গোরা – ৩৯

৩৯

দাক্ষিণাত্য ঘুরে গোরা যখন পুরুষোত্তমপুরে ফিরল, তখন সে অন্য মানুষ। নানা তীর্থে অনেকানেক দেবদেবী, সাধক, সন্ন্যাসী, ভক্ত আর অসংখ্য ধর্মভীরু দীনহীন মানুষ দেখে গভীর মর্মবেদনায় সে টের পেয়েছে, মানুষ বড় দুঃখী, অনন্তকাল ধরে সে কেঁদে চলেছে, তাকে দেখার জন্যে কৃষ্ণ থাকলেও দুঃখের সমুদ্রে মানুষ তলিয়ে যাচ্ছে। রোজ লক্ষবার কৃষ্ণনাম জপ করার সঙ্গে নিজের বাপকে সে জিজ্ঞেস করে, হে কৃষ্ণ; করুণাসিন্ধু, দীনবন্ধু, জগতের পিতা, তুমি থাকতেও মানুষের কেন এত দুঃখ, দুর্দশা, তোমার নাম আর প্রেমভক্তি প্রচার করে মানুষের দুঃখ, অভাব আমি কি ঘোচাতে পারব? যে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার তাড়না মাথায় নিয়ে সারাক্ষণ তোমাকে খুঁজে চলেছি, তা কি কখনও সফল হবে?

প্রশ্নটা মাথায় জেগে উঠলে নামজপের সঙ্গে দুঃখী মানুষের জন্যে তার দু’চোখ বেয়ে দরদর করে জল ঝরতে থাকে। তখন সে কৃষ্ণের জন্যে কাঁদছে, না অনাথ আতুর মানুষের দুঃখে কাঁদছে, নিজেই বুঝতে পারে না। পুরুষোত্তমপুরে ফিরে গোরা প্রথমে শুনল তার অনুজপ্রতিম প্রাণের বন্ধু গদাধর নিরুদ্দেশ। তাকে ছেড়ে গোরা দাক্ষিণাত্যে রওনা হওয়ার পরে সে শোকে ভেঙে পড়েছিল। সারাক্ষণ কাঁদছিল। খাওয়া বন্ধ করেছিল, ঘুম ছুটে গিয়েছিল তার। এক সকালে তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। গদাধরের নিখোঁজ হওয়ার খবরে গোরা উদ্বিগ্ন হলেও সে জানত নবদ্বীপের এই বন্ধুটি বেশিদিন তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। পুরুষোত্তমপুরে তার ফিরে আসার খবর গদাধরের কানে গেলে সে ফিরে আসবে। ছেলেবেলা থেকে কত আনন্দে, শোকে তার পাশে রয়েছে গদাধর! নবদ্বীপে এ নিয়ে কম কথা চালাচালি হয়নি। গোরা যা ভেবেছিল, মাস ঘুরতে তাই ঘটল। কৃষ্ণের একটা গোপালমূর্তি নিয়ে গদাধর সোজা সাতাসনে গোরার কুটিরে পৌঁছে গেল। জগদানন্দকে নিয়ে গোরা গিয়েছিল পরমানন্দ পুরীর সঙ্গে দেখা করতে।

লোকনাথ মন্দিরের পথে বালিশাহিতে মাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য পরমানন্দ পুরীর কুটিরে শেষ বিকেলে গোরা বসেছিল। কুটিরের বাইরে পরমানন্দের দুই ভক্ত লিখি মহান্তি, কানাই খুটিয়ার সঙ্গে গল্প করছিল জগদানন্দ। সাতাসনে কাশী মিশ্রের বাগানে কুটির বানিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে গোরা রয়েছে শুনে গদাধর প্রথমে সেখানে গিয়ে গোরার দেখা পেল না। পাশের কুটিরে ছিল দামোদর। কম-বেশি দেড়বছর পরে গদাধরকে দেখে সে যত অবাক হল, খুশি হল তার চেয়ে বেশি। গোরাকে দেখার জন্যে অস্থির হলেও শান্ত স্বভাবের গদাধর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। ছলছল করছিল তার দু’চোখ। তার মনের ব্যাকুলতা বুঝতে দামোদরের অসুবিধে হল না। গদাধরকে নিয়ে পরমানন্দ পুরীর কুটিরের দরজায় সে হাজির করে দিল। পুরুষোত্তমপুরের বাইরে এক দু’বার এলে নারকোল পাতার ছাউনি লাগানো এই ঘরে রাত কাটায় পরমানন্দ। কুড়ি বছর ধরে বারবার যাতায়াতে তার কিছু শিষ্য ভক্ত জুটে গেছে সেখানে। সন্ন্যাসী পরমানন্দের সেবায় কুটিরের কাছাকাছি একটা কুয়ো বানিয়ে দিয়েছে তারা। এলাকার মানুষ বলে পুরী গোঁসাই-এর কূপ। দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে কাশী মিশ্রের বাগানে গোরার থাকার জায়গা মিললে এক সকালে তাকে পরমানন্দের কাছে নিতাই নিয়ে এসেছিল। পুরুষোত্তমপুরের মানুষের কাছে গোরার পরিচয় তখন তার সঙ্গীদের সুবাদে পৌঁছে গেছে। গৌড়ের এক নবীন সন্ন্যাসীর মহিমায় উৎকলের প্রজারা নিরাপদে, শান্তিতে বাস করতে চলেছে, এমন এক জল্পনা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। গৌড়ের সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড শ্রীক্ষেত্রের প্রজারা এতকাল মহাপ্রভু জগন্নাথের সঙ্গে শাক্তদেবী বিরজা, শৈবসাধকদের দেবী বিমলার কৃপা প্রার্থনা করত, তাদের প্রার্থনা কতটা পূরণ হয়েছে, তারা নিজেরাও জানে না। নবদ্বীপের এক তরুণ সন্ন্যাসী অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে হাজির হওয়ার খবর শুনে অসংখ্য ধর্মভীরু মানুষ আঁকড়ে ধরতে চাইল তাকে। গোরা দাক্ষিণাত্যে থাকলেও তার সঙ্গীদের সৌজন্যে, দীনতা, বিনয়, সর্বোপরি সঙ্কীর্তন শুনে বৈষ্ণবগোষ্ঠীর প্রধান সন্ন্যাসী কৃষ্ণচৈতন্য যে কত বড়মাপের সাধক তারা অনুমান করে নিল। বিজয়নগর রাজ্যের সঙ্গে উৎকলের সম্ভাব তৈরিতে যে গোরার ভূমিকা রয়েছে, ভাসাভাসা এ খবরও তাদের কানে এসেছিল। পরমানন্দ গোঁসাই নিজে উদ্যোগ নিয়ে কানাই খুটিয়াকে সঙ্গী করে নিতাই-এর সঙ্গে যোগাযোগ করল। নিতাই যে মাধবেন্দ্র পুরীর গুরু লক্ষ্মীপতির শিষ্য, এ খবর জেনে বয়সে বড়ো হলেও পরমানন্দ প্রণাম করেছিল নিতাইকে। নিতাইও সাষ্টাঙ্গে পরমানন্দকে প্রণাম করে বলেছিল, গুরু লক্ষ্মীপতির শিষ্য হলেও আমি ছিলাম অবধূত, এখন আমি কেশব ভারতীর শিষ্য, শ্রীচৈতন্যের অনুগামী।

নিতাই-এর মুখে গোরার বিবরণ শুনে তাকে দেখার জন্যে পরমানন্দ উদগ্রীব হয়েছিল। গোরাকে না দেখলেও সে চেনা, তাকে অনেক কথা পরমানন্দের বলার আছে। দাক্ষিণাত্যে পরিব্রাজন শেষ করে গোরা পুরুষোত্তমপুরে ফেরার কয়েকদিনের মধ্যে দু’জনের দেখা হল। ঝকঝকে সোনার মতো গায়ের রং, বিশাল শরীর অল্পবয়সী সন্ন্যাসী প্রণাম করতে মাথা নিচু করলে দু’পা পিছিয়ে গেল পরমানন্দ। দু’হাতে গোরাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিল। বয়স্ক সন্ন্যাসীর বুকে শরীর ঠেকিয়ে গৃহীর স্নেহাদরের তাপ পেল গোরা। পরমানন্দ বলল, তোমার সঙ্গে দেখা হবে, অনেকদিন ধরে আমার মন জানান দিচ্ছিল। পুরুষোত্তমপুরে তুমি একদিন আসবে, আমি অনুমান করেছিলাম।

প্রথম পরিচয়ের কয়েকদিন পরে গোরাকে এক আশ্চর্য কাহিনি শুনিয়েছিল। সে কাহিনির মূল চরিত গোরার দাদা বিশ্বরূপ, সন্ন্যাস নিয়ে যার নাম হয়েছিল শঙ্করারণ্য। পান্ধারপুর থেকে পরমানন্দের সঙ্গে সেই সন্ন্যাসী পুরুষোত্তমপুরে এসেছিল। অনুজকল্প সেই সন্ন্যাসীর মুখ থেকে ধীরে ধীরে তার পূর্বাশ্রমের পরিচয়, সে নবদ্বীপের মানুষ, তার বাবার নাম জগন্নাথ মিশ্র, মা শচী, ছোট ভাই বিশ্বম্ভর, এত সব তথ্য জেনেছিল পরমানন্দ। বিশ্বন্তরের আর এক নাম নিমাই, পাড়াপড়শী আদর করে তাকে গোরা বলে, এ কথাও শুনিয়েছিল। ছোটভাই সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে অল্পবয়সী শঙ্করারণ্যের চোখ ছলছল করত। মা, বাবার অনুমতি না নিয়ে সংসার ছেড়ে তার সন্ন্যাসী হওয়া ধর্মীয় বিধি অনুযাযী সিদ্ধ নয়, তার ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত, তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল। তার মাথাতে বোধহয় এ চিন্তা মাঝেমাঝে আসত। নবদ্বীপে ফেরার ইচ্ছে নিয়ে পুরুষোত্তমপুর থেকে একবার রওনা দিয়ে পূর্বপুরুষের জন্মস্থান শ্রীহট্টে চলে গিয়েছিল। শ্রীহট্ট থেকে কি একটা পুঁথির খোঁজে চলে গেল বিজয়নগরের রাজধানী বাদামীতে। পুরুষোত্তমপুরের পথ দিয়ে বাদামীতে গেলেও সে যাত্রায় পরমানন্দের ঘরে সে আসেনি। এলেও পরমানন্দের দেখা পেত না। সে তখন ছিল প্রাগজ্যোতিষপুরে ঈশ্বরপুরীর আস্তানায়। বাদামী থেকে ফেরার পথে সে এল পরমানন্দের ঘরে। কালাজ্বরে ধুঁকছিল সে। সাধ্যমতো তাকে সেবা শুশ্ৰুষা করেও পরমানন্দ বাঁচাতে পারেনি।

বিশ্বরূপের মৃত্যুর খবর শোনাতে গিয়ে শোকে বুজে আসছিল পরমানন্দের গলা। নিস্তব্ধ গোরার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। দরমার বেড়া জুড়ে তৈরি ঘরের কোনা থেকে এক টুকরো গেরুয়া কাপড়ে জড়ানো ছোট একটা পুঁটলি নিয়ে এল পরমানন্দ। গোরার হাতে পুঁটলিটা দিয়ে বলল, পুরুষোত্তমপুরের শ্মশানে শঙ্করারণ্যের অগ্নিসংস্কার হয়েছে। আমি মুখাগ্নি করে তার চিতা থেকে এক মুঠো ছাই তুলে পুঁটলি বেঁধে নিয়ে এসেছিলাম। তোমার হাতে একদিন এটা তুলে দিতে পারব, এই আশা করে রেখে দিয়েছিলাম। কৃষ্ণের কৃপায় আমার আশা মিটল।

পাথরের মূর্তির মতো গোরা বসে থাকল। তার মনে হল পুরুষোত্তমপুরের আকাশে, বাতাসে, সমুদ্রের জলে বিশ্বরূপ মিশে আছে। জগন্নাথদেব, যে স্বয়ং কৃষ্ণ, সেই দু’ভাইকে মিশিয়ে দিয়েছে। পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে বৃন্দাবনে পাকাপাকি থাকার যে চিন্তা তার মাথায় ছিল, তা কিছুটা আবছা হয়ে গেল। পরমানন্দের দেওয়া পুঁটলি নিয়ে নিজের আস্তানায় ফিরেছিল সে। পরমানন্দের ঘরে তার যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। সীমাহীন ভাবাবেশে আবিষ্ট সন্ন্যাসী গোরাকে পেয়ে সচল সন্ন্যাসী পরমানন্দও আটকে গেল পুরুষোত্তমপুরে।

পরমানন্দের ঘরের বাইরে বাঁশের তৈরি কোমর সমান উঁচু একফালি চালার ওপরে কানাই, শিখি বসেছিল। ঝাঁপ বন্ধ ঘরের সামনে গদাধরকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দামোদর। কানাই খুটিয়া তাদের ডেকে পাশে বসাতে চাইল। দামোদর সে ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের পাশে গিয়ে বসলেও বন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল গদাধর। ঘরের মধ্যে গোরা সঙ্গে ছিল জগদানন্দ। দাক্ষিণাত্য থেকে গোরার আনা ‘ব্রহ্ম সংহিতা’ আর ‘কৃষ্ণকণামৃত’র পুঁথি দুটো বাংলা আর ওড়িয়াতে ভাষান্তর করা নিয়ে কথা বলছিল তারা। পরমানন্দের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সামনে গদাধরকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরল গোরা। গোরার বুকে মুখ রেখে গদাধর কাঁদছে। গদাধরের হাতে বালক কৃষ্ণের মূর্তিতে গোরার নজর পড়তে সে জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেলি আমার বাপের এমন চমৎকার প্রতিমা?

কান্নাজড়ানো গলায় গদাধর বলল, তোমাকে খুঁজতে বৃন্দাবনে গিয়েছিলাম, সেখানে এক ভাঙাচোরা মন্দিরে গোপীনাথের এই মূর্তি দেখে মনে হল, তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছো, বুকে তুলে নিলাম বালক গোপালের এই মূর্তি।

গদাধরের বৃন্দাবনে চলে যাওয়া নিয়ে গোরা কোনো প্রশ্ন করল না। ভাবাবিষ্ট চোখে গোপীনাথের মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। ঘর থেকে বেরিয়ে পরমানন্দ পুরী এসে দাঁড়াল সেখানে। গোরাকে দেখে চালা ছেড়ে দামোদর, কানাই, শিখি আগেই উঠে এসেছিল। ভাবাবিষ্ট গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে পরমানন্দ বলল, আজই শুক্লা পঞ্চমী, আমাদের বালিশাহীর মধ্যে এই ঘনামল্লশাহীতে গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার শুভদিন। পরমানন্দের কথাতে সায় দিয়ে গোরা বলল, বিগ্রহ সেবার ভার দেওয়া হল গদাধরকে। দীনহীন মানুষ যেন গোপীনাথের ভোগের ভাগ পায়। জগন্নাথদেবের মালা পরিয়ে গোপীনাথকে বরণ করা হবে। আমি চললাম মালা আনতে।

গোরার এমন আনন্দিত, তেজী রূপ আগে কেউ দেখেনি। গদাধরকে ফিরে পেয়ে মহাভাবের আবেশে গোরা জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকল। দামোদর, শিখি, কানাই সঙ্গী হল তার। জগদানন্দ, গদাধর থেকে গেল পরমানন্দের ঘরে। মন্দিরের যে অংশকে ‘জগমোহন’ বলা হয়, সাধারণত সেখান থেকে জগন্নাথ দর্শন করে গোরা। সেই সন্ধেতে অন্যরকম ঘটনা ঘটল। জগমোহনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সঙ্গীদের ছেড়ে গোরা ভোগমণ্ডপে, জগন্নাথের সিংহাসনের দিকে এগিয়ে চলল। সিংহসন থেকে একটা মালা নিয়ে গোপীনাথকে বরণ করবে সে। প্রায় বেহুঁশের মতো গোরাকে এগিয়ে যেতে দেখে সঙ্গীরা কি করবে ভেবে পেল না। কিছু একটা গোলমাল হওয়ার আশঙ্কায় তারা সিঁটিয়ে থাকল। শিখি আর কানাই, দু’জনই রাজকর্মচারী, পুরুষোত্তমপুরের মান্যগণ্য লোক। ভাবের আবেশে সিংহাসনের দিকে গোরা এগিয়ে চললেও তাকে আটকানোর সাহস কারো হল না। সিংহাসনের পাহারাদার, বলিষ্ঠ শরীর প্রতিহারী, অনন্ত গচ্ছিকার গোরাকে ঠেকাতে তার একটা হাত ধরল। বাধা পেয়ে গোরা হাতটা সামান্য ঝাঁকাতে অনন্ত প্রতিহারী কয়েক হাত দূরে ছিটকে গিয়ে ‘অবসরপিণ্ডি’ পূজাপীঠে পড়ল। জগমোহনে দাঁড়ানো দর্শকরা ‘হায় হায়’ করে উঠল। ন্যাড়ামাথা গৌড়ের সন্ন্যাসীর কানে সে আওয়াজ ঢুকল না। জগন্নাথের সিংহাসন থেকে মত্ত হাতির মতো মালা, প্রসাদ নিয়ে শান্তমুখে সে ফিরে এল। ঘটনাটা কিছুক্ষণের মধ্যে শ্রীক্ষেত্রে জানাজানি হয়ে গেল। রাজপ্রাসাদ থেকে রাজার দেহরক্ষীদের কয়েকজন খোঁজখবর নিতে অনন্ত প্রতিহারীর সঙ্গে দেখা করল। অনন্ত বলল, আমি যাকে আটকাতে গিয়েছিলাম, তিনি মানুষ নন, স্বয়ং মহাপ্রভু জগন্নাথ, তার কাছে আমি মন্ত্রদীক্ষা নেব, সারাজীবনের মতো গুরু মানব তাকে।

গোরা সম্পর্কে আগেই রাজা প্রতাপরুদ্র অনেক বিবরণ শুনেছিল। রাজগুরু গদাধর মিশ্রের খুড়তুতো ভাই কাশী মিশ্রের মুখ থেকে কয়েকদিন পরে রাজা শুনল অনন্ত প্রতিহারীর বয়ান। কাশী মিশ্রকে রাজা বলল, গৌড়ের সন্ন্যাসী যে মহাপুরুষ, তা বুঝতে পেরেছি। পুরুষোত্তমপুরে তিনি যাতে নির্বিঘ্নে সাধন-ভজন করতে পারেন, তা দেখার দায়িত্ব তোমাকে দিলাম।

কাশী মিশ্র বলল, মহারাজের আজ্ঞা শিরোধার্য। সন্ন্যাসী এখন আমার বাগানের কুঁড়েঘরে বাস করছেন। বালিশাহি টোটায় তাঁর এক ভক্ত গোপীনাথ মূর্তির আসন পেতে পুজো শুরু করেছে। তাদের সঙ্কীর্তনে মেতে উঠেছে এলাকার মানুষ। গোপীনাথের গলায় পরানোর জন্যে মহাপ্রভু জগন্নাথের আসন থেকে মালা নিয়েছিলেন গৌড়ের সন্ন্যাসী।

কাশী মিশ্রের কথা শুনে খুশি হয়ে রাজা বলল, সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমি একদিন দেখা করতে চাই।

বাসুদেব সার্বভৌমকে আপনার ইচ্ছেটা আমি জানাব।

রাজামহেন্দ্রীর রামানন্দ রায়ের সঙ্গে শুনেছি সন্ন্যাসীর ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, তাকেও বলতে পারো।

যে আজ্ঞা।

গোরাকে নিয়ে রাজার প্রাসাদে যখন আলোচনা চলছে, তখন ঝড়ের বেগে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে তার মহিমা। তার ভক্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে আড়ালে প্রতিপক্ষও তৈরি হচ্ছিল। সাতাসন, নরেন্দ্র সরোবর, গৌড় রাজসাহী, বালিশাহীর মতো পাড়ায় পাড়ায় সকাল, দুপুর, সন্ধেতে জমজমাট সঙ্কীর্তনের আসর বসিয়ে দিচ্ছে গৌড়ের ভক্তরা। সবাই যে নবদ্বীপের মানুষ, এমন নয়, গোরার নামও অনেকে আগে শোনেনি, নিছক তীর্থযাত্রী হিসেবে গৌড় থেকে পুরুষোত্তমপুরে এসে গোরার টানে সঙ্কীর্তনে গলা মিলিয়েছে। ওড়িয়াভাষী এলাকার মানুষ কম জুটছে না। নবদ্বীপ, শ্রীক্ষেত্র, শান্তিপুর, কুলীনগ্রাম থেকে গোরার অনুরাগী দু’একজন ঘরে এসে হাজির হল। তাদের মুখে গোরা জানল জগন্নাথদেবের রথযাত্রা দেখতে এ বছর গৌড় থেকে ভক্তের একটা বড় দল পুরুষোত্তমপুরে আসছে। তাদের অনেকে গোরাকে জগন্নাথদেবের চেয়ে বেশি ভক্তি করে।

গোরা থামাল তাদের। নীলাচলে এসে এমন কথা মুখে আনতে নেই, জানিয়ে দিল। বলল, আমরা সবাই কৃষ্ণের ভক্ত। মুকুন্দ, নরহরি পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছে গিয়েছিল। পরমানন্দ পুরী এর মধ্যে গোরাকে দেখভাল করার জন্যে তাঁর ছায়াসঙ্গী করে দিল গোবিন্দকে। গোরাকে ঘিরে এখন ভিড় বাড়ছে। সঙ্কীর্তনের আসর থেকে তার কুঁড়েঘর পর্যন্ত তাকে দেখতে লোক জড়ো হয়ে যাচ্ছিল। ভাবাবিষ্ট গোরা দর্শনার্থীদের মধ্যে কৃষ্ণকে দেখছিল। গোরার ঘরের দরজা আগলে সারাক্ষণ বসে থাকত গোবিন্দ। প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে তাকে পুরুষোত্তমপুরে পাঠিয়েছিল ঈশ্বরপুরী। গোরাকে সেবা করার জন্যে গোবিন্দকে পাঠানো হচ্ছে, পরমানন্দকে জানিয়ে দিয়েছিল। সন্ন্যাসী হলেও গোরার জীবন নিরাপদ নয়, জানিয়েছিল। গৌড়ের সুলতানের শাস্তি এড়াতে সন্ন্যাস নিয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা পুরুষোত্তমপুরে পালিয়েছে, সুলতানি দরবার থেকে এই রটনা শুরু হয়েছিল। বৈষ্ণবদের ভিটেমাটি ছাড়া করতে স্মার্ত, নৈয়ায়িক, শাক্ত, শৈবরা জোট বেঁধে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ফুলিয়া, কাঞ্চনপল্লী, কুলিয়া, কুমারহট্টের বৈষ্ণব ভক্তদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল। শ্রীবাস পণ্ডিত সপরিবারে আশ্রয় নিল কুমার ভিটেতে। নবদ্বীপের বৈষ্ণবদের মধ্যে যারা পালের গোদা, নন্দন আচাৰ্য, শুক্লাম্বর ব্রত্নচারী, শ্রীমান পণ্ডিত, রত্নগর্ভ আচার্য প্রমুখ নবদ্বীপ ছেড়ে কুলীনগ্রাম, গুপ্তিপাড়া, শ্রীখণ্ডে গা ঢাকা দিল। প্রেমভক্তি প্রচারের সঙ্গে গোরা যে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, এমন তথ্য গৌড়ের দরবারে পৌঁছে গিয়েছিল। কৃষ্ণনাম প্রচারের মধ্যে দিয়ে ধর্ম, বর্ণ জাতপাত নির্বিশেষে প্রজাদের যে জমায়েত গোরা করছিল, তার সঙ্গে তাল রেখে রাঢ়, সুষ্ম, সমতটের কয়েকজন রাজণ্য, গৌড়ের মসনদ দখল করতে গোপনে সেনা সমাবেশ করছে, সিন্ধুকীদের সূত্রে এ খবরও পৌঁছে গিয়েছিল সুলতানি দরবারে। উৎকল রাজ্যের পুরুষোত্তমপুরে গোরা ডেরা করেছে, সিন্ধুকীরা এ খবরও দরবারে পৌঁছে দিয়েছিল। উৎকলের গুপ্তচররা আবার পুরুষোত্তমপুর থেকে একজন সিন্ধুকীকে ধরে কারাগারে পুরে দিয়েছে। গোরাকে নিরাপদে রাখার সংকেত বাসুদেব সার্বভৌমকে পাঠিয়েছিল স্বয়ং রাজা প্রতাপরুদ্র। পরমানন্দ পুরীর কানে বাসুদেব সার্বভৌম যখন এই খবর তুলে দেওয়ার সুযোগ খুঁজছে, তার আগে প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে পুরুষোত্তমপুরে গোবিন্দ এসে যেতে তাকে গোরার সেবায় পরমানন্দ লাগিয়ে দিয়েছে। গোরার সহচর হয়ে গেছে। গোরার ভক্ত হয়েও প্রায় তার অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছে দামোদর। গোরাকে ঘিরে যত বড় হচ্ছে ভক্তসমাবেশ, তত কড়া হচ্ছে দামোদরের নজরদারি। গোরার এসবে লক্ষ নেই। দিনে-রাতে বেশি সময় বাস্তব জীবন থেকে ভাবাবিষ্ট দশাতে ঐশী জগতে চলে গেলেও আবেশ কাটলে সে স্বাভাবিক মানুষ হয়ে যায়। সংসার ছেড়ে চলে আসার জন্যে মনে অনুশোচনা জাগে। মায়ের বুকফাটা কান্না, মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাসে মুখে বিষ্ণুপ্রিয়ার তাকিয়ে থাকা, তার বুকের ভেতরটা কান্নায় ভিজিয়ে দেয়। সঙ্গীসাথীদের মাঝখানে বসে কথা, গল্পে মেতে থাকলেও গৌড়, উৎকল, দাক্ষিণাত্যের প্রজাদের দুর্দশা তার নজর এড়ায় না। কুলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির ঘরে যে রাজপুরুষদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, নিজেদের সঙ্কল্পে তারা কতদূর এগোল? নবদ্বীপে কীভাবে চলছে তার সংসার? নবদ্বীপ, শান্তিপুরের বৈষ্ণব সাথীরা তার মা, বৌকে বাঁচাতে নিশ্চয় কিছু আয়োজন করেছে। পক্ষকাল পরে পুণ্য রথযাত্রায় অংশ নিতে গৌড় থেকে যে তীর্থযাত্রীরা আসছে, তাদের বেশিরভাগ নবদ্বীপ, শান্তিপুর, শ্রীখণ্ড আর আশপাশের বৈষ্ণব ভক্ত। তাদের কাছ থেকে গৌড়ের অনেক খবর শুনবে। তার সংসারের খবর, মা-বৌ কেমন আছে, এ নিয়ে কি দু’একজন কিছু বলবে না? মেসো চন্দ্রশেখর নিশ্চয় সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের সংসারের পাশে রয়েছে। শ্রীবাস পণ্ডিত এলে তার মুখ থেকে কিছু খবর শোনা যেতে পারে। গৌড়ের ভক্তদের পুরুষোত্তমপুরে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। নিতাই, দামোদর, জগদানন্দ মিলে বাসুদেব সার্বভৌমের সঙ্গে কথা বলেছে। নবদ্বীপ থেকে পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছানো সোজা কাজ নয়। পুণ্যার্থীদের অনেকে পথে নানা রোগে মারা যায়, জলের অভাবে, মহামারীতে যারা শেষ নিঃশ্বাস ফেলে, তাদের যথাযথ সৎকার করার সুযোগ সঙ্গীরা পায় না। তাদের মৃতদেহ নিয়ে শিয়াল, শকুনে টানাটানি করে। পথ চলার ধকলে পায়ে রক্তাক্ত ক্ষতে কাপড়ের পট্টি বেঁধে যারা শেষপর্যন্ত পৌঁছোয়, দু’চার দিন পরে দেশে ফেরার সামর্থ, সম্বল কিছুই তাদের থাকে না। নবদ্বীপ থেকে পুরুষোত্তমপুর, সেখান থেকে দাক্ষিণাত্য পরিব্রাজন করে নানা বেদনাদায়ক দৃশ্য, ঘটনা গোরা দেখেছে। রথযাত্রা দেখতে পুরুষোত্তমপুরে এসে তার প্রিয়জনেরা যাতে অসুবিধেতে না পড়ে, সে আয়োজন যতটা সম্ভব সে করে রাখবে। শুধু রথ দেখে যাতায়াতে পুণ্যার্থীদের নবদ্বীপ ফিরতে আড়াই মাস লাগবে। ঘোর বর্ষায় জলে ভেসে যাওয়া নদী, পথঘাটের কথা ভেবে অনেকে কিছুদিন পুরুষোত্তমপুরে থেকে যেতে চাইবে। স্নানযাত্রার আগে পুরুষোত্তমপুরে এসে রথযাত্রা, উল্টোরথ দেখে তাদের ঘরে ফিরতে সাড়ে তিনমাস লাগবে। বর্ষার প্লাবন এড়িয়ে রাস্তাঘাট শুকোলে চাতুর্মাস্য পালন করে যারা ফিরতে চায়, তাদের বাড়ি পৌঁছোতে সাত মাস কেটে যাবে। সংসারে যাদের সচ্ছলতা আছে, যেমন শ্রীবাস, শিবানন্দের মতো গৃহীরা সাত মাস সংসার ছেড়ে থাকতে পারে। গোরা খবর পেয়েছে তীর্থযাত্রীদের প্রথম দলের সঙ্গে শ্রীবাস, শিবানন্দ সপরিবারে পুরুষোত্তমপুরে আসছে। দু’বছর পরে প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ভেবে খুশি ছড়িয়ে ছিল গোরার মনে। স্নানযাত্রার কয়েকদিন পরে গোরার কাছে খবর এল খোল, করতাল, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, বাঁশি, ভেঁপু বাজিয়ে গৌড়ের ভক্তবাহিনী আঠারনালার কাছে পৌঁছে গেছে। সঙ্কীর্তনে তারা মাতিয়ে দিয়েছে পুরুষোত্তমপুরে ঢোকার পথ। রাজার অনুমতি নিয়ে গৌড়ের ভক্তদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল কাশী মিশ্র। আঠারনালার কাছাকাছি ভক্ত স্বজনদের আসার খবর পেয়ে, তাদের আপ্যায়ন করে নিয়ে আসার জন্যে জগদানন্দ, নিতাই, দামোদরকে সেখানে পাঠিয়ে দিল। বর্ষার আকাশে তখন ঝকঝকে রোদ। সমুদ্রের হাওয়ায় গাছপালার বুকে সাঁইসাঁই আওয়াজ। রাজবাড়ির ছাদ থেকে কয়েকজন পারিষদ নিয়ে রাজা প্রতাপরুদ্র গৌড়ের সংগঠিত ভক্তদের দেখে, তাদের সঙ্কীর্তন শুনে মুগ্ধ হল। রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে মেয়েরা নিজেদের আড়ালে রেখে গৌড়ীয়দের নাচগান শুনে অবাক হল। উৎকলের মানুষকে কখনও এভাবে পথে নেমে স্বচ্ছন্দে তারা নাচতে দেখেনি। সুর, তাল বজায় রেখে সঙ্কীর্তন করতে শোনেনি। ভক্তদের শোভাযাত্রার সামনে অদ্বৈত আচার্য, শ্রীবাস, ঠাকুর হরিদাস। শোভাযাত্রার শেষমাথায় রয়েছে মুরারি গুপ্ত, শ্রীধর, কুলীনগ্রামের কয়েকজন ভক্ত। রাজার নির্দেশমতো গৌড়ের তীর্থযাত্রীদের জন্যে বাসা, রোজ মন্দিরের প্রসাদ আগে থেকে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল নিতাই, কাশী মিশ্র, গোবিন্দ। ভক্তরা নিজেদের ঠাঁই করে নেওয়ার আগে অদ্বৈত, শ্রীবাস, হরিদাস, শ্রীধর, মুরারির মতো অন্তরঙ্গদের গোরা বুকে টেনে নিয়ে, গৌড়ের সবাইকে গলায় মালা পরিয়ে, কপালে চন্দনের তিলক এঁকে দিল। গোরার হাত থেকে এমন সাদর অভ্যর্থনা পেয়ে হরিধ্বনিতে আকাশ ভরে দিল ভক্তরা। হরিদাসের খোঁজ করে জানা গেল, পক্তিভোজনে না এসে সে চলে গেছে নিজের কুটিরে। প্রসাদ নিয়ে তাকে কুটিরে পৌঁছে দিতে গেছে দামোদর। হরিদাসের জন্যে বরাদ্দ কুটিরে তাকে পৌঁছে দিয়ে দামোদর বলল, ঠাকুর, তোমার পরিচয় কেউ জানতে চাইলে বলবে ঠাকুর হরিদাস। বাইশ বাজারের প্রসঙ্গ যেন পেড়ো না।

দামোদরের কথা তার কানে গেল না। সুভদ্র, দীনাতিদীন হরিদাস, যে রোজ কয়েক লক্ষবার কৃষ্ণনাম জপ করে, নিজের কুটিরের সামনে থেকে মন্দিরের চূড়া দেখে সে ভাবাবেগে ধ্যানস্থ হয়ে গেল। কুটিরের ভেতরে তার জন্যে প্রসাদ রেখে দামোদর চলে যাচ্ছে দেখেও সে তাকাল না। দামোদর জেনে গিয়েছিল হরিদাসের মতো আরো কৃষ্ণভক্তের ধর্ম, জাতপাত জানাজানি হয়ে গেলে গোঁড়া পাণ্ডারা তাদের মন্দিরে ঢুকতে দেবে না। গৌড়ের বৈষ্ণব ভক্তদের সঙ্গে পাণ্ডাদের ঝগড়া পাকিয়ে উঠবে। বিপদের এই আভাস দামোদরকে গোরা দিয়ে রেখেছিল। সেভাবে থাকা-খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। কৃষ্ণপ্রেমী গোরাকে পুরুষোত্তমপুরের উৎকলবাসীরা যথেষ্ট মান্য করলেও ধর্ম, জাতপাত নিয়ে তারা রফা করবে না।

স্নানযাত্রার আগে গৌড়ের ভক্তরা এসে যাওয়ায় পুরুষোত্তমপুরের পথে, মন্দির চত্বরে নগরকীর্তন, বেড়াকীর্তনে জোয়ার উঠল। পাশাপাশি চলল মন্দির থেকে বিপুল উদ্যোগ, জগন্নাথের মাসির ঠিকানা, গুণ্ডিচাবাড়িতে যাওয়ার পথ পরিষ্কারের। জীবনের শ্রী ফেরাতে পরিচ্ছন্নতা গোড়ার কাজ, নবদ্বীপে থাকার সময়ে গোরা টের পেয়েছিল। মন্দির চত্বর থেকে গুণ্ডিচাবাড়ি পর্যন্ত পথ সাফাই-এর মহোৎসবে গৌড় আর উৎকলের কয়েকশো মানুষ নিয়ে সন্ন্যাসী গোরা নেমে পড়ল। মূল মন্দির, যার নাম জগমোহন, তার পাশে তোপমণ্ডপ, নাটমন্দির, রান্নাঘর, উঠোন কিছু সন্ন্যাসী আর কয়েকশো ভক্ত মিলে কলসি কলসি জল ঢেলে কয়েকশো ঝাঁটা হাতে ধুয়ে ফেলল। সেভাবে পরিষ্কার করল গুণ্ডিচাবাড়ি আর সেখানে যাওয়ার পথ। রাজভাণ্ডার থেকে কয়েকশো কলসি আর ঝাঁটা জোগান দেওয়া হয়েছিল। গৌড়ের সন্ন্যাসীর সাফাই কাজ দেখতে কয়েক হাজার লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সাফাইকর্মীরা মাঝেমাঝে হরিধ্বনি দিচ্ছিল, কৃষ্ণনাম নিচ্ছিল। তাদের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিল সাধারণ মানুষ।

জগন্নাথের মহোৎসবরে পরের দিন রথযাত্রা শুরুর আগে সোনার ঝাঁটা হাতে রাজা প্রতাপরুদ্র পথ পরিষ্কার করতে এসে দেখল, মন্দির থেকে গুণ্ডিচাবাড়ি পর্যন্ত পথের চেহারা বদলে গেছে। রথযাত্রায় এমন ঝকঝকে পথ রাজা আগে দেখেনি। সোনার ঝাঁটা হাতে আনুষ্ঠানিক পথ মার্জনা করে গজপতি রাজপরিবারের বৃদ্ধ কুলগুরু গোদাবর মিশ্রকে রাজা জিজ্ঞেস করল, মন্দির থেকে পথ পর্যন্ত কারা এভাবে পরিষ্কার করল?

কুলগুরু জানাল গৌড়ের সন্ন্যাসী। ভক্তদের নিয়ে গুণ্ডিচাবাড়ি পর্যন্ত রাস্তা, গুণ্ডিচাবাড়ির সিঁড়ি, ঘর, দরজা, জানলা পর্যন্ত কয়েকশো কলসি জল ঢেলে এরা ধোয়ামোছা করেছে। সবচেয়ে বেশি জল কুয়ো থেকে টেনে তুলে কাঁধে বয়ে নিয়ে গেছে সন্ন্যাসী কৃষ্ণচৈতন্য।

রাজার সঙ্গে কুলগুরুর কথার মধ্যে বাছাই করা সাত সম্প্রদায়ের কীর্তনীয়াকে নিয়ে সাতটা চক্র তৈরি করে শোভাযাত্রার মধ্যে গোরা ঢুকে পড়ল। শুরু হল সঙ্কীর্তন। সাত সম্প্রদায় মিলে নাচগানের যে লহর তুলল, তার প্রতি বেষ্টনীর মধ্যে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো গোরা নেচে বেড়াতে থাকল। এমন সঙ্কীর্তন, এমন নাচ রাজা বা কুলগুরু আগে দেখেনি। পলকহীন চোখে রাজা দেখছিল শুধু গোরাকে। রথ এগোতে থাকল। শোভাযাত্রায় উৎকলের অসংখ্য মানুষ জড়ো হলেও গৌড়ের সন্ন্যাসী আর তার কীর্তনীয়া সঙ্গীদের জন্যে তারা জায়গা দিল। গুণ্ডিচা বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে উদ্দণ্ড নাচের ছন্দ বদলে গেল। শুরু হল বেড়াকীর্তন। সেখানের মধ্যমণি গোরা। তার জ্যোতিময় সুঠাম শরীরের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে সোনার ঝাঁটা হাতে রাজা হাঁটতে থাকল। বলদণ্ডিতে জগন্নাথকে নিমবড়ি ভোগ দেওয়া নিয়ম। রথ দাঁড়াল সেখানে। ভোগের প্রসাদ নিতে ভিড় বাড়তে গোরা বসল পথের পাশে বাগানে। কীর্তন চলতে থাকলেও সেবক গোবিন্দ এক হয়ে যেতে দেয়নি গোরাকে। তার সারা শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে, দু’চোখে জল। ভাবাবিষ্ট দশা থেকে বাস্তবে ফিরে আসছে সে। বাগানের মধ্যে মাটিতে সে শুয়ে পড়তে তার দু’পা টিপতে শুরু করল গোবিন্দ। ঈশ্বরপুরীর পাঠানো সেবক গোবিন্দকে কয়েক মাসে ছোট ভাই-এর মতো গোরা আপন করে নিয়েছিল। গোরার পাশ থেকে গোবিন্দ নড়ত না। মন্দির থেকে গোরার ঘরে সকাল-সন্ধে রোজ প্রসাদ যেত। প্রসাদের ভাগ পেত গোবিন্দ আর অন্য সঙ্গীরা। গুণ্ডিচাবাড়িতে রথ পৌঁছে গেল। ধুমধাম করে সেখানে উৎসব শুরু হলেও বাগানের মধ্যে তখন গোরাকে দেখতে রাজা প্রতাপরুদ্র ঢুকে পড়েছে। রাজার দু’পাশে রামানন্দ রায় আর বাসুদেব সার্বভৌম। ঘাসের ওপর ঘুমন্ত গোরাকে সযত্নে গা-হাত-পা টিপে আরাম দিচ্ছিল। গোবিন্দ প্রথম নজর করেছিল রাজাকে। সে থতমত খেতে দু’ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে তাকে চুপ করে থাকতে ইঙ্গিত করল রামানন্দ। ঘুমন্ত গোরার দিকে তাকিয়ে সোনার শরীর, দীর্ঘ মানুষটার পাশে নিজেকে খুব ছোট মনে হল। বিষয়ী মানুষের ছোঁয়া গৌড়ের এই সন্নাসী সহ্য করতে পারে না, রাজা শুনেছিল। সন্ন্যাসীর পা ছুঁয়ে রাজার তাই প্রণাম করা হল না। গোরাকে দর্শন করে আনন্দে ভরে গিয়েছিল রাজার মন, খুশিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল মুখ। বাগান ছেড়ে তিনজন নিঃশব্দে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে গোরা ভক্ত, সঙ্কীর্তনীয়ারা গুণ্ডিচা মন্দির ছেড়ে বাগানে ফিরে এসেছে। রাজার আদেশে দু’শো মানুষের জন্যে সেখানে পৌঁছে গেছে বলগণ্ডি ভোগ। গোরা জেগে উঠেছে। দল বেঁধে সবাই গেল নরেন্দ্রসরোবরে চান করতে। চান সেরে মন্দিরের ছত্রিশ পদের বলগণ্ডি ভোগ সঙ্গীদের সঙ্গে বসে গোরা ভাগ করে খেল। খাওয়া শেষ হতে গোরাকে পরমানন্দ পুরী জিজ্ঞেস করল শঙ্করারণ্যের দেহাবশেষ ভাসাতে কবে নবদ্বীপ রওনা হচ্ছো?

কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ থেকে পরমানন্দকে গোরা জিজ্ঞেস করল, মায়ের সামনে দাদার ছাই নিয়ে কীভাবে দাঁড়াব? তার সংসারে দু’ছেলের একজন ফিরবে, এ আশ্বাস তাকে দিয়েছিলাম। বড় ছেলের চিতার ছাই নিয়ে গিয়ে বলতে পারব না, মাগো, তোমার বিশ্বরূপকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম!

আমার কথা শুনে মা হয়তো ভূয়ে লুটিয়ে কাঁদবে। বলতে পারে, তোর কমুণ্ডলে ছাই-এর পুঁটলিটা পুরে সেটা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আয়। তারপর ভাবিস আমার দু’ছেলের একজনকে সংসারে ফিরিয়ে দেওয়ার যে কথা তুই দিয়েছিলি, তা কীভাবে রাখবি!

কথা থামিয়ে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে গোরা বলল, বাপ কৃষ্ণ, আমাকে বাঁচাও, পথ বলে দাও।

নরেন্দ্রসরোবরের পশ্চিমে ডালিমগাছের তলায় একান্তে পরমানন্দকে নিয়ে গোরা কথা বলছিল। পরমানন্দ বলল, সন্ন্যাস নেওয়ার পরে সব সাধুকে একবার মাতৃভূমি দর্শনে যেতে হয়, এটাই নিয়ম, সন্ন্যাসীকে এ নিয়ম মানতে হয়।

গোরা চুপ। কিছুক্ষণ পরে বলল, প্রভুপাদ, আপনার কথা ঠিক। নবদ্বীপে যেতেই হবে আমাকে। তবে নবদ্বীপ থেকে পুরুষোত্তমপুরে ফিরব না। আমি যাব বৃন্দাবনে, সেখানে থাকব।

পরমানন্দ বলল, হে কৃষ্ণচৈতন্য, তুমি যেখানে থাকবে, সেটাই হয়ে উঠবে বৃন্দাবন, তোমার ইচ্ছে সফল হোক। দু’জনের কথা শেষ হতে নরেন্দ্রসরোবর ছেড়ে গোরাকে সামনে রেখে গুণ্ডিচাবাড়িতে এল গৌড়ের ভক্তমণ্ডলী। শুরু হল নতুন উদ্দীপনায় সঙ্কীর্তন। মাঝরাত পর্যন্ত চলল সঙ্কীর্তনের আসর। পুণ্য নক্ষত্রের যোগে দ্বিতীয়াতে যে রথযাত্রা শুরু হয়েছিল, সাতদিন পরে সেই রথে চেপে শুরু হল উল্টোরথের অনুষ্ঠান। নিজের মন্দিরে সুভদ্রা, বলরামকে নিয়ে জগন্নাথ ফিরল। সাতদিন ধরে গুণ্ডিচাবাড়িতে সঙ্কীর্তন আর নাটক অনুষ্ঠানের সঙ্গে গোরা আর নিতাই যে লাঠিখেলা দেখাল, তা দেখে উৎকলের পাকা লাঠিয়ালরা হাঁ হয়ে গেল। তত্ত্বজ্ঞানী, প্রেমভক্তির প্রচারক সন্ন্যাসী শুধু আধ্যাত্মবাদে পারঙ্গম নয়, পাকা হাতে অস্ত্রশস্ত্র চালাতে পারে, দর্শকদের বুঝতে অসুবিধে হল না। রথযাত্রার পরে গৌড়ের ভক্তদের একদল ফিরে গেল, বাকিরা পুরো বর্ষা তারপর শরৎকালের কিছু দিন, প্রায় চারমাস কাটিয়ে এই সুযোগে চাতুর্মাস্য পালন করল। পুরুষোত্তমপুরে পুজো অর্চনার শেষ নেই। শরতে নবরাত্রির মহাউৎসব। রাজা প্রতাপরুদ্রের রাজত্বে পুরুষোত্তমপুরের অধিষ্ঠাত্রী জগজ্জননী বিমলাময়ী অর্চনার জাঁকজমক দেখে গৌড়ের ভক্তদের চোখ কপালে উঠল। আড়ম্বরের শেষ নেই। বিমলাময়ী মন্দিরে হাজির জগন্নাথের দ্বিতীয় এক বিগ্রহ। জগন্নাথের নাম সেখানে দুর্গামাধব। বিমলাময়ীর মন্দিরে ভক্তদের নিয়ে গোরার সঙ্কীর্তন শুরু করতে শক্তিসাধকদের মনে জেগে উঠল ভক্তির উচ্ছ্বাস। রাসপূর্ণিমাতে চাতুর্মাস্য শেষ হতে গৌড়ের ভক্তদের নবদ্বীপের পথে গোরা রওনা করে দিল। পুরুষোত্তমপুর ছাড়ার আগের দিন সন্ধেতে সমুদ্রের ধারে গোরার পাশে নিতাই বসল। দিনের আলো আকাশ থেকে মিলিয়ে পশ্চিম আকাশে আবছা গোলাপি রং লেগে রয়েছে। সমুদ্রের নীল জলের রং অন্ধকারে মুছে ফেলেও পশ্চিম দিগন্তে সরলরেখার মতো দেখা যাচ্ছে হালকা গোলাপি রেখা। নিতাই জিজ্ঞেস করল, কাল তাহলে আমাকেও তুমি বিদায় করতে চাও?

গোরা বলল, তুমি, আমি, অদ্বৈত আচার্য, শ্রীবাস পণ্ডিত, সবাই আমরা দায়বদ্ধ। কৃষ্ণ নামের প্রচার আমাদের করতে হবে। গৌড়, রাঢ়, সমতট, সুর্খ, বরেন্দ্রভূম, বঙ্গালের হাজার হাজার মানুষ, যাদের জাত আছে, ধর্ম নেই, যাদের ধর্ম আছে জাত নেই আর যাদের জাত, ধৰ্ম কিছু নেই, তাদের সবাইকে কাছে টেনে নিতে হবে, কোল দিতে হবে। তুমি আর অদ্বৈত, হ্যাঁ, তোমাদের দু’জনকে প্রেমভক্তির প্রচারে সকলের সামনে থাকবে হবে।

আমাদের সঙ্গে তুমি থাকবে না কেন?

কারণটা তোমার অজানা নয়।

গোরার জবাব শুনে নিতাই বলল, দু’বছর আগে যারা তোমার শত্রুতা করেছে, আজ তোমাকে নিজেদের মধ্যে তারা ফিরে পেতে চায়।

তুমি জানলে কীভাবে?

তোমার দাক্ষিণাত্য ঘোরার দু’বছর কম তীর্থযাত্রী গৌড়, নবদ্বীপ থেকে শ্রীক্ষেত্রে আসেনি। গৌড়ের রাজধানী, একডালার মানুষও তোমার জন্যে চোখের জল ফেলে। নরম হয়েছে সুলতানের মন।

সলতান কি কথাটা তোমাকে বলেছে?

চাঁদ কাজি বলেছে। তার বাড়ির বউ, মেয়েরা নিমাইপণ্ডিতকে নবদ্বীপে ফিরিয়ে আনতে ঝুলোঝুলি করছে।

নবদ্বীপে ফেরার সময় আমার এখনও হয়নি। বিদ্যাবাচস্পতির ঘরে সেই রাতের ঘটনা কি তোমার মনে আছে?

আছে।

বাচস্পতির ঘরে সেই তরুণ রাজপুরুষদের সামনে তোমাকে রেখে বলেছিলাম, আপনাদের ধর্মযুদ্ধের মাটি তৈরি করবে এই মহাপুরুষ। মনে রাখতে হবে যুদ্ধটা এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের নয়। সব মানুষের কল্যাণে সর্বধর্মের সমন্বয়ের মধ্যে গড়ে উঠবে এই ধর্মরাজ্য। আমিও থাকব সেখানে, খালিহাতে নয়, মানুষের জন্যে বুকভরা ভালবাসা নিয়ে। তুমি নবদ্বীপে না ফিরলে ভালবাসার সেই জমি তৈরির কাজ থেমে যাবে।

তোমার আদেশ শিরোধার্য, আমি নবদ্বীপে ফিরে যাব। আমাকে সবাই হয়তো পছন্দ করবে না, তবু যাব।

নিতাই- -এর পিঠে হাত রাখল গোরা। জোয়ারে সমুদ্র এখন উথাল-পাথাল। ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে আঁশটে বাতাস। দূর সমুদ্রে স্থির হয়ে ভাসছে কয়েকটা জেলে ডিঙি। জোনাকির মতো পিটপিট করছে কয়েকটা আলোর বিন্দু। নিতাই-এর পিঠে হাত রেখে গোরা বলল, আর একটা কাজ তোমাকে করতে হবে।

নিতাই তাকালে তার জ্বলজ্বলে দু’চোখের মণি গোরা দেখতে পেল। তার হাতটা এবার সরে এল দাড়িগোঁফে ঢাকা নিতাই-এর থুতনিতে। খুঁতনি ধরে তাকে আদর করে গোরা বলল, ওহে অবধূত বৈষ্ণব, তোমাকে গৃহী হতে হবে, যোগ্য গৃহিণী খুঁজে বিয়ে করতে হবে তাকে।

কি বলছ বন্ধু, তুমি কি আমাকে পথে বসাতে চাও?

তুমি চিরপথিক, কে বাঁধে তোমাকে? নাম প্রচারের দায়ে তোমাকে গৃহস্থ হতে হবে।

সে কাজ তুমিও পারতে, সংসার ছেড়ে তবে পালিয়ে এলে কেন?

প্রাণের ভয়ে।

প্রাণের ভয় তোমার নেই, আমি জানি।

তুমি কতটা জানো?

তোমার মাথা বিগড়ে দিয়ে গেছে তোমার দাদা বিশ্বরূপ।

আর কী জানো?

তোমার মাথায় কৃষ্ণ ঢুকে পড়েছে।

আরও বলো।

নিতাই কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, হে দেবতা, তোমায় গড় করি। তুমি আর আমাকে খুঁচিও না, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সেগুলোর উত্তর জুগিয়ে যেও না। তোমার ইচ্ছে পূর্ণ হোক।

তিন রাত ধরে রাসলীলার আসরে সঙ্কীর্তনে ক্লান্ত গোরার ঘুম পাচ্ছিল। কথাটা সে বলতে কাশী মিশ্রের বাগান পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিল নিতাই। মাঝ আকাশে চাঁদ, চাঁদের তখন খোয়াই দশা চলেছে, শুরু হয়েছে কৃষ্ণপক্ষ। আকাশের দিকে তাকিয়ে গোরা কুঁড়েঘরে ঢুকে গেল। গোবিন্দ কাছাকাছি কোথাও আছে। ঘরের মেঝেতে শরীর এলিয়ে গোরা ঘুমিয়ে পড়ল। ছোট খুপরি ঘর, গোরাকে পা মুড়ে কাত হয়ে শুতে হয়। সে শরীর ছেড়ে শুয়ে পড়লে ঘরে দ্বিতীয়জন ঢুকতে পারে না।

গোরা ফিরে আসার খবর পেয়ে অন্ধকার বাগানের শেষমাথায় তার ঘরের দরজায় গোবিন্দ পৌঁছে গেল। দরজা আটকে শুয়ে গোরা ঘুমোচ্ছে। ঘরে ঢোকার পথ নেই গোবিন্দর। মুশকিলে পড়ে গেল গোবিন্দ। ঘরে ঢুকতে না পারলে গোরার সেবা করবে কীভাবে? গোরা ঘুমোলে তবে সে মন্দিরে রাতের প্রসাদ খেতে যায়। সেটাই রাতের শেষ প্রসাদ, তারপর মন্দিরের ফটক বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে ঢুকতে না পেরে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে গোরার ঘুম না ভাঙিয়ে তার কানের কাছে মুখ রেখে গোবিন্দ চাপা গলায় বলল, গোঁসাই একটু সরে শোও, ভেতরে যেতে দাও আমাকে।

আমি নড়তে পারছি না।

গোরার জবাব শুনে গোবিন্দ বলল, নড়তে চড়তে হবে না, একটু কাত হয়ে তুমি শুলেই আমি ভেতরে ঢুকতে পারি, তোমার গা-হাত-পা টিপতে পারি।

তোর যা খুশি কর, আমি কাত হতে পারছি না।

গোবিন্দ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের গায়ের উড়ুনিটা খুলে ঘুমন্ত গোরার পিঠের ওপর গামছার মতো বিছিয়ে দিল। এক মুহূর্ত খাড়া থেকে উড়ুনি টপকে ঘরের ভেতরে ঢুকে মেঝেতে বসে গোরা শরীরের ওপর থেকে উড়ুনিটা তুলে নিল। গোরাকে ডিঙিয়ে যেতে তার মনে অস্বস্তি থাকল না। ভাবটা এরকম, গোরাকে সে ডিঙোয়নি, নিজের উড়ুনি ডিঙিয়েছে। উবুড় হয়ে শুয়ে গোরা ঘুমোচ্ছে। তার পা, কোমর, পিঠ, ঘাড় দু’হাতে যত্ন করে টিপে তাকে আরাম দিতে থাকল গোবিন্দ। ভারি মধুর সেই সেবা। গোবিন্দ টের পেল মানুষটার শরীরে যন্ত্রণা কমে আসছে, গভীর হচ্ছে তার ঘুম। আরও নরম হাতে তার গা টেপাটেপি করতে থাকল গোবিন্দ। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে ঘুম থেকে জেগে গোবিন্দকে ভেতরে বসে থাকতে দেখে গোরা জিজ্ঞেস করল, তুই এখনও বসে আছিস কেন? মন্দিরে প্রসাদ আনতে যাবি না? আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম, তুই গেলি না কেন? মন্দিরের দরজা বোধহয় এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে, না খেয়ে আজ রাতটা তোকে কাটাতে হবে।

গোবিন্দ একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, দরজা আগলে তুমি শুয়ে থাকলে আমি যাব কী করে?

কেন? যেভাবে ভেতরে ঢুকলি, সেভাবে বেরিয়ে প্রসাদ নিতে পারতিস।

তা হয় না।

কেন?

গোবিন্দ বলতে চাইল, তোমাকে সেবার জন্যে কোটি অপরাধ করতে পারলেও নিজের পেট ভরাতে তোমাকে টপকে যেতে পারি না।

কথাটা মনে এলেও সে বলতে পারল না। চুপ করে বসে থাকল। তার মনের কথাটা বুঝতে গোরার অসুবিধে হল না। উঠে হাসল সে, গোবিন্দকে বলল, আয় গোবিন্দ, আমরা দু’জনে একটু নাচি।

বাগানের চাতালে দুই ভক্ত সেবকের যে নাচ শুরু হল, কাছাকাছি যারা ছিল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে তারা দেখল। বৈষ্ণবসমাজে এই নাচের নাম হল পরিমুণ্ডা নৃত্য। সেবাধর্মের প্রতীক গোবিন্দকে নিয়ে কাহিনীর শেষ নেই।

পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে ভোররাতে নবদ্বীপের পথে পা বাড়াল গৌড়ের ভক্তরা। সপরিবার অদ্বৈত, শ্রীবাস, মালিনীকে এগিয়ে দিতে তাদের সঙ্গে কিছুটা পথ গেল গোরা।

নিতাইকে পাশে নিয়ে নানা কথার মধ্যে সে জিজ্ঞেস করল, শুনেছি নারায়ণীর ছেলে হয়েছে। কত বয়স হল তার? নাম কী?

নিতাই বলল, বয়স বোধহয় বছর দুই। নাম বৃন্দাবন।

ছেলে নিয়ে নারায়ণী আছে কোথায়?

নামগাছিতে, বাসুদেব দত্তের বাড়িতে।

আলালনাথ পর্যন্ত ভক্তদের এগিয়ে ফিরে আসার আগে গোরা একান্তে নিতাইকে ডেকে বলল, রথযাত্রার সময়ে মাঝেমাঝে পুরুষোত্তমপুরে তুমি এলে আনন্দ পাব। শুধু একটা অনুরোধ, বৃন্দাবনকে কখনো এনো না।

গোরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিতাই বলল, সাবধানে থেকো।

—গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই আর তার অনুচররা কিন্তু পছন্দ করছে না তোমাকে।

—গোরা বলল, খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।

—কবে?

—আশা করি, হেমন্ত কালের শেষে, অথবা শীতের মাঝামাঝি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *