গোরা – ৩৮

৩৮

‘ক্রাইস্ট’ শব্দটা আলবুকের্ক যতবার উচ্চারণ করছিল ধ্বনিসাম্যের প্রভাবে ততবার কৃষ্ণনাম জপ করছিল গোরা। গোরার কৃষ্ণনাম উচ্চারণের সঙ্গে আবার ঈশ্বরের পুত্র ক্রাইস্ট-এর ধ্বনিসাম শুনতে পাচ্ছিল আলবুকের্ক আর তার সঙ্গীরা। আলবুকের্কের মনে হচ্ছিল ইউরোপের কোনও দাসব্যবসায়ী ভুল করে নিজের জাতের এক শ্বেতাঙ্গ বালককে ক্রীতদাস হিসেবে জাহাজে তুলে ভারতে এনে বেচে দিয়ে গেছে। শ্বেতাঙ্গ এই সন্ন্যাসীকে নিজেদের গির্জায় কয়েকদিনের জন্যে আশ্রয় ভিক্ষে করার অনুরোধ জানাল আলবুকের্ক। নিজের বিদ্যেবুদ্ধিমতো গোরাকে ওড়িয়া ভাষায় তার কথাগুলো শোনাল চক্রপাণি। আলবুকের্ককে বুকে টেনে গোরা জানাল, তীর্থভ্রমণ শেষ করে পুরুষোত্তমপুরে ফেরার পথে বিজয়নগরে তাকে আবার আসতে হবে। বন্ধু চক্রপাণির বাড়িতে আশ্রয়ভিক্ষা করবে। আলবুকের্ক-এর সঙ্গে তখন দেখা হবে। সঙ্গীসাথী নিয়ে কৃষ্ট আর খ্রিস্টকে দু’হাতে জড়িয়ে গির্জার চাতালে সারারাত নামসঙ্কীর্তন করবে।

বিদেশি ঈশাভক্ত, যাদের বাদামীর মানুষ বলত ভট্টমারি, হাজার হাজার মাইল দূরে অচেনা এক দেশে ধর্মীয়ভাবে তারা কোণঠাসা হয়ে থাকলেও গোরাকে নিজেদের উপাসনাঘরে পেয়ে তাদের মনে হল, এই সন্ন্যাসী দ্বিতীয় যিশুখ্রিস্ট, নিজেদের প্রার্থনাসভায় একে পেলে স্বৰ্গীয় আনন্দে ভরে যেত তাদের বুক। তারা একে একে হাঁটু মুড়ে গোরার সামনে বসে মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানাল তাকে। গোরা বলল, কৃষ্ণ বলো, হরি বলো।

ভট্টমারিরা চাপা গলায় যতটা সম্ভব শুদ্ধভাবে নাম দুটো উচ্চারণ করল।

বাদামী ছেড়ে রামেশ্বরের পথে গোরা রওনা হওয়ার আগের দিন ভোররাতে বিশ্বস্ত দুই মন্ত্রীকে নিয়ে চক্রপাণির বাড়িতে দেখা করতে এল রাজা কৃষ্ণদেব। গোরাকে আগে থেকে চক্রপাণি জানিয়ে রেখেছিল ঊষাকালে তার আশীর্বাদ নিতে আসবে রাজা। আশা করি, ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে দুই রাজ্যের মধ্যে চিরকালীন বন্ধুত্বের শুভসূচনা হবে।

চক্রপাণি যা প্রার্থনা করেছিল, বসন্তের সেই ভোরে তাই ঘটল। উদয়গিরি দুর্গ থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে বিজয়নগরের সেনারা কোণ্ডবীড়ু দণ্ডপাট ছেড়ে শুধু সরে এল না, গোদাবরী নদী পার হয়ে ওড়িষ্যার সিংহাচলম পর্যন্ত দখল করার পরিকল্পনা বাতিল করল। রাজা কৃষ্ণদেবের উদারতার পাল্টা সৌজন্য দেখাতে উদয়গিরি দুর্গে বন্দী রাজপুত্র বীরভদ্রকে বিজয়নগরের রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল প্রতাপরুদ্র। প্রতাপরুদ্রের প্রস্তাব আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়ে তাকে, ঘরজামাই করার অনুমোদন চাইল কৃষ্ণদেব। দুই রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ও সৌজন্য বিনিময়ের যে স্রোত বইছিল, সেই মুক্তধারা খুলে দিয়ে রামেশ্বরের পথে গোরা রওনা দিয়েছিল। রাজকীয় সম্পর্কে নতুন মাত্রা সংযোজনের কাজ চালাচ্ছিল দুই রাজ্যের প্রভাবশালী দু’জন সভাপণ্ডিত, বাসুদেব সার্বভৌম আর চক্রপাণি। গোরাকে না দেখলেও উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের কানে পৌঁছে গিয়েছিল গৌড়ের সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের দৈবী ভাবাবেশের কাহিনী। দাক্ষিণাত্য আর আশপাশের তীর্থ ঘুরে সন্ন্যাসী আবার পুরুষোত্তমপুরে ফিরে আসবে, সেখানে থেকে যাবে, এ ধারণাও এলাকার মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরুষোত্তমপুরে সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ডেরা করলে, এই রাজ্যে চিরশান্তি বিরাজ করবে, উৎকলরাজ্যের গায়ে শত্রুপক্ষ আঁচড় কাটতে পারবে না, এমন এক গভীর বিশ্বাস তাদের মনে শেকড় ছড়াচ্ছিল। নিতাই, জগদানন্দ সমেত যে চার অনুগামীকে পুরুষোত্তমপুরে গোরা রেখে গিয়েছিল, তারা কম উঁচুমার্গের সাধক ছিল না। জগন্নাথ মন্দিরে বিগ্রহের সেবা আর নরেন্দ্র সরোবর, গুণ্ডিচাবাড়ি, সমুদ্রের ধারে দিনে-রাতে সঙ্কীর্তনের আসর বসিয়ে উৎকলবাসী কৃষ্ণভক্তদের কাছে টেনে নিল তারা। কৃষ্ণনাম উচ্চারণ আর সঙ্কীর্তন যে মানুষে-মানুষে এত নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে, প্রেমের আবেগে কাছাকাছি টেনে আনতে পারে, তাদের ধারণা ছিল না। সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্যের অনুপস্থিতিতে তার অনুগামীদের সংসর্গে পুরুষোত্তমপুরের মানুষ প্রেমভক্তির আস্বাদ পেয়ে মেতে উঠল। সঙ্কীর্তনের সঙ্গে তীর্থস্থান পরিচ্ছন্ন রাখার, নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে তারা হাত লাগাল। সৌজন্য, বিনয়, ভদ্রতা, হাসি- মুখে, খোশমেজাজে চেনা-অচেনা সকলকে কাছে টেনে নেওয়ার চর্চা লেগে গেল তাদের মধ্যে। নবদ্বীপে, গৌড়বঙ্গে মানুষে-মানুষে মেলামেশাতে যে সভ্য, সহৃদয় আচরণবিধি গোরা চালু করেছিল, তার অনুগামীরা উৎকলের মানুষকে সেই কাজে নামিয়ে দিল। গোরার ফাঁকা জায়গা নেতৃত্ব দিয়ে পূরণ করল নিতাই। গুণ্ডিচামন্দির থেকে, নরেন্দ্র সরোবরের চাতাল, মন্দিরের সামনের পথ ভক্তদের ধোয়ামাজায় ঝকঝক করতে থাকল।

কটকের রাজবাড়িতে বেজে উঠল রাজকুমার বীরভদ্রের বিয়ের সানাই। বিজয়নগর রাজ্যের তুলুভ রাজপরিবার আর উৎকলের গজপতি রাজপরিবারের মধ্যে হঠাৎ যাওয়া-আসা বেড়ে গেল। পরমাত্মীয়তার হাওয়া বইতে থাকল দুই পরিবারের মধ্যে। গজপতি রাজপরিবারের তরফে বাসুদেব সার্বভৌমকে যেমন বিজয়নগরের রাজবাড়িতে প্রায়ই ঢুকতে দেখা গেল, তেমনই কটকের রাজবাড়িতে তুলুভ রাজা কৃষ্ণদেবের প্রতিনিধি পণ্ডিত চক্রপাণির আতিথ্য নেওয়ার ঘটনা রাজপুরুষদের নজর এড়াল না। বহুদিন পরে দুই রাজপরিবারের মধ্যে পুরানো সৌহার্দ্য ফিরে এসেছে, দু’রাজ্যের মানুষ জেনে গেল। মুখে মুখে রটে গেল ভগবানের মতো চেহারা, গৌড় দেশের এক সন্ন্যাসী, পুরুষোত্তমপুর থেকে বাদামীতে পণ্ডিত চক্রপাণির বাড়িতে কয়েক রাত কাটিয়ে উৎকলের সঙ্গে বিজয়নগর রাজ্যের সৌহার্দ্য ঘটিয়ে দিয়ে গেছে। দেশে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পথ দেখাবে সেই সন্ন্যাসী। রাজা প্রতাপরুদ্রের ছেলে বীরভদ্রের সঙ্গে রাজা কৃষ্ণদেবের মেয়ে চন্দ্রাবলীর শুভপরিণয় ঘটতে চলেছে, এ খবরও গোপন থাকল না। যুবরাজ বীরভদ্রকে কোণ্ডবীড়ু দণ্ডপাটের অধীশ্বর করে দেবে রাজা কৃষ্ণদেব। কোণ্ডবীড়ু একদা উৎকল রাজ্যের অংশ ছিল। সেই দণ্ডপাট ফের উৎকলের সঙ্গে যুক্ত হবে। দণ্ডপাটের কর্তৃত্ব নেবে উৎকল রাজবংশের সন্তান বীরভদ্র। বীরভদ্রের এক অল্পবয়সী অনূঢ়া পিসি, রাজা প্রতাপরুদ্রের বিমাতার কন্যাকে রাজা কৃষ্ণদেব বিয়ে করে রানীর মর্যাদা দিয়ে বাদামীতে নিয়ে যাবে। দুই রাজপরিবারে মহা আড়ম্বরের জোড়া বিয়ে নিয়ে যখন বিরাট প্রস্তুতি চলেছে, গোরা তখন চলেছে সেতুবন্ধের পথে। মুখে কৃষ্ণনাম, মাথায় নামের আবেশের সঙ্গে হরেক চিন্তা। বিশ্বরূপ কোথায়? তাকে খুঁজে বার করে নবদ্বীপে মায়ের সংসারে ফিরিয়ে দিতে না পারলে কথার খেলাপ হবে। গুরু নানক, পান্ধারপুরের তুকারামের দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্য যদি ঘটে যায়, তাহলে প্রেমধর্ম প্রচারে মস্ত জোয়ার উঠতে পারে। কুলিয়ায় বিদ্যাবাচস্পতির বাড়িতে যে রাজপুরুষদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার অধিনায়ক পদে তাকে বরণ করতে চেয়েছিল তারা। তাদের ডাকে সরাসরি সাড়া না দিলেও সে এড়িয়ে যায়নি। নিতাইকে এগিয়ে দিয়েছিল, রাজপুরুষদের সামনে। কলিযুগধর্ম পালনে নিতাই অদ্বিতীয়, তার জুড়ি নেই। ধর্মরাজ্যের কেন্দ্রভূমি হবে বৃন্দাবন। নবদ্বীপ ছেড়ে আসার আগেই ধর্মরাজ্যের রাজধানী হিসেবে বৃন্দাবন গড়ে তোলার চিন্তা সে করতে শুরু করেছে। তার বাপ কৃষ্ণের ছেলেবেলার লীলাভূমি এই ব্রজধাম প্রেম ভালবাসার ভূখণ্ড। স্বাসুখহীন, নিঃস্বার্থ ভালবাসা, অহেতুক ভালবাসার এমন জনমণ্ডল পৃথিবীতে কোথাও নেই। সেই ভালবাসার উৎস কৃষ্ণ, প্রতীকও বাঁশিবাদক। গৌড় থেকে আর্যাবর্ত যাওয়ার মূল সড়কও গেছে বৃন্দাবনকে ছুঁয়ে। দেশের পুব-পশ্চিমকে গিরিগোবর্ধনের মতো দু’হাতে ধরে আছে বৃন্দাবন। তীর্থযাত্রী, পর্যটক, বণিক, সাধারণ মানুষ, যে কেউ দেশের পুব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে যাক, বৃন্দাবনের মাটিতে পা রাখলে তার বুকের ভেতরে প্রেম, ভালবাসা উথলে উঠবে। সেই প্রেমের আবেশে বছরের পর বছর ধরে বৃন্দাবনে আটকে রয়েছে সুবুদ্ধি রায়। তাকে না চিনলেও অদ্বৈত আর বিদ্যাবাচস্পতির মুখ থেকে তার সম্পর্কে অনেক কাহিনী গোরা শুনেছে।

বাদামী থেকে নানা ধর্মের তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে কূৰ্মস্থানে এসে পৌঁছল গোরা। পথে যারাই তার সঙ্গ পাচ্ছে, প্রেমভক্তিতে অভিভূত হয়ে কৃষ্ণনাম জপ করেছে। প্রেমই ঈশ্বর, কৃয়েন্দ্ৰিয় প্রীতিইচ্ছার নাম প্রেম। প্রেমের বিকল্প নেই। অরসজ্ঞ কাক জ্ঞানের নিমফল খায়, রসজ্ঞ কোকিল চোষে প্রেমাম্র মুকুল। কূর্ম থেকে ত্রিমল্ল, শিবকাঞ্জী, বিষ্ণুকাঞ্জী দর্শন করে দাক্ষিণাত্যের অন্যতম প্রধান তীর্থ শ্রীরঙ্গনাথে এসে পৌঁছল গোরা। হাজার হাজার পুণ্যার্থীর ভিড়ের মধ্যে থেকে শ্রীরঙ্গনাথবাসী ভেঙ্কট ভট্টের সঙ্গে গোরার পরিচয় হল। কৃষ্ণপ্রেমী গোরাকে সনিবন্ধ অনুরোধ করে নিজের বাড়িতে আতিথ্যভিক্ষা করতে রাজি করাল ভেঙ্কট। অতিথি গোরাকে পেয়ে সবচেয়ে বেশি খুশি হল ভেঙ্কটের এগারোবছরের ছেলে গোপাল। ধর্মভীরু বাবার যোগাযোগে অনেক সন্ন্যাসী দেখলেও গোরার মতো দেহসৌন্দর্যের অধিকারী, সহৃদয়, গেরুয়াধারী, ন্যাড়া মাথা সন্ন্যাসী, সে আগে দেখেনি। গোরার সেবায় তার সঙ্গে এগারো বছরের গোপাল সারাক্ষণ ছায়ার মতো লেগে থাকল। গোরার এমন অনুরাগী হয়ে গেল যে শ্রীরঙ্গনাথে ভেঙ্কট ভট্টের বাড়ি ছেড়ে সে বিদায় নেওয়ার সময়ে তার সঙ্গী হতে কান্নাকাটি জুড়ে দিল গোপাল। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে ভবিষ্যতে পুরুষোত্তমপুর অথবা বৃন্দাবনে দেখা হওয়ার কথা বলে আশ্বস্ত করল গোরা। তার মুখের দিকে কান্না ভুলে বালক গোপাল এমনভাবে তাকিয়ে থাকল যেন আকাশ থেকে নেমে আসা দৈববাণী শুনছে সে। তার কান্না থামল। বাবার পাশাপাশি গোরার সঙ্গী হয়ে কিছুটা পথ তার সঙ্গে হাঁটল। ভোরের আলোয় সেতুবন্ধের পথে গোরার সুঠাম, লম্বা শরীরটা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত বাবা-ছেলে দাঁড়িয়ে থাকল। শ্রীরঙ্গনাথের মন্দিরে তখন ভোরের আরতির সঙ্গে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছিল। ঘর ছাড়ার আগে ডাকাডাকি করছিল হরেকরকম পাখি। পৃথিবী জেগে উঠছিল। কৃষ্ণনাম জপের সঙ্গে ভেঙ্কট ভট্টের ছেলে গোপালের মুখ ভেসে উঠছিল গোরার মনে। মন্দিরে ভক্তের ভিড়ে, পথের জটলায় আঁতিপাতি করে আরও একটা চেনামুখ খুঁজছিল সে। বিশ্বরূপকে খুঁজছিল। দীর্ঘ পথে অসংখ্য মন্দির, দেবদেবী, হাটপাট, ভক্তের ভিড়ের বাইরে নামপরিচয়হীন ছোট, বড় বহু গ্রাম, অন্নহীন, হতদরিদ্র মানুষ, অসুস্থ শিশু, বৃদ্ধ, কঙ্কালের মতো মা, বোনরা তার নজর এড়ায়নি। ভক্ত কবীরের মুখ থেকে শোনা কয়েকটা দোঁহা থেকে থেকে গুনগুন করছিল তার মাথার মধ্যে। সেতুবন্ধের পথে এরকম কিছু মহাত্মার দেখা পেয়ে গেলে সে কৃতার্থ হবে। শ্রীশৈলে শিবদুর্গা দর্শন করে কামকোষ্টীপুরে কামাক্ষীদেবীর মন্দিরে এল। কামাক্ষীদেবীর বন্দনা করে দক্ষিণ মথুরা, যার আর আর এক নাম মাদুরাই, সেখানে মীনাক্ষীদেবীর মন্দিরে বাদামী ছাড়ার এগারো দিন পরে পৌঁছে গেল। মন্দির প্রদক্ষিণ করে দেবীমূর্তিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। নবদ্বীপ ছেড়ে পুরুষোত্তমপুরে আসার পথে পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে মীনাক্ষীদেবী মন্দিরে ঢোকার আগে পর্যন্ত বড়-ছোট কম মন্দিরে সে ঢোকেনি। পরম ঈশ্বর কৃষ্ণের সৃষ্টি সব দেব-দেবী প্রতিমা যার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছে। মীনাক্ষীদেবীকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে মন্দিরের চাতাল ছেড়ে গোরা বেরিয়ে আসার আগে প্রবীণ এক তীর্থযাত্রী তার সামনে এসে বিনীত ভঙ্গিতে দু’হাত জুড়ে প্রণাম করে বলল, ওঁ নমো নারায়ণায়।

বয়স্ক, অচেনা তীর্থযাত্রীকে একই কথা বলে গোরা অভিবাদন জানাল। মন্দিরের চাতালে ভক্তের ভীড় বাড়তে থাকায় গোরাকে অচেনা মানুষটি বলল, হে সন্ন্যাসী, দয়া করে তুমি একটু সময় আমাকে দিলে কিছু কথা বলতাম তোমাকে।

গোরা তখনই রাজি হয়ে যেতে তাকে নিয়ে সেই অচেনা পুণ্যার্থী মন্দিরের বাইরে একটা আমলকি গাছের তলায় এসে দাঁড়াল। গোরাকে বলল, আমার নাম বলভদ্র ভট্টাচাৰ্য, আমি এক সময়ে গৌড়ের বাসিন্দা ছিলাম। এখন থাকি বৃন্দাবনে। নবদ্বীপে তোমার পূর্বাশ্রমের পরিচয়, সেইসঙ্গে সন্ন্যাস নেওয়ার পরে তোমার কৃচৈতন্য ভারতী হওয়ার বৃত্তান্তও শুনেছি। সেতুবন্ধ রামেশ্বর দর্শন করে মীনাক্ষীদেবীকে প্রণাম জানিয়ে আমি এখন যাচ্ছি পান্ধারপুরে বিলদেবের কৃপা পেতে। তোমাকে দেখে আমার বুক ভরে গেল। শরীরে এমন কাঁটা দিচ্ছে, মনে হচ্ছে সব তীর্থ, সব দেবদেবীর দর্শন পেয়ে গেলাম। হে দেবতা, তুমিই কি আমাকে বৃন্দাবনে পাঠিয়েছিলে?

অচেনা মানুষটার মুখে কৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত বৃন্দাবনের নাম শুনে প্রগাঢ় আবেগে গোরার চোখদুটো ছলছল করতে থাকল। কৃষ্ণনাম জপ করার সঙ্গে গোরা ‘বৃন্দাবন’ শব্দটা বারবার উচ্চারণ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সন্ন্যাসী বেহুঁশ হয়ে গেছে বলভদ্রের বুঝতে অসুবিধে হল না। কৃষ্ণভক্ত গোরার হুঁশ ফেরানোর উপায়ও লোকমুখে সে শুনেছিল। গোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে কৃষ্ণনাম জপ করতে থাকল বলভদ্র। কিছুক্ষণের মধ্যে দু’চোখ খুলে তাকিয়ে গোরা দেখল তার পা দুটো বলভদ্র বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মাটিতে উঠে বসে বলভদ্রের কোল থেকে দু’পা সরিয়ে নিয়ে গোরা বলল, তুমি কাঁদছ কেন বলভদ্র? আমি বোধহয় তোমাকে একটু বিব্রত করলাম। এই আমার রোগ! কৃষ্ণ আর তার বিষয়ে কিছু শুনলে আমি আর নিজের মধ্যে থাকি না। মৃগী রোগীর মতো জ্ঞান হারাই। বৃন্দাবনের নাম শুনলেও হুঁশ থাকে না। বৃন্দাবনে থাকার জন্যে আমি সন্ন্যাসী হয়েছি। তোমার মুখে বৃন্দাবনের কথা শুনে আমার এই দশা! তুমি কেঁদো না। তোমার সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে।

গোরার কথা শুনে বলভদ্র আরও বেশি কান্নায় ভেঙে পড়ল। বলল, হে ঈশ্বর, আমাকে ক্ষমা করো। আমি ঘোরতর পাপী, বৃন্দাবনে ঘর বেঁধে থাকলেও একটা মিথ্যে কথা বলেছি তোমাকে।

গোরার মাথার মধ্যে খুশির আলো ছড়িয়ে পড়ল। বৃন্দাবনবাসী বলভদ্রকে প্রথম দেখে তার মনে তখনই যে প্রশ্ন জেগেছিল, তার সদুত্তর পেয়ে গেছে সে। তার অনুমান মিলে গেছে। বলভদ্রের পিঠে হাত রেখে গোরা বলল, তুমি মিথ্যাচার করনি, কোনও পাপ তোমাকে ছুঁতে পারবে না, আত্মরক্ষার জন্যে গৌড়ের সুবুদ্ধি রায় যদি বৃন্দাবনে বলভদ্র ভট্টাচার্য সেজে বাস করে, তা অন্যায় নয়। কৃষ্ণপ্রেমে আমি সন্ন্যাসী সেজে রয়েছি। কৃষ্ণ আমার বাপ, তার খোঁজে বৃন্দাবনে আমাকে যেতেই হবে। নিমাইপণ্ডিত নামের মায়ায় নবদ্বীপে পড়ে থাকলে কখনও বৃন্দাবনে যেতে পারতাম না। তুমি ভাগ্যবান, আমার আগে সেখানে পৌঁছে গেছ।

চোখের জল মুছে পলকহীন চোখে গোরাকে দেখছিল বলভদ্র। গোরা বলল, বলভদ্র ভট্টাচার্য পরিচয়ে বৃন্দাবনের জনপদ, মানুষের সংস্কারে তুমি লেগে থাকো। তোমার পাশে দাঁড়াতে আমি আরও কয়েকজন কৃষ্ণভক্তকে তোমার কাছে পাঠাব। আমিও সেখানে যাব। পুরুষোত্তমপুর থেকে রওনা হওয়ার আগে তোমায় ডেকে নেব।

হে মহাত্মা, কবে যাবে বৃন্দাবনে?

বলভদ্রের প্রশ্নে হাসিমুখে গোরা বলল, ঠিক সময়ে তোমাকে জানাব

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলভদ্র বলল, যার জন্যে নিজের জন্মভূমি গৌড়, স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে ছেড়ে নাম ভাঁড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, তার ওপর এখন আমার কোনও রাগ নেই। বৃন্দাবনে এসে শান্তি পেয়েছি। পনেরো বছর আগে কাশীতে এক সন্ন্যাসী আমাকে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিয়ে বলেছিলেন, বৃন্দাবনে তুমি ঈশ্বরের দেখা পাবে। আমার মনে হচ্ছে, বৃন্দাবনে ঈশ্বর পৌঁছানোর আগে তার দর্শন আমি পেয়ে গেলাম।

গোরা বলল, আমি ঈশ্বর নই, আমি কৃষ্ণের সন্তান, কৃষ্ণ আমার বাপ। ছেলে আর বাবা দুটো আলাদা সত্তা, আমি বাপকে খুঁজছি, আমার সম্বল প্রেমভক্তি।

চাতক পাখির মতো বলভদ্র শুনছিল গোরার কথা। গোরা থামতে বলল, গৌড় ছেড়ে আসা নিজের পরিবার, বিশেষ করে ছেলেটার জন্যে মাঝেমাঝে মনে বড় দুশ্চিন্তা জাগে। হে প্ৰভু, তাদের কাছে কি কখনও ফিরে যেতে পারব?

বৃন্দাবন ছেড়ে তুমি চলে যেতে চাও?

বৃন্দাবন ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা পর্যন্ত আমি করতে পারি না। পরিবারের সকলের শুধু মঙ্গল চাই।

বলভদ্রের কাঁধে হাত রেখে গোরা বলল, তোমার ছেলে সুশ্রুত ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে তোড়জোড় করছে। ভালো আছে সে।

গোরার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলভদ্র জিজ্ঞেস করল, হে দেবতা, তুমি কি তাকে চেনো, তার খবর রাখো?

দু’হাতে বলভদ্রকে তুলে দাঁড় করিয়ে গোরা বলল, হ্যাঁ, তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে।

হে মহাত্মা, সে কী বলল?

গীতার একটা শ্লোক আমায় শোনাল। তুমি শুনতে চাও?

কৃপা করো।

এক চিলতে হাসি মুখে ছড়িয়ে গীতার সেই শ্লোক গোরা আবৃত্তি করল—যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।/অভ্যুত্থানম ধৰ্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।/পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।/ধৰ্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।

কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধে অর্জুনকে, তার অস্ত্র গাণ্ডীব হাতে তুলে নিতে, সারথি কৃষ্ণের বহুশ্রুত বাণীটা গোরার মুখে শুনে জলে ভেসে গেল বলভদ্রের দু’চোখ। জিজ্ঞেস করল, কৃষ্ণের মতো সারথি কি সুশ্রুত পেয়েছে?

কৃষ্ণের কৃপায় পেয়ে যেতে পারে। তবে এই কলিযুগে কৃষ্ণ নিরস্ত্র। তার পাশে অর্জুন নেই, যুদ্ধের রথ, অস্ত্র নেই, তার দু’হাতে শুধু বাঁশি, বৃন্দাবনে গাছের ছায়ায় বসে বাঁশিতে প্রেমের সুর বাজিয়ে চলেছে আমার বাপ, কৃষ্ণ। কৃষ্ণকে সারথি হিসেবে পেতে হলে চাই প্রেমভক্তি আর সঙ্কীর্তন।

সুশ্ৰুত কি জানে কলিযুগের তত্ত্ব?

জেনে যাবে।

গোরার সামনে আধাচেতনা পাথরের মূর্তির মতো দু’হাত জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বলভদ্র, যে একদা ছিল গৌড়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভূস্বামী, নাম ছিল সুবুদ্ধি রায়। বলভদ্রকে গোরা বলল, আমি চললাম সেতুবন্ধ দর্শনে। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য যখন ঘটেছে, তখন একটা অনুরোধ করছি, আশা করি রাখবে।

মাথা হেঁট করে বলভদ্র বলল, আদেশ করুন দেবতা।

পান্ধারপুরে বিলনাথ দর্শন করে সেই অঞ্চলের দুই সর্বজনপূজ্য একনাথ আর তার ভক্ত তুকারামের সঙ্গে দেখা করো। মহাভক্ত জামদেবের শিষ্য তারা। কলিযুগে কৃষ্ণনামকীর্তন আর প্রেমভক্তি যে সাধনার হৃদয়গ্রাহী পথ, এই কথা তাদের জানিও। সেতুবন্ধ থেকে ফেরার পথে সুযোগ পেলে বিলনাথ দর্শন করতে পান্ধারপুরে আমি যেতে পারি। এ দফায় না হলে পরের বার পরিব্রাজনে সেখানে যাব। পান্ধারপুরের মহাত্মাদের আমার শতকোটি প্রণাম জানিও।

গোরাকে ছেড়ে পান্ধারপুরের পথে পা বাড়াতে বলভদ্রের ইচ্ছে না করলেও আমলকি গাছের তলা থেকে দু’জনের ছাড়াছাড়ি হল। গোরা এগোলো সেতুবন্ধ রামেশ্বরের পথে, বলভদ্র গেল পশ্চিমে, পান্ধারপুরে। বলভদ্রের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে গোরার মনে পড়ল, মহাভারতের পাঁচ পাণ্ডবভাই, তাদের মা কুন্তি, বউ দ্রৌপদীকে নিয়ে একবছর মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের আশ্রয়ে নিজেদের পরিচয় গোপন করে অজ্ঞাতবাসে ছিল। বলভদ্রকে কতদিন নিজের পরিচয় গোপন করে বৃন্দাবনে থাকতে হবে সে চিন্তা গোরার মাথায় এলেও গৌড়ের সুবুদ্ধি রায়কে দেখে সে খুশি হয়েছিল। তীর্থযাত্রীদের মুখ থেকে শোনা জনমানুষ পরিত্যক্ত, দুর্দশাগ্রস্ত শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবনকে নতুন করে গড়ে তোলার ইচ্ছেকে জাগিয়ে দিয়ে গেল বলভদ্র। প্রেমধর্ম প্রচারের কেন্দ্রভূমি হবে বৃন্দাবন। বিদ্যাবাচস্পতির বাড়িতে সুশ্রুত আর অন্য রাজপুরুষরাও বলেছিল, বৃন্দাবন হবে ধর্মরাজ্যের রাজধানী। প্রেমভক্তির পীঠের চেয়ে ভালো রাজধানী আর কোথায় হতে পারে? ধর্মরাজ্যের রাজধানী বৃন্দাবনে অস্ত্রে ঝঞ্ঝনা, রক্তপাত, মৃত্যুদণ্ড, সাধারণ মানুষের নিগ্রহ থাকবে না। কৃপ্রেম আর সঙ্কীর্তনে রাজা, প্রজা মিলে বৃন্দাবনে প্রেমনগরী গড়ে তুলবে। রথযাত্রা, উল্টোরথ আর চন্দনযাত্রার দিনগুলোতে বৃন্দাবন থেকে সে পুরুষোত্তমপুরে ফিরে আসবে।

রামেশ্বরের পথে কৃষ্ণনাম জপের সঙ্গে ভবিষ্যতের নানা কাজের ছক গোরার মাথায় তৈরি হচ্ছিল। শ্রীরঙ্গমে পৌঁছে ভক্তি আর আবেগে ভরে গেল তার মন। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী প্রবাদপ্রতিম সাধক রামানুজ আর তার অনুগামী শ্রী সম্প্রদায় সম্পর্কে অনেক কাহিনী নবদ্বীপে ঈশ্বরপুরীর কাছে সে শুনেছে। নারায়ণের অর্ধাঙ্গিনী লক্ষ্মীর আর এক নাম শ্রী। বিশ্বচরাচরের সর্বত্র জীব, জড়ে মিশে আছে এই শ্রী, শ্রী মানে সৌন্দর্য। ঈশ্বরপুরীর কাছ থেকে ‘শ্রী’ শব্দটা পেয়ে সে দারুণ খুশি হয়েছিল। আশপাশের মানুষ, ফুল, ফল, দেশ, গ্রাম, গ্রন্থ, সব নামের সঙ্গে শ্রী’ জুড়ে দিয়ে ভাবাবেগে নাচতে শুরু করেছিল। কাটোয়ায় নরহরির গ্রাম, যার নাম ছিল ‘খণ্ড’ তাকে করে দিল শ্রীখণ্ড, বেল-এর নাম হল শ্রীফল, পুরুষোত্তমপুর হল শ্রীক্ষেত্র, বৃন্দাবনধামের নাম শ্রীধাম। উত্তর-পশ্চিমে শুধু কৃষ্ণ আর রাম নামে যে অবতারেরা জনপ্রিয় হয়েছিল, রাতারাতি তারা হয়ে গেল শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাম। মানুষ আর প্রকৃতিকে ‘শ্রীযুক্ত’ করতে গোরার উৎসাহ দেখে তার নবদ্বীপের অনুগামীদের মধ্যে ‘শ্রী’ ব্যবহারে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। মাটি থেকে আকাশ, পোকামাকড় থেকে মানুষ সবকিছুর সঙ্গে তারা শ্রী জুড়ে দিতে থাকল। শ্রী শব্দে অর্ন্তনিহিত রয়েছে সত্য, শিব, সুন্দরের ধ্যানকল্পনা। যা সত্য, তাই শিব অর্থাৎ নিষ্পাপ প্রশান্তি এবং তাই সুন্দর, সৌন্দর্যের আলোকিত প্রবাহ। প্রাণীজগৎ, প্রকৃতি চরাচরের অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে আছে এই আলোর প্রবাহ, তাই তারা শ্রীমণ্ডিত। শুধু নবদ্বীপ নয়, আসমুদ্র হিমাচল শ্রীকৃষ্ণের সৃষ্ট সবকিছুর শরীরে, শুধু শরীরে কেন, সকলের চরিত্রে আক্ষরিকভাবে শ্রী জুড়তে অনুগামীদের নিয়ে গোরা মেতে উঠেছিল। আর্যাবর্তের রাধা, গাঙ্গেয় উপত্যকায় হল শ্রীমতী রাধা, তার সখীরা শ্রীমতী ললিতা, শ্রীমতী চন্দ্রাবলী, শ্ৰীমতী বিশাখা। সন্ন্যাস নিয়ে গোরা হল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। তার অনুগামীরা সকলে নামে আগে রাখল শ্রী, শেষে দাস। ‘দাস’ মানে চাকর বা ভৃত্য নয়, অর্থের ব্যাপ্তি ঘটাল গোরা। বৈষ্ণব ভাবনায় দাস অর্থে সেবক, সখা, বন্ধু, ভাই, এমনকি প্রেমিকও একজন সেবক বা দাস। কার সেবক? একে অন্যের সেবক এবং সবাই মিলে সকলের সেবক, ভূলোক, দ্যুলোকের সেবক। বৈষ্ণবপদাবলীকার মহাজন চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরামদাস সবাই কবিতার দাস, বিশ্ব-বৃন্দাবনে প্রেমের দাস।

ঈশ্বরপুরীর কাছে রামানুজ আর তার শ্রীগোষ্ঠীর ভজনবৃত্তান্ত শুনে গোরা এত অনুপ্রাণিত হয়েছিল যে সঙ্কীর্তনের আসরে গানের ঝর্ণাধারায় শ্রী সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি উদ্বেল হয়ে উঠল। শ্রীরামের বাড়িতে সঙ্কীর্তনের রাতে গায়ক, নর্তক, শ্রোতাদের আকুল হয়ে কাঁদতে দেখে বয়সে যারা প্রাচীন, তারা বলতে থাকল, দ্যামড়াগুলা অ্যাতো কাঁদে কেন?

শ্রীরঙ্গমে রামানুজের স্মৃতিবিজড়িত বিষ্ণুমন্দিরের পৌঁছে ভাবাবেশে গোরা নাচতে শুরু করল। রামানুজের শিষ্য রামানন্দ কয়েক মুহূর্ত সন্ন্যাসী গোরার অলৌকিক ভাবাবেশ নজর করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। শ্রী সম্প্রদায়ের সাধকরা কিছুক্ষণের মধ্যে জড়ো হয়ে গেল সেখানে। তিন রাত সেখানে সঙ্কীর্তন, প্রেমভক্তিতত্ত্ব আলোচনায় কাটিয়ে দ্বৈতবাদী মাধ্বসম্প্রদায়ের প্রধান ঘাঁটি উড়ুঙ্গীর পথে হাঁটা দিল গোরা। শ্রীরঙ্গম ছাড়ার আগে রামানন্দকে আগামী বছর পৌষ সংক্রান্তিতে প্রয়াগের কুম্ভমেলায় দর্শন দেওয়ার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিল। পঞ্চনদের দেশ থেকে শিখ সম্প্রদায়ের গুরু নানক যে তখন প্রয়াগে হাজির থাকবে, এ খবরও সারা দিয়েছিল রামানন্দকে। রামানন্দের জন্মভূমি প্রয়াগ। ত্রিশবছর ধরে সে মকরসংক্রান্তির পুণ্যস্নান সারতে প্রয়াগে যাচ্ছে, জানিয়েছিল। শ্রীরঙ্গম থেকে পাঁচ দিনে উড়ুঙ্গী পৌঁছে মধ্বাচার্য প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে কৃষ্ণের গোপবালক মূর্তি দেখে প্রেমে উন্মাদ হল সে। ঈশ্বরপুরীর মুখে কৃষ্ণের এই গোপাল মূর্তি পাওয়ার কাহিনী গোরা শুনেছিল। দ্বারকা থেকে এক বণিক নৌকো ভরে গোপীচন্দন নিয়ে যাওয়ার সময়ে উড়ুঙ্গীর কাছে সমুদ্রে প্রবল ঝড়বৃষ্টির রাতে নৌকোডুবি হয়। কৃষ্ণভক্ত মধ্বাচার্য স্বপ্নে জানতে পারল, গোপীচন্দন বোঝাই নৌকোর মধ্যে রাখা কৃষ্ণের একটা গোপালমূর্তির সলিলসমাধি ঘটেছে। অনুগামীদের নিয়ে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া নৌকো খুঁজে বার করে সেখান থেকে কৃষ্ণমূর্তি উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল মধ্বাচার্য। দুশ’ বছর আগের ঘটনা এটা। শঙ্করের অনুগামী ঈশ্বরের অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী ছিল মধ্বাচার্য। কৃষ্ণমূর্তি পাওয়ার পরে দ্বৈতবাদী সাধনার পথে সে পা বাড়াল। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদী সাধনার ধারা থেকে গড়ে ওঠা দশনামী সম্প্রদায়ের ঘোর বিরোধী হয়ে উঠল মধ্বাচার্য আর তার অনুগামীরা। দশনামী সম্প্রদায়ের এক শাখা ‘ভারতী’ গোষ্ঠীর সন্ন্যাসী হয়েও কোনও সম্প্রদায়ের সঙ্গে গোরার বিরোধ নেই। প্রেমভক্তির সমুদ্রে ভাসছে সে। তার বুকের মধ্যেও রয়েছে সেই মহাসমুদ্র। সেখানে সব ধর্ম, সব বর্ণের সাধু ফকির যাজক থেকে সাধারণ মানুষের অগাধ পরিসর রয়েছে। গোরাকে চিনতে মাধবাচার্যের অনুগামী আচার্যের অসুবিধে হল না। সেতুবন্ধে ধনুতীর্থ দেখে বেশ কিছুদিন রামেশ্বরে কাটাল গোরা। তীর্থযাত্রার সঙ্গে বিদ্যোৎসাহী গোরা এমন কিছু পুঁথি জোগাড় করল, যেগুলো গৌড়ের মানুষের কাছে পৌঁছয়নি। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা সেই পুঁথিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটো পুঁথি ছিল ‘শ্রীকৃকর্ণামৃত’ আর ‘ব্রক্ষ্মসংহিতা’। দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হলেও কথকঠাকুরের মুখে সংস্কৃত শাস্ত্রপাঠ শুনে গোরার বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

বছর ঘুরে বর্ষার মরশুমে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা থেকে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁজির হিসেবে চারমাস, বৃষ্টিবাদলে তীর্থযাত্রায় নানা অসুবিধে ঘটার জন্যে সন্ন্যাসীরা এইসময়ে চাতুর্মাস্য পালন করে। রামেশ্বর থেকে ফেরার পথে শ্রীরঙ্গমে ভেঙ্কট ভট্টের বাড়িতে দ্বিতীয়বার আতিথ্য নিয়ে চাতুর্মাস্য পালন করল গোরা। গোরাকে পেয়ে খুশিতে নাচতে থাকল ভেঙ্কটের ছেলে গোপাল। ভেঙ্কটের কাছে গোরা খবর পেল উৎকলের সঙ্গে বিজয়নগর রাজ্যের শুধু কাগজে-কলমে শান্তিচুক্তি হয়নি; দুই রাজপরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সদ্ভাবের জোয়ার বইছে। প্রতাপরুদ্রের ছেলে বীরভদ্রের সঙ্গে মেয়ে চন্দ্রাবলীর বিয়ে দিয়ে উৎকলের রাজপুত্রকে রাজা কৃষ্ণদেব যেমন ঘরজামাই করেছে, তেমনি নিজের এক ছেলে, বিজয়নগরের রাজপুত্র কেশবদেবকে উৎকল রাজপরিবারে জামাই করার জন্যে রাজা প্রতাপরুদ্রের অনুরোধ খুশিমনে মেনে নিয়েছে। খুব ধুমধাম করে দুটো বিয়ে চুকে যাওয়ার পরে রাজা পুরুষোত্তমের সেজো রানীর এক মেয়ে, প্রতাপরুদ্রের হাঁটুর বয়সি এক বোন, সে-ও রাজকন্যা, রাজার বোন-ও বটে, নাম গোলাপসুন্দরী, তাকে বিয়ে করেছে রাজা কৃষ্ণদেব। দুই রাজপরিবারের এত মাখামাখি আগে কখনও ঘটেনি, সবই কৃষ্ণের ইচ্ছা! আপাতত গোলকুণ্ডা, বিজাপুর, আহম্মদনগরের সেনারা যেমন বিজয়নগরকে খোঁচাখুঁচি করবে না, তেমনি গৌড়ের সুলতানও উৎকল আক্রমণে সাহস পাবে না।

ভেঙ্কটের বাড়িতে চাতুর্মাস্য পালন করে পুরুষোত্তমপুরের পথে রওনা হল গোরা। বিজয়নগরের রাজধানী বাদামীতে চক্রপাণির বাড়িতে কয়েকদিনের আতিথ্যভিক্ষা করে রাজা কৃষ্ণদেবের লেখা প্রজাপালনের নীতি ও আদর্শ সংক্রান্ত গ্রন্থটি হাতে পেয়ে গেল। রাজা কৃষ্ণদেব শুধু সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত নয়, কবিও বটে। সংস্কৃতে লেখা গ্রন্থটি গোরাকে পড়তে সাহায্য করল চক্রপাণি। বই পড়ে গোরা মুগ্ধ হলেও চক্রপাণিকে বলল, রাজা কৃষ্ণদেবের এই পুঁথির নাম বালক বয়সে শুনে পড়ার ইচ্ছে জেগেছিল। তোমার দয়ায় সে ইচ্ছে মিটল। পুঁথি পড়ে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার চমৎকার রূপরেখা পেলাম। তবে যুদ্ধ, রক্তপাতের পরিচ্ছেদগুলো মেনে নিতে পারলাম না। কলিযুগে কৃষ্ণনাম আর প্রেমভক্তি হল ধর্মরাজ্য গড়ে তোলার সেরা পথ। রক্তমাখা শরীরে ধর্মরাজ্যে মানুষ পৌঁছতে পারে না। পথজুড়ে যদি প্রেম, ভালবাসা, সুর, গান ছড়িয়ে না থাকে, তাহলে পথের শেষে আনন্দপুরী মেলে না। প্রজাকল্যাণের জন্যে যে আদর্শ রাজ্যের ‘পুঁথি’ বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব লিখেছেন, তা অজস্র সাধুবাদ পেয়েছে, আরও পাবে। তবে সেই আদর্শ সমাজে পৌঁছুতে প্রেমভক্তির পথ আঁকড়ে থাকতে হবে। যা আজ অলীক মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে তাই সত্য হয়ে উঠবে।

চক্রপাণির সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্যে কৃষ্ণনাম জপে গোরা আবিষ্ট হল। চক্রপাণির বাড়িতে তিন রাত কাটালেও দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের আনন্দে সে এত বিভোর হয়ে থাকল যে নগরের কাকপক্ষী জানল না তার বাদামীতে পৌঁছনোর খবর। তাকে দেখার জন্যে রাজা কৃষ্ণদেব একবছরের বেশি অপেক্ষা করছে, চক্রপাণির মুখে একথা শুনেও এ যাত্রায় তা সম্ভব নয়, জানিয়ে দিল। মুখ খোলার সুযোগ পেল না চক্রপাণি। রাজার জন্যে আশীর্বাদী একটা তুলসীর মালা আর গেরুয়া চাদর চক্রপাণির হাতে দিয়ে তৃতীয় রাত ফুরানোর আগে বাদামী ছেড়ে পুরুষোত্তমপুরের পথে গোরা রওনা হল। পুরুষোত্তমপুরে সে ফিরছে, এ খবর সেখানে সার্বভৌমকে পৌঁছে দিতে দু’দিন আগে এক পুরানো ছাত্রকে রওনা করে দিয়েছিল চক্রপাণি। পুরুষোত্তমপুরে গোরা পৌঁছানোর আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে তার আসার বার্তা পেয়ে সার্বভৌমের সঙ্গে নিতাই, জগদানন্দ, দামোদর আহ্লাদে আটখানা হল। শুধু গদাধরের কথা ভেবে একটু মনমরা হয়ে থাকল জগদানন্দ, দামোদর। দাক্ষিণাত্যের পথে গোরা একা রওনা হওয়ার পর থেকে কয়েকদিন গদাধর চোখের জল ফেলে, কথা বন্ধ রেখে, তোলা হাঁড়ির মতো মুখ করে কাটিয়ে হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হল, দেড়বছরে তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। নবদ্বীপে সে ফিরে গেছে, এমন খবরও নেই। বিদ্যানগরে রামানন্দ রায়ের এলাকাতে তল্লাশি চালিয়ে তার হদিশ মেলেনি। গোরার সঙ্গে সে-ও ফিরতে পারে, এমন এক সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে জগদানন্দের সঙ্গে দামোদর কথা বললেও নিতাই কান দেয়নি। সে জানত গদাধর যেখানেই থাক, গোরা ফিরলে, সে-ও পুরুষোত্তমপুরে হাজির হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *