১১
গঙ্গার পশ্চিমতীরে লোকনাথকে পাশে রেখে বিশ্বরূপ যখন তদ্গত হয়ে সূর্যবন্দনা করছে, উল্টো পাড়ে নবদ্বীপের রামচন্দ্রপুরের বাসিন্দারা তখন পাড়ার এক ব্রাহ্মণ সন্তানকে খুঁজতে শুরু করেছে। গোরার ঘুম ভাঙল একটু বেলাতে। বাড়ির দাওয়ায় সকালের রোদ এসে পড়েছে। বিছানায় শুয়ে ঘরের বাইরে কিছু চেনা অচেনা গলার কথা শুনে সে ধড়ফড় করে উঠে দাওয়ায় এসে দাঁড়াল। সে দেখল, তার মাকে ঘিরে পড়শি গৃহিণীদের ভিড়। বেহুঁশের মতো দাওয়ায় গড়াগড়ি করে মা কাঁদছে। উঠোনে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবা, জগন্নাথ মিশ্র। রুগ্ণ মানুষটার ঘাড় ঝুলে গেছে, থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সারা শরীর। জগন্নাথকে ডান হাতে আঁকড়ে ধরে রয়েছে, গোরার মেসো চন্দ্রশেখর। রামচন্দ্রপুরেই চন্দ্রশেখরের বাড়ি। শ্রীবাস, মুকুন্দ, মুরারি পাড়ার অনেকে, জগন্নাথকে শান্ত করতে চাইছে, সান্ত্বনা দিয়ে বোঝাতে চাইছে বিশ্বরূপ নিরুদ্দেশ হয়নি, কাছাকাছি কোথাও আছে। সবচেয়ে বড় কথা, তার সঙ্গে যখন লোকনাথ রয়েছে, তখন দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বিশ্বরূপের মতো মেধাবী না হলেও লোকনাথ বুঝদার ছেলে। দাদাকে সে আগলে রাখবে। দু’বছরের বড়ো বিশ্বরূপকে বাবার মতো ভক্তি করে লোকনাথ, সহোদর ভাই-এর চেয়ে বেশি ভালোবাসে।
বেলপুখুরিয়াতে নীলাম্বর চক্রবর্তীর বাড়িতে, নবদ্বীপে অদ্বৈতের চতুষ্পাঠীতে, শান্তিপুরে তার ভদ্রাসনে, বারকোনা ঘাট, আপন ঘাট, নাগরিয়া ঘাটে আরও যে সব জায়গায় বিশ্বরূপের যাওয়া সম্ভব, তার খোঁজে লোক চলে গেছে। খোঁজাখুঁজির তদারক করছে মেসো চন্দ্রশেখর। বেলপুখুরিয়াতে নীলাম্বরের বাড়িতে আগেই ঈশানকে পাঠিয়ে দিয়ে অদ্বৈত আচার্যের চতুষ্পাঠী আর বাড়ি, দু’ঠিকানায় শ্রীবাসের দু’ভাই, শ্রীপতি আর শ্রীরামকে পাঠিয়েছে। অদ্বৈত আর শ্রীবাসের পরিবারের মধ্যে গভীর অনুরক্তি, নিত্য যাওয়া আসা। বিশ্বরূপের তল্লাশিতে যখন নানা ঠিকানায় লোক চলে গেছে, তারপরেও জগন্নাথের বাড়ির উঠোনে ভিড় বাড়ছে, তখনই ঘুম থেকে জেগে উঠে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে কী ঘটেছে, গোরা বোঝার চেষ্টা করল। সে দেখল থেকে থেকে জগন্নাথ চোখের জল মুছছে, শূন্য দৃষ্টি, মনে হচ্ছে চারপাশ অন্ধকার দেখছে। সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণায় তার শরীর কাঁপছে, দু’ঠোঁট কাঁপছে কিছু বলার জন্যে। শিশু গোরা ভুল দেখেনি। জগন্নাথ টের পাচ্ছিল, বিশ্বরূপের জন্যে এত খোঁজখবর করা বৃথা। তার খোঁজ আর পাওয়া যাবে না। বাড়ি ছেড়ে চিরকালের মতো সে চলে গেছে, ফিরবে না।’ বিশ্বরূপের গৃহত্যাগের কারণ সে নিজে, কাউকে সেকথা বলতে পারছে না জগন্নাথ গোপন কারণটা জানে শুধু বিশ্বরূপ। তার লেখা পুঁথি পুড়িয়ে ফেলেছে জগন্নাথ। শচীর তোরঙ্গে লুকনো পুঁথি বার করে, পুঁথিটা তোরঙ্গে কোথা থেকে এল, কার লেখা, জামার আগ্রহে সেটা পড়ে, তার মাথায় বাজ পড়েছিল, সে খবর জানে শুধু বিশ্বরূপ। শচীও জানে না। শচীর অজান্তে পুঁথিটা সরিয়ে ফেলেছিল জগন্নাথ। পুঁথি পড়ে তার এমন হৃৎকম্প শুরু হয়েছিল, যে ঘাড়ের ওপর মৃত্যুর নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পেয়েছিল। বাবার দুর্দশা নিজের চোখে দেখেও তার আতঙ্কিত হওয়ার কারণ বিশ্বরূপ সঠিক বুঝতে পারেনি। গোরার জন্মবৃত্তান্ত রচনায় আদৌ সে কোনও গাফিলতি করেনি, দেবদেবীদের অসন্তুষ্ট করার মতো কল্পনার রং চড়ায়নি। বুরহানউদ্দিনের মাজারে যা দেখেছিল, তাই লিখেছে। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করতে যে অবতারের আবির্ভাবের আশায় তার গুরু, অদ্বৈত আচাৰ্য আকুল প্রার্থনা করে চলেছে, গোরা-ই যে সেই অবতার, তাদের পরিবারে দৈবী কৃপায় ভূমিষ্ঠ হয়েছে, এ নিয়ে বিশ্বরূপের সন্দেহ ছিল না। গৌড়ের হতভাগ্য মানুষের নাচগান করার অধিকার গোরা ফিরিয়ে দেবে, মহাভাবের প্লাবনে ভাসিয়ে দেবে গৌড়বঙ্গ, এমন সব অনুসন্ধিৎসু বিবরণ, বিশ্বরূপ লিপিবদ্ধ করেছিল তার পুঁথিতে। পুড়িয়ে ফেলার মতো গর্হিত কোনও বিষয়, পুঁথিতে ঢুকে পড়ছে, লেখার সময়ে তার মনে হয়নি।
হৈচৈ-এর মধ্যে দাওয়ায় কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে গোরা বুঝতে পারল না, বাড়িতে কী ঘটেছে। ঘটনা হৃদয়ঙ্গম করতে কয়েক মুহূর্ত লাগল। তার প্রিয় দাদা, তার প্রাণের একান্ত সহোদর, মনের মানুষ, সংসার ছেড়ে চলে গেছে শুনে তার মাথার ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেল। প্রথমে টানটান, শক্ত হল তার হাত পা, স্থির হল দু’চোখের মণি, দাঁতে দাঁত লেগে শরীরে খিঁচুনি ধরতে দাওয়ার ওপর পড়ে, কাটা মুরগির মতো সে ছটফট করতে থাকল। মুখ থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে। গোরার খিঁচুনি দেখে জগন্নাথ টের পেল, তার ছোট ছেলে মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সেই প্রথম বেহুঁশ হল গোরা। প্রায় দু’ঘণ্টা অচেতন থাকার পরে গোরার যখন জ্ঞান ফিরল, তখনও থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তার শরীর, ফাঁকা চোখ, কথা বলার জন্যে শুকনো দু’ঠোট তিরতির করে কাঁপলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। মুখে ভাষা ফুটতে প্রথম কথা বলল, দাদা কোথায়?
মা, বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে আবার বলল, আমি এখনই দাদাকে খুঁজতে যাব। গোরার গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে চাইল শচী। শিশু গোরার ডাগর দু’চোখ উপচে গাল বেয়ে অবিরত জল পড়ছিল। গোরার মুখের কথাতে শচী গোড়াতে কান না দিলেও ছেলের মুখ থেকে বারবার একই কথা শুনে কথার গভীরে বিশ্বাস করার মতো সংকেত পাচ্ছিল। শচীর মনে হচ্ছিল, দাদাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে গোরার প্রতিশ্রুতি অযথা নয়। অলৌকিক কোনও শক্তি, তাকে দিয়ে কথাগুলো বলাচ্ছে। গোরার মুখ থেকে সে দৈববাণী শুনছে। সদাচঞ্চল গোরা কিছুক্ষণের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে উঠল। বেলা বাড়ছিল। বিশ্বরূপের খোঁজে সম্ভাব্য যত জায়গায় লোক পাঠানো হয়েছিল, ফুলিয়া, কাটোয়া, শান্তিপুর, কুমারহট্ট থেকে এক এক করে সকলে ফিরে এল। কাটোয়া থেকে যারা ফিরল, তাদের একজন, মুকুন্দ দত্ত জানাল, সেখানে সূর্যোদয়ের আগে ভিজে পোশাকে দুই তরুণকে কেউ কেউ দেখলেও তাদের গতিবিধি কারও জানা নেই। তাদের পরিচয় কেউ জিজ্ঞেস না করলেও দু’জনের চেহারার বিবরণ শুনে বিশ্বরূপ, লোকনাথের সঙ্গে মিল পেয়েছে মুকুন্দ। কাটোয়ার পরিচিত কয়েকজন গৃহস্থকে বিশ্বরূপ, লোকনাথের শারীরিক খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত জানিয়ে তাদের হদিশ করতে মুকুন্দ বলে এসেছে। তারা যথাসম্ভব করবে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের বাড়িতে বিশ্বরূপের খোঁজ করতে গিয়ে মহাবিপদে পড়ে গিয়েছিল শ্রীপতি, শ্রীরাম। বিশ্বরূপের নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে ‘হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ’ বলে বুক চাপড়ে কাঁদতে শুরু করেছিল অদ্বৈত। শোকসন্তপ্ত অদ্বৈতের উন্মাদের মতো আচরণ আর কথাবার্তা শুনে শ্রীপতির গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। অদ্বৈতের প্রলাপোক্তি থেকে শ্রীপতি যা বুঝেছে, তা হল—ঈশ্বরের যে নবঅবতারকে অষ্টপ্রহর এই প্রৌঢ় আচার্য, আবির্ভূত হওয়ার জন্যে প্রার্থনা জানিয়ে চলেছে, তার প্রিয়তম ছাত্র বিশ্বরূপের কলেবরে সেই অবতার ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছে, এ নিয়ে তার সন্দেহ নেই, গোপন এই তত্ত্ব অদ্বৈত আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি। বিশ্বরূপকে যথাসময়ে ভক্তমণ্ডলীর প্রধান হিসেবে অভিষিক্ত করার জন্যে মনে মনে প্রস্তুতি চালাচ্ছিল। সাত বছরের বালক বিশ্বরূপকে নিজের চতুষ্পাঠীতে ছাত্র হিসেবে পেয়েই তার মনে হয়েছিল, এ বালক আর পাঁচজনের মতো যে-সে নয়, এ স্বয়ং ঈশ্বর, ছাত্র সেজে তার চতুষ্পাঠীতে এসেছে। বিশ্বরূপকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঈশ্বরকে আলিঙ্গনের মূর্ছাতুর অনুভব হয়েছিল। কয়েক বছর পরে, বিশ্বরূপের ছোটভাই বিশ্বম্ভর, যাকে বাড়িতে সকলে গোরা নামে ডাকে, তাকে দেখে অদ্বৈতের আরও বেশি চমক লাগলেও শিশুটির বিদঘুটে আচরণ, বৈদান্তিক, পরমভাগবদ আচার্যের পছন্দ হয়নি। বলা যায়, অদ্বৈত আচার্যের আশাভঙ্গ হয়েছিল। বিশ্বম্ভরের চেহারায় চোখধাঁধানো দৈবী উজ্জ্বলতা থাকলেও তার বাচালতা, অমার্জিত আচরণে ঈশ্বরত্বের সামান্য আভাস অদ্বৈত পায়নি। উল্টোদিকে, বিশ্বরূপকে বাইরে থেকে দেখে শান্ত, শিষ্ট, নিরীহ বালক মনে হলেও তার প্রকৃতিতে সুস্পষ্ট দৈবীভাব অহরহ অদ্বৈত নজর করেছে। অদ্বৈতের মনে ঈষৎ বিভ্রম থাকলেও বিশ্বরূপকে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে মেনে নেওয়ার অভিলাষ ক্রমশ প্রগাঢ় হচ্ছিল। মাঝে মাঝে মনে হত, বিশ্বম্ভরের দৈবী রূপের সঙ্গে বিশ্বরূপের গুণাবলী যদি একই দেহে বিধৃত থাকত, তাহলে তাকে ঈশ্বরের অবতার ছাড়া আর কিছু ভাবা সম্ভব হত না। বিশ্বরূপের বাহ্যিক রূপ যাই হোক, তার ওপর ঈশ্বরত্ব আরোপ করে ভক্তিতে আবিষ্ট অদ্বৈত ন’বছর ছাত্রের আসনে তাকে বসিয়ে শিক্ষা দিয়েছে। বিশ্বরূপকে ঘিরে তার চেতনায় ছাত্র আর ঈশ্বর একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেই বিশ্বরূপের সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাতে অদ্বৈত আচার্য ভেঙে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
শ্রীবাস আচার্যের পরিবারে এক শ্রীবাস ছাড়া বাকি সকলের দীক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্য। শ্রীবাসের গুরু, মাধবেন্দ্র পুরির শিষ্য, ঈশ্বর পুরি। অদ্বৈত আচার্য আবার মাধবেন্দ্র পুরির শিষ্য হওয়ার সুবাদে ঈশ্বর পুরির গুরুভাই। শচীরও মন্ত্রদাতা গুরু অদ্বৈত। ঈশ্বরের সমতুল্য তাকে জ্ঞান করে শিষ্য-ভক্তরা। জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে বিশ্বরূপকে সেই মহাগুরু অদ্বৈত ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে রেখেছিল, জেনে শ্রীবাসের দু’ছেলে শ্রীপতি, শ্রীরাম হতভম্ব হয়ে গেছে। চোখের জলে বক্ষ প্লাবিত অদ্বৈতকে শান্ত করতে দু’ভাই নাস্তানাবুদ হয়েছে। শুধু অদ্বৈতই নয়, সেই সঙ্গে তার স্ত্রী, শোকাভিভূতা সীতাদেবীকে সান্ত্বনা দিয়ে সবল করতে কম সময় যায়নি। মাঝ দুপুরে বাড়ি ফিরে স্নানাহ্নিক সেরে ভাত খেয়েছিল শ্রীপতি, শ্রীরাম।
বিশ্বরূপ সংসার ছেড়ে চলে যেতে গোরার ভবিষ্যৎ ভেবে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল জগন্নাথ। স্বামীর সঙ্গে শচীও ভয়ে গুটিয়ে থাকল। অসুস্থ জগন্নাথের সব রাগ গিয়ে পড়ল শাস্ত্রশিক্ষার ওপর। শাস্ত্রশিক্ষা যে বিশ্বরূপকে সংসার সম্পর্কে উদাসীন করেছে, সন্ন্যাসী হতে প্ররোচনা দিয়েছে, এ নিয়ে তার মনে সন্দেহ নেই। সবচেয়ে সাংঘাতিক ছিল, পুঁথি রচনাতে বিশ্বরূপকে উসকে দিয়েছে এই শাস্ত্রশিক্ষা। দশ বছরের বালক, এরকম দৈবী অথচ ঈশ্বর অবমাননাকারী, আত্মঘাতী পুঁথি কীভাবে লিখল, জগন্নাথ অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারেনি। সত্যিকথা বলতে কি পুরো পুঁথি পড়ার সাহস তার ছিল না। ইতস্তত পুঁথির পাতা উল্টে চোখ বুলিয়েছে। অধ্যয়নে প্রবল অনুরাগ থেকে বিশ্বরূপের মাথা বিগড়ে গেছে, এই সিদ্ধান্ত করেছে। শ্রীহট্টে যাওয়ার পর থেকে তার মতিচ্ছন্ন হয়েছিল, অনুমান করতে জগন্নাথের অসুবিধে হয়নি। বিশ্বরূপকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে সংসারে তাকে বেঁধে ফেলতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে জগন্নাথ। গৃহত্যাগ করেছে বিশ্বরূপ। বাবাকে ফাঁকি দিয়ে বিশ্বরূপ যে ঘরছাড়া হল, তার কারণ এই শিক্ষা, শাস্ত্রপাঠ। অদ্বৈত আচার্যর চতুষ্পাঠীতে বিশ্বরূপকে উচ্চশিক্ষার জন্যে পাঠানো, জগন্নাথ আর তার পরিবারের কাল হল। নিজের ওপরে ধিক্কারে গঙ্গায় ডুবে মরতে ইচ্ছে করলেও তার আগে জগন্নাথ যে কাজটি করল, তা হল, লেখাপড়া সম্পর্কে বিদ্বেষ থেকে গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠীতে গোরার যাওয়া বন্ধ করে দিল। সংসার ভাসিয়ে সন্তানের চলে যাওয়ার চেয়ে তার আকাট মূর্খ থাকা ভাল। গোরার পুঁথি, পাততাড়ি শচীর চুলোর আগুনে পুড়িয়ে দিল। অন্য সময় হলে, এ ঘটনায় গোরা তুলকালাম কাণ্ড ঘটালেও দাদার শোকে সে এমন মনমরা হয়ে গিয়েছিল যে সেদিকে তাকালো না। মুখ গুঁজে বিছানায় সারাদিন পড়ে থাকত। শচীর চোখের আড়ালে সারাদিন হাপুস নয়নে কাঁদত। মৃগী রোগ চেপে বসল তার ওপরে। মাঝে মাঝে বেহুঁশ হয়ে যেত। দিনে কয়েকবার বিষ্ণুতেল মাখিয়ে তাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা চলল। শচীর চোখের জল পড়াতেও বিরাম ছিল না। মা, ছেলে মাঝে মাঝে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত। স্ত্রী, ছেলের মনের খবর জানার সঙ্গে সংসার টানার ধকলে নাজেহাল জগন্নাথের শরীর ভেঙে পড়ছিল। আরও অসুস্থ হচ্ছিল সে। ঘনঘন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ছিল। শেষের সে দিন গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে, টের পাচ্ছিল। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে গোরার উপনয়ন সেরে ফেলতে চাইছিল জগন্নাথ।
.
অত্যাচারী সুলতান মুজফ্ফর শাহকে প্রাসাদবন্দি করে, পাইকবাহিনী লাগিয়ে তাকে খতম করে, গৌড়ের মসনদ তখন দখল করেছে আলা আল দুনিয়া ওয়াল দীন আবুল মুজফ্ফর হোসেন শাহ, সংক্ষেপে ইতিহাসকথিত সুলতান হোসেন শাহ। সুলতানের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির। সুলতানি দরবারে আমির, ওমরাহ, দবির খাস, সাকর মল্লিকের সঙ্গে সমান মর্যাদায়, কিংবা তার চেয়ে কয়েক কাঠি বেশি গুরুত্বের আসন পেল রাজজ্যোতিষী চারুমিহির। অসম্ভব বুদ্ধিমান, স্পষ্টভাষী, সদাপ্রসন্ন এই মানুষটি ছিল রীতিমত উচ্চাভিলাষী। দরবারে বিশেষ মুখ না খুললেও হোসেন শাহকে একান্তে যেসব পরামর্শ, চারুমিহির দিত, কূটনীতির দিক থেকে তা ছিল অভ্রান্ত। গৌড় বাংলার জনসমাজকে বশে রাখতে সুলতানি শাসনের জাতশত্রু কৃষ্ণকে খুঁজে বার করার সঙ্গে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজাসাধারণের মধ্যে যাঁরা শ্রদ্ধেয়, তালেবর ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনে তাঁদের জায়গা করে দেওয়া যে জরুরি, এই সূত্রটা হোসেন শাহের মাথায় ঢুকিয়ে দিল চারুমিহির। হিন্দু মানে, শুধু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় নয়, ম্লেচ্ছ আর শূদ্র সমাজ থেকে শিক্ষাদীক্ষা, বৃত্তিতে বৈদ্য, কায়স্থরা অতি দ্রুত সমৃদ্ধ, প্রভাবশালী হয়ে উঠছে, মৈথিলি ব্রাত্মণ, চারুমিহিরের তা নজর এড়ায়নি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত শিক্ষা, সুলতানকে পৌঁছে দিতে সে দেরি করল না। আগের সুলতানদের ভুলত্রুটি নজির হিসেবে তুলে হোসেন শাহকে সে বোঝাল, সুলতানি আমলের শুরু থেকে নানা পর্বে তাদের মসনদ থেকে উচ্ছেদ করতে যে কৃষ্ণ আড়াল থেকে চক্রান্ত করে চলেছে, তার শিরশ্ছেদের ছক সাজানোর পাশাপাশি, তার সঙ্গে ওপর ওপর বন্ধুত্ব গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা দরকার। গৌড়ের প্রাক্তন সুলতানদের দু’একজন বুঝে অথবা না বুঝে সে কাজ করেছে। ব্রাত্মণ্যধর্মের প্রতি বিদ্বেষে এবং শাসনকাজ চালানোর প্রয়োজনে সংস্কৃত ভাষার চেয়ে বাংলা ভাষাকে তারা বেশি মদত দিয়েছে। বাঙালি জনসমাজকে ধর্মান্তরিত করতে তাদের ভাষা রপ্ত করা প্রয়োজন, শাসকেরা অতি দ্রুত বুঝে গেছে। চতুর ঐন্দ্রজালিক, রসের নাগর, কৃষকে ঘায়েল করতে হলে ঘাতক নিয়োগ করার পাশাপাশি কৃষ্ণের মহিমা কীর্তনকারী দু’চারজন আখ্যানকারকে সসম্মানে দরবারে জায়গা দিয়ে, প্রশ্রয় দিয়ে, এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলতে চেয়েছে, যাতে সেই সতর্ক মানুষটার নিরাপত্তাবেষ্টনী কিছুটা আলগা হয়ে যায়, সে ভাবতে শুরু করে প্রতিপক্ষের দম ফুরিয়ে এসেছে, সে-ও গা এলিয়ে দেয়। সেই ফাঁকে, অনায়াসে তার ব্যূহে ঢুকে তাকে নিকেশ করতে সুলতানি ঘাতকের অসুবিধে হবে না। শত্রুকে নিশ্চিহ্নকরণের যুদ্ধে তার বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের সঙ্গে তার মহিমাও কীর্তন করতে হয়। শত্রুর অপযশ প্রচারের সঙ্গে যৎসামান্য তার যশ না মেশালে অপযশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না।
সুলতানের সামনে উদাহরণ হাজির করতে চারুমিহির একদিন বলল, বড়ু চণ্ডীদাস নামে এক কবিকে একশ’ বছর আগে সুলতান সিকন্দর শাহ যে কৃষ্ণের উপাখ্যান লিখতে উৎসাহ দিয়েছিল, তার কারণও সম্ভবত ছিল আত্মগোপনকারী কৃষ্ণকে জনসমক্ষে টেনে আনা। সুলতান সিকন্দর অসফল হয়েছিল, তা বলা যায় না। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের অধিপতি অমোঘবর্ষের ছেলে রাজা তৃতীয় কৃষ্ণ দক্ষিণ ভারত ছেড়ে মগধ পর্যন্ত নিজের প্রতিপত্তি বিস্তার করলেও সুলতানি শাসকদের ভূখণ্ড মাড়ায়নি। অথচ উত্তর-পূর্ব ভারতে তার প্রভাব বাড়ছে, সুলতানদের অগোচর ছিল না। নানা ফন্দিফিকির করেও তাকে বন্দি করতে পারেনি সিকন্দর শাহ। সুফি সাধক, কবি মহম্মদ সবীরকে টোপ হিসেবে সামনে রেখে সিকন্দর শাহের ছেলে সুলতান আযম শাহ একই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কৃষ্ণের চতুরালিকে টেক্কা দেওয়া কোনও সুলতানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সবীরের গানের অনুরাগী কৃষ্ণকে সুরের আবেশে অভিভূত করে লোহার খাঁচায় পুরে ফেলতে আযম শাহ ব্যর্থ হয়। লোকশ্রুতি হল, সুফি সাধক, সুরের জাদুকর, মহম্মদ সবীর-ই নাকি সুরের মায়াজালে কৃষ্ণকে ঢেকে দিয়েছিল। সুলতানের সেনাবাহিনীর প্রধান, আখতারুজ্জমানের চোখের সামনে থেকেও মানুষটা অদৃশ্য ছিল। তাকে দৃষ্টিগোচর করা সেনাপতি আর তার সেনাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কুলীন গ্রামের কবি, মালাধর বসুকে দরবারে জায়গা দিয়ে গৌড়ের আর এক সুলতান, সামসুদ্দিন য়ুসুফ শাহ লিখিয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য, কবিকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধি দিয়েছিলেন। সুলতানের ধারণা ছিল, মালাধরের স্তুতি শুনে, তার ঘরে কৃষ্ণ একবার উঁকি দিয়ে, গৌড়ের হালচাল নিয়ে কথা বলে যাবে। লোকটা ধড়িবাজ, কিন্তু গুণী, সাহসী। ‘ভারতবর্ষ’ নামে অখণ্ড একটা দেশ বানাতে চায়, ‘হিন্দু’ নামে এক আজগুবি ধর্ম, যা আছে এবং নেই, যা ধর্ম, না জাতি এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কখনও বলে ঈশ্বর ‘এক’ কখনও বলে ‘বহু’ কখনও নিরীশ্বরবাদী, কখনও তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর ভজনকারী, নানা বিকৃত চেহারায় ভেঙে ছত্রখান হয়ে পড়া বৈদিক ভাষার মাকড়সার জালে দেশকে বেঁধে রাখতে চায়, তণ্ডুলজাতীয় এক খাদ্য, যার নাম ‘ভাত’, সেই ভাত খাওয়ার সুবাদে হিমাচল থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত কয়েক কোটি মানুষকে চরম নৈরাজ্যবাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ রাখে, সেই কৃষ্ণকে তোষামোদ করে মুঠোয় পুরে ফেলা সহজ কাজ নয়। সুলতান য়ুসুফ শাহ পারেনি। কিন্তু য়ুসুফ শাহের শ্রীকৃবিজয় লেখানোর উদ্যোগ, গৌড়ের মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। কৃষ্ণকে জ্যান্ত ধরার চেষ্টার সঙ্গে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বন্দি করে শূলে চড়ানোর ফন্দি এঁটেছিল সুলতান জালালুদ্দিন। রাজা গণেশের ছেলে যদু, ধর্মান্তরিত হয়ে জালালুদ্দিন হওয়ার পরে গোটা হিন্দুসমাজকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুসলমান সুলতানদের চেয়ে একশ’ গুণ বেশি ধর্মান্ধ জালালুদ্দিন, রাজ্যশাসকের ভূমিকা নিলেও তার বাবা, গণেশের আমলে কৃত্তিবাস ওঝা নামে এক কবি, সংস্কৃত রামায়ণের বাংলায় যে তর্জমা শুরু করেছিল, গণেশের জীবদ্দশায় সেই কাজ শেষ করা কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। অসমাপ্ত রচনা, সাতকাণ্ড রামায়ণের উপসংহার পর্যন্ত কৃত্তিবাসকে তর্জমা করার সুযোগ দিয়েছিল সুলতান জালালুদ্দিন। কথক, চারণকবিদের মুখে কৃত্তিবাসের রামায়ণের তর্জমা, একশ’ বছর পরে শোনার সুযোগ হয়েছিল সুলতান হুসেন শাহের। চারুমিহিরও হোসেন শাহকে কৃত্তিবাসী রামায়ণের অংশবিশেষ পাঠ করে শুনিয়েছিল।
কাফেরদের সেই কাব্যে আল্লার নাম একবারের জন্যে উল্লেখ করা না থাকলেও এবং বিস্তর গাঁজাখুরি গল্প ঢোকানো হলেও সুলতানের শুনতে খারাপ লাগেনি। বরং ভাল লেগেছিল। যথেষ্ট তারিফ করেছিল সুলতান। কৃত্তিবাসের পুঁথি পরিমার্জিত করে চারুমিহিরকে অনুলিপি করার নির্দেশ দিয়েছিল। ‘পরিমার্জনা’র অর্থ যে রামায়ণে আল্লার গুণগান ঢোকানো, চারুমিহিরের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সুলতানের নির্দেশ না মেনে চারুমিহিরের উপায় ছিল না। নিজের উচ্চাভিলাষ মেটাতে হলে ক্ষমতাধরকে তুষ্ট এবং ত্রস্ত রেখে চলতে হয়, সে জেনে গিয়েছিল। তুষ্ট রাখার মতো, ত্রস্ত রাখার পদ্ধতিও যে সমান মোলায়েম, নিরূপদ্রব হবে, এ তথ্য তার অজানা ছিল না। দক্ষ কারিগরের মতো এই আচরণবিধির মশলা তৈরি করেছিল চারুমিহির। সূক্ষ্মভাবে তা প্রয়োগ করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল। সুলতান হোসেন শাহের পয়লা সারির পেয়ারের লোক হিসেবে নিজেকে স্থাপন করতে তাই তার অসুবিধে হয়নি। সুলতানি আমলের শুরু থেকে চালু কৃষ্ণকথার কিংবদন্তি সাহায্য করেছিল তাকে। সুলতানকে সে আরও বোঝালো প্রকৃত ক্ষমতাবানের এমন এক ভাবমূর্তি গড়ে তোলা দরকার, যা থেকে প্রজাদের, তাকে বিদ্যোৎসাহী, সংস্কৃতিবান মনে হয়। কয়েক হাজার মানুষকে খুন করে কাদামাটির একটা মন্দির তৈরির হুকুমনামা সুলতান মঞ্জুর করলে তার সব অপরাধ প্রজারা মাপ করে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষ শাসক হিসেবে সে বাহবা পায়। হিন্দ শূদ্রসমাজ থেকে ধর্মান্তরিত লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে নিজের ভাবমূর্তি অপরিম্লান রাখতে আরও লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে মুসলমানে রূপান্তর করা দরকার, এ চিন্তাও হোসেন শাহের মাথায় ছিল। স্বেচ্ছাচারী, কূটনীতিক সুলতানকে সামলানো জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের পক্ষে সহজ ছিল না। তবু সে যে পেরেছিল, তার কারণ, ক্ষুরধার ছিল তার মেধা। সব শাস্ত্র সে প্রায় গুলে খেয়েছিল। নানা সময়ে একান্ত আলাপচারিতায় সুলতানকে হিন্দুধর্মের অন্তর্বস্তু বোঝাতে গিয়ে চারুমিহির যা বলত, তা এরকম—’হিন্দুধর্ম’ নামে যা চালু আছে, আসলে তা কোনও ধর্ম নয়। সিন্ধু নদীর পুবদিকে গড়ে ওঠা যে জনপদ, যাকে ‘সিন্ধুসভ্যতা’ বা ‘হিন্দুসভ্যতা’ বলা হয়, তা সেখানকার বর্বর সম্প্রদায়, যারা ‘স’ উচ্চারণ করতে পারে না, ‘স’ বলতে ‘হ’ বলে, তাদের তৈরি। তাদের কোনও ধর্মবিশ্বাস নেই, দু’টুকরো বসন ছাড়া অন্য পোশাক তারা ব্যবহার করতে জানে না, দু’বেলা ভাত খায়, প্রধানত নিরামিষাশী, জাতপাতে ছিন্নভিন্ন বনবাসী মানুষ। গৌড়বঙ্গালের ব্রাহ্মণরা তাদের ‘বামনাই’ নিয়ে যতই বড়াই করুক, তাদের আশীর্বাদ নিতে শাস্ত্রের নিষেধ আছে। তারা শতায়ু হও’-এর বদলে বলে, ‘হতায়ু হও’, গৌড়িয়া বামুনকে এ জন্যে ‘বিটলে বামুন’ বলা হয়। বৈদিক ভাষা, বৈদিক ধর্ম এখন পৌঁছোয়নি, চোয়াড়দের আড্ডা এই দেশ। কোনও ধৰ্ম না থাকার জন্যে সহজে এদের ধর্মনাশ করা যায়। হিন্দুরাই হিন্দুদের জাতিচ্যুত করার ব্যবস্থা করে রেখেছে। গোঁড়া নৈয়ায়িক আর স্মার্তরা এমন সব বিধিনিষেধ সমাজে জারি করে রেখেছে, যেখানে পান থেকে চুন খসলে হিন্দুকে তার হিন্দুত্ব হারাতে হয়। প্রাণে মরার চেয়ে হিন্দুদের যা নেই, অলীক ধারণায় আছে, সেই জাত যাওয়ার ভয় বেশি। ধর্মনাশ হলে এরা সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। সমাজ-ই মুখ দেখতে চায় না তাদের। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সমাজ থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিতাড়িতকে ইহজীবনে সমাজে ফিরিয়ে নেওয়া হয় না। জন্মগতভাবে যে হিন্দু, সে-ই হিন্দু। ভিন্ন ধর্মের কাউকে ধর্মান্তরিত করে হিন্দুসমাজে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ সে নিষেধ লঙ্ঘন করার উপায় নেই। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতো হিন্দুধর্ম সম্প্রসারণবাদী ধর্ম নয়, আত্মকণ্ডূয়নকারী ধর্ম। শূদ্রের ছায়া মাড়ালে এখানে ব্রাহ্মণের জাত যায়। ব্রাহ্মণের মধ্যে আবার রাঢ়ি, বারেন্দ্রী এবং অন্য নানা ভাগ যেমন রয়েছে, ম্লেচ্ছদের মধ্যে আছে বৈদ্য, কায়েত, নবশাক। নবশাকদের রয়েছে নানা ঘরের শূদ্র। শূদ্রদের মধ্যে কুম্ভকারের সঙ্গে ধীবর, সূত্রকারের বৈবাহিক সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, অনুলোম, প্রতিলোম নিয়ে রীতিমত ভ্রষ্টাচার, যবনপল্লীতে পা রাখলে নৈকষ্য কুলিনের জাত যায়, হিন্দুজাতির মধ্যে ভাগাভাগির শেষ নেই। সুতরাং গৌড়ের এক জমিদার, সুবুদ্ধি রায়কে প্রাণে না মেরে, তার ধর্ম নাশ করলে, সমাজপতিদের দেওয়া প্রায়শ্চিত্তের বিধান পালন করতে গিয়ে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে, এমন এক অমোঘ সিদ্ধান্তে সুলতানকে পৌঁছে দিল চারুমিহির। সুলতান স্তব্ধ। জ্যোতিষার্ণবের ব্যাখ্যা নিশ্ছিদ্র বুঝতে সামান্য অসুবিধে হল না সুলতানের। চারুমিহিরের সঙ্গে একান্তে নানা শলাপরামর্শের মধ্যে সেই সন্ধেতে সুবুদ্ধি রায়ের প্রসঙ্গ তুলেছিল, স্বয়ং সুলতান হোসেন শাহ। সুবুদ্ধিকে নিয়ে সুলতানের জেনানা মহলে কিছুদিন ধরে খটাখটি চলেছে, চারুমিহির অনুমান করলেও, হোসেন শাহকে কোনও প্রশ্ন করেনি। সেটা সহবৎ নয়। এত স্পর্ধা তার ছিল না। সেই সন্ধেতে নিছক বিশ্রম্ভালাপের জন্যে তাকে ডেকে, সুবুদ্ধি রায়কে প্রাণদণ্ডের বিকল্প সাজা দেওয়ার খোঁজ করেছিল সুলতান। তার আগে শুনিয়েছিল নিজের ব্যক্তিজীবন আর জেনানামহলের কিছু কাহিনী। গোপন এসব তথ্য নিয়ে সুলতান আলোচনা করবে, চারুমিহির ভাবেনি। সুলতানের মুখ থেকে কুড়ি বছর আগের এক ঘটনা, যা গৌড়ের অধিপতি, মহাক্ষমতাবান হোসেন শাহ অবলীলায় বলে যাচ্ছিল, এবং চারুমিহির শুনতে শুনতে ঘামছিল, এবং মনে মনে সুলতানকে তুষ্ট এবং ত্রস্ত করার মতো বয়ান রচনা করছিল, সেই সন্ধেতে, সে প্রথম জানল, এতকাল যা গুজব হিসেবে চালু রয়েছে তা গুজব নয়, প্রকৃত ঘটনা, সুলতানের জীবনে ঘটেছে, পনেরো বছর আগে, যখন গৌড়ের দেওয়ান সুবুদ্ধি রায়ের নোকর ছিল হোসেন শাহ।
চারুমিহির মুখ খোলার একটু আগে সুলতান শুনিয়েছিল মুলুকপতি সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে তার কর্মজীবনের কাহিনী। সুবুদ্ধি রায়ের জমিদারিতে চাকরির সূত্রে তখন এক জলাশয় খননের দায়িত্ব চেপেছিল হোসেনের ওপর। তরুণ হোসেনের কর্মপটুতায় তাকে অগাধ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল সুবুদ্ধি। নির্ধারিত দিনে সপারিষদ জলাশয় প্রতিষ্ঠা করতে দিয়ে সুবুদ্ধি দেখল, তখনও খননের কাজ বিস্তর বাকি। ভারপ্রাপ্ত কর্মচারি হোসেনকে জলাশয়ের কাছাকাছি খুঁজে পাওয়া গেল না। শোনা গেল, সে গেছে ভাবি শ্বশুরবাড়িতে। ক্ষিপ্ত সুবুদ্ধি রায় হোসেনকে ধরে আনতে তখনই লাঠিয়াল পাঠাল। হোসেনকে সেখানে পাওয়া গেল না। তার খোঁজ মিলল দু’দিন পরে। যাকে ধরে আনার হুকুম ছিল, তাকে বেঁধে আনল লাঠিয়ালরা। নিজের প্রাসাদের সামনে, খামারে, জনসমক্ষে, পরগনার কোটালকে হোসেনের পিঠে পঁচিশ ঘা বেত মারার হুকুম দিল মনিব সুবুদ্ধি রায়। হোসেনের পিঠে চাবুকের দাগ পাকাপাকি থেকে গেলেও সে জানতে পারল না। পনেরো বছর আগের ঘটনা এটা। দরিদ্র চাষি পরিবারের ভাগ্যান্বেষী সেই তরুণ কীভাবে প্রথমে সুলতান সিকন্দর শাহের দরবারে পৌঁছল, তারপর সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ এবং অবশেষে সুলতান আবুল মুজফ্ফর ফতেহ শাহ-এর দরবারে ঢুকে আমীর বনে গিয়ে, পরের অধ্যায়ে নিজে সুলতানি মসনদে চেপে বসল, সে বৃত্তান্ত পুরো জানা না গেলেও গৌড়ের মসনদ দখলের চক্রান্ত আর দেশজোড়া নৈরাজ্যের মধ্যে রক্তাক্ত, পিছল পথে বুদ্ধিমান হোসেন শাহ যে ক্ষমতায় গিয়েছিল, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। দশ বছরের মধ্যে হোসেন শাহের পিঠের চাবুকের দাগ মিলিয়ে গেলেও কয়েকটা রেখা নিশ্চয় জেগে ছিল। তা আবিষ্কার করেছিল তার পাঁচ বেগমের মধ্যে প্রিয়তমা, নুরুন্নিসা বেগম। হোসেনের আদুল পিঠে অস্পষ্ট দাগ দেখে নুরুন্নিসা বেগম জানতে চেয়েছিল, কালসিটে পড়ার ইতিহাস। চাবুক খাওয়ার প্রায় ভুলে যাওয়া ঘটনার বিবরণ নুরুন্নিসাকে সুলতান শোনালেও পনেরো বছর পরে পিঠে প্রহারের দাগ থেকে গেছে প্রথমে হোসেন শাহ বিশ্বাস করেনি। হেমন্তের মাঝরাতে শোয়ার ঘরে দেওয়ালজোড়া মুখোমুখি দুই বিশাল আয়নার মাঝখানে যেখানে রাজকীয় শয্যা, সেই শয্যার এক ধারে সুলতানকে দাঁড় করিয়ে পেছনের আয়নায় চোখ রাখতে বলল নুরুন্নিসা। চার দেওয়ালের চারটে দেওয়ালগিরি সমেত ঘরের সব আলো, সেজবেগম নুরুন্নিসা জ্বেলে দিয়েছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের আয়নায় নিজের পিঠ দেখার চেষ্টা করল সুলতান। পেছনের আয়নায় গোটা শরীর দেখা গেলেও নিজের পিঠ দেখা কঠিন কাজ। কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে আবছা কয়েকটা কালো রেখা চোখে পড়তে, দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্যে মনিব সুবুদ্ধি রায়ের সাজা দেওয়ার বিবরণ নুরুন্নিসাকে শুনিয়েছিল সুলতান। ঘটনা শুনে রাগে ফোঁস করে উঠে বেগম, তখনই সুবুদ্ধি রায়ের কোতল চেয়ে, তার কাটা মুণ্ডু দেখার জন্যে সুলতানের কাছে আবদার ধরল। বহু বছর পরে চাবুকের দাগ নজর করে সুলতান নিজেও লজ্জিত হওয়ার সঙ্গে প্রতিহিংসাপরায়ণও হয়ে উঠেছিল। তবু প্রাক্তন মনিব সুবুদ্ধি রায় সম্পর্কে হোসেন শাহের মনে কোথাও দুর্বলতা ছিল। তার শিশু অবস্থায়, সে যখন মা-বাবা-হারা অনাথ, না খেয়ে মরতে চলেছে, তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সুবুদ্ধি রায় প্রাণে বাঁচিয়েছিল। বাড়ির বাইরে, জমিদারি সেরেস্তার অদূরে, গোশালার পেছনের ঘরে আশ্রয় দিয়েছিল। সেখানে আর পাঁচটা বাগাল ছেলের সঙ্গে সে-ও দু’বেলা পেট ভরে খোরাকি পেত। ভাত, মুড়ির অভাব ছিল না।
সুবুদ্ধি রায়ের মুণ্ডু দেখার জন্যে ক্রুদ্ধ সেজবেগমের চাল কার্যকর করার আগে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের সঙ্গে এক দফা পরামর্শ সেরে নিতে সেই সন্ধেতে মন্ত্রণাকক্ষ ঢুকেছিল হোসেন শাহ। সুবুদ্ধি রায়ের হাতে তরুণ বয়সে সুলতানের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাতে নুরুন্নিসা বেগমের প্রবল গোঁসা হওয়াকে চারুমিহির সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করে, দুর্বুদ্ধিপরায়ণ সুবুদ্ধিকে ঈষৎ ভিন্নভাবে, সুবুদ্ধির মুখে সুলতানের গোশলখানার ঝাড়ুদারের ব্যবহার করা গাড়ুর জল ঢেলে দিতে পরামর্শ দিল। সুবুদ্ধি তখনই না মরলেও সমাজপতিদের নির্ধারিত বিধান মেনে অবশ্যই মারা যাবে। কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। সাপ মরবে, লাঠি ভাঙবে না। অপবাদ রটবে না সুলতানের নামে। ট্যাড়া পিটিয়ে প্রজাদের ডেকে এনে, সুলতানি প্রাসাদের সামনে খামারে সুবুদ্ধির হাত-পা বেঁধে তাকে মাটিতে ফেলে তাই করা হল। সকলে দেখল, গাড়ুর জল গেলার সঙ্গে সুবুদ্ধির মুখ থেকে উপচে পড়া জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তার চোখের জল। গৌড়ের মসনদে হোসেন শাহ বসার পর দু’বছর ধরে যে কোতল হওয়ার অপেক্ষা করছিল, গর্দান থেকে মুণ্ডু নেমে গেলে যার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল পড়ত না, গাড়ুর জল খেয়ে জাত খোয়ানোর দুঃখে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। সে অঝোরে কাঁদছিল।
সুবুদ্ধির ধর্মনাশের ঘটনা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গৌড় থেকে নবদ্বীপ, বাঙ্গাল, লখনৌতি, সোনারগাঁ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত গ্রামগুলোর চণ্ডীমণ্ডপে সমাজের মাথারা সুবুদ্ধির প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থাপত্র তৈরি করতে আলোচনায় বসে গেল। সবচেয়ে বেশি কোলাহল তুলল নবদ্বীপের সেই নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণরা, যারা সুবুদ্ধির কাছে নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। সমাজের শাসন, অর্থাৎ স্মার্ত, নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণদের শাসন, পুরুষানুক্রমে সুবুদ্ধি রায় মেনে চলেছে। মদত দিয়েছে এই শাসনকে। শাসনকর্তাদের দেবতা জ্ঞানে সমীহ করলেও দরকার মতো তাদের উৎকোচ দিয়ে কাজ উদ্ধার করেছে। উৎকোচ দেওয়ার শিক্ষা সে পেয়েছিল পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। উৎকোচ দেওয়া এবং নেওয়াতে অপরাধ আছে, এই বোধ তার জন্মায়নি। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে অনুগত ব্রাহ্মণ ধরে পাঁজিপুঁথির নির্দেশ আদায় করে নিয়ে যে পরিমাণ অর্থ, সামগ্রী সে দিত, তা যথার্থ দক্ষিণার চেয়ে অনেক বেশি। পেয়ারের বামুনরা কড়া প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেবে না, এমন ধারণা সুবুদ্ধি রায়ের মনের মধ্যে পল্লবিত হতে থাকলেও বাস্তবে উল্টোরকম ঘটল। নবদ্বীপের ব্রাহ্মণকুল শিরোমণিরা পাঁচ পোয়া ফুটন্ত ঘি খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার যে নির্দেশ গৌড়ের সমাজপতিদের পাঠাল, সেখানের ব্রাহ্মণরা জোট বেঁধে তা অনুমোদন করল। প্রায়শ্চিত্তের বিধান শুনে সুবুদ্ধি টের পেল, তাকে সরাসরি কোতল করার বদলে ধর্মনাশের সুবাদে ধরাধাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে সুলতান হোসেন শাহ। সুলতানকে মন্ত্রণা দিয়েছে রাজজ্যোতিষী চারুমিহির। চারুমিহির হয়তো তাকে প্রাণে বাঁচাতে চেয়ে করোয়ার জল খাওয়ানোর বুদ্ধি সুলতানকে দিয়েছিল, আড়বুঝো ব্রাক্ষ্মণরা তা মৃত্যুদণ্ডের সংকেত ভেবে নিয়েছে। পাঁচ পোয়া ফুটন্ত ঘি খেলে, পুরোটা পেটে যাওয়ার আগে তার মৃত্যু ঘটবে, প্রায়শ্চিত্তের বিধান যারা দিয়েছে, তারা ভালো জানে। নরম কোনও বিধান তারা অনায়াসে দিতে পারত। সুবুদ্ধির কাছ থেকে কম দক্ষিণা তারা নেয়নি। অর্থ, সোনাদানায় তাদের দু’হাত ভরে দিয়েছে। তারা এমন বেইমানি করবে সুবুদ্ধি ভাবতে পারেনি। অন্যভাবে প্রায়শ্চিত্ত করল সুবুদ্ধি। প্রাসাদোপম বাড়ি, সংসার, বিত্তসম্পদ ফেলে এক রাতে ভিখিরির ছদ্মবেশে কাশীধামে চলে গেল। প্রায়শ্চিত্ত না করে গৌড় ছেড়ে চলে আসার জন্যে অনুতাপে পুড়তে থাকল তার মন। তার এই অবস্থার জন্যে দায়ী, একদা তার নফর, এখন গৌড় বাংলার সুলতান, হোসেন শাহকে তার মসনদ থেকে উচ্ছেদ করতে সুবুদ্ধিও খুঁজতে শুরু করল কৃষ্ণকে। দুষ্কৃতির শাস্তি আর সুজনের প্রতিপালনে যুগে যুগে কৃষ্ণের যে আবির্ভাব ঘটে, হিন্দুসম্প্রদায়ের একাংশ অন্ধের মতো এই শাস্ত্রবচনে বিশ্বাস করত। উত্তর-পশ্চিম ভারত দখলকারী ইসলাম শাসকরা যেমন কৃষ্ণের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার অতিকথাতে আতঙ্কিত হয়ে থাকত, ভাগবতে বিশ্বাসী, বৈষ্ণবরা তেমনই সর্বান্তঃকরণে কলিযুগের উপযুক্ত কৃষ্ণাবতারের আবির্ভাবের জন্যে প্রার্থনা করত। নবদ্বীপের অদ্বৈত আচার্য ছিল তাদের একজন। অদ্বৈত আচার্যের গুরু ছিল দক্ষিণ ভারতের বৈষ্ণবসাধক মাধবেন্দ্র পুরি। মাধবেন্দ্র পুরি ছিল যথার্থ চলমান, মহাবিরক্ত সন্ন্যাসী, ঠিকানাবিহীন অযাচক, অনিকেতন, পরিব্রাজক তপস্বী, তার সূত্রে অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে সুবুদ্ধি রায়ের যোগাযোগ হয়। দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব ভারতের নবদ্বীপ, শান্তিপুর পর্যন্ত অনবরত পরিক্রমা করত চলমান বৈষ্ণবসাধক মাধবেন্দ্রপুরী। পথে থামত, কাশী, বৃন্দাবন, নীলাচল, রেমুণাতে। সেরকম এক পরিক্রমার মধ্যে সুবুদ্ধির সঙ্গে মাধবেন্দ্রর পরিচয় হয়। প্রেমভক্তির জীবন্ত বিগ্রহ, মাধবেন্দ্রর কাছে ধর্মবিনষ্ট মানুষের প্রায়শ্চিত্তের বিধান, সুবুদ্ধি জানতে চাইলে, তাকে কৃচ্ছসাধন করে জীবিকা নির্বাহের পরামর্শ দেয় পরিব্রাজক সন্ন্যাসী। সুবুদ্ধি রায় না বললেও গৌড় থেকে সুলতানি শাসন উচ্ছেদের জন্যে তার সুপ্ত বাসনা মহাযোগী মাধবেন্দ্রপুরি টের পেয়ে অদ্বৈত আচার্যকে জানালে, গুরুর মারফৎ সুবুদ্ধিকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করার বার্তা পাঠায় অদ্বৈত। পরে মাধবেন্দ্র পুরির আর এক শিষ্য ঈশ্বর পুরির সূত্রে অদ্বৈতের সঙ্গে সুবুদ্ধির নিয়মিত খবরাখবর লেনদেন হতে থাকে, সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। অদ্বৈতের পাঠানো সাংকেতিক বার্তা থেকে সুবুদ্ধি অনুমান করেছিল, কৃষ্ণাবতারের সঙ্গে তাড়াতাড়ি তার দেখা হতে পারে। হোসেন শাহের গুপ্তঘাতকদের হাত থেকে বাঁচতে সুবুদ্ধি তখন সন্ন্যাসীর ভেক ধরে ক্রমাগত নানা তীর্থে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবতারের দেখা পাওয়ার দিন গুনছিল সে। কৃষ্ণের সঙ্গে তার সংযোগের চেষ্টার খবর হোসেন শাহ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, এ তথ্য তার অজানা ছিল না।
মাধবেন্দ্র পুরির পরামর্শে সন্ন্যাসীর ভেক ছেড়ে কাঠুরিয়ার পেশা বেছে নিয়ে জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ জোগাড় করে শহরের বাজারে বেচে রোজ চার-পাঁচ পয়সা রোজগার করতে থাকল সে। নিজের ভরণপোষণের জন্যে এক পয়সা রেখে বাকি পয়সা গরীব দুঃখীদের বিলিয়ে দিত। প্রায়শ্চিত্ত করার বাসনার সঙ্গে কৃষ্ণাবতারের অপেক্ষায় সতেরো বছর কাটানোর পরে সঠিক পথের সন্ধান পেল সুবুদ্ধি। বৃন্দাবন চলে গেল সে।
.
দাদা, বিশ্বরূপের শোকে গোরা কাতর হলেও তার পুঁথিপত্র বাবাকে পুড়িয়ে ফেলতে দেখে, বলা বাহুল্য সে রেগে টং হয়ে গেল। তারপর জগন্নাথ যখন গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠীতে তার যাওয়া বন্ধ করে দিল ক্রোধে সে দামালের মতো আচরণ করতে থাকল। বেড়ে গেল তার দুরন্তপনা। সকাল থেকে সন্ধে, বেশি সময় বাড়ির বাইরে নবশাকপল্লীতে আড্ডা দিয়ে কাটাতে লাগল। শাঁখারি, তাঁতি, কুমোর, কামার, ছুতোর পরিবারের ছেলেরা হল তার খেলার সঙ্গী। সদাচারী ব্রাত্মণ সন্তানের জীবনযাপন থেকে তার এই বিচ্যুতি বিপ্রকলের নজর এড়াল না। ছি ছি করতে লাগল তারা। ব্রাহ্মণ সন্তানকে লেখাপড়া না শিখিয়ে মূর্খ করে রাখলে সে যে কতদূর অধঃপতিত হতে পারে, গোরাকে তার নমুনা হিসেবে হাজির করল। গোরার এই নষ্টামির জন্যে জগন্নাথকে দায়ী করে তাকে ধিক্কার দিতে শুরু করল। শুধু ম্লেচ্ছ, শূদ্র পাড়ায় মেলামেশাতে গোরা থেমে থাকল, এমন নয়। স্নানের ঘাটে দলবল নিয়ে গিয়ে, একদা শ্রীহট্টবাসী, বৃদ্ধদের ‘বাঙাল’ ভাষা নকল করে, তাদের ভেঙাতে থাকল। কেউ ধমক দিলে রাস্তায় তার ভিজে কাপড় খুলে দিত। স্নানের ঘাটের মেয়েরাও রেহাই পেল না গোরার দৌরাত্ম্য থেকে। কারও খোঁপা খুলে দিত, কারও বেণী, কারও এলোচুলে টান মেরে সামান্য সরে গিয়ে মজা দেখত। গোরার নামে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকল শচী-জগন্নাথের কাছে। শচীর কাছে মেয়েরা জানাত গোরার অত্যাচারের বিবরণ। অন্নচিন্তায় বিব্রত জগন্নাথ কীভাবে ছেলেকে সামলাবে, ভেবে পেল না। গোরাকে শাসন করার ক্ষমতা শচীর ছিল না। গোরার মুখের দিকে তাকালে স্নেহময়ী মায়ের রাগ গলে জল হয়ে যেত। বুকের মধ্যে উথলে উঠতো গোরাকে আদর করার ইচ্ছে। মাকেও কম জ্বালাত না গোরা। বিশ্বরূপ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, সেই প্রথম গোরা বেহুঁশ হলেও রোগটা তার শরীরে জাঁকিয়ে বসল। ছ’মাসের মধ্যে আরও দু’বার মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। হাত-পায়ে খিঁচুনি লেগে বেঁকে গিয়েছিল শরীর। জ্ঞান ছিল না। মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। জগন্নাথের প্রতিবেশী শ্রীবাসের বউ মালিনী, শচীর বোন মনোরমা, ভগ্নিপতি চন্দ্রশেখর, পরিবারের কিছু শুভানুধ্যায়ী, গোরাকে পরিচর্যার কাজে শচীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। গোরার অসুস্থতাকে কেউ বলেছিল বায়ুরোগ, কেউ বলল, মৃগী। গোরার মাথাতে রোজ কয়েকবার বিন্নুতেল মাখানোর পরামর্শ দিল কিছু প্রতিবেশী। প্রথমবার গোরা অচেতন হওয়ার পর থেকে গোরাকে বিষ্ণুতেল মাখানো শুরু হয়েছিল। চোখে পড়ার মতো না হলেও কিছু উপকার, অচেতন হওয়াতে সময়ের ব্যবধান বেড়েছিল। শচীকে ভয় দেখাতে এক দুপুরে তার পানের বাটা থেকে একটা পান অল্প চিবিয়ে হাত-পা খিঁচিয়ে চোখের মণি উল্টে গোরা বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার অভিনয় শুরু করতে, শচী হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়শিদের ডাকতে যাওয়ার মুহূর্তে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বয়স্ক মানুষের মতো গোরা গম্ভীর গলায় মাকে বলল, এখন থেকে তুমি একাদশীর দিন ভাত খেও না।
শচী সহজ, সরল গৃহবধূ। চিরকাল হুকুম মেনে এসেছে। সাত বছরের ছেলের শরীরে কোনও দৈবী আত্মা ভর করেছে ভেবে দু’হাত জুড়ে করুণ গলায় বলল, আজ থেকে আপনি যা হুকুম করবেন, মেনে চলব।
একই রকম গম্ভীর গলায় গোরা তখন বলল, একাদশীতে তুমি কখনও উপোস করতে পারবে না।
শচী বলল, তাই হবে।
মনে রেখ।
কথাটা বলে গোরা খিলখিল করে হেসে উঠতে শচী টের পেল, ছেলে এতক্ষণ অভিনয় করছিল। পাথরের মতো প্রাণহীন, টানটান শরীরে এক দুপুরে ঘরের মেঝেতে শুয়ে মৃতের ভূমিকায় অভিনয় করে শচীকে চমকে দিয়েছিল। ঘরে, বাইরে ছেলের কাণ্ড দেখে শচী যখন ভয়াতুর, তখন সবচেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটালো গোরা। শ্মশান থেকে কয়েকটা হাঁড়ি, কলসি এনে বাড়ির পাশে আঁস্তাকুড়ে হাঁড়ির ওপর কলসি সাজিয়ে, কলসির পেটের ওপর হাঁড়ি রেখে তার চূড়ায় বসে, উঁচু গলায় হাঁক পেড়ে মাকে ডাকল। ঘরের ভেতর থেকে ত্রস্ত পায়ে শচী বেরিয়ে আসার সঙ্গে দু’চারজন পড়শিও নিজেদের উঠোনে এসে দাঁড়াল। শ্মশান থেকে হাঁড়ি, কলসি আঁস্তাকুড়ে এনে তার ওপর বসে থাকার বিবরণ শচীকে শুনিয়ে গোরা বলল, ছেলেকে লেখাপড়া না শেখালে সে এরকম কুকীর্তি করে বেড়ায়।
গোরার দুঃসাহস দেখে প্রতিবেশীরা আঁতকে উঠলেও তাকে মূর্খ করে রাখার জন্যে জগন্নাথকে দুষতে থাকল অনেকে। শচীর বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার দশা। মা আর পড়শিদের অনুরোধে শ্মশানের হাঁড়ি, কলসি যথাস্থানে রেখে গঙ্গায় স্নান সেরে গোরা বাড়িতে ঢুকল। দূর থেকে তাকে নজরে রেখেছিল তার মেসো চন্দ্রশেখর, শুক্লাম্বর আরও কয়েকজন। গঙ্গাদাসের টোলে গোরাকে নতুন করে না পাঠিয়ে জগন্নাথের উপায় থাকল না। শচী আর বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে গোরার ছাত্রজীবন আরও একবার শুরু হল। পঠনপাঠনের সুযোগ পেয়ে গোরার দুরন্ত প্রকৃতি অনেক শান্ত হয়ে বিদ্যাচর্চায় প্রগাঢ় হল অভিনিবেশ। জীবনের অন্তিম কাল ঘনিয়ে এসেছে টের পেয়ে, শ্বশুর নীলাম্বর চক্রবর্তীর পরামর্শ মতো গোরার উপনয়নের আয়োজন করল জগন্নাথ। গোরার বয়স তখন নয়। নিয়মমাফিক মাথা মুড়িয়ে শরীরে হলুদ, চন্দন মেখে দাঁড়ানো, ছেলের কানে গায়ত্রী মন্ত্র দিল জগন্নাথ। গোরার উপনয়ন পর্ব চুকল। উপনয়ন অনুষ্ঠানে গোরার পছন্দের যে তিনজন আমন্ত্রণ পেল, তারা ছিল বিন্নু পণ্ডিত, সুদর্শন পণ্ডিত, গঙ্গাদাস পণ্ডিত, তিনজনই, গোরার নানা বয়সে, তার শিক্ষক। দ্বিজত্ব প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে গোরার মতো বাচাল ছাত্রের গাম্ভীর্য দেখে তারা অবাক হয়েছিল। গোরাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময়ে গঙ্গাদাস জানিয়েছিল, গোরার মতো মেধাবী ছাত্রকে নিজের তত্ত্বাবধানে আর বেশিদিন না রেখে বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে পাঠানোর চিন্তা তার মাথায় এসেছে। গোরার উপনয়ন অনুষ্ঠান শেষ হলে জগন্নাথ মিশ্রের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবে। গোরার উচ্চশিক্ষা নিয়ে তখনই জগন্নাথের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ গঙ্গাদাস পেল না। ব্রাহ্মণ্য আচার হিসেবে গোরাকে সাতদিন গৃহবন্দি থাকতে হল। তার মধ্যে জগন্নাথের পরিবারে এমন কিছু উটকো কাণ্ড ঘটল যে, শচী, জগন্নাথ, দু’জনের কেউ সেগুলোর কিনারা করতে পারল না।
বালক বয়স থেকে মায়ের পানের বাটা থেকে সেজে রাখা পান যখন তখন খেয়ে গোরার পান খাওয়ার নেশা হয়েছিল। পান চিবিয়ে মৃগী রোগের ভান করে একবার সে ভয় দেখিয়েছিল মাকে। দ্বিতীয়বার, একই ঘটনা উপনয়নের কয়েকদিন পরে ঘটলো। উপনয়ন অনুষ্ঠানে তার ভিক্ষের ঝুলিতে এক সন্ন্যাসী দান হিসেবে যে সুপুরি দিয়েছিল, সেই দুপুরে পানের মধ্যে সেই সুপুরির কুঁচো খেয়ে গোরা বেহুঁশ হয়ে গেল। জ্ঞান হারানোর আগে এবার কিন্তু তার শরীরে খিঁচ ধরল না, গলা দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ, মুখ থেকে লালা বেরলো না, দাওয়ার ওপর অসম্ভব শান্তভাবে পড়ে থাকল তার অচেতন, নিস্তেজ শরীর। গোরার শরীরে কোনও অস্থিরতা না দেখে শচীও কেঁদেকেটে পাড়া মাথায় তুলল না। গোরার মুখে জলের ছিটে দিয়ে অল্প সময়ে তার হুঁশ ফেরালো। চোখ খুলল গোরা। অনেক দূরে দিগন্তের কোলে তার দৃষ্টি। তার সামনে শচী বসে থাকলেও সে যেন দেখতে পাচ্ছে না। শচীকে দেখলেও সে যেন তার মা নয়, অচেনা কোনও স্ত্রীলোক। তাকে গোরা বিড়বিড় করে বলল, মা, এই দেহ ছেড়ে এখন আমি চললাম। সময় হলে গান শোনাতে ফিরে আসব। তোমার ছেলেকে ঠিকমত প্রতিপালন করো।
কথার মধ্যে গোরার দু’চোখের বিভোরতা কেটে গিয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে এল। সামনে হতভম্ব হয়ে বসে থাকা মাকে জিজ্ঞেস করল, হাঁ করে তুমি কেন দেখছো আমাকে? আমি কি অন্যায় কিছু করেছি?
শচী বলল, দুষ্টু ছেলে, আবার নাটক করছিস?
কী করলাম আমি?
গোরার প্রশ্ন শুনে একটু আগের ঘটনা তাকে বলল শচী। চুপ করে গোরা বসে থাকল। কিছুদিন আগের অভিনয়ের ঘটনা, তার নিজের অজান্তে পুরনাবৃত্ত হবে, সে ভাবেনি। জগন্নাথকে ঘটনাটা জানাতে শচীকে গোরা নিষেধ করলেও, স্বামীকে না বলে শচী পারল না।
রাতে খেতে বসে ছেলের কাছে জগন্নাথ দুপুরে কী ঘটেছিল জানতে চাইলে বাবাকে শোনানোর মতো কোনও বৃত্তান্ত গোরা মনে করতে পারল না। জগন্নাথ ভয় পেলেও সে আভাস না দিয়ে বলল, গান গাওয়াতে সুলতানের নিষেধাজ্ঞা আছে। সাবধান, গঙ্গার ঘাটে বসে উঁচু গলায় কখনও গান গাসনি। কোটালের কাছে খবর গেলে তোকে আস্ত রাখবে না।
এক মুহূর্ত থেকে গলা নামিয়ে জগন্নাথ বলল, সব ব্রাক্ষ্মণপল্লীতে পাষণ্ডিরা রয়েছে। ধর্ম বলতে তারা বোঝে আচার বিচার, ফাঁকিবাজি ন্যায়, যুক্তি, সব শুষ্কং কাষ্ঠং, প্রেমভক্তি, সঙ্গীত, নৃত্যকলার তারা ঘোর বিরোধী। আর আছে পঞ্চ ‘ম’-এ আসক্ত অঘোরপন্থী তান্ত্রিকরা। সুলতানকে তারা তাতাচ্ছে।
গোরা বলল, নবশাকপাড়ায়, শূদ্রপাড়ায় গান নিয়ে কোনও বাধানিষেধ নেই। সেখানে যে কতরকম গান হয়! আমিও গাই তাদের সঙ্গে।
কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে জগন্নাথ বলল, গানের জন্যে ম্লেচ্ছ, শূদ্রপল্লীতে না যাওয়াই ভাল। আমার ইচ্ছে, উপনয়নের পরে, আপাতত তিনমাস, গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠীতে যাওয়া তুমি বন্ধ রাখো।
গোরা চুপ। বাবার কথার জবাব দিল না। ন’বছর বয়সে রীতিমত পরিণত তার মাথা বাবার ফরমান মানা না মানা, তার ওপর নির্ভর করছে, সে জানে। বাস্তবিক তাই। বিধিমত সাত দিনের বদলে পনেরো দিন গৃহবন্দি থেকে চতুষ্পাঠীতে যেতে শুরু করল গোরা। গোরার মারফৎ জগন্নাথকে দেখা করার খবর পাঠাল গঙ্গাদাস। বর্ষার এক প্রদোষকালে গঙ্গাদাসের সঙ্গে জগন্নাথের কী কথাবার্তা হল, গোরা কানে না শুনলেও অনুমান করতে পারল। সে জানে, জগন্নাথ মরে গেলেও বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে তাকে পাঠাবে না। শাস্ত্রপাঠ নিয়ে জগন্নাথের ভয় এ জীবনে কাটবে না। সংসার ছেড়ে বড় ছেলের চলে যাওয়ার ঘটনা থেকে যে শিক্ষা সে পেয়েছে, তা সাংঘাতিক। শাস্ত্র শিক্ষাতে ঘেন্না ধরে গেছে তার। ছোট ছেলেকে ব্যাকরণ-শিক্ষিত পণ্ডিতের চেয়ে বাড়তে দেবে না। গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠীতে আরও তিন বছর তাকে ‘কলাপ’ পড়িয়ে ব্যাকরণের পণ্ডিত হিসেবে অধ্যাপনায় লাগিয়ে দেবে। গোরার বিয়ে দিয়ে ঘরে পুত্রবধূ না আনা পর্যন্ত তার মরার সময় হবে না। গোরার বয়স তখন এগারো, সত্তরের কাছাকাছি জগন্নাথ, শচী পঞ্চান্ন। অসুখবিসুখে প্রায়শ ভুগলেও এই সময়টা সুখে কাটছিল জগন্নাথের। চোখের সামনে চড়চড় করে বেড়ে উঠছিল গোরা। সমবয়সিদের তুলনায় ছেলেবেলা থেকে সে একহাত বেশি লম্বা। এগারো বছর বয়সে তার উচ্চতা, শরীর স্বাস্থ্য দেখে মনে হত একুশ বছরের যুবক। যেমন লম্বা, চওড়া, মজবুত স্বাস্থ্য, তেমনি রূপবান অক্লান্ত পরিশ্রম করলেও ঝিমিয়ে পড়ে না। গায়ে অশ্বের শক্তি। মাথা বোঝাই ঘন কালো চুল, ডাগর, গভীর চোখ, খাঁড়ার মতো নাক, শক্ত ছুঁচোলো চিবুক, দুধে আলতায় মেশানে গায়ের রং, গোরাকে দেখলে মনে হয়, এ পৃথিবীর কেউ নয় সে, ভোরের আকাশ থেকে মাটিতে খসে পড়েছে। সুন্দর তনু ছেলের জন্যে গৃহদেবতার কাছে জগন্নাথ যে প্রার্থনা করত, আমার ছেলেকে ডাকিনী না স্পর্শ করে’, তা একবার আড়াল থেকে শুনে গোরা লজ্জায় দাওয়া ছেড়ে সরে গিয়েছিল। সচ্ছলতা না থাকলেও সংসারে যখন শান্তি রয়েছে, তখনই রোগে পড়ল জগন্নাথ। সান্নিপাতিক জ্বরে ধরল তাকে। মুরারির আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় যখন রোগের নিরাময় হচ্ছে না, প্রিয়তম সন্তানকে এক সকালে ডেকে নিজের অন্তর্জলি যাত্রার ব্যবস্থা করতে বলল জগন্নাথ। গঙ্গার জলে অর্ধেক শরীর ডুবিয়ে শুতে চাইল। স্বামীর কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল শচী। মাকে শান্ত করে অসুস্থ বাবার শীর্ণ শরীর, গোরা একা ঘাড়ে তুলে গঙ্গার ধারে নিয়ে এল। স্বামীর পা ছুঁয়ে থাকল শচী। এগারো বছরের বালক, এক সত্তর বছরের মানুষকে ঘাড়ে তুলে অন্তর্জলি করাতে গঙ্গায় নিয়ে যাচ্ছে এমন ঘটনা দেখতে নবদ্বীপের রাস্তায় ভিড় জমে গেল। সঙ্গীদের ঘনঘন হরিধ্বনির সঙ্গে গোরা নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়তে থাকল। অন্তর্জলিতে শচী, গোরার সঙ্গী হয়েছিল চন্দ্রশেখর, বৈদ্য মুরারি, ঘরের পরিচারক ঈশান। গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত বাবাকে গোরা একা কাঁধে বয়ে নিয়ে এসে, ঘাট থেকে কিছুটা দূরে, পাড়ের ওপরে যেখানে ঈশান খেজুরপাতার চাটাই বিছিয়ে দিয়েছে, সেখানে শুইয়ে দিল। জগন্নাথের হাঁটু পর্যন্ত গঙ্গার জলে ডুবে থাকল। জোয়ারে গঙ্গার ঢেউ থেকে থেকে জগন্নাথের কোমর পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছিল। অন্তর্জলি যাত্রার শেষ মহূর্তগুলোতে দু’চোখ খুলে মুহূর্তের জন্যে অপলকে গোরার মুখ দেখছিল জগন্নাথ, আকাশ দেখছিল, হরিনাম জপ করছিল দুর্বোধ্য স্বরে। শব্দহীন কান্নায় ভেসে যাচ্ছিল শচীর মুখ। তাকে সামলাচ্ছিল চন্দ্রশেখর। গঙ্গার জলে শরীরের হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখা জগন্নাথকে আঁকড়ে ধরে তার মুখের ওপর নজর রেখে কাত হয়ে গোরা বসেছিল। জীবনে এই প্রথম মৃত্যু দেখছে সে। শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত বাবাকে ধরে বসে থাকতে হবে তাকে। সে শুনেছে, শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার আগে বুকের ভেতর বাতাস ফুরিয়ে আসতে থাকলে সেখান থেকে ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোতে শুরু হয়। মুমূর্ষু মানুষটা বাতাসের অভাবে হাঁকপাক করতে থাকে। তখন সে ভারি কষ্ট পায়। পুণ্যবান মানুষের ভোগান্তি কম হয়। পাপীতাপী লোক বেশি কষ্ট পায়। ন্যায়শাস্ত্রীদের এত সব প্রচার গোরা বিশ্বাস না করলেও, তার ধারণা, বাবা জগন্নাথ মিশ্র এমন কোনও গর্হিত কাজ করেনি যে অন্তর্জলিতে এসে তাকে দীর্ঘসময় ভুগতে হবে।
গঙ্গায় ডুবিয়ে রাখা বাবার আধখানা শরীর আঁকড়ে ধরে, কয়েকদিন আগে, জ্বর বিকারের ঘোরে তার বলা কয়েকটা কথা গোরার মনে পড়ল। মাঝ রাতে প্রলাপের মধ্যে স্থির চোখে কিছু মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে জগন্নাথ বলেছিল, ওই তো বিশ্বরূপ চলেছে বুরহানউদ্দিনের মাজারের দিকে। সংসারে ওর ঘেন্না ধরে গেছে, তাই ও সংসার করবে না। মুজাভিরকে ধরে বিশ্বরূপ কী করবে, তা ও-ই জানে। আমার নরম মনের ছেলেটা, মনে হয়, কোনও গোলমালে পড়বে না।
দু’চোখে আতঙ্ক নিয়ে স্বামীর মুখের দিকে শচী তাকিয়েছিল। ঘর ছেড়ে বিশ্বরূপ যে বুরহানউদ্দিনের মাজারে গিয়েছিল জগন্নাথ জানল কীভাবে? কথাটা শচী প্রথম শুনল। ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল তার দু’চোখের মণি। তেমন কিছু ঘটার আগে থেমে গিয়েছিল জগন্নাথের বিকারের বকুনি। রাত বাড়ছিল। নিমগাছ থেকে একটা পেঁচা ডাকতে ডাকতে বেনেপাড়ার দিকে উড়ে গিয়েছিল।
জলের ঢেউ এসে জগন্নাথের কোমর পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে যাওয়ার সঙ্গে গোরার পা দুটো প্লাবিত করছিল। এগারো বছরের কিশোর গোরা ভাবছিল, পাঁচ বছর আগে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া বিশ্বরূপ সম্পর্কে বিকারের ঘোরে বাবা যে কথাগুলো বলেছিল, তা কতটা সত্যি? সংসার ছেড়ে দাদা কেন সিলেটে বুরহানউদ্দিনের মাজারে যাবে? বিকারের ঘোরে বাবা কেন কথাটা বলল? প্রলাপের মধ্যে যদি কিছু সত্য থাকে, তাহলে পাঁচ বছর বাবা কেন কথাটা চেপে ছিল?
মনের মধ্যে ধোঁয়ার মতো নানা জিজ্ঞাসা পাক খেতে থাকলেও জবাব খুঁজে বার করা গোরার পক্ষে দুষ্কর হল। জগন্নাথের সৌভাগ্য, অন্তর্জলি যাত্রা থেকে তাকে কাঁধে নিয়ে গোরাকে বাড়ি ফিরতে হল না। জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃয়াষ্টমী তিথির সন্ধেতে আধনাভি গঙ্গাজলে ডুবিয়ে ইষ্টদেবতার নাম জপের মধ্যে সজ্ঞানে লোকান্তরিত হল জগন্নাথ। মৃত্যুর আগে গোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল, বাবা, আমাকে ভুলিস না। মা রইল, তাকে দেখিস।
মায়ের সঙ্গে গোরা সমান তালে কাঁদলেও তার মনে হল, অনেক রহস্য ধামা চাপা দিয়ে রেখে জগন্নাথ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।
জগন্নাথের পারলৌকিক কাজ শেষ হওয়ার অল্পদিন পর থেকে শচী টের পেল পিতৃহীন গোরাকে নিয়ে সংসার চালাতে অসুবিধে হচ্ছে। গোরাকে চতুষ্পাঠীতে পাঠানো, লেখাপড়ার খরচ চালানোর সঙ্গে ঈশানের দু’বেলা খোরাকি জোগান দেওয়া সঞ্চয়হীন বিধবার পক্ষে সম্ভব নয়। শচীর পাশে এসে অবশ্য দাঁড়িয়েছিল তার বাবা নীলাম্বর চক্রবর্তী, দু’ভাই, দাদা যজ্ঞেশ্বর, ছোটভাই, রত্নগর্ভ। নীলাম্বরের বয়স আশি পেরলেও মেয়ের সংসারের দায়, পরম স্নেহে মাথা পেতে নিয়েছিল। হতভাগিনী যে মেয়ে নিজের পেটের আট কন্যার মৃত্যু সহ্য করেছে, যার বড় ছেলে ষোলো বছর বয়সে নিরুদ্দেশ হয়েছে, স্বামী সদ্যপ্রয়াত, এগারো বছরের একমাত্র ছেলে নিয়ে যে অসহায় বৈধব্যজীবন কাটাচ্ছে, তার জন্যে বৃদ্ধ নীলাম্বরের মন সবসময়ে ব্যাকুল হয়ে থাকে। মেয়ে, নাতিকে নিজের সংসারে নীলাম্বর রাখতে চাইলেও শচী আসেনি। নীলাম্বর জানত, এটা ঘটবে, এটা স্বাভাবিক, শচী রাজি হবে না। স্বামীর ঘর ছেড়ে শচী কেন বাপের বাড়িতে চলে আসবে? পিতৃহীন, ন্যাড়ামুণ্ড কিশোর গোরাকে নিয়ে এক সকালে গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠীর দরজায় গিয়ে দাঁড়াল শচী। গঙ্গাদাসকে বলল, অনাথ এই ছেলেকে লেখাপড়া শেখানোর ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনার চতুষ্পাঠী থেকে আপনি সন্তুষ্ট মনে আমার সন্তানকে অব্যাহতি দিন।
গঙ্গাদাস জানত এরকম ঘটবে। সংসারের অসচ্ছলতার কারণে গোরাকে লেখাপড়া শেখানো স্বামীহারা শচীর পক্ষে সম্ভব নয়। জগন্নাথ বেঁচে থাকতে গোরাকে বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে ন্যায়শাস্ত্র পড়ানোর যে ছক গঙ্গাদাস করে রেখেছিল, এতদিনে তা সফল হতে চলেছে অনুমান করে সে খুশি হল। ন্যায় আর স্মৃতিশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষার জন্য নবদ্বীপ রাজকোষের বরাদ্দ তহবিল থেকে গোরার পড়ার জন্যে জলপানি জোগাড় করতে অসুবিধে হবে না, শচীকে কথাটা জানিয়ে দিল গঙ্গাদাস। সার্বভৌমের আশ্বাস, আগেই আদায় করে রেখেছিল সে। টাকার অভাবে গোরার মতো মেধাবী ছাত্রের উচ্চশিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যাবে, নবদ্বীপের শিক্ষাবিদ, বিদ্যোৎসাহীরা বেঁচে থাকতে তা হবার নয়, সজোরে জানিয়েছিল গঙ্গাদাস।
গুরু গঙ্গাদাসের প্রতি কৃতজ্ঞতায় খুশিতে ডগমগ গোরা প্রতিজ্ঞা করেছিল ‘গঙ্গাদাস’ নামে পোষা কুকুরটাকে আর মিঠাই, মণ্ডা খাওয়াবে না, লাই দিয়ে মাথায় তুলবে না। মেঘ না চাইতে জল পেয়ে, বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে ন্যায়শাস্ত্র পড়ার সুযোগ এসে যেতে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল সে। অর্থের অভাবে গোরার লেখাপড়া আপাতত বন্ধ হচ্ছে না জেনে শচী স্বস্তি পেয়েছিল। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংসারের দায় গোরাকে নিতে হবে, এটাও শচী জানত। কথাটা শচী জানাতে গোরা সায় দিয়ে বলেছিল, সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে খুব বেশি পাঁচ বছর ন্যায়শাস্ত্র পড়ে ষোলো বছর পূর্ণ হওয়ার আগে নিজে চতুষ্পাঠী খুলবে সে। সংসারের সব দায়িত্ব নেবে। তার কথা শুনে দাঁত টিপে পাঁচ বছর সংসারের হাল ধরে থাকার শপথ নিয়েছিল শচী। যাই ঘটুক, নিজের পায়ে গোরা না দাঁড়ানো পর্যন্ত সংসারটা সে ভেসে যেতে দেবে না। গঙ্গাধরের চতুষ্পাঠীতে ব্যাকরণের ‘কলাপ’ অধ্যায় শেষ করে, বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে যোগ দেওয়ার আগে, ন্যায়ের প্রাথমিক পাঠ নিয়ে নিজেকে কিছুটা তৈরি করে রাখতে চাইল গোরা। মনের ইচ্ছেটা গঙ্গাদাসকে জানাতে সানন্দে সে রাজি হল গোরাকে ন্যায় পড়াতে। গঙ্গাদাসের কাছে ন্যায়শাস্ত্র পড়ার তৃতীয় মাসে আচম্বিতে নবদ্বীপ ছেড়ে, বলা যায়, স্থায়ীভাবে কলিঙ্গ রাজের পাঠানো রাজকীয় শিবিকাবহরে চেপে সপরিবারে পুরীতে চলে গেল বাসুদেব সার্বভৌম। নবদ্বীপের চারপাশের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হওয়ায় সেখানে থাকতে বাসুদেব সাহস পাচ্ছিল না। কলিঙ্গরাজ প্রতাপ রুদ্রের আমন্ত্রণে নবদ্বীপের মতো দেশবিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র ছেড়ে সেখানের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত, বাসুদেব সার্বভৌম চিরকালের মতো চলে যেতে পথেঘাটে হাহাকার উঠলেও তা থেমে যেতে সময় লাগল না। রঘুনাথ শিরোমণির মতো নৈয়ায়িকরা তখন নবদ্বীপে চতুষ্পাঠী খুলে জাঁকিয়ে বসেছে। বিখ্যাত মৈথিল নৈয়ায়িক পণ্ডিত পক্ষধর মিশ্রকে ন্যায়শাস্ত্রের আলোচনায় কয়েক বছর আগে রঘুনাথ হতমান করে দেওয়ার পর দেশজুড়ে তার জয়জয়কার উঠেছিল। বাসুদেব সার্বভৌমের ছাত্র রঘুনাথের কাছে গোরাকে ন্যায়শাস্ত্র পড়তে পাঠানোর চিন্তা গঙ্গাদাসের মাথায় এলেও রাজকোষ থেকে তার পড়ার খরচ, জলপানির ব্যবস্থা করা যাবে কিনা, ভেবে পেল না। শচীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গঙ্গাদাস গোরার জলপানির ব্যবস্থা করতে নতুন করে ছুটোছুটি শুরু করে দিল। তার দৌড়ঝাঁপ ব্যর্থ হল না। রঘুনাথের চতুষ্পাঠীতে গোরার পড়ার আয়োজন পাকা করল সে। সার্বভৌমের কাছে ন্যায়শাস্ত্র পড়ার সুযোগ না পেয়ে গোরা বিশেষ বিমর্ষ হল, এমন নয়। সার্বভৌমের ছাত্র, বিখ্যাত নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠীতে জায়গা পাওয়ার জন্যে গোরা যেন অপেক্ষা করছিল। গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠীতে দ্বিতীয় দফায় তিন মাস ন্যায়শাস্ত্র পড়ার পরে গঙ্গাদাস খবর আনল, গোরার ন্যায়শাস্ত্র পাঠের জন্যে রাজকোষ থেকে জলপানি মঞ্জুর হয়েছে। রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠীতে জায়গা হয়েছে গোরার। সাতাশে বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সকাল থেকে ন্যায়শাস্ত্রের আচার্য রঘুনাথ শিরোমণির কাছে শুরু হল, গোরার পঠনপাঠন। গোরা হিসেব করে দেখল, ঠিক এক বছর আগে বাবাকে সে হারিয়েছে। মৃত্যুর আগে মানুষটা কিছু রহস্যের জট তৈরি করে গেলেও বাবা হিসেবে অসম্ভব স্নেহশীল ছিল। বাবার কথা মনে হলে তার চোখে জল আসে। গোরার মতো মেধাবী, শ্রুতিধর ছাত্র পেয়ে রঘুনাথ যেমন খুশি হল, তেমনই রঘুনাথ শিরোমণির মতো অনন্যসাধারণ শিক্ষক পেয়ে গোরা বর্তে গেল। বৈষ্ণবসমাজের মধ্যে থাকলেও বৈষ্ণবদের নিয়ে ঠাট্টা, তামাসা করতে গোরার আটকাতো না। নৈয়ায়িক আর স্মার্তদের কঠোর হিদুয়ানির কড়া সমালোচনা করত। ভেতরে ভেতরে বর্ণাশ্রম প্রথার ঘোর বিরোধী হয়ে উঠেছিল সে। ম্লেচ্ছ, শূদ্রসমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার জন্যে পাড়ার বৈষ্ণব মতবাদী ব্রাহ্মণরা তাকে যখন ছ্যা ছ্যা করছে, সে থাকত নির্বিকার, অচঞ্চল। মুচকি হেসে কখনও বলত, ‘গুরুচণ্ডালি দোষ’ করলেও মাথায় বাজ পড়ে আমি মরব না। গুরু চণ্ডালে মেলামেশা শুরু হলে, সেটা আর দোষ থাকবে না, পুণ্যকর্ম হয়ে দাঁড়াবে।
গোরার মুখে ‘গুরুচণ্ডালি দোষ’ শব্দটা যারা শুনল, তারা টের পেল, এ শব্দ আগে শোনেনি, গোরার তৈরি এই শব্দ তারাও বলতে থাকল।
গঙ্গাদাসের কাছে ব্যাকরণ শিক্ষার পরে, এক বছর ন্যায়ের পাঠ নিয়ে গোরা যতটা বিদ্যার্জন করেছিল, মনের অভ্যন্তরে, আত্মানুশীলনে তার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল বেশি। মগজে গড়ে উঠছিল বড় জ্ঞানভাণ্ডার। গঙ্গাদাসের তত্ত্বাবধানে ব্যাকরণ পড়ার সময়ে শাস্ত্রের নিয়মবিধি নিয়ে সে যেমন একটা টিপ্পনি লিখেছিল, রঘুনাথের ছত্রছায়ায় ছ’মাস ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষানবীশীর জেরে ন্যায়দর্শন নিয়ে অন্তঃকরণ থেকে উঠে আসা কিছু গভীর বয়ান, নথিবদ্ধ করতে থাকল। গঙ্গাদাসের কাছে ন্যায়শাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠ অনেকটা সেরে রাখার ফলে রঘুনাথের ব্যাখ্যা বুঝে গোরার ন্যায় শিক্ষার কাজ তরতর করে এগোচ্ছিল। বিশ্বরূপ যেমন দশ বছর বয়সে শুরু করে বারো বছরে পা দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি শাস্ত্র লেখার কাজ শেষ করেছিল, গোরাও তেমনই, দাদার লেখা শাস্ত্রের খবর না জেনেও রঘুনাথের চতুষ্পাঠীতে ন্যায়শাস্ত্র পড়ার সঙ্গে ন্যায়শাস্ত্র সম্পর্কে যে টিকাভাষ্য লিখে চলেছিল, তা একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের আকার নিচ্ছিল। পাঠগ্রহণের সময়ে গোরা হঠাৎ এমন কিছু মন্তব্য করত, যা শুনে সহপাঠীদের সঙ্গে নবদ্বীপে সেই সময়ের উজ্জ্বলতম অধ্যাপক পর্যন্ত কেঁপে উঠত। রঘুনাথ তখন স্বরচিত ন্যায়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পুঁথি ‘অনুমানদীধিতি’ ছাত্রদের পড়াতে শুরু করেছিল। উপস্থাপনা পর্ব শেষ করে মূল তত্ত্বে ঢোকার আগে এক সন্ধেতে গোরাকে একান্তে পেয়ে রঘুনাথ বলেছিল, ন্যায় বিষয়ে তোর টিকা-টিপ্পনি যত্ন করে লিখে রাখ। পরে কাজ দেবে।
গোরা জানিয়েছিল, ইতিমধ্যে লেখা শুরু করেছে সে। যা লিখেছে, তার আকার একটি পুঁথির চেয়ে কম নয়, এ খবরও দিয়েছিল আচার্যকে। রঘুনাথ যতটা অবাক হয়েছিল, গোরার পুঁথি পড়ার আগ্রহ জেগেছিল তার দশগুণ। চতুষ্পাঠীর বাইরে গঙ্গার ধারে নির্জন গাছতলায়, পরের দিন দুপুরে গুরু-শিষ্য মুখোমুখি বসেছিল। রঘুনাথের কাছে গোরা ন্যায় অধ্যয়ন শুরু করার পরে এক বছর কেটে গেছে। সাড়ে চার হাতের বেশি লম্বা, পাকা সোনার মতো গায়ের রং, ছাত্রটি শুধু আকৃতি নয়, প্রকৃতিতেও যে সহপাঠীদের চেয়ে আলাদা, অল্পদিনে রঘুনাথ বুঝে গিয়েছিল। বারো-তেরো বছরের এই কিশোরের সঙ্গে বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, সর্বোপরি দৈহিক শক্তিতে বাইশ, চব্বিশ বছরের যুবক এঁটে উঠতে পারবে না। রঘুনাথ তার এই বাহান্ন বছর বয়সে এমন মুক্তমনা, সত্যবাদী ছেলে দেখেনি। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের নামে ‘কুকুর’ পোষা থেকে শুরু করে ম্লেচ্ছ, শূদ্রদের সঙ্গে তার মেলামেশা, তাদের দাওয়ায় বসে খাওয়া দাওয়া, এমনকী খোলাবেচা শ্রীধরের সব্জির পসরা থেকে দাম না দিয়ে থোড়, মোচা তুলে নিয়ে আসা পর্যন্ত সব ঘটনা রঘুনাথকে সে শুনিয়েছে। গোরার কাহিনী শুনে তাকে চতুষ্পাঠী থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার উদগ্র ইচ্ছে জাগলেও রঘুনাথ তা পারেনি। কেন পারেনি, সে জানে। বালকটির সত্যবাদিতা নিবৃত্ত করেছে তাকে। ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মবিধ্বংসী শক্তি নিয়ে গোরা জন্মেছে, টের পেয়েও শাস্ত্র মেনে তার শাস্তিবিধান করতে রঘুনাথের বুক কেঁপেছে। সবচেয়ে বড় কথা ছাত্রটি অসাধারণ মেধাবী আর শ্রুতিধর। শাস্ত্রপাঠের সময়ে রঘুনাথ পাঁচটি শ্লোক উপস্থাপনার জন্যে আবৃত্তি করলে, শ্লোকগুলো গোরার কণ্ঠস্থ হয়ে যায়। চতুষ্পাঠী থেকে গোরাকে তাড়ানো দূরের কথা, তার নানা অপকর্ম শুনে তাকে তিরস্কার করার প্রবৃত্তিও রঘুনাথের মন থেকে লুপ্ত হয়। ন্যায়শাস্ত্র গিলে খাচ্ছে এই শ্রুতিধর। রঘুনাথ টের পায় সে তার সম্ভাব্য হত্যাকারীকে দুধকলা দিয়ে পুষছে। তার পাণ্ডিত্যকে অদূর ভবিষ্যতে এই ছাত্রটি ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে কতটা সে এগিয়েছে, ন্যায়শাস্ত্রের ওপর লেখা তার টিকা-টিপ্পনি পড়ে রঘুনাথ জেনে নিতে চায়।
গঙ্গার নির্জন তীরে, গাছতলায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের মুখোমুখি বসে গোরা টের পাচ্ছিল, পণ্ডিতপ্রবর রঘুনাথ শিরোমণি যে কোনও কারণে অস্বস্তি বোধ করছে। কারণ অনুমান করতে তার অসুবিধে হল না। সবিনয়ে সে প্রশ্ন করেছিল, একটা নৌকো নিয়ে মাঝগঙ্গায় চলে গেলে কেমন হয়? সেখানে লগিতে নৌকো বেঁধে পুঁথি শোনাবো।
—নৌকো পাবি কোথায়?
—ঘাটে এখন অনেক নৌকো।
—কে নৌকো দেবে তোকে?
—পেয়ে যাব।
—নৌকোর মাঝি যেন থাকে।
—তাকে শুদ্ধ নিয়ে আসব।
মধ্যবয়সি মানুষের মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে গোরার কথা বলার ভঙ্গি রঘুনাথ চিনে গেছে। সে আরও জানে, গোরা যা বলেছে, তা করবে।
ছাত্র সম্পর্কে অধ্যাপকের মূল্যায়নে ভুল যে হয়নি, এক ঘণ্টা বাদে মাঝগঙ্গায় স্থির হয়ে দাঁড়ানো একটা নৌকো দেখে বোঝা গেল। নৌকোর মধ্যে ফ্যাকাসে মুখে বসে রঘুনাথ শিরোমণি শুনছে ন্যায়শাস্ত্র সম্পর্কে গোরার লেখা টিকা-টিপ্পনির পুঁথি। গোরার খেয়াল নেই, তার ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক, তার পুঁথির শ্রোতা, সামনে বসে আছে। তন্ময় হয়ে পুঁথি পড়ার মধ্যে গোরা শুনল, গাঢ়, গভীর দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ। অভিনিবেশ ভাঙল তার। সামনে তাকিয়ে অধ্যাপকের বিরস, মলিন মুখ দেখে ঈষৎ থতমত খেয়ে সে জিজ্ঞেস করল, আমি কি কোনও অপরাধ করেছি?
শুকনো হেসে রঘুনাথ বলল, তোর কোনও অপরাধ নেই, অপরাধ আমার।
গোরা বিস্মিত, চুপ।
অধ্যাপক বলল, তোর আর ‘অনুমানদীধিতি’ পড়ার দরকার নেই। একটা শ্লোকে আমি সেখানে যা ব্যাখ্যা করেছি, দু’একটা টিকা-টিপ্পনিতে তুই তা লিখে ফেলেছিস। অনেক দূর এগিয়ে গেছিস তুই। বাসুদেব ভট্টাচার্য সার্বভৌম এখন তোর একমাত্র শিক্ষক হতে পারে, আমি নই।
রঘুনাথ শিরোমণির কথা বলার ভঙ্গিতে, কণ্ঠস্বরে মিশে থাকা বিষাদ গোরাকে এত নাড়া দিল যে মুহূর্তের মধ্যে, রঘুনাথ কিছু বোঝার আগে হাতের পুঁথি সে গঙ্গায় ফেলে দিল। হা হা করে তাকে ঠেকাতে গিয়ে রঘুনাথ দেখল, জলে ভেসে যাচ্ছে গোরার লেখা মূল্যবান পুঁথি। নৌকোর মাঝি, গলুই-এ বসে তামাক খাচ্ছিল। গঙ্গায় বিসর্জিত পুঁথি তুলে আনতে থেলো হুঁকো নামিয়ে রেখে সে যখন জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, তাকে ঠেকাল গোরা। বলল, পুঁথি তোলার দরকার নেই।
গঙ্গায় ঢেউ-এ ভাসতে ভাসতে চোখের আড়ালে চলে গেল পুঁথি। গোরা দেখল, পরমপণ্ডিত, রঘুনাথ শিরোমণির দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সস্নেহে ছাত্রের মাথায় হাত রেখে রঘুনাথ জিজ্ঞেস করল, এটা কি করলি তুই? কী ভাঙিয়ে ভবিষ্যতে তুই খাবি?
গোরা বলল, ব্যাকরণের টিকা-টিপ্পনির একটা পুঁথি আমি লিখেছিলাম। সেটা বাড়িতে রয়েছে। ব্যাকরণশিক্ষার একটা চতুষ্পাঠী খুললে আমার ভরণপোষণ চলে যাবে। আমি সে সব নিয়ে এখন ভাবছি না। শিক্ষাগুরুকে কাঁদানোর জন্যে আমার অনুতাপ হচ্ছে। গুরুমারা বিদ্যে জাহির করার জন্যে আমি প্রায়শ্চিত্ত করব। সন্তানতুল্য গোরার মুখে ‘গুরুমারা বিদ্যে’ শব্দবন্ধটা শুনে রঘুনাথের দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। বাংলায় এমন শব্দবন্ধ আগে সে শোনেনি। কথাটা তার কানে আটকে থাকল। রঘুনাথ বলল, তুই কোনও পাপ করিসনি। তোর প্রায়শ্চিত্ত করার প্রশ্ন ওঠে না। আমি আশীর্বাদ করছি, তোর ছায়ায় এলে হাজার হাজার পাপীতাপী পাপমুক্ত হবে, শুদ্ধ, পবিত্র হবে।
গোরার দু’চোখ দিয়ে টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়তে লাগল। তাকে শান্ত করতে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সঙ্গে রঘুনাথ পুরনো দিনের নবদ্বীপের গল্প ফাঁদল। বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে তার সহপাঠী গৌড়ের সুলতানি দরবারের দবীরখান, সাকর মল্লিক, যাদের আসল নাম, সন্তোষ, অমর, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশকে নিয়ে নানা মজার কাহিনী শোনাল। মিথিলা থেকে ন্যায়শাস্ত্রের অনুলিপি লিখে আনা নিষিদ্ধ থাকায় নবদ্বীপ থেকে সেখানে ন্যায় অধ্যয়নে যাওয়া তরুণ ছাত্র বাসুদেব ভট্টাচার্য সম্পূর্ণ ন্যায়শাস্ত্র কণ্ঠস্থ করে নবদ্বীপে ফিরেছিল। মৈথিলি ভাষায় লেখা ন্যায়শাস্ত্রের প্রথম বাংলা অনুলিপি রচনা করেছিল বাসুদেব ভট্টাচার্য। বাসুদেব তখনও ‘সার্বভৌম’ উপাধি পায়নি। ন্যায়শাস্ত্রের বাংলা পুঁথি নবদ্বীপের পণ্ডিতমহলে হাতে হাতে ঘুরছে শুনে মিথিলার ন্যায়শাস্ত্রীদের মধ্যে হুলস্থূল পড়ে গিয়েছিল। প্রকৃত ঘটনা শুনিয়েছিল, পণ্ডিত পক্ষধর মিশ্রের বাবা পণ্ডিত পুরুষোত্তম মিশ্র। পুরুষোত্তম জানিয়েছিল, এ কাজ একমাত্র যে করতে পারে, সে তারই ছাত্র নবদ্বীপের বাসুদেব ভট্টাচার্য। ছাত্রটি শ্রুতিধর। পুরো ন্যায়শাস্ত্র স্মৃতিতে ভরে কেউ যদি নিয়ে যায়, ঈশ্বর ছাড়া কেউ তাকে ঠেকাতে পারে না। ঈশ্বর নিশ্চয় নবদ্বীপে ন্যায়শাস্ত্র চর্চা বাঞ্ছা করেন। মিথিলার সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত পক্ষধর মিত্রের ছাত্র বাসুদেব সার্বভৌম চার খণ্ড ‘চিন্তামণি’ ও ‘কুসুমাঞ্জলি’র অধিকাংশ কণ্ঠস্থ করে নবদ্বীপে ন্যায়শাস্ত্র পঠন পাঠনের কেন্দ্র, চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করেছিল। গোরার কান্না থেমেছে। অবাক হয়ে সে শুনছে কীর্তিধর নানা মানুষের আখ্যান। সূর্য পশ্চিমে ঢলতে তীরে নৌকো লাগাতে মাঝিকে নির্দেশ দিল রঘুনাথ শিরোমণি।