গোরা – ২৭

২৭

নিতাই-এর সঙ্গে নবদ্বীপে কৃষ্ণনাম প্রচারে বেরিয়ে ঠাকুর হরিদাসের বুক উৎকণ্ঠায় টিপটিপ করছিল। দলবল নিয়ে মৃদঙ্গ, করতাল, মন্দিরা বাজিয়ে নবদ্বীপের রাস্তায় সঙ্কীর্তন করার রেওয়াজ নেই। গৌড়ের কোথাও হয় কি না, হরিদাস জানে না। হরিদাসের অস্বস্তির সবচেয়ে বড় কারণ হল তারা দু’জন সন্ন্যাসী হলেও নবদ্বীপে অজ্ঞাতকুলশীল আগন্তুক, এখানকার অল্প মানুষ তাদের চেনে। সে বা নিতাই নবদ্বীপের পথঘাট বিশেষ চেনেনা। হরিদাসের আরও বেশি ভয় নিতাইকে নিয়ে। শান্তিপুরে থাকতে তার গুরু অদ্বৈত আচার্য আড়ালে অনেকবার তাকে বলেছে, নিতাই কুলীন বামুন না ঘোড়ার ডিম, নবশাকদের চেয়েও বেহদ্দ! তার বাপ হাড়াই পণ্ডিত ছিল হাড়ি ডোম বাগদি সম্প্রদায়ের ধর্মদেবতার পূজারী। গাঁই, গোত্র, কুলহীন রাঢ়, ব্রাহ্মণত্বের ছিটেফোঁটা না থাকলেও কোথাকার এক সন্ন্যাসীর হাতে বড় ছেলেটাকে দক্ষিণা হিসেবে তুলে দিয়ে ব্রাক্ষ্মণ হয়ে গেল। পরিচয় ভাঁড়িয়ে ম্লেচ্ছ হাড়াই হয়ে গেল মুকুন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, শুধু ব্রাহ্মণ নয়, কুলীন ব্রাক্ষ্মণ! জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে গোরার আস্কারায় হাড়াই-এর পোলা কুবেরের এখন নবদ্বীপে রমরমা, সে নাকি দ্বাপর যুগের বলরাম! আরও কত দেখতে হবে, শুনতে হবে, কে জানে।

হরিদাসের মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্বৈত আরও বলেছিল, সে এমন এক অবতারের আশায় বসে আছে, যে ধর্ম-জাত-পাতের বেড়া ভেঙে শুদ্ধ ভক্তিস্রোতে মানুষকে ভাসিয়ে দেবে। নাম ভাঁড়িয়ে সমাজের সঙ্গে জোচ্চুরি করবে না। নিতাইকে নিজের গুরু মাধবেন্দ্রপুরীর গুরু লক্ষ্মীপতির শিষ্য জানার পর থেকে অদ্বৈত অবশ্য বদলে গেছে। ঠোঁটকাটা বুড়ো মানুষটা মুখে কুলুপ এঁটেছে, সসম্ভ্রমে নিতাই-এর সঙ্গে কথা বললেও তার ফাজলামো দেখলে চটে গিয়ে মুখ ফসকে এমন দু’একটা কড়া কথা বলেছে, যা গুরুভাই সম্পর্কে বলা বৈষ্ণবাপরাধ। অদ্বৈতের অপমানসূচক কথা শুনে চির-আনন্দের প্রতিমূর্তি নিতাই হাসে। অদ্বৈত আরও চটে গিয়ে গজগজ করতে থাকে। তারপর নিজেই শান্ত হয়ে যায়, বুকে টেনে নেয় নিতাইকে। মেজাজ শান্ত হলে তার কাছে ক্ষমা চায়, আশীর্বাদ চায় অদ্বৈত। সঙ্কোচে নিতাই জিভ কাটে। গুরুপরিচয় নিয়ে সে জাঁক করে না। আপনভোলা, উদাসীন, রাজকীয় মেজাজের মানুষ সে। তার কোমরে জড়ানো কাপড় রাস্তার কেউ ভিক্ষে চাইলে সে দিয়ে দিতে পারে। মাঝে মাঝে এমন সব খাপছাড়া কাণ্ড করে বসে, সঙ্গীরা থতমত খায়। আসর ছেড়ে কেউ কেউ চুপচাপ সরে পড়ে। কয়েকদিন আগে সঙ্কীর্তনের শেষে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, মদ দাও, মদ দাও, তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।

প্রবীণ বৈষ্ণবদের দু’একজন রীতিমতো রুষ্ট হয়ে মুখ চাওয়াচায়ি করছে, নিতাই-এর পিঠে আলতো করে গোরা হাত রাখল। আবেশে বিভোর নিতাই বলল, আহ্, কী আরাম, আমার তেষ্টা একদম মিটে গেল।

গোরার হাত ধরে সঙ্কীর্তনীয়াদের দলে ঢুকে সে আবার নাচতে গাইতে শুরু করল। খোল, করতাল, মন্দিরা বাজিয়ে তখন সঙ্কীর্তন চলছে। কীর্তনের অনিবদ্ধ পর্বের রেশ টেনে শুদ্ধ ধ্রুপদাঙ্গ কীর্তনের নিয়ম মেনে ধ্রুবপদের আলাপ কিছুক্ষণ চলার পরে শুরু হতে চলেছে সুর, তাল মূর্ছনাসমেত কীর্তনের নিবদ্ধ পর্ব। দক্ষিণী মধুর নৃত্যশৈলিতে নিতাই-এর শরীরে বিভঙ্গের যে ঢেউ উঠছিল, গৌড়ের মানুষ তেমন নাচ আগে দেখেনি। সে নাচ উদ্দণ্ড নয়, চোখজুড়োনো মধুর নৃত্যকলার চেয়ে সরস। সে নাচের তালিম গোরা না পেলেও সে অনায়াসে নিতাই-এর সঙ্গে পা মেলাচ্ছিল। মাঝে এক সন্ধের আসরে মালিনীর বিয়ের শাড়ি, গয়না পরে, কপালে সিঁদুরের টিপ, চোখে কাজল, দু’পায়ে আলতা লাগিয়ে জগজ্জননী দুর্গার মতো নিতাই হাজির হতে অদ্বৈত, শ্রীবাস, মুকুন্দ, মুরারি, জগদানন্দ, শুক্লাম্বর, নরহরি পর্যন্ত বাকি সকলের সঙ্গে এমন অভিভূত হয়ে পড়ল, যে সেই মূর্তির সামনে আভূমি প্রণত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছিল। দেবীমূর্তির মুখের লম্বা দাড়িগোঁফ যে টানটান জালিকার আড়ালে লুকোনো রয়েছে কেউ খেয়াল করল না। জগজ্জননীকে চিনতে গোরার অসুবিধে হয়নি। নকল দেবীরূপিণীকে গোরা জড়িয়ে ধরতে, তাকে প্রণাম করেছিল নিতাই। তাকে পাল্টা প্রণাম করেছিল গোরা। নিতাই কতবার বিনা কাপড়ে দিগম্বর হয়ে গোরার বাড়িতে গেছে, তার হিসেব নেই। শচীর রান্নাঘরে ঢুকে হাতের কাছে যা পেয়েছে, তুলে নিয়ে খেয়েছে। তেত্রিশ বছরের ছেলের কাণ্ড হাসিমুখে শচী দেখেছে। তার বারবার মনে পড়েছে বালক বয়সের গোরাকে। বিবস্ত্র নিতাইকে দেখে বিষ্ণুপ্রিয়া লজ্জা পেয়ে ঘরে ঢুকে কপাট বন্ধ করেছে। শ্রীবাসের বাড়িতে যখন তখন এমন ঘটনা ঘটছে। বৈষ্ণবমহলে অনেকে জেনে গেছে নিতাই-এর লাজলজ্জা নেই, ভয় নেই, খাদ্যাখাদ্যের বিচার নেই, ঘৃণা নেই, নির্লোভ সে। সবিপ্র বৈষ্ণবদের অনেকের সন্দেহ সে ব্রাহ্মণ সন্তান নয়, আড়ালে ফিসফাস করে বলে, লোকটা যেন কেমনধারা। দেখে মনে হয়, চাড়াল, হাঁড়ি, ডোম, কোনও শূদ্রের ঘরে জন্মেছে।

তারা আড়ালে যে যাই বলুক, প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলে না। গোরার মিতা, সবচেয়ে কাছের মানুষ নিতাই তারা জেনে গেছে। কৃষ্ণের অবতার, গোরা যে সমাজ থেকে ধর্ম-জাত-পাতের বিভেদ মুছে দিতে এসেছে, নবদ্বীপের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে এ খবর। গোরার ডান-হাত অদ্বৈত মহাপ্রভু, বাঁ-হাত শ্রীবাস পণ্ডিত, মগজ হল নিতাই। নিতাই সম্পর্কে তাদের কারও কিছু বলার সাহস নেই। কৃষ্ণাবতার গোরা, স্বয়ং যাকে বন্ধু ভেবে কাছে টেনে নিয়েছে, তার সমূহ তত্ত্ব কি সে জানে না? লোকমুখে যা রটছে, তা নিতাই-এ কানে এলেও সে কিছুই গ্রাহ্য করে না, মনে রাখে না। সে নিজেও জানে, তার সম্পর্কে যা রটছে, সে তার কিছুই নয়। মানুষ হিসেবে তার পরিচয়ই শেষ কথা, মানুষ পরিচয়ে সে সার্বভৌম। প্রাচীন এক বৃক্ষের মতো তার স্বভাব, চালচলন। মাটি আঁকড়ে নিশ্চল গাছের মতো সে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, বৃক্ষের সঙ্গে এই শুধু তার তফাত। সাধনার অনেক উঁচু মার্গে একই সঙ্গে স্থির আর চঞ্চল এই মানুষটাকে নিয়ে নাম প্রচারের প্রথম দিনে রাস্তায় বেরিয়ে হরিদাস কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। দ্বিতীয় দিনও নির্ঝঞ্ঝাটে কেটেছিল। হরিদাস যা ভাবছিল, নাম প্রচারের তৃতীয় দিনে গঙ্গার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে তাই ঘটল। নাগরিয়া ঘাটের কাছাকাছি এসে মাঝগঙ্গা বরাবর বড়সড় একটা গাছের কালো গুঁড়ির মতো কিছু ভাসতে দেখে হরিদাসকে নিতাই বলল, ওই দেখ একটা কুমির। চল, কুমির বন্ধুর সঙ্গে একটু খেলা করে আসি। সেইসঙ্গে নাম প্রচারের আগে স্নানটাও সেরে নেওয়া যাবে।

কথার মধ্যে হরিদাসের হাতের করতাল, নিজের মৃদঙ্গ, দু’জনের উড়ুনি এক ঝটকায় খুলে ফেলে পাড়ের শুকনো মাটিতে রেখে দিল নিতাই। বাইশ বাজারে চাবুক খেয়ে আধমরা হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও নিতাই-এর কথা শুনে হরিদাসের থরহরিকম্প লেগে গেল। সে কিছু বলার আগেই দু’হাতে তাকে জাপ্টে ধরে গঙ্গার পাড় বেয়ে তরতর করে জলে নেমে পড়ল নিতাই

আহা, কর কী, ডুবে মরব নাকি?

নিতাই-এর দু’হাতের বাঁধন আলগা করতে হরিদাস ছটফট করলেও গলা পর্যন্ত জলে তাকে টেনে নিয়ে গেল নিতাই। হরিদাসকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে নিতাই বলল, ঠাকুর, দাঁড়াও এখানে, কুমিরটার সঙ্গে একটু খেলা করে আসি।

নিতাই-এর হাত চেপে ধরে হরিদাস বলল, প্রভু, সাঁতার আমিও জানি, তা বলে কুমিরের সঙ্গে আপনাকে খেলা করতে যেতে দিতে পারি না।

পাশেই নাগরিয়া ঘাটে যারা চান করছিল, তাদের মধ্যে এক প্রবীণ, দূরে ভাসমান কালো বস্তুটা দেখিয়ে বলল, ওটা কুমির নয়, বল্লালদিঘি শ্মশানের আধপোড়া চিতাকাঠ, জোয়ারের টানে ভেসে এসেছে।

নিতাই বলল, বড় পবিত্র জিনিস চিতাকাঠ, ওটা বুকে জড়িয়ে একটু সাঁতার কাটলে ভারি আনন্দ পাব।

হরিদাস ঝুলোঝুলি করে আটকাতে পারল না নিতাইকে। তার মুখে চোখে দু’হাতের আঁজলা ভরে জল ছিটিয়ে তাকে অস্থির করে, হা হা করে হেসে টুপ করে জলে ডুব দিল নিতাই। জলের ঝাপটা থেকে চোখ দুটো বাঁচাতে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হরিদাস। জলের তলায় নিতাই সেঁধিয়ে যেতে হরিদাস ভাবল, নাম প্রচারে বেরিয়ে ভালো গেরোয় পড়া গেল। কপালে আজ অনেক দুর্ভোগ আছে।

ডুবসাঁতার দিয়ে গঙ্গার অনেকটা ভেতরে গিয়ে নিতাই ভেসে উঠল। লম্বা হাত দুটো দাঁড়ের মতো টেনে সাঁতার শুরু করল সে। স্নান সেরে পাড়ে রেখে দেওয়া নিজেদের খোল, করতাল, উড়ুনি আগলে ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকল হরিদাস। হেমন্তের হাওয়ায় শীতভাব। ভিজে কাপড় জড়ানো শরীরে কাঁপুনি জাগলেও হরিদাস নাম জপ করতে থাকল। গঙ্গার তিরতিরে স্রোতে হালকা চালে ভেসে চলেছে চিতাকাঠ। ভেলার মতো করে কাঠটা আঁকড়ে ভেসে বেড়ানোর জন্যে নিতাই যত তাড়াতাড়ি সাঁতার চলেছে, সেটা একটু একটু করে তত দূরে সরে যাচ্ছে। ঘাটে যারা চান করতে এসেছে, তাদের অনেকের চান শেষ হলেও মজা দেখতে তারা দাঁড়িয়ে গেছে। নাম জপ করলেও হরিদাসের চোখ রয়েছে নিতাই-এর ওপর। খোল, করতাল, দু’টুকরো উড়ুনিও তার নজরে রয়েছে। সম্প্রতি মৃদঙ্গকে শ্রীখোল’ নাম দেওয়া হয়েছে। নাম দিয়েছে গোরা। বেলকে বলছে ‘শ্রীফল’। সুন্দর নামকরণে তার বেজায় ঝোঁক। সে বলে, চারপাশ শ্রীমণ্ডিত না হলে মনে ভক্তিভাব জাগবে কোথা থেকে? পরিচ্ছন্নতার দিকেও তার কড়া নজর। নিজের বাড়ি থেকে পাড়ার পথঘাট, দোকানপাট, গঙ্গার তীর, এমনকি বল্লালদীঘির শ্মশান পর্যন্ত সে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখতে সঙ্কীর্তনের দলবল নিয়ে নেমে পড়ে। খোল, কলতাল, মন্দিরার সঙ্গে অনুষ্ঠান চত্বর সাফাই করতে তার অনুগামীরা ঝাঁটা, কোদাল, বেলচা, ঝুড়ি নিতে ভোলে না। পরিচ্ছন্ন থাকার ধুম পড়ে গেছে বৈষ্ণবসমাজে। স্বাস্থ্যসচেতনতাও জল, আলো, হাওয়ার মতো মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে দরকার, সঙ্কীর্তনের সাথীদের মাথায় এ চিন্তাও সে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আটপ্রহর ধরে নাচ গান করতে হলে চাই তেজালো সুরেলা গলা আর মজবুত শরীর। গোরার নিদান মেনে সুস্বাস্থ্যের জন্যে তাদের অনেকে রোজ সকালে বেল পোড়া, বেলের মোরব্বা, গ্রীষ্মে পাকা বেলের সুগন্ধি সোনালি শাঁস খাচ্ছে। বেলের মাহাত্ম্য প্রচার করতে তারা নিজেরাই বলে বেড়াচ্ছে, তাদের পেটে যতরকম ব্যামো ছিল, সব নিকেশ হয়েছে। শাক-চচ্চড়িতে গোরার প্রীতি জেনে, তার ভক্তরাও শাক খেতে শুরু করছে। কুড়িটা উপকারী শাক—হিঞ্চে, গিমে, কুলেখাড়া, বেতো, পালং, নটে, কমলি, হেলেঞ্চা, পলতা, মেথি, ব্রাহ্মী, পুঁই, কচু, লাউ, কুমড়ো, শাপলা, মুলো শাক, সর্ষে শাক, গাঁদাল কার কী গুণ, গোরার নখদর্পণে। বাঁশের লতি, কচুর লতি, পুঁইমেটুলিও গোরার প্রিয় খাবার। সবচেয়ে বেশি ভালবাসে লাউ-এর পায়েস, বেতের ডগা দিয়ে শুক্তো আর লাউডগা দিয়ে মুগডাল। সম্ভবত মুরারি কবিরাজের কাছ থেকে গোরা শুনেছে সকাল সন্ধে ভাত খাওয়ার পরে দু’বাটি লাউ-এর পায়েস খেলে শরীর ঠাণ্ডা হয়, অভিনিবেশ বাড়ে, গায়ের চামড়া ঝকঝক করে। থোড়, মোচা, কাঁচকলা, কুলেখাড়া শাক খেলে শরীরে রক্ত হয়, শক্তিমান হয় মানুষ। ব্রাহ্মী শাকে স্মৃতি বাড়ে, হেলেঞ্চা শাকে গৃহশান্তি বজায় থাকে, মানে পরিবারের মানুষজন মাথা গরম করে না, অনিদ্রা রোগ দূর করে পুঁই শাক। আমলকি সেদ্ধ চটকে কড়াই শাক, মটর শাক খেলে হজমশক্তি বাড়ে।

পেশাদার আয়ুর্বেদিক মুরারি যেসব পরামর্শ রোগীদের ঘরে ঘরে চিকিৎসার সময়ে বারবার বলেও তাদের মানাতে পারেনি, গোরার মুখের কথা শুনে, তার পছন্দের ভাত, তরকারি দেখে, অনুগামীরা হামলে পড়ে সেসব খেতে শুরু করেছে। শুধু অনুগামীরা কেন, নবদ্বীপের মানুষ যেসব শাকপাতা ছুঁতো না, বুনো, অখাদ্য ভাবত, সেগুলো যে এত খাদ্যগুণসম্পন্ন, পুষ্টিকর কানে আসাতে প্রথমে লুকিয়ে চুরিয়ে, পরে খোলাখুলি খেতে শুরু করল। শাকপাতার এমন বিশাল ভাঁড়ার মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গের নাগালের মধ্যে প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে, গোরা জানিয়ে দিল সবাইকে।

শুধু আতপচালের দু’মুঠো ভাত যে হরিদাস রোজ খেত, ভাতের পাতে এখন তার তরকারির অভাব হয় না। চিতার আধপোড়া কাঠটা নিতাই যখন ধরে ফেলেছে, সেটা জলের ওপর দিকে জেগে উঠে এমন বিকটা হাঁ করল, সকালের আলোয় ঝকঝক করে উঠল সেটার দু’পাটি কুঠারের মতো দাঁত। ঘাটে দাঁড়ানো কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘কুমির কুমির’!

গঙ্গায় সাধারণভাবে কুমির না থাকলেও জোয়ারের সময় দু’একটা জলঙ্গি নদী, আরও দূরে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রে ঢুকে পড়ে আবার সমুদ্রের দিকে ভেসে আসে। ভাটার টানে সমুদ্রের জীব সমুদ্রে ফিরে যায়। নাম জপে আবিষ্ট হরিদাসের কানে ‘কুমির’ শব্দটা যেতে আতঙ্কে সামনে তাকিয়ে মাঝগঙ্গায় জল উথালপাথাল হতে দেখল সে। জলের উচ্ছ্বসিত আবর্তে নিতাইকে দেখার চেষ্টা করল। নিতাই কোথায়? নিতাইকে সেখানে দেখল না। কুমিরও ডুব দিয়েছে। নিতাই-এর ঘাড় কামড়ে ধরে জলের গভীরে কুমির টেনে নিয়ে গেছে তাকে, অনুমান করে হরিদাস ঠকঠক করে কাঁপতে থাকল। গোরাকে গিয়ে সে এখন কী বলবে, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কোন মুখে? চোখের সামনে সন্ন্যাসী গোছের একজন মানুষকে কুমিরে ধরে নিয়ে যেতে হাহাকার করছে ঘাটের স্নানার্থীরা।

পাকাচুল, মাতব্বর এক ব্রাক্ষ্মণ বলল, ব্রাক্ষ্মণ না ছাই! পাগল, সেয়ানা পাগল, কুমিরের সঙ্গে রোয়াবি করতে গিয়েছিল। এখন বোঝ ঠ্যালা!

তার সমবয়সি আর এক বিপ্র, বুকজলে আচমন থামিয়ে ব্রাহ্মণের কথাতে সায় দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ বেদান্ততীর্থ। এরা যে নবদ্বীপে কোথা থেকে এসে জোটে!

হরিদাসের দিকে নজর করে কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে সে গলাখাঁকারি দিল। গোরার অনুগামী হরিদাসকে চিনতে পেরে গলার আওয়াজে সে সঙ্কেত পাঠাল বেদান্ততীর্থকে। বুকজল থেকে এক লহমা ঘাটের দিকে তাকিয়ে মাথা ভেজাতে তখনই গঙ্গায় ডুব দিল বেদান্ততীর্থ। হরিদাসকে দেখে সে-ও চিনেছে। গোরা আর তার দলবলের পাপে নবদ্বীপ উজাড় হয়ে যেতে বসেছে, সেখানকার স্মার্ত, নৈয়ায়িকদের তা বুঝতে বাকি নেই। বাড়ির কপাট বন্ধ করে রাতে যারা খোল, কলতাল, মন্দিরা বাজিয়ে হরিসঙ্কীর্তন করে, তারা যে মদ্যপ, মাংসভোজী, সুন্দরী অপ্সরাদের, বিশেষ করে সুকেশী, মঞ্জুঘোষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুপ্রিয়া, সরমার মতো কামদেবের পোষা রমণীরা, যাদের দেবতা বা অসুরকুল জায়গা দেয়নি, মন্ত্র আওড়ে তাদের ঘরে টেনে এনে লাম্পট্য করে, তারা ভণ্ড সাধক, ব্রাক্ষ্মণসমাজ বুঝে গেছে। ঘাটের মানুষের আক্ষেপ থেমে গেল কয়েক মুহূর্তে। তারা অবাক হয়ে দেখল অক্ষত নিতাই ডুবসাঁতার দিয়ে ঘাটের কাছাকাছি এসে, ভুস করে জলের ওপর ভেসে উঠে সাবলীল ভঙ্গিতে সাঁতার কেটে ঘাটে ফিরছে। মহাসাধক লক্ষ্মীপতির শেষ শিষ্য নিতাইকে গোড়াতে হরিদাসের পাগল মনে হলেও, এখন সে টের পেল, নিতাই নিছক পাগল নয়, সে পাগলের ঈশ্বর। জল ঝরে গিয়ে হরিদাসের ভিজে লুঙির মতো দু’ফেত্তা দিয়ে বাঁধা আট হাতি গেরুয়া ধুতি প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ঘাটে ফিরে নিতাই স্নানার্থীদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হরিদাসকে চাপা গলায় বলল, রোজ যার নাম তুমি লক্ষবার জপ করো, কুমিরের পিঠে চেপে গোলোকধামে গিয়ে সেই হরির সঙ্গে দেখা করে এলাম। তুমি চাইলে, তোমাকেও দেখা করিয়ে আনতে পারি।

হরিদাসের কাঁপুনি থামলেও মুখে কথা সরল না। কুমিরের সঙ্গে নিতাই-এর যুদ্ধের বিবরণ শুনতে ঘাটশুদ্ধ লোক মুখিয়ে থাকলেও তাদের পাশ কাটিয়ে এক দৌড়ে মোটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল সে। চোখের পলকে দিগম্বর হয়ে ভিজে ধুতি নিংড়ে দু’তিনবার ঝেড়ে আধশুকনো করে ফের কোমরে জড়িয়ে নিল। হরিদাসের জিম্মায় রয়েছে তার শুকনো উড়ুনি। নিতাই তাকাল না সেদিকে। সকলের নজর এড়িয়ে দুই বৃদ্ধ, পাকাচুল ব্রাত্মণ আর বেদান্ততীর্থও তাড়াতাড়ি ঘাট ছেড়ে চলে গেল। ঘাটের নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে বেদান্ততীর্থ বলল, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার!

বিহিতটা কীসের জানতে না চেয়ে পাকাচুল ব্রাক্ষ্মণ বলল, গৌড়ের দরবারে মহামান্য সুলতান হোসেন শাহের কাছে আমাদের দস্তখত করা আবেদন পৌঁছে গেছে। খবরটা দিল আমাদের আগমবাগীশ, চেনো তো আগমবাগীশকে?

‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থের লেখক, কৃষ্ণনন্দ আগামবাগীশকে নবদ্বীপে কে না চেনে? সুলতানি দরবারের তত্ত্ব সে জানল কোথা থেকে?

বাহ্, সে তো সুলতানের ডানহাত জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের বন্ধু, এই নবদ্বীপে মহামহোপাধ্যায় ন্যায়শাস্ত্রী বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে দু’জনে একসময়ে পড়ত। সহপাঠী ছিল তারা।

ওসব গপ্পো আমি জানি। কোথায় সুলতানি দরবারের জ্যোতিষার্ণব, আর কোথায় আমাদের আগমবাগীশ, তাকে কি জ্যোতিষার্ণব পৌঁছে?

খুব পৌঁছে। সিরাজকাজির কাছে সুলতানি ফরমান এসে গেছে। দেখ এখন কী হয়! শহরের দুই কোটাল, জগন্নাথ আর মাধব যে কোনওদিন গোরা আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের কোমরে দড়ি বেঁধে কাজির কাছারিবাড়িতে নিয়ে হাজির করে দেবে।

গরিমাদীপ্ত দুই বৃদ্ধ যখন গৌড় দরবারের নানা গোপন খবর আর গুজব নিয়ে আলোচনায় মেতে হেঁটে চলেছে, নিতাই শুকনো উড়ুনি গায়ে জড়িয়ে মৃদঙ্গ হাতে তুলে হরিদাসকে বলল, চল, ঠাকুর, এবার নাম প্রচারে নেমে পড়ি। দু’হাতে পেতলের করতাল হরিদাস তুলে নিতে স্নানার্থীদের দিকে তাকিয়ে নিতাই হাঁক পাড়ল, ভাইসব, একবার ‘হরি হরি’ বল।

তার ডাকে বেশিরভাগ সাড়া দিলেও কয়েকজন চুপ করে থাকল। কথা না বাড়িয়ে নাম প্রচারের তৃতীয় দিনে করতালে ঠুংঠাং বোল তুলে নিতাইকে পাশে নিয়ে হরিদাস রাস্তায় এসে দাঁড়াল। নবদ্বীপের পথে পথে অজ্ঞাতকুলশীল দু’জন গেরুয়াধারী কৃষ্ণনাম প্রচারে নেমে হুলুস্থুলু ফেলে দিয়েছিল। মৃদঙ্গ, করতাল বাজিয়ে গান গেয়ে, নেচে-কুঁদে কৃষ্ণনাম ভিক্ষার এমন অভিনব ঘটনা নবদ্বীপের মানুষ আগে কখনও দেখেনি। নতুন ধরনের দুই সন্ন্যাসীকে অব্রাক্ষ্মণ জনসমাজ বুঝে উঠতে না পারলেও তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’, ‘হরিবোল হরিবোল’ বলতে তারা কসুর করছিল না। ‘কৃষ্ণ’ ‘হরি’ বললে জাতপাতের ব্যবধান থাকবে না, ব্রাহ্মণের মতো সবাই সমান মর্যাদা পাবে, হাতের কাছে মান-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার এমন এক অবিশ্বাস্য সহজ পদ্ধতি পেয়ে নবদ্বীপের হাজার হাজার মানুষ বর্তে গেল। গলায় একটা তুলসির মালা পরে কপালে চন্দনের তিলক এঁকে নিলেই নতুন জীবন পেয়ে যাবে যবন, শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাক, নেড়ানেড়ি, চিরকালের মতো জন্ম পরিচয়ের কলঙ্ক ঘুচিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, এটা কম কথা নয়! সবচেয়ে বড় কথা এই নতুন ধর্মের জোয়ার যে এনেছে সে তাদের প্রিয়জন, ভালবাসার মানুষ, রামচন্দ্রপুরের জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে গোরা। যাদের ছায়া মাড়ালে বামুনরা চান করত, তাদের দেখে গোরা কখনও নাক সিঁটকোয়নি। তাদের ঘরের ছেলেদের সঙ্গে ছেলেবেলায় খেলাধুলা করেছে, এমনকি তাদের সংসারে গিয়ে, যে যা দিয়েছে, হাসিমুখে খেয়েছে। নিজে চেয়েও কি খায়নি? তাও খেয়েছে। বয়স বাড়লে গোরা যে তাদের আরও কাছে টেনে নেবে, তারা জানত। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, গোরা একদিন দেশের রাজা হবে। গৌড়ের সুলতানদের হাবসি চাকরেরা যদি সুলতানি মসনদে বসতে পারে, তাহলে গোরা কেন রাজসিংহাসনে বসবে না? কৃষ্ণও তো দ্বারকায় রাজা হয়েছিল। বৈষ্ণব হওয়ার শলাপরামর্শ শূদ্র আর ম্লেচ্ছপাড়ার ঘরে ঘরে শুরু হয়েছিল। নবশাক সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষা নিতে মনস্থ করে ফেলল। স্বর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তন্তুবায়, কর্মকার, সূত্রধাররা এমন এক শাসক খুঁজছিল, যার পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের তৈরি উদ্বৃত্ত পণ্য গৌড়বাংলার বাইরে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে যায়। গৌড়, রাঢ়, বঙ্গালের কুটিরশিল্পী, কারিগরেরা তাদের নিজেদের পল্লিতে কতরকম পণ্য বানাত, তার হিসেব দেখলে অবাক হতে হয়। সরবতী, মখমল, আলাবালি, তঞ্জীব, তেরিন্দাম, নয়নসুখ, শিববন্ধানি পাগড়ি, ডুরিয়া, জামদানির মতো সূক্ষ্ম মসলিন থেকে গরিবদের জন্যে মোটা কাপড় গৌড়বাংলার তাঁতিদের ঘর থেকে পাণ্ডুয়া, সপ্তগ্রাম, সোনারগাঁও, চট্টগ্রাম, হুগলির শ্রেষ্ঠিদের নৌকোয় চেপে দেশ বিদেশের বন্দরে পৌঁছে যেত। শুধু বস্ত্রসম্ভার নয়, সূত্রধরদের তৈরি কাঠের নৌকো, শঙ্খশিল্পীদের তৈরি শঙ্খের পণ্য, এমনকি কর্মকারদের কামারশালায় বানানো লোহার বাসনের সঙ্গে যুদ্ধের কামান, বারুদও গৌড়ে তৈরি হত। কৃষিপণ্যের মধ্যে চিনি, গুড়, সুপারি, তামাক, তেল, আদা, পাট, মরিচ, ফল, তাড়ি, দু’তিনরকম মদ, নুন, গালা, আফিম, নানারকম মশলা, ভেষজ, গৌড়ের বাইরে হস্তিনাপুর, কর্ণাট, গুর্জর, কলিঙ্গ, বারাণসী, মহারাষ্ট্র, মগধ, কাঞ্চী, অযোধ্যা, মথুরা, অবন্তী, কামরূপের ব্যাপারিদের মালখানায় তুলে দিতে নবশাক ব্যবসায়ীরা জলপথের সঙ্গে স্থলপথেও পৌঁছাত চাইছিল। নবদ্বীপ আর আশপাশে গোরার মহিমা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকলে বিভিন্ন পেশার শ্রেষ্ঠিরা সেই মানুষটাকে ধর্মনেতার সঙ্গে ভবিষ্যতের গৌড়বাংলার শাসক কল্পনা করে নিয়ে তার ধর্মাচরণে রসদ জোগাতে শুরু করল। গৌড়, রাজমহল থেকে মগধ, অযোধ্যা, ইন্দ্রপ্রস্থ হয়ে আরও পশ্চিমের সমৃদ্ধ নগর, শহরগুলোতে, যেখানে অসংখ্য বিত্তবান ক্রেতাদের বাস, সেইসব জনপদে পৌঁছনোর পথ, ধর্মপ্রচারকরাই প্রথম সুগম করতে পারে। ধর্মপ্রচারকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে তার দেশের রাজশক্তি। রাজশক্তি মানে, রাজার অনুগ্রহ, রাজার দেওয়া সুরক্ষা। ধর্মপ্রচারক, ব্যবসায়ীদের আলাদা দল করে ভিন্ন রাজ্যে পাঠিয়ে সুযোগ মতো রাজ্য সম্প্রসারণের অপেক্ষায় থাকে রাজা। গোরা রাজা হলে তাদের ব্যবসাবাণিজ্যে জোয়ার আসবে, এমন এক প্রত্যাশা নিয়ে নবদ্বীপের সচ্ছল বণিকদের একাংশ, একে একে জড়ো হচ্ছিল গোরার পাশে। তাদের নেতৃত্বে ছিল মুকুন্দ-সঞ্জয়, বুদ্ধিমন্ত খাঁ প্রমুখ গোরার ব্যবসায়ী বন্ধুরা। তাদের অনেকে যথেষ্ট বিত্তবান, প্রভাবশালী, সোনার থালায় ভাত খায়।

সঙ্কীর্তন যে গুহ্যসাধনা, ধর্মীয় সর্বজনীনতা, নিতাই, হরিদাস পরপর দু’দিন পথে নেমে নেচে গেয়ে, কৃষ্ণনাম ভিক্ষে করে নবদ্বীপবাসীকে তা জানিয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রকাশ্যে গান গাওয়ার অধিকার সব ধর্মসম্প্রদায়ের রয়েছে, গোরার দুই অনুগামী নবদ্বীপের লোকসমাজকে জানিয়ে দিল। যোগী, তান্ত্রিক, বজ্রযানীদের গুহ্যসাধনা থেকে সঙ্গীতন যে সম্পূর্ণ আলাদা, বসুধাবিস্তৃত মানবসমাজের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতি নির্মাতার অন্তরতম যোগাযোগ, ‘তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি’ সর্বজনের অংশ নেওয়াই কলিকালে সূর্যের আলোর মতো ভক্তিধর্ম, এমন এক ব্যাখ্যা শুনিয়ে, সঙ্কীর্তনকে জনপ্রিয় করতে পথে নেমে ঘরে ঘরে নামভিক্ষার যে কর্মসূচি কয়েকদিন আগে গোরা পেশ করেছিল, তার চার অসমবয়সি সহযোগী, অদ্বৈত, শ্রীবাস, গদাধর, নিতাই, তা সর্বান্তঃকরণে তখনই মেনে নেয়। হরিদাসও ছিল সেখানে। সে নাম জপে বিভোর হয়ে থাকায় সব কথা তার কানে না গেলেও প্রথম তিনদিন নামভিক্ষার দায়িত্ব নিতাই-এর সঙ্গে তাকে দেওয়া হয়েছিল।

গোরা বলেছিল, ঘরে ঘরে গিয়ে ‘কৃষ্ণ ভজ, কৃষ্ণ বল, কর কৃষ্ণ শিক্ষা’ এই হবে আমাদের ভিক্ষা। চাল, ডাল, কলা, মুলোর বদলে হরিনামে আমরা ভরে নেব কৃষ্ণের ঝুলি। শেষ গৃহস্থের ঘরে কৃষ্ণনাম ভিক্ষে করে দু’মুঠো চাল নিতে পারো, তার বেশি নয়। ভিক্ষের চালে দুপুরে পেট ভরাতে হবে, পরিমাণে যাই হোক, সেই ভাতে কুলিয়ে নিতে হবে আমাদের।

ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত নির্বিশেষে মানুষকে সঙ্কীর্তন শরিক করতে ভক্তিধর্ম প্রচারকদের কতটা সহৃদয় হতে হবে, তার রূপরেখা আটটা শ্লোক লিখে গোরা হাজির করতে তার অনুগামীরা অবাক হয়ে দেখেছিল, গয়া থেকে পাঁচমাস আগে ফিরে এই আটটা শ্লোকের নির্দেশ মেনে গোরা জীবন কাটাচ্ছে, বদলে ফেলছিল নিজেকে। গোরার চালচলনে যা খাপছাড়া ঠেকছিল, আসলে সেটাই স্বাভাবিক, জীবনের অভিনব উপলব্ধি থেকে তা উঠে আসছে। সৌজন্যে, ভদ্রতায় সে ভারি নরম করে দিচ্ছিল মানুষের মন, গড়ে তুলছে মানুষে মানুষে সম্পর্কের উদার পটভূমি, খোলামেলা মেলামেশার ভাষা। তার নতুন ভাষা-ভাণ্ডারের চাবিকাঠি হল ‘কৃষ্ণ’ শব্দের উচ্চারণ। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, কায়স্থ, শূদ্র, ম্লেচ্ছ সব স্তরের মানুষের মধ্যে বয়সে যারা বড়, দেখা হলে তাদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করছিল। অব্রাক্ষ্মণ বয়স্কের পায়ে সে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করলে মানুষটা ছিটকে সরে গিয়ে কপাল চাপড়ে ‘হায় হায়’ করত, নরকবাসী হওয়ার ভয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিত। জাতপাত যাইহোক, সমবয়সীদের সমান সৌজন্য দেখাত। বন্ধুবান্ধবকে প্রথমে দু’হাত জুড়ে নমস্কার করে বুকে টেনে নিত। গোরার আপ্যায়নে শূদ্র, ম্লেচ্ছ, চেনা অচেনা মানুষগুলো আহ্লাদে গলে গেলেও কাজটা ঠিক হচ্ছে কিনা ভেবে আতান্তরে পড়ত। বাড়িতে অতিথি এলে সদর দরজা থেকে সসম্ভ্রমে ঘরে এনে বসিয়ে বিনীতভাবে কথা বলে, বাতাসা আর জল খাইয়ে তার ফিরে যাওয়ার সময়ে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিত। হাসিমুখে বিন ভঙ্গিতে বলত, আবার আসবেন, তাড়াতাড়ি ফের যেন দেখা পাই। গোরার শিষ্টাচার দেখে তার অনুগামীরা গোড়াতে তাকে পাগল ভাবতে শুরু করেছিল। নিন্দুকরা বলতে শুরু করেছিল, ন্যাকা। সন্ন্যাস নিয়ে গোরা নীলাচলে চলে যাওয়ার পরে যখন তার নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, তখনও ভদ্র, বিনয়ী মানুষ দেখলে বৈষ্ণববিদ্বেষীরা বলত, “ব্যাটা ন্যাকা চৈতন্য’।

গোরার অনুগামীরা তাকে শুরুতে পাগল ভাবলেও ক্রমশ তারা অনুকরণ করতে থাকল তাকে। কিছু ভুলভ্রান্তি ঘটত তাদের অনুকরণে। গদাধর এক বিকেলে গোরার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময়ে ‘যাচ্ছি’ বলতে তাকে শুধরে দিতে গোরা বলেছিল, বল ‘আসছি’।

কেন?

গদাধর প্রশ্ন করাতে গোরা বলেছিল, আমরা যতদিন বেঁচে থাকি একে অন্যের কাছে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসি, ফিরে আসার ইচ্ছে নিয়ে বেঁচে থাকি। জীবন্ত মানুষের এটাই ধর্ম। ‘যাই’ বললে অন্যরকম শোনায়। যাই বললেই যাওয়া যায় না।

দু’চোখ বড় করে গোরার কথা শুনছিল গদাধর। তার মন ভরে যাচ্ছিল। বাড়ি ফিরে বাবা মাধব পণ্ডিতকে গদাধর শুনিয়েছিল কীভাবে বদলে যাচ্ছে গোরার আলাপচারিতার ভাষা সমবয়সি চেনা-অচেনা মানুষকে ‘হেই’ ‘হোই’ আওয়াজ তুলে গলাখাঁকারি দিয়ে অথবা নাম বিকৃত করে ডাকবার বদলে ‘ভাই’ ‘বন্ধু’ সম্বোধন করে কাছে টেনে নিচ্ছিল। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরে শিখাইবা’–নিজের মুখের কথাটা কাজে মেনে চলছিল নিখুঁতভাবে।

অনুগামীদের সামনে জীবনযাপনের এমন এক আদর্শ খাড়া করছিল, যা তারাও ধীরে ধীরে নিজেদের জীবনে মানিয়ে নিতে পারে। তার চলনে বলনে, প্রতিদিনের ঘরগেরস্থালির কাজে খুবই সাধারণ, অথচ চোখে পড়ার মতো কিছু আচরণবিধি এত সহজে স্বভাবের গভীর থেকে প্রাকৃতিক নিয়মের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে আসছিল, যা শুধু নবদ্বীপ কেন, রাঢ় বাংলার মানুষ আগে দেখেনি। কিছু চোখে দেখলেও গ্রাহ্য করেনি, মেনে চলার দরকার বোধ করেনি। গোরাকে দেখে শিখল, হেলাফেলা করে সমাজ, সংসারে বেঁচে থাকাতে আনন্দ নেই, সংসারের মধ্যেও একটা ভাব আছে, ছন্দ আছে, সুর আর গান আছে, আপাতনজরে তা তুচ্ছ মনে হলেও সব মিলিয়ে সেই অশ্ৰুত গান মানুষকে সুভদ্র করে তোলে, নমনীয় করে তার চরিত্র, পরিচ্ছন্ন করে রুচি, একে বুঝতে পারে অন্যকে, গড়ে ওঠে বৃহত্তর মানবিক সংহতি। গোরাকে দেখে তার অনুগামীদের সঙ্গে তার দর্শনার্থীরা শিখছিল নতুন বাচনভঙ্গি। পথের কোনও শিশুকে নাম জানতে নবদ্বীপের সব বয়সের মানুষ যখন জিজ্ঞেস করত, ‘হ্যাই কার পোলা তুই, তুহেবর নাম ক্যা?” গোরা তখন বদলে দিল প্রশ্নের ভাষা, সে বলত, বাছা, তোমার নাম কী, তোমার বাবার পরিচয়?

বয়স্ক মানুষের গলায় এমন নরম, স্নেহজড়ানো ভাষা শিশুটি আগে শোনেনি। অবাক হয়ে গোরাকে কয়েক মুহূর্ত দেখে সে-ও যতটা সম্ভব গুছিয়ে গোরার প্রশ্নের জবাব দিত। গোরাকে যারা চিনত না, তাকে রক্তমাংসের দেবতা ভেবে তারা ঢিপ করে প্রণাম করত। গদাধর এরকম কয়েকটা ঘটনা নিজের চোখে দেখেছে। গোরার কাছে শিশুরা বাড়তি সমাদর পেত। মা, বাবা, হারানো অনাথ শিশুদের সে ভাবত বালক-কৃষ্ণ। পিতৃপরিচয়হীন অচ্ছুৎ শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে গোরাকে চুমু খেতে, দরদর করে কাঁদতে দেখেছে গদাধর। তাকে পাড়ার বয়স্করা গদা, গদাই, গদু, মাধবের পো বলে ডাকলেও গোরা কখনও গদাধর ছাড়া অন্য নামে ডাকে না। গয়া থেকে দু’জনে ফিরে আসার পরে গোরার স্বভাব, কথাবার্তা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। তার সঙ্গে রোজ গোরার দেখা হলেও প্রথম মুখোমুখিতে কুশল জানতে প্রশ্ন করত গদাধর কেমন আছ?

গদাধরের জবাব শুনে জিজ্ঞেস করত, বাড়িতে মা, বাবা সকলে ভালো আছেন তো?

গোরার সঙ্গে তার মুখের ভাষাও সমান সুন্দর হয়ে উঠছে, গদাধর টের পায়। সঙ্কীর্তনের আসরে সম্প্রতি গদাধরকে ‘সখা’ বলে গোরা ডাকতে শুরু করলে, নিতাই প্রশ্ন করেছিল, আমাকে কী বলে ডাকবে?

এক মুহূর্ত না ভেবে গোরা বলেছিল, ‘তুমি আমার ‘মিতা’ আমি ‘মিতে’ বলব তোমাকে।

অনুগামীদের অনেকে এরকম কানজুড়োনো নাম পেতে কলরোল জুড়তে তাদের থামাতে দুটো বন্ধ ঠোঁটের সামনে তর্জনী তুলে দু’চোখে এমন মনোরম ভঙ্গি করল, নিমেষে নিস্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। গোলমাল যে এত নীরবে, হৃদয়গ্রাহী অভিব্যক্তিতে থামানো যায়, যাদের বোঝার, অদ্বৈত, শ্রীবাস, নিতাই, গদাধর, হরিদাস প্রমুখ বুঝে গেল। গোরা বলল, তোমরা সকলে আমার মহামূল্য অলঙ্কার, কপালে, মুখে চন্দনে আঁকা অলকাতিলকা, জন্ম-জন্মান্তরের আত্মীয়, তোমরা কি তা জানো না? নিশ্চয় জানো।

অদ্বৈতের চোখে চোখ রেখে বলল, আপনি ভালোই জানেন, আপনি কে? আপনি হলেন কৈলাসবাসী নটরাজ শিব, আমাদের শ্রীবাস পণ্ডিত ছিলেন তম্বুরাবাদক, সুরজ্ঞানী মহামুনি নারদ, আমার মিতে নিতাই, দ্বাপর যুগে ছিলেন হলধর বলরাম, ছোটভাইকে বাঁচাতে কলিযুগে নতুন মূর্তিতে অবতীর্ণ হয়েছেন

নরহরি নতুন নাম চাইতে মুচকি হেসে গোরা বললে, তুমি ছিলে বৃন্দাবনের মধুমতী, আমার ষোলোশ’ গোপিনীর একজন, এখন শ্রীখণ্ডের নরহরি।

তার গ্রামের নাম, খণ্ড। গোরার মুখে তা মুহূর্তে শ্রীখণ্ড’ হয়ে যেতে আনন্দে বিগলিত নরহরি জিজ্ঞেস করল, আমার দাদা কী ছিল?

ব্রজের বৃন্দাদূতী। শ্রীখণ্ডের মুকুন্দদাস সরকার ছিল আমার সখি বৃন্দা

নরহরির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিতাইকে গোরা বলেছিল, মিতে, তাহলে কাল থেকে নামভিক্ষায় হরিদাস ঠাকুরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়। ভিক্ষে একটাই ‘কৃষ্ণ ভজ, কৃষ্ণ বল, কর কৃষ্ণ শিক্ষা’। একমুঠো চাল কেউ দিলে নেবে, না দিলে চাইবে না। এর নাম মাধুকরী। ভিক্ষের চাল নিয়ে শেষ দুপুরে গঙ্গার ধারে নির্জন গাছতলায় বসে শুকনো কাঠ, পাতা কুড়িয়ে, আগুন জ্বেলে, নতুন মালসায় ভাত ফুটিয়ে দুটো কলাপাতায় দু’জনে খেয়ে নেবে। খাওয়ার আগে ভাতের মালসায় দুটো তুলসিপাতা ফেলে দিলে পোকামাকড় আসবে না। ভাতের সঙ্গে কোনও একটা শাক, থোড় সেদ্ধ করে নুন ছিটিয়ে খেলে উপাদেয় লাগবে। খাওয়া শেষ করে সেই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার আগে উনুনের আগুন নিভিয়ে, মালসা ভেঙে, এঁটো কলাপাতা জড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে। সামান্য উচ্ছিষ্ট যেন কোথাও না পড়ে থাকে। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাবে না, এর নাম মাধুকরী, তোমাদের কল্যাণে, এটাই বৈষ্ণবসমাজের ব্রত হয়ে উঠুক।

নাম প্রচারে নেমে পেছনে ফিরে তাকাতে নেই, এই নীতিনির্দেশ নিতাই-এর অজানা ছিল না। রোজ দু’লক্ষ হরিনাম জপের প্রতিজ্ঞায় অবিচল হরিদাস ছিল আত্মমুখী সাধক। জপের সূত্রে ক্রমশ একা, আরও বেশি একা হয়ে ইষ্টদেবতার সান্নিধ্য উপলব্ধি করতে শুরু করেছিল। অনুধ্যানের পথে নেমে নামভিক্ষা করে বেড়ানোও জপতপের অংশ, গোরার এই ব্যাখ্যা মেনে নিলেও নির্লিপ্ত হরিদাসের মনে সঙ্কোচ ছিল। আগ্রহও কম ছিল না। নিতাই-এর ওপর অগাধ ভক্তি ভালবাসা থাকলেও সঙ্গি হিসেবে সে কতটা নির্ভরযোগ্য হবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। মানুষটার চালচলন প্রকৃতই পুরাণের হলধর বলরামের মতো। সন্ন্যাসী হলেও তার চালচলনে রাজকীয়তা ঠিকরে পড়ছে। প্রথম দর্শনে ভোগী মানুষ মনে হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ত ভোগ্যবস্তু সম্পর্কে তার সীমাহীন উদাসীনতা। গম্ভীর আলোচনায় বহু সময় কাটিয়ে পরের মুহূর্তে অর্ধনগ্ন শিশুর মতো নাচানাচি করত।

প্রথম দু’দিন নাম প্রচারে নেমে গাদিগাছা আর পারমেদিয়া এলাকা নিতাই প্রায় একাই মাতিয়ে রেখেছিল। ঠুনঠুন করে খঞ্জনি বাজিয়ে, নিতাই-এর সুরেলা, উদাত্ত কণ্ঠস্বরের সঙ্গে যতটা সম্ভব গলা মিলিয়ে ‘হরি হরয়ে নমো, কৃষ্ণ যাদবায়ো নমো, যাদবায়ো মাধবায়ো গোবিন্দায়ো নমঃ’ গেয়েছে। নিতাই-এর সুরের গমকে চাপা পড়ে গিয়েছিল তার গলার মিনমিনে আওয়াজ। মনে মনে তখনও সে নামজপ করে যাচ্ছিল।

নামভিক্ষার তৃতীয় দিনে শঙ্করপুর, বাবলারী, দেওয়ানগঞ্জের পথে আধঘণ্টা হাঁটার মধ্যে খোলের ওপর নিতাই একটা চাঁটিও না দিতে তাকে রসিকতা করে হরিদাস জিজ্ঞেস করল, কুমিরের পিঠে চেপে গোলোক ঘুরে এসে এত ঝিমিয়ে পড়লে কেন ভাই? এতক্ষণে একবারও নাম উচ্চারণ করলে না, খোলে চাঁটা লাগালে না, কী ব্যাপার? আমি একা কত খঞ্জনি বাজাব, আর নামভিক্ষে চাইব? আপনিও মুখ খুলুন।

নিতাই গম্ভীর, হরিদাসের প্রশ্নের জবাব দিল না। হরিদাস বলল, ‘কৃষ্ণ বল’ বলতে বলতে আমার গলা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল প্রভু।

নিতাই বলল, আজ আকাশ ঘন নীল, ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, নেশা ধরে যাচ্ছে আমার, নেশা করতে ইচ্ছে করছে।

নামভিক্ষের কী হবে? মহাপ্রভু আমাদের সেই কাজেই তো পাঠিয়েছেন।

ভিক্ষে-টিক্ষে করতে আমি পারব না। তুমি বরং মহাপ্রভুকে ডেকে নিয়ে ভিক্ষেতে বেরোও।

হরিদাসের মাথায় বাজ পড়ল। স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। কৃষ্ণের অবতার গোরা যে আদেশ নিজের মুখে দিয়েছে, তা নিতাই এমন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে, হরিদাস বিশ্বাস করতে পারছিল না। কুমিরের পিঠে চেপে গোলোকধামে গিয়ে নারায়ণের সঙ্গে দেখা করে কি তার মাথার গোলমাল হয়ে গেল? অসম্ভব কিছু নয়। পুরো প্রকৃতিস্থ মানুষ তাকে বলা যায় না, ঈষৎ ছিটেল বলা-ই ভালো। নামপ্রচারের প্রথমদিনে পথে একটা ষাঁড়ের পিঠে উঠে চেপে বসে ‘আমি মহেশ, আমি ভোলানাথ শিব’, নিতাই হুঙ্কার দিয়ে এমন নাটক করেছিল, যে তাকে ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল। পথের মানুষ মজা পেয়েছিল। দু’একজন বয়স্ক, বিরক্ত গলায় বলেছিল, যত সব ভণ্ড, প্রতারক, সাধু, মধুমতী সিদ্ধি রপ্ত করে পঞ্চকন্যা নামিয়ে রাতভর মজা মারছে।

ষাঁড়ের পিঠ থেকে নিতাইকে নামিয়ে পালাতে পারলে হরিদাস তখন বাঁচে! ষাঁড়ও খেপে গিয়ে পিঠ থেকে তাকে ফেলে দেওয়ার জন্যে বিশাল শরীর ঝাঁকাচ্ছিল। তার ঘাড়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে জীবটাকে পোষা ঘোড়ার মতো শান্ত করে একসময় টুক করে সেটার পিঠ থেকে নেমে পড়েছিল নিতাই। পেছন ফিরে না তাকিয়ে নিজের রাস্তায় হেলেদুলে ষাঁড়টা চলে গিয়েছিল। মজা দেখতে যারা জড়ো হয়েছিল, পাতলা হয়েছিল তাদের ভিড়। চঞ্চল স্বভাবের এই মানুষটা গতকালও ছোটখাট এক উপদ্রবে জড়িয়ে পড়েছিল। মাঝদুপুরে নামভিক্ষার পর্ব চুকিয়ে বিদ্যানগর শ্রীরামপুরের পথে আমবাগানে কাঠকুটো জ্বেলে ভাতের মালসা উনুনে চাপিয়ে হরিদাস দেখল, মাঠে খোটায় বাঁধা একটা দুধেল গোরুর পেছনের দুটো পা নিজের উড়ুনিতে শক্ত করে জড়িয়ে সেটাকে চলচ্ছক্তিহীন করে তার বাঁটে মুখ লাগিয়ে দু’চোখ বুজে নিতাই দুধ খাচ্ছে। আরামে বুজে যাচ্ছে তার দু’চোখ। মাঝে মাঝে মাথা দিয়ে গোরুটার পালানে সে ঢুঁ মারতে স্নেহে খাড়া হয়ে উঠছিল তার গায়ের লোম। নিতাই-এর দুধ খাওয়ার মধ্যে তিড়িং বিড়িং করে দৌড়ে, হাম্বা ডাক ছেড়ে এক বাছুর এসে মায়ের পালানে ঝাঁপিয়ে পড়ল, মায়ের দুধ খেতে ক্ষুধার্ত বাছুর এসে গেছে টের পেয়ে তাকে গলা জড়িয়ে নিজের পাশে টেনে নিল নিতাই। মায়ের দুধের বাঁট গুঁজে দিল বাছুরের মুখে। দুই সহোদর ভাই-এর মতো দু’জনে পাশাপাশি দুটো বাঁট থেকে দুধ খেতে যখন ব্যস্ত তখন লাঠি হাতে যে এসে দাঁড়াল, সে যে গোরুর মালিক একনজরে, হরিদাস বুঝে গিয়েছিল। বাছুরের সঙ্গে গেরুয়াবসন এক সাধুকে গোরুর বাঁটে মুখ লাগিয়ে দুধ খেতে দেখে সে এমন হতভম্ব হয়ে গেল যে তার মুখ দিয়ে কথা সরল না। হাতের লাঠিটার দিকে একবার তাকিয়ে, সেটা দিয়ে নিতাইকে খোঁচা দিতে গিয়েও তা না করে বলল, ও মশাই, বাছুরটাকে মায়ের দুধ খেতে দেবেন তো?

তার কথায় কান না দিয়ে বাছুরের গলা জড়িয়ে পাশাপাশি দু’জন দুধ খেতে লাগল। ভালোরকম একটা বিপত্তি ঘটতে চলেছে, অনুমান করে রান্নার উনুন ছেড়ে হরিদাস এসে দাঁড়াল অচেনা মানুষটার পেছনে। দু’চোখ বুজে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে জাবর কেটে চলেছে মা-গোরু। উড়ুনিতে বাঁধা পেছনের পা দুটো একটু আগে অস্বস্তিতে মাটিতে ঠোকাঠুকি করলেও এখন তার কোনও বৈক্লব্য নেই। মাঝে মাঝে নিজের পিঠের ওপর চামরের মতো লেজটা বুলিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। বাছুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে নিতাই এবার নিজের ইচ্ছেতে উঠে দাঁড়িয়ে গোরুর মালিককে বলল, ‘কৃষ্ণ ভজ, কৃষ্ণ বল, কর কৃষ্ণ শিক্ষা’।

দশাসই শরীর, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, সন্ন্যাসীর জ্বলজ্বলে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে লোকটা বিশেষ কিছু না বুঝে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বলতে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিতাই বলল, ভাই তোমার এই গোরুটি কামধেনু। মায়ের দুধের মতো অফুরন্ত এর দুধ। দুধ খেতে গিয়ে টের পেলাম এর পেটেও একটি বাছুর রয়েছে। সেটাও বকনা বাছুর, সেও কামধেনুর মতো অঢেল দুধ দেবে।

সন্ন্যাসীর কথাতে খুশিতে ভরে উঠল অচেনা মানুষটির মুখ। সে প্রথমে নিতাইকে, পরে হরিদাসকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। অচেনা মানুষের গাইগোরুর দুধ খাওয়া নিয়ে মস্ত একটা ঝামেলা সহজে এড়িয়ে যেতে পেরে হরিদাস খুশি হয়েছিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দু’জনে মালসা ভোগ খেতে বসে গেল। দুধ খাওয়ার প্রসঙ্গ পেড়ে হরিদাস টের পেল ঘটনাটা ইতিমধ্যে নিতাই ভুলে গেছে। অন্য মজায় তখন সে মেতে উঠেছে। ভাতের মালসাটা মাটিতে আছড়ে ভাঙার বদলে দূর থেকে একের পর এক ইটের টুকরো ছুড়ে সেটা ভাঙতে চেষ্টা করছিল। হরিদাসকে বলছিল, ঠাকুর, তুমিও এসো।

ছেলেমানুষী খেলায় হরিদাস গেল না। তখনই এক টুকরো ইঁটে মাটির মালসা ফুটিফাটা হয়ে যেতে খুশিতে হা হা করে হেসে উঠেছিল নিতাই। হাততালি দিয়ে নেচে নেচে শুরু করেছিল কীর্তন।

গেল দু’দিনের সেই হাসিখুশি মেজাজটা হঠাৎ কেন এমন তিরিক্ষি হয়ে উঠল, হরিদাসের মাথায় ঢুকল না। সে-ও একটু বিরক্ত হয়ে নিতাইকে জিজ্ঞেস করল, নাম প্রচারে সায় না থাকলে তুমি এলে কেন?

নাম প্রচারেই আমি এসেছি, তবে তোমাদের মতো ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ ‘হরি হরি’ আমি করতে পারব না।

নিতাই-এর কথা শুনে চমকে গেল হরিদাস। লোকটা নাস্তিক নাকি? অবধূত সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরীশ্বরবাদী কিছু লোক আছে, নিতাই তাদেরই একজন হরিদাস ভাবল। সে প্রশ্ন করল, পরশু আর কাল সারাদিন তো তুমি কৃষ্ণভিক্ষা করে বেড়ালে, আজ উল্টো গাইছ কেন?

মুচকি হেসে নিতাই বলল, আমাদের গোরা তো কলিযুগে কৃষ্ণ অবতার। ঠিক কি না?

তা ঠিক।

চোখের সামনে সেই ভগবান থাকতে দ্বাপরের কৃষ্ণের নাম প্রচার করব কেন?

কী বলতে চাও তুমি?

রক্তমাংসের ভগবানকে ছেড়ে ভাগবত শাস্ত্রের ভগবান নিয়ে অকারণ মাতামাতি আমার পছন্দ নয়।

নিতাই-এর কথাগুলো হরিদাসের কানে হেঁয়ালির মতো ঠেকছিল। নিতাই বলল, আসলে মানুষের দেহধারী ভগবানকে আমরা বিশ্বাস করি না। তাকে ঈশ্বরের অবতার বললেও সে ঈশ্বর কিনা, সন্দেহ করি। আমরা সবাই, তুমি আমি, শ্রীবাস, গদাধর, অদ্বৈত সকলেই নাস্তিক

নিতাই-এর কথায় ভয় পেয়ে হরিদাস দ্রুত নামজপ করতে শুরু করলে তাকে থামিয়ে নিতাই বলল, ঠাকুর, তোমার জপ থামিয়ে আমার সঙ্গে গলা মেলাও।

হরিদাসের ঠোঁট নাড়া থামার আগেই নিতাই যে নামগান শুরু করল, সেখানে কৃষ্ণ নেই, হরি নেই, রক্তমাংসের এক মানুষ, যে কিনা ঈশ্বরের অবতার, তার প্রশস্তি প্রবাহিত হতে থাকল।

‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে
যে জন গৌরাঙ্গ ভজে সে হয় আমার প্রাণ রে।’

গৌরাঙ্গ, অর্থাৎ গোরাকে নিয়ে নিতাই-এর বাঁধা কীর্তন শুনে ভক্তিতে উদ্বেল হয়ে উঠল হরিদাসের বুক। পথচারীদের অনেকে দাঁড়িয়ে পড়ে গৌরাঙ্গ নাম প্রচারে সোৎসাহে ভিড়ে গেল। দিনের মতো নামভিক্ষের শেষে হরিদাসকে নিতাই বলল, এখন থেকে যেখানে যত কীর্তনের আসর বসবে, গোরার ভজনা না করে সেখানে কেউ পালাগান শুরু করতে পারবে না। সঙ্কীর্তনকারীরা নিজেদের হৃদয়ের তাগিদে এই প্রথা মেনে নেবে। অদৃশ্য ভগবানের চেয়ে রক্তমাংসের মানুষের চেহারায় ভগবানকে তারা আদর করে গোড়ায় জায়গা করে দেবে। এই আখরের নাম হবে গৌরচন্দ্রিকা।

নিতাই-এর কথা শুনে আনন্দে ভরে উঠল হরিদাসের মুখ। সে শুধু বলল, হাতের কাছে রক্তমাংসের ভগবানকে পেয়েছি জেনে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! জয় গৌরহরি, জয় গোরা, হরেকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ।

হরিদাসের খাপছাড়া নামজপ শুনে নিতাই ঠোঁট টিপে হাসল। তখনই তার চোখে পড়ল, রাস্তার ধারে পাথরের বেদিতে নবদ্বীপের দুই কোটাল, জগন্নাথ আর মাধব, এলাকার মানুষ যাদের চেনে জগাই-মাধাই নাম, তারা মাটির ভাঁড়ে দারু খাচ্ছে। তাদের পাশে মাটির যে কলসি রয়েছে, তার মধ্যে কতটা দারু রয়েছে, তা বোঝা না গেলেও কলসি খালি হয়নি, নিতাই টের পেল। জগাই-মাধাই দুই সহোদর ভাই, পাঁড় মাতাল, নবদ্বীপের সাধারণ মানুষের কাছে বিভীষিকা। খুন, জখম, লুঠপাট, ধর্ষণ, ঘরদোরে আগুন লাগানো, কোনও কাজে তাদের হাত কাঁপে না। গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের মনোনীত নবদ্বীপের কাজি, লোকে যাকে চাঁদ কাজি বলে ডাকে, তার পেয়ারের দুই কোটাল, এই দুই ভাই। হৃদয়হীন, জহ্লাদ প্রকৃতির এই দুই কোটাল, যা খুশি করতে পারে। নিরীহ নবদ্বীপাবাসী শুধু তাদের ভয় পায়, এমন নয়, দু’জনের নজর এড়িয়ে চলে। জগাই মাধাইকে হরিদাস চিনলেও নিতাই শুধু তাদের নাম শুনেছিল। কাঞ্চনতলায় গঙ্গার ধারে সুলতানি তোরণের মধ্যে শেষ দুপুরে তাদের দারু সেবন করতে দেখে ফ্যাকাসে হয়ে গেল হরিদাসের মুখ। তাদের চোখ এড়াতে সামনে আর এগোতে হরিদাস ভরসা পেল না। উল্টোমুখে সে হাঁটতে শুরু করতে নিতাই বলল, কী হল ঠাকুর, পথ বদলালে কেন?

হরিদাস বলল, পেছনে তাকিও না, যেমন হাঁটছি, সেভাবে আমার পাশাপাশি এসো।

নিতাই দাঁড়িয়ে গেল। হাত ধরে হরিদাসকে দাঁড় করিয়ে পেছনে তাকিয়ে দু’জন ষণ্ডাগণ্ডা লোককে দেখে বলল, বুঝেছি, এদের ভয়ে তুমি উল্টোমুখো হাঁটতে শুরু করেছ, এরা কারা?

জগাই-মাধাই।

পেছনে না তাকিয়ে মিনমিন করে হরিদাস নাম দুটো বলতে মৃদঙ্গে দুই চাঁটা মেরে দ্রিমদ্রিম আওয়াজ তুলে নিতাই বলল, নামভিক্ষে করার জন্যে অতি উত্তম দু’জন ভিক্ষাদাতা পেয়েছি চল, ওদের সামনে গিয়ে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে দাঁড়াই।

খেপেছ? প্রাণে মরতে আমি রাজি নই।

হরিদাসকে ভয়ে কাঁপতে দেখে নিতাই বলল, যশোরের মুলুকপতির শত নির্যাতনে যে হরিদাস কৃষ্ণনাম ছাড়েনি, যাকে বাইশ বাজারে মুলুকপতির পাইকরা পিটিয়ে মৃত ভেবে রায়মঙ্গল নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল, তুমি সেই হরিদাস ঠাকুর হয়ে এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? আমি তো রয়েছি তোমার পাশে।

হরিদাস কিছুটা সাহস পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেও তোরণের দিকে পা বাড়াল না। তাকে নিতাই বলল, প্রাণের ভয় আমারও আছে। কিন্তু নামভিক্ষের দায় যখন নিয়েছি, তা ফেলে পালাই কী করে?

এক মুহূর্ত থেমে নিতাই বলল, একটা কাজ করা যেতে পারে। মিতেকে গিয়ে বলতে পারি, কৃষ্ণের অবতার সেজে শুধু শ্রীবাস আর চন্দ্রশেখরের আঙিনায় দলবল নিয়ে সঙ্কীর্তন করলে চলবে না। অবতার স্বয়ং ঘরে বসে থাকবে আর তার চেলারা নাম প্রচারে বেরিয়ে গুণ্ডা-বদমাশদের মার খেয়ে হাত, পা ভেঙে পড়ে থাকবে, এ চলতে পারে না। জগাই মাধাই-এর মতো পাপিষ্ঠদের হরিবোলা করতে গোরাকে পথে নামতে হবে। পাপীতাপী ইতরদের মুখোমুখি হয়ে তাদের কাছে নামভিক্ষে করতে হবে।

নিতাই-এর পরামর্শ হরিদাসের মনে ধরলেও গোরার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো কীভাবে বলবে ভেবে পেল না। মারধর খাওয়ার কথা শুনে শরীরের কোথায় আঘাত হয়েছে গোরা যদি জানতে চায়, ক্ষতের জায়গা দেখতে চায়, তখন কী হবে? কুলশীলহীন এক ছিটেল অবধূতের পাল্লায় পড়ে প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যের আশ্রয় সে নিতে পারবে না। হরিদাসের মুখ দেখে নিতাই বুঝল, ঠাকুর বেকায়দায় পড়ে গেছে। সে আবার বলল, চল, ফিরে যাই।

নিতাই-এর কথা শেষ হওয়ার আগে তোরণের ভেতর থেকে বাজখাঁই গলায় একজন হুঙ্কার দিল, অ্যাই, হারামখোররা, আমাদের দু ভাইকে নিয়ে তোরা কী গুজগুজ করছিস। এখনি এদিকে আয়, দেখি তোরা কতবড় সাধু!

ভয়ে পিলে চমকে গেল হরিদাসের। নিতাইকে করুণ গলায় সে জিজ্ঞেস করল, এখন কী হবে?

কী আবার হবে। ওরা যখন ডেকেছে, পালানোর উপায় নেই। যেতে হবে।

হেমন্তের শেষ দুপুরে মেঘ জমছিল আকাশে। গঙ্গার দিক থেকে হু হু করে যে হাওয়া বইতে শুরু করেছিল, তা বেশ ঠাণ্ডা। গঙ্গায় তাহলে ষাঁড়াষাঁড়ির বান ডেকেছে। ঝড়, জল হতে পারে। দু’জনে গুটি গুটি পায়ে জগাই-মাধাই-এর সামনে এসে দাঁড়াতে মাধাই চেঁচিয়ে উঠল, তোদের পরিচয় কী? আমাদের নিয়ে কী কথা বলছিলি তোরা?

নিতাই বলল, আমি ভিনদেশি অবধূত।

হরিদাস বলল, আমি হরিবোলা, আমি বৈষ্ণব

কলসির তলানি মদ দুটো মাটির ভাঁড়ে সমান মাপে ঢেলে জগাই বলল, দুটোই ভণ্ড, চোর।

হুম!

মাধাই গর্জন করল। কী বলাবলি করছিলি তোরা?

নিতাই বলল, আপনাদের কাছে ভিক্ষে চাওয়া উচিত হবে কি না, সেই নিয়ে কথা কইছিলাম!

দারুর ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে হা হা করে হেসে জগাই জিজ্ঞেস করল, আমাদের চিনিস?

নিতাই বলল, আপনাদের হাবভাবে মনে হচ্ছে, আপনারা বেশ কেউকেটা, সুলতানি দরবারের কর্মচারী হতে পারেন।

হুম্, ঠিক ধরেছিস। আমরা দুই ভাই, নবদ্বীপের দুই কোটাল। ইচ্ছে করলে তোদের মুণ্ডু দুটো কেটে এখনই আমরা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে পারি। কেউ আমাদের ঠেকাতে পারবে না। নবদ্বীপের আইন আদালতের কর্তা, চাঁদ কাজি হলেন আমাদের মুরুব্বি। আমাদের কথাতে তিনি সুলতানি নথিতে লিখে দেবেন, নবদ্বীপের দুই কোটাল নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ভণ্ড সাধুর ভেকধারী দুই খুনে ডাকাতের গলা কেটে তাদের গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে।

সামনের রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছে, তাদের কেউ ট্যা ফোঁ করবে না। পথের দিকে আঙুল তুলে মাধাই যখন কথাটা বলছে, নিতাই তাকাল সেদিকে। হাটে সওদা বেচে খালি চুবড়ি মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরছিল শ্রীধর। দুই নররাক্ষসের হেফাজতে নিতাই আর হরিদাসকে জমা পড়ে যেতে দেখে ধড়াস করে উঠল তার বুক। হাঁটার গতি বেড়ে গেল। দু’জন ফালতু সাধুর সঙ্গে অযথা বকবক করতে দারুর নেশায় টইটম্বুর জগাই-এর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। দু’জনের পশ্চাতে দুই লাথি কষিয়ে তাদের যখন বিদায় করে দেওয়ার কথা মাধাই ভাবছে, ঘুমে বুজে আসা আধখোলা দু’চোখে জগাই বলল, যা ভাগ, এখনি ভাগ, না গেলে কাপড় খুলে নেব।

রাস্তা দিয়ে শ্রীধরকে যেতে দেখে নিতাই সাহস পেয়েছিল। গোরার অনুরক্তদের একজন, খোলাবেচা শ্রীধর। হাটে বসে থোড়, মোচা, কলাপাতা বেচে সে। অগ্রদানী বামুন হলেও তার পড়শিরা তাকে শূদ্রের অধম ভাবে। তার মনে পড়শিদের অনাদর দাগ কাটে না। সে জানে তাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে, গোরা। গোরার বাড়িতে, শ্রীবাসের আঙিনায় সঙ্কীর্তনের আসরে তার অবাধ যাতায়াত। জগাই তাড়াতে চাইলেও তাদের সঙ্গে আরও কিছুটা সময় কাটাতে স্বভাবসুলভ বিনয়ের সঙ্গে নিতাই বলল, আমাদের যে একটা ভিক্ষে ছিল।

ভিক্ষে!

ঘুমজড়ানো গলায় জগাই কথাটা উচ্চারণ করলেও ভিক্ষেটা কী, জানতে চাইল না। নিতাইকে পেটাতে মাধাই তেড়ে এল। কিছু ভেবে গায়ে হাত তুলল না। বলল, তুই বলিস কি, আমরা কেন ভিক্ষে দেব, কাজির দপ্তর থেকে আমরা ফি মাসে যত তলব পাই, তার দশগুণ নজরানা যেচে আমাদের হাতে দিয়ে যায় নবদ্বীপের মানুষ। কোন সাহসে তুই আমাদের কাছে ভিক্ষে চাইছিস? যা, পালা এখান থেকে। চোখের সামনে থেকে এখনি সরে না গেলে তোদের ভিক্ষের ঝুলিতে যা আছে, সব এখনি কেড়ে নেব।

পাথরের মূর্তির মতো ভয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল হরিদাস। নিতাই বলল, আমাদের ঝুলিতে এক মুঠো চাল, ডাল, এমনকী একটা কানাকড়ি পর্যন্ত নেই।

আবছা ঘুমের মধ্যে জগাই বলল, যমের অরুচি। কে ভিক্ষে দেবে?

আজ্ঞে, অনেক মানুষ ভিক্ষে দিয়েছে।

নিতাই-এর কথাতে চোখ কচলে জগাই বলল, দেখি তোদের ঝুলি। ঝুলিতে নেই।

কোথায় রেখেছিস?

বুকে, হৃদয়ের মধ্যে।

নিতাই-এর কথা শুনে মাধাই আবার হুঙ্কার দিল, ছেনালপনা হচ্ছে? গলা টিপে তোদের দুটোকে এখনি মেরে ফেলব।

দু’জনকে গলা টিপে তখনই না মেরে তাদের ভিক্ষের ঝুলি কেড়ে নিয়ে মাধাই উল্টে দিলেও এককণা চাল, ডাল, মাটিতে পড়ল না। ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছিল মাধাই, নেশার ঘুম চটকে যেতে রাগে লাল হয়ে উঠেছে জগাই-এর দু’চোখ পাকা কালোজামের মতো টসটসে মেঘ ঢেকে ফেলছে আকাশ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। ফাঁকা পথ। ঘরমুখো মানুষ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। তোরণের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। নিতাই নরম গলায় বলল, ভাই জগন্নাথ, ভাই মাধব, তোমাদের কাছে আমরা যে ভিক্ষে চাই, তা ঝুলিতে রাখার নয়, আমাদের বুকে থাকবে। ভিক্ষে দিয়ে তোমরাও আনন্দ পাবে।

দুই কুলাঙ্গার এক মুহূর্ত নিজেরা মুখ চাওয়াচায়ি করে নিল। জগাই জিজ্ঞেস করল, ভিক্ষেটা কী শুনি?

‘কৃষ্ণ বল, কৃষ্ণ ভজ, কর কৃষ্ণ শিক্ষা।’

নিতাই-এর কথাটা জগাই কিছুটা আঁচ করতে পারলেও মাধাই-এর মাথায় ঢুকল না। জগাই নিজের মতো করে নিতাই-এর প্রার্থনা মাধাইকে শোনাতে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে দারুর খালি কলসিটা সে মাথার ওপর তুলে তোরণের শানবাঁধানো চাতালে আছড়ে ভেঙে ফেলল। সামান্য তফাতে ধুলোয় শুয়ে থাকা একটা কুকুর কেঁউকেঁউ করে ডাকতে ডাকতে পালিয়ে গেল। পাথরের মূর্তির মতো হরিদাস যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা ভয়ে নয়, জপে ভাবাবিষ্ট হয়ে ক্রমশ স্বরূপে ফিরে এসে খঞ্জনি বাজিয়ে সে গান ধরল—

‘হরি বোল মুগধা গোবিন্দা বোল রে
যাহা হৈতে নীহি হয় শমন ভয় রে।’

রিনরিনে সুরেলা গলায় হরিদাস গান শুরু করতে তার সঙ্গে মৃদঙ্গ বাজিয়ে গলা মেলাল নিতাই। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে দুই সাধুকে পিটিয়ে দুরমুশ করতে মাধাই যখন মুগুর খুঁজছে, জগাই-এর ঘুম ছুটে গেল। নিজের অস্ত্র, ধারালো পরশু সে কাছছাড়া করে না। পরশু তুলে সে যখন কাকে মারতে হবে ভাবছে, মুগুর খুঁজে না পেয়ে মাধাই তখনই ভাঙা কলসির মাথার কানাটা তুলে ছুঁড়ে মারল নিতাইকে। নিতাই-এর কপাল কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। তার ধড়, মুণ্ডু আলাদা করে দিতে জগাই-এর হাত থেকে পরশু ছিনিয়ে নিল মাধাই। রাগে অন্ধ হয়ে গেছে সে। দেবী চণ্ডীর ভক্ত দু’ভাই, মনসাপুজোতেও তারা হাজির থাকে। দুই দেবীর পুজোর উপচার কয়েক হাঁড়ি কারণবারির সঙ্গে মাংস, মাছ আর যতরকম খাদ্যাখাদ্য আছে, পেট পুরে খেয়ে মত্ত হয়ে নাচানাচি করে। তারপর দু’তিন রাত হাত-পা ছড়িয়ে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোয়। দুই বৈষ্ণব ভক্তের মুখ থেকে ‘কৃষ্ণ বল, কৃষ্ণ ভজ’ বুলি শুনে তাদের ধর্মাভিমানে এমন ঘা লাগল যে, আরাধ্য দুই প্রতিহিংসাপরায়ণা দেবীর মতো তারা সবকিছু ওলোটপালোট করে দিতে চাইল। নিতাই-এর ঘাড়ে মাধাই পরশুর কোপ বসানোর আগে ভাই-এর হাত চেপে ধরে জগাই বলল, ঠিক কী ঘটেছে, আগে আমায় বুঝতে দে। তারপর এই দুই ভণ্ড সাধুকে কেটে আমিই গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব।

শালারা আমাদের ধর্ম তুলে গাল দিয়েছে।

মাধাই আরও কিছু বলার আগে কাঞ্চনপুরের পথ থেকে ভেসে এল অনেক গলার সঙ্কীর্তনের সুর। কাঞ্চনতলার মেঠোপথ ধরে সঙ্কীর্তনের নাতিবৃহৎ যে শোভাযাত্রা এগিয়ে আসছে, তার সামনে গোরা, তার দু’পাশে অদ্বৈত, মুকুন্দ। অনেক মানুষের পায়ের ঘসটানিতে রাস্তায় ধুলোর কুণ্ডলি, আর মেঘের ছায়ায় আবছা হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। অদ্বৈতের পেছনে শ্রীবাসকে নিতাই দেখতে পেল। শ্রীধরের কাছ থেকে কোটালের কোপে নিতাই হরিদাস হেনস্থা হচ্ছে, খবর পেয়ে শ্রীবাসের বিষ্ণুমন্দিরে জমায়েত অনুগামীদের নিয়ে গোরা চটপট চলে এসেছে, দুই নামপ্রচারকের বুঝতে অসুবিধে হল না। নিতাই-এর কপাল দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝরলেও পরশু হাতে মারমুখি মাধাইকে সে বলল, ভাই কৃষ্ণ বল, কৃষ্ণ ভজ, তোমার যত পাপ সব আমি নিজে নিলাম। তুমি শুধু একবার ‘কৃষ্ণ’ বল, এই আমার ভিক্ষা।

মাধাই ফের পরশু হাতে নিতাইকে তেড়ে আসতে জগাই বলল, ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করিস না মাধাই। ভিনদেশি সাধু এরা, অবধূত না কী যেন বলল, নবদ্বীপের নিয়মকানুন জানে না; যেতে দে এদের।

সঙ্কীর্তনের বড়সড় শোভাযাত্রা যত এগিয়ে আসছিল, তত পাঁচ হাত লম্বা, দশাসই চন্দনগাছের লালাভ গুঁড়ির মতো শরীর গোরার দেবোপম মূর্তি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল মাধাই। মানুষটা যে অসীম ক্ষমতা ধরে, ইচ্ছে করলে তাকে তুলে আছাড় মারতে পারে, এমন এক ভয়, তার মনে ঢুকে পড়ল। মুরারি কবিরাজও কম বলবান নয়। মল্লযুদ্ধে বহু পালোয়ানকে কাত করে দিয়েছে। নবদ্বীপের দু’একটা বিখ্যাত আখড়ায় এখনও গৌড়, রাজগৃহ, গয়া, বারাণসীর ওস্তাদ পালোয়ানদের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমন্ত্রণমূলক মল্লযুদ্ধে বুক ঠুকে সে টেক্কা দেয়। পাঁচ-সাত মিনিটের লড়ালড়িতে প্রতিপক্ষকে চিৎপাত করে দিয়ে নবদ্বীপের সম্মান বাঁচিয়ে রাখে। তোরণের দু’পাশে সকাল থেকে দুই কোটাল যে পাঁচজন জাসুকে বসিয়ে রেখেছিল, তাদের কাউকে দেখতে পেল না। কাজির চর, এই জাসুদের মাসের তলব আসে গৌড়ের দরবার থেকে। তাদের হাতে সেটা তুলে দেয় কোটাল, খোদ কোটালের নিজের কিছু গুপ্তচর আছে, তাদের বলা হয় দানী। তিনমাস অন্তর, ত্রিশ কড়ি তারা মাইনে বাবদ নেয় কোটালের কাছ থেকে। জাসুরা একে অন্যকে চিনলেও দানীদের পরিচয়, শুধু কোটাল জানে। জগাই-মাধাই-এর তাঁবেদার জাসু আর দানীরা দুই কর্তাকে যমের মতো ভয় পেলেও কাজে ফাঁকি দিতে কসুর করে না। ওপরওয়ালা যেখানে দারু খেয়ে সারাদিন মাতোয়ারা হয়ে থাকে, অবাধে লুঠপাট করে বেড়ায়, এলাকার মানুষকে আপদবিপদ থেকে বাঁচানোর বদলে তাদের আরও বড় বিপদের দিকে ঠেলে দেয়, সেখানে তার অধস্তন কর্মচারীরা যে দুর্নীতিপরায়ণ, ফাঁকিবাজ হবে, কর্তার বিপদে নিজেরা গা ঢাকা দেবে, এটাই স্বাভাবিক। মাধাই এসব না ভেবেই হাঁক পাড়ল অ্যাই বেচু, পচা, জোঁক, কোথায় গেলি তোরা?

কেউ সাড়া দিল না। জগাই ভাবছিল অন্য কথা। নবদ্বীপের মানুষকে সে হাড়ে হাড়ে চিনে গিয়েছিল। বেশিরভাগ বিদ্যাদিগ্‌গজ, মহাপণ্ডিত, আসলে মহামুখ্যু, কারও বুকের পাটা নেই, সবাই ভীতু, কাপুরুষ, চুরুলিখোর, সামান্য বিপদে লেজ গুটিয়ে পালায় সে জেনে গিয়েছিল। সবচেয়ে ঘরকুনো বৈষ্ণবরা, তারা এখন আবার ‘হরিবোলা’ হয়ে জোট বাঁধছে। গোরাকে সামনে রেখে তাদেরই একদল কেন এগিয়ে আসছে, বুঝতে তার অসুবিধে হল না। ভিখিরি এই সাধু দুটো নিশ্চয়ই গোরার চেলা। চেলা দুটোকে উদ্ধার করে সঙ্কীর্তনের দল নিয়ে এগিয়ে আসছে। যত লোকবল থাকুক, গোটা দলটাকে পিটিয়ে ধরাশায়ী করতে তারা দু’ভাই যথেষ্ট। রক্ষিরা পালালেও এই তোরণে যা লেজা, বর্শা, মুগুর, পরশু, রায়বাঁশ রয়েছে, তা দিয়ে ফলারে বামুনগুলোকে অল্পসময়েই পিটিয়ে শায়েস্তা করে দেওয়া যায়। দু’একজন সঙ্গীর শরীর থেকে লেজার কোপে রক্ত ঝরতে দেখলে বাকিরা চেঁাচা দৌড় লাগাবে। তেমন কিছু করা সম্ভব হলেও, করবে কি না, ভেবে জগাই-এর মনে খটকা লাগল। চাঁদ কাজির কথা থেকে ঠারেঠোরে সে বুঝেছে, নবদ্বীপের গোঁড়া বামুনদের বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে গৌড়ের দরবার থেকে বৈষ্ণবদের প্রশ্রয় দেওয়ার নীতি কিছুদিন আগে নেওয়া হয়েছে। সুলতানি দরবারের সিন্ধুকিদের দু’একজন আভাসে সেরকম জানিয়েছে জগাইকে। তবুও যে মাঝে মাঝে গৌড় থেকে জলপথে নৌকোয় সুলতানের পাইক বরকন্দাজরা নবদ্বীপের বৈষ্ণবদের ধরে নিয়ে যেতে আসছে, গুজব রটে, তার কারণও দরবারের কূটনীতি। নবদ্বীপের স্মার্ত, ন্যায়শাস্ত্রী, তন্ত্রসাধকদের খুশি রাখতে দরবারের নির্দেশে সিন্ধুকিরাই এসব গুজব রটায় মহামহোপাধ্যায়রাও গুজবে ইন্ধন জোগায়। পাইক বরকন্দাজ ভর্তি সুলতানি নৌবহর, কে কোথায় দেখেছে, জলঙ্গিতে অথবা গঙ্গায়, সে খবর এক কান থেকে হাজার কানে পৌঁছে যায়। তারা চেষ্টা করে বৈষ্ণবদের কোণঠাসা করতে। নবদ্বীপে ঈশ্বরের অবতার গোরাকে ঘিরে হেটোমেঠো মানুষের ভিড় বাড়ছে, গৌড়ের দরবারে এ বার্তা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। পৌঁছে দিয়েছিল সিন্ধুকিরা।

বৈষ্ণবদের দল পাকানোতে দরবারের গোপন সায় থাকলে, তিলকধারী এই মানুষগুলোকে জগাই ঠ্যাঙায় কীভাবে? তার সব কাজে চাঁদ কাজি মদত দিলেও গৌড়দরবারের অপছন্দ মারদাঙ্গা নিশ্চয় বরদাস্ত করবে না। সে আর এক বিপদ। সবচেয়ে বড় কথা, যা আগে কখনও ঘটেনি, গোরা আর তার দলবলকে দেখে জগাই-এর মনে এই প্রথম ভীতি ছড়িয়ে পড়ল, অচেনা ভয়ে নেশা ফিকে হয়ে যেতে থাকল। শোভাযাত্রার সামনে গোরার শরীরটা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ক্রমশ বড় হতে দেখল সে। লোকমুখে গোরাকে কৃষ্ণাবতার রটনাতে তার মনে হল, ফাঁকি নেই। আকাশের দিকে দু’হাত তুলে গোরা নাচছিল। মাধাই দেখল, গোরার লম্বা দুটো হাত প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আকাশ। অন্ধকার নেমে আসছে পৃথিবীতে। সোনালি বর্শার মতো বিদ্যুতের ধারালো রেখা আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চিরে ফেলতে, জগাই দেখল, গোরার ডান হাতের তর্জনীর ডগায় উদ্যত সুদর্শন চক্র লক্ষ্যভেদ করার জন্যে স্থির হয়ে আছে। বিশ্বসংসারবিনাশী অস্ত্রটা কৃষ্বাবতারের নির্দেশের জন্যে অপেক্ষায় তিরতির করে কাঁপছে। বিকট আওয়াজে গঙ্গার ওপরে যখন বাজ পড়ল, তোরণের সামনে এসে থেমে গেল। রক্তে ভিজে যাওয়া শরীরে নিতাই গাইছে ‘কহ গৌরাঙ্গ, ভজ গৌরাঙ্গ, জপ গৌরাঙ্গের নাম রে।’

তাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে গোরা জিজ্ঞেস করল, তোমার কপাল থেকে এত রক্ত ঝরছে কেন, কে মারল তোমাকে?

গোরার প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে গিয়ে নরম গলায় নিতাই বলল, কৃষ্ণ বল, ভাই জগন্নাথ, ভাই মাধব, কৃষ্ণ বল।

জগাই কী করা উচিত, ভেবে যখন দিশেহারা, পরশু হাতে মাধাই তর্জন গর্জন করে চলেছে। দুর্যোগে আকাশ ভেঙে পড়তে চলেছে জেনেও সঙ্কীর্তনের শোভাযাত্রাতে কাঞ্চনপল্লীর সঙ্গে আশপাশের সমুদ্রগড়, চাঁপাহাটি, রাহুতপুর, মহেশগঞ্জ, সবডাঙা, সিমুলগাছির বেশ কিছু বাসিন্দা ঢুকে পড়েছে। সঙ্কীর্তনের দল নিয়ে জগাই-মাধাইকে সহবত্‌ শেখাতে গোরা পথে নেমেছে, খবরটা যে কোনওভাবে কাছাকাছি পাড়ার মানুষ জেনে গেছে। গোরাকে সামনে নেতা হিসেবে পেয়ে, দুই কোটাল সম্পর্কে তাদের আতঙ্ক অনেকটা কেটে গেছে। মানুষের ভিড় দেখে মাধাই-এর ইজ্জতবোধ চাগাড় দিয়ে উঠল। পরশু দিয়ে নিতাইকে কোপাতে সে হাত তুলতেই আকাশের দিকে হাত তুলে তার কাঁধের কাছটা গোরা সজোরে চেপে ধরতে মাধাই-এর হাতের পরশু খসে পড়ল। আকাশে ছড়িয়ে পড়ল মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ। জগাই দেখল, গোরার তর্জনীতে একটু আগে দেখা সুদর্শনচক্র প্রাণ পেয়ে ঘুরছে। গোরার মূর্তি দেখে তাকে শান্ত করতে নিতাই বলল, মিতে, জগাই আমাকে বাঁচিয়েছে। তুমি ওকে কৃপা করো।

নিতাই-এর কথা শুনে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল গোরা। বলল, কৃষ্ণ বল, জগাই।

হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জগাই ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বলে যেতে থাকল। নিতাই-এর শরীর থেকে মাধাই রক্ত ঝরিয়েছে, অনুমান করে, তার ওপরে হনুমানের মতো বলবান মুরারি ঝাঁপিয়ে পড়তে তাকে ঠেকাল নিতাই। বলল, ভাই মুরারি, মাধাই-এর সব পাপ আমি নিলাম। আমার যদি সামান্য কিছু সুকৃতি থাকে ওকে দিলাম। ও এখন চন্দনের মতো পবিত্র, নিষ্পাপ, তুমি ওকে রেহাই দাও। আমার মিতে নিশ্চয়ই মাধাইকে ভক্তির স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

গোরার পায়ের ওপর জগাই তখনও বেহুঁশের মতো পড়ে রয়েছে। নিতাই-এর কথা শুনে গোরার বুকের ভেতরটা জুড়িয়ে গেল। মাধাইকে গোরা বলল, আমার প্রাণের নিতাই-এর শরীর থেকে তুমি রক্ত ঝরিয়েছ, নিতাই তার সব সুকৃতি তোমাকে দান করলেও তার কাছে তুমি ক্ষমা না চাইলে তোমার উদ্ধার নেই।

গোরার কথা শেষ হওয়ার আগে নিতাই-এর পায়ে পড়ে গেল মাধাই। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। পায়ের ওপর থেকে তাকে তুলে বুকে টেনে নিল নিতাই।

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলেও তোরণের সামনে ভিড় থেকে একজনও মানুষ নড়ল না। ‘হরিবোল’ ধ্বনির সঙ্গে তারা গোরার নামে জয়জয়কার তুলল। ‘নবদ্বীপচন্দ্র কী জয়’’গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু কী জয়’ ধ্বনিতে বৃষ্টির আওয়াজ চাপা পড়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *