গোরা – ১

রাত এগারোটায় চৌরঙ্গির পাঁচতারা হোটেলের নাইটক্লাবে, যার নাম ‘মন্ত্র’, গোরা যখন ঢুকল, আলো অন্ধকার সেই প্রকোষ্ঠে তখন নাচ-গানের হুল্লোড় চলছে। ঝকঝকে এলিভেটর চেপে হোটেলের তিন তলায় উঠে নরম হলুদ কার্পেট পাতা করিডোর ধরে ডানদিকে খানিকটা এগিয়ে, আবার বাঁ পাশের সিঁড়ি ভেঙে কয়েক ধাপ নামলে, ঘূর্ণায়মান লাল-হলুদ-সবুজ আলো ঝলকিত আদিমকালের গুহার মতো বড়োসড়ো যে হলঘরের দরজায় পৌঁছানো যায়, সেটাই ‘মন্ত্র’। আঠারো থেকে ত্রিশ বছরের তরুণ আর যুবকদের এটা রাতের নন্দনকানন, শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিস্কোথেক। হলঘরের মাঝখানে কাঠের ‘ড্যান্সিং ফ্লোর’, বাঁ দিকে এক দেড় ফুট উঁচু কাঠের মঞ্চ। সেখানে দাদামশাই-গোছের ঝকঝকে আবলুস কাঠের পিয়ানোর দু’পাশে বিশাল ব্যান্ড, বেস্ গিটার, লিড্ গিটার, স্যাক্সোফোন, ক্ল্যারিওনেট, ইলেকট্রিক কি-বোর্ড নিয়ে বসেছে তরুণ বাজনদাররা। জরির কাজ করা ঝলমলে তাদের পোশাক। ড্রামের ওপর বড়ো কাতালের মতো পেতলের ঝকঝকে সিম্বাল ঝনঝন করে বেজে উঠতে কর্ডলেস মাইকে ব্রিটানি স্পিয়ার্সের রীতিমতো ‘হট্’ পপসঙ্গীত শুরু করল, মুম্বাই-এর ‘সান অ্যান্ড শ্যাডো’ হোটেলের ‘ডার্লিং’ গায়িকা নিদিয়া জুল্‌খা। নিদিয়ার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ, সাপের খোলসের মতো স্বচ্ছ, সেঁটে থাকা যে পোশাক তার শরীরে জড়িয়ে রয়েছে, তার ওপর ঘূর্ণায়মান আলো এসে পড়লে পোশাকটাকে সাবানের ফেনার মতো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, শরীর ছেড়ে যে কোনও মুহূর্তে সেটা পিছলে পায়ের কাছে নেমে যাবে। পপগায়িকা হিসেবে নিদিয়া এত চড়চড় করে খ্যাতির চুড়োয় উঠছে, যে ভবিষ্যতে কলকাতার মন্ত্রে গান গাইতে আসার সুযোগ সে আর পাবে কিনা সন্দেহ। অসীম সম্ভাবনাময় এই তরুণী গায়িকা মন্ত্রে গান গাইতে এলে সেখানে ভিড় ভেঙে পড়ে।

পিয়ানোর ভেতর থেকে গমগমে সুর বেরিয়ে আসতে পিয়ানোবাদককে ঘিরে বসে থাকা যন্ত্রীদের বাজনা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। দ্বিতীয় গান শুরু করল নিদিয়া, ‘মাই কিস ইজ ফর স্কাই, ফর ইটারনিটি’ আকাশ আর অনন্তকালের জন্যে আমার চুম্বন

দ্রুত লয়ের বাজনার গানের দ্রুততর লহরীতে পা মিলিয়ে যারা নাচের ঝড় তুলেছে, তার মধ্যে ঐশীকে দেখতে পেল গোরা। কালো টাইটস্-এর ওপরে গা কামড়ানো খয়েরি টপ্ পরে নাচের ঘূর্ণিতে সে মিশে গেছে। তার নাচের জুড়ি গোরার-ই বন্ধু, বৈভব প্যাটেল। প্যাটেলের হাতের দুটো পাতা দু’হাতে ধরে ঐশী নাচছে। দু’জনের মাথার ওপর দিয়ে বিদ্যুতের গতিতে পাক খাচ্ছে দু’জোড়া হাত। হাওয়ায় উড়ছে ঐশীর লম্বা চুল। বাতানুকূল হলঘরে আধ ডজন একপেয়ে ঘুরন্ত পেডেস্টাল ফ্যানের হাওয়ায় শীতল ঝড়ের পরিবেশ। মাঝে মাঝে ঐশীর মুখের অর্ধেকটা এলো চুলে ঢেকে গেলেও সে পাত্তা দিচ্ছে না। বৈভবের ডান হাতের পাতা ধরে চরকির মতো উল্টোপাক দিতে বুকের ওপর ছড়ানো লম্বা চুলের ঢল পিঠে ফিরে এসে কালো পতাকার মতো উড়ছে। ছবির মতো লাগছে ঐশীকে। গোরা তাকিয়ে থাকল।

হলের ডানদিকে আধমানুষ উঁচু মেহগনি কাঠের বার কাউন্টার। বার কাউন্টারের পেছনের দেওয়াল, দু’পাশ, নানা আকার আর বিভিন্ন রঙের বোতলে এমন সাজানো, হঠাৎ তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কাউন্টারের সামনে গদি আঁটা উঁচু টুলের ওপর যারা বসে রয়েছে, তাদের বেশির ভাগের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। জুড়িয়ে যাওয়া শরীর আর মনকে চাঙ্গা করতে শিং ভেঙে বাছুরের দলে প্রায় সন্ধেতে তারা ঢুকে পড়ে। হোটেলের ‘রেগুলার কাস্টমার’ হলেও ‘মন্ত্রে’ তারা রবাহূত। মন্ত্রের যারা সদস্য, আর তাদের অতিথিরা, এই সব আধবুড়োদের পাত্তা দেয় না। তবে তাদের চাহিদামতো কিছু মেয়ে মন্ত্রে জুটে যায়। দেশ জুড়ে যখন লালবাতি জ্বলছে, বিশেষ একটা পাড়াকে যখন ‘রেড লাইট’ এলাকা নামে চিহ্নিত করার উপায় নেই, তখন এই মেয়েদের পারিবারিক পরিচয় না খোঁজাই ভালো। পোশাক-আশাক চালচলনে আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে ফারাক না থাকলেও তারা আসে পেটের ধান্দায়, জীবিকার খোঁজে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। লা মার্টিনিয়ার, লরেটো কলেজে পড়া মেয়েদের মতো কালো আর তামাটে তাদের চুল, তেমনই চৌকশ আদবকায়দা, বেগুনি ঠোঁটরঞ্জনী, শরীরের ওপরে নিচে র‍্যাংলার জিনস্, এক হাতে জিম্‌লেট অথবা ভোডকা, স্ক্রু ড্রাইভার, ব্লাডি মেরি, টম কলিন্স, যা হোক একটা ড্রিঙ্কস্ নিয়ে, অন্য হাতে সঙ্গীর কোমর জড়িয়ে সাবলীল পা ফেলে নেচে চলেছে। শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে প্রসাধনীর ‘আয় আয়’ সুবাস। গ্লাস হাতে যে ভদ্রমহোদয়রা কাউন্টারের সামনে উঁচু টুলে আধখোলা চোখে ভামের মতো বসে আছে, তারা যেমন ড্যান্সিং ফ্লোরের পকেটতোড় খেপখাটা মক্ষিরানিদের চেনে, তেমনি বিগতযৌবন, ভুঁড়িওলা, থপথপে লোকগুলোর হালহদ্দ এই মেয়েদের অজানা নয়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মেয়েগুলো মন্ত্রে ঢোকার সুযোগ পায়। মন্ত্রের সদস্যদের দঙ্গলে তাদের মতো করে মিশে যায়। তাদের খানাপিনার দাম, আর গতর খাটানোর পারিশ্রমিক যারা জোগায়, তারা উঁচু টুলে বসে নাচের তালে তালে দাবনা নাড়ায় আর বয়সটা কেন কুড়ি বছর কম হল না, ভেবে নিঃশব্দে আক্ষেপ করে। তাদের দু’একজনের হোটেলে ঘর বুক করা থাকে। সারা বছরই থাকে। তারা মোটা মাইনের কর্পোরেট মস্তান, তালেবর হাওলাওলা অথবা অজ্ঞাত উৎস থেকে কামানো কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের চোখের ইশারায় হোটেলের যে কোনও ঘর যখন তখন খুলে যায়। তবে হোটেলে তারা রাত কাটায় না। যত রাত হোক, রাত দুটো, আড়াইটেতেও বাড়ি ফিরে যায়। সকালে স্নান সেরে কাউকে হনুমানচালিশা পড়তে হয়, কাউকে গণেশ পুজো করতে হয়। বাড়ি ফেরা তাই বাধ্যতামূলক। বাড়ি ফিরে শোয়ার ঘরে বিছানা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়লেও বিছানায় সহধর্মিণীর নাক ডেকে ঘুমোনোর বহর দেখে টের পায়, মেয়েছেলেটি ঘুমোনোর আগে যথেষ্ট সুখ পেয়েছে। দারোয়ান রামভকতকে রোজ গৃহকর্ত্রী কেন পেস্তাবাদামের শরবত খাওয়ায়, মাঝরাতে ঘরে ফেরা বাবুর বুঝতে অসুবিধে হয় না। বউ-এর পরপুরুষগামিতা নিয়ে বিত্তবান বাবুরা মাথা ঘামায় না, মন্ত্রের কোনও কোনও নটি তা জানে।

মন্ত্রের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, ভেতরে নজর করে, আলো অন্ধকারে কয়েক মুহূর্তের জন্য গোরার চোখে ধাঁধা লেগে গেলেও তাকে দেখে বৈভবকে ছেড়ে ঐশী ছুটে এল। বৈভবও দেখেছে গোরাকে। নাচের ফ্লোর ছেড়ে সে-ও এসে দাঁড়াল গোরার পাশে। গান-বাজনার বহুনিনাদিত ঝিন্‌চাক আওয়াজ, হৈ হল্লাতে নিত্য রাতের মতো আজও কয়েক সেকেন্ডের জন্যে গোরার কানে তালা লেগে গেলেও ঐশী সামনে এসে কথা শুরু করতে কানের কপাট খুলে গেল। কাউন্টারের সামনে পুরু লাল কার্পেট ঢাকা চাতালে গুটিকয়েক র আয়রনের চেয়ার টেবিলের দু’তিনটে খালি রয়েছে। গোরাকে ঐশী বলল, চল, একটু বসি।

গোরা, বৈভবকে নিয়ে তিনটে চেয়ার দখল করে ঐশী বসল। বারকাউন্টারের সামনে লাল কার্পেট মোড়া লম্বা ধাপে বসে রয়েছে কয়েকজন ছেলেমেয়ে। দু’তিন জনের হাতের গ্লাসে ড্রিঙ্কস্। তা প্রকৃত পানীয়, অমৃত না বিষ, যারা খাচ্ছে, শুধু তারা জানে। ক্লাবের নানা কোণে দাঁড়িয়ে বসে যারা গুলতানি করছে, তাদের প্রায় সকলের হাতে গ্লাস। সিগারেট ফুঁকছে কেউ কেউ। পানীয়ের গ্লাসের তলাটা লাল, হলুদ, সাদা পছন্দের ন্যাপকিনে মুড়ে নিয়েছে কয়েকজন। রাত ন’টা থেকে ক্লাবে ঢুকতে শুরু করে টিন-এজার সদস্যরা। বার্ষিক সদস্য চাঁদা ষোলো হাজার টাকা। আড়াইশো টাকার ‘ডেলি টিকিট’ও পাওয়া যায়। স্টুয়ার্ট, বার অ্যাটেন্ডারদের সঙ্গে চেনা থাকলে ফোকটে ঢোকা কঠিন নয়। তবে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গিনী থাকা বাধ্যতামূলক। সঙ্গিনীর অভাব হয় না। সঙ্গিনী ভাড়া পাওয়া যায়। হোটেলের সামনে ফুটপাতে নিয়মিত সদস্যরা যখন জমায়েত হতে শুরু করে, তখন তাদের সঙ্গে মিশে যায় ভাড়াটে বান্ধবীরা। সকলকে একরকম দেখতে লাগে। প্রত্যেকের তরতাজা মুখ দেখে মনে হয়, এইমাত্র সে ঘুম থেকে উঠেছে। কপালে, মুখে চিকচিক করছে ভোরের শিশির। মুখ চোখে কোথাও ক্লান্তির চিহ্ন নেই। হোটেলের নিওনসাইনের আলো তাদের ঘাড়, গলা, চিবুকে লেগে পিছলে যাচ্ছে। সকলে যে বিত্তবান, কেউকেটা পরিবারের সন্তান, এক নজরেই বোঝা যায়। সেই বোঝা ষোলআনা ভুল হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। যুগটা এমন যে সব বিষয়ে বৈষম্য থাকলেও পোশাক পরিচ্ছদে রাজা আর নফর এক হয়ে গেছে।

চেয়ারে তিনজন বসতে গোরাকে ঐশী জিজ্ঞেস করল, তোর এত দেরি?

—মা, বাবার সঙ্গে ক্যালকাটা ক্লাবে গিয়ে উটকো ঝামেলায় পড়ে গেলাম। বাঙালি জাতি নিয়ে সেখানে এমন গোলমেলে ভাষণ শুরু হল যে আধঘণ্টা শুনে আমার মাথা ধরে গেল। মিস্টার আগরওয়ালা হঠাৎ বেহুঁশ হয়ে গিয়ে বাঁচিয়ে দিল আমাকে।

—খিলখিল করে হাসছে ঐশী। জিজ্ঞেস করল, তুই কেন গেলি সেখানে?

—জোর করে বাবা ধরে নিয়ে গেল। বাঙালি বাঁচানোর সেই সভাতে বাবারও ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। বাবার ইচ্ছে ছিল তার জ্বালাময়ী ভাষণ আমাকে শোনানোর। মা-ও চাইছিল, আমি যাই। এড়াতে পারলাম না। সভায় ঢুকে দেখি, ডজন খানেক বক্তা। একবার শুরু করলে কেউ থামতে চায় না। যত্তো সব বয়াশ! বাবা ভাষণ শুরু করার আগের মুহূর্তে বাঙালি জাতির ভবিষ্যতের জন্যে দুশ্চিন্তায় পোস্তা বাজারের গাঁজার হোলসেলার, পবননন্দন আগরওয়াল বেহুঁশ হয়ে যেতে হাইকোর্টের ক্রিমিনাল সাইডের প্রথম পাঁচজনের একজন, সম্ভবত পয়লা নম্বর আইনজীবী, মিস্টার প্রমথনাথ রায়, সংক্ষেপে পি.এন. রায়, মানে আমার জন্মদাতা, ভারি ভেঙে পড়ল। বাঙালি জাতির জন্যে কান্না ভেজানো একটা মস্ত লিখিত ভাষণ ছিল তার পকেটে। আগরওয়াল বেহুঁশ হওয়ায় সভা হঠাৎ শেষ হয়ে যেতে বাবার ভাষণ পড়ার সুযোগ বরবাদ হয়ে গেল। সেই হল্লাগুল্লার মধ্যে কেটে পড়তে পারলে আমি সাড়ে ন’টায় এখানে পৌঁছে যেতাম। পারলাম না। সভা থেকে বেরনোর মুখে ধরা পড়ে গেলাম। অসুস্থ আগরওয়ালাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে বেলভিউ ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ক্লাবের যে কর্মকর্তার ওপর বর্তে ছিল, বাবার বন্ধু, সেই হীরক চাকি, হাতের কাছে আমাকে পেয়ে খপ করে ধরে ফেলল। বলল, তুই সঙ্গে না গেলে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে বেহুঁশ আগরওয়ালার মতো আমিও বেহুঁশ হয়ে যাব। আমার সঙ্গে তুইও থাক। তুই থাকলে আমি ভরসা পাই। আগরওয়ালার বউ-ও যাচ্ছে। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে আমার গাড়িতে না হয় তুই, আমি নার্সিংহোমে যাব।

এড়াতে পারলাম না হীরককাকাকে। সবদিক সামলে এখানে আসতে দেরি হয়ে গেল। নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে হীরককাকাই পৌঁছে দিল আমাকে।

এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে গোরা বলল, বাড়ি ফিরতে ঝামেলা হবে। মোবাইল ফোনে একটু আগে মা জানিয়েছিল, ক্লাব থেকে ফেরার পথে আমাকে তুলে নেবে। আমি ‘না’ করে দিয়েছি। বলেছি ট্যাক্সিতে ফিরব।

—ঠোঁট টিপে হেসে ঐশী বলল, আমি পৌঁছে দেব তোকে।

—ঐশীর থুতনি টিপে দিয়ে গোরা বলল, বহুত বহুত সুক্রিয়া!

আলোলিকা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ দেখেনি। সে বলল, আমার সঙ্গেও কিন্তু গাড়ি আছে।

গোরা বলল, তোরা আমাকে দু’টুকরো করে পৌঁছে দিবি। ঠিক করে নে, কে মুণ্ডু নিবি, কে ধড়।

তুমুল হাসাহাসির মধ্যে বৈভব বলল, দশ সিলিন্ডারের ‘টু হুইলার’এনেছি আমি। মিনিমাম স্পিড, ঘণ্টায় একশো মাইল। কুমোরটুলিতে গোরার বাড়িতে মাঝরাতে অনেকবার তাকে এই বাইকে তুলে পৌঁছে দিয়ে সল্টলেকে আমি বাড়ি ফিরেছি। রাতের কলকাতার ফাঁকা রাস্তায় আশি-নব্বই মাইল স্পিডে বাইক চালানো, এক দারুণ মজা! সাত-আট পেগ্ মালের ঘোর বাড়ি ফেরার আগেই কেটে যায়।

আজ কতটা পেটে গেছে?

গোরার প্রশ্নে বৈভব বলল, আরে ইয়ার, তোর অপেক্ষায় থেকে দু’ঘণ্টায় ‘জাস্ট’ এক বোতল বিয়ার খেয়েছি। এবার একটু ভালো করে খাব। সাদা ‘রাম’ টানব আজ।

ঐশী, আলোলিকাকে গোরা জিজ্ঞেস করল, তোরা কী খাবি?

—ঐশী বলল, স্রেফ নিম্বু পানি

—আলোলিকা বলল, ল্যা কুর উইথ লাইম।

আমেরিকান গায়িকা, শার্লি বেসির মতো এখন সুরের তীব্র সপ্তমে পৌঁছে গেছে নিদিয়ার কণ্ঠস্বর। তার সঙ্গে দ্রুততালে বাজছে ঝিন্‌চাক বাজনা। ঐশীকে বৈভব বলল, তোর ফেভারিট

ড্রিঙ্ক ‘টম কলিন্স’ ছেড়ে নিম্বু পানিতে তুই আটকে গেলি কেন?

—মানত আছে।

—হো হো করে হেসে বৈভব জিজ্ঞেস করল, সন্তোষী মা করছিস নাকি?

—না, অন্য ব্রত, তোকে বলব না।

—পেটে মাল না পড়লে কনকনে ঠাণ্ডা এই ঘরে নাচবি কী করে?

—আমার নাচ শেষ। বাড়ি ফিরব এবার।

—সবে রাত সাড়ে এগারোটা, কলির সন্ধে, এত তাড়া কেন?

বাতানুকূল ক্লাব ঘরে এক ঠ্যাংওলা চারটে বড় চাকার পেডেস্টাল ফ্যান চালু হতে মনে হচ্ছে সামুদ্রিক ঝড় উঠল। জোরালো বাতাসে ঐশীর এলো চুল উড়তে থাকলে আলোলিকা বলল, হাতখোঁপা বেঁধে চারটে কাঁটা গুঁজে নে।

—কাঁটা নেই।

—রুমাল দিয়ে খোঁপাটা বেঁধে রাখ।

—ছোট রুমাল। এত বড় খোঁপা বাঁধা যাবে না।

আলোলিকা কথা বাড়াল না। স্টেপ করে কাটা ঘাড় পর্যন্ত লম্বা আলোলিকার চুল। লম্বাটে ফর্সা মুখের সঙ্গে হেয়ার স্টাইল মানিয়ে গেছে। তার বাবা কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মধ্য কলকাতার এক প্রসিদ্ধ কলেজে ঐশীর সঙ্গে সে এক ক্লাসে পড়ে। ঐশীর সঙ্গে পিতৃপরিচয়ে তার একটা চাপা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর ঐশীর বাবা আবার পাঞ্জাবি। ঐশীর মা বাঙালি। বাঙালি বউ-এর পাল্লায় পড়ে উচ্চশিক্ষিত পাঞ্জাবি আই.আর.এস (ইন্ডিয়ান রেভিন্যু সার্ভিস) অফিসার পুরোপুরি বাঙালি হয়ে গেছে। নিমপাতার ঝোল মেখে ভাত খাওয়া শুরু না করলে তার পেট ভরে না। গোরা আর বৈভব, দু’জন এবছর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পার্ট টু পরীক্ষা দিয়েছে। গোরার বিষয় ইংরেজি, বৈভবের অ্যাকাউন্টেন্সি। দু’জনে শুধু ভালো ছাত্র নয়, কলেজ কুইজ দলের দুই প্রধান পাণ্ডা ছিল। ‘ক্যাট’ পরীক্ষা পাশ করে গোরা ম্যানেজমেন্ট পড়তে চায়। পারিবারিক ব্যবসাতে ঢুকতে হয়েছে বৈভবকে। দেশ-বিদেশ ছড়ানো বিশাল ব্যবসার কোনও এক শাখা সামলাতে হবে তাকে। পার্ট টু পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিন থেকে কলকাতা দপ্তরে রোজ হাজিরা দিতে শুরু করলেও প্রাণের বন্ধু গোরার সঙ্গে একবার দেখা না হলে তার প্রাণ আইঢাই করে। রাত ন’টার আগে দপ্তর থেকে খালাস পায় না। তখন আড্ডা দেওয়ার সেরা জায়গা ‘মন্ত্র’। গোরাকে ‘মন্ত্ৰ’ চিনিয়েছে বৈভব। মন্ত্রে ঢোকার ছাড়পত্র বৈভব বানিয়ে দিতে চাইলেও বার্ষিক সদস্য চাঁদা, নিজের পকেট থেকেই গোরা দিয়েছে। ষোল হাজার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে গেলেও বন্ধুদের কাউকে মুরগি বানিয়ে ফুটুনি মারার ছেলে সে নয়। পরের গাঁট ভেঙে খেতে সে ঘেন্না পায়। কলকাতায় তার পরিবারও কম নামী নয়। আড়াইশো বছর কলকাতাবাসী তাদের পরিবারকে শহরের পুরনো বাসিন্দারা চেনে। তার ঠাকুরদা ছিলেন প্রথিতযশা ডাক্তার। তার জ্যাঠাও এক হাজার এক টাকা দক্ষিণা নেওয়া বিখ্যাত চিকিৎসক। রুগিকে দেখতে তার বাড়ি গেলে নেয় পাঁচ হাজার এক টাকা। খুচরো এক টাকা পর্যন্ত গুনে নেয়। তার আইনজীবী বাবার দাপটে হাইকোর্টে বাঘে বাছুরে এক ঘাটে জল খায়। ঘাতক আর খুন হয়ে যাওয়া মানুষটা এজলাসে, হাকিমের সামনে দাঁড়িয়ে কোলাকুলি করে। তার নভোযান বিজ্ঞানী সেজকাকা থাকে আমেরিকার হাউস্টনে। সেখানে তৈরি যত আকাশযানের ব্যবহারযোগ্যতার শেষ ছাড়পত্রে সেজকাকার সই না থাকলে, সেগুলো আকাশে ওড়ার ছাড়পত্র পায় না, হ্যাঙারে পড়ে থাকে। শোনা যায়, সেই সেজকাকা, প্রথম ভারতীয় মেয়ে মহাকাশযাত্রী, কল্পনা চাওলাকে আমেরিকার নভোযানে ওড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মহাকাশে কল্পনাকে দ্বিতীয়বার পাঠানোতেও সে কলকাঠি নেড়েছিল। আকাশের ওপরে আর এক আকাশে নভোযান দুর্ঘটনায় কল্পনার অকালমৃত্যুর পরে বিজ্ঞানী কাকা চাকরি ছেড়ে ইস্কনের আজীবন সদস্য হয়ে গেছে। গায়ে ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম’ লেখা নামাবলী জড়িয়ে, কপালে রসকলি এঁকে স্বপাক আতপচালের ভাত ফুটিয়ে খায়। শুধু মদ্যপান ছাড়েনি, পুরো নিরামিষাশী হয়ে গেছে। গোরার ছোটকাকা, বিরাজ রায়, কৃষিশিল্পপতি। বছরে দশ কোটি টাকার ফুল বিদেশে রপ্তানি করে। ফুল নিয়ে তার লেখা ইংরেজি বই আমেরিকা, ইউরোপে ‘বেস্ট সেলার’ হলেও এদেশে কম লোক তা জানে

জ্যাঠা, বাবা, কাকাদের পেশা নিয়ে গোরার আগ্রহ না থাকলেও মাথা উঁচু করে সসম্মানে বেঁচে থাকার যে শিক্ষা পরিবার থেকে সে পেয়েছে, তার চালচলন থেকে তা বোঝা যায়। সে দাম্ভিক বা চালিয়াত নয়, সভ্য, ভদ্র, নমনীয় এক কথার মানুষ। তবে মেজাজ বিগড়ে গেলে যা মুখে আসে বলে দেয়। পারিবারিক পরিচয়ের ধার ধারে না। বাবার কাছ থেকে মাসে যথেষ্ট ‘পকেটমানি’ পেলেও, সে টাকায় কুড়ি দিনের বেশি তার চলে না। পুরো টাকা সে নাইটক্লাবে উড়িয়ে দেয় এমন নয়। বই পড়ার অভ্যেস আছে। হাত খরচের টাকা থেকে কেনা দু’হাজারের বেশি পেপারব্যাক আছে তার আলমারিতে। গান শুনতে ভালোবাসে। তার ঘরের নানা জায়গায় স্তূপাকার হয়ে থাকা ক্যাসেট, সিডিতে বাংলা ব্যান্ডের দু’একটা গান থাকলেও বেশির ভাগ ইংরেজি, কিছু হিন্দি। পকেট খালি হয়ে গেলেও টাকার সংস্থান করতে গোরার বিশেষ কাঠখড় পোড়াতে হয় না। মা, কাকিমার কাছে হাত পেতে দাঁড়ালেই ‘ম্যানেজ’ হয়ে যায়। হাতের ওপর নোটবৃষ্টি হয়। বছর বত্রিশ-তেত্রিশের ছোটকাকি মাঝে মাঝে নকল রাগ দেখিয়ে বলে, তোমার সেই ‘মন্ত্র’এর আড্ডায় আমাকে নিয়ে না গেলে আমি আর একটা পয়সা কিন্তু ঠেকাব না।

—জুড়ি না থাকলে ওখানে ঢুকতে দেয় না।

—তুমি তো আছ!

—গোরা থতমত খেয়ে বলে জুড়ি মানে বয়ফ্রেন্ড। ছোটকাকেও নিয়ে যেতে পার।

—তাহলে এ জন্মে আর যাওয়া হবে না।

—নিশ্চয়ই হবে। আমি ব্যবস্থা করব।

—ছোটকাকি ফের বলে, আমার জুড়ি হতে তোমার অসুবিধে কোথায়?

—আমার বেশ কয়েকটা জুড়ি আছে।

—তাদের কাছ থেকে এরপর টাকা নিস।

ছোটকাকি চটেছে টের পেয়েও তার সঙ্গে মজা করতে গোরা বলল, ‘মন্ত্র’র কাউন্টারের সামনে জুড়ি পাকড়ানোর ধান্দায় হুইস্কির গ্লাস হাতে হুমদো মতো কিছু লোক, রোজ রাতে টুলের ওপর বসে থাকে, তাদের যে কেউ চোখের ইসারায় জুড়ি হয়ে যেতে পারে।

হাসিতে ছোটকাকির পেটে খিল ধরে গেলেও গোরার কান পাকড়ে বলে, তোর সাহস বড় বেড়েছে, দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি!

ছোটকাকি যে লাঠি জাতীয় কিছু খোঁজার অভিনয় করছে, টের পেয়ে মুচকি হেসে গোরা বলে, ঠিক আছে, মন্ত্রে এক সন্ধের জন্যে জুড়ি করে আমি নিয়ে যাব তোমাকে।

— প্রমিস্?

—প্রমিস্।

গোরার কান ছেড়ে তার হাতে ততক্ষণে হাত মেলাল ছোটকাকি। ছ’ফুট এক ইঞ্চি লম্বা, পাকা ফুটির মতো গায়ের রং, বৃষের মতো কাঁধ, শালপ্রাংশু, মহাভুজ এই ভাসুরপোর দিকে তাকালে কাকির মনের গভীরে যে বিগলন শুরু হয়, গোরা জানে না। একুশ বছরের ছেলের পক্ষে জানা সম্ভব নয় তার অন্তগূঢ় পরিচয়। ছোটকাকি ভাবতে থাকে কোথায়, কবে যেন এই সুপুরুষ তরুণকে যার পোশাকি নাম গোরা, ভালো নাম স্বয়ম্ভর রায়, দেখেছে। খুব চেনা, অথচ মনে করতে পারছে না, কোথায় প্রথম দেখেছিল। ধোঁয়ার মতো ধন্দ মাথার ভেতরে স্তরে স্তরে জমে উঠলেও কাকি জট ছাড়াতে পারে না। ‘মন্ত্র’ নামে নিশিকুঞ্জে তার যাওয়ার ইচ্ছেও তাই কথার কথা হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

রাত পৌনে বারোটায়, মন্ত্রে এখন তিল ধারণের জায়গা নেই। ড্যান্সিং ফ্লোরে ঢেউ-এর মতো ভেঙে পড়ছে সাম্বা আর সাঁওতালি নাচের ককটেল, তালসাম্বা নাচ। এর নাম নৃত্যকলার ‘ফিউশন’, নাচের বিগলিত ঐক্য। নাচিয়েদের পাতালমন্থনকারী পদক্ষেপে থেঁতলে যাচ্ছে মাটির নিচে পৃথিবীধারক বাসুকি নাগের মাথা। নাচিয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মন্ত্রের ভেতরটা সরগরম করে তুলছে জগঝম্প বাজনা। লাল সবুজ হলুদ আলোর রশ্মি মন্ত্রের মেঝে, দেওয়াল ছাত চেটে অবিরাম পাক খেয়ে চলেছে। আলোয় দেখা যাচ্ছে ঘর বোঝাই সিগারেটের ধোঁয়া। নানা রঙের ধোঁয়ার সঙ্গে নাচ-গান-বাজনার আওয়াজ মিশে ঘন কুয়াশার আবহ তৈরি করেছে। তিন পেগ সাদা রাম খেয়ে ঐশীকে নিয়ে ফ্লোরে তৃতীয় দফা নেচে আরও একটা রামের পেগ নিয়ে কাউন্টারের সামনে চেয়ারে গোরা বসল। তার সঙ্গে ঐশী এবং আরও কয়েকজন মেয়ে ফ্লোর থেকে উঠে এসে প্রায় মালার মতো তাকে ঘিরে বসেছে। তাদের মধ্যে তুন্দ্রা আর ঐন্দ্রিলা এক রাউন্ড করে গোরার সঙ্গে ওয়ালটজ্ নেচে নিয়েছে। আরও দু’একজন এখনও নাচতে চায়। ঐশী ছাড়া সকলের নিঃশ্বাসে স্পিরিটের গন্ধ পেয়েছে গোরা। ঐন্দ্রিলা আবার এত টেনেছে যে বেতালা পা ফেলে বারবার গোরার বুকে ঢলে পড়ছিল। ঐশীকে নিয়ে কোনও ঝামেলা হয়নি। তবে ঐশীও ধোয়া তুলসিপাতা নয়। টম্ কলিন্স্ খেতে ভালোবাসলেও বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে কোনও ককটেল ফুঁকে দিতে পারে। পাঁচ সাত পেগ খেয়ে টলমল করে না, ভুল বকে না। আজ যে অ্যালকোহল সে ছুঁলো না, তার কারণ সম্প্রতি সে কি একটা কবচ ধারণ করেছে। তার সঙ্গে কিছু মানত আছে। ফি শনিবার কড়াকড়িরকম বিধিনিষেধ মেনে চলে। আমিষ পর্যন্ত খায় না। গোরা জানে তাকে একটু অন্য চোখে ঐশী দেখে। সে জন্যে গোরার কোনও অস্বস্তি হয় না। কিছুই গায়ে মাখে না সে। আজও চেয়ারে বসা গোরার দিকে থেকে থেকে ঐশী তাকাচ্ছিল আড়চোখে। গোরাকে দেখছিল। শুধু সুঠাম সুন্দর, অভিজাত চেহারার জন্যে গোরাকে অন্যরকম মনে হয়, এমন নয়। যে কোনও কারণে গোরাকে খুব চেনা লাগে, নীরব প্রাণের স্রোতে অনেক কাল ধরে পাশাপাশি ভেসে আসছে, এরকম অনুভূতি হয়। তার সঙ্গে গোরার ঘনিষ্ঠতা দেখে বন্ধুদের কেউ কেউ যে ‘জেলাস্’ সে জানে। কিন্তু বন্ধুদের ‘জেলাস্’ হওয়ার কারণ নেই, এ কথা তার চেয়ে ভালো করে কেউ জানে না। অন্য মেয়েদের চেয়ে গোরা যে তাকে একটু বেশি পাত্তা দেয়, সেখানে ‘লাভ্’-এর কোনও ‘সিন’ নেই, পাত্তা দেওয়ার কারণটা একদম আলাদা তা-ও সে জানে। তার দিদিমার সঙ্গে গোরার ঠাকুমার লতায় পাতায় কীরকম যেন আত্মীয়তা আছে। ঠাকুমা, দিদিমার মায়েরা সম্ভবত মামাতো পিসতুতো বোন ছিল। মান্ধাতা আমলের সেই যোগাযোগ, মা মাসিরা কীভাবে বয়ে বেড়ায়, ঐশী বুঝতে পারে না। তবে সেই সম্পর্কের ছায়া যে কম করে একশো বছর পরিবারের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে, গোরাকে দেখে টের পায়। গোরার সঙ্গে এক সন্ধেতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক অনুষ্ঠানে পরিচয়ের প্রায় বছরখানেক পরে এই সম্পর্কের খবর ঐশী জেনেছে। খবরটা গোরা বলেছিল তাকে। পুরনো সম্পর্কের বিবরণ, বাড়িতে মা-মাসির মুখে শুনে গোরার মনেও হয়তো একই অনুভূতি হয়েছিল। অনতিদূর এক সম্পর্কে বিজড়িত ঐশীকে আর পাঁচজন চেনা মেয়ের থেকে আলাদা লাগতে পারে। হয়তো লাগেও। ঐশীর মনে হয়, গোরা কিছুটা সমঝে চলে তাকে। তাকে বাদ দিয়ে আলোলিকা, তুন্দ্রা, ঐন্দ্রিলা, মেঘনা এবং আরও যত অনুরাগিনী আছে, গোরাকে দেখলে যারা ল্যাল্যা করে, তাদের কোনও একজনকে নিয়ে হঠাৎ এক সন্ধেতে মন্ত্রের ড্যান্সিং ফ্লোরে গোরা এমন আদিখ্যেতা শুরু করে দেয়, মনে হয়, সেই মেয়েই তার সবচেয়ে পছন্দের গার্লফ্রেন্ড, প্রেমিকা হলেও হতে পারে। পরের সন্ধেতে তাকে দেখে শুধু ‘হ্যালো” বলে পাশ কাটিয়ে ড্যান্সিং ফ্লোরে চলে যায়। চেনা, অচেনা যে কোনও মেয়ের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা নাচের ফাঁকে ফাঁকে তিন-চার পেগ রাম, হুইস্কি খেয়ে কাউন্টারের সামনে রট আয়রনের চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে কিছু সময় বসে থাকে। তাকে চেনে না এমন কোনও মেয়ে সদস্য বা অতিথি মন্ত্রে নেই। বলা যায়, এই ডিস্কোথেকের সে “হিরো”। কাউন্টারের সামনে চেয়ার নিয়ে সে বসলে প্রথমে তার পাশে গিয়ে বসে বৈভব। দু’জনের কেউই গোড়ায় কথা বলে না। আসলে গোরা কথা শুরু না করলে বৈভব মুখ খুলতে ভরসা পায় না। গোরার পাশে বৈভব বসলে আরও দু’চারজন ছেলেমেয়ে গুটিগুটি সেখানে জড়ো হয়। চেয়ার নিয়ে বসে। নতুন কোনও মেয়ে তালাপ জমাতে চাইলে পাশ কাটানো দু’এক কথা বলে, গোরা বুঝিয়ে দেয়, আজ তার কথা বলার ‘মুড’ নেই। তারপরেও তাকে কথা বলানোর জন্যে কেউ খোঁচাখুঁচি করলে, সে এমন এক অশ্রাব্য শব্দ বলে বসে, যা মন্ত্রের মতো ‘পশ’ ক্লাবে মানায় না।

মাস দু’তিন আগে, রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলের ভাগ্নি, রোকেয়া দত্তকে দুম করে এমন একটা কথা বলেছিল, যা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। মুখ চুন করে কয়েক সেকেণ্ড বসে থেকে আধখাওয়া স্প্যাগেটির প্লেট টেবিলে রেখে চেয়ার ছেড়ে রোকেয়া উঠে গিয়েছিল। বাকি যারা বসেছিল, কথা হারিয়ে ফেলেছিল। সেই থেকে গত তিন মাস রোকেয়াকে মন্ত্রে কেউ ঢুকতে দেখেনি। সে নাকি অন্য ‘ডিসকোথেকে’ যেত। সেই রাতে গোরার মেজাজ খারাপ করার কারণ ঐশী জেনেছিল এক মাস পরে। গোরা যা বলেছিল, তা হল—বিত্তবান এক খুনি, নাম উদ্ধব কেজরিওয়াল, আইনমাফিক যার ফাঁসি হওয়ার কথা, তাকে আদালত থেকে বেকসুর খালাস করে এনেছিল মিস্টার পি.এন. রায়, তার বাবা কেজরিওয়াল যে শুধু খুনি নয়, তার চেয়ে বেশি নৃশংস, আদালতের বিচারপতি থেকে খবরের কাগজের ছাপোষা পাঠক পর্যন্ত জেনে গেলেও তাকে কোনও সাজা দেওয়া সম্ভব নয়, তাও জানত। তাই ঘটেছিল। কেজরিওয়ালের ছাড়া পাওয়ার খবর শুনে গোরা, তার মা, ত্রিশ বছর আগের বিখ্যাত সাঁতারু বিপাশা রায়কে বলেছিল, এ বাড়িতে আমি আর থাকব না।

গোরার পিঠে হাত রেখে বিপাশা বলেছিল, বোকা ছেলে, এটাই তোর বাবার পেশা। সে যা করার আইন মেনে করেছে। আদালত যদি কেজরিওয়ালকে নির্দোষ মেনে নিয়ে ছেড়ে দেয়, তোর বাবার কী অপরাধ?

মায়ের ব্যাখ্যা গোরার মনে সামান্য দাগ না কাটলেও গম্ভীর মুখে সে বসেছিল। তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বিপাশা বলেছিল, আজ সন্ধেবেলায় এক জায়গায় যাবি?

— কোথায়?

—গ্র্যান্ড হোটেলের ‘ব্যাঙ্কোয়েট হলে।

—কী আছে সেখানে?

কেজরিওয়ালের রিসেপশন, সেই সঙ্গে ককটেল ডিনার, আয়োজন করেছে বি সি সি আই, বেঙ্গল চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ।

কথাটা শুনে মায়ের পাশ থেকে গোরা ছিটকে সরে গিয়েছিল।

থেঁতলানো গলায় গোরা বিড়বিড় করেছিল, কী বলছ?

গোরা যে কতটা বেসামাল হয়ে পড়েছে, বুঝতে না পেরে বিপাশা বলেছিল, কাল সকালের ফ্লাইটে সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে কেজরিওয়ালজি। তোর বাবাকে সঙ্গী করতে চেয়েছিল। প্লেনের টিকিটও কেটেছিল। মামলার চাপে হাইকোর্ট ছেড়ে পুজোর আগে যে তোর বাবার নড়ার উপায় নেই কেজরিওয়ালজি জানবে কী করে?

মায়ের কথাগুলো শুনতে গোরার এত কষ্ট হচ্ছিল যে অশ্লীলতম কিছু খিস্তি গলা থেকে উগরে পড়ার আগে ঘর ছেড়ে সে বেরিয়ে এসেছিল। দুপুরে না খেয়ে, বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে। কফি হাউসে আড্ডায় সারা দুপুর বসে বারবার পা ঘসছিল মেঝেতে। সিমেন্টের ওপর খরখর আওয়াজে চমকে উঠছিল বন্ধুরা। দু’হাতে আধভর্তি জলের গ্লাস ধরে এমন চাপ দিল যে সেটা চুরচুর করে ভেঙে গেল। দু’হাতের পাতা রক্তারক্তি। কলেজ স্ট্রিটের এক ফার্মেসিতে তাকে নিয়ে গিয়ে বন্ধুরা হাতে ফুটে থাকা কাচ বার করে ব্যান্ডেজ বাঁধার ব্যবস্থা করেছিল। তারপর আরও নানা জায়গা ঘুরে রাত সাড়ে ন’টায় সে মন্ত্রে এসেছিল। হাতে ব্যান্ডেজ, শুকনো মুখ, মাথায় এলোমেলো তামাটে চুল, কী যে তার হয়েছে, কেউ জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেল না। প্রায় চোঁ চোঁ করে তিন পেগ রাম গিলে নিল। কয়েক মিনিট পরে ঘটনাটা ঘটেছিল রোকেয়াকে নিয়ে। বার কাউন্টারের সামনে টেবিল ঘিরে যারা বসেছিল, তাদের একজন, সম্ভবত মেঘনা কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল, একুশ শতকে সভ্যতা কতদূর এগোতে পারে?

তার কথার পিঠে পাল্লা দিয়ে প্রথমে তৃণীর, তারপর রোকেয়া এমন সব আলটপকা মন্তব্য করছিল, যা শুনে ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছিল গোরার মুখ। মনে হচ্ছিল তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার সঙ্গে মন্ত্রের ভেতরে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাঁ হাতে ধরা স্প্যাগেটির প্লেটে ফর্ক ডুবিয়ে কিছুটা তুলে মুখে পুরে রোকেয়া বলেছিল, এখন চাই একুশ শতকের ‘সাইজ’ অনুযায়ী দর্শন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রোকেয়ার চোখে চোখ রেখে গোরা বলল, আমি তা এখনই দিতে পারি।

সর্বনাশা কিছু ঘটতে চলেছে, ঐশী আঁচ করলেও তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল না। দু’চোখে কৌতুক নিয়ে রোকেয়া বলল, একুশ শতকের দর্শন যদি তোর পকেটে থাকে, আমি এখনই নিতে পারি।

পকেটে নেই ‘পেনিস্’-এ আছে।

তার কথাটা কানে গেলেও রোকেয়ার বুঝতে অসুবিধে হলো। জিজ্ঞেস করল, কী বলছিস তুই?

বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? হওয়ার কথা নয়। আমার সঙ্গে ‘টয়লেট’-এ গেলে তোর স্প্যাগেটির প্লেট একুশ শতকের দর্শনে ভাসিয়ে দেব।

‘ওয়াক’ করে একটা আওয়াজ তুলে হাতের প্লেটটা কার্পেটের ওপর রেখে লেডিস টয়লেটের দিকে দৌড়ে চলে গিয়েছিল রোকেয়া। রাগে গনগন করছিল তার মুখ, চোখ। তারপর মন্ত্রের ড্যান্সিং ফ্লোর বা অন্য কোথাও তাকে আর দেখা যায়নি। সাড়ে তিন মাস পরে সে আবার মন্ত্রে ফিরেছে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল গোরা। কীভাবে তার মান ভাঙিয়ে, মন্ত্রে তাকে গোরা হাজির করেছিল, ঐশী জানে না। গোরাকে জিজ্ঞেস করেনি। নিজে থেকে গোরা না বললে, আর যে বলতে পারে, সেই রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করে জানার মতো রুচি ঐশীর নেই। গোরা না বললে তাকেও সে প্রশ্ন করবে না।

ভদ্র, বিনয়ী গোরা মাঝে মাঝে বেফাঁস কথা বলে ফেলে, তার অনেক বন্ধুই জানে। ঐশী জানলেও অ্যাডভোকেট জেনারেলের ভাগ্নি, রোকেয়া সেই প্রথম জানল। গোরার সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেলেও তাকে দেখলে এখনো রোকেয়ার কথা বন্ধ হয়ে যায়। মুখে প্ৰায় কুলুপ এঁটে সকলের কথা শোনে।

রাত সাড়ে বারোটার মধ্যে বেশিরভাগ বাঙালি ছেলেমেয়ে মন্ত্র ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও ভিড় কমল না। শনিবারের রাতে পিলপিল করে যারা ঢুকছে তারা অবাঙালি ছেলেমেয়ে। তাদের বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। অনেকে গোরার চেনা, বন্ধুও আছে কয়েকজন। গোরাকে পেলে নিজেদের ঝাঁক ছেড়ে বান্ধবী নিয়ে তারা বেরিয়ে আসে। হল্লাগুল্লা বাড়তে থাকল মন্ত্রের ভেতরে। ভোরের পাখির কলরবের মতো তা শ্রুতিসুখকর নয়। নতুন ঝাঁকের বন্ধুবান্ধবীরা ঘিরে ফেলার আগে বারের সামনে গদি আঁটা উঁচু টুলের ওপর গোরা বসে গেছে। চেয়ার টেবিলে বসে যারা আড্ডা মারে, টুল ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। গোরাকে যারা ঘিরে ফেলছিল, তারা ক্রমশ সরে যেতে থাকল। ক্লাব ছেড়ে বেরনোর আগে টয়লেটে গেছে বৈভব। গোরার টুলের পাশে এখন ঐশী একা। গোরাকে সে জিজ্ঞেস করল, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘গোরা’ পড়েছিস?

প্রশ্নটা স্পষ্ট করে গোরা শুনতে পায়নি। আরও একবার শুনতে ঘাড় হেঁট করে কানের পাশে হাতের পাতা রেখে জিজ্ঞেস করল, কার উপন্যাস?

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

—মানে, যিনি ‘জনগণমন’ ‘ন্যাশনাল অ্যাথেম’ লিখেছেন?

— হ্যাঁ।

—বাংলা পড়তে ভুলে গেছি।

—কী পড়িস তুই?

—হ্যারল্ড রবিন্স, সিডনি শেলডন, উইলবার্গ স্মিথ, আরও অনেক আছে।

—বাংলা খবরের কাগজ পড়িস না?

—ধুর, বাংলা ‘পেপার’ কোনও ভদ্রলোক পড়ে? সব ট্র্যাশ, টয়লেট পেপার।

ঐশী চুপ করে যেতে কিছু ভেবে গোরা জিজ্ঞেস করল, উপন্যাসটা পড়ার কথা তুললি কেন?

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ঐশী বলল, রবীন্দ্রনাথের গোরার সঙ্গে তোর মিল আছে।

—কীরকম, দু’জনই কি সমান গাণ্ডু?

—বাজে কথা বলিস না।

গোরা সত্যি চুপ করে গেল। ইংরেজি পেপারব্যাক পড়ে সে হদ্দ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ পর্নোথ্রিলার। কড়া স্যাডিজম্ এর সঙ্গে নরম যৌন সুড়সুড়ি মিশিয়ে এই বইগুলো লেখা হয়। মুম্বাই মার্কা বাজারি হিন্দি ছবির মতো এই সব বই-এর আখ্যানে একটা ফর্মুলা আছে। যাই হোক, বইগুলো পড়তে ভালো লাগে। শুরু করলে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়তে হয়। কলেজ জীবনের গোড়াতে রবীন্দ্রনাথের দু’একটা উপন্যাসের পাতা উল্টে মনে হয়েছে, সেগুলো এত বচনসর্বস্ব, ‘টকেটিভ্’ যে অপাঠ্য। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসটা কখনও নেড়েচেড়ে দেখেছে কি না খেয়াল করতে পারল না। ঐশী আবার বলল, সময় করে গোরা উপন্যাসটা পড়িস। তোর বাড়িতে না থাকলে আমি দিতে পারি। বইটার ভেতরে তুই হয়তো খুঁজে পাবি নিজেকে ভালো লাগবে।

ছ’পেগ রামের নেশায় রাত দেড়টায় মাথার ভেতরটা টলমল করলেও ঐশীর কথা শুনতে গোরার ভালো লাগছে। পৃথিবীতে তার জন্মের প্রায় একশো বছর আগে, রবীন্দ্রনাথের সময়ে, যে একজন গোরা ছিল, সেই গোরার সঙ্গে ঐশীর কথা অনুযায়ী, তার মিল রয়েছে, এমন একটা খবর শুনে সে সত্যি উদ্বেলিত হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের গোরার মধ্যে সে খুঁজবে নিজেকে। গোরা উপন্যাসটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পড়ে শেষ করবে, আর চেষ্টা করবে কেতাব থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের মতো হতে।

‘গোরা’ নামে রবীন্দ্রনাথের একটা উপন্যাসের নায়ক, গোরার সঙ্গে তার মিল থাকার খবরে সে এমন অস্থির হয়েছে যে, আরও এক পেগ রাম গেলার ইচ্ছে করছে তার। টয়লেট থেকে বৈভব ফিরলে তারপরে ‘অর্ডার’ করবে দু’পেগ। তার মধ্যে ঐশী চলে যাবে। তার মা, একটু আগেই মোবাইল ফোনে ঐশীকে জানিয়েছে, হোটেলের গেটে গিয়ে দাঁড়াতে। মন্ত্ৰ ছেড়ে এখন যে কোনও মুহূর্তে ঐশী বেরিয়ে পড়বে। ঠিক তাই ঘটল। রাত একটা দশ মিনিটে গেট থেকে মন্ত্রে টেলিফোন এল ঐশীকে নিতে গাড়ি অপেক্ষা করছে। গাড়িতে যারা আছে, তাদের গোরা চেনে। ঐশীর মা, বাবা। কলকাতার অন্যতম এক অভিজাত ক্লাবের সভাপতি, ঐশীর বাবা, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তা, মিস্টার গ্রোভার। গোরা দেখল, মা, বাবাকে নিয়ে ঐশী ফিরে এল মন্ত্রে। গোরা আর বৈভবের হাতে তখন নতুন দুটো পেগ, সবে চুমুক দিয়েছে তারা। ক্লাবের স্টুয়ার্ড জানিয়ে গেছে, এই শেষ পেগ, আর মদ দেওয়া হবে না। ঐশীর বাবা, মিস্টার গ্রোভার গোরাকে বলল, আজ ছিল আমাদের ক্লাবের প্রতিষ্ঠাদিবস। দেড়শো বছর বয়স হল ক্লাবের। সভাপতি হিসেবে অনুষ্ঠানে থাকতেই হল। ক্লাবের কর্তারা ডিনার না খাইয়ে ছাড়ল না।

গ্রোভারের মোটা কাচের চশমার নিচে চোখ দুটো হাসিখুশিতে চকচক করলেও চোখের ভেতরে চোখজোড়া যে আবেশে টইটম্বুর হয়ে রয়েছে, এক লহমায় তা টের পেয়ে, সকলকে তাজ্জব করে দিয়ে ঐশীর বাবাকে গোরা জিজ্ঞেস করল, কী খাবেন মেসোমশাই, হুইস্কি, রাম, ভোদকা?

থতমত খেয়ে প্রাজ্ঞ চেহারার মানুষটি বলল, কিস্সু নয়, বাড়ি ফিরতে হবে।

ঐশী চমকে গিয়েছিল। তার জাঁদরেল বাবাকে গোরা যে এরকম প্রশ্ন করতে পারে, সে কল্পনা করেনি। বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা মিস্টার গ্রোভার ঘোষণা করলেও গোরা নাছোড়বান্দা, বলল, ওয়ান ফর দ্য রোড?

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রবীণ কর্তা পালাতে পারলে বাঁচে। শুধু গোরা নয়, তার বাবাকেও সে চেনে। পরিবারের সকলে কমবেশি খ্যাপা, এ তথ্য তার অজানা নয়। গোরাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গ্রোভার বলল, তোমাকেও তো বাড়ি ফিরতে হবে? আমাদের সঙ্গে গেলে তোমাকে নামিয়ে দিতে পারি।

বৈভবকে দেখিয়ে গোরা বলল, আমার বন্ধু বৈভব। ওর বাইকে ফিরব।

বৈভবের হাতে রামের গ্লাস দেখে, সেটা কত নম্বর পেগ অনুমান করার চেষ্টায় মি.গ্রোভারের কপালে ভাঁজ পড়ল। বলল, সাবধানে যেও।

গোরা এবং তার সঙ্গে বৈভব শব্দ না করে হাসল। মিস্টার গ্রোভারের মনে হল, এখনকার ছোকরারা এত চালু হয়ে গেছে, যে কে কতটা চাপিয়েছে, চট করে ধরার উপায় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *