গোরা – ২৯

২৯

সাতপ্রহরিয়া মহোৎসবের তৃতীয় দিনে, মানে শেষ দিনে ঠিক হয়ে গিয়েছিল এক পক্ষকাল পরে সঙ্কীর্তনবিরোধী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গোরার নেতৃত্বে তার অনুগামীরা মৃদঙ্গ, মন্দিরা, করতাল, মাদল, পাখোয়াজ নিয়ে নগরপরিক্রমায় বেরোবে। পথসঙ্কীর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারি করার অধিকার কাজির নেই, সদলে পথে নেমে কাজিকে তা জানিয়ে দেওয়া হবে। নগরসঙ্কীর্তনের দিনটা স্পষ্ট করে বৈষ্ণবদের সকলে না জানলেও গোরা, নিতাই, অদ্বৈত, শ্রীবাস, হরিদাস, গদাধরের অজানা ছিল না। মহোৎসবের প্রথম দিনে প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনুষ্ঠানে কিছুটা বিপত্তি ঘটলেও পরের দু’দিন আকাশে ঝলমলে রোদ ওঠার পরে সঙ্কীর্তনের মণ্ডপে যে বিপুল জনসমাগম ঘটেছিল, তা দেখে যাদের বোঝার তারা বুঝে গিয়েছিল, নগরসঙ্কীর্তনের ডাক পেলে নবদ্বীপের পথে মানুষের ঢল নামবে। ভক্ত বৈষুব ব্রাহ্মণদের সঙ্গে শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাক, এমনকি যবনরাও মৃদঙ্গ করতাল নিয়ে পথপরিক্রমায় পা মেলাবে মহোৎসবের আসরে খোল করতাল নিয়ে সম্প্রদায়ের মানুষের ভিড় দেখে গোরা আর তার অনুগামীরা কী ঘটতে চলেছে, বুঝে গিয়েছিল।

মহোৎসবের দ্বিতীয় দিনে ঝকঝকে রোদে ভাসন্ত নীল আকাশ দিয়ে যে সকাল শুরু হয়েছিল, সূর্যাস্তের পরে তা শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নার আলো, অসংখ্য তারায় রূপকথার রাতের মতো চোখজুড়োনো সৌন্দর্যে ভরে গিয়েছিল। স্বপ্নের দেশ মনে হচ্ছিল নবদ্বীপ নগরকে। নির্মেঘ রাতের আকাশে ছায়াপথ ধরে স্বর্গের বৈকুণ্ঠধাম পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিল বৈষুব ভক্তরা। সঙ্কীর্তনের আসরে প্রথমদিনের দ্বিগুণ ভিড় হয়েছিল দ্বিতীয় দিনে। তৃতীয় দিনের জনসমাবেশে শ্রীবাসের আঙিনায়, মণ্ডপে, সদরের বাইরে, রাস্তায়, বাগানে তিলধারণের জায়গা ছিল না। কোথা থেকে এত মানুষ এল, গোরা ছাড়া কেউ জানত না। সঙ্কীর্তনকারীদের মধ্যে জাতপাতের বাছবিচার ছিল না। শিশুকাল থেকে গয়া যাওয়ার আগে পর্যন্ত নবদ্বীপের পাড়ায় পাড়ায় টংটং করে গোরা ঘুরত। কুলশীল উপেক্ষা করে অব্রাক্ষ্মণ যত গৃহস্থের বাড়িতে গেছে, হাত বাড়িয়ে খাবার চেয়ে খেয়েছে, চরম অশাস্ত্রীয় হলেও লোহার বাসনে জল খেয়েছে, তারা যে কেউ তাকে ছেড়ে যায়নি, আপনজনের মতো পাশে রয়েছে, মহোৎসবের তিন দিনে গোরা জেনে গেল। সে অনুভব করল সে একা নয়, তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। দাদা, বিশ্বরূপের পুঁথির ভাষ্য অনুযায়ী সে পিতৃপরিচয়হীন, যশোদানন্দন কৃষ্ণের মতো সে শচীর ছেলে। ঈশ্বরের মতো সে অপৌরুষেয়।

মহোৎসবের শেষ সন্ধেতে শ্রীবাসের আঙিনায় কাদামাটি খেলেছিল বৈষ্ণব ভক্তজন। গয়া থেকে গোরা ফিরে আসার পরে রাসপূর্ণিমার রাতে শ্রীবাসের বাড়ির উঠোন থেকে চালু হয়েছিল কাদামাটি খেলা। সে রাতে বাড়ির উঠোনে সঙ্কীর্তনের শেষে, কয়েক’শ কলসি গঙ্গার জল ঢেলে কর্দমাক্ত আঙিনায় ভক্তবৈষ্ণবরা গড়াগড়ি খেয়েছিল অনেকক্ষণ। বৈষ্ণব গায়ক আর ভক্তদের পায়ের ধুলো গায়ে মেখে পবিত্র হয়েছিল। কাদামাটি খেলার আগে গায়ের উড়ুনি খুলে দাওয়ায় রেখেছিল। গাঁয়ের শবরোৎসবে শরীরে কাদা মেখে তাদের নাচগান করতে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বৈষ্ণবসমাজে কাদামাটি খেলার পত্তন করেছিল গোরা। চন্দনবাটার মতো কৃষ্ণভক্তের পায়ের ধুলো সমান পবিত্র, শবরোৎসব থেকে এ বার্তা সে পেয়েছিল। তিনদিন, তিন রাতের সাতপ্রহরিয়া অনুষ্ঠানে নাচ গানে বিভোর কয়েক’শ কীর্তনিয়া, দোহার, নাচিয়ের পায়ের চাপে আঙিনার মাটি ভেঙে গোড়ালিডুব ধুলো জমে গিয়েছিল। বাড়ির আনাচকানাচ, মন্দিরের চাতালে ধুলোর সর পড়েছিল। হাওয়ায় নানা স্তরে উড়ন্ত সেই ধুলোর কুণ্ডলিকে ধোঁয়ার মতো দেখাচ্ছিল সদরের পথ থেকে। সঙ্কীর্তনের শেষে হাল টানা জমির মতো সেই আঙিনায় কত কলসি জল ঢালা হল, তার হিসেব নেই। কাদার সমুদ্র তৈরি হল সেখানে। কাদার মধ্যে গোরা পা রাখতে শুরু হল কাদামাটি খেলা। কাদার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ফুলিয়া, কুলীনগ্রাম, শ্রীখণ্ড আর নানা অঞ্চলের ভক্তরা। কাদামাটিতে গড়াগড়ি দেওয়ার সঙ্গে একে অপরের গায়ে, মুখে ফাগ আবিরের মতো কাদা মাখাচ্ছিল। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মাটির ভাঁড়ে, মালসায় পবিত্র সেই মাটি তুলে রাখছিল অনেকে। কাদামাটি খেলে সকলের চেহারা হয়েছিল ভূতের মতো। কাউকে চেনা যাচ্ছিল না। প্রবল হরিধ্বনির মধ্যে অদ্বৈতকে কাঁধে তুলে নিয়ে নিতাই নাচতে থাকল। খেলা শেষ হতে হৈ হৈ করে সবাই গঙ্গার ঘাটে গেল চান করতে। গঙ্গার ঘাটে তাদের তুলসির মালা দিয়ে আপ্যায়ন করল জগাই-মাধাই—নবদ্বীপের দুই সদ্যদীক্ষিত বৈষ্ণব কোটাল। কাদায় ছোপানো ধুতি কেচে, চান সেরে, পরিষ্কার কাপড়ে শরীর ঢেকে কয়েক’শ ভক্তের শ্রীবাসের বাড়ি ফিরে আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেল। নদী, পুকুরে চানে গেলে নদীমাতৃক জনপদের মানুষের একটু বেশি সময় লাগে। জলে দুটো ডুব দিয়ে তারা চান সেরে উঠে আসতে পারে না। জলে কিছুক্ষণ ঝাঁপাই জুড়ে, সাঁতার কেটে চান করে আনন্দ পায়। দল বেঁধে চানে গেলে তো কথাই নেই। মাঝবয়সিরা পর্যন্ত একে আর একজনের মুখে চোখে জল ছিটিয়ে মজা করে, এক চক্কর সাঁতার কেটে তারপর টুপটুপ করে পাঁচ ছটা ডুব দিয়ে চান শেষ করে।

গঙ্গার ঘাট থেকে ফেরার আগে শ্রীবাসের বাড়ির দাওয়ায়, বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে ভক্তদের জন্যে তালপাতার আসন, জলে ধোয়া সবুজ আঙটপাতা পেতে রাখা হয়েছিল। তাদের ফলারের চিঁড়ে, দই, কলা, বাতাসা পরিবেশন করতে তৈরি ছিল কিছু ভক্ত। তারা কাদামাটি খেলেনি। নবদ্বীপের বাইরে থেকে আসা ভক্তরা বিদায় নিলে তারা কাদামাটি খেলবে। তাদের বেশিরভাগ শ্রীবাসের পরিবারের মানুষ। চিঁড়ে, দই, চাঁপাকলা, বাতাসা, মুড়কি মেখে পংক্তিভোজনে বসে সবাই হুপহাপ শব্দ করে খাচ্ছিল। মাঝে মাঝে হরিবোল আওয়াজ তুলে মেতে উঠছিল আনন্দে। গোরা দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াচ্ছিল তাদের। কার পাতে কী লাগবে, নজর রাখছিল। আকণ্ঠ খেয়েছে এমন ভক্তকে জোর করে ফলার মাখাচ্ছিল সে। উত্তেজনা, আবেগে টগবগ করে ফুটছিল সবাই। ফলার খাওয়ার মধ্যে ভক্তদের চোখ ছিল গোরার দিকে। গোরা যে ঈশ্বরের অবতার, এ নিয়ে তাদের সংশয় ছিল না। গোরাকে দেখলে তাদের বুক ভরে যায়, চোখে জল আসে, নিজেদের ঘরসংসারের কথা মনে থাকে না। অথচ মানুষটা নিজেকে ঈশ্বর ভাবে না, সাধারণ মানুষের একজন মনে করে, কৃষ্ণের সেবক ভাবে নিজেকে। ঈশ্বরের আসনে তাকে কেউ বসালে সে চটে যায়। বলে, আমাকে দ্বিতীয়বার এ কথা ব’লো না, আমি সে নই, তিনি আমার। তিনি আমার বাপ, আমি তার সেবক

অদ্বৈত, শ্রীবাসের মতো ভক্তরা পর্যন্ত গোরার কথা শুনে চুপ করে যায়। সাধারণ ভক্তরা টু শব্দ করে না। তবু নিজেদের বিশ্বাস ছেড়ে কেউ নড়ে না। সঙ্কীর্তনের আসরে, ভাগবত পাঠের অনুষ্ঠানে, আরও নানা উপলক্ষে ভাবাবিষ্ট গোরার শরীর থেকে যে আলো বেরোয়, এমন সব কথা সে বলতে থাকে, যা দিব্যদৃষ্টি ছাড়া বলা যায় না। স্বর্গ মর্ত্য পাতালের সব খবর তখন মুঠোয় পুরে ফেলে সে। ভাবাবেশ কেটে গেলে লজ্জিত হয়। আবেশের সময়ে বলা কথাগুলো অনুগামীদের ভুলে যেতে অনুরোধ করে। অবতারের মুখ থেকে উচ্চারিত কথা কি ভোলা যায়? বিশ্বচরাচরে কোথায় কী ঘটছে, তার ধারাবিবরণ শোনায়। প্রবল জোয়ারে নৌকোসমেত গঙ্গায় নরহরি ভেসে চলেছে, এক সন্ধেতে ভাবাবিষ্ট গোরার মুখ থেকে এ সংবাদ সঙ্কীর্তনের আসরে নিতাই, গদাধর অন্য ভক্তরা শুনে তখনই গঙ্গার ঘাটে ছুটে গিয়েছিল। দু’তিনজন মাঝি গঙ্গা থেকে প্রায় বেহুঁশ নরহরিকে তুলে এনে কয়েক মুহূর্ত আগে চাতালে শুইয়ে দিয়েছিল। ঘাট থেকে নরহরিকে ধরাধরি করে ভক্তরা নিয়ে এসেছিল শ্রীবাসের বাড়িতে।

রোজই এরকম কাণ্ড একাধিকবার ঘটে। ভাবাবেশ ছেড়ে গোরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে সব ভুলে যায়। সত্যি কি ভুলে যায়? গোরার মুখ দেখে কিছু বোঝা না গেলেও কেউ প্রশ্ন করতে সাহস পায় না।

অনুগামীদের ফলার খাওয়ার তদারক করছে গোরা। চেটেপুটে যারা ফলার খাচ্ছে, তাদের কারও মুখে হাসি, কারও চোখে জল, কেউ কেউ খুনসুটি করছিল নিজেদের মধ্যে। আনন্দে ডুবে আছে সবাই। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে এত মানুষ আছে, তাদের বুকে এত ভালবাসা আছে, সহোদর ভাই-এর মতো তারা আপন; নিজেরা বৈষ্ণব হলেও তা আগে জানত না। সঙ্ঘশক্তির স্বাদ পেয়ে সেই সন্ধেতে তারা আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। কাজির ভয়ে কিছুদিন ধরে যারা কীর্তন বন্ধ করে সন্ধের পরে ঘরের কপাট আটকে বসে থাকত, শ্রীবাসের বাড়িতে একটানা তিনদিন তিন রাত নির্ঝঞ্ঝাটে সাতপ্রহরিয়া সঙ্কীর্তন মহোৎসব শেষ করে তারা সাহস ফিরে পেল। সবটাই গোরার মহিমা, তাদের এই বিশ্বাস গভীর হল। গোরাকে আঁকড়ে ধরে তাদের আত্মবিশ্বাস মজবুত হল। নিজেরা কমজোরি নয়, অনুভব করে তারা একে আর একজনের সঙ্গে কোলাকুলি করতে থাকল। কোলাকুলি যে প্রীতির প্রকাশ, গোরাই শিখিয়েছে তাদের। কোলাকুলি করলে হৃদয় প্রশস্ত হয়, মনে আনন্দ ফিরে আসে, মানুষের অবলম্বন যে মানুষ, এই বিশ্বাস সুদৃঢ় হয়। কৃষ্ণও নাকি তার সখা সুদাম, সুবল, শ্রীদামের সঙ্গে আনন্দের মুহূর্তেও কোলাকুলি করত। কৃষ্ণের সম্পর্কে গোরা কিছু বলতে শুরু করলে দিব্য আলোয় ঝলমল করতে থাকে তার মুখ। তখন সে কৃষ্ণের অবতার, না স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, এ প্রশ্ন নিয়ে ভক্তরা মাথা ঘামায় না। ঈশ্বরের সন্তানও ঈশ্বর, গোরাও তাই, দু’ভাবেই অনুগামীরা মেনে নেয় তাকে, মাথার ওপর গোরা থাকলে বিশ্বসংসারের কোনও কাজ অসাধ্য নয়, ভক্তদের মনের গভীরে চারিয়ে গেছে এই বিশ্বাসের শেকড়। অদৃশ্য শেকড়ের সঙ্গে বেড়ে উঠছে আস্থার দৃশ্যমান মহীরুহ। নবদ্বীপের পথে মহামিছিলের নির্ধারিত তারিখ তখনও ভক্তরা স্পষ্ট না জানলেও যে যার এলাকা থেকে আত্মীয় বন্ধু প্রতিবেশীদের উজাড় করে পথসঙ্কীর্তনে আসবে, শ্রীবাসের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রত্যেকে প্রতিশ্রুতি দিল। মানবজীবন সফল করার মতো কাজ পেয়েছে তারা। কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে গোরা। যাগযজ্ঞ, পুজোপাঠ না করেও কীভাবে ব্রাহ্মণের সম্মান পাওয়া যায়, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা যায়, সে পথ গোরা দেখিয়ে দিয়েছে। শুধু কৃষ্ণ ভজনা, কৃষ্ণ চিন্তা করে যে কেউ ব্রাহ্মণত্ব পেতে পারে। সঙ্কীর্তনের আসর থেকে নবদ্বীপ আর আশপাশের অঞ্চলে মুখে মুখে একটা ডাক ফিরতে থাকল, চলো নবদ্বীপ। ডাক পাঠিয়েছে পথের মালিক, গোরা রায় কবে যেতে হবে?

কেউ জিজ্ঞেস করলে মিছিলের সংগঠক বলছে, দু’একদিনের মধ্যে জানতে পারবে।

কথাটা যে শুনছে সে-ও আশ্বাস দিচ্ছে অন্যকে, ঠিক সময়ে জেনে যাবে তারিখটা।

তারিখটা জানা না থাকলেও নবদ্বীপে যাওয়ার হাঁকটা শূদ্র, ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। তাদের কাছে কৃষ্ণাবতার কিংবা স্বয়ং ভগবানের চেয়ে গোরা বড় মাপের মানুষ নয়, মানুষের মতো মানুষ সে। মহোৎসব শেষ হওয়ার পনেরো দিনের মধ্যে নগরপরিক্রমার দিনটা নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ফুলিয়া, শ্রীখণ্ড কুলীনগ্রামের বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে গেল। তাদের সূত্রে ছড়িয়ে যেতে থাকল সমাজের নিচের স্তরের সব অংশে। পক্ষকালের বদলে মহামিছিলের দিন ঠিক করা হল তিন সপ্তাহ পরে। চাঁদ কাজির কানে কথাটা গেলেও সে বিশেষ গ্রাহ্য করল না। গুপ্তচরদের নজর রাখার হুকুম দিলেও এমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাগুলো বলল যে নজরদাররাও দায়িত্বে পালনে গা এলিয়ে দিল। কাজি জেনে গিয়েছিল, নবদ্বীপের ভেতো হিন্দুরা ভীতুর ডিম, ধর্ম জাতপাতের খেয়োখেয়িতে তারা এত মত্ত যে কোনও সম্প্রদায়ের মেরুদণ্ড বলে কিছু নেই। যত গর্জায়, তার একফোঁটা বর্ষায় না। আঠারোজন ঘোড়সওয়ার সৈন্য নিয়ে বক্তিয়ার খিলজি গৌড় দখল করেছিল। ফুঁ দিলে বেটাচ্ছেলেরা উড়ে যায়; তাদের আবার মহামিছিল! খাপ খোলা তলোয়ার হাতে দু’জন ঘোড়সওয়ার সৈন্য নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে কাজিকে পথে ঘুরতে দেখলে নবদ্বীপের মহাপণ্ডিত থেকে রাস্তার ভিখিরি পর্যন্ত যে যার গর্তে সেঁধিয়ে যাবে, সারাদিন পথে বেরোবে না। শুধু নবদ্বীপ কেন, গোটা গৌড়ের লোক, যাদের গৌড়িয়া বলা হয়, তারা তড়পাতে যত ওস্তাদ, কাজের বেলায় সেরকমই ফক্কা। মুসলিমদের ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকে। ইখতিয়ারুদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির তাড়া খেয়ে গঙ্গাতীরে রাজধানী লক্ষ্মণাবতীর তীর্থাবাসের খিড়কি পথ দিয়ে নৌকোয় চেপে লক্ষ্মণ সেনের সোনারগাঁ পালানোর কাঁপুনি এখনও, দু’শ বছর পরেও গৌড়িয়াদের মন থেকে মুছে যায়নি। সেখানে শেষ নয়। সুলতানি শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে গ্রামের পর গ্রাম, ব্রাক্ষ্মণ রাজা, জমিদার থেকে শূদ্র প্রজা পর্যন্ত, কে আগে মুসলিম হবে, এ নিয়ে পাল্লা দিয়েছে। নবদ্বীপের পাশে পিরল্যা গাঁয়ের সাতান্ন ঘর বর্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ রাতারাতি যে ধর্ম পাল্টেছিল, তার কারণ শুধু ভয় নয়। গৌড়িয়ারা ভীষণ লোভী। জমিদারীর লোভে, সুলতানি দরবারে মোটা মাইনের চাকুরির লোভে তাদের অনেকে মুসলিম হয়েছিল। জ্ঞাতিশত্রুকে শায়েস্তা করতে ধর্মান্তরিত হয়েছিল কেউ কেউ। সুলতান আর আমীর ওমরাহদের কৃপা পেতে জাত দেওয়ার সঙ্গে ঘরের বউ মেয়েকে ঘুষ দিয়েছিল। ঘুষের মাল যে যথাযথ ব্যবহার হয়েছে, সেই সব রমণীরা সন্তান প্রসবের পর তা জানা গিয়েছিল। কাজির চার বিবির একজন, সেরকম এক ব্রাহ্মণের মেয়ে। বিবি শুধু রূপবতী নয়, সংস্কৃত পড়তে পারে। পিরল্যা গাঁয়ের মেয়ে সে।

কাজি গোঁফে তা দিয়ে যখন পথসঙ্কীর্তনের তারিখটা ভুলতে বসেছে, তখনই এক বিকেলে রামচন্দ্রপুরে শ্রীবাসের বাড়ির সামনে পিল পিল করে ভীড় জমতে শুরু করল। রাজশক্তির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সেটাই ছিল নগরসঙ্কীর্তনের নির্ধারিত দিন। সাতদিন ধরে মুখে মুখে রটে গিয়েছিল নিষেধাজ্ঞা-বিরোধী মহামিছিলের সূচি। সূর্য ডোবার আগে সঙ্কীর্তন শুরু হলেও নবদ্বীপ পরিক্রমা করে সিমুলিয়ায় কাজির বাড়ির সামনে পৌঁছতে দিন শেষ হয়ে অন্ধকার নামবে পৃথিবীতে, এমন অনুমান করে উদ্যোক্তারা অনুগামীদের মশাল আনতে বলেছিল। পাটকাঠির সঙ্গে শুকনো কাঠপাতা বেঁধে গোরার অনুগামীরা অগুনতি মশাল তৈরি করেছিল। জ্বলন্ত মশালের আলো আরও উজ্জ্বল করতে জ্বালানি তেলের জোগাড় রেখে ছিল তারা। ঘন অন্ধকার নামলে দরকার মতো তেলে চুবিয়ে নেওয়া হবে মশালের মাথা। নবদ্বীপের ঘরে ঘরে মহামিছিলের প্রস্তুতি কিছুদিন আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। নবদ্বীপের বাইরে বৈষ্ণববসতিগুলোতেও চলছিল নগরসঙ্কীর্তনে পা মেলাতে নানা উপকরণ সংগ্রহের আয়োজন। নিজেদের মতো তারা তৈরি করছিল মহাদীপ, রেড়ি, তিষি, তিল, মহুয়ার তেল, তুলসির মালা, হিসেব করছিল গায়ক, নর্তক, দোহার, বাজনদারদের সংখ্যা, পরখ করে নিচ্ছিল তাদের খোল, করতাল, মন্দিরা, পাখোয়াজ, মাদলে বোল আর ঝঙ্কার। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সঙ্গে শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাকপল্লীতে প্রস্তুতি চললেও তা নিয়ে হৈচৈ ছিল না। মানুষের নাচ গানের ওপর সুলতানি নিষেধাজ্ঞার জারিজুরি মানতে প্রজারা নারাজ। পেটে গামছা বেঁধে উপোস করে থাকলেও নাচগান বাদ দিয়ে তারা বাঁচবে না। প্রতিবাদী এই মহামিছিল যে গ্ৰাম্য বাদানুবাদ নয়, কলিযুগে সঙ্কীর্তনই শ্রেষ্ঠ ধ্যান, কৃষ্ণাবতার গোরার এই নির্দেশ, তার অনুগামীরা জেনে গিয়েছিল। সসম্ভ্রমে, শান্ত মাথায় মেনে নিয়েছিল দেবতার নির্দেশ। দলাদলি, ঢলাঢলির সেখানে জায়গা নেই।

হাজার হাজার মানুষের সেই জমায়েতকে সংগঠিত শোভাযাত্রায় রূপ দিতে সকলের আগে রাখা হল বর্ষীয়ান অদ্বৈত আচার্যর সঙ্গে শান্তিপুরের ভক্ত আর সঙ্কীর্তনীয়াদের, অদ্বৈতের পেছনে হরিদাসের সঙ্গী হল ফুলিয়া, কুলীনগ্রামের ভক্তরা, পরের অংশে শ্রীবাস, মুরারি মুকুন্দ প্রমুখ নবদ্বীপের ভক্তবাহিনী, মিছিলের শেষ বেষ্টনীতে গোরা, নিতাই, নরহরি, শ্রীখণ্ড, কুলিয়া কুমারহট্টের জনসমাজ। বিশাল সেই জনসমুদ্রের মধ্যে ঢেউ ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুনছিল গোরা। কিছুদিন ধরে ভাবাবেশে যে জনসমুদ্র দেখছিল, অগুনতি মানুষের জমায়েতে সেই সমুদ্র যেন সামনে এসে গেছে। গয়ায় গঙ্গার স্রোতে বছরখানেক আগে বিশ্বরূপের যে পুঁথি সে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছিল, তার আখ্যানভাগ হুবহু মনে পড়ছিল। নিরুদ্দিষ্ট দাদার পুঁথির প্রতিটা বচন, বাস্তবের সঙ্গে এভাবে মিলে যাবে, তার ধারণা ছিল না। তাকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে অভিহিত করে তার জীবনের যে অভিমুখ বিশ্বরূপ নথিবদ্ধ করেছিল, কুঁড়ির মতো সেই আলেখ্য, শতদল খুলে ফুটে উঠছে। বিশ্বরূপের বিবরণ অনুযায়ী জনজীবনের জোয়ারে মিশে যাচ্ছে তার ছোটভাই গোরা।

মহামিছিলের চার বৃত্তের মুখ্য অধিকারীকে ঘিরে সঙ্কীর্তনের দল খোল, করতাল, মন্দিরা নিয়ে ‘হরিধ্বনি’ দিয়ে বাজনায় বোল ফোটালো। মহামিছিলে অনেক ভক্ত কপালে মুখে চন্দনের অলকাতিলকা এঁকে, গলায় ফুলের মালা ঝুলিয়ে, জ্বলন্ত মাটির প্রদীপ, ধুনুচি হাতে নিয়ে এসেছিল। রামচন্দ্রপুর থেকে এক ক্রোশ দূরে সিমুলিয়া পর্যন্ত গঙ্গার ধার দিয়ে মিছিল প্রথমে এল আপন ঘাটে। রামচন্দ্রপুর আর আশপাশের পাড়ার মানুষের এটাই স্নানের ঘাট। অল্পদূরে সদ্য তৈরি মাধাই-এর ঘাটে গোরা আর তার অনুগামীদের পায়ের ধুলো পড়ার আশায় আত্মীয়, পড়শি নিয়ে দুপুর থেকে অপেক্ষা করছে জগাই-মাধাই। মাটির ঘট, কচিডাব, কলাগাছ পুঁতে, বাঁশের দুটো খুঁটিতে আমের পাতার শিকল টাঙিয়ে ঘাট সাজিয়েছে দু’ভাই, তাদের প্রার্থনাতে নগরের পথ ছেড়ে গঙ্গার ধার দিয়ে শুরু হয়েছে মিছিলের যাত্রাপথ। মাধাই-এর ঘাটে মিছিল পৌঁছলে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গেল গোরা। গোটা মিছিল থেমে থাকল। গোরার সঙ্গে নিতাই, গদাধর, চন্দ্রশেখর আচার্য, বঙ্গেশ্বর সমেত যারা সঙ্কীর্তনের ব্যূহ রচনা করেছিল, সেই ফাঁকে দলবল নিয়ে জগাই-মাধাই ঢুকে গেল। গোরা, নিতাই-এর পায়ে তুলসির মালা, চন্দন দিয়ে প্রণাম করল দুই কোটাল। মাধাই-এর ঘাট ছেড়ে বারকোণা ঘাট ছুঁয়ে মহামিছিল যখন নবদ্বীপ নগরের পথে ঢুকল, দিনের আলো নিভে এসেছে। মিছিলের মাথা থেকে শেষ পর্যন্ত একটা, দুটো করে মশাল জ্বলে উঠতে শুরু করল। নবদ্বীপের মানুষ এমন সুসজ্জিত নাচে গানে বিভোর, উদ্দীপ্ত জনস্রোত আগে দেখেনি বললে কম বলা হয়, কখনও তাদের কল্পনাতে আসেনি। তাদের অনেকে নগরসঙ্কীর্তনের খবর চব্বিশ ঘণ্টা আগে জেনে নিজেদের বাড়ির সদরে মঙ্গলকলস পেতে, দরজার মাথায় আমের পাতা সাজিয়ে, চন্দন লেপে, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে মহামিছিলকে স্বাগত জানাচ্ছিল। ঘরের ছেলেদের নিয়ে গৃহকর্তাদের কেউ কেউ ঢুকে যাচ্ছিল মিছিলে। সাজিতে ফুল, ধামায় খই নিয়ে মিছিলের ওপর বৃষ্টিকণার মতো ছড়িয়ে দিচ্ছিল পথের দু’ধারে বাড়ির চাতালে দাঁড়ানো মেয়ে-বউরা।

নগরসঙ্কীর্তনের সঙ্গে মিছিল থেকে কাজিবিরোধী হুঙ্কারও শোনা যাচ্ছিল। নাচগানে নিষেধাজ্ঞা জারির আগেও কাজি কম নির্যাতন করেনি। স্বয়ং কাজি সামনে দাঁড়িয়ে সব সময়ে অত্যাচার না চালালেও তার কর্মচারী, জাসু, দানি, পাইক, পেয়াদা, গুপ্তচররা যখন খুশি গাঁয়ে ঢুকে যথেচ্ছ নিগ্রহ করে, গাছ থেকে কলার কাঁদি, খেতের ফসল কেড়ে নিয়ে যায়। গরিবের ঘর থেকে কাজির নাম করে বেমালুম হাঁস, মুরগি লুটপাট করে। গরিবগুর্বো মানুষ আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকে। সাত চড়ে রা কাড়ে না। যে যত গরিব, তার তত বেশি দুর্ভোগ। ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থরা জাতধর্ম হারানোর ভয়ে মুখ বুজে থাকলেও অহরহ তাদের হেনস্তা হতে হয় না। জাতধর্ম নিয়ে যারা মাথা ঘামায় না, সেই সব হাড়হাভাতে উপোসী মানুষের সহ্য করতে হয় নিত্যদিনের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা। গোরার ডাকে মহামিছিলে জায়গা করে নিয়ে হতদরিদ্র নিচু জাতের সেই মানুষেরা হঠাৎ যেন নিজেদের মানুষ হিসেবে চিনতে পারল। ঘুম ভাঙল তাদের, চেতনার জাগরণ ঘটল। তাদের মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছে গোরা, গোরা তাদের নেতা। গোরার শত্রু কাজি, তাদেরও শত্রু। তারা আজ কাজির সর্বনাশ করবে। তার দাড়ি গোঁফ উপড়ে নেবে, টাক মাথায় যে ক’টা চুল আছে কামিয়ে দেবে। তছনছ করে দেবে তার বাড়ি, ফুলের বাগান। কাজিগিরি ছুটিয়ে দেবে। যত ভাবছে, তত বাড়ছে তাদের উত্তেজনা, রাগ। বাপ, ঠাকুরদার নির্যাতন, লাঞ্ছনার স্মৃতির সঙ্গে কয়েক’শ বছরের অপমান, খিদে, ক্রোধ, জনতার বঞ্চিত, বুভুক্ষু অংশকে শত্রুনিধনের উত্তেজনায় টানটান করে তুলল। গোরা তখন তার সঙ্গীদের নিয়ে গাইছিল, শারঙ্গধর তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে।’ কাজির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার চিন্তার সঙ্গে চোখের জলে কৃষ্ণকে সে জানাচ্ছিল, পিতৃপরিচয়হীন এই অভাগার তুমি বাপ, তুমিই সর্বস্ব। তোমার নাম প্রচার, তোমার কীর্তনের অধিকার কাজির কাছ থেকে তুমিই আদায় করে দাও। তোমার সন্তানকে, সন্তানের সুহৃদদের তুমি রক্ষাকর্তা। ‘তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে।

দশাসই শরীর, চন্দনবাটা মাখানো জ্যোৎস্নার মতো গায়ের রং ভূতগুপ্ত বামুনটা কেন এত কাঁদছে, পথের দু’ধারে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো কাজির নজরদাররা বুঝতে পারল না। বৈষ্ণববিরোধী পাষণ্ডীদের একজন ফিসফিস করে বলল, ন্যাকা

গোরা কয়েক হাত পেছনে জগাই, মাধাই-এর সঙ্গে জনা তিন-চার চেনা তস্কর, গাঁটকাটাকে দেখে, দুই গুপ্তচরের একজন পাশের সঙ্গীকে বলল, ওই দেখ, জগাই-এর পেছনে গাঁটকাটা ভজু। ভজুও হরিবোলা হয়ে গেছে!

সঙ্গী বলল, ঘোড়ার ডিমের হরিবোলা। মিছিলের ভিড়ে ঢুকে বামুনদের ট্যাক খালি করার মওকা খুঁজছে। কতজনের ট্যাক আজ ও খালি করবে, বলা মুশকিল।

মহামিছিলের বহর দেখে ভয় পেয়ে গেল দুই গুপ্তচর। মিছিলের গোড়াটা নজরের আড়ালে চলে গেছে, শেষটাও চোখে পড়ছে না। কোথা থেকে জুটল এত মানুষ? খেপে গেলে এরা তুলকালাম কাণ্ড ঘটাতে পারে। সিমুলিয়ায় কাজির বাড়িতে কয়েকজন পাইক, বরকন্দাজ থাকলেও মানুষের এই বিশাল সমাবেশ ঠেকানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সুলতানি দরবারের মাইনে করা যে চার ঘোড়সওয়ার সৈন্যের জোরে কাজি নবদ্বীপ দাপিয়ে বেড়ায়, তারাও এই হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ। সবচেয়ে ভয়ের বস্তু এই জ্বলন্ত মশালগুলো। মিছিলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগুনের প্রবাহের মতো সর্বভুক দাউদাউ শিখার দাপাদাপি দেখে সওয়ারি সমেত ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে উল্টোমুখে দৌড়বে না, কে বলতে পারে? ঘনীভূত বিপদ আঁচ করে দুই গুপ্তচর তখনই দৌড় লাগাল কাজিকে জানাতে। মহামিছিলের নানা অংশে কাজিকে পেটাই করার হাঁকডাক তাদের কান এড়ালো না। রাজশক্তির ওপরে এত মানুষ খেপে রয়েছে, তারা জানত না। নবদ্বীপের মাটিতে কিছুক্ষণের মধ্যে যে রক্তগঙ্গা বইবে, তারা অনুমান করতে পারল, কাজির বাড়ির কাছারিতে খবরটা দিয়ে দু’জনে সরে পড়বে, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা ছাড়া আজ উপায় নেই। পালানোর শলা-পরামর্শ গলাজড়াজড়ি করে তারা পথেই সেরে নিল। ভক্তিসঙ্কীর্তন করে প্রেমভক্তিতে উদ্বেল যে মহামিছিল এগিয়ে আসছে, অসংখ্য জ্বলন্ত মশালের সঙ্গে প্রবল জনরোষ তারা বয়ে আনছে। হয়তো উগরে দেবে সেই রোষ। তাদের প্রতিহিংসা থেকে কয়েকজন ঘোড়সওয়ার আর সাত-দশজন পাইক বরকন্দাজ বাঁচাতে পারবে না কাজিকে। কাজির মাইনে খাওয়া রক্ষী, গুপ্তচররা কুটোর মতো উড়ে যাবে।

কাজির সেরেস্তায় আসন্ন বিপদের খবর দুই গুপ্তচর দেওয়ার আগে তা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। পরিবারের মেয়ে, শিশুদের বাঁদিদের জিম্মায় রেখে দুই ঘোড়সওয়ার সেনা নিয়ে গৌড়ের রাজধানী একডালায় সুলতানি দরবারে নবদ্বীপে প্রজা অভ্যুত্থানের খবর পৌঁছে দিতে কাজি তৈরি হচ্ছিল। চণ্ড মেজাজের চটকদার মানুষটা উত্তেজনায় নিজের হাতে ঘোড়াকে জিন লাগাম পরিয়ে পিঠে চাপার রেকাব লাগাচ্ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে দুই গুপ্তচর এসে বাসি হয়ে যাওয়া বিপদের খবরটা দিতে তাদের ধমক দিয়ে কাজি থামাল। নবদ্বীপের বৈষ্ণবরা ধর্মচর্চার আড়ালে গোপনে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চালাচ্ছে, এ খবর গুপ্তচররা আগে না জানানোয়, তাদের কাজে গাফিলতির জন্যে শূলে চড়ানোর হুমকি দিল। সেরেস্তার হিদু কর্মচারীদের একডালা থেকে ফিরে বরখাস্ত করা হবে, জানাতে ভুলল না। হিন্দু কর্মচারীদের মধ্যে যারা বয়সে প্রবীণ, তাদের কেউ কেউ কাজিকে অভয় দিয়ে বাড়ি ছেড়ে যেতে বারণ করল। গোরা যে অসম্ভব ভদ্র, বিনয়ী মানুষ, তার উদার হৃদয়ে ঈশ্বরের মতো অফুরন্ত ভালবাসা, কাজি আর তার পরিবারের সামান্যতম ক্ষতি তাকে দিয়ে হবে না, বারবার বিনয়ের সঙ্গে জানাতে লাগল। পুরনো কর্মচারীদের কথা অবজ্ঞা করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, জেনেও তাদের থামিয়ে দিল কাজি। বলল, হিদুদের আমি বিশ্বাস করি না। বড় বেশি বাড় হয়েছে তাদের। একডালা থেকে ফিরে শায়েস্তা করব। হিদুয়ানি ঘুচিয়ে দেব চিরদিনের মতো।

কর্মচারীদের হম্বিতম্বি করলেও কাজি ভাবছিল, গোরাকে দেখে মারদাঙ্গা করার মতো লোক, তার কখনও মনে হয়নি। তার বাবা, জগন্নাথ মিশ্র ছিল পূজারী বামুন, নিরীহ, সজ্জন মানুষ। জগন্নাথ মিশ্রের শ্বশুর, নামকরা পণ্ডিত, নীলাম্বর চক্রবর্তীও তার অচেনা নয়। ফকির, সাধুগোছের মানুষ নীলাম্বর। ছাপোষা দুই গৃহস্থ ব্রাক্ষ্মণ বংশের রক্ত যার শরীরে রয়েছে, সেই গোরা রাজদ্রোহী হতে পারে না। তাহলে দলবল নিয়ে শয়ে শয়ে মশাল জ্বেলে তার বাড়িতে চড়াও হতে সে আসছে কেন? কাজির হিসেব গুলিয়ে গেল। রেকাব লাগানো ঘোড়া মাটিতে পা ঠুকে পাশে দাঁড়ানো মনিবকে সওয়ার হতে ডাকছে। পা-দানে পা রেখে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল কাজি। শুকনো মুখে সেরেস্তার কর্মীরা পথের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়ির অন্দরমহল থেকে ভেসে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ। জেনানামহল পর্যন্ত আসন্ন বিপদের খবর পৌঁছে গেছে। পরিবারের মেয়েরা ভয়ে কাঁদছে। ঘোড়ার পিঠে চাবুক ছুঁয়ে দৌড় করানোর আগের মুহূর্তে দু’জন মাঝবয়সি হিন্দু কর্মচারীকে ডেকে কাজি বলল, পরিবারের মেয়েদের দেখভালের দায়িত্ব থাকল তোমাদের ওপর। মেয়েদের যেন বেইজ্জতি না হয়!

প্রবীণ এক কর্মচারী বলল, মালিক তেমন কিছু ঘটবে না। মেহেরবানি করে আপনিও এখান থেকে যাবেন না। নিমাই পণ্ডিত নিশ্চয় কোনও আর্জি নিয়ে আপনার কাছে আসছে। আপনাকে অসম্মান সে করবে না।

দৌড় শুরু করতে মুখিয়ে ওঠা ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে ধরে কাজি বলল, আমারও বিশ্বাস রক্তারক্তি করতে গোরা আসছে না, সে সাধুগোছের লোক। কিন্তু তার সঙ্গীরা সবাই একরকম নয়। হাজার কয়েক চ্যালা কাঠ জ্বেলে তারা আসছে। আমার সঙ্গে খেলা করতে আসছে না। আমাকে সপরিবারে বাড়িতে আটকে রেখে তারা পুড়িয়ে মারতে চাইলে তোমাদের নিমাই পণ্ডিত ঠেকাতে পারবে না। এইসব দানো, ডাকাত, ভূতদের সামলানো কৰ্ম্ম নয়।

কাজির কথা শেষ হওয়ার আগে সিমুলিয়ার দক্ষিণদিকে আকাশ আলোয় লাল হয়ে উঠল। খোল করতাল মন্দিরার সঙ্গে ভেসে এল সঙ্কীর্তনের সুর। মহামিছিল কাছাকাছি এসে গেছে টের পেয়ে দুই ঘোড়সওয়ার সঙ্গী নিয়ে অন্ধকার খিড়কির পথে কাজি মিলিয়ে গেল। মালিক চলে যেতে জাসু, দানি, গুপ্তচররা একে একে কেটে পড়তে থাকল। কাজির বাড়ির সদর দরজা আগলে দাঁড়িয়ে গেল বাড়ির কয়েকজন বুড়ি দাসি, বাঁদি আর সেরেস্তার সেই পুরনো কর্মচারীরা, যারা কাজিকে বাড়ি ছেড়ে না যেতে অনুরোধ করেছিল। কয়েক মুহূর্ত পরে অনতিদূরে দেখা গেল মহামিছিলের মুখ। মশালের আলোয় মিছিলের প্রথম সারিতে ভেসে উঠল অনুগামীবেষ্টিত বৃদ্ধ অদ্বৈত আচার্যের মুখ। মাথায় সাদা চুল, মুখভর্তি সাদা দাড়ি-গোঁফ, দু’হাত তুলে যুবকের মতো নাচছে নবদ্বীপ, শান্তিপুরের প্রবীণতম বৈষ্ণব আচার্য। গোরা, নিতাইকে নিয়ে মিছিলের শেষ অংশ তখন বেশ দূরে। কাজির বাড়ির কাছাকাছি এসে ঘোর উত্তেজনায় মিছিলের সামনেটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। জ্বলন্ত মশাল হাতে রে রে করে মিছিল ভেঙে ছুটে এল একদঙ্গল লোক। তাদের দেখে মিছিলের নানা অংশ থেকে ‘মার শালাকে, ধর শালাকে বলে বহু মানুষ ছুটে আসতে থাকল। ঘটনা যে এমন বাঁকা পথে এগোবে, অদ্বৈত আচার্য কল্পনা করেনি। কাজির বাগানে ঢুকে ক্ষিপ্ত একদল মানুষ সাজানো গাছপালা তছনছ করতে থাকল। কাজির খোঁজে প্রাসাদোপম বাড়ির বন্ধ বিশাল দরজার ওপর মারমুখী যে জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাদের ঠেকানো শক্তি বুড়ি দাসিদের ছিল না। তারা ছিটকে সরে গেল। সেরেস্তার দুই হিদু কর্মচারী করজোড়ে তাদের বলল, আপনারা একটু দাঁড়ান, নিমাইপণ্ডিত এলেই দরজা খুলে দেওয়া হবে।

প্রতিশোধপরায়ণ, নিরক্ষর, রগচটা মানুষের অভিশপ্ত অতীত সংস্কারের সঙ্গে মিশে রয়েছে অধৈর্য, উগ্রতা। সেরেস্তার কর্মচারীরা মুখচেনা হলেও তাদের অনুনয়, বিনয়ে ক্ষিপ্ত মানুষ কান দিল না। কাজির মাথা কেটে তারা তখনই গেণ্ডুয়া খেলতে চায়। দুই বয়স্ক কর্মচারীকে তারা বেমক্কা পেটাই করে ধরাশায়ী করল। দরজা ভাঙতে দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ল বন্ধ আবলুশ কাঠের পাল্লার ওপর। তাদের ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে বুড়ি দাসিরা ভয়ে কাঁপছিল। আকাশ ফাটিয়ে কান্না জুড়েছিল কেউ, খিস্তির লহরা ছোটাচ্ছিল দু’একজন। জোরালো ঢেউয়ের মতো একঝাঁক মানুষ যতবার বন্ধ দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে মজুত কপাট কেঁপে উঠছে। কপাটের মড়মড় আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে শক্ত কাঠের দরজা ভেঙে পড়তে দেরি নেই। তাই ঘটল। দরজা ভেঙে পড়ার আওয়াজের সঙ্গে মিশে গেল জেনানামহলের কান্নার রোল। বাড়ির বাইরের মহলে ঢুকে একদল মানুষ যখন আসবাবপত্র ভাঙচুর করছে, নিতাই, গদাধর, হরিদাস, জগদানন্দকে নিয়ে সেখানে এসে দাঁড়াল গোরা। তাকে ঘিরে জ্বলছে দশটা মশাল। আলোয় উদ্ভোসিত সেই দেবপ্রতিম মানুষকে দেখে যারা বাইরের মহল থেকে জেনানামহলে ঢোকার মতলব করছিল, তারা দাঁড়িয়ে গেল। ভাঙচুর বন্ধ হল। জনতার ‘মার মার’ হুঙ্কার থেমে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল কাজির প্রাসাদ। জেনানামহলে মেয়েদের কান্নার আওয়াজ তীব্র হয়েছে। বাড়ির এক দাসিকে গোরা জিজ্ঞেস করল, কাজি কোথায়?

তিনি বাড়িতে নেই।

দাসির উত্তর শুনে কেউ একজন বলল, বাড়িতেই আছে। কোনও ঘরে লুকিয়ে আছে। আমরা গোটা বাড়ি তল্লাশি করব।

গোরা পেছনে তাকিয়ে কথাটা কে বলেছে, দেখার চেষ্টা করল। সবাই চুপ, কেউ মুখ খুলল না। কাজি কোথায়, দ্বিতীয়বার এ প্রশ্ন দাসিকে গোরা করল না। বলল, কাজির সঙ্গে আমরা দেখা করতে এসেছিলাম, তিনি নেই, আমরা ফিরে যাচ্ছি। তিনি ফিরলে বলে দেবেন, নিমাইপণ্ডিত দেখা করতে এসেছিল।

এক মুহূর্ত থেমে দাসিকে গোরা বলল, বাড়ির ভেতরে গিয়ে মা বোনেদের কাঁদতে বারণ করুন। আমরা তাঁদের ক্ষতি করতে আসিনি। আমাদের আদাব জানাবেন তাঁদের। গোরার মতো শ্বেতশুভ্র গায়ের রং, রূপবান, দেবতরুর মতো শরীর কোনও বৈষ্ণব আগে দেখেনি দাসি, বাঁদিরা। তারা অবাক হয়ে দেখছিল গোরাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে দু’হাত জুড়ে একজন দাসি ক্রমাগতে কাঁদতে থাকল। গোরার নাম শুনলেও তাকে আগে সে দেখেনি। তার মনে হল গোরা মানুষ নয়, দেবতা, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। সেরেস্তার সামনে পথের ওপর হাজার মানুষের ভিড়। কাজির বাড়ির দরজায় গোরা গিয়ে দাঁড়াতে, তার কয়েকজন সঙ্গী ছাড়া মহামিছিল থেকে আর কেউ বেরোয়নি। আগের মতো চলেছে নাচ, গান, সঙ্কীর্তন। একটা মশাল নিভলে নতুন পাঁচটা মশাল জ্বলে উঠেছে। দিনের আলোর মতো ঝকমক করছে সিমুলিয়ার মূল সড়ক। বাগানে, বাড়ির ভেতরে ঢুকে যারা ভাঙচুর চালাচ্ছিল, তাদের আগেই শ্রীবাস, অদ্বৈত, মুরারি শান্ত করে মিছিলে ডেকে এনেছে; কাজির বাড়ি ছেড়ে গোরা পথে এসে দাঁড়াতে মহামিছিল ফের নড়ে উঠল, শুরু হল নগরপরিক্রমা। কাছাকোঁচা দিয়ে কাপড় পরে আলাদা উড়ুনিতে গাছকোমর বেঁধে নিয়েছে গোরা। গায়ে জড়ানো উড়ুনির পাশ দিয়ে ঝুলছে ধবধবে সাদা উপবীত। প্রচুর ঘামে কপালে, মুখে অল্প চন্দনের অলকাতিলকা ভিজে গিয়ে সারা মুখে গলায় চন্দন ছড়িয়ে পড়েছে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কোঁকড়া কালোচুলে জড়ানো মালতী ফুলের মালাটা কিন্তু এত নাচগান হাঁটাহাঁটির পরেও এলোমেলা হয়নি। কাজির বাড়ি, বাগানে অনুগামীদের তাণ্ডবে গোরা ক্ষুণ্ণ হলেও মুখে কিছু বলল না। মিছিলের সামনে সে নিজে কেন সঙ্কীর্তনের দল নিয়ে থাকল না, এই ভেবে অপরাধবোধ জাগল তার মনে। মিছিলের প্রথম সারিতে সে থাকলে মারকুটে অনুগামীদের ঠেকাতে পারত। কাজির বাগান তছনছ করে, বাড়ির দরজা ভেঙে কাজিকে যারা পেটাতে চেয়েছিল, তাদের তিরস্কার করতে গিয়েও সে চুপ করে থেকেছিল। যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত, হাড়পাঁজরা সর্বস্ব এই মানুষগুলো কোন জ্বালা থেকে এমন উগ্ৰচণ্ডী মেজাজ পেয়েছে, তার অজানা নয়। সামান্য কাজিয়া থেকে নিজেদের মধ্যে তারা খুনোখুনি করে। শান্তির ভাষা, সৌজন্যের ভাষা, তাদের চোদ্দোপুরুষের কাছে কেউ পৌঁছে দেয়নি। কে পৌঁছে দেবে? মানুষের কাছে ভাতকাপড় পৌঁছে দিতে না পারলে, শিষ্টাচার পৌঁছনো যায় না। উপোসী মানুষকে শিষ্টাচার শেখানো একধরনের নিষ্ঠুরতা। মানুষের ভাতকাপড়ের সংস্থান না করে প্রেমভক্তি প্রচারের কাজে সে কতদূর এগোতে পারবে? প্রশ্নটা মনে জাগলেও তখনি উত্তর না খুঁজে সঙ্কীর্তনে ডুবে গেল সে। সুরের আবেশে সূর্যের আলোর মতো মাথার মধ্যে যে বার্তা জেগে উঠল, তা হল শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও প্রেমভক্তিতে আঁকড়ে থাকতে হবে। ক্রোধ নয়, হিংসা, জিঘাংসা, ধ্বংস নয়, প্রেমভক্তিই প্রথম কথা, শেষ কথাও প্রেমভক্তি। নিষেধাজ্ঞা অমান্যের কর্মসূচিতে কীভাবে প্রেমভক্তি মেশানো সম্ভব, সে ভাবেনি। মন থেকে রাগ, বিদ্বেষ, হিংসে মুছে ফেলতে না পারলে প্রেমভক্তিতে ভেসে যাওয়া সম্ভব নয়। কাজির বিরুদ্ধে তার মনেও কম রাগ ছিল না। তাকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিল সে। মহামিছিলের প্রথম সারিতে এসে কাজির মুখোমুখি হলে, তাৎক্ষণিক রাগে দু’চারটে চড় চাপড় কষিয়ে দিত। দিত কি? হয়তো আরও কর্কশ ব্যবহার করত। কত কর্কশ, আপাতত সে ভাবতে চাইল না। তার আচরণে যে প্রেমভক্তির অভাব ঘটত, এ সম্পর্কে সে নিশ্চিত। কাজির বাড়ির আসার পথে যেখানে পাষণ্ডীদের দেখা গেছে, মিছিল থেকে বেরিয়ে তার অনুগামীদের কয়েকজন তাদের তাড়া করলে সে না দেখার ভান করে সঙ্কীর্তনে মজে থেকেছে। বয়স্ক খোঁড়া কোনও ন্যায়শাস্ত্রীর কাঁধে হনুমানের মতো হুপহাপ আওয়াজ করে কোনও বৈষ্ণব ভক্ত লাফিয়ে উঠে পড়লে, সে থামায়নি। খ্যাতিমান কয়েকজন স্মার্ত পণ্ডিত আর তন্ত্রসাধকের বাগানের ফুল, ফলের গাছ ভেঙেছে মিছিলের কিছু মানুষ। তাদের বাধা দেয়নি সে। উল্টে তাদের উদ্দীপনা, হৈচৈ উপভোগ করেছিল। তার মনে হয়েছিল এটাই স্বাভাবিক। বহু বছর ধরে শেকলে বাঁধা একদল মানুষ যেন মুক্তি পেয়ে মহামানবের আনন্দমেলায় ঢুকে পড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। সঙ্কীর্তনে ভাবাৱিষ্ট হওয়ার আনন্দের চেয়ে তাদের মত্ততার আনন্দ কম নয়। কাজির প্রাসাদে ভেঙে পড়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জেনানামহল থেকে আসা কান্নার আওয়াজ শুনে তার সম্বিত ফিরেছিল দশাক্ষর কৃষ্ণনাম জপ করতে গিয়ে মনে করতে পারল না। আচমকা তার মাথা ঘুরে গেল। জলে ভরে উঠেছিল দু’চোখ। সত্যের অনুভব ঘটেছিল তার। কারও আনন্দ যেন আর একজনের দুঃখের কারণ না হয়। ভালবাসার কান্নার সঙ্গে শোকের কান্নার আকাশ পাতাল তফাৎ। ভালবেসে আনন্দাশ্রু ফেলার সাধনাই সে মানুষের হৃদয়ের অন্তর্নিহিত নির্দেশ, সঙ্কীর্তনের আসরে প্রতি সন্ধেতে সে টের পায়। প্রেমভক্তির সমুদ্রে তুফান তুলে দুষ্কৃতির বিনাশের সঙ্গে সাধুসমাজকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে ধর্মরাজ্য। দুষ্কৃতির শরীরেও যেন প্রেমভক্তি সাধকের ক্রোধের আঁচড় না লাগে! ভুলে যাওয়া কৃষ্ণমন্ত্র তখনই মনে পড়ে যেতে জপে আবিষ্ট হল সে।

মহামিছিলের ভয়ে সংসার, বউ, ছেলেমেয়েকে অরক্ষিত রেখে কাজি পালিয়ে যাওয়ার খবর লোকমুখে নবদ্বীপবাসী জেনে যেতে বিজয়োৎসবের ঢেউ জেগেছে নগরে। বাড়ির দরজায় দরজায় জ্বলন্ত প্রদীপের বুকে নতুন করে তেল ঢালা হয়েছে। আমপাতার নতুন সারি লাগানো হয়েছে বাড়ির সদর দরজায়। মেয়েরা উলুধ্বনি দিচ্ছে, কোলাকুলি করছে পুরুষরা। পাড়া জুড়ে শাঁখ বেজে উঠল। কমবয়সি একদল ছেলে সড়কের ওপর ডিগবাজি খেতে লাগল। নবদ্বীপে যতরকম বাজনা আছে, বেজে চলেছে একসঙ্গে। হাতে যাদের বাদ্যযন্ত্র নেই তারা মুখে নানারকম বাজনার বোল তুলছে। চেনা, আধচেনা, অচেনা মানুষ হঠাৎ দু’হাত তুলে নমস্কার করছে, কখনও দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করছে, কখনও একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে হাউমাউ করে কাঁদছে। তাদের কেউ বলছে, আমি নিমাই পণ্ডিত কেউ বলছে, আমি বিশ্বন্তর, আমি গোরা, সমুদ্রপারে শ্বেতদ্বীপের বৈষ্ণব, কেউ বলছে আমি বৈকুণ্ঠবাসী নারায়ণের অবতার!

মাঝে মাঝে স্মার্ত, নৈয়ায়িক, তান্ত্রিকদের বাড়ি, সেসব বাড়ি, ভূতুড়ে বাড়ির মতো স্তব্ধ, ভেতরটা অন্ধকার; আলো জ্বলেনি। মহামিছিলের শেষে গঙ্গায় চান সেরে সকলের বাড়ি ফেরার কথা। চানের ঘাটে যাওয়ার আগে নবদ্বীপের যেসব পাড়া থেকে মহামিছিলে সবচেয়ে বেশি মানুষের সমাবেশ হয়েছে, সেই অঞ্চল পরিক্রমার ইচ্ছে গোরা জানাতে অদ্বৈত, শ্রীবাস, হরিদাস, নিতাই, সকলেই উৎসাহে সাড়া দিল। মহামিছিল জুড়ে সেই পরিক্রমার খবর ছড়িয়ে পড়ল। সকলে হরিধ্বনি থেকে নাচতে শুরু করল। স্নিগ্ধ হাসিতে ভরে রয়েছে গোরার মুখ। সিমুলিয়া থেকে প্রথমে শঙ্খবণিক পাড়ায় ঢুকল সঙ্কীর্তন বাহিনী। শঙ্খবণিক পাড়ার মানুষ শাঁখ, কাঁসর, ঘণ্টা বাজিয়ে, উলুধ্বনি করে স্বাগত জানাল শোভাযাত্রীদের। মিছিল আসার খবর পেয়ে প্রতি বাড়ির সদরে মঙ্গলঘট বসানো হয়েছে, রোপণ করা হয়েছে কচি সোনালি পাতার নবীন কলাগাছ, ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি সমবেত গলায় হরিধ্বনিতে অভ্যর্থনা জানাল মিছিলকে। শাঁখারিপাড়া ছেড়ে শোভাযাত্রা গেল তাঁতিপাড়াতে। মহামিছিলের জয়ধ্বনি করে পাড়া মাথায় করল তন্তুবায় সম্প্রদায়। জয়ের কোলাহল ছেড়ে তাঁতিপাড়ার শেষপ্রান্তে শ্রীধরের বাড়ির সামনে এসে গোরা দাঁড়িয়ে পড়ল। কীর্তনীয়াদের বেষ্টনী থেকে বার হয়ে শ্রীধরের ঘরের সামনে গিয়ে দেখলে সদর দরজায় সপরিবারে শ্রীধর দাঁড়িয়ে রয়েছে। গোরাকে সামনে দেখে শ্রীধর এত আনন্দ পেল যে কথা বলতে পারল না। গোরা বলল, বন্ধু, খুব তেষ্টা পেয়েছে, জল খাওয়াও।

অগ্রদানী বামুন হলেও বাজারের ব্যাপারী সে। কলা, থোড়, মোচা, কলাপাতা, থোড়ের ডোঙা, সাধারণের মুখে যা খোলা, রোজ সব্জিমণ্ডিতে বসে বিক্রি করে। সবাই তাকে চেনে খোলাবেচা শ্রীধর নামে। নবশাকপাড়ায় থাকে সে। তার ঘরে গোরার নিয়মিত যাতায়াত। গোরার সঙ্গে তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। শ্রীধরের ঘরে জল, ফলমূল সে অনেকবার খেলেও বাইরের কেউ তা জানে না। সমবেত জনতার চোখের সামনে গোরাকে তেষ্টা জল দিতে তার বুক কেঁপে উঠল। ব্রাহ্মণপাড়ায় তার পরিচয়, সে শূদ্র। বৈদিক ব্রাহ্মণকে তেষ্টার জল সে চাইলেও তার দেওয়ার অধিকার নেই। কঠিন প্রায়শ্চিত্তের বিধান ব্রাহ্মণসমাজ দিতে পারে তাকে। নবদ্বীপ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে। বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে সে তখন যাবে কোথায়? ধন্দে পড়ে গেল শ্রীধর। নিজের হাতে শ্রীধর জল দেওয়ার আগে তার ঘরে ঢুকে লোহার চসক ভর্তি জল তুলে জনসমক্ষে ঢকঢক করে গোরা খেয়ে নিল। তেষ্টা মিটতে তৃপ্তিতে ভরে গেল তার মুখ। শ্রীধরকে বুকে জড়িয়ে নাচতে নাচতে সঙ্কীর্তনের বেষ্টনিতে ফিরে এল সে। শ্রীধরও নাচছে তার সঙ্গে। হরিধ্বনিতে মেতে উঠল তাঁতিপাড়ার মানুষ। শ্রীধরকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে থাকল পাড়ার মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছে বৈদ্য, কায়স্থ, এমনকী কয়েকজন ব্রাহ্মণ্য। তৃয়া কৃষ্ণাবতার গোরাকে সেবা করার সৌভাগ্যে খোলাবেচা শ্রীধর হয়ে গেল সর্বজনপূজ্য পরম বৈষ্ণব। জনসমাদরে অভিভূত শ্রীধরের দু’চোখ আনন্দের অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছিল। সেই ঘোরে সঙ্কীর্তনের বেষ্টনিতে সে বেহুঁশ হয়ে গেল। তার পরিচর্যা করে গোরা জ্ঞান ফেরাল। গোরা বন্ধুপ্রীতি দেখে নিতাই, গদাধর চোখের জল ফেলছিল। অদ্বৈত, শ্রীবাসও কান্না সামলাতে উড়ুনিতে বারবার চোখ মুছছে। সকলের চোখে জল দেখে আড়ালে সরে গেল গোরার মেসো চন্দ্রশেখর। অনুগামীদের কাঁদতে দেখে হাসিমুখে গোরা বলল, বৈষ্ণবকে যে তেষ্টার জল দেয়, সে প্রকৃত কৃষ্ণভক্ত। শ্রীধর যে কত বড় ভক্ত আজ জানলাম। কৃষ্ণের অফুরন্ত কৃপা পাবে সে।

শ্রীধরকে সঙ্কীর্তনমণ্ডলীতে নিয়ে গাদিগাছা, পারডাঙা হয়ে মহামিছিল যখন গঙ্গার ঘাটে এসে থামল, রাতের প্রথম প্রহর তখন অনেকটা গড়িয়েছে। মশালের আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত। শ্রীবাসের বাড়ির অন্ধকার খিড়কি পুকুরের ধারে জামগাছের তলায় দাঁড়িয়ে নারায়ণী নিঃশব্দে খানিকটা বমি করল। ওয়াক তোলার শব্দ লুকোতে উঠোনে মালিনীর আঁতুড়ঘরের সামনে থেকে অন্ধকার খিড়কিতে এসে বমি করছে। আজ ভোররাতে শরীরে কিছু একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে যেতে সে টের পেয়েছিল গা গুলোচ্ছে। পরের মুহূর্তেও বমির দমকে শরীর কেঁপে উঠতে মন্দির ছেড়ে এই খিড়কির পথে এসে কোনও আওয়াজ না করে বমি করেছিল। দ্বিতীয় বার করল রাতে, সকালে ভেবেছিল, খাওয়ার অনিয়ম কিছু হয়েছে। পুকুরে মুখ হাত ধুয়ে মন্দিরে ফিরে চাটাই-এ শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গৃহদেবতার পুজোর ব্যবস্থার সঙ্গে আজ মহামিছিলের আয়োজনে সকাল থেকে সারা দুপুর এত ব্যস্ত ছিল, শরীরে কিছু অস্বস্তি টের পায়নি। বাড়ি খালি করে পুরুষমানুষরা চলে যেতে মালিনীর আঁতুড়ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। দু’দিন আগে সন্ধের মুখে মালিনীর ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে। পুতুলের মতো সেই ভাইকে দিনে কতবার সে দেখতে যায়, তার হিসেব নেই। অশৌচ চলছে। তাই আঁতুড়ঘরের ভেতরে ঢোকে না। বাইরে দাঁড়িয়ে খুদে ভাইটাকে দেখে, খুড়ির সঙ্গে দু’চার কথা বলে, তার দরকার, অদরকার জেনে যা দরকার, জুগিয়ে দেয়। তারপর একা হলে ভাবে, হায়রে, আমারও এরকম একটা ছেলে ছিল, মা হয়েছিলাম আমি।

অন্ধকার হতে আঁতুড়ঘরের সামনে নারায়ণী যখন এসেছিল, ছেলেকে বুকের কাছে নিয়ে দরজার উল্টোদিকে মুখ করে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল মালিনী। নারায়ণী কোনও আওয়াজ না তুলে খোলা দরজার কাছে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে খুড়িকে ডাকবে কি না ভাবতেই আঁতুড় থেকে ভক্ করে একটা আঁশটে গন্ধ তার নাকে ঢুকে গেল। গা গুলিয়ে উঠল তার। মুখে আঁচল চেপে প্রায় দৌড়ে খিড়কির ঘাটে চলে এসেছিল সে। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘাট, ঝাঁক বেঁধে জোনাকি উড়ছে। ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝির ডাক। দ্বিতীয় বার বমি করে সে ভয় পেয়ে গেল। মা হওয়ার অভিজ্ঞতা তার আছে। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে ধাপে ধাপে কী ঘটে, সব সে জানে। দু’বছরও হয়নি গর্ভধারণের সেই দিনগুলো পেরিয়ে এসেছে। প্রথমে রজস্বলা হওয়া থেমে যায়, চোখের তলায় কালি জমে, থমথম করে মুখ। ধীরে ধীরে খাবারে রুচি চলে যায়, ভারি হয়ে ওঠে শরীর, গা বমি করে, খেতে খেতে বমি হয়, নারায়ণী সন্তানধারণের প্রতিটা পর্ব স্পষ্ট মনে করতে পারে। খিড়কির অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল সে। ঋতুমতী হওয়ার সময় এ মাসে পেরিয়ে এসেছে, তার খেয়াল ছিল না। চোখের তলায় কালি জমেছে কি না, জানার উপায় নেই। বিধবা হওয়ার পরে আয়নায় নিজের মুখ সে দেখেনি। আয়নায় মুখ দেখার অধিকার বিধবার নেই। পুকুরের জলে নিজের মুখের ছায়া দেখা গেলেও চোখের তলায় কালি জমল কিনা নজর করা যায় না। নারায়ণীও ঠাহর করতে পারেনি। সকাল, সন্ধে দু’বার বমি করে এখন যেন অনুভব করল ভারি হয়ে উঠেছে শরীর। প্রথমবার গর্ভবতী হওয়ার পরে শরীরে যে লক্ষণগুলো দেখা গিয়েছিল, এক এক করে সেগুলো যেন ফিরে আসছে। অর্থাৎ, সে মা হতে চলেছে। কথাটা ভেবে ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। তা কী করে সম্ভব? ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবা সে। গৃহদেবতা বিষ্ণুর সেবাদাসী। তার মনের মধ্যে যাই থাকুক, বাইরে কোনও হ্যাংলামি নেই। বিশেষ কোনও পুরুষের সঙ্গে পাপ সম্পর্কে সে জড়ায়নি। তাহলে সে সন্তানসম্ভবা হল কী করে? বজ্রাহতের মতো অন্ধকার গাছতলায় নারায়ণী দাঁড়িয়ে থাকল। রাক্ষসের মতো হাঁ করে অন্ধকার বনবাদাড় যেন গিলতে আসছে তাকে। মুঠো মুঠো জোনাকি তাণ্ডব নাচছে। মগজের মধ্যে ধারালো করাত চালাছে ঝিঁঝির ডাক। ভয়ে তার গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। কী করবে সে এখন? তার মাথা কাজ করছিল না। সন্তানসম্ভবা বিধবার আত্মঘাতী হওয়া ছাড়া এ সমাজে কোনও উপায় নেই, সে জানে। দূরের কোনও পাড়া থেকে ভেসে আসছে হরিধ্বনির অস্পষ্ট আওয়াজ। মহামিছিল চলেছে, বুঝতে পারল। কান পেতে সঙ্কীর্তনও শুনতে পেল। সম্ভবত তাঁতিপাড়ার মধ্যে দিয়ে গঙ্গায় আপনঘাটে চলেছে শোভাযাত্রা। আপনঘাটে মহামিছিল শেষ করে, গঙ্গায় চান সেরে, সেখান থেকে যে যার বাসায় ফিরবে। খুঁটিনাটি সমেত নগরসঙ্কীর্তনের পুরো সূচি কাকাদের মুখ থেকে একাধিকবার নারায়ণী শুনেছে।

রাতের নিস্তব্ধ পল্লীর বাতাসে ভেসে আসা গানের সুর কানে আসতে নারায়ণী একটু সাহস পেল। তার মনে পড়ল, অবধূত সন্ন্যাসী নিতাই-এর আশীর্বাদের কথা। প্রথম দেখার দিনে তাকে ‘পুত্রবতী হও’ বলে আশীর্বাদ করেছিল নিতাই। সেই আশীর্বচন গোরা শুনেছে। নিতাই-এর বেখাপ্পা কথাটা তার কাকা, শ্রীবাস পণ্ডিতেরও কানে গিয়েছিল। শ্রীবাস চমকে উঠলেও গোরার মুখে ভাবান্তর ঘটেনি। নিতাই যে মর্কট বৈরাগী নয়, দেবাংশী সন্ন্যাসী, কিছুদিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মানুষজন জেনে গিয়েছিল। নিতাই যদি সত্যি ঈশ্বরের অংশ, পুরাণের বলরাম হয়, যা নবদ্বীপের ভক্তবৈষ্ণবরা গভীরভাবে বিশ্বাস করে, তাহলে তার আশীর্বাদ ফলে গেছে, সে পুত্রবতী হয়েছে। তার কোনও পাপ নেই। পরিবারকে কলঙ্কিত করার মতো কোনও অপরাধ সে করেনি। দেবতার কৃপায় সে মা হতে চলেছে। তার গর্ভে নিশ্চয় স্বর্গের কোনও দেবশিশু এসেছে। চিন্তাটা মাথায় আসতে রোমাঞ্চিত হল নারায়ণী। তার গায়ে কাঁটা দিল। তখনই তার মনে পড়ে গেল মহোৎসবের তিনরাতের ঘটনা। তার সারা শরীর শিউরে উঠল। রাতের তিনপ্রহরে পরপর তিনরাত গৃহদেবতা বিষ্ণু, নিজের বিছানা ছেড়ে তার শয্যাসঙ্গী হয়েছিল, আদরে ভাসিয়ে দিয়েছিল তাকে। লম্পটের মতো তার সর্বস্ব লুটেপুটে নিয়েছিল তার প্রাণের ঈশ্বর। তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। জেগে উঠে মনে হয়েছিল, সে জেগে ছিল, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগ থেকে জেগে রয়েছে, কখনও ঘুমোয়নি। রাতের পর রাত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে জেগে রয়েছে। সাতপ্রহরিয়া সঙ্কীর্তনের দ্বিতীয় রাতে সে প্রকৃতই জেগে ছিল। ঈশ্বরের সংসর্গে প্রগাঢ় সুখানুভূতির সেই মুহূর্তে জেগে জেগে ঘুমোনোর সাধ মিটিয়ে অনুভব করেছিল, অন্ধকার পৃথিবীতে আজন্ম সে ঘুমিয়ে রয়েছে। একটানা ঘুমের মধ্যে দেখে চলেছে সুখস্বর্গের স্বপ্ন। তৃতীয় রাতে ঈশ্বরের সারা শরীর, সর্বাঙ্গ সে দু’হাতে ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে টের পেয়েছিল, তার হাতের পাতা দুটোর ওপর স্থির হয়ে আছে ঈশ্বরের দুটো হাত, নিজের হাত সে নাড়তে পারছে না, তার হাত নেই, পা নেই, গোটা শরীর যেন আগুনের তাপে মাখনের মতো গলে গেছে। ঈশ্বরের শরীরের ওম জড়িয়ে ধরেছিল তাকে, ঈশ্বরের লম্বা, গভীর শ্বাস সে শুনতে পাচ্ছিল, টের পাচ্ছিল তার বুকের ওঠাপড়া। অন্ধকার ঘরে চাটাই-এর ওপর সারাক্ষণ জেগে থেকে তার জেগে থাকার সাধ মিটে গিয়েছিল। রোজের পুজোর জোগাড় করতে রাতের চতুর্থ প্রহরে জেগে উঠতে সে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চাইছিল, গভীর ঘুমে ডুবে যেতে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিকে ডাকছিল। সত্যি কি সে ঘুমিয়েছিল? জেগেছিল কি কখনও, অথবা সবই স্বপ্ন?

অন্ধকার খিড়কি পুকুরের ধার থেকে নারায়ণী যখন মন্দিরের চাতালে ফিরল, কিছুটা সুস্থির দেখাচ্ছিল তাকে। দৈবী কৃপায় গর্ভে এক মহাপুরুষকে ধারণ করার মতো বিশ্বাসের উপকরণ কিছুটা মজবুত হলেও অচেনা ভয়ে ঢিপঢিপ করছিল বুক। সবাইকে বোঝাতে পারবে কি ঈশ্বরের সন্তান রয়েছে তার পেটে? যে শিশু ভূমিষ্ঠ হবে সে ঈশ্বরের সন্তান? তাকে যদি নবদ্বীপের মানুষ কুলটা মেয়েছেলে ভাবে, তার ছেলেকে যদি বেজন্মা ভাবে, দু’জনকে যদি মেরে ফেলতে চায়, সে কী করবে? কথাটা ভেবে তার বুক ধড়ফড় করতে থাকল। পাড়াপড়শির চেয়ে বেশি ভয় পরিবারের মানুষদের নিয়ে। তাকে সন্তানসম্ভবা জানলে বাড়ির লোকেরা এমন ছিছিক্কার শুরু করবে যে গলায় দড়ি না দিয়ে তার উপায় থাকবে না। মেজকাকা, মেজখুড়ি ছাড়া এই সংসারে তার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তাকে পুত্রবতী হওয়ার আশীর্বাদ নিতাই করার মুহূর্তে সেখানে মেজকাকা ছিল। মেজকাকা সেই আশীর্বচনী শুনেছে। নিতাইকে উঁচু মার্গের সাধক ভাবে মেজকাকা। তার মুখের বচন বৃথা হওয়ার নয়, এ বিশ্বাস ও মেজেকাকার আছে। তাকে একমাত্র মেজকাকা আর মালিনীখুড়ি বাঁচাতে পারে। নবদ্বীপে মেজকাকার শত্রু কম নেই। সঙ্কীর্তনের দল পাকানোর জন্যে তার জন্মের আগে তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল পাষণ্ডীরা। বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের ওপর পাষণ্ডীদের জাতক্রোধ। বৈষুবদের সঙ্কীর্তন নিয়ে নানা নোংরা কথা তারা বলে বেড়ায়। শ্রীবাসের বাড়িতে সঙ্কীর্তনের নামে সারারাত বৈষ্ণবরা মদ, মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করে, গোষ্ঠীর বাইরের লোককে সেখানে ভিড়তে দেওয়া হয় না, এমন অপবাদও তারা রটিয়েছে। বৈষ্ণবদের নোংরামি বন্ধের প্রার্থনা করে একডালায় গৌড়ের সুলতানের দরবারে চিঠিচাপাটি পর্যন্ত পাঠাচ্ছে। তাদের কূটকচালিতে চাঁদ কাজিও ইন্ধন জোগাচ্ছে। বিধবা নারায়ণীর গর্ভবতী হওয়ার খবর তাদের কানে গেলে তারা যে কী ধুন্দুমার বাঁধাবে, ভেবে নারায়ণীর গলার কাছে ফের বমি উঠে এল। তাকে কুলটা প্রমাণের সঙ্গে তার সন্তানসম্ভবা হওয়ার ঘটনার সঙ্গে পাষণ্ডীরা যেসব পুরুষের নাম জড়াতে পারে, তাদের মুখগুলো ভেবে নারায়ণীর আবার মনে হল, আত্মঘাতী হওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। তার জন্যে দেবতার মতো মহৎ, ফুলের মতো নিষ্পাপ কিছু প্রিয়জনের নামে কলঙ্ক ছড়াক, সে চায় না। প্রিয়জনদের সুনাম বাঁচানোর চিন্তা মাথায় আসতে তার মনে আরও এক চিন্তা জাগল। মহোৎসবের প্রথম দিন সকালে তাকে নিজের পাতের অবশেষ খাইয়েছিল গোরাদাদা। ভক্ত অতিথিদের সামনে গোরার আধখাওয়া থালায় খেতে বসার গৌভাগ্যে সে যেমন অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, তেমনি লজ্জাও পেয়েছিল। সেই ঘটনার সঙ্গে কি তার সন্তানসম্ভবা হওয়ার সম্পর্ক আছে?

চাপা আনন্দের সঙ্গে হাজারো দুর্ভাবনায় নারায়ণী যখন কী করবে, ভেবে কূল পাচ্ছে না, তখন অন্ধকার শাহি সড়ক ধরে দুই ঘোড়সওয়ার সঙ্গী নিয়ে গৌড়ের রাজধানী একডালার পথে ছুটে চলেছে চাঁদ কাজি। সুলতানি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে এত বড় জনসমাবেশ ঘটতে পারে, সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। গোটা গৌড় যে অগ্নিগর্ভ হয়ে রয়েছে, যোগ্য নেতা পেলেই গণঅভ্যুত্থান ঘটে যেতে পারে, অনুমান করতে তার অসুবিধে হয় না। সেই নেতা কি গোরা, না অন্য কেউ? একজন, না একটা সম্প্রদায়, গোষ্ঠী? গোরাকে কি তারাই খাড়া করেছে, পেছন থেকে শলাপরামর্শ দিয়ে চালাচ্ছে? গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের দরবারে নিশ্চয় এসব প্রশ্নের জবাব জমা রয়েছে। রাতের তৃতীয় প্রহর ফুরনোর আগে দুই দেহরক্ষী নিয়ে চাঁদ কাজি একডালায় পৌঁছে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *