গোরা – ৬

ফাল্গুনী পূর্ণিমার পরের দিন দুপুরে, গোরার জন্মের আঠারো ঘণ্টা বাদে, গঙ্গায় স্নান সেরে, নতুন ধুতি, গাত্রবস্ত্রে শরীর ঢেকে আঁতুড়ঘরে ঢুকে দেড় হাত লম্বা দুধে আলতা গোলা গায়ের রং, নবজাত ভাই-এর মুখ প্রথম দেখে বিশ্বরূপের মনে হল, সোনার পুতুলের মতো তার এই ভাই ছদ্মবেশী কোনও দেবতা, স্বর্গ থেকে নেমে এসে মায়ের পাশে শুয়ে রয়েছে। দু’চোখ ভরে ভাইকে দেখছিল সে। সোনার পুতুলটার মুখ, চোখ, নাক, কান খুঁটিয়ে নজর করছিল। যজ্ঞাগ্নি শিখার মতো ভাই দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। জন্মমুহূর্তে এমন ডাগর, রূপবান শিশু আগে সে দেখেনি। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী অল্পস্বল্প যা শুনেছে, মনেপ্রাণে তা সে বিশ্বাস করত। যজ্ঞের পূত আগুন থেকে উত্থিত, মহাপুরুষের দেওয়া পায়েস খেয়ে অযোধ্যার রাজা দশরথের তিন রানীর গর্ভ থেকে চার ছেলে—রাম, ভরত, লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্নর জন্ম হয়। রামচন্দ্ৰ স্বয়ং ভগবান। মহাভারতের কুন্তির কান থেকে যে পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়, সেই কর্ণ ছিল সূর্যদেবের সন্তান কুমারী কুন্তিকে বিয়ের আগে সন্তান ধারণের লজ্জা থেকে বাঁচাতে, তাকে কানীন পুত্রের মা হতে দেবতা সাহায্য করেছিল। তবু সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে, সদ্যোজাত শিশুসন্তানকে কাঠের ঝাঁপিতে শুইয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল কুত্তি। শুধু কুন্তি কেন, মহাভারতের কাহিনীতে রয়েছে, পাঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদী আর তার ভাই দ্রুপদের জন্ম হয়েছিল যজ্ঞাগ্নি থেকে। দৈবী কৃপায় সব সম্ভব। বিশ্বরূপের বুঝতে অসুবিধে হয়নি, তার ছোটভাইটি হেলাফেলার বস্তু নয়, দৈবের দেওয়া উপহার। স্বয়ং ভগবান, অথবা তাঁর পাঠানো কোনও দেবতা তাদের পরিবারে জন্ম নিয়েছে।

শ্রীহট্টে বুরহানউদ্দিনের দরগায়, এক বছরের বেশি আগে, সেই দুর্যোগের রাতে বরুণদেবতা এসে কি তার মাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল? যা বাতাস বইছিল, পবনদেবও এসে থাকতে পারে। তাদের কারও কৃপাতে যে এমন সুন্দর ভাই পেয়েছে, শিশুটিকে প্রথম দর্শনে তার মনে এই বিশ্বাস গেঁথে গিয়েছিল। দু’দিন পরে এক সকালে তার এই ধারণা পুঁথিতে লিখে ফেলেছিল বিশ্বরূপ। দৈবে অগাধ বিশ্বাস সত্ত্বেও তার মনের গভীরে, তবু কোথাও খুঁতখুঁতানি ছিল। বুরহানউদ্দিন দরগায় মুজাভিরের মুখ, তার গর্ভগৃহের রহস্যময় ঘটনার খুঁটিনাটি সে ভুলতে  পারছিল না। ন্যায়শাস্ত্রের বালক ছাত্রটি ঘটনার কার্যকারণ পরম্পরার মধ্যে কিছু একটা ফাঁক খুঁজে পাচ্ছিল। স্বরচিত পুঁথির আখ্যানে দৈবী ক্ষমতায় সীমাহীন বিশ্বাসের বিবরণ প্রকাশ পেলেও তার অজ্ঞাতে সেই গ্রন্থে আরও এক সুপ্ত আখ্যান গড়ে উঠছিল। ছোটভাই, এক মহাপুরুষ কলিযুগের কৃষ্ণ হওয়া অসম্ভব নয়, এমন এক ধারণা আর সংশয় ছায়া ফেলছিল মূল আখ্যানে। দরগার গর্ভগৃহে, মাজারের পাশ থেকে অন্ধকার রাতে মায়ের অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা সে ভুলতে পারেনি। বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ নজর করেছিল খড়ের বিছানায় মা নেই। চোখে ধাঁধা লেগে যেতে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ঠিক কতক্ষণ পরে ফের বিদ্যুতের আলোর ঝলক, যথাস্থানে, সেই বিছানায় এসে পড়েছিল, সে হিসেব করার মতো মনের অবস্থা না থাকলেও সেই আলোয় দেখেছিল, শাড়ি জড়ানো শীর্ণকায়া মা শচীদেবী চাদর বিছোনো খড়ের শয্যায় পুঁটলির মতো পড়ে রয়েছে। আলুথালু বসন, উবুড় হয়ে মা শুয়ে ছিল। তার মনে হয়েছিল, মা-এর হুঁশ নেই। মা কোথায় ছিল, কীভাবে ফিরল, সে ধাঁধার সমাধান করতে কয়েক মুহূর্ত লেগেছিল। পবনদেবকে সঙ্গী করে বরুণদেবতা আড়াল করে রেখেছিল মাকে। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো অগ্নিদেব এসে দুই দেবতাকে ডেকে নিয়ে গেছে। তখনই তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, আগের দু’রাতে কি একই ঘটনা ঘটেছে? দু’রাতে দুর্যোগ ছিল না। প্রকৃতি শান্ত ছিল। জলের দেবতা, বাতাসের দেবতা নেমে আসেনি পৃথিবীতে। হয়তো এসেছিল। নিঃশব্দে এসে, সেভাবে চলে গেছে মাজারের গর্ভগৃহ থেকে। ছেলের কল্যাণ কামনায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা শচী কি জানতে পারছে তাকে ঘিরে এত কাণ্ড ঘটে চলেছে?

মাজারের অন্ধকার গর্ভগৃহের মধ্যে আছড়ে পড়ছিল ভিজে হাওয়া। গায়ে চাদর জড়ানো থাকলেও শীতে কাঁপছিল বিশ্বরূপ। তখনই টের পেয়েছিল, মাজারের অন্ধকার অলিন্দ থেকে ভেসে আসছে দু’জোড়া ভারি পায়ের শব্দ। পবনদেবকে পাশে নিয়ে বরুণদেবতা যে পুনর্বার মায়ের কাছে আসছে, আন্দাজ করে সে এক দৌড়ে ঘরে ফিরে এসে খড় বিছোনো চাতালে শুয়ে পড়েছিল। শেষ রাতের আবছা ঘুমের মধ্যে কানে এল আজানের আওয়াজ। ভক্তদের প্রার্থনায় বসতে ডাক পাঠাচ্ছে দরগার মুজাভির।

ছোটভাই, যার আটকৌড়ের দিনে নাম রাখা হয়েছে নিমাই, তার রূপ দেখে শুধু মা, বাবা কেন, আত্মীয়-প্রতিবেশীরা মুগ্ধ হয়ে গেছে। এতটুকু অঙ্গে এত রূপ আগে কেউ দেখেনি। এ ছেলে বাঁচলে হয়, আশঙ্কা করেছিল কেউ কেউ! ভয়ে ভয়ে ছেলের নাম রাখা হয়েছিল নিমাই। নিমগাছের নিচে আঁতুড়ঘরে যার জন্ম, যে নিমের চেয়ে তেতো, কেউ তাকে ছোঁবে না, এমন কি তাকে পাশ কাটিয়ে মৃত্যু চলে যাবে, পুরনো এই সংস্কার থেকে আট দিনের শিশুর নামকরণ করা হয়েছিল। নিমাই শব্দের আরও এক অর্থ ‘নি’ বা নেই যার মা, মা থাকতেও মা-হারা, হতভাগ্য প্রমাণ করতে নামকরণে এই চালাকি করা হয়। কারণ একটাই। মা-মরা ছেলেকে সকলে, যমও করুণা করে। ভাই-এর যথার্থ নাম রাখা হয়েছে ভেবে বিশ্বরূপ নিরুদ্বিগ্ন হয়েছিল। ছ’মাস বাদে অন্নপ্রাশনের সময়ে নিমাই-এর দ্বিতীয় নাম হয়েছিল বিশ্বম্ভর। ছোটভাই-এর নতুন নাম যে তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে, তা অনুমান করে আহ্লাদিত হয়েছিল বিশ্বরূপ। বিশ্বরূপের ছোটভাই বিশ্বন্তর, আত্মীয়, পড়শীদের বুঝতে অসুবিধে হবে না। বাবা, জগন্নাথ মিশ্র অবশ্য ছোট ছেলেকে গোরা বলে ডাকে। দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তী, মামাবাড়ির সকলে ডাকে গৌরহরি আর গোবিন্দ নামে। বিশ্বরূপের পছন্দ গোরা নামটা। ছোটভাইকে সে-ও বলে গোরা। যে নামেই ডাকা হোক, এক বছরের গোরা সাড়া দেয়। টলমল পায়ে সে যখন হাঁটতে শুরু করল, তখন থেকে তার যত আদর আর অত্যাচার দাদার ওপর। সবচেয়ে বেশি অনুগত দাদার। দাদার কাঁধে, পিঠে চাপতে পেলে আর কিছু চায় না। কোমরে কালো ঘুনসি দিয়ে বাঁধা রয়েছে একটা কড়ি আর একটা রুপোর ঝুমকো। গোরা হাঁটলে কোমরে বাঁধা ঝুমকো এমন রিনঠিন করে বাজতে থাকে যে মনে হয়, পায়ে নূপুর বেঁধে কেউ ঘোরাঘুরি করছে। অন্যমনস্ক শচী পর্যন্ত সে আওয়াজ শুনে মাঝে মাঝে চমকে ওঠে। বিশ্বরূপও হঠাৎ শুনলে থতমত খায়।

ছোটভাই গোরা যে স্বয়ং কৃষ্ণাবতার, এ নিয়ে বিশ্বরূপের সন্দেহ না থাকলেও শ্রীহট্টে সেই রাতের দরগার স্মৃতি মনে করলে সে কেমন অস্থির হয়ে পড়ে। দৈবী ঘটনাকে অবশ্যম্ভাবী সত্য হিসেবে মেনে নিলেও ঘটনার ভেতরের ইঙ্গিতময়তার ব্যাখ্যা এগারো বছরের বালক, বিশ্বরূপ খুঁজে পায় না। খুঁজে পাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব বলেই হয়তো খোঁজ পেতে চায় না। অদ্বৈতবাদী পণ্ডিত কমলাক্ষ ভট্টাচার্যের কাছে ন্যায়শাস্ত্রের পাঠ নিলেও বিশ্বরূপ জানে তার শিক্ষাগুরু আসলে ভক্তিবাদী। মাঝে মাঝে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে কলির অবতারের আবির্ভাব প্রার্থনা করে, দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদে, উত্তেজিত হলে হুঙ্কার দেয়, এসো। হে ভগবান, অসুরদলনকারী, বিপদত্মাতা, মধুসূদন, তুমি এসো, রক্ষা করো আমাদের।

“অনুজানীহি মাং কৃষ্ণ সৰ্ব্বং ত্বং বেৎসি সৰ্ব্বদৃক্।
ত্বমেব জগতাং নাথো জগদেতৎ তবাপিতম্।।”

—হে কৃষ্ণ, যেতে অনুমতি দাও আমাকে। তুমি সব দেখ, সব জানতে পার, তুমি জগৎপিতা, মায়া জড়ানো আমার এই পৃথিবী তোমার হাতে আমি অর্পণ করছি। শিক্ষাগুরুর আবেগঘন আহ্বান যে কৃষ্ণের কানে পৌঁচোচ্ছে, বিশ্বরূপের বুঝতে অসুবিধে হয় না। গুরুগৃহের চতুষ্পাঠীতে ভাগবত পড়াতে তারও এখন হাতেখড়ি হয়েছে। দ্বাদশ স্কন্দ ভাগবতের অষ্টম স্কন্দ পর্যন্ত পাঠ শেষ হয়েছে। বাকিটা এক মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। পাশাপাশি এগোচ্ছে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণের পঠনপাঠন। শান্তিপুরের বাবলা গ্রামের বাসিন্দা কমলাক্ষ ভট্টাচার্য, আদতে ছিল শ্রীহট্টের লাউড় গ্রামের মানুষ। জাতিনাশের ভয়ে জন্মভূমি ছেড়ে জগন্নাথ মিশ্রের আগে সপরিবারে গৌড়ে পালিয়ে এসেছিল। বাসা করেছিল শান্তিপুরে। নবদ্বীপেও কমলাক্ষর আস্তানা ছিল। নবদ্বীপের মানুষ তাকে চিনত ন্যায়শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত অদ্বৈত আচার্য নামে। অদ্বৈতের টোলে সাত বছরের বিশ্বরূপকে শিক্ষার্থী করে পাঠিয়ে দিয়েছিল জগন্নাথ। তার বাবা শ্রীহট্টবাসী উপেন্দ্র মিশ্রের সমবয়সী ছিল অদ্বৈত। নাতির তুল্য মেধাবী ছাত্র বিশ্বরূপকে পেয়ে খুশি হয়েছিল অদ্বৈত। ব্যাকরণ আর শাস্ত্র শিক্ষায় তিন বছরে বিশ্বরূপের অগ্রগতি, চমৎকৃত করেছিল অদ্বৈতকে। পুঁথি লেখাতেও বিশ্বরূপ পারদর্শী হয়ে উঠছিল। নবদ্বীপের চতুষ্পাঠীতে বিশ্বরূপকে পড়ানোর সঙ্গে তাকে মাঝে মাঝে শান্তিপুরের বাড়িতে অদ্বৈত নিয়ে যেত। তিন-চারদিন গুরুর পরিবারে থেকে তার সঙ্গে নবদ্বীপে ফিরে আসত বিশ্বরূপ। তখন আবার বাড়িতে মা, বাবার সঙ্গে থাকত। শ্রীহট্টে এক বছর থাকার সময়েও লেখাপড়াতে বিশ্বরূপের ছেদ পড়েনি। গুরুর দেওয়া পঠনপাঠনের গৃহকর্ম নিয়মিত অভ্যেস করেছে। শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে ফিরে চতুষ্পাঠীতে সে আবার যাতায়াত শুরু করতে, অদ্বৈত দেখল, তার প্রিয় ছাত্রের অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। লেখাপড়াতে আরও তদগত হয়েছে সে। তার অভিনিবেশ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। চলাফেরা, কথাবার্তার ভঙ্গি হয়ে উঠেছে জ্ঞানী, বয়স্ক মানুষের মতো। বিদ্যাবুদ্ধিতে, একদা নবদ্বীপবাসী, ভারতখ্যাত নৈয়ায়িক পণ্ডিত, বাসুদেব সার্বভৌমকে বিশ্বরূপ একদিন ছাড়িয়ে যাবে, এই আশা পোষণ করতে শুরু করেছিল অদ্বৈত। মনের কথাটা জগন্নাথকে না বললেও প্রথমা স্ত্রী সীতাদেবীকে অদ্বৈত জানিয়েছিল। সীতাদেবীও নজর করেছিল বিশ্বরূপের পরিবর্তন। স্বামীর মুখ থেকে শোনার আগে টের পেয়েছিল লেখাপড়ার চিন্তাতে বালক বিশ্বরূপ বিভোর হয়ে রয়েছে। তার বিভোরতা যে শুধু লেখাপড়া নিয়ে নয়, তার ভাবান্তর ঘটেছে, অদ্বৈত অনুভব করছিল। সূর্য ওঠার আগে আচার্যের টোলে পৌঁছে যায় বিশ্বরূপ। দুপুরে বাড়িতে খেতে যাওয়ার কথা মনে থাকে না। ঠেলেঠুলে খেতে পাঠাতে হয় তাকে। অল্প সময়ের মধ্যে স্নান, খাওয়া সেরে ফের সে গুরুগৃহে ফিরে আসে। ছোটভাই নিমাই-এর জন্মের পর থেকে সে যেন বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে। গম্ভীর এবং আনন্দিত। গুরুগৃহে পাঠের কোনও অংশ শেষ করে মাঝে মাঝে সে বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসার জন্যে উসখুস করতে থাকে। অদ্বৈত টের পায় দু’বছরের ভাই, নিমাইকে দেখার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আধঘণ্টার জন্যে তখন তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় অদ্বৈত। জগন্নাথের পুঁচকে ছেলেটা যে খুব ডানপিটে হয়ে উঠছে, এ খবর অদ্বৈতের কানে এসেছে। বিশ্বরূপের মুখ থেকে শোনার আগে জানিয়ে গিয়েছিল জগন্নাথের প্রতিবেশী শ্রীবাস আচার্যের বউ মালিনী। বলেছিল, অদ্বৈতের গৃহিণী সীতাকে। মাঝখানে একটা ঘটনাতে ভাই-এর জন্যে বিশ্বরূপের উদ্বেগ বেড়ে গেছে। শচীর চোখ এড়িয়ে, সেই সকালে পায়ে হেঁটে দু’বছরের নিমাই বাড়ির সদর দরজার বাইরে চলে যায়। তারপর সে নিখোঁজ। কান্নার রোল ওঠে বাড়িতে। পাড়ায় খোঁজ খোঁজ রব। বাজারের বাইরে নির্জন পথে শেষ পর্যন্ত আচম্বিতে তার হদিশ মেলে। অচেনা একজন মানুষের মাথায় রাখা ধামা থেকে নিমাই নাকি রাস্তায় হঠাৎ লাফিয়ে পড়েছিল। হাত-পা বাঁধা ছিল তার। তাকে রাস্তা থেকে চুরি করে হাত-পা-মুখ বেঁধে ধামায় তুলে, কাঁথায় ঢেকে নিয়ে যাচ্ছিল ছেলেধরা। নবদ্বীপ, শান্তিপুরে তখন ছেলে চুরির হিড়িক পড়েছিল। ধর্মান্তর করে নানা কাজে তাদের লাগানো হত। নিমাই-এর মতো হৃষ্টপুষ্ট, গৌরকান্তি শিশুকে পথে একা পেয়ে শিশুচোর দস্যু, মেঘমালী লোভ সামলাতে পারেনি। শিশু নির্বাচনে ভুল করেছে, একটু পরেই মেঘমালী টের পেয়েছিল। সোনার পুতুলের মতো এক শিশুকে ধামা থেকে পথের ওপর লাফিয়ে পড়তে দেখে এক হাটুরে মানুষ এমন হল্লা তুলল যে ধামা ফেলে দৌড় লাগাল মেঘমালী। নাগালের বাইরে সে যাওয়ার আগে তাকে ধরে ফেলেছিল বাজারের পসারিরা। কাজির হাতে জমা করে দেওয়া হয়েছিল দস্যুকে। হারানো ছেলে ফিরে পেয়েছিল শচী। নিমাইকে নিয়ে এই ঘটনার পর থেকে বিশ্বরূপ চাপা আতঙ্কে ভুগছে। চতুষ্পাঠীতে এসেও ছোটভাই-এর কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে। বাড়ির ধারে ঝোপের মধ্যে একবার এক বিষধর কালসাপ ধরতে গিয়েছিল নিমাই। দু’বছরের ছেলে সামলাতে শচী নাস্তানাবুদ হচ্ছে, অদ্বৈত জানত। যজমানি পেশার জন্যে মাসের অর্ধেক দিন জগন্নাথ বাড়ি থাকে না। ফুলিয়া, চক্রদহ, কুমারহট্ট, সুখচর থেকে আকনা, মাহেশ, আটপুর, জিরাট, গুপ্তিপাড়া পর্যন্ত পূজার্চনা, যজ্ঞ করতে যজমানদের ঘরে তাকে যেতে হয়। গঙ্গার পশ্চিম ধারের লোকালয়ে গেলে অনেক সময় রাতে বাড়ি ফিরতে পারে না। জগন্নাথের পরিবারে সচ্ছলতা না থাকলেও অভাব নেই। দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। যজমানী পেশার আর পাঁচজন ব্রাহ্মণের মতো সে-ও সুদরিদ্র। ঘরগেরস্থালির কাজে গতর লাগিয়ে খাটার মতো গৃহভৃত্য রাখতে পারে।

পাঁচজন সহপাঠীর সঙ্গে অদ্বৈতের বাড়ির দাওয়ায় বসে পাঠ নিচ্ছিল বিশ্বরূপ। দুরন্ত ভাই-এর মুখ বারবার মনে পড়ছে। অদূরে গঙ্গা। অদ্বৈতের বাড়ির সামনে গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার পথ ধরে সূর্যোদয়ের আগে থেকে কেউ একা, কখনও সদলে মানুষ চলেছে গঙ্গা ঘাটে, স্নান করতে। অদ্বৈতের বাড়ির কাছে নগরিয়া ঘাট। ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত সেখানে যারা স্নান করতে যায়, তাদের বেশির ভাগ নবশাক সম্প্রদায়ের মানুষ, অল্প কিছু ব্রাহ্মণ। তারা টোলের পণ্ডিত আর ছাত্র। সংখ্যায় তারা কম নয়। দূর-দূরান্ত থেকে কত যে জ্ঞানব্রতী মানুষ রোজ নবদ্বীপে আসে, হিসেব নেই। মেয়েরা যে ঘাটে স্নান করে, সেটা নগরিয়া ঘাটের পাশে, নাম আপনঘাট। শূদ্রদের স্নানের ঘাট বেশ খানিকটা দূরে, নাম গঙ্গানগর ঘাট। ব্রাহ্মণরা সে ঘাট মাড়ায় না। তাদের জন্যে নির্ধারিত বারকোণা ঘাট আর আপনঘাটে শূদ্রদের স্নানের অধিকার নেই। স্মার্ত রঘুনন্দনের জাতিভিত্তিক কঠোর অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব মেনে চলতে হয় নবদ্বীপের মানুষকে। মুখ বুজে মেনে চলে সবাই। ব্রাক্ষ্মণ হয়েও তাদের থেকে অদ্বৈত কিছুটা আলাদা। জলচল নবশাকদের সঙ্গে নগরিয়া ঘাটে, স্নান করতে তার আপত্তি নেই। নগরিয়া ঘাটে বুক জলে দাঁড়িয়ে সে বিস্তব করে, কৃষ্ণের তর্পণ শেষ করে তার পুনরাবির্ভাবের জন্যে হাঁক দেয়। তার বাড়ির দাওয়ায় বসে পাঠরত ছাত্ররা শুনতে পায় তাদের আচার্যের হুঙ্কার। সূর্যোদয়ের আগে বারকোণা ঘাটে স্নান সেরে বিশ্বরূপ গুরুগৃহে চলে আসে। তার আগে গঙ্গায় সাত ডুব দিয়ে আসে শচী। ঘুমিয়ে থাকা নিমাইকে তখন পাহারা দেয় বিশ্বরূপ। প্রায়ান্ধকার ঘরে ভাই-এর মুখের দিকে তাকিয়ে তার পাশে বসে থাকে। শচীর ফাইফরমাশ খাটার জন্যে সংসারে যে গৃহভৃত্য আছে, তার নাম ঈশান। জগন্নাথের বাড়ি থেকে এক ক্রোশ দূরে বড়গাছি গ্রামে তার বাস। সূর্যোদয়ের আগে সে জগন্নাথের বাড়ি পৌঁছে যায়। অদ্বৈতের চতুষ্পাঠীতে যাওয়ার আগে বিশ্বরূপ যখন বারকোণা ঘাটে স্নান করতে যায়, তখন তার সঙ্গী হয় ঈশান। বিশ্বরূপের ভিজে ধুতি, মেরজাই নিয়ে বাড়ি ফিরে, সেগুলোর সঙ্গে আরও কিছু বসন কাচাকুচি করে শুকোতে দেয়। তারপর গোয়ালে বাঁধা দুগ্ধবতী গাই-গরুর পরিচর্যা করে মাঠে চরাতে নিয়ে যায়। ঘাট থেকে বিশ্বরূপ সোজা চলে যায় চতুষ্পাঠীতে।

স্নান সেরে ছাত্রদের মাঝখানে কুশের আসন দিয়ে ঢাকা জলচৌকির ওপর বসল অদ্বৈত আচার্য। পরিধানে, ঘরে ধোয়া পট্টবস্ত্র, ঊর্ধ্বাঙ্গে জড়ানো রেশমের উত্তরীয়। ছাত্রদের দিকে একবার নজর চালিয়ে বিশ্বরূপকে অদ্বৈত জিজ্ঞেস করল, নিমাই কেমন দস্যিপনা করছে?

বিশ্বরূপ বলল, সাংঘাতিক। কাল সকালে মায়ের সাজানো ষষ্ঠীপুজোর নৈবেদ্য পুজোর আগে গোরা খেয়ে ফেলেছে।

বলিস কি, আতপচালের নৈবেদ্য এতটুকু ছেলে খেয়ে ফেলল?

চাল খায়নি। কলা-বাতাসা-সন্দেশ খেয়ে, সারা ঘরে চাল ছড়িয়ে রেখেছিল।

তোর মা কোথায় ছিল।

গোয়ালঘরে ঈশানদা দুধ দুইছিল। পুজোর দুধ আনতে মা সেখানে গিয়েছিল।

বাকরহিত হল অদ্বৈত। দু’বছরের শিশু এত দুরন্ত হতে পারে অদ্বৈতর ধারণা ছিল না। সেও সংসারী মানুষ। দুই স্ত্রী, ছয় ছেলে, ছয় মেয়ে, অগুনতি নাতি-নাতনি নিয়ে তার বিরাট সংসার। সংসারের বাড় এখনও থামেনি। সম্প্রতি তার দ্বিতীয় স্ত্রী, শ্রীদেবী, এক কন্যা প্রসব করার পরের মাসে মেজ ছেলে কৃষমিশ্রের চতুর্থ পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সেই আঁতুড়ে আবার এক কন্যার জন্ম দিয়েছে দৌহিত্রী কমলা। বাবা, ছেলে আর নাতনি, তিন পুরুষের তিনজনের সন্তান পাল্লা দিয়ে পৃথিবীতে এলে, সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন প্রজন্মের মানুষটিকে যে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হতে হয়, নিজেকে দিয়ে অদ্বৈত তা টের পেয়েছিল। তিন নবজাত শিশু সারাদিন, এমনকী মাঝরাতেও পরিত্রাহি কান্নায় বাড়ি মাথায় করলেও অদ্বৈত মুখে সামান্য বিরক্তি দেখাতে পারে না। সে উপায় তার নেই। তিন চিৎকারকের একজনের বাবা হওয়ার জন্যে তাকে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হয়। নিজের পরিবারে এত ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি থাকলেও কেউ যে জগন্নাথের দু’বছরের ছেলে, নিমাই-এর মতো রামদুষ্টু নয়, জোর গলায় অদ্বৈত তা বলতে পারে। গোরার দুরন্তপনার বিবরণ শোনাতে শুরু করে স্নেহাতুর হয়েছিল বিশ্বরূপের গলা। সে বলছিল, গোরার ভীষণ বুদ্ধি, সে জানে, তাকে ধরতে মা আঁস্তাকুড়ে যাবে না, তাই সেখানে গিয়ে বসেছিল। আপনার কাছে পাঠ শেষ করে বাড়ি ফিরে দেখি গোরা তখনও সেখানে বসে আছে। ঈশানদাদার সঙ্গে তাকে গঙ্গায় গিয়ে স্নান করে আসার জন্য মা সাধ্যসাধনা করলেও সে কানে তুলছিল না। গোরাকে চ্যাংদোলা করে তুলে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আঁস্তাকুড়ের বাইরে ঈশানদাদা অপেক্ষা করছিল। মা একবার ইসারা করলেই গোরাকে কোলে তুলে নিত সে। মা তা করেনি। চতুষ্পাঠী থেকে আমার ফেরার জন্যে সম্ভবত অপেক্ষা করছিল। গোরাও হয়ত চাইছিল আমার ফিরে আসা। আমাকে দেখে খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। হেলেদুলে হেঁটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তাকে কোলে তুলে গঙ্গায় স্নান করিয়ে, নিজে আর এক দফা স্নান সেরে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফেরার পথে গোরা অবশ্য ঈশানদাদার কোলে চেপে এসেছিল।

সহপাঠীরা অবাক হয়ে শুনছিল বিশ্বরূপের মুখ থেকে গোরার বিবরণ। প্রায়ই শোনে। তাদের গুরু অদ্বৈত, প্রত্যেক ছাত্রের পারিবারিক খুঁটিনাটি খবর শুনতে চায়। সকলের পরিবারে মা, বাবা, সমবয়সী ভাই-বোন থাকলেও গোরার মতো ডানপিটে শিশু নেই। অদ্বৈতও যে শুনতে চায়, তার মুখের অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশ পায়। গোরার জন্মের পরে, প্রথম তার মুখদর্শন করে শিশুর আকৃতি দেখে অদ্বৈত যে বিহ্বল হয়েছিল, বিশ্বরূপ নিজে তা চাক্ষুষ করেছে। অদ্বৈত মন্তব্য করেছিল, এ তো দেখছি জ্বলন্ত উল্কা!

আচার্যের মুখে আর কথা সরেনি। শিশুকে আশীর্বাদ করে তার কপালে একটা রুপোর চাঁদি ছুঁইয়ে গোরার বালিশের নিচে অদ্বৈত রেখে দিয়েছিল। অদ্বৈতের দু’পাশে ছিল তার দুই স্ত্রী সীতাদেবী, শ্রীদেবী। সীতাদেবীর বয়স পঞ্চাশ, দ্বিতীয় স্ত্রী শ্রীদেবীর বয়স ত্রিশের বেশি নয়। অতি সম্প্রতি ভূমিষ্ঠ অদ্বৈতের কন্যাটির মা হল শ্রীদেবী। অদ্বৈতের শান্তিপুরের চতুষ্পাঠীতেও প্রচুর ছাত্র। অদ্বৈতের বাড়ির চৌহদ্দির ছাত্রনিবাসে তাদের অনেকে থাকে। সোনার গাঁ, লখণৌতি, হরিকেল, বাঙ্গালা থেকেও অদ্বৈতের টোলে ছাত্ররা পড়তে আসে। অদ্বৈতের বড় ছেলে, অচ্যুতানন্দ সেখানে শিক্ষাধ্যক্ষ। অচ্যুতানন্দকে সাহায্য করে তার ছোট তিনভাই, কৃষ্ণমিশ্র, গোপাল ও বলরাম। শ্রীদেবীর কমবয়সী ছেলেরাও সেই টোলে পড়ে। হপ্তায় তিন অপরাহ্ণে সেখানে ছাত্রদের স্বয়ং অদ্বৈত পড়ান। মহাভাগবত, মহাবিরক্ত বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, প্রেমভক্তির জীবন্ত বিগ্রহ, মাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য, অদ্বৈত আচার্য। মাধবেন্দ্র পুরীর কাছে মন্ত্ৰ নিয়ে কৃষ্ণপ্রেমে অদ্বৈত বিভোর হয়। ন্যায়শাস্ত্রের সঙ্গে বিশুদ্ধ ভক্তিকে মেলাতে জেরবার হলেও অদ্বৈত আশা করে কৃষ্ণাবতারের জন্ম হলে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ভক্তির প্লাবনে সে ভেসে যাবে। দীর্ঘকাল ধরে জ্ঞানচর্চা করে অদ্বৈত জেনেছে, জ্ঞান সব সময় বাহ্য, জ্ঞানের সীমা আছে। সেই সীমা ভাঙতে পারে ভক্তি। জ্ঞানবান ভক্তের পরম ভক্তিই হল জ্ঞানের উন্নততর স্তর। এই স্তরে জ্ঞানী মানুষ লীন হয়ে যায় ভক্তিসমুদ্রে।

ভাগবতের পাঠ রপ্ত করানোর সময়ে বিশ্বরূপকে একাধিকবার ভক্তিতত্ত্বের এই ব্যাখ্যা অদ্বৈত শুনিয়েছে। সেই সকালেও অদ্বৈত এই তত্ত্ব যখন ব্যাখ্যা করছে, বিশ্বরূপ হঠাৎ ভাগবতের একাদশ স্কন্দের পঞ্চম অধ্যায়ের বত্রিশ সংখ্যক শ্লোকের দুটি শব্দ, ‘কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষায়ং’-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ জানতে চায়। বালকের প্রশ্নে অদ্বৈত জানায় ‘দ্বিধা’ বা শান্তিতে যে ‘কৃষ্ণ’ তাকেই বলা হয়েছে ‘ত্বিষাকৃষ্ণ’। অদ্বৈতর টিকা বিশ্বরূপের মনে দাগ কেটেছে কিনা, আচার্য বুঝতে পারল না। প্রশ্নটা মাথায় থেকে যেতে একটু পরে অদ্বৈত বলল, শব্দটি সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে গ্রহণ করলে, যার ‘ত্বিষা’ বা গায়ের রং অ-কৃষ্ণ, এমনও বলা যায়।

দ্বিতীয় এই ব্যাখ্যা শুনে বিশ্বরূপের চোখ দুটো মুহূর্তের জন্যে কেন চকচক করে উঠেছিল, অদ্বৈত বুঝতে পারেনি। আষাঢ় মাসের সেই মধ্যাহ্নে অদ্বৈতের বাড়ির পেছনে ছায়াজড়ানো ঝাঁকড়া জারুল গাছে তখন একটা কোকিল ডাকছিল। সমানে ডেকে চলেছিল সেই সুকণ্ঠ বিহঙ্গ। বিশ্বরূপকে অদ্বৈত বলল, প্রশ্নটা করে আমার মনের পুষ্করিণীতে তুমি যে ঢিল ফেললে, তার ঢেউ এখনও উঠছে। বিষয়টা নিয়ে আমি আরও ভাবব। আজ সন্ধের আসরে পারলে তুমি হাজির থাকো।

ঘাড় নেড়ে বিশ্বরূপ জানাল, সে আসবে। নবদ্বীপে অদ্বৈত এসে থাকলে প্রায়ই তার বাড়িতে ভক্তপণ্ডিতদের যে সান্ধ্যআসর বসে, শ্রীহট্ট থেকে ফেরার পরে, প্রায় দেড় বছর ধরে সেখানে আসছিল বিশ্বরূপ। ন্যায়শাস্ত্রবেত্তা অদ্বৈত আচার্য আর তার বন্ধুরা যে বিশুদ্ধ ভক্তিবাদী, এই আসরে না এলে বিশ্বরূপ জানতে পারত না। সারা সকাল আচার্যের কাছ থেকে সহপাঠীদের সঙ্গে জ্ঞান, তন্ত্র, মায়াবাদের মতো শুকনো বিষয়ে পঠনপাঠন করে যখন নতুন কিছু শোনার জন্যে তার প্রাণ আইঢাই করত, দেড় বছর আগে, তখনই অদ্বৈতের কাছ থেকে এই আসরে আসতে ডাক পেয়েছিল বিশ্বরূপ। ভক্তিবাদের মহিমায় প্রথম সন্ধেতে সে আপ্লুত হয়েছিল। তত্ত্বালোচনার সঙ্গে চলছিল প্রেমভক্তি, ভালোবাসার গান। নানা রাগ-রাগিনীসমৃদ্ধ সেই গান, মুহ্যমান হয়ে বিশ্বরূপ শুনেছিল। বিশ্বরূপের দশা দেখে অদ্বৈতের বন্ধুরা স্নেহ, সমাদরে ভরিয়ে দিয়েছিল তাকে। অদ্বৈতের অনুমতি না নিয়ে তার বাড়ির সান্ধ্যআসরে এক সন্ধেতে মামাতো ভাই লোকনাথকে নিয়ে এল বিশ্বরূপ। বেলপুখুরিয়ার নীলাম্বর চক্রবর্তীর বড় ছেলে, যজ্ঞেশ্বর চক্রবর্তীর দ্বিতীয় পুত্রসন্তান লোকনাথও ছিল অদ্বৈতের ছাত্র। শাস্ত্রজ্ঞ নীলাম্বর চক্রবর্তীর নাতি হয়েও সে যে অদ্বৈতের চতুষ্পাঠীতে ছাত্র হিসেবে নাম লিখিয়েছিল, তার কারণ ছিল বিশ্বরূপ। দু’বছরের বড়, পিসতুতো ভাই, বিশ্বরূপের অন্ধ অনুরাগী ছিল লোকনাথ। বিশ্বরূপকে সে ছায়ার মতো অনুকরণ আর অনুসরণ করত। গোরার জন্মের আগে থেকে সহোদরের মতো লোকনাথকে ভালবাসত বিশ্বরূপ। গুরুগৃহে সকালে ব্যাকরণপাঠ আর শাস্ত্রচর্চার চেয়ে সন্ধের এই আসর যে, আবেগপ্রবণ লোকনাথের বেশি পছন্দ হবে, তাকে তৃপ্ত করবে, অনুমান করে তাকে এনেছিল বিশ্বরূপ। তার অনুমান অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। প্রথম সন্ধের পর থেকে ভক্তিতত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনে দু’হাতে বিশ্বরূপের একটা হাত জড়িয়ে ধরে আসরে বসে সে কাঁদত। বিশ্বরূপের একান্ত অনুগামী হয়ে উঠল লোকনাথ। অদ্বৈতর বাড়ির চতুষ্পাঠীর চেয়ে সান্ধ্যআসর তার কাছে প্রিয়তর ঠেকল। ভক্তির উদ্বেলতায় সে বেশি করে আঁকড়ে ধরল বিশ্বরূপকে। বিশ্বরূপ টের পাচ্ছিল তার ওপর লোকনাথের নির্ভরতা বেড়ে চলেছে। শুধু লোকনাথ কেন, তাকে আশ্রয় করে প্রাজ্ঞ শিক্ষক অদ্বৈত আচার্যও যেন কিছু খুঁজে চলেছেন। কী খুঁজছেন, বিশ্বরূপ আভাস পেলেও মুখ খোলার চপলতা দেখায় না।

.

‘কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণং’ শব্দযুগলের অর্থ যে ‘কালো’ এবং সেই সঙ্গে ‘কালো নয়’, উজ্জ্বল নীলকান্তমণির অভ্যন্তরের শুভ্র দ্যুতির মতো গৌরবর্ণ, অদ্বৈতের এ ব্যাখ্যা শোনার তিন দিনের মধ্যে পুঁথি লেখা শেষ করল বিশ্বরূপ। পুঁথি লেখা শেষ করে গত আড়াই বছরে বারবার সেটা পড়ে তার মনে হয়েছে, পুঁথিটা সকলের পাঠের উপযুক্ত হয়নি। গোরার জন্মবিবরণে দৈবী কৃপার উল্লেখ করতে গিয়ে নিজের অগোচরে সে এমন এক অনভিপ্রেত আখ্যানের আভাস দিয়েছে, যা সে গ্রন্থস্থ করতে চায়নি, যা পরিচিত জনেরা পড়লে সমূহ বিপত্তি হতে পারে। বুরহানউদ্দিন দরগার সেই দুর্যোগের রাতে বরুণদেব, পবনদেবের উপস্থিতির সঙ্গে সেখানকার পীর মুজাভিরের চরিত্র মিলে মিশে এমন একাকার হয়ে গেছে, পুঁথি থেকে এমন সংকেত উঠে আসছে, যার কদর্থ করা দুষ্ট পণ্ডিতের পক্ষে কঠিন নয়।

পুঁথিটা কাপড়ে জড়িয়ে হেমন্তের ভোরে গঙ্গায় বিসর্জন দিতে গিয়ে, বারকোণা ঘাটের অনেকটা দূরে নির্জন গাছতলায় বিশ্বরূপ বসে থাকল। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে কাকপক্ষিকে না জানিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে পুঁথি লেখা শেষ করেছিল সে। মা ছাড়া কেউ তাকে পুঁথি লিখতে দেখেনি। মা ভেবেছে পুঁথি লেখাটা চুতম্পাঠী থেকে আনা গৃহপাঠ্য কাজের অংশ। পুঁথি লেখার পাঠ অভ্যাস করছে বিশ্বরূপ। মা কখনও জানতে চায়নি, দিনের পর দিন, কী রচনাতে সে ব্যস্ত রয়েছে। জগন্নাথের চোখের আড়ালে গোটা পুঁথি লিখেছে। বাবার হাতে এই পুঁথি গেলে যে অনর্থ হবে, সে জানত। ছেলের পুঁথি লেখার ঘটনা স্বামীকে জানানো দরকার, শচী মনে করেনি। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজে ছেলে, বুড়ো রোজ এরকম শত শত পুঁথি লেখে, নিজেদের মধ্যে লেনদেন করে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তা নিয়ে বাদবিতণ্ডা চালায়। রাস্তায়, গঙ্গার ঘাটেও শোনা যায়, তাদের তর্ক-বিতর্ক। বাটি ভর্তি তেলকে ‘পাত্রাধার তৈল’, ‘তৈলাধার পাত্র’ বলা হবে, এই বিতর্কের আজও নিষ্পত্তি ঘটেনি। তাছাড়া, চতুষ্পাঠীতে বিশ্বরূপের পঠনপাঠন, পুঁথিরচনা নিয়ে, তার বাবা জগন্নাথের মাথা ঘামানোর মতো অবসর নেই, শচী জানে। যজমানির কাজে রোজই তাকে ছুটতে হয় কুমারহট্ট থেকে কাটোয়া, অথবা সুখচর থেকে রেমুনা। বাবার নজর এড়িয়ে পুঁথি লেখা শেষ করে; তা গোপনে আগলে রাখলেও সেই পুঁথির পাঠযোগ্যতা নিয়ে বিশ্বরূপের মনে সন্দেহ জেগেছিল, তা ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে ভীতি সঞ্চার করছে। তার বয়স এখন পনেরো। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা দিয়েছে। দৈবের ওপর অন্ধ বিশ্বাস নিয়েও জীবনের কিছু রহস্য সে বুঝতে পারে।

সূর্যোদয়ের আগে গঙ্গায় জোয়ার এসেছিল। উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটে চলেছে জলোচ্ছ্বাস। জোলো হাওয়া বইছে হু হু করে। বিশ্বরূপের শীত করছিল। গায়ের উড়নি টেনেটুনে গলায় জড়িয়ে নিল। আকাশে হালকা অন্ধকার ছড়িয়ে থাকলেও এক-দু’জন করে স্নানার্থী বারকোণা ঘাটে আসতে শুরু করেছে। ঘাটের কাছাকাছি স্মার্ত আর ন্যায়শাস্ত্রীদের পাড়া। প্রত্যেকের বাড়িতে চতুষ্পাঠী আছে। সব চতুষ্পাঠীর কিছু ব্রাক্ষ্মণ পড়ুয়া গুরুগৃহে বাস করে। কাকভোর থেকে বারকোণা ঘাটে তাই ব্রাহ্মণদের ভিড়। বিশ্বরূপ দেখল তার মেসো চন্দ্রশেখর একগলা জলে দাঁড়িয়ে গঙ্গাস্তব করছে। অন্ধকার থাকলেও মেসোর নজর এড়াতে বুড়ো বটের গুঁড়ির আড়ালে বিশ্বরূপ সরে গেল। ঘাটের হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে সূর্যের আলো দেখার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জগদানন্দ পণ্ডিত। সূর্যোদয় দেখে ‘জবাকুসুম সঙ্কাশং’ মন্ত্রোচ্চারণ করার পরে জগদানন্দ স্নান করবে। বটগাছের মাথায় বসে ডেকে চলেছে বেনেবৌ পাখি। শুধু বেনেবৌ কেন, ভোরের আভা দেখে পক্ষিকুল হৈচৈ জুড়ে দিয়েছে। কাটোয়ার দিক থেকে একটা নৌকো এসে মাঝগঙ্গায় পড়ল। নৌকো যাচ্ছে নগরিয়া ঘাটের দিকে। নবশাকদের এই ঘাটে কাটোয়া, কালনা থেকে নানা পণ্য বোঝাই গয়নার নৌকো রোজ ভিড় করে। নবদ্বীপ থেকে বহুরকম জিনিস নিয়ে সেই নৌকোগুলো ফিরে যায়। যাত্রী পারাপারের নৌকো সব ঘাটে যাতায়াত করে। পার হওয়ার কড়ি বাঁচাতে সাঁতার কেটেও নবদ্বীপ, কাটোয়া যাতায়াত করে অনেক মানুষ।

জগদানন্দের সূর্যবন্দনার দু-একটা শব্দ বিশ্বরূপের কানে আসতে, পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে ধান্ত নামে অসুরের নিধনকারী সূর্যদেবতাকে ভক্তিতে সে প্রণাম করল। কাপড় জড়ানো পুঁথি জোয়ারের জলে ভাসিয়ে দিতে গিয়ে কী ভেবে থমকে দাঁড়াল। পুঁথি ঘিরে তার মনে অচেনা মায়া তৈরি হয়েছে। ছোটভাই গোরার মতো পুঁথিটা সযত্নে এতদিন সংরক্ষণ করছে। পুঁথি লিখতে কম পরিশ্রম সে করেনি। পুঁথির পাতায় নানা ঘটনার সঙ্গে লিখেছে সুলতানের হুকুমে গান নিষিদ্ধ হওয়ার বৃত্তান্ত। সিংহাসনে যে সুলতানই আসুক ‘কৃষ্ণ’ নামে একজন আধা মানুষ আধা বাজিকরের ভয়ে, সে সন্ত্রস্ত। সাংঘাতিক সেই মানুষটা গানের বশ। তার নামকীর্তন হলেই সে এসে হাজির হয়। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে তাই গান গাওয়া বারণ। সঙ্গীত নেই, সুর নেই। গৌড়ের মানুষ হাসতে ভুলে গেছে। সম্পদের জন্যে সকলে লালায়িত, মুখে শাস্ত্র আউড়ে ভোগবাসনা মেটাতে শুধু ‘দাও দাও’ করছে। নীরস কাঠের মতো সমাজের কর্তারা সংগীত বলতে বোঝে, মনসার ভাসান আর মঙ্গলচণ্ডীর মহিমা পাঠ। দুই দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে অঢেল ঐশ্বর্য পাওয়া যায়। মা মনসার আশীর্বাদে চাঁদ সদাগর মৃত সাত সন্তানের জীবনের সঙ্গে ফিরে পেয়েছিল ডুবে যাওয়া সমস্ত বাণিজ্যতরণী। কালকেতুর মতো হতদরিদ্র ব্যাধ, দেবী চণ্ডীর কৃপায় গুজরাটের রাজা হয়েছিল। সুর, সংগীত হারিয়ে নবদ্বীপ মরুভূমির মতো হয়ে উঠেছে। পরপর দু’বছর খরায় পুড়ে গেছে মাঠের ফসল। পানীয় জলের অভাবে মহামারি দেখা দিয়েছিল অনেক অঞ্চলে। জলের অভাবে মাঠে, ঘাটে পড়ে থাকত গরু, বাছুর, ছাগল, কুকুরের শব। গোরার জন্মের পরে গৌড় যে শস্যশ্যামল হয়ে উঠেছে, আর কেউ না জানলেও বিশ্বরূপ নজর করেছিল। অসম্ভব এক প্রত্যাশা বুকে নিয়ে সে লিখে গেছে তার পুঁথি। গোপনে কীর্তনের আসর বসানোর জন্যে শ্রীবাস আচার্যের বাড়ি কয়েক বছর আগে কাজির অনুচরেরা পুড়িয়ে দেয়। তাদের মদত দিয়েছিল পাষণ্ডিরা। স্মৃতি আর ন্যায়শাস্ত্রের পণ্ডিত, এই পাষণ্ডিরা সুলতানি শাসনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কাজির সঙ্গে পাষণ্ডিরা ষড় করে শ্রীবাসের বাড়ি পুড়িয়ে দিলেও ভক্তদের সংগীতপ্রেম অবরুদ্ধ করতে পারেনি। ভস্মীভূত বাড়ি নতুন করে বানিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে শ্রীবাস ফের গোপনে গানের আসর বসাচ্ছে। তবে এখন শুধু একা শ্রীবাসের বাড়িতে নয়, বাসুদেব ঘোষ, বাসুদেব দত্ত, নন্দন আচার্য, শুক্লাম্বর ব্রষ্মচারী, শিবানন্দ সেন, এমন কি বিশ্বরূপের মেসো চন্দ্রশেখরের বাড়িতেও প্রায় রাতে কপাট বন্ধ করে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকীর্তন চলছে, এ খবর বিশ্বরূপের অজানা নয়। শ্রীবাস আর চন্দ্রশেখরের বাড়ির আসরে দু-এক বার সে গেছে। পাষণ্ডিদের চোখে ধুলো দিতে বেশ রাত করে আসর শুরু হয়। এক আসরে গুরু অদ্বৈতকে নাচগানের ভাবাবেশে হাউহাউ করে কাঁদতে দেখে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। ন্যায়শাস্ত্রের বর্মে মোড়া অদ্বৈত যে ভক্তিবিহ্বল হয়ে এভাবে কাঁদতে পারে, তার ধারণা ছিল না। হাহাকার করে কৃষ্ণকে ডাকছিল অদ্বৈত। সেই আহ্বান কৃষ্ণ এড়াতে পারবে না, এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে বিশ্বরূপের মনে।

ভোরের আলোয় গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে বিশ্বরূপ ঠিক করল, পুঁথিটা সে বিসর্জন দেবে না। কাউকে না পড়ালেও গোরার জন্যে যত্ন করে রেখে দেবে। গোরা বড় হয়ে পুঁথিটা পড়ুক, এই তার আত্যন্তিক প্রার্থনা। গোরার পড়া দরকার। পুঁথি পড়ে সে শুধু অনেক তথ্য জানবে, তাই নয়, নিজের পরিচয়, পথ চলার সঠিক দিশা পাবে। জগন্নাথের হাতে কোনওভাবে পুঁথিটা না যায়, শুধু এই কঠিন কাজটা তাকে করতে হবে। পুঁথিটা জগন্নাথ পড়লে আত্মঘাতী হওয়া ছাড়া বিশ্বরূপের উপায় থাকবে না। পুঁথি পড়ার বয়স গোরার এখনও হয়নি। পুঁথি পড়ে হৃদয়ঙ্গম করতে কম করে আরও দশ বছর লাগবে তার। তিন বছর বয়স হতে তার হাতেখড়ি হয়েছে। বিষ্ণু পণ্ডিতের উপস্থিতিতে ছেলের হাতেখড়ি দিয়েছিল স্বয়ং জগন্নাথ। গোরার মতো দুর্ধর্ষ ছাত্রকে তিন মাসের বেশি বিষ্ণু পণ্ডিত পড়াতে পারেনি। বিষ্ণু পণ্ডিতের উত্তরীয়ের প্রান্তে এক সকালে একটা কোলাব্যাঙ বেঁধে রেখেছিল গোরা। গোরাকে পড়ানো শেষ করে গায়ে উত্তরীয় জড়িয়ে রাস্তায় এসে বিষ্ণু টের পেয়েছিল উত্তরীয়ের আঁচলে কোনও এক জীব দাপাদাপি করছে। বিষ্ণু ভয় পেয়ে এমন চেঁচামেচি শুরু করল যে পথে লোক জমে গেল। তার শরীর থেকে পথে খসে পড়া নৃত্যরত উত্তরীয়ের গিঁট খুলে ব্যাঙ তাড়িয়েছিল খোলাবেচা শ্রীধর। বাজারে সব্জি বিক্রি করে সে। থোড়, মোচা, নানারকম শাক নিয়ে সে তার পসরা সাজায়।

তিন বছরের ছাত্রের হাতে বিষ্ণুর নাস্তানাবুদের কাহিনী পাঁচ কান হতে পণ্ডিতকে নিয়ে হাসাহাসি চলার সঙ্গে ছাত্রও যে পাজির শিরোমণি, রটে যেতে সময় লাগল না। গোরাকে বর্ণমালা, হস্তলিপি শেখানোর উপযুক্ত শিক্ষক পেতে জগন্নাথের যখন ঘাম ছুটে যাচ্ছে, তখনই কাঞ্চনপল্লীর সুদর্শন পণ্ডিতের খোঁজ মিলল। বিষ্ণুর মতো সুদর্শনও শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিল না। তাদের দৌড় ছিল, ছাত্রকে বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করানো আর হস্তলিপি শিক্ষা দেওয়া। সুদর্শনের যা বড় গুণ, তা হল—বিষ্ণুর মতো সে রোগা, দুব্‌লা নয়। সুদর্শন ছিল যথেষ্ট বলবান। প্রাথমিক শিক্ষক ছাড়াও মল্লযোদ্ধা হিসেবে নবদ্বীপের মানুষ তাকে চিনত। ডানপিটে ছাত্রদের জন্যে সে ছিল আদর্শ গৃহশিক্ষক। মল্লযোদ্ধা শিক্ষক সুদর্শনের শাসন থেকে গোরাকে বাঁচাতে বিশ্বরূপ এগিয়ে এসেছিল। ছোটভাইকে বর্ণপরিচয়, হস্তলিপি শেখানোর দায়িত্ব নিল বিশ্বরূপ। দাদার সস্নেহ উদ্যোগে তরতর করে শিখতে শুরু করল গোরা। চার বছর বয়সে সে শিখে গেল স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ। পড়তে আর লিখতে সমান পটু হয়ে উঠল। চার বছর পূর্ণ হতে দেখা গেল সুদর্শনের কাছে গোরার আর কিছু শেখার নেই। জগন্নাথকে সে কথা জানিয়ে, গঙ্গাদাস পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে গোরাকে পাঠানোর পরামর্শ দিল সুদর্শন। সুদর্শন পণ্ডিতের গুরুদক্ষিণা মিটিয়ে তাকে সসম্মানে বিদায় দিল জগন্নাথ।

বারকোণা ঘাটের কাছে বটগাছের তলায় উত্তরীয়ে জড়ানো পুঁথি নিয়ে নিরতিশয় জাড্যে ভারাক্রান্ত বিশ্বরূপ এক ঘণ্টার বেশি বসে থাকল। গঙ্গায় পুঁথি বিসর্জন দেওয়া হল না। গোরার পড়ার জন্যে পুঁথিটা না রাখা অপরাধ হবে, এই বিবেচনায় বাড়ি ফেরার জন্যে যখন সে পথে এসে দাঁড়াল, পরিপূর্ণ সূর্যদেব তখন পুব আকাশের দখল নিয়েছে। কোমরে শক্ত করে বাঁধা ধুতির কসির নিচে পুঁথি রেখে, শরীরের উড়নিটা ভালো করে জড়িয়ে, বাড়ির উঠোনে পা দিয়ে বিশ্বরূপ দেখল, সেখানে হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে। সকালের রোদ পড়ে ঝিলমিল করছে বুড়ো নিমগাছের ঝাঁকড়া মাথা। উঠোনের মাঝখানে হলুদ রেশমের বলের মতো একটা কুকুরছানা নিয়ে গোরা বসে আছে। খুব বেশি এক মাসের ছানাটা গোরার কোলে চুপ করে বসে মাঝে মাঝে চাটছে গোরার মুখ। গোরার সামনে থালা বোঝাই ভাত। বাচ্চাটার মুখ দু-একবার থালার ভাতে গুঁজে দিয়ে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে গোরা। দু-এক দানা ভাত তার মুখে গেলেও বেশি ঢুকছে নাকে। অবোধ জীবটা কুঁইকুই করে ডাকছে। ভাতের থালাটা যে গোরার, একবার দেখে বিশ্বরূপের চিনতে অসুবিধে হল না। ছেলের জাতধর্ম নষ্ট হচ্ছে দেখে তাকে একটানা করুণ গলায় শচী যা বোঝাতে চাইছে, তা হল—ম্লেচ্ছ, যবনরা রাস্তার কুকুর ধরে বাড়িতে পালন করলেও ব্রাহ্মণ সন্তানের পক্ষে এটা গর্হিত কাজ। রাস্তার যেখান থেকে ধরে এনেছে, সেখানে গিয়ে এখনই শাবকটিকে রেখে আসা উচিত। মা কুকুর হয়তো খুঁজছে নিজের বাচ্চাকে। মায়ের দুধ খাওয়ার জন্যে বাচ্চার পেট খিদেতে চুঁইছুঁই করছে।

গোরার মন গলাতে যতভাবে সম্ভব শচী বোঝালেও চার বছরের শিশুর ভাবান্তর দেখা গেল না। বিশ্বরূপকে দেখে গোরা হাসলেও কোল থেকে বাচ্চাটা নামানোর লক্ষণ দেখাল না। নিমগাছের তলায় মাথাতে গামছা জড়ানো, খালি গা, পরনে খেটো ধুতি, ঈশানদাদা দাঁড়িয়ে দেখছে, কুকুর বাচ্চাকে গোরার আদর। ঈশানদাদার মুখে মুচকি হাসি। শচী ঠাকরুণ হুকুম করলে এখনই চিলের মতো ছোঁ মেরে গোরার কোল থেকে বাচ্চাটা তুলে নিয়ে সে এমন জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসতে পারে, যেখান থেকে এই কুকুরশাবক আর কখনও এ বাড়িতে ফিরতে পারবে না। গোরার সামনে তেমন হুকুম জারি করতে শচী সাহস পাচ্ছে না। চার বছরের ছেলেটা যেমন একরোখা, তেমনি তার গায়ের জোর। যে গতিতে মাথায় লম্বা হচ্ছে, সেভাবে তার ওজন বাড়ছে। তাকে কোলে তুলে শচী এখন হাঁসফাস করে। গা তুলোর মতো নরম হলেও হাত পায়ের হাড় বিশ্বরূপের চেয়ে চওড়া। বিশ্বরূপ নজর করেছে, গর্ভধারিণী মা হয়েও শচী কখনও-সখনও গোরার মুখের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন এ ছেলে, তার নয়, স্বর্গের কোনও দেবতা তাদের ঘরে নেমে এসেছে। বিশ্বরূপের সন্দেহ হয়, বুরহানউদ্দিন দরগার তিন রাতের স্মৃতি মা রোমন্থন করছে। অন্ধকার মাজারে স্মৃতি বিস্মৃতিতে আধেক লীন তিন রাত হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার কিছু ঘটনা মা আজও ভুলতে পারেনি।

উঠোনে ভাতের থালা দেখে চারপাশে জড়ো হওয়া কিছু কাক সমানে ডেকে চলেছে। থালার দিকে দু’পা এগিয়ে এসে, পেছিয়ে যাচ্ছে তিন পা। ধুতির নিচে তলপেটের কাছে গুঁজে রাখা পুঁথিটা ঘরের গোপন জায়গায় রাখার জন্যে বিশ্বরূপ ব্যস্ত হয়ে পড়লেও উঠোন ছেড়ে নড়তে পারছে না। গোরার ভাতের থালাটা শচী যে আর হেঁসেলে তুলবে না, বিশ্বরূপ জানে। ঈশানদাদাকে হয়তো দান করে দেবে এই কাঁসার থালা। শচী অন্যভাবে গোরাকে বোঝাতে চেষ্টা করল। বলল, এই মাগিগণ্ডার দিনে তুই এক থালা ভাত নষ্ট করলি? কত লোক না খেয়ে আছে! এভাবে ভাত নষ্ট করতে হয়?

মায়ের মুখের ওপর চোখ রেখে গোরা বলল, নষ্ট করলুম কোথায়?

কুকুরছানাকে এত যে ভাত দিয়েছিস?

মাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে গোরা বলল, আমরা খেলে নষ্ট হয় না, আর কুকুরছানাকে খাওয়ালে কেন নষ্ট হয় মা?

চার বছরের ছেলের প্রশ্নের জবাবে থমতমত খেয়ে শচী কী বলবে, ভাবতে থাকল। গোরার পেছনে দাঁড়িয়ে চোখের ইসারায় ঈশান কিছু বলতে চেষ্টা করছে। শচী না বুঝলেও বিশ্বরূপের আন্দাজ করতে অসুবিধে হল না। ঈশান বলতে চাইছে, আপাতত ছোট ঠাকুরকে ছাড়ান দ্যান। কুকুরছানাটা ঠিক সময়ে আমি সরিয়ে ফেলব।

ঈশানের সংকেত না বুঝলেও শচী চুপ করে গেছে। গোরার প্রশ্নটা তার সংস্কারের শেকড় পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে। আজন্ম সে জানত, মানুষের রান্না করা ভাত-তরকারি, কুকুর বেড়ালের জন্যে নয়, মানুষের পেটে গেলে, তবেই অন্নব্যঞ্জনের সদ্ব্যবহার হয়, পশুপাখিতে খেলে অপচয় হয়, তার এতদিনের জানা, গোরার প্রশ্নে এলোমেলো হয়ে গেল। বিশ্বরূপ অবাক হল না। চার বছরের ভাই যে এরকম প্রশ্ন করার অধিকারী, এ আভাস তার পুঁথিতে আছে। পুঁথিতে লেখা আরও অনেক বিষয় ভবিষ্যতে মিলে যাবে, এ নিয়ে তার সন্দেহ নেই। ভাগ্য ভালো, পুঁথিটা সকালে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়নি। এ পুঁথি শুধু গোরার পড়ার জন্যেই রেখে যাওয়া দরকার।

গোরার হাঁটুতে বসে তার থালা থেকে কুকুর ছানাটা জিভ দিয়ে দু’চার দানা ভাত তুলে শ্লথ ভঙ্গিতে খাচ্ছে। খুশিতে জ্বলজ্বল করছে গোরার দু’চোখ। তার আদুল গা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে সোনালী আভা। বিশ্বরূপের দিকে তাকিয়ে গোরা মিটিমিটি হাসছে। বিশ্বরূপের মনে হল, উড়নি জড়ানো তার তলপেটে গুঁজে রাখা পুঁথি গোরা দেখতে পাচ্ছে। উঠোন ছেড়ে শশব্যস্তভাবে ঘরে ঢুকে যে গুপ্ত জায়গায় পুঁথিটা রাখা ছিল, সেখানে রাখল। খড়ের ছাউনি দেওয়া দু’ঘরের মাটির বাসাতে পুঁথি লুকিয়ে রাখার মতো গোপন জায়গা বিশেষ নেই। শচীর পরিত্যক্ত, ছেঁড়া, কাপড়, কানি বোঝাই চ্যাচাড়ির ঝুলির একদম নিচে, নিজের মতো একটা গোপন জায়গা বানিয়ে আড়াই বছর ধরে সেখানে পুঁথি রাখছে বিশ্বরূপ। ঝুলিতে শচী সাধারণত হাত দেয় না। ধুলো ময়লা ঝেড়ে, ঝুলি পরিষ্কার করে, বাতিল বসন, ন্যাকড়া গুছিয়ে রাখার চিন্তা কদাচিৎ মাথায় এলে, শচী বরাত দেয় বিশ্বরূপকে। দ্বিতীয়বার মাকে বলার সুযোগ দেয় না সে। পুরনো চ্যাচাড়ির ঝুলি নিয়ে সে উঠোনে চলে যায়। মায়ের নির্দেশমতো ঝুলি পরিষ্কার করতে বসে টের পায়, পুঁথিটা বেশিদিন এভাবে লুকিয়ে রাখা যাবে না। তার অনুপস্থিতিতে মা কখনও ঝুলি সাজাতে বসলে পুঁথির খবর ফাঁস হয়ে যাবে। নতুন জায়গা খুঁজতে হবে। নিজের পড়ার পুঁথিপত্রের দপ্তরের কোথাও ঢুকিয়ে রাখার চিন্তা মাথায় এলেও সব দিক ভেবে সাহস পায়নি। প্রায়ই তার পাঠের দপ্তর বাবা নেড়েচেড়ে দেখে। তেমন ঘটলে, তার লেখা পুঁথি বাবার নজর এড়াবে না। সংসারে দক্ষযজ্ঞ লেগে যাবে। ঝুলির তলায় যত্ন করে পুঁথিটা রেখে বিশ্বরূপের মাথায় অন্য যে ফন্দি এল, তা হল—শচীর কাছে পুঁথিটা গচ্ছিত রাখবে। মা পড়তে জানে না। কোনও পাঁজিপুঁথিতে উৎসাহ নেই। আড়াই বছর আগে যে পুঁথি তার ছেলে লেখা শেষ করেছে, সেটাই মায়ের কাছে জমা রাখছে, শচী বুঝবে না। যত্ন করে নিজের লোহার তোরঙ্গে পুঁথি রেখে দেবে। মায়ের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ থাকবে তার পুঁথি। খবরটা জগন্নাথকে জানানোর মতো নয়, ধরে নিয়ে শচী ভুলে যাবে।

পুঁথি রাখার সমস্যার সমাধান পেয়ে বিশ্বরূপের মন যখন খুশিতে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে, তখনই উঠোন থেকে ভেসে এল জগন্নাথের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর। কাটোয়ার যজমানবাড়িতে মধ্যরাতের শান্তি স্বস্ত্যয়ন ছেড়ে বাবা ঘরে ফিরেছে, বিশ্বরূপের বুঝতে অসুবিধে হল না। আগের দিন দুপুরে কাটোয়া রওনা হয়ে সারারাত গৃহস্থের বাড়িতে বাবা পূজার্চনা করেছে। ঘর ছেড়ে দাওয়ায় এসে বিশ্বরূপ দেখল, নিমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে গোরার কোলের কুকুরছানাটা ঈশানের হাতে তুলে দেওয়ার হুকুম দিল বাবা। মনিবের হুকুম মতো ঈশান সামনে এসে দাঁড়ালেও তার দিকে গোরা ভ্রুক্ষেপ করছে না। বাবার গলা চড়লেও গোরা নির্বিকার রাগে জগন্নাথের শরীর থেকে গরদের উত্তরীয় উঠোনে খসে পড়েছে। গলা থেকে পিঠ, বুক জুড়ে ঝুলছে পরিচ্ছন্ন, সাদা যজ্ঞসূত্র, যার আর এক নাম উপবীত, ব্রাহ্মণ পরিচয়ের পবিত্রতম চিহ্ন। ধুন্ধুমার কিছু ঘটতে চলেছে অনুমান করে গোরাকে শচী বলল, দিয়ে দে বাবা, ঈশানদাদার হাতে ছানাটা দিয়ে দে।

মায়ের অনুরোধে গোরা কান দিল না। রাগে ফুঁসে উঠে ঈশানকে জগন্নাথ বলল, নির্বোধের মতো তাকিয়ে না থেকে ওটা কেড়ে নিয়ে গঙ্গার ওপারে ছেড়ে দিয়ে আয়।

ঈশানকে দ্বিতীয়বার বলার আগে গোরাকে বাঁচিয়ে কুকুরশাবকের ওপর চিলের মতো সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গোরার আঘাত না লাগলেও তার কোল থেকে ছোঁ মেরে ছানাটা ঈশান তুলে নিতেই তলপেটে গোরা এমন এক লাথি কষালো যে, মাঝবয়সি মানুষটা ওঁক করে আওয়াজ করল। পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো গোরার লাথিটা যে জোরালো, কারও বুঝতে অসুবিধা হল না। পেটে লাথি খেয়েও কুকুরছানা কাঁধে তুলে খিড়কি দরজার দিকে দৌড় দিল ঈশান। আজন্ম ব্রাক্ষ্মণ মনিবের হুকুম মেনে আসতে শিখেছে সে। কাজে তার ব্যত্যয় নেই। শিশুর নরম কোল থেকে কড়াপরা হাতের মুঠোয় বন্দি কুকুরছানার কুঁইকুঁই কান্না, যখন সদরের বাইরে মিলিয়ে যাচ্ছে, গোরার চোখ দিয়ে তখন আগুন ছুটছিল। সে উঠে দাঁড়ালেও কুকুরছানা কাড়তে ঈশানকে তাড়া করল না। আচমকা এসে জগন্নাথের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সজোরে টান মেরে তার উপবীত ছিঁড়ে নিয়ে খোলা সদর দরজার দিকে দৌড় লাগাল। টাল খেয়ে মাটিতে পড়ার আগে নিজেকে সামলে নিয়ে যন্ত্রণামাখা মুখে জগন্নাথ সোজা হয়ে দাঁড়াল। যন্ত্রণার কারণটা তখনও সে বুঝতে পারেনি। পরের মুহূর্তে দেখল, পঞ্চাশ বছর ধরে যে উপবীত শরীরে ধারণ করছে, ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের সেই পবিত্র চিহ্ন বুকের ওপর থেকে অদৃশ্য হয়েছে। উপবীত ছেঁড়ার যন্ত্রণায় একটু আগে মুখে যে কাতর ভাব জেগেছিল, নিমেষে তা মৃত্যুযন্ত্রণায় রূপান্তরিত হল। দু’হাতে মুখ ঢেকে জগন্নাথ আর্তনাদ করে উঠল, আমার ধর্মনাশ হল। গঙ্গায় ডুবে মরা ছাড়া আমার কোনও উপায় নেই।

ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল শচীর মুখ। জল পড়ছিল দু’চোখ দিয়ে। বিশ্বরূপকে বলল, দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? যা গোরাকে গিয়ে ধর্, ধরে নিয়ে আয়, বাবার পৈতেটা উদ্ধার করে দে।

উঠোনেতে হাঁটু ভেঙে বসে কপাল চাপড়ে জগন্নাথ শাস্ত্রবাক্য আউড়ে চলেছে। শরীর থেকে ছিঁড়ে নেওয়া পৈতে যে আর ব্যবহার করা যায় না, সেটা করা গুরুচণ্ডালী দোষ, মহাপাতক হওয়া, মৃত্যু ছাড়া এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত নেই, প্রলাপের মতো বকে চলেছে।

রাত জেগে পুজো-অর্চনা করার জন্যে জগন্নাথের দু’চোখ লাল। হাহাকার করলেও শুকনো খটখটে দু’চোখের জমি। জগন্নাথ বলছিল, এ ছেলে আমার নয়, ব্রাহ্মণের রক্ত নেই এর শরীরে। আমাদের কুলভ্রষ্ট করে দেবে ও। যবন আর পাষণ্ডিদের চেয়ে ও সাংঘাতিক প্রতিলোমজাত সন্তানের অধম এই ছেলে যেন কোনওভাবে আমার পারলৌকিক কাজে অংশ না নেয়।

জগন্নাথের শেষ কথাটা শুনে শচী আতঙ্কে কেঁপে উঠল। স্বামীর মুখে এমন মন্তব্য শুনবে সে আশা করেনি। ‘প্রতিলোমজাত সন্তান’ শব্দ দুটো শুনে বিশ্বরূপও আঁতকে উঠেছে। শব্দ দুটোর অর্থ সে জানে। ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে শূদ্র পুরুষের পরিণয়কে প্রতিলোম বিবাহ এবং তাদের সন্তানকে প্রতিলোমজাত সন্তান বলা হয়। ন্যায়শাস্ত্রীরা তেমন সন্তানকে শূদ্রের বেশি গুরুত্ব দেয় না।

.

বাবার রুষ্ট আক্ষেপোক্তির মধ্যে যে রহস্যের ছায়া বিশ্বরূপ দেখল, তা সে নিজের পুঁথির আখ্যানের ভেতরে অব্যক্ত আখ্যানেও খুঁজে পায়। ক্রোধাবিষ্ট বাবার না বলা কথার সঙ্গে কীভাবে যেন মিলে গেছে তার পুঁথির অলিখিত কথকতা। উঠোনে সে আর দাঁড়াতে সাহস পেল না। গোরার খোঁজে বাড়ির সদরে এসে দেখল, সামনে ফাঁকা মাঠের দিগন্তের দিকে গোরা ছুটে চলেছে। গোরা কোথায় যেতে পারে, বিশ্বরূপের অনুমান করতে অসুবিধে হল না। মাঠের উত্তর-পুব দিকে আরও আধ ক্রোশ দূরে, বেলপুখুরিয়া গ্রামে দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তীর বাড়ি। দাদামশাই-এর নয়নের মণি হল গোরা। গুরুতর কোনও দুষ্টুমি করে দাদামশাই-এর কোলে গিয়ে একবার বসে পড়তে পারলে, আর কোনও শাস্তির ভয় নেই, গোরা জানে। ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেলেও তাকে ছুঁতে পারবে না জগন্নাথ। তার শরীর থেকে ছিঁড়ে নেওয়া উপবীত মাথায় জড়িয়ে নিয়ে চার বছরের গোরা তখনও ছুটে চলেছে বেলপুখুরিয়ার দিকে।

গোরা কোথায় যাচ্ছে, আঁচ করতে পেরে তার পেছনে বিশ্বরূপ ছুটল না। মাঠের মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে মামারবাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। মাথা ঘুরছিল তার। গোরা সম্পর্কে বাবার কটূক্তি, তার পনেরো বছরের জীবনের শেকড় পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছিল। তার চারপাশের পৃথিবী নাচছিল, সমাজ, সংসার, পরিবার নাচছিল, সেই সঙ্গে মা-বাবা-ভাইকে ঘিরে তার যে ভালোবাসার জগৎ, তার ওপরে পড়ল এক উদাসীন নক্ষত্রের ছায়া। বেলপুখুরিয়ার দিকে যন্ত্রের মতো হাঁটছিল, প্রশ্নের ঝড় বইছিল মাথাতে। নিজের সন্তানকে জগন্নাথ কীভাবে প্রতিলোমজাত সন্তান বলতে পারল। মৃত্যুর পরে জন্মদাতার পারলৌকিক কাজ থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করার ফরমান কীভাবে স্ত্রী আর বড় ছেলের সামনে জারি করল? চার বছর আগে সদ্যোজাত গোরার মুখ দেখে জগন্নাথ কি সন্দেহজনক কিছু অনুমান করেছিল? জগন্নাথ কি ধরে নিয়েছিল নবজাত ছেলের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক নেই। বুরহানউদ্দিনের দরগায় দুর্যোগের রাতে বরুণদেব, পবনদেবের হাজির হওয়ার খবর জগন্নাথের জানা সম্ভব ছিল না। মাজারের গর্ভগৃহে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা শচীর কাছে দুই দেবতা হয়তো তিনরাত-ই এসেছিল। যজ্ঞাগ্নি থেকে উদ্ভূত কোনও দেবদূত পায়েস খেতে দিয়েছিল শচীকে। বরুণদেবের নির্দেশে দেবদূত এ কাজ করতে পারে। পবনদেব করে থাকলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সন্তানশোকে জর্জরিতা শচীকে কৃপা করে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করার ব্যবস্থা তারা করতেই পারে। নিজের লেখা পুঁথিতে, স্পষ্ট করে না হলেও এমন সঙ্গত সম্ভাবনার কথা বিশ্বরূপ লিখেছে।

হেমন্তের সূর্য পুব আকাশের ওপরে উঠে এসেছে। মাঠ জুড়ে সকালের রোদ ছড়িয়ে থাকলেও, তাপ সেরকম অসহ্য নয়। মামাবাড়িতে যাওয়ার সুয়োগ পেলেই বিশ্বরূপ সেখানে পৌঁছে যায়। সমবয়সি মামাতো ভাই লোকনাথ আছে সেখানে। ঠিক সমবয়সি নয়, বিশ্বরূপে চেয়ে দু’বছরের ছোট। বিশ্বরূপকে প্রাণাধিক ভালোবাসে। হপ্তায় অন্তত পাঁচদিন বিশ্বরূপের সঙ্গে দেখা করতে বেলপুখুরিয়া থেকে পিসিমা, শচীর বাড়ি যায়। প্রায় রাতে থেকে যায় পিসির বাড়িতে। রাতে বিছানায় বিশ্বরূপের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত গল্প করে। বিশ্বরূপের পুঁথি লেখার ঘটনা পরিবারের কেউ না জানলেও লোকনাথ জানে। পুঁথির বিষয় তার অগোচর। তবে পুঁথি লেখা শুরু করার পর থেকে বিশ্বরূপ পাল্টে যাচ্ছে, উড়ুউড়ু ভাব, উদাসীন হয়ে যাচ্ছে, সে অনুভব করে। পুঁথিটা গোপনে রাখতেও বিশ্বরূপ সদাসতর্ক। পুঁথি পড়ার কৌতূহল থাকলেও মনের ইচ্ছে লোকনাথ জানাতে পারেনি বিশ্বরূপকে। বেলপুখুরিয়াতে দাদামশাই-এর বাড়ি থেকে গোরাকে নিয়ে আসা তার কর্ম নয়, জেনেও বিশ্বরূপ যে সেখানে যাচ্ছে, তার একটা কারণ লোকনাথ। অদ্বৈতের চতুষ্পাঠীতে লোকনাথ তার সহপাঠী। চার বেদ, ব্যাকরণ, কাব্য, স্মৃতি ও দর্শনের প্রথমাংশ অর্থাৎ বেদ আর ব্যাকরণ পাঠের চৌহদ্দি লোকনাথ এখনও টপকাতে পারেনি। শাস্ত্রবিদ নীলাম্বর চক্রবর্তীর নাতি হয়েও ছাত্র হিসেবে সে তেমন মেধাবী নয়। স্মৃতি আর দর্শনের পাঠক্রমে বিশ্বরূপ পৌঁছে গেলেও তেরো বছর বয়সেও ব্যাকরণে হোঁচট খাচ্ছে লোকনাথ। সে ধরে নিয়েছে, ভবিষ্যতে মহাপণ্ডিত হয়ে বিশ্বরূপ টোল খুললে, সেখানে তার কর্মসংস্থান হয়ে যাবে। শিশুদের বর্ণপরিচয়, হস্তলিপি শিক্ষক হতে অসুবিধে হবে না। এক বিছানায় শুয়ে মধ্যরাতে মনের ইচ্ছেটা একদা সে জানাতে তার বুকের ওপর হাত রেখে সস্নেহে বিশ্বরূপ বলেছিল, আমি থাকতে তোর কোনও অসুবিধে হবে না।

লোকনাথের মন ভোলাতে এ আশ্বাস বিশ্বরূপ দেয়নি। সহোদরের মতো লোকনাথকে সে স্নেহ করত। গোরার জন্মের আগে, যখন সে পরিবারের একমাত্র সন্তান, তখন থেকে লোকনাথকে ভাবত আপন ছোটভাই। আজও সেই মনোভাব বজায় রয়েছে। দাদার আশ্বাসে গলে গিয়ে লোকনাথ বলেছিল, ইহজীবনে তোমার পাশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।

.

মামাবাড়ি থেকে গোরাকে নিয়ে ফেরা অসম্ভব জেনেও প্রাক-দ্বিপ্রহরে বিশ্বরূপ বেলপুখুরিয়া যাচ্ছিল, লোকনাথের সঙ্গ পেতে। লোকনাথ তার ন্যাওটা, তাকে ভালবাসে, সবসময়ে তার প্রশংসা করে। লোকনাথ পাশে থাকলে তাই সে আনন্দ পায়। দুই কিশোরের বন্ধুত্ব এমন যে একজন অন্যের জন্যে প্রাণ দিতে পারে। কৈশোর, তারুণ্যে এটা সম্ভব। এক রাতের জন্যে নবদ্বীপে গিয়ে বিসূচিকা রোগে অদ্বৈত সেখানে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় তাঁর মেজছেলে কৃষ্ণমিশ্র এসে কয়েকদিন ধরে নবদ্বীপের টোল সামলাচ্ছে। অদ্বৈতের অনুপস্থিতির জন্যে যেহেতু চতুষ্পাঠীতে যাওয়া বিশ্বরূপ বন্ধ রেখেছে, লোকনাথও সে রাস্তা মাড়াচ্ছে না। বিশ্বরূপের সঙ্গে দেখা করতে পিসির বাড়িতেও আসেনি। গোরার মতো সহোদরতুল্য লোকনাথের সঙ্গে রোজ দেখা না হলে বিশ্বরূপের মন হু হু করত। মেঠো পথ ধরে দ্রুততর হল বিশ্বরূপের হাঁটা। গোরাকে বাড়িতে ধরে আনার চেয়ে লোকনাথের খবর নেওয়া কম দরকারি নয়। বেলপুখুরিয়ায় মামাবাড়িতে বিশ্বরূপ পৌঁছালো, সূর্য যখন প্রায় মাঝ আকাশে ঠেকেছে। গোরা অনেক আগে সেখানে পৌঁছে গিয়ে, বাড়িতে যা ঘটেছে, আদ্যোপান্ত দাদুকে শুনিয়ে মাথায় জড়ানো ছিন্ন উপবীত খুলে বয়স্ক মানুষটার হাতে তুলে দিয়েছিল। চার বছরের ছেলে যে বাড়ি থেকে তিন পোয়া পথ একা চলে আসতে পারে, মাতুলালয়ের কারও কল্পনায় ছিল না। মা-বাবার সঙ্গে বেশ কয়েকবার, এমন কি বিশ্বরূপের সঙ্গে একাধিকবার এলেও একা কখনও আসেনি। মায়ের সঙ্গে এসেছে ডুলি চেপে। ডুলির পাশে তাল মিলিয়ে হেঁটে এসেছে জগন্নাথ। পাশে বিশ্বরূপ। পাল্কি চেপে চারজন একসঙ্গে এসেছে শুধু একবার। এক বছরের গোরাকে কোলে নিয়ে একবারই মামাবাড়িতে এসেছিল বিশ্বরূপ। পথে পাঁচ-সাতবার গাছতলায় দাঁড়িয়ে কপালের ঘাম মুছে হাঁপরের মতো বুক ভরে বাতাস নিয়েছে। তার এক বছরের ভাই-এর আকার আর ওজন তিন-চার বছরের যে-কোনও হৃষ্টপুষ্ট ছেলের সমান, তা জেনেও কোন সাহসে গোরাকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল সে জানে না। পথের মাঝখানে বার কয়েক গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময়ে, কাজটা যে বেহিসেবির মতো হয়েছে, টের পেয়েছিল। আসলে, গোরাকে কোলে রাখলে ঘরে বাইরে অনেক মানুষের দৃষ্টি কাড়া যায়, বহুজনের নজর আকর্ষণ করে হেঁটে যাওয়ায় যে মজা হয়, ঈষৎ অহঙ্কার জন্ম নেয়, ছোটভাই-এর তিন মাস বয়স থেকে বিশ্বরূপ তা ঠাহর করেছে। গোরার মতো দশাসই, রূপবান শিশু যে গৌড়বাঙ্গালায় দ্বিতীয় নেই, বিশ্বরূপ হলফ্ করে বলতে পারে। গোরার যখন এক-দেড় বছর বয়স, তখন তাকে কোলে নিতে পাড়ার জ্যেঠি, কাকিরা হামলে পড়ত। বেশিদিন সে সুযোগ তারা পায়নি। হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের থেকে তারা সরে গিয়েছিল। গোরা দু’বছরে পা দেওয়ার পরে, দাই সনকা ছাড়া তাকে চাগিয়ে কোলে তোলার শক্তি পাড়ার মেয়েমহলে কারও ছিল না।

দাদামশাই, নীলকান্ত চক্রবর্তীকে বাবার উপবীত ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার বিবরণ গোরা শোনালেও তার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সবচেয়ে বড় কথা, তাকে নিয়ে সেই মুহূর্তে কী করা যায়, নীলকান্তর দুই ছেলে যজ্ঞেশ্বর, রত্নগর্ভ, দুই পুত্রবধূ, অন্য আত্মীয়-পরিজন যারা ছিল, ভেবে পাচ্ছিল না। সবাইকে শান্ত করে, গোরাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ভার নীলকান্ত নিজে নিলেও ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই এত বিহ্বল যে তাদের গুলতানি থামেনি। দাদামশাই-এর কোলের কাছে বসে অকুতোভয়ে দিদিমাকে গোরা শোনাচ্ছিল তার পছন্দের খাদ্যতালিকা। চার বছরের নাতিকে সেই দুপুরে ষোড়শোপচারে খাওয়ানোর জোগাড় করার আগে দিদিমা, নাতিতে যখন বাক্যালাপ চলছে, বিশ্বরূপ সেখানে পৌঁছল। দাদাকে দেখে গোরা এত খুশি হল, যে তাকে জড়িয়ে ধরে, তার পছন্দের তরকারির নাম বলতে থাকল। বলল, শুক্তো খাব, বড়ি, মরিচের ঝোল খাব, লাবড়া খাব, ফুলবড়ির তরকারি খাব।

—আর কী খাবি?

দিদিমার প্রশ্নের জবাবে গোরা বলে চলল, মুগের ডাল, পটলভাজা, কুমড়ো, মানচাকী, বড়ার অম্বল, লাউ-এর পায়েস, কলাবড়া, ঘন দুধ।

গড়গড় করে খাওয়ার ফর্দ গোরা বলার মাঝখানে বিশ্বরূপকে বাড়ির অন্দরমহলে ডেকে নিয়ে গেল, তার বড়মামার মেয়ে, মাধুরী। লোকনাথের ছোট বোন মাধুরীর বয়স দশ। তার কাছ থেকে বিশ্বরূপ জানল, তিনদিন ধরে জ্বরে লোকনাথ শয্যাশায়ী। বিশ্বরূপ এসেছে শুনে, লোকনাথ বিছানায় উঠে বসেছে। গোরার কাণ্ড দেখে হতবাক দুই মামিও পুরো ঘটনা বিশ্বরূপের মুখ থেকে শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। লোকনাথের বিছানায় বসে, তার বুকে হাত রাখল বিশ্বরূপ। দু’হাতে তার ডান হাত চেপে ধরল লোকনাথ। জ্বরে মুখটা শুকিয়ে গেলেও বিশ্বরূপকে দেখে চকচক করে উঠল লোকনাথের দু’চোখ। মাটির মেঝেতে তালপাতার পাটি বিছোনো বিছানায় লোকনাথ আর বিশ্বরূপকে ঘিরে পরিবারের সবাই বসেছে। বিছানার ধার ঘেঁষে দুই মামি জায়গা করে নিলেও বাকিরা বসেছে মেঝেতে। দুই মামি, তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছোটমামা, সুধন্যকেও দেখল বিশ্বরূপ। গোরার কুকুরছানা ধরে আনা থেকে বাবার পৈতে ছিঁড়ে নিয়ে পালিয়ে আসা পর্যন্ত পুরো বিবরণ শুনে ছোটমামা, দুই মামি আঁতকে উঠলেও কমবয়সিরা যে খানিক মজা পেয়েছে, বিশ্বরূপ অনুভব করল। মজা পেলেও বড়দের মতো মুখ করে তারা গম্ভীর হয়ে রয়েছে। ছোটমামা প্রশ্ন করল, এখন উপায়? জামাইবাবুকে আবার উপবীত ধারণের অনুষ্ঠান করতে হবে। প্রায়শ্চিত্তের কিছু বিধান হয়তো আছে।

ছোটমামাকে আশ্বস্ত করতে বড়মামি বলল, বাবা নিশ্চয় নিদান বাতলে দেবেন।

তা বটে, বাবা যখন রয়েছেন, জামাইবাবুর কোনও অসুবিধে হবে না।

স্বামী কথা শেষ করতে মাধুরীকে ছোটমামি বলল, যা, গোরাকে এখানে ডেকে নিয়ে আয়। ওর নাচ অনেকদিন দেখিনি।

চার বছরের ছেলেটা গান শুনলে, এমনকি তাল মিলিয়ে হাততালি বাজালে নাচতে শুরু করে পরিবারের সকলে, পাড়াপড়শি পর্যন্ত জানে। বেতাল পায়ে হাঁটতে শুরু করার পর থেকে শুরু হয় তার নাচুনি। শুরুতে নাচত এলোমেলো পদক্ষেপণে, তারপর নিজের থেকে কীভাবে যে এক সুচারু ভঙ্গিমা সে রপ্ত করল, কেউ জানে না। বাড়ির দরজায় গান গেয়ে ভিক্ষুক এসে দাঁড়ালেও সেই গানের সঙ্গে পা মিলিয়ে সে নাচতে শুরু করে। ভিক্ষে চাইতে ভুলে গিয়ে নাচন্ত শিশুর দিকে তাকিয়ে নিজের গানে ভিখিরি আরও তন্ময় হয়ে যায়। স্বর্গ থেকে দু’পায়ে নৃত্য নিয়ে শিশুটি যে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, এমন বিশ্বাস নিয়ে তারা ফিরে যায়। গোরাকে ছেলেধরার চুরি করতে চাওয়ার কারণ যে তার নৃত্যপারদর্শিতা, এমন সন্দেহ অনেক প্রতিবেশী করে। মুসলমান মৌলবি আর ভট্টমারিরা যে নিজের নিজের সম্প্রদায় বাড়াতে শিশু চুরি করছে, এ বিশ্বাস ব্রাহ্মণদের মধ্যে চালু ছিল। বিশ্বাসের যথেষ্ট কারণ ছিল। নানা অঞ্চল থেকে শিশু চুরির খবর প্রায়ই পাওয়া যেত।

গোরার নাচ দেখতে পড়শি জ্যেঠি, কাকি, পিসিরা তাকে কোলে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। তার সব আবদার, দস্যিপনা হাসিমুখে মেনে নিতে তাদের আটকায় না। প্রায় লুটপাট করে তাদের ঘরের দৈ, সন্দেশ খায়, হাঁড়ি, কলসি ভাঙতে পর্যন্ত কসুর করে না। তার ডানপিটেমি অনেক সময় অসভ্যতার পর্যায়ে চলে গেলে, জ্যেঠি-কাকিদের কেউ আড়ালে দু-একটা চড়চাপড় কষিয়ে দেয়। বাড়িতে ফিরে মায়ের কাছে গোরা কোনও অভিযোগ না করলেও সে খবর পড়শিদের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। শচীর কানে পৌঁছোয়। শান্ত, নির্বিবাদী শচী, সব শুনে চুপচাপ, স্নেহান্ধ জননী হলেও সন্তানের দুরন্তপনা তার চেয়ে কে বেশি জানে! ছেলেকে নিজে শাস্তি দিতে না পারলেও গোরা যে শাস্তি পাওয়ার মতো কাজ হামেশা করে, এ নিয়ে তার সন্দেহ ছিল না। শুধু নিজের বাড়িতে নয়, অন্যের বাড়িতে ঢুকে, সেখানে সাজানো পুজোর নৈবেদ্য সে খেয়ে নেয়। গৃহস্থের বিস্ফারিত চোখের সামনে অহরহ এ কাজ করার পরেও তার মুখে অপরাধবোধের ছাপ থাকে না। কেউ শাসন করতে এলে বলে, আমার জন্যেই তো এসব রাখা ছিল।

চার বছরের ছেলের কথা শুনে গৃহস্থের ভির্মি খাওয়ার দশা হয়। সে ভাবে, লম্বা, চওড়া, সুগঠিত শরীর, এ ছেলে, শিশু নয়, সা-জোয়ান এক নটবর, নেচে গেয়ে জ্যেঠি, কাকি, পিসি, দাদা, দিদি, পিতৃব্যদের হৃদয় জয় করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে অনেক ঝামেলা পাকাবে।

দাদুর ঘর থেকে গোরাকে ডেকে আনতে মাধবীকে যারা পাঠিয়েছিল, নিজের ঘরে তাদের ডেকে নিল নীলাম্বর চক্রবর্তী। ছেলেমেয়ে নিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলে দুই পুত্রবধূ সেখানে ঢোকার আগে সুধন্য পৌঁছে গিয়েছিল। বাবার সামনে রাখা জলচৌকির ওপর জগন্নাথের গলা থেকে ছিঁড়ে আনা তালপাকানো পৈতেটা দেখে রত্নগর্ভ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, এখন উপায়?

শান্ত গলায় নীলাম্বর বলল, শাস্ত্রমতে ব্রাক্ষ্মণ শিশু কৃত বিধিবহির্ভূত কোনও কাজ অনাচার নয়। শিশুতে কোনও পাপ বর্তায় না।

এক মুহূর্ত থেমে নীলাম্বর বলল, আজ বিকেলে জগন্নাথের বাড়ি গিয়ে তার উপবীত সংস্কার করে আসব।

নীলাম্বর কথা শেষ করার আগেই তার দুই পুত্রবধূ, নাতিনাতনিরা ঘরে ঢুকে পড়েছিল চড়াই পাখির মতো কিচিরমিচির করে গোরাকে তারা ডাকছিল নিজেদের কাছে। দিদিমার কোল ঘেঁষে বসে, সকৌতুকে ভাইবোনদের দিকে তাকিয়েছিল গোরা। বড়মামি ডাকল, এই যে সোনার চাঁদ গোরা, আমার কাছে আয়।

গোরা নড়ল না। ছোটভাইকে বিশ্বরূপ বলল, মামিমা ডাকছেন, এসো।

গোরা না শোনার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। ছোটমামি বলল, গোরা, বাপ আমার, একটু এসো আমার কোলে।

দিদিমার পাশ ছেড়ে ওঠার কোনও লক্ষণ গোরা দেখাল না। বিছানা ছেড়ে অসুস্থ লোকনাথ উঠে এসেছিল। ঘরের চৌকাঠের বাইরে দাঁড়ানো ছোট বোন মাধুরীর কানে নিচু গলায় লোকনাথ কিছু বলতে দ্রুতলয়ের দশকোশী তালে মাধবী গান শুরু করল,

খোকা নাচে কোনখানে

শতদলের মাঝখানে।

প্রথম পংক্তি গেয়ে, আবার আখরে ফিরে গিয়ে দ্বিতীয় পংক্তির শুরুতে মাধুরী যখন হাতে তালি বাজাতে শুরু করল, এবং দ্রুত হল তার তালি বাজানো, দিদিমার পাশ থেকে ত্রিং করে উঠে গোরা নাচতে শুরু করল। মামাবাড়িতে এসে আগেও মাধুরীর গানের সঙ্গে সে নেচেছে, ভাইবোনদের সঙ্গে উঠোনে খেলার মধ্যে নেচেছে, সবটা ছিল খেলা, আজও তাই। তবু সে নাচ দেখে আগে কেউ এত উপভোগ করেনি। দশকোশী তালের সঙ্গে গোরার পা মেলানো, হাতের মুদ্রা, কটাক্ষ, চোখের অভ্যিবক্তি, সব মিলে এক নিপুণ নর্তকের অনুষ্ঠান দেখে সপরিবার বৃদ্ধ নীলাম্বর চক্রবর্তী অবাক হলেও তার বিস্ময় কাটতে সময় লাগল না। গোরার জন্মের আগে তার কুষ্ঠি, ঠিকুজি তৈরি করে এমন লক্ষণ নীলাম্বর দেখেছিল, যা মহাপুরুষদের ছক ছাড়া পাওয়া যায় না। গোরার জন্মের পরে সেই ছক, অল্পবিস্তর সংস্কার করতে হলেও সিংহ রাশি, সিংহ লগ্নে জন্ম শিশুটি ভবিষ্যতে অসাধারণ কিছু হবে, এ নিয়ে তার সংশয় ছিল না। গোরার নাচ দেখে অভিভূত নীলাম্বরের মনে হল প্রলয় পয়োধি জলের গভীর থেকে শিশু নটরাজ উঠে এসে নৃত্য করছে। গোরাকে একটু কোলে নেওয়ার জন্যে বুকের ভেতর যেমন আনচান করতে থাকল, তেমন আকুলতা অনুভব করল ছোটমামি। পরিবারের চার পাঁচজন শিশু গোরার সঙ্গে নাচে পা মিলিয়েছে। দশ বছরের মাধুরী সুরেলা গলায় গেয়ে চলেছে দ্রুতলয়ের দশকোশী,

সেখানে খোকা চুল ঝাড়ে
থোকা থোকা ফুল পড়ে
তাই নিয়ে খোকা খেলা করে।

মাধুরী গান শেষ করার পরে আরও কিছুক্ষণ গোরা নেচে গেল। শেষ পর্যন্ত দিদিমা দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে থামাল।

গৃহিণীকে নীলাম্বর বলল, দু’ভায়ের নাওয়া-খাওয়ার ব্যবস্থা করো। রোদ পড়লে ওদের আমি জগন্নাথের বাড়িতে দিয়ে আসব।

কথা শেষ করে ছোট ছেলে সুধন্যকে নীলাম্বর বলল, জগন্নাথ, শচীকে খবর পাঠিয়ে দাও, তার দু’ছেলেকে বিকেলে আমি পৌঁছে দেব।

এক মুহূর্ত থেমে নীলাম্বর বলল, জগন্নাথকে আরও জানিয়ে দাও, সে যেন একটা উপবীত কিনে, স্নান করে তৈরি থাকে। সূর্যাস্তের আগে তার বাড়িতে আমি পৌঁছে যাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *