গোরা – ২৮

২৮

সাক্ষাৎ জহ্লাদের মতো নবদ্বীপের দুই কোটাল, জগাই, মাধাই, হরিবোলা বৈষ্ণব হয়ে গেছে শুনে নবদ্বীপের মানুষ গোড়ায় বিশ্বাস করল না। দিনের বেলায় কাজকর্মে যাতায়াতের পথে তাদের অনেকে চৌকিদারি তোরণগুলোতে কয়েকদিন উঁকিঝুঁকি মেরে জেনে গেল, যা রটেছে, মিথ্যে নয়। ঘটনা তার চেয়ে গুরুতর। কপালে চন্দনের তিলক এঁকে, গলায় তুলসিমালা ঝুলিয়ে জগাই মাধাই কোটালের দায়িত্ব পালন করছে। মুখে জপছে কৃষ্ণনাম। কারও সঙ্গে চোখাচোখি হলে অগ্নিবর্ষী দৃষ্টিতে না তাকিয়ে বিনয়ের হাসি হেসে বলছে, ‘কৃষ্ণ বল, কৃষ্ণ ভজ।’ দু’ভাইয়ের চোখ থেকে নেশাখোরের লালচে ভাব কেটে গিয়ে জেগে উঠেছে শিশুর সরলতা। গোঁড়া ন্যায়শাস্ত্রী, স্মার্তদের কেউ কেউ আড়াল থেকে তাদের দেখে গিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে থাকল, এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা।

বেআক্কেলে মন্তব্যও করল দু’-একজন। বলল, শ্রীবাসের আঙিনায় সঙ্কীর্তনের নামে গভীর রাতে যে মধুচক্র বসে, সেখানে মধুর দু’-এক ফোঁটা ভাগও কোটাল দু’জন নিশ্চয় পাচ্ছে।

নিন্দে গুজব যাই রটুক, গোরার অনুগামীর সংখ্যা জনসমুদ্রের চেহারা নিতে থাকল। বিশেষ করে ভিড় জমাতে থাকল বৈদ্য, কায়স্থরা। বৈদ্য সম্প্রদায়ের সামনের সারিতে যেমন মুরারি গুপ্ত, নরহরি দাস সরকার ছিল, তেমনি কায়স্থদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল বুদ্ধিমন্ত খাঁ, মুকুন্দ সঞ্জয় প্রমুখ। গোরাকে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে মানতে যারা বৈষ্ণববিরোধী হয়েছিল, জগাই মাধাই বৈষ্ণবভক্ত হয়ে যেতে তাদের মনে দোদুল্যমানতা ঢুকল। নিজেদের মধ্যে গল্পগাছায় তারা বলতে থাকল, মনে হচ্ছে, কলিযুগে জ্ঞানের চেয়ে ভক্তির জোর বেশি। হেলাফেলা করার মানুষ নয় আমাদের গোরা। পুরনো ভক্তির স্রোতকে নবদ্বীপে সে চাগিয়ে তুলেছে, বলা যায় জোয়ার এনেছে। আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে গোরা যে কৃষ্ণের অবতার, বুঝতে পারিনি।

বুঝতে চাইনি।

তা বটে, বুঝেও বুঝতে চাইনি। গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।

নানা টুকরো কথাচালাচালির মধ্যে বয়স্ক একজন বলল, অনেক হয়েছে, গোরাকে আমরা বিস্তর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি, আর নয়, তার পায়ে এখন প্রেমভক্তিতে আমরা লুটিয়ে পড়তে চাই। জগাই মাধাই-এর মতো মহাপাপীকে যে বুকে টেনে নিয়েছে, আমাদের সে ফেলে দিতে পারবে না।

কোটালের চাকরিতে ইস্তফা না দিয়ে জগাই মাধাই হরিবোলা হয়েছে, রাতে সঙ্কীর্তনের আসরে যাতায়াত করছে শুনে চাঁদকাজি চটলেও গৌড় দরবারের অনুমতি না নিয়ে তখনই দুই কোটালকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করতে ভরসা পেল না। হরিবোলাদের কড়া শিক্ষা দিতে সময় নেওয়ার সঙ্গে গৌড়ের দরবারে দুই কোটালের হরিবোলা হয়ে যাওয়ার বিবরণ দিয়ে ছোট রাজা সাকর মল্লিকের পরামর্শ চাইল। কাজির অভিযোগ পেয়ে সাকর মল্লিক, যার পিতৃদত্ত নাম অমর, সে দুই কোটালকে ছাঁটাই না করে পরিস্থিতির ওপর কাজিকে নজর রাখতে বলল। সাকর মল্লিকের নির্দেশ দরবারি মোহর লাগানো কাগজে নিজের হাতে লিখল সাকর মল্লিকের ছোটভাই দবীর খাস, যার পারিবারিক নাম সন্তোষ। সে আবার ছোট রাজা, অমরের সহোদর ছোটভাই। সন্তোষের হস্তাক্ষর ছিল মুক্তোর মতো সুন্দর। দরবারের গুরুত্বপূর্ণ গোপন দলিল চিঠিচাপাটি লেখার দায়িত্ব ছিল দবীর খাস, সন্তোষের। সঙ্কীর্তনকারীদের ওপর নজর রাখার নির্দেশ পেয়ে, কাজটা ঠিক কী, কাজি মালুম করতে পারল না। মাঝখান থেকে জগাই মাধাই উদ্ধারে সঙ্কীর্তনের দল নিয়ে পথপরিক্রমা করে গোরা এমন এক নজির সৃষ্টি করেছিল যে, নবদ্বীপের নানা পাড়া থেকে এমনকী শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নবশাকরাও প্রায় রোজ পথপরিক্রমায় বেরোচ্ছিল সঙ্কীর্তনের দলে। নবদ্বীপ জুড়ে, কাঞ্চনতলা, সমুদ্রগড়, রাহুতপুর, চাঁপাহাটি আরও নানা এলাকার পথে পথে সঙ্কীর্তন করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। হিদুয়ানির স্পর্ধা দেখে কাজি তেলেবেগুনে চটে ওঠার সঙ্গে পাইক নিয়ে কয়েকটা দলকে রাস্তায় বেধড়ক পিটিয়ে দিল, তাদের মৃদঙ্গ, মন্দিরা, করতাল কেড়ে নিয়ে ভেঙে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিল। নিরীহ সঙ্কীর্তনকারীদের মনে আতঙ্ক ছড়াতে তাদের জানিয়ে দেওয়া হল, একই অপরাধ দ্বিতীয় বার করতে তাদের জাত মেরে দেওয়া হবে, পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তাদের ঘরদোর। হাড় হিম করা সেই হুমকিতে অচিরে সঙ্কীর্তনে ভাটা পড়ল। পাষণ্ডিরা সুযোগ বুঝে রটিয়ে দিল, নবদ্বীপের হরিবোলাদের ধরে নিয়ে যেতে গৌড় থেকে পাইক বরকন্দাজ বোঝাই যে সুলতানি নৌকো পাঠানো হয়েছে, যে কোনওদিন সেই বহর এসে যাবে। হরিবোলা ধরতে এসে নবদ্বীপের গোটা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে দেবে সুলতানের বাহিনী। নবদ্বীপ সম্পর্কে গৌড় দরবারের মতিগতি কিছুটা কাজি জানলেও সঙ্কীর্তনের হুজুগ মাথায় চেপে বসার আগে সতর্ক নজর রাখার পাশাপাশি উপযুক্ত অন্য ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি সে জানিয়ে রেখেছিল। একাধিক কীর্তনবাহিনীকে তার পেটাই করার খবর গুপ্তচরদের সূত্রে গৌড়ের দরবারে পৌঁছে যেতে সাকর মল্লিক, যার নাম অমর সে পরামর্শ করল দবীর খাসের সঙ্গে। সাকর মল্লিক, অমরের ছোটভাই দবীর খাস, যার পারিবারিক নাম সন্তোষ, দু’জনেই সুলতান হোসেন শাহের পদস্থ কর্মচারী। কাজির আর্জি মেনে পথ আটকে সঙ্কীর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারি করার চিন্তা তাদের মাথায় এলেও তখনই সেই ফরমান তারা নবদ্বীপে পাঠাল না। সুলতানের ডান হাত, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরের সঙ্গে একদফা আলোচনা করে নিতে চাইল। চারুমিহির সবুজ সঙ্কেত দিল। বলল, কাজিকে তোমরা যে নির্দেশ পাঠাতে মনস্থ করেছ, তার চেয়ে উপযুক্ত হুকুমনামা হতে পারে না। কাজি হুকুমনামা মেনে কাজ করলে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। পথ অবরোধ না করে দলবল মিলে বিশ্বম্ভর মিশ্রের কৃষ্ণনাম প্রচারের সঙ্গে আগের মতো সঙ্কীর্তন যেমন চলবে, তেমনি আলগা হতে থাকবে গোঁড়া ব্রাহ্মণদের সমর্থনের ভিত।

উল্টোরকমও হতে পারে।

সাকর মল্লিক কথাটা বলতে চারুমিহির বলল, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক, আমি আশা করি তেমনই যেন ঘটে। বিশ্বস্তর মিশ্রের মতো তেজি বৈষ্ণবসাধক সহজে সুলতানি নিষেধাজ্ঞা মেনে নেবে না। পথে পথে সে সঙ্কীর্তনের দল নিয়ে ঘুরবে।

তারপর?

আমার তৈরি গোপন জ্যোতিষ গণনা থেকে যা পেয়েছি, তাই ঘটবে। জলস্রোতের মতো গৌড় বাঙ্গালা, রাঢ়, সমতট, সুত্মের মানুষ এসে মিলে যাবে তার সঙ্গে। গৌড়ের অধিপতি হবে কৃষ্ণাবতারের মতো গুণবান, নবদ্বীপের সেই ব্রাহ্মণসন্তান।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সাকর মল্লিককে ফিসফিস করে চারুমিহির বলল, তুমি তো জানো, নবদ্বীপে যিনি আমাদের শিক্ষাগুরু ছিলেন, এখন ফুলিয়াবাসী, সেই বিদ্যাবাচস্পতি, নবদ্বীপে আমাদের সহপাঠী, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, যে কিনা এখন ঘোর বৈষ্ণববিদ্বেষী, তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে, পত্র লেনদেন হয়, তারাও এই পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছে। পরিবর্তনের পক্ষে বিদ্যাবাচস্পতি দাঁড়ালেও বৈষ্ণবদের রমরমা কৃষ্ণানন্দ মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। তার বিশ্বাস প্রেমভক্তি প্রচার করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, শক্তিশেল হানতে হবে।

ভ্রু কুঁচকে, কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করল চারুমিহির। বলল, এ নিয়ে আর কথা নয়। দেওয়ালেরও কান আছে।

দবীর খাসকে বিজ্ঞপ্তি মুসাবিদা করে নবদ্বীপে চব্বিশঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে জ্যোতিষার্ণব চলে যেতে তিনজনের বৈঠক শেষ হল। পঁচিশবছর আগে নবদ্বীপে বাসুদেব সার্বভৌমের চতুষ্পাঠীতে অমর, সন্তোষ দু’জনেরই সহপাঠী ছিল চারুমিহির। দাদা বাসুদেবের সঙ্গে ছোটভাই বিদ্যাবাচস্পতি সেই চতুষ্পাঠীতে শিক্ষক ছিল তাদের। লেখাপড়া নিয়ে অমর, সন্তোষ অভিনিবিষ্ট থাকলেও উচ্চাভিলাষী চারুমিহির যত না পাঠে মনোযোগী ছিল, তার চেয়ে বেশি আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখত। চলমান ঘটনাস্রোত সম্পর্কে তার প্রবল আগ্রহ ছিল। গৌড় দরবারের এত খুঁটিনাটি খবর রাখত, যে কে কবে সুলতানি মসনদে বসতে চলেছে, অনুমানে বলে দিতে পারত। আশ্চর্য হল, তার প্রায় সব অনুমান মিলে যেত। সুলতান শাহজাদাকে খুন করে সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ কুর্সি দখল করতে চলেছে, চারুমিহির বলার পনেরো দিনের মধ্যে তা ঘটেছিল। বছর ঘোরার আগে ফিরোজকে খুন করে কুতবুদ্দিন মাহমুদ শাহ সুলতানি দখল করতে চলেছে, চারুমিহিরের এই ভবিষ্যৎ গণনাও মিলে গিয়েছিল। এক বছরের বদলে সময় লেগেছিল তেরো মাস। চারুমিহিরের বাক্‌সিদ্ধি দেখে সহপাঠীরা অবাক হত। কেউ কেউ ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করত, তুমি কবে সিংহাসনে বসবে?

বন্ধুদের প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে চারুমিহির বলত, রাজা হওয়ার চেয়ে রাজা বানানোতে আমার বেশি শখ। সেটাও কম দায়িত্বের কাজ নয়। রাজা তৈরির কারিগর হতে চাই আমি।

তার লম্বাচওড়া কথা শুনে সহপাঠীদের অনেকে হাসাহাসি করলেও অমর কখনও হাল্কাভাবে তাকে নেয়নি। সন্তোষও যথেষ্ট সম্ভ্রম দেখাত চারুমিহিরকে। অমর, সন্তোষ, দুই ভাই-এর সঙ্গে চারুমিহিরের সদ্ভাব গড়ে উঠেছিল। হোসেন শাহ, গৌড়ের সুলতান হওয়ার অল্পদিনের মধ্যে জ্যোতিষার্ণব শিরোপা দিয়ে চারুমিহিরকে সসম্মানে দরবারে আসন দেওয়ার কয়েকবছর পরে তারই পরামর্শে অমর, সন্তোষকে সুলতানি প্রশাসনের উঁচু পদে বহাল করেছিল হোসেন শাহ। অমরের পদমর্যাদা হল সাকর মল্লিক অর্থাৎ ছোট রাজা, সন্তোষ হল দবীর খাস, বাংলায় যাকে বলা হয় মুখ্যসচিব। মুক্তোর মতো হাতের লেখা ছিল সন্তোষের। সুলতানি দরবারের বেশির ভাগ জরুরি আর গোপন ফরমান, বিজ্ঞপ্তি, হুকুমনামা সে নিজের হাতে লিখলে তবেই তার ওপরে হুকুমতের মোহর পড়ত। তার লেখা, পথ আটকে সঙ্কীর্তনে নিষেধাজ্ঞা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে নবদ্বীপে কাজির হাতে পৌঁছে যেতে গোঁফে চাড়া দিয়ে সে রটিয়ে দিল, সুলতানি আদেশে নবদ্বীপে, ঘরে-বাইরে সঙ্কীর্তন নিষিদ্ধ হয়েছে। হুকুম অমান্যকারীকে কঠোর সাজা দেওয়া হবে।

নবদ্বীপমণ্ডলের পুবে আমঘাটা থেকে পশ্চিমে বিদ্যানগর আর উত্তরে বেলপুকুরিয়া থেকে দক্ষিণে মহিশূরা পর্যন্ত ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল, গৌড় দরবার থেকে পাঠানো মোহর আঁকা বিজ্ঞপ্তির বয়ান। ট্যাড়ার আওয়াজ শুনে নবদ্বীপের নিরীহ, শান্তিপ্রিয় অবৈষ্ণবও ভয়ে গুটিয়ে গেল। বয়স যাদের বেশি, তারা মনে করতে পারল, সেই দুর্ভিক্ষের বছরে সঙ্কীর্তন করার অপরাধে শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

গোরা আর তার অনুগামীরা কাজির আদেশকে পাত্তা দিল না। মাথায় সেই স্মৃতি জেগে থাকলেও শ্রীবাস ভয় পেল না। তার বাড়িতে আগের মতো সন্ধে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চলতে থাকল সঙ্কীর্তন। আসর থেকে শুধু কয়েকটা চেনা মুখ সরে গেল। অদ্বৈত, শ্রীবাস, গদাধর, নরহরি, জগদানন্দ, মুরারি, হরিদাস নিত্যানন্দ প্রমুখ বৈষ্ণব ভক্তদের সঙ্গে বসে গোরা ঠিক করল, সুলতানি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নবদ্বীপের পথে সঙ্কীর্তন নিয়ে তারা শোভাযাত্ৰা করবে। তার আগে তারা তিনদিন ধরে শ্রীবাসের বাড়িতে সাতপ্রহরিয়া সঙ্কীর্তনের আসর বসাবে। নবদ্বীপের যেখানে যত সঙ্কীর্তনের দল তৈরি হয়েছে, তারা সবাই তিনদিন, নানা প্রহরে হাজির থেকে প্রহর ভাগাভাগি করে জাগিয়ে রাখবে কীর্তনের আসর। সাতপ্রহরের নানা পর্বে আসরমুখ্যের ভূমিকায় থাকবে অদ্বৈত আচার্য, শ্রীবাস, নিত্যানন্দ, হরিদাস, গদাধর, নরহরি, জগদানন্দ, বাসু ঘোষ, বাসুদেব দত্ত, শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী, শ্রীমান পণ্ডিত, মুরারি, মুকুন্দের মতো প্রবীণ আর কমবয়সী ভক্তরা। গোরা থাকবে সব আসরে। সে আসরে যাওয়া আসা করবে।

গৃহদেবতা বিষ্ণুর নিত্যপূজার সঙ্গে তিনদিন, সাতপ্রহর ধরে আসরে ভক্তদের সেবার দায়িত্ব নিল কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী নারায়ণী। তিনঘণ্টায় একপ্রহর ধরলে, সাতপ্রহর মানে একুশঘণ্টা, অর্থাৎ পরপর তিনটে সারাদিন, সারারাত একটানা কাজের মধ্যে তাকে থাকতে হবে। কিছুক্ষণের জন্যে, একপ্রহর অবসর মিললে তখনও সজাগ থাকা চাই। কৃষ্ণপ্রেমের আবহে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে বড় হয়েছে। নবদ্বীপ ছেড়ে মা-বাবার সঙ্গে কুলিয়ায় চলে গেলেও শিশু বয়সের স্মৃতি কখনও ভোলেনি। কৃষ্ণের আচরণে পাশের বাড়ির যে কিশোরকে দেখতে শুরু করেছিল, আজও তাকে দেখলে শরীরে রোমাঞ্চ জাগে, তিন রাত, তিন দিন তার সান্নিধ্যে কাটানো, তার সেবা করার এই মস্ত সুযোগ ছাড়তে নারায়ণী রাজি নয়। সে বৈষ্ণব পরিবারের মেয়ে, অবিচল তার বিষ্ণুভক্তি। গৃহদেবতা বিষ্ণুর আসনে গোরাকে বসিয়ে নিতাই যেদিন পুজো করেছিল, ষড়ভুজ গোরাকে দেখে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল অদ্বৈত, আনন্দে চোখের জলে ভেসেছিল ভক্তরা, নারায়ণীর সেদিন চোখ খুলে গিয়েছিল। সে-ও ঈশ্বরের অবতার ভাবতে শুরু করেছিল গোরাকে। সঙ্কীর্তনের আবেশঘন মুহূর্তে সেটা বেশি অনুভব করত। সারাদিন গৃহদেবতার সেবা, সংসারের কাজে সেই অনুভূতি ফিকে হয়ে গেলে মাথার মধ্যে জেগে উঠত ডানপিটে কিশোর গোরার মূর্তি, যার কোলে চেপেছে, যাকে ঘোড়া বানিয়ে পিঠে বসে বাড়ির উঠোনে ঘুরেছে, যার দিকে কিশোরী বয়সে, এমনকি বিয়ের পরেও সলজ্জ তাকিয়ে থেকেছে, সেই গোরাদাদাকে সে ঈশ্বর ভাবে কী করে? শিশুবয়সে কতবার যে বালক গোরার মুখ থেকে তার চিবোনো পান চেয়ে সে খেয়েছে। তাকে খাওয়াতেই বোধহয় মায়ের কাছ থেকে জেদ ধরে পান সাজিয়ে খেত। পান মুখে পুরে তাকে দেখিয়ে মসমস করে চিবোতো সেই দুষ্টু বালক। গৃহদেবতা পাথরের বিষ্ণুমূর্তির মধ্যে যেদিন ভাবাবেশে গোরাদাদাকে দেখেছিল, সেই দেখা যেমন সত্যি, তারপর সেই দর্শন আর ঘটেনি, সেটাই তেমনি সত্যি। পাশের বাড়ির এই মানুষটা যদি তার স্বামী হত, তাহলে সারাজীবন কী সুখেই সে সংসার করতে পারত। রাতে ঘুমের মধ্যে সেই সুখস্বপ্নের ছবি চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলে তার ঘুম ভেঙে যেত। টের পেত কাঁটা দিয়ে উঠেছে গোটা শরীর। মৃত স্বামী বৈকুণ্ঠের মুখ চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না। তার মাথা থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছে হারানো স্বামী, সংসারের স্মৃতি। লজ্জায় গুটিয়ে গিয়ে এরকম মুহূর্তে বিষ্ণুপ্রিয়ার মঙ্গল কামনা করে সে। কপালে এয়োতির সিঁদুর, স্বামী সন্তান, ভরপুর সংসার নিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া সুখে থাকুক, এই চায়

সাতপ্রহরিয়া মহোৎসবের জন্যে শ্রীবাসের বাড়িতে সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছিল। নবদ্বীপের নানা পাড়া থেকে কীর্তনীয়রা ছাড়াও বিশিষ্ট অতিথি, আত্মীয়, পড়শি, অনাহূত, হুজুগে মানুষের ভিড় কম হবে না বাড়িতে। রোজ কম করে একশ’ মানুষের পাত পড়বে। তার সঙ্গে রয়েছে গৃহদেবতা বিষ্ণুর রোজের নৈমিত্তিক পুজো অনুষ্ঠান। নারায়ণী স্বেচ্ছায় নিত্যপুজোর সঙ্গে মহোৎসবের সব দায়িত্ব নিলেও একা হাতে সবকিছু তাকে সামলাতে হবে না, সে নিজেও জানে। মালিনী খুড়ি ছাড়া তার আরও তিন খুড়িমা, পিসি, মাসিরা পাশে এসে দাঁড়াবে। প্রয়োজনে কাজে হাত লাগাবে। তার সামনে তাকে প্রশংসা করে আড়ালে গিয়ে নানা খুঁত বার করে নিন্দেমন্দ করবে, ফের সাহায্য করবে, গলা জড়িয়ে আদর করবে, পরপুরুষের দিকে বিধবা স্ত্রীলোকের তাকানো মহাপাপ, এরকম জ্ঞানের কথা শোনাবে। সংসারের মানুষগুলোকে নারায়ণী ভালোরকম চেনে, রোজ আরও বেশি করে চিনছে। ভালো চিনছে, মন্দ চিনছে। সব জেনেও সংসার আর চারপাশ সম্পর্কে তার ভালবাসা কমেনি। বরং ভালবাসা বাড়ছে। উনিশবছরের মেয়েটা নিজেকে কিছুতেই একজন বিধবা বুড়ি হিসেবে ভাবতে পারে না। গৃহদেবতার পাথরের মূর্তির দিকে তাকিয়ে কখনও সখনও তাকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখে। কখনও মনে হয়, মূর্তির চোখের মণিদুটো নড়ে উঠল, কখনও কেঁপে উঠল নাকের পাটা, সস্নেহে তার গলা জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিচ্ছে, পাথরের মূর্তির হৃৎপিণ্ডের ওঠাপড়ার আওয়াজ শোনার অনুভবও তার হয়েছে। স্বামী, ছেলে হারালেও ঈশ্বর তাকে ছেড়ে যায়নি, এ বিশ্বাস তার রয়েছে। ভগবান বিষ্ণুই হরি, কৃষ্ণ, আবার সে-ই ঈশ্বরের অবতার গোরা জানার পরে, জীবনের কাছে নারায়ণীর প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে। সে টের পাচ্ছে, অঘটন কিছু ঘটবে, যা তাকে নতুন জীবন দেবে।

সাতপ্রহরিয়া কীর্তন অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রাতের অনুষ্ঠান থেকে পূর্বাহ্ন, মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ, সায়াহু, প্রদোষ ও রাত্রিলীলার পর্যায়ে, রাতের তৃতীয় প্রহরে, দু’দণ্ডের বিরতি চলবে। রাত তিনটের পর থেকে ফের শুরু হবে রাত্রিলীলার পালা, চলবে সূর্যোদয়ের মুহূর্তে প্রাতঃলীলা শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত। রাতে সেই দু’দণ্ড বিশ্রামের সময় পাবে নারায়ণী। দু’দণ্ড কম সময় নয়, একঘণ্টার তিন চতুর্থাংশের কিছু বেশি। ইচ্ছে করলে সে তখন সামান্য সময়ের জন্যে দু’চোখ বুজিয়ে নিতে পারে। রাত ফুরনোর আগে চান সেরে বাসি পোশাক ছেড়ে ঘরে কাচা, ভাঁজ করে রাখা থানে শরীর জড়িয়ে গৃহদেবতার পুজোর উপকরণের সঙ্গে ঊষাভোগ সাজিয়ে ফেলবে। তার কাজের বিলিব্যবস্থা মালিনীখুড়িই বুঝিয়ে দিয়েছে। হেঁসেল ভাঁড়ার সামলাবে মালিনী। অতিথি আপ্যায়নে শ্রীবাস সমেত থাকবে আরও তিন কাকা—শ্রীরাম, শ্রীপতি, শ্রীনিধি। তাদের পাশে বৈষ্ণব সমাজের প্রবীণ কেউ কেউ নিশ্চয় দাঁড়াবে। প্রহর অনুযায়ী কীর্তন সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকবে বাসুদেব দত্ত, মুকুন্দ দত্ত। তারা দু’ভাই। তাদের সাহায্য করবে কীর্তনীয়া বাসু ঘোষ।

সঙ্কীর্তন মহোৎসবের দিন যত এগিয়ে আসতে থাকল, নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজে বাড়তে থাকল উত্তেজনা। শ্রীবাসের গৃহস্থালিতে ব্যস্ততা জাগতে থাকল। গোরার অনুগামীদের পাঠানো মহোৎসবের উপকরণে ভরে যেতে থাকল বাড়ির ভাঁড়ার। ঘরে ঘরে ফলারের চিঁড়ে কুটতে, নাড়ু, মোয়া, মণ্ডা বানাতে বসে গেল মেয়েরা। কাজির নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্বহীন করে দিতে অনুগামীদের নিয়ে সঙ্কীর্তনের আসর বসিয়ে গোরা বড়রকম ঘোঁট পাকাতে চলেছে দানি, জাসু, সিন্ধুকদের সূত্রে সে খবর কাজির কাছে পৌঁছে গেল। কাজি রাগে ফুঁসলেও শ্রীবাসের বাড়িতে তখনই আগুন লাগাতে ভরসা পেল না। গৌড়ের দরবার থেকে পথ আটকে সঙ্কীর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নিজের বাড়িতে কোনও গৃহস্থ সঙ্কীর্তনের আসর বসালে, তা বরবাদ করার হুকুম দরবার দেয়নি। পুরনো দিনকাল থাকলে গৌড় দরবারের হুকুমের অপেক্ষায় না থেকে শ্রীবাসের ঘরে সে আগুন লাগিয়ে দিতে পারত। কাজির হুকুম তখন ছিল শেষ কথা। সে সুযোগ আর নেই। হোসেন শাহের সুলতানিতে উজির, নাজির হয়ে কিছু হিদু দরবারে ঢুকে পড়তে কাজির ক্ষমতা খাটো হয়ে গেছে। কাগজে লেখা ফরমান না পেলে দণ্ড দেওয়া যায় না। সাকর মল্লিকের ছোটভাই দবীর খাস লোকটা লেখালিখির কাজে ওস্তাদ। সারাদিন দলিল, দস্তাবেজ, হুকুমনামা লিখে সুলতানি মোহর লাগাচ্ছে। মোহর লাগানো তার বিজ্ঞপ্তিই আইন। গৌড়ের যেখানে যত কাজি আছে, সবাইকে তা মেনে চলতে হবে। শ্রীবাসের ঘরে মহোৎসবের তোড়জোড় চলতে থাকার খবর নিয়মিত কানে আসতে কাজি রাগে ফুঁসলেও তখনই কড়া ব্যবস্থা নিতে পারল না। সুযোগের অপেক্ষায় থাকল। এক মাঘে শীত যায় না, সে জানে। তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দুই কোটালের মাথা যারা ঘুরিয়ে দিয়েছে, সেই হরিবোলাদের সে সহজে ছাড়বে না।

কাজি যখন হরিবোলাদের কঠোর সাজা দিয়ে মনের ঝাল মেটানোর ফন্দি আঁটছে, নিতাই তখন অদ্বৈত, শ্রীবাসের কানে উল্টো প্রশ্ন তুলে দিল। জগাই মাধাই-এর মতো কাজিকে বৈষ্ণবসমাজের মধ্যে টেনে আনতে নগরসঙ্কীর্তনে বেরোলে কেমন হয়, জানতে চাইল। তার পরামর্শ শুনে প্রবীণ বৈষ্ণব অদ্বৈত থতমত খেলেও কথাটা ফেলে দিতে পারল না। শ্রীবাসের দিকে তাকাল অদ্বৈত। নিতাইকে সংসারে আশ্রয় দিয়ে, সে যে সাধারণ অবধূত নয়, শ্রীবাস জেনে গেছে। সে জানে, নিতাই একই সঙ্গে শিশু আর প্রজ্ঞাবান মানুষ। মালিনীকে বুকের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে তাকে যেভাবে অবলীলায় নিতাই আরোগ্য দিয়েছে, তা পাঁচজনকে বলার মতো না হলেও শ্রীবাস জানে। মালিনী বলেছে শ্রীবাসকে। নিতাইকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়ে তার দাঁতের স্পর্শ পায়নি মালিনী। দুটি স্তনের বোঁটায় কচি শিশুর নরম দুটি ঠোঁটের ছোঁয়া ছাড়া আর কিছু অনুভব করেনি। ঘটনাটা ক’দিনের মধ্যে পরিবারে কীভাবে যেন জানাজানি হয়ে গেছে। মালিনীও গোপন করেনি। বলেছে, নিতাই আমার ছেলে, কোলের শিশু সে।

মালিনী যতবার কথাটা বলে আবেগে তার দু’চোখে জল এসে যায়। মুখে ফুটে ওঠে স্নেহাতুর মায়ের অভিব্যক্তি। তার সামনে কেউ কিছু না বললেও আড়ালে দু’একজন মন্তব্য করে, বুড়ি মাগীর ঢং!

সংসারে খোলাখুলি আর আড়াল-আবডালে যা ঘটছে, কথা চালাচালি হচ্ছে, তা নিয়ে শ্রীবাস মাথা না ঘামালেও, সে সব জানতে পারে। মালিনী যা বলছে, তার সত্যতা নিয়ে শ্রীবাসের এক ফোঁটা সন্দেহ নেই। নিতাইকে নিজের পেটের ছেলের চেয়ে সে বেশি স্নেহ করে। হঠাৎ করে দুধে স্ত্রীলোকের স্তন ভরে ওঠার ঘটনা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও যে রয়েছে, কবিরাজ মুরারি গুপ্তের মুখ থেকে শ্রীবাস শুনেছে। আয়ুর্বেদে এ রোগের নিদান নেই। ভাগ্য ভালো, মালিনী সন্তানসম্ভবা। দু’মাস বাদে সে মা হবে। তখন আর নিতাই-এর তাকে চিকিৎসার দরকার পড়বে না। চিকিৎসাটা নিতাই-এর নিজের, না কারও থেকে সে শিখেছে, শ্রীবাস জানে না। নিতাইকে জিজ্ঞেস করতে সঙ্কোচ বোধ করেছে। শ্রীবাস বুঝে গেছে, নিতাই সব পারে। কাজিকে কৃষ্ণ নামে ভজনায় টানতে নগর সঙ্কীর্তনে নিতাই-এর নামার ইচ্ছেটা অল্পদিনের মধ্যে ঘটতে চলেছে সে বুজে গেল। দুই প্রবীণ বৈষ্ণবকর্তার দিকে তাকিয়ে এক মুখ হেসে নিতাই বলল, মহোৎসবের পরে নবদ্বীপের পথে পথে সঙ্কীর্তনের জোয়ার উঠবে। হাজার হাজার হরিবোলাকে কেউ আটকাতে পারবে না। গাছে কুঁড়ি এলে ফুট ফুটবে না, তা কখনও হয়? ভোর হচ্ছে অথচ পাখি ডাকছে না, কখনও সম্ভব? মানুষ সংসারধর্ম পালন করবে, অথচ প্রকৃতির সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান করতে পারবে না, এ হুকুম খাটবে না, শুকনো পাতার মতো উড়ে যাবে। কাজির বাড়িতেই হয়তো আমাদের সঙ্কীর্তনের আসর বসবে।

অদ্বৈত কিছু অনুমান করে বলল, সঙ্কীর্তন নিয়ে পথে নামতে হলে গোরার অভিমত

নেওয়া দরকার।

অদ্বৈতর কথা শুনে নিতাই হাসল। দু’দিন আগে গভীর রাতে সঙ্কীর্তনের শেষে তার মাথাতে সঙ্কীর্তন নিয়ে পথে নামার ভাবনাটা গোরা ঢুকিয়ে দিয়েছে, অদ্বৈত জানে না। কাজির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পথে নামার ইঙ্গিত দিয়েই মহোৎসবের আয়োজন শুরু হয়েছে। সঙ্কীর্তনের ঢেউ কাজির বাড়িতে গিয়ে লাগতে পারে, এ আভাসও দিয়েছিল। সঙ্কীর্তনের জনসমুদ্র নবদ্বীপের পথে ঘাটে সুরের ঢেউ তুলবে, এ নিয়ে গোরার সন্দেহ নেই। জনসমুদ্রের কথাটা বলে সে চুপ করে গিয়েছিল। গভীর আবেশে ডুবে গিয়ে সেই মুহূর্তে তার কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। বিষ্ণুমন্দিরের দাওয়ায় বসে ঘরে ফেরার কথা ভুলে গিয়েছিল। আমলকি গাছের তলা থেকে অন্ধকার চাতালের পাশে গদাধর এসে দাঁড়াতে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি সমুদ্র দেখেছ?

দেখেছি।

কোথায়?

দক্ষিণ দেশে, পশ্চিমে দ্বারকা থেকে পুবে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত পরিক্রমা করেছি।

কাছাকাছির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্রতীর কোথায়?

পুরুষোত্তমে, লোকে যাকে বলে পুরী, কৃষ্ণ যেখানে পুরুষোত্তম জগন্নাথরূপে অধিন করছেন, সেখানে। পুরীর চেয়ে চোখজুড়োনো সমুদ্রসৈকত কাছাকাছি কোথাও নেই। কূলকিনারাহীন সমুদ্র, ঘন নীল জল, আকাশছোঁয়া ঢেউ, নাদব্রহ্মের একটানা ওঠাপড়া, ঝাউবন।

আহা!

চোখ বুজে তন্ময় হয়ে নিতাই-এর বর্ণনা শোনার মধ্যে গোরা বলল, পুরীকে ‘নীলাচল’বলা যায়, কী বলো তুমি?

‘নীলাচল’ শব্দটা মধু ঢেলে দিল নিতাই-এর কানে। চোখে না দেখে সমুদ্রতীরের এক তীর্থস্থানকে এরকম হৃদয়হরণকারী নাম দেওয়া যায়, নিতাই-এর ধারণা ছিল না। বলল, বলিহারি! তোমার মুখের কথা খসলে মনে হয়, অমৃত ঝরছে। পুরুষোত্তমের পায়ের কাছেই নীলগিরি, উৎকলের পাহাড়ি এলাকা। নীল পাহাড়, নীল সমুদ্র আর নীল আকাশ মিলে তৈরি পুরীধামের নাম নীলাচল ছাড়া আর কীইবা হতে পারে? তোমার দেওয়া এই নাম গৌড় বাঙ্গালার মানুষের মুখে মুখে রটে যাবে। চিরকাল তারা মনে রাখবে। জগন্নাথদেবের সঙ্গে সমুদ্র দর্শন করতে তারা পুরী ছুটবে।

আমাকে একবার নীলাচলে নিয়ে চলো। যাব।

যেদিন বলবে, তোমার সঙ্গী হব।

গদাধর বলল, তোমাদের সঙ্গে আমিও যাব।

গোরা বলল, আমি এখনই সমুদ্রের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। জনসমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দে মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের আওয়াজ।

কাল বাদে পরশু অষ্টাহ অনুষ্ঠান শুরুর আগে গোরা কেন সমুদ্রের কথা পেড়ে বিহ্বল হল, নিতাই কিছুটা অনুমান করলেও গদাধর জানালো সমুদ্রে ঢেউ ভেঙে পড়ার আওয়াজ সে-ও শুনতে পাচ্ছে। সবাই যখন চুপ হয়ে গেছে, গদাধর বলল, নাগরিয়া ঘাটের দক্ষিণে নতুন একটা গঙ্গার ঘাট বানাচ্ছে মাধাই। দু’ভাই মিলে দিচ্ছে ঘাট তৈরির খরচ। ঘাট তৈরি শেষ হওয়ার আগে আজই দেখলাম, সামনের পথটা ঝাঁটা হাতে জগাই নিজে সাফ করছে। বেশ ভিড় হয়েছিল ঘাট বানানোর কাজ দেখতে। ভিড়ের থেকে দু’-একজন ঝাঁটা জোগাড় করে জগাই-এর সঙ্গে সাফাই করতে লেগে গিয়েছিল।

গোরা বলল, কৃষ্ণনাম জপের সঙ্গে চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা বৈষ্ণবধর্ম। জগাই মাধাই বৈষ্ণবধর্ম মেনে কাজ করছে। গঙ্গার ধারে যত স্নানের ঘাট, মন্দির, দেউল, পায়ে হাঁটা পথ আছে এখন থেকে সপ্তায় একদিন ঝাঁটা হাতে আমরা সাফাই করব।

নিতাই বলল, যেখানে ভক্তি, সেখানে সঙ্কীর্তন, সেখানে পরিচ্ছন্নতা।

স্নেহের হাসি জাগল গোরার মুখে। নিতাইকে বলল, তোমার সুকৃতির জোরে জগাই মাধাই নতুন জীবন পেল, তারা আরও জনহিতৈষী হয়ে উঠবে, ভক্তির স্রোতে ভাসিয়ে দেবে নবদ্বীপ। কাজির কাছারি ছুঁয়ে ফেলবে।

নিতাই টের পেয়েছিল তিনদিনের মহোৎসব ঢুকলে আরও বড় এক উৎসবের আয়োজন শুরু হবে। দু’দিন পরে শ্রীবাসের বাড়ির আঙিনায় সূর্যোদয়ের মুহূর্তে শুরু হল সাতপ্রহরিয়া সঙ্কীর্তন মহোৎসব। প্রথম দিনেই নবদ্বীপ, ফুলিয়া, শান্তিপুর, শ্রীখণ্ড, কুলিয়া থেকে নানা প্রহরে দলে দলে আসতে থাকল বৈষ্ণবভক্তরা। তাদের অনেকে বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয় কীর্তনীয়া। মৃদঙ্গ, মন্দিরা, করতাল বাঁশিবাদকরাও সংখ্যায় কম নয়। সবাই নাচ, গান, বাজনাতে চৌখস। প্রত্যেক সম্প্রদায়ে একজন নর্তক, একজন মূল গায়েন। পাঁচজন পালি গায়েন, অর্থাৎ দোহার আর দু’জন মাদলবাদক। প্রধান চার সম্প্রদায়ে নর্তক ছিল অদ্বৈত, নিত্যানন্দ, হরিদাস ঠাকুর আর বজ্রেশ্বর পণ্ডিত। এদের সঙ্গে মূল গায়েন ছিল স্বরূপ দামোদর, শ্রীবাস, মুকুন্দ দত্ত আর গোবিন্দ ঘোষ। কুলীনগ্রাম, শান্তিপুর, শ্রীখণ্ডের নর্তক ছিল রামানন্দ বসু, শান্তিপুরের নর্ত’ক অদ্বৈতের বড় ছেলে অচ্যুতানন্দ, শ্রীখণ্ড থেকে ছিল নরহরি সরকার, আর তার ভাইপো রঘুনন্দন। ভেবেচিন্তে দল গড়ে সাতপ্রহরিয়া পালাকীর্তন সাজানো হয়েছিল। উচ্চাঙ্গ রাগসঙ্গীতের ধাঁচে তৈরি মনোহরসাহী ঠাটের কীর্তন গাইয়েরা ছিল শ্রীখণ্ড সম্প্রদায়ভুক্ত। শ্রীখণ্ডের গায়কীর চেয়ে পুরনো গরাণহাটি ঠাটের কীর্তন ছিল কুলীনগ্রাম ঘরানার গায়কীর বিশিষ্টতা। কুলীনগ্রামের কীর্তনীয়ারা ছিল এই ঠাটে ওস্তাদ। গরাণহাটি ঠাটের কীর্তনের গায়নপদ্ধতিতের উঁচুমানের নৈপুণ্যের দরকার ছিল। মহোৎসবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল মনোহরসাহী ঠাটের কীর্তনীয়াদের। শুরু থেকে তারা সঙ্কীর্তনের আসর জমিয়ে দিল। কৃষ্ণলীলা কীর্তনের মধ্যে ‘কথা’ ‘আখর’ ‘তুক’ ‘ছুট’ যোজনা করে কখনও শ্রোতাদের চোখে জল আনল, কখনও জাগিয়ে তুলল কৌতুকের ভাব। ভক্তির সঙ্গে কীর্তনের কাব্যময়তা, রাগরাগিণী, সুরের কুহকে আসর ভেসে গেল।

মহোৎসবের প্রথম দিনের দুপুর থেকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি, কোনও বছরে এক-দু’বার কালবৈশাখীর ঝড় ওঠার আগে মেঘে কালো হয়ে যায় আকাশ। ঝড় আসে সন্ধের আগে। তুমুল ঝড়ে অনেক সময় মাঠ থেকে মানুষকে পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যায়। গঙ্গা থেকে একবার একটা খালি ডিঙি নৌকো উড়ে এসে রামচন্দ্রপুরে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ির সামনে পড়েছিল। ঝড়ের দাপটে কিছু ঘরবাড়ি, ছোট বড় অনেক গাছ ভেঙে পড়ে। আধঘণ্টা থেকে দু’দণ্ড দাপাদাপি করে ঝড় চলে গেলে প্রকৃতি জুড়ে বসন্তের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। আবহাওয়া জুড়িয়ে যায়। ঝড়ের ধাক্কায় সঙ্কীর্তনের মণ্ডপ যাতে না ভেঙে পড়ে, সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সেই কাজে হাত লাগাল শ্রীবাসের ভাই শ্রীপতি। বিষ্ণুমন্দিরের আঙিনায়, বাড়ির ভেতরে, উঠোনে, যেখানে যেমন মহোৎসবের উপকরণ ছড়ানো ছিল, সব গুছিয়ে রাখা হল। ঝড়ের মধ্যে ঘর ছেড়ে কেউ না বেরোয়, আত্মীয়, অতিথিদের সতর্ক করে দিল শ্রীপতি। সঙ্কীর্তনের আসর নাচে, গানে, ভাবাবেশে মাতোয়ারা হয়ে থাকল। সাবধানীরা অনেকে ঝড় ওঠার আগেই বাড়ি ফিরে যেতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেও মালসাভোগ নিতে ভোগের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

প্রায় মাঝরাতে স্নান সেরে গৃহদেবতার পুজোর জোগাড়ের সঙ্গে মহোৎসবের প্রথম প্রাতঃকালীন আসর সাজাতে নারায়ণী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পূর্ণগর্ভা মালিনীখুড়ি শেষরাতে গভীর ঘুমে ডুবে রয়েছে। নারায়ণীর সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে ঘুম থেকে তাকে তুলে দিতে সে বলে রাখলেও নারায়ণী জাগায়নি তাকে। কাকির শরীরের খবর সংসারে তার চেয়ে বেশি কেউ রাখে না। সংসারের হাল ধরে আছে মালিনী। হেঁসেল, ভাঁড়ার সামলানোর ধকলে সারাদিন দম ফেলার সময় পায় না। বাড়ির সবাই ঘুমোলে শুতে যাওয়ার সময় হয় তার। কাকভোরে রান্নাঘরে চুলো ধরায় মালিনীখুড়ির মা। শেষ দুপুরে উনুন নিভে গেলে তবেই সেখান থেকে উঠতে পারে। তিন খুড়িমাও রান্নার কাজে দিদিমাকে সাহায্য করে। কুটনো কোটা, মশলা বাটা থেকে শুরু করে হাঁড়ি, কড়া, হাতা খুন্তি গঙ্গাজলে ধুয়ে দিদিমাকে এগিয়ে দেয়। কাঠের উনুনের তাপ সয়ে সারাক্ষণ কিন্তু রাঁধতে হয় দিদিমাকে। দিদিমার হাতের রান্না ছাড়া ভাত, ডাল, তরকারিতে মেজকাকার রুচি হয় না। জামাই-এর জন্যে দিদিমাও প্রাণ ঢেলে রান্না করে। মেজকাকার দেখাদেখি তার তিন ভাইও দাদার শাশুড়ির হাতের রান্না ভাত তরকারি না পেলে আধপেটা খেয়ে উঠে যায়। আদরের ভাইদের পাশাপাশি খেতে বসে মেজকাকা ঘটনাটা নজর করে বুড়ি শাশুড়িকে ঠিক কবে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিল, নারায়ণী জানে না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে দিদিমাকে রাঁধতে দেখেছে। সেইসঙ্গে শুনেছে, খাওয়া শেষ করে মেজকাকা সমেত তিনকাকাকে তৃপ্তিতে ঢেঁকুর তুলতে। নিজের শাশুড়ির রান্নার প্রশংসা মেজকাকা নিজের মুখে না করলেও তার তিনভাই সে কাজ করেছে। তারা ধন্য ধন্য করেছে দাদার শাশুড়িকে। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে তাদের বউরা, অন্য আত্মীয়স্বজন। বুড়ি দিদিমা খুশিতে গলে গিয়ে জামাই আর তার ভাইদের খাওয়াতে আর বেশি যত্ন নিয়ে হাতা, খুন্তি নেড়েছে।

মানুষ হিসেবে মেজকাকা শ্রীবাস পণ্ডিতের জুড়ি নেই, নারায়ণী জানে। স্নেহে যেমন অকাতর, তেমনই রগচটা। প্রথম জীবনে মানুষটা ছিল নাস্তিক। বিত্তসম্পত্তি বাড়ানো ছাড়া আর কিছু বুঝত না। বিষয়আশয় কম বানায়নি। তার মধ্যে মানুষটার মনে হঠাৎ কীভাবে মৃত্যুভয় ঢুকল, কেউ জানে না। মৃত্যুভয়ে ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে থাকল। পরিবারের মানুষেরা ভয় পেয়ে বাড়িতে শান্তিস্বস্ত্যয়ন, পূজাপাঠ শুরু করে দিল। কবচ, তাবিজ ধারণ করে মৃত্যুভয় থেকে রেহাই পেতে চাইল শ্রীবাস। উপকার কিছু হল না। মৃত্যুভয়যাত্রী শ্রীবাসকে এক পূর্ণিমার সন্ধেতে প্রায় জোর করে জগন্নাথ মিশ্র ধরে নিয়ে গেল ভাগবদ পাঠের আসরে। ভাগবদ পাঠ, ব্যাখ্যাতে নবদ্বীপে তখন দেবানন্দ পণ্ডিতের খ্যাতি তুঙ্গে। নবদ্বীপের রাজবাড়ির দোতলার চালাতে সেই সন্ধেতে ভাগবদের প্রহ্লাদচরিত্র পাঠ আর ব্যাখ্যাতে দেবানন্দ পণ্ডিত এমন এক অলৌকিক পরিবেশ তৈরি করেছিল, যা শুনে কঠিন মনের শ্রোতা পর্যন্ত কেঁদে আকুল হয়েছিল। কান্নার আবেগে, হয়তো মনের ভেতরে কোনও বেদনায় আসর ছেড়ে শ্রীবাস কখন উঠে গেছে, জগন্নাথ জানতে পারেনি। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে ছিল আকাশে। শ্রোতাদের সঙ্গে অভিভূতের মতো জগন্নাথ শুনছিল দৈত্যকুলে ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনী। ছোটভাই-এর মতো প্রতিবেশী বন্ধু, শ্রীবাস কখন পাশ থেকে উঠে গেছে খেয়াল করেনি। প্রহ্লাদকাহিনী পাঠ শেষ হওয়ার আগের মুহূর্তে দোতলা চাতালের নিচে মন্দিরের ঠাকুরদালানে ভারি কিছু পড়ার আওয়াজে চুপ হয়ে গেল দেবানন্দ পণ্ডিত। তখনই ঠাকুরদালানে কয়েকজন হৈ চৈ শুরু করল। চোখের জল মুছে জগন্নাথ সজাগ হয়ে দেখল, পাশে শ্রীবাস নেই। তার বুক ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। মৃত্যুভয়ে অসুস্থ, শ্রীবাসের কোনও বিপদ ঘটেছে অনুমান করে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল সে। ভাগবদ পাঠের আসর ছেড়ে অনেকে তখন নিচের দালানে পৌঁছে গেছে। সেজবাতির আলোয় দালানে শ্রীবাসের বেহুঁশ শরীরটা দেখে ভয়ে ধড়ফড় করতে থাকল জগন্নাথের বুক। শ্রীবাস বেঁচে আছে তো’ প্রশ্নটা মাথায় জাগতে তার শরীর অসাড় হয়ে গেল।

কে একজন বলল, ‘রামচন্দ্রপুরের শ্রীবাস!’

দোতলার পাঁচিল টপকে নিচের দালানে পড়ল কীভাবে?

কেউ একজন প্রশ্ন করতে শ্রীবাসকে ভালো করে দেখে দেবানন্দ পণ্ডিত বলল, মানুষটা বেঁচে আছেন। শরীর থেকে রক্ত ঝরেনি। মনে হচ্ছে, মাথায় চোট লাগেনি। মানুষটা হুঁশ ফেরাতে আগে বৈদ্যের কাছে নিয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে, জানতে পারবেন, কীভাবে পড়ে গেলেন।

মুরারির চিকিৎসায় মাঝরাতে শ্রীবাসের জ্ঞান ফিরেছিল। লোকজন জুটিয়ে রাজবাড়ির ঠাকুরদালান থেকে শ্রীবাসকে মুরারির কাছে জগন্নাথ নিয়ে গিয়েছিল। মূর্ছিত শ্রীবাসকে দেখে তার বাড়িতে কান্নাকাটি লেগে গিয়েছিল। তার বিছানার পাশে হুঁশ না ফেরা পর্যন্ত জগন্নাথ ছিল। জ্ঞান ফেরার কয়েকদিন পরে, স্বাভাবিক জীবনে শ্রীবাস সংসারধর্ম শুরু করলে সবাই দেখল তার মৃত্যুভয় কেটে গেছে। বিষয়আশয়ের চেয়ে ধীরে ধীরে ধর্মে মতি বসছে। সবচেয়ে নজর করার মতো ঘটনা হল, রোজ সন্ধের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভাগবদ পড়তে শুরু করেছে। ভাগবদ খুলে বসলে জলে ভিজে উঠছে দু’চোখ। অসুস্থ জামাইকে তখন কাটোয়া থেকে দেখতে এসে বিধবা শাশুড়ি সেই যে মেয়ের সংসারে ঢুকল, আর বেরতে পারেনি। শ্রীবাস আটকে দিল শাশুড়িকে। বলল, শাশুড়ির হাতের রান্না না খেলে সে আবার বেহুঁশ হয়ে যাবে। মেয়ের সংসারে তার মাকে ধরে রাখতে মোক্ষম যে চালটা দিল, তা ছিল নিজের বাড়ির বারদালানে শাশুড়ির ইষ্টদেবতার মন্দির গড়ে সেখানে বিষ্ণুর ষড়ভুজ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করল। শ্রীবাসও ইতিমধ্যে বৈষ্ণব হয়ে গিয়েছিল। তার বাড়ি ক্রমশ নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের শ্রীপাট হয়ে উঠতে থাকল।

পরিবারে যখন এসব ঘটনা ঘটছে, নারায়ণী তখন কোলের শিশু। পার্থিব কিছু বোঝার মতো বয়স তার হয়নি। মালিনীখুড়ি আর তার মা, যাকে সে দিদিমা বলে, তাদের মুখে এতসব বৃত্তান্ত শুনলেও বিষয়াসক্ত নাস্তিক মেজকাকার মনে কেন মৃত্যুভয় ঢুকেছিল, আজও সে জানে না। মালিনীখুড়িকে কখনও জিজ্ঞেস করেনি। খুড়ি কি জানে? প্রশ্নটা মাথায় এসে সেখানেই মিলিয়ে গেছে। সঙ্কীর্তনের আসরে গোরা ঢুকে পড়তে কীর্তনীয়ারা উদ্দীপ্ত হয়ে হরিধ্বনি তুলে আখর দিল। সজাগ হল নারায়ণী। ঝড় ওঠার আগে বিষ্ণুর সন্ধ্যারতি সেরে রাতের মতো তাকে শয্যায় তুলে দিতে হবে। মহোৎসবের তিনদিন সকাল থেকে রাতে বিগ্রহের শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত নিত্যপূজার পুরোহিতের শ্রীবাসের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। পুরোহিতও বৈষ্ণব, যজমান বাড়িতে পূজার্চনা তার বৃত্তি। নারায়ণীকে সে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করে। তার নিষ্ঠা, ভক্তি দেখে যেমন আপ্লুত হয়, তেমনই সুন্দরী এই বিধবা তরুণীর দুর্ভাগ্যে কষ্ট পায়। বালবিধবার পরমায়ু আবার এয়োস্ত্রীদের চেয়ে লম্বা হয়। দীর্ঘ কাল কষ্ট পেতেই বোধহয় দীর্ঘজীবন লাভ করে। বিষ্ণুপুজোর আসনে বসে মন্ত্র পড়ার সঙ্গে শ্রীবাসের গৃহদেবতার কাছে নারায়ণীর কল্যাণ কামনা করে পুরোহিত। আকাশে মেঘ ঘন হওয়ার সঙ্গে পুরোহিতও সন্ধ্যারতি শুরু করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সঙ্কীর্তনের আসরে মধুর রসের পালাগানের সঙ্গে গোরা নাচছে। তাকে ঘিরে শ্রীখণ্ড সম্প্রদায়কে নিয়ে নাচছে নরহরি। গোরার দু’পাশে দাঁড়িয়ে গেছে গদাধর আর নিতাই। নাচের মধ্যে গোরা আগে কতবার যে পড়ে যেত, হিসেব নেই।, নাচ গান বাজনার লহরীতে বেহুঁশ হয়ে যেত। জলের স্রোত নামত দু’চোখ থেকে। রোজ-ই তেমন ঘটে। তবে কয়েকমাস ধরে সঙ্গীরা এমনভাবে ঘিরে রাখছে তাকে, যে নাচের মধ্যে জ্ঞান হারালেও সে মাটিতে পড়ছে না। সঙ্গীরা আগেই ধরে ফেলছে তাকে। অপলকে গোরাকে দেখছে নারায়ণী। তার সামনে পাথরের বিগ্রহ। পেছনে তারই অবতার, রক্তমাংসের মানুষ গোরা। পাথরের বিগ্রহের সামনে সেজবাতির আলো। পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে আরতির আয়োজন করছে পুরোহিত। পাথরের বিগ্রহে প্রদীপের আলো পড়ে কাঁপছে বিষ্ণুর ছ’টা হাত, বুক, এমনকি ঠোঁট দুটোও নড়ে উঠছে। পুরোহিত আরতি শুরু করতে সঙ্কীর্তন আসরের দিকে তাকাল নারায়ণী। বেহুঁশ গোরাকে নিতাই, গদাধর ধরাধরি করে জাজিমে শুইয়ে দিচ্ছে। দরদর ঘামে গোরার কপালের চন্দনের তিলক ধেবড়ে গেছে, নাক বরাবর নেমে এসেছে চন্দনের রেখা। নারায়ণীর মনে হল চাঁদের শরীর থেকে চন্দন গড়িয়ে পড়ছে। গোরাকে দেখে তার সাধ মিটছিল না। ভোগের ঘর সামলাতে একটু আগে নারায়ণীর পাশ থেকে মালিনী উঠে গেছে। রাত থাকতে তাকে ঘুম থেকে নারায়ণী না জাগানোতে দুপুর পর্যন্ত চটে থাকলেও ক্রমশ তার রাগ পড়ে গেছে। ভারী শরীর নিয়ে সংসারের সঙ্গে মহোৎসবের যাবতীয় কাজে জড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে। তিন জা, ননদ, মেয়েদের নিয়ে ভোগের দই, চিঁড়ে, কলা, মুড়কি, বাতাসা প্রতিটা মালসা আর সরাতে আলাদা করে রেখেছে। বাড়িতে যারা পাত পেড়ে খাবে, তাদের জন্য আলাদা রান্না হচ্ছে। সেখানেও দেখভাল করছে মালিনী। মাঝদুপুরে বিষ্ণুসেবা থেকে নারায়ণীকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে খেতে বসিয়েছিল। নারায়ণী জানে, এই সংসারে তার মাথার ওপরে ছাতার মতো রয়েছে মালিনী। ঝড়, দুর্যোগে মালিনীখুড়ি বাঁচাবে তাকে। মালিনী পাশে থাকলে অসুবিধে একটাই, গোরার দিকে তাকানোর উপায় থাকে না। অবধূত নিতাই-এর মুখ থেকে প্রথম দিনে পুত্রবতী হওয়ার আশীর্বাদ শুনে নারায়ণী যতটা চমকে গিয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকেছিল, ততটা ভয় পেয়েছিল দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখ এই সাধুকে। ভয় এখন অনেকটা কেটে গেছে। মানুষটা যে শিশুর মতো সরল, উদার আর প্রকৃত জ্ঞানী, এ নিয়ে তার সন্দেহ নেই। মালিনীর মুখ থেকে নিতাই-এর জীবনের নানা গল্প শুনে তার সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মানুষটা নিরীহ, তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, বুঝে গেছে।

সকাল থেকে নারায়ণীর বাঁ চোখের পাতা কাঁপছিল, মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল অচেনা খুশি। মেয়েদের বাঁ চোখ, শরীরের বাঁদিকের কোনও অঙ্গ কাঁপলে, তা শুভলক্ষণ, নারায়ণী জানে। চোখের পাতা কাঁপার সঙ্গে তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল সুখের অনুভূতি। দুপুরের পর থেকে সে টের পেল বাঁ কাঁধের একটা শিরা কেঁপে উঠছে। কাঁধ থেকে কাঁপুনির জের হাতের পাতায় নেমে আসছে। বিষ্ণুমূর্তির মুখে অস্পষ্ট হাসি জেগে রয়েছে। পাথরের বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে নারায়ণী নিঃশব্দে জিজ্ঞেস করল, আমার মতো হতভাগিনীর শরীরে এই শুভলক্ষণ জাগছে কেন? আমার জন্যে কোন সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে?

পাথরের দেবতা জবাব না দিলেও নারায়ণীর মনে হল, মহোৎসবের তিনটে দিন তার ভালো কাটবে। আনন্দে ভরে যাবে মন। শরীরে শুভলক্ষণ জাগলে তার কিছু সুফল অবশ্য‍ই পাওয়া যায়। সে-ও পাবে। তখনই ঝড় উঠল। ধীরে ধীরে হাওয়া বইতে শুরু করলেও দূরের খোলা মাঠ, প্রান্তর, গঙ্গার ঘাট থেকে বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজে বোঝা যাচ্ছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঝড় আসছে। মহোৎসবের মণ্ডপ উড়ে যেতে পারে। সঙ্কীর্তনের আসরে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। কুলীনগ্রামের সম্প্রদায়, নিজেদের বাদ্যযন্ত্রের আড়ম্বর, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, করতালের সঙ্গে ঝাঁজ, রুদ্রবীণা, পাখোয়াজ, রবাব, চন্দ্রতারা, খণ্ডরী, সপ্তস্বর বাজিয়ে আসর মাতিয়ে তুলেছে। ঝড়ের আওয়াজ ঢাকা পড়ে গেছে সঙ্কীর্তনের ঐকতানে। সেজবাতির আলোয় শিখাগুলো হাওয়ায় নিভু নিভু হয়ে ফের জেগে উঠছে। বাতাসের ঝাপটা এড়িয়ে আরতি শেষ করতে জ্বলন্ত প্রদীপদান হাতে মূর্তির সামনে পুরোহিত কয়েক পা এগিয়ে গেছে। আরতি শেষ হওয়ার আগের মুহূর্তে দৈত্যের মতো এসে গেল সেই ঝড়। সঙ্কীর্তন থেমে গেলেও কয়েকটা শাঁখ, কাঁসর, ঘণ্টা, মাদল বেজে উঠল। ঝড়ের সঙ্গে শাঁখ, কাঁসরের আওয়াজ মিশে সমুদ্রে ঢেউ ভেঙে পড়ার গুমগুম ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে। থরথর করে কাঁপতে থাকল মণ্ডপ। মণ্ডপের চারপাশের চাদর, মাথার ওপরের সামিয়ানা ঝড় আসার আগে খুলে ফেলা হয়েছিল। মণ্ডপের খাঁচাটা শুধু দাঁড়িয়েছিল। ঝড় কেটে গেলে আগের মতো মণ্ডপ সাজাতে বেশি সময় লাগবে না। চেনা ঝড়। ফি-বছরে এইসময়ে, এক, দু’বার এরকম ঝড় ওঠে। ঝড়ের তাণ্ডব সামলাতে মানুষ তৈরি থাকে। ভাঙচুর সামলে নেয়। মণ্ডপের খাঁচা ভেঙে পড়ার ভয়ে কীর্তনীয়া আর শ্রোতাদের অনেকে মন্দিরের চাতালে এসে দাঁড়িয়েছে। আসর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে অনেক মানুষ। অন্ধকার নেমেছে পৃথিবীতে। মন্দিরের মধ্যে ত্রিপদিকাতে মিটমিট করে যে প্রদীপ জ্বলছে, সেটা যে কোনও মুহূর্তে হাওয়ায় নিভে যেতে পারে। মন্দিরের মধ্যে বিষ্ণুর খাটে এসে বসেছে গোরা। নিতাই দাঁড়িয়েছে তার পাশে। দু’জনের মুখেই প্রদীপের আলো পড়েছে। ঘোমটার আড়াল থেকে তাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে নারয়ণী চোখ ঘুরিয়ে নিল। গদাধরের গলা শুনতে পেল নারায়ণী। গদাধর বলল, আকাশের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। তখনই বিদ্যুৎ চমকাল আকাশে।

মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ কানে আসার পরের মুহূর্তে চারপাশ কাঁপিয়ে বাজ পড়ল বিষ্ণুমন্দিরের চাতালে উপচে পড়ছে ভিড়। মন্দিরের পেছনে মড় মড় করে ভেঙে পড়ল একটা বড় গাছ। ভয় পাওয়া পাখিদের চেঁচামেচির মধ্যে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। অন্ধকার চাতালে নিভে যাওয়া দুটো সেজবাতি জ্বলে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে আবার শুরু হল সঙ্কীর্তন। সকালে রোদে ঝলমল দিনটা শেষ বিকেলে এমন দুর্যোগ আনবে কেউ ভাবেনি। শ্রোতাদের ভিড় হালকা হয়ে গেলেও দূরদূরান্ত থেকে যারা সঙ্কীর্তন করতে এসেছিল, তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ল না। জলে ভিজলেও আসর ছেড়ে গেল না কেউ। মৃদঙ্গ, মন্দিরা, পাখোয়াজ আর অন্য বাজনাগুলো শুধু মন্দিরের ভেতরে চাপাচুপি দিয়ে রাখল। রাত বাড়ছিল। বিষ্ণু বিগ্রহকে শয্যায় শোয়ানোর সময় হলেও সে বিছানায় গোরা বসে রয়েছে। নারায়ণী কী করবে ভেবে না পেয়ে অসহায়ের মতো পুরোহিতের দিকে তাকাল। গোরাকে ঘিরে রয়েছে ভক্তের দল। বিষ্ণুর বিছানার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা আলোকিত মেঘের মতো অন্ধকারে গোরার দিকে তাকিয়ে নারায়ণীর মনে হল, গৃহদেবতার বিগ্রহ রক্তমাংসের শরীরে খাটের ওপরে বসে রয়েছে। নারায়ণীর মনে হল তার আরাধ্য দেবতা আর তার গোপন ভালবাসা একাকার হয়ে গেছে। একজন মানুষ হয়ে গেছে ভগবান। নবদ্বীপ ভাসিয়ে দিয়েছে সে। যতদূর চোখ যায় সে ভাসিয়ে দেবে। পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে। পৃথিবীর সব মানুষ দেবতার মতো পবিত্র, গুণবান হয়ে উঠবে।

বাইরের ঝড়বৃষ্টি নারায়ণীর বুকের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। তার এলোখোঁপা খুলে কালো চুলের ঢল বন্যার মতো পিঠে ছড়িয়ে গেলেও ঘোমটা সরিয়ে খোঁপা বাঁধল না। মনে মনে বলল, হে আমার দেবতা, হে প্রিয়তম, আমার ফুয়ল খোঁপা খুলে আমি এলো করে দিলাম আমার চুল, আমার পাপ চিন্তা থেকে আমাকে রেহাই দাও। আমি যে কত পাপ করেছি, কত ময়লা আমার গায়ে লেগে আছে, তার হিসেব নেই। রোজ রাতে সেই পাপ ফিরে আসে আমার কাছে, আমাকে দগ্ধাতে থাকে, চাঁদ নেই, সূর্য নেই, সেখানে শুধু দাউ দাউ আগুন আর পাপ। আমার চোখের জলে তোমার দু’পা ধুয়ে দিয়ে পা দুটো এলোচুলে মুছে দিতে চাই।

নারায়ণীর দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে দেখে পুরোহিত জিজ্ঞেস করল, মা, তোমার কি কোনও কষ্ট হচ্ছে?

তাড়াতাড়ি আঁচলে চোখ মুছে নারায়ণী আবছা হাসল। গোরাকে মহোৎসবের তিনরাত বিষ্ণুশয্যায় ঘুমোতে অদ্বৈত, শ্রীবাস চাপ দিচ্ছে। বিষ্ণুর খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নারায়ণীর কাছে এসে দাঁড়াল গোরা। বলল, বিগ্রহকে শয্যায় শুইয়ে দাও।

গোরার গলা শুনে নারায়ণীর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। তার মনে হল, কিছুক্ষণ আগে তার মনের মধ্যে যে আকুলতা জেগেছিল, গোরা জেনে গেছে। ঘোমটার আড়াল থেকে এলোচুল বুকের ওপর এসে পড়লেও ভক্তজনের সামনে তার খোঁপা বাঁধার সুযোগ নেই। থানের ওপর জড়ানো ভুনিফোতাটা শরীরের দু’পাশে সামান্য টেনে দিল সে। দু’হাতে বিগ্রহ উঠিয়ে সযত্নে বিছানায় শুইয়ে দিল সে। মশা ঠেকাতে টাঙিয়ে দিল নেটের ঝালর লাগানো রেশমের চতুষ্কী। বিষ্ণুসেবার কাজ নারায়ণী শেষ করতে তাকে গোরা বলল, আমাকে প্রসাদ দাও, খিদে পেয়েছে আমার।

স্বয়ং ভগবান নারায়ণীর কাছে ভোগ খেতে চাইতে ভক্তদের মনে আনন্দের ঢেউ উঠল। সঙ্কীর্তনের আসরে সে খবর পৌঁছে যেতে গায়কদের কণ্ঠ জোরালো হল। ঝড়, বৃষ্টির কামাই নেই। গোরা ভোগ চাইতে নারায়ণীর শরীরে শিহরন খেলে গেছে। গৃহদেবতাকে যে থালা বাটিতে ভোগ সাজিয়ে দেওয়া হয়, শ্রীবাস সেগুলো তাড়াতাড়ি মেজে, ধুয়ে আনার ব্যবস্থা করল। গোরা ভোগ খাবে শুনে ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে মালিনীর সঙ্গে বাড়ির বউ-মেয়েরা মন্দিরে এসে গেছে। মন্দিরের ভেতরে ষোড়শোপচারে ভোগ সাজিয়ে একান্তে আসন পেতে গোরাকে খেতে দিল নারায়ণী। থালার চারপাশে তরকারি, পায়েস, মিষ্টির বাটি সাজিয়ে রাখল মালিনী। গোরার আসনের পাশে এখন দু’জন, মালিনী আর নারায়ণী। বাড়ির মানুষজন মন্দিরের ভেতরে দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছে। তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়েছে নিতাই, অদ্বৈত, শ্রীবাস প্রমুখ ভক্তদের সঙ্গে আরও অনেকে। গোরার প্রসাদ পেতে অনন্তকাল তারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ঘি-ভাতে শাকচচ্চড়ি মুখে কয়েক গ্রাস খেয়ে নারায়ণীর রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করল গোরা। মালিনীর বানানো লাউ-এর পায়েস খেয়ে বলল, তোমার হাতের ছোঁয়া লাগা পায়েস খেলে পরমায়ু বেড়ে যায়।

গোরাকে যতটা ক্ষুধার্ত মনে হয়েছিল, সে ততটা খেল না। অর্ধেকের বেশি ভাত তরকারি পায়েস পিঠে মিষ্টি পাতে রেখে চষক ভর্তি জল ঢকঢক করে খেয়ে পরিতৃপ্তির আওয়াজ করে আসনে উঠে দাঁড়াল। পাত পেড়ে খেতে বসলে এরকম করে সে। বাড়িতে তার পাতের বাড়তি খাবারের জন্যে বিষ্ণুপ্রিয়া বসে থাকে, বাইরে কারও বাড়িতে সে আতিথ্য ভিক্ষা করলে তার প্রসাদ পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে ভক্তরা। মহোৎসবের প্রথম সন্ধেতে দুর্যোগের মধ্যেও তার প্রসাদ জন্যে হা-পিত্যেশ করে বেশ কিছু ভক্ত বসেছিল। তাদের দিকে না তাকিয়ে নারায়ণীকে ডেকে নিজের আসনে খেতে বসিয়ে দিল গোরা। অদ্বৈত, শ্রীবাস, নিতাই, গদাধর, মুরারি, হরিদাস, নরহরি প্রমুখ ভক্তরা গোরার কাণ্ড দেখে কথা হারিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। লজ্জায়, ভয়ে নারায়ণীর পেটের মধ্যে হাত-পা সেঁধিয়ে যাওয়ার অবস্থা হল। গোরার ছেড়ে যাওয়া আসনের ওপর পা ছোঁয়াতে সাহস পেল না। গোরা বলল, নারায়ণী আসনে বসো, খেয়ে নাও।

নারায়ণী ভয়ে ভয়ে তাকাল মালিনীর দিকে। মালিনী চোখ রাখল শ্রীবাসের চোখে। নারায়ণীকে খেতে বসতে বলল শ্রীবাস। গৃহদেবতার আসন সরিয়ে সেখানে নারায়ণীকে বসতে তালপাতার আসন পেতে দিল মালিনী। গোরার পাতে সসঙ্কোচে গুটিসুটি মেরে নারায়ণী বসতে ভক্তেরা আনন্দে হরিধ্বনি করে উঠল। নারায়ণীকে পরম সৌভাগ্যবতী মনে হল তাদের। পঞ্চাশজন ভক্ত যে প্রসাদ ভাগাভাগি করে খেতে পেলে এই জীবনের সব পাপ তাপ মুক্ত হয়ে মৃত্যুর পরে স্বর্গে পৌঁছে যেত, কৃষ্ণাবতারের সেই ভুক্তাবশেষ একা নারায়ণীর মিলেছে। গোরার প্রসাদ খেতে বসে বাঁ চোখ, হাতের পাতা পর্যন্ত বাঁ পিঠ কেন কাঁপছে, নারায়ণী টের পেল। মহোৎসবের সন্ধেতে তার কাছে গোরা গৃহদেবতার ভোগ খেতে চাইবে, অর্ধেক খেয়ে বাকিটা তাকে খেতে বলবে, নারায়ণী কখনও কল্পনা করেনি। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ভিজে মাটির গন্ধের মধ্যে ফুলের সুবাস পেল সে। ভাবল, পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে নাকি? দক্ষিণদেশের মলয় পর্বত থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় কি ভেসে আসছে চন্দনের সুগন্ধ? গোরার ভুক্তাবশেষের চারভাগের একভাগ খেয়ে নারায়ণীর পেট ভরে যেতে সে উঠে পড়ল। কুয়োর জলে হাত মুখ ধুয়ে গৃহদেবতার থালা, বাটি, চষক তুলে নিয়ে নারায়ণী যখন বাড়ির ভেতরে ধোয়াধুয়ির জন্যে নিয়ে যেতে হাত বাড়িয়েছে, তাকে থামাল গোরা। মালিনীর পানের বাটা থেকে দু’খিলি পান নিয়ে গোরা তখন চিবোচ্ছিল। নারায়ণীকে জিজ্ঞেস করল, তোর মনে পড়ে আমার চিবোনো পান একটু খাওয়ার জন্যে ছেলেবেলায় তুই কেমন বায়না ধরতিস?

কীর্তনের আসরে চেনা অচেনা মানুষের ভিড়ে গোরা প্রশ্নটা করতে নারায়ণী লজ্জা পেলেও ঠোঁট টিপে হাসল। গোরা তখন যে কাণ্ড করল, এককথায় তা অপার্থিব। চিবোনো পানের একদলা মুখ থেকে বার করে নারায়ণীর হাতে দিয়ে বলল, ঘেন্না না লাগলে খেয়ে নে।

এঁটো বাসন তুলে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে সে ফিরে যেতে চাইছিল। মূহূর্তের মধ্যে পানের দলা সে মুখে পুরে দিল। শ্রীখণ্ডের নরহরি সেই মুহূর্তে উচ্ছিষ্ট ভোগের থালা দু’হাতে তুলে নিয়ে গোরাকে বলল, তোমার প্রসাদের ভাগ চাইছে শ্রীখণ্ডের সম্প্রদায়। বিষ্ণু, তাঁর অবতার আর অবতারের প্রিয়পাত্রী নারায়ণী, তিনজনেই বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের পূজ্য, এই প্রসাদের ভাগ শ্রীখণ্ডের সম্প্রদায়ের সঙ্গে নানা অঞ্চল থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও পাবেন।

নরহরি থামতে সঙ্কীর্তনের আসরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের গায়করা একসঙ্গে হরিধ্বনি করল। নিমেষে খালি হয়ে গেল গৃহদেবতার থালাবাটিতে পড়ে থাকা বাকি ভাত-তরকারি।

জলে থৈথৈ করছে মন্দিরের বাইরে তৈরি সঙ্কীর্তনের মণ্ডপ। ঢাকা চাতালের মধ্যে চলছে সঙ্কীর্তন। ঝড়ের বেগ কমলেও বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টি ধরে এলেও থামেনি। সন্ধের আগে শ্রীবাসের আঙিনায় যে ভিড় ছিল, তা অর্ধেক হয়ে গেছে। কাছাকাছি যাদের বাড়ি, তারা বাড়ি ফিরতে পা বাড়িয়ে রয়েছে। শান্তিপুর, শ্রীখণ্ড, কুলীনগ্রাম থেকে যারা এসেছে, তিনরাত তারা কাটাবে বুদ্ধিমন্ত খান, মুকুন্দ সঞ্জয়, শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী, আরও কয়েকজন বৈষ্ণব ভক্তের বাড়িতে, সেরকম ঠিক করা আছে। তিনরাতের নানা প্রহরে যখন যে সম্প্রদায়ের সঙ্কীর্তনের পালা, তারা আসরে হাজির থাকবে। সাধারণভাবে শ্রোতা হিসেবে সাতপ্রহর জুড়ে সকলের প্রবেশ অবাধ। তবু গায়ক, বাদ্যকরদের বিশ্রাম দিতে অতিথি ভিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বৈষ্ণবসমাজে এটাই প্রথা।

রাত বাড়ছিল। সন্ধের শুরুতে দুর্যোগ শুরু হওয়ায় রাতের প্রথম, দ্বিতীয় প্রহরে কুমারহট্ট, কাঞ্চনপল্লীর যে কীর্তনদলের আসর জাগিয়ে রাখার কথা, তারা নবদ্বীপে পৌঁছতে পারেনি। সকালে মহোৎসব শুরু থেকে সন্ধের পরেও যারা সঙ্কীর্তন চালিয়ে গেছে, তাদের অনেকে ক্লান্ত। গোরা, নিতাই, অদ্বৈত, শ্রীবাস, হরিদাস, গদাধর প্রায় প্রতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্কীর্তনে থেকেছে। বয়স যাদের বেশি তারা ক্লান্ত হলেও গোরা, নিতাই, গদাধরের মতো নবীনদের সঙ্গে টেক্কা দিতে চলনবলনে সতেজ ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। লীলাকীর্তন চলার মধ্যে নানা সময়ে গোরা পাঁচবার ভাবাবেশে বেহুঁশ হয়ে গেছে, দরদর করে ঘেমেছে, তার চোখের জলে গোবরে নিকোনো মাটির উঠোন কর্দমাক্ত হয়ে গেছে, তবু সদ্য ঘুমভাঙা মানুষের মতো তরতাজা দেখাচ্ছে তাকে। আসরে যতক্ষণ গোরা থাকে, গায়ক, বাদক, শ্রোতাদের চোখ মুখ সারা শরীর থেকে উদ্দীপনা ঠিকরে পড়ে। গোরা গরহাজির থাকলে ঝিমুনি নামে আসর জুড়ে। সূর্য চন্দ্রের মতো গোরার উপস্থিতি, গোরা ক্লান্ত হয় না, গোরা নির্ভয়, গোরার ক্ষিধে পায় না, গোরা হাই তোলে না, রাগে না, কড়া কথা বলে না. স্নেহ, মায়া, মমতা, উদ্দীপনা তার সর্বাঙ্গ দিয়ে উপচে পড়ে। হবে নাই বা কেন? সে কৃষ্ণাবতার, ত্রিভুবনজয়ী সে, পৃথিবীতে নবযুগ প্রতিষ্ঠা করতে এসেছে। রাতের প্রথম প্রহরের পরে আসরে ঢুকেছে দ্বিতীয় প্রহরের সঙ্কীর্তন সম্প্রদায়। রাসলীলা সঙ্কীর্তন তারা শুরু করতে গোরাকে অনুনয় বিনয় করে অদ্বৈত, শ্রীবাস, মুরারি, মুকুন্দ বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। বাড়ির সদর পর্যন্ত গোরাকে পৌঁছে দিল গদাধর। সূর্য ওঠার আগে শ্রীবাসের আঙিনায় সে হাজির হওয়ার পর থেকে বিষ্ণুমন্দিরের চাতাল আর সঙ্কীর্তনের আসর ছেড়ে নড়তে পারেনি। ভক্তদের সবাইকে একে একে যেমন বুকে জড়িয়ে ধরে, তাদের মনে শক্তি সঞ্চার করেছে, তেমনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নেচে গেয়ে ভাবসমাধিস্থ হয়ে লোকোত্তর আবহ তৈরি করে প্রেমভক্তির মহিমা বুঝিয়ে দিয়েছে অনুগামীদের। বাইরে থেকে তাকে সকালের মতো সজীব, সপ্রতিভ দেখালেও তারও যে বিশ্রামের দরকার, বৈষ্ণবসমাজের দুই অভিভাবক অদ্বৈত, শ্রীবাসের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। আসর ছেড়ে গোরা চলে গেলেও সঙ্কীর্তনের দলে নিতাই মিশে যেতে কীর্তনীয়রা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। রাসলীলার মধুর রসে প্লাবন জাগল আসরে। সঙ্কীর্তনের মধ্যে মালসা, সরা, ভাঁড়ে, চাহিদা মতো ভোগ বিলি চলেছে। বাড়ির ভেতরে আমন্ত্রিতরা সারি দিয়ে পাত পেতে ভোগের ভাত তরকারি খেতে বসেছে। রাত গভীর হতে শ্রীবাসের বাড়ির নির্ধারিত ঘরে নিতাই ঘুমোতে গেল। অদ্বৈত আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরল নন্দন আচার্য। তার স্ত্রী, বাড়ির মেয়েরা থেকে গেল শ্রীবাসের বাড়িতে মালিনীর তত্ত্বাবধানে। বৃষ্টি থেমে গেলেও গাছপালার গা বেয়ে, পাতা থেকে, নাবাল জমির দিকে গড়িয়ে চলা জলস্রোতের আওয়াজ ভেসে আসছিল। পৃথিবী কাঁপানো ঝড় থেমে গেলেও থেকে থেকে চোরাগোপ্তা হাওয়া হুস করে এক দিগন্ত থেকে আর এক দিগন্তে ছুটে যাচ্ছিল। প্রথম দিনের মহোৎসব জমজমাট হওয়ার আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিছুটা বানচাল হয়ে গেলেও গোরার অনুগামীদের কারও আক্ষেপ ছিল না। আগামী দু’দিন মহানন্দে কাটবে, এই বিশ্বাসে তারা মশগুল হয়ে ছিল। মহোৎসব শুরুর কিছুক্ষণ পরে, দুপুরের দিকে গোরাকে একান্তে নিতাই বলেছিল, নবদ্বীপের পথে তুমি যে মানুষের জোয়ার দেখতে চাও, তার ঢেউ এই মহোৎসবের জমায়েত থেকে উঠতে শুরু হয়েছে। ঢেউ থামবে না, ক্রমশ বাড়বে, আমরা ঠিক পথে এগোচ্ছি।

নিতাই-এর কথা শুনে ভোরের আলোর মতো হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল গোরার মুখে। রাত্রিলীলায় রাতের তিনপ্রহরের পালা শেষ হতে বিষ্ণুর খাটের পাশে মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে নারায়ণী শুয়ে পড়ল। রাতের তৃতীয় প্রহরে দু’দণ্ডের বিরতির পরে শুরু হবে রাত্রিলীলার শেষ পর্ব। দুর্যোগের এই রাত অবশ্য একটু অন্যরকম। প্রাতঃলীলার আগে যাদের সঙ্কীর্তনের আসর চালানোর দায়িত্ব ছিল, তারা সকলে এসে পৌঁছয়নি। যারা এসেছে, অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করতে তারা হয়তো একটু দেরিতে তুলসিমঞ্চে প্রদীপ জ্বেলে নামগান শুরু করবে। তারপর শুরু হবে প্রাতঃলীলা। ঘুমে বুজে আসছিল নারায়ণীর দু’চোখ। সন্ধের পর থেকে সে যেন স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। তার মতো অনাথ আতুর এক বিধবাকে ভক্তদের সামনে গোরা যে মর্যাদা দিয়েছে, নিজের পাতের প্রসাদ এমনকি মুখের পান পর্যন্ত তুলে দিয়ে এত সমাদর দেখিয়েছে, যা সারাজীবনে সে পায়নি। নারায়ণীর মনে হচ্ছিল, সে শৈশবে ফিরে গেছে। বাড়ির উঠোনে, পাশের বাগানে, খিড়কির ঘাটে সমবয়সী যাদের সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে, সেখানে গোরাও রয়েছে। তার মুখে দুষ্টুমির হাসি। কাছে কোথাও বাজ পড়ল, কেঁপে উঠল মন্দিরের মেঝে। গৃহদেবতার ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। মন্দিরের পেছনে ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছে পোকামাকড়ের ডাক। সুর, লয়হীন একঘেয়ে সেই গুঞ্জনের সঙ্গে ঘুমন্ত গলার সঙ্কীর্তনের সুর মিশে যাচ্ছে। তেল ফুরিয়ে একের পর এক দীপ নিভে যেতে মন্দিরের বাইরে জমাট বাঁধছে অন্ধকার। মণ্ডপের পাশে তুলসিমঞ্চে মাটির প্রদীপটা শুধু সারারাত জ্বলবে। হাওয়ায় নিভে গেলেও কেউ জ্বালিয়ে দেবে। ঝড়বৃষ্টিতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আবহাওয়া। ঘুমে চোখ বুজে এলেও খাটের বিগ্রহের দিকে তাকাল নারায়ণী। অন্ধকার গৃহদেবতার বিগ্রহ, নিজের দুটো হাত পর্যন্ত সে দেখতে পেল না। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বিগ্রহের উদ্দেশে দু’হাত জুড়ে সে প্রণাম করল। রাত্রিলীলার শেষ দণ্ডে জেগে ওঠার চিন্তা মাথায় নিয়ে গভীর ঘুমে সে ডুবে গেল। স্বপ্নের ঘোরে নারায়ণী ঘুমিয়ে পড়লেও তাকে সেই স্বপ্ন ছাড়ল না। ঘুম ভেঙে গেল তার। জেগে উঠেও তার মনে হল সে ঘুমিয়ে আছে, স্বপ্ন দেখছে। নিজের শয্যা থেকে নেমে গৃহদেবতা বিষ্ণু তাকে সোহাগ করছে। স্বর্গীয় সুখে উদ্বেল হয়ে উঠছে তার শরীর, অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রঙের আলোর ফুল। পাথরের বিগ্রহ আতপ্ত রক্তমাংসের শরীর হয়ে গেছে। সেই শরীরের মনোরম ভার, গাঢ় নিঃশ্বাসের প্রলেপ, দু’ঠোঁটের আশ্লেষ নারায়ণীকে বিবশ করে দিল। সে জাগতে চাইল না, ঘুমোতে চাইল না, স্বপ্ন দেখছে, না দেবতাকে নিজের সর্বস্ব স্বেচ্ছায় উজাড় করে দিচ্ছে, ভাবতে চাইল না, দেবতার সোহাগে শুধু গলে যেতে থাকল। দেবতার শরীরে তার নিজের হাতে মাখানো চন্দনের সুবাস পাচ্ছিল সে, শুনতে পাচ্ছিল তার বুকের ধুকপুক আওয়াজ, রক্তমাংসের সেই শরীর পাথরের মতো গুঢ়ভার হয়ে যেতে নারায়ণী জ্ঞান হারাল।

বেহুঁশ অবস্থায় সে কতসময় কাটিয়েছে চোখ খুলে তাকিয়ে বুঝতে পারল না। প্ৰথমে মনে হল, ঘুম ভেঙে গেছে, এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। অন্ধকার ঘরে চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। সর্বাঙ্গ তাপ ছড়িয়ে থাকলেও পাখির মতো হালকা লাগছে নিজেকে। খাটের ওপর ঘুমিয়ে থাকা পাথরের বিগ্রহকে অন্ধকার ঢেকে রেখেছে। নিজের শরীরের ওপর হাত বুলিয়ে টের পেল অগোছালো বসন, গায়ের ভুনিপোতা পড়ে রয়েছে পায়ের কাছে, সবচেয়ে বড় কথা দেহের শিহরন তখনও কাটেনি, রোমকূপগুলো আরামে থরথর করছে। থৈথৈ আনন্দের মধ্যে তার কান্না পেল। দু’হাত জুড়ে সে প্রার্থনা করল, হে ঈশ্বর, তোমার এই হতভাগিনী সেবাদাসীকে পায়ে জায়গা দিও। আমি তোমার, শুধুই তোমার।

রাত্রিলীলার অন্তিমপর্বের সঙ্কীর্তন শুরু হওয়ার আগে রাতের থান, ভুনিপোতা ছেড়ে কাচা পোশাক পরে নিতে অন্ধকার মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়াল নারায়ণী। বাড়ির ভেতরে গিয়ে নিঃশব্দে স্নান সেরে পোশাক বদল করে মন্দিরে ফিরল। সঙ্কীর্তনের দল তখন মৃদঙ্গে বোল তুলছে। মহোৎসবের বাকি দুটো রাতে আরও রোমাঞ্চকর কিছু ঘটার প্রত্যাশা নিয়ে দেবসেবার কাজে নারায়ণী ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

নারায়ণীর চোখের সামনে ধীরে ধীরে যে নতুন সকাল শুরু হল, আগের দিনের মেঘ, দুর্যোগের চিহ্ন নেই সেখানে। ভোরের আবছা নীল আকাশে সূর্য ওঠার আগের মুহূর্তের সোনালি রেখা জেগে উঠছে। গাছপালায় পাখিদের কিচিরমিচির ডাকের সঙ্গে রামকিরি রাগে সঙ্কীর্তনের সুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। আনন্দের হিল্লোলে জড়িয়ে থাকা শরীরে গৃহদেবতার নিত্যপুজোর আয়োজনের মধ্যে নারায়ণীর মনে বারবার ভেসে উঠছিল গত রাতের স্মৃতি। লজ্জা জড়ানো চোখে পাথরের বিগ্রহের দিকে সে তাকাচ্ছিল। রাতের তৃতীয় প্রহরে যে দেবতার সোহাগে সে ভেসে গিয়েছিল, তার মুখে পাথরে খোদাই করা চিরকেলে হাসি লেগে থাকলেও সে নিষ্পন্দ। নারায়ণী ভাবল, তাহলে কাল রাতে সে কি স্বপ্ন দেখেছিল? তার মনে কি পাপ ঢুকেছে? প্রশ্নের উত্তর সেই রাতে এবং পরের রাতে নারায়ণী পেয়ে গেল। পরপর দু’রাতে, সঙ্কীর্তন যখন থেমে গেছে, অতিথি ভক্তের দল, পরিবারের সকলে ঘুমে কাদা, অন্ধকার মন্দিরে ঘুমন্ত নারায়ণী টের পেল, নিজের খাট থেকে দেবতা নেমে এসেছে। গভীর সোহাগে ঢেকে দিচ্ছে তার শরীর। আধাঘুমে নারায়ণী সচকিত হয়ে উঠলেও, জেগে যেতে চাইল না। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ভয়ে গাঢ় ঘুমে ডুবে থাকতে চাইল। সে অনুভব করছিল কাঁটা দিয়ে উঠছে তার শরীর, স্নায়ু, শিরা প্রতিটা কোষ শিরশির করছে, মাথার মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা রঙের ফুলকি, আকাশগঙ্গার জলস্রোত ঢুকে পড়ছে শরীরে, জেগে গেলেও স্বপ্নাতুরের মতো দুটো রাতের কয়েক দণ্ড ঘুমের অভিনয়ের সঙ্গে ইচ্ছপূরণের চরিতার্থতায় বুঁদ হয়ে ছিল।

মহোৎসব শেষ হলেও তিনরাতের ঘটনার আবেশ নারায়ণীকে ছাড়ল না। শ্রীবাসের বাড়ির উঠোন, দাওয়া, বিষ্ণুমন্দিরের চাতাল খালি করে অতিথি, ভক্ত, সঙ্কীর্তনকারীরা চলে গেছে। অতিথিসেবার ভার হালকা হয়ে গেলেও আসন্ন রাতের জন্যে বিভোর হয়ে থাকল নারায়ণী। রাত নামল। মন্দিরের ফাঁকা চাতাল থেকে তাকে বাড়ির ভেতরে ডেকে নিয়ে রাতের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়তে বলল মালিনী। বলল, তিনদিন হাড়ভাঙা খাটুনি গেছে তোর। বিশ্রাম দরকার, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।

খুড়ির আদেশ মেনে নারায়ণী তখনই খেয়ে নিলেও সেই মুহূর্তে বিছানায় গেল না। গৃহদেবতার কয়েকটা বাসন ধোয়ার অজুহাত দিয়ে মন্দিরে ফিরে এল। বিষ্ণুর খাটের পাশে মেঝেতে আঁচল পেতে এখন থেকে না শুলে রাতে সে ঘুমোতে পারবে না, এ কথা খুড়িকে সে বলে কেমন করে? আবার কেনই বা বলবে না? গৃহদেবতার নির্দেশে সে রাতে মন্দিরে ঘুমোতে চলেছে, খোলাখুলি তা জানালে অপরাধ কী? খাপছাড়া নানা চিন্তা নিয়ে মন্দিরে ফিরে গৃহদেবতার খাটের পাশে মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল, সত্যি ভীষণ ক্লান্ত ছিল সে। শরীরে তিনরাতের আবেশ ছড়িয়ে থাকলেও সর্বাঙ্গ টনটন করছিল। মেঝেতে শুয়ে কয়েক লহমায় সে ঘুমিয়ে পড়ল, রাত গভীর হলেও মালিনী ডাকতে এল না। রাতের তৃতীয় প্রহরে খাট থেকে নেমে গৃহদেবতা জাগাল না তাকে। সুখস্বপ্ন দেখল না। তার মড়ার মতো সেই ঘুম ভাঙল ভোররাতে মালিনীর ডাকে। বাস্তুর চারপাশের গাছগাছালিতে পাখিরা তখন জেগে উঠে কলরব জুড়েছে। মালিনীর ডাকের সঙ্গে তাদের ডানা ঝাড়ার আওয়াজ কানে ঢুকতে আড়মোড়া ভেঙে নারায়ণী উঠে বসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *