৪০
নীলাচল খালি করে গৌড়ের ভক্তরা চলে যাওয়ার পরে গোরা তার ঘরে ফিরে এল। গেল তিন বছর গৌড়ের ভক্তদের সে এভাবে আপ্যায়ন করছে, কয়েক মাস তাদের সঙ্গে কাটিয়ে পরের বছর রথযাত্রায় দেখা হবে জানিয়ে বিদায় দিচ্ছে। ঠাকুর হরিদাসের সঙ্গে সে রোজ সকালে কিছু সময় কৃষ্ণভজনায় কাটায়। গোরাকে দেখলে শশব্যস্ত ভক্তিতে তাকে দণ্ডবৎ করে বাপের বয়সী হরিদাস। হরিদাস বেশ অসুস্থ, ভিক্ষে করতে যাওয়ার শক্তি কমে আসছে। মন্দিরের পথে যারা ভিক্ষে নেওয়ার জন্যে বসে থাকে, সেদিক হরিদাস মাড়ায় না। পুরুষোত্তমপুরে তার বংশপরিচয় কেউ না জানলেও মন্দিরে সে কখনও ঢোকেনি। তার কুঠির কাছাকাছি যে দু’জনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, তাদের একজন জগদানন্দ, অন্যজন গদাধর, গোপীনাথের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে সে ক্ষেত্রসন্ন্যাস নিয়েছে। গোরার বিচ্ছেদজনিত শোকে পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে সে কৃষ্ণনাম নেয়নি। পুরন্দর মিশ্রের কাছ থেকে যে দীক্ষামন্ত্র পেয়েছিল, সকাল, সন্ধে তা জপ না করার জন্যে ভুলে গেছে। গোরার পরামর্শে পুরন্দরের কাছে নতুন করে মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করছে। ক্ষেত্রসন্ন্যাস নিলে সে জায়গা ছেড়ে মৃত্যুর আগে আর নড়া যায় না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গদাধরকে শ্রীক্ষেত্রে থাকতে হবে। তাতে তার আপত্তি নেই, গোরার কাছাকাছি শুধু এ জন্মে নয়, জন্মান্তরেও সে থাকতে চায়। জগদানন্দ আর গদাধর মিলে নিজেদের ভিক্ষের চাল থেকে একমুঠো করে হরিদাসকে দেয়। যে হরিদাস কিছুদিন আগে পর্যন্ত রোজ তিন লক্ষবার কৃষ্ণনাম জপ করত এখন দু’লক্ষ বত্রিশ হাজারের বেশি পারে না। শরীরের শক্তি কমে যাচ্ছে টের পেয়ে জপের মধ্যে তার দু’চোখ বেয়ে জল পড়েছে, সে কাঁদে। তার কুঠিতে গোরা এলে সে প্রায়ই বলে, তোমায় ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয় না, তবু এবার আমাকে ছুটি দাও। ছুটি পেলেও যে তোমার পাদপথে আশ্রয় মিলবে, তাও জানি।
গোরা বলে, কৃষ্ণভক্তদের তুমি আদর্শ। তুমি চলে গেলে আমি বড় একা হয়ে যাব। আরও কিছুদিন কষ্ট হলেও থেকে যাও।
দু’দিন আগে হরিদাসকে সান্ত্বনা দিতে গোরা যে কথাগুলো বলেছিল, সেই সকালে আবার তাই বলল। বাড়তি যোগ করল, উত্তর-পশ্চিমে তীর্থ করে মাতৃভূমি নবদ্বীপ ঘুরে আমি না ফেরা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা করো ঠাকুর। জগদানন্দ পণ্ডিত আর গদাধর থাকল তোমার দু’পাশে। আমি ফেরার আগে তাদের কেউ পৃথিবী ছেড়ে তোমাকে যেতে দেবে না।
হরিদাসের কুঠুরির সামনে গোরা এসে দাঁড়াতে সেখানে জগদানন্দ, গদাধর কয়েক মুহূর্তে পৌঁছে গিয়েছিল। নাম-জপে তখন ডুবে গেছে হরিদাস। তার দিকে দুই পার্ষদকে নজর রাখতে বলে গোরা নিজের কুটিরে, যাকে কিছুদিন ধরে গম্ভীরা বলা হচ্ছে ফিরে গেল। সার্বভৌমের বাড়িতে সেই দুপুরে ভিক্ষা নিয়ে গম্ভীরায় ফিরে গোবিন্দর সঙ্গে ভাগ করে খেল। বংশপরিচয়ে গোবিন্দ শূদ্র হওয়ায় তার ভিক্ষে চাওয়ার অধিকার থাকলেও ব্রাহ্মণের সামনে বসে খাওয়ার চিন্তা স্বপ্নেও সে করতে পারত না। ঈশ্বর পুরীর সেবা করার বছরগুলোতেও এ নিয়ম মেনে চলেছে। গোরার সেবক হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ঘুচে গেল সে নিয়ম। ভিক্ষান্নের একাংশ তাকে দিয়ে ঘরের সামনে বসিয়ে খেতে বলেছিল গোরা। ভয়ে গোবিন্দর বুক ধড়ফড় করলেও গোরার নির্দেশ সে অমান্য করতে পারেনি। সে নিয়ম জারী রয়েছে। সার্বভৌমের দেওয়া অন্নের ভাগ গোরার কাছ থেকে সেই দুপুরেও গোবিন্দ পেল। জগন্নাথ মন্দিরে সন্ধেতে আরতির সময় এমন এক কাণ্ড ঘটল, যা পুরুষোত্তমপুরের মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। সেটা ছিল অক্ষয়তৃতীয়ার সন্ধে, ভিড় ছিল মন্দিরে। মানুষের চাপে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ভাবাবেশে অনন্ত প্রতিহারীকে দশহাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার দুর্ঘটনার পর থেকে লজ্জিত গোরা মন্দিরে ঢুকে জগমোহনে এক গড়ুর স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দর্শন করে। জগমোহন ছেড়ে ভোগমণ্ডপের দিকে এগোয় না। গড়ুর স্তম্ভ ঘিরে ভক্তের জটলা। স্তম্ভের পাশে জায়গা না পেয়ে ভাবাবেশে মেঝেতে লুটিয়ে সাষ্টাঙ্গে গোরা যখন প্ৰণাম করছে, আরতির ধ্বনির সঙ্গে ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ ধুয়োয় মন্দিরের আনাচকানাচ পর্যন্ত ভরে গেছে, তখন অতি ব্যস্ততায় দেবদাসী লাবণ্য ভিড়ের চাপে সন্ধ্যারতির আলোয় ইষ্টমূর্তি দেখতে না পেয়ে মেঝেতে সাষ্টাঙ্গে প্রণত গোরার পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দর্শন করতে লাগল। গোরার সঙ্গে জগমোহনের চাতালে গোবিন্দ এলেও গড়ুরস্তম্ভ পর্যন্ত সে যেত না। কিছুটা দূরত্ব রেখে গোরার দিকে তাকিয়ে থাকত। ভিড়ের মধ্যে সুন্দরী এক রমণীর উচ্চতা অনেক বেড়ে যেতে, কিছু আশঙ্কা করে কয়েক পা এগিয়ে এসে যা দেখল, তাতে গোবিন্দর মাথা ঘুরে গেল। যে সন্ন্যাসী স্ত্রীমুখ দর্শন করে না, তার পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে সুসজ্জিতা এক স্ত্রীলোক। অস্থির হয়ে আরো কিছুটা এগিয়ে গোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে সে বলল, ঠাকুর ওঠো।
গোরা বলল, ব্যস্ত হোস না, গান শেষ হোক।
জগন্নাথ দর্শনে বিভোর লাবণ্যেরও জ্ঞান নেই। সে জয়দেবের গীতগোবিন্দ গাইছিল, ‘চন্দনচর্চিত লাল কলেবর পীতবসন বনমালী’ ইত্যাদি। আরতি শেষ হতে সচেতন লাবণ্য টের পেল কি মহাপাপ সে করে ফেলেছে। গোরার পায়ে পড়ে আকুল হয়ে সে কাঁদতে থাকল। বলল, প্রভু, মহা অপরাধ করে ফেলেছি, আমাকে রক্ষা করুন। আমি পতিত, আমি অজ্ঞান, উদ্ধার করুন আমাকে
গোরা বলল, তুমি কে আমি জানি না, কোনও অন্যায় তুমি করোনি। আমার চেয়ে কৃষ্ণের জন্যে তোমার আর্তি বেশি বুঝতে পারলাম। ধন্য তুমি। তোমার আর্তির কণামাত্র পেলে আমি বর্তে যেতাম। স্ত্রী-অঙ্গ স্পর্শে সন্ন্যাসীর অপরাধ হয় বলে আমার যে গুমোর ছিল, তা-ও আজ ভেসে গেল।
গোরার পায়ের তলা থেকে ধুলো কুড়িয়ে আঁচলে বাঁধল লাবণ্য। তার দেখাদেখি আরও যারা ভিড় করেছিল, তারাও ধুলো কুড়িয়ে চাদর, উড়ুনিতে বেঁধে নিল। অনন্ত প্রতিহারী এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল গোরাকে। সেই সন্ধে থেকে সন্ধ্যারতির সময়ে জগন্নাথ দর্শন করতে এসে গোরাকেও দর্শন করে লাবণ্য। গলায় তুলসীর মালা জড়াল সে। কপালে আঁকল হরিমন্দির তিলক। লাবণ্যকে অনুসরণ করল বাকি দেবদাসীরা। শ্রীক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ল গোরাভাবে ভাবিত মানুষের সংখ্যা, কপালে নানা ছাঁদের তিলক আঁকার ধুম।
উত্তর-পশ্চিমে তীর্থদর্শন মানে, প্রয়াগ, কাশী, বৃন্দাবন ঘুরে দেখার বাসনা জেগেছিল গোরার মনে, বিশেষ করে প্রয়াগে মকরসংক্রান্তি মেলায় সাধুসমাবেশে গুরু নানক আসছে, বাদামীতে কবীরের মুখে এ খবর শোনার পর থেকে সেই মহাত্মাকে দেখার ইচ্ছে তার বেড়ে চলেছে। কবীর নিজেও আসতে পারে। ‘শ্রী’ সম্প্রদায়ের গুরু রামানন্দর সঙ্গে দেখা হবে। রামানন্দের জন্মভূমি প্রয়াগ। প্রতি কুম্ভমেলায় সে হাজির থাকে। পুরুষোত্তমপুর থেকে অনেকটা পথ গৌড়ের দিকে যখন তাকে যেতেই হবে, তখন জন্মভূমি নবদ্বীপ, মা আর জননী গঙ্গাকে কেন একবার প্রণাম করে আসবে না? সন্ন্যাসের ধর্ম নিশ্চয় পালন করবে। তারপরে যাবে প্রয়াগে। কাশীতে যাবে প্রয়াগের পরে। প্রয়াগের সাধুসমাবেশে সে শোনাবে প্রেমভক্তির সঙ্কীর্তন, দেখাবে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। নানক, রামানন্দ ছাড়া আরও কত মহাত্মার সঙ্গে দেখা হবে, সে জানে না। মাকে শোনাতে হবে বিশ্বরূপের মৃত্যুর খবর, দেখাতে হবে তার দেহাবশেষ, গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে ছাই। বিশ্বরূপের দেহান্ত হওয়ার খবর শুনে মা কী করবে? যে মা-এর দু’ছেলের একজন মৃত, অন্যটা সংসার থেকে পালিয়ে সন্ন্যাসী হয়, সে মা কী করে? গোরা আর ভাবতে চাইল না। নামজপে ডুবে গেল।
নবদ্বীপে গোরার যাওয়ার ইচ্ছেটা পরমানন্দ পুরী প্রথমে জানলেও কাউকে বলেনি। গোরা নিজে-ই বলল গদাধর আর জগদানন্দকে। গদাধর গোঁ ধরল গোরার সঙ্গে সে-ও যাবে নবদ্বীপে। নিজের জায়গা ছেড়ে ক্ষেত্রসন্ন্যাসীর অন্য কোথাও যাওয়া নিষিদ্ধ, গোরার মুখে কথাটা শুনে গদাধর বলল, তুমি-ই আমার ক্ষেত্র, তুমিই আমার সন্ন্যাস। সন্ন্যাসের নিয়ম ভাঙলে যদি আমার নরকবাস হয়, আমি তাতেও রাজি।
তাকে ঠেকাতে গোরা অনেক বোঝাল। বাপের বয়সি হরিদাসকে বাঁচিয়ে রাখার দায় জগদানন্দের সঙ্গে সে-ও নিয়েছে মনে করিয়ে দিল। তার প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথের নিত্যসেবা সে ছাড়া আর কে করবে?
গোরার যুক্তি শেষপর্যন্ত গদাধর মেনে নিলেও অঝোরে কাঁদল। তার পিঠে হাত রেখে গোরা শান্ত করল তাকে। কটক পর্যন্ত গোরাকে এগিয়ে দিল জগদানন্দ, সার্বভৌম, রামানন্দ রায়। মাটির ঘটে বিশ্বরূপের দেহাবশেষ ভরে গোরার বোঁচকায় যত্ন করে রেখে দিল গোবিন্দ গম্ভীরায় তাকে রেখে গেল গোরা। কটক থেকে মহানদী পার হয়ে জাজপুর, সেখান থেকে মন্তেশ্বর নদী পেরিয়ে একুশ দিন পরে নবদ্বীপ, শান্তিপুরে না গিয়ে কুলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির ভিটেতে ঢুকল। বিদ্যাবাচস্পতির কাছে প্রথমে সে জানতে চাইছিল গৌড়ের হালচাল। দুৰ্গত, দুঃখী মানুষ এ রাজ্যে কেমন আছে? সন্ন্যাস নেওয়ার সন্ধেতে যে রাজপুরুষদের সঙ্গে এখানে পরিচয় হয়েছিল, প্রেমভক্তি প্রচারে, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় তারা কতদূর এগোল, সে শুনতে চায়। গৌড়ে প্রেমভক্তি প্রচারে অদ্বৈতের সঙ্গে নিতাইকে জুড়ে দিয়ে জনসমুদ্রে ভাবের যে জোয়ার আনতে চেয়েছিল, তার কতটা সফল হল, তা জানার আগ্রহ ছিল তার। সোজা অদ্বৈতের বাড়িতে গিয়ে এসব খবর জানা যেত না। শুধু ভক্তের ভিড় সামলাতে হত। ভক্তদের সে ভালবাসে, তারা তার মনের মানুষ। তাদের অনেক গুণ, সবাই কৃষ্ণভক্ত। কিন্তু বিদ্যাবাচস্পতির মতো গৌড়ের নাড়ির খবর, শুধু গৌড় কেন, নরদ্বীপ থেকে মল্লভূম, সমতট থেকে চন্দ্রদ্বীপের খবর কেউ রাখে না। বাচস্পতি বলল, প্রেমভক্তির জোয়ারে শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়। পাণিহাটি থেকে সপ্তগ্রাম, ভগীরথীর দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষকে মাতিয়ে রেখেছে নিতাই কপালে রসকলি, মুখে অলকা-তিলকা এঁকে, গলায় তুলসীর মালার সঙ্গে সোনার হার, দু’হাতে সোনার মকরমুখো বালা, রেশমের গেরুয়া উত্তরীয়ে শরীর ঢেকে সঙ্গীদের নিয়ে সে যখন ভক্তদের নিয়ে ‘ভজ গৌরাঙ্গ জপ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’ গেয়ে গঙ্গার ধারে গ্রামের পর গ্রামে ঘুরে বেড়ায়, মানুষ তখন কেঁদে কুল পায় না। নিতাই, কীর্তনীয়ারা যত কাঁদে, তার চেয়ে বেশি কাঁদে গাঁয়ের মানুষ। তারা বলে, আমাদের গৌরাঙ্গকে ফিরিয়ে আনো। সপ্তগ্রামের সুবর্ণবণিক জমিদার উদ্ধারণ দত্ত আর ধনকুবের শ্রেষ্ঠীরা তার কাছে গৌরমন্ত্র নিয়েছে। শুধু সেখানে থেমে নেই। ডোম, চন্ডাল, হাঁড়ি, মুচি থেকে জাতধর্মহারানো নেড়ানেড়িদের নিতাই বুকে জড়িয়ে ধরে, কপালে তিলক, গলায় তুলসীর কণ্ঠি পরিয়ে বৈষ্ণব সমাজে জায়গা করে দিয়েছে। নিতাই-এর সম্মোহনী শক্তি, তার পেছনে মানুষের ঢল দেখে সুশ্রুত রায়, পীতাম্বর রায় আর তাদের বন্ধু রাজপুরুষরা উদ্দীপনা নিয়ে নিজেদের কাজ করে চলেছে। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় যোগ্য সারথিকে নবদ্বীপের গোরা বেছে দিয়েছে, এ নিয়ে তাদের সন্দেহ নেই, তবে রাজপুরুষদের নিজেদের মধ্যে কোঁদল লেগে রয়েছে। আজ একটার মীমাংসা হয় তো কাল নতুন একটা মতবিরোধ জেগে ওঠে। কেউ বলে, অপেক্ষা করো, এখনও সময় হয়নি, কেউ বলে, সময় হয়েছে আর অপেক্ষা করা যায় না।
বিদ্যাবাচস্পতির কথা মন দিয়ে গোরা শুনছিল। রাজবেশে নিতাই-এর প্রচারের ধরনটা ভালো না লাগলেও আরো শুনতে চাইছিল। বাচস্পতি বলল, নিতাই-এর চালচলন, জাতকুল ভাসিয়ে সবাইকে বুকে টেনে নেওয়া, মুচি, মেথরের ঘরে ঢুকে তাদের কপালে তিলক এঁকে দিয়ে অন্নজল খাওয়া বোধহয় অদ্বৈত আচার্য পছন্দ করছে না। আমার বাড়িতে একদিন এসেছিল সে। নিতাই-এর প্রসঙ্গ উঠতে রীতিমত বিরক্তি প্রকাশ করল। বামুনের ছেলেকে বৈষ্ণব হতে যদি নবশাক সম্প্রদায়ের একজনকে গুরু মেনে তার কাছে দীক্ষার মন্ত্র নিতে হয়, সে ছেলে মানবে কেন? অদ্বৈতর আপত্তি আছে।
চুপ করে গোরা শুনছিল বাচস্পতির বিবরণ। আচণ্ডাল সকলকে প্রেম বিতরণের পরামর্শ তাকে অদ্বৈতই দিয়েছিল, কথাটা সে বলল না।
বাচস্পতি বলল, একটা খুশির খবর হল, তোমার অন্তর্ধানের পরে নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের ওপর যে জুলুম হয়েছিল, তা বন্ধ হয়েছে। ঘরদোর ছেড়ে অন্যত্র যারা বাসা করেছিল, তাদের প্রায় সকলে নবদ্বীপে ফিরে এসেছে। দরবারের খবর, সুলতান এতদিনে ভুলে গেছে সঙ্কীর্তনের ঘটনা। তুমি সন্ন্যাস নিয়েছ জেনে সে খুব নিশ্চিন্ত। তবে একডালা দরবারের আমীর, ওমরাহদের অনেকে দবীর খাস আর সাকর মালিককে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। সাকর মালিক আর দবীর খাসের ঘরোয়া নাম যে সন্তোষ, অমর, ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে তাদের জন্ম, সুলতানের অজানা ছিল না। সুলতান যে খবর জানত না, তা হল দরবারে উঁচু পদের অধিকারী দু’জনের শরীরে রাজরক্ত বইছে। তারা একদা কর্ণাটকের ব্রাহ্মণ রাজা জগদগুরুর বংশধর। খুব বেশি সাত পুরুষ আগে কর্ণাটকের অধীশ্বর ছিল জগদ্গুরু। পাকা খবর জোগাড় করে সুলতানের কানে তুলে দিয়েছিল, দরবারের খান-ই-জাহান, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদী। আরক্ষা বাহিনীর প্রধান, যাকে বলা হয় কোতয়াল-বকালী, সেই কোতয়াল প্রধান আসগর খাঁ এনে দিয়েছিল দু’জনের বংশপরিচয়। একে রাজপরিবারের সন্তান, তারপর ব্রাক্ষ্মণ, সুলতানী মসনদ নিয়ে জ্যোতিষীদের গণনা মিলতে চলেছে, সুলতানকে এমন আভাস দিয়েছে ইসলামাবাদী। সুলতান কিছুটা তটস্থ হলেও চাকরি থেকে দু’ভাই-এর কেউ এখনও বরখাস্ত হয়নি। তাদের ওপর নজর রাখা হয়েছে।
বেশ রাত পর্যন্ত বাচস্পতির সঙ্গে গোরার আলাপচারিতা চলল। গোরা শুনল বেশি, বলল কম। অল্পকথায় দাক্ষিণাত্য পরিব্রাজনের বিবরণ জানাল। উৎকলের সঙ্গে বিজয়নগর রাজ্যের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, জানালেও নিজের ভূমিকা সম্পর্কে মুখ খুলল না। তার জোগাড় করে তিনটে দুর্লভ পুঁথির নাম শুনে বাচস্পতি পড়ার জন্যে শুধু গভীর আগ্রহ দেখাল না, সার্বভৌমের সম্বন্ধী গোপীনাথকে দিয়ে পুঁথিগুলোর অনুলিখন করানোর ইচ্ছে প্রকাশ করল।
গোরা বলল, সে কাজ হয়ে গেছে। অনুলিপি পাঠিয়ে দেব।
বাচস্পতির সঙ্গে কথা চালানোর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন নাম জপ করছিল গোরা, বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের খবর নিচ্ছিল। বাচস্পতির মুখ থেকে ভাগবদপাঠ শুনল কিছুক্ষণ। তখন তার মাথার মধ্যে বাঁশি বাজছিল, নামজপের আড়ালে দেখতে পাচ্ছিল বংশীধারীর রূপ। ভাগবদ পাঠের মধ্যে বাচস্পতি নজর করছিল, অনেক বছরের চেনা যতিগ্রহণকারী, উদ্ভাসিত, শান্ত মুখ, তার গোটা শরীর থেকে সোনালি আভা যেন গড়িয়ে পড়ছে। বাচস্পতির ঘরে আত্মগোপন করে থাকতে চাইলেও সেখানে তার আসার খবর চাপা রইল না, তা ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে মানুষ তাকে দেখতে আসতে শুরু করল। সঙ্কীর্তনের দল নিয়ে প্রথমে এল নিতাই। সঙ্কীর্তনের ধুয়ো ‘ভজ গৌরাঙ্গ, জপ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম’।
বাচস্পতির ঘরে বসে গানের কলি শুনে নিজের দু’কান দু’হাতে ঢাকল গোরা। ঘরে ঢুকে গোরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিতাই বলল, বন্ধু গৌরাঙ্গভজনা শুনে কানে আঙুল দিও না। যুগধর্ম বলে একটা কথা আছে। পৃথিবীর মানুষের মন ক্রমশ নরম হচ্ছে, ভালবাসায় ভরপুর হচ্ছে। যুগের চাহিদা মেনে ঈশ্বরকে তারা রক্তমাংসের মানুষের চেহারায় দেখতে চায়। বরাহ, কূর্ম অবতারের চেয়ে মানুষ তাই শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীরামকে আঁকড়ে ধরেছে। অস্ত্র হাতে শ্রীকৃষ্ণের বদলে বাঁশি হাতে শ্রীকৃষ্ণ আর ধ্যানী বুদ্ধকে বেশি ভালবেসেছে। যুগাবতার কলিকে এ যুগের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেভাবে ভজনা করছে। কাঠিন্য এ সময়ের ধর্ম নয়।
নিতাই-এর কথার মধ্যে অদ্বৈত ঘরে ঢুকে গোরাকে প্রণাম করতে তাকেও গোরা প্রণাম করল। অদ্বৈত হাহা করে তাকে ঠেকাতে চাইলেও গোরা মান্য করল না। নিতাই, অদ্বৈতর সঙ্গে দুপুরের আগে শান্তিপুরে গোরা পৌঁছে গেল। ভক্তেরা ভিড় করেছিল অদ্বৈতর বাড়ির সামনে। নবদ্বীপ থেকে শচীকে আনতে পাল্কি পাঠান হল। শচী এল পরের দিন সকালে। ফাঁকা ঘরে মুখোমুখি হল মা, ছেলে। মা-এর পায়ে লুটিয়ে পড়ে গোরা প্রণাম করল। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শচীর দু’চোখ জলে ভরে গেলেও ফুঁপিয়ে সে কাঁদল না। ছেলেকে বুকে টেনে নিল। কত কথা ছেলেকে বলার ছিল, মুখ থেকে একটা শব্দ বেরল না। গোরার গায়ে, মাথায় শুধু হাত বোলাতে থাকল। গোরা বলল, মা, জীবন অনিত্য, তুমি তা জানো। তোমায় জানাই, দাদা আর নেই। পাঁচ বছর হল কৃষ্ণের পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। মা, তুমি স্থির থাকো ভেঙে পড়ো না। পরশু নবদ্বীপে ঢোকার আগে বারকোনা ঘাটে স্নানের সময়ে তার দেহাবশেষ গঙ্গায় বিসর্জন দেব।
শচী না কাঁদলেও পাথরের মতো নিস্তব্ধ হয়ে থাকল। গেরুয়ায় বাঁধা ঝোলা থেকে দাদার চিতার একমুঠো ছাইভরা ঘট বার করে মাকে দেখিয়ে বলল, এই ঘট ছুঁয়ে তাকে স্নেহ, আদর জানাও তুমি। শচী এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ভিজে গলায় জিজ্ঞেস করল, তাহলে আমার সংসারে থাকবে কে?
গোরা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে প্রশ্ন করল, সন্ন্যাস ছেড়ে তুমি কি আমাকে সংসারে ফিরতে বলছ?
ছেলের মুখের দিকে চেয়ে শচী বলল, না।
অদ্বৈতের বাড়িতে গোরার জন্যে তার প্রিয় পদ, শাক, সুক্তো, ডাল, ডালের বড়া, লাউয়ের পায়েস রাঁধল মা। মায়ের সামনে আঙটপাতা ধরে গোরা বলল, মা, ভিক্ষে দাও!
দুঃখে বুক ফেটে গেলেও ছেলেকে মা ভাত ডাল তরকারি দিল। অদ্বৈতের বাড়িতে দু’দিন শচী থাকার পরে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হল তাকে। জন্মভূমি, ভিটে দেখতে পরের দিন গোরা নবদ্বীপে যাচ্ছে, এরকম ঠিক হল। মুখে মুখে গোরার আসার খবর ছড়িয়ে গেল নবদ্বীপে। গোরার সঙ্কীর্তনের সঙ্গী অদ্বৈত, নিতাই এল শান্তিপুর থেকে, শ্রীবাস এল কুমারহট্ট থেকে, ভক্তের ভীড় লেগে গেল। সদরদরজার সামনে দাঁড়িয়ে গোরা দেখল বাড়ির ভেতরের আঙিনা, সেই নিমগাছ, গাছতলায় সেই কুঁড়েঘর, যেখানে সে জন্মেছিল। তার স্থির, শান্ত, সৌম্য মুখের দিকে তাকিয়ে চেনাজানারা যত প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা নিয়ে এসেছে, ভুলে গেল। শ্রদ্ধায়, বিনয়ে সব বয়সের মানুষ অভিভূতের মতো তাকিয়ে থাকল। বহু স্মৃতিবিজড়িত জন্মভূমিতে এসে, পুরানো দিনের অনেক ঘটনা গোরার মনে পড়লেও মুখে কোনো ছাপ ফেলল না। শচী জিজ্ঞেস করল বাড়িতে ঢুকবি না?
গোরা হাসল, বলল, এই তো বেশ আছি।
বৌমার সঙ্গে দেখা করবি না?
গোরা নিশ্চুপ। তার পাশ থেকে নিতাই বলল, কেন দেখা করবে না?
নিশ্চয় করবে। নিতাই-এর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগে লম্বা ঘোমটা টেনে ধীর পায়ে স্বামীর সামনে এসে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সাষ্টাঙ্গে তাকে প্রণাম করল বিষ্ণুপ্রিয়া। এয়োতির চিহ্ন শাঁখা, পলা হাতে; রোগা শরীর সেই স্ত্রীমূর্তিকে সামনে দেখে গোরা দু’পা পিছিয়ে গেলেও তাকে চিনে ফেলল। বেশ রোগা হয়ে গেছে বিষ্ণুপ্রিয়া। সর্বাঙ্গ জড়ানো তার শাড়িটাও বেশ পুরনো। তিন বছর আগে মাঝরাতে ঘুমন্ত যে মেয়েটাকে শেষবার দেখেছিল, সে আধপেটা খেয়ে বেঁচে আছে গোরা টের পেল। দেখল, বধূটির দু’পা আলতা রাঙানো। দৃষ্টি সরিয়ে গোরা দেখল তার সামনে ভিখিরির মতো হাত পেতে বিষ্ণুপ্রিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখে কোনো কথা নেই, শুধু দু’চোখে টলটল করছে জল।
বিষ্ণুপ্রিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে গোরা বলল, আমি সন্ন্যাসী, তোমাকে দেবার মতো আমার কিছু নেই।
আমি কী নিয়ে থাকব?
তুমি বিষ্ণুপ্রিয়া, যিনি বিষ্ণু, তিনিই কৃষ্ণ। তাই তুমি কৃষ্বপ্রিয়াও বটে। কৃষ্ণনাম জপ করো, শান্তিতে থাকো, মায়ের সংসারে ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না।
গোরা আর কথা বাড়াল না। পায়ের খড়মজোড়া খুলে রেখে নিঃশব্দে চলে গেল। সদ্য ছেড়ে যাওয়া খড়মজোড়া দুহাতে তুলে স্বামীর পায়ের তাপ, গন্ধ পেল বিষ্ণুপ্রিয়া। বাড়ির ভেতরে চলে গেল সে। গোরাকে দেখতে তার চারপাশে তখন’ থিকথিক করছে। খড়দহ, পানিহাটি, কাঞ্চনপল্লীর সঙ্গে গুপ্তিপাড়া, কুলীনগ্রাম, সপ্তগ্রাম থেকে ঝাঁক বেঁধে এল ভক্তের দল। প্রেমভক্তির জোয়ার এনেছে, এক নিমেষে গোরা অনুভব করল। গঙ্গা পেরিয়ে দু’নৌকো ভরে ভক্তদের নিয়ে এল শ্রীখণ্ডের নরহরি। দু’হাত জুড়ে ভক্তদের নমস্কার করে গোরা স্বস্তিবচন শোনাতে ‘হরিবোল’ ধ্বনিতে চারপাশ ভরে গেল। নবদ্বীপ ছেড়ে গৌড়ের পথ ধরে গোরা যখন বৃন্দাবনের দিকে রওনা হল, তার সঙ্গে সচল হল সেই জনসমাবেশ। কিছু মানুষ ঘরমুখো হলেও দূরের আর কাছের গ্রামগুলো থেকে দ্বিগুণ মানুষ এসে সেই ফাঁক ভরে দিচ্ছিল। কার্তিক মাসের শেষ, আকাশে ঝকঝকে রোদ, ধান কাটার মরসুম শুরু হতে দেরি নেই। শরতের শেষেও হঠাৎ কখনও কয়েক পশলা বৃষ্টিতে চান করে সবুজ হয়ে আছে রাস্তার দু’পাশের গাছপালা। রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা কাঠবেড়ালি দৌড়ে পাশের জামগাছে উঠে পড়তে হলুদ মাখা সবুজ ডানা মেলে উড়ে গেল কাঠঠোকরা পাখি। এই পথ, গাছগাছালি, কাঠবেড়ালি, কাঠঠোকরা, দোয়েল, কোকিল, পুকুর ঘাট সব তার চেনা। খানিকটা এগোলে ভট্টাচার্যদের ডাঙাজমিতে এখন একপাল শালিককে ডাকাডাকি করতে দেখা যাবে। বিকেলের মধ্যে রামকেলিতে পৌঁছোতে লম্বা পা ফেলে সে হাঁটছে। তার একপাশে নিতাই, আর পাশে নরহরি। বৃদ্ধ অদ্বৈত, প্রবীণ শ্রীবাস কিছু পিছিয়ে পড়লেও সঙ্কীর্তনের দলের সঙ্গে রয়েছে। নবদ্বীপের সন্ন্যাসী গোরা যে এই পথ দিয়ে গৌড়ে চলেছে, এ খবর আশপাশের গ্রামগুলোতে যেভাবে হোক ছড়িয়ে গেছে। পথের দু’ধারে তাকে দেখার জন্যে সারবেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে মানুষ। দু’হাত জুড়ে কেউ কাঁদছে, কেউ বলছে আমি খুব গরিব খেতে পাই না, আমি বড় দুঃখী, আমাদের উদ্ধার করো। বেশিরভাগের চেহারা কঙ্কালের মতো, পেট চুপসে গেছে, খুঁতনি ঝুলে পড়েছে, কোটরে ঢোকা চোখ, এই হতদরিদ্র মানুষগুলো তার চেনা, এদের মধ্যে ছেলেবেলা থেকে সে কাটিয়েছে। সকলকে বলার সুযোগ না থাকলেও মাঝেমাঝে সে বলছিল, কৃষ্ণ নাম নাও, কৃষ্ণকে ডাকো, তিনিই পারেন তোমাদের দুঃখ ঘোচাতে।
সঙ্কীর্তনের সুরেও ঘুরছিল কৃষ্ণনাম। ‘কৃষ্ণ যাদবায় মাধবায় গোবিন্দায় নমো।’ ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম, শ্রীমধুসূদন।’
নামজপে আবিষ্ট গোরার দু’চোখে জল আসছিল। কৃষ্ণকে সে বলছিল, আমার মৃত দাদার পুঁথি যদি সত্যি হয়, হে বাপ, আমি যদি তোমার সন্তান হই, তাহলে আমার প্রার্থনা পূরণ করো। উদ্ধার করো দুঃখী মানুষকে, তারা যেন খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। তোমার ছেলের মানসম্মান বজায় রাখো, তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিও না।
বিশাল শোভাযাত্রা নিয়ে গোরা যখন রামকেলির দিকে চলেছে, ঘোড়সওয়ার এক সিন্ধুকী তখন ঝড়ের গতিতে ছুটেছে রাজধানী একডালার পথে। ঘোড়ার ক্ষুরের চক্করে কোথাও ঠিকরে উঠছে ভিজে মাটি, কোথাও উড়ছে ধুলো। ঘোড়সওয়ারের নাম আফতাবউদ্দীন, মোকাম, মুড়াগাছি। নবদ্বীপে গোরার হাজির হওয়া, তাকে ঘিরে জনসংঘ, তার গ্রামের মানুষকে পিলপিল করে ঘর ছেড়ে মূল সড়কের দিকে যেতে দেখে পড়শিকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী ব্যাপার, সাতসকালে ভিটে ছেড়ে এরা চলল কোথায়?
পড়শি বলল, কাল সন্ধেতে হাটে শুনলাম, হাজার হাজার লোক নিয়ে সন্ন্যাসী চৈতন্য যাবে একডালার মসনদ দখল করতে। নবদ্বীপের লোক সে, জাতে বামুন। জ্যোতিষীদের কথা ফলতে চলেছে। দেশের সিংহাসনে বসবে হিন্দু রাজা।
কথাটা বলে নিরীহ লোকটা ভয় পেয়ে গেল। কাকে বলছে এসব? ভুল শোধরাতে সে বলল, সন্ন্যাসী দেখতে আমি কিন্তু যাচ্ছি না।
যা হওয়ার ততক্ষণে হয়ে গেছে। তদ্দণ্ডে ঘরে ফিরে ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে আফতাবউদ্দীন রওনা দিয়েছিল। মূল সড়ক এড়াতে ঘুরপথে ঘোড়া ছুটিয়েছিল সে। সুলতানী জমানা শেষ হয়ে যাবে সে ভাবতে পারে না। কয়েক বছর আগে চাকরির লোভে জাত পাল্টেছে, ভবনাথ থেকে আফতাব হয়েছে। সুলতানী আমল শেষ হলে খতম হয়ে যাবে তার চাকরি।’জাত গেল, পেটও ভরবে না। সংসার নিয়ে আতান্তরে পড়তে হবে। নিজের জাতে ফিরতে পারবে না। সেখানে নিয়ম-কানুন বড়ো কড়া। ঘোড়া ছুটিয়ে চলল আফতাব। দলবল নিয়ে সন্ন্যাসীর একডালায় আসার খবর এখনই কোতোয়াল ওয়াশলির দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে।
গোরার অনুগামীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছিল। সন্ধের আগে রামকেলি পৌঁছে গেল গোরা। সে পৌঁছোনোর কয়েক ঘণ্টা আগে কোতয়ালপ্রধান আসগর খাঁর দপ্তরে আফতাব খবর পৌঁছে দিয়েছিল। তড়িঘড়ি দরবারে সুলতানের কানে সে খবর পৌঁছে গেল। বিশ্বস্ত আমীরদের নিয়ে সুলতান বৈঠকে বসলেও সেখানে কেশব ছত্রী ছাড়া শুধু জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরকে ডাকা হল। সাকর মল্লিক, দবীর খাসকে রাখা হল না। কূটনৈতিক শলাপরামর্শে সুলতানের হুকুমে মুখ খোলে খান-ই-জাহান ইসলামাবাদী। সেই রাতে মন্ত্রণাতে তা ঘটল না। ব্যক্তিগত দেহরক্ষী কেশব ছত্রীর অভিমত জানতে চাইল সুলতান। কেশব ছত্রী বলল, যতদূর খবর পেয়েছি সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রেমভক্তির প্রচারক। রামকেলিতে তার কিছু ভক্ত আছে। ভক্তদের কোন একজনের বাড়ির বিষ্ণুমন্দিরে সন্ন্যাসী থাকবে। তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
কোথা থেকে এ খবর কেশব ছত্রী জানল, সুলতান শুনতে চাইলে দেহরক্ষী বলল, কোতয়াল-প্রধান আসগর খাঁর বিবরণ এটা। কি ব্যবস্থা নিয়েছে সে?
নজরদারী বসিয়েছে। সন্ন্যাসীর সঙ্গে রামকেলি পর্যন্ত যারা এসেছিল, তাদের অনেকে ঘরে ফিরে যাচ্ছে; রামকেলির কিছু ভক্ত যাতায়াত করছে।
কারা ভিড় করছে?
রামকেলির-ই ভদ্রলোক, সবাই ব্রাক্ষ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাক সম্প্রদায়েরও কয়েকজন আছে।
কেশব থামতে ইসলামাবাদীর কাছে সুলতান জানতে চাইল, কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়?
মুখ খোলার জন্যে অপেক্ষা করছিল ইসলামাবাদী। বলল, ছত্রীমশাই যা বললেন, তার অনেকটা ঠিক, আরও কিছু যোগ করা দরকার; সেই সন্ন্যাসী, যার নাম ছিল নিমাই পণ্ডিত, কয়েকশো লোক নিয়ে মশাল জ্বেলে নবদ্বীপের কাজির ঘর পোড়াতে গিয়েছিল। তাকে ধরতে দরবার থেকে ফতোয়া বেরোচ্ছে অনুমান করে সন্ন্যাসী সেজে নবদ্বীপ থেকে পালিয়েছিল। এই লোকটা সন্ন্যাসী আর ফেরারি আসামী, দুই-ই। রামলাল ভুঞার বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে সে উঠলেও তাকে দেখতে বহু লোক জুটেছে। নবদ্বীপ থেকেও পঙ্গপালের মতো মানুষ এনেছে সে। সামনের দু’দিনে কয়েক লাখ মানুষ জড়ো করে কি কাণ্ড সে করতে পারে, বুঝতে পারছি না। কোতোয়াল-প্রধানের সন্দেহ, সমতট, মল্লভূম, চন্দ্রদ্বীপে যারা বিদ্রোহ করার মতলব এঁটেছে, তাদের সঙ্গে এই ছদ্মবেশী সন্ন্যাসীর যোগাযোগ থাকতে পারে। রাজধানী একডালার দোরগোড়ায় এরকম অনিশ্চিত অবস্থা মেনে নেওয়া বোধহয় ঠিক নয়। জাঁহাপনা এখন যা হুকুম করেন, সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুলতানের কপালে ভাঁজ পড়ল, লালচে হয়ে উঠল দু’চোখ, বলল, ফেরার আসামীকে ধরে আনা-ই তো প্রথম কাজ।
আইন তাই বলে।
ভ্রু কুঁচকে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরকে সুলতান জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলো?
জাঁহাপনা, আমাকে গণনার জন্যে একরাত সময় দিন। ছক বানিয়ে গ্রহনক্ষত্রের যোগাযোগ দেখে ভয়ের কিছু থাকলে কাল দুপুরের আগে আপনাকে জানিয়ে দেব।
তার আগে বদমাসটাকে ধরে আনতে তুমি কি বারণ করেছ?
জাঁহাপনা, গোস্তাফি মাপ করবেন। আমার জ্যোতিষ গণনায় কি কখনও গাফিলতি হয়েছে?
তা নয়, তবে এরকম পরিস্থিতি আগে হয়নি। রাজধানীর সদরের সামনে বিনা হুকুমে এক দঙ্গল লোক নিয়ে কোনো সন্ন্যাসী ঘাঁটি গাড়েনি। এ তো বেয়াদপি।
এক মুহূর্ত থেমে এক পাইককে দবীর খাস আর সাকর মল্লিককে সুলতান ডাকতে পাঠাল। মন্ত্রণালয়ের ডাক শুনে ধড়াস ধড়াস করতে থাকল তাদের বুক। তাদের আর এক ভাই, বল্লভক্ত সুলতানি দরবারে চাকরি করে। সুলতান কেন ডেকেছে, দু’ভাই-এর বুঝতে সময় লাগল না। দবীর খাস বলল, সাবধান, মেপে কথা বলতে হবে।
সাকর মল্লিক বলল, প্রাণ থাকতে সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্যের বিপদ ঘটতে দেব না।
গম্ভীর মুখে দু’ভাই মন্ত্রণালয় দূরে সুলতানকে কুর্নিশ করে দাঁড়াতে তাদের বসতে বলা হল। সাকর মল্লিককে সুলতান জিজ্ঞেস করল, রামকেলিতে যে সন্ন্যাসী এসেছে তাকে কতটা চেন?
সন্ন্যাসীর নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, নবদ্বীপে ঘর, তখন নাম ছিল নিমাই, সন্ন্যাস নেওয়ার পরে এখন থাকেন পুরুষোত্তমপুরে।
—মানে, উৎকলে?
—হ্যাঁ জাঁহাপনা।
—তুমি কি করে জানলে সন্ন্যাসীর ডেরা?
—গৌড় থেকে ফি বছর রথের সময় অনেক তীর্থযাত্রী যায়, তাদের মুখে শুনেছি।
—আর কিছু জানো?
—না, জাঁহাপনা।
দবীর খাসকে সুলতান জিজ্ঞেস করল, তুমি বাড়তি কিছু জানো?
সাকর মল্লিক যা বলল, তার বেশি জানি না জাঁহাপনা।
শুনেছিলাম, লম্বা, চওড়া, টকটকে ফর্সা গায়ের রং, ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে নিমাই পণ্ডিত, তা কি ঠিক?
জাঁহাপনা, আমিও এরকম শুনেছি, কখনও দেখিনি তাঁকে।
দেখার ইচ্ছে আছে?
জাঁহাপনা হুকুম করলে অবশ্যই দেখা করব।
নিমাই পণ্ডিত কি কোনো রাজপরিবারের ছেলে?
যতটা জানি, তাঁর বাবা যজমানী করতেন।
বাবার বাবা, তাঁর বাবা?
বংশপরিচয় আর কিছু জানি না জাঁহাপনা।
ইসলামাবাদী এবার মুখ খুলল, জাঁহাপনা হুকুম করলে একটা কথা বলতে পারি।
বলো।
আমাদের সিন্ধুকীরা সেই সময়, মানে চারবছর আগে সেই মশাল শোভাযাত্রার পরে খবর এনেছিল, নিমাইপণ্ডিত শ্রীহট্টের লোক। দু’জন সিন্ধুকীকে তখন শ্রীহট্টে পাঠানো হয়। শ্রীহট্টে গিয়ে তারা খোঁজখবর করে জেনেছিল, রাজবংশের রক্ত উপেন মিশ্রের পরিবারের সাতপুরুষে কারও ছিল না, ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবার
রাতের প্রথম প্রহর, চারপাশ নিস্তব্ধ হলেও একডালার দরবারে জরুরী দরবারে আমীর, ওমরাহদের সুলতান বসিয়ে রেখেছে। নিমাই পণ্ডিতের শরীরে রাজরক্ত নেই জেনে সুলতানের কুঁচকে থাকা ভ্ৰূজোড়া একটু স্বাভাবিক হল। বলল, সাকর আর দবীরকে রামকেলিতে গিয়ে সন্ন্যাসী আর তার সঙ্গীদের চালচলন নজর করে জানতে হবে, ওদের মতলব কী? সকাল হওয়ার আগে খবরাখবর জোগাড় করে ফিরতে হবে তোমাদের। যাও, এখনই রওনা দাও। আস্তাবলে তোমাদের ঘোড়া মজুত আছে তো?
হ্যাঁ জাঁহাপনা ।
মন্ত্রণালয় থেকে দু’জন বেরিয়ে যাওয়ার আধঘণ্টা পরে প্রাসাদের অন্দরমহলে সুলতান ঢুকে গেল। সুলতান চলে যেতে মন্ত্রণাসভা থেকে বাকিরা বেরিয়ে পড়ল। দরবার খালি হতে সময় লাগল না। কেশব ছত্রীর সঙ্গ নিল জ্যোতিষার্ণব। রাতের প্রথম প্রহর। রাজধানী একডালার প্রাণচঞ্চলতা কমলেও থেমে যায়নি। বেশিরভাগ বাড়ি আর দোকানপাটে আলো জ্বলছে। জ্যোতিষার্ণব আর কেশব পাশাপাশি পল্লীতে থাকে। কেশব ছত্রীকে জ্যোতিষার্ণব বলল, কী বুঝলে?
কেশব বলল, এক রাতের মতো সন্ন্যাসীকে রাজরোষ থেকে রেহাই দিতে ভুমি জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্য নিলে, কাল সকালে কী করবে?
কাল কী করব তা নির্ভর করছে আজ রাতে তুমি কী করবে তার ওপর।
তোমার সবচেয়ে বিশ্বাসী কোনো ঘোড়সওয়ারকে এখনই রামকেলিতে পাঠাও। ঝড়ের বেগে সে যেতে পারলে পথের কোথাও অমর, সন্তোষকে ধরে ফেলতে পারে। পথে না পেলে রামকেলি পর্যন্ত যেতে হবে। সেখানে পৌঁছে দু’ভাই-এর যাকে হাতের কাছে পায়, তাকে কানে কানে যেন বলে, রামকেলি থেকে আজ রাতেই সন্ন্যাসীর একা কিম্বা একজন সঙ্গী নিয়ে নিঃশব্দে চলে যাওয়া উচিত।
কেন বলছ একথা?
আমার গণনায় সুলতানের আগের মতো বিশ্বাস নেই। আজ রাতের মধ্যে কিছু না ঘটলে, কাল দুপুরের আগে সন্ন্যাসীকে কয়েদখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। গুমখুন হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমার ঘোড়সওয়ার সাকর মল্লিক, দবীর খাসের কানে এ খবর তুলে দিতে পারলে আমার গণনা একরকম হবে; না পারলে আর একরকম হবে।
কেশব ছত্রী বলল, দেখি, কী করা যায়।
পল্লীর পথে সেখানে দু’জনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার এক দণ্ডের মধ্যে একটা কালো তুর্কি ঘোড়াকে রাজধানীর পথ ছেড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দেখা গেল। সওয়ারিকে চেনা গেল না। রাতের দ্বিতীয় প্রহর শেষ হওয়ার আগে রামকেলির কিছু আগে পথের ধারে জঙ্গল থেকে ধুতি, চাদর জড়ানো দু’জন মানুষকে ভূতের মতো বেরিয়ে আসতে দেখে তুর্কি ঘোড়ার সওয়ারি, রামকেলির ভূঞাবাড়ি কোথায় জানতে ঘোড়ার রাশ টেনে দাঁড়াল। ঘোড়া দাঁড়িয়ে যেতে দুজন মানুষ রাস্তা ছেড়ে ফের অন্ধকারে ঢুকে পড়ল। জঙ্গলের আগে ঝোপঝাড়। তার ওপর দিয়ে সওয়ারি জঙ্গলে ঢুকে মানুষ দু’জনের নাগাল পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, ও মশাই, আপনারা কি রামকেলির মানুষ।
দু’জনের কেউ সাড়া করল না।
সাকরের কানের কাছে মুখ এনে দবীর বলল, গলাটা চেনা লাগছে।
সাকর বলল, ঘোড়াটাও চেনা, মনে হচ্ছে, কেশব ছত্রীর ভাগনে নীলগ্রীব, মামাবাড়িতে এসেছিল। পুতুলের মতো নিস্তব্ধ দু’জন মানুষকে চুপ করে থাকতে দেখে ঘোড়সওয়ার জিজ্ঞেস করল, রামকেলির ভূঞাবাড়ি কোন্ দিকে বলতে পারেন?
সাকর মল্লিক জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কেশব ছত্রীর ভাগ্নে নীলগ্রীব?
নীলগ্রীবেরও কণ্ঠস্বরের মালিককে চেনা লাগল। ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল সে। মুঠো মুঠো জোনাকি উড়ছে ঝোপের মাথাতে। অন্ধকারে বিটকেল স্বরে ডেকে একটা বাদুড় উড়ে গেল। নীলগ্রীব দেখল সামান্য দূরে ঝাঁকড়া একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটো কালো তুর্কি ঘোড়া। দেখে দুই ঘোড়ার একটা চিঁহি চিঁহি করে ডেকে উঠল। ধুতি, চাদর জড়ানো দু’জনকে চিনতে নীলগ্রীবের অসুবিধে হল না। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের চোগা, চাপকান কুর্তা, ফেজটুপি কোথায়? আপনাদের খোঁজে বেরিয়ে আপনাদেরই চিনতে পারিনি। হায় ভগবান!
কেন খুঁজছ আমাদের?
দবীরের প্রশ্নে নীলগ্রীব বলল তার আসার কারণ। রাত পোহানোর আগে যেন সন্ন্যাসী চুপচাপ রামকেলি ছেড়ে চলে যায়। একজন সঙ্গী নিতে পারে, তার বেশি নয়। সুলতানের মাথায় কোনো কুবুদ্ধি আছে।
সাকর বলল, আমরাও সে অনুমান করেছি। চোগা চাপকান গায়ে চাপিয়ে ঈশ্বরের মতো এক সন্ন্যাসীর সামনে যাওয়া উচিত নয়, লজ্জা লাগে। তাই দরবারের পোশাক ছেড়ে ধুতি, চাদর ধরলাম। পোশাক রইল দুটো ঘোড়ার পিঠে। আমরাও চিনতে পারিনি তোমাকে, মনে হয়েছিল সিন্ধুকীদের কেউ নজরদারি করছে।
নীলগ্রীব বলল, ভালোই হয়েছে, আমাকে আর রামকেলি পর্যন্ত দৌড়োতে হল না। খবরটা পৌঁছে দিতে পেরে এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
নীলগ্রীব চলে যাওয়ার এক দণ্ডের মধ্যে রামকেলিতে পৌঁছে গেল সাকর, দবীর। চোগা চাপকানে যাদের দেখতে অভ্যস্ত, ভূঞা বাড়ির কর্তা গোড়ায় তাদের চিনতে পারেনি। ভূঞার পাশে ছিল নিতাই। মামুলি পোশাকের দু’জন মানুষ যে জবরদস্ত শাহীকর্মচারী কয়েক মুহূর্তে ভুঞা চিনতে পেরে কীভাবে তাদের অভ্যর্থনা করবে ভেবে পেল না। হেমন্তের নিস্তব্ধ রাত ধোঁয়াটে আকাশে অগুনতি তারা জোনাকির মতো মিটমিট করে জ্বলছে। ভূঞাবাড়ির চারধারে জমেছে বিস্তর মানুষ। তারা সবাই সন্ন্যাসীর সঙ্গী হতে চায়। সন্ন্যাসী ঠিক কোথায় যাচ্ছে, বৃন্দাবন, না কাশী অথবা অন্য কোথাও এ নিয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। তারা শুধু সন্ন্যাসীর সঙ্গ চায়। অন্ধকার গাছতলায়, মাঠে থিকথিক করছে জনতা। তাদের অনেকে খড় বিছিয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ফাঁকা মাঠে কয়েক জায়গায় গুলতানি করছে কিছু মানুষ। প্রেমভক্তির টানে সন্ন্যাসীর সঙ্গ নিলেও এমন লোকও আছে, যারা ধরে নিয়েছে গৌড়ের মসনদে সন্ন্যাসী বসতে চলেছে। ভূঞাবাড়ির সদরের কাছাকাছি এমন কাউকে সাকর মল্লিক দেখল না, যাকে সিন্ধুকী মনে হয়। গোরার দর্শন পেতে একডালার দরবারের দুই মন্ত্রী এসেছে, খবরটা নিয়ে নিতাই গেল গোরার কাছে। সাকর মল্লিক, দবীর খাসের নাম, বংশপরিচয়, সদগুণের বৃত্তান্ত নবদ্বীপে থাকতে বিদ্যাবাচস্পতির কাছে গোরা শুনেছে। গোরাকে কয়েদ করতে রুষ্ট সুলতানের মতিগতির বিবরণ বিদ্যাবাচস্পতির কাছে এই দুই আমীর জানাত। সুলতানী দরবারে বসে গোরাকে বাঁচানোর চেষ্টা যতটা করা যায় তারা করত। রাজকীয় পদমর্যাদায় অনেক উঁচুতে থাকলেও দু’ভাই-এর মনে সুলতানী দরবারে চাকরি করার জন্যে হীনমন্যতা ছিল। মুসলমান সমাজের অনেক ব্যবস্থার সঙ্গে রফা করে বছরের পর বছর চাকরি করে তারা যে জাত খুইয়েছে, এ নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিল না। কর্ণাটকের ব্রাহ্মণ রাজা ভগৎগুরুর সপ্তমপুরুষ হয়েও তারা ব্রাক্ষ্মণত্ব কেন, সুলতানী দরবারের চাপে বিশুদ্ধ হিন্দুত্ব পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। বেঁচে থাকার ধিক্কারে তারা যখন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল, নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের আচণ্ডাল প্রেমের বাণী তাদের মনে নতুন আশা জাগল। গোরাকে না দেখেও তার ভক্ত হয়ে গেল তারা! রাজধানী একডালার চাকরি ছেড়ে, গোরা-অনুগামী হয়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় পালাতে চাইছিল।
ভূঞাবাড়ির বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে কাঠের পিঁড়ির ওপর গোরা বসেছিল। বিষ্ণুর আসনের সামনে লম্বা এক পিলসুজের ওপর বড়ো প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের আলো হালকাভাবে চাতালে এসে পড়েছে। দু’পা মুড়ে দু’হাঁটু সামনে রেখে সন্ন্যাসী বসে রয়েছে। তার বাঁ পাশে কমণ্ডুল। সাকর মল্লিক, দবীর খাস দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করল। গোরা উঠে দাঁড়িয়ে দু’ভাইকে পরপর বুকে জড়িয়ে ধরতে তারা বলল, প্রভু এ কি করলেন? আমাদের জাতধর্ম নেই, আমরা পতিত
গোরা হাসল, বলল, তোমরা বিনয়ী, প্রেমভক্তি ছাড়া এমন বিনয় হয় না, তোমরা আসল বৈষ্ণব।
ভূঞাবাড়িতে সদ্য ঢুকে পড়া দু’জন মানুষকে শনাক্ত করতে বিষ্ণুমন্দিরের সদরের অন্ধকার থেকে একজন সিন্ধুকী উঁকি মেরে দেখে গেলে সাকর মল্লিক, দবীর খাসকে চিনতে পারল না। ধুতি, চাদর জড়ানো ছাপোষা দু’জন লোককে দেখে তারা যে একডালার দুই রাজকর্মচারী সাকর মল্লিক, দবীর খাস বোঝার উপায় ছিল না। গোরার পাশে তখন নিতাই আর নরহরি ছাড়া কেউ নেই। অমর বলল, প্রভু, আমাদের উদ্ধার করুন।
সন্তোষ বলল, আপনার পথ চেয়ে আমরা বসেছিলাম। আমার পথ চেয়ে কেন বসে আছো? শুনেছি তোমরা বিদ্বান, বুদ্ধিমান, বিদ্যাবাচস্পতির ছাত্র ছিলে, চতুষ্পাঠী খুলে অধ্যাপনা করলে না কেন?
সাকর বলল, প্রভু করেছিলাম।
বন্ধ হয়ে গেল কেন?
মাধাইপুরে আমাদের বাড়িতে শিবিকা পাঠিয়ে সুলতান তুলে নিয়ে গেল।
তোমাদের খবর সুলতান জানল কিভাবে?
সন্তোষ বলল, সেটাও এক কাহিনী। একডালা সুরক্ষার জন্যে সুলতান এক উঁচু মিনার তৈরির ভার দিয়েছিল রাজমিস্ত্রি লিক শাহকে। মিনার তৈরির কাজ যখন শেষের দিকে, তখন এক সকালে মিনার দেখতে এল সুলতান। মিনার দেখে সুলতান যখন পিরুকে তারিফ করছে, বেফাঁস একটা কথা সে বলে ফেলল। বলল, জাঁহাপনা, আরো ভাল মিনার আমি বানাতে পারি।
পিরুর কথা শুনে রাগে সুলতানের মাথায় রক্ত উঠে গেল, জিজ্ঞেস করল বানালি না কেন?
পিরু কোনো কৈফিয়ত দেওয়ার আগে দু’জন পাইক ডেকে তাকে মিনারের চুড়ো থেকে ফেলে দেওয়ার হুকুম করল সুলতান। সুলতানের আজ্ঞায় তখনই ধরাধাম থেকে বিদায় নিল পিরু। পারিষদদের মধ্যে সুলতানের তখন পাশে ছিল জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির, দেহরক্ষী কেশব ছত্রী, পাইক, বরকন্দাজের দল। মিনারের গম্বুজ গাঁথার কাজ তখনও শেষ হয়নি। সুলতান রাগে ফুঁসছে। হিঙ্গা নামর এক বরকন্দাজকে সুলতান বলল, এখনই মাধাইপুর যা।
হুকুম শনে দৌড় লাগাল হিঙ্গা। মাধাইপুরে পৌঁছে সে ভেবে পেল না, কেন তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছে। মাধাইপুরের রাস্তায় এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের চতুষ্পাঠীর সামনে এসে দাঁড়াতে তাকে গোড়ায় নজর করল অমর। মানুষটা মাধাইপুরের বাইরে থেকে এসেছে বুঝে তাকে জিজ্ঞেস করল, সে কোথায় থাকে, চতুষ্পাঠীর সামনে দাঁড়িয়েই বা আছে কেন? সুলতানের ক্রোধের ভয়ে সে তখনও কাঁপছে। নিজের নাম, পরিচয় জানিয়ে সুলতানের হুকুমে মাধাইপুর এসেছে, হিঙ্গা জানাল। বলতে পারল না কেন এসেছে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। আমরা দু’ভাই বুঝেছিলাম তার মাধাইপুরে আসার কারণ। মাধাইপুরের রাজমিস্ত্রিদের খুব সুনাম। অসমাপ্ত মিনারের কাজ শেষ করতে হিঙ্গাকে মাধাইপুরে পাঠিয়েছে সুলতান। আমরা দু’ভাই তবু কয়েকবার তাকে বললাম, ভেবে দেখ কেন সুলতান তোমাকে মাধাইপুর পাঠাল? কিছু নিশ্চয় বলেছে, তুমি ভুলে গেছ। আমরা যতবার কথাগুলো বলি, সে বলে, তেমন কিছু বলেননি জাঁহাপনা
অমর তখন বলল, মিনারের কাজ শেষ করতে পাকা রাজমিস্ত্রি ডেকে আনতে পাঠিয়েছে তোমাকে।
হিঙ্গা খানিক থতমত খেয়ে আমাদের পরামর্শ মেনে নিল।
দু’জন ভালো রাজমিস্ত্রি নিয়ে সে একডালায় পৌঁছোতে সুলতান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তোকে রাজমিস্ত্রি আনার কথা তো বলেনি, তুই জানলি কি করে?
সুলতানের প্রশ্নে মাধাইপুরে যা ঘটেছে, হিঙ্গা বলল। সুলতান অবাক হলেও জ্যোতিষার্ণব হয়নি। তাকে সুলতান জিজ্ঞেস করল, এটা কিভাবে সম্ভব।
জ্যোতিষার্ণব বলল, শুনেছি মাধাইপুরে সন্তোষ আর অমর নামে দু’ভাই আছে, তারা চতুষ্পাঠী চালায়। তাদের মতো দূরদর্শী, বিচক্ষণ জ্ঞানী পণ্ডিত গৌড়ে বিশেষ নেই।
আমাদের পরিচয় সুলতানকে দিলেও জ্যোতিষার্ণব বলল না, বিদ্যাবাচস্পতির চতুষ্পাঠীতে আমাদের সহপাঠী ছিল সে। তিনদিন পরে সুলতানের শিবিকা এসে সসম্মানে তুলে নিয়ে গেল আমাদের। পনেরো বছর আগের ঘটনা এসব। সুলতানী দরবারে আমরা আমীরের আসন পেলাম। আমাদের নাম হয়ে গেল সাকর মল্লিক, দবীর খাস। মাধাইপুরে আমাদের আত্মীয়রা সমাজ আমাদের ছিছিক্কার করতে থাকল, বলল যবন হয়ে গেছে দু’ভাই আর একডালার প্রভুরা ভাবে আমরা কাফের। অমর থামতে সন্তোষ বলল, প্রভু, আমাদের পরিচয় ফিরিয়ে দাও, তোমার প্রেমভক্তির প্রচারে দাসজ্ঞানে জায়গা দাও।
চোখের জলে গোরা ভাসছিল, বলল, বড়োভাই সন্তোষের নাম দিলাম সনাতন, ছোট অমরের নাম রূপ
দু’ভাই নতুন নাম পেয়ে দু’হাতে গোরার পা ধরে গড় করল। সন্তোষ বলল, প্রভু, আমাদের ছোট ভাই, বল্লভ চাকরি করে সুলতানের কাছারিতে, তারও একটা নাম আপনি বলে দিন।
গোরা এক মুহূর্ত না ভেবে বলল, অনুপম।
নামটা শুনে নিতাই বলল, আহা, অনুপম, প্রাণজুড়োনো নাম।
আমাদের কি হবে প্ৰভু?
সনাতন প্রশ্ন করতে গোরা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি এখনই চাকরি ছেড়ে দিতে চাও। রূপ বলল, আমরা তিন ভাই-ই তোমার সেবায় লাগতে চাই।
পৌষসংক্রান্তিতে প্রয়াগে চলে এসো, তখন কথা হবে।
সেই ভালো।
রূপ বলল, প্রভু, একডালায় সুলতানের মতলব ভালো নয়। তার মন্ত্রণালয়ে জরুরি শলাপরামর্শে আজ বিকেলে বসেছিল সুলতান। আমরা দুভাই পনেরো বছরে এই প্রথম মন্ত্রণাসভায় ডাক পেলাম না। রামকেলির কাছাকাছি এসে এক বিশ্বাসী ঘোড়সওয়ার বলে গেল, আজ রাতেই যেন একজন সঙ্গী নিয়ে রামকেলি ছেড়ে সন্ন্যাসী চলে যায়। ফেরার আসামী হিসেবে তাকে কয়েদখানায় পুরে দিয়ে অপরাধের বিচার হবে। এই সুলতান সব পারে। তেমন ঘটলে বুক ফেটে আমরা মরে যাব। ঊষাকাল হওয়ার আগে আপনি রওনা দিন।
রাতের চতুর্থ প্রহরে নিতাইকে নিয়ে রামকেলি ছেড়ে গোরা চলে গেল।
সাতসকালে একডালার বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা সাকর মল্লিক আর দবীর খাসকে দু’জন পাইক পাঠিয়ে সুলতান তলব করল। ঘুমে চোখ বুজে যেতে থাকলেও চোগা চাপকান পরে দু’ভাই পৌঁছে গেল দরবারে। সুলতানের সঙ্গে সেখানে রয়েছে, খান-ই-জাহান ইসলামাবাদী আর কেশব ছত্রী। বাড়ি ফেরার পথে জ্যোতিষার্ণবের সঙ্গে পরামর্শ করে এসেছে দু’জন। সুলতানকে সাকর মল্লিক জানাল, সন্ন্যাসী খুব নিরীহ। তাকে ঘিরে যারা রয়েছে তারাও হেটো মেঠো গরীব মানুষ। কারো কাছে অস্ত্র আছে মনে হয় না।
—সন্ন্যাসীর সঙ্গে তোমরা দেখা করেছিলে?
—দূর থেকে প্রণাম করেছি জাঁহাপনা।
—তোমাদের পোশাক দেখে কি তারা ভয় পেয়েছিল?
—বোধহয় পেয়েছিল। সদরদরজার সামনে জটলা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
—তোমার যা বলছ, সব কি ঠিক?
রূপ বলল, হ্যাঁ জাঁহাপনা।
—ভূইঞাবাড়িতে কোনো সিন্ধুকী তোমাদের দেখেনি।
—হতে পারে জাঁহাপনা, আমরাও কোনও সিন্ধুকীকে বাড়ির আশপাশে দেখিনি।
সুলতান ভ্রূ কুঁচকে দু’জনকে বলল, তোমরা এখন যেতে পারো।
সূর্য পুব আকাশ ছেড়ে কিছুটা ওপরে উঠতে সুলতানের কাছে গ্রহনক্ষত্রের ছক আঁকা জ্যোতিষের কাগজ নিয়ে হাজির হল জ্যোতিষার্ণব। তখনও সেখানে সুলতানের সঙ্গে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী আর কেশব।
সুলতানের সামনে ছোট একটা জলচৌকি রেখে হাতের পাকানো কাগজটা সেখানে পেতে কোন্ গ্রহ কোথায় আছে, রাহুর অবস্থান কোথায়, বোলাতে কিছুটা বিরক্ত হয়ে সুলতান বলল, তোমার গ্রহনক্ষত্রের ব্যাপার আমি বুঝি না। আমি জানতে চাই, রামকেলিতে ফৌজ পাঠানো দরকার কিনা?
ছক বলছে, সেনা পাঠানোর দরকার নেই, দু’জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে কোতয়াল- প্রধান গেলেই কাজ হবে।
কোতয়াল-প্রধান ডেকে সুলতান হুকুম করল, আসগর, কয়েকজন ঘোড়সওয়ার নিয়ে এখনই তুমি রামকেলি যাও। সেখানে এক সন্ন্যাসী এসেছে, ফেরার আসামী সে। তার বিস্তর চেলা-চামুণ্ডা জড়ো হয়েছে। শান্তিভঙ্গের লক্ষণ দেখলে ভিড় হটিয়ে সন্ন্যাসীকে তুলে নিয়ে
চলে আসবে।
সুলতানকে কুর্নিশ করে কোতয়াল-প্রধান আসগর খাঁ বেরিয়ে গেলে জ্যোতিষার্ণব ভাবল, জল কতদূর গড়াবে কে জানে!