গোরা – ১৪

১৪

কুবেরকে আরও কিছুদিন নবদ্বীপে গোরা আটকে রাখতে চাইলেও, তা সম্ভব হল না। তার বিয়ের অষ্টমঙ্গলা অনুষ্ঠান চুকতে শুভাইকে নিয়ে শ্রীখণ্ডে চলে এসেছিল কুবের। তার পিতৃব্য, রাজবৈদ্য, মুকুন্দদাশ সরকারের সঙ্গে বাড়ির গুরুজনদের বিশেষ করে সম্পর্কে ঠাকুর্দা অশীতিপর নারায়ণদাশকে সে কথা দিয়ে এসেছিল, খলাপপুরে ফিরে যাওয়ার আগে কয়েক দিন শ্রীখণ্ডে কাটিয়ে যাবে। খবরটা গোরার অজানা থাকার কথা নয়। কুবের বলেছিল তাকে। নতুন বউ আর চতুষ্পাঠী নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে দম ফেলার সময় না থাকলেও এক সকালে অধ্যাপনা শেষ করে গোরা, যাকে তখন নিমাইপণ্ডিত নামে নবদ্বীপের মানুষ ডাকতে শুরু করেছে, নৌকোয় চেপে চলে এসেছিল শ্রীখণ্ডে। নারায়ণদাশের বাড়িতে ঢোকার আগে কুলিয়ার ঘাটে স্নান সেরে নিয়েছিল। সকালে চতুষ্পাঠী শুরু হওয়ার আগে কুবেরকে খবর পাঠিয়ে দেওয়ায় গঙ্গার ঘাটে সে অপেক্ষা করছিল। তার পাশে ছিল আরও একজন, তার নাম নরহরি। নারায়ণদাশের ছোট ছেলে সে, মুকুন্দদাশের ভাই। কুবেরের পিতৃব্য হলেও তার সমবয়সি নরহরি গঙ্গার ঘাটে চলে এসেছিল গোরাকে নিতে। কুবের, নরহরি, দু’জনেই গঙ্গায় স্নানের জন্যে নিজেদের গামছা, ধুতি আনার সঙ্গে গোরার জন্যেও একপ্রস্থ আনতে ভোলেনি। শুকনো পোশাক আশাক নিয়ে ঘাটে দাঁড়িয়েছিল শুভাই। ভোরবেলাতে স্নান করে নেওয়া তার অভ্যেস। স্নানের এমন নিখুঁত আয়োজন দেখে গোরা খুশি হয়েছিল। গ্রীষ্মের দুপুরে মনের সুখে স্নান করে জুড়িয়ে গিয়েছিল শরীর। স্নান সেরে ভিজে পোশাক ছেড়ে নিভাঁজ ধুতি, উত্তরীয় গায়ে জড়িয়ে নারায়ণদাশ সরকারের বাড়িতে ঢুকেছিল গোরা। গোরার ভিজে পোশাক খর রোদে শুকোতে দিয়েছিল শুভাই। দুপুরের মধ্যে ধুতি, উত্তরীয় শুকিয়ে গেলে শেষ বিকেলে গোরার নবদ্বীপে ফিরতে অসুবিধে হবে না। নরহরির দেওয়া পোশাক ছেড়ে নিজের অঙ্গবস্ত্রে শরীর ঢেকে নিতে পারবে। সব দিক ভেবেই তৎপর ছিল হাড়াই পণ্ডিতের গৃহসেবক শুভাই। সদ্যবিবাহিত গোরাকে দেখতে বাড়ির অন্দরমহলে যথেষ্ট চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে, কুবের জানত। কুবেরের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে আসার দিনে আড়াল-আবডাল থেকে গোরাকে মুহূর্তের জন্যে যারা নজর করেছিল, তাদের খুচরো বৃত্তান্তের সঙ্গে নরহরির ব্যাপক বিবরণ মিশে নবদ্বীপের নিমাইপণ্ডিতের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, তা সতেরো বছরের এক তরুণকে তার বয়সের চেয়ে বেশি উচ্চতায় তুলে ধরেছিল। লম্বা, চওড়া, আজানুবাহু, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা ঘন কালো চুল, দেবদূতের মতো সুন্দর এই পুরুষটি যে সতেরো বছরের ছেলে, বিশ্বাস করতে প্রথমে তাদের অসুবিধে হলেও গৃহকর্তা নারায়ণদাশ, যে কিনা প্রয়াত জগন্নাথ মিশ্রকে ভালোরকম চিনত, গোরার বয়সের হিসেব যে নির্ভুল, সে জানাতে পরিবারের সকলে মেনে নিয়েছিল। গঙ্গার ঘাট থেকে স্নান সেরে নরহরি, কুবেরের সঙ্গে পরিষ্কার শুকনো পোশাক, পরিপাটি করে আঁচড়ানো লম্বা চুল, গোরা নারায়ণদাশের বাড়িতে ঢুকতে আড়াল থেকে পরিবারের মেয়েরা আর সামনে দাঁড়ানো পুরুষরা তার অনিন্দ্যসুন্দর তরুণ মুখের দিকে নজর করে, সে যে প্রকৃতই বালক মুহূর্তে বুঝে গেল। বালক হলেও পাণ্ডিত্যের অভিমানে ঝকমক করছিল তার মুখ। দু’চোখে বয়সোচিত সরলতার সঙ্গে কৌতুকের ঝিলিক মাঝে মাঝে জেগে উঠে তখনই সরে যাচ্ছিল। গোরার চেয়ে নরহরি সাত, আট বছরের বড় হলেও কিছুদিন আগে গোরাকে প্রথম দেখার পর থেকে এত অভিভূত হয়েছিল যে, দ্বিতীয় দফায় তাকে পেয়ে তার পাশ ছেড়ে নড়ছিল না। নরহরির হাবভাব দেখে সমবয়সি কাকার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করছিল কুবের। কুবেরের তামাশা উপভোগ করার সঙ্গে নরহরি ভাবছিল, খলাপপুরের ভাইপোটি নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরেও গোরার সঙ্গে তাকে যোগাযোগ বজায় রাখতে হবে। সন্ন্যাস নিলেও ভাইপো কুবের যেমন রত্ন, তার বন্ধু গোরাও তাই। মনের ভেতরের অদেখা আলোতে দু’জনই সমান দীপ্যমান

দুপুরের ভূরিভোজ শেষ করে সুলতান হোসেন শাহের বৈদ্য মুকুন্দদাশ শুরু করল সুলতানের কামতাপুর আর কামরূপ জয়ের কাহিনী। সেনাবাহিনী নিয়ে সুলতান এখনও কামরূপে থাকলেও পক্ষকালের ছুটি নিয়ে মুকুন্দ ঘরে ফিরেছে। এত রক্ত, মারামারি, কাটাকাটি, যুদ্ধের বিভীষিকা তার সহ্য হচ্ছিল না। আরও এক ভয়াবহ ঘটনা অদূর ভবিষ্যতে ঘটতে চলেছে, যা দেখার মতো সাহস রাজবৈদ্যর ছিল না। দু’জন সহকারীকে চারুমিহিরের জিম্মায় রেখে সে ফিরে এসেছিল। সুলতানের জ্যোতিষী, বলা যায় মুখ্য পরামর্শদাতা চারুমিহির তদ্বির না করলে মুকুন্দর ছুটি মঞ্জুর হত কি না সন্দেহ। সুলতানের মন্ত্রিসভায় যদিও এখন কনৌজি ব্রাহ্মণ অমর রায়, (পরে, গোরা যার নামকরণ করেছিল সনাতন) সে হল ‘সাকর মল্লিক’ (সগীর মালিক, অর্থ ছোট রাজা) আর তার ভাই সন্তোষ রায়, (গোরার দেওয়া নাম ‘রূপ’) দবীর খাস, প্রধান সচিব, তবু সুলতানের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের। তার পরামর্শে অমর রায় আর সন্তোষ রায়, দু’ভাইকে সাম্রাজ্য প্রশাসন উঁচু পদে বহাল করেছিল হোসেন শাহ। জ্যোতিষার্ণবের গ্রহ-নক্ষত্র গণনার ফলাফল জেনে কামতাপুর, কামরূপ বিজয়ে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে হোসেন শাহ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গৌড়ের কাছে একডালায় রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেখানে ‘খিটাহ’ পাথরের মহাকায় দুর্গ বানিয়েছে সুলতান। গৌড়ে রাজধানী থাকলেও সে শহর ছিল অরক্ষিত, ‘কাহ’, সেখানে দুর্গ ছিল না। একডালায় সুলতান আর তার পরিবারের জন্যে নতুন প্রাসাদ নির্মাণের সঙ্গে দরবারের হরেক কিসিমের কর্মচারি ‘হাজিন’, ‘সিলাহ্দার’, ‘শরাবদার’, ‘জমাদার’, ‘দরবান’ প্রমুখদের মর্যাদা অনুযায়ী আবাসনপাড়া বানানো হল। দুর্গ পরিবেষ্টিত প্রকৃত ‘খিটাহ’ সুরক্ষিত রাজধানী হল একডালাতে। সভার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত ছিল হাজিবরা, সুলতানের বর্ম বয়ে নিয়ে যেত সিলাহ্দাররা, শরাবদাররা সুলতানের বিলাসব্যসন, সুরাপানের আয়োজন করত, জমাদাররা ছিল সুলতানের জেল্লাদার পোশাকের তত্ত্বাবধায়ক। প্রাসাদের ফটক পাহারা দিত অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দারবানরা, সুলতানের মাথায় ছত্র ধরত যারা, তাদের শিরোপা ছিল ‘ছত্রী’। সুলতানী দরবারে ‘ছত্রী’ ছিল মহাসম্মানের পদ। সভাকবিরা সাধারণত অলঙ্কৃত করত এই পদ মুকুন্দদাশ ছিল সুলতান হোসেন শাহের ‘অন্তরঙ্গ’। রাজবৈদ্যরা এই উপাধি পেত। রাজদরবারে খিদমত্ খাটত কয়েক ডজন ‘খোজা’ অর্থাৎ নপুংশক ক্রীতদাস। সুলতানি দরবার আলো করে বসে থাকত আমীর, উজীর, মালিক, লস্করউজীর, লস্কর, সুলতানের বিশ্বস্ত প্রধানমন্ত্রীরা, যাদের শিরোপা ছিল ‘খান-ই-জহান’, ‘আমীর-উল-উমারা’, পদস্থ আমীর কর্মচারীর কারও শিরোপা ছিল ‘খান মজলিস’, ‘মজলিস-অল-মজালিস’, ‘মজলিস-বারবক’ মুকুন্দদাশের মুখ থেকে সুলতান হোসেন শাহের দরবারের বিবরণ নিমগ্ন হয়ে গোরা শুনছিল। দাদার মুখ থেকে এরকম অনেক কাহিনী ছোটভাই নরহরি আগে শুনলেও সুলতানের কামতাপুর, কামরূপ জয়ের হাতে-গরম বিবরণ শুনতে সেও বসে গিয়েছিল। পেশায় সে-ও বৈদ্য। বৈদ্য হিসেবে মুকুন্দদাশের সুখ্যাতির জন্যে নরহরিরও পসার বেড়েছে। দু’ভাই হরিহর আত্মা।

ঘরের চৌকাটে বসে শুভাই হাঁ করে শুনছে সুলতানি জাঁকজমকের গল্প। বাড়ির মেয়েরা দরজার দু’পাশে খোলা জানলা থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গোরাকে দেখে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে, চোখের আড়ালে সরে যাচ্ছে। শুভাই টের পেয়েও তাকাচ্ছিল না। অন্দরমহলের মেয়েদের কৌতূহলী আনাগোনা নরহরিও নজর করছিল। খোলা জানলার ওপাশে এক ঝলক নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে দেখেও পাত্তা দিল না। নির্বিকার মুখে শুনতে থাকল সুলতানি দরবারের জমকালো বৃত্তান্ত। মুকুন্দ বলল, গৌড় থেকে একডালায় রাজধানী সরিয়ে আনতে খরচের বহরে সুলতানের ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মহলে, মুলুকে সুলতানের কর যারা আদায় করে, সেই ‘আরিন্দা’দের ঝাঁকে ঝাঁকে পাঠাতে থাকল ‘সর-ই-গুমাশ্-তাহ’ মানে রাজস্ব দপ্তরের বড়কর্তা। সুলতানের খাজনা আদায় হয় দু’ভাবে। খাজনার মোটা অংশ আসে ‘গণীমাহ্’ অর্থাৎ লুঠতরাজ থেকে। লুঠের সম্পদ ঘরে তুলতে হলে পাশের স্বাধীন রাজ্য দখল না করে উপায় নেই। অশ্বারোহী, গজারোহী, পদাতিক, পাইক বরকন্দাজ বাহিনী নিয়ে তাই যুদ্ধে যেতে হয়। সুলতানের কামারশালায় বর্শা, বল্লম, শূলের সঙ্গে সেগুলো ছোঁড়ার জন্যে ‘আরাদা’, ‘মঞ্জুালিক’ তৈরির ধুম পড়ে যায়। কামারপাড়ার পুরুষ কারিগরদের সঙ্গে তাদের বউ-ঝিরা পর্যন্ত নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করে। সারারাত কামারশালা থেকে ভেসে আসে হাপরের হাঁসফাস আওয়াজ। মুকুন্দ এক মুহূর্ত ভেবে বলল, সাগরপার থেকে পর্তুগিজ়-জলদস্যুরা নতুন একটা অস্ত্র এনেছে। শুনেছি সেটার নাম কামান। বারুদের গোলা কামানের নলের মুখে পুরে দিয়ে নলের পেছন থেকে জোর ধাক্কা মারলে আগুন-বৃষ্টি হয়। সাংঘাতিক অস্ত্র। গৌড়ে সে অস্ত্র এসে পৌঁছোলো কী অনাসৃষ্টি ঘটবে, কে জানে। গোরা স্থির হয়ে শুনছিল মুকুন্দর বিবরণ। আলোড়ন চলছিল তার মনের মধ্যে। গৌড়ের মধ্যে নবদ্বীপ নামে যে গ্রাম রয়েছে, সেখানের সব মানুষও অগ্নিবৃষ্টিতে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। তার মা, নববধূ লক্ষ্মী, কেউ বাঁচবে না। তার মনের বিপন্নতা অল্প সময়ে মুকুন্দর গল্পের স্রোতে ভেসে গেল। মুকুন্দ আর এক রকমের খাজনার নাম করল, যা প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। এই আদায়ের নাম ‘খরজ্’। খরজ আদায়ের ঘটনা গোরার অচেনা নয়। গৃহস্থ থেকে ব্যাপারী, সকলকে নির্ধারিত ‘খরজ্‌’ দিতে হয়। সুলতানের নির্ধারিত মুলুকপতি আর অধিকারীদের ওপর ন্যস্ত ছিল প্রজাদের কাছ থেকে খরজ আদায় করার দায়িত্ব। সপ্তগ্রাম মুলুকের খরজ্ বাবদ যেমন সেখানের দুই মুলুকপতি গোবর্ধন আর হিরণ্য বছরে কুড়ি লাখ টাকা আদায় করে, তা থেকে বারো লাখ টাকা সুলতানকে দিতে হয়। দুই মুলুকপতি মাথাপিছু চার লাখ টাকা করে মোট আট লাখ নিজেদের জন্যে রাখে। মুলুকপতিরা প্রায় সকলে সুলতানের আমীর। দুই মজুমদার-ও তাই। রাজধানী স্থানান্তরের বিপুল ব্যয় হাসিল করতে আগের দু’সনে আদায়ের মোট কুড়ি লাখ টাকা পুরোটা সুলতানের আদায়কারী নিয়ে গেছে। তারা সাধারণ আদায়কারী ছিল না। রাজস্ব সংগ্রহের কর্তা, ‘সর-ই-গুমাশ-তাহ্’র সচিবদের কেউ ছিল আরিন্দাদের সঙ্গী। তাদের সঙ্গে ছিল দশজন অশ্বারোহী সেনা আর বাহিনীর প্রধান, যার খেতাব ‘সর-ই-খেল’। দ্বিতীয় বছরে দশজন সর-ই-খেলের একশো অশ্বারোহী সেনার সঙ্গে ছিল তাদের অধিপতি, পদমর্যাদায় যে ‘সিপাহশলার’। সাধারণ আরিন্দাদের ওপর ঘাটকর, পথকর, হাটকর, ঘাটশুল্ক, যার নাম ‘কুতকর’ আদায়ের দায়িত্ব চেপে ছিল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে দ্বিগুণ কড়ি তারা কর দিয়েছে। কত হাটুরে, ব্যাপারী সর্বস্বান্ত হয়ে মুলুক ছেড়ে পালিয়েছে, হিসেব নেই। শুধু নিরীহ প্রজা কেন, গোবর্ধন মজুমদার আর হিরণ্য মজুমদারের মতো দাপুটে মুলুকপতিও তৃতীয় বছরে খরজ আদায়ের আগে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। সুলতানেরই কোনও গুপ্তচর, যাকে ‘সিন্ধুকী’ বলা হত, আগাম খবর দিয়ে রেখেছিল সপ্তগ্রামের দুই মুলুকপতিকে। সিপাহশলারের কানে আবার তার বাহিনীর এক ‘সিন্ধুকী’ খবর তুলে দিয়েছিল যে হিরণ্য আর গোবর্ধনের কোনও একজন বনগ্রামের মহলদার রামচন্দ্র খানের বাড়িতে লুকিয়ে আছে। বেনাপোলে খরাজনিত কারণে দু’বছর সুলতানের নির্ধারিত খরজের পুরো দিতে না পারায় সেখানের মহলদারের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার ফরমান জারি করার চিন্তা খাজনা আদায়ের কর্তার মাথাতে ছিল। সপ্তগ্রামে পাঠানো ঘোড়সওয়ার বাহিনীর সিপাহশলারের তা অজানা ছিল না। রামচন্দ্রকে হেনস্তা করার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে দশ ‘সর-ই-খেল’ সমেত একশো বিশ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে সপ্তগ্রাম থেকে বেনাপোলে হাজির হল সুলতানের সিপাহশলার মহাজ্জাম নাসির। সপ্তগ্রামে বেপরোয়া লুঠপাট করে, সেই মুলুক ছাড়ার আগে গোবর্ধনের নাবালক ছেলে রঘুনাথকে বন্দি করে সঙ্গে নিতে সিপাহশলার ভুলল না। রামচন্দ্র খান সে বছরও বকেয়া খরজ্ সমেত পুরো টাকা দিতে অক্ষম শুনে, প্রথমে আত্মগোপনকারী সপ্তগ্রামের দুই মুলুকপতির খোঁজে তার বাড়ি ঘিরে ফেলল অশ্বারোহী বাহিনী। বাড়ির অন্দরমহল, বাইরের মহলে তছনছ করে তল্লাশীর সঙ্গে মহলদারের যাবতীয় সম্পদ লুঠ করে নিল। রামচন্দ্রসমেত পরিবারের স্ত্রী, পুরুষ, ছেলেমেয়েদের বন্দি করে বাড়ির দুর্গামণ্ডপে গোরু বলি দিয়ে সেই মাংস রেঁধে তিনদিন ধরে পরিবারের সকলকে খেতে বাধ্য করল। সপরিবার ধর্মনাশ হল রামচন্দ্রের।

মুকুন্দদাশের মুখে এই নিষ্ঠুর কাহিনী শুনে নরম মনের মানুষ কুবেরের দু’চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকল। থমথম করছে গোরার মুখ। মুকুন্দ বলল, সুলতানের ‘অন্তরঙ্গ’ পদ আঁকড়ে পড়ে থাকতে আর ভালো লাগে না। গোলামি ছেড়ে চলে আসারও উপায় নেই। সুলতান হয়তো জাতিনাশ করে কারাগারে আটকে রাখবে, শূলে চড়ানোও অসম্ভব নয়। পৃথিবীজুড়ে পিশাচের রাজত্ব চলছে।

গলা নামিয়ে মুকুন্দ বলল, শুধু সুলতান হোসেন শাহকে দোষ দিয়ে কী হবে, কামতাপুর-কামরূপের খেনবংশীয় রাজা নীলাম্বর যে পাপ করেছে, তা শুনলে তোমরা শিউরে উঠবে। রাজার পত্নী, মানে রানীর সঙ্গে ব্রাক্ষ্মণ মন্ত্রীপুত্রের অবৈধ সম্পর্কের খবর নীলাম্বরের কানে যেতে হতভাগ্য সেই ব্রাক্ষ্মণতনয়কে রাজঅন্তঃপুরে খুন করে তার মাংস রেঁধে মন্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়েছিল। মন্ত্রীর খাওয়া শেষ হতে তাকে ঘটনাটা শুনিয়েছিল রাজার মশানের জহ্লাদ। অতিথি মন্ত্রীকে পরিতুষ্ট করে খাইয়ে তার সামনে রাজকীয় আসনে বসে রাজা নীলাম্বর তখন মিটিমিটি হাসছিল। শোকাহত মন্ত্রী পাথর হয়ে গিয়েছিল। নরমাংস ভোজনের দূরপনেয় পাপস্খালনের অজুহাতে গঙ্গাস্নান করার জন্যে রাজসভা থেকে ছুটি নিয়ে ব্রাক্ষ্মণ মন্ত্রী গৌড়ে এসে সুলতান হোসেন শাহের সঙ্গে দেখা করে। রাজা নীলাম্বরকে সিংহাসচ্যূত করে কামতাপুর, কামরূপ দখল করতে অনুরোধ জানায়। নীলাম্বরের গোপন ঐশ্বর্যভাণ্ডার থেকে কীভাবে রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুর পর্যন্ত পৌঁছান যাবে সেই পথ বাতলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। হোসেন শাহের ধনসম্পদ ও বিত্তের খাঁই ছিল অসম্ভব। কোষাগার ভরার সুযোগ পেয়ে রাজা নীলাম্বরের মন্ত্রীর প্রস্তাবে সুলতান রাজি হয়ে যায়। শুরু হল কামতাপুর-কামরূপ অভিযান। আমি রাজবৈদ্য, সুলতানের দরবারের অন্তরঙ্গ। যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তারক্তির মধ্যে থাকতে পছন্দ না করলেও সুলতানের সঙ্গী না হয়ে উপায় নেই। হস্তিবাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী, পদাতিক বাহিনীর পেছনে জ্যোতিষার্ণবের সঙ্গে একই শিবিকায় ছিলাম আমি। কামার, তেলি, তাম্বুলি, নাপিত, মিষ্টান্ন তৈরির জন্যে মোদক, কিরাত, ছুতার, পাটনিরা থাকত খোজা দাস পরিবৃত অন্তঃপুরিকাদের শিবিকার সামনে, তার পেছনে হাড়ি, ডোম, বাগদি সম্প্রদায়ের বিশাল পাইকবাহিনী। তারা ছিল দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল। তীরন্দাজিতে তাদের নৈপুণ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা শুধু সাহসী যোদ্ধা নয়, গান বাজনাতেও ওস্তাদ। সুলতানের বাহিনীতে তার অনুগত মুলুকপতি, মহলপতি, ‘সিক’দার, জমিদারদের কারও পাঠানো চার হাজার ‘চৌহান সিপাই’ কারও ‘বিয়াল্লিশ কাহন’ তীরন্দাজ, কোনও মুলুকপতি পাঠাল সাত হাজার অশ্বারোহী সেনা, কেউ দশ হাজার, কোনও সিকদার যোগ দিল আট হাজার ঢালি পাইক নিয়ে। বাগদি সেনাপতির ‘হাতে-বালা, কানে সোনা’, পাইকদের ‘কোমরে ঘাঘর, গলায় ওড়ের মালা, হাতে ধনুক বাণ।’ ডোম সেনা ছিল পঞ্চাশ হাজার। ঢাক, ঢোল, ভেরী, জগঝম্প, দামামা, রণশিঙ্গা, কাংস্য করতাল, কাঁসি, ঘণ্টা, কাড়া-নাকাড়ার আওয়াজে জনপদ কাঁপিয়ে কামতাপুরের পথে এগিয়ে চলল সুলতানি সেনারা। গানবাজনায় তারা মুখরিত থাকলেও সকলেই অস্ত্রসজ্জিত, সেই মুহূর্তে যুদ্ধ লেগে গেলে লাঠি সড়কি, বর্শা, শূল চালাতে কসুর করত না। কারও হাতে শূল জাতীয় নেঞ্জা, কারও হাতে বর্শা, শক্তি বা শেল, কুঠার জাতীয়-পরশু, ডাবুশ, পরশ্বধ, পট্টিশ, মুগুর জাতীয়-ভূষণ্ডী, তোমর, মুদ্‌গর, পাশ আর চক্র। তবে প্রধান অস্ত্র বলতে বেশির ভাগ হাতে ছিল রায়বাঁশ, তীরধনুক, অসি আর ঢাল। সেনাবাহিনীতে একঝাঁক স্ত্রী-সেনানীও ছিল। ছয় ধর্ম, ছত্রিশ জাতের চলমান মেলার মতো লাগছিল রক্তপিপাসু যোদ্ধৃবাহিনীকে। যবনদের আবার জাতপাতের জ্ঞান নেই। কালু ডোমও পাইকসেনাদের সেনাপতিত্ব করছিল। শুনলাম, সে নাকি সাংঘাতিক বীর! কত জঙ্গল, পাহাড়, নদী পেরিয়ে কামতাপুরের সীমানায় দশ দিন পরে সুলতানের বাহিনী ছাউনি করল। যুদ্ধের ময়দান থেকে এক ক্রোশ দূরে খোজা প্রহরীদের কড়া পাহারার মধ্যে সুলতানের বেগম, নর্তকী, তাদের পরিচারিকা, দাসীদের শিবির স্থাপন করা হল। সুলতানী সেনাকে অভ্যর্থনা জানাতে তৈরি ছিল রাজা নীলাম্বরের বাহিনী। উঁচু মানের যোদ্ধা তারা, অভিনব তাদের যুদ্ধ কৌশল। পাঁচ দিন যুদ্ধ করে সুলতানের বাহিনী যখন নাস্তানাবুদ, ইজার’ ‘কাবাই’ পরা সেনারা ছত্রভঙ্গ, মাটি থেকে কাটামুণ্ডু তুলে তার আড়ালে মুখ লুকোতে চেষ্টা করছে, নীলাম্বরের বাহিনীর হাতে ধৃত আমার চেনা নটু পাইক হাউমাউ করে কেঁদে বোঝাতে চাইছে, সে আসলে পাইক নয়, তাকে জোর করে পাইকের পোশাক পরিয়ে ধরে আনা হয়েছে, বন্দি ব্রাক্ষ্মণ পাইকরা দাঁতে ঘাস কেটে পৈতে হাতে সন্ধ্যামন্ত্র পড়ছিল, সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনীর ব্যুহের মধ্যে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির, রাজা নীলাম্বরের পুত্রহারা ব্রাক্ষ্মণ মন্ত্রী, কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীর সঙ্গে তখন চলছিল শলাপরামর্শ। সেখানে আমি ছিলাম না। নিরাপদ ব্যূহের মধ্যে আলাদা শিবিরে ছিলাম।

পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে সুলতান গৌড়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তার আগে দূতের মাধ্যমে খবরটা রাজা নীলাম্বরের কাছে পাঠিয়ে জানাল, তার বেগম একবার মহারাজার পাটরানীর সঙ্গে দেখা করে পরিচিত হতে চায়। সুলতানের অনুরোধে রাজা নীলাম্বর রাজি হয়। হোসেন শাহের শিবির থেকে দাসদাসী পরিবৃত বেগমের বাহিনী, পাঁচটা পাল্কি চেপে নীলাম্বরের রাজপুরীর অন্তঃপুরে পৌঁছে গেল। সেখানে যা ঘটল, কহতব্য নয়। পাঁচ পাল্কির দরজা খুলে কালো বোরখা ঢাকা যে কুড়িজন স্ত্রীলোক নামল, তারা চোখের নিমেষে পাকা সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত হয়ে নীলাম্বরের একাধিক স্ত্রী, সন্তান, পরিবার, পরিকর সমেত রাজপুরী দখল করে নিল। পরিবার পরিজন বাঁচাতে রাজা নীলাম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

বিজয়ী সুলতানী সেনা যখন কামতাপুর লুঠতরাজে ব্যস্ত, তখনই রক্ষিসমেত গৌড়ের পথে সুলতানী হারেমের একদল স্ত্রীলোকের সঙ্গে আলাদা শিবিকায় শ্রীখণ্ডে ফেরার অনুমতি পেল রাজবৈদ্য। খুব বেশি মাসাধিককাল আগের ঘটনা এসব। মুকুন্দর কাছে খবর আছে, তেরশো সোনার থালা সমেত বিস্তর গুপ্তধন পেয়েছে হোসেন। ধর্মকর্মের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক নেই, মন্দিরে ঢোকাতে যাদের ওপর কড়া নিষেধ আছে, স্থানীয় সেই শূদ্র ম্লেচ্ছরা সুলতানী সেনাকে গুপ্তধনের হদিশ দিয়েছে। গৌড়ের হিন্দু মন্দিরগুলো যে গুপ্তধনের খনি, হোসেন শাহের জানতে বাকি ছিল না। ফৌজের সেনাপতি খান, মালিক, আমীরদের সঙ্গে সুলতানী মসনদে বসার আগে হোসেন শাহের যে চুক্তি হয়েছিল, সেই অনুযায়ী মাটির ওপরে লুঠ করা বিত্তসম্পদের এক পঞ্চমাংশ সুলতানী রাজস্ব হিসেবে জমা করতে হবে। পাঁচ ভাগের চারভাগ পাবে সেনাবাহিনী। মাটির তলা থেকে লুণ্ঠিত যাবতীয় বিত্তসম্পদে শুধু সুলতানের অধিকার বর্তাবে। দুই সিপাহশলারের অধীন কয়েক হাজার সেনা সেই চুক্তি অমান্য করে মাটির নিচে, গোপন ঘরে লুকানো গুপ্তধন লুঠ করায় তাদের বিচার করে সুলতান মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে শুনে তড়িঘড়ি কামতাপুর ছেড়ে মুকুন্দ চলে এসেছে। সে যত বৈদ্য হোক, চোখের সামনে পাঁচ হাজারের বেশি সুলতানি সেনার মৃতদেহ দেখার মতো মনের জোর তার ছিল না।

হোসেন শাহের কামতাপুর অভিযানের কাহিনীতে ছেদ টানতে মুকুন্দ বলল, মেজো ছেলে দানিয়েল, যাকে গৌড়ের লোক চেনে দুলাল গাজী নামে, কামতাপুর-কামরূপ শাসনের ভার তার হাতে দিয়ে অল্প দিনের মধ্যে সুলতান একডালায় নতুন রাজধানীতে ফিরে এলে আমার ছুটি শেষ হবে। সুলতানের শিবিকা এসে আমাকে নিয়ে যাবে একডালাতে।

লম্বা শ্বাস ফেলে মুকুন্দ বলল, সবচেয়ে বড় আপদ হল সুলতান আর খান, মালিক, আমীররা মধুর খোঁজ জেনে গেছে। প্রাচীন হিন্দু মন্দিরগুলো যে ধনভাণ্ডার, তা জানাজানি হওয়ার পরে একটা মন্দির আস্ত থাকবে না। কাল যবনদের পথ দেখিয়ে মন্দিরের গোপন কক্ষে ধর্মাধর্মবিহীন এদেশীয় শূদ্র, ম্লেচ্ছরা পৌঁছে দেবে। দেশ থেকে সনাতন ধর্ম মুছে যেতে বেশি দেরি নেই।

মুকুন্দদাশের কপালে ভাঁজ পড়ল, মুখ চোখে জাগল হতাশার অভিব্যক্তি। গোরার মনে হল, নবদ্বীপে জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত পণ্ডিত, অধ্যাপক, শিক্ষার্থীদের ক’জন জানে গৌড় জুড়ে কী ঘটে চলেছে? তার সুহৃদ খোলাবেচা শ্রীধর থেকে হাটবাজারের দোকানি, পসারি, নবশাক সম্প্রদায়ের মানুষের কানে কখনও পৌঁছোবে না এসব খবর। হাড়ি, ডোম, বাগদিপাড়া কয়েকজন, যারা সুলতানের পাইকবাহিনীতে আছে, তাদের হর্তাকর্তাবিধাতা নবদ্বীপের রাজা, ভুজঙ্গ মজুমদার। কৃষ্ণনগরের সেনা ছাউনিতে তারা থাকে। ভুজঙ্গও সুলতানের এক আমীর। সুলতান রাজ্য জয়ে বেরোলে, তার বাহিনীতে ভুজঙ্গ পাইক জোগান দেয়। তেমন হুকুম থাকলে রাজা, আমীরকেও অংশ নিতে হয় সুলতানী অভিযানে। নবদ্বীপে নবশাকপল্লীর বাইরে শূদ্র পাড়ায় গোরার যাতায়াত থাকলেও সেখানে যারা পাইকের চাকরি করে, তাদের কারও সঙ্গে তার পরিচয় নেই। হাড়ি, বাগদি পাড়ায় ঘোরার সময়ে হঠাৎ কখনও কান্নার আওয়াজ শুনলে পাড়ার মানুষকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, পরিবারের এক সমর্থ পুরুষ, যে কৃষ্ণনগরের রাজার ফৌজে পাইকের চাকরি করত, কোনও এক যুদ্ধের ময়দানে সে মারা গেছে। খবরটা তাকে সেই মুহূর্তে বিষণ্ণ করলেও কৌতূহলী করেনি। রাজবৈদ্য মুকুন্দদাশের অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনে তার চোখ খুলে গেল। নবশাকপল্লীর চেয়ে ম্লেচ্ছ, শূদ্র এলাকার মানুষের সঙ্গে বিশেষ করে যেসব পরিবারে পাইকের চাকরি করে, এমন মানুষ আছে, তাদের সঙ্গে বেশি করে মেলামেশার ইচ্ছে তার মনে উদগ্র হল। আসলে সে গল্প শুনতে চায়, চেনা মানুষের মুখ থেকে দেশের বিবরণ, দেশবাসীর বৃত্তান্ত আর সেই সব যুদ্ধের কাহিনী, যার আঁচ, যুদ্ধক্ষেত্র যত দূরেই হোক, তার গায়ে, নবদ্বীপ, গৌড়ের লক্ষ কোটি মানুষের গায়ে লাগছে, সেই সব গল্প শুনতে চায়। দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তীর মুখ থেকে সে শুনেছে, পঞ্চাশ বছর আগে এক টাকায় সারা বছর তিন জনের ছোট একটা সংসারের খাইখরচ চালানো যেত। পঞ্চাশ বছর পরে এখন আড়াই, তিন টাকাতেও সম্বৎসর পেটের ভাত জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিন আনা থেকে বেড়ে পাঁচ আনা হচ্ছে ভালো বাঁশফুল চালের মণ। ঘি-এর মণ দেড় টাকা থেকে হয়েছে এক টাকা বারো আনা। বলতে কি, সব জিনিসই এখন দুর্মূল্য।

গল্পের আসর ছেড়ে মুকুন্দদাশের তখনি উঠে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও অন্দরমহল থেকে জরুরি ডাক আসায় তাকে যেতে হল। তাছাড়া যুবাবয়সিদের নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় সে বিঘ্ন ঘটাতে চায় না। চৌকাঠ ছেড়ে শুভাই গেল গঙ্গার ধারে। খলাপপুরে গঙ্গার এমন চোখ জুড়োনো শোভা দেখার সুযোগ নেই। উত্তর রাঢ়ের ভূখণ্ডে গঙ্গার সোঁতা কোথায়? গোরার থমথমে, গম্ভীর মুখ স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। কুবের বলল, গুরুর সঙ্গে কয়েক বছর আগে বঙ্গালভূম, লখনৌতি, সোনার গাঁ পরিক্রমা শেষ করে করতোয়া নদীর তীর ধরে কোচবিহার রাজ্যে ঢুকে শুনলাম সুলতান হোসেন শাহের সেনা রাজধানী অবরোধ করে বসে থাকলেও গড়, পরিখা পেরিয়ে নগরের মধ্যে ঢুকতে পারেনি। রাজা বিশ্বসিংহের মেজো ছেলে, যার নাম মল্লদেব তখন কোচবিহারের রাজা। নরনারায়ণ নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসে ছোট ভাই শুক্লধ্বজকে একই সঙ্গে মন্ত্রী আর সেনাপতি পদে নিয়োগ করল মহারাজ নরনারায়ণ। সেনাপতি শুক্লধ্বজের নেতৃত্বে অহোমদের কয়েকটা খণ্ডযুদ্ধে হারিয়ে ডিহং নদী পর্যন্ত ধাওয়া করে অহোম রাজধানী দখল করে। শুক্লধ্বজ ছিল অসম্ভব সাহসী, বীর যোদ্ধা। গভীর জঙ্গলের পথে বিশাল যত গাছের মগডালে তার সেনাবাহিনী লুকিয়ে থাকত। বিরোধী পক্ষের সেনারা হঠাৎ আবিষ্কার করত আকাশ থেকে শত্রুবাহিনী নেমে তাদের ঘিরে ফেলেছে। পালানোর পথ নেই। আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের উপায় থাকত না। চিলের মতো ছোঁ মেরে শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করার এই যুদ্ধকৌশল শুক্লধ্বজের মাথা থেকে বেরোনোর জন্যে তার নাম হয়েছিল চিলা রায়। ঘোড়ার পিঠে চেপে চিলা রায় অনায়াসে ভৈরবী নদী পার হয়ে যেত। অহোম জয় করে রাজধানী পার্বতীপুরে ফেরার সাতদিনের মধ্যে সুলতানের বাহিনী নগর অবরোধ করেছিল। অবধূত গুরুর আশ্রিত শিষ্য আমি। গুরুর দয়ায় পরিব্রাজনে কোনও বিপদ ঘটবে না জানতাম। রাজা নরনারায়ণের বাবা রাজা বিশ্বসিংহ যে দুর্জয় সাহসী ছিলেন, তিনিই কোচবিহার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর মৃত্যুর পরে সিংহাসনে বসেছিল বড় ছেলে নরসিংহ, গুরুর মুখে এসব কাহিনী শুনেছিলাম। নরসিংহ-র রাজত্বকালে জয়ান্তয়া, খয়রাম, দিমরুয়া, শ্রীহট্ট ইত্যাদি বঙ্গালভূম আর অহোমের মুলুকগুলি কোচবিহারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। রাজা নরসিংহ বিশাল কোচবিহার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও বেশিদিন রাজ্যশাসনের সুযোগ পায়নি। কালাজ্বরে হঠাৎ তার মৃত্যু হতে মেজো ভাই মল্লদেব কোচবিহারের অধিপতি হয়েছিল। ভয়ঙ্কর সুলতানি বাহিনীকে এড়িয়ে গুরুর সঙ্গে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের পথ পেরিয়ে যে গাঁয়ে ঢুকলাম, সে গ্রাম প্রায় খালি। সুলতানের সেনাবাহিনী আসার খবর পেয়ে কিছু বুড়ি, শিশু বাদ দিয়ে বাড়ি ছেড়ে সকলে পালিয়েছে। গৃহস্থ এক শিষ্যবাড়িতে গিয়ে গুরু হাজির হতে বুঝলাম, রাতটা সেখানে কাটানো যাবে। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে গৃহস্থ শিষ্য যখন যায়নি, তখন বাড়িতে সে আছে। গুরু জানালেন, তাঁর গৃহী শিষ্য নগেন্দ্র না থাকলেও তার বৃদ্ধা মা থাকবেন বাড়িতে। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার সামর্থ্য তাঁর না থাকলেও বন্ধ দরজা খুলে দেওয়ার মতো হাঁটা-চলার শক্তি আছে। ভাগ্য ভালো থাকলে রাতের খাওয়ার চিঁড়ে-দুধ জুটে যেতে পারে।

গুরুবাক্য মিথ্যে হয় না। তিনি যা যা বলেছিলেন তাই ঘটল। গুরুকে দেখে আনন্দে উদ্বেলিত শিষ্যের বুড়ি মা গলবস্ত্র হয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। দু’জনে পেট ভরে ফলার খেয়ে মাটিতে ধুতির খুঁট পেতে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়তে সময় লাগল না। মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যেতে টের পেলাম জলে ভাসছি। প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে জলস্রোত। ক্ৰমশ বাড়ছে জলস্রোত। গলা তুলে গুরুকে ডাকতে শান্ত গলায় তিনি জানালেন, কিছুক্ষণের মধ্যে জলে ভরে যাবে ঘর। তার আগে দরজা খুলে ঘরের বাইরে দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। কাছে কোথাও বড় গাছ পেলে, গাছের টং-এর উঠে বসে থাকতে পরামর্শ দিলেন। অন্ধকারে তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু তাঁর গলা শুনছিলাম। তিনি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, জানতে চেয়ে শুনলাম, শিষ্যের বুড়ি মাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে ভেসে যাওয়ার অপেক্ষা করছেন তিনি। ভাসমান অবস্থায় কোনও গাছের ডাল নাগালের মধ্যে পেলে সেটা ধরে ফেললে গাছে উঠতে সমস্যা হবে না। স্রোতের টান ক্রমশ বাড়ছিল। খটখটে শুকনো দিন। বর্ষার মরশুম শেষ হয়েছে কয়েক মাস আগে। গত কয়েকদিন ছিটেফোঁটা বৃষ্টি না হলেও কীভাবে এমন প্রলয়ঙ্কর বন্যা পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কুবের বুঝতে পারছিল না। প্রচণ্ড এক জলস্রোত মাটির দাওয়া থেকে কুবেরকে ধাক্কা মেরে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে গুরুকে সে হাঁক দিয়ে একবার ডাকল। কেউ সাড়া দিল না। স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া কুবেরের সৌভাগ্য যে আঁকড়ে ধরার মতো গাছের একটা শক্ত ডাল হাতের কাছে পেয়ে সে দু’হাতে সজোরে সেটা চেপে ধরল। ডালটা সামান্য নেমে এলেও সহজে ভাঙবে না, কুবের অনুমান করতে পারল। ক্রমশ শক্তপোক্ত মোটা ডালপালা মুঠোয় ধরে জলস্রোত থেকে কুবের যখন কিছুটা ওপরে উঠেছে, তখন গাছের আরও ওপর থেকে যে কণ্ঠস্বর ভেসে এল, সে গলা যে তার গুরুর, মুহূর্তে কুবের চিনতে পারল। গাছটার নাম তেঁতুল এবং এ গাছের ডালপালা যে প্রভূত ভার বহন করতে পারে, কুবেরকে তা জানিয়ে নির্ভয়ে, সতর্ক হয়ে ওপরে আসতে গুরু উপদেশ দিল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে থাকা তেঁতুল গাছের ঝাঁকড়া ডালপালায় হাত বুলিয়ে পছন্দের শক্ত ডাল ধরে সাবধানে ওপরে উঠতে থাকল কুবের। গাছের ডাল, পাতা শিশিরে ভিজে থাকলেও বর্ষার অবিরত বৃষ্টিতে যেমন পিছল হয়ে থাকে, তেমন নয়। বৃষ্টি হয়নি অনেকদিন। চারপাশ এখন সারাদিন শুকনো খটখটে। গাছের তলা দিয়ে তোড়ে জলস্রোত ছলছল কলকল করে বয়ে যাচ্ছে। মানুষ এই স্রোতের মুখে পড়লে কুটোর মতো ভেসে গিয়ে মহানন্দা, তিস্তা অথা জলঢাকা নদীতে গিয়ে পড়বে। বেশ খানিক ওপরে উঠে কৌতূহল চাপতে না পেরে অন্ধকারের মধ্যে গুরুকে কুবের জিজ্ঞেস করল, আমার গুরুভাই নগেন্দ্রর মা ঠিক আছেন তো?

হ্যাঁ, তিনি ঘুমোচ্ছেন।

ঘুমের মধ্যে পড়ে যাবেন না তো?

না, নিরাপদে আছেন তিনি। ত্রিশূলের মতো শক্ত একটা ডালের খাঁজে তাঁকে জুত করে আরামে বসিয়ে আমার কাষায় বস্ত্রখণ্ড দিয়ে নিজেকে এভাবে বেঁধেছি যে গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেই। কয়েক মুহূর্তে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, রাতে তাঁর ঘরে গুরুর বেশে যিনি এসেছিলেন, তিনি ভগবান ছাড়া কেউ নন। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে তাঁকে তিনিই বাঁচিয়ে দিয়েছেন। জীবনের ভয় তাঁর কেটে গেছে। কথার মাঝখানে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন নগেন্দ্রর মা।

ঈশ্বরপ্রতিম গুরুকে কুবেরের অনেক কথা বলার থাকলেও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে জিজ্ঞেস করল, অসময়ে এখানে বন্যা হল কেন?

তারপর গুরু-শিষ্যে যে কথোপকথন হল তা থেকে কুবের জানল, জলস্রোতের কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, কোচ সেনাপতি চিলা রায়ের রণকৌশলে পর্যুদস্ত হয়েছে গৌড়ের সেনারা। যুদ্ধের মাঝখানে জলস্রোতে তাদের ভাসিয়ে দেওয়ার ফাঁদ নিশ্চয় পেতে রেখেছিল কোচ সেনাপতি চিলা রায়।

গুরুর অনুমান যে মিথ্যে নয়, কয়েকদিন পরে কুবের জানতে পেরেছিল। কোচবিহারের রাজধানী পার্বতীপুর ঘিরে চিলা রায়ের নির্দেশে এমনভাবে গড় কেটে রাখা হয়েছে, সেখানে সারা বছর ধরলা নদী, জলঢাকা নদীর জল যাতায়াত করতে পারে। পাঁচিলঘেরা গড়ের জলস্রোতের উচ্চতা যে পথে শত্রু চলাচলের সুবিধে রয়েছে, সেই অংশের উচ্চতা, রাজধানী পার্বতীপুরের চেয়ে বেশি। রাজধানী কখনও শত্রু পরিবেষ্টিত হলেও গড়ের পাঁচিলের বাইরে থেকে আক্রমণকারী বাহিনী তা বুঝতে পারে না। যুদ্ধের এক তুঙ্গ মুহূর্তে পাঁচিলের গোপন দরজাগুলো হঠাৎ খুলে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো সেই জলস্রোত রাজধানী অবরোধ করে থাকা শত্রুবাহিনীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। গৌড়ের সুলতানী সেনাদল সেভাবে ভেসে গেছে। আত্মরক্ষা করার মতো যথেষ্ট সুযোগ না পেলেও তাদের দু’একজন গাছের ডাল ধরে, কলার ভেলা আঁকড়ে বেঁচে গিয়ে, ঘরে ফিরে শুকনো মাঠে মাঝরাতে বন্যা আসার অলৌকিক গল্প শুনিয়েছে আত্মীয়স্বজনকে। জলস্রোত নেমে গিয়েছিল পরের দিন সন্ধের আগে। নগেন্দ্রর মাকে গাছ থেকে নামিয়ে তার ঘরে পৌঁছে দিতে গিয়ে অবধূত গুরু দেখলেন বিকেলের আগে সপরিবারে তাঁর শিষ্য বাড়ি ফিরে এসেছে। মাকে নিয়ে গুরুকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে তাঁর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে নগেন্দ্র কাঁদতে লাগল। মাকে জীবিত দেখবে, সে কল্পনা করেনি। সুলতানী সেনার ভয়ে বুড়ি মাকে ঘর আগলানোর জন্যে সপরিবার পালানোর সময়ে সে কল্পনা করতে পারেনি, শিষ্যের চরম বিপদের মুহূর্তে তাকে গুরু রক্ষা করবেন। ‘গুরু কৃপাহি কেবলম্।’ গুরুর পায়ে মাথা রেখে নগেন্দ্র গুরুবন্দনা করতে থাকল, গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুদেব মহেশ্বর।’ নগেন্দ্র ভাবাবেগ দেখে টের পেয়েছিলাম, প্রকৃত গুরু পেয়েছে সে। তার চোখে গুরুই ঈশ্বর। তার গুরুভক্তি দেখে আমি লজ্জিত হয়েছিলাম। নগেন্দ্র বাড়িতে সেই রাত কাটিয়ে পরের দিন ভোরে আমরা কলিঙ্গের পথে রওনা হয়েছিলাম। দেড় বছরের সেই পরিক্রমায় নেপাল, কাঞ্ঝী, অযোধ্যা, অবন্তী, মথুরা, মায়াপুর, দ্বারাবতী, মগধ, কাম্বোজ, বারাণসী আরও কত জনপদে মন্দির, দেবদেউলের মাটি স্পর্শ করেছিলাম, হিসেব নেই। দেশের যেখানে যাই সেখানে অশান্তি, যুদ্ধ, হানাহানি চলছিল। দিল্লির সুলতান সিকন্দর লোদির সঙ্গে কোথাও হোসেন শাহের বাহিনী লড়াই করছিল, কোথাও চলছিল অহোমের রাজার সঙ্গে ভাটগাঁও নৃপতিদের যুদ্ধ, শাক্যকূটরাজ দ্বিতীয় গোবিন্দর সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের বিন্ধপর্বতের পূর্বঘাটে বেঁধে গিয়েছিল কলিঙ্গ রাজ প্রতাপরুদ্রদেবের মহাসংগ্রাম। বেশ কয়েকবার গুরুর কৃপায় আমি প্রাণে বেঁচে গেছি।

সুহৃদ কুবের, নরহরির সঙ্গে কথায় গল্পে অনেকটা সময় কেটে গেছে, ঘরের আলো জুড়িয়ে আসতে গোরা বুঝতে পারল, খোলা জানলা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তে দেখল ভাগীরথীর পশ্চিমে সূর্য হেলে পড়েছে। ভাগীরথীর জলে কিছুক্ষণের মধ্যে টুপ করে ডুব দেবে সূর্যদেবতা। সারা রাত ধরে অন্ধকারে ডুবসাঁতার কেটে কাল উষালগ্নে ফের ভেসে উঠবে পুব আকাশে। যুগ যুগ ধরে চলছে বিশ্বস্রষ্টার এই লীলাখেলা, অনন্তকাল চলবে। বেশিরভাগ কথা বলছিল কুবের, নরহরি। গোরা শুনছিল দুই অগ্রজ সুহৃদের আলাপচারিতা। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল, কিছু ভাবছিল। ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্রের বাইরে যে দেশ, জীবনপ্রবাহ রয়েছে, তার যৎকঞ্জিৎ বিবরণ আগে শুনলেও রাজবৈদ্য মুকুন্দদাশ আর কুবেরের বৃত্তান্ত শুনে সে অনুভব করল, বিশাল এক কর্মযজ্ঞ তাকে ডাকছে। নবদ্বীপ ফেরার জন্যে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অন্ধকার নামলে খেয়া চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নৌকো পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। তবে শ্রীখণ্ড বা কুলিয়ার ঘাটে এমন কোনও মাঝি নেই যে গোরাকে, নবদ্বীপের নিমাইপণ্ডিতকে চেনে না। মুখ থেকে সে কথা খসালে যে কোনও মাঝি তাকে নৌকোয় তুলে নবদ্বীপে পৌঁছে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা, ছেলেবেলা থেকে সাঁতার কেটে বহুবার সে ভাগীরথী পারাপার করেছে, গ্রীষ্মের এই শেষ বিকেলে আনন্দের সঙ্গে সাঁতরে নবদ্বীপের বারকোণা ঘাটে চলে যেতে পারে। কোনওটাতে যার আপত্তি নেই, তার ঘরে পৌঁছানো ঠেকায় কে? গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত গোরাকে এগিয়ে দিতে এল কুবের, নরহরি। তাদের পেছনে ছায়ার মতো লেগে থাকল শুভাই। গোরাকে ছাড়তে কুবেরের মন চাইছিল না। নরহরির চোখে জল দেখে গোরা তাকে যখন খুশি নবদ্বীপে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল। কুবেরকে চাপা গলায় বলল, সংস্কৃত ভাষা যতটা সম্ভব শিখে নিতে। নবদ্বীপে যাওয়ার আমন্ত্রণ রাখতে নরহরি যেমন দশদিনের মধ্যে এক দুপুরে গোরার চতুষ্পাঠীতে হাজির হল, তেমনি কুবের খলাপপুরে ফিরে বাবার বন্ধু, পণ্ডিত গঙ্গাহরি চক্রবর্তীর কাছে সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের পাঠ নিতে শুরু করল। গোরা বয়সে ছোট হলেও তার অনুরোধ, কুবেরের কাছে নির্দেশ মনে হয়েছিল। শ্রীখণ্ডের ঘাটে এসে, বারকোণা ঘাটের চেনা এক মাঝির নৌকো পেয়ে, সেই নৌকোতে উঠে দিন শেষ হওয়ার আগে গোরা নবদ্বীপে ফিরে এসেছিল। বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে গোরা দেখল তুলসীতলায় সন্ধে দিচ্ছে মা। শাশুড়ির গা ঘেঁষে লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে নববধূ লক্ষ্মী। প্রদীপের আলো লেগে চকচক করছে লক্ষ্মীর মুখের একপাশ। বউয়ের ফেটে পড়া রূপের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধের মতো নিস্তব্ধ গোরা দাঁড়িয়ে থাকল। রাজবৈদ্য মুকুন্দদাশের যুদ্ধবৃত্তান্তের বিভীষিকা ততক্ষণে তার মাথা থেকে সরে গেছে।

.

বাড়িতে নতুন বউ লক্ষ্মী, আর বাইরে মুকুন্দসঞ্জয়ের বাড়িতে নিজের চতুষ্পাঠী নিয়ে গোরার দিন কাটছিল তরতরিয়ে। সন্ধের পরে গঙ্গার ঘাটে বসে বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপের সঙ্গে কিছু দুষ্টুমিও করছিল। শূদ্র, ম্লেচ্ছপাড়াতে যখন তখন চলে গিয়ে সামাজিক বিধিনিষেধ ভুলে তাদের সঙ্গে মেলামেশাতে ক্ষান্তি দেয়নি। পৈষ্টীপায়ী (ধেনো মদ ) পূর্বাঙ্গণাসংসর্গকারীর (অগম্যাগমন) সঙ্গে গল্পগুজব করতে তার যেমন আটকাত না, তেমনি অন্ত্যজদের ঘরে বসে শাস্ত্রে অনুমোদিত ক্ষীর, দই খাওয়ার পাশাপাশি জাতিদুষ্ট, ক্রিয়াদুষ্ট, কালদূষিত, আশ্রয়দূষিত, সংসর্গদুষ্ট, শহুল্লেখ, এরকম যত নিষিদ্ধ খাদ্যাখাদ্য আছে, নিঃসংশয়ে গলাধঃকরণ করত। নিজেকে কখনও মহাপাতক ভাবত না। কোনও পাপবোধ ছিল না তার। রঙ্গরসিকতার ভাঁড়ার ছিল অফুরন্ত। নবশাক, ম্লেচ্ছদের নিয়ে প্রায়ই নাটকপালা অভিনয় করত। স্ত্রী চরিত্রে সে ছিল নিখুঁত অভিনেতা। শুধু অভিনয় কেন, সবরকম উৎসবে, এমনকী শবরোৎসবে পর্যন্ত ঢুকে পড়ত। নামে ‘শবর’ হলেও বিপ্রবর্ণের মানুষ ছাড়া সব গাঁইগোত্রের লোক এই অনুষ্ঠানে মেতে উঠত। সারা শরীরে কাদা মেখে, কর্দমাক্ত নগ্নদেহ পাতায় ঢেকে নাচ গান বাজনার সঙ্গে চলত অশ্রাব্য গালিগালাজের লহরা। শবরোৎসবের এটাই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। মদনদেবের পুজো, এমনকি দুর্গাপুজোতেও দেবদেবীদের খুশি করতে অকথ্য, অশ্লীল খিস্তিযুদ্ধ করা ছিল লোকাচার। কৃষ্ণচন্দ্র আগমবাগীশের বিধান অনুযায়ী অশ্লীল গালিগালাজ শুনতে দেবী দুর্গা, মদনদেবতা ভালবাসেন। গ্রাম্য আচারে অংশ না নিলেও প্রায় সব সামাজিক আনন্দানুষ্ঠানে গোরা যেত। নিজেদের মধ্যে একজন ব্রাক্ষ্মণসন্তানকে পেয়ে অন্ত্যজ সমাজের মানুষ উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে যেত। এইসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে নবশাকসম্প্রদায়ের দু’চার জন বন্ধুকে সঙ্গী করত গোরা। বাজারের খোলাবেচা শ্রীধরকেও প্রায়ই ডেকে নিত। গোরার পাশে দাঁড়িয়ে মন্দ রুচির আমোদ-তামাশা দেখতে শ্রীধর সঙ্কোচ বোধ করত। গোরাকে বলত, দা’ঠাকুর এসব তর্জামেলায় আপনার আসা মানায় না।

—কেনরে?

—আপনি ব্রাহ্মণ, ব্রাক্ষ্মণ মানে, দেবতা।

—তুই আসিস কেন?

আমার কথা ছাড়ান দেন। আমরা অগ্রদানী বামুন, বলা যায়, শুদ্দুর, বামুনদেবতার পায়ের নখের যুগ্যি নই। জাতধম্ম বলে কিছু আছে নাকি আমাদের? আজ হিদু, কাল মোচরমান, পরশু আর একটা। যে রাজা খেতে দেয় আর যখন তখন ধরে নিয়ে গিয়ে হাটবাজারে পাঁচজনের সামনে চাবুক কসায়, তার ধর্ম মেনে নিই। হিদু মন্দিরে আমাদের ঢোকা নিষেধ, মসজিদের দিকে তবু আমাদের পা চলে না। বৌদ্ধ মঠগুলো মন্দ না হলেও ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। হিদুদের মতো বৌদ্ধরাও ঝাঁকে ঝাঁকে যবন হচ্ছে। তবে আমরা যেখানেই যাই, কারও মত্তর তন্তর মগজে ঢোকে না, বলতে গেলে জিভ জড়িয়ে যায়। আমাদের মগজে ঘিলু বলে কিছু নেই, শুধু গোবর। এইসব নোংরা আসর ছাড়া তাই কোথাও আমাদের ঠাঁই মেলে না। মানুষের মতো দেখতে হলেও আমরা জানোয়ার। আপনি বামুন, আপনি দেবতা, এখানে আপনি কেন আসবেন?

শ্রীধরের কথা শুনে গোরা ঠোঁট টিপে হাসলেও তাকে উড়িয়ে দিতে পারে না। শূদ্রপাড়ার বন্ধুরা যারা তখন গোরার আশপাশে থাকে, শ্রীধরের কথাতে তারাও খিকখিক করে হাসে। শ্রীধরের আক্ষেপের কারণ বুঝতে গোরার অসুবিধে হয় না। সংস্কৃতে লেখা শাস্ত্র, ব্যাকরণ, স্মৃতি, ন্যায়ের তত্ত্ব, এমন সহজ, প্রাঞ্জল, সর্বজনবোধ ভাষায় লেখা দরকার, যাতে মায়ের কোলের দুধের শিশু থেকে তার নিরক্ষর বুড়োর ঠাকুর্দা পর্যন্ত কানে শুনে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। চিন্তাটা তার মাথায় এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল, যে নানা প্রসঙ্গে মনের মধ্যে ফিরে আসতে থাকে। গঙ্গার ঘাটে, বাড়ি ফেরার পথে মুকুন্দ, মুরারি, গদাধরের মতো সহপাঠী, পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাদের শাস্ত্রীয় ফাঁকি (একরকম ধাঁধা) জিজ্ঞেস করে এমন নাস্তানাবুদ করে যে দূর থেকে গোরাকে নজর করলে তারা দ্রুত অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়ে গা-ঢাকা দেয়। শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে এসে বসবাসকারীরা সকলে গোরার আত্মজন। তাদের কাউকে পেলে শ্রীহট্টীয় বাংলা উপভাষায় এমন মস্করা শুরু করে যে তারা চটে লাল হয়ে যায়। দু’একজন কাজির কাছে তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনপত্র পাঠিয়েছিল। জগন্নাথ মিশ্রের সঙ্গে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল যাদের, গোরাকে তারা আলাদাভাবে বোঝাত। নবদ্বীপে ভূমিষ্ঠ হলেও গোরা যে আদতে শ্রীহট্টীয়, সেখানেই তার পরিবারের শিকড়, এরকম নানা তথ্য শুনিয়ে ভাষা নিয়ে গোরার ভেংচি কাটার হাত থেকে তারা আত্মরক্ষা করতে চাইত সবচেয়ে বেশি গোরা ঠাট্টা বিদ্রূপ করত বৈষ্ণবদের। পড়শি কোনও বৈষ্ণবের সঙ্গে পথঘাটে কোথাও দেখা হয়ে গেলে নানা খোঁচা দেওয়া প্রশ্নে তাকে অস্থির করে তুলত। কখনও জিজ্ঞেস করত শান্তিপুরের কমলাক্ষ ভট্টাচর্জি, অই যে, তোমরা যাকে অদ্বৈত আচার্য বলে থাকো, তার হুঙ্কার শুনে কৃষ্ণ নাকি মাঝপথে এসে দাঁড়িয়ে গেছেন? শুনেছি, তাঁকে নিজের ঘরে আনতে চেলাচামুণ্ডা জুটিয়ে শ্রীবাসপণ্ডিত রাতভোর নেচে গেয়ে কেঁদেকুঁদে একসা হচ্ছেন?

শ্লেষমেশানো গোরার টেরাবাঁকা মন্তব্যগুলো অদ্বৈত আচার্য, শ্রীবাস পণ্ডিতের কানে অনতিবিলম্বে পৌঁছে গেলেও অসহায়ের মতো তাদের শুনতে হয়। দু’জনে কদাচিৎ গোরার ঝাঁঝালো কথাগুলো নিয়ে বাক্যবিনিময় করে। ক্ষিপ্ত অদ্বৈতকে শান্ত করতে শ্রীবাস বলে, তার ধারণা গোরা একদিন বদলে যাবে, পরম বৈষ্ণব হবে।

শ্রীবাসের আশ্বাসে প্রশান্তির উদ্ভাস ছড়িয়ে পড়ে অদ্বৈতের মুখে। মনে মনে সে প্রার্থনা করে, ফুলচন্দন পড়ুক শ্রীবাসের মুখে। শ্রীবাসকে বলে, পণ্ডিত তাই যেন হয়। এরকম ঘটলে দেশ, কালের চেহারা বদলে যাবে। আমার মন্ত্রদীক্ষিতা শচীর জয়জয়কার হলে ভারি তৃপ্ত হব আমি।

অদ্বৈত, শ্রীবাসের মধ্যে যতই আশাবাদী কতাবার্তা হোক ঘটনাস্রোত বইছিল উল্টোখাতে। নবদ্বীপে নিমাইপণ্ডিতের খ্যাতি যত ছড়াচ্ছিল, তত বাড়ছিল তার ঔদ্ধত্য, বাচালতা। বৈষ্ণবদের পায়ে পা জড়িয়ে ঝগড়া করছিল, তিতিবিরক্ত করে তুলছিল তাদের। সমাজের নিচুতলার বন্ধুরা ক্রমশ তার আপনজন হয়ে উঠছিল। তার সঙ্গ পেতে সকাল থেকে নিমাইপণ্ডিতের চৌপাঠির কাছাকাছি তারা ঘুরঘুর করত। পণ্ডিতের দাঁতভাঙা কঠিন অধ্যাপনার অংবংচং নিরর্থক আওয়াজ ছাড়া আর কিছু তাদের কানে ঢুকত না। যে মানুষটার প্রতিটা কথা এত সহজ, সরল, রঙ্গ রসে টইটম্বুর, তার পঠনপাঠনের একটা বর্ণ কেন মাথায় ঢোকে না, এমন এক আবছা প্রশ্ন তাদের মনে জাগলেও ভরসা করে গোরাকে জিজ্ঞেস করতে পারত না। প্রশ্ন করতে পারে শ্রীধর। বাজারে থোড়, মোচার পসরা নিয়ে দোকানদারি করলেও সে ব্রাক্ষ্মণ। তবে পাতকুড়োনো, পিণ্ডভোজী ব্রাহ্মণ সে। ব্রাহ্মণের মধ্যে পতিত, অগ্রদানী ব্রাহ্মণ। গোরার সংসর্গ পেলে দীনাতিদীনের মত কথা বলে। এক সন্ধেতে বারকোণা ঘাটের চাতালে বসে গোরাকে সে জিজ্ঞেস করল, মামা, ধৰ্ম কী?

সামান্য ইতস্তত করে গোরা বলেছিল, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভজনা।

—মন্ত্রটা কী?

—মন্ত্রে তেমন কিছু নেই। তাঁকে ভালবাসতে হবে।

—যাকে ধরাছোঁয়া যায় না তাকে ভালবাসব কীভাবে? তার চেয়ে বড়কথা হল, ভালবাসা কী?

—বাড়ি ফিরে বউকে জিজ্ঞেস করিস ভালবাসা কী? সে বুঝিয়ে দেবে।

জিভ কেটে শ্রীধর বলেছিল, কী যে বলেন! মামা!

ভুল কিছু বলিনি। তুই যতটা বউকে ভালবাসিস, তা না জেনেও তোকে তোর বউ যতটা ভালবাসে, দু’জনের সেই ভালবাসার মধ্যে ঈশ্বরকে স্থাপন করলে, তার যথার্থ ভজনা করা হয়। ভক্তের ধরাছোঁয়ার মধ্যে এসে যায় ঈশ্বর।

গোরার কথা শুনে শ্রীধর হকচকিয়ে গিয়ে বলেছিল, আমার পায়ের নিচে কুটোর মতো গিন্নি থাকতে চায়, সাত চড়ে রা কাড়ে না, মানী লোক ভাবে আমাকে, সংসারটা বুক দিয়ে আগলে রাখে।

শ্রীধরের কথাগুলো কান খাড়া করে শোনার মুহূর্তে গোরার মাথায় প্রকৃত ধর্মের যে উজ্জ্বল ছক তৈরি হতে থাকল, তার মূল ভাষ্য হল, মানুষকে বিনয়ী হতে হবে, সহনশীল হতে হবে, চিরকাল ধরে যারা অবমাননা সহ্য করছে, তাদের সম্মান দিতে হবে, মনে রাখতে হবে সেই পরম গুণনিধিকে, যিনি যাবতীয় মানবিক বৃত্তির আকর। গোরার মাথাতে আরও অনেক ভাব, চিন্তা জেগে উঠলেও তা প্রকাশ করার ভাষা সে খুঁজে পাচ্ছিল না। খোঁজার মতো যথেষ্ট সময় পেল না।

শ্রীধর বলল, দাসীর মতো আমাকে সেবা করে আমার বিয়ে করা বউ। আমি এক চাকর, তার আবার বাঁদি, বোঝেন কাণ্ড!

গোরার চিৎশক্তিতে ঘা দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলছিল শ্রীধরের সাংসারিক বিন্যাসের খণ্ড ছবিগুলো। গোরা বলল, আমরা সবাই দাস, দাসের দাস।

অবাক হয়ে গোরার দিকে তাকিয়ে শ্রীধর জিজ্ঞেস করল, যে মালিকের আমরা দাস, তিনি কার দাস?

কথাটা গোরা ভেবে না বললেও নিজের বাচনের জালে জড়িয়ে পড়ে সে চুপ করে থাকল। উথালপাথাল চিন্তার ঢেউ উঠল তার মনের মধ্যে। তাকে নিশ্চুপ দেখে কিছু ভেবে শ্রীধর বলল, মামা, আপনি কোন দুঃখে দাস হতে যাবেন? আপনি কুলীন বামুন, আপনি দেবতা, গুরুর গুরু। আপনার পায়ের ধুলো আমরা মাথায় দিতে পেলে বর্তে যাই। দাস হলুম আমরা, দাসের দাস, শ্মশানের পিণ্ডিচাটা অগ্রদাণী বামুন।

মুচকি হেসে গোরা বলল, শ্রীধর, দাস মানে চাকর, আবার দাস অর্থে সেবকও। মানুষ মাত্রই ঈশ্বরের সেবক, সেই সেবককে যে সেবা করে সেও কম মহৎ সেবক নয়। ঈশ্বর যেহেতু ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাই ঈশ্বরজ্ঞানে তোমাকে সেবা করে তোমার বউ, ঈশ্বরের সৃষ্টি বিশ্বপ্রকৃতিরও সে সেবা করে, ঘরদোর ঝেড়ে মুছে, গোবরজলে নিকিয়ে ঈশ্বরের পৃথিবীকে পরিচ্ছন্ন রাখে, ভিটের সামনে ফুলগাছে জল ঢেলে দেবতার পুজোর ফুল ফোটায়, মালা গাঁথে। ঈশ্বর যেহেতু আমাদের ভালবাসার বস্তু, আমরা তাই ভালবাসার দাস, ভালবাসার সেবক। ঈশ্বরকে হাতের কাছে না পেয়ে ভালবাসার মানুষের সেবা করি, তুলসীতলায় জল দিই, হাঁড়িতে বাড়তি ভাত থাকলে কুকুর, বেড়াল, কাক, শালিককে খাওয়াই। তুই খাওয়াস বউকে। তোর বউ যেমন তোর দাসী, তুই আবার তেমনি বউ-এর দাস, একে অন্যের সেবা করিস, তাই সেবক।

চোখ গোল গোল করে শ্রীধর শুনছিল গোরার মুখ থেকে ঈশ্বরতত্ত্ব আর ভালবাসার ব্যাখ্যা। রোজ সকালে বাজারে সে থোড়, থোড়ের খোলা, মোচা, কলাপাতা বেচে। তার একজন খদ্দের গোরা। গাঁটে কড়ি না থাকলে ধারবাকিতে সে কেনাকাটা করে। দরদস্তুর করতেও কসুর করে না। দরকষাকষিতে দোকানি শ্রীধরও ওস্তাদ। নিজের জায়গা ছেড়ে দু’জনের কেউ একচুল নড়তে না চাওয়ায় হৈচৈ লেগে যায়। দু’জনের বচসা শুনতে তাদের ঘিরে হাটুরে লোকের ভিড় লেগে যায়। প্রায় রোজকার এই ঘটনা নবদ্বীপের ব্রাহ্মণপল্লীর বয়স্ক বিপ্রদের কানে গেলে তারা ক্রুদ্ধ হয়। নবদ্বীপের বাজার থেকে একাধিকবার ব্রাহ্মণসমাজে জল অচল শ্রীধরকে তারা উৎখাত করার বন্দোবস্ত করলেও গোরার জন্যে পেরে ওঠেনি। বাজারের ভেতরে সকলের সামনে শ্রীধরের সঙ্গে তুমুল ঝগড়াঝাটি করলেও আসলে সবটা যে সাজানো, নকল কলহ, আত্মাভিমানী প্রবীণ ব্রাহ্মণদের তা জানিয়ে গোরা তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিল। শ্রীধরের বাগানের থোড়, মোচার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল সে। রোজ শ্রীধরের থোড় কিনে এনে মায়ের হাতের রান্না থোড়ের তরকারি না খেলে তার পেট ভরে না, এ খবর দিতেও ভোলেনি। সমাজচ্যুত শ্রীধরের সঙ্গে তার এই মাখামাখি পাড়ার প্রবীণ ব্রাহ্মণরা নিদারুণ অপছন্দ করলেও সাহসের অভাবে নীরব ছিল। বৈদিক ব্রাহ্মণের আভিজাত্য, মানসম্মান, মৃত জগন্নাথের ছেলেটা ধূলিসাৎ করবে, এ নিয়ে তারা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। জাতিধর্মদূষিতকারী ব্রাহ্মণ পরিবারে এই কুলাঙ্গার সন্তান চৌপাঠি খুলে পণ্ডিত সেজে সেখানে বসতে, তাকে নবদ্বীপ থেকে তাড়াতে নৈয়ায়িক আর স্মার্ত ব্রাহ্মণরা গোপনে শলাপরামর্শ শুরু করে দিল। তাকে নবদ্বীপ ছাড়া করতে স্ব-বর্ণের শিখিধারীরা নিকট ভবিষ্যতে উঠে পড়ে লাগবে, এ নিয়ে গোরার সন্দেহ ছিল না। ভয় পাওয়ার পাত্র সে নয়। ভয় সে পায়নি। ন্যায়শাস্ত্রী, স্মার্ত পণ্ডিতদের ঝামেলা এড়াতে তাদের প্রতিপক্ষ বৈষ্ণব আখড়াতে আশ্রয় নেওয়ার চিন্তা মুহূর্তের জন্যে তার মাথায় আসেনি। প্রান্তিক অস্পৃশ্য মানুষের সঙ্গে শুধু বাড়ছিল তার যোগাযোগ। তাদের মধ্যে পাইক, বরকন্দাজের কাজ যারা করেছে, তাদের খুঁজে বার করছিল। তাদের যুদ্ধযাত্রার অভিজ্ঞতা শুনে সামাজিক জীবনের আলাদা প্রেক্ষাপট খুঁজে পাচ্ছিল। মনের মধ্যে কখনও বিষাদ, কখনও উদ্দীপ্ত ভাব জাগলেও প্রকৃত আলো দেখছিল না কোনওদিকে। শ্রীধর বা তার মতো দু’একজন অনুগামী বন্ধু ধর্মকথা শুনতে চাইলেও তাদের সঙ্গে আলোচনা বেশি দূর এগোত না। হতদরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ শ্রীধরকে দু’চার কথা বোঝানো গেলেও ব্রাহ্মণ ছাড়া ধর্মালোচনার অধিকার অন্য সম্প্রদায়ের ছিল না। ধর্ম বিষয়ে নবশাক, শূদ্রদের মুখ খোলার মতো পর্যাপ্ত বিদ্যের অভাব ছিল। যক্ষপূজা, শবরোৎসব, মদনপূজা, মনসার ভাসান, মঙ্গলচণ্ডীর গীত, বারোমাসে তেরো পার্বণ লেগে থাকলেও, সব পুজো অর্চনার শেষ কথা ছিল বিত্তসম্পত্তি, টাকা, সোনা দাও, সুন্দরী স্ত্রীলোক দাও, পঞ্চ ‘ম’ কার দাও, আরও দাও, আরও আরও দাও। ঈশ্বর হয়ে উঠেছিল পাওনা আদায়ের যন্ত্র, আখের রস নিংড়ে নেওয়ার মাড়াই কল। উচ্চবর্ণের এই ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের ছায়া অনুসরণ করছিল নিচের তলার বিভিন্ন সম্প্রদায়। তাদের কাছে ধর্ম ছিল সংস্কৃত ভাষার নিরর্থক কচকচি।

গোরার ধর্ম ব্যাখ্যাতে অস্বচ্ছতা থাকলেও ধর্মের ভেতরে গায়ে কাঁটা দেওয়া কিছু মর্ম আছে, শ্রীধরের মতো মানুষেরা টের পেত। বাইরে থেকে গোরাকে যত উচ্ছল, প্রাণচঞ্চল দেখাক, তার মাথার মধ্যে নানা ভাবনা জট পাকাচ্ছিল। রাজবৈদ্য মুকুন্দ সরকারের মুখে রাজা নীলাম্বরের মন্ত্রীর নারকীয় দুর্দশা, কুবেরের কাছে দেশজোড়া যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তপাতের কাহিনী শুনে মানসিকভাবে সে যেমন বেসামাল হয়েছিল, তেমনই নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কঠোর অনুশাসনও তাকে কিছুটা দুশ্চিন্তায় রেখেছিল। শ্রীধরের মতো অনুগামীদের প্রায়ই সে বলত, আমাদের সমাজ আমার চালচলনে ‘গুরুচণ্ডালী’ ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে। তাদের ধারণা ব্রাক্ষ্মণকুলে আমি চণ্ডাল, খুব তাড়াতাড়ি যবন হয়ে যাব। আমাকে নিয়ে এমন আরও কিছু কথা জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কেউ কেউ বলছে, যার দু’একটা আমার কানে এলেও মুখে বলা যায় না। আমি অন্তত বলতে পারব না।

গোরার ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে ভুঁইমালী সম্প্রদায়ের ষষ্ঠীধর বলল, তক্কোবাগীশ পণ্ডিত নাটের গুরু। আপন ঘাটে বুড়ো চতুর্ভুজ তক্কোবাগীশকে তার পাড়ার দু’তিনজন টিকিওলা, ফোকলা বামুনকে নিয়ে তোমার নামে কুচ্ছো করতে শুনেছি। আমাকে দেখে না দেখার ভান করে কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল।

ষষ্ঠীর কথা শুনে তর্কবাগীশকে ডোবাতে ছুতোরপাড়ার নকুড় যে কাণ্ডটা ঘটাতে চাইল, তা বিপজ্জনক হলেও গোরার বন্ধুরা চুপসারে সায় দিল সেই খেলাতে। গোরা তখন মাঝে মাঝে বায়ুরোগে আক্রান্ত হয়ে বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিল। অল্প বয়সে এই রোগে বেশ কিছুকাল ভুগে মাথায় বিষ্ণুতেল মেখে সেরে উঠেছিল। বিয়ের পরে দ্বিতীয়বার সেই ব্যাধি তার শরীরে জেঁকে বসতে একই ওষুধ বিষ্ণুতেল মাখার নিদান দিয়ে মুরারি কবিরাজ জানাল, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন কাটাতে হবে গোরাকে। যতটা হাসিখুশি থাকা যায়, তত ভালো, বায়ুরোগ থেকে দ্রুত আরোগ্য মিলবে। গোরাকে সুস্থ করে তুলতে তাকে নিয়ে তার বন্ধু অনুগামীদের রাস্তায় মজা মারার বহর বেড়ে গেল। তার মধ্যে চতুর্ভুজ তর্কবাগীশকে পূর্বাঙ্গণার ফাঁদে ফেলে শায়েস্তা করার ছক তৈরি করল গোরার দোসররা।

প্রাক্ সন্ধেতে দলবল নিয়ে গোরা গঙ্গার ধারে জুটে গল্পে, মস্করায় সময় কাটানোর সঙ্গে নিত্য নতুন ফাঁকি জিজ্ঞেস করে পণ্ডিতদের ঘোল খাওয়ানোর মজায় মেতে থাকত। পাশাপাশি চলত বৈষ্ণবদের ভয় দেখিয়ে দৌড় করানোর খেলা। দু’চারজন শ্রীহট্টিয় নবদ্বীপবাসী বয়স্ক মানুষকে হাতের কাছে পেয়ে গেলে, শ্রীহট্টের ভাষাভঙ্গি নকল করে বন্ধুদের সঙ্গে নাটুকে সংলাপ জুড়ে দিত। গোরার ফিচেলপনা বুঝতে প্রতিবেশী বৃদ্ধ শ্রীহট্টিয়দের অসুবিধে হত না। তার রঙ্গরসিকতায় চটে গিয়ে শ্রীহট্টিয়রা যত তর্জনগর্জন করত, সে অনুপাতে বর্ষাত না। গোঁড়া বৈষ্ণব কাউকে দেখলে গোরার ইঙ্গিতে তার কোনও সহচর চেঁচিয়ে উঠত, সিন্ধুকী আসছে, বৈষ্ণব ধরতে সুলতানের সিন্ধুকী (গুপ্তচর) আসছে।

সেই আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার আগে কপালে চন্দনের তিল আঁকা বৈষুববাবাজি চোঁ চোঁ দৌড় মেরে অদৃশ্য হয়ে যেত। গোরার এটাই ছিল সবচেয়ে আমোদের খেলা। রাস্তায় বৈষ্ণব ধরে তাদের এমন খোঁচা দিয়ে কথা বলত, যে দূর থেকে গোরাকে দেখলে তারা ভিন্ন পথে হাঁটা দিত। তর্কবাগীশকে শিক্ষা দিতে ফাল্গুন মাসের এক বিকেলে সহচরদের নিয়ে দারুণ দুঃসাহসী সেই কাণ্ডটা গোরা ঘটিয়ে দিল।

বারকোণা ঘাটে গোরার অপেক্ষায় সেই বিকেলে বসে থাকা তার বন্ধুরা পথের অদূরে কোমরে সোনার ঘুঙুর লাগানো নীবিবন্ধ, শরীরে জড়ানো পৌরাণিক পালার ছবি আঁকা ওড়না, আমলকি দিয়ে ধোয়া ঘন কালো চুলে দেবমহল খোঁপা, কানে মদনকড়ি, কানপাশা, গলায় চন্দ্রাবলী হার, গ্রীবাপত্র, দু’পায়ের ছ’আঙুলে চুটকির মতো উজ্ঝটিকা, ঠোঁটে মোহিনী হাসি, সুসজ্জিতা, সালঙ্কারা যে সুন্দরী ঢেউ-এর মতো হেঁটে যাচ্ছিল, তাকে দেখে ঘাটের ছেলে-ছোকরাদের মাথা ঘুরে গেলেও বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ভরসা পেল না। কয়েক মুহূর্ত নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হল। ডানাকাটা পরীর মতো রূপবতী সেই তরুণীকে প্রায় বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে চতুর্ভুজ তর্কবাগীশের সুপ্রৌঢ়া গৃহিণী। ঝগড়ুটে বুড়ি বলতে যা বোঝায়, তর্কবাগীশ গৃহিণী তাই। ঝগড়ুটে আর দজ্জাল দুই-ই। নবদ্বীপের উঠতি বয়সের ছেলেরা তাকে চেনে, মুখে ‘ঠাকুমা’, ‘দিদিমা’ বললেও তার কাছে ঘেঁষে না। বাড়িতে এক ঝাঁক সুন্দরী কচি নাতনি থাকায় পথেঘাটে জোয়ান ছেলে দেখলে তাকে লম্পট ভেবে নেয় তর্কবাগীশ গিন্নি। অথচ রাস্তায় সুন্দরী মেয়ে দেখলে, তার কুলপরিচয়ের খবরাখবর চালাচালির ছুতো ধরে প্রায় জোর করে তাকে ধরে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে। উদ্দেশ্য মহৎ। তর্কবাগীশ পরিবারে পুত্রবধূ অথবা নাতবউ করে মেয়েটিকে আনতে চায় সে। মেয়েটার কানের কাছে গুজগুজ, ফুসফুস করে সেই মর্মে তাকে ভজায়। তর্কবাগীশ পরিবারে সাত ছেলে বিয়ে নিয়ে কয়েক বছর ধরে এমন এক কুলাপবাদ চেপে রয়েছে, যার জেরে তার দু’ছেলে আজও অবিবাহিত থেকে গেছে। তাদের জন্যে উপযুক্ত ব্রাহ্মণকন্যা মিলছে না। পরিবারের পঞ্চম পুত্রের বিয়ের আগে ষষ্ঠ পুত্র বিয়ে করে নেওয়াতে এই দুর্ভোগ ঘটে। নবদ্বীপের কোনও কুলীন ব্রাক্ষ্মণ পরিবারের কর্তা, চতুর্ভুজের সংসারে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি নয়। বিবাহিত ছেলেদের পুত্রসন্তানদের বয়স এদিকে বেড়ে যাচ্ছে। বিয়ের বয়সে পৌঁছে গিয়ে কেউ কেউ স্ত্রীরত্ন ঘরে আনতে উসখুস করলেও দুই কাকার অবরোধে আটকে গিয়ে শুভ পরিণয়ের পিঁড়িতে বসার সুযোগ পাচ্ছে না। পুত্রবধূর সঙ্গে নাতবউ খোঁজার কাজও অবশ্য তর্কবাগীশ পরিবারের বুড়ি গিন্নি শুরু করে দিয়েছে। কার কপাল আগে খুলবে কেউ জানে না।

রূপসী মেয়েটাকে নিয়ে তর্কবাগীশগিন্নি এখন বাড়িতে ঢুকলে পরিবারের মেয়েমহলে যে হুল্লোড় পড়ে যাবে, বারকোণা ঘাটে ফুরফুরে হাওয়ায়, গুলতানিতে মেতে ওঠা গোরার বন্ধুরা তা জানে। তরুণীকে ঘিরে ধরবে পরিবারের মেয়েরা। মেয়েদের সেই ভিড়ের মধ্যে তর্কবাগীশ পরিবারের সবচেয়ে সুন্দরী, চোদ্দ বছরের যে মেয়েটি, নাম ফুলমালা, চতুর্ভুজের নাতনি, তার চোখে চোখ রেখে নবাগতা নিশ্চয় ঠোঁট টিপে হাসবে। দু’চোখের চাহনিতে কিছু একটা বার্তা পৌঁছে দেবে। চোদ্দ বছরের কিশোরী কি বুঝবে সেই বার্তা? সে না বুঝলেও অচেনা রূপসীর হাস্য, লাস্য, কটাক্ষে তার গায়ে কাঁটা দেবে। মেয়েমহলের বাইরে, আড়াল থেকে চতুৰ্ভুজ অবশ্যই লুকিয়ে নজর করবে গিন্নির নবতম সংগ্রহ সুসজ্জিতা, সালঙ্কারা তরুণীকে। যুবক বয়সের দিনগুলোর স্মৃতি তাকে উৎপীড়িত, এমনকি উত্তেজিত করতে পারে।

বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে হওয়ার আগে বারকোণা ঘাটের পথে সেই রূপসীকে ফের যখন দেখা গেল, গঙ্গার তীরে স্নানার্থীর ভিড় নেই। হাটুরে মানুষের যাতায়াত কমে গেছে। সুসজ্জিতা তরুণীর পাশে তর্কবাগীশের বুড়ি গৃহিণীর বদলে রয়েছে স্বয়ং গৃহকর্তা, চতুর্ভুজ। মেয়েটিকে ঘরে পৌঁছানোর দায়িত্ব পরিবারের কাছ থেকে সে নিজে নিয়েছে। ঘটনাস্রোতের ছবি গোরা যেভাবে কল্পনা করেছিল, সেভাবে ঘটছে। এখন শেষ রক্ষা করার ভার ষষ্ঠীপদ, নকুড়, শ্রীধর, ভোলানাথ আর বাকি বন্ধুদের। বারকোণা ঘাট ছেড়ে কিছুটা দূরে, পথ যেখানে নির্জন সেখানে হঠাৎ মাটিফুঁড়ে যে ছেলেরা বেরিয়ে এল, তাদের কারও মুখ চতুর্ভুজের অচেনা নয়। তারা টিপটিপ করে চতুর্ভুজকে প্রণাম করতে বয়স্ক মানুষটা কিছুটা ভয়, কিছু সঙ্কোচে জিজ্ঞেস করল, তোরা এখানে কী করছিস?

—গাদিগাছায় নীলের মেলা দেখে ফিরছি।

—গঙ্গার ঘাটে তোদের যে একটু আগে দেখলুম।

—আমাদের নয়, বোধহয় আমাদের বন্ধুদের দেখেছেন দাদামশাই।

শ্রীধরের কথা শুনে চতুর্ভুজ ঈষৎ দমে গেল। মনে হল, তেমন হতেও পারে। ভুল দেখেছে সে। এখনও যাদের দেখছে, তারা বাদ দিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে কয়েকজন রয়েছে। তাদের দেখা না গেলেও উপস্থিতি অনুমান করা যায়। পাশে দাঁড়ানো সুন্দরীর মুখে হাসি, চোখের বাঁকা ভ্রুতে প্রাণঘাতী দৃষ্টি। নকুড় জিজ্ঞেস করল, কোথায় চললেন দাদামশাই?

তর্কবাগীশ কিছু বলার আগে তার সঙ্গিনী বলল, পানশিলা। সেখানেই আমার ঘর। আমি কচিবেলা থেকে এই দাদামশাইকে চিনি। প্রায়ই আমার মাসির ঘরে যেতেন।

ভরসন্ধেতে দেহোপজীবিনীপল্লী পানশিলার নাম শুনে চতুর্ভুজ চমকে গেল। পল্লীটা তার চেনা, যুবা বয়সে রীতিমতো যাতায়াত ছিল। তর্কবাগীশ চলেছে শুনে ছেলের দল প্রায় রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পানশিলা শব্দটা চাপা গলায় বারবার বলতে থাকল। পানশিলার আধাগেরস্থ মেয়েটাকে শ্রীধর জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

ইলাচি।

মেয়েটা নিজের নাম জানিয়ে যোগ করল, আমার মাসির নাম লবঙ্গলতা। কাঁচা বয়সে সে যে কী সুন্দরী ছিল, এই দাদামশাই তা জানে। বামুনপাড়ার অনেকে, যাদের পানশিলায় যাতায়াত ছিল, সকলে জানে।

হাসিতে মেয়েটা ঢলে পড়ছিল চতুর্ভুজের গায়ে। রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তাদের কেউ কেউ ‘পানশিলা’ নামটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ছিল, অবাক হয়ে দেখছিল তর্কবাগীশের বুকের ওপর হাস্যময়ী এক সুন্দরীর গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য।

যথেষ্ট ভীত তর্কবাগীশ বলছিল, কী হচ্ছে এসব? আমাকে যেতে দাও।

তরুণী বলল, দাদামশাই, আমাকে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল আপনার। মাঝ রাস্তায় আমাকে ফেলে আপনি চলে গেলে ভারি মুশকিল হবে আমার। আমি একা ঘরে ফিরলে মাসি কেলেঙ্কারি করবে। সব শুনে আপনার বাড়িতে দিদিমার কাছে মাসি চলে আসতে পারে।

এক মুহূর্ত থেমে মেয়েটি ফের বলল, পানশিলার পথও সন্ধের পর মাতাল, বজ্জাতে ভরে যায়। তাদের কেউ আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে, যদি গুম-খুন করে?

ষষ্ঠীপদ, শ্রীধরের দিকে তর্কবাগীশ যখন অসহায়ের মতো তাকাচ্ছে, নকুড় বলল, দাদামশাই, একটা শর্তে এলাচিকে পানশিলায় আমরা পৌঁছে দিতে পারি।

কী শর্ত?

আমাদের বন্ধু এই ভোলানাথ, শ্রীগোপাল বিদ্যারত্নের ছেলে, ওরাঁ বারেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণ বংশ, আপনি জানেন। ভোলানাথের সঙ্গে আপনার নাতনি ফুলমালার বিয়ে দিতে হবে।

কাঁপা গলায় চতুৰ্ভুজ বলল, এ এমন কি কঠিন কথা? ভোলানাথের বাবা শ্রীগোপাল, তার বাবা মথুরনাথ, সকলকে চিনি। ফুলমালার সঙ্গে ভোলানাথের বিয়েতে আমি রাজি।

কথা দিচ্ছেন?

পৈতে ছুঁয়ে বলছি।

চাদরের আড়াল থেকে উপবীত বার করে হাতে ধরে থাকল তর্কবাগীশ। নকুড় বলল, দাদামশাই, কথা না রাখলে কিন্তু এলাচির মাসিকে ডেকে আনব, পৌঁছে দেব আপনার বাড়িতে।

এলাচি বলল, মাসি এলে তার সঙ্গে আমিও আসব।

চতুর্ভুজ তর্কবাগীশ বলল, সেরকম কিছু ঘটবে না। আমাকে এখন যেতে দাও। পথচলতি লোকজন দেখছে আমাকে।

চেনা ছেলেগুলোর বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এসে চতুর্ভুজ আচমকা এলাচির ডান হাতটা নিজের দু’হাতে ধরে বলল, বাছা গোরা, তুমি বাঁচিয়ে দিলে আমাকে। অবিবাহিত দুই ছেলের বিয়ে দিতে বিয়ের যোগ্য নাতিদের জন্যে পাত্রীর খোঁজে এত ব্যতিব্যস্ত ছিলুম যে যোগ্য ব্ৰাহ্মণ পরিবারে নাতনিদের কাউকে বিয়ে দিয়ে কুলাপবাদ কাটানো যায়, মাথায় আসেনি। তুমি পথ দেখালে আমাকে। ভোলানাথের বাবা, শ্রীগোপালের কাছে কাল সকালেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব আম। প্রস্তাব, শ্রীগোপালের কাছ থেকে এলেও আমি বর্তে যেতুম। খেলার ছলে বড় একটা কাজ তুমি করে ফেলেছ। কলঙ্কমুক্ত হতে সুযোগ করে দিয়েছ আমার পরিবারকে। বাড়ি গিয়ে তার কাছ থেকে ভোলানাথকে ভিক্ষা চাইব। বলব, তোমার ছেলেকে আমি নাতজামাই করতে চাই।

এলাচিরূপিণী আঠারো বছরের গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে আশি ছুইছুই চতুর্ভুজের দু’চোখ দিয়ে জল ঝরছিল। বুড়ো মানুষটাকে কাঁদতে দেখে শ্রীধর, নকুড়, ষষ্ঠী কিছু দূরে আমগাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়ানো ভোলানাথের চোখে পর্যন্ত জল এসে গিয়েছিল। পুব আকাশে তখন জ্বল জ্বল করছিল রাতের প্রথম প্রহরের শুকতারা।

চতুর্ভুজ তর্কবাগীশ বাড়ির পথে রওনা হতে বন্ধুদের বারকোণা ঘাটে অপেক্ষা করতে বলে গোরা বাড়ি গেল পোশাক বদলাতে। আধঘণ্টার মধ্যে ঘাটে ফিরল সে। ঘাটের পাশে অশ্বত্থতলায় বন্ধুরা বসে ছিল তার জন্যে। তার তৈরি নাটকের শেষ দৃশ্য বৃদ্ধ চতুর্ভুজের মুঠোয় চলে যাবে, আগে থেকে কেউ না ভাবলেও নানা কথার মধ্যে গোরা জানাল, এমন যে ঘটতে পারে, তার ধারণায় ছিল। বন্ধুরা কোনও প্রশ্ন করার আগে গোরা প্রথমে বন্ধুদের যার যার কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কার নিয়েছিল, এক এক করে ফেরৎ দিল। তর্কবাগীশের বাড়িতে মেয়েমহলে তাকে দেখে সোরগোল পড়ে যাওয়ার সঙ্গে আর কি ঘটেছিল, গোরা বিশদে জানাল। তাকে একবার দেখেই সে যে ভোলানাথের বিয়ের ঘটকালিতে এসেছে, সে গোরা, জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে, ফুলমালা বুঝে গিয়েছিল। গঙ্গার ঘাটে ভোলানাথের সঙ্গে তার বহুবার চোখাচোখি হলেও দু’জোড়া হাতের কবে মেলবন্ধন হবে, আদৌ হবে কি না, এ সংশয় ফুলমালার ছিল। রঙ্গমঞ্চে গোরা ঢুকতে ফুলমালা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। গোরা যখন ঘটকালির দায়িত্ব নিয়েছে, ভোলানাথের সঙ্গে তার বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না। গোরার মুখের ওপর বারবার সলজ্জ প্রত্যাশার করুণ দৃষ্টি রেখে ফুলমালা সরিয়ে নিচ্ছিল। বাড়িতে লক্ষ্মীকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে, তার পরামর্শ মেনে দৃষ্টিবিনিন্দিত স্ত্রীলোকে রূপসজ্জা নেওয়ার সময়ে যে ত্রুটি ঘটে গেছে তর্কবাগীশ পরিবারে মেয়েদের দঙ্গলে বসে গোরা টের পাচ্ছিল। কাঁচুলির নিচে, বুকের দু’পাশে বসানো নারকোলের মালাদুটো যথাস্থানে, সরলরেখায় থাকছে না। শরীরের সামান্য নড়াচড়ায় বাঁদিকের নারকোলমালা ঈষৎ নেমে যাওয়ার সঙ্গে ডানদিকেরটা কয়েক সুতো ওপরে উঠে যাচ্ছিল। ফুলমালার পাশে বসে তাকে আশ্বস্ত করার চিন্তা মাথায় থাকলেও সেই গোলমেলে পরিস্থিতিতে নতুন কোনও ঝুঁকি না নিয়ে তর্কবাগীশ-গৃহিণীর গা ঘেঁষে সে বসে গিয়েছিল। তার পাঠানো বার্তা ফুলমালা বুঝে গেছে এমন আন্দাজও সে পেয়ে গিয়েছিল। কাজটা শেষ পর্যন্ত এত সহজে উদ্ধার হবে, ভোলানাথের সঙ্গে ফুলমালার বিয়ে দিতে তর্কবাগীশ দাদামশাই রাজি হয়ে যাবে গোরা ভাবতে পারেনি।

গোরার গা-ঘেঁষে ভোলানাথ বসেছিল। সে বলল, তোমাদের সবাইকে এখন ময়রার দোকানে নিয়ে গিয়ে নাড়ু, তক্তি, চন্দ্রপুলি খাওয়াব।

গোরা বলল, তাম্বুলির দোকান থেকে আমার জন্যে কাঁচা সুপুরি দিয়ে একটা পান এনো। মিষ্টি খাব না।

—কেন?

—পেট ভরে বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।

গোরা খাবে না শুনে ময়রার দোকানে ভোলানাথের যাওয়ার আগ্রহ কমে গেল। তার গা এলানো ভাব দেখে তাকে প্রায় ঠেলে মিষ্টি কিনতে পাঠাল গোরা। সে ভরপেট খেয়ে আসার জন্যে বন্ধুরা মিষ্টান্ন থেকে বঞ্চিত হবে, এটা তার পছন্দ নয়। সে বলল, বাড়িতে চেটেপুটে খাওয়ার পরে এক খিলি পান খেতে বেশ লাগে। চুন, খয়ের, কাঁচা সুপুরি, এলাচ, লবঙ্গ দিয়ে নরম এক খিলি পান চিবোলে ঢুলুঢুলু ভাব আসে! মাথার ভেতরে ঝিমঝিম করতে থাকে, ঘুম পেয়ে যায়।

উপবীত নেওয়ার দিন আস্ত একটা কাঁচা সুপুরি খেয়ে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার পর থেকে যে পানের নেশা তাকে পেয়ে বসেছে, এ খবর দিতেও সে ভুলল না। কাঁচা সুপুরি খাওয়ার জন্যে তাকে বায়ুরোগ ধরেছে, দু-একজন কবিরাজ এমন অভিমত দিলেও গোরা তা মানে না।

শ্রীধর জানাল, কাঁচা সুপুরি খেয়ে বায়ুরোগে ভুগছে এরকম দু’জনকে সে চেনে। তার ধারণা কাঁচা সুপুরিই বায়ুরোগের কারণ।

নিচু গলায় গোরা জানাল, শ্রীধরের ধারণা নির্ভুল। তবে সে যতদিন কাঁচা সুপুরি দিয়ে পান খাবে, পাঁচজনের সামনে কথাটা তার মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সে পাপী হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানপাপী নয়!

অনেকগুলো তরুণ গলার হাসির আওয়াজ অন্ধকার গঙ্গার ধারে বাতাসে যখন ছড়িয়ে পড়ছে, শালপাতার ঠোঙায় ক্ষীরের তক্তি, দুধনারকোলের চন্দ্রপুলি নিয়ে ভোলানাথ ফিরল তার পাশে কলাপাতা জড়ানো পানের খিলি হাতে নকুড়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *