জানলে কড়া প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিতে পারে। স্মার্তদের কানে ঘটনাটা গেলে, পাড়াছাড়া হওয়ার ভয় আছে। দু’পক্ষ একমত হলে, পাঁচপো গোমূত্র, এমনকি পুরীষ খাওয়ার নিদান দিতে পারে। ব্রাহ্মণসমাজ থেকে এমন ফরমান জারি হলে জগন্নাথের জীবনে সর্বনাশ ঘটে যাবে। উচ্ছন্নে যাবে তার সংসার। শচী, দুই ছেলে এমনকি গোয়ালের গাভীটা পর্যন্ত খাদ্যের অভাবে শুকিয়ে মরবে। পুরীষ খেয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করার খবর যজমানদের কানে পৌঁছলে, সে যত বড়ো শাস্ত্রজ্ঞ পুরোহিত হোক, তার নাক উঁচু, বিত্তবান শিষ্যরা, সুকৌশলে তাকে কুলপুরোহিতের পদ থেকে সরিয়ে দেবে। পাঁচ বছরের গোরাও চিরজীবনের মতো ব্রাত্মণসমাজের চক্ষুশূল হয়ে থাকবে। তাকে ব্রাহ্মণবিদ্বেষী কালাপাহাড় ভাবতে শুরু করবে সবাই।

উপবীত ধারণ অনুষ্ঠান নির্ঝঞ্ঝাটে চুকে যেতে জগন্নাথ হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। গোরার ওপর থেকে ক্রোধ ধীরে ধীরে কমে এলেও মনের গভীরে এক অচেনা আশঙ্কা ঘনীভূত হতে থাকল। বয়স বাড়ার সঙ্গে এই সন্তান কী মূর্তি ধারণ করবে, কতরকম বিপত্তি ডেকে আনবে, সদাসর্বদা এই চিন্তা শশব্যস্ত করে রাখল তাকে।

পাঁচে পা দিয়েছে গোরা, দুষ্টুর শিরোমণি। ঘরে, বাইরে তার দুষ্টুমিতে সকলে সন্ত্রস্ত! সমবয়সিদের চেয়ে বড়োদের সঙ্গে তার বেশি ওঠাবসা। তার লম্বা চওড়া শরীর, তাকে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বয়সি করে দিয়েছে। অসম-বয়সের বন্ধুদের সঙ্গে বারকোণা ঘাট, আপন ঘাটে সকাল সন্ধে এমন ডানপিটেপনা করে বেড়ায় যে স্নানার্থীরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দেবদূতের মতো চেহারার এক শিশু কীভাবে এত অশিষ্ট, অভব্য হতে পারে যারা তাকে চেনে আর যারা চেনে না, দু’পক্ষই তার আচরণে সমান অবাক হয়। কেউ ভাবে, সঙ্গদোষে ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গোরার সাথীরা শুধু তার চেয়ে বয়সে বড়ো নয়, বেশির ভাগ শূদ্র পরিবারের ছেলে। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ, সংক্ষেপে ‘ব্রাবৈকা’ গোষ্ঠীর সঙ্গে আছে নবশাক সম্প্রদায়ের ছেলেরা। সংখ্যায় বরং তারাই বেশি। ব্রাক্ষ্মণপল্লীর বাইরে নিজেদের পাড়ায় তারা থাকলেও পারিবারিক পরিচয়ে তাদের কেউ শাঁখারি, কেউ মালাকার, কেউ গোয়ালা, গন্ধবণিক, তাম্বুলি, বাদ্যকর, মালো, ভাট, বৈশ্য পরিবারের ছেলে। ধীবর, খোলাবেচা পরিবারের ছেলেদের সঙ্গেও তার ঘোরাফেরা। খোলাবেচা কেদারের ছেলে শ্রীধরের সঙ্গে তার হলায় গলায় বন্ধুত্ব।

নবদ্বীপে একাধিক ব্রাত্মণপল্লী থাকলেও আকারে সেগুলি ছিল ছোট। অল্প কয়েকটা পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা পল্লীগুলোতে মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। ব্রাহ্মণপাড়ায় শিশুকে খেলার সঙ্গী খুঁজতে শূদ্র পাড়ায় যেতে হয়। সবাই যায় না। দু’চারজন অতিসাহসীরা যায়। শূদ্রপাড়ার শিশুদের অনেকে আবার উচ্চবর্ণের শিশুদের সঙ্গে খেলতে ভয় পায়। তাদের এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। বেশি সময় তা সম্ভব হয় না। শিশুদের ভয়ডর কম। জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই। গোরা আর তার সঙ্গীরা মাথা ঘামাত না। জাতপাত ভুলে গিয়ে তারা একে অন্যের সঙ্গী হয়ে যেত। রূপে, স্বাস্থ্যে সমুজ্জ্বল গোরার সঙ্গীদের বেশির ভাগ ছিল সাত, আট, দশের বালক। পাঁচ বছরের গোরাকে শুধু তার বেশি বয়সের বন্ধুরা কেন, তাদের মা-বাবারাও সাত, আট বছরের বালক ভাবত। বালক বন্ধুদের নিয়ে শিশু গোরা গঙ্গার একাধিক ঘাট দাপিয়ে বেড়াত। চার, সাড়ে চার বছরে সাঁতার শিখে গিয়েছিল। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছের মতো সাঁতার কেটে, স্নান করে এমন সব কাণ্ড ঘটাত, যা বয়স্ক স্নানার্থীদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। ডুব সাঁতার দিয়ে ঘাটের কাছে এসে গলা জলে দাঁড়ানো মন্ত্রপাঠরত কোনও প্রবীণের পা ধরে এমন হেঁচকা টান লাগায় যে জলে চিত হয়ে পড়ার আগে আর্তনাদ করে ঘাটের মানুষকে সে ভয় পাইয়ে দেয়। ইষ্টদেবতার বন্দনা সদ্য শেষ করে জলে ডুব দিয়ে কোনও ব্রাহ্মণ অনুভব করে জল থেকে সে মাথা তুলতে পারছে না। তার ঘাড়ের ওপর যেন ব্রহ্মদৈত্য চেপে বসেছে। জলের নিচে খাবি খেতে খেতে সে যখন ধরে নেয়, মৃত্যু অনিবার্য, তখনই ঘাড়ের বোঝা নেমে যায়, জলের ওপর ভুস করে ভেসে ওঠে তার মাথা। হাঁচাপাঁচা করে আশপাশে নজর করে নিজের বয়সি দু-একজন স্নানার্থী ছাড়া কাউকে দেখতে পায় না। ডুবসাঁতারে ঘাট ছেড়ে গঙ্গার অনেক ভেতরে গিয়ে গোরা ভেসে উঠলে তার খোঁজ পায় না ভয়ার্ত মানুষটার ঝাপসা দৃষ্টি। দু-একজন দেখলেও চুপ করে থাকে। ঘাটের সন্ত্রস্ত স্নানার্থী কখনও গোরাকে দেখতে পেলে, আকাশ ফাটিয়ে চেল্লালেও তার নাগাল পায় না। গোরার নামে রোজ যে কত অভিযোগ জগন্নাথ আর শচীর কাছে জমা হয়, তার হিসেব নেই। শচীর চেয়ে বেশি অভিযোগ শুনতে হয় জগন্নাথকে। মা, মাসির সঙ্গে ঘাটে স্নান করতে আসা দু-একজন বালিকাকে নাকি বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত গোরা দিয়েছে। স্নেহশীল বাবা হলেও জগন্নাথ কড়া ধাতের লোক। তাকে বাড়ি থেকে ডেকে, অভিযোগকারীদের কেউ গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যেতে চাইলে, ছড়ি হাতে সে চলে যায়। গোরাকে পেটানোর ছড়ি শেষ পর্যন্ত কাজে লাগে না। তার স্যাঙাৎদের কেউ ‘বেত হাতে জগন্নাথ আসছে’ খবরটা আগেই গোরাকে পৌঁছে দেয়। ঘাট ছেড়ে গোরা উধাও হয়। ঘাট ছেড়ে পালানোর আগে রাগে অন্ধ হয়ে দু-চারজন স্নানার্থীর মুখে ছড়িয়ে যায় কুলকুচোর জল।

মেয়েদের ঘাটেও গোরা কম উপদ্রব করে না। বেশি বয়সের সাথীরা তাকে উসকে দেয়। ঘাটে স্নান করতে আসা সুন্দরী কোনও বালিকাকে দেখিয়ে সাথীদের কেউ হয়ত জানাল, মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে লুকিয়ে চুরিয়ে গোরাকে দেখছে। বোধহয় বিয়ে করার ইচ্ছে হয়েছে গোরাকে।

মেয়েটা সত্যি বিয়ে করতে চায় কিনা, তা জানতে গোরাকে প্ররোচনা দিল আর এক সাথী। ব্যস্ বলার অপেক্ষা মাত্র। এক মুহূর্ত না ভেবে গোরা তাকে জিজ্ঞেস করল, বিয়ে করবি আমাকে?

রূপবান বালকের আকৃতি, এক শিশুর মুখে এই প্রশ্ন শুনে মেয়েটি কী বলবে, ভেবে পায় না। চোখে অন্ধকার দেখে। বেহুঁশ হওয়ার দশা হয় তার। মা, ঠাকুমা পাশে থাকলে তার আঁচলের তলায় লুকোয়। তাদের কারো কানে গোরার প্রস্তাবটা না গেলে, মেয়েদের অনেকে উচ্চবাচ্য করে না। বাড়ি ফিরে অভিভাবকদের কাছে কম মেয়ে-ই অভিযোগ করে। স্বপ্নের রাজকুমারের চেয়ে অনুপম সুন্দর এক বালকের কাছ থেকে বিয়ে করার ডাক পেলে শিক্ষা, বয়স নির্বিশেষে কোনও বালিকা রুষ্ট হয়? বরং সে-ও রঙিন কল্পনার স্রোতে ভাসতে থাকে। গোরার মুখোমুখি হয়ে যে মেয়েরা সঙ্কোচে গুটিয়ে যেত, একান্তে সেই বালকের অনন্যসুন্দর মুখের কথা ভেবে বিমোহিত হয়ে থাকত। বালকটিকে ভবিষ্যতের স্বামী হিসেবে যে কল্পনা করত না, তা-ই বা কে বলতে পারে? সুতরাং কোনও মেয়ে পুজোর নৈবেদ্য গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়ার আগে তার এক খাবলা তুলে গোরা খেয়ে নিলে, তাদের মা, কাকিরা হৈচৈ করে উঠলেও মেয়েরা মজা পেত। যতটা সম্ভব গম্ভীর থেকে মুখের হাসি চেপে রাখত। দূর থেকে তাদের পেত্নি, শাঁকচুন্নি বলে ডেকে গোরা রাগিয়ে দিত। এসব ছিল তার প্রতিদিনের খেলা। বাজার হাটে, পথে, গঙ্গার ঘাটে নবদ্বীপবাসী বয়স্ক শ্রীহট্টের কয়েকজন মানুষ একত্র হয়ে সিলেটি ভাষায় আড্ডা জুড়ে দিলে, তাদের অনুকরণ করে একই ভাষায় সাথীদের সঙ্গে উঁচু গলায় গোরা আলাপ শুরু করে দিত। সে থাকত বক্তা, বাকিরা শ্রোতা। প্রবীণদের কথার অনুকরণ করে, তাদের হাস্যাস্পদ করতে সিলেটি ভাষা কিছুটা বিকৃত করে, গোরা যে এই কাণ্ড করছে, বয়স্ক মানুষগুলোর বুঝতে অসুবিধে হত না। হাতের লাঠি উঁচিয়ে গোরাকে তাড়া করত তারা। গোরা পালাত। দু’এক ঘা লাঠি কখনও সখনও পিঠে তার যে না পড়ত, এমন নয়। দুরন্ত এক শিশুর ধষ্টামির খবর কোটাল, কাজির কাছে যখন পৌঁছে গেছে, তখন কামরূপ অভিযানের পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে গৌড়ের অধিপতি সুলতান হোসেন শাহ। কামরূপের কামাখ্যা মন্দিরে সঞ্জিত সম্পদ লুঠ করে নিতে পারলে খরা, বন্যায় জর্জরিত গৌড়ের রাজস্বের ঘাটতি অনেকটা মেটানো যাবে। সেনাবাহিনীর বকেয়া বেতন পুরো মিটিয়ে দেওয়া যাবে। সেনাবাহিনী ঠিক সময়ে বেতন না পেলে যে কি সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে, গত পঞ্চাশ বছরে কয়েকজন সুলতান প্রাণ দিয়ে তা দেখিয়ে গেছে। পর পর দু’তিন মাসের মাইনে বাকি থাকার জন্যে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বিশ্বস্ততম অংশ প্রাসাদের দেহরক্ষীদের হাতে খুন হয়ে গেছে, সুলতান আলাউদ্দীন আলী শাহ, তার ধাত্রীমাতার ছেলে হাজি ইলিয়াসের ছকবাজিতে খুন হয়েছে। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি নিয়ে লখনৌতির সিংহাসনে বসেছে হাজি ইলিয়াস। সুলতানি মসনদে বসার জন্যে খুনজখম সেখানে শেষ হয়নি। শামসুদ্দিনের মৃত্যুর পরে তার ছেলে সিকন্দর শাহ অল্প কিছুদিন সুলতান পদে আসীন থাকার পরে তার কাকার হাতে খুন হল। ভাইপোকে খুন করে সুলতানি কুর্শিতে বসল কাকা সুলতান জালালুদ্দিন আবুল মুজফ্‌ফর ফতেহ্ শাহ। সুলতানি পাইকদের নেতা, ক্ষমতা ও অর্থলোভী খোজা হাবশি বরবকের চক্রান্তে নিহত হল সুলতান জালালুদ্দিন। জালালুদ্দিন খুন হওয়ার আগে গোরা ভূমিষ্ঠ হয়েছে। জালালুদ্দিনের মৃত্যুতে ফের শুরু হল নৈরাজ্য। সুলতান শাহজাদা নাম নিয়ে সিংহাসনে খুনী বরবক বসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে খুন হয়ে গেল আর এক হাবশি পাইক, মালিক আন্দিলের হাতে। সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ নাম নিয়ে সুলতানি মসনদের দখল নিল মালিক আন্দিল। সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পরে তার বড় ছেলে কুতবুদ্দিন মাহমুদ শাহ অল্পকাল সুলতানি করার মধ্যে সিদি বদর নামে এক হাবশি পাইকের হাতে খুন হয়ে গেল। সুলতান মুজাফ্ফর শাহ নাম নিয়ে সুলতানি ততে চেপে বসল সিদি বদর। অত্যাচারী সুলতান মুজফ্‌ফর যার হাতে মারা পড়ল সে ছিল মুজফ্‌ফরের আমির, নাম সৈয়দ হোসেন, ইতিহাসকথিত মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সুলতান। পুরো নাম ‘আলা আল দুনিয়া ওয়াল দীন আবুল মুজফ্‌ফর হোসেন শাহ’।

কৃষ্ণের নতুন নতুন নামে জন্ম, পুনর্জন্ম নিয়ে যে রটনা একশো বছরের বেশি সময় ধরে চলছিল, অত্যাচারী সুলতান মুজফ্‌ফর শাহের আমলে সেই প্রচার প্রবলতর হয়। সুলতানের দরবারের আমিররা আর এক আমির হোসেন শাহের নেতৃত্বে মুজাফ্ফরকে প্রাসাদবন্দি করে শেষ পর্যন্ত হত্যা করে। গৌড়ের নতুন সুলতান পদে সমাসীন হয়, সৈয়দ হোসেন ‘আলা আল দুনিয়া ওয়াল দীন আবুল মুজফ্‌ফর হোসেন শাহ।’

ইতিহাসের এই রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটে কৃষ্ণের আবির্ভাবের শাস্ত্রবলে ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’ গৌড়ের ব্রাহ্মণদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রতিটা সুলতানের পোষা এক ঝাঁক হিন্দু জ্যোতিষী ছিল। সুলতানদের জন্মছক তৈরি, কোষ্ঠিবিচার থেকে শুরু করে তাদের যুদ্ধযাত্রা, দৈনন্দিন হাঁচিকাশি পর্যন্ত নিয়ে শুভ, অশুভের নিদান দিত জ্যোতিষীরা। তারাই কৃষ্ণকে জাদুকর, সর্বক্ষমতাধর হিসেবে প্রচার করে সুলতানদের রক্তে আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিত। সঙ্ঘবদ্ধ আমীর উজিরদের হাতে ধারাবাহিক সুলতান খুনের চক্রান্তেও যে অদৃশ্য কৃষ্ণের প্ররোচনা আছে, ভারতে আগন্তুক ইসলামধর্মাবলম্বী অভিজাত সম্প্রদায়ের মনের গভীরে বদ্ধমূল হচ্ছিল এ ধারণা। জাদুকর কৃম্বুকে ধরে ফাটকে পোরা, তার মুণ্ডচ্ছেদ করা, প্রশাসনিক কর্মসূচির তালিকাভুক্ত করেছিল তারা। জীবন্ত অথবা মৃত কৃষ্ণের হদিশ পেতে ট্যাড়া পিটিয়ে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। সব সুলতানের আমলেই তা বহাল ছিল। হোসেন শাহের মতো বিচক্ষণ নবাব পর্যন্ত কৃষ্ণের ভয়ে শঙ্কিত ছিল।

যে সুলতানি সেনার তাড়া খেয়ে পাঁচ বছরের গোরা কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছিল তারা ছিল সুলতান মুজফ্‌ফর শাহের বাহিনীর লোক। মুজফ্‌ফর ছিল অসম্ভব নৃশংস চরিত্রের মানুষ। হিন্দু ধর্মবিদ্বেষী হলেও হিন্দু জ্যোতিষীদের ওপর আস্থা ছিল। জ্যোতিষীরা তাকে বুঝিয়েছিল, প্রাসাদের ভেতরের চক্রান্তে তার কুর্শিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমৃত্যু সুলতানি শাসন চালাতে পারবে। কিন্তু জন্মপত্রিকায় এমন কিছু অশুভ গ্রহের যোগাযোগ পাওয়া যাচ্ছে, যা থেকে মনে হয়, বিধর্মী কোনও কাফের তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। মুজফ্‌ফরকে জ্যোতিষীকুল আরও জানিয়েছিল সেই ঘাতক এখনও শিশু। ঘাতকের ভূমিকা নিতে তার আরও কুড়ি বছর লাগবে। আপাতত কুড়ি বছর সুলতান নিশ্চিন্তে রাজধর্ম পালন করতে পারে।

সুলতান প্রশ্ন করে, সেই কাফের কি জন্মেছে?

—হ্যাঁ হুজুর।

—কোথায়?

—গোকুলে।

ক্ষিপ্ত মুজফ্‌ফর গোকুল জায়গাটা ঠিক কোথায় জানতে চাইলে জ্যোতিষী যে দিকনির্দেশ করল, তা শুনে মুজফ্‌ফর হতাশ হল। গোকুল তার সাম্রাজ্যের বাইরে। সুলতানের মুখের থমথমে চেহারা দেখে জ্যোতিষীর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়, আর কি! সে বলল, গৌড়ের নবদ্বীপ, ফুলিয়া, কুমারহট্টেও জন্মাতে পারে। আরও কয়েকবার অঙ্ক কষে বলতে চেষ্টা করতে পারি হুজুর।

জ্যোতিষী যখন অঙ্ক কষে সময় অপহরণ করছে, তার মধ্যে গুপ্তচরের কাছ থেকে খবর পেয়ে সুলতানি সেনারা গৌড়ের শিক্ষিত, সমৃদ্ধ জনপদগুলিতে তেজীয়ান, সুন্দর মুখশ্রী এক কাফের শিশু, যার গায়ের রং কালো, তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। জন্মের পর, পাঁচ বছর বয়সে তেমনি এক তল্লাশীর ধাক্কা খেল প্রস্ফুটিত চাঁপা ফুলের মতো উজ্জ্বল স্বর্ণাভ যার গায়ের রং, সেই গোরা। পাড়ার লোকজন জুটিয়ে কুয়ো থেকে গোরাকে উদ্ধার করে প্রায় চোরের মতো আধ ঘণ্টার চেনা পথ ছেড়ে, তিন ঘণ্টা ধরে মাঠ, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে ঘরে ফিরে জগন্নাথ, শুনল, সুলতানের এক সেনা কুয়োর জল খেতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেছে। নবদ্বীপ থেকে তিন শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে সুলতান মুজফ্‌ফর শাহের সেনারা। গোরার জন্যে উদ্বেগে কেঁদেকেটে ভূমিশয্যা নিয়েছে তার মা শচী। তাকে শান্ত করে সাহস জোগাচ্ছে বিশ্বরূপ গোরার সমান্য ক্ষতি যে সুলতানের সেনারা করতে পারবে না, এই আশ্বাসবাক্য শোনানোর মধ্যে মাকে বিশ্বরূপ বলেছিল, মা, আমার একটা কথা, তোমায় রাখতে হবে।

দু’চোখে জল নিয়ে ছেলের পিঠে হাত রেখে শচী জিজ্ঞেস করল, কী কথা বাবা?

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বিশ্বরূপ বলল, গোরার জন্যে সে যে পুঁথিটা লিখেছে, সেটা মাকে যত্ন করে নিজের পেটিকায় রেখে দিতে হবে। পড়ার মতো বিদ্যার্জন গোরা করলে, তার হাতে তুলে দিতে হবে সেই পুঁথি।

ছেলের কথা শুনে শচী অবাক হয়ে বলেছিল, তুমি নিজেই তো ভাইকে তখন দিতে পারো।

নিরাপদে পুঁথি রাখার মতো গোপনীয় জায়গা যে তার নেই, সে কথা মাকে না বলে, দার্শনিকের ভঙ্গিতে বিশ্বরূপ জানিয়েছিল, কার যে কখন কী ঘটে, কে বলতে পারে!

শচী মেনে নিয়েছিল বিশ্বরূপের যুক্তি। খড়ের ছাউনি দেওয়া পাশের ঘরের বাতাতে গুঁজে রাখা লুকনো পুঁথিটা, সেখান থেকে এনে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল সে। তার বিশ্বাস ছিল পুঁথিপত্র নিয়ে যে মা কখনও উৎসাহ দেখায়নি, সে নিশ্চয় স্বামীকে ছেলের লেখা পুঁথির খবর দেবে না। বলার ইচ্ছে থাকলেও বলতে ভুলে যাবে। সংসারের চাপে জর্জরিত মা, হেঁসেল, ভাঁড়ার, একাদশী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ছাড়া কিছু মনে রাখতে পারে না। মনে রাখার দরকার হয় না। ডালপালা ছড়ানো সংসারে আত্মীয়, নিকটজনদের দুর্দশা, অভাব নিয়েও তাকে ভাবতে হয়। বিশ্বরূপের লেখা তুচ্ছ পুঁথি নিয়ে মা স্মৃতি ভারাক্রান্ত করবে না।

নিজের সবচেয়ে শক্তপোক্ত পেটিকায় বিশ্বরূপের পুঁথি যত্ন করে রাখার মুহূর্তে শচীর মনে হচ্ছিল, ভবিষ্যতে গোরার পড়ার জন্যে বিশ্বরূপ যে পুঁথি রাখছে, তা থেকে প্রমাণ হয়, সুলতানি গুপ্তচর, সেনারা মিলে নবদ্বীপ থেকে যত ছেলেকে তুলে নিয়ে যাক, গোরার ক্ষতি করতে পারবে না। আঁচড় লাগবে না গোরার গায়ে। ঠিক তাই ঘটল। মাঝদুপুরে গোরাকে নিয়ে সন্তর্পণে জগন্নাথ যখন ঘরে ফিরল, তখনও তার শরীরে কাঁপুনি থামেনি। ভৃত্য ঈশান দাওয়ার সামনে মাটিতে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। গোরা নির্বিকার। তার মুখে এত বড় বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ছাপ পড়েনি। দাওয়ায় উঠে শচীর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, লাউ-এর পায়েস কোথায়?

জগন্নাথ আর ঈশানের দশা দেখে শচী যতটা অস্থির হল, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তি আর আরাম পেল কোলজুড়ে এলিয়ে থাকা গোরার শরীরের তাপে। পরপর দু’ঘটি জল খেয়ে শচী কোনও প্রশ্ন করার আগে জগন্নাথ বলতে শুরু করল, কীভাবে যমের দুয়ার থেকে আজ গোরাকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। কুয়োর মুখে, গর্তের বাসিন্দা বিষধর এক কেউটে সাপ গোরাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সুলতানি সেনার কপালে সেই কেউটে ছোবল মেরে কয়েক মিনিটের মধ্যে তাকে পৃথিবীর পরপারে পাঠিয়ে দিলেও সাপের আড্ডায় তখনও কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকা দেবী বিষহরির সন্তানদের কেউ গোরাকে ছোঁয়নি। কুয়ো থেকে গোরাকে তুলতে ঈশানের সঙ্গে স্থানীয় যে সূত্রধর ভেতরে নেমেছিল, তারাও অক্ষত শরীরে ফিরে এসেছে। তাদের কেউ সাপের ছোবল খায়নি। দেবী বিষহরির আশীর্বাদী তেল মেখে কুয়োয় নেমেছিল তারা। বর্ষার রাতে এই তেল মেখে তারা ঘুমোয়-ও। ঈশানকে এই তেল দিয়েছিল তাদের একজন।

গোরাকে বুকে চেপে ধরে শচী যখন স্বামীর কথা শুনছে, ভয়ে সাদা হয়ে যাওয়া তার মুখ, চিবুক বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছিল। দূরের গাছ থেকে ভেসে আসছিল কুবো পাখির ডাক। গোরাকে ধরতে সুলতানি সেনার তাড়া করার ঘটনা বিশ্বরূপ আর শচীকে পাঁচ কান করতে বারণ করেছিল জগন্নাথ। ঈশানকে আগেই, পথে আসার সময় নিষেধ করেছিল।

ঘটনাটা তবু চেপে রাখা যায়নি। নবশাকপল্লী থেকে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল সে বিবরণ। বিবরণে মিশতে শুরু করেছিল এমন সব বাড়তি উপকরণ, যা কিংবদন্তির জন্ম দেয়। শ্রীবাস এসে এক সকালে জগন্নাথকে আড়ালে ডেকে ঘটনার সত্যাসত্য জাতে চাইলে, জগন্নাথ যা ঘটেছে বিশদে বলেছিল। জগন্নাথের পাশে দাঁড়িয়েছিল তার দুই ছেলে—বিশ্বরূপ, গোরা। অপলক দৃষ্টিতে গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রীবাস কী অনুমান করতে চাইছিল, তা সে জানে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেছিল, ভাগবতের বাক্য মিথ্যে হয় না। কালীয়দমনের পরের পর্ব শুরু হয়ে গেছে। জয় শ্রীহরি, জয় শ্রীকৃষ্ণ, যাদবায় মাধবায় নমো নমঃ।

শ্রীকৃষ্ণের প্রেমগান কীর্তন করার জন্যে কয়েক বছর আগে সুলতানের গুপ্তচর আর পাষণ্ডিরা মিলে, যে শ্রীবাসের ভদ্রাসন আগুন লাগিয়ে ছাই করে দিয়েছিল, নতুন আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল তার মুখ। জগন্নাথকে শ্রীবাস বলেছিল, দিনকাল ভালো নয়। সুলতানি সেনারা আবার যে কোনওদিন নবদ্বীপে চড়াও হতে পারে। গোরাকে সাবধানে রেখো।

শ্রীবাসের আশঙ্কা ভুল ছিল এমন নয়। কিন্তু সে সুযোগ সুলতান মুজফ্‌ফর শাহ পেল না। নবদ্বীপের রাস্তা থেকে তিন শিশুকে সুলতানি সেনারা তুলে নিয়ে যাওয়ার ছ’মাসের মধ্যে নিজের প্রাসাদে অবরুদ্ধ মুজফ্‌ফর শাহ খুন হয়ে গেল। সুলতানি মসনদের দখল নিল হোসেন শাহ। শাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে দরবারে আমির ওমরাহদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার সঙ্গে নিভৃতে অনুগত জ্যোতিষীদের নিয়ে নিজের ঠিকুজি কোষ্ঠি, জন্মছক খুলে গণনাতে বসিয়ে দিল। জ্যোতিষী দলের শিরোমণি, চারুমিহির জ্যোতিষার্ণব ছিল হোসেন শাহের খাস জ্যোতিষী। সুলতান মুজফ্‌ফর শাহের দরবারে হোসেন শাহ যখন আমির, তখন তার জন্মপত্র গণনা করে চারুমিহির যা বলেছিল, তা হল, আমির সৈয়দ হোসেন অদূর ভবিষ্যতে সুলতান হতে চলেছে। জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের মুখে প্রায় হাত চেপে তাকে থামিয়েছিল আমির সৈয়দ হোসেন। নিজের প্রাসাদোপম বাড়ির অন্দরমহলের একান্ত ঘরে বসেও জ্যোতিষার্ণবের কথা কেউ শুনেছে কিনা, চারপার্শে তাকিয়ে দেখে নিল। সুলতান মুজফ্‌ফর শাহের কানে কথাটা গেলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে তার গর্দান যাবে, এ নিয়ে আমির সৈয়দ হোসেনের সন্দেহ ছিল না। মৈথিলী ব্রাহ্মণ চারুমিহির উপাধ্যায় তখনও শুধু সাধারণ এক জ্যোতিষী। সুলতান বা অভিজাত সম্প্রদায়ের নেকনজরে আসেনি। শাহি দরবারে কুল্লে একবার গেলেও সুলতান মুজফফরের কাছাকাছি তার বিশ্বস্ত জ্যোতিষীরা ঘেঁষতে দেয়নি চারুমিহিরকে। আমির শাহ হোসেনের সঙ্গে শুধু তার কিঞ্চিৎ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। হপ্তায় তিন, চার দিন অতি সকালে আমিরের প্রাসাদে সে হাজিরা দিত। জ্যোতিষ সংক্রান্ত নানা তথ্য, গ্রহবিগ্রহের অবস্থান আর আমিরের জীবনে সে সবের প্রভাব নিয়ে মনস্তুষ্টিকর নানা খবর পরিবেশন করত। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ছিল এই মৈথিলী ব্রাক্ষ্মণ। শাহ হোসেনের ইমারতে যাতায়াতের সূত্রে সে আঁচ করেছিল, অত্যাচারী সুলতান মুজফ্‌ফর শাহের শাসন শেষ হতে চলেছে। পথে ঘাটে সাধারণ মানুষ চাইছে, সুলতান মুজফ্‌ফর শাহের জমানা শেষ হোক। আপদ বিদায় নিক। আমিরদের মধ্যে প্রভাবশালী কেউ কেউ মাঝরাতে সে শাহ হোসেনের বাড়িতে এসে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে ভোরের আলো ফোটার আগে বেরিয়ে যায়, তা-ও চারুমিহিরের চোখে পড়েছে। আমির শাহ হোসেনের অট্টালিকায় ঢোকার আগে প্রাক-ভোরের নির্জন রাজপথ দিয়ে কখনও একা, কখনও আগে, পেছনে দু’তিন জন মুখ চেনা তুর্কি ঘোড়ার সওয়ার, আমিরদের দুরন্ত গতিতে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে ব্যাপক কিছু ঘটতে চলেছে, বুদ্ধিমান চারুমিহির টের পেয়েছিল। ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছিল সে। ফস্ করে এক সকালে শাহ হোসেনকে বলে দিল, হুজুর, আপনার জন্মছক আর গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে দেখতে পাচ্ছি, আপনি হতে চলেছেন গৌড়ের নতুন সুলতান, ‘আলা আল দুনিয়া ওয়াল দীন আবুল মুজফ্‌ফর হোসেন শাহ।’

জ্যোতিষীর কথা শাহ হোসেন অবিশ্বাস করেনি। মুজফ্‌ফরকে তার প্রাসাদের মধ্যে আটকে রেখে গুপ্তহত্যার ছক তখন সে পাকা করে ফেলেছিল। মসনদ দখলের জন্যে আমিরদের মধ্যে খুনোখুনি লেগে গেলে, যা অনবরত লাগত, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ সাফ করতে অনুগত আমিরদের নিয়ে প্রায়ই মাঝরাতে প্রাসাদে মন্ত্রণাসভা করছিল। উষালগ্নের ধূসর আলোয় আমির শাহ হোসেনের বাড়ির পথ ধরে ঘোড়সওয়ার, কোনও আমিরকে ফিরতে দেখলে সেই সকালে হুজুরের প্রাসাদে চারুমিহির যেত না। সে জানত, হুজুর শাহ হোসেনের সঙ্গে সকালের এই মুহূর্তে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। সারা রাত ধরে সহযোগী আমীরদের সঙ্গে শলাপরামর্শ সেরে হুজুর এখন ঘুমোচ্ছেন। জ্যোতিষী চারুমিহিরের ভবিষ্যৎবাণী শুনে শাহ হোসেন আহ্লাদিত হলেও কথাটা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতে বারণ করল। ধুরন্ধর চারুমিহির জানল, আন্দাজে সে ঢিল ছুঁড়লেও তা ঠিক জায়গায় গিয়ে লেগেছে। সুলতানি মসনদে বসতে চলেছে শাহ হোসেন। মুখে কুলুপ এঁটে চারুমিহির শুধু রোজ সকালে একবার শাহ হোসেনের চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে ঘরে ফিরে যেত। অল্প দিনের মধ্যে গৌড়ের সুলতানি মসনদে পৌঁছে গেল শাহ হোসেন। জ্যোতিষী চারুমিহিরকে ‘জ্যোতিষার্ণব’ উপাধিতে বিভূষিত করে সুলতানি দরবারে তাকে সসম্মানে আসন করে দিল নতুন সুলতান। হোসেন শাহের খাস জ্যোতিষী পদে অভিষিক্ত করা হল চারুমিহিরকে। জ্যোতিষের পথ ধরে দু’বছরের মধ্যে সুলতানের কূটনৈতিক পরামর্শদাতা হয়ে উঠল জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী, প্রবাদপ্রতিম মেধাসম্পন্ন চাণক্যের মতো বুদ্ধিমান, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের পরামর্শে বেশ কয়েকজন ব্রাহ্মণ আর কায়স্থকে মন্ত্রীত্ব দিয়ে সুলতানি শাসনের অঙ্গীভূত করে ফেলল হোসেন শাহ। চারুমিহিরের সংস্পর্শে এসে হোসেন শাহ জানতে পারল, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুসম্প্রদায়কে শাসনে রাখতে গেলে শাসনব্যবস্থার উঁচু পদে দু’চারজন উচ্চবর্ণের, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের নিয়োগ করা দরকার। শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে কর্ণাটকি ব্রাহ্মণ তিন ভাই—সনাতনকে ‘সাকর মল্লিক’ এবং রূপকে ‘দবির খাস’ উপাধি দিয়ে সুলতানি শাসনের সঙ্গে জুড়ে নিল। অর্থাৎ সনাতন প্রধানমন্ত্রী, রূপ উপ-প্রধানমন্ত্রী, তাদের চেয়ে ছোট যে ভাই, অনুপম—সে নিযুক্ত হল টাঁকশালের অধ্যক্ষ পদে। বছর খানেক বাদে কায়স্থপ্রধান গোপীনাথ বসুকে ‘পুরন্দর খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করে সুলতানি শাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সুলতান মুজফ্‌ফর খাঁ কোতল হওয়ার পরের ঘটনা এসব। হুসেন শাহের দরবারের আমির ওমরাহ অভিজাতরা এই নিয়োগে ক্ষুণ্ণ হলেও তখনই ঘোঁট পাকাতে সাহস পেল না। সুলতানি মসনদ বাঁচাতে হুসেন শাহকে তিন ব্রাহ্মণ কর্ণাটকি ভাই, যাদের পিতৃদত্ত নাম—অমর, সন্তোষ, বল্লভ এবং সাধকজীবনে যারা সনাতন, রূপ এবং অনুপম নামে পরিচিত, তাদের সঙ্গে কায়স্থ গোপনাথ বসু এবং আরও কয়েকজন অভিজাত নিষ্ঠাবান হিন্দুকে নিয়োগ করার পরামর্শ হোসেন শাহকে দিয়েছিল জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির। তার পরামর্শ উড়িয়ে দেওয়ার সাহস সুলতানের ছিল না। জ্যোতিষার্ণব হিসেবে যাকে নিজে বরণ করে নিয়েছিল, সেই মানুষটা যে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এবং তার প্রতিটা নির্দেশ শাস্ত্রবাক্য, এ নিয়ে সুলতানের বিশ্বাস ততদিনে সুদৃঢ় হয়েছিল।

সুলতানের অনুরোধ এড়াতে না পেরে কর্ণাটি ধর্মগুরু পদ্মনাভের চতুর্থ প্রজন্ম অর্থাৎ প্রপৌত্রদের তিনজন—সনাতন, রূপ, অনুপম রাজকাজে যোগ দিলেও মনেপ্রাণে তারা ছিল তত্ত্বজ্ঞ ধার্মিক। পূর্বপুরুষদের মতো ধর্মকর্ম নিয়ে সারা জীবন তারা কাটাতে চাইলেও কীভাবে সুলতান হোসেন শাহের রাজ্যপ্রশাসনে জড়িয়ে পড়ল, সেও এক কাহিনী। গৌড়ের অনতিদূরে মাধাইপুর গ্রাম থেকে তাদের আনতে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের পরামর্শে এক সুবৃহৎ শিবিকা পাঠিয়েছিল স্বয়ং সুলতান হোসেন শাহ। পনেরো বছর পরের ঘটনা সেসব।

গোরা তখনও দুর্দান্ত শিশু। সন্ন্যাসী হওয়ার কোনও লক্ষণ তার ছিল না। সুলতান মুজফ্‌ফরের সেনাদের ফাঁদ থেকে রেহাই পেয়ে বাড়িতে ফিরেও সে এতটুকু ভয় পায়নি, দমেনি। শেষ দুপুরে বাবা, দাদার সঙ্গে খেতে বসে তাদের দুজনের সমান ভাত, পাঁচ রকম ব্যঞ্জন দিয়ে খেয়ে শেষপাতে প্রায় এক হাঁড়ি লাউ-এর পায়েস খেয়ে নিল। সন্ধে পর্যন্ত ঘুমিয়ে জেগে ওঠার পরে নতুন কি দুষ্টুমি করা যায় সেই মতলব ভাঁজতে থাকল।

.

গোরার দুরন্তপনা থামাতে পণ্ডিত গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠীতে তাকে পাঠিয়ে দিল জগন্নাথ। বেশি বয়সের সন্তান গোরাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাবলম্বী করতে নিজের পৈশাতে নিয়ে আসতে তৎপর হয়েছিল জগন্নাথ। অদ্বৈত আচার্যের চতুষ্পাঠীতে বেদান্ত আর ভক্তিশাস্ত্রে সুপণ্ডিত করতে বড় ছেলে বিশ্বরূপকে পাঠানো যে বেহিসেবির মতো কাজ হয়েছে, গোরার জন্মের পর থেকে জগন্নাথ তা অনুভব করছিল। বিশ্বরূপের পঠনপাঠন সহজে শেষ হবে না, জগন্নাথ টের পাচ্ছিল। পাণ্ডিত্য অর্জন সহজ কাজ নয়। আরও কঠিন, সেই পাণ্ডিত্য ভাঙিয়ে অর্থ উপার্জন করা। উপার্জনক্ষম প্রকৃত শাস্ত্রবিদ হয়ে উঠতে বিশ্বরূপের সময় লাগবে। পাণ্ডিত্য অর্জনের মূল পাঠ্যসূচি শেষ হলেও আরও বিস্তর গ্রন্থ পড়া বাকি থেকে যায়। বাকি গ্রন্থ শেষ করার মধ্যে আরও নতুন গ্রন্থ পাঠকের কাছে এসে যায়। মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার এত বড় যে কোনও জ্ঞানতাপস ইহজীবনে তা সম্পূর্ণ আহরণ করতে পারে না। পড়ুয়া তবু পড়ে যায়। জ্ঞান অধিগত করাও এক ধরণের নেশা। তা একবার জাঁকিয়ে ধরলে সহজে ছাড়ে না। বিশ্বরূপ সত্যিকার পড়ুয়া। তাকে যজমানিতে আনা অনায়াসসাধ্য নয়। সে তুলনায় চঞ্চল, চপল গোরাকে ব্যাকরণ আর ‘লৌকিকসৎক্রিয়াবিধি’ শিক্ষা দিয়ে নিজের পেশাতে জুড়ে দেওয়া জগন্নাথের পক্ষে অনেক সহজ। পাণ্ডিত্য অর্জনের লক্ষণ গোরার স্বভাবে নেই। তার পক্ষে গঙ্গাদাসের টোল উপযুক্ত শিক্ষণকেন্দ্র।

পেশা শিক্ষার টোল হিসেবে গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠীর সুনাম হয়েছিল। ছাত্রের ভিড় লেগে থাকত সেখানে। চতুষ্পাঠীতে যাওয়া শুরু করার অল্পদিনের মধ্যে একঝাঁক সমবয়সি সহপাঠী পেয়ে গোরা স্বমূর্তি ধারণ করল। ঘরে বাইরে তার উপদ্রবে গঙ্গদাস রেগে টং হতে থাকল। মারমুখি হল আত্মীয় প্রতিবেশীরা। মা, বাবার আদরে গোরা যে বাঁদর হচ্ছে, অভিজ্ঞ গঙ্গাদাসের বুঝতে অসুবিধে হল না। বাড়িতে বেত হাতে জগন্নাথ ছেলেকে যতই তর্জন, গর্জন করুক (একাধিকবার সে দৃশ্য গঙ্গাদাস দেখেছে) এক ঘা বেতও গোরার পিঠে কখনও যে পড়েনি, এ বিষয়ে গঙ্গাদাস নিঃসন্দেহ। তার চোখের সামনে একবারও তেমন ঘটেনি। ননীর পুতুল ছেলেকে লাই দিয়ে শচীদেবী গোল্লায় পাঠাচ্ছে—এ খবরও গঙ্গাদাসের কাছে পৌঁছেছিল। গোরাকে শাসনের দায়িত্ব অগত্যা নিজের হাতে নিতে হল গঙ্গাদাসকে। চপল গোরাকে সহবৎ শেখাতে তার পিঠে মাঝে মাঝে বেত্রাঘাত না করে গঙ্গাদাসের উপায় থাকল না। গোরার উজ্জ্বল ফর্সা পিঠে বেতের সিঁদুরে রেখা কিছুদিন অন্তর শচীর নজরে পড়তে থাকল। গোরাকে আড়ালে ডেকে পিঠের দাগের কারণ শচী জিজ্ঞেস করলে খুদে ছাত্রটি গঙ্গাদাসের নাম উচ্চারণ করত না। বলত, সহপাঠীদের সঙ্গে ‘লড়াই লড়াই’ খেলতে গিয়ে পিঠে আঁচড় লেগেছে। শুধু পিঠে নয়, হাতের পাতায়, মুখে, কানে আঘাতের দাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে গোরা শোনাত সহপাঠী খেলুড়েদের সঙ্গে উদ্দাম খেলার বিবরণ। সবটা মিথ্যে নয়। সহপাঠীদের সঙ্গেও তার হাতাহাতি হত। সজল চোখে নয়নের মণি, ছেলের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিত শচী। জগন্নাথকে কিছু বলত না। রগচটা মানুষ জগন্নাথ। হঠাৎ খেপে গিয়ে গোরাকে কখন চড়িয়ে দেয়, এই ভয়ে শচী সবসময়ে কুঁকড়ে থাকে। কখনও তেমন ঘটেনি। ছেলের গায়ে জগন্নাথ কখনও হাত না তুললেও ছাত্রকে তার শিক্ষাগুরু শাস্তি দিলে জগন্নাথের তাতে আপত্তি ছিল না। বরং সায় ছিল। গোরার মতো বেয়াড়া ছাত্রের পিঠে দু’চার ঘাত বেত পড়তেই পারে, এটা সে মেনে নিয়েছিল। গঙ্গাদাসকে পথে সুবিধেমতো পেলে গোরা ইট-পাটকেল ছুড়ে মারতে পারে এ ভয়ও তার ছিল। গঙ্গাদাসকে গোরা ইট ছুড়ে না মারলেও, চতুষ্পাঠীর অদূরে পথের এক কুকুরকে ‘গঙ্গাদাস’ নাম দিয়ে পোষ মানাল। গোরাকে দেখলে সেই সারমেয় পথের ধুলোয় গড়াগড়ি খেত। গোরার পা চাটত। গুরুর বেতে লাঞ্ছিত গোরা চতুষ্পাঠী থেকে বেরিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে কয়েক পা গিয়ে, গঙ্গাদাসের কানের আড়ালে পৌঁছে ‘গঙ্গাদাস’ বলে হাঁক ছাড়লে পোষা সেই সারমেয় যেখানে থাকুক, তীরবেগে ছুটে আসত। গোরার পায়ের সামনে শুয়ে লেজ নাড়ত। হেসে গড়িয়ে পড়ত তার সহপাঠীরা। খবরটা গঙ্গাদার্সের কানে যেতে রাগে ক্ষিপ্ত হল সে। বেতে তেল মাখিয়ে চতুষ্পাঠীতে গোরার জন্যে সেদিন গঙ্গাদাস যখন অপেক্ষা করছে, সেই সকালে জগন্নাথের বাড়িতে হুলস্থূল কাণ্ড চলছিল। যজমান বাড়িতে কালসর্পযোগ কাটাতে শান্তিস্বস্ত্যয়ন করতে গিয়েছিল জগন্নাথ বাবার অনুপস্থিতিতে সাত সকালে চতুষ্পাঠীতে যাওয়ার বদলে গোরা আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ছেলের কান্নার কারণ বারবার প্রশ্ন করে জানতে না পেরে শচীর বুক ধড়ফড় করতে থাকল। শচী যতই জিজ্ঞেস করে, তার কী হয়েছে, তত বেড়ে চলে তার কান্নার তোড়। চোখ, মুখ, বুক বেয়ে যে পরিমাণ জল ঝরতে থাকে, তা দেখে শচীর হাত-পা ভয়ে পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। মাটির দাওয়া ভিজে ওঠে, কাদা জমতে থাকে। ছেলের দু’চোখে এত জল আছে—শচীর ধারণা ছিল না। হাসিখুশি, ডানপিটে গোরার কান্না আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়, শচী জানত। সহজে সে কাঁদে না। কান্না শুরু করলে শ্রাবণের বৃষ্টিধারার মতো চাতাল ভাসিয়ে দেয়। অকারণে আগে কখনও এমন করে কাঁদেনি। চোখের জলে মাটির দাওয়া ভিজিয়ে কাদা করে দেয়নি। তার কান্নার আওয়াজ শুনে পড়শি দুই গৃহিণী এসে হাজির হল শচীর বাড়ির উঠোনে। ছেলের কান্নার সঠিক কারণ শচী বলতে পারল না তাদের। চক্রবর্তী গৃহিণী ভয় পেয়ে পাড়ার আরও পাঁচজন ব্রাক্ষ্মণ-গৃহিণীকে ডেকে আনল। তাদের সকলের স্বামী শাস্ত্রবিদ, পণ্ডিত। রোজ, সকাল থেকে রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত স্মৃতি, ন্যায়, বেদান্ত, ভাগবত আর ভক্তিচর্চার আলোচনা শুনে নিজেদের মহাজ্ঞানী ভেবে নিয়ে জটিল বিষয়ে তারাও যে পরামর্শ দিতে সক্ষম এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। গুরুগম্ভীরভাবে গোরার কান্নার কারণ এবং উপশমে নিজেদের অভিমত তারা জানাতে শুরু করল শচীকে। তাদের কেউ বলল, মন্দ বায়ুর প্রকোপে গোরার বায়ুরোগ হয়েছে। কেউ বলল, তাকে ভূতে ধরেছে। পাড়াতুতো জেঠি-কাকিদের গুলতানির মধ্যে সশব্দে কেঁদে যাচ্ছিল গোরা। শচী বলল, তোমাদের কথাই ঠিক, ছেলেটা আমার পাগল।

কথাটা গোরার কানে যেতে মুহূর্তের জন্যে কান্না থামিয়ে সে বলল, তোমরা সবাই পাগল।

ছ’বছরের শিশুর কথা শুনে গৃহিণীরা হাঁ হয়ে গেল। তাদের মুখচোখে সমূহ সর্বনাশের এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠল, যা দেখে শচী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। গোরার রোগটা পাগলামি, না তাকে ভূতে ধরেছে, এই নিয়ে গৃহিণীদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হওয়ার আগেই গোরা কাঁদতে শুরু করেছিল। দু-একটা কথা বলে গৃহিণীরা চুপ হয়ে গেল। রীতিমতো চিন্তামগ্ন তাদের মুখ। ছেলের কান্না ফের শুরু হতে শচীর কান্না বন্ধ হল। চন্দ্রশেখর আচার্যের বৌ মনোরমা, সম্পর্কে শচীর মাসিশাশুড়ি, তাকে শচী বলল, ছেলে আমার খারাপ নয়, মায়াদয়া আছে, তবে ঘোর নাস্তিক। বলে, ঠাকুরদেবতা আবার কে? আমি ঠাকুর, আমিই দেবতা। আঁস্তাকুড়ে গিয়ে বসে থাকে, শুচি, অশুচি মানে না। শূদ্র আর নবশাক সমাজের ছেলেরা তার বন্ধু, তাদের সঙ্গে যতরকম খেলাধুলো। আমি বারণ করলে বলে—শূদ্র, নবশাকদের ছুঁলে যদি আমার জাত যায় তাহলে আমাকে ছুঁয়ে তারাও জাতে ওঠে, ব্রাক্ষ্মণত্ব পায়। শচীর বিবরণ শুনে গৃহিণীরা সমবতেভাবে ত্রাস মেশানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গোল্লা চোখে হতভাগিনী মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। শচী বলল, আরও কত সাংঘাতিক কথা যে গোরা বলে তার হিসেব নেই। ছেলের জন্যে দুশ্চিন্তায় শচী বিলাপ করলেও গোরার ভ্রূক্ষেপ নেই। মন দিয়ে উচ্চনিনাদে সে কেঁদে চলেছে। পণ্ডিত বৃহস্পতি সার্বভৌমের গৃহিণী বলল, বাবা নিমাই, তুমি ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে, তোমার বাবা দিগ্‌গজ পণ্ডিত, নাস্তিক হওয়া তোমাকে মানায় না।

ক্রন্দনরত গোরা বলল, আমার আবার আস্তিক, নাস্তিক কি? আমিই তো ভগবান।

জগন্নাথের বাড়ির দাওয়ায় যেন বাজ পড়ল। গৃহিণীরা কথা থামিয়ে মুখ চাওয়াচায়ি করতে থাকল। ছেলের কথায় আঁতকে উঠে শচী বলল, চুপ কর বাপ্, এমন কথা বলতে নেই। শচীর কথায় কান না দিয়ে একভাবে গোরা কাঁদতে থাকল। নিচু গলায় ভট্টগৃহিণী বলল, সব লক্ষণ দেখে মনে হয়, গোরাকে অপদেবতা ভর করেছে।

ভট্টগৃহিণীর কথাতে সায় দিল একজন। অন্য একজন বলল, ভূতে ধরার ঘটনা এটা নয়, এ কঠিন ব্যামো। রোজ অন্যূন পাঁচবার মাথায় বিষ্ণুতেল মেখে চান না করলে গোরার রোগ সারবে না।

গৃহিণীদের নানা মন্তব্যের মধ্যে বারেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণ জীবন মৈত্রের বৌ বলল, আজ ভোরে হিরণ্যভাগবতের বাড়ির সামনে গোরাকে যখন দেখলাম, তখনও যথেষ্ট হাসিখুশি দেখাচ্ছিল তাকে। মৈত্রগৃহিণীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে মুখুটি গৃহিণী বলল, সূর্যোদয়ের কিছু পরে গোরাকে খোসমেজাজে আমার বাড়ির সামনের পথে আমিও ঘুরতে দেখেছি। বাড়ি ফিরে সে এমন কাঁদতে পারে আমার জানা ছিল না। কথাটা মিথ্যে নয়। সাতসকালে বাড়ির সামনে, পথে গোরাকে দেখে তার ধারণা হয়েছিল, উল্টোদিকে জগদীশ আচার্যের বাস্তুসংলগ্ন বাগানে এক জোড়া আমগাছ এ বছর ফলে ভেঙে পড়েছে। সোনালি আভা জেগেছে আমের গায়ে। এক পশলা বৃষ্টির পরে একটু গুমোট হলে দুটো গাছের আম পেকে উঠবে। জগদীশের বাগানে আমের মরশুমে পাড়ার ছেলে ছোকরারা গৃহস্থের নজর এড়িয়ে প্রায়ই ঢুকে পড়ে। দু-একজন কখনও-সখনও ধরা পড়ে তিরস্কৃত হলেও বেশিরভাগ ছেলে আম নিয়ে চম্পট দেয়। জগদীশের বাগানের সামনে গোরাকে ঘুরঘুর করতে দেখে তার উদ্দেশ্য অনুমান করতে পেরেছিল মুখুটি গৃহিণী। মধ্যবয়সী স্ত্রীলোকটির মনে হল, আমগাছ পর্যন্ত পৌঁছোতে না পারার শোকে গোরা কাঁদছে। মৈত্রগৃহিণী, মুখুটিগৃহিণীর কথাতে গোরা আরও হৈহৈ করে কাঁদতে লাগল। ব্যতিব্যস্ত শচী শুধু জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে বাপধন? কাঁদিস কেন বল?

গোরা এতক্ষণে মুখ খুলল। বলল অই, অই। মনোরমা ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, কী দাদু, কী চাই তোমার?

গোরাকে কয়েকবার খুঁচিয়ে মনোরমা জানল, হিরণ্যভাগবত আচার্য আর জগদীশের ঘরে আজ একাদশীর যে নৈবেদ্য সাজানো হয়েছে, তা সে খেতে চায়। গোরার আবদার শুনে গৃহিণীরা কানে আঙুল দিল। বাপের জন্মে এমন অলক্ষুণে কথা তারা শোনেনি। দেবতার জন্যে সাজানো ভোগ কোনও শিশু, বিশেষ করে ব্রাহ্মণসন্তান খেতে চাইতে পারে, এ ছিল তাদের কল্পনাতীত। গোরা কি তা জানে না? গোরা জানে। তবু তার কান্না থামল না। আশপাশের বাড়ি থেকে গোরার সমবয়সি দু’চারজন বালক সেখানে জুটে গেছে। তাদের একজন, একাধিক জনও হতে পারে, দৌড়ে গিয়ে হিরণ্যভাগবত আর জগদীশ আচার্যকে গোরার পাগলামির খবরটা দিতে দু’জনই ছুটে এল জগন্নাথের বাড়িতে। দু’জনই সৎ বিপ্র। গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী। প্রতি একাদশীতে ইষ্টদেবতা গোপালের জন্যে নৈবেদ্য সাজিয়ে তারা নির্জলা উপবাসে কাটায়। নৈবেদ্য খাওয়ার জন্যে ছ’বছরের বালককে আকুল হয়ে কাঁদতে দেখে দুই ব্রাহ্মণের মধ্যে চোখাচোখি হল। দু’জোড়া চোখে নিঃশব্দে বিনিময় হল এমন কিছু বার্তা, যার জেরে দু’জনে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে দু’থালা নৈবেদ্য নিয়ে দুই বিপ্ৰ জগন্নাথের বাড়িতে ফিরে এসে গোরার সামনে রাখল। গোরার কান্না থামল। পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুটো তামার থালা থেকে সন্দেশ, কলা, খৈ, বাতাসা খেল। সমবয়সি খেলুড়েদের কিছু দিল, কিছু ছড়াল, তারপর পিতৃতুল্য দুই বিপ্রকে বলল, আমিই গোপাল।

গোরা বলার আগেই দুই ব্রাক্ষ্মণ ধরে নিয়েছিল, ঈশ্বরের ইচ্ছে ছাড়া কোনও বালক নৈবেদ্য খাওয়ার জন্যে এত আকুল হয়ে কাঁদতে পারে না। মুগ্ধ চোখে তারা তাকিয়ে থাকল গোরার দিকে। নৈবেদ্য খাওয়া শেষ করে শুরু হল গোরার নাচ। হিরণ্যভাগবত আর জগদীশ অবাক চোখে সেই নৃত্য দেখতে থাকলেও ছেলের ঘাড় থেকে ভূত নামাতে শচীকে তাড়াতাড়ি ষষ্ঠীপূজা করার উপদেশ দিল বৃহস্পতি সার্বভৌমের বৌ। গোরার মাথায় বিষ্ণুতেল মাখানোর পরামর্শ যারা দিয়েছিল, নিজেদের অবস্থান থেকে তারা নড়ল না। মাথার ব্যাধিতে গোরা ভুগছে এই নির্ণয়ে তারা অটল থাকল।

ষষ্ঠীপুজোর আয়োজন আর বিষ্ণুতেল জোগাড়ের কাজে শচী নেমে পড়ল সন্তর্পণে। দুটো কাজ চলতে থাকল গোপনে, গোরার নজর এড়িয়ে। জানল, শুধু জগন্নাথ আর বিশ্বরূপ শুভযোগ দেখে আষাঢ় মাসের প্রথম দিনে ষষ্ঠীর নৈবেদ্য সাজাল শচী। সূর্য ওঠার আগে গঙ্গায় স্নান সেরে শরীরে নতুন শাড়ি জড়িয়ে সুদরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ পরিবারের গৃহিণীর পক্ষে পুজোর আয়োজনে যতটা আড়ম্বর করা সম্ভব শচী করেছিল। বীজহীন কাঁঠালিকলা, শশা, জাম, কাঁঠাল, ক্ষীর, সন্দেশ, খৈ, মোয়া, নানা উপচারে নৈবেদ্যর থালা, পুজোর ডালি, ফুল, বেলপাতা, দূর্বা, চন্দন, গঙ্গাজল নিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় বসেছিল শচী। ষষ্ঠীদেবীর পুজো জগন্নাথের করার কথা। ঊষালগ্নে ফুলিয়ায় এক যজমানের নতুন বাড়ির ভিত পুজো করতে প্রায় মাঝরাতে জগন্নাথ রওনা হয়েছিল। ভিতপুজো সেরে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা তার। স্বামীর আসার পথ চেয়ে শচী ঘর-বার করছিল। অদ্বৈত আচার্যের চতুষ্পাঠীতে, সূর্য ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে ছোট ভাইকে নিয়ে বিশ্বরূপ চলে গেলেও চতুরচূড়ামণি গোরা যে কোনও মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে পারে ভেবে শচী ভয় পাচ্ছিল। ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে আটকে রাখতে বিশ্বরূপ হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে পারে। গোরা বাড়ি ফিরলে ষষ্ঠীদেবীর নৈবেদ্যের ওপর তার ঝাঁপিয়ে পড়া ঠেকানো শচীর সাধ্য নয়। শচী তা ভালো জানে। বুক ঢিপঢিপ করছিল তার। রান্নাঘরে উনুনে বসানো ভাতের হাঁড়ি থেকে ফেন উপচে পড়লে যে পোড়া গন্ধ বেরোয় তা শচীর নাকে গেল। দাওয়া ছেড়ে যে আশঙ্কা নিয়ে শচী রান্নাঘরে ঢুকেছিল, ভাতের হাঁড়ির ঢাকা খুলে, তাই দেখল। ফেন শুকিয়ে হাঁড়ির তলা ধরে গেছে। হেঁসেল সামলাতে ব্যস্ত হল শচী। ভাতের হাঁড়িতে জল ঢেলে, ঘরে ফিরে ভির্মি খাওয়ার দশা হল শচীর। দেখল, নৈবেদ্যর থালা লুঠ হয়ে গেছে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে আতপচাল, পুজোর ফুল, বেলপাতা, দুর্বো। ফল, মিষ্টি উধাও। ফাঁকা ঘর। নৈবেদ্য খেয়ে কে পালিয়েছে, শচীর বুঝতে অসুবিধে হল না। চোখের নিমেষে এমন ঘটনা যে ঘটিয়েছে, সে বেশি দূর যেতে পারেনি। গোরাকে খুঁজতে সদর দরজার বাইরে এসে কাউকে দেখতে না পেয়ে খিড়কির দিকে গেল শচী। সেদিকেও পায়ে হাঁটা পথ আছে, পথ আর বাড়ির মাঝখানে আঁস্তাকুড়। শচী দেখল, আঁস্তাকুড়ে একটা উচ্ছিষ্ট হাঁড়ির ওপর বসে গোরা এক ছড়া কলা থেকে একটা করে ভেঙে খাচ্ছে। কোঁচড়ের ওপর স্তূপ করে রাখা খৈ, মুড়কি, বাতাসা, সন্দেশ। আঁস্তাকুড়ে বসে চণ্ডাল ছাড়া কেউ এভাবে খেতে পারে না। গোরা জানে প্রাণ গেলেও তার মা এই আঁস্তাকুড়ে পা দেবে না। বাস্তবিক তাই। উচ্ছিষ্ট ফেলতে খিড়কিতে আসে গৃহভৃত্য ঈশান। কদাপি খিড়কির পথ শচী মাড়ায় না। তাই হল। খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে ছেলের ওপর রাগে, অভিমানে কপাল চাপড়ে শচী কাঁদতে লাগল। গোরা গ্রাহ্য করল না। কলার ছড়া শেষ করে মুখে একটা সন্দেশ পুরে শচীকে বলল, মা, আমিই গোপাল, আমিই ষষ্ঠী

দু’কানে আঙুল দিয়ে কান্না জড়ানো গলায় শচী বলল, চুপ চুপ, এসব কথা বলতে নেই। যে বলে, তাকে নরকে যেতে হয়।

তখনই এক সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটল। মাকে ভয় দেখাতে ভাঙা হাঁড়ি, কলসির স্তূপ থেকে একটা আধলা ইট তুলে, সেটা শচীর কানের পাশ দিয়ে যাতে চলে যায়, সেভাবে ছুড়ল বাস্তবে ঘটল অন্যরকম। আধলা ইঁট গিয়ে শচীর কপালে লাগতে মুহূর্তে কপাল ফেটে ঝরঝর করে রক্তস্রোত নেমে এল। এমন হবে গোরা ভাবেনি। মায়ের শরীর থেকে রক্ত ঝরানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। কোঁচড়ে রাখা সন্দেশ, বাতাসা, নাড়ুর কথা ভুলে আঁস্তাকুড় থেকে দৌড়ে এসে শচীকে জড়িয়ে ধরে ‘মা’ ‘মা’ করে কান্না জুড়ে দিল। তার কাঁধের ওপর শচী প্ৰায় এলিয়ে পড়েছে। তার কান্না আগেই থেমে গেছে। হাউ হাউ করে গোরাকে কাঁদতে দেখে দু’চারজন প্রতিবেশী জড়ো হয়ে গেল। রক্তাক্ত শচীকে দেখে আঁতকে উঠে শ্রীবাস আচার্যের স্ত্রী, সীতা জিজ্ঞেস করল—শচীর এ দশা হল কী করে?

কান্নার মধ্যে গোরা বলল, আমি ইট ছুঁড়ে মেরেছি।

সে কী? কেন মেরেছিস?

জবাব না দিয়ে গোরা কেঁদে চলল। তার গলায় শুধু ‘মা’ ‘মা’ ডাক। গোরার জবাব শুনে প্রতিবেশীরা তাজ্জব বনে গেল। ইট মেরে জননীর কপাল থেকে কোনও সন্তান রক্ত ঝরাতে পারে তাদের কল্পনাতে ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা সন্তানটির বয়স ছয়। শচীর মতো স্নেহময়ী মায়ের রক্তপাত যে সন্তান ঘটাতে পারে, বয়স বাড়লে সে যে খুনে, ডাকাত হবে এমন আশঙ্কায় শিহরিত হল কেউ কেউ। কপালে চোট পেয়ে শচী প্রায় বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। তাকে অর্ধচেতন অবস্থায় ধরাধরি করে যে সব গৃহিণীরা ঘরে পৌঁছোচ্ছিল, তাদের শচী ফিসফিস করে বলছিল, ঘটনাটা যেন জগন্নাথের কানে না যায়। গোরা মারতে চায়নি তাকে। তার ছোড়া ইটের টুকরো হঠাৎ লেগে গেছে মায়ের কপালে। ঘরেতে শচীকে এনে শোয়ানোর আগের মুহূর্তে গঙ্গায় স্নান সেরে জগন্নাথ বাড়িতে ফিরল। দাওয়ায় প্রতিবেশিনী বৌদের দেখে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে রক্তে ভেজা শচীর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। আসল ঘটনা, তখনই জগন্নাথকে সীতা বলল না। শচীর সখী সে। গোরাকে নিজের পেটের সন্তানের মতো স্নেহ করে। দু-এক কথায় জগন্নাথকে সে বুঝিয়ে দিল, খিড়কির চৌকাঠে আছাড় খেয়ে শচীর কপাল কেটে গেছে। বাড়িতে তখন ফিরে এসেছিল বিশ্বরূপ। পথে শুনেছিল প্রকৃত ঘটনা। গোরা যে এমন কাণ্ড করতে পারে, তার কল্পনায় ছিল না। ছোট ভাই-এর ওপর অপরিসীম স্নেহে যে পুঁথি সে লিখেছে, তা এমন অবধারিত হয়ে ফলতে থাকবে, তার ভাবা উচিত ছিল। এখন থেকে ভাববে। অনেক দূরের ভবিষ্যৎকে দেখতে পাচ্ছিল সে। জগন্নাথের কানে যে কোনও মুহূর্তে খবরটা পৌঁছে যেতে পারে, অনুমান করে, বাবার ক্রোধ থেকে ছোটভাইকে আগলে রাখতে তার পাশে গিয়ে বসল বিশ্বরূপ। মায়ের পায়ের কাছে বসে অবিশ্রান্তভাবে গোরা কেঁদে চলেছে। শচীর কপাল থেকে রক্ত মুছে, ক্ষত ধুয়ে আয়ুর্বেদীয় মলমের প্রলেপ লাগিয়ে, তার ওপর পানপাতা রেখে এক টুকরো পরিষ্কার সাদা কাপড় বেঁধে দিয়েছে জগন্নাথ। স্বামীর পরিচর্যা অনেক দিন পরে দু’চোখ বুজে শচী অনুভব করছিল। মৃত আট মেয়ের জন্যে বুকের ভেতরটা ব্যথিত হয়ে উঠলেও পায়ের কাছে বসে থাকা দুই ছেলেকে মুহূর্তের জন্যে দেখে ফের চোখ বুজেছিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শচী উঠে বসল। ক্রন্দনরত গোরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শচী বলল, বাপধন, তুই আমার গোপাল, তুই আমার মা ষষ্ঠী।

হতচকিত জগন্নাথ, কী বলবে ভেবে পেল না। মা ষষ্ঠীর পুজোতে বসার জন্যে জগন্নাথ অপেক্ষা করছে টের পেয়ে শচী বলল, মায়ের পুজো হয়ে গেছে।

জগন্নাথকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে স্বামী, ছেলেদের জন্যে দুপুরের ভাত, তরকারি বানাতে, চান সেরে, শাড়ি বদলে শচী রান্নাঘরে ঢুকল। গোরা তখনও কাঁদছে। ভাইকে শান্ত করতে তাকে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে চান করতে গেল বিশ্বরূপ। তাদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে সঙ্গ নিল জগন্নাথ। গোরার দুষ্কর্ম না জেনে, তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। মাথায় বাবার ছোঁয়া পেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল গোরা। তার গালে চুমু দিয়ে জগন্নাথ আদর করতে বিশ্বরূপ স্বস্তি পেল। রগচটা বাবা অতঃপর প্রকৃত ঘটনা জানলেও গোরাকে কিলোবে না, এ বিশ্বাস তার দৃঢ় হল।

গোরা তখনকার মতো রেহাই পেয়ে গেলেও তার অঘটনপটুতা কমল না। তার কাণ্ডকারখানার খবর সমাধ্যায়ীদের মুখ থেকে চতুষ্পাঠীতে পণ্ডিত গঙ্গাদাসের কানে যাচ্ছিল। গোরা যে বাস্তবিক বায়ুরোগাক্রান্ত, গঙ্গাদাসের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে বালক ছাত্রকে সে ভয় পেতে শুরু করেছিল। ইটের আঘাতে নিজের গর্ভধারিণী মায়ের কপাল যে ফাটিয়ে দিতে পারে, চতুষ্পাঠীর গুরুর প্রাণহানি করা তার কাছে কোনও কঠিন কাজ নয়। বরং জলভাতের মতো সহজ। সুতরাং টোলে পাঠাভ্যাসের সময়ে গোরার পিঠে বেত ব্যবহারের অভ্যেস গঙ্গাদাসকে ছাড়তে হল। গোরাকে ‘বাবা’ ‘বাছা’ বলে তার সুনজরে থাকতে গিয়ে গঙ্গাদাস জানতে পারল, তার অশিষ্ট, ডানপিটে ছাত্রটি শুধু অসাধারণ মেধাবী নয়, চতুষ্পাঠীতে তার পাঠ্যসূচি অক্ষরে অক্ষরে রপ্ত করছে। নানা দুষ্টুমি সত্ত্বেও লেখাপড়াতে অবহেলা করেনি। তার উদ্ধত স্বভাবের আড়ালে ভীষণ কোমল এক হৃদয় লুক্কায়িত রয়েছে। বাইরের মানুষের সঙ্গে নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গপরিহাস করতে তার আটকায় না। নিজেকে আঘাত করে, তা কতটা যন্ত্রণাদায়ক জানার কৌতূহল, শিশুবয়সে তার মনে উপ্ত হয়েছে। গোরাকে নিয়ে গঙ্গাদাসের বিস্ময় আর বিহ্বলতা এত বাড়ছিল যে তাকে শাস্ত্রপাঠে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার জন্যে নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে পাঠানোর পরামর্শ দিল জগন্নাথকে। কথাটা জগন্নাথের মনে ধরলেও তার মধ্যে এমন এক কাণ্ড ঘটল যে নবদ্বীপ জুড়ে ঢিঢিক্কার পড়ে গেল। ঘটনাটা এরকম—বছর কুড়ি বয়স, জাতিতে বৈদ্য মুরারি গুপ্ত পারিবারিক পেশায় ঢুকে তখন সুনাম অর্জন করছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের দুরূহ টিকাটিপ্পনি প্রাঞ্জল করে বুঝতে প্রায়ই গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে সে যেত। গঙ্গাদাসের বন্ধুস্থানীয় ছিল মুরারি। আয়ুর্বেদশাস্ত্রের ব্যাখ্যার সঙ্গে দু’জনের মধ্যে ঈশ্বরতত্ত্ব, অদ্বৈত বেদান্ত, ভক্তিধর্ম নিয়ে এমন সব নীরস কূটতর্ক হত, যা গোরা আর তার সমাধ্যায়ীরা না বুঝলেও শুনতে বাধ্য হত। তাদের লেখাপড়া তখনকার মতো শিকেয় উঠলেও মুখ ফুটে গুরুকে কিছু বলতে পারত না। কমলাকান্ত, কৃষ্ণানন্দ নামে দুই চেলাকেও মাঝে মাঝে গঙ্গাদাসের টোলে নিয়ে আসত মুরারি। তখন তাদের আলোচনার বিষয় হত ‘যোগবাশিষ্ট’ শাস্ত্রগ্রন্থ। শুরুতে আলোচনা থাকলেও তা তুমুল বাক-বিতণ্ডার চেহারা নিত। যোগবাশিষ্টের উপদ্রব ঠেকানোর দায় গোরার ওপর দিয়েছিল তার বন্ধুরা। চতুষ্পাঠীর শেষে এক সকালে বয়স্যদের সঙ্গে গোরা যখন বাড়ি ফিরছে, তখনই তাদের সামনে পড়ে গেল মুরারি। মুরারির নিবাস জগন্নাথের পাড়ার পাশের ব্রাত্মণপল্লীতে। সপারিষদ যোগবাশিষ্টের আলোচনায় মুখের সঙ্গে দু’হাত নেড়ে নানা অঙ্গভঙ্গী করছিল মুরারি। তার পেছনে দলবল নিয়ে গোরা লেগে গেছে, প্রথমে খেয়াল না করলেও অল্প সময় পরে জানতে পারল। বৈরাগ্যবাদ, মুমুক্ষু ব্যবহার, উৎপত্তি, স্থিতি, উপশম, নির্বাণ; যোগবাশিষ্টের এই ছয় প্রকরণ নিয়ে নিজের মৌলিক অভিমত প্রকাশে মশগুল মুরারি হঠাৎ শুনল, পেছন থেকে তার কথার প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে। অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল, তার মতো অঙ্গভঙ্গি করে বাচনভঙ্গি নকল করে তাকে অনুসরণ করার সঙ্গে সমানে গোরা ভেংচি কেটে চলেছে। হেসে গড়িয়ে পড়ছে তার বন্ধুরা। প্রথমবার দেখেও না দেখার ভান করে চোখ ঘুরিয়ে আগের মতো যোগবাশিষ্ঠ আলোচনায় মন দিল। তার দু’পাশে কমলাকান্ত, কৃষ্ণানন্দ ছাড়া আরও কয়েকজন বয়স্য ছিল। কিছুটা এগোনোর পরেও মুরারি টের পেল আগের মতো দলবল নিয়ে গোরা ভেংচে যাচ্ছে তাকে। মুরারি দাঁড়িয়ে গেল। রাগে খাড়া হয়ে গেছে তার মাথার শিখি। জগন্নাথ মিশ্রের ‘অকাল কুষ্মাণ্ড’ ছেলে বলে গোরাকে ভর্ৎসনা করে তার বন্ধুদের তেড়ে গেল। প্রিয় বন্ধু মুরারির হেনস্তায় চটে লাল কমলাকান্ত, কৃষ্ণানন্দ তখনই শাস্তি দিতে চাইল সবাইকে। গোরার এক সমাধ্যায়ীকে কানচাপাটি চড় কসাল কৃষ্ণানন্দ যে যার মতো ছেলেরা যে দিকে খুশি পালাল। শুধু গোরা নিজের জায়গায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।

শেষ দুপুরে কাঁসার থালায় ভাত, ডাল, তরকারি সাজিয়ে মুরারি যখন অর্ধেক খেয়েছে, তখন সে শুনল, তার নাম ধরে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় কেউ ডাকল। মুরারি সাড়া দেওয়ার আগে ঘরে তার অর্ধভুক্ত থালার সামনে দাঁড়াল গোরা। বলল, যোগবাশিষ্ঠ ছেড়ে ভালো কথা বলতে শেখ।

মুরারি কিছু বোঝার আগে ছরছর করে হিসু করে তার ভাতের থালা ভাসিয়ে দিল গোরা। কানাওলা থালায় ভাসতে থাকল ভাত, তরকারি। মুরারির ঘরে যে এমন কাণ্ড ঘটে গেল, অন্য কাজে ব্যস্ত পরিবারের কেউ জনতে পারল না। বিকেলে বাড়ির সদর দরজায় মুরারিকে দেখে, জগন্নাথ তাকে সাদরে ভেতরে ডেকে নিয়ে দাওয়ায় বসাল। জগন্নাথ প্রশ্ন করার আগেই মুরারি জিজ্ঞেস করল, আপনার কনিষ্ঠ পুত্র কি বাড়িতে আছে?

জগন্নাথ একই সঙ্গে বিস্মিত আর ঈষৎ সন্ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কার কথা বলছ? গোরা?

—হ্যাঁ।

—আবার কি করল সে?

সে কিছু করেনি। আমি এসেছি তাকে প্রণাম করতে।

ব্রাহ্মণ সন্তান, সে শিশু, বৃদ্ধ যাই হোক, অব্ৰাত্মণ সব বয়সের স্ত্রী-পুরুষের প্রণম্য, সামাজিক এই বিধান সকলে জানে, মেনে চলে। ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলোর মহিমা দাতা, গ্রহীতা কারও অজানা নয়। তবু ছ’বছরের গোরাকে কুড়ি-একুশের যুবক বৈদ্য মুরারি প্রণাম করতে এসেছে শুনে জগন্নাথ ধন্দে পড়ে গেল। বলল, না, তা হয় না। বৈদ্যরাও ব্রাহ্মণ। গোরাকে তুমি প্ৰণাম করলে তার অকল্যাণ হবে।

জগন্নাথের কথা মুরারি মানল না। বলল, আপনার সংসারে কে এসেছে, কিছুদিনের মধ্যে জানতে পাবেন।

মুরারির গলা শুনে গোরা তখন মায়ের আঁচলের তলায় আশ্রয় নিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *