২২
ভোরের আলো ফোটার আগে ঘুম থেকে গদাধরকে জাগিয়ে গোরা জানাল, তাকে এখনই একবার গঙ্গার ঘাটে যেতে হবে। গদাধর ঘুমচোখে তাকিয়ে গোরাকে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে কী ঘটেছে, বোঝার চেষ্টা করল। গোরা কিছু না বলে এক টুকরো কাপড় জড়ানো লম্বাটে পুঁথির মতো কিছু নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে পা দিতে গদাধর বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে নেমে, গোরার পাশে এসে দাঁড়াল। শ্রীহট্ট থেকে লুঙির মতো ফেত্তা দিয়ে ধুতি পরতে শিখে এসেছিল গোরা। কোমরে ধুতি জড়ানোর হেরফেরে গোড়ায় হাঁটাচলাতে তার অসুবিধে হলেও ক্রমশ এই রদবদল সে রপ্ত করে ফেলেছিল। ব্রাহ্মণপাড়াতে তার এই যাবনী পোশাক নিন্দিত হলেও তাকে অনুকরণ করার মতো ছেলেছোকরা নবদ্বীপে কম ছিল না। তাদের একজন গদাধর। সে-ও ধুতি ফেত্তা মেরে লুঙির মতো করে পরতে থাকল।
ধর্মশালার বাইরে মেঠো পথ ধরে কাপড়ে জড়ানো মোড়ক হাতে গোরা হনহন করে হেঁটে চলেছে। তাকে ধাওয়া করল গদাধর। পুব আকাশে সবিতৃদেবের লোহিত শরীর শ্লথ গতিতে জেগে উঠলেও ধর্মশালায় এখনও কারও ঘুম ভাঙেনি। আড়াইশ’ ক্রোশ পথ হেঁটে গয়া পৌঁছনোর ধকলে, দু’দিন আগে রাজগৃহ ছেড়ে দলের যারা এসে গেছে, তারাও মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে।
ঝড়ের গতিতে গঙ্গার ধারে পৌঁছে, সেখানে স্নানের ঘাটে নেমে, সাত ডুবের মধ্যে হাতের মোড়ক স্রোতের জলে ভাসিয়ে দিয়ে দু’দণ্ডের মধ্যে গোরা যখন ধর্মশালায় ফিরল, সেখানে তখন তার খোঁজ শুরু হয়ে গেছে। তাকে ঘরে না দেখে নবদ্বীপের তীর্থযাত্রীরা রীতিমতো হৈচৈ জুড়ে দিয়েছে। সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে চন্দ্রশেখর আচার্য জেগে উঠে কৃষ্ণনাম জপ করে গোরার ঘরে উঁকি দিয়ে তাকে না দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। কোথায় গেল গোরা? গদাধর-ই বা কোথায়? চন্দ্রশেখর ঘরে ঘরে গিয়ে গোরার তল্লাশি চালাতে যারা ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল, আর যারা তখনও ঘুমোচ্ছিল, তারা জেগে উঠে কোলাহল শুরু করে দিল। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে তারা যখন গোরাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে, গঙ্গায় স্নান সেরে পিণ্ডদান অনুষ্ঠানের জন্যে কেনা নতুন পাটভাঙা ধুতি, চাদরে শরীর ঢেকে ধর্মশালায় ফিরল গোরা। তার পাশে গদাধর। গদাধরের মুখে ঈষৎ সঙ্কোচ মিশে থাকলেও গোরাকে বেশ খাপছাড়া দেখাচ্ছিল। তার থমথমে মুখ, লালচে চোখ দেখে চন্দ্রশেখর ভয় পেয়ে গেলেও নবদ্বীপবাসী উদ্বিগ্ন সাথীরা আনন্দে হৈ হৈ করে উঠল।
বসন্ত ঋতু শেষ হলেও তখনও গয়ায় বেশ শীত রয়েছে। কাঁথামুড়ি দিয়ে রাতে ঘুমনোর সময়ে চন্দ্রশেখর টের পেয়েছিল, নবদ্বীপের চেয়ে গয়ায় শীত বেশি, প্রলম্বিত হেমন্তের ঠাণ্ডা শরীরের হাড় পর্যন্ত জড়িয়ে ধরছিল। জ্বর থেকে সদ্য ভুগে উঠে, গোরা ভোররাতে গঙ্গায় স্নান করতে যাবে, চন্দ্রশেখর জানত না। আগের রাতে শেষবার দেখা হওয়ার সময়ে তাকে গোরা কিছু বলেনি। তেমনি হয়েছে গদাধর। সব জেনেও ঠোঁট টিপে ছিল। গোরার ঘরে তার সঙ্গে গেল রাতে নিজে না থাকার জন্যে চন্দ্রশেখরের আক্ষেপ হল। ঘরে সে থাকলে ভোররাতে গঙ্গায় গোরার স্নান করতে যাওয়া ঠেকাতে পারত। তার অনুরোধ, উপরোধ গোরা এড়াতে পারত না। চন্দ্রশেখরের যত রাগ গিয়ে পড়ল মাধব পণ্ডিতের ছেলে গদাধরের ওপর। গঙ্গাস্নানে গোরার সঙ্গী হওয়ার আগে তাকে একবার জানাতে পারত গদাধর। ছোকরা শুধু দায়িত্বজ্ঞনহীন নয়, একেবারে নির্বোধ। গোরার ন্যাওটা শুধু নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। গোরাকে দেখলে সে এলিয়ে পড়ে, তার মুখচোখে ফুটে ওঠে ‘সখি ধরো ধরো’ ভাব।
নিজের ঘরে গোরা ঢুকে গেছে। তার সঙ্গে ছায়ার মতো ঘরে সেঁধিয়ে গেছে গদাধর প্রাতঃকৃত্য সেরে মুরারি এসে পাশে দাঁড়াতে তাকে চন্দ্রশেখর জানাল, গঙ্গাস্নান থেকে গোরার ফেরার খবর। গোরার মুখ থমথমে লাল, দু’চোখ ছলছল করছে, যে-কোনও মুহূর্তে ধুম জ্বর আসতে পারে, আশঙ্কার করার মতো এই তথ্যগুলো চন্দ্রশেখর তুলে দিল মুরারির কানে। চন্দ্রশেখর যা চেয়েছিল, তাই ঘটল। শশব্যস্ত হল মুরারি। অসুস্থ গোরাকে নিজের চোখে দেখতে তার ঘরে ঢোকার আগে চন্দ্রশেখরকে অভয় দিয়ে আশ্বস্ত করল। গোরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে না পড়লে পিণ্ডদান অনুষ্ঠানের আগে তাকে চাঙ্গা করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিল। গোরার চেয়ে মুরারি বয়সে কিছু বড় হলেও গঙ্গাদাসের টোলে সহপাঠী থাকার সময় থেকে বন্ধুর প্রকৃতি সে হাড়ে হাড়ে জেনে গিয়েছিল। পারিবারিক পেশা, বৈদ্যবৃত্তি শুরু করে অল্পসময়ে নবদ্বীপে পসার জমিয়ে নিয়েছে। গোরাকে পরীক্ষা করে তার শরীরের হালচাল বুঝতে মুরারির অসুবিধে না হলেও গোরার মনের নাগাল পেল না সে। বায়ুরোগে আক্রান্ত হয়ে ছেলেবেলা থেকে কয়েকবার বেহুঁশ হয়ে গেলেও গোরার শরীরে রোগব্যাধির লক্ষণ নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ সে। অথচ কথা বলতে গিয়ে কান্নায় কেন বুজে যাচ্ছে তার গলা, মুরারির বোধগম্য হল না। পটের ছবির মতো গোরার গভীর দু’চোখে জল টলটল করছে। রাতারাতি সে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। গোরার মনের খবর জানতে তাকে দু’-একটা প্রশ্নের খোঁচা মুরারি দিতে শালগাছের পাতায় জমে থাকা জলের মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়তে থাকল তার অশ্রুবিন্দু। মুরারি ভ্যাবাচাকা খেল। খাটিয়ায় গোরার পায়ের কাছে বোবার মতো বসে আছে গদাধর। ব্যাপারটা জানতে তার দিকে তাকাল মুরারি। তার দু’চোখে একরাশ জিজ্ঞাসা জড়ো হয়ে থাকলেও সে কোনও প্রশ্ন করল না গদাধরকে। তাকে প্রশ্ন করলেও সে প্রকৃত ঘটনা বলতে পারত না মুরারিকে। গোরার ডাকে ভোররাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে তাকে অঝোরে কাঁদতে দেখলেও কান্নার কারণ তারও অজানা। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে, তাকে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে যাওয়া থেকে গোরা যা যা করেছে, সবটাই তার কাছে হেঁয়ালি। গোরাকে এত আকুল হয়ে সে কখনও কাঁদতে দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কি, গোরা কাঁদতে পারে, এ ধারণা তার ছিল না। গোরার আচরণের মাথামুণ্ডু, সেই মুহূর্তে যেমন তার বোধগম্য হচ্ছিল না, তার কাছে যেমন হেঁয়ালি ঠেকেছিল, স্নানের ঘাট থেকে ফিরে তেমনি অগোচরে রয়ে গেছে। মুরারির নিস্তব্ধ দৃষ্টির সামনে বিব্রতবোধ করলেও তাকে বলার মতো গদাধরের কিছু ছিল না। সে যা দেখেছে, সেটুকুই শুধু বলতে পারে। ঘুম থেকে উঠে দু’চোখ কচলে সে দেখেছিল, গোরা অঝোরে কাঁদছে। নিরবচ্ছিন্ন কান্নার মধ্যে, ঝাপসা চোখে থান কাপড়ে জড়ানো মোড়ক আর নতুন ধুতি, চাদর নিয়ে গোরা প্রায় দৌড়ে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে, স্নানার্থীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে জলে নেমে ক্রমাগত ডুব দিয়ে যাচ্ছিল। গোরার মুখে কোনও মন্ত্র নেই, প্রত্যূষের সূর্যবন্দনা নেই, সকালের ভরা জোয়ারে গঙ্গার স্রোতে তার চোখের জল মিশে পারাপারহীন রহস্যে পৌঁছে দিয়েছিল গদাধরকে। গঙ্গায় একগলা জলে নেমে গোরার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও তাকে কোনও প্রশ্ন করতে গদাধর সাহস পাচ্ছিল না। গোরার যাতে কোনও বিপদ না ঘটে, এই ভেবে তাকে শুধু পাহারা দিচ্ছিল। গলা জলে দাঁড়িয়ে গোরা একের পর এক টুপটুপ করে ডুব দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মধ্যে গদাধর একসময়ে নজর করল, কাপড়ে জড়ানো মোড়কটা গোরার হাতে নেই। ডুবন্ত অবস্থায় জোয়ারের টানে গোরা সেটা ভাসিয়ে দিয়েছে। কী ছিল মোড়কে? গদাধরের মনে প্রশ্ন জাগলেও সে জানতে চায়নি। রাতে, ঘুমের মধ্যে কোনও দুঃস্বপ্ন দেখে পিণ্ডদানের কিছু উপচার কি গোরা গঙ্গায় বিসর্জন দিল? কী সেই উপচার? বিশ্বরূপের লেখা পুঁথির বৃত্তান্ত গদাধরের জানার কথা নয়। জগন্নাথ মিশ্রের পরিবারের বাইরে তার বড় ছেলের লেখা পুঁথির খবর কেউ জানে না। তরুণ গদাধরের বোধবুদ্ধি কাজ করছিল না। রাতে, পাশাপাশি খাটিয়ায় যে গোরার সঙ্গে সে ঘুমিয়েছে, সকালে সেই মানুষটা যেন একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। কী এমন ঘটল রাতে সে জানে না। গভীর ঘুমে সে ডুবেছিল। সে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত গোরা জেগে ছিল। খাটিয়ায় গোরার জন্যে বিছানা পেতে সব আয়োজন করে তবে সে শুয়েছে। খাটিয়ায় শরীর এলিয়ে দিয়ে গোরার সঙ্গে কথা বলার মধ্যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, খেয়াল নেই। তখনও পর্যন্ত গোরা জেগে ছিল। নিজের ঝুলি খুলে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছিল। গোরা কখন ঘুমিয়েছে সে জানে না। ঘুমের আগে পর্যন্ত প্রদীপ জ্বলতে দেখে মাথা পর্যন্ত কাঁথামুড়ি দিয়ে চোখ বুজেছিল। ভোররাতে গোরা না ডাকলে তার ঘুম ভাঙত না। গোরা আদৌ রাতে ঘুমিয়েছে কি না, এ নিয়ে এখন তার সন্দেহ জাগল। রাতে না ঘুমোলে কি করছিল গোরা? দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকারের মতো গেল রাতটা তার কাছে প্রহেলিকাচ্ছন্ন হয়ে উঠল।
গোরার কপালে হাত রেখে, তার কব্জি ধরে নাড়ির গতি দেখে, জ্বরের কোনও লক্ষণ না পেয়ে মুরারি নিশ্চিন্ত হলেও অস্বস্তি কাটাতে পারল না। থমথমে গোরার মুখ। সদানন্দময়, উজ্জ্বল সেই মুখ কী কারণে এমন লালাভ হয়ে উঠেছে, মুরারি অনুমান করতে চেষ্টা করল। গোরার পুরনো বায়ুরোগ কি আবার ফিরে এল? বায়ুরোগে আক্রান্ত গোরাকে একাধিকবার সে চিকিৎসা করেছে। তার দেওয়া বিষ্ণুতেল মাথায় মেখে পুরোপুরি রোগ নিরাময় না হলেও গোরা আরাম পেয়েছিল। রোগের ধাক্কায় বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ইদানীংকালে ঘটেনি। দুষ্ট বায়ুরোগ নিরাময়হীন, যখন তখন ফিরে আসতে পারে। গোরা কান্নায় ভেঙে পড়লেও বেহুঁশ হওয়ার লক্ষণ তার শরীরে নেই। তার দু’চোখে জল আর বিহ্বলতা একাকার হয়ে থাকলেও তাকে অতিরিক্ত সজাগ মনে হল মুরারির। ভেজা চোখে, রুদ্ধ গলায় স্বগতোক্তির মতো বারবার নিজেকে যে প্রশ্ন গোরা করছিল, তা শুনে মুরারির মনে হল, মৃত বাবার শোকে, প্রয়াত স্ত্রীর জন্যে কাতরতায়, তাদের পিণ্ডদানের আগে গোরা বেসামাল হয়ে পড়েছে।
আমি কে, এখানে কেন এসেছি, ঘুরেফিরে গোরার এই দুটো প্রশ্ন, মুরারি শুনেও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। গোরার প্রশ্নের জবাবে এখন কিছু বলা বাতুলতা। কিছুক্ষণের মধ্যে মনের শোক সরিয়ে রেখে, গোরা শান্ত হয়ে যাবে, অনুমান করে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে চন্দ্রশেখরকে বিষ্ণুপাদ মন্দিরে যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে বলল মুরারি। বৈদ্য মুরারির কথা শুনে চন্দ্রশেখর হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। গোরা অসুস্থ নয়, দু’জন মৃত মানুষের পিণ্ডদান পর্বের ধকল সামলাতে পারবে, জেনে সে নিশ্চিন্ত হল। নবদ্বীপের পুণ্যার্থীরা সকালের ক্রিয়াকর্ম সেরে তৈরি হওয়ার মধ্যে তাদের নিতে ধর্মশালায় মন্দিরের পাণ্ডা পুরোহিত এসে গেল। পিতৃপুরুষের পিণ্ড দিতে নবদ্বীপ থেকে যত মানুষ এসেছে, তার চেয়ে বেশি এসেছে মুমুক্ষু পুণ্যার্থীরা। সূর্য ওঠার কয়েক দণ্ডের মধ্যে পুরোহিত আর পাণ্ডার সঙ্গে পিণ্ডদানের উপচার, পুজোর নৈবেদ্য নিয়ে ফল্গু নদীর পশ্চিম তীরে কালো পাথরের বিশাল মন্দিরের হাতায় নবদ্বীপের যাত্রীরা পৌঁছে গেল। মন্দিরের মাথায় আটকোণা বিশাল গম্বুজ। গম্বুজের চূড়া রুপোর পাতে মোড়া। মন্দিরের উত্তরে শোণ নদীর ধারে সূর্যমন্দির। আরও দক্ষিণে, আধক্রোশ দূরে বহমান গঙ্গা। সীতার শাপে ফল্গু অন্তঃসলিলা হলেও সামান্য বালি সরালে জলস্রোত বেরিয়ে পড়ে।
বিষ্ণুপাদ মন্দিরের গর্ভগৃহে পুরোহিতের সঙ্গে চন্দ্রশেখর, মুরারি, মুকুন্দ, মাঝখানে গোরাকে নিয়ে ঢুকল। তাদের পেছনে গদাধর, নবব্দীপের যাত্রীরা। মন্দিরে কোনও মূর্তি নেই। তার বদলে রয়েছে, পুরাকালে গয়াসুর নিধনে, তার বুকে চাপিয়ে দেওয়া যে পাথরে তেত্রিশ কোটি দেবতা জাঁকিয়ে বসলেও গয়-র মৃত্যু না হওয়ায়, গোলোকধাম থেকে ভগবান বিষ্ণু, স্বয়ং এসে দেবতাদের সরিয়ে সেখানে নিজের ডান পা রেখেছিলেন সেই পদচিহ্ন আঁকা জগদ্দল পাথর। পাথরের ওপর চিরকালের জন্যে খোদিত হয়ে গেল বিষ্ণুর পায়ের ছাপ। পাথরে চাপা গয়কে তার মৃত্যুর আগে ভগবান বিষ্ণু বর দিয়েছিল, তাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ না করে কেউ স্বর্গে যেতে পারবে না। প্রাচীন সেই জনপদ, তখন থেকে গয়া তীর্থক্ষেত্র নামে পরিচিত হতে শুরু করল। গয়াসুরের বুকে চাপানো পাথর হয়ে উঠল রাক্ষসরাজ রাবণের পরিকল্পিত, অথচ অনির্মিত-স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়ি। লঙ্কার রাজা রাবণের সিঁড়ির সঙ্গে অসুর বংশের গয়-র বুকে ধৃত পাথরের তফাত হল, লঙ্কাধিপতি যেখানে পৃথিবীর মানুষকে সশরীরে স্বর্গে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল, গয় সেখানে মৃত মানুষের আত্মার স্থায়ী অভিবাসনের পাকা বন্দোবস্ত করেছিল।
মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকার আগে থেকে গোরার দু’চোখ উপচে জল পড়তে শুরু করেছিল। গাল বেয়ে চিবুক, গলা, বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে কোমরের বস্ত্রাংশ পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছিল। গর্ভগৃহের আবছা অন্ধকারে ভিজে চোখে ঝাপসা দেখছিল সে। অস্থির করছিল তার শরীর।। পুরোহিতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মন্ত্রপাঠে বসার আগে কয়েক পা এগিয়ে পাথরে খোদিত বিষ্ণুর পাদপদ্মে দু’হাতে অর্ঘ্য চড়াতে গিয়ে গোরা বেহুঁশ হয়ে গেল। পেতলের থালায় কলাপাতার ওপরে সাজানো অর্ঘ্য গোরার দু’হাত থেকে শব্দ করে গর্ভগৃহের মেঝেতে পড়ে ছড়িয়ে গেল। পাথরের মেঝেতে কাটা কলাগাছের মতো গোরা আছড়ে পড়ার আগে তাকে দু’হাতে ধরে ফেলল বলিষ্ঠ-শরীর মুরারি।
অর্ঘ্যের থালা গোরা হাতে তোলার পর থেকে তার শরীরে কাঁপুনি ধরতে দেখে চন্দ্রশেখর অবাক হওয়ার সঙ্গে ভয় পেয়েছিল। বিষ্ণুর পাদপদ্ম পর্যন্ত জগন্নাথ মিশ্রের পিণ্ডের উপচার পৌঁছবে না, এ আশঙ্কা সে করেছিল। গোরার শরীরের কাঁপুনি মুরারিরও নজর এড়ায়নি। দুর্ঘটনার ভয় সে-ও পেয়েছিল। চন্দ্রশেখরের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা সরেনি। গোরা নিজেও জেনে গিয়েছিল যে, জগন্নাথ মিশ্রের পিণ্ডদানে সে অনধিকারী, শচীর সন্তান, বিশ্বরূপের সে ছোট ভাই হলেও মিশ্রবংশের কেউ নয়। লক্ষ্মীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় নিয়মবিধি মেনে তার বিয়ে হলেও বিশ্বরূপের পুঁথি পড়ে সে জেনে গেছে, সে পরিণয় সিদ্ধ নয়, লক্ষ্মীর স্বামী হওয়ার দাবি সে করতে পারে না। লক্ষ্মীর আত্মার মুক্তি কামনায় তার দেওয়া পিণ্ড যথাস্থানে পৌঁছবে না। গয়াসুরের পবিত্র মন্দিরে ঢুকে মহাপাপ করেছে সে। হিন্দুদের এই পবিত্র তীর্থভূমিতে তার মতো অজ্ঞাতকুলশীলের ঢোকা নিষিদ্ধ। গত রাতে সে জেনেছে, নবদ্বীপে সবাই যে পরিচয়ে তাকে জানে, সেটা তার প্রকৃত পরিচয় নয়। সে বিশ্বম্ভর মিশ্র নয়, নিমাই পণ্ডিত, গৌরাঙ্গ, গোরা নয়, সে নামগোত্রহীন, আকাশ থেকে খসে পড়া সদ্যোজাত এক শিশু। তাকে খুঁজে নিতে হবে নিজের ধর্ম, নিজের কুলশীল, নাম, আত্মপরিচয়। বিশ্বরূপের পুঁথির সঙ্গে গলায় জড়ানো উপবীতটা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার কথা মনে না থাকার জন্যে তার আক্ষেপ হল। গঙ্গায় উপবীত বিসর্জন দিয়ে এলে তাকে এই পিণ্ড দেওয়ার বিড়ম্বনা পোহাতে হত না। ধর্মশালা থেকে বিষ্ণুপাদ মন্দিরে পা রেখে, অর্ঘ্যের থালা হাতে নেওয়ার মুহূর্ত থেকে তার শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়েছিল। ঘোর অনাচার করছে ভেবে ঘূর্ণিঝড় বইছিল মাথার ভেতরে, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল দৃষ্টি, সে টের পেয়েছিল অর্ঘ্যের থালা হাতে বিষ্ণুশিলা স্পর্শ করতে পারবে না, তার আগে অঘটন ঘটবে।
মুরারির সঙ্গে মুকুন্দ, গদাধর মিলে বেহুঁশ গোরার বিশাল শরীর ধরাধরি করে গর্ভগৃহের বাইরে মন্দিরের চাতালে এনে শুইয়ে দিল। বিষ্ণুর পাদপদ্ম দেখে প্রগাঢ় ভক্তিতে গোরা যে হুঁশ হারিয়েছে, এ নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিল না। চন্দ্রশেখরের কানে মুখ রেখে ফিসফিস করে মুরারি বলল, পৃথিবীতে অতি বড় ভক্ত ছাড়া এ দশা কারও হয় না। এ বায়ুরোগ নয়, মৃগী নয়, এ হল ভাবসমাধি, সাত্ত্বিক বৈয়বের লক্ষণ।
মুরারির ব্যাখ্যা, এক কথায় চন্দ্রশেখর উড়িয়ে দিতে পারল না। বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ, ভাবসমাধি।
মুকুন্দরও মনে হল, গোরার মনের ভাবসমুদ্রে জোয়ার এসেছে। তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভক্তির স্রোত। গদাধরকে কথাগুলো মুকুন্দ বলতে সে বিশ্বাস করল। মন্দিরের চাতালে, সুপুরুষ গোরাকে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তাকে ঘিরে ভিড় জমতে থাকল। গরদ-বস্ত্র জড়ানো উজ্জ্বল স্বর্ণাভ, লম্বা, মজবুত শরীর, খঙ্গের মতো নাক, ঘন ভ্রু-যুগলের নিচে মুদ্রিত টানা চোখ, শক্ত চিবুক, লালাভ পাতলা ঠোঁট, ঘাড় পর্যন্ত কালো চুল, স্বর্গভ্রষ্ট দেবরাজ ইন্দ্রের মতো অনুপম সুন্দর, জ্ঞানহারা মানুষটাকে কিছু তীর্থযাত্রী দেবতা ভেবে নিল। তাদের মতো হেটো-মেঠো লোকেদের ধারণা দিব্যকান্তি, সুদর্শন সব মানুষ-ই আসলে ছদ্মবেশী দেবতা। তাদের শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়। তাদের মতো চোয়াড়ে চেহারার গৌড়িয়ারা কখনও দেবতা হতে পারে না। বেহুঁশ গোরাকে ঘিরে নবদ্বীপের যাত্রীরা নিরাপদ বেষ্টনী করে রেখেছে।
দিন গড়ানোর সঙ্গে মন্দিরের ভেতরে বাইরে পিণ্ডদানকারীদের ভিড় বাড়ছে। পরিবারের মৃতদের স্বর্গবাসের আয়োজন করতে তারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। পিণ্ডদানের শাস্ত্রীয়বিধি আর লোকাচার কম নয়। শুরু বিষ্ণুর পাদপদ্মে অর্ঘ্য নিবেদন করে, মন্দির প্রাঙ্গণের শেষপ্রান্তে অক্ষয়বটের তলায় কর্মফল ত্যাগের প্রতীক হিসেবে নিজের প্রিয় ফলটি উৎসর্গ করতে হয়। ইহজীবনে সেই ফল দাঁতে কাটা যাবে না। কর্মফলত্যাগের অনুষ্ঠান শেষ করে পিণ্ডদাতাদের অনেকে অক্ষয় বটের পাশ দিয়ে একহাজার সিঁড়ি ভেঙে ব্রত্নজনি পাহাড়ের চূড়ায় শিবমন্দিরে অর্ঘ্য দিতে যায়। ভোলা মহেশ্বরকে তুষ্ট করে মৃত স্বজনের ইন্দ্রলোকে পৌঁছনোর ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে তাদের এই অর্ঘ্যদানের অনুষ্ঠান।
গোরা জ্ঞান হারালেও অচেতন মৃগী রোগের শরীরে যত রকম বিকার ঘটে, দাঁতে দাঁত লেগে যায়, খিঁচুনি ধরে শরীরে, দু’কশ বেয়ে গাঁজলা বেরোয়, গোরার শরীরে তেমন কিছু ঘটেনি। মৃগী রোগের কোনও লক্ষণ তার দেহে নেই। তাকে দেখে অচেনা যাত্রীদের দু’-একজন ভাবছিল, দূরের দেশের এই মহাকায় তীর্থযাত্রী বিষ্ণুপাদ মন্দিরে পৌঁছে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। আধঘন্টা পরে গোরার হুঁশ ফিরতে চোখ খুলে সে প্রথমে দেখল ঈশ্বরপুরীকে। এক নজরে চিনতে পারল তার প্রিয় মানুষ পুরী-গোঁসাইকে। ঈশ্বরপুরীর দু’চোখে টলটল করছে কৌতুক আর কৌতূহল। দ্বারকায় যার এখন থাকার কথা, জীবনের এই ক্রান্তি মুহূর্তে তাকে গয়ায় সামনে দেখে গোরার মুখে কথা সরল না, ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকল, স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল তার মুখ জুড়ে। গোরার মুখ হঠাৎ কেন আলোকিত হয়ে উঠেছে, ঈশ্বরপুরীর বুঝতে অসুবিধে হল না। গয়ায় পা দেওয়ার পর থেকে যা যা ঘটেছে, চন্দ্রশেখরের মুখে একটু আগেই সে বিবরণ ঈশ্বরপুরী শুনেছে। বিষ্ণুপাদ মন্দিরে ঢুকে গোরার শরীরের কাঁপুনি, ভাবাবেশ, অর্ঘ্যদানের আগের মুহূর্তে মূর্ছিত হওয়ার বৃত্তান্ত জেনে ঈশ্বরপুরীর ধারণা হল, নবদ্বীপের এই সুসন্তানের ওপর কৃষ্ণের কৃপাবর্ষণ শুরু হয়েছে। গোরার জন্মান্তর ঘটে গেছে। মানুষ নিষ্কলুষ হয়ে না উঠলে তার দেহ থেকে এমন দ্যুতি বেরোয় না। কৃষ্ণাবতারের জন্যে নবদ্বীপে গুরুভাই অদ্বৈত আচার্যের তীব্র আর্তি এতদিনে বোধহয় মিটতে চলেছে।
হুঁশ ফিরে পেয়ে চোখের সামনে ঈশ্বরপুরীকে দেখে গোরা উঠে বসতে তাকে ঘিরে থাকা নবদ্বীপবাসীরা আনন্দে ভগবান বিষ্ণু আর পবিত্র গয়াধামের মহিমায় জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। সহযাত্রীদের কোলাহল গোরার কানে ঢুকল না। তার চোখ ফেটে জল ঝরতে থাকল। তার মুখের দিকে স্নেহাতুর চোখে তাকিয়ে থাকল ঈশ্বরপুরী। গোরার চোখ দিয়ে জল পড়লেও তার মুখে, শরীরে মুক্তির মহাভাব নজর করে, ঈশ্বরপুরীরও জ্ঞান হারানোর অবস্থা হল। তাকে গোরা জিজ্ঞেস করল, আমি কে, কী আমার পরিচয়?
ভক্তিতে বিহ্বল ঈশ্বরপুরী বলল, আমার মতো তুমিও একজন শূদ্রাধম, নামপরিচয়হীন, সন্ন্যাসী, কৃষ্ণপ্রেমের কাঙাল।
স্থির চোখে পুরীগোঁসাই-এর দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছিল গোরা। মাঝরাতে আত্মপরিচয় হারানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঈশ্বরপুরীর মুখ থেকে সে এমন এক সত্যের খবর পেল, যা তার মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সর্বস্ব হারানোর অস্থিরতা মুছে দিয়ে তাকে বিনয়ে বিগলিত, শান্ত করে দিল। কুলশীল, বংশগতির চেয়ে মানুষের যে আরও বড় পবিত্র, সর্বজনীন এক পরিচয় আছে, গয়াধামে এই সংকট মুহূর্তে সেই বার্তা তাকে শুনিয়ে দিয়েছে ঈশ্বরপুরী। নতুন ভবিষ্যৎ রচনার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। সন্ন্যাসীর কোনও পরিচয় দরকার হয় না। সে শূদ্রাধম, ধর্ম বর্ণ জাতপাত নির্বিশেষে, আপামর জনসাধারণের একজন, জলের মধ্যে মাছের মতো তার বিচরণভূমি।
গোরার পিণ্ডদানে বিঘ্নের কাহিনী সে বেহুঁশ থাকার সময়ে চন্দ্রশেখরের মুখ থেকে ঈশ্বরপুরী শুনে তাকে ক্রিয়াদোষের কথা মুখে আনল না। নতুন করে পিণ্ডদানের নির্দেশ দেওয়ার বদলে বলেছিল, গোরার নিবেদিত পিণ্ড যথাস্থানে পৌঁছে গেছে। গোরাকে একই অভিমত জানিয়ে ঈশ্বরপুরী বলল, তোমার শরীর ফুটে বেরনো আলো দেখে বুঝতে পারছি, পৃথিবীতে তুমি সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছ, বিষ্ণুপাদপদ্মের আলো ঢুকে গেছে তোমার শরীরে। ক্রমশ তা উজ্জ্বল হবে।
চাতালে বসে বিষ্ণুপাদ মন্দিরের রুপো বাঁধানো গম্বুজ, নীল আকাশ, জনিপাহাড়ের শিবপীঠ, চারপাশে পুণ্যার্থী মানুষের ভিড় দেখে গোরাও অনুভব করছিল, মাতৃরূপা পৃথিবীর কোলে শুয়ে এই প্রথম চোখ খুলে সে বিশ্বরূপ দর্শন করল। তার হারানোর কিছু নেই। সকালে গঙ্গায় বিসর্জিত বিশ্বরূপের পুঁথি থেকে নিজের আত্মপরিচয়, ভবিষ্যতের দিশা পেয়ে গেছে সে। তার দু’চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে থাকল। সে বলল, আপনার মতো আমিও শূদ্রাধম, উপবীত ছেড়ে আমিও সন্ন্যাস নেব। আমার কুলপরিচয়, পিতৃপরিচয় কেউ জানতে চাইবে না। আপনি সন্ন্যাসের মন্ত্র দিন আমাকে।
গোরার আকুল প্রার্থনা শুনে ঈশ্বরপুরী হকচকিয়ে গিয়ে তাকাল চন্দ্রশেখরের দিকে। গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার প্রস্তাবে চন্দ্রশেখর যেমন আঁতকে উঠল, ততোধিক ভয় পেল মুকুন্দ, মুরারি। গোরার তারা বন্ধুলোক। গোরাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। মুখ থেকে গোরা কোনও কথা খসালে, তার নড়চড় হয় না। গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছে যে ফেলনা নয়, টের পেয়ে মুরারির দু’চোখে জল এসে গেল। ভয় পেল মুকুন্দ। কান্না সামলাতে গদাধর সরে দাঁড়াল। পরিস্থিতি সামাল দিতে চন্দ্রশেখর সময় নিল না। গোরাকে বলল, বাড়িতে তোমার বিধবা মা, অল্পবয়সি বউ রয়েছে। তুমি ছাড়া তাদের দেখার কেউ নেই। তুমি সন্ন্যাস নিলে তাদের না খেয়ে মরতে হবে। তুমি কি তাই চাও?
গোরার দিকে তাকিয়ে তার দু’চোখ ছলছল করছে দেখে নরম গলায় চন্দ্রশেখর বলল, তুমি শাস্ত্রজ্ঞানী, পণ্ডিত, তুমি ভালোই জানো, মা, বউ-এর অনুমতি না নিয়ে সংসার ছেড়ে তুমি চলে যেতে পার না। সেভাবে সন্ন্যাস নিলে তা শাস্ত্রবিরুদ্ধ হবে।
ঈশ্বরপুরীর অনুমোদন পেতে তার দিকে কাতর ভঙ্গিতে চন্দ্রশেখর তাকাতে পুরীগোঁসাই শান্ত গলায় বলল, চন্দ্রশেখর আচার্যমশাই যা বলছেন, ভুল নয়। তাছাড়া একলাফে সন্ন্যাসী হওয়া যায় না। ধাপে ধাপে এগোতে হয়, শাস্ত্রবিহিত সন্ন্যাস নেওয়ার আগে মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে নামজপ, সঙ্কীর্তন করে কিছুকাল গৃহীসন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাতে হয়। গোরাকে নবদ্বীপে গিয়ে নামজপ, সঙ্কীর্তনের ঢেউ তুলতে হবে, সুলতানি আদেশে নিষিদ্ধ প্রেমগীতি, ভক্তিগীতির অবরুদ্ধ স্রোতকে মুক্ত করতে হবে। শাস্ত্রানুমোদিত পরামর্শ দিল ঈশ্বরপুরী। বলল, কৃষ্ণ শুধু একটা নাম নয়, এক বিশাল ভাবৈশ্বর্য, মহান আদর্শ, পাপতাপমোচনকারী দেশব্যাপ্ত কর্মযজ্ঞ। কৃষ্ণ মানে মুক্তি, কৃষ্ণ মানে জ্ঞান, দুর্নীতির উচ্ছেদ, দুষ্কৃতি দমনের শেষে সাধুসমাজের অভ্যুদয়। মাধ্ব সম্প্রদায়ের গুরু, মধ্বাচার্য থেকে পাঁচশ’ বছরের বেশি সময় ধরে পরম্পরাক্রমে গুরু ব্যাসতীর্থপুরী, লক্ষ্মীপতিপুরী, তাঁর শিষ্য মাধবেন্দ্রপুরীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এপর্যন্ত অসংখ্য দুর্যোগ সত্ত্বেও পরিত্রাতা কৃষ্ণের অবতারতত্ত্ব নিয়ে বিশ্বাসের যে ধারা বয়ে চলেছে, তা ব্যর্থ হওয়ার নয়। আমি অনুভব করছি, সুদীর্ঘ তপস্যার শেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেছে। তুমিও সেই শুভক্ষণ টের পেলে, গৃহস্থাশ্রমে তোমাকে বেঁধে রাখা যাবে না। সন্ন্যাস নেওয়ার শুভক্ষণ হাজির হবে। তোমাকে সন্ন্যাস মন্ত্র দেওয়ার উপযুক্ত গুরুও অপেক্ষা করে থাকবে। তোমার মা, স্ত্রী মেনে নেবে তোমার সন্ন্যাসব্রত।
গোরার পিঠে আশীর্বাদী হাতের ছোঁয়া রেখে ঈশ্বরপুরী বলল, ভগবান কৃষ্ণকে মহাপ্রেমিক, ত্রাণকর্তা মেনে নিয়ে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, লক্ষ কোটি মানুষের মধ্যে তার অবস্থান, তার দেহের তাপ, বুকের স্পন্দন অনুভব কর, অভিভূতের মতো নিজেকে কৃষ্ণ ভাবো, সবাইকে কৃষ্ণজ্ঞান কর, সবাইকে কৃষ্ণ দেখাও, নবদ্বীপ আর গৌড়বাসীকে গুরু মাধবেন্দ্রপুরীর ভাবস্রোতে ভাসিয়ে দাও। সাধুসমাজের জেগে ওঠার সঙ্কেত দেখা যাচ্ছে, দুরাচারের পতন ঘটতে দেরি নেই, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার যে সঙ্কল্প পাঁচশ’ বছর ধরে প্রদীপের মতো জ্বলছে, তা জ্যোতির্ময় হওয়ার লক্ষণ দশ দিগন্তে ফুটে উঠেছে, গোরা তুমি এক বার ‘কৃষ্ণ’ বল, গেয়ে ওঠ ‘সারঙ্গধর, তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে।’
গোরা আচ্ছন্নের মতো ‘কৃষ্ণ’ শব্দটা উচ্চারণ করে তখনই জ্ঞান হারাল। তার দিকে তাকিয়ে ভাবাবেশে আচ্ছন্ন হয়ে গেল ঈশ্বরপুরী। গোরার কপালে গুঁড়ো ঘাম, শরীরে কাঁপুনি দেখা দিল। তাকে ঘিরে থাকা যাত্রীরা হরিধ্বনি দিল, মন্ত্রোচ্চারণের মতো কেউ কেউ বলল, কৃষ্ণ গোবিন্দায়, বাসুদেবায়, নমঃ।
শুদ্ধ সাত্ত্বিকতার এত জীবন্ত মূর্তি ঈশ্বরপুরী আগে দেখেনি। সে ভাগবতের শ্লোক আওড়াতে থাকল। দ্বারকা যাওয়ার পথে গয়ায় রাত্রিবাস করার জন্যে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল তার। গুরুভাই, অদ্বৈত আচার্যের আকুল আহ্বানে গোলোকপতি বিষ্ণু অবতার যে নবদ্বীপে অবতীর্ণ হয়েছে, গোরাকে দেখে ঈশ্বরপুরীর মনে এ ধারণা দৃঢ় হল। গোরার জ্ঞান ফিরতে তাকে একান্তে ডেকে নিয়ে, নবদ্বীপে ফিরে গোরাকে প্রথমে অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিল ঈশ্বরপুরী। পণ্ডিতপ্রবর, পরমভাগবত অদ্বৈত আচার্য পঞ্চাশবছর ধরে গোরার জন্যে অপেক্ষা করছে। গোরাকে তার সঠিক আত্মপরিচয় শুধু অদ্বৈত জানাতে পারে। মহাসমারোহে তার অভিষেকের আয়োজনও করবে অদ্বৈত।
বিশ্বরূপের পুঁথির ভাষ্যের সঙ্গে ঈশ্বরপুরীর পরামর্শের মিল পেয়ে গোরা ফের মহাভাবে ডুবে গেল।