১৬
শ্রীহট্টে, মৃত ঠাকুর্দা উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়িতে জ্যাঠা, কাকাদের সংসারে থাকার বদলে দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তীর পরামর্শে গোরা গিয়ে উঠল, তাদের পারিবারিক সুহৃদ, জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা হৃদয় মিশ্রের ছেলে তপন মিশ্রের বাড়িতে। নবদ্বীপের বারকোণা ঘাট থেকে একঝাঁক শ্রীহট্ট যাত্রীর ভাড়া নেওয়া নৌকোতে নিজের জায়গা গোরা করে নিলেও কাউকে জানতে দিল না শ্রীহট্টে কোথায় সে উঠছে। সহযাত্রীরা কেউ জানতে চাইল না। তারা ধরে নিয়েছিল, শ্রীহট্টের ঢাকা, দক্ষিণ গ্রামে বাপ-পিতামহের ভিটেতে গোরা থাকবে। পৈতৃক বিষয়সম্পত্তির যথাবিহিত নিষ্পত্তি করতে জ্যাঠা-কাকাদের সংসারে বাস করাই স্বাভাবিক। বাস্তবে তা ঘটল না। শ্রীহট্টের ঘাটে নেমে তার আসার খবর ঠাকুর্দা, স্বর্গত উপেন্দ্র মিশ্রের পরিবারে পৌঁছোনোর আগে সে বাতাসে মিলিয়ে গেল। সহজ কথায়, মুখে কুলুপ এঁটে নৌকো থেকে নেমে গা-ঢাকা দিল। কিছুদিনের জন্যে ঢাকা, দক্ষিণ গাঁয়ের উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়ির লোকজনের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। নীলাম্বর চক্রবর্তী সেরকম পরামর্শ দিয়ে বিশ্বরূপের খোঁজখবর করার পর্ব চুকিয়ে ঠাকুমা, শোভাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে বলেছিল। কাজটা কঠিন। তল্লাশি শুরুর আগে সে খবর পাঁচ কান না করতে বলেছিল গোরাকে। ভূয়োদর্শী নীলাম্বর অনুমান করেছিল, তার আগে উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়িতে গোরা হাজির হলে, জ্যাঠা, কাকা, তাদের ছেলেরা ভাবতে পারে, পৈতৃক সম্পত্তির ভাগীদার এসেছে। শ্রীহট্টে সুলতানের গুপ্তচরদের ঘাঁটিতে খবরটা পৌঁছে গেলে অনর্থ হতে পারে। বিত্তসম্পদের লোভে সে যে শ্রীহট্টে যায়নি, তা প্রমাণ করতে বিশ্বরূপের তল্লাশির কাজ শেষ করে, নবদ্বীপে ফেরার আগে ঠাকুমার কাছে গোরাকে যেতে বলেছিল নীলাম্বর। সে জানত, আঠারো বছর আগে শ্রীহট্ট থেকে অন্তঃসত্ত্বা শচী নবদ্বীপে ফেরার আগে তাকে শাশুড়ি বলেছিল, মৃত্যুর আগে একবার, শচীর সন্তান, সে ছেলে মেয়ে, যাই হোক, একবার দেখতে চায়। সন্তানটির মুখ না দেখে মরলে তার ইহজীবনের একটা সাধ অপূর্ণ থেকে যাবে। সন্তানসম্ভবা পুত্রবধূর শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে তাকে শ্রীহট্ট ছেড়ে যেতে দিতে চায়নি শোভাদেবী। সংসারের নানা জনের চাপে শোভাদেবীর সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। শাশুড়ির অঝোর চোখের জলের মধ্যে তাকে শচী কথা দিয়েছিল, সুযোগ পেলেই সে সন্তানকে শ্রীহট্টে এনে ঠাকুমার কোলে তুলে দেবে। নবদ্বীপে গোরার জন্মের কিছুদিন পরে বাবা, নীলাম্বর চক্রবর্তীকে স্নেহশীলা শাশুড়ির বিবরণ শোনাতে বসে, শচী এই ঘটনা বলেছিল। নীলাম্বর অনুমান করেছিল, নিরুদ্দিষ্ট বড় ছেলের খোঁজে গোরাকে শ্রীহট্টে যেতে রাজি করানোর সময়ে তাকে ঠাকুমার কাছে যাওয়ার কথা শচী বলবে। গোরাকে শাশুড়ির কাছে পাঠিয়ে প্রতিশ্রুতি পূরণের দায় থেকে মুক্ত হবে। সঠিক ছিল নীলাম্বরের অনুমান। আঠারো বছর পরেও শাশুড়িকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি শচী মনে রেখেছে। ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করার কথা, পইপই করে মনে করিয়ে দিয়েছিল গোরাকে।
নৌকো থেকে নেমে, জয়পুর গাঁয়ের তপন মিশ্রের বাড়ি খুঁজে তার সদর দরজায় গোরা পৌঁছে গেল। ছোট একটা নদী পেরোতে আরও একবার নৌকো চাপতে হয়েছিল তাকে। হাঁটতে হয়েছিল কয়েক মাইল পথ। বাড়িতে ছিল তপন। বাড়ির ভেতর থেকে এসে দরজায় পাকা সোনার মতো গায়ের রং, দেবদূতের আকৃতি, উত্তুঙ্গ, উজ্জ্বল, প্রখর ব্যক্তিত্ববান এক যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বঙ্গালভূমের নিম্নবিত্ত ব্রাহ্মণসন্তান তপনের বুক স্নিগ্ধ আনন্দে ভরে গেল। খুব চেনা মনে হলেও এই যুবককে আগে কোথায় দেখেছে, খেয়াল করতে পারল না। তপনের হাতে নীলাম্বর চক্রবর্তীর লেখা চিঠি তুলে দিয়ে গোরা যখন অপেক্ষা করছে, তার মধ্যে দ্রুত একাধিকবার চিঠি পড়ে ফেলল তপন। তার মুখ দিয়ে কথা সরল না। দু’হাতে গোরাকে যখন সে বুকে জড়িয়ে ধরল, তার দু’চোখ বেয়ে দরদর করে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কুলগুরু নীলাম্বর চক্রবর্তীর দৌহিত্র গোরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অভিভূতের মতো গুরুস্তোত্র জপ করছিল তপন—
“গুরুব্রহ্মা, গুরুবিষ্ণু, গুরুদেবো মহেশ্বরঃ
গুরুরেব পরমং ব্রত্ম, তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ।”
গোরা অনুভব করছিল, শ্রীহট্টে প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী, যথার্থ প্রিয়জনের ঠিকানা, সে পেয়ে গেছে। তপন মিশ্রের পরিবারে পরমাত্মীয়ের মতো জায়গা মিলে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে বিশ্বরূপের খবরের সঙ্গে গোরা এমন আরও তথ্য জানল, যা তার চিন্তার জগতে গভীর আলোড়ন জাগাল। তার আগে আরও একটা কাহিনী আছে।
গোরা শ্রীহট্টে আসার আগে, নবদ্বীপে রাজা লক্ষ্মণসেনের উত্তরপুরুষকে খুঁজতে সুলতানের সিন্ধুকীরা যে তল্লাশি শুরু করেছিল, তা ক্রমশ বাড়তে থাকল। ব্রাক্ষ্মণ, নবশাক পল্লীতে এমন কিছু কাণ্ড ঘটল, যার ঢেউ পৌঁছে গেল গোরার সংসারে। শ্রীহট্টে গোরা রওনা হওয়ার পরে গঙ্গায় স্নানের ঘাটে, পড়শিদের মুখে সুলতানের সিন্ধুকীরা গোরাকে ধরে নিয়ে যেতে নবদ্বীপে ডেরা গেড়েছে, এ গুজব শচী আর লক্ষ্মীর কানে গেল। শচী যত ভয় পেল, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত হল লক্ষ্মী। খবরটা প্রথম শুনে পনেরো বছরের কিশোরী বধু লক্ষ্মী বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। হুঁশ ফেরার পরেও সে স্বাভাবিক হল না। তার ক্ষিধে তেষ্টার বোধ পর্যন্ত ভোঁতা হয়ে গেল। আলুলায়িত চুল, এলোমেলো পোশাক, থেকে থেকে ভয়ে চমকে উঠছিল। নবদ্বীপের নানা সম্প্রদায়ের বেশ কিছু সন্দেহভাজন মানুষকে লক্ষ্মণসেনের বংশধর ভেবে আটক করে গৌড়ে চালান দেওয়াতে সেখানে ব্রাবৈকা সমাজে (ব্রাক্ষ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ) ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব উঠেছিল। রীতিমত ভয়ের বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল সেখানে। কানাঘুষোয় মানুষ জেনে গিয়েছিল সুলতানের সম্ভাব্য নিধনকারী, যে কিনা সেনরাজবংশের নবম অথবা দশম উত্তরপুরুষ, নবদ্বীপে সে বড় হচ্ছে। গৌড়ের সিংহাসনের সেই ন্যায্য দাবীদারের শরীরে তিনশ’ বছর পরেও প্রবাহিত হচ্ছে রাজা লক্ষ্মণসেনের রক্ত। তার বয়স সঠিক জানা না গেলেও সে দিব্যকান্তি তরুণ, তার চেহারায় রাজসিক বৈশিষ্ট্যগুলি এক নজরে ধরা যায়, এ গুজবও লোকসমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল।
কাটোয়া থেকে নরহরি যে বার্তা বয়ে এনেছিল, অন্য সূত্রে প্রায় একই খবর পৌঁছেছিল নীলাম্বর চক্রবর্তীর কানে। নীলাম্বর অনুমান করেছিল, নাতি গোরার ওপর সিন্ধুকীদের নজর পড়লে, তার বিপদ ঘটতে পারে। নিমাই পণ্ডিতকে ইতিমধ্যে তারা শনাক্ত করে থাকলে, যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষকে নিশ্চয় তা জানিয়েছে। ব্রাক্ষ্মণ থেকে নবশাক, সব সম্প্রদায়ের বাছাই করা সুন্দরীদের নিয়ে রাজা লক্ষ্মণসেনের অন্তঃপুরে পত্নী, উপপত্নীর সংখ্যা কম ছিল না। তিনশ’ বছরে তাদের সন্তানসন্ততির কত শাখাপ্রশাখা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে, কে তার হিসেব রাখে? সহজ কাজ নয় সে হিসেব রাখা। অথচ জ্যোতিষী রব্বানির গণনা অনুযায়ী অদৃশ্য সেই শত্রুকে নিকেষ করার মতো দূরূহ কাজে সিন্ধুকীবাহিনীকে নামিয়ে দিয়েছে সুলতান।
লোকপরম্পরায় সুলতান হোসেন শাহের পরিকল্পনা, নীলাম্বরের কানে এলেও পরিবারের কারও কাছে সে ভাঙেনি। বাতাসে উড়ে বেড়ানো খবরের সত্যিমিথ্যে যাচাই না করে শচীকে একান্তে ডেকে আলোচনা করাও তার অবান্তর মনে হয়েছিল। বিশ্বরূপকে খুঁজতে গোরার শ্রীহট্টে যাওয়ার আয়োজন পাকা হতে বেলপুকুরিয়ার বাড়িতে মেয়ে, শচীকে ডেকে পাঠিয়েছিল নীলাম্বর। সুলতানের সিন্ধুকীবাহিনী সম্পর্কে উচ্চবাচ্য না করে বিশ্বরূপের খোঁজে গোরাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্রীহট্টে পাঠানোর উপদেশ দিয়েছিল। শচীকে বিশেষভাবে যে কথাটা বলেছিল, তা হল শ্রীহট্টে গোরার বসবাস প্রসঙ্গে। পিতামহ উপেন্দ্র মিশ্রের সংসারের বদলে গোরা যেন তপন মিশ্রের ঠিকানায় আশ্রয় নেয়, এই ছিল নীলাম্বরের পরামর্শ। পিতৃদেবের নির্দেশ শচীর কাছে ছিল বেদবাক্য। বাবার নির্দেশ অমান্য করার চিন্তা করতে পারে না সে। মায়ের মতো গোরাও দাদামশাই-এর অনুগত। তপন মিশ্রের পরিবারে জায়গা পেয়ে গোরা অনুভব করল, শ্রীহট্টে এত প্রীতিকর, নিরাপদ আশ্রয় কোথাও মিলত না। মা আর নববিবাহিতা বধূর জন্যে মন কেমন করার সঙ্গে তাদের অমঙ্গলের আশঙ্কা প্রায়শ তার মাথায় ভর করত। লক্ষ্মণসেনের বংশধর খুঁজতে সুলতানের সিন্ধুকীবাহিনী তাদের বাড়িতে হঠাৎ এসে হাজির হলে শচী আর লক্ষ্মীর কী দশা হবে? সিন্ধুকীদের কী বলবে শচী? লক্ষ্মী হয়তো ভয়ে জ্ঞান হারাবে। দাদা বিশ্বরূপকে খোঁজার চেয়েও বড় কাজে, সুলতানের প্রতিহিংসা থেকে বাঁচতে নবদ্বীপ ছেড়ে শ্রীহট্টে তার স্বামী গা-ঢাকা দিয়েছে, লক্ষ্মী বুঝে নেবে। পরিবারের লোকজন, বিশেষ করে তার মা, পড়শিরাও এরকম ভাবতে পারে। নবদ্বীপ থেকে নিরাপদ দূরত্বে, শ্রীহট্টে গোরা যে বিপদে পড়বে না, এই ভেবে মা, বউ আপাতত আশ্বস্ত হলেও ভয়ে তারা গুটিয়ে থাকবে। ভয় তাড়াতে না পারলে তা ক্রমশ বাড়ে, বাড়তে থাকে। নবদ্বীপে মেয়ে, নাতবউ-এর পাশে দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তী থাকাতে নিজের সংসার নিয়ে গোরা অবশ্য বিশেষ চিন্তিত নয়, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে দাদামশাই, দুই মামা মিলে সামলে দিয়েছে তাদের সংসার। জগন্নাথ মিশ্র বেঁচে থাকতেও সব দরকারে তারা পাশে থেকেছে। তপন মিশ্ৰ আর তার পরিবারের সঙ্গে গোরার অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকে। তপনের কাছ থেকে সংসার ছেড়ে বিশ্বরূপের চলে যাওয়ার অনেক খবর গোরা জানতে পারল।
বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন ভাই লোকনাথকে নিয়ে রাঢ় আর গৌড়ের পথে উদাসীনের মতো ঘুরে বেড়িয়ে শেষপর্যন্ত দশনামী শৈব ‘অরণ্য’ সম্প্রদায়ের এক সন্ন্যাসী, শ্রীকৃষ্ণ ভারতী, মতান্তরে কেশব ভারতীর কাছে শৈবমন্ত্রে কাশীতে ষোলো বছরের তরুণ, বিশ্বরূপ দীক্ষা নেয়। তার নাম হয় শঙ্করারণ্য। দশনামী শৈব সম্প্রদায়ের গুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়াতে তার নামের শেষে ‘অরণ্য’ শব্দটি জুড়ে গিয়েছিল। সন্ন্যাস নেওয়ার পরে পরম স্নেহের ভাই, যাত্রা-সঙ্গী লোকনাথকে নরদ্বীপে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে রাজি করায়। অনেক অনুরোধ,উপরোধ করতে হয়েছিল বিশ্বরূপকে, বিস্তর ঝরাতে হয়েছিল চোখের জল। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল বারো বছরের কিশোর লোকনাথ। সে এখন রীতিমত সংসারী, দু’ছেলের বাবা। বাড়ি ছাড়ার পাঁচ বছর পরে শ্রীহট্টে বিশ্বরূপ যখন এসেছিল, তখন তার মাথায় জটাজুট, মুখভর্তি লম্বা দাড়ি-গোঁফ, লোহিত বসন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে দণ্ড, কাঁধের ঝোলায় আর এক প্রস্থ লাল পোশাক, চিমটে, কমণ্ডলু, কমনীয় মুখের রীতিমত নিরেট সন্ন্যাসী। পূর্বাশ্রমের স্মৃতি নিয়ে বিশেষ আলাপ না করলেও প্রায়ই গোরার প্রসঙ্গ তুলে দীর্ঘ সময়ের আলোচনাতে সন্ন্যাসী শঙ্করারণ্যের দু’চোখ জলে ভিজে উঠত। ছোটভাই-এর মধ্যে আকাশচুম্বি মহিমার ভ্রূণ নজর করে, তার পড়ার জন্যে বিশ্বরূপ যে একটা পুঁথি লিখেছিল, সে কথা তপনকে বলেছিল। পুঁথির পরিণাম কী ঘটেছিল, তা জানাতেও দ্বিধা করেনি। পুঁথিটা গোরাকে পড়ানোর যে কী সুতীব্র ইচ্ছে বিশ্বরূপের ছিল, তপন তা ভাষায় বলতে পারেনি। সন্ন্যাস জীবনেও সে আক্ষেপ শঙ্করারণ্য বয়ে বেড়াচ্ছিল। পুত্রবধূ হিসেবে বাবা জগন্নাথ মিশ্রের পছন্দের মেয়েটিকে ‘পৌনর্ভবা’ করার জন্যে সন্ন্যাস নেওয়ার পরেও তার মনের গভীরে যে অপরাধবোধ জন্মে আছে, তপন টের পেয়েছিল। স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী, পৌনর্ভবা কন্যারা, অর্থাৎ বিয়ে ভেঙে যাওয়া বাগদত্তা কুমারীরা বিয়ের অযোগ্য হয়ে যায় এবং সেই কারণে বর্জনীয়, স্মৃতিশাস্ত্রের ছাত্র বিশ্বরূপ তা জানত। নবদ্বীপে কিছু প্রতিবেশির সংসারে পৌনর্ভবা মেয়েদের দুর্দশা, নিজের চোখে তার দেখা ছিল। পৌনর্ভবা কন্যা ঘরে থাকার কারণে, তার পরিবারকে হেনস্থার একশেষ করা হয়। শুধু বাগদত্তা মেয়ে কেন, মনোদত্তা কন্যা, পুরুষ মানুষের সঙ্গে কুমারী মেয়ের হেসে কথা বলা, এক পাত্র থেকে পুরুষের সঙ্গে জল ভাগ করে খাওয়া, এমন কি কোনও পুরুষের হাত একবার একটি মেয়ে ধরলে, তাকে পৌনর্ভবা, বিয়ের অযোগ্য ঘোষণা করা হত। এটা ছিল সমাজের কড়া নির্দেশ। হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ত না। আত্মহত্যা করা ছাড়া তাদের গতি থাকত না। নবীন স্বামীর জন্যে প্রতীক্ষায় থাকা সেই বাগ্দত্তা কিশোরী শেষ পর্যন্ত নিজের জন্যে সুখের সংসার খুঁজে পেয়েছিল কিনা, শঙ্করারণ্যের মাথায় সে প্রশ্ন প্রায়ই জেগে উঠত। দাড়ি-ঘোঁফের আড়ালে তার মুখ না দেখা গেলেও দু’চোখ করুণ হয়ে উঠতে দেখেছে তপন। শ্রীহট্টে শঙ্করারণ্যর আসার প্রধান কারণ ছিল, বুরহানউদ্দিন দরগা দর্শন, সেখানে মুজাভিরের মুশকিল আসান চামরের ছোঁয়া পাওয়া। জয়পুর থেকে স্থলপথ, জলপথে বুরহানউদ্দিন দরগা পর্যন্ত শঙ্করারণ্যের সঙ্গী হতে চেয়েছিল তপন। তার আবেদন সরাসরি নাকচ করে দিয়ে দু’ঘণ্টার পথ শঙ্করারণ্য একা যেতে চেয়েছিল। দরগা দর্শন করে মুজাভিরের আশীর্বাদ নিয়ে সন্ধের মধ্যে তপনের বাড়িতে শঙ্করারণ্যের ফেরার কথা থাকলেও তিনদিন অপেক্ষার পরেও সে না ফিরতে চতুর্থ দিন সকালে দরগার মুজাভিরের কাছে তপন চলে গিয়েছিল। বিশ্বরূপকে খোঁজাখুঁজি করে শুধু জেনেছিল, দরগায় এক রাত মুজাভিরের আশ্রয়ে কাটিয়ে পরের দিন ভোরে, প্রথম আজানের আগে সেখান থেকে সে বেরিয়ে যায়। শঙ্করারণ্য ঠিক কোথায় গেছে, মুজাভিরের অনুগামীরা কেউ যখন বলতে পারল না, তখন সাহসে বুক বেঁধে মুজাভিরের সাক্ষাৎপ্রার্থী হল তপন। দূধে আলতা গায়ের রং, ঘন দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখ, বিশালদেহী মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে তপনের হৃৎকম্প হচ্ছিল, আটকে গিয়েছিল কণ্ঠস্বর। বারকয়েক ঢোক গিলে, যৎসামান্য সাহস সংগ্রহ করে বিশ্বরূপের খবর জানতে চেয়েছিল।
গম্ভীর গলায় মুজাভির প্রশ্ন করেছিল, বিশ্বরূপ কে?
থতমত খেয়ে তপন বলেছিল, আজ্ঞে, স্বামী শঙ্করারণ্য।
প্রসন্ন হেসে মুজাভির বলল, খোদার বন্দা, মালিকের খোঁজে দাক্ষিণাত্যে রওনা হয়েছে।
স্থির চোখে তপনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুজাভির প্রশ্ন করল, তুমি কে?
তপন নিজের পরিচয় দিতে তার মাথায় শরীরে মুশকিল আসান চামর বুলিয়ে দিয়ে মুজাভির বলেছিল, দরগায় আসা যাওয়া রেখ। আল্লার কসম, তোমার জন্যে ‘দোয়া’ চাইব।
সত্তরোর্ধ্ব মুজাভিরের শরীরে বয়সের ছাপ পড়েনি। টানটান গায়ের চামড়া, দু’চোখে ঝিলিক কাটা দৃষ্টি, তপনের মনে হচ্ছিল তার বুকের ভেতর পর্যন্ত মানুষটা দেখে নিচ্ছে। তপনের গা সিরসির করছিল। তাকে না জানিয়ে শ্রীহট্ট ছেড়ে বিশ্বরূপের উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা শুনে প্রথমে সে মর্মাহত হলেও, মুজাভিরের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে, তার দু’চোখের জ্বলজ্বলে মণি দুটো দেখে তপনের গা কাঁপছিল। দরগা ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে আসতে ব্যস্ত হয়েছিল সে। তার মনে হয়েছিল, মুজাভিরের কাছে শঙ্করারণ্য সন্ন্যাসী হিসেবে নিজের পরিচয় দিলেও জগন্নাথ মিশ্রের সন্তানকে চিনতে বয়স্ক মানুষটা ভুল করেনি। শ্রীহট্টের সবচেয়ে পবিত্র সুফি দরগার গর্ভগৃহ, বুরহানউদ্দিন মাজারে, মায়ের তিন দিন তিন রাতের ধর্নার সঙ্কল্পে, শেষ রাতে দুর্যোগের জন্যে দশ বছরের যে সন্তানটি সেখানে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল, আরও দশ বছর পরে সেই বালক বিশ্বরূপের মুখে যতই দাড়িগোঁফ গজিয়ে থাকুক, এক নজরে তাকে চিনে ফেলেছে মুজাভির। দশনামী শৈব, শঙ্করারণ্য কি তাকে কোনও প্রশ্ন করেছিল? ঘটনাক্রমের কোথাও কিছু রহস্য আঁচ করে তপন ভয় পেয়েছিল। শ্রীহট্ট ছেড়ে, সপরিবারে বারাণসী ধামে গিয়ে থাকার আয়োজন গত তিন বছর ধরে সে করে চলেছে। শ্রীহট্টের আত্মীয় বন্ধুদের কেউ জানে না বাড়ি, বিষয়সম্পত্তি বেচে চিরকালের মতো জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার ছক, সে গোপনে সেরে ফেলেছে।
গোপন পরিকল্পনার বিবরণ গোরাকে শোনাতে শুরু করে বারবার তপনের দু’চোখ জলে ভিজে উঠছিল। শ্রীহট্টে বসবাস করা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে, ঘরের মেয়ে বউ পর্যন্ত নিয়মিত লুঠ হয়ে যাচ্ছে, এমন অনেক ঘটনা, তপনের কাছ থেকে কয়েকদিনে গোরা শুনে ফেলল। সমাজের অত্যাচারের সঙ্গে গৌড়, দিল্লি থেকে সুফি পীর ফকিরের ছদ্মবেশে ঝাঁকে ঝাঁকে যারা শ্রীহট্ট, আরাকানে এসে ডেরা বাঁধছে, তাদের মধ্যে যেমন অসংখ্য গুপ্তচর রয়েছে, তেমনি আছে তুখোড় যোদ্ধা, উচ্চাভিলাষী সৈনিক। সুফি সাধকদের কেউ কেউ হঠাৎ ঘোড়সওয়ার সেনাপতি বেশে দলবল নিয়ে ছোট-বড় দ্বীপ, জমিদারি দখল করে শাসক সেজে বসছে, তাদের অত্যাচারে প্রজাদের মান-সম্ভ্রম, এমনকী প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন হচ্ছে।
তপনের মুখে বিশ্বরূপের শ্রীহট্ট ছেড়ে যাওয়ার বিবরণ শুনে গোরা তখনই ঠিক করল দরগার মুজাভিরের সঙ্গে পরের দিন সে দেখা করবে। তপনকে মনের ইচ্ছেটা গোরা জানাতে সে চমকে উঠল। ভয়ে সাদা হয়ে গেল তার মুখ। মুজাভিরের সঙ্গে গোরার সাক্ষাৎকার থেকে যে কোনও অঘটন ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা কাঁপিয়ে দিল তাকে। গোরাকে কয়েকদিন ধরে দেখে, তার সঙ্গে মেলামেশা করে, তাকে যতটা নম্র, শান্ত মনে হয়েছে, ততটাই মনে হয়েছে অসমসাহসী, একরোখা যুবক। মুজাভিরের মতোই শক্ত, সমর্থ, সমান উচ্চতার মানুষ মুজাভিরের মতো সুনির্দিষ্ট অথচ আলাদা কোনও ধর্মমত গোরার আছে কিনা, তপন জানে না। দু’জনের আলাপচারিতায় নানা কথার মধ্যে ধর্মীয় আলোচনা যদি শুরু হয়, বিসম্বাদ লেগে যায়, তা অনেক দূর গড়াবে। তপন সবিনয়ে গোরাকে দরগায় মুজাভিরের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া থেকে বিরত করতে চাইলেও পারল না। গোরা অটল থাকল নিজের ইচ্ছেতে। তপন দ্বিতীয়বার একই অনুরোধ নিয়ে মুখ খুলতে সাহস পেল না। নিরুদ্দেশ দাদাকে খুঁজতে এসে গোরার কোনও বিপদ হলে, অনেক দূরে নবদ্বীপে, নীলাম্বর চক্রবর্তীর পরিবারের কাছে ইহজীবনে সে মুখ দেখাতে পারবে না। পরের দিন সাতসকালে গোরা যখন বুরহানউদ্দিন দরগার মুজাভিরের সঙ্গে দেখা করার জন্যে জয়পুর থেকে নৌকোয় উঠছে, তপন নিঃশব্দে ইষ্টনাম জপ করছিল। গোরার কোনও অনিষ্ট না হয়, এই প্রার্থনা করছিল। গোরা কথা দিয়েছে, সন্ধের মধ্যে জয়পুরে ফিরবে, এই ভরসাটুকু ছিল তপনের সম্বল। কথা রেখেছিল গোরা। সন্ধে কাবার করে, অন্ধকার ঘন হওয়ার কিছু পরে, গ্রাম যখন নিঝুম, পথঘাট ফাঁকা, ঝোপঝাড়ে থোকা থোকা জোনাকি জ্বলছে, জয়পুরের ঘাটে গোরা নেমেছিল নৌকো থেকে। মাঝবিকেল থেকে ঘাটে তার জন্যে অপেক্ষা করে অন্ধকার নামতে ঘাট যখন জনমানবহীন, রাতের মতো নৌকো পারাপার থেমে গেছে, দুশ্চিন্তায় ধড়ফড় করছে তপনের বুক, অপেক্ষা করা নিরর্থক জেনেও ঘরে ফিরতে পা উঠছে না, বনবাদাড়ে কীটপতঙ্গের গুঞ্জন শুরুর কিছুক্ষণ পরে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে, তখন অন্ধকার নদীর বুক চিরে ছপছপ করে জল কেটে অচেনা এক নৌকো এসে দাঁড়াল ঘাটে। নৌকোয় গোরা একা, দ্বিতীয় যাত্রী না থাকলেও গোরাকে ঘিরে ছিল বলবান শরীরের, কয়েকজন মানুষ। শ্রীহট্টের ঘাট থেকে গোরাকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে মুজাভিরের নির্দেশে তার অনুগামীরা জয়পুরের ঘাট পর্যন্ত এসেছিল। গোরা ঘাটে নামতে, ফিরতি নৌকোয় যাত্রীদের আলাপ শুনে তপন ব্যাপারটা ধরতে পারল।
বাড়ি ফিরে রেড়ির তেলের সেজবাতির আলোয় গোরার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে তপন জিজ্ঞেস করল, দেখা হল মুজাভিরের সঙ্গে?
হ্যাঁ।
মুজাভিরের সঙ্গে গোরার আলোচনার বিষয় সম্পর্কে তপন প্রশ্ন করল না। তার ধারণা ছিল গোরা নিজেই জানাবে। গোরা মুখ খুলল না। তপন হঠাৎ নজর করল সকালে কাছাকোঁচা দিয়ে ধুতি পরে যে গোরা বুরহানউদ্দিনের দরগায় গিয়েছিল, ফেত্তা দিয়ে ধুতিটা লুঙির মতো করে কোমরে জড়িয়ে সে ঘরে ফিরেছে। গোরার পোশাকে অকস্মাৎ ভোল বদল দেখে তপন চমকে গেল। ধর্মান্তরিত গোরা কি বাধ্য হয়ে পরনের ধুতি দু’ভাঁজ করে যবনদের মতো লুঙি ধারণ করল? প্রশ্নটা মনে জাগতে তপন শিহরিত হল। কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে সে প্রশ্ন করল, বিশ্বরূপের কোনও হদিশ মিলল?
মনে হয়, দাক্ষিণাত্যের দশনামী শৈবসম্প্রদায়ের কোনও আখড়ায় সে রয়েছে।
মুজাভির জানালেন?
তপনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গোরা বলল, সে ক্ষুধার্ত। তার ঘুম পেয়েছে।
গোরার রাতের খাওয়ার আয়োজন করতে তপন তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে স্ত্রীকে খবর দিতে গেল। রাতে ঘুমনোর আগে তপনকে গোরা জানাল, তার বারাণসীধামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সেখানে তপনের চলে যাওয়া উচিত। বিস্ফারিত চোখে গোরার নির্দেশ শুনছিল তপন। তাকে ঘুমনোর আগে অনায়াস ভঙ্গিতে গোরা জানাল, ভবিষ্যতে কখনও তার বারাণসী যাওয়ার সুযোগ ঘটলে, সে অবশ্যই সেখানে তপনের খোঁজ করে তার সঙ্গে দেখা করবে।
গোরার কথা বলার ভঙ্গিতে তপনের গায়ে কাঁটা দিল। তার মনে হল বুরহানউদ্দিনের দরগায় সকালে যে গোরা গিয়ে সন্ধেতে যে জয়পুরে ফিরল, দু’জন আলাদা মানুষ। বুরহানউদ্দিন মাজারে গোরা এমন কোনও সত্য জেনেছে, যা তাকে দু’ভাগ করে দিয়েছে সকালের গোরা আরা রাতের অন্ধকারে যে ফিরল, তারা এক মানুষ নয়। আচমকা অজ্ঞাত কোনও সত্য জানলে, একজন মানুষ এরকম দ্বিখণ্ডিত অস্তিত্ব, দু’জন মানুষ হয়ে যায়। মুজাভিরের মুশকিল আসান চামরের ছোঁয়ায় কি গোরা দু’টুকরো হয়ে গেল? গোরা কি নিজের পূর্বজন্মের পরিচয় জেনেছে অথবা পরের জন্মের ঠিকানা পেয়ে গেছে? মুজাভিরের সঙ্গে গোরার আলোচনার বিন্দুবিসর্গ তপন অনুমান করতে না পারলেও এটুকু বুঝল যে, তাড়াতাড়ি শ্রীহট্টের পাট চুকিয়ে সপরিবারে অন্য কোথাও, সম্ভব হলে গৌড় বাংলার বাইরে নিরাপদ, শান্ত কোনও রাজ্যে সরে পড়া দরকার।
রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুলেও গোরার দু’চোখে ঘুম ছিল না। নিজের পরিচয় সে দেওয়ার আগে, শুধু তাকে দেখে পাথরের মূর্তির মতো মুজাভির কেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, পলকহীন চোখে তাকে দেখছিল, গোরা বুঝতে পারেনি। মুজাভিরের কয়েকজন সেবক, বান্দাও সবিস্ময়ে নজর করছিল তাকে। কারও মুখে যখন কথা সরছে না, গোরা নিজের পরিচয় দিয়ে জানিয়েছিল, নবদ্বীপ থেকে সে আসছে। তাকে বাড়তি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুজাভির ডেকে নিয়েছিল গর্ভগৃহে, নিজের খাস কামরায়। স্বল্পভাষী মুজাভির দু’চার প্রশ্নে গোরার পরিবারের খবর, এমন কি দু’বছর আগে লক্ষ্মীকে সে বিয়ে করেছে, জেনে নিয়েছিল। শান্তভাবে শুনেছিল, জগন্নাথ মিশ্রের মৃত্যুর খবর, শচীর অসচ্ছল সংসারের টুকিটাকি তথ্য, তাদের বড় ছেলে বিশ্বরূপ সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে শঙ্করারণ্য নাম গ্রহণ করে দেশ প্রদক্ষিণ করছে, এবম্বিধ ঘটনাবলী।
মুজাভির প্রশ্ন না করলেও তার দু’চোখের উজ্জ্বল তারা থেকে যে নিঃশব্দ জিজ্ঞাসা ঝরে পড়ছিল, তার টানে কথা বলে যাচ্ছিল গোরা। বুরহানউদ্দিন দরগায় কয়েক বছর আগে শঙ্করারণ্য এসে দেখা করে গেছে, সে বিষয়ে মুজাভির উচ্চবাচ্য করল না। ধ্যানস্থের মতো গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছিল মুজাভির। তার প্রত্যেকটা কথা প্রতিটি শব্দ, এমনকি বর্ণ পর্যন্ত মনোজগতে শুষে নিচ্ছিল। গোরা টের পাচ্ছিল শ্রোতার প্রগাঢ় অভিনিবেশ, কথা বলিয়ে নিচ্ছে তাকে। গুটিকয়েক যে কথা মুজাভির বলেছিল, তার একটা ছিল, মক্কা-মদিনা পেরিয়ে আরও পশ্চিমে কৃষ্ণসাগরের তীরে শঙ্করারণ্য পৌঁছে গেছে। বিধর্মীদের বসবাসের ক্রমশ অযোগ্য হয়ে উঠছে শ্রীহট্ট, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে হিন্দুদের চলে যাওয়া উচিত। সবশেষে কয়েকটি আচরণবিধি গোরাকে নিজের সমাজে চালু করতে বলেছিল। তার মধ্যে একটা ছিল, ধুতিকে ফেত্তা দিয়ে লুঙির মতো কোমরে জড়ানো, সবাই মিলে পংক্তিভোজের আসরে বসে খাওয়ার সঙ্গে সমবেতভাবে নাচ, গান, বিনোদন করা। মুজাভির জানিয়েছিল, হতদরিদ্র মানুষের পক্ষে একফেত্তা বসন, খুব বেশি তিন হাত, জোগাড় করতে প্রাণ যেখানে ওষ্ঠাগত হয়, সেখানে লজ্জানিবারণে সর্বসাধারণকে লুঙি পরার স্বাধীনতা দিলে, গরিব মানুষের জন্যে শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ একটু আলগা করলে, সমাজের কল্যাণ হবে। জাতপাতের ব্যবধান মুছে, স্বল্পাবৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, সকলে মিলে ভোজের আয়োজন, আনন্দোৎসব করলে, নিরন্ন, কাঙালিরা সেখানে জায়গা পেতে পারে, খুশির আলো ছড়িয়ে পড়তে পারে তাদের সংসারে। সস্নেহে, পিতৃপিতামহের মতো গোরাকে বুঝিয়েছিল ধর্মের আর এক নাম প্রীতি, মানুষকে ভালোবাসা। ধর্ম, জাতপাত নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। গোরাকে মুজাভির এমনভাবে কথাগুলো বলছিল যেন সে-ও এক যবনসন্তান, নিজের ধর্ম ছেড়ে সদ্য যবনধর্ম গ্রহণ করেছে। মুজাভির একবারও অবশ্য তাকে ধর্মান্তরিত হতে বলেনি, সেরকম আভাস পর্যন্ত দেয়নি। গোরাকে রাতটা দরগায় থেকে যেতে মুজাভির অনুরোধ জানালে, সে যখন জয়পুরে ফেরার প্রতিশ্রুতির কথা শোনাল, মুজাভির দ্বিতীয়বার এ প্রসঙ্গ পাড়েনি। গোরার দিকে বারবার শুধু সতৃয়, কাতর চোখে তাকিয়ে গভীর সমুদ্রের অন্তঃস্তল দেখার মতো কিছু খুঁজছিল। মুজাভিরের ঘর ছেড়ে গোরা বেরোনোর আগে বয়স্ক মানুষটা হঠাৎ তাকে ফিসফিস করে বলেছিল, তুমি চাইলে আমার পরে এই দরগার মুজাভির হতে পারো। আমার বিশ্বাস আল্লার বান্দারা তোমাকে এক কথায় মুজাভির হিসেবে মেনে নেবে।
মুজাভিরের কথা শুনে গোরার বুকের ভেতরটা মুহূর্তের জন্যে কেঁপে উঠেছিল। তখনই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, আমি বৈদিক ব্রাক্ষ্মণসন্তান, আমার এমন চিন্তা করা-ই মহাপাপ।
জলে ভেজা দু’চোখ নিয়ে মুজাভির বলেছিল, দোজখে যাওয়ার মতো কাজ তোমাকে করতে বলব না, তবে নবদ্বীপে ফিরে গিয়ে কখনও যদি তোমার মনে মুজাভির হওয়ার ইচ্ছে জাগে, তাহলে সটান এখানে চলে এসো। আমি বেঁচে থাকলে তো কথা নেই, মরে গেলেও তোমার জন্যে মুজাভিরের পদ তখনও খালি হয়ে যাবে।
মুজাভিরের প্রস্তাব শুনে তপনের মতো গোরা ভয় না পেলেও বিহ্বল হয়েছিল। উদ্গত কান্না চোখে নিয়ে বয়স্ক মানুষটা পরিহাস করছে না, সে অনুভব করেছিল। মাথা নিচু করে গোরা দরগা থেকে নিঃশব্দে নদীর ঘাটে পৌঁছে মুজাভিরের নৌকোয় তার পাঠানো একঝাঁক রক্ষি পরিবেষ্টিত হয়ে জয়পুরে ফিরেছিল। অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে মুজাভিরের স্নেহকাতর অভিভাবকের মতো আচরণ সম্পর্কে গোরা ভেবে যাচ্ছিল। ভিন্ন ধর্মের এক গোঁড়া সাধক এমন স্নেহশীল, হৃদয়বান হতে পারে, গোরার ধারণা ছিল না। তাকে সবচেয়ে অভিভূত করেছিল বুরহানউদ্দিন দরগার মুজাভির হওয়ার ডাক। নবদ্বীপের বিধর্মী এক কাফেরকে দরগার সর্বোচ্চ পদে বসতে একজন মুসলিম পীর যে এত আকুল মিনতি করতে পারে, এ ধারণা তার ছিল না। গোরা সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছে, মুজাভিরের সঙ্গে নিজের শরীরের গঠন, চালচলন, কথা বলার ভঙ্গিতে মিল দেখে। শ্রীহট্ট আর নবদ্বীপের দুই ভিন্নধর্মের দু’জন মানুষের মধ্যে এত মিল সম্ভবত তপনেরও নজর এড়ায়নি। বাড়ির সদর দরজা খুলে আবছা অন্ধকারে প্রথমবার গোরাকে দেখে সেদিন তাই সে চমকে গিয়েছিল। মুজাভিরের সঙ্গে তার দেখা করতে যাওয়াতেও চাপা আপত্তি ছিল তপনের। মুখে কথাটা না বললেও ঠারেঠারে জানিয়েছিল গোরাকে। গোরা পাত্তা দেয়নি।
জয়পুর থেকে শ্রীহট্টে যাতায়াত, আরও নানা ধকল গোরার ওপর দিয়ে গেলেও ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ার মতো শরীর তার নয়। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার পরে সমান মেহনত সে রাত জেগে করতে পারে। মুজাভিরের চেহারা, মুখ, মনের মধ্যে পাকাপাকি গেঁথে যাওয়ার সঙ্গে চোখের সামনে তরুণী বধূ লক্ষ্মীর, যে কিনা কুললক্ষ্মী, সেই দীর্ঘাঙ্গিনীর মুখ তার বুকের মধ্যে জেগে উঠল। স্বামী নবদ্বীপ ছেড়ে আসার আগের রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে অস্থির হয়েছিল লক্ষ্মী। তাকে আদর করে, বুঝিয়ে, শান্ত করে ঘুম পাড়াতে গোরাকে রাতের প্রায় তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত জাগতে হয়েছিল। স্বামী সোহাগিনী লক্ষ্মী শেষ পর্যন্ত বলেছিল, তুমি কিছু ভেবো না। নিশ্চিন্তে শ্রীহট্টে যাও। বিষ্ণুপুজো থেকে শাশুড়িমায়ের সেবা, সব আমি সামলাব পান থেকে চুন খসতে দেব না।
গোরার গলা জড়িয়ে কথা বলার মধ্যে লক্ষ্মী ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতের তৃতীয় প্রহরে ঘুমোলেও আকাশে ঊষার আলো ফোটার আগে লক্ষ্মী জেগেছিল। শচীর সঙ্গে গঙ্গার ঘাট থেকে স্নান সেরে যখন বাড়ি ফিরল, গোরার তখন সদ্য ঘুম ভেঙেছে। চটপট স্নান সেরে পোশাক গায়ে চাপিয়ে সে তৈরি হয়ে নিল। দুপুরের আগে বারকোণা ঘাট থেকে নৌকো রওনা হওয়ার কথা। গোরার সঙ্গে দেখা করতে আত্মীয়, বন্ধু, পড়শিরা আসতে শুরু করেছিল। বেলপুকুরিয়া থেকে দুই মাথা যজ্ঞেশ্বর, রত্নগর্ভ, দু’জন মামাতো ভাই (লোকনাথ নয়), পড়শিদের মধ্যে শ্রীবাস পণ্ডিত, চন্দ্রশেখর আচার্য, গদাধর, মুকুন্দ দত্ত, মুরারি, খোলাবেচা শ্রীধর, শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্য, যে কিনা শচীর দীক্ষাগুরু, এমনকি কাটোয়ার নরহরি সরকার পর্যন্ত রামচন্দ্রপুরে, জগন্নাথ মিশ্রের ভদ্রাসনে পৌঁছে গিয়েছিল। শ্বশুর-ভাসুর পর্যায়ের মানুষদের সম্মান দিতে তাদের চোখের আড়ালে, দরজার পাল্লার পাশে দাঁড়িয়েছিল লক্ষ্মী। তার দিকে নজর পড়তে দাওয়া থেকে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল গোরা। আলগোছে লক্ষ্মীর হাত নিজের দু’হাতের মধ্যে নিয়ে গোরা বলেছিল, কাল রাতে তোমাকে যে কথাগুলো বলেছিলাম, মনে রেখ। কুলদেবতার পুজো, মায়ের সেবায় ত্রুটি যেন না হয়। আরও একটা কথা, শ্রীহট্ট থেকে আমি না ফেরা পর্যন্ত তুমি বাপের বাড়ি যেও না।
লক্ষ্মীর দু’চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ছে। সে ফিসফিস করে বলেছিল, মরে গেলেও এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না। কথা দিচ্ছি। আমার কথার নড়চড় হবে না।
ঘরের বাইরে দেখা করতে আসা আত্মীয়, বন্ধুদের সংখ্যা বাড়লেও লক্ষ্মীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে গোরা জিজ্ঞেস করল, বলো, তুমি কি চাও, তোমার জন্য শ্রীহট্ট থেকে কী আনব? গোরার ছোঁয়ায় সলজ্জ, রাঙা মুখে লক্ষ্মী বলেছিল, আমি আর কী চাইব গো? বাড়িতে তোমার যে খড়মজোড়া রইল, রোজ আমি তা পুজো করব। দাদাকে খুঁজে বের করে, তাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো, আজ থেকে এই আমার প্রতি মুহূর্তের প্রার্থনা!
নিজের উত্তরীয়ের প্রান্ত দিয়ে লক্ষ্মীর দু’চোখের জল মুছে দিতে গোরার কষ্ট হচ্ছিল। যত কষ্ট হোক, সে বাস্তববাদী। দাদাকে খুঁজে মায়ের কাছে এনে দিতে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে। তার মনের গোপনে আরও যে ইচ্ছেটা ছিল, তা হল, শ্রীহট্টের ছাত্রদের মধ্যে নিজের লেখা ব্যাকরণের টিকা প্রচার করা। নিজের রচিত পুঁথির একাধিক অনুলিপি সে নিয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গালের ছাত্রদের সুশিক্ষার কাজে অসংখ্য চতুষ্পাঠীর কিছু পণ্ডিতকে যদি এই অনুলিপি পঠনপাঠনে রাজি করানো যায়, তাহলে সংসারে সচ্ছলতা বাড়ানোর সুযোগ ঘটতে পারে। গোরার মাথায় মুদ্রা আমদানির হিসেব নিকেশ ছাপিয়ে সরোবরে ভাসন্ত পদ্মকুঁড়ির মতো চোখের সামনে ফের লক্ষ্মীর মুখ জেগে উঠতে সে নিজের গলা থেকে যজ্ঞোপবীত খুলে সহধর্মিণীর হাতে দিয়ে বলল, এর চেয়ে বড় কিছু আমার নেই। তোমার হাতে তুলে দিলাম এই কুলচিহ্ন। আমি না ফেরা পর্যন্ত যত্ন করে রেখে দিও। আমার জন্যে অপেক্ষা করো।
উপবীত হাতে নিয়ে লক্ষ্মী প্রণাম করেছিল স্বামীকে। স্বামীর পায়ে কপাল, চিবুক, দুটো নরম ঠোঁট ঠেকিয়ে সে যখন ভূমি থেকে উঠে হাঁটু গেড়ে বসল, চোখের জলে অন্ধ হয়ে গেছে সে। বাইরে থেকে শচীর গলা ভেসে আসতে, মা ঘরে ঢোকার আগে দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়াল গোরা। আত্মীয় বন্ধুরা তাকে ঘিরে নিতে লক্ষ্মী ফের কপাটের আড়ালে লুকিয়ে রাখল নিজেকে। স্বামীর স্পর্শে শিহরিত লক্ষ্মীর হাতের মুঠোয় গোরার সে যজ্ঞোপবীত।
বাড়ি ছেড়ে যাত্রা শুরুর আগে প্রয়াত বাবার দুই সুহৃদ, শ্রীবাস পণ্ডিত, অদ্বৈত আচার্যকে আলাদা করে ডেকে প্রণাম করে গোরা বলেছিল, আমার মা, বউ রইল। আপনারা একটু দেখবেন তাদের।
অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে সারাদিন দরগার মুজাভিরের সান্নিধ্যে কাটানো গোরার মনে যে তোলপাড় চলছিল, নবদ্বীপের ভিটে, মা, বউ-এর স্মৃতি এসে সব ঝাপসা করে দিল। দু’হাতে লক্ষ্মীকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরার বাসনা উদগ্র হয়ে উঠতে গোরার কপালে ঘাম জমল। রোজ রাতে ঘুমনোর আগে এরকম হয়। বুকের ভেতরটা জুড়ে ‘লক্ষ্মী, লক্ষ্মী’ করে হাহাকার ওঠে। নবদ্বীপে ফেরার প্রবল তাগিদ অনুভব করল সে। কাল সকালে সে নবদ্বীপ রওনা হলে কৈফিয়ত চাওয়ার কেউ নেই। তবে বিশ্বরূপের যাত্রাপথ সম্পর্কে শুধু মুজাভিরের দেওয়া খবর শুনে শ্রীহট্ট ছেড়ে চলে যেতে সে রাজি নয়। আরও তল্লাশি চালাতে হবে তাকে। মাথা থেকে একটা দায়িত্ব নেমে গেছে। ঠাকুমা, শোভাদেবী গত অঘ্রাণ মাসে লোকান্তরিত হওয়ায় তার সঙ্গে দেখা করতে উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়িতে তাকে যেতে হবে না। উপেন্দ্র মিশ্রের সংসারে জ্যাঠা-কাকাদের কানে তার শ্রীহট্টে আসার খবর নিশ্চয় এখনও পৌঁছায়নি। খবর গেলেও তারা বিশ্বাস করেনি। বাপ-ঠাকুর্দার জন্মভূমিতে এসে তাদের বাড়িতে না উঠে অন্য আশ্রয়ে গোরা দিন কাটাবে, এটা তারা ভাবতে পারে না। অবশ্য শ্রীহট্টে আসার অন্য উদ্দেশ্য যদি জগন্নাথ মিশ্রের ছোট ছেলের থাকে, তাহলে আলাদা কথা। পৈতৃক সম্পত্তির হক চাইতে এলে পাকা মাথা কোনও আইনজ্ঞের ঠিকানায় সে ডেরা করতে পারে। আদালতের কর্মচারীরা ছাড়া সে খবর কেউ জানবে না। স্বয়ং কাজি হয়তো জানতে পারে। সম্ভাব্য আইনি ঝামেলা নিয়ে জ্যাঠা, কাকারা হয়তো শলাপরামর্শ শুরু করে দিয়েছে। কথাটা ভেবে, ফিকে তন্দ্রার প্রাথমিক আবেশে মুচকি হেসে গোরা ঘুমিয়ে পড়ল।
শ্রীহট্টে, পদ্মার তীরে দাদা বিশ্বরূপের খোঁজে গোরা যখন তপন মিশ্রের বাড়িতে দিন কাটাচ্ছে, নবদ্বীপে তখন স্বামীর সমূহ বিপদের আভাস পেয়ে তার উপবীত সযত্নে গেরুয়া চাদরে মুড়ে মালা, চন্দন দিয়ে লক্ষ্মী পুজো করছিল। লক্ষ্মী তখনও জানত না যে সুলতান হোসেন শাহের সম্ভাব্য আততায়ীর খোঁজে গৌড়ের ফৌজ দেশের নানা জায়গায়, বিশেষ করে নবদ্বীপ চষে ফেলছে। সুলতানী তত্-এর হিন্দু দাবিদার হিসেবে, সেনরাজবংশের সন্তান না হলেও গোরার ওপর যে কোনও সময়ে নজর পড়া অসম্ভব নয়। বেলপুকুরিয়ার বাড়িতে শচীকে ডেকে খবরটা শুনিয়েছিল তার বাবা নীলাম্বর চক্রবর্তী। খবর শুনে শচী ভয়ে বেহুঁশ হয়ে যায়। মেয়ের জ্ঞান ফেরাতে সস্ত্রীক নীলাম্বর হিমশিম খেয়ে গিয়েছিল। হুঁশ ফেরার পরে বাড়ি ফিরে শচী জবুথবু হয়ে থাকল। শাশুড়ির হাবভাবে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্মী নজর করলেও, কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। তার মনে অশান্তি বেড়ে গেল। বড় ছেলের খোঁজে, তার স্বামী গোরাকে শ্রীহট্টে পাঠানোর জন্যে শাশুড়ির ওপর অভিমানে ভারী হতে থাকল বুক। শ্রীহট্টের মতো দুর্গম জায়গায় গোরাকে পাঠানো, মা হয়ে, শচীর পক্ষে ঠিক কাজ হয়নি। গোরা যেমন শচীর ছেলে, তেমনি তার স্বামী, তার সর্বস্ব। মা, ছেলের সম্পর্কের চেয়ে হাজার গুণ বেশি দামি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। লক্ষ্মীর বয়স কম হলেও মনের অন্তর্গত কোনও দূরভাষ থেকে গোরার বিপদের সংকেত পাচ্ছিল সে। শুধু বিশ্বরূপের খোঁজে যে গোরা শ্রীহট্টে যায়নি, আরও গভীর কারণ আছে, যা তাকে জানানো হয়নি, আন্দাজ করে শাশুড়ি সম্পর্কে তার মনে অভিমানের সঙ্গে ক্ষোভ জমছিল।
শ্রীহট্টে গোরা চলে যেতে তরুণী বধূ লক্ষ্মীর সংসার জীবনের ছন্দ কেটে গেল। প্রায়ই চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল সে। স্বামীর বিরহে সে এত কাতর হল যে ক্ষিদে তেষ্টার বোধ হারিয়ে ফেলল। ভাতের থালা নিয়ে বসলে, খাওয়া ভুলে চুপ করে বসে থাকে। তেষ্টা পেলে কলসি থেকে জল গড়িয়ে, পাশে জলভর্তি বাটি রেখে কিছুক্ষণ শূন্য মনে বসে থেকে, জল না খেয়েই সেখান থেকে উঠে যায়। জলের বাটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কলসির পাশে পড়ে থাকে। বিষাদে মুষড়ে থাকা লক্ষ্মীকে নিয়ে শচী বিপদে পড়ল। দেবীপ্রতিমার মতো সুন্দরী, কচি পুত্রবধূকে প্রথমে স্নেহে, আদরে, পরে কড়া কথা শুনিয়েও শচী বাগে আনতে পারল না। লক্ষ্মী যেন শচীর সংসারের কেউ নয়, আকাশ থেকে অচেনা এক বাড়ির উঠোনে খসে পড়েছে, এমন কাতর হয়ে গেল তার হাবভাব। পুত্রবধূর দশা দেখে অকূল পাথারে পড়ে গেল শচী। রেগে গিয়ে কখনও ধমক দিল, কখনও কথা শোনাচ্ছিল। কিশোরী বধূও মাঝে মাঝে তেড়ে ফুঁড়ে শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করছিল। লক্ষ্মীকে কয়েক দিনের জন্যে মা-বাবার কাছে পাঠালে হয়তো সে স্বাভাবিক হবে, এ চিন্তা তার মাথায় এল। স্বামীর দেওয়া পৈতে, খড়ম পুজো করার সঙ্গে বাড়ির উঠোনে তুলসিতলায় গোবরে নিকোনো মেঝেতে সরু কাঠি দিয়ে বিভোর হয়ে এঁকে চলেছে গোরার মুখ। কাঠের পিঁড়ি, পাটাতেও আঁকে গোরার মুখ। হলুদ কাপড় দিয়ে সে চিত্র কখনও ঢেকে রাখে, কখনও আকুলতা জড়ানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছবির দিকে। মনে মনে বলে, ওগো, কবে আসবে তুমি, এভাবে একা আমি যে আর থাকতে পারছি না!
শ্রীহট্টের নানা অঞ্চলে গোরা যখন বিশ্বরূপকে খুঁজছে, দাদাকে খুঁজতে গিয়ে গৌড়ের গুপ্তচরদের দেখা পেয়ে যাচ্ছে, তপন মিশ্রের বাড়িতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসা সাক্ষাৎপ্রার্থী ছাত্রদের যতটা সম্ভব ব্যাকরণ পড়ানোর সঙ্গে চতুষ্পাঠীর গুরুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বলিখিত ব্যাকরণ, টিকা পাঠ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন কাঠের পিঁড়িতে, পোড়ামাটির খোলামকুচিতে স্বামীর মূর্তি এঁকে সেই পিঁড়ি, তার সঙ্গে স্বামীর রেখে যাওয়া নানা স্মারক বুকে আঁকড়ে বিরহিনী কিশোরী লক্ষ্মী অনুভব করছিল গোরার সংসর্গ। লক্ষ্মীর জন্যে গোরার মনও হু হু করছিল। তাকে শ্রীহট্টে ধরে রাখতে আড়াল থেকে মুজাভির কলকাঠি নাড়ছে, দলে দলে শিক্ষার্থী পাঠাচ্ছে, চতুষ্পাঠী খোলার আবেদন নিয়ে পাঠাচ্ছে তাদের অভিভাবকদের, গোরা বুঝতে পারলেও তার প্রতি মুজাভিরের এত অনুগ্রহের কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। গোরার কাছে ছাত্রের ভিড় দেখে তপনও প্রমাদ গুনছিল। মুজাভিরের সঙ্গে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে গোরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকাতে ভয় বাড়ছিল তার মনে। গোরার অমঙ্গলের কথা ভেবে সে ভয় পাচ্ছিল। মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে তার মনে অবিশ্বাস ছাড়া কিছু জন্মায়নি। তাদের ধর্ম, খাওয়াপরা, আচার আচরণ, হাবভাব, কথা, সবটাই শত্রুতাপূর্ণ। চার’শ বছর গৌড়ে বাস করলেও, সেখান থেকে কয়েক হাজার যোজন দূরে, মক্কা মদিনা, আরব দেশের মরুভূমিতে পড়ে রয়েছে তাদের মন। তপন জানে, তার সম্পর্কে পাশের পাড়ার মাসুদের, সাধারণভাবে হিন্দুদের সম্পর্কে মুসলিম সম্প্রদায়ের সমান বৈরী ধারণা। দু’পক্ষই একে অন্যকে ধর্মান্ধ, গোঁড়া ভাবে। তপনের মাঝে মাঝে মনে হয়, লোহার দুটো নিশ্ছিদ্র কেল্লার মতো হিন্দু, মুসলিম মুখোমুখি দুটো পক্ষ দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাজার বছর পরেও সামাজিকভাবে পরস্পরের কাছে তারা অচেনা থেকে যাবে, তাদের মধ্যে বনিবনা হবে না। গোরাকে ফেত্তা দিয়ে ধুতি পরতে শিখিয়েছে যে মুজাভির, সে-ই শেষ পর্যন্ত উপেন্দ্র মিশ্রের নাতিকে মুসলিম ধর্মাবলম্বী হতে বাধ্য করবে। গোরাকে নানাভাবে ঘিরে ফেলতে, তপনের বাড়িতে স্রোতের মতো ছাত্র, অভিভাবকদের ভিড় জমানোর কলকাঠি নাড়ছে মুজাভির। খবরটা কানে গেলে গোরার লেখা ব্যাকরণ পুঁথির প্রচারে নিজেই অঢেল অর্থ ঢেলে সেগুলো মুজাভির কিনে নেবে। দরগার কোষাগারে যে পরিমাণ বিত্তসম্পদ জমা আছে, চট্টগ্রাম, আরাকান, বঙ্গাল, গৌড়ের সুলতানের ভাঁড়ারে সঞ্চিত অর্থের চেয়ে তা কম নয়। মুজাভিরকে নিজের সম্পর্কে গোরা কতটা বলেছে, তা জানতে না পারার জন্যে বন্ধনহীন কল্পনাতে তপন হাবুডুবু খেতে থাকে। ভয়ে ধড়ফড় করে তার বুক। সন্ন্যাসী শঙ্করারণ্যের দাদা হিসেবে জয়পুর গাঁয়ের যে তপন মিশ্রকে মুজাভির দেখেছিল, সেই তপন যে গোরার আশ্রয়দাতা কুটুম, তা জেনে মানুষটা কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? গোরা এ বিষয়ে মুখ না খুলতে জটিল গোলমালে পড়ে গিয়েছিল তপন। শ্রীহট্ট থেকে ঝটিতি বারাণসী পাড়ি দেওয়ার দিনক্ষণ পাকা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। নবদ্বীপে গোরার ফিরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তপন অবশ্য তা প্রকাশ করল না।
বিশ্বরূপের খোঁজে শ্রীহট্টের নানা অঞ্চলে ঘোরার মধ্যে এক ফাঁকে ঢাকা-দক্ষিণ গ্রামে, বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে দূর থেকে দেখলেও গোরা বাড়ির ভেতরে ঢুকল না। উপেন্দ্র মিশ্রের নাতি হয়েও নিজের গাঁয়ে সে বিদেশি। গাঁয়ের রাস্তায় হাঁটলে এমনিতে তার ওপর পথচারীদের নজর পড়ে। পথের কোথাও দাঁড়িয়ে পড়লে, তার চারপাশে পথচলতি মানুষও যে থেমে যাবে, সে জানে। আগে একাধিকবার এই অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়ির সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে তার চোখে জল এসে গেল। বাবা, জগন্নাথ মিশ্র যখন এই বাড়িতে থাকত, ভাইবোনদের সঙ্গে খেলা করত, ঝগড়া করত, এই রাস্তা দিয়ে চতুষ্পাঠীতে যাতায়াত করত, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের সেই দিনগুলো গোরার চোখের সামনে অল্পক্ষণের জন্যে স্থির হয়ে গেল। বাতাসে সে যেন শুনল প্রয়াত বাবার কিশোর কালের গলার স্বর। পুরনো দিনের রূপরসগন্ধ গোরার রোমকূপ দিয়ে শরীরের ভেতরে ঢুকতে থাকল। গোরা অনুভব করল, বাপ, পিতামহের গাঁয়ের এই বাড়ি চাক্ষুষ না করলে তার শ্রীহট্টে আসা অপূর্ণ থেকে যেত। ঢাকা, দক্ষিণ গাঁয়ের পথে হেঁটে তীর্থপরিক্রমার পুণ্য অর্জন করল সে।
নবদ্বীপে তখন গোরার বিরহে আধাউন্মাদিনী লক্ষ্মীকে সামলাতে শচীর বেহাল দশা। ভগ্নিপতি চন্দ্রশেখর আচার্যকে নিয়ে শচী গেল শ্রীবাস পণ্ডিতের উপদেশ নিতে। জগন্নাথ মিশ্রের বন্ধু, মিশ্র পরিবারের শুভার্থী, শ্রীবাস পণ্ডিত ছিল নবদ্বীপের মান্যগণ্য মানুষ। গোরাকে পাঁচজনের সামনে সস্নেহে, হাসিমুখে ‘উদ্ধতের শিরোমণি’ বলার অধিকার রামচন্দ্রপুরে শুধু শ্রীবাসের ছিল। বাবার তুল্য শ্রীবাসের ধমক আর স্নেহ, দুটোই গোরা শান্তভাবে মেনে নিত। গুরুজন হোক, বয়ঃকনিষ্ঠ হোক, ব্রাক্ষ্মণ হোক, শূদ্র হোক, প্রকৃত ভালোবাসা কারও কাছ থেকে পেলে, তার পায়ের ধুলো খেতে পারত সে। শ্রীবাসের ওপর অগাধ ভক্তি ছিল তার। তাকে একাধিকবার মিষ্টি কথায় শ্রীবাস বৈষ্ণব হওয়ার অনুরোধ করলেও সে ডাকে গোরা আমল দেয়নি। উপেক্ষাও করেনি শ্রীবাসকে। তার পায়ে, দেখা হলে সবিনয়ে হাত ঠেকিয়ে পদধূলি নিয়েছে। সামাজিকতার ত্রুটি রাখেনি। গোরা শ্রীহট্টে যাওয়ার পর থেকে তার মেসোমশাই চন্দ্রশেখর আচার্য যেমন নিয়মিত বড় শ্যালিকা শচী, বধূ লক্ষ্মীর খবরাখবর করত, তেমনি জগন্নাথ মিশ্রের সংসারের খবর প্রায় রোজ নিত শ্রীবাস পণ্ডিতের বউ মালিনী। শচীর সমবয়সি ছিল মালিনী। একে অন্যকে ‘সই’ বলত। শচীর কাছে মালিনী কখনও একা, কখনও তিন জা-এর কোনও একজনকে নিয়ে আসত। তাদের কোলেকাঁখে চেপে গোরা বেড়ে উঠেছে, বড় হয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে যেমন ছিল অন্তরঙ্গতা, তেমনি ছিল অবাধ যাতায়াত। লক্ষ্মীর মানসিক ভাঙচুরের কিছু খবর, স্ত্রীর সূত্রে শ্রীবাসের কানে আগে পৌঁছেছিল। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে হেমন্তের এক সায়াহ্নে শচীর মুখ থেকে লক্ষ্মীর বিপর্যয়ের বিশদ বিবরণ শুনে শ্রীবাস দুশ্চিন্তায় কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে জানাল, পরের দিন সকালে চন্দ্রশেখরকে নিয়ে সে তেঘরি গ্রামে বল্লভাচার্যের বাড়ি যাবে। লক্ষ্মীর বাবা, বল্লভাচার্যকে, তার মেয়ের মানসিক বিপর্যয়ের বৃত্তান্ত শুনিয়ে, তার পরামর্শ মতো লক্ষ্মীর শুশ্রুষার জন্যে যা করার করবে।
অভিজ্ঞ শ্রীবাসের অভিমত তখনই শচী মেনে নিল। চন্দ্রশেখরের সায় ছিল শ্রীবাসের পরামর্শে। শ্রীহট্টে গোরা রওনা হওয়ার দিন সকালে, তার সঙ্গে দেখা করে বিদায়সম্ভাষণ জানাতে, বল্লভাচার্য সেই যে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে গিয়েছিল, তারপর এক মাস কেটে গেলেও মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে আসেনি। বিবাহিতা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে তার পিতৃকুলের কেউ, ইচ্ছে করলেই সে যুগে আসতে পারত না। স্বামীর হাতে দান করে দেওয়া কন্যার সঙ্গে তার মা, বাবাকে দেখা করতে হলেও শ্মশ্রুকুলের গৃহকর্তা, কর্ত্রীর আগাম অনুমতি নিতে হত। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গেলে তখন মেয়ের দেখা পেত। বাবা একা বিনা বিজ্ঞপ্তিতে মেয়ের বাড়িতে হাজির হয়ে অনেক সময়ে তার দেখা পায়নি, এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটত। শ্বশুর, শাশুড়ির নির্দেশ ছাড়া গৃহবধূ তার বাবার সঙ্গেও দেখা করতে পারত না। শাস্ত্রে নিষেধ ছিল। ছাপোষা সংসারী মানুষ, সে নিষেধ অমান্য করার সাহস পেত না। সমাজের নব্বই ভাগ মানুষ তখন ছিল ছাপোষা। সামাজিক বিধান অলঙ্ঘনীয়, তারা মেনে নিয়েছিল। সেই সকালে বল্লভাচার্য ভাবতে পারেনি, স্নেহের পুত্তলি, কন্যা লক্ষ্মীকে মিশ্রপরিবারে বিবাহ সূত্রে দান করে দেওয়ার পরে, স্বামীর জন্যে কাতর সেই মেয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলতে তার শ্বশুরকুলের দু’জন তেঘরিতে তার বাড়িতে আসবে। শুরুতে কুটুম্বিতায় বল্লভাচার্য উথলে উঠেও লক্ষ্মীর দুর্দশার খবর শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। ব্রাক্ষ্মণ হলেও সে দীনদরিত্র, ছাপোষা সমাজের তলানি। ব্যাধিগ্রস্ত মেয়েকে কষ্টেশিষ্টে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত দেওয়ার বেশি পরিচর্যা করার সামর্থ তার নেই। কথাটা মুখ ফুটে বল্লভাচার্য বলার আগে ঘরের ভেতর থেকে খুকখুক কাশির আওয়াজ যে গিন্নির ডেকে পাঠানোর সংকেত গৃহকর্তার বুঝতে অসুবিধে হল না। দুই অতিথি, শ্রীবাস, চন্দ্রশেখরও সম্ভবত সেই সংকেত হৃদয়ঙ্গম করল। কাঁচুমাচু মুখে বল্লভাচার্য অল্পক্ষণের জন্যে ছুটি ভিক্ষা করতে ত্বরিতে রাজি হয়ে গেল শ্রীবাস। দুই অতিথিকে দাওয়ায় বসিয়ে রেখে ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে রোরুদ্যমানা স্ত্রীকে দেখে বল্লভাচার্য যা বোঝার বুঝে গেল। স্ত্রীর পাশে গিয়ে করুণ গলায় বলল, জন্মদুখী মেয়েটা আর কত দুঃখ পাবে ঈশ্বর জানেন। কালই তাকে এখানে আনার জন্যে দুই বেয়াই-এর কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছি। ঘর থেকে বেরনোর আগে গলা আরও নামিয়ে বলল, সাবধান, তোমার কান্নার আওয়াজ যেন ঘরের বাইরে গিয়ে অতিথিদের মর্যাদা নষ্ট না করে। তাঁরা ভাবতে পারেন, তাঁদের হেলাফেলাতে আমাদের মেয়ের এই দুর্দশা, মেয়ের মায়ের কান্না। দান করে দেওয়া মেয়ের জন্যে কেঁদে লাভ নেই।
শ্রীবাস, চন্দ্রশেখরের সম্মতি নিয়ে পরের দিন সকালে লক্ষ্মীকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে বল্লভাচার্য এল রামচন্দ্রপুরে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে। অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে স্ত্রী মালিনীকে নিয়ে শ্রীবাস আর সস্ত্রীক চন্দ্রশেখর পৌঁছে গেল। লক্ষ্মীকে নিতে বল্লভাচার্য আসছে, শচীর কাছে চব্বিশ ঘণ্টা আগে খবরটা এসে গেলেও পুত্রবধূকে প্রাণে-ধরে শাশুড়ি তা জানাতে পারেনি। লক্ষ্মীবিহীন ফাঁকা গৃহস্থালির নিঃসঙ্গতা ভেবে শচীর বুক কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। পুত্রবধূকে বাপের বাড়িতে পাঠানোর কথাটা সে বলতে পারেনি। ঘটনাপরম্পরার নিষ্পেষণে বোবা হয়ে গিয়েছিল। পুত্রবধূকে নিজের কাছে রাখতে যেমন ভরসা পাচ্ছিল না, তেমনি তাকে ছেড়ে থাকার চিন্তা মাথায় আসতে চোখে অন্ধকার দেখছিল।
জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে দু’মাস পরে বাবাকে দেখে লক্ষ্মী যতটা খুশি হল, অবাক হল তার চেয়ে বেশি। কুটুম-বাড়িতে আগাম খবর না দিয়ে দরিদ্র হলেও প্রাজ্ঞ, তার বাবা কীভাবে চলে এল লক্ষ্মী বুঝতে পারল না। দাওয়ার ওপর কুশাসনে বসে বল্লভাচার্য বলল, মা,তোকে তেঘরিতে নিয়ে যেতে এসেছি। তোর গর্ভধারিণী মা তোকে দেখার জন্যে বড় ব্যাকুল হয়ে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। তুই না গেলে কেঁদে সে ঘরদোর ভাসিয়ে দেবে
বাবার অনুরোধ এক বাক্যে নাকচ করে দিয়ে লক্ষ্মী জানাল, শ্রীহট্টে গোরা যাওয়ার আগে তাকে সে কথা দিয়েছে, বাড়িতে স্বামী ফিরে না আসা পর্যন্ত এখান থেকে সে নড়বে না। মায়ের সেবা, কুলদেবতার নিত্যপুজোর দায়িত্ব তাকে গোরা দিয়ে গেছে। বাড়ি ছেড়ে তার কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।
প্রথমে শচী, তারপর শ্রীবাস, চন্দ্রশেখর পরম স্নেহে লক্ষ্মীকে বোঝাতে চাইল, যে সে মায়ের কাছে গেলে শচীকে দেখাশোনা করার, কুলদেবতাকে ফুল-জল-নৈবেদ্য দিয়ে অর্চনার কাজ আগের মতো মসৃণভাবে চলবে, কোথাও কোনও বিঘ্ন ঘটবে না, তাদের কথা অর্ধউন্মাদিনী কিশোরী বধূ কানে তুলল না। নিজের প্রতিজ্ঞায় অবিচল লক্ষ্মী জানাল, গোরা ফিরে না আসা পর্যন্ত এ বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। তাকে জোর করে বাপের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে গিয়ে সে গলায় দড়ি দিয়ে মরবে।
কথাগুলো বলার সময়ে অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল তার স্বর, অক্ষিকোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল দু’চোখ, এত ঘনঘন শ্বাস পড়ছিল, যা দেখে শ্রীবাসের মনে হচ্ছিল হতভাগিনী বধূটি এখনি দমবন্ধ হয়ে মারা যেতে পারে।
পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে লক্ষ্মীকে তেঘরিয়ায় নিয়ে যাওয়ার বাসনা বল্লভাচার্যকে তখনকার মতো ছাড়তে হল। অভাগিনী পুত্রবধূর জন্য করুণায় বিগলিত শচীও পুত্রবধূকে তখনকার মতো কাছছাড়া করতে চাইল না। নিজের কাছে রেখে দিল। হতাশ বল্লভাচার্য মাঝদুপুরে একা বাড়ি ফিরে গেল।
শ্রীহট্ট থেকে গোরা তখন ফেরার আয়োজন করছে। নবদ্বীপে ফেরার আগেই শচীর সংসারে এল ভয়ঙ্কর শমন। দুপুরে বল্লভাচার্য ফিরে যাওয়ার পরে সংসারের কাজ সেরে শচী যখন শ্রীবাসের বাড়িতে মালিনীর সঙ্গে দুটো প্রাণের কথা বলতে গেল, তার কিছু আগে দুপুরের খাওয়া সেরে তুলসি মঞ্চের সামনে মাটিতে গোরার মুখ আঁকছিল লক্ষ্মী। তার পাশে গেরুয়া রঙের কাপড়ে জড়ানো গোরার খড়ম, উপবীত রাখা ছিল। ছবি আঁকা শেষ করে খড়ম, উপবীতের সঙ্গে গোরার ব্যবহার করা টুকিটাকি সাজিয়ে সন্ধে পর্যন্ত লক্ষ্মী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। সেটাই তার পূজার্চনা, ধ্যান। গোরা চলে যাওয়ার পর থেকে রোজ এ দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে শচী। এই সময়টুকুতে তার স্বস্তি। গোরা ভালো আছে তো, সে কবে ফিরবে, বারবার শচীকে এইসব প্রশ্ন নিয়ে লক্ষ্মী এখন ঘ্যানঘ্যান করবে না। প্রবাসী স্বামীর জন্যে প্রোষিতভর্তৃকার যে এত দুশ্চিন্তা অমঙ্গলকারী, লক্ষ্মীকে শচী বোঝাতে পারে না। অন্ধকার একটু ঘন হলে শাশুড়ির সঙ্গে বসে চিঁড়ে, দই, কলা মেখে অল্প ফলার খেয়ে বিছানায় শাশুড়ির পাশে লক্ষ্মী শুয়ে পড়ে। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত নিজের মনে নানা কথা বলে যায়, ঘুমন্ত শচীকে শোনায়, আবার কাউকে শোনায় না, বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কখন ঘুমোয়, শচী টের পায় না। লক্ষ্মীর আগে সে ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত থাকার জন্যে সে রাতে শচী বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। শাশুড়ির নাক ডাকার আওয়াজ লক্ষ্মীকে বেশিক্ষণ শুনতে হয়নি। স্বামীর জন্যে বিরহযন্ত্রণার সাথে স্নেহপরায়ণ বাবার সঙ্গে সকালে নিষ্ঠুর ব্যবহার করার অনুশোচনা, তার মন বিষাদে এমন সিক্ত করে তুলেছিল, সেও অল্প সময়ে ঘুমিয়ে পড়ল। শেষ রাতে, হেমন্তের জ্যোৎস্নায় এক কালসাপ, সম্ভবত বিষধর কেউটে, শীতের দীর্ঘ সুখনিদ্রায় যাওয়ার আগে গলা ভর্তি বিষের থলি খালি করতে বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে লক্ষ্মীর পায়ে কামড় বসাল। পয়লা ছোবলে কেউটের বিষের থলি খালি হল না। বাকিটা বার করে দিতে আরও দু’বার ছোবল দিল সে। প্রথম ছোবলেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল লক্ষ্মী। গাঁয়ের মেয়ে সে। প্রথম দংশনে বুঝেছে কী ঘটল। পরের দুটো ছোবলে অস্ফুট আওয়াজ করল। মাথার কাছে রাখা সেজবাতি তখনই জ্বেলে শচী দেখল দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মতো এক কালকেউটে। দরজার বাইরে তার শরীর চলে গেলেও লেজ দেখে জাতসাপ চিনতে তার অসুবিধে হল না। নিজের ডানপায়ের হাঁটুর তলা দু’হাতে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত টিপে লক্ষ্মী বসে ছিল। শুকনো এক গামছা দিয়ে তার পায়ে তাগা বাঁধার নিচে বেঁধে শচী আকাশ ফাটানো আর্তনাদ তুলে ‘ওগো আমার কী হল গো’ বলে কেঁদে উঠল। নিস্তব্ধ অন্ধকার গ্রামে তার আর্তকণ্ঠের আওয়াজ ছড়িয়ে যেতে প্রতিবেশীদের দু’একজন ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে জেগে গেল। সকলের আগে জাগল মালিনী। স্বামী শ্রীবাসের ঘুম ভাঙিয়ে সে বলল, শুনতে পাচ্ছো, আমার সই-এর কান্নার শব্দ।
কান খাড়া করে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বিছানা ছেড়ে শ্রীবাস উঠে দাঁড়াল। যন্ত্রণায় মাটি আঁকড়ে লক্ষ্মী তখন আছাড়পাছাড় খাচ্ছে। শাশুড়িকে বলছে, মাগো, বিষের জ্বালায় আমার প্রাণ যায়। চোখে যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
বাইরে অন্ধকার দাওয়ায় অনেক পায়ের শব্দে প্রতিবেশীরা কয়েকজন এসে গেছে, শচী টের পেল। দরজার পাল্লায় টোকা দিয়ে যে বন্ধ দরজা খুলতে বলল, তার গলা শুনে শচী বুঝল, সে মালিনী, তার সই। বুকফাটা কান্নার মধ্যে শচী দরজা খুলে দিল। চৌকাঠের বাইরে মালিনী শ্রীবাসের সঙ্গে তাদের পরিবারের বয়স্ক সকলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পেছনে শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী, নন্দন আচার্য, শ্রীমান পণ্ডিত, অন্ধকারে আরাও যারা রয়েছে তাদের চিনতে পারল না শচী। তাকে সাপে না কাটলেও চোখে সে স্পষ্ট করে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। লক্ষ্মীর ডান পায়ের হাঁটুর নিচে তাগা বেঁধে শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো গেল না। বিষে জরজর লক্ষ্মী বুঝল, সে মরতে চলেছে। সবুজ হয়ে যাচ্ছিল তার শরীর, ঘুমে বুজে আসছিল দু’চোখের পাতা। বউমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তার কপালে, গালে চুমু খেয়ে অবিরল কান্নার মধ্যে শচী বলছিল, ওরে মা, আমাকে ছেড়ে তুই কোথায় চললি? নিমাই ফিরলে কী বলব তাকে, কীভাবে তার সামনে দাঁড়াব?
যন্ত্রণায় বুজে আসা গলায় নিচু স্বরে লক্ষ্মী বলল, মা, ঘরে আমি মরতে পারব না। গঙ্গার ঘাটে নিয়ে চল আমাকে। অন্তর্জলি যাত্রা আমি করতে চাই। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আধাজাগ্রত অবস্থা থেকে ফের হুঁশ ফিরে আসতে সে বলল, যা করো আর তা করো, সবকিছুর আগে স্বামীর পবিত্র উপবীত জড়িয়ে দাও আমার গলাতে। সে যে যাওয়ার আগে সেটা দিয়ে গেছে আমাকে।
শচী ছুটে গিয়ে গোরার পৈতে এনে তিন ফেত্তা দিয়ে পরিয়ে দিল লক্ষ্মীকে। লক্ষ্মীর আধবোজা চোখের সামনে দিয়ে তখন ছবির স্রোত, আপন ঘাটে গোরার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া, তারপর আলাপ, প্রেম, বিয়ের আগে তার গলায় গোরার মালা পরিয়ে দেওয়া, সব স্মৃতি জেগে উঠেছে। ঘুমের ঘোর কাটিয়ে মুহূর্তের জন্যে বাস্তবতায় ফিরে এসে তার মনে হল, কালসাপ নয়, গোরার অদর্শনই কেউটের চেহারা নিয়ে তাকে ছোবল দিয়েছে। গোরার বিরহে সে মরে যাচ্ছে। সাপের কামড় খাওয়ার যন্ত্রণা ধীরে ধীরে তার মনোরম আরামের মতো লাগতে থাকল। গলা থেকে একটাই কথা বেরিয়ে এল, হায়, তোমাকে যে আর দেখতে পাব না।
.
শ্রীহট্টে বিশ্বরূপকে গোরা খুঁজতে যাওয়ার দিনক্ষণ পাকা করার সঙ্গে মায়েপোয়ে বানানো একটা গল্প লক্ষ্মীকে শুনিয়েছিল। কথাটা শচী বলেছিল লক্ষ্মীকে। গোরা শ্রীহট্টে শুধু তার দাদাকে খুঁজতে যাচ্ছে না, পৈর্তৃক বিষয়সম্পত্তি বেচে বিস্তর টাকাকড়িও সেখান থেকে সে নিয়ে আসবে। উপেন মিশ্রের ভূসম্পত্তি কম নেই। কয়েক পুরুষ ধরে জমানো বিত্তসম্পদও আছে প্রচুর। পেতলের ঘড়াভর্তি সোনাদানা, টাকাকড়ি বাস্তুবাড়ির একাধিক গোপন জায়গায় মাটির নিচে পোঁতা আছে। একটা ঘড়া নয়, বাস্তুর নানা কোণে, সংখ্যায় ঠিক কতগুলো ঘড়া ভূগর্ভে আছে, সাত ছেলের কেউ না জানলেও, উপেনের তৈরি একটা নকশা তার স্ত্রী, শোভাদেবীর কাছে সযত্নে রাখা আছে। সংরক্ষণ এত কড়া যে নিজের তৈরি নকশার হদিশ উপেনও জানে না। উপেন মিশ্র মারা যাওয়ার পরে, তার স্ত্রী শোভাদেবীর উপস্থিতিতে, সেই সম্পদ, সম্পত্তি সাত ভাই-এর মধ্যে সমানভাবে ভাগ হলে, জগন্নাথের অংশ হিসেবে গোরা যা পাবে, তা দিয়ে সারাজীবন তার হেসেখেলে চলে যাবে। শণের ছাউনির এই বাস্তু ভেঙে, ইঁট পুড়িয়ে পাকা বাড়ি বানাতে গোরার অর্থের অভাব হবে না।
উপেন মিশ্রের শ্রীহট্টের বাড়িতে মাটির তলায় সোনাদানা ভর্তি ঘড়া না থাকলেও সে যে বিত্তবান ছিল, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। শ্রীহট্ট ছেড়ে নবদ্বীপে চলে আসা ব্রাহ্মণদের মধ্যে সে এতই সচ্ছল ছিল যে, দেশত্যাগের চিন্তা তার মাথায় আসেনি। ছেলেমানুষ গৃহবধূর বিরহ বেদনার উপশম ঘটাতে তাকে নিছক বানানো গল্প শচী শোনায়নি। পাকা বাড়ি হওয়ার সম্ভাবনায় খুশিতে লক্ষ্মীর বুক ভরে গেলেও কিছুদিনের জন্যে স্বামী অদর্শনজনিত কষ্ট যে কত দুঃসহ হতে পারে, তখনি বুঝতে পারেনি। গোরা চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে টের পেয়েছিল, পাকা বাড়ি কেন, আস্ত একটা রাজপ্রাসাদ পেলেও স্বামীর অনুপস্থিতির যন্ত্রণা ঘুচবে না। সুদূর শ্রীহট্টে বসে গোরা হয়তো টের পাচ্ছিল লক্ষ্মীর মনের কষ্ট। তপনের সঙ্গে সন্ধের পরে পুকুরঘাটে বসে কথা বলার মধ্যে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত। তপনের নজর এলেও সে প্রশ্ন করত না। গোরাকে প্রশ্ন করার বদলে সে শোনাত বিশ্বরূপের সান্নিধ্য পাওয়ার দিনগুলির খুঁটিনাটি বিবরণ। পূর্বাশ্রমের বিবরণ এড়িয়ে গেলেও শঙ্করাণ্যের প্রসঙ্গ উঠলে সে থামতে ভুলে যেত। স্বতোৎসার হত তার কাহিনী। বিশ্বরূপের মুখে গোরার পুঙ্খানুপুঙ্খ বৃত্তান্ত শুনে শিশুটি সম্পর্কে তপনের মনে যে মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল, তাকে যুবক বয়সে দেখে তা শতগুণ বেড়ে গেল। তপনের চোখে ঘোর লেগে গেল। তার সঙ্গ পেতে ক্রমাগত তাকে শোনাতে থাকল শঙ্করারণ্যের বিবরণ। দাদার বিষয়ে জানতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতন্দ্র অভিনিবেশ নিয়ে গোরা শুনে যেত তপনের কথকতা। তপনের মুখে গোরা শুনল, শ্রীহট্টে সাতদিন কাটিয়ে শঙ্করারণ্যের দাক্ষিণাত্য যাওয়ার যে খবর মুজাভির শুনিয়েছিল, তা তপনের কাছে উড়োকথা মনে হয়নি। মুজাভিরের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে তপনকে এমন সব বৃত্তান্ত বিশ্বরূপ শুনিয়েছিল, যা থেকে বোঝা গিয়েছিল দাক্ষিণাত্য সম্পর্কে প্রচুর খবর সন্ন্যাসী শঙ্করারণ্য জেনেছে। সেই সব তথ্যের অন্তর্নিহিত সত্যের হদিশ করতে অদূর ভবিষ্যতে তার দক্ষিণ ভারত পরিক্রমার সদিচ্ছা আছে। দাক্ষিণাত্যের বিজয়নগর রাজ্যের শ্রেষ্ঠ অধিপতি তুলুভ রাজবংশের রাজা, কৃষ্ণদেব রায় যে পুরাকাহিনীর কৃষ্ণঐতিহ্যের চলমান ধারা, এই ব্যাখ্যা শুনিয়ে তপনকে শঙ্করারণ্য বলেছিল, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন নিয়ে কৃষ্ণদেবের লেখা রাষ্ট্রশাসনতন্ত্রের বইটি সংগ্রহ করা, তার বিজয়নগরে যাওয়ার মূল অভিপ্রায়। গ্রন্থটি সম্পর্কে প্রয়াগ, বারাণসী, উৎকলে রাজপুরুষ আর সন্ন্যাসীদের মুখে ভূয়সী প্রশংসা শুনে শঙ্করারণ্যের মনে হয়েছিল সাধু ও সুশীল সমাজ গড়ে তোলার যথার্থ দিকনির্দেশ সেখানে পাওয়া যাবে। সুশাসিত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এটাই আদিগ্রন্থ। বিভিন্ন রাজদরবারে কৃষ্ণদেব রচিত বইটি হৈচৈ তুলেছিল। গৌড়, উৎকল, সমতট, সূক্ষ্ম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল কৃষ্ণদেবের বই-এর খ্যাতি। শঙ্করারণ্যের ধারণা হয়েছিল, রাজা কৃষ্ণদেব রায়-ই পরমপুরুষ, সাধুসমাজের পরিত্রাতা শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণদেবের গ্রন্থ পড়ে যদি তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়, তাহলে সেই গ্রন্থটি জোগাড় করে যে কোনওভাবে ছোটভাই গোরাকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে। গোরার জন্যে কঠোর পরিশ্রমে নিজের লেখা পুঁথির আগুনে আহুতি হওয়ার ঘটনা, তার মনের মধ্যে যে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছিল, সেখান থেকে অহরহ রক্তক্ষরণ হত। কৃষ্ণদেব রায়ের গ্রন্থ হয়তো তার পুঁথির শূন্যতা পূরণ করবে, এরকম প্রত্যাশা তার ছিল।
বিজয়নগরের প্রভাব প্রতিপত্তি ফিরিয়ে আনতে বাহমনি রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়েছিল রাজা কৃষ্ণদেব রায়। উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্র দেবের সঙ্গে বিজয়নগররাজ কৃষ্ণদেবের সুসম্পর্কে তখন চিড় ধরেছিল। অকস্মাৎ সেনা অভিযান করে বিজয়নগর রাজ্যের সীমানা, উদয়গিরি পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছিল রাজা কৃষ্ণদেব। দু’পক্ষই আরও একদফা শক্তি পরীক্ষার জন্যে যখন অস্ত্র শানাচ্ছে, সেই সময়ে হোসেন শাহ উড়িষ্যার জাজপুর আক্রমণ করলে, উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের পাশে রাজা কৃষ্ণদেবকে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে ভূর্জপত্রে যে চিঠি মাধবেন্দ্রপুরী লিখেছিলেন, তা বহন করার দায়িত্ব পড়েছিল শঙ্করারণ্যের ওপর। অন্য সূত্রে এ তথ্য তপন জেনেছিল, শ্রীহট্ট ছেড়ে শঙ্করারণ্য চলে যাওয়ার এক বছর পরে। পুরো বিবরণটা ছিল এরকম। প্রয়াগের পথে কোনও এক জায়গায় মাধবেন্দ্রর কাছে দীক্ষা নিয়ে তাকে গুরুপদে শঙ্করারণ্য বরণ করেছিল। কৃষ্ণদেবের কাছে মাধবেন্দ্রপুরীর চিঠি নিয়ে শঙ্করারণ্য পৌঁছেছিল কি না, তপন জানে না। শ্রীহট্ট ছেড়ে শঙ্করারণ্য চলে যাওয়ার বছরখানেক বাদে মাধবেন্দ্রর কাছে তার দীক্ষা নেওয়ার খবর তপন পেয়েছিল। তবে কৃষ্ণদেব রায়ের ‘আদর্শ রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থা’ গ্রন্থের খবর শঙ্করারণ্যের কাছে তপন প্রথম জেনেছিল। বিজয়নগররাজ কৃষ্ণদেব রায়ের হাতে সন্ন্যাসী মাধবেন্দ্রের চিঠি পৌঁছেছিল কি না, সে সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানার সেটা ছিল আগের পর্ব। পরবর্তী ঘটনাক্রম দেখে নিজের শোনা তথ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিল তপন। গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের বাহিনীর সঙ্গে উৎকলরাজের তুমুল যুদ্ধ চলার তুঙ্গ মুহূর্তে উৎকল বাহিনীর সুবিধে করে দেওয়ার জন্যে উদয়গিরি থেকে বিজয়নগরের সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়েছিল রাজা কৃষ্ণদেব। যুদ্ধের ময়দানে, প্রয়োজন হলে পিছু হঠার মতো নিরাপদ জায়গা পেয়েছিল উৎকল সেনাবাহিনী। উৎকল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত জাজপুর তখনকার মতো হোসেন শাহের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
আধ্যাত্মিক তত্ত্বের সঙ্গে দেশের ঘটনাবলীর খবর রাখত সন্ন্যাসী শঙ্করারণ্য। উৎকল রাজ্য দখলের জন্যে হোসেন শাহের একাধিক যুদ্ধাভিযানের কিছু কাহিনী তপনকে শুনিয়েছিল শঙ্করারণ্য। হোসেন শাহের বাহিনীর আক্রমণে যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে রাজা প্রতাপরুদ্রের সেনাদলের পর্যুদস্ত হওয়ার মূল কারণ যে উৎকল রাজসভার প্রভাবশালী অমাত্য, গোবিন্দ ভোই বিদ্যাধরের বিশ্বাসঘাতকতা, এখবরও তপনকে দিয়েছিল শঙ্করারণ্য। গোপন এ খবর শঙ্করারণ্যকে দিয়েছিল, তার গুরু মাধবেন্দ্রপুরী। মাধবেন্দ্রের কানে, হোসেন শাহের কাছে আত্মবিক্রীত, গোবিন্দ বিদ্যাধরের কুকীর্তির বিবরণ যে দু’জনের সূত্রে পৌঁছেছিল, দু’জনই ছিল উৎকল রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ রাজন্য, একজন কাশীশ্বর মিশ্র, সে রাজপুরোহিত, জগন্নাথ মন্দিরের পূজারী, অন্যজন রাজা প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত, একদা নবদ্বীপবাসী ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ বাসুদেব সার্বভৌম আচার্য। তাদের কারও কাছ থেকে মাধবেন্দ্র খবর পেয়ে তখনকার মতো বিশ্বরূপের দাক্ষিণাত্য পরিক্রমার ছক পাল্টে তাকে প্রয়াগ থেকে পূর্ব ভারতে তীর্থদর্শনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই যাত্রাতে শ্রীহট্টে এসে তপনের আশ্রয়ে কয়েকদিন থেকে গিয়েছিল বিশ্বরূপ। তপনের বাড়িতে ঢোকেনি। সন্ন্যাসের নিয়ম মেনে বাড়ির সদরদরজার বাইরে দাওয়াতে নিজের কম্বল পেতে রাতে ঘুমতো। তপনের দেওয়া ভিক্ষের চাল, নিজের হাতে ফুটিয়ে খেত। তাকে নামোচ্চারণের মহিমা, গুরুত্ব বুঝিয়েছিল সচল সন্ন্যাসী মাধবেন্দ্রপুরী। নাম জপের সূত্রে মানুষ যে তার আদর্শ, প্রত্যাশিত ব্যক্তি, কর্মসূচির কাছে পৌঁছে যায়, দেশকাল ইতিহাসের রূপান্তর ঘটাতে পারে, যা প্রতিদিন তিলে তিলে অগোচরে ঘটার সূত্রে, লক্ষ কোটি মানুষের উচ্চারণ ও প্রত্যাশার টানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ওলটপালট করে দেয়, মাথার মধ্যে ঝড় তোলা এমন এক তত্ত্ব মাধবেন্দ্র শুনিয়েছিল বিশ্বরূপকে। নামোচ্চারণ তত্ত্বের তীব্র আকর্ষণী শক্তিতে বিহ্বল বিশ্বরূপ ‘গুরুশ্রেষ্ঠ’ মেনেছিল মাধবেন্দ্রকে।
তপনকে বস্তুজগত আর অধ্যাত্ম জীবন সম্পর্কে সচেতনতার একমুঠো ঐশ্বর্য দিয়ে গিয়েছিল সন্ন্যাসী শঙ্করারণ্য। তার দেশটা যে গৌড়ের চেয়ে অনেক বড়, সেই প্রথম আন্তরিকভাবে তপন অনুভব করেছিল। উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের প্রধান অমাত্য, বলা যায় ডান হাত, গোবিন্দ ভোই বিদ্যাধরকে প্রচুর টাকা উৎকোচ দিয়ে, তাকে হোসেন শাহের অধীনস্থ করে ফেলার ঘটনাতে তপন যেমন ব্যথিত হয়েছিল, তেমনি খুশি হয়েছিল হোসেনের শিবির ছেড়ে প্রতারপুদ্রের রাজসভায় গোবিন্দর ফিরে আসার খবর শুনে। গোবিন্দকে রাজধানী কটকে ফিরিয়ে আনতে গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল রাজা প্রতারপরুদ্রের এক মন্ত্রী, পরম বৈষ্ণব, রামানন্দ রায়। অপমানজনক কিছু শর্ত, যা রাজা প্রতাপরুদ্র, মেনে নিতে বাধ্য হয়, তার একটা ছিল ভবিষ্যতে (রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের মৃত্যুর পরে) সিংহাসনে গজপতি রাজবংশের ছেলেদের সঙ্গে ভোইবংশের সন্তানদের উত্তরাধিকার থাকবে। মন্ত্রী রামানন্দ রায়ের পরামর্শে সেই আপৎকালে গজপতি রাজবংশের শাসক, প্রতাপরুদ্রদেব, এই শর্ত অঙ্গীকার করে। গড় মান্দারণ কেল্লায় গোবিন্দ বিদ্যাধরের তত্ত্বাবধানে ডেরা করে থাকা সুলতানি সৈন্যবাহিনী, ওই ঘটনার অল্পদিন পরে উৎকল যোদ্ধাদের সঙ্গে রণক্ষেত্রে পর্যুদস্ত হয়ে গৌড়ে পালায়। গোবিন্দ ভোই-এর নেতৃত্বে উৎকলবাহিনী গড় মান্দারণ কেল্লার দখল নেয়।
শঙ্করারণ্য সন্ন্যাসী হলেও দেশকাল নিয়ে নিজের উদ্বেগ তপনের কাছে প্রকাশ করার সঙ্গে বারবার যে কথা উল্লেখ করেছিল, তা হল, ছেলেবেলায় গোরার জন্য লেখা তার পুঁথিতে কিছু আজগুবি বিবরণ থাকলেও, এমন কিছু বৃত্তান্ত ছিল, যা এই সময়ের ঘটনাবলীর সঙ্গে মিলে যায়। ছোটভাই গোরার প্রসঙ্গ উঠতে, তার কাহিনী শোনাতে শঙ্করারণ্য বিহবল হয়ে পড়েছিল। নানা গল্পগুজবের মধ্যে তপন একসময়ে গোরাকে জানিয়েছিল, তার ঠাকুমা, শোভাদেবীর মৃত্যুর ঘটনা। স্বামী উপেন্দ্র মিশ্র মারা যাওয়ার পরে পারিবারিক অশান্তিতে জেরবার হয়ে গিয়েছিল সেই বৃদ্ধার জীবন। বয়স হয়েছিল পঁচাশি, কানে কম শুনলেও মগজ ছিল স্বাভাবিক। দৃষ্টিশক্তি বিশেষ ঝাপসা হয়নি। শান্ত মাথায় একান্তবর্তী মিশ্রপরিবারকে নিজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাঁচানোর চেষ্টা করে গেলেও পৃথিবী ছেড়ে সে চলে গেলে, সংসারে যারা রইল, তাদের বাঁধন আলগা হয়ে যাবে, শোভাদেবী টের পেয়েছিল। ঠাকুমা লোকান্তরিত হয়েছে শুনে উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়িতে গোরার যাওয়ার ইচ্ছে উবে যায়। শ্রীহট্টে দাদাকে না পেয়ে তখনই তার খোঁজে গোরা দক্ষিণভারতে যাওয়ার সঙ্কল্প করলেও তাকে আটকালো তপন। নবদ্বীপে যার মা, বউ অপেক্ষা করছে, তাদের সঙ্গে দেখা না করে, বলা যায়, পুরো অন্ধকারে তাদের রেখে, দাক্ষিণাত্যে গোরার যাওয়ার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত, তপনের পছন্দ হয়নি। গোরাকে তার অভিযান থেকে বিরত করতে তপন যখন সুহৃদসুলভ নানা পরামর্শ দিচ্ছে, গোরা তখন অন্যকথা ভাবছিল। নবদ্বীপে তার ফিরে যাওয়াতে, সেই মুহূর্তে যে বিপদ রয়েছে, তপনকে তা জানানো কতটা উচিত হবে, গোরা ভেবে পাচ্ছিল না। সে মুখ বুজে থাকাতে শ্রীহট্টে চতুষ্পাঠী খোলার জন্যে তার ওপর চাপ বাড়ছিল। স্থানীয় একাধিক মাদ্রাসা, মক্তবের শিক্ষক মৌলবিরা গোরার সঙ্গে দেখা করতে এসে সংস্কৃত ভাষা শেখার আগ্রহ প্রকাশ করছিল। তাদের আগ্রহে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। শ্রীহট্টে গোরার বসবাসে উৎসাহ জোগাতে বুরহানউদ্দিন দরগার বিদ্যোৎসাহী মুজাভিরের পরামর্শে, তাকে ঘিরে যে জনসমাগম ঘটছে, গোরা বুঝেছিল। দরগায় তাকে নিজের উত্তরাধিকার দিতে মুজাভিরের প্রস্তাবে যে ধাক্কা সে খায়, তার ঘোর মন থেকে যাচ্ছিল না। অসহায়, দরিদ্র, নেংটি-পরা মানুষের লজ্জানিবারণে মুজাভিরের দেওয়া ন্যূনতম বসনের ব্যবস্থাপত্র, তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। একজন পুরুষের জন্যে নির্ধারিত আট হাতের একটা ধুতি প্রায় উলঙ্গ দু’জন মানুষ ভাগ করে নিলে বস্ত্রসংকটের কিছুটা সমাধান হয়, ব্যবহারিক জীবনে এই অঙ্কটা কাজে লাগানোর চিন্তা ঢুকে গিয়েছিল তার মাথাতে।
তপনের অনুরোধে বিশ্বরূপের খোঁজে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার ইচ্ছে ভবিষ্যতের জন্যে গোরা তুলে রাখলেও, খুব বেশি দেরি করার মতো ধৈর্য তার ছিল না। নবদ্বীপে ফেরার জন্যে বুকের ভেতরটা আনচান করতে শুরু করেছিল। লক্ষ্মীর মুখটা ভাবলে, তখনই খেয়াঘাটে গিয়ে নবদ্বীপের নৌকো খুঁজে উঠে পড়ার তাগিদ যেমন তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকল, তেমনই বয়স্কা মায়ের শরীর স্বাস্থ্যের চিন্তা মাথায় এলে রাতের ঘুম ছুটে যেত। তার বাড়ি ফেরার ব্যগ্রতা টের পেয়ে, তপন তাড়াতাড়ি পাঁজিপুঁথি মিলিয়ে যাত্রার শুভদিন নির্ধারণ করে ফেলল। নবদ্বীপ থেকে গোরা খালি হাতে এলেও শ্রীহট্ট ছাড়ার আগে ভোজবাজির মতো এমন কিছু ঘটনা ঘটল, যে তার লেখা ব্যাকরণের পাঁচটা অনুলিপি মোটা দামে চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের জন্যে স্থানীয় দু’জন জমিদার কিনে নিল। শ্রীহট্টে তাকে চতুষ্পাঠী খোলার অনুরোধ জানাতে যেসব অভিভাবক, ছাত্র, একাধিকবার তপনের বাড়িতে এসেছিল, তারাও গোরাকে যে যার সাধ্য অনুযায়ী স্বর্ণমুদ্রা, রজতমুদ্রা, তামা, পেতলের বাসন, রেশমের বসন, চাদর, রঙিন কম্বল, দিব্যাসন এবং আরও যা উপহার দিল, সব গুছিয়ে তুলতে চারটে ছালা লাগল। গোরাকে নৌকোয় তুলে দিতে জয়পুরের ঘাটে সপরিবারে তপন ছাড়াও গাঁয়ের অনেক মানুষ হাজির ছিল। তাদের সকলকে বিধিমত সম্ভাষণ করে, তপনকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করে ‘আবার, দেখা হবে’ বলে গোরা নৌকোয় উঠতে ঘাট থেকে কিছু দূরে জনা দশ স্বাস্থ্যবান, বল্লম, লাঠিধারী সওয়ার নিয়ে একটা ছিপ নৌকো এসে দাঁড়াল। নৌসেনারা সাধারণ এরকম ছিপ নৌকো ব্যবহার করে। ঘাটে ভিড় করে দাঁড়ানো জয়পুরের মানুষের কাছে মুজাভিরের এই ছিপ নৌকো, তার রক্ষিবাহিনী অচেনা ছিল না। মুজাভিরের দরগার রক্ষিভর্তি এই নৌকো যে গোরাকে পদ্মার মাঝবরাবর এগিয়ে দিয়ে আসবে, আগে থেকে তপন জানত। গাঁয়ের মাতব্বরদের কাছেও সে খবর পৌঁছেছিল। মুজাভিরের মতো দশাসই শরীরের কাঠামো, অথচ তার চেয়ে একশ’ গুণ বেশি উজ্জ্বল, আলোকিত তেজঃপুঞ্জের মতো মানুষটাকে নিয়ে নৌকো ঘাট ছেড়ে চলে যেতে তীরে দাঁড়ানো মানুষের অনেকে কেঁদে উঠল।
কুড়ি বছর আগে মাতৃগর্ভে ভ্রুণাবস্থায় যে জলপথ গোরা পাড়ি দিয়েছিল, সেই মনোরম পথের শোভা, যুবক গোরাকে মুগ্ধ করল। সুর্মা নদী থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, জলঙ্গী, গঙ্গার প্রবাহ ধরে সপ্তম দিনে নবদ্বীপে ফিরল গোরা। বারকোণা ঘাটে গোরার নৌকো লাগতে তার ফিরে আসার খবর রামচন্দ্রপুরে পৌঁছে গেল। ভিড় জমল ঘাটে। মেয়েদের জটলার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে লক্ষ্মীকে খুঁজল গোরা। চোখে না দেখলেও আড়ালে লক্ষ্মী কোথাও আছে, ধরে নিল। ঘাটে পরিচিত যারা, বালকবেলার মতো তাদের বাঙাল ভাষা শুনিয়ে ঠাট্টা তামাশা করল। গৃহভৃত্য ঈশানের কাঁধে চাপিয়ে ছাঁদা বেঁধে আনা দানসামগ্রী নিয়ে রামচন্দ্রপুরের বাড়িতে গোরা যখন ফিরল, সেখানেও অনেক চেনা মুখ জমে গেছে। শ্রীবাস পণ্ডিতকে প্রণাম করে শ্রীহট্টের কিছু খবর দিয়ে গোরা দেখল শুকনো মুখে দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছে। গোরার সঙ্গে চোখাচোখি হতে চোখের জল লুকোতে শচী ঘরে ঢুকে গেল। শ্রীহট্ট থেকে ছাঁদা বেঁধে আনা বিপুল উপহারসামগ্রী না দেখে মা ঘরে ঢুকে যেতে গোরা অবাক হল। দাওয়ার আনাচকানাচে লক্ষ্মীকে কোথাও দেখল না। তিনমাস পরে শ্রীহট্ট থেকে বাড়ি ফিরে সেখানে আনন্দ উৎসবের হাট বসে যাওয়ার যে ছবি দেখার প্রত্যাশা গোরার মনে তৈরি হয়েছিল, তার বদলে থমথমে গম্ভীর পরিবেশ নজর করে সে একটু দমে গেল। বাড়ির অঙ্গনে শ্রীবাসকে রেখে গোরা সোজা ঘরে ঢুকে মায়ের পাশে দাঁড়াল। মায়ের মুখের চেহারা দেখে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস কর, মা তুমি ঘরে কেন? তোমার মুখে হাসি নেই কেন?
গোরার পেছনে সস্ত্রীক শ্রীবাস পণ্ডিত, চন্দ্রশেখর ঘরে ঢুকেছিল। গোরার মেসোমশাই চন্দ্রশেখর বলল, বাছা গোরা, তোমার পত্নী গঙ্গাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
গঙ্গাপ্ৰাপ্ত!
শব্দটা আর্তনাদের মতো গোরার গলায় জেগে উঠতে ঝরঝর করে শচী কেঁদে ফেলল। শচীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকল, তার সই, শ্রীবাস পণ্ডিতের সহধর্মিণী মালিনী। সাপের কামড়ে লক্ষ্মীর মৃত্যুর ঘটনা আদ্যোপান্ত গোরাকে শোনাল চন্দ্রশেখর। পাথরের মূর্তির মতো গোরা স্থির, দেহে যেন প্রাণ নেই, অনেকক্ষণ মাথা হেঁট করে রইল। মাত্র দু’বছর তার ঘরণী হিসেবে কাটিয়ে লক্ষ্মীর সংসার করার সাধ কি মিটে গেল? তাকে ছেড়ে কোথায় গেল লক্ষ্মী? গোরার বুক ফাটছে, কিন্তু মুখে উচ্চারণ করল, ‘মাগো সংসার অনিত্য।’ একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, হায়, কোথায় আমি, কোথায় লক্ষ্মী, কী দরকার এই ধনসম্পদ, উপহারের ছালা? এ সবই অনর্থ, মানুষের জীবন পদ্মপত্রে জল, নইলে লক্ষ্মী কেন ছেড়ে যাবে আমাকে?
শোকাতুর গোরা স্বগতোক্তির মতো একক সংলাপ বলে যাচ্ছিল। আত্মসঙ্গোপনে যে জীবনের কথা ভাবছিল, তা নিজের জীবন, লক্ষ্মীর জীবন, আত্মীয়পরিজনের জীবনের চেয়ে অনেক বড়, আদিঅন্তহীন এক বিশাল জীবনপ্রবাহের ঢেউ ভাঙার ছলাৎছল আওয়াজ কানে আসছিল তার। সে আপনমনে বলে যাচ্ছিল, লক্ষ্মী, সংসার অনিত্য, কেউ কারও নয়, সেই জ্ঞান তুমি রেখে গেল আমার জন্যে। এ মহাজ্ঞান! তুমি নেই, তোমার রেখে যাওয়া জ্ঞানাধার এখন থেকে আমি বয়ে বেড়াব। স্বগতোক্তির মধ্যে মায়ের কাঁধে পরম শ্রদ্ধায় হাত রেখে গোরা বলল,
‘ভবিতব্য যা আছে তা খণ্ডিবে কেমনে
এই মত কাল গতি কেহ কার নহে,
অতএব সংসার অনিত্য বেদে কহে।’
গভীর শোকাবেশের সঙ্গে পুনর্বার ‘সংসার অনিত্য’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করে গোরা দু’হাতে মাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। মালিনী, চন্দ্রশেখরের চোখেও জল। গম্ভীর মুখে ‘অনিত্য’ শব্দটা নিঃশব্দে জপ করে চলেছে শ্রীবাস পণ্ডিত। ডান হাতের বেষ্টনীতে মাকে বুকে আগলে রেখে আত্মকথনের ভঙ্গিতে গোরা বলে যাচ্ছিল, মা তোমার ঘরের বউ, লক্ষ্মী ছিল আসলে দেবরাজ ইন্দ্রের সভার অপ্সরা। নাচের সভায় তালে ভুল হওয়াতে ইন্দ্রের অভিশাপে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিল। পৃথিবীতে তার নির্বাসনের কাল পূর্ণ হওয়াতে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। স্বর্গ তার জন্মভূমি। সেখানে ফিরে গেছে। বধূ হারানোর শোকে মা, তুমি ভেঙে পড়ো না। বিধাতার লেখা নিবন্ধ কে খণ্ডাবে?
জিজ্ঞাসার মত, একান্ত আপনমনে, গভীর গোপন যেসব কথা, মায়ের কানে গোরা বলে যেতে থাকল, সেই কথাগুলো চোখের জলে ভাসতে থাকা মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেও, গোরা বস্তুত নিজের সঙ্গে কথা বলে স্বাভাবিক ঘটনাস্রোত আর ঘটনার আকস্মিকতার মধ্যে ফয়সালার সূত্র খুঁজছিল। দুঃখে বুক ফেটে গেলেও তার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। শোকাতুর মাকে শান্ত করার জন্যে তার কথকতার মধ্যে থেকে থেকে ‘সংসার অনিত্য’ এই শব্দ দুটো এসে যাচ্ছিল। তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বন্যা, খরা, মহামারির সঙ্গে দিল্লি, জৌনপুর, কনৌজ, ত্রিশুত, উৎকল, গৌড়ে মসনদের দখল নিয়ে যে হানাহানি, ষড়যন্ত্র, রক্তপাত, মৃত্যু সে দেখেছে, তা রক্তের মোড়ক জড়ানো ভয়ঙ্কর অনিত্যতা ছাড়া কিছু নয়। বৃদ্ধ আর শিশু সেখানে মৃত্যুশয্যার কার্যকারণহীনভাবে শুয়ে রয়েছে, পোকামাকড়ের মতো মানুষ মরছে। ইতিহাসের সেই দুঃস্বপ্নময় তমসার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল দেশবাসীর কান্না, তার প্রাণের প্রেয়সী হারানোর শোক। গোরা অনুভব করছিল, সময়ের প্রবাহ আসলে অসহায় মানুষের হাজার লক্ষ অনিত্য মুহূর্তের সমষ্টি, এক সমুদ্র লবণাক্ত দ্রবণ। অনিত্য মুহূর্তগুলোর মধ্যে কোথাও কি মানুষের জন্যে এক ফোঁটা সুখ, নিরাপত্তা নেই? গোরার হঠাৎ মনে হল, তার দাদার লেখা পুঁথি থেকে হয়তো এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। তা সম্ভব নয়। অনিত্যের মধ্যে নিত্যকালের মহিমা কিছু আছে কিনা, তাকেই খোঁজ করতে হবে। সুর, সংগীত, মানুষে মানুষে ভালোবাসা, পৃথিবীর প্রতি মানুষের এই প্রগাঢ় টান, তা না হলে ব্যর্থ হয়ে যাবে। অনিত্য সংসারে কোথাও কিছু নিত্য বস্তু আছে, যার ক্ষয় নেই।