৪৩
স্নানযাত্রার কয়েকদিন পরে সেই বছরই মারা গেল ঠাকুর হরিদাস। বলা যায়, ইচ্ছামৃত্যু হল তার। ভোরের আলো ফোটার আগে গম্ভীরা থেকে হরিদাসের কুঁড়েতে গোরাকে ডেকে নিয়ে গেল দামোদর। বলল, শেষবারের মতো তোমাকে দেখতে চাইছে ঠাকুর হরিদাস। মাঝরাত থেকে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলেও নামজপ সে ছাড়েনি, বলছে, আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। তাঁর হুকুমে প্রাণটা এতদিন ধরে রেখেছিলাম। তিনি এসে আমায় যাওয়ার অনুমতি দিন।
গোরা তখনই রওনা দিল দামোদরের সঙ্গে। জোয়ারের ঢেউ ভাঙছে সমুদ্রে। নির্জন সকাল। ঝাউবনের মাথায় ভোরের প্রথম আলো এসে পড়েছে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ধবধবে সাদা একঝাঁক বক। নিঃশব্দে কৃষ্ণনাম জপ করছে গোরা। তার মনে হচ্ছে হরিদাসের মতো অতুলনীয় কৃষ্ণভক্তি বৈষ্ণবসমাজে কারো নেই। তার নিজের আছে কিনা, এ নিয়েও তার মনে সংশয় জেগেছে। দু’চোখ বুজে হরিদাস যেভাবে তাকে স্বয়ং কৃষ্ণ ভেবে ভজনা করেছে, কৃষ্ণকে পেয়ে তৃপ্ত হয়েছে, সেভাবে কি হরিদাসকে কৃজ্ঞানে সে মেনে নিতে পারত? ভাবাবিষ্ট অবস্থায় নিজেকে তার কৃষ্ণাবতার মনে হলেও আবেশ কাটলে দিনের বাকি সময় সে একজন কৃষ্ণপ্রেমী সন্ন্যাসী ছাড়া কিছু নয়। ঠাকুর হরিদাসের পরমায়ু ফুরিয়ে এসেছে, কিছুদিন ধরে সে টের পাচ্ছিল। পৃথিবী ছেড়ে হরিদাস চলে যাবে অনুমান করে হুহু করছিল তার বুক। প্রার্থনা করছিল, বাপ কৃষ্ণ, হরিদাস যেন তোমার শ্রীচরণে ঠাঁই পায়।
দামোদরের সঙ্গে হরিদাসের কুঁড়েতে গোরা যখন পৌঁছোল, সেখানে জগদানন্দ, গদাধর, গোপীনাথ আরও অনেকে পৌঁছে গেছে। খোল, খঞ্জনি নিয়ে বটমঞ্জুরী রাগে সঙ্কীর্তন করছে কয়েকজন। কুঁড়ের ভেতরে মাটির ওপরে শুয়ে হরিদাস বিড়বিড় করে নামজপ করলেও তার দু’ঠোঁট ক্লান্তিতে ভারী হয়ে আসছে, একনজরে গোরা বুঝে গেল। তার বুজেথাকা দু’চোখের পাশ দিয়ে সরু জলের রেখা শুকিয়ে রয়েছে। গোরা এসেছে শুনে অনেক কষ্টে চোখ খুলে তার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, হে কৃষ্ণ, আমার মাথার পাশে এসে একবার দাঁড়াও।
গোরা তাই করল। সঙ্কীর্তন থেমে গেছে। জীবনের শেষমুহূর্তে গোরার কাছে হরিদাসের কি প্রার্থনা, সবাই শুনতে চায়। হরিদাসের মাথার কাছে গোরা গিয়ে দাঁড়াতে মুমূর্ষু মানুষটা গোরার পায়ের ওপর মাথা রেখে বলল, জন্মে জন্মে যেন তোমার কৃপা পাই।
হরিদাস কথা শেষ করতে তার মাথাটা গোরার পা থেকে মাটিতে ঢলে পড়ল। স্থির হয়ে গেল তার শরীর। গোরার ভক্ত, অনুরাগীদের অনেকে তখন কুঁড়ের সামনে জড়ো হয়েছে। তাদের চোখে জল, ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ। সদাব্রত, বৃদ্ধ হাসিমুখ কৃষ্ণপ্রেমী হরিদাসকে সবাই ভালবাসত। তার কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে শিষ্য হতে চেয়েছিল কেউ কেউ। লজ্জা, সঙ্কোচ, বিনয়ে জিভ কেটে হরিদাস বলত, দীক্ষা দেওয়ার অধিকার আমার নেই। আমি শুধু ‘কৃষ্ণ’ নাম জপ করতে পারি।
তার অনুরাগীদের কেউই জানত না সন্ন্যাস নেওয়ার আগে তার পূর্বাশ্রমের পরিচয়। দু’একজন জানলেও তারা মুখ খোলেনি। হরিদাসের মরদেহ শ্মশানে দাহ করার প্রস্তুতি জগদানন্দ, দামোদর যখন নিতে শুরু করেছে, গোরা বলল, সমাধি দেওয়া হবে হরিদাসকে।
হরিদাসের পূর্বাশ্রমের পিতৃপরিচয়, সে মুসলমান ছিল যারা জানে না, তারা মুখ চাওয়াচারি করতে থাকল। জগদানন্দ, দামোদর বলল, তাই হোক।
হরিদাসের মরদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে একটা দরমার চালা জোগাড়ে দামোদর ব্যস্ত হতে গোরা বলল, ঠাকুরকে আমরা বয়ে নিয়ে যাব, চালা খোঁজার দরকার নেই। এসো, হাত লাগাও।
হরিদাসের মরদেহের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ভক্ত, অনুগামীদের দিকে গোরা তাকাল। গদাধর, দামোদর, জগদানন্দ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসাতে তাদের দেখে কিছু অনুমান করে গোরা একা দু’হাতে তুলে নিল মৃত হরিদাসকে। ঘুমন্ত ছোট শিশুকে বাবা যেমনি দু’হাতে সযত্নে তুলে নিয়ে নিজের কোলে শোয়ায়, সেভাবে হরিদাসকে নিজের বুকের কাছে রাখল। স্নেহাতুর বাবার কোলে শিশু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে। সবাই নিস্তব্ধ, চোখে জল, শুকনো মুখ। শ্মশানে সমাধিতে মরদেহ সৎকার করতে চুপচাপ যেতে হয়, এটা ছিল সে যুগের রীতি। গোরা রীতি ভাঙল, চাপা গলা বলল, বলো হরি, হরিবোল।
সঙ্গীরা প্রথমে একটু থতমত খেলেও দু’পা এগিয়ে গলা মেলাল। সকালের নরম রোদ ছড়িয়ে আছে আকাশে। বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে সৎকারকারী দল। সকলের সামনে গোরা। তার দু’হাতে চিরদিনের জন্যে ঘুমিয়ে রয়েছে হরিদাস। হরিদাসের কুঁড়ের সামনে খোল, খঞ্জনি নিয়ে যারা সঙ্কীর্তন শুরু করেছিল, তারা এখন সবার পেছনে মল্লার রাগে গাইছে ভাবসম্মিলনের পদ। সমুদ্রে সারারাত যারা মাছ ধরেছে, নৌকো নিয়ে ঢেউয়ের মাথায় চেপে তারা এক এক করে ফিরছে। নৌকো থেকে নেমে তাদের কয়েকজন দেখছে সঙ্কীর্তনমুখর সৎকারকারীদের। গৌড়ের সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য আর তার কোলে ঘুমন্ত হরিদাসকে তারা চেনে, ভক্তি করে। বালিতে উবু হয়ে বসে তারা দণ্ডবৎ করল মৃত হরিদাসকে। হরিধ্বনি দেওয়ার মধ্যে গোরা ভাবছিল অন্যকথা। হরিদাসকে শ্মশানে যারা দাহ করতে চেয়েছিল, তাদের মধ্যে নবদ্বীপের কয়েকজন ছাড়া সবাই জানত মানুষটা হিন্দু। শ্মশানে চিতা জ্বেলে হিন্দুদের সৎকার করতে হয়। মুসলমানরা মরদেহ কবর দেয়। ঠাকুর হরিদাসের গৃহাশ্রমের পরিচয় জানা থাকার জন্যে তাকে সমাধিস্থ করতে নিয়ে যাচ্ছে সে। গদাধর, জগদানন্দ, দামোদর জানে সে খবর। তারা নিঃশব্দে মেনে নিয়েছে হরিদাসকে সমাধিস্থ করার আজ্ঞা। দু’জনে বুঝে গেল, এখন থেকে বৈষ্ণবদের মাটির নিচে সমাধিস্থ করার রীতি চালু হয়ে গেল। প্রেমভক্তিতে সে মাটিতে বসে ভাবসমাধি হয়, সেই মাটির তলায় সমাধিস্থ হওয়ার গৌরব কম নয়। ভক্ত, অনুরাগীরা হরিদাসের শেষযাত্রায় পা মেলালেও অবাক হয়েছে। মুখে কিছু না বললেও সৃষ্টিছাড়া এই কাণ্ডকে হয়তো হজম করতে পারছে না। বৈষ্ণব সাধককে চিতায় দাহ করার বদলে মাটির নিচে কবর দেওয়া হয়েছে শুনলে পুরুষোত্তমপুরের কড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীরা হৈচৈ তুলতে পারে। তাদের উসকে দেওয়ার মতো লোক যথেষ্ট আছে। পুরুষোত্তমপুর থেকে গৌড়ীয়দের হঠাতে তারা কোমর বেঁধে নেমে পড়বে। আরো কিছু প্রশ্ন তার মাথায় ঘোরাফেরা করছিল। হরিদাসের মরদেহ বয়ে নিয়ে যেতে সে যখন অনুগামীদের ডাক দিল, স্বরূপ বাদে তাদের কেউ সেই মুহূর্তে এগিয়ে এল না কেন? গদাধর, জগদানন্দ, দামোদরও কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়েছিল। হরিদাসের জাতপাত নিয়ে শোকাতুর মানুষগুলোর মনে কি সন্দেহ জেগেছিল? হরিদাসের আসল পরিচয় যারা জানে, সেই তিনজনের মনেও কি যবনসন্তান পরম বৈষ্ণবের মৃতদেহ ছুঁতে দ্বিধা ছিল?
হরিদাসের নিথর দেহ কোলে নিয়ে সমানে হরিধ্বনি দেওয়ার সঙ্গে আরো নানা প্রশ্ন জাগছিল গোরার মনে। বৈষ্ণব সমাজে মৃতের সৎকারের জন্যে এখনই সাধারণ এক বিধান দরকার। মাটির নিচে হরিদাসকে শেষযাত্রায় শুইয়ে দিয়ে সৎকারের বৈষ্ণববিধান সেখানে সে জানিয়ে দেবে। সবাই খুশি হবে না, নানা জটিলতা তৈরি হবে, তবু বৈষ্ণবদের জন্যে আলাদা বিধান চাই। বৈষ্ণবদের সমাধির বিধান শুনলে পুরুষোত্তমপুরের গোঁড়া স্মার্ত, নৈয়ায়িকরা হল্লা জুড়ে দেবে। তারা রটাবে গৌড়ের সুলতানের প্রজারা ধর্মের নামে অপকর্ম করছে। তারা হিন্দু নয়, ছদ্মবেশী যবন। সন্ন্যাসী ভেকধারী গৌড়ের শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য আসলে ভণ্ড, সুলতানের গুপ্তচর। তার অনুগামীদের মধ্যে এখন এসে মিশে গেছে গৌড় দরবারের দুই মন্ত্রী। উৎকলের রাজনৈতিক খবরাখবর নিয়ে গৌড়ের রাজধানী একডালায় তারা পৌঁছলে ফের শুরু হবে সুলতানী সেনার অভিযান। লুঠপাটের সঙ্গে তারা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে। গরীব মানুষের বেঁচে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, সকালে যে আছে, বিকেলে সে নেই, শ্মশানে তার চিতা জ্বলছে। পোকামাকড়ের মতো মানুষ জন্মাচ্ছে আর মরে যাচ্ছে। তার মধ্যে আবার একটা যুদ্ধ বাঁধলে কত ভিটেমাটি জ্বলবে, চিরদিনের মতো কত মানুষ মারা পড়বে, নিখোঁজ হবে, দেশান্তরী হবে কেউ জানে না। হরিদাসের সমাধি, তার স্মরণ মহোৎসবের জন্যে মন্দিরের আনন্দবাজারের দোকানিদের কাছ থেকে প্রসাদ ভিক্ষের ঘটনা ঝড় তুলল পুরুষোত্তমপুরের ব্রাহ্মণ্যবাদী মহলে। গৌড়ীয় বৈষুবদের ওপর প্রবল হল তাদের বিদ্বেষ।
পুরুষোত্তমপুরের পরিস্থিতি যখন জটিল হচ্ছে, গৌড়ের রাজধানী একডালায় সুলতানের মন্ত্রণালয়ে চলছে গোপন শলাপরামর্শ। সুলতানের কয়েকজন বিশ্বস্ত আমীর, ওমরাহর সঙ্গে সেখানে রয়েছে একজন বাইরের লোক। মেদিনীপুর সমেত গড়মান্দারণ কেল্লার সে সার্বভৌম শাসক। তার নাম গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই। তাকে সার্বভৌম শাসক মুখে বলা হলেও সুলতানের সঙ্গে কয়েক বছরের যোগাযোগে ইতিমধ্যে তার বশংবদ হয়ে গেছে বিদ্যাধর। সে জেনে গেছে তার ক্ষমতার উৎস গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহ। সুলতান একটু ভ্রু কোঁচকালে মেদিনীপুর মহল, গড়মান্দারণ কেল্লা থেকে কুটোর মতো সে উড়ে যাবে। গজপতি রাজবংশকে সরিয়ে উৎকলের রাজসিংহাসন তার দখল করা সহজ হবে না। সুলতানের তলব পেলেই প্ৰায় দৌড়ে তার সামনে হাজির হয়ে যায়। উঠতে বসতে দশবার জাঁহাপনা বলে কুর্নিশ ঠোকে সুলতানকে। একডালার মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে গৌড়ের খান-ই-জাহান, প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদী সমেত যাদের সে দেখল, তাদের সবাইকে চেনে। তাদের একজন ঝড়বৃষ্টির রাতে ইসমাইল গাজীকে খুন করে তার সমাধিতে মাজার গড়ে দিয়েছে। কোতোয়ালপ্রধান আসগর খাঁ গোঁফ মুচড়ে বিদ্যাধরের দিকে তাকাতে ভয়ে হিম হয়ে গেল বিদ্যাধরের বুক। আসগরের চোখে চোখ রেখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে তুলল সে। আসগর পাত্তা দিল না। কাজের কথা তখনই শুরু হল। জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরকে সে কোথায় উধাও করে দিল, কেউ জানে না। দরবারের দু’একজন আমীর-ওমরাহ জানলেও তারা মুখ খোলে না। প্রথমে মুখ খুলল সুলতানাবাদী। বলল, সিন্ধুকীদের কাছ থেকে খবর আসছে, সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায়ের সঙ্গে মল্লভূম, চন্দ্রদ্বীপের রাজপুত্রেরা হামীর রায়, পীতাম্বর রায়, তাদের অনুগত কয়েকজন মহলদার হাত মিলিয়ে বিশাল এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। গৌড়ের সুলতানী মসনদ তারা দখল করতে চায়। তাদের প্রধান পরামর্শদাতা নবদ্বীপের সেই নিমাই পণ্ডিত, নাম ভাঁড়িয়ে যে এখন হয়েছে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। পুরুষোত্তমপুরে ঘাঁটি গেড়ে বিদ্রোহের মশলা জোগাচ্ছে। তার সঙ্গে গিয়ে জুটেছে দরবারের দুই বেইমান আমীর সাকর মল্লিক, দবীর খাস। আরও একজন ছিল, তার নাম জানার দরকার নেই।
খান-ই-জাহান যে জ্যোতিষার্ণবের কথা বলছে, সবাই বুঝে গেল। শান্ত মুখে ইসলামাবাদীর কথা শুনছে সুলতান। তার মুখ-চোখে কোনও উত্তেজনা নেই। হীরে, মুক্তো, চুনি, পান্না, সোনার কারুকাজ করা মাথার ফেজটুপি মাঝেমাঝে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিচ্ছে। আতরদানে দু’আঙুল ডুবিয়ে হাতের দু’পাতাতে ঘসে চলেছে। মনে চাপা উত্তেজনা থাকলে সুলতান এরকম করে। ইসলামাবাদী বলল, আমরা যাদের নাম করছি, তারা প্রত্যেকে মৃত্যুর সাজা পাওয়া আসামী। তাদের কোতল করার আদেশ দিয়েছে দরবার। পুরুষোত্তমপুরে বসে বিদ্রোহের কলকাঠি নাড়ছে। বিদ্রোহীদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সন্ন্যাসী এক ঘনিষ্ঠ চ্যালা, নিতাইকে খড়দহ, পানিহাটিতে রেখে গেছে। ‘ভজ গৌরাঙ্গ, জপ গৌরাঙ্গ’ গান গেয়ে গঙ্গার দু’ধারের হাজার হাজার মানুষকে সে যখন-তখন জমায়েত করে ফেলছে। গৌরাঙ্গের নাম শুনলেই মানুষ নাকি কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। নিতাই সন্ন্যাসী হলেও রাজকীয় পোশাক, অলঙ্কারে সেজে দলবল নিয়ে যখন বেরোয়, অনেকে তাকে গৌড়ের রাজা ভেবে নেয়। সেটাই হল একটা চক্রান্ত। বিদ্রোহীদের সঙ্গে নিতাইকে জুড়ে দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলছে সেই সন্ন্যাসী। একডালার মসনদ বিদ্রোহীরা দখল করলে সেখানে সে এসে বসবে বিদ্রোহীদের খতম করতে আমাদের একদিন-ও লাগবে না। তার আগে নাটের গুরু, গেরুয়া কৌপীন জড়ানো সন্ন্যাসীকে আমরা চাই।
মন্ত্রণালয় নিস্তব্ধ। দু’হাতে সুলতান আতর ঘসতে খুশবু ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। হঠাৎ মুখ খুলল সুলতান। বিদ্যাধরকে বলল, উৎকলের ভাবী রাজা তুমি। সন্ন্যসী আর তার কয়েকজন চেলাকে নিয়ে তোমার সঙ্গে আগে যে কথা হয়েছিল, তা কতদূর এগোল?
আমার কাজ গুছিয়ে ফেলেছি জাঁহাপনা। সন্ন্যাসী আর তার কয়েকজন মাতব্বর সাকরেদকে প্রায় ঘিরে ফেলেছি।
কাজের ছকটা কী?
আষাঢ় মাসে স্নানযাত্রা মহোৎসবের পরে শ্রাবণের কৃষ্ণা পঞ্চমীতে সন্ন্যাসী আর আপনার দরবারের দুই আমীরকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে জাঁহাপনার হুকুমে কোতল করা হবে। মন্দিরের পেছনে শবর সেবকদের জন্যে গুপ্ত পুজোর চাতাল আছে, যার নাম অনসরপিণ্ডি, সেখানে গৌড় দরবারে সাজা পাওয়া তিন কয়েদীকে ধরে এনে কাজ হাসিল করব। তাদের মাটি চাপা দেওয়ার কবর আগে থেকে খুঁড়ে রাখা হবে। মাটি চাপা দিয়ে এমনভাবে তার ওপর পাথর গেঁথে দেওয়া হবে, বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাবে না। তারপর আমরা প্রচার করে দেব, মন্দিরের দারুব্রষ্ম, জগন্নাথদেবের শরীরে কৃষ্ণের অবতার নবদ্বীপের শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য একঝলক আলোর মতো মিশে গেছে।
স্থির চোখে বিদ্যাধরের দিকে তাকিয়ে সুলতান জিজ্ঞেস করল, মন্দিরের রাজভক্ত কর্মচারী, যারা মন্দির আগলায়, কি যেন বলে তাদের, হ্যাঁ, গচ্ছিকার, প্রতিহারী, তারা কি চুপ করে দেখবে, মন্দির চত্বরে তিনজন মানুষের কোতল, মাটির নিচে তাদের ঢুকিয়ে দেওয়ার ঘটনা?
সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে জাঁহাপনা। রক্ষীদের অনেকে মাতাল, শেষ বিকেল থেকে তাদের পা টলমল করে। সুরা খাইয়ে তাদের বেহুঁশ করে রাখা হবে।
তোমাদের তৈরি জগন্নাথের শরীরে সন্ন্যাসীর মিশে যাওয়ার গল্প কি পুরুষোত্তমপুরের মানুষ বিশ্বাস করবে?
করবে জাঁহাপনা। যার মুখ থেকে এই ঘটনার বিবরণ ছড়াবে, সে-ও বৈষ্ণব, ‘অতিবড়’ সম্প্রদায়ের মাথা, জগন্নাথ দাস। পুরুষোত্তমপুরের অনেক মানুষ বিশ্বাস করে কৃচৈতন্যের চেয়ে জগন্নাথের অলৌকিক ক্ষমতা বেশি, জ্ঞানে সে বড়। শ্রাবণে কৃপঞ্চমীর কয়েকদিন আগে থেকে পাঁচ, সাত দিন ধরে এ প্রচার আমার অনুগতরা করেছে। তারাই ফন্দি করে চৈতন্যের প্রাণের বন্ধু জগন্নাথকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। শ্রাবণের কৃয়াপঞ্চমীর রাতে আমার বাহিনীর সঙ্গে মন্দিরে জগন্নাথ থাকবে। চৈতন্যের চেয়ে তাকে বড়ো মহাত্মা প্রমাণ করতে আমরা এমন ঘুঁটি সাজাব, বাবাজিকে প্রাণ নিয়ে মন্দির থেকে বেরতে হবে না। পুরুষোত্তমপুরে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়, বলা যায় দিন রাত বৃষ্টি ঝড়, অন্ধকারে একাকার হয়ে যায়। মন্দিরের পাকশালা থেকে প্রদীপ জ্বেলে নিয়ে জগন্নাথদেবের আরতি হওয়ার নিয়ম মেনে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। ঝোড়ো হাওয়ায় বারবার প্রদীপ নিভে যায়। এবার তা হবে না। জগন্নাথ দাশের হাতের প্রদীপ জ্বলবে, নিভে যাবে চৈতন্যের দীপ, সেইসঙ্গে তার জীবন।
বিদ্যাধরের লম্বা বিবরণ শুনতে সুলতান বিরক্ত হলেও তাকে থামায়নি। এবার থামাল, বলল, আরও কিছু ভেতরের খবর বলো।
সবিনয়ে বিদ্যাধর বলল, জাঁহাপনা, আমার গোস্তাকি যদি মাপ করেন, তাহলে বলি, হরিদাস ঠাকুর নামে এক বুড়ো যবনকে বৈষ্ণব সাজিয়ে পুরুষোত্তমপুরে গোরা নিয়ে এসেছিল। সে মরে যেতে খোল, খঞ্জনি নিয়ে তাকে গঙ্গার ধারে কবর দেওয়া হয়। হরিদাসের মৃতদেহ দু’হাতে একা বয়ে নিয়ে যায় চৈতন্য। সন্ন্যাসী হলেও মানুষটার গায়ে ভীষণ জোর। লাশটাও বিরাট, লাঠি খেলতে পারে, পাকা লাঠিয়াল। হরিদাসকে কবর দিয়ে তার শ্রাদ্ধের আয়োজন করতে মন্দির বাজারের ব্যাপারীদের কাছ থেকে নানা জিনিস জোগাড় করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। হরিদাসকে কবর দেওয়া, তাকে নিয়ে শ্রাদ্ধের মাতামাতিতে পুরুষোত্তমপুরের মানুষের মনে খটকা জেগেছিল। উৎকলের ব্রাক্ষ্মণ আর অভিজাতরা ঘটনাটা সহজভাবে নেয়নি। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের জাতপাতের খোঁজখবর করে তারা জানল, আসলে এরা সমাজের উচ্ছিষ্ট, প্রায় সবাই যবন, গৌড়ের গুপ্তচর। দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ, বিদ্বেষ বাড়ানোর মতলবটা আমাদেরই করতে হয়েছে। সুফল পেয়েছি। চৈতন্য আর তার গৌড়ীয় চেলাদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে মানুষ। চৈতন্য খুন হয়ে গেলে পুরুষোত্তমপুরে তার জন্যে কাঁদার কেউ থাকবে না। সে সুযোগ আমরা দেব না। জগন্নাথের শরীরে তার বিলীন হয়ে যাওয়ার বিবরণ অতিবড়ি বৈষ্ণব জগন্নাথের মুখ থেকে শুনলে উৎকলের সবাই বিশ্বাস করবে, মেনে নেবে। চৈতন্যের আরও কিছু কুকর্মের খবর আপনাকে জানিয়ে রাখি জাঁহাপনা। পানিহাটিতে চেলা নিতাই-এর কাছে নতুন যত গান তৈরি করে সে পাঠিয়েছে, তা শুনলে বোঝা যায়, তার ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। পুরানো ‘ভজ গৌরাঙ্গ, জপ গৌরাঙ্গ’ গানের পাশাপাশি এখন শুরু হয়েছে নতুন গান,
‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ
হরেকৃষ্ণ হরেরাম শ্রীরাধে গোবিন্দ।’
নিজেকে কলির কৃষ্ণ সাজিয়ে নিতাইকেও চৈতন্য জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। রাঢ় থেকে সমতটে শুরু হয়েছে দুজনের কাঠপুতুল পুজো। চৈতন্যর সেনাপতি নিতাই। বিদ্রোহী রাজা, মহলদার, সামন্তদের সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখছে। শুধু গঙ্গার দু’ধারে এ প্রচার চলছে না। কয়েকবছর ধরে পুরুষোত্তমপুরে এসে মহাপ্রভু জগন্নাথের মতো চৈতন্যকে গৌড়ীয়রা মহাপ্রভু বলতে শুরু করেছে। উৎকলের মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে তাদের চালচলন, আচরণ। তারা বলছে, এ রাজ্যে মহাপ্রভু একজন, তিনি হলেন জগন্নাথদেব। আর একজন ভেকধারী মহাপ্রভুর এখানে জায়গা নেই। স্নানযাত্রার উৎসবে এ বছর হয়তো ‘মহাপ্রভু’ কে, তা রফা করতে লাঠালাঠি লেগে যাবে। জাঁহাপনা, হয়তো বুঝেছেন, চৈতন্য নিধনের কাজ সারতে নানাভাবে আমি ঘুঁটি সাজিয়ে ফেলেছি।
গোঁফ মুচড়ে সুলতান বলল, খানিকটা বুঝলেও সবটা নয়। তার মুণ্ডুটা হাতে না পাওয়া ইস্তক সে বেঁচে আছে, আমাকে ধরে নিতে হবে। দরকার হলে মন্দিরে ঢুকে তার কবর খুঁড়ে লাশ তুলে আনার জন্যে গৌড়ের সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে দেব। তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে তাদের।
সুলতানের ফরমান শুনে বিদ্যাধরের বুকে ধ্বক করে উঠলেও স্বাভাবিক গলায় সে বলল, জে আজ্ঞা জাঁহাপনা, তাই হবে।
বিদ্যাধর থামতে তাকে প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদী জিজ্ঞেস করল, চৈতন্য শুধু গৌড়ের মসনদ দখল করতে চায় না, গৌড় রাজ্যটা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিতে চায়। গৌড়ীয়দের নতুন একটা নাম দিয়েছে সে, বাঙ্গালী, বা কাঙ্গালী এমন কিছু। সবটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়, আপনি কতটা জানেন?
বিদ্যাধর বলল, ঠিক-ই শুনেছেন আপনি, কাঙ্গালি নয় বঙ্গালী, কানে এসেছে আমার। গৌড়ীয়দের ওপর আমাদের রাজ্যের মানুষের রাগ, ঘৃণা বাড়তে থাকায় তাদের নতুন পরিচয় গড়ে তুলতে পরামর্শ দিয়েছে চৈতন্য। বলেছে, তোমরা গৌড়ীয় নয়, তার চেয়ে আরও বড়ো পরিচয় রয়েছে তোমাদের। গৌড় থেকে রাঢ়, সমতট, মল্লভূম, বরেন্দ্রভূম, সুম্ম, প্রাগজ্যোতিষ, শ্রীহট্ট, বঙ্গাল নিয়ে যে বাঙ্গালা জনপদ, সেখানে বাঙ্গালরা বাস করে, তোমরা সেখানকার মানুষ, তোমরা বাঙ্গালী। বঙ্গালের একটা অংশ হল গৌড়। অংশ কখনও সমস্তের সমান হয় না। তোমরা যেমন বাঙ্গালী, গৌড়ের মানুষও তেমনি বাঙ্গালী। তার বোঝানোতে কিছু কাজ হয়েছে। পুরুষোত্তমপুরের গৌড়ীয়রা অনেকে এখন নিজেদের বাঙ্গালী বলতে শুরু করেছে। শুনেছি, মুখে মুখে বাঙ্গালী, বঙ্গাল দেশ কথাগুলো গঙ্গার দুতীরে, এমনকি সমুদ্রের ধারে সমতট পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। গৌড়ের মাটি ধরে পাকা মাথার লোক চৈতন্য টান মেরেছে, এ দুশ্চিন্তা আমার মাথাতেও জেগেছে।
এত জেনে আপনি চুপ করেছিলেন, আগে কেন জানাননি আমাদের?
বিষয়টা বুঝতে আমার সময় লেগেছে খান-ই-জাহান। প্রথমে মনে হয়েছিল সবটা ধাঁধা প্রশ্ন জেগেছিল, গৌড়ীয়ারা কীভাবে রাতারাতি বাঙ্গালী হয়ে যায়, বাঙ্গালা হয়ে যায় গৌড়, পরে টের পেলাম এ এক সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র। চৈতন্য নাকি বলেছে, বাঙ্গালীর নতুন পরিচয় সমাজের ওপর থেকে তলা পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়তো পাঁচশো বছর লেগে যাবে। তা লাগুক। তোমরা আশা হারিও না।
মন্ত্রণাসভা শেষ করার আগে বিদ্যাধরকে সুলতান আরও একবার হুঁশিয়ারি দিল, দেখ, পুরুষোত্তমপুরে আমাকে আবার সেনাবাহিনী না পাঠাতে হয়!
জাঁহাপনা, বলে থেমে যাওয়া ছাড়া বিদ্যাধরের উপায় ছিল না। ভয়ের আঠায় তার দু’ঠোট জুড়ে গিয়েছিল। মন্দিরের মধ্যে চৈতন্যকে কবর দেওয়া গেলেও সেখান থেকে তার শবদেহ বার করে আনা কতটা কঠিন, সুলতানকে বলতে পারল না। ভয় পেল সে, উৎকলের সিংহাসন বোধহয় বেহাত হতে চলেছে। মন্ত্রণালয়ের বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে তার চার ঘোড়সওয়ার দেহরক্ষীরা দু’পাশে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গড়মান্দারণের পথে রওনা দিল সেখানের অধীশ্বর বিদ্যাধর। একরাতের বেশি মান্দারণে সে থাকতে পারবে না। কালই পুরুষোত্তমপুরে রওনা দিয়ে কৃপঞ্চমীর রাতে চৈতন্যকে কবরে ঢোকানোর কাজ পাকা করে ফেলতে হবে। উৎকল রাজ্যের আইন অনুযায়ী সাকর মল্লিক, দবীর খাসকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে প্রাণদণ্ড দেওয়া যায়। রাজ্যের ভাবী রাজার সে ক্ষমতা আছে। মন্দিরের মধ্যে কবর থেকে চৈতন্যের কঙ্কাল তুলে আনা কতটা সম্ভব হবে, সে বুঝতে পারল না। তার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকল। রাতে ভালো ঘুম হল না। সুলতানের পাথরের মতো দু’টো চোখ বারবার মনে পড়তে থাকল। রাজসিংহাসনে বসার জন্যে যার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছে, সে মানুষ নয়, শয়তান, হতে পারে ভগবান, যে কোনও মুহূর্তে তার টুটি টিপে ধরতে পারে, এই আতঙ্ক তার শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা রাজা কৃষ্ণদেব রায়কে এনে বিজয়নগর রাজ্যের সিংহাসনে বসাতে পারলে, তার গলা টিপে ধরা সুলতানের মুঠো খানিকটা আলগা করা যায়। কৃষ্ণদেবের সঙ্গে দেখা করে, তাকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেবে। ভোররাতে মন্দারণ ছেড়ে ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে রওনা হল বিদ্যাধর।