গোরা – ২৪

২৪

ঝড়ের বেগে নবদ্বীপে রটে গেল গয়া থেকে পাগল হয়ে গোরা ফিরে এসেছে। কেউ বলল, আধপাগল, কেউ বলল পুরো, বদ্ধ উন্মাদ। আত্মীয় বন্ধু যাকে দেখছে, তাকে হয় মারতে তেড়ে আসছে, না হয় হাঁউমাউ করে ছেলেমানুষের মতো কাঁদছে। গোরার নামে গুজব যারা রটাচ্ছিল, সবাই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জাহির করছিল নিজেদের। রটনাকারীদের কেউ কেউ বলছিল, গোরার পুরনো বায়ুরোগ ফের চাগাড় দিয়েছে। গোরার প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকজন টুলো পণ্ডিত এই সুযোগে নিমাই পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীর ছাত্র ভাগিয়ে এনে নিজেদের টোল ভরাতে নেমে পড়ল, তারা প্রচার করতে শুরু করল, আত্মীয়-বন্ধুদের চেয়ে ছাত্রদের দেখলে গোরা বেশি খেপে উঠছে। রগে রক্ত উঠে যাচ্ছে তার। থান ইট নিয়ে ছাত্রদের মারতে তাড়া করছে। স্মার্ত, নৈয়ায়িক, তান্ত্রিকদের একাংশ, যারা গোরাকে অপছন্দ করত, তারা আড়াল থেকে অপপ্রচারে ইন্ধন জোগাতে থাকল।

ছেলেদের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন হলেও গোরার ছাত্ররা কিন্তু তাদের প্রিয় গুরুকে ছেড়ে অন্য টোলে পড়তে যেতে রাজি হল না। গোরা গয়া যাওয়ার আগে নিজের চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের সাময়িকভাবে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেও তার ফেরার পথ চেয়ে ছাত্ররা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল। তাদের কাছে যষ্টিধারী অধ্যাপকের চেয়ে অনেক বেশি আপনজন ভালবাসার মানুষ, বন্ধু, দিকদর্শক শিক্ষক, নেতা হয়ে উঠছিল গোরা। ছাত্রদের মধ্যে যারা বয়সে একটু বড়, গৌড়ের সুলতানি মসনদে গোরাকে সমাসীন দেখার কল্পনা করত তারা। বাপ-ঠাকুর্দার মুখ থেকে রাজা লক্ষ্মণ সেন, রাজা গণেশ, রাজা কংস, রাজা দনুজমর্দনদেবের কিংবদন্তি মেশানো ঘটনাপরম্পরা বারবার শুনে সেই সব রাজবংশের উত্তরপুরুষের ছায়া গোরার মধ্যে তারা দেখতে শুরু করেছিল। সর্বোপরি ছিল সুলতানি শাসনবিরোধী চক্রান্তকারীর খোঁজে সিন্ধুকীবাহিনীর উপর্যুপরি নির্মম হামলা দেখার অভিজ্ঞতা। শিশু গোরাকে বন্দি করতে সুলতানি পাইকদের তাড়া করার ঘটনা, কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে গোরার আত্মরক্ষা, এরকম নানা কাহিনী অভিভাবকদের মুখ থেকে তারা শুনেছিল। বৈষ্ণবগুরু মধ্বাচার্যের অনুগামী, মাধবেন্দ্রপুরী আর তার শিষ্য ঈশ্বরপুরী, অদ্বৈত আচার্য প্রমুখ যখন কৃষ্ণাবতারের প্রার্থনায় দেশজোড়া গণমঞ্চ গড়ে তুলতে জপতপ কীর্তনে মেতে উঠেছে, তখন নবদ্বীপ সমেত গৌড়, রাঢ়, সমতটের তরুণরা মিথিলাধিপতি মহর্ষি জনকের মতো এক সন্ন্যাসী রাজার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তাদের প্রত্যাশার মানুষটির হুবহু প্রতিচ্ছবি দেখছিল গোরার রাজকীয় চেহারায়, চালচলনে। গোরার মজবুত শরীর, অসম্ভব শক্তিধর আজানুলম্বা হাত, নরমচোখে সরল দৃষ্টির মধ্যে আগুনের ফুলকির মতো তেজ, পাতলা দু’ঠোটে চাপা হাসিতে লুকনো ঔদ্ধত্য, গম্ভীর আলোচনায় প্রকৃত জ্ঞানীর প্রাঞ্জলতা, সব মিলে তার ব্যক্তিত্বের জৌলুসে ছাত্রদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। গোরাকে তারা আদর্শ অধ্যাপক হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণের চেয়ে তৃতীয় পাণ্ডব, গাণ্ডীবধারী, মহাবীর অর্জুন ভাবতে বেশি পছন্দ করত। রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, অযোধ্যারাজ, রাক্ষসদলনকারী রাজা রামচন্দ্র হিসেবে কল্পনা করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। কিন্তু সেই রাম যদি রাক্ষসের ভূমিকা নেয়, তখন মানুষ কী করবে? কল্পনায় গড়া, রক্তমাংসের নিমাই পণ্ডিতের টোল ছেড়ে অন্য পণ্ডিতের কাছে পঠনপাঠন নেওয়ার কথা ছাত্ররা স্বপ্নে ভাবতে পারত না। গোরার পাগল হয়ে যাওয়ার গুজবের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়ালেও গুরুর নাগাল পাচ্ছিল না। নিমাই পণ্ডিতের টোল কবে চালু হচ্ছে, তা জানতে প্রিয় মানুষটির কাছে সাহস করে পৌঁছোতে পারছিল না। তাদের বাঁচাল গঙ্গাদাস পণ্ডিত। গোরার চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের নিয়ে সে এক বিকেলে স্বয়ং হাজির হল গোরার বাড়িতে। গোরাকে চতুষ্পাঠী চালু করে দায়মুক্ত হতে চাইল গঙ্গাদাস। গোরারও একদা অধ্যাপক ছিল গঙ্গাদাস পণ্ডিত। পণ্ডিতের কাছে গোরা ঋণী। গুরুকে যথোচিত সম্বর্ধনা করে দাওয়ায় বসিয়ে পরের দিন থেকে চতুষ্পাঠী চালু করার প্রতিশ্রুতি দিল সে। শিক্ষকের প্রতিশ্রুতি শুনে ছাত্ররা আনন্দে হৈহৈ করে উঠতে তাদের কয়েকজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে গোরা আদর করল।

গোরার পাগল হয়ে যাওয়ার গুজব গঙ্গাদাসের কানে গেলেও সে বিশ্বাস করেনি। তার অনুরোধে পরের দিন সকাল থেকে চতুষ্পাঠী খুলতে গোরা রাজি হতে সে খুশি হল। গোরাকে দেখে তার বিভ্রম কাটল। গোরা আগের মতোই আছে, সে বদলায়নি। গোরাকে নিয়ে গুজব রটনাকারী কিছু টুলো পণ্ডিতের বয়ান যে পুরো মিথ্যে বুঝতে গঙ্গাদাসের অসুবিধে হল না। তার মনে কোথায় তবু খটকা থেকে গেল। সে টের পেল, একদা তার চতুষ্পাঠীর দুর্ধর্ষ ছাত্রটি, যে টোল খোলার পরে পাণ্ডিত্যের দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করত, সে হঠাৎ আমূল বদলে গেছে। নিমাই পণ্ডিত নামে খ্যাতিমান এই ছাত্রটি আগে কখনও এত শান্ত, সুস্থির, ভাবাকুল, বিনয়ী, নম্র ছিল না। দু’চোখের তারায় সজল আচ্ছাদনে অগ্নিকণা চেপে রেখে সে গভীরভাবে কোনও চিন্তায় ডুবে রয়েছে। গঙ্গাদাসের মনে হল, গয়াতে ঈশ্বরপুরীর কাছে মন্ত্র নেওয়ার পাশাপাশি গোরা কোনও দৈবাদেশ পেয়েছে। তার দেহ, আচার-আচরণ, কথা থেকে ঐন্দ্রজালিক আলো ছড়িয়ে পড়ছিল। গোরার বাচনভঙ্গিতে এত আকুলতা, গলায় এত ভাবাবেগ, এমন ছলছল দীপ্তি দৃষ্টি, সে গয়া যাওয়ার আগে গঙ্গাদাস কখনও নজর করেনি। নজর করবে কোথা থেকে? গোরার চরিত্র, চালচলনে, এসব লক্ষণ তখন ছিল না। বরং উল্টোটা চোখে পড়ত। উদ্ধতের শিরোমণি ছিল সে। সব কাজে নিজেকে নিখুঁত, নির্ভুল ভাবত। সে যা বলছে, সেটা-ই শেষকথা, এমন এক নীরব আস্ফালন, ফুটে উঠত তার আচরণে। গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাকে মহর্ষি গার্গ্যের ছেলে, যদুবংশের চরম শত্রু, কালযবন ঠাওরাতে শুরু করেছিল। গোরাকে টোল খোলার পরামর্শ দিতে এসে অন্যরকম এক গোরাকে দেখে গঙ্গাদাস যতটা চমকে গেল, তার একশ’ গুণ বেশি মোহিত হল গোরার অনুগত পড়ুয়ারা। তাদের মনে হল, হৃদয়বান, স্নেহশীল অধ্যাপকটি যেন সুদৃঢ় কোনও শপথে বলীয়ান হয়ে উঠেছে। তার সর্বাঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে রূপকথার আলো। গোরার পাশ ছেড়ে তাদের যেতে ইচ্ছে করছিল না।

গঙ্গাদাস পণ্ডিতকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পরের দিন থেকে গোরা চতুষ্পাঠী খুললেও পাঠ্যসূচি মেনে ছাত্রদের পড়াতে শুরু করে, সে বারবার ঠেকে যেতে থাকল। মূল বিষয় থেকে সরে এসে কৃষ্ণকথা, কৃষ্ণতত্ত্ব ব্যাখ্যায় পথ হারিয়ে ফেলছিল। গয়ায় গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া বিশ্বরূপের পুঁথির আখ্যান, ঈশ্বরপুরীর দেওয়া ‘কৃষ্ণকেশব’ বীজমন্ত্র, বিশ্বচরাচরের সুরঝর্ণার মতো তার অস্তিত্বে মিশে গিয়ে তাকে-উদ্বেল করে তুলল। ছাত্রদের দিকে তর্জনি তুলে বলতে থাকল, রামের পাশের বন্ধু, শ্যামকে এই মুহূর্তে প্রতিভাধর মনে না হলেও অদূর ভবিষ্যতে তাকে চিনে নিতে অসুবিধে হবে না। শ্যাম-ও হয়তো বুঝবে, রাম যথার্থ প্রতিভাবান যাজ্ঞবল্ক্য, বাল্মীকি, ব্যাসদেব, পাণিণি, মনুর মতো প্রতিভাবান কবি, পণ্ডিত, দার্শনিকরা সব যুগে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়, সাধারণ মানুষের ভিড়ে তারা অতি সাধারণ হয়ে মিশে থাকে, সময় হলে আত্মপ্রকাশ করে। ঈশ্বরও তা-ই। পাশের বাড়ির বন্ধুটিকে ঈশ্বর হিসেবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও হঠাৎ একদিন টের পাওয়া যায়, সে বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা। মৃত্যুর পরে যাদের মহৎ বলা হয়, তারা বেঁচে থাকার সময়েও কম মহিমা বিকীরণ করে না। জীবিতদের মধ্যেও মহৎ, প্রতিভাবান অনেক মানুষ থাকে। তাদের খুঁজে নিতে হয়। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আত্মস্বার্থের ছোট গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে নিজের মহিমা উপলব্ধি করতে হয়।

গোরার কথকতা ছাত্ররা সবাই না বুঝলেও যাদের বয়স একটু বেশি তারা ঠারেঠোরে আঁচ করতে পারছিল। গোরা বলছিল, শুধু জন্মপরিচয় দিয়ে মানুষকে বিচার করা যায় না। সমাজে হাজার হাজার ব্রাক্ষ্মণ থাকতে স্বয়ং ত্রিলোকেশ্বর শ্রীবিষ্ণু নারায়ণ যে গোয়ালার ঘরে কৃষ্ণাবতার হয়ে জন্ম নিল, তার কারণ কী? ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। ধর্ম, জাতপাত, তৈরি করেছে মানুষ। সেই বিভাজন মেনে চলার দায় ঈশ্বরের নেই। কুল গোত্র জাতপাত বিচার করে মানুষের রূপ ধরে ঈশ্বর পৃথিবীতে আসে না। গোপকুলে কৃষ্ণের জন্ম হলেও শ্রেষ্ঠ মানুষের উদাহরণ তৈরি করতে কৃষ্ণাবতারের আবির্ভাব ঘটেছিল। কে শ্রেষ্ঠ মানুষ? ভদ্র, সভ্য, বিনীত, সহিয়ু, সাহসী, বীর্যবান যে মানুষ, ধর্ম জাতপাত নির্বিশেষে আপামর মানুষকে ভালবাসে, অন্যায়ের পরিত্রাণ করে, সে-ই আদর্শ মানুষ, নররূপী ঈশ্বর সে।

কৃষ্ণতত্ত্ব ব্যাখ্যায় বিভোর হয়ে পাঠ্যসূচি থেকে সুদূর কোনও জগতে পৌঁছে গিয়ে গোরা বলতে থাকল, সদবিপ্র জগন্নাথ মিশ্রের সন্তান, আমি বিশ্বম্ভর মিশ্র, তোমাদের নিমাই পণ্ডিত, আমি কি আদর্শ মানুষ? আমার এই বংশপরিচয় কি আমার সর্বস্ব? পিতৃপরিচয় হারালে মানুষ কি ভিখিরি হয়ে যায়? কখনও না। ঈশ্বরের সন্তান সে। ঈশ্বর কখনও সন্তানের পিতৃপরিচয় কেড়ে নেয় না। মানুষ কখনও পিতৃপরিচয় হারায় না। সে নিজে ঈশ্বর হয়ে যায়।

গোরার দু’চোখে আগের বিকেলে যে রূপকথার আলো পড়ুয়ারা দেখেছিল, চতুষ্পাঠীতে বসে নজর করল, চোখের সেই আলোর গভীর থেকে জলের ধারা নেমেছে। তাদের পণ্ডিত কাঁদছে। কী আশ্চর্য! ডাকাবুকো নিমাই পণ্ডিত কাঁদতে পারে, তাদের ধারণা ছিল না। পাথরের মূর্তির মতো নিস্পন্দ বসে রয়েছে গোরা। তার শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কি না, বালক ছাত্ররা বুঝতে পারল না। গোরার দু’চোখের অবিরল অশ্রুধারা থেকে তারা অনুমান করল, মানুষটা মরেনি, বেঁচে আছে। নিজের কথার তোড়ে আবিষ্ট, বাক্যহারা, বেহুঁশ হয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গোরা স্বাভাবিক হল। দু’চোখ মুছে ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, অনেক এলোমেলো কথা বোধহয় বলে ফেলেছি। তোমরা কিছু মনে করো না।

ছাত্রদের কাছে গোরার কথাগুলো অস্পষ্টবোধ্য, রহস্যময় ঠেকলেও অনুগত ছাত্ররা সমস্বরে জানাল, গোরা যা বলেছে, সে ব্যাখ্যা অমৃত সমান।

চুপ করে থাকল অল্পবয়সি আর তাদের চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছাত্ররা। তাদের পরিবারের জ্যাঠা, বাবা, কাকারা নবদ্বীপের অগ্রগণ্য পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত। স্মৃতি, ন্যায়, তন্ত্রশাস্ত্রের ঝুলি কাঁধে না নিয়ে, তারা বাড়ি থেকে বেরোয় না। চতুষ্পাঠী গুটিয়ে সেদিনের মতো ছাত্রদের ছুটি করে দেওয়ার আগে গোরা বলল, একটু আগে যা ঘটে গেল, ছেলেরা যেন ভুলে যায়। বাড়িতে অভিভাবকদের এ কাহিনী শোনানোর দরকার নেই। তরুণ ছাত্রদের দু’একজন টোলের বাইরে এসে বলল, পণ্ডিত যে পাগল হয়ে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

তাদের কেউ বলল, ব্যাকরণ পড়ানোর বদলে জন্মপরিচয়, পিতৃপরিচয় নিয়ে বিধর্মীদের মতো আলফাল বকে গেল। এটাই তো পাগলামি! তার কথাতে সায় দিয়ে এক সহপাঠী বলল, বাবা, কাকার কানে এসব কথা গেলে নিমাই পণ্ডিতের টোলে আমাদের পড়তে আসা তারা বন্ধ করে দেবে। পণ্ডিতকে রাস্তায় ধরে ঠেঙাতে পারে।

চতুষ্পাঠীতে গোরা নিয়মিত যাতায়াত করলেও রোজ প্রায় একই কাণ্ড সেখানে ঘটতে থাকল। ব্যাকরণ পঠন-পাঠনের বদলে গোরা মুখ খুললেই অবতারতত্ত্ব ব্যাখ্যা, প্রকৃত আদর্শবাদী মানুষের আলোচনা এসে যাচ্ছিল। আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ, পরহিতব্রতী, ধর্মানুরুদ্ধ মানুষই যে আদর্শ মানুষ, তার পক্ষে জগতের তমোশক্তি, কৃষ্ণবেশী দৈত্যের নিধনকারী কৃষ্ণাবতার হওয়া অসম্ভব নয়, এ যুক্তিও গোরা উপস্থিত করেছিল। তার অনুরাগী ছাত্ররা চাতকের মতো অধ্যাপকের ব্যাখ্যা, অন্তনির্হিত অর্থ খুঁজে যখন নতুন পথের সঙ্কেত পাচ্ছিল, গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী পরিবেশে লালিত ছাত্রদের কেউ কেউ অধৈর্যে হাই তুলছিল। ব্যাকরণের কলাপ অংশ পড়ানো কখন শুরু হবে, এমনও জানতে চাইছিল দু’একজন।

গোরা সসঙ্কোচে পাঠ্য পুঁথি খুলে বসলেও তার পক্ষে ছাত্র পড়ানো আর সম্ভব নয়, টের পাচ্ছিল। কলাপ অধ্যায়ের কিছুটা সেদিন পড়িয়ে পরের দিন দুপুরে বকেয়া পাঠ্যাংশ পড়ানো শুরু করে, সেখান থেকে নিজের অজান্তে কৃষ্ণতত্ত্ব ব্যাখ্যানে সরে যাচ্ছিল। কলাপের বদলে আত্মশক্তির ব্যাখ্যায় মশগুল হচ্ছিল। আত্মার শক্তি হল আত্মশক্তি, তার আর এক নাম বৈষ্ণবী শক্তি। দুধ আর তার ধবলতা যেমন অভিন্ন, তেমনি বৈষ্ণবীশক্তি বা আত্মশক্তি আর জনহিত অবিচ্ছেদ্য। জনহিতব্রতের আদর্শ অধিনেতা হল কৃষ্ণ। হাজার লক্ষ মানুষের মধ্যে যেমন এক বা একাধিক কৃষ্ণ রয়েছে, তেমনি সেই গুটিকয়েকের সান্নিধ্য পেয়ে বেড়ে ওঠে অসংখ্য কৃষ্ণ, তখন কৃষ্ণনামের ঝড় ওঠে। দুরাত্মার শাসন, অন্যায়, অবিচার তখন কুটোর মতো উড়ে যায়। ভয়, ঘৃণা, অসূয়া, নানা দোষ, দুর্বলতায় অবদমিত জনপদে প্রকৃত সাধুসমাজের উত্থান ঘটে। সাধুসমাজ মানে, দাড়ি গোঁফ, জটাজুটধারী, গেরুয়া বসন, সন্ন্যাসীদের মঞ্চ নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সহৃদয়, স্বাভাবিক, সজ্জন, শিষ্ট মানুষের সমাজ।

ব্যাকরণের বদলে নিত্যদিন ভাবাকুল নিমাই পণ্ডিতের মুখে কৃকথা শুনতে শুনতে কিছু ছাত্র বাড়িতে অভিভাবকদের জানাল, নিমাই পণ্ডিতের মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে। সব সময়ে ‘কৃষ্ণ’, ‘কৃষ্ণ’ করে, ধর্ম জাতপাত নিয়ে এমন সব ভাষণ শুরু করে, যা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। স্মার্ত, নৈয়ায়িক, তন্ত্রাচারী অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ভয় পেয়ে গেল। পরিবারের ছেলে ‘হরিভজা’ হয়ে যাওয়ার আগে নিমাই পণ্ডিতকে যথোচিত শিক্ষা দিতে ঘোঁট পাকাতে শুরু করল তারা। গোরার দাদা, বিশ্বরূপের একদা সহপাঠী, তন্ত্রাচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তখন নবদ্বীপে খুব নামডাক। ‘তন্ত্রসার’ নামে পুঁথি লিখে, সেই পুঁথির ভাষ্য যে ব্রাহ্মণ্যবাদের শেষকথা, তার প্রচার করে বেড়াচ্ছিল কৃষ্ণানন্দ। গোরাকে কড়কে দেওয়ার জন্যে তন্ত্রাচার্য আগমবাগীশের শরণাপন্ন হল তার ভক্ত অভিভাবকরা। আগমবাগীশ আশ্বস্ত করল তাদের। অভিভাবকরা ধর্না দেওয়ার আগেই গোরাকে জব্দ করার কর্মসূচি কৃষ্ণানন্দ ছকে ফেলেছিল।

বুদ্ধিমন্ত খানের বাড়িতে গোরার চতুষ্পাঠীর একাংশ ছাত্রের মনে ধীরে ধীরে বিরূপতা জমে ওঠার সঙ্গে শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়ির উঠোনে গোরাকে মধ্যমণি করে নবদ্বীপের বৈষ্ণবরা সঙ্কীর্তনের যে ঝড় তুলল, তা গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীদের কম রুষ্ট করল না। নবদ্বীপের কাজি সিরাজুদ্দিনের কাছে বৈষ্ণবদের শাস্ত্রবিরোধী নাচ গান, মধ্যরাতে শীধু পান, মাংসাহার, নর্তকী, বারাঙ্গনা নিয়ে তন্ত্রশাস্ত্রোক্ত পঞ্চকন্যা নামিয়ে বেলেল্লাপনা করার ফলে নগরের শান্তিশৃঙ্খলা যে বিঘ্নিত হচ্ছে, বেশ কয়েকবার লিখিতভাবে এ অভিযোগ তারা দায়ের করেছিল। গৌড়ের রাজধানী একডালাতে সুলতান হোসেন শাহের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল তাদের নালিশ। সুলতানি দরবারে তাদের মুরুব্বি ছিল জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির। তার পরামর্শে, কর্নাট দেশে দুই যজুর্বেদীয় ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিত অমর আর সন্তোষকে মুকুটগ্রামে তাদের বাড়ি থেকে সসম্মানে শিবিকায় তুলে একডালার সুলতানি দরবারে নিয়ে গিয়ে উঁচু পদের চাকরিতে নিয়োগ করেছিল হোসেন শাহ। সুলতানি মন্ত্রণালয়ের সচিব ‘দবিরখাস’ পদে অমরকে আর রাজস্ব দপ্তরের প্রধান, ‘সাকর মল্লিক’ পদে সন্তোষকে বসিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর পরে গোরা সন্ন্যাস নেওয়ার পরে অমর আর সন্তোষের নতুন নামকরণ করেছিল, সনাতন, রূপ। তাদের ছোটভাই বল্লভ, সেও তখন গৌড়ের সুলতানের উঁচু পদের কর্মচারী, তার নামেরও নবীকরণ করেছিল গোরা। বল্লভের নতুন নাম হয়েছিল অনুপম। সুলতানি দরবারে তখনও চারুমিহিরের অপ্রতিহত প্রভাব। যবন রাজার বিশ্বস্ত হতে তাকে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে, অনেক গুণাগার দিতে হয়েছিল। দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়তে বাধ্য হলেও হিন্দুত্ব বজায় রাখতে বামাচারি তান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল। ‘তন্ত্রসার’ পুঁথি প্রণেতা কৃষ্বানন্দ আগমবাগীশের সঙ্গে চারুমিহিরের যোগাযোগ ছিল। দু’জনের মধ্যে চিঠি বিনিময় হত। চিঠিপত্রে কৃয়ানন্দ আগমবাগীশের সঙ্গে চারুমিহিরের যোগাযোগ থাকলেও জ্যোতিষার্ণব ছিল প্রকৃত জহুরি। গুণীর কদর করত। কৃষ্ণানন্দকে সুলতানি দরবারের গুপ্তচর হিসেবে চারুমিহির সুকৌশলে যতটা ব্যবহার করত, ততটা তাকে খাড়া করে নানা বৈষয়িক কাজ হাসিল করে নিত তন্ত্রাচার্য। নবদ্বীপের বিখ্যাত নৈয়ায়িক বাচস্পতি ভট্টাচার্য সার্বভৌমর কাছে চারুমিহির যখন ন্যায়শাস্ত্র পড়ত, তখন বাচস্পতির দাদা, কিংবদন্তি ন্যায়শাস্ত্রী বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীর ছাত্র ছিল অমর আর সন্তোষ—দুই ভাই। শিক্ষার্থী হিসেবে তখন থেকে অমর, সন্তোষের অসাধারণ মেধা ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে চারুমিহিরের পরিচয় ঘটে। সুলতানি দরবারে নিজের অবস্থান শক্ত করতে অমর, সন্তোষের মতো দুই প্রাক্তন সহপাঠীকে পাশে রাখার ছক, সুলতানি মসনদে হোসেন শাহ বসার পর থেকে তৈরি করতে শুরু করেছিল চারুমিহির। দশ বছর পরে, পুরনো ছক কার্যকর করার সুযোগ পেয়ে, পয়লা চালে, মুকুটগ্রাম থেকে অমর, সন্তোষকে একডালার দরবারে নিয়ে আসার কাজে সে-ই ছিল মুখ্য ব্যবস্থাপক। নবদ্বীপ থেকে বৈষ্ণবধর্মীদের উপদ্রবের বিরুদ্ধে সুলতানের দরবারে পাঠানো অভিযোগের চিঠিগুলো প্রথমে যাচ্ছিল দবিরখাস, সনাতনের দপ্তরে। চিঠি যেমন পাষণ্ডীরা পাঠাচ্ছিল, তেমন সুলতানি প্রশাসনের তরফে খবরাখবর আসছিল। বৈষ্ণবমণ্ডলীতে গোরা আসার আগে নির্বাচিত কিছু অভিযোগ সুলতানের নজরে সনাতন আনলেও গোরার উত্থানের পরে কৃষ্ণপ্রেমে নবদ্বীপ মেতে ওঠার বিকৃত ব্যাখ্যাসমেত যে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগলিপি আসতে থাকল, তার প্রায় সবটা নিজের দপ্তরে আটকে রাখল সনাতন। দরবারের নিষ্ক্রিয়তায় অধৈর্য হয়ে চারুমিহিরকে তাড়াতাড়ি কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে নবদ্বীপ থেকে তখন চিঠির পর চিঠি লিখে চলেছে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তান্ত্রিক পণ্ডিতের অনুরোধ হেলাফেলা করার নয়। তুখোড় বুদ্ধি, চারুমিহির বুঝে গেল, কী ঘটছে। বৈষ্ণবদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে বিশ্বম্ভর মিশ্র, ওরফে গোরার বিরোধী অভিযোগপত্রগুলো, নিজের দপ্তর থেকে সনাতন হিমঘরে চালান করে দিচ্ছে, আন্দাজ করে এক দুপুরে সনাতনের সঙ্গে একান্তে সে কথা বলল। প্রায় এক ঘণ্টার আলোচনার পরে ঠিক হল, জ্যোতিষার্ণব আর দবিরখাস দু’জনই আলাদাভাবে সুলতানকে হিন্দুদের ধর্মীয় কোঁদলে নাক না গলানোর পরামর্শ দেবে। সুলতানকে বোঝাতে দু’জনে একই যুক্তি পেশ করবে। সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বহু বছর ধরে গোপনে যে ঘোঁট পাকিয়ে চলেছে, হিন্দুসমাজের ভেতর থেকে যদি তার প্রতিপক্ষ খাড়া হয়ে যায়, তাতে সুলতানি প্রশাসনেরই লাভ। ধর্মীয় কোঁদলে, জাতপাত নিয়ে খেয়োখেয়িতে হিন্দুসমাজ টুকরো টুকরো হয়ে গেলে গৌড়ে সুলতানি শাসন গেড়ে বসতে সুযোগ পাবে। গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীদের জারি করা জাতিচ্যুতির এলোপাথাড়ি নির্দেশে শুধু নবশাক, ম্লেচ্ছ, শূদ্ররা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল এমন নয়, সুলতানি শাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্রাহ্মণরা, যেমন চারুমিহির, অমর, সন্তোষ, রাজধানী একডালায় সুলতানের চিকিৎসক, শ্রীখণ্ডের বৈদ্য পরিবারের মুকুন্দদাস সরকার পর্যন্ত একঘরে হওয়ার আশঙ্কাতে চটেছিল। স্মৃতি, ন্যায়শাস্ত্র, তন্ত্রের নাম ভাঙিয়ে ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের একতরফা ছড়ি ঘোরানোতে সুলতানি দরবারের পদস্থ এই চাকুরিজীবী আর তাদের পরিবার দেশগাঁয়ে সত্যিই একঘরে হয়ে পড়েছিল। প্রায়শ্চিত্তের নামে তাদের কাছ থেকে মোটা টাকা জরিমানা আদায় করছিল ব্রাহ্মণ পাণ্ডারা। শাস্ত্রীয় নিয়মে প্রায়শ্চিত্ত করার হুকুম এড়াতে মুলুকপতি সুবুদ্ধি রায়ের দেশছাড়া হওয়ার ঘটনা কারও অজানা ছিল না। নবদ্বীপে বৈষ্ণববাদের অভ্যুত্থানের ঘটনাতে সুলতানি দরবার, উদাসীন দর্শকের ভূমিকা নিলেও তার কার্যকারণ, স্বয়ং সুলতান, তার জ্যোতিষার্ণব এবং দবিরখাস ছাড়া কেউ জানতে পারল না।

শ্রীবাসের অঙ্গন থেকে সঙ্কীর্তনের ঝড়, নবদ্বীপের বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাক, ম্লেচ্ছ, শূদ্র পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকল। কীর্তনের মাঝখানে আগে পরে গোরা প্রায়ই ‘কৃষ্ণ আমার বাপ বলে বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিল। জ্ঞান ফিরলে ‘বাপ তুমি কোথায়? দেখা দাও’ বলে কেঁদে আকুল হচ্ছিল। চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল তার পোশাক। ভাবোন্মত্ত গোরার কৃষ্ণপ্রেম দেখে সঙ্কীর্তনের সঙ্গীরা কখনও ভাবছিল, এত বড় ভক্ত আগে পৃথিবীতে আসেনি, কখনও তাদের মনে হচ্ছিল, গোরা নিজেই কৃষ্ণ, সাক্ষাৎ ভগবান। পৃথিবীর মানুষকে বিশুদ্ধ ভক্তিতত্ত্ব শেখাতে মানুষের চেহারায় পুণ্যভূমি নবদ্বীপে কৃষ্ণাবতারের আবির্ভাব ঘটেছে। কীর্তনের আসরে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা গুটিকয় প্রদীপের শিখা রাত বাড়ার সঙ্গে নিষ্প্রভ হয়ে আসত। প্রদীপের বুকের তেল কিছুক্ষণের মধ্যে শুকিয়ে গিয়ে একে একে সবকটা নিভে গেলে অন্ধকারে ডুবে যেত আসর। কীর্তনীয়াদের বেশির ভাগ বাড়ি ফিরে গেলেও দু’একজন রাতে থেকে যেত শ্রীবাসের অঙ্গনে। ভাবাবেশে তারা সেখানে ঘুমিয়ে পড়ত। গোরার জাদুকর প্রভাবে তার সঙ্গে আপামর নবদ্বীপবাসী, বেশিরভাগ গরিব অব্রাহ্মণ, প্রায় রাতেই নেচে, গেয়ে বিশ্বাস, ভক্তিতে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে, কয়েকশ বছরের একঘেয়ে, দারিদ্র্য জর্জরিত, মানহীন, নির্যাতিত জীবনবৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে নতুন প্রাণপ্রবাহের ছোঁয়া পাচ্ছিল। গোরাকে দেখে মনে হচ্ছিল নবদ্বীপের মাটিতে ঈশ্বর নেমে এসেছে। বৈবদের মধ্যে গোরাকে নিয়ে গড়ে উঠতে থাকল উপকথা। উপকথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকল এবং অতিরঞ্জিত প্রচার হতে থাকল যে গোরাকে একবার চোখে দেখার জন্যে জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মানুষ বৈষ্ণব, ব্রাক্ষ্মণ, অব্রাক্ষ্মণ, নবশাক, ম্লেচ্ছ, শূদ্র, নিরীহ, গরিব, ধর্মভীরু জনসাধারণ, সন্ধে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত শ্রীবাস পণ্ডিতের কপাট বন্ধ বাড়ির সামনে অন্ধকার সদর রাস্তায় ভিড় করতে লাগল। গোরা শুধু কৃষ্ণাবতার নয়, সে ঈশ্বর। শ্রীবাসের বাড়ির অঙ্গনে তুমুল সঙ্কীর্তনে সে মধ্যমণি। কৃষ্ণাবতার গোরাকে গৃহাঙ্গনের বাইরে দাঁড়ানো মানুষ এক ঝলক দেখার সুযোগ না পেলেও বাড়ির ভেতর থেকে মৃদঙ্গ, করতাল, মন্দিরা, বাঁশির সঙ্গে সমবেত সুকণ্ঠ গায়কদের সুরেলা কীর্তনের প্লাবন, কানে এসে ঢুকলে তাদের মন ভরে যেত। কীর্তনীয়াদের পায়ে বাঁধা নূপুরের আওয়াজ, মঞ্জিরার রিনিঝিনি, মাঝে মাঝে হরিধ্বনি, উলুধ্বনি অন্ধকার রাতের আকাশে ছড়িয়ে পড়লে বোঝা যেত, আসরে পুরুষদের সঙ্গে পরিবারের বারাঙ্গনারাও জায়গা পেয়েছে। তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের ফুঁ-এ ত্রিকালভেদী শঙ্খনাদ, তাদের নরম পায়ে বাঁধা মঞ্জিরার ধ্বনি, সঙ্কীর্তনে আলাদা বিভা এনেছে, বৈয়বী মাত্ৰা যোগ করেছে, সদর দরজার বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, তা দেখতে না পেলেও হৃদয় দিয়ে টের পেত। নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করত, পাপিষ্ঠ পাষণ্ডীদের এড়াতে গোরা বাধ্য হয়ে শ্রীবাসের বাড়িতে কপাট এঁটে সঙ্কীর্তন করছে। পাষণ্ডীদের জন্যে নবদ্বীপের ভালো মানুষরা সঙ্কীর্তনের আসরে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে না। হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ তারা ছিল না। গোরাকে তারা ভালোরকম চিনত। নিজেদের ঘরের লোক ভাবত। গোরা আর তার গণদের সঙ্কীর্তনে, নাচে তাড়াতাড়ি যে সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষ জায়গা পাবে, এ বিশ্বাসে তারা নিঃসংশয় ছিল। তাদের বাদ দিয়ে পৃথিবীকে পাপমুক্ত করার চিন্তা গোরা অন্তত কখনও করে না। সাধুসমাজ গড়ার কাজে পাইক, বরকন্দাজ হিসেবে গোরা অবশ্যই নিজের পাশে তাদের রাখবে। নবদ্বীপের মাটি থেকে উঠে আসবে আর একজন রাজা গণেশ, রাজা কাস অথবা রাজা দনুজমর্দনদেব। তাদের চেয়ে অনেক বেশি সহৃদয়, প্রজাপালক রাজা হবে তাদের গোরা রায়।

শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়ি ছাড়াও চন্দ্রশেখর আচার্যের বাড়ির আঙিনাতেও সঙ্কীর্তনের জমজমাট আসর বসছিল। মাঝরাত পেরিয়ে রাতের তৃতীয়, চতুর্থ প্রহরেও চলত সপার্ষদ গোরার নামসঙ্কীর্তন, বিবশ হয়ে আঙিনায় অথবা বিষ্ণুর আসনের সামনে তার লুটিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত সুরের প্রবাহ থামত না। খোল, করতাল, মৃদঙ্গের আওয়াজ থেমে গেলে অন্ধকারে ভেসে বেড়াত নানা রাগরাগিণী, কেদার, পটমঞ্জরী, মালশ্রী, মল্লার, বরাড়ী আরও কত নাম, কত সুর!

রাতের আসর নিয়ে কৃয়ানন্দ আগমবাগীশের মতো মানুষ শুধু অকথা কুকথা রটিয়ে থেমে যাওয়ার পাত্র ছিল না। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা, তার অনুগামীরা ঘটিয়ে বেড়াচ্ছিল। শ্রীবাসের বাড়ির খিড়কি পথে, পরিবারের মানুষের চোখ এড়িয়ে কীর্তনের আসরে যেদিক অন্ধকার সেখানে বসে পড়ছিল, রাতের দ্বিতীয় প্রহরে। কীর্তনে, নাচে, ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল অদ্বৈত, মুকুন্দ, বাসুদেব, গদাধর, জগদানন্দ, দামোদর প্রমুখ ভক্তজন। তাদের মাঝখানে মধুর নৃত্যের ভাবাবেশে মুহ্যমান গোরা-ই প্রথম অচেনা এক মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে, মুকুন্দকে ইঙ্গিতে ঘটনাটা জানিয়েছিল। তন্ত্রবিশ্বাসী অনাহূত মানুষটা ধরা পড়ে গিয়ে স্বীকার করেছিল, সে-ও ব্রাহ্মণ, তার নাম বিপ্রদাস। বৈষ্ণবদের সঙ্কীর্তনে আসরে অনাচার ঘটে কিনা জানতে এসেছিল। তাকে পাঠিয়েছে তার গুরু কৃয়ানন্দ আগমবাগীশ। ভয় পেয়ে গেলেও আনন্দে তার দু’চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। গোরাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে জানিয়েছিল, গুপ্তচরবৃত্তির মতো অপরাধ করতে এসে আসরে বসে ভক্তিরসে ডুবে গিয়েছিল সে। তন্ত্রে তার বিশ্বাস কেটে গেছে। অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবে সে। চার সপ্তাহ প্রয়োপবেশনে কাটিয়ে, তারপর বেঁচে থাকলে, শ্রীবাসের বাড়ির বাইরে অন্ধকারে, আর পাঁচজন শ্রোতার পাশে দাঁড়িয়ে, ভবিষ্যতে সঙ্কীর্তন শোনার যোগ্য হয়ে উঠতে চায় সে। তখন আসরের এক কোণে ঠাঁই পাওয়ার প্রার্থনা করেছিল সে। তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিল গোরা। তাকে আশ্বস্ত করে, তার বাড়িতেও সঙ্কীর্তন আসর বসাতে বলেছিল। ভবিষ্যতে কখনও সুযোগ পেলে তার বাড়ির আসরে সপারিষদ সে যাবে, জানিয়েছিল। আসরের কীর্তনীয়ারা খুশিতে হরিধ্বনি করেছিল। ব্রাহ্মণের নাম বিপ্রদাস। কথা রেখেছিল সে। একমাস নির্জলা উপোস করে কঙ্কালসার শরীরে শ্রীবাসের বাড়ির বাইরে যখন সে সঙ্কীর্তন শুনতে এল, প্রথমে তাকে কেউ চিনতে পারেনি।

তার মধ্যে, সেই একমাসে চাঞ্চল্যকর আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিল। শ্রীবাসের বাড়ির সদর দরজার বাইরে একাধিক রাতে মদ, মাংস রেখে গিয়েছিল কেউ। নবদ্বীপে সেই খবর ছড়িয়ে যেতে পাষণ্ডীরা উল্লাস প্রকাশ করলেও বৈষ্ণব ভক্তরা ভয়ে মুষড়ে পড়েনি। দল বেঁধে রোজ নতুন নতুন ভক্ত এসে জোটায়, তাদের উদ্দীপনা বেড়ে গেল। সঙ্কীর্তনের শেষে শ্রীবাসের সদর দরজার সামনে এক রাতে, মধ্যপ্রহরে কাঁধে ঝোলাবোঝাই মানুষের মাথার খুলি, হাড়সমেত এক পাষণ্ডী, নাম চাপালগোপালকে ভক্তেরা ধরে ফেলল। শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়িকে অপবিত্র করে, ভক্তদের ভয় দেখাতে, কপাটের বাইরে নরকঙ্কালের খণ্ডাংশ, মুণ্ডু, হাড় রেখে, সে পালানোর আগের মুহূর্তে গোরার অনুগামীরা তাকে ধরে ফেলেছিল। চাপালগোপালকে তারা হেনস্তা করার আগে গোরা ক্ষমা করে দিয়েছিল। তান্ত্রিক বিপ্রদাসের প্রায়োবেশনে প্রায়শ্চিত্ত করার কাহিনীর সঙ্গে চাপালগোপালের বৃত্তান্ত নবদ্বীপে ছড়িয়ে পড়তে জনসাধারণের মনে গোরাকে নিয়ে কৌতূহল বাড়ার সঙ্গে তার সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল হচ্ছিল। শ্রীবাসের বাড়ি অশুদ্ধ করার ছক ভেস্তে যেতে লজ্জায় কাশিতে পালিয়ে গেল চাপালগোপাল। পক্ষকালের মধ্যে কাশি ফেরৎ নবদ্বীপের তীর্থযাত্রীদের মুখ থেকে জানা গেল, তাদের দু’একজনের সঙ্গে কাশিতে বিশ্বনাথ মন্দিরের সামনে চাপালগোপালের দেখা হয়েছিল। হতভাগ্য চাপালগোপাল! নবদ্বীপের চেনা মানুষ পেয়ে সে জানিয়েছিল, কাশিতে পা রেখে সে জেনেছে, তাকে কুষ্ঠ রোগে ধরেছে। নবদ্বীপবাসীদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে। বলেছে, শ্রীবাস পণ্ডিতের মতো বৈষ্ণব মহাত্মার ভদ্রাসন অশুদ্ধি করতে যাওয়ার শাস্তি সে ভোগ করছে। পাপের বেতন মৃত্যু! মৃত্যুর দিকেই সে এগোচ্ছে।

চাপালগোপালের দুর্দশার কাহিনী লোকমুখে নবদ্বীপের মানুষের কানে পৌঁছে যেতে গোরাকে নিয়ে অতিকথা তৈরি হতে থাকল, গড়ে উঠলে থাকল নতুন সব কিংবদন্তি, যার মূল কথা, গোরা সাধারণ মানুষ নয়, দৈবীশক্তিসম্পন্ন পুরুষ। কাশি থেকে ফেরা নবদ্বীপের তীর্থযাত্রীদের কেউ কেউ বলতে শুরু করল চাপালগোপালের এখনই বারাণসী থেকে নবদ্বীপে ফিরে এসে গোরার পা ধরে ক্ষমা চাওয়া উচিত। গোরার করুণা পেলে এ যাত্রা সে বেঁচে যেতে পারে।

চাপালগোপালের কানে এ পরামর্শ পৌঁছে দিল, নবদ্বীপ থেকে কাশিতে পৌঁছনো নতুন তীর্থযাত্রীদল। ঘটনাস্রোত যখন আঁকাবাঁকা খাতে এগিয়ে চলছিল, তখন এক প্রাক্ প্রত্যূষের আলো আঁধারে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার পথে চেনা এক মানুষকে মুহূর্তের জন্যে গোরা দেখতে পেল। পল্লীর পথে, কুয়াশা ছেয়ে থাকা দক্ষিণ-বাঁকে লোকটা ঢুকে যেতে গোরা ভালো করে তাকে ঠাহর করতে পারল না। তার মনের মধ্যে অচেনা, মিষ্টি এক সুর গুনগুন করে বাজতে থাকল। গয়া ঘুরে আসার পর থেকে আজকাল সুর, সঙ্গীত, সঙ্কীর্তনের আসরে বসলে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে সে লোকান্তরে পৌঁছে যায়। নিজের আত্মপরিচয়, চারপাশের বাস্তবতা ভুলে উদ্দণ্ড নৃত্যের সঙ্গে, নানা রসের গানের মধ্যে নিজেকে সর্বশক্তিমান, বিশ্বচরাচরস্রষ্টা হিসেবে দাবি করে। বৈষ্ণব অনুগামীরা তার প্রতিটা কথাকে অলৌকিক বেদবাক্য মেনে নিয়ে তার দু’পা চোখের জলে ভিজিয়ে দেয়। ভক্তিতে রোমাঞ্চিত হয়ে হরিধ্বনি করে। সঙ্কীর্তনের আসরে ঢুকলে গোরার মনে হয়, ঘুম থেকে সে জেগে উঠল, নাচ, গান, সুরের প্রভাবে তার শরীর, রূপ, হাসি, চাহনি, মুখের ভাষা বদলে যায়। ভাবে বিভোর হয়ে যায় সে। অনুগামীদের চোখে সে অলৌকিক মানুষ হয়ে ওঠে। বেশ কয়েক বছর মৃগী রোগে ভোগার সময়ে মাথাতে বিষ্ণুতেল মাখলে মাথার মধ্যে এরকম সুখানুভূতি হত। উপবীত গ্রহণের সময়ে কাঁচাসুপুরি খেয়ে মাথার মধ্যে স্বপ্নজড়ানো যে আবেশ তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে কাঁচা সুপুরিকুচো দিয়ে পান খাওয়ার যে নেশা তৈরি হয়, তা অদ্যাবধি সে ছাড়তে পারেনি। সঙ্কীর্তনের আসরে হাজির থাকা যে সবচেয়ে তীব্র নেশা, এ নিয়ে তার সন্দেহ নেই। নাচ, গান, খোল, করতাল, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ-এর মিলিত সুরের প্রবাহ মগজের মধ্যে এমন অমৃতদায়ী ভেষজের মতো ছড়িয়ে পড়ে, তার জানা ছিল না। সঙ্গীত, শ্লোক, স্তব, কীর্তন, সুরারোপিত কৃষ্ণকথা কানের ভেতর দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছে তাকে স্বপ্নাতুর, দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন করে তোলে, মাটিতে দু’পা রেখে বেঁচে থাকলেও সে অনুভব করে বাতাসে ভাসছে, আকাশ, আলো, নক্ষত্রলোক পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলতে পারে।

স্নানের ঘাট থেকে ফেরার পথে মুহূর্তের জন্যে একজন মানুষকে দেখে গোরা মনে যে আনন্দ জাগল, তার সঙ্গে সঙ্কীর্তনের সুখানুভূতি মিশে রয়েছে। গঙ্গায় স্নান সেরে, ঘাট ছেড়ে উঠে এসে ভিজে কাপড় বদলানোর সময়ে, একটু আগে কয়েকজন অভিভাবকের আচরণে মনে যে আঘাত সে পেয়েছিল, মাথার মধ্যে অশ্রুত সুরের গভীর সঞ্চরণে তা ক্ৰমশ কেটে যেতে থাকল। পরিকল্পনা করে দল পাকিয়ে তাকে অপমান করতে তার চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের কয়েকজন অভিভাবক ঘাটে এসেছে, গোরা এক নজরে বুঝে গিয়েছিল। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে সাধারণত তারা স্নানের ঘাটে আসে না। বেলা গড়ালে ঘাটে এসে তারা স্নান, আচমন করে। ভুল শিক্ষা দিয়ে তাদের সন্তানদের বিপথগামী করার অভিযোগে গোরাকে প্রায় ঘিরে ফেলে তারা যেসব অকথা, কুকথা শুনিয়েছিল, চব্বিশ বছরের জীবনে সে শোনেনি স্নানার্থীদের দু’চারজন এগিয়ে এসে তাদের না ঠেকালে গোরাকে তারা শারীরিক লাঞ্ছনা পর্যন্ত করতে পারত। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ন্যায়শাস্ত্রী বটকৃষ্ণ পণ্ডিত জানিয়েছিল, গোরাকে সুলতানি গারদে পোরার ব্যবস্থা তারা পাকা করে ফেলেছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার মতো ম্লেচ্ছ, কুলাঙ্গার ব্রাহ্মণের জীবনহানি ঘটতে পারে, এ ভয়ও দেখিয়েছিল কেউ কেউ। নবদ্বীপের চেনা আপন ঘাটে এভাবে অপমানিত হতে হবে, গোরা কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। ভিজে কাপড়ে স্তব্ধ হয়ে সে দাঁড়িয়েছিল। ন্যায়শাস্ত্রী এক প্রবীণ অভিভাবক তেড়িয়া ভঙ্গিতে তার টোলের ঝাঁপ বন্ধ করতে বলল গোরাকে। ছাত্রদের লেখাপড়া শেখানোর নাম করে, তাদের মাথা খাচ্ছে গোরা, এমন অভিযোগ করল। স্মার্ত নিধিরাম বলল, নিমাই পণ্ডিতের এত স্পর্ধা যে বাপ-মাকে উপেক্ষা করতে শেখাচ্ছে ছেলেদের। পিতৃপরিচয় নাকি এমন কিছু বড় পরিচয় নয়, একথাও টোলে বসে প্রচার করছে।

নিধিরামের অভিযোগ শেষ হতে আক্ষেপে ‘ছ্যা ছ্যা’ করে উঠল কয়েকজন অভিভাবক। গোরার টোল উচ্ছেদ করতে বুদ্ধিমন্ত খাঁর কাছে তদ্বির করবে, গোরাকে জানিয়ে দিল। ভয় পাওয়ার মানুষ গোরা নয়। তাকে ভয় দেখাতে চোখ লাল করে চড়া গলায় যে মানুষগুলো কথা বলছিল, সকলেই তার চেনা। তার সম্পর্কে অনেক কুকথা বছরখানের ধরে তারা রটিয়ে বেড়াচ্ছে। গোরাকে নপুংসক, এমনকি সমকামী অপবাদ দিতে তারা পিছপা হয়নি। দৈত্যের মতো তাগড়া শরীর যে সমর্থ পুরুষের তরুণী বধূ বিয়ের দু’বছর পরেও সন্তানহীনা থাকে, সে নিশ্চয় পুরুষত্বহীনতায় ভুগছে। বিয়ের পরে, বছর না ঘুরতেই যেখানে সতেরো, আঠারো বছরের ছেলে ‘বাবা’ হয়ে যায়, ‘মা’ হয় তেরো, চোদ্দোর মেয়ে, সেখানে চব্বিশের গোরা বিয়ের দু’বছর পরেও বাবা হতে পারে না, এ প্রশ্ন বাতাসে উড়ে বেড়ায়। ছোকরা নিশ্চয় নপুংসক, নপুংসক হওয়ার জন্যেই সে সমকামী। মাধবপণ্ডিতের ছেলে গদাধরের সঙ্গে তার এত ফস্টিনস্টি। উর্বর-মগজ পণ্ডিতদের কারণ বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তাদের কেউ কেউ বিষ্ণুপ্রিয়াকে বাঁজা ‘সন্দেহ করে। নিরীহ, নিরপরাধ গৃহবধূ বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে গুজব ছড়াতে তারা কসুর করেনি। শচীর কানে কথাটা তুলে দিতে আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়েছিল তারা। গোরা জানত, বিধর্মী যবনদের চেয়ে নবদ্বীপের রক্ষণশীল ব্রাক্ষ্মণপণ্ডিতদের একাংশ কম বিপজ্জনক নয়। যে কোনও অজুহাতে এই মানুষগুলো তাকে সমাজচ্যুত করে, এমন প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিতে পারে, যা মৃত্যুদণ্ডের শামিল। প্রায়শ্চিত্ত এড়াতে তখন আত্মঘাতী হওয়া ছাড়া তার উপায় থাকবে না।

মারমুখী অভিভাবকদের হুমকির সামনে ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে গোরা হাসল। তার দু’ঠোঁটে নির্ভয়, উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পড়তে দেখে লোহিতলোচন অভিভাবকেরা থতমত খেয়ে মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল। শান্ত গলায় গোরা তাদের জানাল, নবদ্বীপের মান্যবর পণ্ডিতদের নির্দেশ পাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে চতুষ্পাঠী বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা সে নিজেই শুরু করেছে। অভিযোগকারী অভিভাবকদের আশ্বস্ত করে ঘরমুখো রওনা করিয়ে দিল সে। ঘাটে স্নানার্থীর ভিড় বাড়ছিল। তাদের অনেকে গোরার বন্ধু, প্রিয়জন, তাকে ভালবাসে। গোরাকে কয়েকজন খিটকেল পণ্ডিতের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে দেখে তারা অবাক হল। গঙ্গায় না নেমে সামান্য দূরত্ব রেখে তারা দাঁড়িয়ে গেল। নবদ্বীপে গোরার অসংখ্য বন্ধু, শুভার্থী থাকলেও কিছু শত্রু আছে, তারা জানত। মানুষ হিসেবে তারা ভালো নয়। তারা কুচক্রী, ঘোঁট পাকাতে, ক্ষতি করতে তারা যে কোনও কাজ করতে পারে। গোরার বন্ধুদের কয়েক হাত দূরে জটলা করতে দেখে রুষ্ট অভিভাবকরা তড়িঘড়ি চম্পট দিল। ভিজে পোশাক বদলে বাড়ি ফেরার পথে চতুষ্পাঠী তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত, মনের মধ্যে গোরা পাকা করে নিল। দু’তিনদিন ধরে সে অনুভব করছিল, ছাত্র পড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কেতাবি জ্ঞানের চেয়ে বড় জ্ঞানে ভরে আছে চরাচর। সেই জ্ঞান কৃষ্ণভজনা। কৃষ্ণ মানে, ভালবাসা, ভালবাসা মানে কৃষ্ণ যে কৃষ্ণ, সেই হরি, ভালবাসা, প্রেম, প্রীতির জীবন্ত মূর্তি কৃষ্ণ, হরি, গোপাল, গোবিন্দ, মাধব, কেশব, যার যেমন খুশি সেই নামে ডাকে। শতেক নামে আসলে আবাহন করে ভালবাসাকে। গয়া থেকে নতুন আত্মপরিচয় নিয়ে নবদ্বীপে ফিরে গোরা টের পাচ্ছিল, সে একদম বদলে গেছে, রূপান্তর ঘটেছে তার। গুটি ভেঙে প্রজাপতি বেরিয়ে এসেছে। সুবিশাল নীল আকাশের নিচে উড়ন্ত প্রজাপতির রঙিন দুই ডানা থেকে ঝরে পড়ছে সত্যনিষ্ঠা, অলোলুপতা, ত্যাগ, সংযম, সত্ত্বসংশুদ্ধি। গঙ্গায় স্নান সেরে প্রজাপতির মতো ফুরফুরে মেজাজে ঘাটের সিঁড়ি ধরে ওঠার মুহূর্তে আচমকা একদল চেনা মানুষের আক্রোশের মুখোমুখি হয়ে সে ভয় না পেলেও বিষণ্ণ বোধ করছিল। মুখে হাসি ধরে রাখলেও বুকের ভেতরটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল। শুকনো ধুতি, চাদর শরীরে জড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে আধচেনা এক গেরুয়াধারী মানুষকে পলকের জন্যে দেখে তার মনের মেঘ দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল। মানুষটাকে চিনতে না পারলেও বিদ্যুৎ চমকের মতো এক সম্ভাবনা তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। অপরিচিত সন্ন্যাসী যে পথে বাঁক নিল, সেদিকে নন্দন আচার্যের বাড়ি। নন্দনও পরম বৈষ্ণব। শ্রীনিবাসের বাড়িতে সান্ধ্য-সঙ্কীর্তনে গোরাকে দেখে আর পাঁচজন ভক্তের মতো নন্দনও বিহ্বল হয়ে পড়ে। তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে হৃদয় বিগলিত আর্তির জল। পরম অতিথিপরায়ণ নন্দনের বাড়িতে অচেনা সন্ন্যাসী যে আতিথ্য ভিক্ষা করতে পারে, এমন এক ধারণা মাথায় নিয়ে গোরা ঘরে ফিরল। তার জন্যে সকালের জলখাবার নিয়ে শচী অপেক্ষা করছিল। তার গা ঘেঁষে বসেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। গোরা চতুষ্পাঠী খোলার পর থেকে এই নিয়মে চলছে শচীর সংসার। গোরা গয়া যাওয়ার পরে কিছুদিন বন্ধ ছিল সংসারের দৈনন্দিন চলন। সে ফিরতে আবার আগের মতো চতুষ্পাঠী চালু হওয়ার সঙ্গে চেনা ছন্দে সংসার জেগে উঠছে। সেই সকালেও তাই ঘটল। দুধ, চিড়ে, মুড়কি, কলা মেখে ফলার খেয়ে টোলের পথে রওনা দিল গোরা। বুদ্ধিমন্ত খাঁর বারবাড়িতে গোরা পৌঁছনোর আগে থেকে এক-দু’জন করে ছাত্র আসতে শুরু করেছে। বারবাড়িতে টোলের ঝাঁপ ভোরের আগে খুলে দেয় বুদ্ধিমন্তের এক খাসচাকর। টোল ঝাড়ামোছা, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাকে দিয়েছে বুদ্ধিমন্ত। গোরাকে প্রায় প্ৰভুজ্ঞানে সেবা করে সেই চাকর, যার নাম মান্যদাস। পড়ুয়াদের বসার জন্যে সে-ই টোলের দরজা খুলে দিল। গয়াফেরত গোরা যে আগের নিমাই পণ্ডিত নেই, সেও বুঝতে পারে। পুঁথিপত্র সামনে খুলে রেখে যে গোরা আগে ছাত্রদের পড়াত, এখন সে পুঁথির বাঁধন খোলে না। শুধুই কৃষ্ণনামের মহিমা ব্যাখ্যা করে। কৃষ্ণ মানে ভালবাসা, ভালবাসাই কৃষ্ণনাম, বারবার এই মন্ত্ৰ আওড়ে যায়। ছাত্ররা কতটা কী বোঝে, মান্য অনুমান করতে না পারলেও তার বুক আবেগে, ভালবাসায় ভরে ওঠে। চতুষ্পাঠীর দাওয়ায় গোরা এসে দাঁড়ালে, তার দু’পায়ের খড়ম খুলে পা দুটো ধোয়ার সময়ে মান্য ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ উচ্চারণ করলে সেই শূদ্রসন্তানকে গোরা বুকে টেনে নেয়। ছাত্ররা অবাক চোখে দেখে নিমাই পণ্ডিতের কাণ্ড। মান্যদাসের দু’চোখ জলে ভরে উঠেছে, এ দৃশ্যও তাদের নজর এড়ায় না। পুঁথি খুলে গোরা বসতে, তাকে ব্যাকরণের পাঠ্যে মনোনিবেশে বাধ্য করতে এক ছাত্র অনুরোধ করল, পণ্ডিতমশাই ব্যাকরণের ‘ধাতু’ বিষয়ে যে আলোচনা শুরু করেছিলেন, তা যদি একটু ব্যাখ্যা করেন। ধাতু শব্দটা শুনে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে গোরা বলল, কৃম্নশক্তিকে ধাতু বলা হয়।

প্রশ্নার্থী ছাত্রের মুখে বিরক্তি জাগলেও সরল গলায় সে কৃষ্ণশক্তির অর্থ জানতে চাইল। প্রশ্ন শুনে খুশিতে ঝলমল করে উঠল গোরার মুখ। বলল, পৃথিবীতে যত রাজা, প্রজা, চন্দনচর্চিত গুণী মানুষ, বিত্তবান মানুষ যতরকম সৌন্দর্য, তাদের অভ্যন্তরীণ প্রাণশক্তি হল ধাতু। ধাতুহীন রাজা, প্রজা, পণ্ডিত ধনীর দিকে মানুষ ফিরে তাকায় না। তাদের সব ঐশ্বর্য, সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। যে নিমাই পণ্ডিতকে পথেঘাটে দেখলে তোমরা প্রণাম করো, ধাতুহীন হয়ে গেলে, সে মৃত। তখন সেই নিমাই পণ্ডিতকে ছুঁলে তোমরা গঙ্গায় স্নান করবে। বাবার কোলে চেপে যে ছেলে মহাসুখে ঘুরে বেড়ায়, সেই একদিন বাবার ধাতু চলে গেলে তার মৃত মুখে আগুন দেয়।

উদ্ভাসিত ছাত্রদের মুখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে গোরা বলল, ধাতু হল প্রাণ, প্রাণের আরেক নাম কৃষ্ণশক্তি। প্রাণের প্রতি ভালবাসা আর কৃপ্রেম এক। যতদিন দেহে প্রাণ আছে, ততদিন কৃষ্ণভজনা করো, বল কৃষ্ণ মা, কৃষ্ণ বাবা, প্রাণের অমূল্য ধাতু কৃষ্ণ

ধাতুর ব্যাখ্যায় তন্ময় গোরা আরও দু’চার কথা বলে, হঠাৎ ধাতস্থ হয়ে ছাত্রদের মুখের দিকে নজর করে ঈষৎ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, ধাতু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি বোধহয় অনেক খাপছাড়া কথা বলে ফেললাম।

গোরার অনুরাগী ছাত্রদের একজন বলল, ব্যাকরণ বই-এর আলোচনার চেয়ে ধাতু সম্পর্কে অনেক উঁচু মানের ব্যাখ্যা করেছেন আপনি। আর কোনও পণ্ডিত এমন ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। আমি অন্তত শুনিনি। ভারি একঘেয়ে তাদের ব্যাখ্যা। ‘ধাতু’ অর্থে ‘ক্রিয়াগত শব্দমূল’ ছাড়া তারা কিছু বলবেন না।

‘ক্রিয়াগত শব্দমূল’ বললে কি কিছু ভুল বলা হয়, ছাত্রদের মধ্যে কেউ প্রশ্নটা করতে, গোরার ব্যাখ্যাতে মুগ্ধ এক ছাত্র বলল, ভুল বলা না হলেও পুরোটা বলা হয় না। ধাতু মানে প্রাণ, প্রাণের অন্তর্গত কান্তি, প্রাণের প্রাণ, যার নাম কৃষ্ণ

ছাত্রের ব্যাখ্যা শুনে মনে গভীর আরাম পেল গোরা। বলল, কৃষ্ণই হল কৃষ্ণশক্তি, প্রাণ। গোরার ব্যাখ্যা মেনে নিতে অরাজি ছাত্রদের এক পাণ্ডা বলল, হরিনামের সূত্র দিয়ে ব্যাকরণের ধাতু, ক্রিয়া, কাল, পদ, যাবতীয় অধ্যায় ব্যাখ্যা করা আমি বুঝতে পারি না। আমার মতো আরও কেউ কেউ এই ব্যাখ্যা শুনে বিষম খায়। আমাদের আদৌ ব্যাকরণ শিক্ষা হচ্ছে কিনা, এ নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ জেগেছে।

কিশোর ছাত্রটির মুখের দিকে গোরা যখন বিষাদমাখা চোখে তাকিয়ে আছে তার অনুগত ছাত্ররা তখন হৈচৈ জুড়ে দিয়েছে। সবাই বলছে আমাদের গুরুর মতো এত পণ্ডিত নবদ্বীপের আর কোনও টোলে নেই।

গাঁকগাঁক করে বিরোধীরা উল্টোকথা বলতে থাকল। কচিমুখগুলো গোরার চেনা। তাদের দেখলে স্নেহে ভরে ওঠে গোরার মন। তাকে গঙ্গার ঘাটে কাকভোরে যারা চতুষ্পাঠীতে তালা লাগানোর হুকুম করেছিল, তাদের সন্তান এই ছাত্ররা। গোরাকে তারা অপমান করলেও সে রাগল না। গয়া ঘুরে আসার পর থেকে তার মনে রাগের সামান্য ঝাঁঝ অবশিষ্ট ছিল না। শিশু, বালক দেখলেই তার মনের ভেতরটা স্নেহে নরম হয়ে যেত। কচিকাঁচা, কিশোর ছাত্রদের মুখের দিকে নজর করলে শুনতে পেত বাঁশির ধ্বনি। কৃষ্ণবর্ণ এক শিশু অদূরে কোনও গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছে, সুরে মোহিত করছে তার হৃদয়, বিশ্বচরাচর। গয়া যাওয়ার আগে পর্যন্ত নাচ, গান, অভিনয় নিয়ে মেতে থাকার দিনগুলোতে সে শুধুই আনন্দ পেত, অনুষ্ঠান উপভোগ করত, সম্প্রতি তার শরীরে, মনে নতুন কিছু লক্ষণ জাগছে। সঙ্কীর্তনের আসরে, সুরের অচেনা লহরী তার মনে ভর করে, কাঁটা দিয়ে ওঠে শরীর, ঘাম জমতে থাকে কপালে, মাথার ভেতরে স্থান, কাল, পাত্রের চেতনা ক্রমশ এত ধূসর হতে থাকে, সে অনুভব করে, পায়ের নিচে মাটি নেই, হাওয়ায় ভাসছে তার শরীর, যে কোনও মুহূর্তে সে জ্ঞান হারাতে পারে। চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের প্রশংসা, সমালোচনার মধ্যে কৃষ্ণবর্ণ বালকটির বাঁশির সুর তার কানে ভেসে আসতে থাকল। কাঁপুনি জাগল তার শরীরে, আনন্দে গায়ে কাঁটা দিল, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম ভাব আসতে পুঁথি বন্ধ করে সুতো দিয়ে সেটা বেঁধে গোরা বলল, তোমাদের পড়ানোর ক্ষমতা আমার আর নেই। তোমরা ছুটি দাও আমাকে। কাল থেকে এই চতুষ্পাঠীর দরজা আর খুলবে না। নবদ্বীপে আমার মতো অনেক পণ্ডিত আছে। তাদের চতুষ্পাঠীতে যোগ্য শিক্ষা পাবে তোমরা। আমার শুধু একটা উপদেশ, তোমরা কৃষ্ণের শরণ নাও, তোমাদের জিভের ডগায় সবসময়ে কৃষ্ণনাম যেন স্ফুরিত হয়।

গোরার কথা শুনে তার প্রিয় ছাত্ররা হাউহাউ করে কাঁদতে থাকল। অনুরাগী শিষ্যদের কেউ বলল, আপনার মতো শিক্ষক কোথাও পাব না। করজোড়ে কেউ বলল, আপনার মুখে ব্যাকরণের যে ব্যাখ্যা শুনেছি, জন্মে জন্মে তা বুকের মধ্যে জমা থাকবে।

গোরার পঠনপাঠনের পদ্ধতিতে ক্ষুব্ধ ছাত্ররা ভাবল, বাপরে বাপ, শেষ পর্যন্ত পাগল পণ্ডিতের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। তাদের বাবা-কাকাদের ভয়ে নিমাই পণ্ডিত টোলের ঝাঁপ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, এই গর্বে ফুলে উঠল তাদের বুক। চতুষ্পাঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র তখন প্রিয় অধ্যাপকের টোল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত শুনে হাপুস নয়নে কাঁদছিল। চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের মঙ্গল কামনা করে চিরকালের মতো সেখান থেকে গোরা চলে এল। বাড়ি ফিরল না সে। অশ্রুসজল ছাত্রদের মুখগুলো ভেবে ভারাক্রান্ত মনে শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়িতে এসে ঢুকল। শ্রীবাসের একান্নবর্তী বড় পরিবার। দু’বেলা পঞ্চাশটা পাত পড়ে। নবদ্বীপে বৈষ্ণবসমাজের নেতা শ্রীবাসের বাড়িতে বিষ্ণুমন্দির আছে। সকাল সন্ধে সেখানে সমারোহে বিষ্ণুর সেবা, আরতি হয়। শ্রীবাসের তিন ভাই শ্রীরাম, শ্রীপতি, শ্রীকান্তের যৌথ সংসারে তাদের সকলের অগ্রজ, লোকান্তরিত নলিনী পণ্ডিতের বিধবা বউ, এক ছেলে, এক মেয়ে নারায়ণী ছিল, আশ্রিত আর যারা ছিল, তাদের একজন শ্রীবাসের বিধবা শাশুড়ি, কয়েকজন নিকটাত্মীয়। অল্পবয়সে বিধবা হয়ে কুমারহট্টের শ্বশুরালয় থেকে বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে হয়েছিল নারায়ণীকে। কুমারহট্টের বাসিন্দা বিপ্র বৈকুণ্ঠের সঙ্গে নারায়ণীর বিয়ের দ্বিতীয় বছরে সে হারায় স্বামীকে। তার কোলে তখন দু’মাসের শিশ। স্বামী পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরের মাসে তিন মাসের ছেলেকে হারিয়েছে নারায়ণী। শ্বশুরবাড়িতে তার ভাত জুটত না। কুমারহট্ট থেকে তাকে নবদ্বীপে নিয়ে এসেছিল সেজকাকা শ্রীপতি। গৃহদেবতা বিষ্ণুসেবার সব দায়িত্ব নিয়েছিল ভাগ্যহীন, বালবিধবা নারায়ণী। সকাল থেকে বিষ্ণুপুজোর সঙ্গে সংসারের কলকাকলিতে শ্রীবাসের বাড়িতে আনন্দের যে প্রবাহ বয়ে যেত, শিশুবয়স থেকে তার মধ্যে গোরা বড় হয়েছে। বাড়িতে কোনও দুষ্টুমি করলে বাবা জগন্নাথ মিশ্রের ভয়ে সে যেমন শ্রীবাসের স্ত্রী মালিনীর আঁচলের আড়ালে লুকতো, তেমনি বিনা আমন্ত্রণে মনের খুশিতে শ্রীবাসের উঠোনে এসে নেচেগেয়ে পরিবারের সকলের হৃদয় জয় করে নিত। দেবশিশুর মতো রূপবান জগন্নাথের ছোট ছেলে কোথা থেকে নাচগানের এমন তালিম পায়, তারা বুঝতে পারত না।

চতুষ্পাঠী থেকে বেরিয়ে মনের আরাম খুঁজতে শ্রীবাসের বাড়ির উঠোনে গোরা পা রাখতে শ্রীবাস, শ্রীপতি, তাদের বউ, ছেলেমেয়েরা আনন্দে হৈ হৈ করে তাকে অভ্যর্থনা করল। বিষ্ণু মন্দিরের দাওয়ায় শ্রীবাসের সঙ্গে বসেছিল মুকুন্দ, গদাধর, জগদানন্দ, দামোদর, আরও কয়েকজন গোরার অনুরাগী বৈষ্ণবভক্ত। গঙ্গার ঘাটে সেই সকালে গোরাকে কয়েকজন পাষণ্ডীর ঘিরে ফেলার ঘটনা তাদের কানে পৌঁছে গিয়েছিল। নবদ্বীপবাসী বেশিরভাগ বৈষ্ণব কিছুক্ষণের মধ্যে এই খবর শুনে গোরার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়েছিল। তার খোঁজখবর করতে ভক্তদের দু’একজন জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে হাজির হয়ে জেনেছিল, গোরা চতুষ্পাঠীতে গেছে। চতুষ্পাঠী পর্যন্ত ধাওয়া করে আড়াল থেকে সুস্থ, হাসিমুখ গোরাকে দেখে তারা শ্রীবাসের বাড়িতে তার পরামর্শ নিতে এসেছিল। পরামর্শ চলার মধ্যে গোরাকে উঠোনে দেখে সসম্ভ্রমে সবাই উঠে দাঁড়াল। প্রতি সন্ধেতে এই উঠোনে সঙ্কীর্তনের আসরে দিব্যভাবে আপ্লুত যে মানুষটা ঈশ্বরপ্রতিম হয়ে ওঠে, তার অবতারত্বে অনুগামীদের বিশ্বাস ততদিনে গভীর হয়েছে। শান্তিপুর থেকে শ্রীবাসকে স্বয়ং অদ্বৈত আচার্য প্রায় নিয়মিত একই বার্তা পাঠাচ্ছিল। রোজ রাতে কখনও চতুর্ভুজ, কখনও ষড়ভুজ কৃষ্ণের বেশে গোরা দেখা দিচ্ছে তাকে। অবতার বেশে ঈশ্বরকে মর্ত্যে আনতে তার প্রার্থনা পূরণ হয়েছে। গোরার দর্শন পেতে আকুল হয়ে সেবক অপেক্ষা করছে। দাওয়ায় আপনজনদের দেখে বিষাদে ভারি হয়ে থাকা গোরার মন একটু হালকা হল। উজ্জ্বল হতে থাকল তার মুখ। শ্রীবাস সমেত অনুগামীরা সাষ্টাঙ্গে তাকে প্রণাম করে বসার জন্যে আসন পেতে দিল। সুতোর ঝালর লাগানো সেই আসনের দিকে না তাকিয়ে মন্দিরের মধ্যে ভগবান বিষ্ণুর খাটের ওপর গোরা জাঁকিয়ে বসতে ভক্ত অনুগামীরা কয়েক মুহূর্তের জন্যে থতমত খেল। সকালে যে বিষ্ণুমূর্তি পূজার জন্যে খাটে পাতা বিছানা থেকে নামিয়ে বেদিতে স্থাপন করা হয়, দুপুরে বিশ্রামের জন্যে তাকে ফিরিয়ে আনা হয় খাটে পাতা দুধসাদা শয্যাতে। তার আগে পর্যন্ত খাট খালি থাকে। চোখ কচলে শ্রীবাস দেখল খাটের ওপর যে বসে আছে, সে গোরা নয়, আবার গোরাও বটে। তার মতো স্বর্ণাভ গায়ের রঙ, স্বয়ং কৃষ্ণ, দু’হাতে দণ্ড, কমণ্ডলু, অন্য চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে খাট আলো করে বিরাজ করছে। ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ মূর্তি দেখে শ্রীবাস ভিরমি খেল। শ্রীবাস বেহুঁশ হয়ে যেতে বাকিরা টের পেল, খাটে প্রকৃতই ষড়ভুজ গোরা অধিষ্ঠান করছে। গোরার শরীরে কৃষ্ণ, বিষ্ণুর রূপারোপে তাদেরও জ্ঞান হারানোর দশা হল। হরিধ্বনি করে উঠল গদাধর, জগদানন্দ দামোদর আবৃত্তি করতে থাকল ভাগবত। মুকুন্দর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল না। অঝোরে কাঁদতে থাকল সে। শ্রীবাসের পরিবারের প্রায় সবাই বিষ্ণুমন্দিরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাগবত আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্কীর্তন শুরু হয়ে যেতে গোরা টের পেল মাথার ভেতর মধুর সুরে বাঁশি বাজতে শুরু করছে সারা শরীরে ভেঙে পড়ছে অদৃশ্য ঢেউ-এর পর ঢেউ। সক্ষম মুঠিতে এখন স্বর্গ, মর্ত্য, রসাতল ধরার অনুভূতি জাগবে। বাস্তব পৃথিবীর সব পরিচয় থেকে কিছুক্ষণের জন্যে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। গোরার মুখে শরীরে এক মহাভাব আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে দীপ্তিমান করে তুলছিল তাকে। বিষ্ণুসেবিকা বিধবা নারায়ণী অবাক হয়ে দেখছিল ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠা রূপবান গোরাকে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে পাশের বাড়ির গোরাদাদাকে সে দেখছে। কী সাংঘাতিক ডানপিটে ছিল, বলার কথা নয়। গঙ্গার ঘাটে তার হতে সাজানো শিবপুজোর ডালা থেকে কলা, সন্দেশ, বাতাসা তুলে খেয়ে নিয়ে বলত আমিই শিব, কখনও বলত, শিবের বাবা আমি।

গোরার দস্যিপনায় নারায়ণী যত ভয় পেত, তার চেয়ে বেশি লজ্জা পেত। গোরাকে শিব ভাবলে নারায়ণীর গায়ে কাঁটা দিত। বেড়ে যেত বুকের ধুকপুকুনি। মা, কাকিদের আড়ালে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির গোরাদাদাকে বিষ্ণুশয্যায় সুখাসনে সমাসীন দেখে তার মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে স্বয়ং গোলোকপতি তাদের বাড়িতে নেমে এসেছে। সম্ভ্রমে, ভালবাসায় সে মোহিত হয়ে গেল। গোরার ভাবাবেশ কাটতে বিশেষ সময় লাগল না। সকালে চতুষ্পাঠী যাওয়ার পথে কুয়াশার মধ্যে শরীরে নীল ধুতি চাদর, মাথায় একই রঙের কাপড়ের পাগড়ি জড়ানো যে মানুষটাকে মুহূর্তের জন্যে দেখে চেনা লেগেছিল, অল্প সময় মনে ছড়িয়ে ছিল ভুবনভোলানো আনন্দ, সে যে খলাপপুর, একচক্রা গ্রামের কুবের, এ বিষয়ে তার সন্দেহ থাকল না। কাটোয়ার শ্রীখণ্ডে সুলতানি দরবারের কর্মচারী, নারায়ণ দাস সরকারের বাড়িতে তার দুই ছেলে, মুকুন্দ আর নরহরির সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কুবের। নরহরি এখনও তার সহচর, প্রত্যেক সন্ধেতে সঙ্কীর্তনের সঙ্গী। তার দাদা মুকুন্দ গৌড়ের সুলতানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। সে-ও নিয়মিত গোরার খোঁজ নেয়। সুযোগ পেলে নবদ্বীপে গোরার বাড়িতে এসে তার সাহচর্য উপভোগ করে। কুবেরের পরিবারের সঙ্গে লতায়-পাতায় সম্পর্ক থাকলেও তার বিশেষ খবর শ্রীখণ্ডতে আত্মীয়রা পেত না। কুবেরের বাবা হাড়াই পণ্ডিত, কুলপরিচয়ে যার নাম, মুকুন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, সে একবার চিঠিতে গৌড় দরবারের চিকিৎসক শ্রীখণ্ডের মুকুন্দকে জানিয়েছিল, কুবের তার পুরনো অবধূত গুরুর হদিশ না পেয়ে সঙ্কর্ষণপুরীকে সঙ্গী করে মহারাষ্ট্রের পান্ধারপুরে পৌঁছে মাধবেন্দ্রপুরীর গুরু লক্ষ্মীপতির কাছে দীক্ষা নিয়েছে। কুবেরই নাকি একশ’ বত্রিশ বছর বয়সী লক্ষ্মীপতির শেষ শিষ্য। তাকে দীক্ষা দেওয়ার জন্যে বৈষ্ণবসাধক লক্ষ্মীপতি এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছিল। পান্ধারপুর ছেড়ে কুবের কোথায় গেছে, তার বাবা, হাড়াই পণ্ডিত ওরফে মুকুন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাতে পারেনি। শ্রীখণ্ডের সরকার পরিবারের নরহরির সূত্রে সেই খবর গোরা জেনেছিল। খুশি হয়েছিল খবরে। আনন্দের রসে সবসময়ে মৌমাছির মতো ডুবে থাকা হৃদয়বাণ, আত্মভোলা কুবেরের সঙ্গে পরিচয়ের পর যতবার তার সঙ্গে গোরার দেখা হয়েছে, পুলকে ভরে গেছে তার মন। প্রাণের স্তরে স্তরে গভীর আরাম পেয়েছে। সেই সকালে নীল পোশাক, পাগড়ি ঢাকা মানুষটা যে কুবের, গুরুর গুরু মাধবেন্দ্র পুরীর গুরুভাই সেই অর্থে মহাগুরু, গোরা টের পেল। সাতবছর আগে কুবেরের সঙ্গে মেলামেশা করার দিনগুলোতে যে আনন্দ পেয়েছিল, ঠিক সেই অনুভূতি কয়েক মুহূর্তের জন্যে ফিরে এসেছিল তার মনে। তারপর কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। শ্রীবাসের বাড়ির মন্দিরে বিষ্ণুদেবতার খাটে বসে কিছুক্ষণ ভাবাবেগে স্তব্ধ হয়ে থাকার পরে ফের সেই আনন্দে ভরে উঠল গোরার মন। মুকুন্দকে বলল, আমার মনে হচ্ছে নবদ্বীপে একজন উঁচু দরের সন্ন্যাসী, মহাপুরুষও বটে, আজ এসেছে। তাকে দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়েছে আমার মন। তোমরা খুঁজে বের করো তাকে।

গোরার ষড়ভুজ বিষ্ণুতে রূপান্তরের কাহিনী ততক্ষণে প্রতিবেশীদের মধ্যে, সেখান থেকে মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছিল। বিষ্ণুমন্দিরে এসে হাজির হয়েছিল মুরারি, নারায়ণ আরও কিছু বৈষ্ণবভক্ত। গোরার অনুরোধে শ্রীবাস আর মুকুন্দ ছাড়া বাকিরা সন্ন্যাসী মহাপুরুষের খোঁজে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে রামচন্দ্রপুরের নানা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল, শ্রীবাসের উঠোন ব্রাহ্মণপাড়ার বেশ কিছু বৈষ্ণবভক্ত জড়ো হয়েছিল। মহাপুরুষের তল্লাশিতে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের মধ্যে মুরারি গেল শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারীর বাড়ি, গদাধর হাজির হল চন্দ্রশেখর আচার্যর বাড়ি, রামচন্দ্রপুরের বৈষ্ণবভক্তদের প্রায় সকলের ঠিকানায় ঘুরে কোনও বিদেশি সন্ন্যাসীর দেখা না পেয়ে একে একে সবাই হতাশ হয়ে শ্রীবাসের বাড়ি ফিরে এল। গোরা শুনল, নামী বৈষ্ণবভক্তদের কারও বাড়িতে অচেনা কোনও সন্ন্যাসীর দেখা মেলেনি। বিষ্ণুর খাট ছেড়ে গোরা নিজে উঠে সঙ্গীদের নিয়ে সেই সন্ন্যাসী, অর্থাৎ কুবেরের খোঁজে বেরল। কুবেরকে ভোরের কুয়াশায় পথের যে বাঁকে গোরা মিলিয়ে যেতে দেখেছিল, সেখান থেকে অল্প দূরে পরম বৈষ্ণব নন্দন আচার্যের বাড়ি। যৌবনে নন্দনও তান্ত্রিক অবধূত গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। বছর তিনেক অবধূতের জীবন কাটিয়ে নন্দন সংসারে ফিরে আসে। অদ্বৈত আচার্যের প্রভাবে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। বৈষ্ণবসমাজে সে এখন নেতৃস্থানীয় ভক্ত। অনুগামীদের নিয়ে সোজা নন্দন আচার্যের বাড়িতে ঢুকে গোরা দেখল নীল পোশাকে দাওয়ায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কুবের হাসছে। সদরে কয়েক জোড়া পায়ের শব্দে সেদিকে তার নজর পড়ল, প্রায় সবগুলো তার চেনা মুখ। সকলের সামনে গোরা। বিষ্ণুখাট দখল করে বসে থাকা মহাজ্ঞানে আচ্ছন্ন গোরাকে তার অনুরাগীরা তসরের চাদর, মালা, ফুল, কপালে চন্দন তিলক এঁকে সাজিয়ে অদেখা বিম্বুকে খুঁজে পেয়েছিল। তার চাদরে, ধুতিতে সুবাসিত তরল ছিটিয়ে, দু’পা গঙ্গাজলে ধুয়ে, পায়ের পাতায় রক্তচন্দন লেপে আরাধ্য দেবতার মতো সাজিয়ে তুলেছিল তাকে। মহাকায়, সুদীর্ঘ বাহু, সুসজ্জিত গোরাকে সাতবছর পরে দেখে আনন্দে, আবেগে, ভালবাসায় ভরে গেল কুবেরের মন। তার দু’চোখ জলে ভরে গেল। দু’জনে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকল। চলচ্ছক্তিহীন হয়ে গিয়েছিল কুবের। গোরার শরীর থেকে অস্থির ঢেউ উঠছিল। সে দৌড়ে দাওয়ায় উঠে এসে কুবেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করল, এতদিনে আমাকে তোমার মনে পড়ল নিত্যানন্দ?

গোরার কাঁধে মাথা রেখে কুবের বলল, তোমার মুখ থেকে নিত্যানন্দ নামটা শোনার জন্যে দিন গুনছিলাম।

কুবের মুহূর্তে নিত্যানন্দ নামে অভিষিক্ত হয়ে আনন্দে শিশুর মতো কাঁদছিল। গদাধরের দিকে তাকিয়ে মুরারি বলল, বল প্রভু, নিত্যানন্দের জয়!

নিত্যানন্দের জয়ধ্বনিতে গদাধরের সঙ্গে সবাই গলা মেলাল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নন্দন আচার্য বলল, গৌর, নিত্যানন্দের মিলনে এবার প্রেমভক্তিতে নবদ্বীপ ভেসে যাবে।

কুবের তখনও বলছিল, আহা, কী মধুর নাম, নিত্যানন্দ!

গোরার গলা জড়িয়ে ধরে কুবের বলল, সখা, আমার জন্মান্তর ঘটিয়ে দিলে তুমি। নিত্যানন্দ, শব্দটা শুনলেই প্রাণ ভরে যায়। প্রকৃত নিত্যানন্দের স্বরূপ খুঁজতে দেশে দেশে ঘুরে শেষপর্যন্ত আমি নিজেই নিত্যানন্দ হয়ে গেলুম। আমার বুকের ভেতরটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের নামে সৌন্দর্য না থাকলে তার মর্যাদা বাড়ে না। মানহীন অনেক মানুষের নাম, পরিচয়ে তুমি বদল ঘটাবে, আমি বুঝতে পারছি। সেই আশা নিয়ে নবদ্বীপে তোমার কাছে এসেছি।

গোরা তার গুরুর গুরু, তারও গুরু লক্ষ্মীপতির কাছে নিত্যানন্দের দীক্ষা নেওয়ার খবর শুনেছিল। নিত্যানন্দকে গোরা ঢিপ করে প্রণাম করতে, তাকেও সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল নিত্যানন্দ। গোরা অস্বস্তিতে দু’পা পিছিয়ে গেলেও বৈষ্ণব ভক্তরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল উঁচু মাপের দু’জন মানুষের সৌজন্য বিনিময়। তাদের কেউ কেউ ভাবল, সমাজজীবনে এই ভদ্রতা, বিনয়, সৌজন্যবোধ ছড়িয়ে পড়লে রাঢ়ের মানুষের চরিত্র বদলে যেত। তাদের মুখচোখে ছড়িয়ে পড়ল মহামানবিক এক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন!

নিত্যানন্দকে নিয়ে গোরা সপারিষদ শ্রীবাসের বাড়ির সদরে এসে দাঁড়াতে বাড়ির বউ, মেয়েরা শাঁখ বাজিয়ে উলুধ্বনি করে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। গোরার ষড়ভুজ মূর্তি পরিগ্রহণের বিবরণ ইতিমধ্যে ছড়িয়ে যেতে বাড়ির উঠোনে ভিড় করেছিল পাড়ার মানুষ বিষ্ণুমন্দিরের সামনে জড়ো হওয়া পরিবারের মেয়েদের সকলের আগে ছিল গৃহদেবতার সেবিকা নারায়ণী। তাকে দেখিয়ে নিত্যানন্দকে তার পরিচয়, শ্রীবাস জানাতে, অবধূত, বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর পা ছুঁয়ে ভক্তিভরে নারায়ণী প্রণাম করল। সাদা থান জড়ানো বিধবা নারায়ণীর মাথায় লম্বা ঘোমটা, তরুণী মেয়েটির মুখ না দেখে তাকে নিত্যানন্দ আশীর্বাদ করল, পুত্রবতী হও।

নিত্যানন্দের বাঁপাশে দাঁড়িয়ে তার আশীর্বাণী শুনে শ্রীবাসের বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠল। সামান্য এগিয়ে ছিল গোরা। সে ভাবাবিষ্ট থাকলেও ঘুরে তাকাল শ্রীবাসের দিকে। প্রণাম সেরে লজ্জিত নারায়ণী উঠে দাঁড়িয়ে নিত্যানন্দের সামনে থেকে তাড়াতাড়ি সরে গেল। তাকে এক মুহূর্ত দেখে নিত্যানন্দ বুঝল, আশীর্বাদ করতে গিয়ে মেয়েটাকে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে। নিত্যানন্দকে শ্রীবাস নিচু গলায় জানাল, কিছুদিন আগে তার এই ভাইঝি, নারায়ণী বিধবা হয়েছে। নারায়ণীর কোলে একটি শিশুপুত্র ছিল। স্বামীকে হারানোর একমাস পরে ছেলেটিও পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়।

নারায়ণীর দুর্ভাগ্যের বিবরণ শুনে দুঃখে কালো হয়ে গিয়েছিল তার মুখ। তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কোনও মেয়ের অকাল বৈধব্য ঘটলে সে কেন আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার সুযোগ পাবে না? স্বামী, ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সংসার করার স্বপ্ন, কেন চিরকালের মতো মুছে যাবে?

বেশ কিছুদিন পরে প্রশ্নটা গোরাকে সে করেছিল। নিত্যানন্দের প্রশ্ন শুনে গোরা বলেছিল, প্রশ্নটা আমার মনে বহুবার জেগেছে।

নারায়ণীর জন্যে সমবেদনায় গাঢ় স্বরে গোরা ফের বলেছিল, মেয়েটার পেটের সন্তানটা যদি বেঁচে থাকত! স্বামীর চেয়ে মেয়েদের বেশি দরকার হয় সন্তানের, সন্তানধারণ না করলে তাদের জীবনে পূর্ণতা আসে না। একটা বাচ্চার জন্যে তারা হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে।

নিতাই বলেছিল, বিধবা সাবিত্রীকে শতপুত্রের জননী হওয়ার বর দিয়েছিল মৃত্যুপুরীর রাজা, যম। সাবিত্রী সেই বর পেতে তখনই তার মৃত স্বামী, সত্যবানের শরীরে প্রাণ ফিরে এসেছিল।

গোরার সঙ্গে নিত্যানন্দের এসব আলোচনা যখন চলছে, তখন শ্রীবাসের বাড়ির বাসিন্দা সে। তাকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল গোরা। শ্রীবাসের বাড়িতে তিনরাত কাটার আগেই তার পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিল বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত অবধূত সন্ন্যাসী নিত্যানন্দ। তাকে মাতৃস্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিল শ্রীবাসের স্ত্রী মালিনী। পরিবারের সকলের সে আপনজন হয়ে উঠলেও তাকে এড়িয়ে চলত নারায়ণী। নিত্যানন্দকে ভয় না পেলেও তাকে দেখলে নারায়ণীর বুকের ভেতরটা দুড়দুড় করত। সন্ন্যাসীর মুখ থেকে পুত্রবতী হওয়ার আশীর্বাদের ঘটনাটা মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দিত। চোখের সামনে ভেসে উঠত মৃত ছেলের মুখ। পৃথিবী ছেড়ে তিন মাসও হয়নি সেই শিশু চলে গেছে। সকাল, সন্ধে এখনও ভিজে ওঠে তার বুকের কাপড়

পরিবারে ততদিনে তাকে নিতাই নামে ডাকা শুরু হয়ে গেছে। খটোমটো নিত্যানন্দের বদলে সহজ নিতাই নাম, গৃহিণী মালিনী-ই রেখেছিল। ভক্তিতে বিগলিত নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজ সানন্দে মেনে নিল নিতাইকে। সন্ন্যাসীর দণ্ড কমণ্ডলু ভেঙে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে গোরার ছায়াসঙ্গী হয়ে গেল নিতাই। স্বভাব বাউণ্ডুলে মানুষটা শ্রীবাস পণ্ডিতের সংসারে প্রায় গৃহীর মতো বাস করলেও নতুন ভাবাবেশে মাতোয়ারা হয়ে উঠল। সঙ্কীর্তনের আসরে দেখা গেল একচাকা, খলাপপুর থেকে আসা মানুষটি গোরার প্রধানসহচর। গোরার মতো নেচেগেয়ে ভক্তদের মনে ভাবের তরঙ্গ তুলে চলেছে সে। সন্ন্যাসীর দণ্ড কমণ্ডলু ভেঙে ফেলেছে। গোরাই এখন তার ধ্যান, জ্ঞান, প্রাণ। গোরার মতো মানুষের সঙ্গ পেলে একজন সন্ন্যাসীর আর দণ্ড কমণ্ডলুর দরকার হয় না। সঙ্কীর্তনের আসরে নিতাই একদিন গেয়ে উঠল, ‘যে জন গৌরাঙ্গ ভজে সে হয় আমার প্রাণ রে।’

ভক্তদের মুখে মুখে সে গানের কলি ছড়িয়ে পড়ার আগে নিতাইকে থামিয়ে দিল গোরা। বলল, কৃষ্ণ বলো, কৃষ্ণ ভাবো, কৃষ্ণ চিন্তা করো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *