গোরা – ১২

১২

রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠীতে ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষার পাট আপসে চুকে যেতে গোরা মোটেই দমে গেল না। সে যেন জানত, এরকম ঘটবে। রঘুনাথের কাছ থেকে তার বিদায় নেওয়ার ঘটনা, সহপাঠীরা এমনকি গঙ্গাদাস পণ্ডিতকে পর্যন্ত সে জানাল না। রঘুনাথের চতুষ্পাঠীতে তার যাওয়া বন্ধ হয়েছে, নবদ্বীপের কেউ নজর করল না। শচীর কাছেও অজানা থেকে গেল এই ছাড়াছাড়ি। ঘটনাটা গোরা গোপন রাখল। আগের মতো চতুষ্পাঠীতে যাওয়ার নাম করে লেখাপড়ার দপ্তর বগলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে থাকল। বাড়িতে মা, রামচন্দ্রপুরের পাড়াপড়শি জানল রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠীতে যাচ্ছে গোরা। দপ্তর নিয়ে চতুষ্পাঠী যাওয়ার ছুতো করে গোরা ঘুরত গঙ্গার ঘাটে ঘাটে, ম্লেচ্ছ আর শূদ্রপাড়াতে। লম্বা, চওড়া, সুঠাম, সুপুরুষ কিশোর গোরাকে দেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিন্ন নরগোষ্ঠীর বাঙালি সম্প্রদায়ের মনে হত তাদের মধ্যে আকাশ থেকে যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র খসে পড়েছে। পথভোলা এই রূপবান পথিক ঠিকানা গোলমাল করে জগন্নাথ, শচীর সংসারে চলে এসেছে। শরীরের গঠন আলাদা হলেও দুরন্ত এই কিশোরের সহজ, সরল ব্যবহারে আত্মীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমাজের বাইরে যে জনসমাজ অপাংক্তেয় পড়েছিল, তারাও মুগ্ধ হল। গোরার আচরণে কথায় গলে যেত তাদের মন। তারা ভালবেসে ফেলল গোরাকে। তাকে ঘরের লোক ভাবতে শুরু করলেও নিজেদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর সাহস তাদের ছিল না। আমন্ত্রণের পরোয়া না করে গোরা নিজেই চলে আসত নবশাকমহল্লায়, শূদ্রপল্লিতে। সে আসত সমবয়সী বন্ধুদের কাছে, তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে। সবচেয়ে বড় কথা, রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠীতে তার না যাওয়ার কারণ কেউ এখানে জানতে চাইবে না। রঘুনাথ শিরোমণির নাম-ই এ অঞ্চলে কেউ শোনেনি। সে এলে পতিতপাড়ায় আনন্দের লহর উঠত। সব বয়সের মানুষের কাছে সে হয়ে উঠল, সোনার ঠাকুর, ঠাকুর গোরাচাঁদ। গৃহস্থদের কে, কীভাবে গোরাকে সমাদর করবে ভেবে পেত না। ব্রাহ্মণ সন্তানকে ঘরের ভাত খাওয়ানো মহাপাতকের কাজ হবে জেনেও চিঁড়ে, দুধ, দই, মধু, পাটালি, গাছের ফল, ডাব, হাতের কাছে যে যা পেত, গোরার সামনে সসঙ্কোচে সাজিয়ে দিত। নির্বিকারভাবে গোরা খেয়ে নিত খাদ্যসম্ভার। জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামাত না। সমাজের বাইরে অবহেলায় পড়ে থাকা এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে গোরার সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, নানা প্রশ্নে তত কণ্টকিত হচ্ছিল তার মন। তার মতো একই ভাষায় যারা কথা বলে; কলহ করে, গান গায়, নাচে, আমোদ আহ্লাদ করে, তারা কেন সমাজের বাইরে, বিশ্বসংসারের আঁস্তাকুড়ে পড়ে থাকে, জীবন কাটায়, এই প্রশ্ন তার মনে ধন্ধ তৈরি করত। ধাঁধার সমাধান খুঁজে পাচ্ছিল না সে। মৃত্যুর পরে তাদের স্বর্গবাসের ব্যবস্থা পাকা করতে শ্মশান থেকে তাদের হাড়গোড় কুড়িয়ে, ছেলেবেলায় অনেকবার গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছে গোরা। গঙ্গার পবিত্র জলের স্রোতে মৃত ম্লেচ্ছ, শূদ্রের চিতার ছাই, শরীরের অদাহ্য অংশ স্বর্গে পৌঁছে যায়, সে বিশ্বাস করে। বিধর্মীদের কবরের পাশে ছড়ানো হাড়, এমনকি ভাগাড় থেকে মৃত জীবজন্তুদের দেহাংশ তুলে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে। মহাপাপী ছাড়া স্বর্গে যাওয়ার অধিকার জাতিধর্ম নির্বিশেষে যখন সকলের রয়েছে, তখন নেড়ানেড়ি, যবন, কেন সেখানে জায়গা পাবে না? মৃত জন্তু-জানোয়াররাই বা কী এমন দোষ করল, যে তাদের স্বার্গে যাওয়ার পথে কাঁটা পড়বে? দেহত্যাগের পরে স্বর্গে বাস করাতে সকলের সমানাধিকারের ধারণা গোরার মাথায় কীভাবে এল, স্পষ্ট জানা না গেলেও রঘুনাথের কাছে কিছুদিন ন্যায়শাস্ত্রে তালিম নেওয়ার আগেই হয়তো তার মাথায় এই চিন্তা এসেছিল। রঘুনাথের সংস্পর্শে যুক্তিবাদী চিন্তার জল সিঞ্চিত হয়েছিল তার মগজে।

দলিত, পতিতদের সঙ্গে গোরার সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, নতুন নতুন প্রশ্ন জাগছিল তার মনে। এত পরিশ্রমী, এত বলবান, সাহসী, পরোপকারী, হাজার অভাব-অনটন, কষ্টের মধ্যে হাসিখুশি, উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত এই মানুষদের কেন অস্পৃশ্য নাম দিয়ে দূরে ঠেলে রাখা হয়? এরা নিরক্ষর, এক ছত্র সংস্কৃত জানে না, সবচেয়ে বড় কথা লোকগুলো হাভাতে, খেতে পায় না, গরীবের চেয়ে গরীব, তাই কি এরা সমাজের তলানি, ব্রাক্ষ্মণপাড়ার পথ সামনে অবরুদ্ধ? দু’চারজন সেবক, ভৃত্য বাদ দিয়ে এদের সেই পথ, ব্যবহারের করার অধিকার নেই? সব প্রশ্নের জবাব বালক গোরা মনের ভেতর থেকে না পেলেও মাথার মধ্যে প্রশ্নগুলো জেগে থাকে, খোঁচায়। ম্লেচ্ছপাড়ায় তার যাতায়াত বেড়ে গেল। সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে ডাংগুলি, কবাড্ডী, গাদি খেলার সঙ্গে নাচগানের আসরে বসে যেতে তার আটকাল না। নতুন যে খেলা শুরু হল, তার নাম অভিনয়। নবদ্বীপের গাঁ-গঞ্জে সারা বছর মনসার পালা, মঙ্গলচণ্ডীর গীত, যাত্রা, ভাঁড়যাত্রা, তর্জার অনুষ্ঠান লেগে থাকত। বেশির ভাগ আসরের উদ্যোক্তা ছিল বিত্তবান নবশাক সম্প্রদায়। ভোগবিলাসে মত্ত, সম্পন্ন কায়স্থরাও হাত মেলাত তাদের সঙ্গে। জমিদারদের বেশিরভাগ ছিল কায়স্থ। সুলতানি দরবারে তাদের কেউ চাকরি করত। উঠতি ধনী নবশাকদের বিশেষ করে সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তিলি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের বিত্ত প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা চলত। বৈষয়িক কারণে দু’পক্ষই ছিল ধর্মভীরু। পূজার্চনা করত আরও বেশি সমৃদ্ধি, বিলাসব্যসনের ক্ষমতা অর্জনের জন্যে। দেবদ্বিজে ভক্তির কারণও ছিল তাই। ধর্মের আধ্যাত্মিক ভিত্তি নিয়ে তারা মাথা ঘামাত না। দার্শনিক বিষয়সমূহ ছিল তাদের বুদ্ধির অগম্য। সমাজের ওপরতলা থেকে আভূমি ছড়িয়ে পড়েছিল অর্থলিপ্সা, ভোগশক্তি। যাত্রাপালার মাঝখানে ব্যাধ কালকেতুর বউ ফুল্লরা, মৃত লখিন্দরের সদ্যবিধবা সহধর্মিণী বেহুলাকে এনে শুরু হয়ে যেত খেউড়। পাঁচ স্বামী বেষ্টিত মহাভারতের দ্রৌপদীকে আসরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে যে সব কেচ্ছাকাহিনী উগরে দেওয়া শুরু হত, সেখান থেকে সম্ভবত ‘ভাঁড়যাত্রা’ নামে নতুন আঙ্গিকের জন্ম হয়।

ঝাড়বাতিতে আলোকিত আসরে সমাসীন বিত্তবান উদ্যোক্তাদের চোখের আড়ালে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়ানো ম্লেচ্ছ, শূদ্র শ্রোতারা এই সব অনুষ্ঠান দেখে আহ্লাদে ফেটে পড়ত। বাড়িতে মা, বাবার চোখে ধুলো দিয়ে যাত্রা, তর্জার আসরে গোরাও মাঝে মাঝে এসে বসত। মা, বাবা ঘুমিয়ে পড়লে, তখন আসত গোরা। দাদা বিশ্বরূপ সব জেনেও গোরাকে আটকাতে পারত না। চোখের মণির চেয়ে ছোটভাইকে বেশি ভালবাসতো বিশ্বরূপ। স্নেহে অন্ধ ছিল সে। মনসার ভাসান, মঙ্গলচণ্ডীর গীত, যাত্রা, ভাঁড়যাত্রার আসরে অন্ধকার রাতে শিশু গোরাকে একা যেতে দেওয়া, বিশ্বরূপ চিন্তা করতে পারত না। গোরার হাত ধরে তাকে সুরক্ষা দিতে তার সঙ্গী হত। রাত শেষ হওয়ার আগে ভাইকে নিয়ে বিশ্বরূপ ফিরে আসত বাড়িতে। নিঃশব্দে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে দু’ভাই বেলা পর্যন্ত ঘুমতো। বিশ্বরূপ নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে গোরাকে ঠেকানোর কেউ থাকল না। ঘুমন্ত মায়ের পাশ থেকে উঠে যাত্রার আসরে চলে যেত সে। শচী আগে থেকে জেনেও মুখ বুজে থাকত। রগচটা স্বামীর ক্রোধ থেকে গোরাকে বাঁচাতে তার নৈশ অভিযানের বৃত্তান্ত জগন্নাথের কাছে ভাঙত না। নবদ্বীপের ব্রাহ্মণপাড়ার ছেলেরা এসব আসরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারত না। শূদ্র, ম্লেচ্ছদের ছোঁয়া বাঁচাতে অভিভাবকদের মতো তারা শশব্যস্ত ছিল। সবচেয়ে বড় ছিল সুলতানি হুকুমনামার ভয়! গানবাজনা নিষিদ্ধ করে সুলতানি ফরমান জারি হওয়ার পর থেকে ধর্মনাশের ভয়ে ব্রাহ্মণমহল্লা থেকে সবরকম গান অন্তর্হিত হয়েছিল। গুনগুন করে সুর ভাঁজতেও ভয় পেত তারা। গভীর রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে সামান্য যে কয়েকজন বৈষ্ণবভক্ত কাঁপা গলায় সঙ্কীর্তন করত, তাদের ভীত সন্ত্রস্ত ভঙ্গী দেখে, বালক বয়সে গোরা অবাক হলেও বয়স একটু বাড়লে তাদের ঘৃণা করতে শুরু করল। বৈষ্ণবদের বেশির ভাগ শ্রীহট্টিয় ব্রাক্ষ্মণ হওয়াতে এবং তাদের সঙ্গে লতায়পাতায় পারিবারিক সম্পর্ক থাকাতে, মনের ঘৃণা বাইরে উগরে দিতে না পারলেও কাপুরুষ বৈষ্ণবদের সঙ্গে পথেঘাটে দেখা হলে গোরা এমন ঠাট্টামস্করা করত সে সম্মান বাঁচাতে ছাপোষা বিষ্ণুভক্তরা দৌড় লাগাত। যথার্থ ধার্মিক কখনও কাপুরুষ হয় না, বালক বয়স থেকে গোরার মনে এ বিশ্বাস ঢুকে গিয়েছিল। ঈশ্বরে যাদের অটল ভক্তি, ঈশ্বর তাদের সহায়, রক্ষাকর্তা। তারা কেন ভয় পাবে? বিশেষ করে তার পিতৃভূমি শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে বাস করতে আসা ব্রাহ্মণদের ভীরুতা যন্ত্রণা দিত তাকে। দল বেঁধে বুক ফুলিয়ে পথে ঘুরে ঘুরে সঙ্কীর্তন গাওয়ার স্বপ্ন দেখত সে। শুধু ভক্তিরসের গান কেন, প্রেম, প্রীতি ভালবাসার গানে কম ছিল না তার অনুরাগ। সুর, সংগীত কখনও শৃঙ্খলিত থাকতে পারে না। বালক গোরার মনে এমন বিশ্বাস অস্পষ্টভাবে জাগলেও তা প্রকাশ করার মতো তার মুখের ভাষা তখনও তৈরি হয়নি। মনের ভেতরে সে গুমরোতো। হাতের কাছে বৈষ্ণবদের পেলে তাদের যৎকিঞ্চিৎ সাহসী করে তুলতে এমন ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করত, যে প্রায়ই দু’পক্ষে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম হত। গোরার মনে যন্ত্রণা হত, রাগ হত, অবসাদে ব্যাজার হয়ে থাকত কয়েকদিন, তারপর ফের খোঁচা দিয়ে তাতিয়ে তুলত আত্মীয়, পড়শি, বৈষ্ণব মানুষজনকে। ম্লেচ্ছ, শূদ্রপাড়াতে যাতায়াত বাড়ানোর পর থেকে গোরার উল্টো অভিজ্ঞতা হল। নবশাকপল্লীতে ডোম, চণ্ডাল, চামার, মেথর সমাজে ভাতের অভাব থাকলেও প্রাণের খুশিতে তারা যখন তখন গান গেয়ে উঠতে পারে, সেই প্রথম গোরা জানল। কান পেতে সে শুনত অন্ত্যজ সমাজের গান। ভক্তিভাবের গান কিছু থাকলেও অধিকাংশ ঘরোয়া জীবনের গান, লোকসঙ্গীত। লোকসঙ্গীতের নায়িকা, রসের বিনোদিনী, নায়ক পীরিতের নাগর, তাদের মেলামেশাতে উপচে পড়ে খুশির ঢেউ। সুর, তালেও কত রঙ্গ, কী বিপুল মজা! সুলতানি নিষেধের ফরমান ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে এরা বুক চিতিয়ে যে কোনও মুহূর্তে গায়কবাহিনী নিয়ে পথে নেমে পড়তে পারে, গোরা বুঝে গেল। গানের ওপর সুলতানি নিষেধাজ্ঞা জারির খবর তাদের কানে পৌঁছোয়নি, তারা শোনেনি। শুনলেও তোয়াক্কা করত না। গোরা ঢুকে গেল অন্ত্যজপল্লীর বন্ধুদের সঙ্গে তাদের হেঁসেলে, ভাঁড়ারে, গানে, অভিনয়ে। মানিনি নায়িকার ভূমিকায় বালক অভিনেতার অভিনয় দেখে অস্পৃশ্যপাড়ার বউ, মেয়েরা পর্যন্ত কখনও অবাক হত, কখনও হেসে গড়িয়ে পড়ত। নায়িকার রূপসজ্জায় অসাধারণ সুপুরুষ গোরার চালচলন, হাত, পায়ের হিল্লোলিত ভঙ্গি, দু’চোখের দৃষ্টি, হাসি, লাস্য, কটাক্ষ দেখে তাকে পরমাসুন্দরী দেবকন্যা ছাড়া দর্শকদের আর কিছু মনে হত না। গলায় সুর, সহজাত অভিনয় প্রতিভা নিয়ে ব্রাত্যপল্লীর সববয়সী স্ত্রী-পুরুষের মন গোরা যখন জয় করে নিচ্ছে, তখন ব্রাহ্মণপাড়ার ন্যায়শাস্ত্রী, স্মার্তরা ঘোঁট পাকাচ্ছিল প্রতিবেশী বৈষ্ণবদের বিরুদ্ধে। বৈষ্ণবমণ্ডলীর প্রমুখ, শ্রীনিবাস পণ্ডিতের বাড়িতে আগুন দিয়ে সপরিবার পণ্ডিতকে কিছুদিনের জন্যে বাস্তুচ্যুত করে তারা থামল না। চন্দ্রশেখর আচার্য, নন্দন আচার্য, শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারীর বাড়িতে আগুন দেওয়ার ছক করার সঙ্গে বৈষ্ণবদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত কড়া ব্যবস্থা নিতে গণস্বাক্ষর করা একাধিক আর্জি, সুলতান হুসেন শাহের দরবারে পেশ করল স্মার্ত, নৈয়ায়িক পণ্ডিতরা। সুলতানের কাছে আর্জিতে তারা জানাল, চাট, জট নট ভট প্রব্রজিত রঙ্গবতারী (অর্থাৎ অভিনেতা) ও রাজকাজে বিঘ্নসৃষ্টিকারী বৈষ্ণবরা, সারা রাত ঘরের দরজা বন্ধ করে নাচ, গানের মধ্যে দিয়ে যে মোহজাল বিস্তার করছে, তা শুধু মহান সুলতানি শাসনের শত্রুতা নয়, নবদ্বীপের মতো জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রের পক্ষেও বিঘাতকারী। নাচ, গান, অভিনয়ের ছুতো করে তারা ভদ্রপল্লীতে চোর, বেশ্যা, অভিনেতা, পাগল, এমনকি চামার, ধোপা, ডোম, জেলে, কামার, এমতি শূদ্রদের নিয়ে শাস্ত্রীয় নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে রভসকর্মে মত্ত হয়ে থাকছে। নৃত্য ও সঙ্গীত সম্পর্কে সুলতানি নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তারা এমন অদ্রোহী নজির খাড়া করছে, যা অদূর ভবিষ্যতে সৈয়দ হোসেন আলা আল দুনিয়া ওয়াল দীন আবুল মুজফ্‌ফর হোসেন শাহের ছত্রছায়ায় আশ্রিত গৌড়বঙ্গে ঘোর নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে।

দুর্দান্ত পাণ্ডিত্য সহকারে মুসাবিদা করা পাষণ্ডীদের (স্মার্ত, নৈয়ায়িকদের বৈষ্ণবরা ‘পাষণ্ডী’ বলত) পাঠানো একের পর এক আর্জি সুলতানের দরবারে পৌঁছোলেও, সেগুলির যথাযথ বয়ান হোসেন শাহের কর্ণগোচর হত না। পাষণ্ডীদের পাঠানো আবেদনপত্রগুলি ‘হরিবংশ’, ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’, ‘মনুসংহিতা’, ‘যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা’ ইত্যাদি নানা শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করা হত। সুলতানের দরবারে যত আবেদন, নিবেদন, চিঠিপত্র আসত, সেগুলো প্রথমে জমা পড়ত শাহী মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের প্রধানমন্ত্রী আর উপপ্রধানমন্ত্রী ছিল দু’ভাই, তাদের নাম—সনাতন আর রূপ। সুলতানি দরবারে তাদের পরিচয় ছিল সাকর মল্লিক, দবীর খাস। দু’ভাইকে সুলতান হোসেন শাহ এই সাম্মানিক পদে নিয়োগ করেছিল। গৌড়ের অনতিদূরে মাধাইপুরের বিখ্যাত পণ্ডিত, কুমার দেবরায়ের যে তিন ছেলে—অমর, সন্তোষ, বল্লভ ভূমিষ্ঠ হয়, সাধকজীবনে তারা সনাতন, রূপ, অনুপম নামে পরিচিত হয়েছিল। তাদের নামান্তর ঘটিয়েছিল গোরা, সে দশ বছর পরের কাহিনী।

বৈষ্ণবদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করলেও বৈষুববিরোধী পাষণ্ডীদের সঙ্গে গোরার সম্পর্ক ছিল না। তরুণ বয়সের আবেগ, উচ্ছ্বাসে ভেসে বেড়ানোর দিনে বারকোণা ঘাটে তার নজরে পড়েছিল লক্ষ্মীকে। গোরার মনে হয়েছিল, তার সামনে সদ্য স্নান সেরে, সিক্তবসনা রাধা এলোকেশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সকালের তাজা আলোয় প্রতিবেশী বল্লভাচার্যের অতি চেনা মেয়েকে তার মনে হয়েছিল শূদ্রপল্লীর যোগিপাড়ায় শোনা গোপীচন্দ্রের গানের দুই নায়িকার চেয়ে বেশি রূপবতী। লক্ষ্মীর রূপে সতেরো বছরের গোরার চোখ ঝলসে গিয়েছিল। অনিন্দ্যসুন্দর, দেবোপম, শরীর গোরাকে দেখে তেরো বছরের লক্ষ্মীর কি বুকের মধ্যে ঢেউ ওঠেনি? উঠেছিল, গগনচুম্বী, বিপুল ঢেউ। গোরার নজরে পড়ার আগে থেকে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল লক্ষ্মী। মনের আকুলতা প্রকাশের সুযোগ সে যুগে মেয়েদের ছিল না। চব্বিশ ঘণ্টা সে শুধু অনুভব করত, দেহের ভেতরে উথালপাথাল চলেছে, আনচান করছে মন। লক্ষ্মীর চাউনি দেখে গোরা বুঝে গিয়েছিল তার বধূ হওয়ার জন্যে এ মেয়েকে বল্লভাচার্যের ঘরে বিধাতা পাঠিয়েছে। মেয়েদের স্নানের ঘাটে যাতায়াত বাড়িয়ে দিল সে। তবে ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে পাঁচ বছর বয়স থেকে গঙ্গার ঘাটে যত দৌরাত্ম্য করত, বয়স বাড়তে তা কমে গিয়ে ঘাটগুলোতে দলবল নিয়ে সকাল-সন্ধে আড্ডা মারার বহরও খাটো হচ্ছিল। তবে আগের মতো ঠোঁটকাটা রয়ে গেল। বালকের মতো এমন কিছু উপদ্রব করত, যা অসভ্যতার নামান্তর। পথে, দোকানবাজার, গঙ্গার ঘাটে বৈষুবদের ‘হিজড়ে’ বলে বিদ্রূপ করত। বাবা, জগন্নাথ মিশ্রের বন্ধু, পরম বৈষ্ণব শ্রীনিবাস পণ্ডিত পর্যন্ত রাস্তায় দূর থেকে গোরাকে আসতে দেখলে ভয়ে অন্য দিকে হাঁটা দিত। ছেলেবেলায়, পাঁচ-ছ’বছর বয়সে স্নানের ঘাটে মুখের জল কুলকুচো করে তর্পণরত ব্রাহ্মণদের গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে, ঘাটের সিঁড়িতে রাখা তাদের নারায়ণ শিলা, ভাঁজ করা ধুতি-চাদর-খড়ম, আচমনের কোসাকুসি নিয়ে সে পালাত। বেশি দূরে না গিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে ভিজে পোশাক, হিলহিলে ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপতে থাকা ব্রাহ্মণদের ভেংচি কেটে বলত, আমিই নারায়ণ, আমিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, তাদের নাম করে গঙ্গায় ভাসাতে ডাব, কলা, খাজা, গজা, সন্দেশ যা এনেছো, আমাকে দাও। আমার কথা না শুনলে ভিজে কাপড়ে বাড়ি ফিরতে হবে তোমাদের। দেবতাদের ক্রোধে ভারি রকম ব্যাধিতে পড়বে। আমি ছাড়া তোমাদের কেউ বাঁচাতে পারবে না।

জগন্নাথ মিশ্রের শিশুসন্তানের কথা শুনে রাগে শরীর রি-রি করলেও ধর্মভীরু ব্রাক্ষ্মণরা কম ভয় পেত না। দেবতাদের জন্যে আনা অর্ঘ্য গোরার হাতে তুলে দিত। বয়স একটু বাড়লে গোরার নজর পড়ল বারকোণা ঘাটের স্নানার্থিনীদের ওপর। বৈশাখ মাস জুড়ে বালিকাদের মধ্যে শিবপুজোর ধুম পড়ে যেত। মাটির শিব গড়ে পুজোর উপচার নিয়ে নানা বয়সের অনুঢ়া বালিকারা গঙ্গার ঘাটে পুজোয় এলে তাদের কারও কাঁসার থালায় সাজানো ফুলের মালা তুলে নিয়ে নিজের গলায় পরে, কারও বাটি বোঝাই শিশিরে গোলা চন্দন নিজের সারা গায়ে মেখে বলত, আমি হলাম পরম পুরুষপ্রকৃতি। শিব, মহেশ্বর, কালী, দুর্গা আর সব দেবদেবীরা আমার দাসদাসী, তোমাদের উচিত ষোড়শোপচারে আমাকে পুজো করা।

আট, দশ বছরের অনিন্দ্যসুন্দর গোরার কথা শুনে কচি মেয়েগুলো ভয়ে গুটিয়ে গেলেও বিশ্বাস অবিশ্বাসে মেশা সলজ্জ চোখে মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিত। রূপবান বালকটিকে আরও একবার দেখতে ইচ্ছে করলেও সঙ্কোচে ঘাড় তুলতে পারত না। কথা হারিয়ে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকত। মেয়েদের মধ্যে যাদের সাহস একটু বেশি, জগন্নাথ মিশ্রের ছেলেকে চেনে, শচীকে ডাকে খুড়িমা বলে, তাদের ভেতর থেকে দু’একজন বলত, গোরা, তুমি তো খুড়িমার ছেলে, গ্রাম সম্পর্কে আমাদের ভাই, আমরা তোমার বোন, এসব কথা বোনদের বলতে নেই। নিজেকে ‘ভগবান’ বলে প্রচার করাও পাপ।

বুদ্ধিমান গোরা তখনই কথা ঘুরিয়ে বলত, আমি বর দিলাম, তোমরা সুপুরুষ স্বামী পাবে, সাতটা করে ছেলে মেয়ে হবে, সংসারের মুখ উজ্জ্বল করবে তারা।

গোরার বর পেয়ে তারা মুখে বিরক্তির ভাব প্রকাশ করলেও কয়েকজনের জ্বলজ্বলে চোখ দেখে তারা যে কি খুশি হয়েছে, বোঝা যেত। তাদের থালায় সাজানো নৈবেদ্যের ফলমূল, ততক্ষণে গোরার জিম্মায় এসে যেত। নৈবেদ্য নিয়ে যে মেয়েরা পালাত, তাদের হাঁক পেড়ে গোরা বলত, শোনরে কিপ্টে মেয়ে, আমাকে নৈবেদ্য না দিয়ে পালানোর জন্যে বুড়ো স্বামী নিয়ে তোকে ঘর করতে হবে। কোলে সন্তান আসবে কিনা সন্দেহ!

দেবপুত্রের মতো সুন্দর বালকের কথা শুনে দু’একজন পলাতকা ভয় পেয়ে নৈবেদ্যর থালা নিয়ে ফিরে আসত। খুশি মনে থালার ফল-মিষ্টির সদ্ব্যবহার করত গোরা। আশীর্বচন শোনাত পলাতকাকে।

বিত্তবান জমিদার বুদ্ধিমন্ত খানের মুখ থেকে জগন্নাথ মিশ্রের বন্ধু মুকুন্দসঞ্জয় জেনেছিল, রঘুনাথের চতুষ্পাঠীর সঙ্গে গোরার সম্পর্ক চুকে গেলেও খবরটা পাঁচকান হয়নি। মৃত জগন্নাথের বিধবা স্ত্রী শচী পর্যন্ত জানে না। গোরার উচ্চশিক্ষার জন্যে রাজকীয় জলপানির ব্যবস্থা করে তাকে হাত ধরে রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠীতে যে পৌঁছে দিয়েছিল, সেই গঙ্গাদাস পণ্ডিতের কানে পর্যন্ত গুরু-শিষ্যে যোগাযোগ শেষ হওয়ার খবর পৌঁছোয়নি। দু’জনের ছাড়াছাড়ির সঠিক কারণ মুকুন্দসঞ্জয় না জানলেও রঘুনাথ শিরোমণির কাছ থেকে কায়স্থ জমিদার, বুদ্ধিমন্ত খাঁ-এর মারফত সে এমন এক বার্তা পায়, যা তাকে সাতিশয় বিস্মিত করেছিল। রঘুনাথের মতো দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত যে চতুষ্পাঠী পালানো ছাত্র গোরার পরম হিতৈষী বুঝতে অসুবিধে হয়নি। বুদ্ধিমন্তর কাছে গোরার পাণ্ডিত্যের অশেষ গুণগান করে তার জন্যে একটি চতুষ্পাঠী খোলার ব্যবস্থা করে দিতে রঘুনাথ অনুরোধ করে তাকে। বুদ্ধিমন্ত শুধু জমিদার নয়, নবদ্বীপের বিদ্বজন সমাজের এক মাথা। ব্রাক্ষ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যদের নিয়ে নতুন ‘ব্রাবৈকা’ সংস্কৃতি (ব্রাহ্মণের ‘ব্রা’, বৈদ্যের ‘বৈ’, কায়স্থের ‘কা’, ব্রা+বৈ+কা= ‘ব্রাবৈকা’) গড়ে তোলার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে বাঙালির সামাজিক কাঠামোকে শক্তপোক্ত করে গড়ে তুলতে অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছে। হেলাফেলা করার মতো মানুষ সে নয়। গোরাকে চতুষ্পাঠী খোলার জন্যে বাল্যবন্ধু মুকুন্দসঞ্জয়কে তার বাড়ির বারমহলের দাওয়া ব্যবহার করতে দেওয়ার অনুরোধ বুদ্ধিমন্ত জানাতে আনন্দের সঙ্গে মুকুন্দসঞ্জয় রাজি হয়ে গেল। মুকুন্দসঞ্জয়ের রাজি হওয়ার আরও একটা কারণ, গোরার চতুষ্পাঠী খোলার জন্যে রামচন্দ্রপুরবাসী বাল্যবন্ধু মুকুন্দসঞ্জয়ের ভদ্রাসন ব্যবহার করা সম্ভব কিনা, এমন প্রশ্ন বুদ্ধিমন্তকে রঘুনাথ করেছিল। ছেলেবেলার বন্ধুকে বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত রঘুনাথ মনে রেখেছে এটা কম কথা নয়। আত্মগরিমার চাপে অভিভূত মুকুন্দসঞ্জয় তখনই গোরার চতুষ্পাঠী খোলার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। বন্ধু, বুদ্ধিমন্তের কাছে শুধু একটা অনুরোধ রাখে। চতুষ্পাঠী চালু হলে তার ভদ্রাসনে রঘুনাথ শিরোমণিকে বুদ্ধিমন্ত যেন একবার নিয়ে আসে। মহাপণ্ডিত রঘুনাথের পদধূলিতে তার বাড়ি পবিত্র হওয়ার সঙ্গে তার পরিবারের সামাজিক মর্যাদাও বেড়ে যাবে। মুকুন্দসঞ্জয়কে বুদ্ধিমন্ত সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে জানায়, সতেরো বছরের গোরা এমন এক ব্যাকরণশাস্ত্র লিখেছে, যা নিয়ে নবদ্বীপের পণ্ডিতকুল গর্ব বোধ করবে। গোরার চতুষ্পাঠীর সুবাদে মুকুন্দসঞ্জয়ের ভদ্রাসনের ঠিকানা ইতিহাসের খাতায় চিরকালের মতো লেখা হয়ে যাবে। অল্প সময়ের জন্যে গোরা ছাত্র হলেও তার চতুষ্পাঠী পরিদর্শন করতে রঘুনাথ শিরোমণি যে স্বেচ্ছায় একদিন আসবে, এ নিয়ে বুদ্ধিমন্তের সন্দেহ ছিল না। তার মুখে কথাটা শুনে আহ্লাদে বিগলিত হয়েছিল মুকুন্দসঞ্জয়।

বাড়ির সদর দরজার পাশে বৈঠকখানা ঘরটা গোরার চতুষ্পাঠীর জন্যে সে ছেড়ে দিল। প্রথম যে পাঁচজন ছাত্র নিয়ে চতুষ্পাঠীর দ্বারোদ্ঘাটন হল, তাদের জোগাড় করে আনল বুদ্ধিমন্ত খাঁ। মুকুন্দসঞ্জয়, বুদ্ধিমন্ত খাঁ, দুজনেই ছিল বিশ্বরূপের বন্ধু, অদ্বৈত আচার্যের টোলে সহপাঠী ছিল তিনজন। পরে তারা গোরার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। পক্ষকালের মধ্যে পাঁচ থেকে বেড়ে বারো হল চতুষ্পাঠীর ছাত্র সংখ্যা। চতুষ্পাঠী খুলে গোরার অধ্যাপনা করার খবর সেই প্রথম শচী জানল। অর্থ উপার্জনে ছেলের মন হয়েছে শুনে শচী খুশি হলেও রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠী ছেড়ে, লেখাপড়ার পাট শিকেয় তুলে গোরা যে দীর্ঘদিন ভবঘুরের মতো জীবন কাটাচ্ছিল এ খবরও তার কানে গেল। মর্মাহত হল সে। গোরাকে নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ফিসফাস কিছু কথা সে শুনছিল। ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো সে সব কথা। রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠী ছেড়ে দিয়ে গোরা নাকি সারাদিন টংটং করে ঘুরে বেড়ায়। ঘোরার জায়গাটাও বলার মতো নয়। ম্লেচ্ছপল্লী, শূদ্রপাড়াতে তাকে বেশি দেখা যায়। অজাত কুজাতের ছেলেদের সঙ্গে তার মেলামেশা, ওঠাবসা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের সঙ্গে খোশগল্প করে কাটানোর সঙ্গে তাদের নিয়ে গোরা নাকি নাচ, গান করে, নিজে মেয়ে সেজে নাটক করে, বাগজীবন (পেশাদার গল্প বলিয়ে) করে। তাদের দেওয়া অন্নজল খায়, আরও কত অনাচার করে, তার হিসেব নেই। বাতাসে ভেসে আসা সেসব খবর কানে এলেও শচী মনে রাখে না। ইচ্ছে করে ভুলে যায়। ভুলে গিয়ে শান্তি পায়। গঙ্গাদাস পণ্ডিতকে তদ্বির করে, রাজার কোষাগার থেকে জলপানির ব্যবস্থা করে রঘুনাথ শিরোমণির কাছে যে ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্যে পাঠিয়েছিল, লেখাপড়া শেষ করে যার সংসারে সচ্ছলতা আনার অপেক্ষায় দিন গুনছে, সেই ছেলে বখে যেতে পারে, শচীর কল্পনাতে আসেনি। নানা গুজব শুনলেও সন্দেহ করেনি, প্রশ্ন করেনি গোরাকে। প্ৰশ্ন করতে সাহস পায়নি। ডানপিটে গোরাকে নিয়ে তার মনে ভয় আছে। মায়ের কথা শুনে, দাদা বিশ্বরূপের মতো হুট করে সংসার ছেড়ে গোরা চলে গেলে, সে সাতদিনও বাঁচবে না। বুক ধড়ফড় করে মারা যাবে।

বুদ্ধিমন্তর মুখ থেকে মুকুন্দসঞ্জয়ের বৈঠকখানার ঘরে গোরার চতুষ্পাঠী চালু হয়েছে এবং গোরা সেখানে অধ্যাপনা করছে শুনে শচী আনন্দে অভিভূত হলেও তার মনের গভীরে কোথাও ঈষৎ শূন্যতা জেগে থাকল। গোরাকে বংশের মুখ উজ্জ্বলকারী পণ্ডিত বানাতে চেয়েছিল সে। সেই তাগিদে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে শত অভাব, দারিদ্র্যের মধ্যেও সংসারের জোয়াল টানতে ক্লান্ত হয়নি, উদ্যম হারায়নি। রঘুনাথের চতুষ্পাঠীর শিক্ষা শেষ না করে গোরা নিজে চতুষ্পাঠী খুলে বসতে বাহ্যত খুশি হলেও শচীর মনে কিঞ্চিৎ হতাশা ঢুকে থাকল। গোরাকে যথার্থ বিদ্বান বানাতে না পারার জন্যে মৃদু পরাজয়বোধ! পাশাপাশি গজিয়ে উঠল নতুন সংশয়। প্রবল মাতৃভক্তি থাকলেও ভবঘুরে স্বভাবের গোরা, কতদিন চতুষ্পাঠী চালাবে, নিয়ম মেনে, সময় করে ছাত্রদের লেখাপড়া শেখাবে, ভেবে শচী কুল পেল না। তবে শচীর এই বিষাদ দীর্ঘস্থায়ী হল না। গোরাকে দেখলেই মায়ের চোখ দুটো জুড়িয়ে যায়, বুক ভরে ওঠে। এমন সন্তান গর্ভে ধারণ করলে সব হতাশা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়, শচী অনুভব করে। আপাতত সংসারে কিছু দিন ভাত কাপড়ের চিন্তা থাকবে না। পাঁচজনের দয়ার ওপর নির্ভর করে সংসার চালানোর পর্ব এবার বুঝি শেষ হল। সকলের আগে গোরাকে সংসারী করা দরকার। মায়ের মন যেমন হয়, শচীর মনের মধ্যেও তাই ঘটল। গোরার যোগ্য, ফুটফুটে বালিকা বধূর তল্লাশে তার মাথার মধ্যে জেগে উঠতে থাকল নানা চেনা মেয়ের মুখ। গোরার পাশে মানাবে, এমন মেয়ে খুঁজে বার করা কি সহজ কাজ? অনতিদূরের সুখের দিনগুলোর কথা কল্পনা করে আর্দ্র হতে থাকল শচীর হৃদয়।

.

চতুষ্পাঠী খোলার পর থেকে গোরার দৌরাত্ম্য কিছুটা কমলেও তার স্বভাবের বিশেষ হেরফের ঘটল না। আগের মতো ঠোঁটকাটা, চপল থেকে গেল। সাতসকালে চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা শুরু করে, দুপুরের আগে কাজ শেষ করে, গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে আসে। পুরুষদের স্নানের ঘাট, ‘আপন ঘাটে’ যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে মেয়েদের ঘাট, ‘বারকোণা ঘাটে’ কলাটা, সন্দেশটা খাওয়ার সুযোগ ঘটতে পারে জেনে ঢুঁ দেয়। প্রায়ই সে সুযোগ ঘটে। আপন ঘাটে যাওয়ার আগে সেই দুপুরে বারকোণা ঘাটের চাতালে পা রেখে সামান্য এগোতে যে মেয়েটিকে তার চোখে পড়ল, এমন পরমা সুন্দরী কন্যা আগে সে দেখেনি। নবদ্বীপে এমন সুন্দরী মেয়ে থাকতে পারে, তার ধারণা ছিল না। প্রথম দর্শনে তাকে চেনা মনে হলেও কোথায় দেখেছে মনে করতে কয়েক মুহূর্ত লাগল। হ্যাঁ, যথাযথভাবে মেয়েটির মুখ মনে করতে পারল। মেয়েটিকে তার ছেলেবেলায় মায়ের কোলে দেখেছে, তার দেখায় ভুল নেই। সিক্তবসনা তরুণীটি সেই লক্ষ্মী। কোথায় ছিল লক্ষ্মী এতদিন? বাড়িতে ছিল নিশ্চয়। সুদরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ, বল্লভাচার্যের মেয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় গিয়ে-ই বা থাকবে? দেববালার মতো রূপসী, ব্রাহ্মণপল্লীর এই মেয়ে, যে পাশের পাড়ায় বাস করে, তাকে কেন আগে নজর করেনি, ভেবে সে অবাক হল। মুহূর্তের বিস্ময় কাটিয়ে প্রকৃত ঘটনা হৃদয়ঙ্গম করতে তার অসুবিধে হল না। স্নানের ঘাটে, মিঠেকড়া টিকাটিপ্পনি কেটে মেয়েদের পুজোর অর্ঘ্য থেকে যতই ফলমিষ্টি উদরস্থ করুক, মেয়েদের সঙ্গে মজা করতে, তাদের চটিয়ে দিতে নির্লজ্জের মতো বিয়ের প্রস্তাব দিক, পল্লীর পথে, প্রাঙ্গণে কোনও মেয়ের দিকে, উপনয়নের পর থেকে কখনও চোখ তুলে তাকানোর ঘটনা সে মনে করতে পারল না। উপনয়ন অনুষ্ঠান হয়েছে, সে-ও প্রায় সাত বছর আগে!

গোরা দেখল, মা পাশে থাকলেও লক্ষ্মী প্রথমে আড়চোখে, পরে সরাসরি তার দিকে তাকাল। কয়েক পলকের জন্যে দু’জোড়া চোখের দৃষ্টি জড়িয়ে যেতে খুশির বিদ্যুৎ খেলে গেল গোরার শরীরে। সতেরো বছরের তরুণ তখনই জেনে গেল বল্লভাচার্যের এই মেয়েটি তার সহধর্মিণী হওয়ার জন্যে নির্ধারিত। অন্য সংসারে এর যাওয়ার উপায় নেই। লক্ষ্মীকে সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে রেখে কাঁসার ঘড়ায় গঙ্গাজল ভরতে কয়েক ধাপ নেমে গেছে তার মা। গোরা দেখল, লোকলজ্জা ভুলে ডাগর চোখে তার দিকে লক্ষ্মী তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখের পাতা কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে, বুকের ভেতর কথার স্রোত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বেরনোর পথ না পেলে শরীর জুড়ে যত লক্ষণ সচকিত হয়, সব ঘটে চলেছে। দু’জনের ফের চোখাচোখি হতে লক্ষ্মী অবনত করল আরক্তিম মুখ। তার স্নানের ঘাটের সখীদের দু’একজন অদূরে দাঁড়িয়ে হৃদয় বিনিময়ের এই খেলা দেখে নিজেদের মধ্যে সন্তর্পণে গা টেপাটেপি করছিল। লক্ষ্মীর লম্বা, কালো, নিবিড় এলোচুলের ডগা থেকে একাধিক ধারায় জলের স্রোত নেমে পরের পর সিঁড়িতে আলপনা এঁকে গঙ্গায় ফিরে চলেছে। গোরার চোখের জাদুতে ঘাড় হেঁট করে লক্ষ্মী বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে আবার চোখ তুলে তাকাল। দু’জোড়া চোখ মিলল, দু’জোড়া ঠোটের কম্পন বাতাসে মিশে ছুঁয়ে ফেলল দু’জনকে। বারকোণা ঘাটে নানা বয়সি মেয়েদের ভিড়। মা, মাসি, পিসিদের সঙ্গে থাকে পরিবারের কুমারী মেয়েরা। বয়স্ক পুরুষরা এই সময়ে সাধারণত এ ঘাটে না এলেও সদ্য গোঁফ গজানো দু’একজন তরুণ দুষ্টুমি করতে কখনও সখনও হাজির হয়। তাদের একজন গোরা। তার দুষ্টুমিতে মেয়েরা উত্ত্যক্ত হলেও গোরা যে ‘মেয়েধরা’ নয়, তারা জানে। দেবতাকে উৎসর্গের ভোগ কেড়ে খেলেও উৎসর্গকারিণীকে পাত্তা দেয় না, অল্পস্বল্প জ্বালাতন করে। দু’একজন মেয়ে ভয় পেয়ে বাড়িতে নালিশ করলেও বেশিরভাগ মেয়ে গোরার দুষ্টুমি উপভোগ করে। চোখের আঠায় জড়িয়ে গেলেও ঘাটের সিঁড়ি আটকে দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ গোরা আর লক্ষ্মীর তখন ছিল না। কয়েকটা সিঁড়ি নেমে গিয়ে গোরা দেখল, ভিজে শাড়ি জড়ানো, আঁটোসাঁটো ছিপছিপে শরীর, বাঁশির মতো নাক, পটলচেরা চোখ, পিঠ ছাপানো ভিজে চুল, যা শুকিয়ে গেলে মেঘের মতো ফেঁপে উঠবে। রামচন্দ্রপুরের পাশের গ্রাম, তেঘরির বল্লভাচার্যের এই মেয়েকে কবে শেষবার দেখেছে, গোরা মনে করতে চাইল। তার চোখের আড়ালে লক্ষ্মী রূপবতী হয়ে উঠেছে। তাকে দেখে লক্ষ্মীও বিবশ হয়েছে, সে আঁচ করতে পারল। তাকে দেখে নবদ্বীপের বেশিরভাগ তরুণীর যে এই দশা হয়, গোরা জানত না। লক্ষ্মী যে অনেক আগে থেকে তাকে নজর করছে, এ তথ্যও তার অজানা ছিল। জেনেছিল লক্ষ্মীকে বিয়ে করার পরে। লক্ষ্মী নিজেই বলেছিল।

মোটামুটি হিসেব করে লক্ষ্মীর স্নানের সময়ে বারকোণা ঘাটে প্রায় নিয়মিত আসতে থাকল গোরা। বিশেষ তিথি, ব্রতের দিনগুলোতে মায়ের সঙ্গে লক্ষ্মী গঙ্গার ঘাটে এলেও বেশিরভাগ দিনে স্নান করতে পাড়ার সমবয়সি মেয়েদের সঙ্গিনী হত। তাদের চোখের সামনে দু’জনের মন দেওয়া নেওয়ার ঘটনাটা পেকে উঠতে মেয়েমহলে খবরটা কানাকানি হয়ে গেল। শচীও শুনল। পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে তখন অনুঢ়া মেয়েদের শিবপুজো চলছিল। নরম মাটির শিবপুত্তলিকা গড়ে, তাকে পুজো করে, সেই পুত্তলিকার সঙ্গে পুজোর ফুল, বেলপাতা, যৎসামান্য অর্ঘ্য, গঙ্গায় ভাসাতে মাঝ আকাশে সূর্য পৌঁছানোর আগে ঝাঁক বেঁধে মেয়েরা ঘাটে আসছিল। রোজের স্নানার্থিনীদের সঙ্গে বালিকা পূজারিণীর ভিড় জমে যাচ্ছিল ঘাটে। মেয়েলি ভিড়ের অদূরে মাঝে মাঝে নটবর বেশে এসে দাঁড়াত গোরা। ‘নটবর’ অর্থে তখন বোঝাত লম্পটশ্রেষ্ঠ। অভিনেতা, বিশেষ করে স্ত্রী চরিত্রাভিনেতা, মেয়েলি স্বভাবের পুরুষকে ‘নটবর’ নামে চিহ্নিত করার রেওয়াজ ছিল। নটবরের মতো সাজসজ্জা করা পুরুষকে ঘৃণা করত মধ্যবিত্ত সমাজ। বসন্ত ঋতুর শুরুতে এক দুপুরে অগ্নিবর্ণ পুরুষের মতো রূপবান গোরাকে দেখে লক্ষ্মীর শুধু মাথা ঘুরে যায়নি, গোটা বৈশাখ মাস ধরে মনের মধ্যে গোরার মুখ ধরে রেখে সে শিবপুজো করেছে। শিবের কাছে ক্রমাগত প্রার্থনা করেছে, হে মহেশ্বর, হে নীলকণ্ঠ বুড়োশিব, হে ভোলানাথ, আমার প্রার্থনা পূরণ করো। গোরাকে স্বামী হিসেবে আমি পেতে চাই। ব্রাহ্মণের দুঃখী মেয়েটিকে তুমি বাঁচাও, তার প্রার্থনা মেটাও।

তখনই এক দুপুরে শিবের জন্যে সাজানো নৈবেদ্য গঙ্গার জলে ভাসানোর আগে সামনে হাঁটু জলে দু’হাত পেতে দাঁড়ানো গোরাকে দেখে লক্ষ্মী চমকে উঠল। দু’পাশে, পেছনে কিলবিল করছে ব্রাহ্মণপল্লীর মেয়েরা। তাদের ওপর মা, মাসি, পিসিরা নজর রাখছে। তাদের সকলের চোখের সামনে শিবের জন্যে উৎসর্গিত নৈবেদ্য অসংকোচে গোরার হাতে তুলে দিয়ে দু’হাত জুড়ে তাকে নমস্কার করল লক্ষ্মী। গোরা জানত, তাকে ভালবেসে, প্রেমসাগরে তেরো বছরের লক্ষ্মী হাবুডুবু খাচ্ছে। সব জেনেও তাকে খোঁচা দিতে গোরা বলল, সোহহং, আমি-ই সে। আমি শিব, আমি নীলকণ্ঠ মহেশ্বর, আবার আমিই সৃষ্টি করেছি তাদের। তোমার অর্ঘ্য নিলাম, তুমি যা চাইছ, তা পাবে।

নটবরের মতো সুসজ্জিত গোরার মুখে কৌতুক মেশানো এক চিলতে হাসি। গোরার কথা শুনে ঠোঁট টিপে লক্ষ্মী হাসলেও বলতে পারল না, অনেকদিন ধরে নবদ্বীপচন্দ্র গোরাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার প্রার্থনা সে করে চলেছে। বৈশাখের শুভ মধ্যাহ্নে গোরার কাছ থেকে সুস্পষ্ট সঙ্কেত পাওয়ার পর থেকে তার বাঁ চোখের পাতা নাচতে শুরু করল। মেয়েদের বাঁ চোখের পাতা নাচলে তার সৌভাগ্যের শুরু হয়, লক্ষ্মী জানে। মা, মাসিদের মুখ থেকে এ তত্ত্ব সে অনেকবার শুনেছে। ছেলেদের উল্টো হয়। সৌভাগ্য আসার আগে তাদের ডান চোখ নাচতে থাকে। গোরার ডান চোখ না নাচলেও লক্ষ্মীকে বিয়ে করার ইচ্ছে ক্রমশ বাড়তে থাকল। পাড়ার ঘটক, বনমালি আচার্যের বাড়িতে এক সকালে হাজির হয়ে, তাকে একান্তে ডেকে, বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীর সঙ্গে নিজের বিয়েতে ঘটকালি করার জন্যে নানাভাবে ভজিয়ে রাজি করাল। জগন্নাথ মিশ্রের বড় ছেলে বিশ্বরূপের বিয়ের ঘটকালি করেছিল বনমালি। সে বিয়ে হয়নি। বিয়ের আগে বাড়ি ছেড়ে বিশ্বরূপ নিরুদ্দেশ হতে বনমালি ফাঁপরে পড়লেও জগন্নাথ মিশ্র এমন সাহ্মণ ছিল যে ঘটকের গায়ে ছিটেফোঁটা কলঙ্ক লাগেনি। জগন্নাথ মিশ্ৰ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তার পরিবারের সুযশ এখনও অটুট আছে। জগন্নাথের ছেলে অসাধারণ রূপবান, চতুষ্পাঠীর নবীন পণ্ডিত, গোরার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে এক কথায় দরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ বল্লভাচার্য রাজি হয়ে যাবে, এ নিয়ে বনমালির সন্দেহ ছিল না। বনমালিকে সাধ্যমতো ঘটক বিদায়ের প্রণামি দিতে কার্পণ্য করবে না বল্লভাচার্য। গোরার মতো জামাই পেলে বল্লভাচার্য বর্তে যাবে। সবার আগে গোরার মা শচীর সঙ্গে এক দফা কথা বলে নিতে বনমালি দেরি করল না। সেই বিকেলে চুনট করা ধুতি, গরদের অঙ্গবস্ত্রে শরীর মুড়ে বনমালি পৌঁছে গেল শচীর কাছে। দু’চার কথা ধানাই-পানাই করে বলার পরে আসল কথা, অর্থাৎ বল্লভাচার্যের সুন্দরীতমা মেয়ের জন্যে গোরা যে সবচেয়ে উপযুক্ত পাত্র, অথবা গোরার মতো অসাধারণ ছেলের বিয়ে দিতে হলে বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মী ছাড়া আর কাউকে বিবেচনা করা যায় না, এ যে রাজযোটক, খোলসা করে জানিয়ে দিয়ে বল্লভাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে শচীর অনুমতি চাইল বনমালি। গোরার জন্যে উপযুক্ত মেয়ে, চেনাজানা মহলে কেউ আছে কি না, স্মৃতি হাতড়ে শচী খুঁজে চললেও বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীর নাম শুনে মুখে কোনও অভিব্যক্তি প্রকাশ না করে সে আঁতকে উঠল। সুন্দরী মেয়েকে পুত্রবধূ করতে চাইলেও আগুনের মতো এমন মেয়েকে ছেলের বউ করে আনলে সংসার যে সুখের হয় না, মা, ঠাকুমার মুখ থেকে একথা শচী কতবার শুনেছে, তার হিসেব নেই। মা, ঠাকুমা আবার শুনেছে তাদের মা, ঠাকুমার মুখ থেকে। জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো কাঞ্জনবর্ণা মেয়েকে ঘরে বধূ হিসেবে এনে কত সংসার যে ছারখার হয়ে গেছে, সে তালিকা পুরজনদের কণ্ঠস্থ।

বল্লভ আচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীর নাম শুনে শচী দমে গেলেও বনমালি ঘটক পেছিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়, সে বলল, লক্ষ্মী যতই অগ্নিরূপিণী হোক, আকাশ ভাসানো বিদ্যুতের আলোর মতো দীপ্তিমান গোরার পাশে সে কিছু নয়। জ্বলন্ত চুলোর পাশে পাটকাঠির আলো। গোরার রূপের পাশে স্বর্গের অপ্সরীরা পর্যন্ত লেজ গুটিয়ে পালানোর পথ পাবে না। গোরাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলতে শচীকে নরম করতে বনমালি যৎপরোনাস্তি চেষ্টা চালালেও শচীকে বাগে আনতে পারল না।

মোক্ষম যুক্তিটা শচী দিল আলোচনার শেষ পর্যায়ে। বলল, গোরা সদ্য চতুষ্পাঠী খুললেও কী এমন অর্থোপার্জন করবে, যা দিয়ে সংসার চলবে, বউকে খাওয়াতে পারবে? আমার উপোস করার অভ্যেস আছে। আমাকে ভরণপোষণ জোগানোর চিন্তা করতে হবে না। হালচাল বুঝতে তার আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করা উচিত।

বনমালির প্রস্তাব এক কথায় শচী যখন নাকচ করে দিল, তখন শেষ বসন্তের বিকেলে ফুরফুর করে হাওয়া বইছিল। কৃষ্ণচূড়ার রক্তাভ ফুলের গুচ্ছে কালো শরীর ঢেকে ডাকছিল একটা কোকিল। কোকিলার সাড়া পেতে ক্রমাগত তীব্র হচ্ছিল তার কুহুধ্বনি। বনমালিকে প্ৰায় ধুলোপায়ে বিদায় করে দিয়ে শচীর মনে হল, কাজটা কি ঠিক করল? বিয়েতে অরাজি হওয়ার কথা বনমালির কাছ থেকে গোরার কানে পৌঁছোলে সে কী করবে? চিন্তাটা মাথায় আসতে ভয়ে শচীর বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠল। গোরা যেমন সরল, ততটাই রাগি, একই সঙ্গে সমান দুরন্ত আর অভিমানী। মায়ের ওপর অভিমানে যেদিকে দু’চোখ যায়, চলে যেতে পারে। শচী টের পেল, ছেলের বিয়ের কথা উঠতে তার মাতৃত্বের অভিমানে ঘা লেগেছে। সব মায়ের এরকম হয়। ঘরে বউ এলে, মায়ের পেটের সন্তান যে গর্ভধারিণীর কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তা কোন্ মা না জানে? তবু ছেলের বিয়ের আয়োজন মাকে করতে হয়, পরের বাড়ির মেয়েকে সদর দরজা থেকে বরণ করে নিতে হয় পুত্রবধূ হিসেবে। সবচেয়ে বড় কথা, বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীকে সহধর্মিণী করে গোরা ঘরে তুলতে চাইলে, তাকে ঠেকানো মুশকিল। ঠেকাবে-ই বা কেন? আগুনের শিখার মতো লক্ষ্মী সুন্দরী হলেও তার চেয়ে গোরা বেশি অগ্নিবর্ণ, বিদ্যুতের ধারালো, স্থির আলোর ঝলকের মতো রূপবান। লক্ষ্মীর পাশে গোরা থাকলে আগে গোরাকে দেখবে সবাই, তারপর লক্ষ্মীকে নজর করবে। লক্ষ্মী যতই রূপসী হোক, গোরার আলোয় ঢাকা পড়ে যাবে। সংসারে অভাবের কথা শুনিয়ে ঘটক বনমালিকে প্রায় ধমক দিয়ে বিদায় করা উচিত হয়নি। দুটো বাতাসা, এক ঘটি জল খাওয়ানো উচিত ছিল। বনমালিকে দেখলে শচীর মনের মধ্যে পুরনো এক ক্ষতে যন্ত্রণা শুরু হয়। মানুষটার মুখোমুখি সহজে সে হতে চায় না। বিশ্বরূপের বিয়ের ঘটকালি করেছিল বনমালি। বিয়ের কয়েকদিন আগে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল বিশ্বরূপ। তাকে বিয়ের জন্যে চাপাচাপি না করলে সে হয়তো সংসার ছেড়ে যেত না। বিয়েতে তার কেন ভয় ধরে গিয়েছিল, শচী জানে না। ছোটভাই, গোরার জন্যে অনেকদিন ধরে যত্ন করে বিশ্বরূপের লেখা পুঁথিতে হয়তো এমন কিছু ছিল, যা পড়ে জগন্নাথ মিশ্র তাড়াতাড়ি বড় ছেলের বিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পুঁথিটা জগন্নাথ মিশ্র পুড়িয়ে না ফেললে গোরা পড়ার সুযোগ পেত। তার পড়ার জন্যে লেখা পুঁথি, যথাসময়ে তার হাতে তুলে দিতে মায়ের তোরঙ্গে রেখে দিয়েছিল। পুঁথিটা গোরাকে দেওয়ার দায়িত্বও চাপিয়েছিল মায়ের ওপর। তোরঙ্গ খুলে জমির দাখিলা, পরচা খুঁজতে গিয়ে জগন্নাথের হাতে পুঁথি চলে যাবে শচী ভাবেনি। রুগ্ণ শরীরে সেই পুঁথি পড়ে জগন্নাথ খেপে গিয়ে পুঁথিটা পুড়িয়ে ফেলে। জগন্নাথের মতো মানুষকে ক্রোধে এমন চণ্ডমূর্তি হতে দেখে শচী কথা হারিয়ে ফেলেছিল। আরও বেশি অসুস্থ হয়ে জগন্নাথ বিছানা নিলেও বিশ্বরূপকে সংসারী করতে তার জন্যে পাত্রী খুঁজতে লাগিয়ে দিয়েছিল বনমালিকে। পছন্দের মেয়ে পেতে অসুবিধে হয়নি। পুত্রবধূকে সংসারে এনে, তার তত্ত্বাবধানে বিশ্বরূপকে গার্হস্থ্য জীবনে বেঁধে ফেলতে জগন্নাথ যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা সফল হল না। মাঝখান থেকে বিশ্বরূপ ঘর ছাড়ল। বনমালিকে দেখলেই সেই দুঃখের দিনের দমবন্ধ করা স্মৃতিগুলো শচীর মাথার মধ্যে জেগে ওঠে। তার কষ্ট হয়। ফের একটা অমঙ্গল ঘটতে চলেছে ভেবে সে ভয় পায়। গোরার বিয়ের ঘটকালি করতে বনমালি এসেছে শুনে শচী আতঙ্কিত হয়েছিল। অতিথিপরায়ণ, সুভদ্র মিশ্রপরিবারের গৃহকর্ত্রী হয়েও বনমালিকে সমাদর করতে পারেনি।

গোরার বিয়ে নিয়ে সাতপাঁচ ভেবে শচী যখন অথৈ চিন্তায় ভাসছে, বাড়ি থেকে সামান্য দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় বনমালির জন্যে গোরা অপেক্ষা করছিল। মাঝরাত থেকে যে কোকিলটা গাছের ডগায় বসে ডাকতে শুরু করে, তখনও ডেকে চলেছিল। গোরা ভাবছিল, ফি বছর ফাল্গুন মাস শুরু হওয়ার দু’তিনদিন আগে থেকে পাখিটার কানে কে ডেকে ওঠার মন্ত্র পাঠায়? কৃষ্ণচূড়ার শরীরে এত লাল রং কে মাখিয়ে দিল? প্রকৃতির ভেতর লুকিয়ে থাকা সেই জাদুকরের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে তার কাছ থেকে কী চাইবে সে? গ্রীষ্মের বিকেলে নাতিউয় ফুরফুরে হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই জাদুকরের মূর্তি কল্পনা করে গোরার বুকের ভেতর আনচান করতে থাকল। তখনই বাড়ির সদর দরজা খুলে বনমালিকে বেরোতে দেখে, কী ঘটেছে, গোরার বুঝতে অসুবিধে হল না। বনমালি যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের বাড়িতে ঢুকেছিল, তা সফল হয়নি। ঘটকের সঙ্গে ছেলের বিয়ে নিয়ে কোনও মায়ের আলোচনা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় না। এক কথা থেকে সাত কথা, বল্লভাচার্যের মেয়ে, লক্ষ্মীর রূপগুণের বর্ণনা থেকে চেনাজানা আরও দশ জন সুপাত্রীর প্রসঙ্গ এসে গেলে কথকতা গড়াতে থাকবে গল্পসমুদ্রের দিকে। কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় কমবেশি ঘণ্টাখানেক বনমালির প্রতীক্ষায় থাকতে মনে মনে গোরা তৈরি ছিল। সিকি দণ্ডের মধ্যে বাড়ি থেকে বনমালি বেরিয়ে আসতে সে যে কার্যোদ্ধার করতে পারেনি, গোরা বুঝে গিয়েছিল।

গোরার সামনে এসে শুকনো মুখে যা ঘটেছে, বনমালি জানাল। সদ্য প্রতিষ্ঠিত গোরার চতুষ্পাঠী থেকে সংসার প্রতিপালনের মতো উপার্জন গোরা না করা পর্যন্ত ছেলের বিয়ে দিতে শচী রাজি নয়। বনমালির কাছ থেকে মায়ের অভিমত শুনে গোরা দমল না। সে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। শচীকে রাজি করানোর হাজার এক উপায় সে জানে। বনমালিকে আশ্বস্ত করে, পরের দিন সকালে তাকে ফের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করল। তার অনুরোধ ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এক কথায় রাজি হয়ে গেল বনমালি। গোরার বিয়ের ঘটকালি করতে শচীর সঙ্গে দেখা করে আনুষ্ঠানিক দু’চার কথা বললেও বনমালি জানায়নি, তাকে গোরা পাঠিয়েছে। ঘটকঠাকুরকে তেমনই নির্দেশ দিয়েছিল গোরা। কার পরামর্শে বনমালি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, শচীও জানতে চায়নি। শচী সম্ভবত ভেবেছিল, মেয়ে লক্ষ্মীকে পাত্রস্থ করতে বল্লভাচার্য পাঠিয়েছ বনমালিকে। সেটাই স্বাভাবিক। অল্পক্ষণের মধ্যে গোরা বাড়ি ফিরে ঘরের সামনে দাওয়ায় বসে দুটো বাতাসা, এক ঘটি জল খেয়ে সামনে দাঁড়ানো মাকে বলল, পথে বনমালি ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হল।

বনমালি কী বলল, শচী জানতে চাইলে গোরা বলল, শুকনো মুখে শোনাল, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।

গোরা থেমে যেতে শচী জিজ্ঞেস করল, আর কিছু বলেছে?

এক মুহূর্ত নীরব থেকে গোরা বলল, দুঃখী মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। আমি আর খোঁচাইনি। বুঝে গিয়েছিলাম, তোমার সঙ্গে দেখা করে তার ইচ্ছেপূরণ হয়নি। হতাশ হয়ে সে ফিরে যাচ্ছে। জলের খালি ঘটি হাতে নিয়ে নিস্তব্ধ মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গোরা বলল, ঘটকঠাকুরের মুখে হাসি ফোটাতে তার কথা মেনে নিলে ভালো করতে।

বুদ্ধিমান ছেলের মনের কথা টের পেতে শচীর অসুবিধে হল না। পরের দিন সকালে বনমালি আসতে তাকে সমাদর করে দাওয়ায় বসিয়ে নাড়ু, জল খেতে দিয়ে নিজে থেকে গোরার বিয়ের কথা পেড়ে বনমালিকে পাত্রী খুঁজতে বলল শচী। সাতদিনের মধ্যে বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীর সঙ্গে গোরার বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়ে গেল। গ্রহ, নক্ষত্রের সবচেয়ে শুভ অবস্থান বিচার করে এই কঠিন কাজ সম্পাদন করে দিল, বেলপুখুরিয়ার বাসিন্দা, গোরার দাদামশাই, জ্যোতিষার্ণব, মহাপণ্ডিত নীলাম্বর চক্রবর্তী। লক্ষ্মীকে ঘরের বধূ করতে চেয়ে বনমালির সূত্রে পাঠানো শচীর প্রস্তাবে আনন্দে আত্মহারা হল বল্লভাচার্য আর তার স্ত্রী। শচী যেভাবে লক্ষ্মীকে জীবনসঙ্গিনী করতে গোরার ব্যাকুলতা টের পেয়েছিল, সেভাবে গঙ্গার ঘাটে গোরাকে দেখলে লক্ষ্মীর দুচোখের প্রগাঢ় মুগ্ধতা তার মায়ের নজর এড়াত না। মা-ও চেয়েছিল দু’জোড়া কচি হাত মিলিয়ে দিতে, গোরাকে জামাই করতে। রীতিমতো পণ্ডিত, দেবদুর্লভ রূপের অধিকারী, সৎ পিতামাতার ছেলে গোরার বাড়িতে এসে শচীকে করজোড়ে নমস্কার করে বল্লভাচার্য বলেছিল, লক্ষ্মীকে বধূ করতে চেয়ে আপনি যে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, সে তার সৌভাগ্য। শুধু তার কেন, আমিও ভাগ্যবান। আমাদের পরিবার সম্মানিত হল। কিন্তু আমি বড় দরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ। কী দিয়ে মেয়েকে শ্বশুরঘরে পাঠাব? দু’বেলা খুদকুঁড়ো খেয়ে আমরা গ্রাসাচ্ছাদন করি। আমার দারিদ্র্যের জন্যে আমি লজ্জিত। আপনি কৃপা না করলে আমি এগোতে ভরসা পাচ্ছি না।

ঈষৎ হেসে শচী বলল, কী বলছেন বেয়ানমশাই? বিয়ের প্রস্তাব আমি পাঠিয়েছি। লক্ষ্মীকে সম্প্রদানের সঙ্গে পাঁচটি হরতুকি, বিয়ের যৌতুক হিসেবে আমার ছেলের হাতে তুলে দেবেন। তাই যথেষ্ট!

কৃতজ্ঞতায় বল্লভাচার্যের চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। তাকে সসম্মানে ফল, মিষ্টি খাইয়ে বিদায় দেওয়ার পরে শচী ভেবেছিল, এ হল ভালবাসার বিয়ে। গোরা যাকে ভালবেসে বিয়ে করতে চায়, তাকে ঘরে না এনে উপায় নেই। যৌতুকের প্রশ্ন এখানে ওঠে না। যৌতুক নেওয়ার চিন্তা গোরার মাথাতেও আসবে না। সুতরাং তার বিয়ে ঠেকানো ঈশ্বরের পক্ষেও অসম্ভব।

লেগে গেল গোরার সঙ্গে লক্ষ্মীর বিয়ে। শচী শুধু ভাবছিল, জীবনের এই রহস্যের কোথায় শুরু, কোথায় শেষ? ষোলো বছর বয়সে বিশ্বরূপ বিয়ে করার ভয়ে সংসার ছেড়েছিল। তখন গোরা ছ’বছরের শিশু। দশ বছর পরে, ষোলো ছেড়ে সতেরো বছরে পা দিয়ে পছন্দসই সহধর্মিণী খুঁজে বার করে, তাকে বিয়ে করতে চলেছে গোরা।

বিয়ের নির্ধারিত দিনে পাড়ার নানা বয়সি মেয়েতে ভরে গেল শচীর পাটবাড়ি। সংসারে অভাব থাকলেও ছেলের গায়ে হলুদ আর মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে পল্লীর এয়োরা না থাকলে হয়? প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে গিয়ে শচী তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিল। প্রতিবেশী বউ, মেয়েরা দল বেঁধে এসে গোরাকে নিয়ে হুলস্থূল লাগিয়ে দিল। নবদ্বীপের মেয়ে, বউরা যতই গৃহ অবরোধে থাকুক, আনন্দানুষ্ঠানে একত্র হয়ে তারা যে সুরসিকা নাগরী, নিমাই-এর গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে তাদের হাসি, কৌতুক, সরস টিপ্পনিতে তা বোঝা যাচ্ছিল। কোমরে গরদের জোড় জড়ানো, হলুদবাটা মাখানো তপ্ত সোনার রং, আদুল শরীর গোরাকে দেখে তরুণীদের মাথা ঘুরে গেল। সদর দরজার বাইরে অপেক্ষা করে থাকা মেয়েদের ঝাঁক, উঠোনে আলপনা আঁকা কাঠের পিঁড়িতে দাঁড়ানো হলুদমাখা গোরার কাছে যাওয়ার জন্যে হাঁকপাক করতে থাকল। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গোরার শরীরে যৎসামান্য বাটা হলুদ মাখিয়ে এক রমণী, পাশের সঙ্গিনীকে বলল, ও লো সখী, আমার গা কাঁপছে।

মেয়েদের অনেকে নজরকাড়া সুন্দরী হলেও গোরার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। বয়সে বড় বিবাহিতা, অল্পবয়সী কুমারী, তাদের কারও মুখে লজ্জা, ভয়ে কথা না ফুটলেও তাদের বুকের ভেতরে দাহ চলছে, অভিজ্ঞ প্রৌঢ়া, বৃদ্ধারা টের পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠছিল। তরুণীরাও হাসছিল। তাদের হাসি-কটাক্ষে বিদ্যুৎ খেলছিল মঙ্গলানুষ্ঠান জুড়ে। গোরাকে নিয়ে নববধূ লক্ষ্মী কীভাবে ফুলশয্যার রাত কাটাবে, ভেবে বিবশ হচ্ছিল মেয়েরা। কনেবাড়িতে তেল, হলুদ পাঠানোর জন্যে গোরার শরীর থেকে যে মহিলারা দু’আঙুলে বাটা হলুদ তুলে তামার থালায় রাখছে তাদের কেউ কেউ ইচ্ছে করে গোরার হাঁটু, পায়ের পাতা নিজেদের স্ফীত বুকে মুহূর্তের জন্যে চেপে ধরে সরিয়ে নিচ্ছিল। লজ্জা, সঙ্কোচ, সতীত্ব হারানোর ভয়, কোনও কিছুর তারা পরোয়া করছিল না। কুমারী মেয়ে, সদ্যবিবাহিতা তরুণী, সকলে ভাবছিল গোরার এই শরীর নিয়ে সে-ই বিলাস করার একমাত্র অধিকারী। বাস্তবে তা সম্ভব নয়, খেয়াল করে লক্ষ্মীর সৌভাগ্যে তারা ঈর্ষাকাতর হল। লোকাচারে মেতে মজা পাচ্ছিল গোরা। শূদ্রপল্লীতে কখনও পুরুষ চরিত্রে, বেশিরভাগ স্ত্রী ভূমিকায় অভিনয় করে, দর্শকের হৃদয় আলোড়নকারী নাটকীয় মুদ্রাগুলি এমন রপ্ত করেছিল, যে তার নয়নশরে কুলকামিনীদের মূর্ছা যাওয়ার দশা হল।

বল্লভাচার্যের ভদ্রাসনে পাল্কিতে চেপে বিয়ে করতে গেল গোরা। দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তী, দুই মামা, মেসো চন্দ্রশেখর, শ্রীবাস পণ্ডিত, মুকুন্দসঞ্জয়, বরযাত্রী হল। বরযাত্রীদের মধ্যে আলখাল্লা জড়ানো যে সন্ন্যাসীটি ছিল, তাকে সবাই না চিনলেও শ্রীবাস পণ্ডিত, চন্দ্রশেখর, মুকুন্দসঞ্জয়ের কাছে সে চেনা ছিল। সন্ন্যাসীর সঙ্গে গোসাই তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সন্ন্যাসীর নাম কুবের। দরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ বল্লভাচার্য নমো নমো করে বিয়ে সারলেও জনা দশ বরযাত্রীকে সামর্থ্য মতো ফলার খাওয়াল। বিয়েবাড়িতে খাওয়ার আয়োজন যাইহোক, দেবরাজ ইন্দ্রের মতো অনিন্দ্যসুন্দর, রূপবান গোরাকে দেখতে বিয়ের আসরে ভিড় করল আত্মীয়, প্রতিবেশী। মেয়েরাই সংখ্যায় বেশি। গোরাকে যারা দেখেছে, যারা না দেখে ভুবনমোহন রূপের বর্ণনা শুনেছে, তাদের সবার নজর পড়ল বিয়ের পিঁড়িতে বসে থাকা গোরার ওপর। রামচন্দ্রপুরের মেয়েদের চেয়ে তারা বেশি বিবশ হল। গোরার পাশে আগুনের মতো রূপ লক্ষ্মীকে সন্ধ্যাকালীন একটি খদ্যোত ছাড়া তাদের আর কিছু মনে হল না। সয় চোখে গোরার দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ ভাবল, হায়! লক্ষ্মীর মতো ভাগ্যবতী আমিও তো হতে পারতাম!

পরের দিন দুপুরে শাঁখের আওয়াজ, উলুধ্বনি, খই ওড়ানোর কলরবের মধ্যে নববধূ নিয়ে পাল্কি চেপে গোরা বাড়ি ফিরল। বাড়ির অঙ্গনে গাদাগাদি ভিড়, নানা রসালাপের মধ্যে ছেলে আর পুত্রবধূকে শচী বরণ করে গোরার দিকে তাকিয়ে প্রথমে লক্ষ্মীকে পরে গোরাকে সশব্দে চুম্বন করল। একবার নয়, দু’বার তিনবার। শচীর মুখে মিটিমিটি হাসি। দু’চোখে কৌতুক ছিটিয়ে গোরা সামনে তাকালেও লক্ষ্মী লজ্জায় ঘাড় তুলতে পারল না।

ঘনঘন উলুধ্বনি বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকল। গোরাকে এক লহমা চোখের দেখা দেখতে মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সধবা রমণীদের একজন কনুই-এর গুঁতোয় প্রতিবেশিনীকে সরিয়ে সামনে যেতে চাইলে গুঁতো খাওয়া এয়োস্ত্রী রেগে উঠে বলল, কী ব্যাপার, তুমি একা গোরাকে দেখবে নাকি?

পাশের রমণী ঝঙ্কার দিয়ে উঠে বলল, না, আমি কেন একা দেখব, একা দেখবে তুমি। নদেরচাঁদকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে কপাট আটকে ভালো করে দেখবে।

গগনভেদী শাঁখের আওয়াজ, উলুধ্বনিতে তাদের গলার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল। কলহকারিনীরা গলা চড়ালেও তাদের বাক্যবাণ পরস্পরকে বিদ্ধ না করায় হতাশ হয়ে তারা চুপ করে গেল। লোলুপ নয়নে গোরাকে দেখার জায়গা দু’জনই তখন করে নিয়েছে। ঝগড়া করার মতো অবস্থা দু’জনের কারো নেই। রূপৈশ্বর্যে ঝলমল করতে থাকা নবীন বর দেখে তারা হতবিহ্বল হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *