গোরা – ৩৩

৩৩

বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগের দিন সকালে গঙ্গায় চান সেরে সাততাড়াতাড়ি ঘরে ফিরল গোরা। মাঘের শীতে বাঘের শরীরে কাঁপুনি ধরলেও গোরা স্বচ্ছন্দে বাড়িতে ঢুকে ভিজে পোশাক পাল্টে শরীরে ধুতি চাদর জড়িয়ে এক কাঁসি ফলার মেখে দাওয়ায় খেতে বসল। তার মুখোমুখি বসল মা, বাঁদিকে ঘেঁষে বিষ্ণুপ্রয়া। মা, বউ-এর সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করে অনেকটা সময় নিয়ে চিঁড়ে, দুধ, চাঁপাকলা, বাতাসা মাখা ফলারের কাঁসি শেষ করল সে। ছেলের সহজ, ঘরোয়া হালচাল, ফুর্তিতে উপচে পড়া চোখ দুটো দেখে শচী মনে মনে ভাবল, যাক্ বাঁচা গেল, গোরার মতিগতি বদলাচ্ছে, সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছে নিশ্চয় কেটে যাচ্ছে। ঘরসংসারে এবার হয়তো তার মন বসবে। নবদ্বীপ ছেড়ে তাকে শেষ পর্যন্ত যেতে হবে না। তার হয়ে গৌড়ের দরবারে সুলতানের কাছে কেউ সম্ভবত সালিশি করে করে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে। গোরাকে বাঁচাতে তদ্বির করার মতো মানুষ একডালার দরবারে কয়েকজন আছে, শচীর অজানা নয়। তারা হেঁজিপেজি লোক নয়, কেউ সাকর মল্লিক, কেউ দবীর খাস, কেউ ছত্রী, লস্কর, উজির, সুলতানের অন্তরঙ্গ পারিষদ। গরিব ব্রাহ্মণসন্তান গোরাকে বাঁচাতে তাদের কেউ সুলতানের কাছে আর্জি পেশ করে নিশ্চয় জানিয়েছে, ছেলেটা একটু খ্যাপাটে হলেও মাতাল, লম্পট নয়, বরং উল্টোরকম। গোরা বিনয়ী, ভদ্র, ভালোমানুষ, নাচ গান অভিনয় নিয়ে মেতে থাকে। কিছুদিন ধরে কৃপ্রেমে পাগল হলেও রাজদ্রোহী নয়। দরবারের বিশ্বস্ত কোনও রাজপুরুষের অনুরোধে সুলতানের মন গলে গেছে। গোরাকে মাপ করে দিয়েছে সুলতান।

গোরার কানে সেই সুখবর পৌঁছে গেলেও মা, বউ-এর কাছে খবরটা এখনও সে ভাঙেনি। বোধহয় আজ বলবে। চেটেপুটে ফলার খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে দাওয়ায় ফিরে এসে এখনই সম্ভবত খবরটা সে শোনাবে অনুমান করে শচী নড়েচড়ে বসল। গোরা দাওয়ায় ফিরে এলেও বসল না। বিষ্ণুপ্রিয়ার হাতের পানের বাটা থেকে এক খিলি পান নিয়ে মুখে পুরে শোয়ার ঘরে ঢুকে তক্তপোশে শরীর এলিয়ে দিল। সারারাত সঙ্কীর্তনের পরে রোজ সকালে, এই সময়ে গোরা লম্বা একটা ঘুম দেয়। তক্তপোশে শুয়ে কয়েক মুহূর্তে গভীর ঘুমে ডুবে যায়। জন্মের মতো নবদ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নিজের সংসারে শেষ সকালটা ঘুমিয়ে কাটানোর কথা ভেবেও বিছানায় উঠে বসল। সদর দরজা থেকে তখনই কেউ হাঁক দিল, দাঠাকুর আছেন নাকি?

চেনা গলা, শ্রীধর এসেছে, বুঝতে গোরার অসুবিধে হল না। ঘর ছেড়ে দাওয়ায় এসে দেখল, একটা কচি লাউ হাতে শ্রীধর উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গোরাকে দেখে শ্রীধর বলল, পাতোপেন্নাম, আই কোথায় গো?

রান্নাঘর থেকে শচী উঠোনে এসে দাঁড়াতে তার হাতে লাউটা দিয়ে গোরাকে শ্রীধর বলল, ফিনফিনে কচি লাউ, পায়েস হবে ভালো, আজই খেও।

শ্রীধরের কথা শুনে গোরা চমকে গেল। লাউটা আজই সে খেয়ে নিতে বলছে কেন? শ্রীধর কি জেনে গেছে সংসারে আজ তার শেষ দিন? না, তা নয়। শ্রীধরের কথার ধরন এরকম। হাসিমুখে শচীকে গোরা বলল, মা, শ্রীধর কী বলছে, শোনো।

হাসিমুখে শচী বলল, তোর জন্যে থোড়, মোচা, লাউ আনলে, শ্রীধর সবসময়ে এই এক কথা, ‘আজই কিন্তু খেও’ বলে। ঠিক কিনা শ্রীধর?

শ্রীধর একটু লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে জিনিসটা তাজা থাকলে তার সোয়াদ আলাদা।

শ্রীধর আর দাঁড়াল না, বলল, যাই, বাজারে ছালা রেখে এসেছি।

শ্রীধর চলে যেতে গোরাকে শচী ঘুমোতে যেতে বলল। গোরা বলল, মা, তোমার রান্না দেখব, লাউ কোটা দেখব।

খুশির হাসি ছড়িয়ে পড়ল শচীর মুখে। বাচ্চাবেলায় এরকম কত আবদার যে গোরা করত, হিসেব নেই। শচী বলল, লাউ কুটবে তোর বউ। আমি রাঁধব পায়েস। তুই বরং লাউটা বঁটিতে দু’ভাগ করে দে।

গোরা জানে লাউ, কুমড়ো, চালকুমড়ো বঁটিতে কোটার আগে পরিবারের কোনও পুরুষকে দিয়ে সেটা দু’টুকরো করে নেওয়া মেয়েলি প্রথা। সে রান্নাঘরে ঢুকে লাউটা ভালো করে ধুয়ে বঁটিতে দু’ভাগ করে হাসিমুখে বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলল, নাও, লাউ কুটতে বসে আবার হাত কেটে ফেলো না।

বিষ্ণুপ্রিয়া সাড়া না করলেও ঠোঁটে হাসি নিয়ে দু’খণ্ড লাউ কাটাতে বসল। সুলতানের মার্জনা পাওয়ার খবরটা গোরার মুখ থেকে শোনার জন্যে শচী কান খাড়া করে থাকলেও ছেলে মুখ না খোলায়, মা অধৈর্য হচ্ছিল। মা, বউ-এর হেঁসেলে সময় কাটাতে এসেও গোরা বেশিক্ষণ সেখানে বসল না। বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে না পারলেও রান্নাঘরে লাউ কাটার পরে ঘুমে বুজে আসছিল তার চোখ। রান্নাঘর ছেড়ে গোরা চলে যেতে শচী ভাবছিল, সংসারে গোরাকে বিবাগী করাতে তার কানে বুড়ো অদ্বৈত আচার্য ফুসমন্তর দিয়েছে। তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে শ্রীবাস পণ্ডিত আর তাদের দলবল। গোরাকে কৃষ্ণাবতার সাজিয়ে তাকে খেপিয়ে দিয়েছে কৃষ্ণাবতারের নির্দেশে গৌড়ের সুলতানি মসনদের দখল নিতে চলেছে তার নির্বাচিত রাজা, এ গুজবও রটিয়েছে অনেকে। শচীর সন্দেহ, সম্পর্কে তার ভগ্নিপতি হলেও চন্দ্রশেখর তলে তলে অদ্বৈত, শ্রীবাসের পোঁ ধরে চলেছে। সবাই মিলে ফন্দি করে পাগল করে দিতে চায় তার সোনার চাঁদ ছেলেকে।

কাঠের উনুনের আগুনের আঁচ এসে পড়ছিল শচীর মুখে। স্বামীহারা বিধবার বুকের ভেতরটা কিছু মানুষের ওপর অভিমানে জ্বালা করছিল। মাথায় ঘোমটা টেনে রান্নাঘরের একপাশে লাউ কুটছে বিষ্ণুপ্রিয়া। সেদিকে চোখ পড়তে শচীর সব রাগ গিয়ে পড়ল বিষ্ণুপ্রিয়ার ওপর। মনে হল, এই বউটাই বা কী? বিয়ের তিনবছর পরেও পেটে একটা ছেলে ধরতে পারল না, এ কেমন বউ? বাঁজা নাকি? স্বামীকে সংসারে বাঁধতে গেলে তার বংশধরকে গর্ভে নিতে হয়। রাতের পর রাত এতগুলো বছর স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় কাটিয়ে যে মা হতে পারে না, সে বউ নিয়ে সংসারে গোরার মন বসবে কেন? বউ-এর বয়স তো কম হল না। ষোলোবছর বয়সে তিন মেয়ের মা হয়ে গিয়েছিল শচী। তাদের কেউ বেঁচে নেই, এটা যেমন ঠিক, তেমন সত্যি হল, আট মেয়ে মরে গেলেও শেষ পর্যন্ত দু’ছেলের মা হয়েছে সে। তার চোখের সামনে মৃত আট মেয়ের মুখ ভেসে উঠতে মনটা ভারি ব্যাকুল হল। প্রথম মেয়ে যখন জন্মালো, তার বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়। কীভাবে কী ঘটল, বোঝার আগে সে মা হয়ে গিয়েছিল। তেরো বছরের শচীকে তার মা বলেছিল, মেয়ে এবার মা হল। চেয়েছিলাম, মেয়ের ছেলে হোক, হল মেয়ে!

মায়ের মুখে হতাশার ছাপ, কথাতে আফশোস শুনে বড় একটা অপরাধবোধ জেগেছিল শচীর মনে। আঁতুড়ঘরে, দু’দিনের মেয়েটাকে পুতুলের মতো কোলে নিয়ে বসে থাকলেও তার মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিল না। পাঁচদিনের বাচ্চাকে নিজের কোল থেকে বিছানায় শোয়াতে গিয়ে এক সন্ধেতে যে হাত ফসকে আঁতুড়ঘরের মেঝেতে সে পড়ে গেল, তার কারণও কি মেয়ে জন্ম দেওয়ার জন্যে নিজের ওপর তার হতছেদ্দা? হতে পারে। মাটির ঘর। নিকোনো মাটির মেঝেতে পড়ে মেয়ের খুব বেশি চোট না লাগলেও আবছা একটা শব্দ করে সে চুপ করে গিয়েছিল। ফাঁকা আঁতুড়ঘর। মা, বোনরা কাছাকাছি কেউ না থাকায় ঘটনাটা কারও নজরে পড়ল না। মাটি থেকে তুলে মেয়েকে বিছানায় শোয়ানোর সময়ে শচী টের পায়নি, সে মৃত। আধ ঘণ্টা পরে মা এসে মরা শিশুকে আবিষ্কার করেছিল। মেয়েটা যে অল্প আঘাতে কেন মরে গেল, তার তেরোবছরের মা সেদিন বুঝতে না পারলেও প্রকৃত ঘটনা গোপন করে গিয়েছিল। দ্বিতীয় মেয়েটা পেট থেকে বেরনোর সময়েই তার প্রাণ ছিল না। তৃতীয় মেয়েটা সবচেয়ে বেশিদিন, একমাস বেঁচেছিল। মাটির তিজেল হাঁড়িতে ভাত ফুটে উঠতে বাকি পাঁচটা মেয়ের মৃত্যু নিয়ে শচী ভাবার সুযোগ পেল না। মৃত মেয়েদের নিয়ে সে ভাবতে চাইছিল না। সংসারে ছেলের কদর আলাদা। দশবছরের ব্যবধানে দুই ছেলের জন্ম দিয়ে সে জেনেছে পেটের পুত্রসন্তানকে বাঁচাতে গোটা সংসার কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উলু দিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে পাড়া মাথায় করে তাকে পৃথিবীতে আনার পরে কত স্নেহ, যত্নে আগলে রাখা হয়। মেয়ে জন্মেছে শুনলে সেই আত্মীয়, প্রতিবেশীদের মুখ থমথমে হয়ে যায়। সদ্য পৃথিবীতে আসা শিশুকন্যার মুখ দেখতে বিশেষ কেউ আগ্রহ বোধ করে না। মা হিসেবে নিজের পেটের মেয়েদের বাঁচাতে সে কি অবহেলা দেখিয়েছিল? মাথায় এ চিন্তা এলে শচীর বুক কাঁপে। বিশ্বরূপ, গোরা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে, যেভাবে আঁতুড়ঘর থেকে ননীর পুতুলের মতো আগলে রেখে দু’জনকে বড় করেছিল, মৃত মেয়েদের কেউ জন্মমুহূর্ত থেকে সেই পরিচর্যার ছিটেফোঁটা পায়নি।

উনুন থেকে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ফেন আলাদা করে শাকচচ্চড়ি রান্না শুরু করেও পুরনো দিনগুলোর কথা শচী ভেবে চলেছিল। একের পর এক মেয়ে প্রসব আর তাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাতে, নিজের সংসার আর সমাজের চোখে হেনস্থার একশেষ হতে হয়েছিল তাকে। মেয়েদের কেউ কেউ, কিছু পুরুষও তাকে আড়ালে ‘মেয়ে বিয়োনি বউ’ বলে খোঁটা দিত। তাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে দাই সনকা বলত, মেয়ে আর ছেলেতে কোনও তফাত নেই গো দিদি। মেয়েরা না থাকলে পৃথিবীতে মানুষ আসত কোন পথে? তুমি থাকতে না, আমি থাকতাম না। মা ডাকার জন্যে খুঁজে পাওয়া যেত না কাউকে। প্রসবের মুহূর্তে সে কথা থামিয়ে পাকা হাতে পৃথিবীতে সন্তান আনার কাজ করত। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে শচীর পেটের আদল খুঁটিয়ে দেখে বলত, তোমার কোলে এবার ফুটফুটে একটা ছেলে আসছে। ছেলের মা হওয়ার সৌভাগ্যের কথা শুনে খুশিতে ভরে উঠত শচীর বুক। সনকার আশ্বাস কাজে লাগত না। ছেলের বদলে মেয়ে প্রসব করেছে জেনে হতাশায় শুকিয়ে যেত শচীর মুখ। গত জন্মের পাপে তার গর্ভে ছেলে আসছে না, এ আলোচনাও বউ-ঝিদের মধ্যে হত। নতুন বউ হয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া সংসারে আসার পরে তাকে এসব কাহিনী শচী শুনিয়েছিল। শচীর প্রায়ই মনে হয়, তার মৃত মেয়েদের গল্প শুনে গর্ভধারণ করতে বিষ্ণুপ্রিয়া কি ভয় পেয়ে গেল? জগন্নাথ মিশ্রের পরিবারে মেয়েসন্তান বাঁচে না, এমন এক গুজব জ্ঞাতি শাশুড়ি ননদের কয়েকজন রটিয়েছিল। অনেক বছরের ব্যবধানে সে গুজব হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেও দু’একজন বুড়ো-বুড়ি এখনও সেসব আওড়ায়। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাপের বাড়ির পাড়ার কোনও বুড়ি হয়তো সুযোগ পেয়ে তার কানে কথাটা তুলে দিয়েছে। ছেলের মা হতে তাই সে ভয় পাচ্ছে।

নাতির মুখ দেখার ইচ্ছে, গোরাকে আহ্লাদ করে জানাতে শচীও ভরসা পাচ্ছিল না। বিয়ের নাম শুনে বিশ্বরূপ যে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল, তার কারণও আট সহোদরার পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াকে পারিবারিক অভিশাপ ভেবেছিল সে। তার ভয় হয়েছিল, বিয়ে করে আনা তার বউ-এর মেয়ে হলে সে মেয়ে বাঁচবে না। গোরার জন্যে যে পুঁথি লিখে মায়ের জিম্মায় বিশ্বরূপ রেখে গিয়েছিল, সেখানে হয়তো এসব বৃত্তান্ত লেখা ছিল। আরও কিছু কি লেখা ছিল? থাকতে পারে। মৃত স্বামী, জগন্নাথের হাতে চলে গিয়েছিল সেই পুঁথি। পুঁথি পড়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছিল জগন্নাথ। তাড়াতাড়ি বিশ্বরূপের বিয়ে দিয়ে সংসারে বউ আনতে চেয়েছিল। বাবার ইচ্ছের বিরোধিতা না করে বাড়ি থেকে এক রাতে নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল বিশ্বরূপ। সংসার ছেড়ে বড় ছেলে চলে যেতে জগন্নাথ বিছানা নিয়েছিল। শয্যাশায়ী ছিল অনেকদিন। কিছুটা সেরে উঠে সংসারে ফের জড়িয়ে পড়লেও কঠিন ব্যামো থেকে রেহাই পায়নি। কয়েকবছর মাত্র বেঁচেছিল। মারা যাওয়ার আগে সকলের চোখের আড়ালে পুড়িয়ে ফেলেছিল বিশ্বরূপের লেখা পুঁথি। ঈশ্বরের আশীর্বাদে ছোটভাই-এর জন্যে লেখা পুঁথি, গোরার হাতে পড়ার সুযোগ ঘটেনি। পুঁথিটা গোরা পড়লে সংসারে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যেত। বিষ্ণুপ্রিয়াকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করত না। সতেরোবছর বয়সে লক্ষ্মীকে কি বিয়ে করত? পুঁথি পড়ার মতো বিদ্যে তো লক্ষ্মীকে বিয়ের আগেই তার হয়েছিল। নিজের চতুষ্পাঠী বসিয়েছিল সতেরো বছরে পা দিয়ে। তবে লক্ষ্মীকে বিয়ের পরে বউ নিয়ে যেরকম মাতামাতি করেছিল, বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিয়ের পরে তেমন ছেলেমানুষী করেনি। বিষ্ণুপ্রিয়াকে বউ করে ঘরে আনলেও গোরার হাবভাবে কোথাও ফাঁক রয়ে গেছে। বউ সম্পর্কে সে যেন কেমন উদাসীন! বিষ্ণুপ্রিয়াকে এড়াতেই যেন রাতের পরে রাত শ্রীবাসের বাড়ির উঠোনে সঙ্কীর্তনে কাটিয়ে দেয়। বিছানায় একা শুয়ে বউটা রাত কাটায়। চাপা স্বভাবের বিষ্ণুপ্রিয়া কিছু বলে না শাশুড়িকে। লক্ষ্মী ছিল অন্যরকম। গোলা পায়রার মতো সবসময়ে বকমবকম করত। কথা না বললে তার পেটের ভাত হজম হত না। লক্ষ্মী বেঁচে থাকলে এতদিনে তার দু’তিনটে ছেলেমেয়ে হয়ে যেত। মা হওয়ার বয়স হয়েছিল তার। মাত্র তেরোবছর বয়সে সংসারের ওপর অভিমান করে চিরকালের মতো সকলকে ছেড়ে চলে গেল সে।

রান্নাঘরের কাজ শেষ করে ঘরের দাওয়ায় বসে শচী যখন নানা রঙের সুতো ছুঁচে ভরে কাঁথা সেলাই করছে, কাঁথায় ফুটে ওঠা ফুল, পাখির নকশা বাঁশের খুঁটি ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবাক চোখে দেখে শাশুড়ির পাশে বসে পড়ল বিষ্ণুপ্রিয়া। শাশুড়ি যা সেলাই করছে, শীতে গায়ে চাপা দেওয়ার কাঁথা সেটা নয়। নবজাত শিশুর বিছানা শুকনো রাখার কাঁথা। বাচ্চার প্রথম বছরে কম করে পাঁচ, সাতটা কাঁথার দরকার হয়। ঘনঘন সে কাঁথা ভেজায়। আগের দুটো ভেজা কাঁথা কেচে শুকিয়ে তোলার মধ্যে পরের দুটো কাঁথা ভিজে ওঠে।

পরিবারের নিঃসন্তান বউকে মা হওয়া কত জরুরি, তা বোঝাতে কাঁথা সেলাই-এর সঙ্গে অনেকগুলো কাঁথা কেন তৈরি রাখতে হয়, শচী যখন শোনাচ্ছিল, আচমকা গোরা এসে দাঁড়াল সেখানে। মুচকি হেসে মাকে জিজ্ঞেস করল, কি এত সেলাই ফোড়াই নিয়ে পড়লে? গোরার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে তাকাল শচী। লজ্জায় লাল হল বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখ। মাথার ঘোমটা আরও একটু টানতে গিয়ে তার ভিজে খোঁপা ভেঙে লম্বা, চকচকে কালো ঝর্নার মতো চুল পিঠে ছড়িয়ে পড়ল, বিষ্ণুপ্রিয়ার লজ্জামাখা মুখের ভঙ্গিমা দেখে মা-এর নকশাদার কাঁথা বানানো রহস্য বুঝতে গোরার অসুবিধে হল না। উঠোনের ঝাঁকড়া নিমগাছের ডালপাতার ফাঁক দিয়ে পঞ্চপ্রদীপের আলোর মতো শীতের দুপুরের এক পশলা রোদ এসে পড়েছে বিষ্ণুপ্রিয়ার শরীরে। দাওয়া থেকে দেখা যাচ্ছে রান্নাঘরে নিভে যাওয়া কাঠের উনুন, মাটির হাঁড়ি, লোহার কড়া, খুন্তি, সাঁড়াশি, কাঁসার থালা, বাটি, জলের ঘটি, মাটির দেওয়ালে বাতায় ঝোলানো দড়ির জালিকার মধ্যে গামলা, জামবাটি, হেঁসেলের কাজের জিনিসগুলো গোরা খুঁটিয়ে দেখতে থাকল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বহুবার দেখা এইসব জিনিসগুলোকে মনে হল প্রথম দেখছে। শেষ দেখা আর প্রথম দেখার অনুভূতিতে কোথাও মিল রয়েছে, মনে হল তার। বাকি জীবনে আর কখনও মা-এর হেঁসেলপাতি দেখতে পাবে না। মা, বউ-এর পাশাপাশি বসে থাকা, কাঁথা সেলাই, নিচুগলার কথা, বিষ্ণুপ্রিয়ার ঠোঁট টিপে হাসি, দু’চোখ ভরে দেখে তার আশ মিটছিল না। মা-এর কাঁথা সেলাই-এর সঙ্গে আশাভঙ্গের যে প্রবল দুঃখ মিশে রয়েছে, অনুভব করে গোরার চোখে জল এল। মুখে হাসি টেনে চোখের জল সামলে দাওয়ায় বিষ্ণুপ্রিয়ার পাশে সে বসে গেল। রাস্তা দিয়ে খুরের আওয়াজ তুলে ছুটে গেল সুলতানি ঘোড়সওয়ার বাহিনী।

ছেলেকে শচী জিজ্ঞেস করল, এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়লি?

ঘুমোলাম তো দু’ঘণ্টা!

পাঁচ ঘণ্টার আগে ঘুম ভাঙে না তোর।

গোরা জবাব দিল না। স্বামী গা ঘেঁষে বসায় বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখে দুপুরের আলো বাড়তি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। মা, বউ, খড়ের ছাউনি, দু’ঘরের এই বাড়ি, সংসার,গেরস্থালি, গোরার মনে হল মায়ায় টইটম্বুর হয়ে আছে। গৃহী মানুষ এত মায়া ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। সংসার ঘিরে মায়ার এই আবরণ তো মিথ্যে নয়। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, এই শাস্ত্রবাক্যই বরং সত্যের অপলাপ। জগৎ সত্য, মানুষ, পশুপাখি, পোকামাকড়, গাছপালা, সমুদ্র, পর্বত, মহাকাশ, নক্ষত্রমণ্ডলী, সূর্য, চাঁদ, বিশ্বচরাচর, শব্দ, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ, দৃশ্য, জাগতিক এসব কিছু সত্য, আর সবাইকে জড়িয়ে রয়েছে যে প্রেম, ভালবাসা, তারই আর এক নাম মায়া, তার চেয়ে বড় সত্য কিছু নেই। যেখানে মায়া নেই, প্রেম, ভালবাসা সেখানে থাকতে পারে না। ভালবাসার প্রতিমূর্তি, পরম প্রেমিক কৃষ্ণ, সে-ও সেখানে থাকে না। গয়ায় বাবা আর লক্ষ্মীর পিণ্ড দিতে গিয়ে বিশ্বরুপের লেখা লোমহর্ষক পুঁথিটা পড়ে কৃষ্ণের মায়ায় পড়ে গেছে সে। সে জেনেছে সে কৃষ্ণের সন্তান, কৃষ্ণ তার বাপ। পঁচিশবছর আগে তুমুল ঝড়বৃষ্টির এক রাতে দুই দেবতা, বরুণ আর পবনের বেশে স্বয়ং কৃষ্ণ শ্রীহট্টে বুরহানউদ্দিনের দরগায় এসে বজ্রবিদ্যুৎ, মেঘ আর উদ্দাম হাওয়ার মধ্যে কয়েক মুহূর্ত অদৃশ্য করে রেখেছিল তার মাকে। বিশ্বরূপের জন্মের দশবছর পরে, শচীর সন্তানধারণের পর্ব জীবনের মতো চুকে গেলেও ফের সে গর্ভবতী হয়েছিল। কৃয়ের স্পর্শে আরও একবার মাতৃত্বের লক্ষ্মণ ফুটে উঠেছিল তার শরীরে।

দুপুরের শুরুতে মা, বউ-এর পাশে বসে নিজের পিতৃপরিচয় মনে পড়তে গোরার চোখের সামনে দৃশ্যপট বদলে গেল। সঙ্কীর্তনের আসরে পটমঞ্জুরী রাগে প্রেমকীর্তনের মধ্যে যেভাবে বিবশ শরীরে চেতনা হারানোর দশা হয়, সেই ঘোর জাগল মাথাতে। ভয় পেল, বেহুঁশ না হয়ে যায়!

গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে শচী বলল, তোর চোখে কিন্তু ঘুম রয়েছে, আরও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নে। শেষ রাত পর্যন্ত আবার সঙ্কীর্তনের আসরে জাগতে হবে।

গোর নড়েচড়ে বসল। বলল, ঘুম চলে গেছে।

শচী আর কথা বাড়াল না। হালকা হাসি দু’ঠোঁটে ছড়িয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। তার মুখের দিকে নজর করে গোরার মনে হল, কৃষ্ণের মায়ায় ভেসে গেলেও মনের গভীরে এখনও মা, বউ-এর জন্যে কিছু মায়া ঘনীভূত রয়েছে। প্রাণের দায়ে সংসার ছাড়তে না হলে পরমপ্রেমিককে ভালবেসে জাগতিক মায়া কাটানোর কষ্ট পেতে হত না। কৃষ্ণপ্রেমে ভাবাবিষ্ট থেকেও সংসার করা যেত। সন্ন্যাস নেওয়ার দরকার পড়ত না। নবদ্বীপের মানুষের সামনে আদর্শ চরিত্রের উদাহরণ খাড়া করতে সে সন্ন্যাস নিচ্ছে। গোঁড়া বামুনরা যাকে চিরকাল অপছন্দ করেছে, যার নামে জঘন্যতম কুৎসা রটনার সঙ্গে যাকে খুন করার ষড়যন্ত্র করেছে, সেই মানুষটা শুধু শরীরী দৈর্ঘ্য প্রস্থে তাদের চেয়ে বড় নয়, বিনয়, সৌজন্য, ভদ্রতায় তার উচ্চতা আকাশচুম্বি, অসম্ভব তার সাহস, তার অসাধ্য কিছু নেই, এটা সবাইকে সে দেখাতে চায়। সবচেয়ে কঠিন কাজটা এখনও বাকি। বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছ থেকে সন্ন্যাসের অনুমতি নিতে হবে। আজ রাতে সারতে হবে সেই গুরুদায়িত্ব।

দুপুরের খাওয়া সেরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল গোরা। নগরিয়া ঘাটে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল নিতাই আর মুরারি। নবদ্বীপ ছেড়ে তার অন্তর্ধানের খবর কাল সকালে ছড়িয়ে পড়লে এখানে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ওপর মস্ত একটা ধাক্কা আসতে পারে, অনুমান করে নিতাই আর মুরারিকে আগে থেকে আলাদা করে ডেকে সেই বিকেলে নগরিয়া ঘাটে গোরা আসতে বলেছিল। তার অনুপস্থিতিতে নবদ্বীপ থেকে ঝাড়েবংশে উচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে যত বৈষ্ণব পরিবার। গৌড়ের পাষণ্ডী বামুন আর সুলতানি সেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণে তছনছ হয়ে যেতে পারে বৈষ্ণবসমাজ। বিশেষ করে শ্রীবাস পণ্ডিত, শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী, নন্দন আচার্য, গদাধর, মুকুন্দ দত্ত, চন্দ্রশেখর আচার্যর মতো প্রথম সারির বৈষ্ণব ভক্তদের আক্রান্ত হওয়ার ভয় সবচেয়ে বেশি। তবে ভয়ভীতির এই পরিবেশ দু’তিন দিনের বেশি থাকবে না। তারপর বইবে উল্টো হাওয়া। তার সন্ন্যাস নেওয়ার ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে নবদ্বীপ, কাটোয়া, কুলিয়া, শান্তিপুর, ফুলিয়া, কুমারহট্ট জুড়ে কৃয়াবতারের নামে জয়ধ্বনির যে ঝড় উঠবে, তার ঝাপ্টায় যারা অস্ত্র শানাচ্ছে, তারা পালানোর পথ পাবে না। বৈষ্ণবসমাজের নামে সাধারণ জনসমাজে ভালবাসার ঢেউ উঠবে। গৌড় থেকে রাঢ়, সমতট, বরেন্দ্রভূমি, বঙ্গাল প্রেমভক্তিতে ভেসে যাবে।

নিতাই, মুরারির সঙ্গে পরামর্শ সেরে সন্ধের আগে একঝুড়ি ফুল আর মালা নিয়ে সোজা বাড়ি ফিরতে শচী যত অবাক হল, তার চেয়ে বেশি ধাঁধা খেল বিষ্ণুপ্রিয়া। স্বামীকে এমন ফুলের বোঝা নিয়ে সে কখনও বাড়িতে ঢুকতে দেখেনি। ফুল, মালা নিয়ে আসে তার ভক্ত, অনুরাগীরা। তাকে মালা পরায়, পায়ে ফুলের অঞ্জলি দেয়। তামার বাটি বোঝাই চন্দনবাটা এনে কপালে তিলক টেনে, অলকা-তিলকা এঁকে, দু’বাহু, পায়ের পাতায় চন্দন মাখিয়ে দেয় তারা। অনেক সময়ে ভোররাতে শ্রীবাসের আঙিনা থেকে গলায় মালা নিয়ে ঘরে ফিরে আসে গোরা। নিজের হাতে এত ফুল মালা নিয়ে আজ পর্যন্ত তাকে ঘরে আসতে বিষ্ণুপ্রিয়া দেখেনি সে কোনও প্রশ্ন করল না। শচী চুপ করে থাকল। সবচেয়ে আশ্চর্যের যা ঘটল, শ্রীবাসের বাড়িতে সেই রাতে সঙ্কীর্তনের আসরে গোরা গেল না। ফুলের ঝুড়ি ভরে রেখে মা, বউকে দু’পাশে নিয়ে দাওয়ায় বসে বলল, সংসারের সব ভার যখন নিয়েছি, তখন দু’একটা বিকেল আমার ঘরে কাটানো উচিত। সঙ্কীর্তনে আজ থাকব না, নিতাই, শ্রীবাসকে কাল রাতে বলে রেখেছি। গোরার কথাতে খুশিতে উজ্জ্বল হল বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখ। শচী বলল, সঙ্কীর্তনের আসরে ফুলের ঝুড়ি নিতে কে আসবে?

কেউ আসবে না। এ ফুলের ঝুড়ি আমার, আজ আমার ঘরে থাকবে।

গোরার জবাব শুনে শচী চুপ করে থাকলেও কিছু রহস্যের আভাস পেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে তাকাল। বিষ্ণুপ্রিয়ার দু’চোখে সরলতা, কিছুই জানে না সে। শ্রীবাসের বাড়িতে তার স্বামী আজ যাবে না, সারা বিকেল, সন্ধে ঘরে থাকবে, এতেই সে ভীষণ খুশি। খুশিতে চকচক করছে তার দু’চোখের তারা। গাঁদাফুল ছাড়া ঝুড়িতে হাস্নুহানা, গোলাপ আরও কয়েকরকম ফুল দেখেছে সে। মালাও নিশ্চয় কয়েকটা আছে। তবু সে নিজের হাতে স্বামীর জন্যে কয়েকটা মালা গেঁথে তাকে পরাবে। শীতের বিকেল ফুরিয়ে অন্ধকার নামল পৃথিবীতে। শচী রান্নাঘরে ঢুকতে জ্বালানি কাঠের বোঝা উনুনের পাশে রেখে এল পুরনো গৃহভৃত্য ঈশান। মাটির তেলের পিদিম জ্বেলে পিলসুজে রাখল। সে বুঝে গেল, দাঠাকুর যখন ঘর থেকে বেরলো না, তখন দুধ চিঁড়ে ফলারে রাতের খাওয়া চুকবে না, ফের চুলো জ্বলবে, রান্নাবান্না হবে। তাই ঘটল। শ্রীধরের আনা যে লাউ-এর অর্ধেক দিয়ে সকালে পায়েস হয়েছিল, বাকিটা কুটে আরও একবার পায়েস বানানোর তোড়জোড় শুরু করল শচী। হাঁড়ি, হেঁসেল, নিয়ে শচী যখন ব্যস্ত, ঘরের মেঝেতে বসে তখন বিষ্ণুপ্রিয়া গাঁদা, গোলাপ, হাস্নুহানা ফুলের মাথা গাঁথছিল। তক্তপোশে বসে গোরা দেখছিল বিষ্ণুপ্রিয়াকে। জিজ্ঞেস করল, কার জন্যে মালা বানাচ্ছ?

ঠোঁট টিপে হেসে বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, তোমার জন্যে। তোমাকে আজ আমি ফুল, মালা, চন্দন দিয়ে সাজাব।

তক্তপোশ থেকে উঠে বিষ্ণুপ্রিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল গোরা। বলল, দুটো মালা গেঁথে রেখ। আমিও সাজাব তোমাকে। নতুন বউ-এর মতো তোমাকে সাজিয়ে বিছানায়, বালিশের পাশে রজনীগন্ধার গোছা, ফুল রেখে আজ রাতে দ্বিতীয়বার ফুলশয্যা করব।

বিষ্ণুপ্রিয়ার গা ঘেঁষে উবু হয়ে বসে তার চিবুক দু’হাতে ধরে মুখে হাসি ছড়িয়ে গোরা জিজ্ঞেস করল, রাজি তো?

ছুঁচ-সুতো, অর্ধেক তৈরি মালা হাতে গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় বিষ্ণুপ্রিয়ার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরলো না, শুধু সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। স্বামীর দু’চোখ ভালবাসায় উপচে পড়ছে বিষ্ণুপ্রিয়ার নজর এড়াল না। ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসল গোরা। পায়েস বানিয়ে মা পিঠে বানাচ্ছে। ক্ষীরপুলি, নারকেল পুলি, পাটিসাপটা, সরুচাকলি, আলাদা করে কয়েকটা থালায় মা সাজিয়ে রেখেছে। মায়ের কাঁধের ওপর হাত রেখে গোরা বলল, দেখছি এলাহি আয়োজন।

মনে হচ্ছে, আজ দিনটা খুব ভালো। সারাদিন বাড়িতে আছিস তুই। কী খুশি যে লাগছে, বলার নয়।

গোরা হাসল, বলল, হ্যাঁ, আজ সত্যি ভালো দিন, আমারও খুব আনন্দ হচ্ছে।

একডালার দরবার থেকে কি কোনও সুখবর পেয়েছিস?

চারপাশের প্রচারে তাকে নিয়ে মা যে বেশ ভয় পেয়ে আছে, গোরার অজানা নয়। তার জীবনহানি ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কাতে মা, বউ কাঁপছে। মায়ের কাঁধে হাতের চাপ বাড়িয়ে গোরা বলল, তোমার ছেলের অনিষ্ট কেউ করতে পারবে না। তোমার ছেলের বাপ হল কৃষ্ণ।

গোরার শেষ কথাটা তার মুখ থেকে আগে শুনলেও মাঘের কনকনে শীতের রাতে আরও একবার কানে যেতে শচীর বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। গোরা সেদিকে নজর করল না। রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে নিজের ঘরে সে ঢুকতে চাইছিল। বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছ থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার অনুমতি আজ রাতে আদায় করতে না পারলে তাকে ঘুমের মধ্যে একা ফেলে রেখে অন্ধকার থাকতে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। ধর্মবিরোধী হবে সে কাজ। সন্ন্যাসের শুরুতে অধর্মাচরণের দায়ে অপরাধী হয়ে যাবে। মালা গাঁথা শেষ করে রান্নাঘরের কাজে শাশুড়িকে সাহায্য করে বিষ্ণুপ্রিয়া এসে যেতে তাকে মাটির হাঁড়িতে পুলিপিঠে সেদ্ধ করার কাজে শচী লাগিয়ে দিল। লম্বা শ্বাস টেনে গোরা বলল, আহ্, দারুণ গন্ধ! গন্ধেই খিদে পেয়ে গেছে।

ছেলের খিদে পেয়েছে শুনে শচী ব্যস্ত হয়ে বলল, কোন দুপুরে ভাত খেয়েছিস খিদে তো পাবেই। খেয়ে নে। পিঠে, পায়েস সব তৈরি। গরম খেতে ভালো লাগবে। রাতও কম হল না।

গোরা তাই চাইছিল। তাড়াতাড়ি খেয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেলে, মা, বউ দেরি না করে খেতে বসে যাবে। রান্নাঘরে শচীর কাজ শেষ হলে বিষ্ণুপ্রিয়া রাতের মতো রেহাই পেয়ে স্বামীর কাছে আসতে পারবে। কাঁসার থালায় পাঁচরকমের পিঠে, জামবাটি ভর্তি লাউ-এর পায়েস সাজিয়ে গোরাকে খেতে দিল শচী। হাতমুখ ধুয়ে গোরা খেতে বসল। ক্ষীরপুলি, চুষিপিঠে, পুলিপিঠে, পাটিসাপটা, পায়েস, সব কিছুতে আজ বাড়তি স্বাদ পেল। রান্নায় মায়ের স্নেহ না মিললে তার হাতে বানানো পিঠে, পায়েসে এমন অমৃতের স্বাদ আসে না। পূর্বাশ্রমে, নিজের বাড়িতে সন্ন্যাসী ফিরে আসতে পারে না। মায়ের হাতের রান্না খাওয়া এ জন্মের মতো বোধহয় শেষ হল। পরিপাটি করে রাতের খাওয়া শেষ করে হাত ধোয়ার সময়ে বিষ্ণুপ্রিয়াকে একা পেয়ে নিচু গলায় গোরা বলল, তাড়াতাড়ি ঘরে এসো। দেরি করলে আমি কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ব।

স্বামীর কথা শুনে ফিক্ করে হেসে পরের মুহূর্তে মুখ গম্ভীর করে বিষ্ণুপ্রিয়া রান্নাঘরে ঢুকল। অন্ধকার উঠোনের একধারে দাঁড়িয়ে গোরা তাকাল আকাশের দিকে। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়েছে। রাতের আকাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। স্তরে স্তরে জমে থাকা কুয়াশার অনেক ওপরে মিটমিট করে আলোর যে বিন্দুগুলো নজরে পড়ছে, সেগুলো তারা, না ঠাণ্ডায় স্থির হয়ে যাওয়া আধমরা জোনাকি, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। ডানদিকে ঝাঁকড়া নিমগাছের তলায় চালের খড় খসে পড়া যে জরাজীর্ণ আঁতুড়ঘরে আট মৃত সহোদরা, দাদা বিশ্বরূপ ভূমিষ্ঠ হওয়ার দশবছর পরে তার জন্ম হয়েছিল, চব্বিশবছর আগের সেই সন্ধেটা তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। ঘরটা যেন সদ্য বানানো হয়েছে, ঘরের সোনালি খড়ের চাল থেকে ভেসে আসছে খামারে তোলা তাজা ধানের গন্ধ। হিমেল হাওয়ায় নিমগাছের ডালপাতা থেকে সিরসির আওয়াজ উঠছে। অন্ধকার বাস্তু, আঁতুড়ঘর, নিমগাছ, আশপাশের গাছপালা, মাটির গন্ধের সঙ্গে তার শরীর মিশে একাকার হয়। কোথায় তাকে টেনে নিয়ে চলেছে, পুরুষোত্তমপুরে জগন্নাথের কাছে, বৃন্দাবনে চিরকিশোর বংশীবাদকের কাছে, না গৌড়ের ভবিতব্যের সঙ্গে জুড়ে দিতে, সে জানে না। সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায়, চন্দ্রদ্বীপের রাজপুত্র পীতাম্বর রায়, রাঢ়ের নানা মুলুক, মহলের বেশ কিছু অধিপতি যে তাকে কৃষ্ণাবতার মেনে নিয়ে ধর্মরাজ্যের নেতা বানাতে চায়, এ তথ্য তার অজানা নয়। তাদের কেউ সরাসরি তাকে পুরোধা হতে না বললেও নানা সূত্রে তাদের প্রস্তাব এসেছে তার কাছে। বৈষ্ণব সমাজের বিশাল সঙ্ঘশক্তির সুভদ্র অভ্যুত্থান দেখে গৌড়ের সুলতান থেকে ক্ষমতার নানা বলয়ে কর্তৃত্বধারী অধিনায়করা সজাগ হয়ে নড়েচড়ে বসেছে। সুলতানি দরবারের কয়েকজন উঁচুপদের কর্মচারীও তার গুণগ্রাহী, সে জানে। সুলতানের ক্রোধ থেকে তাকে সেই ক্ষমতাবানরা বাঁচাবে, শচীও যেভাবে হোক জেনেছে। ছেলের মুখ থেকে সেই সুখবর শুনতে মা প্রতীক্ষা করে রয়েছে, গোরা টের পায়। গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার দরকার হবে না, অনুমান করে তাকে সন্ন্যাসী হতে শচী অনুমতি দিয়েছি। বিষ্ণুপ্রিয়াও সেরকম কিছু ভেবে তার সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছেতে সায় দিলে সংসারের নিয়মরক্ষা হয়। মনে কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে নিজের ঘরে এসে ঢুকল গোরা

শীতের সময়ে সন্ধের এক প্রহর পরে গ্রামদেশে মাঝরাতের নীরবতা নেমে আসে। গৃহস্থেরা রাতের খাওয়ার পাট তাড়াতাড়ি সেরে ঘরের কপাট এঁটে তেলের বাতি নিভিয়ে কাঁথা, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘরের পাশে, ঝোপঝাড়ে, শিয়াল ডাকে, গাছপাতায় সরসর আওয়াজ তুলে পোকামাকড় ঘোরাফেরা করে। অন্ধকারে নানা নকশা এঁকে উড়ে বেড়ায় মুঠো মুঠো জোনাকি। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে দূরের আকাশ আর পৃথিবীর মাটি কাছাকাছি এসে মাতৃজঠরের মতো আগলে রাখে মাটির ছেলেমেয়েদের। গোলাপ, হাসুহানা ফুল মিলিয়ে মিশিয়ে চমৎকার দুটো মালা, ফুলের কয়েকটা অলঙ্কার গড়ে রেখেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। বিছানায় বসে সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখে ফুলের ঝুড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল গোরা। প্রচুর ফুল তখনও রয়ে গেছে ঝুড়িতে। তক্তপোশের চারটে পায়ার সঙ্গে কয়েকগাছা রজনীগন্ধা সে সুতো দিয়ে বেঁধে দিল। ঘরের কুলুঙ্গি থেকে লক্ষ্মীর সরা নিয়ে সবরকম ফুল ভরে বিছানার পাশে রাখল। গোটা পল্লী নিঝুম হয়ে গেছে। ফুলের গন্ধে ভুরভুর করছে ঘরের বাতাস। রান্নাঘরে শাশুড়ির সঙ্গে হাঁড়ি-হেসেল গুছিয়ে নিজের ঘরে বিষ্ণুপ্রিয়া ঢুকল এক দণ্ড পরে। বিষ্ণুপ্রিয়া ঘরে ঢুকতে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গোরা বলল, আর একটু দেরি হলে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।

বিষ্ণুপ্রিয়ার বুকের ভেতরটা জুড়িয়ে গেল। বিয়ের পর থেকে তক্তপোশের একধারে শুয়ে যার তিনবছর কেটে গেছে, পাশে স্বামী ঘুমোলেও কখনও যার স্পর্শ পায়নি, সঙ্কীর্তন সেরে মাঝরাতের আগে যে কখনও বিছানায় আসেনি, সমাদর করে সেই মানুষ কাছে ডাকতে খুশিতে বিষ্ণুপ্রিয়া গলে গেল। বিছানায় স্বামীর পাশে এসে বলল, আমি কিন্তু আজ ফুল, চন্দন দিয়ে তোমাকে সাজাব। তুমি রাজি হয়েছিলে।

এখনও আমি রাজি। তোমার সাজানো শেষ হলে আমিও সাজাব তোমাকে। তুমি তখন ‘না’ করতে পারবে না।

মেয়ে সাজানো পুরুষমানুষ কতটা আর জানে, এই ভেবে বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, তাই হবে। তোমার যেমন খুশি তুমি সাজিও আমাকে।

ফুল, চন্দন দিয়ে স্বামীকে সাজাতে শুরু করল বিষ্ণুপ্রিয়া। প্রথমে স্বামীর দু’গালে অলকা-তিলকা এঁকে কপালে চন্দনের কারুকাজ করে মুগ্ধ চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। কাঁটাহীন গোলাপকুঁড়ির সঙ্গে হাস্নুহানার ঝাড় দিয়ে তৈরি মালা স্বামীর গলায় পরিয়ে কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলে জড়িয়ে দিল রজনীগন্ধার মালা। মাথায় ফুলের মুকুট রেখে দু’কানে ঝুলিয়ে দিল রজনীগন্ধা আর রক্তমুখী গাঁদাফুলে তৈরি কুন্তল। সাজানো শেষ করে বিছানা থেকে নেমে পানের বাটা খুলে এক খিলি পান পুরে দিল স্বামীর মুখে। তক্তপোশ থেকে দু’হাত সরে গিয়ে লজ্জা জড়ানো চোখে রূপবান স্বামীর দিকে তাকিয়ে রোমাঞ্চিত হল তার শরীর। স্বামীকে দেখে তার আশ মিটছিলে না। গোরা বলল, এসো, এবার আমার পালা তোমাকে সাজানো।

স্বামীর এত সোহাগ বিষ্ণুপ্রিয়া আগে কখনও পায়নি। মাথায় ঘোমটা সামান্য টেনে বিষ্ণুপ্রিয়া দু’পা এগিয়ে তক্তপোশে স্বামীর সামনে এসে বসল। স্ত্রী-ভূমিকায় বহুবার পৌরাণিক পালাতে অভিনয় করে মেয়ে, পুরুষ, দু’পক্ষকে সাজাতে গোরার মতো রূপসজ্জাকার তখন বিশেষ কেউ ছিল না। ‘লক্ষ্মীকাচ’, ‘দানবিনোদ’ নাটকের খ্যাতিমান রূপসজ্জাকার বাসুদেব আচার্যর কাছে সে তালিম পেয়েছিল। এত খবর বিষ্ণুপ্রিয়া রাখত না। রাখার সুযোগ ছিল না তার। সে টের পাচ্ছিল কয়েকটা আঙুল তার কপালে, মুখে ঘোরাফেরা করে তাকে সাজিয়ে তোলার সঙ্গে তার শরীরে একের পর এক ঢেউ জাগছে। তার কপালে এক ফোঁটা সিঁদুরের টিপ লাগিয়ে চারপাশে গুঁড়িগুড়ি চন্দনবিন্দু দিয়ে কপাল থেকে দু’গাল ধরে মুখের দু’পাশের চিবুক পর্যন্ত ময়ূরের কলাপের মতো কারুকাজ করে নববধূর সৌন্দর্যের মোড়কে বিষ্ণুপ্রিয়াকে ঢেকে দিল। বলল, হাত আয়নায় দেখ, নিজেকে চিনতে পারো কিনা। তোমার ভুবনমোহিনী রূপ দেখে আমারই মাথা ঘুরে যাচ্ছে।

কাঠের পেঁটরা খুলে ছোট একটা আয়না বার করে বিষ্ণুপ্রিয়া প্রথমে সেটা স্বামীর সামনে ধরল। প্রাঞ্জল হাসি মুখে নিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে বিষ্ণুপ্রিয়ার আঁকা অলকা-তিলকার প্রশংসা করল গোরা। বলল, বাহ্, তোফা হয়েছে।

খুশিতে বিভোর বিষ্ণুপ্রিয়া এবার আয়নায় দেখল নিজের মুখ। এত সুন্দরী সে, সত্যি ভুবনমোহিনী, আজ রাতের আগে জানত না। গোরা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁগো, এত সুখ আমার সইবে তো?

এ প্রশ্ন কেন করছ?

বিয়ের রাতে ঘরের চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে আমার বাঁ পা থেকে রক্ত ঝরেছিল, তুমি তো জানো। তুমি নজর করে নিজের ডানপায়ের বুড়ো আঙুল সেখানে চেপে রেখে রক্ত পড়া ঠেকিয়েছিলে, মনে পড়ে?

বিষ্ণুপ্রিয়াকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে গোরা বলল, আছে। সব মনে আছে। সে দুর্ভোগ কেটে গেছে। কৃষ্ণের বরাভয় পেতে চলেছি আমরা।

কীরকম?

কৃষ্ণ আমার বাপ, আমাকে দিয়ে কিছু কাজ সে করিয়ে নিতে চায়, সে ডেকেছে আমাকে।

কী কাজ?

সব বলব।

গোরার বুকের ওপর এলিয়ে পড়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়ার শরীর। গোরার কথা তার কানে ঢুকছিল না। ঘরের মধ্যে রেড়ির তেলের জ্বলন্ত প্রদীপটা থেকে ফুটফাট আওয়াজ বেরোচ্ছে। প্রদীপের তেল কমে এলে এরকম হয়। গোরার বক্ষলগ্না হয়ে তার কথা শোনার চেয়ে তার দু’চোখের মণি থেকে তিনবছরে এই প্রথম উপচে পড়া অন্যরকম চাউনি বিবশ করে দিল বিষ্ণুপ্রিয়াকে স্বামীর কোনও কথা কানে ঢুকছিল না তার। ভালবাসার জোয়ারে ভেসে যেতে দু’চোখ বুজে অপেক্ষা করছিল সে। চোখ খুলে তাকালে দেখছিল তার মুখের সামান্য ওপরে স্বামীর দু’চোখে প্রেমের উচ্ছ্বাস আটকে রয়েছে। সেই উচ্ছ্বাস যে কোনও মুহূর্তে ঢেউ হয়ে ভেঙে পড়তে পারে। স্বামীর চোখে চোখ পড়লে লজ্জায় চোখ বুজিয়ে ফেলছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। কয়েকবার এভাবে লুকোচুরি খেলার মধ্যে হঠাৎ দপ্ করে ঘরের প্রদীপ নিভে গেল। বিষ্ণুপ্রিয়া টের পেল স্বামীর আদরে সে ভেসে চলেছে। ঘন অন্ধকারের মধ্যে তার চোখের সামনে নানা রঙের দীপ জ্বলে উঠে পরের মুহূর্তে নিভে যাচ্ছে। বিছানা জুড়ে ফুলের সুবাস, সুখস্বর্গে সে যেন পৌঁছে গেছে। এর নাম-ই বোধহয়ে ফুলশয্যার রাত। ঘুমে জড়িয়ে আসছে বিষ্ণুপ্রিয়ার দু’চোখ। স্বামীর গলা জড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল, আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাবে না তো?

তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গোরা প্রশ্ন করল, আমাকে তুমি ভুলবে না তো?

—তোমাকে ভোলার শক্তি আমার নেই। আমার বুকের মধ্যে তোমার ছবি সবসময়ে থাকবে।

—আমারও তাই। তোমার ছবি বুকের মধ্যে রেখে আমি ঠাণ্ডা করব আমার প্রাণ।

কথার পিঠে কথা বলে বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছ থেকে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি আদায় করে নিয়ে গোরা সেখানে থামল না। বাপের সঙ্গে ছেলে দেখা করতে গেলে কিছু নিয়ম মেনে যেতে হয়। হাতে কিছু উপঢৌকন নিয়ে যথাযোগ্য বেশে বাপের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, গেরুয়া পোশাক পরে দণ্ড কমণ্ডলু হাতে নিয়ে কৃষ্ণের সামনে দাঁড়ানো হল প্রথা। তারপর সন্তর্পণে প্রায় ঘুমন্ত বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলল, সন্ন্যাস না নিলে কৃষ্ণের কাছে পৌঁছনো যায় না। তুমি কি আমাকে সেভাবে কৃষ্ণের কাছে যেতে দিতে রাজি?

গোরা স্পষ্ট করে সন্ন্যাস নেওয়ার অনুমতি চাওয়ার বদলে একটু ঘুরিয়ে অন্যভাবে কথাটা বলে, স্বামীর আদরে আচ্ছন্ন বিষ্ণুপ্রিয়াকে রাজি করিয়ে ফেলল। আধো ঘুমের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, বাবার কাছে গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে না তো?

—কখনও ভুলব না তোমাকে।

—কবে দেখা হবে?

—কৃষ্ণের নাম নিলেই আমার দেখা পাবে।

স্বামীর সুখের কথা শেষ হওয়ার আগে বিষ্ণুপ্রিয়া অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। সহধর্মিণীর কাছ থেকে সন্ন্যাসে যাওয়ার অনুমতি পেলেও কাজটা আদৌ নিয়মমাফিক হল কি না, এ নিয়ে গোরার মনে খটকা থেকে গেল। রাতের দ্বিতীয় প্রহর শেষ হয়েছে। নিস্তব্ধ রাতে শিয়ালের হাঁকডাক বেড়েছে। ফুলের গয়নাগুলো গোরা এক এক করে শরীর থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখল। রাত শেষ হতে তখনও কয়েক ঘণ্টা বাকি। বিছানায় আধশোয়া গোরা তবু শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘুমনোর কথা ভাবল না। মাথার বালিশটা আলগোছে ঘুমন্ত বিষ্ণুপ্রিয়ার বুকের ওপর এমনভাবে রাখল, যাতে ফাঁকা বিছানাতে সে স্বামীর স্পর্শ পায়। তার পায়ের ওপর থেকে বিষ্ণুপ্রিয়ার বাঁ পা আলতো করে তুলে রাখলে পাশবালিশের ওপর। বিষ্ণুপ্রিয়ার পাশ থেকে সরে এসে ঘাড় হেঁট করে শেষবারের মতো স্ত্রীর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বিছানা থেকে নেমে কিছুক্ষণ আগে বিষ্ণুপ্রিয়ার পছন্দের গরদ, তসরের পোশাক ছেড়ে সাদামাটা ধুতি, চাদর গায়ে জড়িয়ে নিল। কপাল, মুখ থেকে চন্দনের তিলক, টিপ, কারুকার্য মুছে ফেলে নিঃশব্দে দরজা খুলে ঘরের বাইরে এসে, পাল্লা দুটো তেমনই শব্দ না করে বন্ধ করে দিল। বাইরে নিস্তব্ধ, নিশুতি রাত। অন্ধকারে ডুবে আছে বিশ্বচরাচর। গাছ থেকে শিশির পড়ার টুপটুপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দাওয়া থেকে তিনটে সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে দাঁড়িয়ে মায়ের ঘরের দিকে তাকাল গোরা। কপাট বন্ধ করে মা ঘুমোচ্ছে। মায়ের মুখটা ভেবে তার মনের মধ্যে কষ্টের ঢেউ ভেঙে পড়তে থাকল। উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা খুলে বাড়ির বাইরে এসে দরজার পাল্লা দুটো নিঃশব্দে বন্ধ করল। সদর দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াতে মনে হল, বন্ধ পাল্লা দুটো দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে। জন্মভূমি নবদ্বীপ আর গর্ভধারিণী মাকে মনে মনে প্রণাম করে বারকোণা ঘাটের দিকে সে হাঁটতে শুরু করল। রাতের নির্জন ঘাট, ঘাটের প্রতিটা বাঁক, কয়েকটা নৌকো অন্ধকারে ঘুমন্ত ছবির মতো স্থির হয়ে রয়েছে। ঘাটের বাইরে একটা নৌকোর ছাউনির মধ্যে এক কণা আগুনের মতো ধকধক করে জ্বলতে দেখে কেউ তামাক খাচ্ছে বুঝতে গোরার অসুবিধে হল না। মানুষটা যে নিতাই, এক লহমায় বুঝে গেল সে। ছাউনি ছেড়ে নৌকোর ওপরে এসে দাঁড়াল, মুরারি আর চন্দ্রশেখর। হুঁকোর আগুন নিভে গেল। গোরার সামনে নিতাই হুঁকো টানে না। বোধহয় হুঁকোর জ্বলন্ত ছিলিম মাঝির হাতে পাচার করে দিল সে। ধর্ম, জাতপাতের বিচার না করে, মনের মতো যে কোনও মানুষের হাত থেকে হুঁকো নিয়ে সে টানতে বসে যায়। সবটা করে গোরার চোখের আড়ালে। ঘাট ছেড়ে গোরা নৌকোয় ওঠার আগে ছাউনি ছেড়ে পাটাতনে চন্দ্রশেখর, মুরারির পাশে এসে দাঁড়াল নিতাই। গোরাকে বুকে জড়িয়ে ধরল সে। কারও মুখে কথা নেই। মাঝির কাছে গিয়ে তাকে নৌকোর বাঁধন খুলতে বলল মুরারি। মাঝগঙ্গার অন্ধকার আর কুয়াশার মধ্যে নৌকো মিলিয়ে গেছে, পাতলা হয়ে আসা ঘুমের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া টের পেল, বিছানায় গোরা নেই। চমকে জেগে উঠল সে। তার গোটা শরীরে তখনও জড়িয়ে রয়েছে স্বামীর আদর, তাপ, ফুলচন্দনের সুবাস। অন্ধকার ফাঁকা বিছানার কিনারা পর্যন্ত হাত বুলিয়ে স্বামীর ছোঁয়া না পেয়ে দরজার দিকে তাকাল। বন্ধ দরজা। দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে অন্ধকারের রং দেখে বুঝল রাতের শেষ প্রহর। উঠোনের নিমগাছে ভোরের সেই পাখিটা ‘গেরস্থের খোকা হোক’ ডাক শুরু করেছে। বন্ধ দরজা খুলে স্বামী এখনই ঘরে ঢুকবে আশা করে ঘুমজড়ানো চোখে দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অচেনা আতঙ্কে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল বিষ্ণুপ্রিয়া। রাতের সুখস্মৃতির সঙ্গে আধো ঘুমে গোরার সঙ্গে তার কিছু কথা চালাচালি হয়েছিল। কথাগুলো সে মনে করতে চেষ্টা করল। গোরা বলেছিল, তার বাপ কৃষ্ণ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। বাপ, ছেলেতে কিছু কথা আছে। ছেলেকে জরুরি কোনও কাজের দায়িত্ব বাবা দিতে চায়।

স্বপ্নের মতো এত কথার শেষ কথাটা বেশ চেষ্টা করে মনে আনার মুহূর্তে ছলাৎ করে উঠল বিষ্ণুপ্রিয়ার বুকের রক্ত। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করার আগে সন্ন্যাস নেওয়ার বাধ্যবাধকতার কথা জানিয়ে, তার অনুমতি চেয়েছিল গোরা। স্বামী সন্ন্যাসী হতে চায় শুনেও তার সোহাগে আহ্লাদী বউ হয়ে গিয়েছিল সে। সুখের আবেশ আর ঘুমে বিবেচনা হারিয়েছিল। স্বামী যা চেয়েছে, অকাতরে তা তুলে দিয়েছে তাকে। সন্ন্যাসের অনুমতি দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেনি। কী সর্বনাশ সে করে ফেলেছে অনুমান করে আকাশ ফাটিয়ে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করল তার। কান্না গিলে নিয়ে কপাল, মুখে আঁকা অলকা-তিলকা, সিঁদুরের টিপ শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালো করে মুছে নিল। গলার মালা, খোঁপার ফুল খুলে ফুলের ঝুড়িতে রাখল। চোখের জলে তার মুখ, গলা ভেসে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকার তখনও কাটেনি। বিষ্ণুপ্রিয়ার অপরাধী মনে হল নিজেকে। গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছে করল। আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় এলেও বিষ্ণুপ্রিয়া শান্ত করল নিজেকে। কান্নার আওয়াজ চেপে কাঁদতে কাঁদতে শাশুড়ির ঘরের সামনে এসে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিল। ঘুম থেকে একটু আগে জেগে উঠলেও ভোরের আলো ফোটার জন্যে বিছানায় শুয়েছিল শচী। বুকের মধ্যে তার সবসময়ে চাপা ভয়, এই বুঝি মাথায় কোনও দুর্যোগ ভেঙে পড়ল। দরজায় ধাক্কার আওয়াজে ধড়াস্ করে উঠল তার বুক। বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কে গা?

মা ওঠো, মা, আমি তোমার ছেলের বউ।

বিষ্ণুপ্রিয়ার কান্নাভেজা গলা শুনে শচী হাঁসফাঁস করে দরজা খোলার আগে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বউমা, গোরা ভালো আছে তো?

নেই মা, ঘরে নেই।

কোথায় আমার সোনার চাঁদ কোথায়?

শাশুড়ির প্রশ্নের জবাব দেওয়ার বদলে বিষ্ণুপ্রিয়া শুধু ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। মাঘ মাসের রাতের শেষ প্রহরে অন্ধকার তখনও জমাট বেঁধে ছিল। তাড়াতাড়ি একটা প্রদীপ জ্বেলে শচী রান্নাঘর, উঠোন, আঁতুড়ঘর বাড়ির আনাচে কানাচে পাগলের মতো গোরাকে খুঁজে বেড়াতে থাকল। তার গলায় ‘গোরা গোরা’ ডাক। শচীর কাঁপা গলার ডাকে হিমে ভেজা নিস্তব্ধ রাত পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠলেও কেউ সাড়া দিল না। রামচন্দ্রপুরের রাস্তায় তখন সংখ্যায় কম হলেও লোক চলাচল শুরু হয়েছে। সূর্য ওঠার আগে যারা গঙ্গায় চান করতে অভ্যস্ত, বারকোণা ঘাটে চলেছে তারা। তাদের সবাই জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ি চেনে। গোরাকে কেউ কেউ পছন্দ না করলেও মিশ্রপরিবারের গৃহিণী, স্ত্রীলোকে কান্নার আওয়াজ শুনে তাদের কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেল। বাড়ির বন্ধ সদর দরজায় এসে দরজায় টোকা দিল একজন। তার পাশের জন বন্ধ দরজার পাল্লায় চাপ দিতে সেটা খুলে গেল। সদর দরজা খোলা পেয়ে দু’একজন উঠোনে এসে দাঁড়াল। পরিবারের মা, বউকে অন্ধকার দাওয়ায় দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে দেখে বয়স্ক এক পড়শি শচীকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আই?

কান্নাজড়ানো গলায় শচী কী বলল পরিষ্কার বোঝা গেল না। প্রতিবেশী শ্বশুর, ভাসুরদের সামনে মাথার ঘোমটা আরও বেশি করে টেনে দেওয়ার কথা বিষ্ণুপ্রিয়ার খেয়াল নেই। গোরা নাম ধরে শচী ডাকতে শুরু করলে পড়শিরা বুঝল গোরা বাড়িতে নেই। সদর দরজার বন্ধ পাল্লা যার হাতের চাপে খুলে গিয়েছিল, সে জানাল, দরজা খোলা পেয়ে বাড়িতে তারা ঢুকতে পেরেছে। তাদের কথা শচীর কানে ঢুকল না। প্রদীপের আলো হাতে সে বাড়ির সামনে মেঠো পথে এসে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ, সরু গলায় ‘গোরা’ বলে হাঁক ছেড়ে তাড়াতাড়ি ঘাটের পথে পা বাড়াল। শচীর পেছনে ঘোমটা ঢাকা বিষ্ণুপ্রিয়া। কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছে। ছেলের নাম ধরে বারবার ডেকে চলেছে শচী। বিষ্ণুপ্রিয়াকে একবার বলল, ওলো বউ, তুই ডাকছিস না কেন? ডাক, স্বামীকে ডাক

শাশুড়ির কথায় থতমত খেল বিষ্ণুপ্রিয়া। রাস্তায় পাঁচজনের সামনে স্বামীকে কীভাবে ডাকবে, ভেবে পেল না। তার কান্না বেড়ে গেল। ঘাটের পথে শাশুড়ি, বউকে ঘিরে ভিড় বাড়তে থাকল। শ্রীবাসের বাড়িতে রাতভর সঙ্কীর্তন শেষে গোরাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যারা গঙ্গার ঘাটে চানে যায়, তারা ইতিমধ্যে এসে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে শ্রীবাস, গদাধর, জগদানন্দ, হরিদাস, মুকুন্দ ছিল। তারা জানত, গোরা কোথায় গেছে, কেন গেছে। সব জেনেও তারা মুখ খুলল না। শচী, বিষ্ণুপ্রিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে, বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘরে নিয়ে এল শ্রীবাস। পুব আকাশে তখন ভোরের আলো ফুটছে। বাড়ি ছেড়ে গোরার চলে যাওয়ার খবর মুখে মুখে নানা বাখানায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। সুলতানি সেনারা গভীর রাতে গোরাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে, এ গুজবের সঙ্গে গোঁড়া বামুনদের ভাড়াটে খুনীদের হাতে গোরার খুন হওয়ার ঘটনাও হু হু করে রটছিল। দুটো ঘটনা চোখে দেখেছে, এরকম একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী শোনাচ্ছিল, ঘোড়ার পিঠে গোরাকে লোহার শেকল বেঁধে একডালার পথে মাঝরাতে ঝড়ের বেগে ছুটে যেতে দেখেছে চার ঘোড়সওয়ারকে। অন্যরকম দেখেছে আর একদল। তারা দেখেছে, রাতের তৃতীয় প্রহরে মাঝগঙ্গায় নৌকো থেকে গোরার লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার দৃশ্য। অদূরে একটা নৌকোয় তারা ঘাপটি মেরে ছিল। ঘন কুয়াশা থাকায় তাদের নৌকোটা খুনেরা দেখতে পায়নি। খুনেদের নৌকো আর গোরার লাশ, তারা কীভাবে দেখল, এ প্রশ্ন কেউ করল না। গোরার অন্তর্ধানের ঘটনা সাধারণ মানুষের মুখে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে গৌড়ের সুলতানের দরবারে সিন্ধুকী, জাসু, দানিরা পৌঁছে দিল। দরবার থেকে কাজি, মুলুকপতি, তালুকদারদের কাছে গৌড়ের সীমান্ত জুড়ে কড়া নজরদারির হুকুম, গোরা যেন গৌড় ছেড়ে পালাতে না পারে, ঝটিতি চলে গেল। গোরার সঙ্গে তার তিন ঘনিষ্ঠ সঙ্গী, নিতাই, চন্দ্রশেখর, মুরারিও নবদ্বীপ ছেড়ে ভেগেছে, এ খবর জানল শ্রীবাস, গদাধর, জগদানন্দের মতো কয়েকজন বৈষ্ণবভক্ত। তাদের বিশ্বস্ত এক অনুগামী শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্যের কাছে খবরটা পৌঁছে দিল। তিন সঙ্গী নিয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা কোথায় গেছে, তাদের কেউ জানল না। বলায় ভুল হল। গদাধর, জগদানন্দ, মুকুন্দ, হরিদাসের মতো কয়েকজন অন্তরঙ্গের অজানা ছিল না। গোরা চলে যাওয়ার পরের দিন স্ত্রী মালিনী আর সন্তানসম্ভবা নারায়ণীকে নিয়ে কুমারহট্টের বাড়িতে গিয়ে উঠল শ্রীবাস। শ্রীবাসের জন্যে এ নির্দেশ মুকুন্দের কাছে রেখে গিয়েছিল গোরা

গোরার মহানিষ্ক্রমণ নিয়ে নবদ্বীপের নানা মহলে যখন বাকবিতণ্ডার ঝড় উঠছে, আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে কাজির পাইক, পেয়াদারা তল্লাশি চালিয়েছে, হামলা, হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে, আরও বড় উপদ্রব, পাহাড়ের মতো ভেঙে পড়ার সময় নিচ্ছে, তখন কাটোয়ার গঙ্গাতীরে মাঘের শেষ দিনে পুণ্য সংক্রান্তিতে এক বৈষ্ণবসন্ন্যাসীর পাটে অন্য আয়োজন চলেছে। গুরু কেশবভারতীর আখড়ায় গোরাকে সন্ন্যাসের মন্ত্র দেওয়ার আনুষ্ঠানিক আয়োজনে লেগে গেছে আখড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে নিতাই, চন্দ্রশেখর, মুরারি। নতুন গেরুয়া বসন, কৌপীন, কুশাসন, দণ্ড, কমণ্ডলু, তুলসীর মালা কেশবভারতীর আসনের সামনে জমা পড়েছে। কেশবভারতীর পাটে গোরা আর তার সঙ্গীরা দু’দিন গোপনে কাটালেও শেষ পর্যন্ত তা বজায় রাখা সম্ভব হল না। গোরার খোঁজে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ফুলিয়া, কুলীনগ্রাম, কাটোয়া চষে ফেলছিল সুলতানের গুপ্তচরবাহিনীর পাশাপাশি গোঁড়া ব্রাহ্মণদের ভাড়াটে দাঙ্গাবাজরা। গর্ভবতী নারায়ণীকে গায়েব করতে তারা যেমন শ্রীবাসের বাড়িতে হানা দিয়েছিল, তেমনি গোরার খোঁজে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ফুলিয়া, কুলীনগ্রাম, কুলিয়া কাটোয়ার নানা ঠিকানায়, এমনকি অদ্বৈত আচার্য, সপ্তগ্রামের নরহরির বাড়িতে চড়াও হয়েছিল। ফুলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির ঘরে উঁকিঝুঁকি দিতেও কসুর করেনি। পাষণ্ডীরা ভাবছিল, গোরাকে একডালায় ধরে নিয়ে গিয়ে সুলতানের পক্ষে জবাই করা সম্ভব হবে না, নবদ্বীপ ছেড়ে, নতুন ভেল্কি দেখাতে কাছাকাছি কোনও দ্বীপে পোয়াতি, বিধবা নারায়ণীকে নিয়ে গোরা আত্মগোপন করে রয়েছে। বাজিমাত করার মতো চাল দিয়ে গৌড়ের মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেবে। তার শরীরী বিশালতা, অসাধারণ সৌন্দর্য, উজ্জ্বল হাসি, নটবরের মতো হাবভাব, বিনয়, জাতপাত নির্বিশেষে সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরা, সর্বোপরি বুড়ো অদ্বৈত আচার্যের কাছ থেকে কৃষ্ণাবতার উপাধি পাওয়া, তাকে শ্রদ্ধা, খ্যাতির যে উত্তুঙ্গ আসনে বসিয়ে দিয়েছে, নতুন একটা চমক দিয়ে সেই আসনের উচ্চতা হাজারগুণ সে বাড়িয়ে নেবে। তাড়াতাড়ি তাকে খুঁজে বার করে তার সব কেরামতি ঘুচিয়ে দিতে পাষণ্ডীবাহিনী কোমরবেঁধে কাজে নেমে পড়েছিল। তাদেরই এক অনুচর খবর এনেছিল ঊনত্রিশে মাঘ সংক্রান্তির সকালে কাটোয়ায় গঙ্গার ধারে কেশবভারতীর পাটে গোরা সন্ন্যাস নিতে চলেছে।

গোরা এত দুঃসাহসী সঙ্কল্প নিয়ে ঘর ছেড়েছে, পাষণ্ডীরা কল্পনা করতে পারেনি। প্রথমে তারা হতভম্ব হয়ে গেলেও কেশব ভারতীর আখড়ায় ভিড় জমিয়ে গোরার সন্ন্যাগ্রহণের অনুষ্ঠান বানচাল করার চক্রান্ত করল। শাস্ত্রমতে সহায়সম্বলহীন বিধবা মা, যুবতী স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা না করে, তাদের ফেলে চব্বিশ-পঁচিশের এক যুবক সন্ন্যাস নিতে পারে না। সে অধিকার তার নেই। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে অবশ্যই মা, বউ-এর অনুমতি নিতে হবে। মহামুনি মনুর অনুশাসন অনুযায়ী পঞ্চাশবছর বয়স না হলে বাণপ্রস্থে যাওয়ার ছাড়পত্র মেলে না। বাণপ্রস্থে যেতে সন্ন্যাস নেওয়ার দরকার পড়ে না। ব্রহ্মচর্য পালন করে ঈশ্বরের চিন্তায় নিমগ্ন থেকে আশ্রমিক জীবন যাপন করতে হয়, বাণপ্রস্থের পরের অধ্যায় সন্ন্যাসজীবন। পঁচিশবছরের গোরার সন্ন্যাস গ্রহণ যে অশাস্ত্রীয়, প্রতিপক্ষ তা প্রচার করে কেশবভারতীর আশ্রমের সামনে বিস্তর লোক জড়ো করে হল্লা জুড়ে দিল। গঙ্গার ঘাট থেকে চান সেরে গোরা ঢুকল কেশবভারতীর আশ্রমে। ভিজে কাপড়, বিশাল শরীর, জ্যোৎস্নার আলোর মতো গায়ের রং মানুষটার দিকে তাকিয়ে হল্লাবাজরা একটু দমে গেল। তাদের অনেকে গোরাকে আগে দেখেনি। হাজার লক্ষ মানুষের মধ্যে এরকম একজনকে সহজে দেখা যায় না, বুঝতে তাদের অসুবিধে হল না। তাদের হৈচৈ কিছুটা কমে গেল। কেশবভারতীর আসনের সামনে দাঁড়িয়ে গোরা বলল, হে দয়াময়, আপনার চরণে আমি আত্মসমর্পণ করলাম। আপনি আমাকে সন্ন্যাস মন্ত্র দিয়ে এই ভবসাগর থেকে উদ্ধার করুন।

গোরা মতো শিষ্য সহজে মেলে না তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের মুহূর্ত থেকে কেশবভারতী বুঝেছিল। বলল, তুমি বসো, তোমাকে দীক্ষা দেওয়ার কাজ এখনি শুরু করব।

গোরা বসতে তার শরীরের রং, চোখ, নাক, মুখ, চিবুক, হাত পায়ের গড়ন সতৃয় চোখে, খুঁটিয়ে দেখতে থাকল কেশবভারতী। গোরার শরীরে, মনে কোথাও বিন্দুমাত্র কালিমা তার নজরে পড়ল না। আখড়ার সামনে ভিড় বাড়ছে। চব্বিশবছরের এক বিবাহিত যুবককে চেলা বানাতে বাড়ি থেকে ফুঁসলে বার করে এনে এক ভণ্ড সন্ন্যাসী দীক্ষা দিতে চলেছে, স্বার্থান্বেষী মহল থেকে মুখে মুখে কাটোয়ার পথে, পল্লীতে প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল। পাপের পাঁকে ডুবন্ত ধর্মকে বাঁচাতে হেটো, মেঠো লোকেরা দলবেঁধে কেশবভারতীর ডেরার সামনে, মাঠে, সদর রাস্তায় জড়ো হচ্ছিল। গোরার সন্ন্যাসগ্রহণ অনুষ্ঠান ভেস্তে দেওয়ার জন্যে যারা ঘোঁট পাকাচ্ছে, তাদের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিল সেই নিষ্কর্মাদের ভিড়। কেশভ ভারতীকে বেধড়ক ঠেঙানোর কথা দু’একজন ভাবলেও সাহস করে বলতে পারছিল না। সন্ন্যাসী পেটালে ঘরে বাজ পড়তে পারে, ওলাওঠায় মারা যেতে পারে ছেলে, বউ। গোরাকে দীক্ষা না দেওয়ার জন্যে গলা ফাটিয়ে কেশভারতীকে তারা তড়পাতে থাকল। জনতার তর্জন, গর্জনে কেশবভারতী কিছুটা ভয় পেলেও দীক্ষাদানের আসন ছেড়ে প্রবীণ সন্ন্যাসী নড়ল না। গোরাকে মন্ত্র দিতে আগে থেকে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিশ্রুতি ভাঙলে সন্ন্যাসী নামে কলঙ্ক লাগবে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় গোরা বলল, গোসাঞি, আপনি কথা দিয়েছিলেন আমাকে সন্ন্যাসের মন্ত্র দেবেন। দয়া করে এখন কথা রাখুন।

কথা তো আমি রাখতে চাই। কিন্তু এত মানুষের ভিড় করে অন্যরকম বলছে, ঘরে অনাথিনী বিধবা মা, বউকে ফেলে রেখে, তাদের অনুমতি না নিয়ে তুমি সন্ন্যাস নিতে এসেছ, এটা তো বাপু ঠিক নয়। তোমার পরিবারের মাননীয়া সেই দুই স্ত্রীলোকের অনুমতি না পেলে আমি কীভাবে দীক্ষা দেব তোমাকে? আগে সে ব্যবস্থা করো।

গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার অনুষ্ঠানে বাগড়া দিতে, বিশেষ মতলব এঁটে কিছু গোঁড়া বামুন মিলে এই জমায়েত করেছে, অযথা সময় নষ্ট করছে, নিতাই-এর অনুমান করতে অসুবিধে হল না। গোরাকে ধরতে সুলতানি পাইক, বরকন্দাজদের আসার অপেক্ষায় পাষণ্ডীরা হয়তো সময় নিচ্ছে। এমনও হতে পারে, ভাড়াটে খুনীদের দিয়ে কাজ হাসিল করাতে গোরার সন্ন্যাস নেওয়া তারা ঠেকাতে চাইছে। গোরার পক্ষে কথা বলার মতো মানুষের অভাবও সেখানে ছিল না। খণ্ডগ্রাম থেকে নরহরির সঙ্গে যেমন অনেক ভক্ত বৈষ্ণব কেশবভারতীর পাটে এসেছে, তেমনি সরল, নিরীহ স্থানীয় মানুষও সেখানে কম ছিল না। তাদের অনেকে গোরাকে শুধু চিনত বললে, সবটা বলা হয় না, তার অনুরাগী ছিল। নরহরি আর তার সঙ্গীরা চাইছিল গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার পর্বটা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলতে। কিন্তু শাস্ত্রীয় বিধান মেনে মা, বউ-এর অনুমতি নিয়ে গোরা সন্ন্যাস নিতে এসেছে কিনা, তাদের জানা না থাকায়, কেউ মুখ খুলতে পারছিল না। তারা আশা করছিল গোরার সঙ্গীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, তারই মেসো, চন্দ্রশেখর আচার্য, সন্তানতুল্য গোরার সমর্থনে মুখ খুলবে। প্রতিপক্ষে ধমকানিতে চন্দ্রশেখর সম্ভবত ভয় পেয়ে চুপ করে ছিল। চন্দ্রশেখর সামান্য ভয় পেলেও গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার অনুষ্ঠান বানচাল হতে চলেছে টের পেয়ে মনের মধ্যে চাপা খুশিও অনুভব করছিল। সত্যি কথা বলতে কি, গোরা সন্ন্যাস নিয়ে সংসার ছেড়ে চলে যাক, অন্তর থেকে সে চাইছিল না। গোরা শুধু তার শালির ছেলে নয়, জগন্নাথ মিশ্র মারা যাওয়ার পর থেকে গোরাকে পুত্রস্নেহে আগলে রেখেছে সে। শচীর সংসারের দুঃখে সুখে যেমন তার পাশে থেকেছে, তেমনি পিতৃহীন গোরাকে সংসারের শূন্যতা বুঝতে দেয়নি। গোরার স্নেহশীল অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সন্ন্যাস নিয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা চলে গেলে পুত্রবধূ সমেত শচীর সংসার ভেসে যাবে, তার অজানা নয়। গোরা ভক্ত, অনুগামীর দুচার মাস তার মা, বউ-এর ভরণপোষণ জোগালেও কতদিন টানতে পারবে, সন্দেহ আছে। গোরা সন্ন্যাস না নিয়ে চার, ছ’মাস পুরুষোত্তমপুরে থেকে, পরিস্থিতি বুঝে ঘরে ফিরলে তার আপত্তি নেই। নিতাই, মুরারির সঙ্গে তার আসার কারণ আলাদা। সন্ন্যাসের পথ থেকে গোরাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ মিলবে, অনুমান করে তার সঙ্গী হয়েছিল চন্দ্রশেখর। বিধবা শচী তার বড় কুটুম। বড় ছেলে বিশ্বরূপ নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে ছোট ছেলে গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনওরকমে সে বেঁচে আছে। সংসার ছেড়ে গোরা চলে গেলে শচী বাঁচবে না। শচী মারা গেলে ঘরের বউ, বিষ্ণুপ্রিয়ার কী হবে? পঞ্জিকা মতে গোরা সন্ন্যাস মন্ত্র নেওয়ার শুভ প্রহর একদল মানুষের হট্টগোলে ক্রমশ ফুরিয়ে আসতে থাকায় চন্দ্রশেখর খুশি হচ্ছিল। ভিড়ের দিকে দু’হাত জুড়ে তাকিয়ে গোরা বলল, মাননীয়বৃন্দ, বৃন্দাবনের কৃষ্ণ আমাকে ডেকেছে। সন্ন্যাস আমায় নিতেই হবে। আপনারা দয়া করে আমাকে সন্ন্যাস নিতে অনুমতি দিন।

গোরার গলায়, কথা বলার ভঙ্গিতে এত বিনয়, ব্যাকুলতা মিশে ছিল, ভিড়ের একদল গোলমাল থামিয়ে চুপ করে গেল। কেশবভারতীকে তাদের একজন বলল, গুরুগোঁসাই, আপনি চাইলে ওনাকে সন্ন্যাসের মন্ত্র দিতে পারেন।

তখনও যারা গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করছিল, তাদের দু’হাত জুড়ে নমস্কার করে, কেশবভারতীকে শুনিয়ে নিতাই বলল, সন্ন্যাস নিতে যিনি এখানে এসেছেন, তিনি আমার মিতে, আমার প্রাণের বন্ধু। মা, বউ-এর কাছ থেকে তিনি অনুমতি পেয়েছেন। তাঁর পিতৃতুল্য মেসোমশাই, চন্দ্রশেখর আচার্য এখানে রয়েছেন। আমার বন্ধুর সন্ন্যাস গ্রহণে তার মা, বউ-এর যে সম্মতি আছে, আচার্যমশাই তার প্রধান সাক্ষি।

চন্দ্রশেখর আচার্যকে সামনে এনে নিতাই বলল, শুনিয়ে দিন আমার বন্ধুর পরিবারের খবর।

চন্দ্রশেখর যা আশা করছিল, তা ঘটল না। নিতাই-এর ডাকে তাকে বলতে হল, পরিবারের অনুমতি পেয়েই গোরা সন্ন্যাস নিতে এসেছে।

চন্দ্রশেখরের কথাতে নিস্তব্ধ হয়ে গেল মানুষর জটলা। সন্ন্যাস নেওয়ার অনুষ্ঠান বানচাল করতে যারা ঘোঁট পাকাতে এসেছিল, সংখ্যায় অল্প সেই কয়েকজন মানুষ ভিড় থেকে বেরিয়ে গা-ঢাকা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সঙ্গীদের নিয়ে ঘটনার রাশ ধরল খণ্ডগ্রামের নরহরি। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে গোরার মাথা কামানোর জন্যে নিজের পরিবারের ক্ষৌরকার, মধু নাপিতকে নিয়ে এসেছিল। বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর আস্তানায় মানুষের ভিড়, হল্লায় নাপিত ভয় পেয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়েছিল। আশপাশে তাকে দেখতে না পেয়ে তার খোঁজে নরহরি পাঠাল সঙ্গীদের। নাপিতের খোঁজে তারা ছড়িয়ে পড়ার আগেই মধু এসে গেল সেখানে। গোরার সঙ্গে মধু এবং নিজের দলবল নিয়ে গঙ্গায় ডুব দিয়ে এলে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুষ্ঠান শুরু হবে। মধুকে আগেই তার করণীয় কাজের ফিরিস্তি শুনিয়ে রেখেছিল নরহরি। নিরীহ, সরল মধু নাপিত সব জেনেও গোরার সঙ্গে গঙ্গায় চান করতে রাজি হল না। তার অবাধ্যতায় নরহরি রাগল না, অবাক হল না। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, তুই কি আমার বন্ধুর সন্ন্যাস নেওয়া পণ্ড করতে চাস?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মধু বলল, তোমাদের সঙ্গে আমি গঙ্গায় চান করতে রাজি আছি, কিন্তু ওই সৌখিন, ফর্সা মানুষটার বাহারি চুল আমি কামাতে পারব না।

তুই মাথা না মুড়োলে ওর সন্ন্যাস নেওয়া হবে না। সন্ন্যাস মন্ত্র নিয়ে ও গঙ্গায় চান করবে। তুই তো সব জানিস। আমার বন্ধুর মাথা কামাতে তুই রাজি হয়েছিলি। এখন তুই পেছিয়ে

গেলে আমার মান থাকবে না।

আমার ভয় করছে মেজকর্তা!

কেন?

জানি না, তুমি-ই দেখ, আমার গা, হাত কাঁপছে।

নরহরির সঙ্গে মধুর কথা চালাচালি গোরা শুনছিল। তার পিঠে হাত রেখে গোরা বলল, ভাই মধু, তুমি উদ্ধার করো আমাকে।

গোরার হাতের ছোঁয়ায় মধু চমকে উঠল। বলল, তোমার এত সখের চুল, মুড়িয়ে দিতে আমার মন চাইছে না। কোনও অপরাধ লাগবে না তো আমাকে?

না। লাগবে না। সুখে, আনন্দে ভরে উঠবে তোমার সংসার।

মধু আর আপত্তি করল না। গোরার মাথায় খুর চালাতে তার হাত কাঁপলেও ধীরে ধীরে মাথা মুড়নোর কাজ শেষ করল সে। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে গঙ্গার ঘাটে সেই সকালে দ্বিতীয় বার চানে নামল গোরা। তার সন্ন্যাস অনুষ্ঠান দেখতে যারা জড়ো হয়েছিল, তাদের অনেকে পুণ্য অর্জনের আশায় সন্ন্যাসীর সঙ্গে জলে ডুব দিতে ঘাটে নেমে পড়ল। নিতাই, মুরারি, চন্দ্রশেখর, নরহরি আর তার দলবলের সঙ্গে ঘাটের সকলে আকাশ ফাটিয়ে হরিধ্বনি করতে থাকল। অন্যদিনের তুলনায় লম্বা সময় ধরে চান না করে সঙ্গীদের নিয়ে ভিজে কাপড়ে কেশবভারতীর কুটিরের সামনে গোরা ফিরে এল। কেশবভারতী তিন টুকরো গেরুয়া, যার একটা কৌপীন আর একজোড়া খাটো ধুতি তুলে দিল গোরার হাতে। তিন টুকরো গেরুয়া নিয়ে ভক্তিতে আপ্লুত গোরা মাথায় ঠেকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বন্ধুদের বলল, হে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুগণ, মা, বাবা, গুরুজন, তোমরা অনুমতি দিলে পূজ্যপাদ কেশবভারতীর কাছে এখন আমি সন্ন্যাসের মন্ত্র গ্রহণ করতে পারি। তোমাদের আশীর্বাদে বৃন্দাবনে গিয়ে আমি যেন কৃষ্ণ পাই।

মন্ত্রদাতার আসনে কেশবভারতী বসলে তার বাঁ-পাশে গেরুয়া ধুতি, মাথায় গেরুয়া কৌপীন জড়িয়ে কুশাসনে বসল গোরা। সমবেত জনতা নিশ্চুপ। মন্ত্রদানের শুভ মুহূর্ত শেষ হতে খুব বেশি এক দণ্ড দেরি। সকালের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। আনুষ্ঠানিক পূজা, হোম, পূর্বকর্ম সেরে গোরার কানে মুখ রেখে চাপা গলায় কেশবভারতী সন্ন্যাস মন্ত্র ‘ক্লীং কৃষ্ণায় গোবিন্দায় স্বাহা’ উচ্চারণ করে, তার ডান হাঁটুতে বাঁ হাতের পাতা রেখে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করল, আজ থেকে তোমার পূর্বাশ্রমের পরিচয় লুপ্ত হল, সন্ন্যাস জীবনে তোমার নাম পরিচয় হল, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী।

গোরাকে সন্ন্যাসে দীক্ষা দিয়ে ভারতী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। চোখের জল মুছে গোরার হাতে তুলে দিল, সন্ন্যাসীর দণ্ড, কমণ্ডলু, শাস্ত্রমতে এই দুটি ছাড়া সন্ন্যাসীর আর কোনও সম্পত্তি নেই। সম্পত্তি রাখার বিধান নেই। নবদ্বীপ থেকে নিখোঁজ গোরার সন্ন্যাস নেওয়ার খবর গঙ্গার পুব পশ্চিমের গ্রাম, জনপদে ঝড়ের মতো যখন ছড়িয়ে পড়ছে, তার আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহ উৎকল রাজ্য অভিযানে বেরিয়ে পড়েছিল। উৎকল রাজ্যের অন্তর্গত যাজপুর জেলা পর্যন্ত গৌড়ের সীমানা সম্প্রসারণ করার সঙ্গে পুরুষোত্তমপুরে জগন্নাথ মন্দিরের বিপুল সম্পদ হাতানো ছিল তার উৎকলে হানা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য। গৌড় থেকে উৎকলে ঢোকার সবগুলো পথ ধরে বিশ্বস্ত সেনাপতিদের নেতৃত্বে পিলপিল করে সুলতানি সেনারা এসেছে খবর পেয়ে গোরাকে কয়েকদিনের জন্যে পুরুষোত্তমপুরে যাওয়া মুলতুবি রাখতে লোক মারফৎ জানিয়েছিল ফুলিয়ার বিদ্যাবাগীশ। পুরীর বদলে বৃন্দাবনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। বৃন্দাবনে যাওয়ার পথ যে অনেক সুগম, তা নয়, সেখান থেকে অনায়াসে পুরুষোত্তমপুরে চলে যাওয়া যায়। ঘন জঙ্গলে ভরা সেই পথে বন্য জন্তুজানোয়ার, ডাকাতের উপদ্রব থাকলেও সুলতানি সেনাদের খপ্পরে পড়ার ভয় নেই। বৃন্দাবনে যাওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধে হল, সেখানে বেশ কয়েকবছর ধরে সুবুদ্ধি রায় ঘর বেঁধে দিন কাটাচ্ছে। কাশীতে প্রায় সর্বত্যাগীর মতো জীবনযাপন করে বৃন্দাবনে এসে নিষ্ঠাবান বৈয়বের মতো দিনগুজরান করছে সে। বৃন্দাবনে পৌঁছে গোরা অনায়াসে তার আতিথ্য ভিক্ষা করতে পারে। কেশবভারতীর আশ্রয়ে এক রাত কাটিয়ে পুরুষোত্তমপুর বা বৃন্দাবনের পথে না গিয়ে পরের দিন সকালে গোরা ফুলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির বাড়িতে হাজির হল। নিতাইকে সঙ্গে রাখলেও নবদ্বীপের স্বজনদের আপদ বিপদে তাদের পাশে থাকতে মুরারিকে সেখানে পাঠিয়ে দিল। ফুলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির সঙ্গে দুপুর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত নানা বিষয়ে নিতাইকে নিয়ে গোরা যে কথোপকথন চালাল, তার মূলে কৃষ্ণভক্তি, কৃষ্ণপ্রেম থাকলেও আরও যে প্রচ্ছন্ন আখ্যান ছিল, তার শেষকথা হল ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প। বিদ্যাবাচস্পতির সঙ্গে আলোচনার মধ্যে নিতাইকে দেখিয়ে গোরা একবার বলল, এ হবে ধর্মরাজ্যের অধীশ্বর!

নিতাই মুচকি হেসে মন্তব্য করেছিল, ধর্মরাজ্যের রথের সারথি হবে আমার এই বন্ধু, যে কৃষ্ণাবতার, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী।

বিদ্যাবাচস্পতি বলল, তোমাদের মুখের কথাগুলো সত্য হয়ে উঠুক, অন্তর থেকে আমি তা কামনা করি।

বিদ্যাবাচস্পতির বাড়ি থেকে ফুলিয়ায় হরিদাসের কুটিরে উঁকি দিয়ে, তারপর শান্তিপুরে অদ্বৈতের বাড়িতে কয়েকদিন আতিথ্য নিয়ে সে জেনে গেল, তার সন্ন্যাস নেওয়ার ঘটনা গৌড়, রাঢ়, সমতটের জনমানসে প্রেমভক্তির যে জোয়ার তুলেছে, সেই স্রোতে ভেসে গেছে ধর্ম, জাতপাতের বিভাজন, তার নামে প্রচারিত যত অপবাদ, কুৎসা প্রেমভক্তির ঝোড়ো হাওয়ায় খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে, লোকসমাজের চোখে সে ক্রমশ ঈশ্বর হয়ে উঠছে। কেউ বলছে, গোরার আর এক নাম গান, কেউ বলছে শুধু গান নয়, নাচও। কেউ বলছে প্রেমভক্তির নাম গোরা, ভদ্রতা, সৌজন্য, বিনয়, চোখের জলের নাম গোরা। কেউ বলছে ক্ষমতা, কালাকানুন, ঔদ্ধত্য, দম্ভের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নাম গোরা, ঘরে ঘরে রোজ যত শিশু জন্ম নিয়েছ, তাদের সরল, নিষ্পাপ মুখে স্বর্গীয় হাসির নাম গোরা। সত্যনিষ্ঠা, অলোলুপতা, ত্যাগ, অভয়, অদ্রোহ, অহিংসা, নিরহংকার, ক্ষমা, অক্রোধ, সংযম, সত্ত্বসংশুদ্ধির নাম গোরা। সন্ন্যাসী গোরা, যার নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, তাকে দেখতে শান্তিপুরের বাবলা গ্রামে অদ্বৈত আচার্যের বাড়ির দরজায় কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় করতে থাকল। অদ্বৈতের বাড়িতে কয়েকদিনের আতিথ্য চুকিয়ে পুরুষোত্তমপুরের পথে পা বাড়াল গোরা, সন্ন্যাস নেওয়ার পরে যার নাম হয়েছে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। পুরুষোত্তমপুরের পথে গোরার সঙ্গী হল, নিতাই, গদাধর, জগদানন্দ, মুকুন্দ। কৃষ্ণনামের সঙ্গে ভবিষ্যতের এক আবছা কর্মসূচি নিয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে গোরা চলে গেল। কর্মসূচির গোড়াতে থাকল দাক্ষিণাত্য সমেত ভারত পরিক্রমার ছক। পরিক্রমার মধ্যে কোথাও হয়তো দাদা, বিশ্বরূপের দেখা পাওয়া যাবে, এ আশাও তার মাথায় জেগে থাকল। মায়ের সংসারে দাদাকে ফিরিয়ে দেওয়ার হলফ করে সে সন্ন্যাস নেওয়ার অনুমতি পেয়েছে, একথা সে ভুলবে কী করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *