গোরা – ৩০

৩০

নবদ্বীপে গণঅভ্যুত্থানের দুঃসংবাদ নিয়ে গৌড়ের রাজধানী একডালাতে মাঝরাতে চাঁদকাজি পৌঁছনোর আগে থেকে সেখানে নানা সূত্রে পৌঁছচ্ছিল রাঢ়, সমতট, সুম্ম জুড়ে বৈষ্ণবদের উপদ্রবের সত্যিমিথ্যে কাহিনী। নগরের দুই কোটাল, জগাই মাধাই-এর রাতারাতি হরিবোলা হয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত সুলতান হোসেন শাহের কানেও চলে গিয়েছিল। নবদ্বীপে বড়রকম একটা গোলমাল পাকিয়ে উঠছে, সুলতানের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কাজি সেখানে কী করছে, তার জবাবদিহি চাওয়ার সঙ্গে নিজের দরবারের ঝাড়ামোছার কাজে হাত লাগাতে সুলতান মনস করে ফেলেছিল। দরবারের অধিবেশনে কিছুদিন ধরে গা-ছাড়া ভাব এসেছে, ফাঁকফোকর দেখা যাচ্ছে প্রশাসনে। দরবারের ‘খান-ই-জাহান’ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, ফারুক ইসলামাবাদীকে একান্তে ডেকে নবদ্বীপের ঘটনাবলী যাচাই করতে পক্ষকাল আগে সুলতান হুকুম দিয়েছিল। দরকার হলে সেখানের কাজিকে একডালায় ডেকে পাঠাতে বলেছিল। সুলতানের কাছ থেকে এরকম একটা সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় ছিল প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদী। নবদ্বীপের সামাজিক পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠছে, যে-কোনও সময় বড় একটা হাঙ্গামা ঘটে যেতে পারে, অনুগত সিন্ধুকীদের কাছ থেকে নিয়মিত এমন খবরাখবর সে পাচ্ছিল। বৈষ্ণবরা দলে ভারী হওয়ার সঙ্গে তাদের প্রতিপক্ষও সমান তেজে জোট বাঁধছে। ন্যায়শাস্ত্রী আর স্মার্তদের উসকনিতে শাক্ত, শৈব, তান্ত্রিক, হিদুধর্মের যত শাখাপ্রশাখা, শ্মশান থেকে মন্দির পর্যন্ত বহু বছর ধরে গুলতানি পাকাচ্ছে, নবদ্বীপ থেকে হরিবোলাদের উচ্ছেদ করতে তারা সুযোগ খুঁজছে। বিদ্যাসমাজের রাজধানী নবদ্বীপ থেকে নৈষ্ঠিক বামুনরা যেমন হাবেলীশহর, যার আর এক নাম কুমারহট্টে ডেরা করে, ত্রিবেণী, গুপ্তিপাড়া, বংশবাটি, বৈদ্যবাটি, উলা আরও নানা অঞ্চলে লোকবল বাড়াতে শলাপরামর্শ করতে যাচ্ছে, তেমনই বৈষ্ণবরাও বসে নেই। প্ৰথমে তারা দলে টেনেছে শূদ্র, ম্লেচ্ছ, অচ্যুৎদের, এখন বাড়াচ্ছে প্রভাবের এলাকা। গঙ্গার পশ্চিমপাড় থেকে কুমারহট্ট, কাঞ্চনপল্লী ছেড়ে আরও দক্ষিণে সমুদ্রের কাছে সমতট পর্যন্ত তারা যাতায়াত শুরু করেছে। প্রতিপক্ষকে তারা ‘পাষণ্ডী’ বলে। ইতর, ম্লেচ্ছদের কাছে টানতে নাচগানের হুল্লোড় তুলে পথে পথে ঘুরে তারা ধর্মপ্রচার করছে। তাদের আরও বড় চালাকি হল, তারা প্রচার করছে, শূদ্র, ম্লেচ্ছরা নাকি একবার ‘কৃষ্ণ’ বললে বামুন হয়ে যাবে। বেদ, ব্রাহ্মণ, রাজা সবকিছু তারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চায়। চুলোয় যাক বেদ, ব্রাহ্মণ, তা নিয়ে ইসলামাবাদীর মাথাব্যথা নেই। কিন্তু রাজাকে উপেক্ষা করা যে সুলতানি শাসন অমান্য করার বিপজ্জনক চিন্তা, এটা বুঝেছিল ইসলামাবাদী। ধর্মের নামে বে-আদবি আর বাড়তে দেওয়া যায় না। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বামুনদের জব্দ করতে গোড়াতে হরিবোলাদের নাই দিয়েছিল সুলতানের দরবার। নাই দিলে হরিবোলারা এত মাথায় উঠবে, প্রশাসন ভাবেনি। সত্যি কথা বলতে কি, প্রশাসনকে ভাবতে দেওয়া হয়নি। প্রশাসনকে ভাবানোর বদলে সাকর মল্লিক, দবীর খাস, আরও কয়েকজন কাফের রাজকর্মচারী, হরিবোলাদের বজ্জাতির অনেক ঘটনা সুলতানের কাছে চেপে গেছে। দরবারের রীতি মেনে নবদ্বীপের পরিস্থিতি বিশদ জেনেও চুপ করে থেকেছে ইসলামাবাদী। হিদু সম্প্রদায়ের নিজেদের ভেতরের আকচাআকচির বিবরণ সাকর মল্লিক আর দবীর খাস, এই দু’ভাই ভালোরকম রাখে। দরবারের তরফ থেকে তাদেরই দায়িত্ব নবদ্বীপের সব খবর সুলতানকে জানানো। তারা জানায়নি, দরবারকে অন্ধকারে রেখেছিল। কেন জানায়নি, সুলতান এতদিনে নিশ্চয় টের পেয়েছে। নবদ্বীপকাণ্ডের ফয়সালা করার ভার দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদীকে। সাকর মল্লিক, দবীর খাসের ওপরওলা সে। সুলতানের হুকুমের অপেক্ষায় আইন মেনে মুখ বুজে অপেক্ষা করছিল। এতদিনে সুলতানের অনুমোদন পেয়েছে। এবার তার মাঠে নেমে পড়ার কথা। সে তাই করল।

নবদ্বীপের হিঁদুসম্প্রদায়ের ভেতরের খবর জোগাড় করতে ‘কোতওয়াল-ই-বক আলা’ সুলতানি গুপ্তচর শাখার কর্মকর্তাকে কাজে নামিয়ে দিল প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদী। কোতওয়ালপ্রধানের কাছ থেকে উদ্বেগজনক কোনও খবর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে না এলেও খুচরো যত তথ্য ইসলামাবাদীর নজরে পড়ছিল, তার সবটা স্বস্তিকর নয়। শ্রীবাসের বাড়িতে মহোৎসবের যে বিবরণ সিন্ধুকীরা এনেছিল, তা পিলে চমকে দেওয়ার মতো। নবদ্বীপে বড়রকম ঝামেলা হতে চলেছে, তখনই আভাস পেয়েছিল ইসলামাবাদী। বৈষ্ণবরা দল বেঁধে পথসঙ্কীর্তনে নামতে চলেছে, গুপ্তচর শাখা থেকে সেই উড়ো খবর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে এলেও কবে সেটা ঘটছে, সে হদিশ মিলল না। তখনই ধন্দে পড়েছিল ইসলামাবাদী। দিন ঠিক না করে এতবড় একটা অনুষ্ঠানের ঘোষণা হয় কীভাবে? ধাঁধা কাটল নবদ্বীপের কাজি প্রায় সারা রাত ঘোড়া ছুটিয়ে স্বয়ং হন্তদন্ত হয়ে রাজধানী একডালায় পৌঁছতে।

খান-ই-জাহানের অতিথিশালায় সকালের নাস্তাপানি সেরে ইসলামাবাদীর দপ্তরে পৌঁছে গেল চাঁদকাজি। নবদ্বীপে গণঅভ্যুত্থানের যে বিবরণ প্রধানমন্ত্রীকে সে শোনাল, তা স্ববিরোধিতায় ভরা। সঙ্কীর্তনকারীদের হাতে অস্ত্র না থাকলেও শুকনো চ্যালাকাঠে আগুন ধরিয়ে তারা ‘মার মার’ করে সিমুলিয়ায় কাজির বাড়ির দিকে ছুটে আসছিল। কাজির বাড়িতে আগুন লাগিয়ে সপরিবারে তাকে পুড়িয়ে মারার মতলব করেছিল তারা। তাদের নেতা, খ্যাপা বামুনপণ্ডিত, নবদ্বীপের মানুষ যাকে নিমাইপণ্ডিত নামে চেনে, দলবল নিয়ে নেচে গেয়ে অনুগামীদের মাতিয়ে দিয়েছিল। মুখে আনন্দের হাসি লেগে থাকলেও থেকে থেকে পাগলের মতো কাঁদছিল। দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছিল জল। মুখ, গলা, বুক ভেসে যাচ্ছিল চোখের জলে। মাঝে মাঝে সিংহের মতো এমন হুঙ্কার ছাড়ছিল যে, সঙ্গীদের বুক কেঁপে উঠছিল। মিছিলে মিশে থাকা সাদা পোশাক সিন্ধুকীরা খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জড়োসড় হয়ে থাকলেও কেউ তাদের গায়ে হাত তোলেনি। সুলতানের সিন্ধুকীদের মধ্যে যারা স্থানীয় লোক, নবদ্বীপবাসীদের অনেকে তাদের চেনে। তাদের কেউ কেউ নিজেদের পরিচয় লুকোতে সঙ্কীর্তনে গলা মেলালেও গোরার ভক্তরা সেইসব ফুৎকারীদের বিদ্রুপ করেনি, উল্টে কীর্তনের আবেশে তাদের বুকে টেনে নিয়ে কেঁদে কঁকিয়ে অস্থির হচ্ছিল। মহামিছিলের মধ্যে কিছু গুণ্ডাবদমাশও কপালে চন্দনের তিলক কেটে ঢুকে পড়েছিল। তারাই ‘কাজিকে মার কাজিকে কেটে ফেল’ হাঁক পেড়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা করতে সঙ্গীদের উসকে দিচ্ছিল। সমাজবিরোধীদের প্ররোচনায় কিছু মানুষ তেতে উঠছে, গুপ্তচরদের মুখ থেকে এ পর্যন্ত শুনে সিমুলিয়াতে মহামিছিল ঢুকতে নবদ্বীপ ছেড়ে কাজি পালিয়ে এসেছিল। তারপর কী ঘটেছে, সে জানে না।

কাজির বিবরণ শুনে ইসলামাবাদীর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠলেও সে মুখ খুলল না। যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে আসা মানুষটার দিকে না তাকিয়ে অবজ্ঞায় ভ্রু কোঁচকাল। দু’দণ্ড পরে কাজিকে নিয়ে সুলতানের খাস দরবারে পৌঁছে গেল। কাফেরদের চক্রান্তে নবদ্বীপ ডুবতে বসেছে, কাজির মুখ থেকে এ খবর সুলতানকে শোনাতে চায় ইসলামাবাদী। খাসদরবারে নিজের কামরায় খান-ই-জাহান ইসলামাবাদীকে নিয়ে চাঁদ কাজির মুখ থেকে নবদ্বীপের উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির বিবিরণ শুনে সুলতান হোসেন শাহের কোনও ভাবান্তর ঘটল না। মোমের তৈরি মূর্তির মতো রেখাহীন, শান্ত সুলতানের মুখ। তা দেখে যা বোঝার, ইসলামাবাদী বুঝে গেল। সুলতান ক্ষিপ্ত হয়েছে। নবদ্বীপের প্রজাদের ওপর যতটা চটেছে, তার দ্বিগুণ চটেছে কাজির পালিয়ে আসাতে। সুলতানের নরুনচেরা আধবোজা চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে। বিধ্বংসী যে কোনও কাণ্ড এখন ঘটতে পারে। সুলতানের মনস্তত্ত্ব বুঝতে ইসলামাবাদী ভুল না করলেও তার বোঝাতে খানিকটা খামতি ছিল। শুধু নবদ্বীপের ঘটনাতে সুলতানের ক্রোধ তুঙ্গে ওঠেনি, গৌড়ে ব্রাক্ষ্মণরাজ প্রতিষ্ঠার ছক তলে তলে অথচ দ্রুত এগিয়ে চলেছে, এমন কিছু তথ্যও নানা গোয়েন্দা সূত্র থেকে কয়েকদিন ধরে সুলতানের কানে আসছিল। কাজির বিবরণের সঙ্গে গোয়েন্দাবিভাগের পাঠানো গোপন তথ্য জুড়ে নিয়ে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সুলতান। ক্রোধ চেপে কাজিকে তখনই নবদ্বীপে গিয়ে সেখানে আগের রাতে বড় কিছু ঝামেলা হয়েছে কি না, জানাতে হুকুম দিল। চাঁদকাজিকে তার নিজের জায়গায় ফেরত পাঠিয়ে সেই বিকেলে খান-ই-জাহানের সঙ্গে সাকর মল্লিক, দবীর খাস, ব্যক্তিগত ছত্রধর, অর্থাৎ রক্ষীপ্রধান কেশব ছত্রীকে নিয়ে মন্ত্রণায় বসল সুলতান। মন্ত্রণার বিষয়, নবদ্বীপে অশান্তির কার্যকারণ, সুলতানি শাসনের ভিত মজবুত রাখতে উপযুক্ত ব্যবস্থার হদিশ করা। আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদীকে বাকি তিন পদস্থ রাজকর্মচারীর চেয়ে সুলতান বেশি গুরুত্ব দিল। অমর, সন্তোষ, কেশব, তিনজনই বুঝে গেল, ইসলামাবাদীর ছাতার তলায় এখন থেকে তাদের থাকতে হবে, নবদ্বীপসংক্রান্ত বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হবে শেষকথা। সুলতানের বড় বেশি শান্ত ভাবভঙ্গি দেখে চারজনই টের পেল রাগে গরগর করছে সুলতান। নির্বিকারভাবে চারজনকে এখনই শূলে চাপাতে পারে। মোলায়েম গলায় ক্রমাগত ‘জী জাঁহাপনা’ বলে আত্মরক্ষা করতে থাকল চার সর্বোচ্চ পদের রাজকর্মচারী। বৈঠক শেষ করে সুলতান ফিরল দরবারে। চার রাজকর্মচারীও দরবারে এসে যে যার জায়গায় বসল।

মসনদে বসে রাগ কিছুটা কমলেও সুলতানের মাথায় দুশ্চিন্তা পাক খাচ্ছিল। গৌড়ের মসনদ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, সুলতান হোসেন শাহের অজানা ছিল না। সুলতান হওয়ার পরে জেনেছে, গৌড়ের, শুধু গৌড় কেন, গোটা আর্যাবর্তের শাসকদের হিমশিম খাওয়াচ্ছে হিন্দু, মুসলিমের ধর্মীয় বিভাজন। পাঁচশ’বছরে শত্রুতা দু’সম্প্রদায়ের রক্তের গভীরে এত প্রবলভাবে ঢুকে গেছে যে এখানে সিংহাসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ অথবা সংখ্যালঘু যে সম্প্রদায়ের শাসক বসুক, তাকে নিজের সম্প্রদায়কে তুষ্ট রাখতে হবে, বৈরী ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে বজায় রাখতে হবে দূরত্ব; নরমে গরমে বশে রাখতে হবে তাদের। দরবারের হিন্দু রাজকর্মচারীদের সঙ্গে মুসলিম উজির লস্করদের যে চাপা রেষারেষি রয়েছে, সুলতানের অজানা ছিল না। মুসলিম কর্মচারীরা যেমন ভাবত তাদের ধর্মীয় সুলতান তাদের নিজেদের লোক, তেমনই হিন্দু কর্মচারীরা ভাবত তাদের তোষামুদিতে সুলতান গলে গিয়ে, তাদেরই বেশি বিশ্বাসী, নির্ভর করার মতো কর্মচারী ভাবছে। নিজেদের গোঁড়ামি আড়াল করে তারা সুলতানের কত অনুগত বোঝাতে চাইত। সুলতানি তত্‌-কে দু’সম্প্রদায়ের এই রেষারেষি সাহায্য করত। পরস্পরের ওপর দু’পক্ষ সবসময়ে নজর রাখার জন্যে প্রশাসনে সচলতা থাকত। সুলতান উপভোগ করত এই রেষারেষি, পছন্দসই মাত্রায় কোঁদল জিইয়ে রাখতে চাইত। নবদ্বীপে জনজাগরণের ঘটনাতে সুলতান ভালোরকম ধাক্কা খেয়েছে। নবদ্বীপের কাজির কাছ থেকে পুরো বিবরণ না পাওয়া পর্যন্ত উৎকণ্ঠা কাটবে না। প্রধানমন্ত্রী ফারুক ইসলামাবাদীর দপ্তরে এর মধ্যে ‘কোতওয়াল-ই-বক আলা’র কাছ থেকে কিছু খবর আসতে পারে। দরবারের খবরাখবরের চেয়ে লোকমুখ ছড়িয়ে পড়া গুজব, কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুলতানি মসনদের দাবিদার হয়ে কোনও এক বিপ্রসন্তান হঠাৎ একদিন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গুজবকে সত্যের চেহারা দিতে পারে। গুজবের যে অংশ সুলতানকে বেশি তটস্থ করেছে, তা হল, সেই বিপ্রসন্তানের শরীরে রাজরক্ত বইছে। সে হিন্দুশাস্ত্রের ঐন্দ্রজালিক কৃষ্ণ হলে আরও বেশি বিপজ্জনক। সে ব্রাহ্মণত্বের ধার ধারে না। সমাজের যে-কোনও সম্প্রদায় থেকে সে উঠে আসতে পারে। পনেরোবছর ধরে গৌড় শাসন করে সুলতান জেনে গেছে এ দেশে সব সম্ভব। রাজ্যশাসকের দরকার, সব সম্ভাবনাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো দাপট। সুলতান হিসেবে সেই দাপট হোসেন শাহ দেখিয়েছে, আগামী দিনগুলোও দেখিয়ে যাবে।

নবদ্বীপ থেকে দু’দিন পরে কাজির পাঠানো বিবরণের সঙ্গে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের দেওয়া তথ্যে অনেক মিল খুঁজে পেয়ে ইসলামাবাদীকে সুলতান বলল, সিন্ধুকীদের জোগাড় করা খবরের চেয়ে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া গুজব যে বেশি সত্যি, আমার এ ধারণা ভুল নয়, বুঝতে পারছ?

—জী জাঁহাপনা।

—নবদ্বীপে যত নষ্টের মূল যে নিমাই পণ্ডিত, বুঝতে পারছ?

—জী জাঁহাপনা।

—সে তো বামুনের ছেলে?

—জী জাঁহাপনা।

—নবদ্বীপের অনেক প্রজা তাকে কাবতার বলছে, তাই তো?

—জী জাঁহাপনা।

—তাকে কোতল করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

সুলতানের এই শেষ কথাটা প্রধানমন্ত্রী মেনে নিলেও ‘জী জাঁহাপনা’ না বলে কারুকাজ করা মাথার ফেজ টুপিটা ডাইনে বাঁয়ে ঈষৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

—খান-ই-জাহান চুপ কেন?

সুলতানে প্রশ্নে ইসলামাবাদী বলল, জাঁহাপনা, গোস্তাফি মাফ করবেন, কাজির পাঠানো বিবরণ থেকে জানা গেল সেই রাতে হরিবোলাদের মিছিল থেকে কয়েকজন বদমাশ বেরিয়ে এসে কাজির বাগান নষ্ট করে, বাড়ির সদরদরজা ভেঙে ফেলতে নিমাই পণ্ডিত থামিয়েছিল তাদের। কাজির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল সে। কাজির পরিবারের কোনও ক্ষতি করেনি। ফলে আইনমাফিক বিচার করে তাকে কোতল করার হুকুম কাজি দিতে পারবে না। তাকে অন্য কোনও অভিযোগে ফাঁসিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিতে হবে।

সে অভিযোগটা কী?

সুলতানের প্রশ্নে ইসলামাবাদী বলল, জাঁহাপনা আর কিছুদিন সময় মঞ্জুর করুন, আমি আইনদপ্তরের ‘মালিক উল উমারা ওয়াল ওয়াজারা’র পরামর্শ নেওয়ার সঙ্গে নবদ্বীপে বিছিয়ে দিচ্ছি সিন্ধুকী, দানী, জাসুর জাল, আশা রাখি, নিমাই পণ্ডিতের বিরুদ্ধে এমন একটা জুৎসই অভিযোগ খাড়া করতে পারব, যে সুলতানি আইনের জাল কেটে সে বেরোতে পারবে না। তার গর্দান যাবে।

এক মুহূর্ত থেমে ইসলামাবাদী বলল, বেআদবি হলে মাফ করবেন, আপনার কাছে নিশ্চয় খবর আছে যে নবদ্বীপে নিমাই পণ্ডিতের শত্রুপক্ষ কম জোরদার নয়। তাকে নিকেশ করতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের উদ্যোগে শৈব, শাক্ত, তান্ত্রিক আরও গণ্ডাখানেক সম্প্রদায় জোট বেঁধেছে। জাঁহাপনা মেহেরবানি করলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চেষ্টা করব আমি।

প্রধানমন্ত্রীর আর্জি সুলতান শুধু মঞ্জুর করল না, তার বিচার-বুদ্ধির তারিফ করে প্রায় দুশ’ বছর আগে ইলিয়াস শাহী রাজবংশের সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ-র সুবিচার সম্পর্কে চালু একটা কাহিনী শোনাল। সন্তান-স্নেহাতুর বাবা সুলতান সিকন্দর শাহকে খুন করে ছেলে গিয়াসুদ্দিন মসনদে বসলেও প্রজাবৎসল সুলতান হিসেবে সে খ্যাতি পেয়েছিল। গজল শিখত গিয়াসুদ্দিন, শিকারের নেশা ছিল তার। শিকারের এক ঘটনাতে তার তীরে একবার এক বিধবার অল্পবয়সি ছেলে আহত হয়। কাজি মিজানুরের এজলাসে সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল আহত ছেলের মা। পেয়াদার হাতে আদালতে হাজির হওয়ার সমন কর্তব্যপরায়ণ কাজি পাঠাল সুলতানকে। সুলতানের হাতে সমন ধরাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও তার পেয়াদা পৌঁছতে পারল না। তখন এক দুপুরে শাহিসড়কে পারিষদদের সঙ্গে সুলতানকে দেখে, তার নজর কাড়তে পেয়াদা বুদ্ধি করে অসময়ে আজানের ধ্বনি তুলল। সুলতান সড়কে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে পেয়াদাকে ডেকে নিতে সে সমন ধরিয়ে দিল সুলতানকে। সুলতান তখনই কাজির আদালতে হাজিরা দিল। সুলতানকে কোনও খাতির না করে কাজি তখনই বিধবা মাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার হুকুম দিল। কাজির রায় মেনে বিধবাকে ক্ষতিপূরণের টাকা মিটিয়ে দিল সুলতান। কুর্সি ছেড়ে কাজি উঠে দাঁড়িয়ে সসম্মানে সুলতানকে মসনদে বসাল। সুলতানের বগলের নিচে একটা তলোয়ার লুকনো ছিল। সুলতান সেটা বার করে কাজিকে দেখিয়ে বলল, তার বিচারে পক্ষপাতিত্ব থাকলে, তখনই তার মাথা মাটিতে লুটতো।

সুলতানের কথা শুনে নিজের কুর্সির নিচে থেকে একটা বেত তুলে কাজি বলল, তার রায় অমান্য করলে সুলতানের পিঠের চামড়া তুলে নিত সে।

কাজির কথা শুনে দু’হাতে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আপ্যায়ন করেছিল সুলতান গিয়াসুদ্দিন। কাজিকে অনেক উপহার আর পুরস্কার দিয়েছিল।

সুলতান হোসেন শাহ থামতে ইসলামাবাদী আভূমি নত হয়ে মনিবকে কুর্নিশ করে ‘কেয়াবাত কেয়াবাত্‌’ বলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় গলে গেলেও ইলিয়াসশাহী আমলের এই গল্প ছেলেবেলায় নানা-নানির মুখ থেকে একাধিকবার শুনেছে, বলল না। সুলতান গিয়াসুদ্দিনের চেয়ে সুলতান হোসেন শাহ অনেক দূরদর্শী শাসক, বারবার সে কথা বলতে থাকল। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় খুশি হয়ে সুলতান জিজ্ঞেস করল, তোমাকে এই গল্পটা কেন শোনালাম বলো তো?

ইসলামাবাদী বলল, জাঁহাপনা, বান্দার ওপর এ আপনার মেহেরবানী!

মুচকি হেসে সুলতান বলল, বহুবার তোমার শোনা এই পুরনো গল্পটা আমার মুখ থেকে শুনে তুমি প্রশংসা করো কিনা, তা জানতে গল্পটা বললাম। আমি যা চাইছিলাম, তাই ঘটেছে, আমার মর্যাদা রেখেছ তুমি।

ইসলামাবাদীর বুকটা মুহূর্তের জন্যে ধক্ করে উঠলেও মুখে বিনয়ের ভাব সে ফুটিয়ে রাখল। ক্ষুরধারবুদ্ধি সুলতানের। তার সঙ্গে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির ছাড়া কোনও আমি ওমরাহ উজির নাজির পাল্লা দেওয়ার চিন্তা স্বপ্নেও করে না। ইসলামাবাদীকে সুলতান জিজ্ঞেস করল, নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিত কি কোনও রাজপরিবারের ছেলে?

কুলজি বংশপঞ্জি খতিয়ে দেখে সাতদিনের মধ্যে আপনাকে জানাচ্ছি জাঁহাপনা

ইসলামাবাদীর জবাব শুনে সুলতান ফিসফির স্বরে বলল, লোকমুখে শুনেছি, আমার দরবারের সাকর মল্লিক, দবীর খাস ও তাদের এক ভাই বল্লভ, সে-ও আমার কর্মচারী, তারা জাতে বামুন, তাদের পূর্বপুরুষ কোনও এক সময়ে নাকি রাজা ছিল, কোন রাজ্যের সে রাজা ছিল, সেই সঙ্গে এই তিন ভাই-এর বংশপরিচয় জানতে চাই। বিষয়টা জরুরি, খুবই গোপন।

সাকর মল্লিক, আর তার দু’ভাই এখন আধা-যবন হলেও দরবারে চাকরিতে ঢোকার আগে তারা জাতে বামুন ছিল, ইসলামাবাদী এই পর্যন্ত জানত। তাদের শরীরের রাজরক্ত বইছে শুনে সে চমকে গেল। ক্ষমতাসীন সুলতানকে খুন করে তার দরবারের ক্ষমতালিপ্সু কোনও আমির ওমরাহের সুলতানি মসনদে বসার প্রথা যেমন গৌড়ের নিয়তি হিসেবে প্রজারা মেনে নিয়েছে, সেভাবে যদি ব্রাহ্মণ রাজার ক্ষমতা দখলকে তারা ন্যায্যতা দেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাকর মল্লিক, দবীর খাসের তেমন উচ্চাভিলাষ থাকতেই পারে। দু’জনই বামুন, পদ-মর্যাদায় দরবারের আমীরও বটে। অন্তর্ঘাতের সব উপকরণ বিদ্যমান। সাকর মল্লিক আর তার ভাই দু’জনকে মোটেই সুবিধের মানুষ মনে হয় না ইসলামাবাদীর। সুলতানকে ইসলামাবাদী বলল, জাঁহাপনা, সাকর মল্লিকের বংশপরিচয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিন্ধুকীদের লাগিয়ে বার করে ফেলছি। আপনি অভয় দিলে এই সঙ্গে একটা আর্জি পেশ করতে চাই।

ইলামাবাদীর আর্জি শুনতে তার দিকে সুলতান তাকাতে সে বলল, জাঁহাপনা, আমি শুনেছি সাকর মল্লিক, দবীর সঙ্গে আমাদের জ্যোতিষার্ণবের বহুদিন ধরে চেনাজানা। নবদ্বীপের এক টোলে তাঁরা একসঙ্গে লেখাপড়া করেছেন কয়েকবছর। তাঁরা একে অন্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সাকর মল্লিকের পরিবারে ঊর্ধ্বতন কেউ রাজা ছিলেন কিনা, জ্যোতিষার্ণবের অজানা থাকার কথা নয়। তাঁকে যদি আপনি একবার জিজ্ঞেস করেন। কথাটা অর্ধেক বলে বাকিটা আভাসে জানিয়ে ইসলামাবাদী থেমে যেতে সুলতান বলল, জ্যোতিষার্ণবকে এখনই জড়াতে চাই না। তার যোগাযোগে অমর, সন্তোষকে দরবারে সাকর মল্লিক আর দবীর খাস পদে এনে বসিয়েছিলাম। তারা দু’জনই যে জ্যোতিষার্ণবের সহপাঠী ছিল আমি জানি। তাদের নাড়িনক্ষত্র জ্যোতিষার্ণবের অজানা নয়, এটাও আমার জানা আছে। আপাতত জ্যোতিষার্ণবকে এই খোঁজখবর করা থেকে দূরে রাখছি। আমাকে সাকর মল্লিকের পূর্বপুরুষদের বংশপরিচয় যে জানিয়েছে, পাকা খবরটা সে-ই দেবে। আমার কোনও তাড়া নেই। আপাতত সাকর মল্লিক, দবীর খাসের সঙ্গে পরামর্শ করে নবদ্বীপের ওপর নজর রাখো। যাদের সঙ্গে পরামর্শ করছ, তারাও যেন নজরে থাকে। দরবার ছেড়ে সুলতান প্রাসাদে নিজের মহলে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে ইসলামাবাদী বুঝে গিয়েছিল, ঘটনা অনেকদূর গড়াবে। তার হাতে এই মুহূর্তে বিপুল ক্ষমতা তুলে দিয়েছে সুলতান হোসেন শাহ। নবদ্বীপে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সঙ্গে সেই অঞ্চল তদারকির দায়িত্বে যে দু’জন রাজকর্মচারী এতদিন সর্বেসর্বা ছিল, তাদের ওপরও নজর রাখতে হবে তাকে। নতুন উদ্যমে কাজে নেমে পড়ল ইসলামাবাদী।

সিন্ধুকীদের সূত্রে গৌড়ের পুরনো রাজবংশের উত্তরপুরুষদের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখার কাজে সুলতানি আমলে কখনও ঢিলে পড়েনি। ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালে, হাবশী সুলতানদের আমলে পুরাণের কৃষ্ণকে নিয়ে যখন শাসকদের মনে প্রবল আতঙ্ক ছিল, তখন দক্ষিণ ভারতে বিজয়নগর রাজ্যের কৃষ্ণ, গোবিন্দ প্রমুখ নামের রাজারা কৃষ্ণা, গোদাবরী নদীর দক্ষিণ-পশ্চিমের জনপদে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মুসলিম শাসকরা কৃষ্ণ, গোবিন্দ নামধারী রাজাদের কখনও পুরাণের কূটনীতিবিদ, বীর যোদ্ধা, অপরিসীম ক্ষমতাধর, পুরুষোত্তম কৃয়ের ছদ্মবেশী সংস্করণ, কখনও অষ্টোত্তর শতনামের কোনও এক নামগ্রহণকারী অবতার ধরে নিয়ে দূরত্ব বজায় রাখত। গৌড়ের সুলতানদের কাছে প্রথমপর্বে পৌরাণিক কৃষ্ণের পাশাপাশি ভীতিপ্রদ হয়েছিল রাজধানী লক্ষণাবতী ছেড়ে নদীমাতৃক বঙ্গাল-এ পালিয়ে যাওয়া রাজা লক্ষ্মণ সেনের উত্তরপুরুষরা নদীতে ঘেরা সেই জনপদে গৌড়ের মতো রাজকীয় ক্ষমতায় দীর্ঘ বছর ধরে রাজ্য শাসন করেছে লক্ষ্মণ সেনের উত্তরপুরুষ। তাদের একজন মধু সেনের প্রতাপে গৌড়ের সুলতানি শাসনও মাঝে মাঝে আতঙ্কে কোণঠাসা হয়ে থাকত। তিনশ’ বছর আগে লক্ষণাবতী ছেড়ে রাজা লক্ষ্মণ সেন চম্পট দিলেও জলভূমি ঘেরা পূর্বদেশের কয়েকটা দ্বীপে তখনও তার পৌত্র, দৌহিত্রদের বংশের কেউ কেউ রাজত্ব করছিল। পৌত্রধারার সেনরাজাদের সঙ্গে দৌহিত্র-ধারার দেবপরিবারের রাজাদের নাম প্রায়শ গৌড়ের জনপদে সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহে, রাজধানী একডালার ক্ষমতাসীন মহলে জেগে উঠত। স্মৃতি রোমন্থন করে সাধারণ মানুষ তখন আনন্দ পেলেও ক্ষমতাসীনরা চক্রান্তের ভূত দেখত। বজ্রকঠিন হত তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। লক্ষ্মণ সেনের উত্তরপুরুষদের নিয়ে সুলতানের দুশ্চিন্তা কমলে অল্পদিন তা স্থায়ী হত। সামনে এসে দাঁড়াত রাজা গণেশের কোনও এক উত্তরসুরির ক্ষমতা দখলের তৎপরতার গুজব। গুজব আসত সত্যের পোশাকে। তা কখনও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেত, কখনও কিংবদন্তি হয়ে ক্রমশ মিশে যেত ইতিহাসে। অনেকানেক কাকতালীয় ঘটনা আর কিংবদন্তি জুড়ে ইতিহাস লেখা হয়। লক্ষ্মণ সেনের গৌড় ছেড়ে চলে যাওয়ার দুশবছর পরে সুলতানি শাসনের মাঝখানে গৌড়ের সিংহাসনে হঠাৎ হিন্দুরাজা গণেশের সমাসীন হতে চমকে গিয়েছিল দেশের সাধারণ মানুষ। খুশি হয়েছিল তারা। আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিল ব্রাহ্মণসমাজ, উঁচু বর্ণের হিন্দুসম্প্রদায়। রাজা গণেশের তিন ছেলের বড়জন, যদু, যে পরে সুলতান জালালুদ্দিন পরিচয়ে গৌড়ের মসনদে বসেছিল, তার বংশলতিকা নিয়ে সুলতানি আমলে কোনও উদ্বেগ না থাকলেও মেজছেলে চন্দ্রদ্বীপের রাজা রমাবল্লভের নাতি জয়দেব রায়ের দু’একজন বংশধর যে রাঢ়, সমতটে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে, গুপ্তচর মারফত মাঝে মাঝে এরকম খবর দরবারের নির্দিষ্ট দপ্তরে পৌঁছে যেত। বন-বাদাড়ের মধ্যে ভেঙে পড়া বৌদ্ধবিহার, পরিত্যক্ত ভূতুড়ে জৈনমন্দিরে দস্যু, লুঠেরাদের যেসব ডেরা রয়েছে, তার কয়েকটা যে রাজদ্রোহীদের আস্তানা, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের সন্দেহ ছিল না। সেইসব ভয়ানক অঞ্চলের পথ তারা মাড়াত না, তারা শুধু বিদ্রোহের প্রতীক্ষা করত। বিদ্রোহীদের খবর সিন্দুকীরা দরবারে দিলেও তাদের সঠিক ঠিকানা জানাতে পারে না। সুলতানের নিজের নিরাপত্তাবাহিনীর গোয়েন্দারা সন্দেহজনক কোনও পোড়ো বিহার, মন্দির, গুম্ফা, সংঘারামে হানা দিয়ে জানতে পারে, গোপন আশ্রয় ছেড়ে বাসিন্দারা আগেই সরে পড়েছে। চোখের আড়াল থেকে তারা যে গৌড়ের মসনদের ওপর নজর রাখছে, সুলতানের অজানা ছিল না। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে রাজা দনুজমর্দনদেব, রাজা কংসের উত্তরপুরুষরাও রয়েছে, এমন সন্দেহ সুলতানের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। সবচেয়ে বিপজ্জনক যে লোকটা এই যোগাযোগের মাথা, সে হল সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায়। বাবার অপমানের প্রতিশোধ নিতে আদাজল খেয়ে সুশ্রুত তৈরি হচ্ছে, এমন খবর সুলতানের কানে এসেছে। গৌড়, রাঢ়ের কিছু হিন্দু জমিদার গোপনে সাহায্য করছে সুশ্রুতকে। সেনাবাহিনী গড়তে সাহায্য করছে, রসদ জোগাচ্ছে। তবে নিজেদের জমিদারির চৌহদ্দির মধ্যে তাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। বাঁকুড়ার সামন্তভূমের রাজা শঙ্খ রায়ের ছেলে হামীর রায়ের দৌলতে রাজধানী ছাতনার কাছাকাছি এক গভীর জঙ্গলে সুশ্রুতের ঘাঁটি করার খবর সিন্ধুকীরা নিয়ে এসেছে। ভালোরকম খোঁজ নিতে নেমে পড়েছে গোয়েন্দারা। শোনা যাচ্ছে চন্দ্রদ্বীপের রাজকুমার পীতাম্বর রায়ও সুশ্রুতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সুলতান টের পেল, তার ষোলোবছরের শাসনকালে সবদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলার এমন হিসেবি চক্রান্ত আগে হয়নি

সুবুদ্ধি রায়কে এই উপদ্রবের সময়ে পাশে পেলে হয়তো অনেক সুবিধে হত। ছেলের চক্রান্তের অংশীদার সুবুদ্ধি নয়, এ খবর সুলতান অনেক আগেই পেয়েছে। গরম ঘি খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার সঙ্গে আত্মহত্যা করার তফাত নেই বুঝতে পেরে গৌড় ছেড়ে সে পালিয়েছিল। গৌড় ছাড়ার আগে স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে কোথায় পাচার করে দিয়েছিল, সিন্ধুকীরা পর্যন্ত জানতে পারেনি। সুবুদ্ধির ছেলে সুশ্রুতের বয়স তখন সাত, দু’মেয়ের বড়জনের বয়স ছয়, ছোটর বয়স চার। বাড়ি ছেড়ে সুবুদ্ধি চলে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে সুলতান জেনেছিল নিজের পরিবারকে সে সঙ্গে রাখেনি। সে একা গিয়েছিল কাশীতে। সংসার ছেড়ে দীনহীনের মতো সতেরোবছর অনাড়ম্বর জীবন কাটিয়ে তার মনের রূপান্তর ঘটেছিল। হোসেন শাহের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার যে আগুন মনে নিয়ে কাশীতে এসেছিল, তা কখন নিভে গেছে সে নিজেই জানত না। সে অনুভব করত প্রশান্ত ক্ষমায় ভরে উঠছে বুক। সে বদলে গেছে। তার পরিবারের হদিশ যখন পাওয়া গেল, তারা তখন সমতট ছেড়ে সম্ভবত বরেন্দ্রভূমে কোথাও চলে গিয়েছিল। সিন্ধুকীরা তাদের কোনও খোঁজ তারপর পায়নি। পরিবারের সঙ্গে সুবুদ্ধিও হয়তো যোগাযোগ হারিয়েছিল। সুবুদ্ধি আজ থাকলে অনেক উপকারে আসত। আসত কি? সে-ও হয়তো সুলতান হোসেন শাহকে উৎখাত করার চক্রান্তে পরামর্শদাতার ভূমিকা নিয়ে জনমানবহীন বৌদ্ধবিহারে বা পাহাড়ের গুহায়, যেখানে হেঁড়েল, ভাম, কটাস, গন্ধগোকুল দল বেঁধে বাস করে, তাদের তাড়িয়ে আত্মগোপন করে থাকত। কাফেরদের কোনও আক্কেল নেই, কৃতজ্ঞতা নেই। সুলতানের সন্দেহ তার দরবারের পদস্থ হিন্দু কর্মীদের মধ্যে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির আর দেহরক্ষী কেশব ছত্রী ছাড়া কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। রাজদ্রোহীদের নীরব সমর্থক আছে কেউ কেউ। বেইমান হলেও তাদের মতো দক্ষ রাজকর্মচারী উজির, নাজিরদের মধ্যে খুব কম আছে। দু’চারজন সন্দেহভাজন হিন্দু রাজকর্মচারীকে দূরের কোনও মুলুকে বদলি করে দেওয়া যায়। তাতে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। চোখের আড়ালে গিয়ে তারা আরও বেশিরকম নাশকতার কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। দু’একজনকে প্রাণদণ্ড দেওয়া যায়, জনসমক্ষে বিচার না করে, গুপ্তঘাতক লেলিয়ে অনায়াসে তাদের নিকেশ করে দেওয়া যায়, কিন্তু তাদের শূন্য পদ ভরতে যোগ্য মুসলিম কর্মচারী জোটানো মুশকিল। সবচেয়ে বড় কথা হল, সুলতানি দরবারের সংস্পর্শে এই হিন্দুরাজকর্মচারীরা বহু বছর কাটানোয় নিজেদের সম্প্রদায়ের কাছে তাদের আর জাতহিন্দুর মর্যাদা নেই। কড়োয়ার জল খেয়ে সুলতানের সঙ্গে তারা পাঁচ ওয়াক্ত নমাজে না বসলেও সুলতানের উপহার দেওয়া ফেজ টুপি মাথায় চাপিয়ে দরবারে অধিবেশনে হাজির থেকে, দরবার ভর্তি রাজকর্মচারীদের চোখের সামনে সুলতানের ফরমাশি আখরোট, পেস্তা, বাদামবাটার শরবত খেয়ে নিজেরাই ধরে নিয়েছে, তারা জাতিচ্যুত হয়েছে। তারা নিজেদের হিন্দু ভাবে না। বর্ণহিন্দু সমাজও তাদের একঘরে করে দিয়েছে। সুলতানের বিরুদ্ধে তারা যত ষড়যন্ত্র করুক, হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে আর কল্কে পাবে না, নিজেদের মধ্যে হাজার ঘোঁট পাকালেও বিষ উগরে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। সুলতানবিদ্বেষী গৌড়ের স্মার্ত, ন্যায়শাস্ত্রী, তন্ত্রাচারীরাও তাই, শুধুই বচনবাগীশ। মীমাংসাহীন শাস্ত্রীয় তর্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। আগের দিনের জের টেনে পরের দিনে চলতে থাকে পুরনো তর্ক। গ্রাম্য কোঁদলও তর্কে মিশে যায়। পণ্ডিতদের দলপাকানো নিয়ে সুলতান তাই মাথা ঘামায় না। তাদের দৌড় সুলতানের অজানা নয়। পাইক বরকন্দাজ ভর্তি একটা শাহি নৌকো নবদ্বীপের ঘাটে ভিড়লে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়, নিঝুম হয়ে পড়ে গোটা নগর। কিন্তু নগরের পথে অসংখ্য মানুষের সমাবেশ হলে, তারা শোভাযাত্রা করে নগর পরিক্রমা করলে, তখন আর চোখ বুজে থাকা যায় না। মানুষের জমায়েত মানেই বিপজ্জনক, সুলতানি দরবারের কাছে তা অশনি সঙ্কেত, এ সত্য দুনিয়ার সব রাজ্যশাসক জানে।

প্রজা অভ্যুত্থান ঠেকাতে রাজধানী একডালাতে কূটনৈতিক আলোচনা, মত বিনিময় যখন পুরোদমে চলেছে, নবদ্বীপে ততক্ষণে চাঁদ কাজি পৌঁছে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদীর নির্দেশ মতো সেখানকার প্রজাসাধারণকে সহবত শেখাতে শুরু করে দিয়েছিল। নবদ্বীপে জুড়ে দিন, রাতে টহল দিচ্ছিল এগারোজনের ঘোড়সওয়ারবাহিনী। চাঁদকাজির সঙ্গে একডালা থেকে এই বাহিনী নবদ্বীপে এসেছিল। দশ ঘোড়সওয়ারের কর্তা, দরবারে যার পদমর্যাদা ‘সর-ই-খেল’, সে আর নবদ্বীপ মহলের কাজি, একই মাপের রাজকর্মচারী। কাজি আর সর-ই-খেলকে নিয়ে একদফা জরুরি বৈঠক সেরে নিয়েছিল ইসলামাবাদী। আইনের শাসন কায়েম করতে, কাজের ফর্দ তৈরি করে দু’জনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর হুকুম মেনে প্রথমেই নবদ্বীপের ব্রাহ্মণপাড়া, শূদ্রপাড়া, নবশাকপাড়ায় গুপ্তচরের সংখ্যা চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল কাজি। মহামিছিলের চার অংশে যারা সঙ্কীর্তনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, অদ্বৈত আচার্য, হরিদাস, শ্রীবাস, গোরা, নিতাই-এর সঙ্গে তাদের সহযোগীদের নামের তালিকা তৈরি করে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিল সিন্ধুকীরা। এলাকা ভাগ করে নিয়ে দু’তিনজন মিলে বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছিল। দীর্ঘক্ষণ এমন জেরা করছিল যে ভয় পেয়ে যাচ্ছিল পরিবারের মানুষ। তার মধ্যে কোনও নিরীহ প্রজার মাটির ঘরের দেওয়াল ভেঙে, কারও বাড়ির এক চিলতে ফুল, সবজির খেত দুরমুশ করে, ধুলোর ঝড় তুলে পল্লীর এক পথ থেকে আর এক পথে ছুটে বেড়াচ্ছিল ঘোড়সওয়ার বাহিনী। সাংঘাতিক বিপর্যয়ের সব লক্ষণ চারপাশে ফুটে উঠতে দেখছিল নবদ্বীপের মানুষ। বৈষ্ণবদের একাংশ ভয়ে কাঁপছিল। গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণরা শাপশাপান্ত করছিল গোরা আর তার অনুগামীদের। বাতাসে গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল। সিন্ধুকীরা যেমন গুজব ছড়াচ্ছিল, তেমনই গুজব রটাচ্ছিল নবদ্বীপের মানুষ। নবদ্বীপের কয়েক ক্রোশ দূরে বামুনদের বসতি, পীরল্যা গ্রামকে যেমন রাতারাতি ধর্মান্তরিত করে মুসলিম গ্রাম বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নবদ্বীপের ভাগ্যেও তাই ঘটতে চলেছে, এ গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্মীয় বাছবিচার না করে নবদ্বীপের গোটা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে নির্মূল করতে, একডালা থেকে নৌ সেনাপতি ‘মীর-ই-বহর’ তার পাইক বরকন্দাজ পাঠিয়ে দশটা নৌকোয় নবদ্বীপের সমস্ত বামুনকে ধরে নিয়ে গিয়ে একডালায় ফাটকে পুরে দেবে। পরিবারের বউ, মেয়ে, শিশুদের পর্যন্ত ছাড়বে না। পুরুষদের কোতল করবে। সম্ভোগের উপযুক্ত মেয়েদের সুলতানের হারেমে পাঠিয়ে দিয়ে মাঝবয়সি আর বুড়িদের বাঁদিবৃত্তিতে লাগিয়ে দেবে। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাতগাঁয়ের বন্দরে সাদাচামড়ার ভট্টমারি আর দাসব্যবসায়ীদের সঙ্গে দরাদরি করে বেচে দেবে। বিদেশি নৌকোর গুমঘরে ছাগলছানার মতো বন্দি হয়ে তারা সমুদ্রপারের কত দেশে চালান হয়ে যাবে, কেউ জানে না। তাগড়াই চেহারা যুবকদের খোজা বানিয়ে একডালার জেনানামহলে বান্দার কাজে লাগিয়ে দেবে। নবদ্বীপ ছেড়ে যাদের পালানোর সামর্থ্য নেই, তাদের কেউ কেউ জাতধর্ম বাঁচাতে আত্মঘাতী হওয়ার চিন্তা শুরু করল। গলায় দড়ি দেবে, না বিষ খাবে, শাস্ত্রমতে কোন অপঘাত মৃত্যুতে পাপ কম, এই আলোচনায় রাত কাবার করতে থাকল। রাত জেগে শুকিয়ে যেতে থাকল তাদের মুখ, কোটরে ঢুকে গেল চোখ, কালি জমল চোখের তলাতে। ভয়ে চুপসে যেতে থাকল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বয়স্ক মানুষরা। রাজধানী একডালার বৈঠকে নবদ্বীপে ভয়ের বাতাবরণ তৈরির উপায় কাজিকে শিখিয়ে দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদী। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর প্রধান, ‘সর-ই-খেল’ সেই বৈঠকে জেনে নিয়েছিল কাজের খুঁটিনাটি। দু’জনকেই ইসলামাবাদী বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ প্রজাসাধারণকে ভয়ে কাবু করে ফেলা, নবদ্বীপের মানুষকে এমন ভয় ধরিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা রাতে পাশ ফিরে শুতে সাহস না পায়, আত্মঘাতী হওয়ার চিন্তা করে, দু’চারজন সেই পথ বেছে নেয়। নবদ্বীপের মানুষের মনে ভয় জেঁকে বসলে,পরের ধাপ সম্পর্কে সুলতানের ফরমান কাজি পেয়ে যাবে। রাজধানীতে খান-ই-জাহান যেভাবে কাজের ছক তৈরি করে দিয়েছিল, ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটবে বলেছিল, মিলে গেছে, ইসাল্লা, একশ’ ভাগ সফলতা পেয়েছে কাজি। তাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিল। সে দায়িত্বও কাজি পালন করেছে। নবদ্বীপ সেরেস্তার এক ঘোড়সওয়ার রক্ষীর হাতে একডালাতে প্রদানমন্ত্রীকে চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে নিমাই পণ্ডিতের বংশপঞ্জি। পণ্ডিতের সাতপুরুষে কেউ রাজা-উজির ছিল না, কুলবৃত্তি ছিল পুজোপাঠ, জানিয়েছে। চাঁদকাজি অবশ্য অনেককাল আগে থেকে চেনে গোরার পরিবারকে। গোরার দাদামশাই, নীলাম্বর চক্রবর্তীর কাছে একবার নিজের ভাগ্যগণনা করাতে গিয়েছিল সে। একাধিক দিন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সাহচর্যে কাটিয়ে মানুষটি সম্পর্কে মনে শ্রদ্ধা জেগেছিল। রাজধানী একডালাতে ইসলামাবাদীকে অবশ্য এ তথ্য কাজি জানায়নি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে খবর পাঠানোর আগে আরও একবার ভালোরকম খোঁজখবর করে নিতে চেয়েছিল। শ্রীহট্টের চালকলা খাওয়া সুদরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ, মিশ্র পরিবারের বিশদ পরিচয় জোগাড় করতে তার অসুবিধে হয়নি। আগে যা জানত, এখন তা যাচাই করে বিশেষ গরমিল পায়নি। গোরার শরীরে একফোঁটা রাজরক্ত নেই, এ বিষয়ে সে নিশ্চিত,

পাশাপাশি, নিরীহ ব্রাক্ষ্মণ বংশের রক্ত, গোরার ধমনীতে কতটা বইছে, এ নিয়ে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে। গোরার দাদামশাই, পণ্ডিত নীলাম্বর চক্রবর্তীকে সে যেমন কাছ থেকে দেখেছে, তেমনই গোরার বাবা জগন্নাথ মিশ্রও তার অচেনা ছিল না। নীলাম্বরের সঙ্গে পরিচয় ঘটলেও জগন্নাথের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ ঘটেনি। উঁচুদরের রাজপুরুষ কাজির সঙ্গে খেজুরে আলাপ করতে আসার মতো সাহস রামচন্দ্রপুরের গরিব ব্রাহ্মণ, জগন্নাথের ছিল না। সামাজিক জীবনের দুই উল্টোমুখো সড়কে তাদের যাতায়াত। সুলতানি সেরেস্তার পথে ছোটখাটো, শীর্ণ চেহারা জগন্নাথকে কাজি দু’একবার দেখেছে। সেরেস্তার কোনও মুন্সি বা আমিন দূর থেকে চিনিয়ে দিয়েছিল মানুষটাকে। চোখে পড়ার মতো তালেবর মানুষ ছিল না জগন্নাথ। তাকে নজর করলেও কাজি মনে রাখেনি। মনে রাখার কথা নয়। হয়তো এক ঘণ্টার মধ্যে ভুলে গিয়েছিল। বহু বছর বাদে বারকোণা ঘাটের কাছে কাজিকে তার সঙ্গীদের কেউ, চন্দনগাছের লালাভ বিশাল গুঁড়ির মতো সাড়ে চারহাত লম্বা, সুদর্শন এক জোয়ানকে দেখিয়ে, তার পরিচয়, জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে নিমাই পণ্ডিত, ঘরোয়া নাম গোরা, বলতে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল কাজি, কয়েক মুহূর্ত নজর সরাতে পারেনি। গড় গৌড়িয়া বামুনদের মতো ক্ষয়াটে শরীর জগন্নাথ মিশ্রের এমন এক দশাসই, সৌন্দর্যে অনুপম, ছেলে থাকতে পারে কাজির বিশ্বাস হচ্ছিল না। ব্যাকরণশাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন নিমাইপণ্ডিতের যশ তখন ছড়িয়ে পড়েছিল নবদ্বীপে। ‘দীধিতি’ বই-এর লেখক সর্বজনশ্রদ্ধেয় নবদ্বীপের স্মার্তপণ্ডিত, রঘুনাথ শিরোমণির একদা গোরা ছাত্র ছিল, এ খবরও কাজিকে তার কোনও হিন্দু পার্ষদ জানিয়েছিল। ছাত্রের চতুষ্পাঠী পরিদর্শনে এসে তাকে আশীর্বাদ করেছিল রঘুনাথ শিরোমণি। নিমাইপণ্ডিতের টোলে সেই থেকে শুরু হয়েছিল ছাত্রের ভিড়। পারিষদের মুখ থেকে কাজি শুনেছিল, গোরা ঘোর নাস্তিক, জাতধর্ম মানে না, শূদ্র ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মেলামেশা করার সঙ্গে তাদের ঘরে গিয়ে অবলীলায় অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়ে নেয়।

গোরার স্বভাবচরিত্রের বিবরণ জেনে কাজি তাজ্জব হওয়ার সঙ্গে খুশিও হয়েছিল। গোঁড়া ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার মতো নবদ্বীপে এতদিনে উপযুক্ত একজন মানুষ এসেছে, এই ভেবে মনের মধ্যে আরাম পেয়েছিল। জগন্নাথ মিশ্রর সংসারে এমন একটা ছেলে কীভাবে জন্মাল, শুধু এই ধাঁধার সমাধান করতে পারল না। গোটা নবদ্বীপ ভয়ে জবুথবু হয়ে গেলেও গোরা আগের মতো শ্রীবাসের বাড়িতে দলবল নিয়ে খোল, করতাল, মন্দিরা বাজিয়ে সারারাত সঙ্কীর্তন করে চলেছে, কাজির কানে এ খবর পৌঁছে যেতে সে আরও দিশেহারা হয়ে গেল। সুলতানি ঘোড়সওয়ারদের রাতের টহল অবজ্ঞা করে অনুগামীদের নিয়ে যে সুলতানের সঙ্গে টক্কর দিতে চায়, তাকে কোতল করা ছাড়া নবদ্বীপে আইনের শাসন ফেরানোর উপায় নেই, এমন এক সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও কাজি হোঁচট খেল। তার জেনানামহলে বিবি, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দাসিবাঁদিরা পর্যন্ত রে রে করে পথ আটকে দাঁড়াল। বিপজ্জনক সেই মানুষটার এমন স্তুতি সবাই মিলে করতে লাগল যে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল কাজি। গোরাকে শায়েস্তা করতে নতুন উপায় যখন সে ভাবছে, তখনই শুনল, নবদ্বীপের গোঁড়া ব্রাহ্মণরা কোমর বেঁধে গোরার বিরুদ্ধে চক্রান্তে নেমেছে। রাগে তারা অগ্নিশর্মা। গোরাকে নবদ্বীপ থেকে তাড়াতে না পারলে ধরাধাম থেকে তাকে সরিয়ে দেবে। ব্যস্‌, এই একটা খবরে গোরাকে নিকেশ করার পথ পেয়ে গেল কাজি। গৌড়ে সুলতানি শাসন উচ্ছেদ করতে বামুনরা চক্রান্ত করলেও তারা দলবাজ। সুলতানকে সরিয়ে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। গৌড়ের সব ধর্মীয় গোষ্ঠীই ক্ষমতালোলুপ, দলবাজিতে পোক্ত। একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। স্মার্ত, নৈয়ায়িক, তান্ত্রিক, শাক্ত, শৈব, সব গোষ্ঠীর এখন সাধারণ শত্ৰু গোরা, আর তার অনুগামী বৈষ্ণব সম্প্রদায়। নিজেদের কলহ ভুলে বৈষ্ণববিরোধীরা গোরাকে খতম করতে এখন যে জোট বেঁধেছে, তাদের দু’তিন জন প্রতিনিধি এর মধ্যে কাজির সঙ্গে দেখা করে তার সহযোগিতা চেয়ে গিয়েছিল। বামুনদের কাজি দু’চক্ষে দেখতে না পারলেও কূটনীতিতে শত্রুর শত্রু যে পরম বন্ধু, তার অজানা ছিল না। গোরার প্রতিপক্ষকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস সে দিয়ে রেখেছে। গোরা খুন হয়ে গেলে কাজির তরফে কোনও তদন্ত হবে না। গোরার লাশ ঘাতকরা নিঃশব্দে গায়েব করে দিতে পারলে সংসারবিমুখ মানুষটার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার বিজ্ঞপ্তি কাজির দপ্তর থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে। নবদ্বীপের ঘরে ঘরে তা পৌঁছে দেবে গৌড়ের সিন্ধুকীরা। গোরাকে খুনের জোগাড়যন্ত্র বামুনরা পাকা করে ফেললে সুলতানি গুপ্তঘাতকদের কাজে লাগিয়ে পৃথিবী থেকে গোরাকে সরিয়ে দেবে কাজি। কাজটা এমনভাবে সারবে, যাতে সব দোষ বামুনদের ঘাড়ে চাপে। তাদের সব ক’জনকে ফাটকে পুরে দিয়ে চরম দণ্ড দেওয়া যায়।

চক্রান্তকারীরা গোরাকে ঘিরে ফেললেও এ নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। অনুগামীদের সাহস জুগিয়ে ঘর থেকে শ্রীবাসের বাড়ির সঙ্কীর্তনের আসরে টেনে আনছিল সে। কৃষ্ণপ্রেমে আপ্লুত তার দৈনন্দিন জীবনে অশান্তির ছায়া পড়েনি। সুলতানি সন্ত্রাস, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রতিহিংসাপরায়ণতা কিছুমাত্র স্পর্শ করল না তাকে। তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু, নিতাই, গদাধর, মুরারি, হরিদাস কেউ-ই ভয় পেল না। শ্রীবাসের সাহস বরং কয়েককাঠি বেড়ে গেল। সঙ্কীর্তন অনুষ্ঠানে সন্ধে থেকে রাতের তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত বাড়ির সদরদরজা হাট করে খুলে রাখতে থাকল। শান্তিপুরের বাড়িতে অদ্বৈতকে কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রায় আখমাড়াই করার মতো করে সিন্ধুকীরা জেরা করার মধ্যে সত্তর পেরনো মানুষটা বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। সিন্ধুকীরা তখনকার মতো চলে গেলেও ‘আবার আসবে’ বলে যাওয়ায় ভক্তিশাস্ত্র, ভাগবতের বদলে একদা জ্ঞানমার্গী অদ্বৈত ফের যোগবাশিষ্ঠ পড়তে শুরু করেছিল। যোগবাশিষ্ঠ জ্ঞানমার্গ অনুশীলনের গ্রন্থ। তোরঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছিল ভাগবত। জ্ঞানমার্গ ধরে প্রেম ভক্তির লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়, এরকম কথা সে বলছে, এই প্রচারও শুরু হয়েছিল। প্রেমভক্তির উদ্‌গাতা অদ্বৈতের ডিগবাজি খাওয়ার খবর পল্লবিত হয়ে নবদ্বীপে পৌঁছতে, সেখানে সন্ত্রস্ত বৈষ্ণবদের একাংশ যোগবাশিষ্ঠ খুলে পড়তে শুরু করল। শান্তিপুরের উত্তর-দক্ষিণে নবদ্বীপ, কুমারহট্টে বৈষ্ণব প্রেমভক্তি প্রচারের পিতামহপ্রতিম অদ্বৈতের জ্ঞানমার্গে ফিরে যাওয়ার বৃত্তান্ত পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে খুশিতে উদ্বাহু হয়ে নাচ জুড়ে দিল তথাকথিত পাষণ্ডীরা। গোঁড়া ব্রাহ্মণপণ্ডিতেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বলাবলি করছিল, সুলতানি হুড়কো খেয়ে বুড়োটার সখিভাব এতদিনে কাটল। প্রেমভক্তির পথ ছেড়ে অদ্বৈতের জ্ঞানমার্গে ফিরে যাওয়ার খবর গোরাও পেয়েছিল। প্রথমে সে বিশ্বাস করেনি। অদ্বৈত আচার্যের মতো ভক্ত, স্বধর্ম ছেড়ে উল্টো পথে হাঁটতে পারে, স্বপ্নেও সে ভাবতে পারে না। শান্তিপুরে অদ্বৈতের খোঁজ করতে হরিদাসকে পাঠিয়ে জানল, যা রটেছে, তার পুরোটা মিথ্যে নয়। শান্তিপুর থেকে কাঁদতে কাঁদতে নবদ্বীপে ফিরে গোরাকে হরিদাস যা জানিয়েছিল, তা হল ভয়ে আচার্য পাগল হয়ে গেছে। হরিদাসকে সে বলেছে জ্ঞানমার্গে পরিপক্ব না হলে প্রকৃত ভক্ত হওয়া যায় না। মন দিয়ে সব বৈষ্ণবকে গোড়ায় যোগবাশিষ্ঠ পড়তে হবে। জ্ঞানচর্চার আকরগ্রন্থ, যোগবাশিষ্ঠ, বলা যায়, ভাগবতের উল্টো মেরুর চিন্তাসম্ভার যোগবাশিষ্ঠ, গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারক পুঁথি। ভাগবত ছেড়ে অদ্বৈতের যোগবাশিষ্ঠ নিয়ে মেতে ওঠার বিবরণ হরিদাসের কাছ থেকে জেনে গোরা বিষণ্ণ হল। চোখে জল এল তার। সঙ্কীর্তনের আসরে সুর আর নৃত্যকলার যুগল মূর্ছনায় যে ভাবাবেশে তার দুচোখ দিয়ে অবিরল জল পড়তে থাকে, সে বেহুঁশ হয়ে যায়, এ চোখের জলের চরিত্র তেমন নয়। গোরার মনে হল, তাকে নিয়ে এতদিন অদ্বৈত ছেলেখেলা করেছে। ন্যায়শাস্ত্রের আচার্য হয়েও প্রেমভক্তি উজাড় করে গঙ্গায় গলা ডুবিয়ে, দু’কুল কাঁপিয়ে প্রার্থনা করে, হেসে কেঁদে, নেচে গেয়ে পৃথিবীতে কৃষ্ণাবতার, গোরাকে আনার দাবি যে করেছে, সেই মানুষটা কীভাবে প্রেমভক্তির প্রচারক গোরাকে তার দুর্দিনে একা ফেলে গোঁড়া ন্যায়শাস্ত্রীর মতো জ্ঞানমার্গে ফিরে গেল? এই মানুষই শ্রীবাসের বাড়িতে বিষ্ণুর খাটে গোরার মধ্যে প্রথমে ষড়ভুজ কৃষ্ণ, তারপর বাঁশি হাতে বৃন্দাবনের কৃষ্ণকে দেখে জ্ঞান হারিয়েছিল। জ্ঞান ফিরতে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিল তাকে। সবটাই কি অদ্বৈতের অভিনয়? জন্ম থেকে আর কত প্রতারিত হবে ভেবে জল এসেছিল গোরার চোখে, হরিদাস চলে যেতে ঘরের দরজা বন্ধ করে হাউহাউ করে সে কাঁদলেও মনে মনে বলেছিল বাপ কৃষ্ণ, তুমি ছেড়ে যেও না আমাকে। আমি হারব না। তোমার নামের মালায় বিশ্বচরাচরকে ফুলের মতো গেঁথে নেব।

ভেজানো দরজায় খুটখুট করে আওয়াজ হতে গোরা বুঝল, দুপুরের খাওয়ার সময় হয়েছে। তাকে ডাকতে এসেছে বিষ্ণুপ্রিয়া। দরজার পাল্লা খুলে বিষ্ণুপ্রিয়াকে দেখল সে। লালপেড়ে ঘন হলুদ রং-এর শাড়ি জড়ানো ছিপছিপে ষোলোবছরের বিষ্ণুপ্রিয়ার শরীর থেকে প্রথম যৌবনের লাবণ্য উপচে পড়ছে। গভীর, টানা দু’চোখ, টিকলো নাক, পাতলা ঠোঁটের নিচে মসৃণ, নাতিআয়ত চিবুক, লম্বা ঘন কালো চুল কোমরের তলায় নেমে গেছে, সকালে চান করলেও ভিজে ভাব রয়েছে চুলে, মুখে ছড়িয়ে স্নিগ্ধ সঙ্কোচ, ঈষৎ বিষণ্ণতা, বিষ্ণুপ্রিয়াকে এত খুঁটিয়ে গোরা আগে কখনও দেখেনি। লক্ষ্মীর তুল্যমূল্য না হলেও সে-ও প্রকৃত সুন্দরী, ঠাওর করেনি। বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে তাকালে মৃত লক্ষ্মী এসে মাঝখানে দাঁড়াত। স্বর্গের অপ্সরাদের চেয়ে চোখ ঝলসানো সুন্দরী লক্ষ্মীর আড়ালে হারিয়ে যেত বিষ্ণুপ্রিয়া। তাকে আদর করা দূরে থাকুক, চোখের সামনে গোরা খুঁজে পেত না। বিয়ের পর থেকে দু’বছরে স্বামীর প্রাথমিক আদরটুকুও বিষ্ণুপ্রিয়া পায়নি। তৃষিত চাতকির মতো স্বামীর সোহাগের জন্যে কত রাত না ঘুমিয়ে অতৃপ্ত কেটে যাচ্ছে, রাতের দেবতা ছাড়া সে খবর কেউ রাখে না। সম্প্রতি এসে জুটেছে সুলতানি ঘোড়সওয়ারবাহিনীর সঙ্গে সিন্ধুকীদের উপদ্রব। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে গৌড়ের প্রতিপত্তিসম্পন্ন ব্রাক্ষ্মণ সম্প্রদায়। তাদের সকলের একটাই লক্ষ্য, পৃথিবী থেকে গোরাকে সরিয়ে দেওয়া। নবদ্বীপের বৈষ্ণববিরোধীদের পাশে এখন গৌড়ের সুলতান এসে দাঁড়িয়েছে। গোরাকে যে কোনওদিন গৌড়ের রাজধানী একডালায় ধরে নিয়ে গিয়ে শূলে চড়িয়ে দিতে পারে সুলতান। ভগবানের চেয়ে তার ক্ষমতা বেশি। ছেলের বিপদের খবর শুনে সারাক্ষণ কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে আছে শচীর দু’চোখ, আবোল তাবোল বকছে সে। স্বামীর অমঙ্গলের কথা ভেবে বিষ্ণুপ্রিয়া কেঁদে আকুল হলেও সংসার সামলে যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখছে। স্বামীর চোখে সেই দুপুরে প্রথম এমন কিছু সে নজর করল, যা আগে দেখেনি। নববধূর দিকে যুবক স্বামী বোধহয় এরকম কামনাতুর চোখে তাকায়। বিষ্ণুপ্রিয়ার বুকের মধ্যে আলোড়ন উঠল। সে অনুভব করল, দু’বছর ধরে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষ্মী সরে গেছে। বিষ খেয়ে আত্মঘাতী সতীনের প্রেতাত্মা এতদিনে সদয় হয়ে স্বামীর অধিকার তাকে ছেড়ে দিয়ে মিশ্রবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। লজ্জায় জড়ানো গলায় স্বামীকে সে বলল, খেতে চলো, তোমার ভাত নিয়ে মা বসে আছে।

বিয়ের পরে এই প্রথম ঘরের আড়ালে বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে গিয়ে গোরার একটু আদর করার ইচ্ছে হলেও সে সামলে নিল নিজেকে। দুপুর অনেকটা গড়িয়ে গেছে। সে না খেলে মা, বউ অভুক্ত থাকবে। বুড়ো ঈশানদাদাও উপোস করে থাকবে। খাওয়ার জন্যে আলাদা ঘর নেই। রান্নাঘরে বসে খাওয়া প্রথা নয়। মায়ের ঘরে, মায়ের সামনে বসে দু’বেলা গোরা ভাত খায়। মায়ের হাতের রান্না তাকে সামনে বসিয়ে না খেলে গোরা তৃপ্তি পায় না। গোরার খাওয়ার মধ্যে তার থালায় শচীকে মাঝে মাঝে হাঁড়ি, গামলা থেকে ভাত, ডাল, তরকারি জুগিয়ে যেতে হয়। ছেলেবেলা থেকেই সমবয়সি কারও থেকে অনেক বেশি খায় গোরা। বয়সের তুলনায় তখন থেকে তার শরীরের বাড় বেশি। পনেরোতে পা দিতে পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো দেহের গঠন হল তার। শরীরের বেড়ে ওঠা থেমে গেলে, কুড়িবছর বয়সে তার দেহের আকার যা দাঁড়াল, পরিচিত জনের সঙ্গে তুলনায় তা অদ্বিতীয়, নবদ্বীপে তার জুড়ি নেই, গৌড় রাজ্যে আছে কিনা সন্দেহ। ছেলেবেলায় দশবছরের বড় দাদা, বিশ্বরূপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেত। তার থালায় ভাতের পরিমাণ দেখে বিশ্বরূপ যেমন খুশি হত, তেমনই মজা পেত ছোট ভাই-এর খাওয়ার ধরন দেখে। বিশ্বরূপ নিজে নাকে মুখে গুঁজে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলেও ছোট ভাই-এর পাশে তার শেষ গ্রাস পাওয়া পর্যন্ত বসে থাকত, অবাক হয়ে দেখত কত অবলীলায়, কত যত্নে পরিতৃপ্তির সঙ্গে ছ’বছরের ভাইটি খেয়ে চলেছে। মা, বাবা বাড়ির কেউ এভাবে খেতে শেখায়নি তাকে। নিজের হাতে সে খেতে শিখলে তাকে সময় নিয়ে, পরিষ্কার করে খেতে বলত মা। তিন, চারবছরের শিশুকে গুছিয়ে খাওয়ার কথা খুব বেশি মাকে বলতে শোনেনি বিশ্বরূপ। মাকে সামনে বসিয়ে নিজের হাতে ভাতের প্রতিটা দানা, শাকের কণা, থোড়, মোচার টুকরো, যত্ন করে গোরা খেত। মা খাইয়ে দিতে চাইলে ভাতের থালা ফেলে উঠে যেত। কয়েকবার এ ঘটনা ঘটতে ছোট ছেলেকে খাইয়ে দেওয়ার কথা শচী আর বলত না। বলার দরকার হত না। নিজের হাতে খেতে শেখার সঙ্গে পাঁচবছরের ছেলে কীভাবে খেতে হয় শিখে নিয়েছিল। শুক্তোর ঝোল মাখা প্রতি গ্রাস ভাত মুখে পুরে, ভাতের প্রতিটা দানা দাঁতে ভেঙে, জিভে শুক্তোর স্বাদ উপভোগ করে এমন তারিয়ে তারিয়ে খেত, যা দেখে মুগ্ধচোখে শচী তাকিয়ে থাকত। মুখের গ্রাস পেটে না যাওয়া পর্যন্ত পরের গ্রাস মুখে তুলত না। শুক্তোর পর শাক, তারপর ডাল, থোড়, মোচা, ডালবড়ার অম্বল, যত্ন করে শেষ কণা পর্যন্ত খুঁটে খেত। সংসার ছেড়ে বিশ্বরূপ চলে যাওয়ার কয়েক বছর পর থেকে মায়ের রান্নার তারিফ করতে শিখল সে। মাকে বলত, কৈলাস পর্বতে কার্তিক-গণেশের মা, দেবী পার্বতীও আমার মায়ের মতো রাঁধতে পারে না।

গোরার কথা শুনে শচী খুশি হলেও দেবতাদের নিয়ে ছেলে টানাটানি করলে ভয় পেয়ে যেত। দেবী পার্বতীর সঙ্গে নিজের মায়ের তুলনা করে ছেলে যেন পাপের ভাগী না হয়। শিশুর চপলতা ক্ষমা করে দেওয়ার জন্যে মা দুর্গার কাছে নীরবে প্রার্থনা করত।

পাথরের বড় বাটি ভর্তি লাউ-এর পায়েস খাচ্ছে গোরা। পুরোটা খেয়ে আরও খানিকটা চেয়ে নেবে। শচী দু’হাতা পায়েস দিলে অর্ধেক খেয়ে বাকিটা বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্যে রেখে দেবে। রোজই রাখে। শুধু পায়েস নয়, বাটি ভরে যতরকম ডাল, তরকারি দেওয়া হয়, এমনকি থালাতে দু’মুঠো ভাতও রেখে দেয়। ছেলের থালাতে বিষ্ণুপ্রিয়াকে ভাত, তরকারি দিয়ে বউমার সঙ্গে শচী খেতে বসে। সত্যিকারের সতীসাধ্বী বধূরা, মা হওয়ার আগে পর্যন্ত এভাবেই খায়, এটাই গার্হস্থ্যধর্ম, সাংসারিক আচার। স্বামীর ভুক্তাবশেষ খেয়েও সন্তানসম্ভবা হওয়ার বিশ্বাস মেয়েমহলে বহুকাল চাল রয়েছে। বিয়ের পর থেকে তিনবছরে একবারও স্বামীর সোহাগ না পেলেও, বিষ্ণুপ্রিয়া এখনও বিশ্বাস করে, স্বামীর থালার অবশেষ খেয়ে যে কোনওদিন তার গর্ভসঞ্চার হবে, মা হয়ে যাবে সে। পায়েসের বাটি শেষ করে দ্বিতীয়বার পায়েস না চেয়ে গোরা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। শচী কিছু বলতে গিয়ে গোরার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। ছেলেকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। রামচন্দ্রপুরের রাস্তায় ভেসে উঠল দুরন্ত গতির দশটা তুর্কি ঘোড়ার খুরের শব্দ। ভয়ে ডুকরে উঠল শচী। থরথর করে কাঁপছে তরুণী বধূ বিষ্ণুপ্রিয়া। প্রতিবেশী বাড়ির দরজা বন্ধ করে হুড়কো লাগানোর আওয়াজ শোনা গেল। তাড়াতাড়ি এঁটো হাত দিয়ে মা, বউকে দু’পাশে দুহাতে আগলে নিজের ঘরে ঢুকল গোরা। সদরদরজায় ঈশান খিল তুলে দিয়েছে। কাছাকাছি কোনও বাড়িতে একটা শিশু কেঁদে উঠল। গোরার হাতের ছোঁয়ায় বিষ্ণুপ্রিয়ার কাঁপুনি থামলেও শচী ফোঁপাতে থাকল। গোরা যে ভীষণ বিপদের মধ্যে রয়েছে শচীর অজানা ছিল না। মাকে নিজের আরও কাছে টেনে নিয়ে গোরা অভয় দিল। বলল, আমি তো রয়েছি।

শচী তাকাল গোরার দিকে। মায়ের চোখে চোখ রেখে গোরা জিজ্ঞেস করল, আমি কে? কী আমার পরিচয়?

ছেলের প্রশ্নে শচীর বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠল। এ কী অলক্ষুণে প্রশ্ন করছে গোরা? পঁচিশবছর আগে শ্রীহট্টে মুজাভিরের দরগায় হত্যে দেওয়া তিন দুর্যোগের রাত, ঘন গভীর স্মৃতি, শচীর মাথার মধ্যে উথালপাথাল করতে থাকল। মাথার দেওয়াল ফেটে এখনই যেন চারপাশে ঘিলু রক্ত ছড়িয়ে পড়বে। যন্ত্রণায় শচী চোখ বুজতে গোরা জিজ্ঞেস করল, মা, আমি কৃষ্ণাবতার, তুমি কি বিশ্বাস করো?

করি বাবা, করি।

দু’হাতে শচী মুখ ঢাকতে গোরা ফেরে জিজ্ঞেস করল, মা, আর কী বিশ্বাস করো?

মুখে হাত চেপে শচী ডুকরে কেঁদে উঠতে গোরা একই প্রশ্ন করল দ্বিতীয়বার। শচীর কান্না থেমে গেল। মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তুই আমার ছেলে, আমি তোর গর্ভধারিণী মা।

মায়ের দু’কাঁধে হাত রেখে গোরা বলল, হ্যাঁ তাই। আমি তোমার ছেলে, শুধু তোমার, তোমার-ই।

মা, ছেলের কথা চালাচালির এই হেঁয়ালি বিষ্ণুপ্রিয়ার মাথায় না ঢুকলেও অশ্বারোহী বাহিনীর ঝটিকা টহলের আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তার বুকের ভয় অনেকটা সরে গিয়েছিল। তার স্বামীকে রাজধানী একডালায় ধরে নিয়ে যেতে সুলতান ঘোড়সওয়ারদের পাঠিয়েছে, নবদ্বীপের সব মানুষের মতো এ খবর তার কানেও এসেছে। নৌবহর এসে গেলে বামুনপাড়া সাফ করে সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। আতঙ্কে বিষ্ণুপ্রিয়ার রাতে ঘুম হয় না। ফাঁকা বিছানায় একা হাত-পা মুড়ে শুয়ে থাকে। ঘুমে দু’চোখ বুজে আসার মুহূর্তে চমকে জেগে যায়। ধড়ফড় করতে থাকে বুক। শ্রীবাসের বাড়িতে সঙ্কীর্তন সেরে গোরা যখন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে, সে টের পায় না তখনও বউ জেগে আছে। ভাবে, বিষ্ণুপ্রিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। গৌড় থেকে সুলতানের সিন্ধুকীরা আর সেনাবাহিনী আসার পর থেকে বিষ্ণুপ্রিয়ার ঘুম ছুটে গেছে, গোরা জানে না। নিজের ভাবে সে বিভোর হয়ে আছে।

মা, বউকে খেতে পাঠিয়ে ঈশানকে ভাত দিতে বলে গোরা সেই দুপুরে বিশ্রাম করল না। উড়ুনি গায়ে জড়িয়ে কিছুটা পথ হেঁটে মুরারির বাড়িতে এল। শেষদুপুরে গভীর ভাতঘুমে ডুবেছিল মুরারি। গোরা আচমকা এসে যেতে মুরারির বাড়িতে হুলস্থূল পড়ে গেল। মুরারির বউ এঁটো থালাবাসন মাজছিল, উঠোনে খেলছিল তাদের দুই ছেলে। তারা অবাক হয়ে গোরাকে যখন দেখছে, মাথায় কাপড় টেনে তাদের মা ঘরে ঢুকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে স্বামীকে ঘুম থেকে তুলল। গোরা এসেছে শুনে কাঁচা ঘুম থেকে জেগে তড়াক করে তক্তাপোশ থেকে নেমে পড়ল মুরারি। শেষ দুপুরে বিনা বিজ্ঞপ্তিতে তার বাড়িতে গোরা চলে আসবে, এমন সৌভাগ্য তার কল্পনায় ছিল না। ঘর থেকে বেরিয়ে আঙিনায় দাঁড়ানো দশবছরের ছোট গোরাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল সে। তার দেখাদেখি তার বউ, দুই ছেলেও তাই করল। স্বয়ং কৃষ্ণাবতার বিনা আমন্ত্রণে অতিথি হয়ে এলে তাকে কীভাবে আপ্যায়ন করতে হয়, মুরারি ভেবে পেল না। শাঁখ বাজাবে, দুই ছেলের হাতে কাঁসর ঘণ্টা ধরিয়ে দিয়ে, বউকে উলুধ্বনি দিতে বলবে, নাকি পড়শি বৈষ্ণবভক্তদের ডেকে সঙ্কীর্তন শুরু করবে, ভেবে পেল না। মুরারিকে উশখুশ করতে দেখে তার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় গোরা বলল, মুরারি, ব্যস্ত হয়ো না। অনেকদিন তোমার বাড়িতে আসা হয় না, আজ ইচ্ছে হল, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি, চলে এলাম।

বিনয়ে অবনত হয়ে মুরারি বলল, হে দেবতা, তোমাকে বসাব কোথায়?

তোমার ঘরের দাওয়াতে বসতে পারি।

গোরার কথাতে লজ্জা পেয়ে মুরারি বলল, আমার বাড়িতে শোয়ার ঘর আছে, সেখানে বসব।

মুরারির বাড়িতে শোয়ার একটাই ঘর। সে ঘর দখল করলে মুরারির বউ ছেলেদের দুপুরে বিশ্রাম হবে না, আঁচ করে গোরা বলল, তোমার রোগী দেখার ঘরে বসাই ভালো। নিরিবিলিতে প্রাণ খুলে আলাপ করা যাবে।

গোরার কথায় উজ্জ্বল হল মুরারির মুখ, বলল, আমি এই ভয় পাচ্ছিলাম, আমার বাড়িতে তুমি আসবে জানতাম। এ যাত্রা আমি বোধহয় বেঁচে গেলাম।

মুরারির কথা শুনে কিছু একটা অনুমান করলেও গোরা তখনই কিছু বলল না। তার রোগী দেখার ঘরে ঢুকে তক্তপোশে বসে বলল, মুরারি, আত্মহত্যা করা পাপ। তোমার সংসার রয়েছে, দুটো ছেলে, বউ রয়েছে, তাদের ভরণপোষণের ভার তোমার। গৃহকর্তার দায়িত্ব পালন না করে পৃথিবী ছেড়ে তোমার যাওয়ার উপায় নেই।

গোরা কথা শেষ করার পরের মুহূর্তে ঝরঝর করে মুরারি কেঁদে ফেলল। বলল, আজ মাঝরাতে তেলিপাড়ার ভাগাড়ের পশ্চিমকোণে শ্যাওড়া গাছে গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ব ভেবেছিলাম। ফাঁস তৈরি করে দড়িটা গাছের একটা ডালে রেখে এসেছি। হে দেবতা, আমার ইচ্ছেটা যে তোমার কাছে গোপন থাকবে না, আমি জানতাম। তুমি নিজেই ইচ্ছাময়, তুমি ইচ্ছেপূরণকারী, আবার ইচ্ছেটা তুমি কেড়েও নাও। আমার আত্মঘাতী হওয়ার পথ আটকে তুমি দাঁড়াবে, তা-ও আমার অজানা ছিল না। হে অবাঙমানসগোচর দেব, আমাকে ব্রতপালনে তুমি আজ্ঞা দাও।

কেন তুমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কঠিন ব্রত নিলে?

গোরার প্রশ্নে মুরারির বলল, যে পৃথিবীতে তুমি নেই, সেখানে আমি থাকতে পারব না। তুমি পৃথিবী ছাড়ার আগে আমি মরতে চাই।

সুলতানি ফৌজ দেখে তুমি কি ভয় পাচ্ছ, ধরে নিয়েছ, সেনাবাহিনী আমাকে রাজধানীতে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেবে?

দু’কান নাক ছুঁয়ে সঙ্কোচে জিভ কাটল মুরারি, বলল, তোমাকে ছোঁয়ার সাধ্য কোনও সুলতানের নেই। তোমার গায়ে কোনও রাজা-মহারাজা, সম্রাট আঁচড় কাটতে গেলে ভস্ম হয়ে যাবে।

তাহলে তোমার ভয় কীসের? .

ভয় একটাই, তুমি যদি চোখের আড়ালে চলে যাও, আমি বাঁচব না। সেরকম কিছু ঘটার আগে আমি এ জীবন শেষ করে দিতে চাই।

তেমন কিছু ঘটবে না। তুমি যখনই চাইবে, আমার দেখা পাবে।

কথাটা বলে গোরা পুরনো প্রসঙ্গ পাড়ল। বলল, মুরারি মনে করতে পারো অনেকবছর আগের সেই দুপুরটা?

কোন দুপুর?

তুমি খেতে বসেছিল, আমি অপকর্ম করে তোমার ভাতের থালা নষ্ট করেছিলাম, মনে পড়ে?

প্রশ্ন শুনে বিব্রত মুরারি স্তব্ধ হয়ে রইল, বলল, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কী লাভ!

গোরা স্বগতোক্তি করল, ভীষণ গোঁয়ার, ইতর ছিলাম, ভাবলে লজ্জা পাই, ভারি কষ্ট হয়। কত মানুষের মনে দুঃখ দিয়েছি, কারণে অকারণে কতজনকে অপমান করেছি, হিসেব নেই। তোমার মতো সকলে কি ক্ষমা করবে আমাকে?

কান্না জড়ানো গলায় মুরারি বলল, আমাকে আর সাজা দিও না, কাঁদিও না আমাকে। তুমি হলে জীবন্ত ক্ষমা, আমার মতো ছারপোকার সাধ্য কি তোমাকে ক্ষমা করে?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গোরা বলল, গঙ্গাদাস পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে পড়তাম আমরা। তুমি ছিলে স্মৃতিশাস্ত্রের কৃতী ছাত্র। সহাধ্যায়ীদের সঙ্গে সুযোগ পেলেই ‘যোগবাশিষ্ঠ’ আলোচনা করতে। আমারা কয়েকজন কমবয়সী দুষ্টু ছাত্র, বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই তোমাদের পেছনে লেগে যেতাম, তোমাদের আলোচনার কিছু না বুঝে আজেবাজে মন্তব্য করতাম, ভেংচি কাটতাম, মনে পড়ে?

চোখের জল মুছে মুরারি তাকাতে গোরা বলল, যোগবাশিষ্ঠের মতো মহাগ্রন্থের গুরুত্ব বুঝতাম না, বড় বেশি জ্ঞানগর্ভ, বাক্যের কচকচি মনে হত। রামচন্দ্রকে বৈরাগ্যবাদী অযোধ্যাপতি হতে দেবর্ষি বশিষ্ঠের যোগশিক্ষার প্রকরণগুলো নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। আসলে বয়সটা কম ছিল, ছ’-সাতবছরের বেশি নয়।

গোরা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমার ঘরে যোগবাশিষ্ঠ পুঁথিটা কি আছে? আমাকে একবার দিতে পারো?

গোরার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল মুরারি। যোগবাশিষ্ঠ পুঁথি গোরা চাইতে পারে, সে ভাবেনি। গয়া থেকে গোরা ফেরার অল্পদিনের মধ্যে যোগবাশিষ্ঠকে গঙ্গার জলে সে ভাসিয়ে দিয়েছে। শুকনো জ্ঞানমার্গের পথ ছেড়ে তখন প্রেমভক্তির স্রোতে সে ভাসতে শুরু করেছিল। সমুদ্রস্নানের আনন্দ ছেড়ে কেন এঁদোপুকুরে ডুব দিতে যাবে, এই ভেবে যোগবাশিষ্ঠ ছেড়ে শ্রীমদ্ভাগবত আঁকড়ে ধরেছিল।

গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসা সেই পুঁথি গোরাকে এখন কীভাবে দেবে বুঝতে না পেরে মুরারি জিজ্ঞেস করল, তোমার আবার যোগবাশিষ্ঠ পড়তে ইচ্ছে করল কেন?

গোরা হাসল। বিষণ্ণ সেই হাসি দেখে মুরারি ভয় পেলেও প্রশ্ন করল না। গোরা বলল, শুনলাম, শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্য নাকি তোরঙ্গে ভাগবত রেখে দিয়ে সকাল সন্ধে যোগবাশিষ্ঠ পড়ছেন। হরিদাসকে বলেছেন, যোগবাশিষ্ঠ, মানে বশিষ্ঠ রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে দেবর্ষি বশিষ্ঠের ছয় প্রকরণের ব্যাখ্যা, বৈরাগ্যবাদ, মুমুক্ষু ব্যবহার, উৎপত্তি, স্থিতি, উপশম, নির্বাণ, বিশদভাবে না বুঝলে ভাগবতের প্রেমভক্তির যথার্থ আস্বাদন হয় না।

মুরারির কানেও শান্তিপুরের এই খবর পৌঁছেছিল। ভাগবদ ছেড়ে অদ্বৈত আচার্যের যোগবাশিষ্ঠ পড়ার আজগুবি খবরে মুরারি পাত্তা দেয়নি। গোরার মুখে একই ঘটনা শুনে মুরারির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পঞ্চাশবছর ধরে ভাগবদ পড়ে, প্রার্থনার জোরে যে মানুষ, পৃথিবীতে কৃষ্ণাবতার আবির্ভাব সম্ভব করেছে, সে যদি ভাগবদ সরিয়ে রেখে নীরস যোগবাশিষ্ঠের আচারবিধি চর্চা করে, তাহলে কৃষ্ণাবতারের অস্তিত্বই নকচ হয়ে যায়। মুরারির মুখে কথা সরল না। পাথরের মতো সে বসে থাকতে গোরা বলল, দুঃখ করো না মুরারি, আচার্যদেব আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসবে, দু’হাতে মাথায় তুলে নেবে ভাগবত

গোরার আশ্বাসে মুরারির বুক থেকে পাথর নেমে গেল। বলল, দেবতা, সবই তোমার ইচ্ছে।

গোরা হাসল, বলল, বাবার ওপরেও বাবা আছে।

—তিনি কে?

—কৃষ্ণ।

—তাঁরও পরে কি কোনও বাবা আছে?

—মুরারির প্রশ্নে এক লহমা চুপ করে থেকে গোরা বলল, আছে।

—তিনি কে?

—ভক্ত! ভক্তের ইচ্ছে, তার ব্যাকুল প্রার্থনা! ভক্তের প্রার্থনায় স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল কেঁপে উঠতে পারে। অদ্বৈত আচার্য প্রকৃত ভক্ত, তাকে ঘিরে অসংখ্য ভক্ত, আচার্য পালাবে কোথায়?

গোরা যাওয়ার আগে তার পায়ে চন্দন, বেলফুলের মালা, তুলসি-মঞ্জুরি দিয়ে প্রণাম করল মুরারি, তার বউ। প্রতিবেশীদের কেউ মুরারির বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিল গোরাকে। পাড়ায় খবরটা রটে যেতে আশপাশ থেকে গোরার বেশ কিছু ভক্ত এসে অপেক্ষা করছিল মুরারির বাড়ির উঠোনে। তারাও প্রণাম করল গোরাকে। তাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে সঙ্গী হল কয়েকজন। শ্রীবাসের বাড়ির আঙিনায় সেই সন্ধেতে সঙ্কীর্তনের আসরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উদ্দণ্ড নৃত্যের মধ্যে গোরা বেহুঁশ হয়ে গেল। সঙ্কীর্তনের সময়ে তাকে ঘিরে থাকে নিতাই, গদাধর, দামোদর, মুকুন্দ, মুরারি, জগদানন্দ প্রমুখ ভক্তরা। বেহুঁশ গোরা মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে তাকে ধরে নেয় অনুগামীরা। সযত্নে শুইয়ে দেয় চাদরের ওপরে। সঙ্কীর্তন থামে না। কেদার রাগ থেকে গুর্জরী রাগে সঙ্কীর্তন শুরু করে বাসু ঘোষ, সবাই গলা মেলায়। কিছুক্ষণের মধ্যে গোরার জ্ঞান ফিরে আসে। প্রেমভক্তির সঙ্গে অদ্বৈতের ওপর অভিমানে সেই সন্ধেতে ভাবাবেশের তুঙ্গে ছিল গোরা। অন্য রাতের চেয়ে বেশিবার হুঁশ হারাচ্ছিল। সে জ্ঞান হারালে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল গৃহকর্তা শ্রীবাস। পরিষ্কার ঠাণ্ডা জলে নিজের দু’হাত ধুয়ে আধভেজা দু’হাতের পাতা গোরার মুখে, ঘাড়ে, পিঠে বুলিয়ে, তার কপালে নতুন করে চন্দনবাটা লেপে জ্ঞান ফিরিয়ে আনছিল। গোরা ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে না বসা পর্যন্ত তার পাশ থেকে শ্রীবাস নড়ে না। গোরা বারবার বেহুঁশ হতে থাকলেও তার পরিচর্যায় অন্য রাতের মতো শ্রীবাসকে পাওয়া গেল না। সঙ্কীর্তন শুরু হলে আসর ছেড়ে যে কখনও বেরোয় না, সেই শ্রীবাস মাঝেমধ্যে গোরাকে শুক্লাম্বর, দামোদরের হাতে ছেড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। ভয়ের রাজত্ব চলছিল নবদ্বীপে। শ্রীবাসের বাড়ির চালে যে কোনও মুহূর্তে আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কা করছিল কেউ কেউ। সঙ্কীর্তনের মধ্যে জ্যান্ত পুড়ে মরার আতঙ্কে আসরে ভিড় কমছিল। সঙ্কীর্তনের আসর থেকে শ্রীবাসের মাঝে মাঝে অদৃশ্য হওয়ার ঘটনাকে তার ঘনিষ্ঠরা সহজভাবে নিয়েছিল। বিপদের সময়ে গৃহকর্তা তদারকি করতে যেতেই পারে। শ্রীবাসের বাড়ি আগে একবার পুড়েছিল। সপরিবারে বেঁচে গেলেও ঘর পোড়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তার আছে। যৌথ পরিবারের সব দিকে নজর রেখে তাকে চলতে হয়। তার মধ্যে শুক্লাম্বর একবার শ্রীবাসকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার পণ্ডিত, এত ঘর-বার করছ কেন?

তেমন কিছু নয়।

কথা শেষ করে সঙ্কীর্তনে গলা মিলিয়ে নাচতে শুরু করেছিল শ্রীবাস। শ্রীবাসের কথার ভঙ্গিতে অচেনা কিছু নজর করলেও দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না শুক্লাম্বর। শ্রীবাসের পাশে সে-ও ভাবাবেগে নাচতে শুরু করে টের পেল বেতালে পা ফেলছে শ্রীবাস, তার ছুটতাল ঘটছে। নাচ ছাড়া গান হয় না, সঙ্কীর্তনের কথা ভাবাই যায় না। নাচ, গান মিলে সঙ্কীর্তন। দুটোতে সমান পারঙ্গম হতে হয়। রাসোৎসব পালার গানে ‘ঘটকালি’ আর ‘রসের ভিয়ানে’ তেওট তালের নাচই খাপ খায়, তাল মেনে শ্রীবাসের পা পড়ছে না জেনেও সঙ্কীর্তনে ভাবাবেশে সেদিকে শুক্লাম্বরের নজর থাকল না। নির্ভুল তেওট তালে সে নেচে চলল। তেওট তালের নাচে নাটকীয়তা আছে। রাসলীলা জুড়ে এই নাটকীয়তা যেমন মধুর রসে উজ্জ্বল, বিরহে তেমনই অঝোরবর্ষী জলধারার মতো।

প্রায় মাঝরাতে সঙ্কীর্তন শেষ হতে জানা গেল, রাতের প্রথম প্রহরে সঙ্কীর্তন চলার সময়ে শ্রীবাসের নবজাত ছেলেটি মারা গেছে, দেড়মাসের শিশুটি চব্বিশ ঘণ্টা উদরাময়ে ভুগে রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে মায়ের কোল ছেড়ে চলে গেছে। শিশুসন্তানের মৃত্যুর সময়ে স্ত্রী মালিনীর পাশে ছিল শ্রীবাস। পরিবারের বউ, মেয়েরা সকলেই মালিনীর ঘরে, বাইরের দাওয়ায় জড়ো হলেও কারও গলা থেকে কান্নার আওয়াজ বেরোয়নি। সঙ্কীর্তনের আসর তখন জমে উঠেছে। উদ্দণ্ড নৃত্য করছিল গোরা। মরণোন্মুখ শিশুটি হিক্কা তুলতে শুরু করলে শ্রীবাস বুঝেছিল কী ঘটতে চলেছে। স্ত্রী মালিনী সমেত সবাইকে গলা থেকে কান্নার শব্দ বার না করতে কড়া হুকুম দিয়েছিল। আকাশ ফাটানো কান্নার রোল তুলে সঙ্কীর্তন পণ্ড করলে গোটা পরিবারের অকল্যাণ হবে, শাস্ত্র উল্লেখ করে সবাইকে জানিয়েছিল। সঙ্কীর্তন থামলে কান্নাকাটি করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। মাঝপথে সঙ্কীর্তন থেমে গেলে পরিবারের ঘাড় থেকে পাপের বোঝা কোনওদিন নামবে না।

হরিধ্বনি তুলে আসর ভাঙলে শ্রীবাসকে মজা করে শুক্লাম্বর বলল, তেওট তালের নাচে তোমার তালছুট চোখে পড়ল। বাবা হওয়ার আহ্লাদে নাকি?

প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সন্তানের মৃত্যুসংবাদ শোনাল শ্রীবাস। হতভম্ব শুক্লাম্বর কথা হারিয়ে তখনই গোরাকে জানাল সেই দুঃসংবাদ। গোরা চমকে গেল। শ্রীবাসের সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, এসব কী শুনছি পণ্ডিত?

শ্রীবাস বলল, শুক্লাম্বর যা শোনাল, তা ঠিক। সঙ্কীর্তনে ব্যাঘাত না ঘটাতে বাড়ির মেয়েদের কান্না বন্ধ রাখতে বলেছিলাম।

শ্রীবাসের চোখ দুটো ছলছল করে উঠতে তাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে গোরা হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। শ্রীবাসের ছেলের শোকে কৃষ্ণাবতারকে কাঁদতে দেখে তার অনুগামীরা চোখের জল সামলাতে পারল না। বাড়ির ভেতরটা তখনও নিশ্চুপ। সঙ্কীর্তন শেষ হয়েছে টের পেলে দু’একজন ফোঁপালেও গলা ছেড়ে কেউ কাঁদতে সাহস পেল না। বিষ্ণুমন্দিরের অন্ধকার চাতালে শ্রীবাসকে জড়িয়ে গোরাকে কাঁদতে দেখে মন্দিরের ভেতরে নারায়ণীর দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে থাকল। কিছুক্ষণ আগেও মৃত সন্তানকে আগলে বসে থাকা মালিনীকে জড়িয়ে ধরে তার পাশে ছিল নারায়ণী। কান্নায় বুক ফেটে গেলেও প্রার্থনা করেছিল, মালিনীখুড়ির অকালমৃত এই ছেলে যেন তার গর্ভে ফিরে আসে, এ সংসার ছেড়ে চিরকালের মতো চলে না যায়। মালিনীখুড়ির বারোজন জীবিত ছেলেমেয়ের সঙ্গে সদ্য চলে যাওয়া এই শিশু নতুন করে পৃথিবীতে যেন ফিরে আসে। নারায়ণীকে ‘মা’ বলে সে ডাকবে, নারায়ণীর সন্তান হলেও আসলে সে মালিনীর ছেলে, খুড়িকে একদিন সে জানিয়ে দেবে। তার কোলের ছেলেকে নারায়ণীর গর্ভে পাঠিয়ে গৃহদেবতা বিষ্ণু সংসারে ফিরিয়ে এনেছে, শুনলে মালিনীখুড়ি নিশ্চয় আনন্দে ভেসে যাবে। মন্দির থেকে সঙ্কীর্তন আসরের চোখ এড়িয়ে মালিনীর পাশে নারায়ণীর এসে দাঁড়ানোর পরের মুহূর্তে গোরাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল শ্রীবাস। শুক্লাম্বর, জগদানন্দ, গদাধর রয়েছে চৌকাঠের বাইরে। অঝোরে কেঁদে চলেছে গোরা। কান্না গিলে যারা এতক্ষণ কাঁদার জন্যে অপেক্ষা করছিল, গোরা দু’চোখের অঝোর বর্ষণ দেখে তারা বোবা হয়ে গেছে। আওয়াজ বেরোচ্ছে না তাদের গলা থেকে। সেজবাতির আলো এসে পড়েছে মৃত শিশুর মুখে। হাঁটু গেড়ে বসে গোরা চুমু খেল প্রাণহীন শিশুর গালে। বলল, সোনামণি আবার ফিরে এসো।

গোরার কথাতে ঘরের দেওয়ালে দীপের আলোয় কাঁপতে থাকা ঝাপসা ছায়াগুলোর সঙ্গে মৃত শিশু যেন নড়ে উঠল। মালিনী চমকে উঠে ছেলের বুকে হাত রাখতে গোরা বলল, খুড়ি, তোমার ছেলে ফিরে আসবে। আমি যার ছেলে, তিনিই ফিরিয়ে দেবেন তোমার ছেলেকে।

ঘরের অন্ধকার দাওয়ায় সকলের চোখের আড়ালে দাঁড়িয়ে গোরার কথাগুলো শুনে নারায়ণীর শরীরে কাঁটা দিল। শ্রীবাসের পরিবারে নতুন এক শিশু অতিথি আসতে চলেছে, আগেভাগে গোরা কীভাবে পেল এ খবর? প্রশ্নটা মনে জাগতে অন্ধকারে নিজের শরীরের দিকে নারায়ণী তাকাল। ভালো করে দেখল নিজেকে। প্রায়ই নিজেকে একান্তে এভাবে সে দেখে। শরীরের ভেতরে কী পরিবর্তন ঘটছে, সে টের পেলেও বাইরের মানুষ, এমনকি মালিনীখুড়ি পর্যন্ত এখনও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি। গেল একমাসে দু’তিনবারের বেশি গোরাদাদার মুখোমুখি সে পড়েনি। তাকে দেখেও গোরা দেখে না। নিজের ভাবাবেশে সে বিভোর থাকে। প্রতিবেশী পরিবারের বিধবা মেয়ের গর্ভসঞ্চার অথবা গর্ভনাশে তার কিছু যায় আসে না, সন্তানসম্ভবার প্রসবের আগের মুহূর্তেও তার দিকে তাকাবে না সে।

শ্রীবাসের স্ত্রী, আত্মীয় পরিজনদের সান্ত্বনা দিয়ে গোরা যখন বাড়ি ফিরল তিন প্রহর রাত শেষ হতে চলেছে। সঙ্কীর্তনের আসরে তার যে ভাবাবেশ জেগেছিল, শ্রীবাসের ছেলের মৃত্যুতে তা ছুটে গেছে। ছেলেকে হারিয়েও সঙ্কীর্তনে আপ্লুত যে শ্রীবাস আসর জাগিয়ে সেখানে নাচতে পারে, তার মতো প্রিয়জনকে কীভাবে অভিনন্দিত করবে, গোরা ভেবে পেল না।, তাকে কৃষ্ণাবতার জেনে, তার মর্যাদা বাঁচাতে গোটা পরিবারের শোক অবরুদ্ধ করে রেখেছিল শ্রীবাস পণ্ডিত। সরল, নিরীহ, মাটির মানুষ এই ভক্তের কল্যাণ কামনায় উদ্বেলিত হচ্ছিল গোরার হৃদয়। সদর দরজা খুলে ঈশান ফের খিল লাগাল। শব্দ না করে আলগোছে ভেজানো পাল্লা খুলে অন্ধকার ঘরে ঢুকে গোরা প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। স্থির হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতে দেখল, তক্তপোশের ধার ঘেঁষে সামান্য জায়গা নিয়ে হাঁটু মুড়ে বিষ্ণুপ্রিয়া ঘুমোচ্ছে। ফুলশয্যার রাত থেকে গেল আড়াইবছর এভাবে ঘুমোচ্ছে সে। স্বামী কখনও কাছে ডেকে নেয়নি, রাতে আদর করেনি তাকে। দুপুরে মুরারির বাড়ি যাওয়ার আগে বিষ্ণুপ্রিয়াকে দেখে চনমন করে উঠেছিল গোরার শরীর, তার দু’চোখের দৃষ্টিতে যে তাগিদ ফুটে উঠেছিল, বিষ্ণুপ্রিয়ার তা নজর এড়ায়নি। স্বামীর চোখে চোখ পড়তে ভালবাসার আঠায় জড়িয়ে বিবশ হয়ে গিয়েছিল সে। স্বামীকে ভাত খেতে ডাকতে এসে নড়তে পারছিল না। দরজার বাইরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার গায়ে এসে লাগছিল স্বামীর শরীরের নাতিউয় সোহাগের ঢেউ। দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও রান্নাঘরে ভাত নিয়ে অপেক্ষায় থাকা মায়ের কথা ভেবে গোরা সংযত করেছিল নিজেকে। অপরিমেয় এক সম্ভাবনা সময়ের সমুদ্রে টুপ করে ডুবে গিয়েছিল। স্বামীর সেই ক্ষুৎকাতর চাউনির টানে মাঝরাত পর্যন্ত অনেক আশা বুকে নিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া জেগে ছিল। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে ফাঁকা বিছানায় একা ঘুমিয়ে পড়েছে। শ্রীবাসের ছেলের মৃত্যুর জন্যে বাড়ি ফিরতে গোরার এক ঘণ্টা দেরি হয়েছে। শ্রীবাসের মতো ভক্তের পাশে সারারাত বসে থেকে ভক্তির মহিমা অনুভব করতে চেয়েছিল সে। অনুগামীরা তা ঘটতে দেয়নি। প্রায় জোর করে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। শ্রীবাসের মহিমা দেখার পর থেকে বারবার তার মনে পড়ছিল, অদ্বৈত আচার্যের তোরঙ্গে ভাগবত তুলে রেখে যোগবাশিষ্ঠ পড়ার ঘটনা। ভাগবত ছেড়ে অদ্বৈত যোগবাশিষ্ঠ পড়তে পারে, গোরা ভাবেনি। এ কি আচার্যের খেলা, তাকে পরীক্ষা করার চাতুরি? হরিদাস পর্যন্ত নিজের গুরুর এই স্বধর্মচ্যুতি মেনে নিতে পারেনি। শান্তিপুর থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসে জানিয়েছিল গৌড়ের সুলতানের হামলাতে ভয় পেয়ে পরমভাগবত অদ্বৈত আচার্য প্রেমভক্তির পথ ছেড়ে নতুন করে জ্ঞানমার্গে সাধনার তত্ত্ব প্রচার করে বেড়াচ্ছে। তক্তপোশে ঘুমন্ত বিষ্ণুপ্রিয়ার দু’হাত দূরে শুয়ে ক্রমশ তেতে উঠছিল গোরার মেজাজ। সুলতানি সেনা, গুপ্তচরে নবদ্বীপ ছেয়ে গেলেও শ্রীবাস যেখানে জীবন-মৃত্যু তুচ্ছ করে নির্ভয়ে নিজের বাড়ির আঙিনায় রোজ সঙ্কীর্তনের আসর বসাতে পারে, সেখানে

শান্তিপুরে বৈষ্ণবসমাজের পুরোধা অদ্বৈত আচার্য ভয়ে গুটিয়ে ভক্তিবাদের উল্টো পথে হাঁটবে, এই ঘটনা সহ্য করা যায় না। তাকে কৃষ্ণাবতার বানিয়েছে অদ্বৈত। তার আগে বিশ্বরূপের কানে স্বধর্মপ্রতিষ্ঠার দায় চাপিয়ে তাকে সংসার ছাড়ার প্ররোচনা অদ্বৈত-ই দিয়েছিল। অদ্বৈতর সঙ্গে হিসেব নিকেশ চুকোতে বাকি রাত না ঘুমিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শান্তিপুরে যেতে তৈরি হল গোরা। আকাশে তখনও আলো ফোটেনি। গোরা পোশাক পাল্টে ঘর ছেড়ে বেরনোর আগে বিষ্ণুপ্রিয়া জেগে গিয়েছিল। ঘুমচোখে বিছানায় সে উঠে বসতে গোরা বলল, আমি শান্তিপুর যাচ্ছি।

—কেন?

—অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে দেখা করতে।

—এখনও সকালের আলো ফোটেনি।

—জানি, সবাই এখন ঘুমোচ্ছে। মানুষজন জেগে ওঠার আগে নবদ্বীপের তল্লাট ছেড়ে আমি শাহিসড়কে পৌঁছে যেতে চাই। সঙ্গীসাথী না নিয়ে একা যেতে চাই আচার্যের বাড়ি। ঘুম থেকে উঠে মা আমাকে খুঁজলে তাকে জানিয়ে দিও আমি শাস্তিপুরে গেছি। আজ রাতে অথবা কাল ভোরে ফিরব। খবরটা পাঁচকান করতে বারণ করো।

নবদ্বীপের মানুষের নজর এড়িয়ে গোরা যেমন চেয়েছিল, একা শাহিসড়কে পৌঁছে গেল। পুব আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। পথের দু’পাশের গাছে ডাকাডাকি করছে হরেকরকম পাখি ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য উঠবে। বেলা বাড়লে শরতের রোদ তেতে ওঠে। রোদ লেগে তখন গা জ্বালা করে। শান্তিপুরে পৌঁছে প্রথমে গঙ্গার ঘাটে চান সেরে তারপর অদ্বৈত আচার্যের বাড়িতে যাওয়ার চিন্তা মাথায় এলেও পরের মুহূর্তে গোরা তা ঝেড়ে ফেলল। শান্তিপুরে সবাই তাকে চেনে। ঘাটে যারা চান করতে আসবে, তাকে হঠাৎ সেখানে দেখলে তারা হরিধ্বনিতে পাড়া কাঁপিয়ে দেবে। শুধু শান্তিপুর কেন, গঙ্গার দু’ধারে, মনোহরশাহী পরগনা থেকে শুরু করে নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, সপ্তগ্রাম, উদ্ধারণপুর, ফুলিয়া, কুমারহট্ট এমনকী গড়েরহাট পরগনার অনেক মানুষ তাকে চেনে। তাকে যারা চোখে দেখেনি, গোরা নাম তারা শুনেছে। নবদ্বীপে যে একজনই গোরা, গৌড় রাঢ়ে কোথাও তার মতো সুদেহী, সুন্দর, দেবপ্রতিম দ্বিতীয় কোনও গোরা নেই, সবাই জানে। তাকে দেখলেই চিনে নেওয়া যায়, তাকে নিয়ে মুখে মুখে হাজার রটনা, মানুষ জেনে গেছে। পথে ঘাটে তাকে দেখলে ভিড় জমে যায়। সবাই যে তার অনুরাগী এমন নয়, প্রতিপক্ষের লোক, এমনকি গুপ্তঘাতক ভিড়ে মিশে থাকে। শাহিসড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে শান্তিপুরে যাওয়া যায়, শান্তিপুরে পৌঁছলে বাবলা গ্রামে অদ্বৈতের বাড়িতে যেতে এক দণ্ডের বেশি সময় লাগবে না। সূর্য ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল গোরা। লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝড়ের গতিতে সে হাঁটে। জঙ্গলের ছায়া ঢাকা মেঠোপথে কিছুটা এগোতে সামনে দেখল একটা গোরুর গাড়ি হেলেদুলে চলেছে। গাড়ির মধ্যে হোগলার ছাউনি ঘেরা একফালি বসার জায়গা। ধনী পরিবারের মেয়েরা এ গাড়িতে যাতায়াত করে। গোরুর গাড়ির চেয়ে দ্রুতগতিতে গোরা এগোচ্ছিল। গাড়িটা পেছনে ফেলে সে কয়েক পা এগোতে পেছন থেকে গাড়োয়ান হাঁক পাড়ল, দাদাঠাকুর যান কোথায়?

গোরা দাঁড়াতে গাড়ি ছেড়ে যে লোকটা সামনে এসে দাঁড়াল, তাকে মুখচেনা লাগলেও নাম মনে করতে পারল না। গলায় গামছা জড়ানো, কোমরে লুঙি, ছাগলদাড়ি লোকটা বলল, দাদাঠাকুর আমারে চিনতে পারতেছেন না? আমি হলাম গিয়ে মালোপাড়ার গফুর। আমাদের পাড়ার নকুড়ের সঙ্গে সেই যে আপনি চিনুপার ঘরে গিয়েছিলেন, তখন আলাপ হয়েছিল আপনার সঙ্গে। চিনুপা আমার কাকা, নেড়ানেড়িদের ধর্ম ছেড়ে আমার বাবা মোচরমান হলেও চিনুপা কথা দিয়েও হল না। নেড়ানেড়িদের সঙ্গে থেকে গেল সে। অথচ তার ভরসাতে আমার বাবা সাততাড়াতাড়ি মোচরমান হয়ে গেল। বাপ মোচরমান হলে ছেলের কোনও উপায় থাকে না। বাপের ধম্ম মেনে নিতে হয় তাকে। আমিও নিলাম। নাম ছিল নফর, হয়ে গেলাম গফুর। যাহোক, তাই হোক, এখন আমি হরিদাস ঠাকুরের চেলা, সেদিনে মিছিলেও গিয়েছিলাম, কাজির বাগানে বেশ কয়েকটা গাছপালা ভেঙে দিয়ে এসেছি। কী ভাগ্য আমার, দাদাঠাকুরকে পেয়ে গেলাম জঙ্গলে। কোথায় আপনে যাচ্ছেন গো দাদাঠাকুর?

গফুরের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে গোরা বলল, শান্তিপুর।

গোরার জবাব শুনে দু’হাত জুড়ে গফুর বলল, দাদাঠাকুর, কৃপা করেন আমাকে, ওঠেন আমার গাড়িতে, আপনাকে শান্তিপুরে আমি রেখে আসছি।

গোরা রাজি হল না। দুপুরের আগে শান্তিপুরে সে পৌঁছতে চায়। অদ্বৈতের সঙ্গে জরুরি ফয়সালা আছে তার। গোরুর গাড়ির চেয়ে পায়ে হেঁটে আগে শান্তিপুর পৌঁছে যাবে সে। তার কথা শুনে গফুর জানাল টাট্টুঘোড়ার চেয়ে তার বলদ দুটো জোরে ছোটে। মাঝ-আকাশে সূর্য আসার আগে শান্তিপুরের বাবলা গ্রামে ঢুকে যাবে তার গাড়ি। গফুরের কথা শুনে গোরা বলল, আমাকে পৌঁছতে গোরুদুটোকে চাবুক মেরে দৌড় করানো আমার পছন্দ নয়। সেটা আমি দেখতে পারব না।

গোরার কথা শুনে তার পায়ে পড়ে গেল গফুর। হাতের চাবুকটা জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিয়ে বলল, ছপটি ফেলে দিলাম। জিভে আওয়াজ তুলে আর বলদ দুটোর ন্যাজে সুড়সুড়ি দিয়ে শান্তিপুরে ঠিকসময়ে পৌঁছে দেব আপনাকে। গাড়ি চালাতে আর কখনও ছপটি ধরব না।

গফুরের অনুরোধ গোরা ফেলে দিতে পারল না। গোরুর গাড়িতে উঠে হোগলার ছাউনির নিচে সে বসতে গফুর জিভে টকাটক আওয়াজ করতে বলদজোড়া চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণে আগে গাড়িটা বনের পথে যত ঢিমে তালে চলছিল, গোরা উঠতে বদলে গেল সেই চলন। গাড়িতে সওয়ারি না থাকায় বলদ-জোড়াকে বিশ্রাম দিতে তাদের খেয়ালখুশিতে গফুর ছেড়ে রেখেছিল গাড়ির গতি। গোরা উঠতে গাড়ির রাশ গফুর নিজে ধরতে উঁচু নিচু মেঠোপথে দ্রুততা এল গতিতে। সূর্য মাঝ আকাশে ওঠার আগে বাবলা গ্রামে অদ্বৈত আচার্যের বাড়ির সামান্য আগে ফাঁকা পথের ধার ঘেঁষে গোরুর গাড়ি দাঁড় করাল গোরা। রাস্তার মানুষজন নেই দেখে সে নিশ্চিন্ত হল। গ্রামের সকলে চেনে তাকে। অদ্বৈতের বাড়িতে সে এসেছে জানলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে হাজির হবে ভক্তরা। গাড়ি থেকে গোরা নেমে দাঁড়াতে গফুর বলল, দাদাঠাকুর, নবদ্বীপে আমি ফিরিয়ে নে যাব আপনারে।

গফুরের কাঁধে হাসিমুখে গোরা হাত রেখে বলল, কখন আমি ফিরব ঠিক নেই। আজ হয়তো ফেরা হবে না, কাল কখন যাব, এখন বলা মুশকিল। নিজের কাজে আলগা দিও না, তুমি যাও।

গোরাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে গাড়োয়ান গফুর গাড়িতে নিজের জায়গায় বসল। অল্পসময়ে গোরা পৌঁছে গেল অদ্বৈতের বাড়ির বারদুয়ারে, চতুষ্পাঠীতে। পড়ুয়ারা কেউ নেই, ফাঁকা ঘর। গোরা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকতে অদ্বৈত টের পেল না। কুশাসনে বসে, নিবিষ্ট হয়ে জলচৌকিতে যে পুঁথিটা রেখে অদ্বৈত পড়ছে, তা যে যোগবাশিষ্ঠ, এক লহমা দেখে গোরা বুঝে গেল। সঙ্কীর্তনের আসরে প্রেমভক্তির আবেশে যে মানুষ কেঁদে কূল পায় না, থেকে থেকে জ্ঞান হারিয়ে স্বর্গীয় প্রলাপ বকে, অদ্রোহী, অক্রোধী ভালবাসার মানুষ হিসেবে যাকে সকলে চেনে, তার মাথায় দপ্ করে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। পাকাচুল, ধবধরে সাদা দাড়ি গোঁফ, পঁচাত্তোরোর্ধ্ব জরাজীর্ণ, শুকনো শরীর অদ্বৈতের ওপর বিশাল কলেবর মানুষটা ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে ভয়ে অদ্বৈত কঁকিয়ে উঠতে গোরা সামান্য আলগা করল শরীর। কয়েক মুহূর্তের সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে গোরার শরীরের তলা থেকে বেরিয়ে বাড়ির দাওয়ার দিকে অদ্বৈত দৌড় দিল। চতুষ্পাঠীর পেছনে দরজা বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে। গৃহস্বামী ঢুকে পড়ল বাড়িতে। অদ্বৈতের বয়স হলেও যোগাভ্যাসে অটুট ছিল শরীরের কাঠামো। গোরার সঙ্গে এঁটে ওঠা তবু তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। গোরা পেছনে এসে দাঁড়ানোর আগে দাওয়া থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ার মতলব ছিল তার। সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে ঘাড়ের কাছে গোরার নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেয়ে উঁচু দাওয়া থেকে উঠোনে লাফ দিলেও অদ্বৈত ধরা পড়ে গেল। তার পিঠের ওপর তখনই ঝাঁপিয়ে পড়ল গোরা। দুহাতে চেপে ধরল তার ঘাড়। অদ্বৈতের মনে হল ঘাড়ের সব হাড় চুরচুর করে ভেঙে যাচ্ছে। কাঁধের ওপর থেকে এখনই খসে পড়বে মাথা। বুড়ো অদ্বৈতকে বাড়ির উঠোনে ফেলে সমানে কিলিয়ে চলার সঙ্গে রাগে গর্জাচ্ছিল গোরা, তোকে আজ শেষ করে ফেলব, ভণ্ড, প্রতারক। হ্যাঁরে নাড়া, ভক্ত সেজে আমাকে অবতার হিসেবে তুই কেন প্রচার করলি? তোর দেওয়া টোপ না গিলে আমার উপায় ছিল না। অন্ধকার দুর্যোগের রাতে প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আকাশ থেকে খসে পড়া আমি এক কুলপরিচয়হীন শিশু, প্রলয়পয়োধিজলে ভাসছিলাম, তখন আমাকে ষড়ভুজ, কলির কৃষ্ণ হিসেবে খাড়া করে মাথায় তুললি তুই। আমার সঙ্গে গলামিলিয়ে প্রেমভক্তিতে এতদিন হাবুডুবু খেয়ে আবার যখন ঘনঘটা করে দুর্যোগ আসছে, তখন ভাগবত গুটিয়ে রেখে বাশিষ্ঠ পড়তে শুরু করেছিস, তোর জ্ঞানযোগের আজ গুষ্টির তুষ্টি করে ছাড়ব আমি। রাগে গরগর করার সঙ্গে অদ্বৈতকে পেটাই করে চলেছিল গোরা। শুরুতে যন্ত্রণায় অদ্বৈত আর্তনাদ করলেও ধোলাই-এর চরম পর্বে তার গলা থেকে আর শব্দ বেরোচ্ছিল না। গৃহকর্তার যন্ত্রণাকাতর চিৎকারে ইতিমধ্যে পরিবারের সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। দাওয়ায়, উঠোনে দাঁড়িয়ে গোরার রুদ্রমূর্তি দেখে তারা এত ভয় পেয়ে গেছে যে অদ্বৈতকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসতে ভরসা পাচ্ছে না। তার চার ছেলের মধ্যে ছোট দু’জন, বলরাম আর জগদীশ, যারা নিজেদের বাবাকে এতদিন কৃষ্ণাবতার ভাবত, জন্মদাতার নির্যাতন দেখে রাগে ফুসঁলেও গোরাকে পেটানোর জন্যে দু’পা এগিয়ে পরের মুহূর্তে পেছিয়ে আসছিল তিন পা। অদ্বৈতের বড় আর মেজ ছেলে অচ্যুতানন্দ, আর কৃষ্ণ ঠেকাতে চাইছিল দু’ভাইকে। কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো গোরাকে নিগ্রহ করলে পরিবার ছারখার হয়ে যাবে, বলরাম, জগদীশকে বারবার সে কথা বলে তারা সতর্ক করছিল। বাবা কৃষ্ণাবতার হলেও স্বেচ্ছায় লাঞ্ছিত হচ্ছে, একথাও শুনিয়েছিল। উল্টোটাও হতে পারে। প্রকৃত কৃষ্ণাবতারের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে স্বর্গসুখ পাচ্ছে অদ্বৈত। পরমভাগবতের এটাও প্রেমভক্তির আস্বাদনের আর এক খেলা। অচ্যুত, কৃষ্ণ দু’ভাই-ই বাবার মতো গোরার ভক্ত। গোরাকে কৃষ্ণাবতার হিসেবে শুরু থেকে মেনে নিয়ে প্রেমভক্তিতে তারাও বাবার মতো মাতোয়ারা। নবদ্বীপ, শান্তিপুরে সুলতানের বাহিনী টহলে নামলেও অদ্বৈতের বাশিষ্ঠপাঠ, নতুন করে ছাত্রদের জ্ঞানমার্গে ঠেলে দেওয়াটা তারা পছন্দ করেনি। মুখে কিছু না বললেও বাবা অপরাধ করছে, তারা অনুভব করছিল। অপরাধের শাস্তি বুড়ো বাবা এত তাড়াতাড়ি পাবে, তারা ভাবেনি। অদ্বৈতকে মাটিতে ফেলে গোরা যখন কিল, চড়, থাপ্পড় মেরে চলেছে, তখন স্বামীকে বাঁচাতে আকাশফাটিয়ে কাঁদছে গৃহিণী সীতাদেবী। গোরাকে অদ্বৈতের বউ অবতার ভাবলেও সে সব ভুলে গিয়ে দু’হাত জুড়ে বলছে, ও বাবা গোরা, তোমার পায়ে পড়ছি, বুড়ো মানুষটাকে ছেড়ে দাও। ও এখনই মরে যাবে। তোমার বাবার চেয়ে বয়সে বড় মানুষটাকে এবারের মতো ক্ষমা করো। উনি তোমার মায়ের দীক্ষাগুরু, ওকে এভাবে মেরো না। বুড়ো খুনের দায়ে পড়বে। ফাঁসিকাঠে লটকে দেবে তোমাকে। গোরার কানে সীতার হাহাকার পৌঁছচ্ছে না। অদ্বৈতের নড়া ধরে মাথা কিছুটা তুলে মাটিতে ঠুকে দিয়ে গোরা বলছিল, ভক্তচূড়ামণি সেজে আমাকে আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তুই এখন জ্ঞানমার্গ বোঝাচ্ছিস, তোকে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেব।

অদ্বৈতের দ্বিতীয় স্ত্রী শ্রীদেবী, চার ছেলে, ছেলেদের বউ, নাতিনাতনি, দাসী, চাকর যে যেখানে ছিল, উঠোন ঘিরে সকলে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে অদ্বৈতের নির্যাতন। অদ্বৈত হঠাৎ অদ্ভুত কাণ্ড করল। মারের চোটে বুড়োটার কথা বন্ধ হয়ে গেছে ভেবে সকলে যখন তার শেষনিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে কান খাড়া করে রয়েছে, অদ্বৈত খলখল করে হাসতে শুরু করল। হাসির আওয়াজ শুনে সন্ত্রস্ত আত্মীয়দের সঙ্গে গোরা পর্যন্ত চমকে গেল। অদ্বৈতের পিঠের ওপর থেকে নিজের হাঁটুটা সরিয়ে নিয়ে তাকে খালাস করে দিল গোরা। অদ্বৈত তখনও হেসে চলেছে, তার হাসি আর থামে না। হঠাৎ হাসি থামিয়ে কাঁদতে লাগল, কান্নার মাঝখানে হেসে উঠল। মাটি থেকে উঠে হাততালি দিতে থাকল। পরের মুহূর্তে দু’হাত জুড়ে গোরার দিকে তাকিয়ে স্তুতি করতে থাকল, ‘হে কৃষ্ণ, করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে। গোপেশ্বর, গোপিকান্ত, রাধাকৃষ্ণ নমোহস্তুতে।’

অদ্বৈতের দু’পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে গোরা প্রশ্ন করল, আচার্য কখন এলাম আপনার বাড়িতে, কীভাবে এলাম? কোনও অপরাধ কি করে ফেলেছি?

গোরার প্রশ্ন শুনে অদ্বৈত চোখ টিপে বলল, তোমার লীলা আমি ধরে ফেলেছি। আমি যা চাইছিলাম, তাই ঘটেছে। আমার কাছে তুমি লুকোতে পারবে না নিজেকে

আবেগে বিহ্বল অদ্বৈত ভাগবত আবৃত্তি করতে থাকল। কৃষ্ণ বন্দনার দুটো শ্লোকে গোরার মহিমা কীর্তন করে স্ত্রী সীতাদেবীকে বলল, তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যাও, ভোগের আয়োজন কর। মহাঅতিথিকে নিয়ে আমি নেয়ে আসছি। মাটিতে হুটোপুটি করে ধুলোয় মাখামাখি হয়েছে আমাদের শরীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *