গোরা – ৪৪

৪৪

স্নানযাত্রার শেষে পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে ঘরেফেরা পুণ্যার্থীদের ভিড়ে মিশে সনাতন, রূপ কোথায় গেল বিদ্যাধরের গুপ্তচর বাহিনী নাগাল পেল না। একডালা দরবার থেকে পালিয়ে আসা দুই রাজকর্মচারী জেনে গিয়েছিল, তাদের ‘চাঙ্গে’ চড়িয়ে তার ওপর থেকে নিচে ধারাল খাঁড়ার ওপর ফেলে দু’টুকরো করে ফেলে তাদের মৃত্যুদণ্ডের রাজার হুকুম বিদ্যাধর বার করে দিয়েছে। পুরুষোত্তমপুর থেকে সনাতন, রূপকে সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ গোপনে গোরাকে দিয়েছিল বাসুদেব সার্বভৌম। বাসুদেব জানিয়েছিল, এই রাজ্যে থাকতে সেও নিরাপদ বোধ করছে না। বারাণসীতে ডেরা করার আয়োজন করছে। কুলিয়া থেকে সেখানে তার ভাই বিদ্যাপতি চলে যেতে পারে। পুরুষোত্তমপুরের পাট ছেড়ে গোরাকেও চলে যেতে হবে, সার্বভৌমের কথাতে এ আভাসও ছিল। গোরা কি জানত না? জানত, নানা সূত্রে তার কানে আসছিল, রাজ্যের অধীশ্বর বদলাতে চলেছে, রাজসিংহাসনে বিদ্যাধরের বসা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিদ্যাধর সিংহাসনে বসার আগে বিপন্ন হতে পারে তার জীবন, পৃথিবী ছেড়ে তাকে চলে যেতে হতে পারে। কিছুদিন ধরে এমন সব ঘটনা ঘটছিল, যা বিরক্ত করছিল তাকে। ক্ষমতাবান রাজপুরুষরা পর্যন্ত তাদের বৈষয়িক ঝঞ্ঝাটে তাকে কাজে লাগাতে চাইছিল। ভবানন্দ রায়ের ছেলে, গোরার ঘনিষ্ঠ রামানন্দ রায়ের ভাই রাজকোষের টাকা চুরি করে সাজা পেয়েছে, তাকে খালাস করে আনতে ভবানন্দের শুভার্থীরা গোরার কাছে ধরনা দিয়ে পড়ল। তাদের অনুরোধে গোরা রেগে গিয়ে পুরুষোত্তমপুর ছেড়ে আলালনাথে ঝুপড়ি বেঁধে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। কাশী মিশ্রকে বলল, আমি ভিখিরি সন্ন্যাসী, নিজেদের দুঃখের বিবরণ শুনিয়ে মানুষ কেন আমাকে দুঃখ দেয়?

বছর দুই আগের ঘটনা এসব। আলালনাথে শেষপর্যন্ত গোরার যাওয়া না হলেও তার কাছে তদ্বির করার ভিড় প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল কাশী মিশ্র। গোরা বুঝতে পারছিল কৃষ্ণনামে ডুবে থেকে তার প্রেমভক্তি প্রচারের কাজ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে পড়ছে। মনের ভেতরে নানা প্রশ্ন জাগলেও মুখের স্নিগ্ধতা, ভাবাবেশ মুছে যায়নি। ধীর, শান্ত, কৃষ্ণপ্রেমীর প্রসন্নতা সে বজায় রেখেছিল। সঙ্কীর্তনের আসরে সব সন্ধেতে নেচে গেয়ে, কৃষ্ণবিরহে কেঁদে বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিল। দিনে, স্বাভাবিক অবস্থায় নামজপের সঙ্গে চলছিল তার গভীর আত্মসমীক্ষা। আমি কি সত্যি সন্ন্যাসী, এই প্রশ্ন তাকে সারাক্ষণ খোঁচাত। সংসার প্রতিপালনও মহৎ ধর্ম, কেন আমি সংসার ছেড়ে পালিয়ে এলাম? আমি কি তখন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম? হতে পারে। আমাকে কোতল করতে একডালার সুলতানী দরবার হুকুম তৈরি করে ফেলেছিল। সুলতানের সঙ্গে টক্কর দেওয়া আমার সম্ভব ছিল না। কৃষ্ণপ্রেমে পাগল সেজে, সন্ন্যাস নিয়ে পুরুষোত্তমপুরে পালিয়ে এসে প্রাণে বেঁচেছিলাম। প্রকৃত সন্ন্যাসজীবন এত বছর কাটানোর পরে কেন আমার মনে আক্ষেপ জাগছে? কেন মনে হচ্ছে কৃষ্ণপ্রেমীর সঙ্গে সংসারে থাকার বিরোধ নেই? সংসারে থেকেও প্রেমভক্তি প্রচার করা যায়। সংসারধর্ম মেনে চলা একরকম ব্রতপালন, জীবনের ধর্ম। প্রকৃতি, আকাশ, সমুদ্র, মাটিতে মিশে আছে এই ধর্ম মেনে চলার সঙ্কেত। সংসার ছেড়ে পালিয়ে আসা তাই অপরাধ। সে কি মা শচী আর বিষ্ণুপ্রিয়াকে সংসার-সমুদ্রের অথৈ জলে ফেলে পালিয়ে এসে ভুল করেছে? তার এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী সে। দাদা বিশ্বরূপের পুঁথি পড়ে জেনেছে সে জগন্নাথ মিশ্রের ছেলে নয়, কৃষ্ণের সন্তান, শান্তিপুরের কৃষ্ণভক্ত অদ্বৈত আচার্যের আকুল ভজনায় কৃষ্ণের অবতার হিসেবে নবদ্বীপে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তা সত্যি হলে কেন সে বলে বেড়াচ্ছে, আমাকে সন্ন্যাসী ভাবার কারণ নেই। আমাকে সন্ন্যাসী জ্ঞান করে তোমরা মাথায় তুলে নেচো না। আমি ধর্মনাশ করেছি, শুধু এ কথা বলতে পারি। আমি প্রকৃত মায়াবাদী, ধর্মতত্ত্ব বিশেষ জানি না, এখনও মায়াবাদে ভাসি।

তার ভক্ত অনুরাগীর দল এসব কথা শুনে ভাবত গোরার ভাবাবেশ ঘটেছে। অবতারদের এমন ঘটে। কৃষ্ণ কি কখনও নিজেকে সন্ন্যাসী বলে উল্লেখ করেছে? করেনি। ব্রজধামের গোপীদের মায়াতে মুগ্ধ থেকেছে সারাক্ষণ। এ মায়া ব্রহ্মস্বরূপের ছায়া নয়, মানুষের সংসারধর্ম পালনের মায়া, মা, বৌ, ছেলেমেয়ে নিয়ে পরিপূর্ণ সংসারের জন্যে মায়া। ভক্তদের সংসারধর্ম পালনের পরামর্শ দিতে শুরু করেছিল সে। এমনকি প্রেমধর্ম প্রচারে তার ডান হাত নিতাইকে ও বিয়ে করার কথা বলতে তার মুখে বাধেনি।

গম্ভীরার এক চিলতে শক্ত মেঝেতে শুয়ে গোরা যখন এত ভেবে চলেছে, বাইরে থেকে ছায়াসঙ্গী গোবিন্দ বলল, গৌড়ের মানুষ, এমনকি আচার্য, ব্রাক্ষ্মণদের কাছে তোমার জন্যে আমাকে আর কত মিথ্যে বলতে হবে?

কী মিথ্যে বললি?

সবাইকে বলছি তোমার আনা খাবার মহাপ্রভু চেটেপুটে খেয়েছে, খুব খুশি হয়েছে। আমার কথা শুনে আনন্দে তারা আটখানা। হেসে, কেঁদে, নেচে গেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়েছে। তাদের দেখে আমার ভারী কষ্ট হয়, ভাবি আর কত বঞ্চনা করব?

গোবিন্দর কথা শুনে শরতের সকালের মতো স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়ল গোরার মুখে। গোবিন্দকে বলল, যে যা দিয়েছে, এক এক করে নিয়ে আয়। আমাকে ধরে দেবার আগে জানাবি, কে এনেছে।

মহা আনন্দে গোবিন্দ একের পর এক মিঠাই, মণ্ডা, পিঠে, খাজার চ্যাঙাড়ি এনে গোরার সামনে রেখে বলতে থাকল, অদ্বৈত আচার্য এনেছে এই পেঁড়া, রসপুলি, শ্রীবাস পণ্ডিত এনেছে পিঠে, মণ্ডা, শঙ্খচিনি, আচার্যরত্ন চন্দ্রশেখর এনেছে নাড়ু, বাসুদেব দত্তের ঝালিতে আছে রসবড়া, বুদ্ধিমন্ত খান পাঠিয়েছে ক্ষীরের তক্তি, কালাকাঁদ,শ্রীমান পণ্ডিত, নন্দন আচাৰ্য, কুলীনবাসী, শ্রীখণ্ডবাসীদের পাঠানো খাবারের ঝালিগুলো খুলে তৃপ্তিতে ঝলমল করতে থাকল গোরার মুখ। কিছু খাবার এর মধ্যে নষ্ট হয়ে গেলেও সে খেয়ে নিল। তার মুখে কোনও বিকার গোবিন্দ দেখতে পেল না। পানিহাটি থেকে রাঘব পণ্ডিতের ঝালি, গোবিন্দকে আলাদা করে রাখতে বলল। রাঘবের ঝালিতে তার বোন দময়ন্তীর পাঠানো ভোজ্যে কী কী আছে, গোরা জানে। সেখানে রয়েছে আমের কাসুন্দি, আদার কাসুন্দি, লঙ্কার ঝাল কাসুন্দি, লেবু, আদা, আম, কুলের নানা আচার, আমসি, আমতেল, আমচুর, আম্রটক (আমড়া), গুন্ডিপাকানো মুখরোচক পুরানো পাটপাতা, ধনে, মৌরি, চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মিষ্টি নাড়ু, শুকনো কুলের আচার, গুঁড়ো কুল, শুকনো টুকরো কুল, নারকেল টুকরো, নারকেল নাড়ু, গঙ্গাজল, কড়াপাক ক্ষীর, মণ্ডা, অমৃত, কর্পূর, শালিকাচটি ধানের চিঁড়ে, কিছু চিঁড়ে, খাঁটি ঘিয়ে ভেজে গুঁড়ো করে মরিচ, লবঙ্গ, কর্পূর মিশিয়ে নাড়ু, চিঁড়ের চাক; শালিধানের খই ঘিয়ে ভেজে চিনি, কর্পূর দিয়ে পাক করে বানানো নাড়ু, ফুটকড়াই ঘিয়ে ভেজে, গুঁড়ো ছাতুতে চিনি মিশিয়ে নাড়ু, ঘিয়ে মুড়ি ভেজে মুড়ির চাক, রসবাস, কাবাব চিনি, আরও কত খাবার থাকত তা বলে শেষ করা যায় না। ফি বছর পানিহাটি থেকে মকরধ্বজ করের তদারকিতে এসব খাবারদাবার রথযাত্রার আগে পুরুষোত্তমপুরে গোরার ঘরে পৌঁছে যেত।

রাঘবের ঝালি সরিয়ে রেখে অন্যদের আনা খাবার খেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গোবিন্দকে গোরা বলল, আমার জন্যে তোকে আর মিথ্যে বলতে হবে না। তোর মিথ্যে বলার যত অপরাধ আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম।

রোজ একমুঠো ভিক্ষের চাল একবেলা খেয়ে যে মানুষটা বেঁচে রয়েছে, তার খাওয়ার বহর দেখে গোবিন্দ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। প্রতিবছর এই ঘটনা দেখেও তার অবাক ভাব কাটে না। সে কী করবে?

খাবার গোরার পেটে গেলেও নবদ্বীপ থেকে স্নানযাত্রার আগে জগদানন্দ ফিরল এক কলসি চন্দনতেল আর অদ্বৈত আচার্যর পাঠানো হেঁয়ালির মতো এক গোপন বার্তা কণ্ঠস্থ করে। বছরে অন্তত একবার পুরুষোত্তমপুর থেকে নবদ্বীপে শচীমার খবরাখবর করতে যেত জগদানন্দ। দামোদরকে জগদানন্দের সঙ্গে এবার নবদ্বীপে পাকাপাকি থাকার জন্যে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছে গোরা। শচীর সংসারের ভালমন্দ দেখার জন্যে দামোদর পণ্ডিতের মতো অবিবাহিত, নিরাসক্ত ব্রাহ্মণসন্তান নবদ্বীপে দ্বিতীয় পাওয়া যাবে না। গোরার অন্তরঙ্গদের মধ্যে সবচেয়ে বিচারশীল, বিচক্ষণ মানুষ ছিল। একদিকে সে যেমন ত্যাগী, তপস্বী ছিল, অন্যদিকে জনসংযোগে ছিল নিপুণ দক্ষতা। গোরার সন্ন্যাসজীবনে তার সঙ্গী হয়ে পুরুষোত্তমপুরে তার সেবাতে ঢেলে দিয়েছিল নিজেকে। গোরার ওপর নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী দামোদর সবসময়ে সতর্ক নজর রাখত। তার চালচলনে, কথায়, তার অকলঙ্ক চরিত্রে যাতে কোনও দাগ না লাগে, তা ঠেকাতে দামোদর চোখ, কান খোলা রাখত। পুরুষোত্তমপুরের এক বাপহারানো কমবয়সি ছেলে এই সময়ে গোরার কাছে যাতায়াত শুরু করে। শান্ত স্বভাব, দেখতে সুন্দর, ভক্তিভাবে কিছুটা তত ছেলেটাকে গোরা স্নেহ করত। বাপহারানো ছেলেটা গোরার আদর পেয়ে তার কাছে যাতায়াত বাড়িয়ে দিল। দামোদরের চোখে দুজনের ঘনিষ্ঠ মেলামেশা ভাল লাগেনি। ঠোঁটকাটা দামোদর কথাটা একদিন সরাসরি বলে ফেলল গোরাকে। বলল, এই ছেলেটার বিধবা মা ভক্তিমতী হলেও কমবয়সি, সুন্দরী। বিধবা, সুন্দরী মায়ের ছেলের সঙ্গে গোরার পিরীত দেখলে লোকনিন্দা হতে পারে, এ কথা বুঝিয়ে গোরাকে, বলা যায় হুঁশিয়ার করে দিল। দামোদরের অভিভাবকত্বে গোরা খুশি হল। বন্ধ করল ছেলেটার সঙ্গে মেলামেশা। তখনই ঠিক করে ফেলল নবদ্বীপে মাকে দেখাশোনার ভার দামোদরকে দিয়ে সেখানে তাকে পাঠিয়ে দেবে। পুরুষোত্তমপুরে তার দেখভাল করার জন্যে অভিভাবক কম নেই। তাদের একজন স্বরূপ দামোদর, যাকে সবাই এখন স্বরূপ নামে চেনে। দামোদর থেকে গেলেও প্রতিবছর রথযাত্রায় সে পুরুষোত্তমপুরে আসে। তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে এবারেও এসেছিল। তার আগে পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছে গিয়েছিল জগদানন্দ। সে ছিল গোরার ছেলেবেলার বন্ধু, চিরজীবনের সাথী। নবদ্বীপে শিবানন্দ সেনের বাড়ি থেকে এক কলসী চন্দন তেল ঘাড়ে নিয়ে দেড় মাস হেঁটে পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছেছিল জগদানন্দ। বায়ুরোগগ্রস্ত গোরার ছেলেবেলায় তার মাথাতে রোজ একপলা এই তেল, যার নাম বিষ্ণুতেল মাখিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলেছিল তার বন্ধু কবিরাজ মুরারি গুপ্ত। নবদ্বীপে জগদানন্দ আসছে খবর পেয়ে শিবানন্দের পরামর্শে চন্দন তেল তৈরি করে রেখেছিল মুরারি। পুরুষোত্তমপুরে পৌঁছে তেলের কলসী গোবিন্দর জিম্মায় রেখে জগদানন্দ বলেছিল, বায়ু, পিত্ত, কফের অব্যর্থ ভেষজ মহাপ্রভু যেন রোজ গায়ে, মাথায় মাখে। নবদ্বীপ থেকে জগদানন্দ চন্দন তেল এনেছে শুনে গোরা বলল, তেল মাখার অধিকার সন্ন্যাসীর নেই। বিশেষ করে সুগন্ধি তেল ব্যবহার করা সন্ন্যাসীর পক্ষে লজ্জার ঘটনা।

গোবিন্দকে গোরা বলল, জগন্নাথ মন্দিরে প্রদীপ জ্বালানোর কাজে এই তেল ব্যবহার করলে জগদানন্দের খাটুনি যেমন সার্থক হবে, তেমনি কৃষ্ণের কৃপা পাবে সন্ন্যাসী গোরা।

গোবিন্দর মুখে তেলের কলসী মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাতে পৌঁছে দেওয়ার খবর শুনে জগদানন্দ গম্ভীর হয়ে গেল। তেল নিয়ে দশদিন উচ্চবাচ্য করল না। গোবিন্দর কাছে থেকে গেল তেলের কলসী। গোবিন্দ একদিন তেলের কলসী নিয়ে কী করবে জানতে চাইলে জগদানন্দ বলল, যার জন্যে আনা হয়েছে, তার কাজে লাগুক।

গোবিন্দ ফের গোরাকে জানাল জগদানন্দের ইচ্ছের কথা। গোরা একটু চটে গিয়ে এমন কিছু কথা শোনাল, যা তার মতো মানুষের থেকে আশা করা যায় না। সঙ্কল্পে অটল সন্ন্যাসীর মুখ থেকে অসম্ভবও নয়। গোরা বলল, গন্ধ তেল গায়ে, মাথায় মেখে ঘোরার জন্যে আমি সন্ন্যাসী হইনি। এরপরে তেলমাখাতে তোমরা একজন মর্দনকারিণী আনার বায়না ধরবে। আমার গা থেকে সুবাস জড়ানো তেলের গন্ধ পেয়ে রাস্তার মানুষ ভাববে, গৌড়ের ভক্ত সন্ন্যাসীটা বেশ্যাবড়ি যাতায়াত শুরু করেছে। তোমরা দেখছি ডোবাবে আমাকে।

গোরার কথাতে ভয়ে গুটিয়ে গেল গোবিন্দ। জগদানন্দকে পরের দিন জানাল মহাপ্রভুর প্রতিক্রিয়া। গম্ভীরার চাতালে জগদানন্দকে দেখে একই কথা শোনাল গোরা। বলল, পণ্ডিত, গৌড় থেকে আমার জন্যে সুগন্ধি তেলের যে কলসী ঘাড়ে বয়ে এনেছ, আমি দেখেছি। ওই তেল আমার কি দরকার? তুমি বরং মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাতে তেলের কলসী দিয়ে এসো।

প্রায় দু’শো ক্রোশ রাস্তা ঘাড়ে বয়ে যে কলসী এনে শরীরের ব্যথায় তিনদিন বিছানা থেকে জগদানন্দ উঠতে পারেনি, ঘাড়, কোমর, হাঁটু যন্ত্রণায় খসে যাচ্ছিল, এখনও থেকে থেকে টনটন করছে, পরম যত্নে বয়ে আনা সেই বিমূতেল নিতে গোরা অরাজি হতে অভিমানে জগদানন্দ ভেঙে পড়ল। বলল, কই, তোমার জন্য তেলের কলসী আমি তো আনিনি, আর কেউ বোধহয় এনেছে। চাপা কান্না গলায় নিয়ে গোরার সামনে দিয়ে গটগট করে হেঁটে তার ঘরে ঢুকল জগদানন্দ। দু’হাতে তেলের কলসী ঘর থেকে বার করে এনে ঘরে সামনে উঠোনে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল।

জগদানন্দর কাণ্ড দেখে স্নেহের হাসি ফুটে উঠল গোরার মুখে। গোবিন্দর সঙ্গে সে-ও ভাঙা কলসীর টুকরো সাফাইয়ে হাত লাগাল। জগদানন্দ নিঃশব্দে নিজের কুঁড়েতে ফিরে এসে কপাট আটকে বিছানায় শুয়ে পড়ল। উপোস করে বিছানায় শুয়ে থাকল দু’দিন। জগদানন্দ কুঁড়ের বন্ধ কপাটে ঘা মেরে গোবিন্দ দু’দিনে কয়েকবার ডাকাডাকি করেও তার সাড়া পেল না। নীলাচলবাসীর প্রিয় অনুগামী জগদানন্দকে দু’দিন না দেখে পরের দিন সকালে গোবিন্দর কাছে তার খবর নিয়ে গোরা শুনল, কুঁড়ের দরজা আটকে প্রিয়জনটি দু’দিন উপোস করে শুয়ে আছে। জগদানন্দের অভিমান ভাঙাতে তখনই তার কুঁড়েতে গোরা পৌঁছে গেল। সঙ্গী গোবিন্দ। জগদানন্দের বন্ধ দরজায় দু’বার ঠোকা দিয়ে গোরা বলল, পণ্ডিত, দুপুরে তোমার সঙ্গে ভাত খাব। রেঁধে রেখো। জগন্নাথদেবের দর্শনে মন্দিরে যাবার তাড়া আছে। এখন চললাম। গোরা চলে যেতে বিছানা ছেড়ে উঠে জগদানন্দ চান সেরে নিল। দু’দিন বাদে কাঠকুঠো জ্বেলে চুলো ধরিয়ে রাঁধতে বসল। নিজের দু’জন ভক্ত রামাই, রঘুনাথকে জোগাড়ের কাজে ডেকে নিল। গোরার পছন্দের ভাত, শুক্তো, শাক, ডাল, তরকারি রেঁধে লাউয়ের পায়েস বানাল জগদানন্দ। তার ঘরে দুপুরে খাওয়ার সময় গোরা পৌঁছে গেল। তাকে পা-হাত ধোয়ার জল দিয়ে ভিজে হাত-পা জগদানন্দ নিজের হাতে গামছায় মুছে আসন পেতে বসতে দিল আঙট পাতায় শালিধানের চালে গরম পাতে ঘি ঢেলে গোরার সামনে রাখল। কলাগাছের ডোঙাতে তরি-তরকারি ভরে পাতার চারপাশে সাজিয়ে ভাতের ওপর কয়েকটি তুলসিমঞ্জুরি ছড়িয়ে দিল। খাবারের আয়োজন দেখে গোরা খুশি হলেও বয়স্ক মানুষটার রান্নার ধকল কম হয়নি, অনুমান করে সঙ্কোচ বোধ করল। দু’দিন না খেয়ে থাকা জগদানন্দ নিজেও নিশ্চয় ক্ষুধার্ত। গোরা কথা না বাড়িয়ে জগদানন্দকে বলল, পণ্ডিত এসো, তুমিও আমার সঙ্গে খেতে বসো।

তোমার পাতের প্রসাদ খেয়ে আমি উপোস ভাঙব।

জগদানন্দের কথাতে ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে গোরা বলল, মন্দির থেকে মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথের পিঠাপানা প্রসাদ নিয়ে এসেছি। এসো, দু’জনে আগে প্রসাদ খাই। তারপরে একসঙ্গে খেতে বসব।

জগন্নাথের প্রসাদ খেয়ে দু’জনে মুখোমুখি পাতা সাজিয়ে বসলেও জগদানন্দকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে গোরা ভাত স্পর্শ করল না। জগদানন্দ খেতে অনুরোধ করতে গোরা বলল, তুমি আগে হাত লাগাও, উপোস ভাঙো, তারপর আমি খাব।

জগদানন্দ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, বলল, তোমার প্রসাদ না পেয়ে আমি উপোস ভাঙব না।

কান্না চাপতে ঠোঁট কামড়ে জগদানন্দ বলল, আমার এই প্রার্থনা দয়া করে মঞ্জুর করো।

গোরা হেসে বলল, তাই হোক।

জগদানন্দের রাঁধা ভাত, ডাল, তরকারি তারিয়ে তারিয়ে খাবার সঙ্গে গোরা বলতে থাকল, কি সুস্বাদু যে হয়েছে তোমার রান্না, বলার নয়। কৃষ্ণের ভক্ত রেগে গেলে বোধহয় এমন চমৎকার রান্না করতে পারে। স্বয়ং কৃষ্ণ এখন এসে পাত পেড়ে খেতে চাইলে আমি অবাক হব না। এখন থেকে তুমি ক্রুদ্ধ অবস্থাতে রান্নাবাড়ি করবে। ভাত-তরকারির স্বাদ তাহলে বেড়ে যাবে।

খাবারের যত প্রশংসা গোরা করতে থাকল, তার পাতে তত বেশি ভাত, তরকারি তুলে দিতে লাগল জগদানন্দ। তাকে ঠেকালে সে ফের উপোস করতে পারে অনুমান করে গোরা আটকাল না। ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী হলেও জগন্নাথের প্রসাদ আর খুদকুঁড়ো ফোটানো খেয়ে রিশাল শরীর এই মানুষটির পাকস্থলী শুকিয়ে যায়নি, ভক্তের চাপে দশজনের খাবার অনায়াসে একা খেয়ে নিতে পারে, জগদানন্দ জানত। দশজনের জন্যে তৈরি ভাত-তরকারি ঠেসেঠুসে গোরাকে খাওয়াতে আব্দার করে যেতে লাগল। একসময় গোরা থামল। বলল, তুমি এত খাওয়ালে মনে হচ্ছে নড়তে পারব না।

হাতমুখ ধুয়ে মুখশুদ্ধির সঙ্গে জগদানন্দের দেওয়া মালাচন্দন নিয়ে গোরা বলল, অনেক হয়েছে, আমার সামনে বসে এবার তুমি খাও, আমি দেখি।

তোমাকে আর কষ্ট করে বসে থাকতে হবে না। তুমি ঘরে ফিরে বিশ্রাম করো। রামাই আর রঘুনাথকে ডেকে নিয়ে আমি খেতে বসব। সকাল থেকে রান্নার কাজে আমার সঙ্গে ওরা হাত মিলিয়েছিল। তোমার প্রসাদ পাবার জন্যে ওরা হা-পিত্যেশ করে বসে আছে। প্রসাদের ভাত-তরকারি পেলে দু’জন কৃতার্থ হবে।

জগদানন্দের মুখের হাসিখুশি ভাব দেখে তার অভিমান কেটে গেছে বুঝে গোবিন্দকে ডেকে গোরা বলল, পণ্ডিতের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুই এখানে থাকবি। খাওয়া শেষ হলে আমাকে গিয়ে জানাবি।

গোরা চলে যেতে জগদানন্দ খেতে না বসে গোবিন্দকে বলল, তুই এখনই প্রভুর কাছে ফিরে যা। তার হাত-পা টিপে ঘুম পাড়িয়ে ফিরে আয়।

প্রভুর প্রসাদ রামাই, রঘুনাথ, গোবিন্দ আর নিজের জন্য চারভাগ করে রেখে জগদানন্দ বলল, এই রইল আমাদের চারজনের প্রসাদ। তুই ফিরলে রামাই, রঘুনাথকে ডেকে নিয়ে খেতে বসব।

জগদানন্দের হুকুম শুনে গোবিন্দ ঝঞ্ঝাটে পড়ে গেল। প্রভুর নির্দেশে পণ্ডিতের খাওয়া শেষ হলে তবেই সে গম্ভীরায় ফিরতে পারে। সে হুকুমের নড়চড় নেই। পণ্ডিত আবার প্রভুর সেবায় গম্ভীরায় যেতে বলছে তাকে। দোটানায় পড়ে গেল গোবিন্দ। প্রভুর প্রসাদ খাওয়ার চেয়ে তাকে সেবা করাই তার বেশি আনন্দ। তাছাড়া সকালে মন্দির থেকে পাঠানো প্রসাদ খেয়ে তার তেমন খিদে নেই। প্রভুকে ঘুম পাড়িয়ে ফিরে এসে প্রসাদ পেলে সে গুছিয়ে খেতে পারে। তখন খিদে পাবে। কী করবে ভেবে সে যখন চিন্তার পাথারে ভাসছে, জগদানন্দ বলল, তুই তাড়াতাড়ি যা। তোর সেবা না পেলে প্রভু ঘুমোতে পারে না। আর দেরি করিস না। প্রভু জিজ্ঞেস করলে বলবি, প্রসাদ সাজিয়ে পণ্ডিত বসে পড়েছে। গা তোল, রওনা দে। সাতপাঁচ ভাবনা মাথায় এলেও প্রভুকে সেবা করার টানে পণ্ডিতের ঘর থেকে বেরিয়ে গম্ভীরার পথে গোবিন্দ হাঁটা দিল। তাকে এত তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে গোরা জিজ্ঞেস করল, পণ্ডিতের খাওয়া এর মধ্যে হয়ে গেল?

প্রসাদ সাজিয়ে বসেছে।

সে খাওয়া শেষ করার আগে তুই চলে এলি কেন?

গোরার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘরের মেঝেতে পাটখোলা গেরুয়া অঙ্গবস্ত্রের ওপর এলিয়ে থাকা তার শরীরটা সযত্নে দলাই মলাই শুরু করল গোবিন্দ। গোবিন্দ কেন ফিরে এসেছে টের পেতে গোরার অসুবিধে হল না। জগদানন্দই ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে গোবিন্দকে। কয়েক মুহূর্তে গভীর ঘুমে সে ডুবে যেতে গোবিন্দ গম্ভীরা ছেড়ে জগদানন্দর কুঁড়েতে ফিরে এলে। রামাই, রঘুনাথকে জগদানন্দ ডেকে নিতে আঙটপাতা বিছিয়ে চারজন খেতে বসল।

গোবিন্দ চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে গোরার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। নবদ্বীপ থেকে জগদানন্দ শুধু চন্দন তেলের কলসী নিয়ে ফেরেনি, অদ্বৈতের পাঠানো হেঁয়ালির মতো একটা তর্জা কণ্ঠস্থ করে এসেছিল। সেটাই ছিল গোরার কাছে পাঠানো অদ্বৈতের এক সাংকেতিক বার্তা। গোরা তখনই না বুঝলেও পক্তিগুলো খোঁচাতে শুরু করেছিল। হাসিমুখে জগদানন্দ তর্জা শোনালেও সেখানে ভেতরে বাইরে নানা অর্থের মোড়ক আছে, বুঝতে তার অসুবিধে হয়নি। তর্জার ভেতরের অর্থ রোজ অনেক সময় ধরে সে ভেবে চলেছে।

বাউলকে কহিও লোকে হইল আউল
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল।
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল
বাউলকে কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল।

গোরার মাথাতে আবছা জেগে ওঠা অর্থ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। নিতাই-এর প্রেমভক্তি প্রচারে গঙ্গার দু’তীরের যে জনসমাজ ভেসে গেছে তারা বাউল নয়। অদ্বৈত আচার্যের ভাষাতে তারা আউল। প্রেমভক্তিতে তারা ভেসে গেছে। ধর্মরাজ্য তৈরির চিন্তা তাদের মাথাতে নেই। নিতাইয়ের নেতৃত্বে রাঢ়, মল্লভূম, চন্দ্রদ্বীপের যে রাজন্যবর্গ ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েছিল, সেই চাল কেনার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। অদ্বৈত ক্ষুণ্ণ হলেও এই ঘটনা স্বাভাবিক। নিতাই অবধূত, সহজিয়া সন্ন্যাসী। প্রেমভক্তিতে মানুষের হৃদয় কেড়ে নিতে পারে। সে তাই করুক। গোরার কোনও আক্ষেপ নেই। প্রেমভক্তি প্রচারের জন্য তাকে আরও বড় জনপদের খোঁজ করতে হবে। আর্যাবর্তে প্রচার সেরে যেতে হবে আরও পশ্চিমে, দরকার হলে সমুদ্র পেরিয়ে অন্য দেশে। সবই করবে বাপ কৃষ্ণের ডাকে। মনে মনে সে প্রার্থনা করল, তার চেনা স্বপ্নদর্শী তরুণ রাজন্যবর্গ যেন সুলতানী সেনাদলের হাতে রক্তাক্ত না হয়, ভেঙে না পড়ে। তারা-ও অস্ত্র রেখে প্রেমভক্তি প্রচারে নেমে পড়ে। প্রেমভক্তির পরাজয় নেই। চাল কেনাবেচার হাট কখনও বন্ধ হওয়ার নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *