গোরা – ৩১

৩১

মহামিছিলের খবর যত তাড়াতাড়ি গৌড়ের রাজধানী একডালায় সুলতানের দরবারে পৌঁছে গিয়েছিল, তার চেয়ে একটু শ্লথগতিতে লোকমুখে সাতকাহন হয়ে গোরার প্রতিপক্ষ শিবিরের কানে যাচ্ছিল। গোরার নেতৃত্বে শ্রীবাসের বাড়িতে ছত্রিশ জাতের মানুষের জমায়েত আর মহোৎসবের ঘটনা আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে শান্তিপুর, হালিশহর পরগণার কুমারহট্ট, ফুলিয়া, গুপ্তিপাড়া, সপ্তগ্রাম, বংশবাটি, ত্রিবেণীর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা জেনে গেলেও গোটা রাঢ়, সুক্ষ্ম, সমতটে সে কাহিনী সাত-দশদিন ধরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। বৈষ্ণববিরোধী স্মার্ত, নৈয়ায়িক, শাক্ত, তন্ত্রাচারীরা রাগে খেপে উঠছিল। নিষ্কর্মা, ভিক্ষাজীবী, উচ্ছৃঙ্খল বৈষ্ণবদের স্বেচ্ছাচারিতায় সনাতন হিন্দুধর্মের সর্বনাশ ঘটতে চলেছে, এ নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিল না। গোরা আর তার অনুগামীদের শায়েস্তা করতে তারা ঘোঁট পাকাতে শুরু করল। নবদ্বীপের রাজা কাশীনাথ রায় ও বৈষ্ণবদের পৃষ্ঠপোষক ছিল না। গোরার জনপ্রিয়তার খবর যত বেশি তার কানে যাচ্ছিল, তার গাত্রদাহ বাড়ছিল। রাজসভায় স্মার্ত, নৈয়ায়িক, তন্ত্রবিশ্বাসীরা রাজার কান ভাঙানোর সঙ্গে বৈষ্ণবদের নবদ্বীপ ছাড়া করতে নিজেরা সংগঠিত হচ্ছিল। রাজা কাশীনাথ রায় ছিল সুলতানি দরবারের একজন প্রভাবশালী আমীর। রাজাকে সামনে রেখে গোরার বিরুদ্ধে সুলতানকে লাগিয়ে দিতে তারা শলাপরামর্শ চালাতে থাকল। গোরাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে তারা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইল, যাতে প্রাণ হাতে করে নবদ্বীপ ছেড়ে পালাতে গোরা বাধ্য হয়। পৃথিবী ছেড়ে সে চলে গেলেও তাদের আপত্তি নেই, বরং যাওয়ার পথ তারা সুগম করে দিতে পারে। গোরাকে ধরাধাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার পন্থা প্রকৃতপক্ষে তারা ভাঁজতে শুরু করল।

সুলতানি মসনদের সুরক্ষার জন্যে গোরাকে শূলে চড়ানোর চিন্তা, একডালার দরবারে ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছিল। নবদ্বীপের বৈষ্ণবসম্প্রদায়কে উচ্ছন্নে পাঠাতে খান-ই-জাহান, প্রধানমন্ত্রী সুলতানাবাদী দায়িত্ব পেয়েছে, এমন গুজব শুনে গৌড়ের ব্রাহ্মণ্যবাদীরা স্বস্তির সঙ্গে কিছুটা ভয় পেয়েছিল। সুলতানাবাদী কড়া ধাতের লোক। তার চোখে কাফেরমাত্রই শয়তান বামুন, বৈয়বে কোনও ফারাক নেই। নবদ্বীপের কয়েক ক্রোশ দূরে, নৈকষ্য কুলীন ব্রাহ্মণদের গ্রাম পীরল্যাকে রাতারাতি মুসলিম বসতি করে দিয়েছিল ইসলামাবাদী। পীরল্যার প্রতিটা পরিবারকে গোমাংস খেতে বাধ্য করেছিল সে। সকলের জাতিনাশ করেছিল। নবদ্বীপে একইরকম ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নবদ্বীপ থেকে বৈষ্ণবদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারলে সুলতানের প্রতিহিংসা থেকে এই নগরের ব্রাহ্মণকুলকে বাঁচানো যায়। হ্যাঁ, সেটাই পথ। নবদ্বীপের গোঁড়া ব্রাহ্মণবাদীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। নবদ্বীপকে বৈষ্ণবমুক্ত করতে গোরাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে তারা দল পাকাতে শুরু করল। কুরমাহট্ট থেকে সপ্তগ্রাম পর্যন্ত নানা জায়গায় গোপন সভাতে জড়ো হয়ে শলাপরামর্শ চালাতে থাকল। গোরাকে নিকেশ করতে পারলে নবদ্বীপ খালি করে বৈয়বেরা পালাতে শুরু করবে, এ নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিল না। বৈষ্ণবদের বিরুদ্ধে, আরও খোলাখুলি বললে গোরাবিরোধী ব্রাত্মণ্যবাদীদের চক্রান্তে সব স্মার্ত, নৈয়ায়িক, শাক্ত, তান্ত্রিক ব্রাহ্মণরা হাত মিলিয়েছিল, এমন নয়। প্রকৃত জ্ঞানী, সুবিবেচক অদ্বৈত বেদান্তবাদী ব্রাহ্মণ্য তখন নবদ্বীপে কম ছিল না। উড়িষ্যারাজ গজপতি প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত, বাসুদেব সার্বভৌমের ভাই, কুলিয়ার বিদ্যানগরবাসী, বাচস্পতি ভট্টাচার্য, যাকে বিদ্যাবাচস্পতি নাম পণ্ডিতমহল একডাকে চিনত, স্মার্তপণ্ডিত রঘুনন্দন, তন্ত্রাচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ভাই, মাধবানন্দ সহপ্রাক্ষ জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ হৃদয়ানন্দ বিদ্যার্ণব আরও কেউ কেউ গোরার বিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে শামিল হতে পারল না। তারা দূরে সরে থাকল। ‘অনুমানদীধিতি’ গ্রন্থের রচয়িতা, কিশোর গোরার স্বল্পকালের শিক্ষক পণ্ডিতপ্রবর ন্যায়শাস্ত্রবিদ রঘুনাথ শিরোমণি জানত গোরা কী মাপের ছাত্র, স্বভাব, চরিত্রেও সকলের থেকে আলাদা, রঘুনাথের অজানা ছিল না। মুকুন্দ সঞ্জয়ের বাড়িতে গোরা চতুষ্পাঠী খোলার পরে, ছাত্রের টোল দেখতে এসেছিল রঘুনাথ। নব্যন্যায়ের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতির তুঙ্গে নবদ্বীপকে প্রতিষ্ঠা করতে বিদ্যাচর্চায় রঘুনাথ মেতে থাকলেও পুরনো ছাত্র গোরার কীর্তিকলাপের ওপর সে নজর রেখেছিল। গোরা যে ক্রমশ বৈষ্ণবসমাজে নমস্য হয়ে উঠছে, তার অজানা ছিল না। নবদ্বীপে প্রেমভক্তির জোয়ার উঠলেও রঘুনাথের চতুষ্পাঠীতে ছাত্রের অভাব হয়নি। কুলিয়ার বিদ্যানগরে বিদ্যাবাচস্পতির টোলেও সমান তালে ন্যয়াশাস্ত্রে পঠনপাঠন চলছিল, গোরা সম্পর্কে দু’জনের মনেই যথেষ্ট স্নেহ ছিল। জগন্নাথ মিশ্রের বন্ধু, বিদ্যাবাচস্পতির মনে স্নেহের সঙ্গে অল্পবয়সে বাপ-হারানো ছেলেটার জন্যে কিছু দুর্বলতা জমা ছিল। লোকমুখে গোরার খবর সে যেমন পাচ্ছিল, তেমনই একডালার দরবার থেকে প্রাক্তন দুই ছাত্র, সন্তোষ, অমর যারা এখন সুলতানি দরবারের সাকর মল্লিক, দবীর খাস, তাদের লেখা চিঠি থেকে জানছিল, গোরার জনপ্রিয়তার খবর গৌড়ের দরবারে পৌঁছে গেছে। শুধু তাই নয়, গোরার প্রেমভক্তির আবেশ দরবারের দুই পদস্থ কর্মচারীকে ছুঁয়ে ফেলেছে। উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের আভাস পেতে শুরু করেছে তারা। দুই ছাত্রের লেখা চিঠির আবেগ বিদ্যাবাচস্পতিকেও কিছুটা উত্তেজিত করেছে। গোরা শুধু তার বন্ধুর ছেলে নয়, তার পরম স্নেহভাজন। গয়ায় বাবার পিণ্ড দিতে যাওয়ার আগেও ফুলিয়ায় তার বাড়িতে এসে শাকভাত খেয়ে গেছে। পৃথিবী থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যারা করছে, তারা ব্রাহ্মণপণ্ডিত হলেও সদাচারী নয়। তাদের সঙ্গে হাত মেলানোর চিন্তা বিদ্যাবাচস্পতি করতে পারে না। রাজধানী একডালা থেকে সন্তোষ, অমরের নিয়মিত চিঠি পাওয়ার সঙ্গে আর এক প্রাক্তন ছাত্র, চারুমিহির, সুলতানি দরবারে যে জ্যোতিষার্ণব নামে পরিচিত, তার কাছ থেকে হঠাৎ করে কিছু গোপন খবর, মাঝে মাঝে বাচস্পতির কাছে আসে। ভূর্জপত্রে লেখা সম্বোধনবিহীন, স্বাক্ষরহীন সেইসব খবর পড়ে বাচস্পতি বুঝতে পারে, সুলতানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত জ্যোতিষার্ণবও মনিবের কাছে ষোলোআনা দায়বদ্ধ নয়। গৌড়ের মসনদ ওল্টানোর গোপন তৎপরতার সঙ্গে চারুমিহিরের অল্পবিস্তর যোগাযোগ আছে। সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায়, যার অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে বিদ্যাবাচস্পতি যজ্ঞের আগুন জ্বেলে প্রথম ঘৃতাহুতি দিয়েছিল, সেই সুশ্রুতের সঙ্গেও চারুমিহির তলে তলে সংযোগ রেখে চলেছে। সুশ্রুত-ই সেই গোপন তথ্য ঝড়-বৃষ্টিতে উথাল-পাথাল এক রাতে জ্যোতিষার্ণবের বাড়িতে এসে বলে গেছে। কাকপক্ষি এ খবর জানে না। সুশ্রুতের বাহিনী গড়তে দু’হাতে যারা সাহায্য করছে, সেই দুই রাজকুমার, সামন্তভূমের হামীর রায়, চন্দ্রদ্বীপের পীতাম্বর রায়ের কাছেও অজ্ঞাত ছিল এই তথ্য। গৌড়, সুষ্ম, সমতট, বারেন্দ্রভূম, বঙ্গাল জুড়ে গত একশ’ বছর ধরে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে কে রয়েছে, কে নেই, বিদ্যাবাচস্পতি তা স্পষ্ট না জানলেও সে নিজেও জড়িয়ে পড়েছিল। তার বাড়িটা যোগাযোগের ঘাঁটি হিসেবে পনেরো বছর ধরে ব্যবহৃত হলেও সিন্ধুকী, জাসুরা টের পায়নি। বৈষ্ণব সন্ন্যাসী মাধবেন্দ্র পুরী, ঈশ্বরপুরী, রাজপুরুষদের মধ্যে পীতাম্বর রায়ের ঠাকুর্দা, বিশ্বনাথ রায়ও তার বাড়িতে একাধিকবার ঘুরে যাওয়ার আগে বলেছে, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার দিন বেশি দূরে নয়, বিদ্যাবাচস্পতি যেন সেই নতুন ব্যবস্থাকে আবাহন করতে তৈরি থাকে। চারুমিহির একাধিকবার শিক্ষাগুরুর সঙ্গে দেখা করতে এসে আভাসে একই ইঙ্গিত দিয়েছে। বিদ্যাবাচস্পতির মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার গোপন স্থপতিদের একজন চারুমিহির। সুলতানি দরবারের অন্দরমহলে জ্যোতিষার্ণবের আসনে বসে কিছু ভবিষ্যৎবাণী অব্যর্থভাবে মিলিয়ে দেওয়ার সঙ্গে গোপন ধর্মরাজ্য কায়েম করার ঘুঁটি সাজাচ্ছে সে। সুবুদ্ধি রায়ের ছেলে সুশ্রুত রায়ের মতো তার বন্ধুভাবাপন্ন আরও একঝাঁক সেনাপতি গৌড়ের নানা দুর্গম অঞ্চলে সেনাবাহিনী গড়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে। নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে গোরা কি এই বিশাল কর্মকাণ্ডে অধিনেতার ভূমিকা নেবে? অসম্ভব নয়। প্রেমভক্তির স্রোতে ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের ব্যবধান মুছে দিয়েছে সে। কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করে যবন, চণ্ডাল, মুচি, ডোম সবাই বামুনের মর্যাদা পাচ্ছে, হাজারে হাজারে তারা নামসঙ্কীর্তন করতে পথে নেমে পড়েছে, চাঁদ কাজি ভয় পেয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে রাজধানী একডালায় পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকে ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে ফিরেছে। ঘটনার পর ঘটনায় নবদ্বীপ যখন টালমাটাল, গোরার প্রাণ নিয়ে টানাটানি, চারুমিহিরের কাছ থেকে বিদ্যাবাচস্পতির কাছে তখনই গোপন যে নির্দেশ এল, তার মর্মার্থ ছিল, গোরাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নবদ্বীপের বাইরে কোথাও যেন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গৌড়ের সুলতানি রাজত্বের তল্লাট ছেড়ে দূরে কোথাও সপরিবার তার কিছুকাল কাটানো এখন সবচেয়ে নিরাপদ। গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে গোরা খুন হওয়ার আগে সুলতানি সেনারা যে তাকে বন্দি করে একডালায় নিয়ে যাবে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গোরাকে বিচার করে তার প্রাণদণ্ডের বিধান দেওয়া হবে। বিচারের বিধান আগে শোনানো হবে, না প্রাণদণ্ডের পরে শোনানো হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। সপ্তগ্রামের বিত্তবান বণিক আর তাদের উপদেষ্টা প্রভাবশালী বামুনরা গোরাকে চরম সাজা দেওয়ার দাবি তুলে সুলতানি দরবার তাতিয়ে দিয়েছে।

বিদ্যাবাচস্পতিকে একডালা থেকে ভূর্জপত্রে লেখা চারুমিহিরের চিঠিতে প্রাপককে যেমন কোনও সম্বোধন করা ছিল না, তেমনই ছিল না প্রেরকের স্বাক্ষর। চারুমিহিরের চিঠিতে নবদ্বীপ থেকে গোরাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে যে তাড়া ছিল, তা বুঝতে বিদ্যাবাচস্পতির অসুবিধে না হলেও কারণটা তখনই ধরতে পারল না। পুরীতে, দাদা বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে গোরাকে পাঠানোর চিন্তা সেই মুহূর্তে মাথায় এলেও, দাদাকে কীভাবে খবরটা তাড়াতাড়ি জানানো যায়, ভাবতে শুরু করল। সুলতানি আদালতে গোরাকে যে চালান করা হবে, এই খবরে বিদ্যাবাচস্পতির বুকে কাঁপুনি ধরেছিল। নবদ্বীপ থেকে রোজের খবর ফুলিয়ায় না গেলেও সেখানে গোরাকে ঘিরে মানুষের ভিড় বেড়ে চলেছে, নবদ্বীপের বাইরে গৌড়বাসী বৃহত্তর জনসমাজের চোখের মণি হয়ে উঠছে সে, এ খবর বিদ্যাবাচস্পতি পাচ্ছিল। মহামিছিলের পরে বেশ কয়েকমাস কেটে গেলেও গোরাকে সুলতানি ফৌজ একডালায় ধরে নিয়ে না যাওয়ায় সে এ যাত্রা রেহাই পেয়ে গেল, এমন ধারণা বিদ্যাবাচস্পতি করেছিল। বাস্তবে তা অন্যরকম হয়ে যেতে তার মনে হল, গোরার প্রতিপক্ষ সাংঘাতিক কোনও চালে বাজিমাৎ করেছে। প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদীকে তদ্বির করে গোরাকে শূলে চড়ানোর ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। গোরার জন্যে তুমুল দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে তাকে পুরীতে পাঠানোর উপায় বাচস্পতি যখন খুঁজছে, তখন নবদ্বীপে নারায়ণীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনা জানাজানি হয়ে গেছে। শ্রীবাসের পরিবারের ভেতর থেকে সে খবর পাড়ায়, সেখান থেকে সারা নবদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল। গোরাকে জড়িয়ে সেই কেলেঙ্কারির বৃত্তান্ত, ফুলিয়াতে বিদ্যাবাচস্পতির কাছেও পৌঁছে গেল। কেঁপে উঠল বিদ্যাবাচস্পতি। গোরার জন্মের সময় তার নাড়ি কেটেছিল যে দাই, সেই সনকা-ই সম্ভবত নারায়ণীকে দেখে তার শরীরে সন্তানসম্ভবা হওয়ার লক্ষণগুলো প্রথম নজর করেছিল। আশিবছর বয়স হলেও মালিনীর শেষ সন্তানটিকে পৃথিবীতে এনেছে সে। চারমাস আগে এক সঙ্কীর্তনের রাতে সেই শিশু মারা গেলেও শ্রীবাস পণ্ডিতে বাড়িতে সনকার যাতায়াত বন্ধ হয়নি। পরিবারের একজন হয়ে গেছে সে। নবদ্বীপের নানা বাড়িতে তার অবাধ যাওয়া আসা। বাড়ির কোনও বউ, বিবাহিতা মেয়ের পেটে বাচ্চা এলে একবার নজর করে সে বলে দিতে পারে। নারায়ণীর শরীরে সন্তানবতী হওয়ার লক্ষণ, তার চোখ এড়ায়নি। মালিনীকে আড়ালে ডেকে কথাটা সে জানাতে মালিনী চমকে গিয়েছিল। সনকাকে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে বলে নিজেও নিঃশব্দে নারায়ণীর চালচলনের ওপর নজর রাখছিল। সনকা কথা রেখেছিল। বিধবা নারায়ণীর সন্তানসম্ভবা হওয়ার ঘটনা পাঁচকান করেনি। প্রতিবেশীদের কেউ হয়তো অন্ধকার পুকুরঘাটের পাশে গাছতলায় তাকে একাধিক সন্ধেতে বমি করতে দেখে কিছু অনুমান করে পড়শি কোনও বউকে কথাটা বলেছিল। শ্রীবাসের বাড়ির এমন কেউ দেখে থাকতে পারে, যে গৃহকর্ত্রী মালিনীকে পছন্দ করে না। মালিনীর স্নেহের ভাসুরঝি বিধবা নারায়ণীর পা পিছলোনোর গল্প ছড়ানোর এমন সুযোগ সে ছাড়বে কেন? নারায়ণীর গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা, নানা কুকথা, উপকথার মিশেলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। ঝড় উঠল নবদ্বীপে। নবদ্বীপ থেকে সেই খবর গৌড়ের রাজধানী একডালার সুলতানি দরবার পর্যন্ত পৌঁছে গেল। গোরাকে কোতল করার জবরদস্ত সুযোগ পেয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদী। নারায়ণীর গর্ভবতী হওয়ার ঘটনার সঙ্গে গোরাকে জড়িয়ে তার ব্যভিচারের বৃত্তান্ত ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নবদ্বীপের গোঁড়া বামুনরা এমনভাবে রটনা করতে থাকল যে, গোরাকে শূলে চড়ানোর জন্যে জনরোষ ফুঁসতে থাকল। তার ভক্তদের বড় একটা অংশ এই প্রচারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। শাস্ত্র পড়া বৈষ্ণব ভক্তদের কেউ বলল, গোরা চিবোনো পানের ছিবড়ে খেয়ে সন্তানসম্ভবা হয়েছে নারায়ণী। অদ্বৈত, শ্রীবাস বলল, মহোৎসবের প্রথম সন্ধেতে গোরা ভাতের থালার ভুক্তাবশেষ খেয়ে নারায়ণী মা হতে চলেছে।

উদাহরণ হিসেবে রামায়ণ, মহাভারত থেকে এরকম ভূরি ভূরি ঘটনা তুলে তারা নারায়ণীর গর্ভসঞ্চার যে শাস্ত্রসম্মত, প্রমাণ করতে চাইল। সূর্যবংশীয় পুত্রসন্তানহীন রাজা দশরথ ছেলের আশায় পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করে অর্ঘ্য হিসেবে যে পায়েস নিবেদন করেছিল, সেই পায়েস খেয়ে রাজার তিন রানী—কৌশল্যা, কৈকেয়ী, সুমিত্রার চার ছেলে—রাম, ভরত, লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্নর জন্ম হয়েছিল। ঠিক কিনা?

ঠিক, একদম ঠিক।

পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের মেয়ে দ্রৌপদী আর ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্নও দেবতাদের বরে যজ্ঞবেদিতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সে কাহিনী শোনাল অদ্বৈত আচার্য। অদ্বৈত, শ্রীবাসের যুক্তি বৈষ্ণবসমাজ মেনে নিলেও প্রতিপক্ষ নিস্তেজ হল না। গোরাকে ফাঁসানোর মস্ত একটা সুযোগ পেয়ে ধরাধাম থেকে তাকে সরিয়ে দিতে চট্টগ্রাম, আরাকানে গোখাদক ভাড়াটে গুপ্তঘাতক জোগাড় করতে তারা যোগাযোগ শুরু করল। শাস্ত্রজ্ঞানহীন লম্পটদের হাত থেকে নবদ্বীপের সুভদ্র সমাজকে বাঁচাকে সুলতানের কাছে লিখিত বিনয়াবনত আর্জি পেশ করে রাখতেও তারা কসুর করল না। সামাজিক কেলেঙ্কারির প্রবল ধাক্কায় বৈষ্ণবদের বাড়বাড়ন্ত কিছুদিনের জন্যে ঝিমিয়ে পড়ল। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও শ্রীবাসের পরিবারে অশান্তি চাপা থাকল না। বাড়ি থেকে নারায়ণীকে তাড়াতে পরিবারের দু-একজন কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। নবদ্বীপ জুড়ে পাষণ্ডীরা গোরার নামে কুৎসার বন্যা বইয়ে দিলেও বৈষ্ণব ভক্তদের বেশিরভাগ তা বিশ্বাস করল না। শ্রীবাসের বাড়িতে ভক্তদের নিয়ে গোরা আগের মতো মেতে থাকলেও জনসমাগমে কিছুটা ভাটা পড়ল। সনকার বাড়িতে রেখে নারায়ণীর গর্ভমোচনের প্রস্তাব পরিবারের কেউ কেউ দিলেও শ্রীবাস তা উড়িয়ে দিয়েছিল। মালিনীর সামনে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। শ্রীবাসকে সাহস জুগিয়েছিল গোরা। তাকে জড়িয়ে পাঁকের প্রবাহের মতো অপপ্রচার রটেছে জেনেও শ্রীবাসের মাথা থেকে নারায়ণীর মাতৃত্ব নষ্টের চিন্তাকে সে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। সঙ্কীর্তনের শেষে, রাতের তৃতীয় প্রহরে বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে বসে শ্রীবাস, নিতাই, শ্রীবাসের ছোটভাই শ্রীরামকে গোরা বলেছিল, আমার প্রিয় জন্মভূমি এই নবদ্বীপ ছেড়ে তাড়াতাড়ি হয়তো চলে যেতে হবে আমাকে, কোথায় যাব, তোমরা জানতে চেও না। আমি নিজেও এখনও ঠিক করিনি, কোথায় যাব। নবদ্বীপ কেন ছাড়তে হচ্ছে, তোমাদের অজানা নয়। নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজকে বাঁচাতে তোমরা এখানে থাকবে। তোমাদের সঙ্গে থাকবে কৃষ্ণনাম, স্বয়ং কৃষ্ণ, আমার শুরু করা যত কাজ আর সঙ্কীর্তন। মানুষের মধ্যে দুটো অংশ আছে, এক হচ্ছে তার কাজ, দ্বিতীয় যা রয়েছে, তা কাজের চেয়ে অনেক বড়, তা হল কৃষ্ণের উপস্থিতি। মানবাত্মার বিকাশের কথা যদি ভাব, তার প্রত্যেকটা ধাপ, কত যুগের কীর্তি জমে গড়ে উঠেছে হিসেব পাবে না। অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়েছে মানুষের কাজ, তার কৃষ্ণসাধনা মানুষের কাজের এক নমুনা হল অযোধ্যা, কৃষ্ণের আগের অবতার রাম, আর এক নমুনা হস্তিনাপুর, যেখানে কৃষ্ণ ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। অন্য এক ধর্মমত, বৌদ্ধধর্মও সেরকম এক প্রতিষ্ঠা। মুসলিমদের ধর্মও তাই। আমাদের অনেক কিছু তারা শিখিয়েছে। তাদের সঙ্গে গৌড়ে জায়গা দিয়েছে কৃষ্ণনাম, শুধু নাম আর নামসঙ্কীর্তন। আমাদের যুগে কৃষ্ণনাম আর সঙ্কীর্তনই সত্য। সব সাধনাই চলেছে কৃষ্ণের দিকে। এ হল সবচেয়ে সহজ, সরল প্রেমভক্তির পথ। এত সরল, এত প্রত্যক্ষ সাধনা যে আর নেই, এটাই আমি দেখাতে চাই তোমাদের। আমাদের কৃষ্ণের জন্মের পরেও দেবকী, যশোদা, কেউই সেভাবে সরাসরি মা পরিচয় পেল না। আমাদের নারায়ণীও তাই। নিরীহ, বিধবা, অতি সাধারণ বিষ্ণুসেবিকা সে। রামায়ণ, মহাভারতের যুগে তাকে হয়তো চোখেই পড়ত না, তার পুত্রবতী হওয়ার ঘটনা নিয়ে এত কুৎসা ছড়াত না, সতী পঞ্চকন্যার একজন গণ্য করে তাকে দেবী ভাবা হত। সে তো প্রকৃতই দেবী, দেবকন্যা। মহাভারতের কুন্তির গর্ভসঞ্চার, তার মা হওয়ার ঘটনা, কারও নজরে পড়েনি। মহাবীর কর্ণের মাতৃপরিচয় গোপনে বহন করেছিল সে। নারায়ণীও সে পথে হাঁটতে শুরু করেছে। গোপনে, নিঃশব্দে সে তিল তিল করে গড়ে তুলছে একটি শিশু, তার প্রাণ, মানুষের প্রবাহের প্রাণ, সভ্যতার বিস্ময় আর আনন্দ! ভবিষ্যতের মানুষ তাই বললেও এখনকার নীতিবাগীশ সমাজ নারায়ণীর সন্তানধারণকে অবৈধ বলবে, গালিগালাজ দেবে, কাদা মাখাবে। সেসব শুরু হয়ে গেছে। নারায়ণীর মা হতে চাওয়া প্রকৃতিবিরোধী না হলেও ন্যায়শাস্ত্রের বিরুদ্ধে। নিজের তাগিদে সে মা হচ্ছে না, সে জন্ম দিচ্ছে কৃষ্ণের কৃপায়, গৃহদেবতা বিষ্ণুর প্রসাদে। আজ থেকে জীবনের উৎসে কোনও বাধ্যতা রইল না। আগামী দিনগুলিতে প্রাণ জন্ম নেবে নিজের তাগিদে, কৃষ্ণের প্রেরণায়। নারায়ণীর সন্তানধারণের ঘটনা বৈষ্ণবসমাজের জন্যে যে নতুন বার্তা উপহার দিল, তা অসাধারণ, গতানুগতিক নয়, মহা উৎসব, শাস্ত্রীয় বাধ্যতার বদলে দেখাল কৃষ্ণকৃপা এই মানবিক ঘটনাকে বুঝতে হলে স্বর্গের চোখ দিয়ে পৃথিবী আর মানুষকে দেখতে হবে, পরম প্রেমিক কৃষ্ণের ওপর ভরসা রাখতে হবে, সশ্রদ্ধ হৃদয়ে মেনে নিতে হবে কৃষ্ণের পুণ্য বিভায় নারায়ণী সন্তানসম্ভবা হয়েছে। রামায়ণ, মহাভারতে ক্ষেত্রজ সন্তান জন্মের কাহিনী পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছিল। তখন আমরা পবিত্র মাতৃত্বের ঘটনা সঠিকভাবে বুঝিনি, বুঝতে চাইনি। মহাপ্রস্থানের পথে চলে গেল পাণ্ডবেরা, বাতাসে মিলিয়ে গেল অযোধ্যা আর হস্তিনাপুরের রাজবংশ, কিন্তু সব কি শেষ হয়ে গেল? না। মানুষ, সমাজ, দেশ জাতি থেকে গেল, মানুষের মধ্যে একজন পুরুষোত্তম হয়ে উঠলেন, তিনি কৃষ্ণ, তিনি বন্ধন, তিনিই মুক্তি, তাঁর জীবনী হয়ে উঠল ঈশ্বরচরিত, তা ভরে দিল বিশ্বচরাচর, স্বর্গরাজ্যের অধীশ্বর হল মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *