গোরা – ১৯

১৯

জপমন্ত্রে আবিষ্ট যবন হরিদাসকে পেয়ে অদ্বৈত আচার্য টের পেল, তার গুরু, সচল সন্ন্যাসী মাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্কল্প পূরণের দেরি নেই। আসমুদ্রহিমাচলের মানুষকে যে মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে চারদশক ধরে মাধবেন্দ্র জাগাতে চাইছে, প্রত্যাসন্ন করতে চাইছে দুষ্কৃতিমুক্ত মানবিক সমাজের আবির্ভাব, তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দেশ জুড়ে গড়ে তোলা মাধবেন্দ্রর আধ্যাত্মিক সংগঠনের রথী, মহারথীরা নবদ্বীপে আসতে শুরু করেছে। তার মানে, রথের সারথী অত্যল্প কালের মধ্যে উপস্থিত হবে। ভারতের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে আদিগুরু মধ্বাচার্যের সময় থেকে সাড়ে চারশো বছর ধরে পরম্পরাক্রমে চোদ্দো প্রজন্ম ব্যাপ্ত যে অনুগামীকুল, মাধব সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিল, তা মাধবেন্দ্রর গুরু লক্ষ্মীপতি পুরী, তার গুরু ব্যাসতীর্থ পুরীর ধর্মীয় পরিক্রমার আগে থেকে, সামাজিক দুর্যোগে কৃষ্ণই যে পরিত্রাতা, এই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরেছিল। চোদ্দো প্রজন্মের বিশ্বাসকে ক্ষুরধার করেছিল মাধবেন্দ্র পুরীর সাংগঠনিক প্রতিভা। তার সংস্পর্শে শ্রীহট্টের কমলাক্ষ ভট্টাচার্য, নবদ্বীপে এসে যার নাম হল অদ্বৈত আচার্য, চট্টগ্রামে পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি, দক্ষিণ ভারতে স্থিত, একদা ত্রিপুরবাসী পরমানন্দ পুরী, দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে শ্রীরঙ্গ পুরী, উত্তর ভারতে ঈশ্বরপুরী, কৃষ্ণনাম প্রচারে গুরু মাধবেন্দ্র পুরীর দেশজোড়া সংগঠনের স্তম্ভ হয়ে উঠল। নৈহাটির কাছে কুমারহট্টে ঈশ্বরপুরীর জন্ম হলেও সন্ন্যাস নিয়ে সে উত্তর ভারতে চলে যায়। গৌড় বাঙ্গলায় যাতায়াতের সুবাদে ঈশ্বরপুরী হয়ে উঠেছিল, অদ্বৈত আচার্যের পরম সুহৃদ। মাধবেন্দ্র পুরীর প্রিয়তম শিষ্য ছিল ঈশ্বরপুরী। সুলতান রুকনুদ্দীন বাববক শাহের সভাকবি, ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যের রচয়িতা, বর্ধমানের কুলীন গ্রামের মালাধর বসু, (সুলতানি দরবার থেকে ‘যশোরাজ খান’ শিরোপা পেয়েছিল) ছিল মাধবেন্দ্র পুরীর মন্ত্রশিষ্য।

নবদ্বীপবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণভক্ত আদিতে ছিল শ্রীহট্টের মানুষ। তাদের প্রেরণাদাতা গুরু ছিল অদ্বৈত আচার্য। শান্তিপুরবাসী মহাপণ্ডিত, স্বনামধন্য এই অধ্যাপকের ছিল সিংহের মতো দাপট, ব্যক্তিত্ব। অদ্বৈতের বৈষ্ণব অনুগামীরা ছিল ছাপোষা, সংসারী মানুষ। বেশিরভাগ ছিল নবদ্বীপের বাসিন্দা। শ্রীবাস পণ্ডিত, চন্দ্রশেখর আচার্য, শুক্লাম্বর পণ্ডিতের মতো কয়েকজন আত্মমগ্ন, নীরব কৃষ্ণভক্তকে বাদ দিলে বাকিরা ছিল সুলতানি শাসনের প্রতাপে সন্ত্রস্ত, উঠতে বসতে ভয়াতুর, তলানি মধ্যবিত্ত মানুষ। সুলতানি শাসনের কোপে পড়ার আশঙ্কায় সবসময়ে কুঁকড়ে থাকত। তাদের মনে শক্তি জোগাতে নিয়মিত নবদ্বীপে যাতায়াত করতে হত অদ্বৈতকে। সেখানেও একটা টোল খুলে ছাত্র পড়াত। খ্যাতিমান পণ্ডিতের টোলে ছাত্রের অভাব হয় না। ‘বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’, পণ্ডিত মানুষের খাতির সর্বত্র। ভক্তিমার্গে কৃষ্ণানুরক্ত অদ্বৈতের অটল বিশ্বাস থাকলেও পেশায় বৈদান্তিক পণ্ডিত হওয়ার জন্যে জ্ঞানচর্চাতেও ছিল সমোৎসাহী। বেদবেদান্ত পঠনপাঠনে টোলের ছাত্রদের সাহচর্য দিত। জ্ঞানব্রতও সাধনার একটা মাৰ্গ, অনেক চেষ্টা করেও মন থেকে এ ধারণা, মুছে ফেলতে পারেনি। ছেলের বয়সি যবন হরিদাসের নিরঙ্কুশ ভক্তির মহিমায় মোহিত হয়ে তাকে পুত্রস্নেহে নিজের ভদ্রাসনে আশ্রয় দিয়ে দর্শনশাস্ত্র, ভাগবত শিক্ষা দিতে শুরু করল অদ্বৈত। অদ্বৈতের আশ্রয়ে থেকে যবন হরিদাস ধীরে ধীরে ঠাকুর হরিদাসে রূপান্তরিত হল। রোজ সকালে গঙ্গাস্নানে তাকে সঙ্গী করে নিল অদ্বৈত। গঙ্গার তীরে পদচারণরত হরিদাস যখন তন্ময় হয়ে ইষ্টদেবতার নাম জপ করত, গঙ্গার বুকে জলে নেমে, যথাযথ আচমন করে অদ্বৈত তখন কৃষ্ণাবতারের মর্ত্যে অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে আকুল প্রার্থনা জানাত। তার চোখ দিয়ে কখনও অশ্রু গড়াত, কখনও সিংহের মতো সে গর্জন করত। ভোরের বাতাসে অদ্বৈতের কান্না, গর্জন, প্রার্থনা, পূরবী রাগের মতো ছড়িয়ে পড়লে স্নানার্থীরা শুধু সচকিত হত ভাবলে ভুল হবে, তারা বিশ্বাস করত, আচার্যের প্রার্থনা বিফলে যাবে না। ভক্তবৎসল কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটতে দেরি নেই। শান্তিপুর, নবদ্বীপ থেকে ভাগীরথীর দু’তীর জুড়ে মানুষের মনে এই বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। মথুরার কৃষ্ণ, বৃন্দাবনের কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের সারথি কৃষ্ণ, যে কিনা একই সঙ্গে পাড়ার ডানপিটে ছেলে, সুদর্শন তরুণ প্রেমিক, মহাবীর যোদ্ধা, ক্রান্তদর্শী দার্শনিক, এমন এক শক্তিধর মানুষ, যার ক্ষয় নেই, লয় নেই, যে মানবপ্রেমিক, অসাধারণ সেই মানুষটি ভক্তের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে না। সারা দেশ জুড়ে হাজার হাজার, লক্ষ, কোটি ভক্ত যদি গলা মিলিয়ে সাধুসমাজের পরিত্রাণের জন্য সমবেত গলায়, একসঙ্গে হাঁক দেয়, তাহলে আর্তজনের ত্রাতা, সেই মহাপ্রাণের সিংহাসন কেঁপে উঠবে, দুর্গত মানুষের উদ্ধারে অবশ্যম্ভাবী হবে তার আবির্ভাব। কোনও শক্তি ঠেকাতে পারবে না তাকে। যবন হরিদাসের সঙ্গ পেয়ে গৌড় বাঙ্গলায় কৃষ্ণাবতারের জন্যে অদ্বৈতের প্রার্থনা ক্রমশ যখন প্রবল হচ্ছে, তখন এক সকালে অদ্বৈতের বাড়িতে তার গুরুভাই, ঈশ্বরপুরী হাজির হল। জপে নিবিষ্ট হরিদাসকে দেখে ঈশ্বরপুরী অভিভূত হওয়ার সঙ্গে কয়েকদিনের জন্যে তার সান্নিধ্য প্রার্থনা করল। নবদ্বীপে অদ্বৈতের বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে ফুলিয়ায় বাস করতে সেই সকালে হরিদাসের সেখানে রওনা হওয়ার কথা ছিল। ফুলিয়ায় হরিদাসের থাকার ব্যবস্থা করেছিল অদ্বৈত। তালপাতার ছাউনি দেওয়া ছোট একটা ঘর, ফুলিয়ার জনবিরল এলাকায় হরিদাসের বসবাসের জন্যে তৈরি করে রেখেছিল অদ্বৈতের এক ভক্ত। ঠাকুর হরিদাসকে দেখার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল ফুলিয়ার মানুষ। ঈশ্বরপুরীর অনুরোধে হরিদাসের ফুলিয়া যাওয়া তিনদিন পেছিয়ে গেল। ঈশ্বরপুরীকে প্রায় ঈশ্বরের মর্যাদা দিয়ে পরম ভক্তিতে হরিদাস যখন বিনয়াবনত, তখন পুরীগোঁসাই দিব্যদৃষ্টিতে দেখছিল, অদূর ভবিষ্যতে সর্বজনমান্য ভক্তের দৃষ্টান্ত হতে চলেছে পথ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া, দীনাতিদীন স্বভাবের এই মানুষটি। রোজ যে মানুষ তিন লক্ষ নামজপ করে, সাধনার উচ্চস্তরে সে পৌঁছে গেছে, বুঝতে ঈশ্বরপুরীর কয়েক মুহূর্ত লেগেছিল। অদ্বৈতকে আড়ালে কথাটা বলতে দ্বিধা করল না।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষ্ণনামসেবক গুরুভাইদের খবরাখবর অদ্বৈত শুনতে চাইলে, ঈশ্বরপুরী কয়েকজন গুরুভাই, বিশেষ করে কেশব ভারতী, ব্রহ্মানন্দ পুরী, নৃসিংহ তীর্থ, কৃষ্ণানন্দ ভারতী, সুখানন্দ পুরী, ব্রহ্মানন্দ ভারতী, গোপাল পুরী, রঘুনাথ পুরী, সঙ্কর্ষণ পুরী প্রমুখের প্রচার কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল। দেশ জুড়ে ভক্তিবাদের যে প্লাবন তারা তুলেছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না, সেই মহামানবের আবির্ভাব ঘটতে চলেছে। কুরুক্ষেত্রে অন্যায়, অধর্মের বিরুদ্ধে যে ন্যায়যুদ্ধ সংঘটিত হয়, অধর্মের পরাজয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মরাজ্য, দ্বিতীয়বার, দু’হাজার বছর পরে, কলিযুগে সেই ঘটনা পুনরাবৃত্ত হতে চলেছে। ক্ষেত্র প্রস্তুত। দ্বারকা থেকে মগধ, ত্রিশুত, কলিঙ্গ, গৌড়-বাঙ্গলা পর্যন্ত সব রাজ্যের সমবেত রথী, মহারথীরা সেই যুদ্ধের শেষে কৃষ্ণাবতারের নেতৃত্বে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে—গৌড়ের ভক্তদের মনে এ নিয়ে সন্দেহ ছিল না। দ্বিতীয় কুরুক্ষেত্রের রঙ্গমঞ্চ সাজাতে, প্রধান মঞ্জু-পরিকল্পক, মাধবেন্দ্র পুরী, ‘মহাভারত’ মহাকাব্য রচয়িতা, স্বয়ং ব্যাসদেব পরিচয়ে জনসমাজে অভিহিত হয়েছিল, দেশ জুড়ে কৃষ্ণনাম প্রচারে সেই-ই হয়ে উঠেছিল প্রধান সংগঠক। মাধবেন্দ্রর কৃষ্ণাবতারতত্ত্বের ব্যাখ্যা, দাক্ষিণাত্যের সাধক রামানুজের শ্রী সম্প্রদায়, ধর্মনেতা রামানন্দ, শিখগুরু নানক. ভক্ত কবীর, অল্প বয়সে পিতৃহীনা বালিকা মীরাবাঈ-এর ঠাকুর্দা, রাও দাদুজী, মহারাষ্ট্রের নামদেব, তুকারাম, যাদের অনুগামীরা প্রায় সবাই ছিল অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য, দয়াল দাদু প্রমুখ প্রভাবশালী ধর্মনেতারা পুরোপুরি মেনে না নিলেও সম্ভাব্য এক ধর্মযুদ্ধের লক্ষণ টের পেয়ে তারাও মাধবেন্দ্রর সহযোগী হবে, জানিয়েছিল। মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহের পঞ্চদশী কৃষ্ণপ্রেমী পুত্রবধূ, যুবরানী মীরাকে তার ভজনগান শুনে কৃষ্ণভাবাবিষ্ট মাধবেন্দ্র সেই সুরলহরীতে মানুষের হৃদয় ভাসিয়ে দিতে প্রেরণা দিয়েছিল। স্বামী ভোজরাজের অনুমতি নিয়ে মীরা সন্ন্যাসিনী হওয়ার ইচ্ছে জানালে তখনকার মতো তাকে সংসারধর্ম পালনের উপদেশ দিয়েছিল মাধবেন্দ্র। তার আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণ, অদূর ভবিষ্যতে স্বয়ং এসে তাকে ডেকে নেবে, এ আশ্বাস দিয়েছিল। মেবার জুড়ে তার আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল তরুণী যুবরানীর ভজনগীতির সুখ্যাতি। রাজপুতানার মানুষের মুখে মুখে ফিরছিল সেই গান। ‘কানু ছাড়া গীত নাই’ এমন এক লব্‌জ ভেসে বেড়াচ্ছিল বাতাসে। বালিকা মীরাকে কৃষ্ণনামের মন্ত্র দিয়েছিল মাধবেন্দ্র। রাজপুতানার এক মরু অঞ্চল, মেড়াতার জায়গিরদার, রাজা রত্ন সিংহ রাঠোর, যে ছিল দাদুজী রাও-এর চতুর্থ পুত্র, তার মেয়ে, মীরার সঙ্গে মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহের বড় ছেলে ভোজরাজের বিয়ের নির্বন্ধও হয়েছিল মাধবেন্দ্রর উদ্যোগে। রাজকীয় জাঁকজমক সহকারে পরমাসুন্দরী মীরার সঙ্গে রাজপুত্র ভোজরাজের বিয়ে হল। রাজপুত্র যে কঠিন ক্ষয়রোগে ভুগছে, রাজপুরীর বাইরে কেউ জানত না। নিরাময়হীন রোগে স্বামী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে, শ্বশুরবাড়িতে এসে অল্প দিনে মীরা জেনে গেলেও সে অবিচল থাকল। আরও বেশি করে ডুবে গেল কৃষ্ণপ্রেমে। স্বামী ভোজরাজের অকাল মৃত্যুর পরে সংগ্রাম সিংহের আর এক ছেলে, রাণা বিক্রমজিৎ ষড়যন্ত্র করেছিল পৃথিবী থেকে মীরাকে সরিয়ে দিতে। মেবারের প্রাসাদে মীরার সঙ্গীতচর্চা নিষিদ্ধ করতে সে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। রাণা সংগ্রাম সিংহ ছিল বীর যোদ্ধা। গোটা আর্যাবর্তের অধীশ্বর হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। যুদ্ধের ময়দানে বছরের বেশি সময় কাটানোর জন্যে মেবারের রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে কি ঘটছে, নজর করার সময় তার ছিল না। বিধবা যুবরানী, মীরাকে নিয়ে সেখানে প্রবল জল ঘোলা হচ্ছে, রাণা জানতে পারল না। বিক্রমজিতের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলেও রাজপ্রাসাদে প্রায় বন্দিনী হয়ে থাকল মীরা। আপাতত মীরার প্রসঙ্গ স্থগিত থাকুক। তার পরিব্রাজিকা হওয়ার কাহিনী পরে ফের আসবে।

ধর্মের প্রতিষ্ঠায় দেশ জুড়ে ধর্মীয় নেতাদের যে সংহতি মঞ্চ মাধবেন্দ্র গড়ে তুলছিল, সেখানে কৃষ্ণ আর তার পরিকররা এই ভূখণ্ডের নানা অঙ্গ রাজ্যে অবতীর্ণ হতে চলেছে, এ নিয়ে তার সন্দেহ ছিল না। গুরু লক্ষ্মীপতি আর তস্য গুরু ব্যাসতীর্থের কাছ থেকে এই পটভূমি রচনার দায়িত্ব, উত্তরাধিকার সূত্রে মাধবেন্দ্র পুরীর ওপর বর্তেছিল। প্রিয়তম শিষ্য ঈশ্বরপুরীর ওপর মাধবেন্দ্র ন্যস্ত করেছিল, পূর্বসূরীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক শাখাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বজায় রেখে সংগঠনের কাঠামো মজবুত করার দায়িত্ব। ঈশ্বরপুরী, বলা যায় জনসংযোগ অধিকর্তার ভূমিকা পালন করছিল।

গুরুভাই, অদ্বৈত আচার্যের অনুগামী, ঠাকুর হরিদাসের সান্নিধ্য পেয়ে ঈশ্বরপুরী বুঝল, অদূর ভবিষ্যতে নবদ্বীপ হতে চলেছে পুরাণের ব্রজভূমি, হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ, কুরুক্ষেত্রের সমন্বিত রঙ্গমঞ্চ। এখানে কোথাও গোকুলে বড় হচ্ছে, অত্যাচার, অবিচার, দুষ্টবিরোধী, সাধুসমাজের রক্ষাকর্তা কৃষ্ণ। শান্তিপুরে গুরুভাই অদ্বৈতের আতিথ্য ভিক্ষা করে কয়েকদিন তার এবং ভক্তশ্রেষ্ঠ হরিদাসের সঙ্গে পরমানন্দে কাটিয়ে ঈশ্বরপুরী নবদ্বীপে মাধব পণ্ডিতের বাড়িতে হাজির হল। শান্তিপুরে থাকাকালীন নিজের লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত’ পুঁথি, অদ্বৈত আর ঠাকুর হরিদাসকে পড়ে শুনিয়ে, তাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিল পুরীগোঁসাই। ‘শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত’ পুঁথির একটি অনুলিপি নিজের কাছে রাখার ইচ্ছে থেকে অদ্বৈত নবদ্বীপে, মাধব পণ্ডিতের ঘরে পাঠিয়েছিল ঈশ্বরপুরীকে। অনুলিপি করার কাজে মুক্তোর মতো হস্তাক্ষর, মাধবের খ্যাতি আছে। অদ্বৈতের কাছ থেকে পুঁথি অনুলিপি করার অনুরোধ এলে, মাধব এড়াতে পারবে না, অদ্বৈতের অজানা ছিল না। সব জেনেই একটা চিঠি লিখে ঈশ্বরপুরীর হাতে দিয়ে, তাকে সে পাঠিয়েছিল মাধবের কাছে। মহাবৈষ্ণব ঈশ্বরপুরীকে আতিথ্য ভিক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে কৃতার্থ বোধ করল মাধব। সন্ধের মুখে, প্রদীপ জ্বেলে, ছেলে গদাধরকে নিয়ে মাধব যখন ঈশ্বরপুরীর শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত পুঁথি পাঠ শুনতে বসেছে, সেখানে ঝড়ের মতো গোরা হাজির হল। গোরা এসেছিল গদাধরকে নিয়ে বল্লালদীঘির কাছে নিদয়া, ভারুইডাঙা গ্রাম দুটোতে, যেখানে অধিকাংশ বাসিন্দা, বাগদি, হাড়ি, ডোম, তাদের সঙ্গে সন্ধেটা কাটাতে। নিদয়া, ভারুইডাঙাতে এমন প্রবীণ মানুষ অনেক আছে, যারা এক সময়ে সুলতানের সেনাবাহিনীতে পাইক, বরকন্দাজ ছিল। কোচবিহার, কামতাপুর, আসাম, ত্রিপুরা এমনকি চট্টগ্রামে অভিযান করেছে। গাঁয়ের জোয়ান মরদেরা এখনও সুযোগ পেলে সুলতানের সেনাবাহিনীতে ঢুকে পড়ে। সুলতানি সেনাবাহিনীতে সব সময়ে এ দুই গাঁয়ের কিছু জোয়ান, পাইকের চাকরি পায়। হাড়ি, ডোম, বাগদিপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ পাইকদের মুখ থেকে যুদ্ধের বিবরণ শুনে গোটা দেশের ছবি গোরা মানসচক্ষে দেখতে পায়। যুদ্ধের বর্ণনার চেয়ে তাকে বেশি আলোড়িত করে দেশঘর থেকে উচ্ছিন্ন হতদরিদ্র হাজার হাজার মানুষের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কাহিনী। দেশহীন, বাস্তুচ্যুত কঙ্কালের মতো মানুষ প্রাণের ভয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে কোথায় হারিয়ে যায়, কেউ খোঁজ করে না। করবে কে? সবাই সমান দুদর্শাগ্রস্ত, শ্যাওলার মতো ভেসে চলেছে। গোরার মর্মমূল পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।

মাধব পণ্ডিতের ঘরে গোরা ঢুকতে ঈশ্বরপুরীর পুঁথি পড়া থে-ে গেয়েছিল। নবদ্বীপের আকাশে তখন শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। মাধবের বাড়ির উঠোনে, আশপাশের গাছে পাখিদের কলরব থেমে গেলেও তারা ঘুমোয়নি। মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল দু’একটা পাখি। তাদের ডানা ঝাড়ার খসখস আওয়াজ, নড়েচড়ে বসার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। শ্রীকৃষ্ণলীলামৃতের দ্বিতীয় সর্গের অর্ধেক পড়ে ঈশ্বরপুরী যখন মাধব আর তার ছেলে গদাধরকে ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছে, সেই ভক্তিবিহ্বল তদ্‌গত আসরে গোরা এসে দাঁড়াতে তার দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল ঈশ্বরপুরী। প্রদীপের আলোয় মাটির দেয়ালে তার লম্বা ছায়া পড়েছে। গোরাকে আগে ঈশ্বরপুরী, শচীর কোলে শিশু অবস্থায় দেখলেও মনে রাখেনি। তাকে নিয়ে অদ্বৈত আচার্যর সঙ্গে কখনও কথা না হওয়ায় তার পরিচয়ও জানা ছিল না। নবদ্বীপে এমন দশাসই, মজবুত, উজ্জ্বল, স্বর্ণকান্তি, প্রখর মুখাবয়ব, মায়াজড়ানো চোখ একজন যুবক রয়েছে, এ খবর তার কানে আসেনি। গোরার দিকে মুগ্ধ চোখে সে যখন তাকিয়ে রয়েছে, তখন শশব্যস্ত মাধব পণ্ডিত সস্নেহে বসতে বলল গোরাকে। গোরা না বসলেও ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াতে তার সঙ্গে ঈশ্বরপুরীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে মাধব জানাল, সেই মুহূর্তে নবদ্বীপে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অধ্যাপক এই নিমাই পণ্ডিত, প্রয়াত জগন্নাথ মিশ্রের সন্তান। জগন্নাথ মিশ্রকে ভালোরকম চিনত ঈশ্বরপুরী। ছোটখাটো, পাতলা চেহারা জগন্নাথের যে এমন এক দেবদুর্লভ সৌন্দর্যের অধিকারী পুত্র সন্তান থাকতে পারে, তার ধারণা ছিল না। পলকহীন চোখে গোরার দিকে পুরীগোঁসাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত শুনতে গোরাকেও আহ্বান জানাল মাধব পণ্ডিত। লীলামৃত পাঠ শুনতে গোরা আসেনি। বাড়ি থেকে গদাধরকে নিতে এসেছিল সে। গদাধরকে সঙ্গী করে শূদ্রপাড়ায় গিয়ে গল্পগুজব করার অভিসন্ধি ছিল তার। গোরার সঙ্গে মাধবের ছেলে গদাধরের ঘনিষ্ঠতা দেখে ব্রাহ্মণপাড়ার অনেকে নানা অকথা, কুকথা রটিয়ে বেড়ায়, কেউ বলে গদাধর হচ্ছে গোরার ‘ছায়া’, কেউ বলে ‘পুতুল’, সন্দেহজনক অন্য সম্পর্কের কথা যে দু’একজন বলে না, এমন নয়। গোরা পাত্তা দেয় না। তার সামনে মুখ খোলে না কেউ। আসরে বসতে গোরাকে মাধব ডাকলেও তার দ্বিধা দেখে ঈশ্বরপুরী রেহাই দিল তাকে। বলল, কাল-ই নিজের লেখা পুঁথির ভুলত্রুটি সংশোধন করে নিতে নিমাই পণ্ডিতের কাছে সে যাবে। গোরার মুখ দেখে ঈশ্বরপুরী বুঝল, তার কথাতে জগন্নাথ মিশ্রের পণ্ডিত সন্তানটি খুশি হয়েছে। তরুণ পণ্ডিতকে আরও আপন করে নিতে ঈশ্বরপুরী জানাল, নিমাই পণ্ডিতের সঙ্গে আগে তার পরিচয় না হলেও গুরুভাই অদ্বৈতের মুখ থেকে তরুণ পণ্ডিত সম্পর্কে প্রভূত প্রশস্তি সে শুনেছে। জগন্নাথ মিশ্রের সঙ্গে তার শুধু পরিচয় ছিল বললে—কম বলা হয়, কুড়ি-একুশ বছর আগে আতিথ্য ভিক্ষা করে দু’রাত কাটিয়ে গিয়েছিল। ঈশ্বরপুরীর কথায় মাধব পণ্ডিতের পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। গুরু মাধবেন্দ্র পুরীকে নিয়ে সেবার খুব ধুমধাম করে জগন্নাথের বাড়ির অঙ্গনে বৈষ্ণব মহোৎসব হয়েছিল। সেই মহোৎসবের সময়ে গোরা যে কোলের শিশু ছিল, ঈশ্বরপুরীকে স্মরণ করিয়ে দিল মাধব।

ঈশ্বরপুরী আর মাধবের সহৃদয় স্মৃতিচারণ শুনতে গোরার ভালো লাগছিল। প্রকৃত সৎ বিনয়ী অথচ তেজস্বী এক বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর এই প্রথম দেখা পেল সে। ঈশ্বরপুরীকে প্রথম দর্শনে গোরার যতটা পছন্দ হয়েছিল, পুরীগোঁসাই পুঁথি সংশোধন করার অনুরোধ জানাতে তা আরও বাড়ল, তার পাণ্ডিত্যাভিমান তৃপ্ত হলেও মুখে সে কিছু বলল না। পুঁথি শুধরে দেওয়ার প্রস্তাব হৃষ্ট মনে মেনে নিয়ে পরের দিন বিকেলে তার বাড়িতে পুরীগোঁসাইকে আতিথ্য ভিক্ষা গ্ৰহণ করতে অনুরোধ জানাল। অনুরোধ স্বীকার করে নিল সন্ন্যাসীপ্রবর। কৃষ্ণলীলামৃত পাঠের আসর ছেড়ে গোরার সঙ্গী হতে গদাধর ব্যাকুল হলেও বাপের ভয়ে চাটাই ছেড়ে উঠতে পারল না। গোরার চেয়ে গদাধর বয়সে কয়েক বছরের ছোট হলেও গঙ্গাধর পণ্ডিতের টোলে দু’জন সহাধ্যায়ী ছিল। টোলের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম দিকে গদাধর, বয়োজ্যেষ্ঠ মুরারির ন্যাওটা থাকলেও ক্রমশ মনের টানে গোরার ছায়াসঙ্গী হয়ে তার পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকল। গোরাকে পথে কোথাও দেখলে কাছাকাছি গদাধরকে পাওয়া যাবে, রামচন্দ্রপুরের মানুষ যেমন অবলীলায় বুঝে যেত, তেমনি গদাধরকে দেখলে অদূরে গোরা রয়েছে, আন্দাজ করতে তাদের অসুবিধে হত না। গোরাকে নিয়ে গদাধরের সঙ্গে ফিচেল কারও ঠাট্টা তামাশার ইচ্ছে জাগলে যে কোনও মুহূর্তে গোরার উপস্থিত হওয়া অনিবার্য জেনে, মনের ইচ্ছে সংবরণ করত। ইচ্ছেটা মনেই রেখে দিত। গোরাকে নিয়ে তার সামনে লঘু ঠাট্টা ইয়ার্কি মারার সাহস কারও ছিল না। কত বিখ্যাত মল্লযোদ্ধাকে কুস্তির আখড়ায় ডেকে এনে গোরা কুপোকাত করেছে, তার যেমন হিসেব ছিল না, তেমনি কত অন্যায়কারী বাহুবলীকে পথেঘাটে বেধড়ক ঠেঙিয়েছে, সে সংখ্যা কেউ মনে রাখেনি। পাড়াপড়শি যেমন তার অসম্ভব দৈহিক ক্ষমতা সম্পর্কে জানত, তেমনই জানত সে রীতিমতো মারকুটে, বদ স্বভাবের লোক, হাতের কাছে পেলে যখন তখন পিটিয়ে দিতে পারে। গোরা, গদাধরের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আড়ালে আবডালে কানাকানি হলেও গোরার সামনে খোঁচা মেরে কথা বলতে কেউ সাহস পেত না।

পরের দিন বিকেলে টোলের পাট শেষ করে গোরা ঘরে ফেরার অল্পক্ষণ পরে, গদাধরকে সঙ্গী করে ঈশ্বরপুরী সেখানে হাজির হল। ঈশ্বরপুরীকে পৌঁছে দিয়ে গদাধর ফিরে যেতে চাইলে গোরা আটকে দিল তাকে। গোরার অনুরোধে গদাধর থেকে গেল। ‘শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত’ পুঁথি নিয়ে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে গোরা বসল। ঈশ্বরপুরীকে সভক্তি প্রণাম করে শচীদেবী বৃহদাকার রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে গেল। দু’সন্ধে গোরার বাড়ির দাওয়ায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত নিজের লেখা পুঁথি পড়ে শোনাল ঈশ্বরপুরী। শ্রোতা দুজন—গোরা আর গদাধর। মাঝে মাঝে শ্লোক আর শব্দের ব্যাখ্যা, ভাষ্য শোনাল গোরাকে। প্রদীপের আলোয় কৃষ্ণভক্ত ঈশ্বরপুরীর আরাধ্য দেবতার লীলাকাহিনী টিকা ভাষ্যসমেত পাঠ শুনে, গোরা মুগ্ধ হলেও আন্তরিক ভাবোদ্বেলতার চেয়ে পুঁথির ব্যাকরণগত কিছু ত্রুটি তার কানে খোঁচা মারছিল। দ্বিতীয় সন্ধেতে পাঠ শেষ হতে পুঁথিতে কিছু ব্যাকরণগত অশুদ্ধির নিদর্শন, পরস্মৈপদী ক্রিয়ার বদলে আত্মনেপদী ক্রিয়ার বহুল ব্যবহার প্রসঙ্গে গোরা উল্লেখ করতে লীলামৃত রচনাকার, ঈশ্বরপুরী প্রথমে থতমত খেলেও পরের মুহূর্তে জানাল, কর্তব্যকর্ম যথাযথ পালন করতে পরস্মৈপদী ক্রিয়া ব্যবহারের চেয়ে আত্মনেপদী ক্রিয়া প্রয়োগ করলে অবরুদ্ধ ভক্তহৃদয়ের দরজা খুলে যায়।

পুঁথিতে শ্রোতার জন্যে কর্তব্যনির্দেশক ধাতু ব্যবহারের অনুপস্থিতি যে একটি বড় ত্রুটি, গোরা একথা পুরীগোঁসাইকে শত চেষ্টাতেও বোঝাতে পারল না। নিজের পাণ্ডিত্যাভিমানে গোরা যখন অনড় হয়ে উঠছে, ঈশ্বরপুরী সবিনয়ে জানাল, সে শূদ্রাধম’ দীনের চেয়ে দীন কর্তব্যনির্দেশক ক্রিয়াপদ’ প্রয়োগ করার অধিকার তার নেই, সে শুধু নিজের সাধ্য মতো ধর্মাচরণব্রতী, ধাতুবিহীন নিজের আত্মকথনে, জ্ঞান দেওয়ার অধিকার তার নেই। সে শুধু ভক্ত, তার বেশি নয়।

ঈশ্বরপুরীর শেষ কথাটা শুনে গোরা চমকে গেল। আত্মকথনে যে ধাতু দরকার হয় না, অনেক প্রগাঢ় বাণী, ভাববাচ্যে নিজেকে শোনানো যায়, গোরা অনুভব করল। বাণীপ্রচারের চেয়ে নিজেকে জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে মানুষের সামনে হাজির করা সর্বোত্তম ক্রিয়া, এমন কঠিন সত্যকে কীভাবে এই সন্ন্যাসী অধিগত করল, গোরার মনে এই প্রশ্ন জাগার সঙ্গে উত্তর তৈরি হয়ে গেল। মন্ত্রটা হল, ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখায়।’ পরিব্রাজক ভক্ত, সন্ন্যাসী ঈশ্বরপুরী আত্মনেপদী ধাতুর প্রয়োগবিধি বোঝাতে নিজের জীবনকে উদাহরণ হিসেবে খাড়া করে, নিজেকে ‘শূদ্রাধম’ অভিহিত করে সে চিরস্মরণীয় শিক্ষা দিল, তা অনুভব করে গোরা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে দেখল, চোখের সামনে অন্ধকার তারাভরা আকাশ থেকে তার জন্যে এক বিশাল কর্মসূচি টাঙানো রয়েছে। রাতের পরিষ্কার নীল আকাশে বিদ্যুতের চিকুর কেটে খোদিত সেই কর্মসূচি সে পড়ে ওঠার আগে আলোর হরফগুলো দিগন্তে মিলিয়ে গেল। ঈশ্বরপুরীকে গোরা জানাল, আত্মনেপদী ধাতু ব্যবহারের উপযুক্ত শিক্ষা তার না ঘটলেও সদ্য এক পংক্তি তার মাথায় এসেছে। পংক্তিটি ঈশ্বরপুরী শুনতে চাইলে গোরা আবৃত্তি করল, “আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়।” শ্লোকের মতো এই বাক্যটি প্রথমবার শুনে পুরীগোঁসাই-এর আশ মিটল না। দ্বিতীয় বার সে শুনতে চাইলে, গোরা ফের আওড়ালো। সে থামতে তাকে দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিল ঈশ্বরপুরী। প্রসন্নমুখ ঈশ্বরপুরী বলল, আত্মনেপদী ধাতুর উদাহরণ হিসেবে তোমার উচ্চারিত এই পংক্তি বাঙালি জনসমাজ চিরকাল মনে রাখবে।

ঈশ্বরপুরীর কথাতে গোরা বিনীতভাবে হাসল। উদ্ধত গোরাকে এত ভদ্র, বিনয়ী আচরণ করতে গদাধর আগে দেখেনি। দু’জনের মধ্যে সাঙ্কেতিক কোনও ভাববিনিময় চলছে, আগের সন্ধে থেকে গদাধর অনুমান করছিল। তা আরও দৃঢ় হল। গুরুর আদেশে দেশজুড়ে ঈশ্বরপুরী ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার আধ্যাত্মিক বীজ বুনে চলেছে, বাবা মাধব পণ্ডিতের মুখ থেকে এই গোপন তত্ত্ব কয়েকদিন আগে গদাধর শুনেছে। বীজ বপনের কাজে নায়ক হয়ে উঠবে গোরা, এবং তার পাশে আমৃত্যু তাকে থাকতে হবে, গদাধর তখন জানত না। কয়েক বছর বাদে জেনছিল। গোরার মুখ থেকে ‘আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়’ পংক্তিটি শুনে সে মনের মধ্যে ঝাঁকুনি খেল। আগেও কয়েকবার, যখন গোরা বলেছিল আমার বিরুদ্ধে ‘গুরুচণ্ডালী দোষে’র অভিযোগ যারা আনছে, তারা জানে না, কলিযুগে ‘গুরুচণ্ডালী দোষ’ আসলে মহাগুণ। গুরু আর চণ্ডালে এখন একাকার হয়ে থাকার সময়।

পুরনো কথা গদাধরের মনে পড়তে সে শোনায় ঈশ্বরপুরীকে। নবদ্বীপের টোলে ছাত্রদের কাছে নিমাই পণ্ডিত ‘গুরুচণ্ডালী’ গুণের মহিমা ব্যাখ্যা করেছে শুনে ভাবাতুর হর ঈশ্বরপুরী। অশ্রুসজল হল তার দু’চোখ। নবদ্বীপে এবারের পরিক্রমায় হরিদাস আর গোরাকে পেয়ে, সাধুসমাজ প্রতিষ্ঠার অবশ্যম্ভাবী ঘণ্টাধ্বনি শুনল। সাত দিনের মধ্যে মাধব পণ্ডিতকৃত ‘শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত’ পাণ্ডুলিপির নিখুঁত, নির্ভুল অনুলিপি ঈশ্বরপুরীর হাতে এসে গেলেও তখনই নবদ্বীপ ছেড়ে সেই কৃষ্ণভক্ত সন্ন্যাসী পরিব্রাজনে বেরোল না। গঙ্গার তীরে আরও পনেরো দিন একাধিক ভক্তের বাড়িতে আতিথ্য ভিক্ষা করে কাটাল। পুরীগোঁসাই-এর সংসর্গে নবদ্বীপের বৈষ্ণবমণ্ডলী যেমন উদ্বুদ্ধ হল, তেমনি প্রকৃত এক বৈষ্ণব সাধকের সান্নিধ্যে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে গোরার ধারণার কিছু রদবদল ঘটল। নবদ্বীপের বৈষ্ণবকুলকে নিয়ে সংযত হল তার রঙ্গ-রসিকতা। বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার সঙ্কল্প না করলেও বৈষ্ণবতত্ত্ব যে রাতে ঘারের কপাট এঁটে ভীত নবদ্বীপবাসীর অর্ধস্ফুট নামসংকীর্তনের চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার, গোরা উপলব্ধি করল। লক্ষ্মীর সঙ্গে তার প্রথম বিয়ের সময়ে হঠাৎ কুবের নবদ্বীপে এসে তার সাধুসঙ্গ করার যে অভিজ্ঞতা শুনিয়েছিল, সেখানে বৈষ্ণব ধর্ম এবং সেই ধর্মের নেতা, সচল সন্ন্যাসী, মাধবেন্দ্র পুরীর প্রীতিস্নিগ্ধ, তেজস্বী ব্যক্তিত্বের বিবরণই ছিল বেশি। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চার বর্গের ওপরে যে প্রীতি, যাকে বৈষ্ণব তত্ত্বে পঞ্চম বর্গ বলা হয়েছে, এই পাঁচ বর্গকে মালার মতো গেঁথে রেখেছে সাধক হৃদয়ের সাহস আর তেজস্বিতা। কুবেরের মুখ থেকে কয়েক বছর আগে বৈষ্ণব সাধক সম্পর্কে শোনা কথাগুলোর জীবন্ত প্রতিমূর্তি, ঈশ্বরপুরীকে নবদ্বীপে দেখতে পাবে, গোরার কল্পনায় ছিল না। ঈশ্বরপুরীর সান্নিধ্যে কয়েকদিন কাটিয়ে, তার গুরুভাই, বৃদ্ধ অদ্বৈত আচার্য, যে কিনা মা শচীর দীক্ষাগুরু, সে যে হেলাফেলার লোক নয়, গোরা এই প্রথম স্পষ্ট করে বুঝতে পারল। ঈশ্বরপুরীর অনুপস্থিতিতে তার গুরুভাই, অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলার চিন্তা তার মাথায় উদয় হল।

নবদ্বীপে নির্ধারিত সময়ের বাইরে বাড়তি পনেরো দিন ঈশ্বরপুরী কেন কাটিয়ে গেল, তা গোরার কাছে মানুষটি ভাঙল, পরিব্রাজন শুরুর আগের দিন। নবদ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগে, গোরাকে একান্তে ডেকে বুকে কাঁপন ধরানো সদ্য সংগ্রহ করা এমন কিছু খবর ঈশ্বরপুরী শোনাল, যার বিন্দুবিসর্গ গোরা জানত না। গোরাকে সতর্ক থাকতে দরকার হলে কিছুদিন নবদ্বীপের বাইরে গা-ঢাকা দিয়ে থাকার পরামর্শ দিল পুরীগোঁসাই। গোরাকে পুরীগোঁসাই যা জানাল, তা এরকম।

গৌড়ের রাজা গণেশের প্রপৌত্রের পুত্রসন্তানের খোঁজে গণেশের মৃত্যুর প্রায় একশ’ বছর পরে, সম্প্রতি গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের সিন্ধুকীবাহিনী (গুপ্তচরের দল), গোটা গৌড়-বাঙ্গলায় চিরুনি তল্লাশি শুরু করে বেশ কিছু তরুণ, যুবককে সন্দেহের বশে রাজধানী একডালার কারাগারে কয়েদ করে রেখেছে। তাদের কীভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, সুলতানি দরবারে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। পনেরো, কুড়ি বছর আগে বেশ কয়েকবার সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের খোঁজে সুলতানের গুপ্তচরবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। একদা গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেনের বংশধরদের কেউ চক্রান্তের মাথা, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী হিন্দুরা মদত করছে তাদের, গোপন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে সুলতানের মনে এই সন্দেহ জেগেছিল। ঈশ্বরপুরীর কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেও গোরা বলল না, চার বছর আগে এমন এক সুলতানি গুপ্তচরবাহিনীর তাড়ায় দেশান্তরী হতে হয়েছিল তাকে। নবদ্বীপ ছেড়ে শ্রীহট্টে তিন মাসের চেয়ে বেশি সময় থাকতে বাধ্য হয়েছিল। ঘরে ফিরে দেখেছিল, স্ত্রী লক্ষ্মী, পৃথিবী ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গেছে। দ্বিতীয়বার, বিষ্ণুপ্রিয়াকে বধূ করে ঘরে এনেও লক্ষ্মীকে হারানোর দুঃখ আজও তার মন থেকে যায়নি। বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে নতুন করে সংসার পাতার পরেও গৃহধর্মে কেন আন্তরিকভাবে মন বসাতে পারছে না, এ প্রশ্নের জবাব গোরার কাছে নেই।

ফি বারের মতো সেবারেও লক্ষ্মণ সেনের বংশধর খুঁজে নাকাল হয়েছিল সুলতানের সিন্ধুকীরা। নবদ্বীপে ফিরে লক্ষ্মীর মৃত্যুসংবাদের সঙ্গে গোরা জেনেছিল, তার অনুপস্থিতির সময়ে বাড়িতে সুলতানি ফৌজ হামলা করেনি। রাজা লক্ষ্মণ সেনের বংশলতিকায় কোনওভাবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করার মতো যোগসাজশ, সুলতানি মন্ত্রণালয় খুঁজে পায়নি। কিছুকালের জন্যে তাদের তল্লাশিতে আলগা ভাব এসেছিল। ঈশ্বপুরীর মুখ থেকে গোরা শুনল চক্রান্তকারী খোঁজার কাজ নতুন হিজরি অব্দের পঞ্জিকার গণনা মেনে নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে। রাজা লক্ষ্মণ সেনের উত্তরসূরির বদলে অদূর গৌড়ের রাজা গণেশের কোনও বংশধরের নাম এই মুহূর্তে দরবারের জ্যোতিষী রব্বানির ছকে ফুটে উঠেছে। রাজা গণেশের পরিবারের কোনও পুত্রসন্তান সুলতানি মসনদ দখলের জন্যে রাঢ় বাঙ্গলার অজ্ঞাত ঠিকানায় ওৎ পেতে বসে আছে, তার খোঁজে চলেছে গোপন অভিযান। সিন্ধুকীদের সঙ্গে সুলতানি গুপ্তঘাতকবাহিনী নেমে পড়েছে এ কাজে।

ঈশ্বরপুরী বলছিল, ক্ষমতাসীনরা সবসময়ে চারপাশে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। ঘরে বাইরে দেখতে পায় চক্রান্তকারী প্রতিপক্ষকে। নিজের ছায়া দেখে চমকে ওঠে। তাদের মতো কানপাতলা, পেটআলগা, প্রতিহিংসাপরায়ণ লোক সচরাচর দেখা যায় না। ক্ষমতার পরিমণ্ডলই তাদের বুদ্ধিনাশ করে, তাদের ইতর, অমানুষ করে তোলে। একদা গৌড়ের মুলুকপতি সুবুদ্ধি রায়ের অনুগত কর্মচারী, সৈয়দ হোসেন, যে ছিল সাদাসিধে, সরল, দিলখোলা মানুষ, ঘটনাচক্রে সে সুলতানি মসনদ দখল করে কয়েক বছরের মধ্যে হয়ে গেল ছাঁচে ঢালা, রাজ্যসম্পদলোভী, সন্দিগ্ধ, নিষ্ঠুর, প্রতিহিংসাপরায়ণ রাষ্ট্রশাসক সুলতান হোসেন শাহ। পুরনো মনিব সুবুদ্ধি রায়ের ধর্মনাশ করে, দেড় সের ফুটন্ত ঘি খেয়ে তার প্রায়শ্চিত্তের যে বিধান, অনুগত ব্রাহ্মণদের উৎকোচ দিয়ে সুলতান বার করে আনল, তার জেরে দেশ ছাড়তে সুবুদ্ধি বাধ্য হয়েছিল। জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে ফুটন্ত দেড় সের ঘি খাওয়ার হুকুম যে আসলে মৃত্যুদণ্ড, সুবুদ্ধি বুঝেছিল। সুলতানের বিরুদ্ধে চক্রান্তের প্রসঙ্গ সেই থেকে দরবারে উঠলেই সুবুদ্ধি রায়ের নাম এসে যায়। সুলতানকে উৎখাত করে গৌড়ের মসনদ দখল করতে বছরের পর বছর ধরে সুবুদ্ধি ঘোঁট পাকাচ্ছে, এমন কাহিনী গৌড়ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। সুলতানি শাসনকে উচ্ছন্নে পাঠানোর চক্রান্তে সুবুদ্ধির যোগসাজশে, রাজা গণেশের কোনও এক উত্তরসূরি লিপ্ত হয়েছে, তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, দু’হাজার বছর ধরে আর্যাবর্ত জুড়ে তাণ্ডব সৃষ্টিকারী, সেই অমিতশক্তিসম্পন্ন জাদুকরও যোদ্ধা কৃষ্ণ। সে আর্য না হলেও ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে পালের গোদা, আর্যরা তাকে ভয় পায়, সম্মান সমীহ করে, অবতারের মর্যাদা দেয়। চক্রান্তকারী এই জোটের খবর সুলতানের কানে যেতে সে সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে। গোপন এই খবর দরবারের আমীর ওমরাহরা এখনও না জানলেও সুলতানের এক অন্তরঙ্গের কাছ থেকে ঈশ্বরপুরী পেয়েছে।

ঈশ্বরপুরী বলছিল, দেশে সুলতানি শাসন শুরু হওয়ার আগে থেকে অত্যাচারী, প্রজাপীড়ক রাজপুরুষরা ঘুমে, জাগরণে কৃষ্ণের ভূত দেখছিল। যেখানে অন্যায়, সেখানে প্রতিরোধ, সেখানে কৃষ্ণ। যেখানে উৎপীড়ন, সেখানে প্রতিরোধ, যথারীতি সেখানে কৃষ্ণ। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের পাতায় পাতায় হরেক নামে কৃষ্ণকথা, কৃষ্ণস্তুতি, কৃষ্ণভজনা, নানা অলৌকিক কাণ্ড! লোকিক, অলৌকিকে তখন বিশেষ তফাত ছিল না। দেবতা আর মানুষের মধ্যে খুব বেশি এক বিঘৎ ব্যবধান ছিল। স্বর্গ আর মর্ত্য ছিল পাশাপাশি দুটো গ্রাম। ভারতীয় সভ্যতার সেই শৈশবে এই ভূখণ্ডের মানুষের ধ্যানধারণা, বিশ্বাস ছিল শিশুসুলভ সরল। শিশুর সারল্যের আভ্যন্তরীণ প্রাজ্ঞতা কৃষ্ণচরিত্র নির্মাণে ছাপ ফেলেছিল। কৃষ্ণ আসলে কি, ঈশ্বর, না মানুষ এ নিয়ে আর্যাবর্তের মানুষের মনে ধন্দ থাকলেও, তিনি যে সঙ্কটত্রাতা, মানুষ হলে পুরুষশ্রেষ্ঠ, দেবতা হলে, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের নিয়ন্তা, এ নিয়ে শিক্ষিত, নিরক্ষর, কারও সন্দেহ ছিল না। তাদের কাব্য গান প্রবাদ প্রবচন আকীর্ণ করে আছে কৃষ্ণ-মাহাত্ম্যের কাহিনী, ঈশ্বরপুরীর লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত’ পুঁথির বিষয়ও তাই। দেশের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে থাকা কৃষ্ণমহিমার কাহিনী শুনে, ভারতের বাইরে নানা দেশ থেকে আসা বিবিধধর্মী শাসক আর তাদের অনুচরেরা আতঙ্কিত হয়েছিল। কয়েক’শ বছরে সে ভয় কাটেনি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষ্ণভক্তদের চোখে, কোথাও মানুষটা ছিল ননীচোর শিশু, কোথাও দুরন্ত কিশোর, কখনও তরুণ প্রেমিক, পরাক্রান্ত সাহসী যোদ্ধা, দার্শনিক, মহাযুদ্ধে রথের সারথি, তীক্ষ্ণবুদ্ধি জাদুকর, সব মিলে যুগে যুগে নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত ঈশ্বরের অবতার। মাহদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আর্যাবর্তের নানা প্রদেশে যারা ক্ষমতাসীন হত, পুরাকালের কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত অসংখ্য লোককথা, কিংবদন্তি শুনে তাদের ধারণা হয়েছিল, লোকটা তন্ত্রসিদ্ধ মনুষ্যরূপী পিশাচ, নিজের জন্মমৃত্যুর জাদুকাঠি তার মুঠোয় ধরা রয়েছে। শাসকদের মসনদ নিষ্কণ্টক করতে তাদের স্বধর্মী আমীর ওমরাহ থেকে শুরু করে মেরুদণ্ডহীন অর্থ, যশলোভী ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিত, জ্যোতিষী পর্যন্ত সবাই, শাসককুলের মন রাখা, তোষামুদি পরামর্শ দিত। বিভিন্ন অবলুপ্ত হিন্দু রাজবংশের প্রকাশ্য আর প্রচ্ছন্ন ধারার কোথায় কে চক্রান্তকারী লুকিয়ে আছে, সম্ভবত সেই কৃষ্ণ, কল্পকথা মেশা এমন এক বাস্তব, কয়েক’শ বছর ধরে রাজপুরুষদের কানে ক্রমাগত তুলে দিয়ে তারা লুটেপুটে খাওয়ার হৃদয়হীন এক সামাজিক কাঠামো খাড়া করে তুলেছিল। রাজা গণেশের মৃত্যুর একশ’ বছর পরে তার পরিবার পরম্পরার একাধিক শাখা যে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, আশপাশের অঞ্চলে তখনও বসবাস করছে, গোরাকে এ তথ্য জানিয়ে ঈশ্বরপুরী বলেছিল, আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা এটা নয়। তার চেয়ে বড় হল, রাজা গণেশের বংশলতিকার একজন, যে সুবুদ্ধির বন্ধু, গোরার সমবয়সী, তাকে ধরে আনতে অথবা কোতল করে তার মুণ্ডু নিয়ে আসতে সুলতানি গোপন ফরমান জারি হয়েছে। নবদ্বীপে আসার আগে এ খবর বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পুরীগোঁসাই পেয়েছিল। মাধব পণ্ডিতের ঘরে প্রদীপের আলোয় গোরাকে প্রথম দেখে রাজা গণেশের উত্তরপুরুষকে দেখার বিভ্রম হয়েছিল তার।

ঈশ্বরপুরীর বিবরণে গোরা মুখে আবছা হাসি জাগল। গোরার কাছে বিষয়টা আরও প্রাঞ্জল করতে ঈশ্বরপুরী বলল, খুব বেশি একশ’ বছর আগে গৌড়ে সুলতানি জমানা উৎখাত করে সিংহাসনে বসেছিল রাজা গণেশ। বরেন্দ্রভূমের ব্রাহ্মণরা ছিল রাজা গণেশের মন্ত্রণাদাতা, পৃষ্ঠপোষক। গৌড়ে গণেশ ক্ষমতাসীন হতে আমীর ওমরাহ মুসলিম ধর্মনেতারা ভয় পেয়ে পুনর্বার সুলতানি শাসন কায়েম করতে চক্রান্ত শুরু করে দিল। ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ গণেশের ছেলে জিতমল্লকে হাতের কাছে চক্রান্তকারীরা পেয়ে গেল। রাজা গণেশের ছেলে, জিতমল্ল (জয়মল্লও হতে পারে) চালু নাম যদু, চক্রান্ত করে নিজের বাবা, রাজা গণেশকে খুন করিয়ে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেছিল। রাজা গণেশকে খুন করে জিতমল্ল সিংহাসনে বসলেও গৌড়ে বেশিদিন হিন্দুশাসন কায়েম রাখা গেল না। শত্রু পরিবৃত যদু ক্ষমতা সুরক্ষিত করতে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীর পরামর্শে ধর্মান্তরিত হয়ে নাম নিল, জালালুদ্দিন ফতে শাহ। সসৈন্যে সুলতান ইব্রাহিম শর্কী, জৌনপুর থেকে গৌড়ে এসে, বলা যায় গায়ের জোরে গণেশকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে তাকে সাহায্য করেছিল যদু। সুলতান ইব্রাহিম শর্কীর কাছে নিজের আনুগত্য প্রমাণ করতে জালালুদ্দিন না হয়ে যদুর উপায় ছিল না। গৌড়ের সিংহাসন থেকে রাজা গণেশকে সরাতে জৌনপুরের সুলতান, ইব্রাহিম শর্কীকে ডেকে এনেছিল মুসলিম দরবেশদের নেতা, নুর কুত্ব আলম। তখনও রাঢ় বাঙ্গলার রাজধানী ছিল পাণ্ডুয়া। দরবেশ ফকিরদের ঘাঁটি ছিল সেখানে। পাণ্ডুয়াতেই ছিল নুর কুত্ব-এর দরগা। সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের দরবারে সুলতানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ‘অন্তরঙ্গ’ সম্মাননীয় মহাজ্যোতিষীর আসন পেল নুর কুত্ব আলম। গৌড়ের বিধর্মী রাজা গণেশের অত্যাচার থেকে মুসলিম প্রজাদের বাঁচাতে জৌনপুরের সুলতান, ঈব্রাহিম শেকীকে ঘোর উত্তেজনাপূর্ণ চিঠি পাঠিয়ে, গৌড় বাঙ্গলার শাসনকর্তা বদল করার যে কর্মসূচি দরবেশ নেতা ছকেছিল, তা সফল হতে সে হাতে হাতে পুরস্কার পেয়ে গেল। দরবেশ নুর কুত্ব-এর উদ্দেশ্য সাময়িকভাবে সিদ্ধ হলেও অল্পকালের মধ্যে ঘটনার চাকা ঘুরে গেল। কারাগারে নিহত রাজা গণেশের সন্তান যদুকে সিংহাসনে বসিয়ে গৌড় ছেড়ে সুলতান ইব্রাহিম শর্কী জৌনপুরে ফিরে যেতে মৃত রাজা গণেশ যেন আকাশ থেকে সশরীরে নেমে এল। রাজার অলৌকিক প্রত্যাবর্তনে তার বরেন্দ্রীপাত্রমিত্র, অমাত্য, পরিবার, পরিজন, প্রজামণ্ডলী উল্লাসে ফেটে পড়ে তাকে স্বাগত জানাল। সুলতান ফতেহ জালালুদ্দিনকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে তাকে কারাগারে পুরে গণেশ আবার প্রজাপালক রাজার ভূমিকা গ্রহণ করল। কারারুদ্ধ ছেলেকে যথাবিহিত প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে তার পুরনো হিন্দু পরিচয়ে ফিরিয়ে আনল রাজা গণেশ। সমাজ, সংসারে নতুন করে তার প্রতিষ্ঠা ঘটল। হিন্দুধর্মে পুনঃপ্রবেশে যদুর অনিচ্ছা থাকলেও ছেলের আবদারে গণেশ কান দিল না। হিন্দুত্বে যদুকে ফিরিয়ে এনেও তাকে কারাগার থেকে তখনই গণেশ মুক্তি দিল না। পাণ্ডুয়া থেকে গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তর করার পরে ছেলেকে কারামুক্ত করল রাজা গণেশ। হিন্দুবৃত্তে জালালুদ্দিন ফিরে এলেও প্রতিহিংসার বাসনা মনে পুষে রাখল। গৌড়ের সিংহাসন হাতাতে নতুন করে অতি গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিছোতে থাকল।

শত্রুপরিবেষ্টিত রাজা গণেশ আত্মরক্ষার জন্যে সবরকম আটঘাট বেঁধে ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে দ্বিতীয়বার অবতীর্ণ হয়েছিল। সিংহাসনে বসার আগে শাস্ত্রীয় নিয়মনির্দেশ মেনে, গণেশ নাম পাল্টে নতুন নাম নিল, পরমভট্টারক মহাকুলপতি রাজা দনুজমর্দনদেব। বড় ছেলে জিতমল্লের প্রতি স্নেহ থাকলেও তার ক্ষমতালোভী, অন্তর্ঘাতক মনের খবর রাজা দনুজমর্দনদেবের অজানা ছিল না। ক্ষমতাসীন হয়ে, গৌড়ে রাজধানী সরিয়ে এনে তাই রাজা দনুজমর্দনদেব সবকিছুর আগে ছোট ছেলে মহন্দ্রেদেবকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করল, দনুজমর্দনের অবর্তমানে সিংহাসনের উত্তরাধিকার যে যুবরাজ মহেন্দ্রদেব পাবে, তা সাড়ম্বরে জানিয়ে দিল। তবু ঘরের শত্রু যদুকে প্রাসাদে পুষতে রাজার অস্বস্তির সীমা ছিল না। কিন্তু নিজের ঔরসজাত সন্তানকে হত্যা করা যায় না। শুলে চাপিয়ে অথবা কৃপাণের এক কোপে, মুহূর্তে তার ধড়, মুণ্ডু, আলাদা করে পৃথিবী থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হলেও অন্ধ স্নেহে, অনেক কষ্টে নিজেকে বিরত রাখল রাজা দনুজমর্দনদেব। যুবরাজ মহেন্দ্রদেব নিয়মানুযায়ী সিংহাসনে বসলেও দু’বছরের বেশি রাজত্ব করতে পারেনি। স্বধর্মে প্রত্যাগত যদুর খোলস ছেড়ে ততদিনে জালালুদ্দিন বেরিয়ে এসেছে। তার-ই নিযুক্ত গুপ্ত ঘাতকের হাতে গৌড়ের রাজা মহেন্দ্রদেব খুন হয়ে যেতে দ্বিতীয় দফায় সিংহাসনে বসল যদু ওরফে জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ।

পুরীগোঁসাই বলে চলেছে রাজকাহিনী। ভূয়োদর্শী সন্ন্যাসীর দেশকাল, চেতনা, ইতিহাসবোধে মুগ্ধ গোরা শুনে চলেছে গৌড়ের বিস্তৃত ইতিহাস। ঈশ্বরপুরী বলল, রাজা গণেশের একাধিক মহিষী আর বেগম ছিল। পাটরানীর দুই পুত্রসন্তান, জিতমল্ল, মহেন্দ্ৰ দেব ছাড়া একাধিক মহিষীর ছেলেমেয়েরা ছিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ জালালুদ্দিন সিংহাসনে দ্বিতীয়বার ফিরে আসতে রাজা গণেশ ওরফে রাজা দনুজমর্দনদেবের দু’তরফের ছেলেমেয়েরা ভয়ে গুটিয়ে গেল। পুত্রসন্তানদের কেউ কেউ গৌড় ছেড়ে পালাল। তাদের দু’একজন নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কুমারহট্ট, কাটোয়ায় ডেরা করতে পারে সুলতান জালালুদ্দিনের কানে এ খবর .পৌঁছলেও পাশে পান্ডুয়ায়, রাজা কংসের উত্থানে প্রথমে সে হতবাক হলেও পরে ভয় পেয়েছিল। রাজধানী গৌড়কে জালালুদ্দিন যখন দুর্ভেদ্য করে সাজিয়ে তুলছে, সিন্ধুকীদের কাছ থেকে পাণ্ডুয়ার বিবিধ সংবাদ পৌঁছাচ্ছিল সুলতানি দরবারে। সবচেয়ে ভয় পাওয়ার খবর ছিল, রাজা কংস আসলে পুত্রের হাতে নিহত রাজা গণেশ বা রাজা দনুজমর্দনদেব। যদুর গুপ্তঘাতকরা প্রথমে রাজা গণেশ, পরে রাজা দনুজমর্দনদেব ভেবে যে দু’জনকে খুন করেছিল, তারা অন্য লোক। ঘাতকদের চোখে ধুলো দিয়ে রাজা গণেশকে বাঁচাতে তার ঘনিষ্ঠ অমাত্যবাহিনী প্রহেলিকাময় ব্যূহ রচনা করেছিল। প্রকৃত রাজা গণেশ-ই গৌড়বাসীকে রক্ষা করতে রাজা কংস নামে পাণ্ডুয়ায় অবতীর্ণ হয়েছে। রাজা গণেশ শুধু প্রজাপালক, জনপ্রিয় বীর রাষ্ট্রশাসক নয়, কৃয়ের মত সেও দক্ষ ঐন্দ্রজালিক, বাঁশিবাদক প্রেমিক। রাজা কংস সম্ভবত পুরাণের কৃষ্ণ, এ গুজব রটে যাওয়ার পরে গৌড়ের শূদ্র, ম্লেচ্ছ হাজার হাজার প্রজা ভিটেমাটি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পান্ডুয়ায় পালিয়ে যাচ্ছিল। রাজা কংসের প্রশাসকরা সেখানে তাদের সংসার পাততে দু’হাত বাড়িয়ে, নিষ্কর চাষের জমি দিয়ে সাহায্য করছিল। রাজা কংসের নাম গোরা শুনলেও পাণ্ডুয়ার রাজপরিবারের এত কাহিনী তার জানা ছিল না। আপাত বিচারে মৃত রাজা গণেশ যে মৃত্যুর পরে দু’বার নবজন্ম পেয়ে, প্রথমে দনুজমর্দনদেব, পরে কংস নাম নিয়ে প্রবল প্রতাপ আর গভীর জনহিতৈষণায় গৌড় শাসন করেছিল, এ কাহিনী বিহ্বল করল গোরাকে। কথকঠাকুরের মুখে গাঁয়ের চণ্ডীমণ্ডপে বসে গৌড়ের রাজা দনুজমর্দনদেবের বীরত্বের কিছু বিবরণ তার শোনা ছিল। দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তী শুনিয়েছিল, রাজা দনুজমর্দনদেবের সভাকবি, কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরাম পাঁচালী’ লেখার কাহিনী। মূল শ্রীরাম পাঁচালী পুঁথির একটা অনুলিপি অনেক কষ্টে জোগাড় করে সেটা যখের ধনের মতো দাদামশাই আগলে রেখেছে। যথেষ্ট শ্রোতা পেলে, নিজে সেই পুঁথি পাঠ করে শোনালেও কদাপি তা হাতছাড়া করেনি। দাদামশাই ঠাট্টা করে বলে, পুঁথির যতই মাহাত্ম থাকুক, পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরে আসতে পারে না। বলতে পারে না অরসিকের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। মামার বাড়িতে কৃত্তিবাস রচিত শ্রীরামপাঁচালী পাঠ, গোরা যতবার শুনেছে, অঝোরে কেঁদেছে। তার বুকের গভীর থেকে কেন এত চোখের জল উঠে আসত, কার জন্যে সমবেদনায় সে দ্রব হত, বুঝতে পারত না। গাছপালা, পুকুর, মাঠ, মাটি, আকাশের দিকে তাকালেও তখন তার দু’চোখ জলে ভেসে যেত। তবে রাজা গণেশ, রাজা দনুজমর্দনদেব, রাজা কংস যে একই ব্যক্তি জানত না। ঈশ্বরপুরীর আগে কেউ এ তথ্য তাকে জানায়নি। পুরীগোঁসাই-এর মুখ থেকে গৌড়ের ইতিহাস শুনতে সে সয় হয়ে থাকল। নিজের শৈশবে, ঈশ্বরপুরী যখন এসব কাহিনী শুনেছে, তখনও গোরার জন্ম হয়নি। গৌড়, পাণ্ডুয়া ঘিরে রোজ তখন নতুন ঘটনার সমারোহ। পাণ্ডুয়ায় রাজা কংসের উত্থানে ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে সতেজে জেগে উঠেছে বরেন্দ্রভূমি।

প্রাচীন এই ইতিবৃত্ত গোরার শোনার কথা নয়। ঈশ্বরপুরীর চোখে গোরা তো সেদিনের ছেলে! এরকম অসংখ্য ছেলের থেকে গোরাকে আলাদা মনে হতে ব্যতিক্রমী এই শ্রোতাকে ইতিবৃত্ত শোনানো ঈশ্বরপুরীর জরুরি মনে হয়েছিল। আশি বছর বয়সেও খুঁটিনাটি সমেত সেসময়ের স্মৃতিকথা গোরাকে অনর্গল বলছিল ঈশ্বরপুরী। অবরুদ্ধ ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চের পর্দা সরিয়ে ফেলে আসা কয়েকশ’ বছরের বৃত্তান্ত শুরু করে আধ্যাত্মিকতার মোড়ক লাগানো এমন কিছু রাজনৈতিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা শোনাচ্ছিল, যা গোরা আগে না শুনলেও তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছিল না। গভীর অভিনিবেশে পাণ্ডুয়া, গৌড়ের জনজীবনের উত্থানপতনের কাহিনী শোনার সঙ্গে তার ইতিহাস অনুসন্ধিৎসা বেড়ে যাচ্ছিল।

চারশ’ বছর আগে রাজধানী গৌড় ছেড়ে রাজা লক্ষ্মণ সেনের সপরিবারে নদনদী পরিবৃত বাঙ্গলায় পালিয়ে গিয়ে নতুন রাজধানী লক্ষণাবতী নির্মাণ, রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরের ঘটনাবলি, কয়েক পুরুষ পর থেকে এতই ছায়াবৃত যে তার হদিশহীন বংশধর, পৌত্র, প্রপৌত্রদের নাতিপুতির শ্মশানের ছাই ঘেঁটে সুলতানি শাসনের প্রতিপক্ষ খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে মাত্র একশ’ বছর আগের রাজা গণেশের বংশধরদের চেঁচেমুছে সাবাড় করে দেওয়া সুলতানের কাছে বেশি যুক্তিসঙ্গত, জলবৎ তরল মনে হয়েছিল। চোদ্দো পুরুষ আগে গৌড়শাসক, রাজা লক্ষ্মণ সেনের উত্তরাধিকারীদের চেয়ে অনতি অতীতের রাজা গণেশের অধস্তনদের চক্রান্তে গদি হারানোর আশঙ্কা, হোসেন শাহের মনে সর্বদা কাজ করছিল। ক্ষমতা হারানো ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিজাতরা কোনও এক রাজপরিবারের প্রতিনিধিকে সাক্ষিগোপাল দাঁড় করিয়ে, যথেষ্ট শক্তি জড়ো করে যে কোনও মুহূর্তে রাজধানী একডালায় হানা দিতে পারে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সংখ্যাগত প্রাধান্য তাদের কয়েকশ’ বছর ধরে ক্ষমতালিপ্সু করে রেখেছে। দেশের সর্বত্র বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্র তারা করে চলেছে। জাতপাতের বিভাজনের জন্যে সবাইকে এক নিশানের নিচে এখনও জড়ো করতে না পারলেও, অদূর ভবিষ্যতে তা করে ফেললে, তাদের সঙ্গে আর এঁটে ওঠা সম্ভব হবে না। জনসংখ্যার বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠা, তাই সুলতানি শাসননীতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর্যাবর্তে ইসলামি শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে গত পাঁচশ’ বছরে পঞ্চাশ হাজার ইসলামধর্মীকে নানা কৌশলে ত্রিশ লক্ষে রূপান্তরিত করা সম্ভব হলেও ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী জনসংখ্যা এখনও মুসলিমদের দ্বিগুণ, অর্থাৎ ষাট লক্ষের কম নয়। সামনে দুশ’ বছরে আশা করা যায়, দুই ধর্মসম্প্রদায়ের জনসংখ্যাতে ভারসাম্য এসে যাবে। সুলতানি শাসননীতিতে আপাতত ধর্মান্তরিত করা মহা পুণ্যের কাজ। পাশাপাশি আরও একটা কর্মসূচি তাদের ছিল। বাছাই করা সৎ, শ্রদ্ধেয় কিছু ব্রাহ্মণকে সুলতানি প্রশাসনের মাথায় বসিয়ে, তাদের মুঠোয় রাখার সঙ্গে, তাদেরই অনুগামী, এক ঝাঁক বৈদ্য, কায়স্থ যজমানকে মুলুকপতি, মহলপতি, সিপাহসলার, ছত্রী, অন্তরঙ্গ পদে বহাল করে ক্ষমতাচ্যুত সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজকে তাঁবে রাখার বন্দোবস্ত করল সুলতানি রাজনীতি। গোটা সুলতানি আমল জুড়ে সে প্রথা চালু ছিল। সুলতান হোসেন শাহের শাসনকালে তা চোখে পড়ার মতো গুরুত্ব পেল। ক্ষমতাসীনদের কূটনীতিতে কাজ হলেও কূটনীতির ওপরে যে রাজনীতি, সুলতানি শাসনের সেই রাজনীতির বিজয়রথের আগ্রাসন, সদম্ভ এগিয়ে চলা, দরবারের দু’চারজন ব্রাক্ষ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রশাসকের পক্ষে থামানো সম্ভব ছিল না। কূটনীতি বলতে বোঝায়, প্রধানত পরিচ্ছন্ন চেহারার গুপ্তচরবৃত্তি, সিন্ধুকীদের জোগাড় করা তথ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সঠিক সম্প্রসারণ কর্মসূচি বানিয়ে পররাজ্য গ্রাস করা। পররাজ্য গ্রাসের ফৌজি মতাদর্শ হল রাজনীতি, সৈন্যবাহিনীকে সক্রিয় করে, তদের পররাজ্য গ্রাসের প্রবৃত্তি উদ্দীপ্ত করা, তাদের নরখাদক বানিয়ে তোলা। কূটনীতি মানে, হাতে হাত মিলিয়ে রাজপুরুষদের করমর্দন, আলাপ, আলোচনা, গলা নামিয়ে যৎসামান্য বিতর্কের উত্তাপ ছড়িয়ে মোলায়েম বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বাক্যবিনিময়ের সঙ্গে আনন্দসন্ধ্যা কাটানো। আনন্দসন্ধের মধ্যে পরবর্তী যুদ্ধপ্রস্তুতির পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা। প্রস্তুতি শেষ হলে দুই প্রতিপক্ষ সসৈন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে শান্তির জন্যে লোক-দেখানো যে আলাপ আলোচনা পর্ব শুরু করে, তাই হল রাজনীতি। কূটনীতির পরের পর্ব, রাজনীতি। কূটনীতি যখন রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়, যুদ্ধ তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তা ঠেকানো যায় না। শুরু হয়ে যায় দুই প্রতিপক্ষের সশস্ত্র সংঘর্ষ, যুদ্ধ, রক্তপাত, গণহত্যা, লুঠতরাজ, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়, সে এক নরমেধ যজ্ঞ। যজ্ঞাহুতির আগুন নিভলে এক পক্ষের জয়, প্রতিপক্ষের পরাজয়ের সূত্রে শুরু হয় আরও জটিল এক কূটনৈতিক পটভূমি, যার অনিবার্য পরিণাম, আরও বড় সংঘর্ষ, যুদ্ধ, রক্তপাত, খুন। উলুখাগড়া মানুষের হাহাকার আকাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, মৃতরা নীরব থাকে। কূটনীতি দিয়ে যে শাসনব্যবস্থা শুরু, রাজনীতিতে তার শেষ, এই শেষ থেকে আবার নতুন কূটনীতি জন্ম নেয়।

যাইহোক, রাজা লক্ষ্মণ সেনের বংশধরদের চেয়ে রাজা গণেশ বা রাজা দনুজমর্দনদেবের উত্তরপুরুষরা সেই মুহূর্তে গোপন বার্তাবহের পাঠানো খবর নির্ভর করে সুলতানের বেশি বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় সুলতান ভয় পেয়েছিল। গভীর রাতে একডালা প্রাসাদের অলিন্দে, দালানে, বারান্দায়, ঘরের দেওয়ালে শত্রুপক্ষের ভূতুড়ে ছায়া দেখে সুলতান অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেছিল। প্রকৃত শত্রুকে ধরে এনে ফাটকে পুরে অথবা তার শিরশ্ছেদ করে সেই মুণ্ডু হুজুরে হাজির করতে না পারলে সুলতানি দরবারের বেশ কিছু কেউকেটার গর্দান যাবে, হোসেন শাহের অন্তরঙ্গরা টের পাচ্ছিল। নিজের গর্দান বাজাতে তারা রোজ পাঁচ, সাতটা নিরীহ মানুষের মুণ্ডু পৌঁছে দিচ্ছিল সুলতানের মশানে। নামধামহীন এই মুণ্ডুগুলোর পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কারও ছিল না। তারা সন্দেহভাজন, এর বেশি পরিচয়ের দরকার পড়ত না। গৌড়ের মসনদ বরাবরের মতো নিরাপদ করতে সেখানে যত সম্ভাব্য শত্রু রয়েছে, তাদের উপড়ে ফেলার অভিযান পূর্বপুরুষদের মতো হোসেন শাহও চালিয়ে যাচ্ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা যার হাতে থাকে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চেয়ে সে পরাক্রান্ত, হেন কাজ নেই, সে করতে পারে না। সন্তানসম্ভবা একশ’ রমণীর মধ্যে, স্রেফ মজা করার জন্যে পঁচানব্বই জনের গর্ভের ভ্রূণ, নানা খেলায় বিনাশ করে, বাকি পাঁচ জনের গর্ভের সন্তানদের ভূমিষ্ঠ হওয়ার এলাহি আয়োজন করে, রাজার মহানুভবতার প্রচারে, স্তাবকদের জয়ঢাক বাজাতে নির্দেশ দেওয়ার কাহিনী ইতিহাস নথিবদ্ধ করেছে। সব সমাজে আটানব্বই শতাংশ মানুষ হল ক্ষমতাধরের জয়ঢাকবাদক। শাসকের পা চেটে তারা আনন্দ পায়। পঁচানব্বই শতাংশ রমণীর গর্ভের ভ্রূণহত্যাকারীর নাম তাই ইতিহাসে উল্টোভাবে, তাকে ‘মহামহিম’ আখ্যা দিয়ে উল্লেখ করা হয়। ক্ষমতা প্রয়োগের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব পেয়ে ক্ষমতাধর যখন তার সীমাহীন শক্তির স্বরূপ জেনে যায়, তখন সে আকাশের কান ধরে তাকে মাটিতে নামিয়ে তার পশ্চাদ্দেশে লাথি মেরে, তাকে চর্বিপাক খেতে আদেশ করে, আকাশহীন আকাশের শূন্যতায় পৃথিবীকে নাকে খৎ দিতে বলে। পৃথিবী দেয়। ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ করে না।

ঈশ্বরপুরীর আলাপচারিতা শুনে তাকে সন্ন্যাসী, গৃহী, আস্তিক, নাস্তিক অথবা অন্য কিছু ভাবতে গোরার অসুবিধে হচ্ছিল। তার চোখের সামনে মানুষটার উচ্চতা শুধু বেড়ে যাচ্ছিল, কথার প্রবাহ থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল অনন্তকালের রোমাঞ্চ জাগানো ধ্বনি। ঈশ্বরপুরী বলল, পাণ্ডুয়ার রাজপ্রাসাদে রাজা গণেশের খুন হওয়ার খবর সে যেমন বিশ্বাস করেনি, তেমনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছিল, সাতকাহন করে প্রচারিত, রাজা দনুজমর্দনদেবের মৃত্যুবৃত্তান্ত। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কির চক্রান্তে, ছেলে যদুর হাতে গণেশের নিহত হওয়ার ঘটনাকে রাজপরিবারের আত্মরক্ষার আভ্যন্তরীণ গোপন কৌশল ছাড়া কিছু ভাবেনি। দনুজমর্দনদেবের মৃত্যুর ঘটনাও তাই সে ধরে নিয়েছিল নিছক গুজব। তার ধারণা যে নির্ভুল, গুরু মাধবেন্দ্র পুরীর মতামত শুনে টের পেয়েছিল। পাণ্ডুয়ার সিংহাসনে রাজা কংস সমাসীন হতে প্রমাণ হয়েছিল, তার বিচারে ভুল ছিল না।

গঙ্গা, মহানন্দা, কালিন্দী—এই তিন নদীর সঙ্গম ঘেঁষে পাণ্ডুয়াকে গৌড়ের রাজধানী হিসেবে আদর্শ নগর ভাবত ঈশ্বরপুরী। মাধবেন্দ্র পুরীর ব্যাখ্যা শুনে এ বিশ্বাস তার হয়েছিল। তিন নদীর জলপথ ব্যবহার করার মতো সুযোগ শুধু পাণ্ডুয়াতে পাওয়া যেত। তীর্থযাত্রায় উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণ ভারতে পৌঁছানো যেমন সহজ ছিল, তেমনি দেশে বিদেশে বাণিজ্য করার সুযোগ ছিল। পাণ্ডুয়ার নানা নদীপথ ধরে চট্টগ্রাম, তাম্রলিপ্ত, সোনারগ্রাম বন্দরে নিয়মিত পণ্যবাহী নৌকো যাতায়াত করত। বহু বাণিজ্য তরণী দূরদূরান্তে, উৎকল, করমণ্ডল, মালাবার, এমনকি আরবসাগর, লোহিতসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে জলপথে ব্যবসাবাণিজ্য চালাত। পাণ্ডুয়ায় রাজা কংসের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার ঘটনা থেকে ঈশ্বরপুরী বুঝে গিয়েছিল, দমকা হাওয়ার মতো পাণ্ডুয়ায় ক্ষমতাসীন কংস (কেউ কেউ বলে, কাস্‌) নামে এই নৃপতি, নবাগত, ভুঁইফোড় ক্ষমতালিপ্সু রাজা নয়। আসলে রাজা গণেশ, যার আর এক নাম রাজা দনুজমর্দনদেব, সেই-ই রাজা কংস। গৌড়ের সমৃদ্ধির জন্যে রাজা গণেশের মতো জলপথ, স্থলপথে দেশ-বিদেশে বাণিজ্য করার প্রেরণা আর কোনও শাসক দেয়নি। বাণিজ্য সড়কের অনেক অংশ আবার পরিব্রাজক সন্ন্যাসীরা রাজন্যবর্গ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষকে চিনিয়েছিল। বিশেষ করে বিহার, উত্তর ভারত, আর্যাবর্তের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত গঙ্গা আর মহানন্দার জলপথ দিয়ে অনায়াসে পণ্যবাহী বাণিজ্যবহর যাতায়াত করতে পারে, পরিব্রাজক সন্ন্যাসীরা গৌড়ের মানুষকে সে বার্তা প্রথম দিয়েছিল। বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের পরোক্ষ সাহায্যে গৌড়ের বণিক সম্প্রদায়ের এত দ্রুত সমৃদ্ধি ঘটল যে এক দশকের মধ্যে তারা বৈষ্ণব সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহের পাশাপাশি, পাণ্ডুয়ায় তার প্রতিস্পর্ধী যে কংস, (নিরক্ষর মানুষের উচ্চারণে ‘কানস’) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল, তার আসল নাম কাশীশ্বর। পান্ডুয়ার রাজা কাশীশ্বর যে প্রকৃতপক্ষে তার জন্মদাতা, রাজা গণেশ, তা জানতে জালালুদ্দিনের সময় লাগেনি। রাজা গণেশ যখন নামান্তরে নবোদ্যমে গৌড় বাঙ্গলার নানা মুলুকে রাজকীয় মহিমায় দেদীপ্যমান হয়ে উঠছিল, তার আগে ছোট ছেলে মহেন্দ্রদেবকে গৌড়ের যুবরাজ অভিষিক্ত করা সময়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে গণেশ আরও একটা কাজ সেরে রেখেছিল। গৌড়ের অনতিদূরে, চন্দ্রদ্বীপের সার্বভৌম নৃপতি ঘোষণা করে, মেজছেলে রমাবল্লভকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিল। পাণ্ডুয়ায় রাজা কংসের ইহলীলা সংবরণের পরে, বছর ঘুরতে সুলতান জালালুদ্দিন শাহ পাণ্ডুয়া দখল করে নিলে চন্দ্রদ্বীপের অধীশ্বর রমাবল্লভ ভয় পেয়ে গেল। প্রতিহিংসাপরায়ণ দাদা, যদু ওরফে সুলতান জালালুদ্দিনের ক্রোধ থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই, এই ভয়ে রমাবল্লভ দিন গুনতে থাকল। রমাবল্লভ যা ভয় করছিল, তাই ঘটল। সুলতানি মোহর লাগানো এত্তেলা দিয়ে সহোদর ভাই রাজা রমাবল্লভকে তদ্দণ্ডে একডালায় ডেকে পাঠাল সুলতান জালালুদ্দিন। এত্তেলা নিয়ে গিয়েছিল সুলতানি দরবারের ‘মালিক’ পদমর্যাদাসম্পন্ন দশহাজার অশ্বারোহী বাহিনীর এক মনসবদার। দশ হাজারি সেনাধ্যক্ষ, পুরো বাহিনীর বদলে অধস্তন এক ‘খান’-এর কর্তৃত্ত্বাধীন একশ’ জন অশ্বারোহী নিয়ে চন্দ্রদ্বীপের সীমানায় পৌঁছে, রাজা রমাবল্লভের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করল। সুলতান জালালুদ্দিনের সেরকম হুকুম ছিল। সেনাধ্যক্ষ ‘মালিক’কে দশ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে রাজধানীতে ঢুকতে অনুমতি দিল রমাবল্লভ। সামরিক শক্তিতে খাটো হলেও সুলতানি ফরমানের জোরে তখনই একডালায় হাজিরা দেওয়ার মতো কাপুরুষ ছিল না রমাবল্লভ। সবচেয়ে বড় কথা তার পাশে ছিল কৃষ্ণবল্লভের মতো বীর যোদ্ধা সন্তান। যুবরাজ পদে তাকে আগেই অভিষিক্ত করেছিল রাজা রমাবল্লভ। কৃষ্ণবল্লভ শুধু পরাক্রান্ত যোদ্ধা ছিল না, প্রকৃত প্রজাবৎসল রাজপুরুষ ছিল সে। সুলতান জালালুদ্দিনের সেনাধ্যক্ষ আর তার অধস্তন সেনাকর্তা, ‘খান’কে রাজসভায় অতিথি হিসেবে রাজা রমাবল্লভ সাদরে ডেকে নিলেও তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক কথাবার্তা চালাল যুবরাজ কৃষ্ণবল্লভ। বয়স্ক রাজা রমাবল্লভ তখন যথেষ্ট সুস্থ না থাকায় বাবার বদলে সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে রাজধানী একডালায় যুবরাজ কৃষ্ণবল্লভ যেতে চাইল। সুলতানি এত্তেলার বাইরে দশহাজারি ‘মালিক’ সেনাধ্যক্ষ আলাদা কিছু করতে চাইল না। রমাবল্লভকে একডালায় নিয়ে যেতে সে জেদ ধরে থাকতে কৃষ্ণবল্লভ সরাসরি জানিয়ে দিল তা সম্ভব নয়। ফৌজ নিয়ে দশহাজারি মনসবদার একডালায় ফিরে গিয়ে চন্দ্রদ্বীপের যুবরাজ কৃষ্ণবল্লভের বাড়াবাড়িরকম ঔদ্ধত্যের বিবরণ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে শোনাতে, রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল সুলতান জালালুদ্দিন। গৌড় জুড়ে যুদ্ধাভিযানের দামামা বেজে উঠল। যুদ্ধের শুরুতে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীর দরবার থেকে যে গোপন বার্তা জালালুদ্দিনকে পাঠানো হল, তার সারাংশ হল, সাবধান, সিন্ধুকীদের সূত্রে খবর এসেছে চন্দ্রদ্বীপের মসনদে বসতে চলছে সেই কুচক্রী, ঐন্দ্রজালিক কৃষ্ণ তার উত্থান আটকাতে গৌড়ের সুলতানের এখনই চন্দ্রদ্বীপে সেনাবাহিনী পাঠানো উচিত। গৌড়ের সুলতানকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে সুলতান ইব্রাহিম শর্কী তৈরি আছে। সর্বশক্তিমান জাদুকর, কৃষ্ণের চন্দ্রদ্বীপে পুনরাবির্ভাবের খবরে গৌড়ের সুলতানি দরবারে চাঞ্চল্য জাগলেও প্রাসাদের অন্দরমহলে, একান্তে সুলতান জালালুদ্দিন মুচকি হাসল। পারিবারিক সম্পর্কে ভাইপো কৃষ্ণবল্লভ রায় যে পুরাণের সর্বশক্তিমান কৃষ্ণ নয়, যদু ওরফে সুলতান জালালুদ্দিনের ভালোরকম জানা ছিল। জৌনপুর আর গৌড়ের সিন্ধুকীরাও কৃষ্ণবল্লভের পিতৃপরিচয়, বেশি করে তার বংশপরিচয় জানত। রাজা গণেশ, রাজা দনুজমর্দনদেব, রাজা কান্‌স, তিনজন একই ব্যক্তি এ বিষয়ে তাদের অনেকে যেমন নিঃসন্দেহ ছিল, কিছু জনের তেমন সংশয়ও ছিল। কৃষ্ণাবতারের অবশ্যম্ভাবিতার বিষয়কে অবশ্য কেউ, এমনকি সুলতান জালালুদ্দিন পর্যন্ত উড়িয়ে দিতে পারত না। ইব্রাহিম শর্কীর কৃষ্ণভীতির কারণ ছিল, দেশি তন্ত্রমন্ত্র, ইন্দ্রজালের অধিকারী, কৃষ্ণ নামের মানুষটাকে সে অময় ভাবত। যদু তা ভাবত না। ‘তবু সংস্কার কাটে না মলে।’ কৃষ্ণাবতার আবির্ভাবের অনিবার্যতা নিয়ে যদুর সংশয় ছিল না। সুলতান জালালুদ্দিন শাহ নাম নিয়ে মসনদে বসেও সে মনে করত অধর্মের উচ্ছেদসাধন করে, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কারণে যুগে যুগে কৃষ্ণাবতার ভূমিষ্ঠ হয়।

সুলতান হওয়ার পরেও এই বিশ্বাস যদুর মাথা থেকে যায়নি। চন্দ্রদ্বীপের রাজা, কৃষ্ণবল্লভ রায়, সম্পর্কে তার ভাইপো জেনেও সে ছোকরা কোনওমতে কৃষ্ণের অবতার হতে পারে না, এরকম স্পর্ধার চিন্তা করতে সে অপারগ। চন্দ্রদ্বীপ অভিযান করতে তাই সে গুছিয়ে তৈরি হচ্ছিল। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কী, যে কিনা তাকে গদিতে বসিয়েছে, স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত সে বাড়িয়ে দিতে জালালুদ্দিনের প্রস্তুতির তেজ দশগুণ বেড়ে গেল। কৃষ্ণবল্লভকে উৎখাতের প্রস্তুতি জালালুদ্দিন যখন প্রায় সেরে ফেলেছে, সিন্ধুকীদের এক পাণ্ডা খবর দিল, উন্মাদ হাতিকে বশে আনার সময়ে দুর্ঘটনায় যুবরাজ কৃষ্ণবল্লভ মারা গেছে। পাগলা হাতি সম্ভবত পায়ে পিষে মেরে ফেলেছে যুবরাজকে। অসুস্থ, বৃদ্ধ রাজা রমাবল্লভদেব যুবরাজের মৃত্যুতে এতই কাতর যে, হঠাৎ ভবলীলা শেষ করতে পারে। সিন্ধুকীদের পেশ করা সংবাদ, পুরো বিশ্বাস করেনি জালালুদ্দিন। সুলতানকে ভাঁওতা দিতে নিজের নাম পাল্টে হরিবল্লভ সেজে চন্দ্রদ্বীপের সিংহাসনে কুয়বল্লভ ফিরে এলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মানুষের মুখে সেরকম ঘটেছিল, শোনা গেলেও জালালুদ্দিন অনায়াসে চন্দ্রদ্বীপ জয় করে নিল। রাজপ্রাসাদে মৃত কৃষ্ণবল্লভের বিধবা স্ত্রী সুরক্ষা আর তার ছেলে জয়দেব রায়ের খোঁজ, বিজয়ী বাহিনীর অধীশ্বর জালালুদ্দিন পেল না। কৃষ্ণাবতারের আবির্ভাবের আতঙ্কে গৌড়বঙ্গ, উত্তরে ত্রিপুরা, পশ্চিমে রাজগৃহ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর সুলতান জালালুদ্দিনের ঘুম উবে গেল। জালালুদ্দিনের মৃত্যুর পরে তার ছেলে শামসুদ্দিন আহমদ শাহ গৌড়ের সুলতান হয়েই প্রশাসনিক কাজের তালিকায় যুবরাজ কৃষ্ণদেবের বিধবা স্ত্রী আর ছেলের খোঁজে কয়েকশ’ সিন্ধুকী নামিয়ে দিয়েও তাদের হদিশ করতে পারল না। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে দুই ক্রীতদাসের হাতে নিজের প্রাসাদে খুন হয়ে গেল সুলতান শামসুদ্দিন। চন্দ্রদ্বীপের বিধবা যুবরানী সুরক্ষা আর প্রিয় নাতি জয়দেব রায়কে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে অসুস্থ, বৃদ্ধ রাজা রমাবল্লভদেব পাঠিয়েছিল, সুলতান জালালুদ্দিনের কারাগারে বন্দিদশায় অকথ্য নির্যাতনেও জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও তা অপ্রকটিত রেখেছিল রাজা রমাবল্লভদেব।

আধ্যাত্মিক মার্গের ধর্মনেতা ঈশ্বরপুরীর মুখে অদূর অতীতের রক্তাক্ত কাহিনী শুনে গোরার মনে এমন আলোড়ন জাগল যে সে স্তব্ধ হয়ে রইল। ঈশ্বরপুরী বলল, রাজা গণেশের একশ’ বছর আগে, সুলতান ইলিয়াস শাহের আমল থেকে গৌড় বাঙ্গলার ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু হয়েছিল। শাহী আমলের শাসকরা এ রাজ্যের স্বাধীন অধীশ্বর হতে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকলেও প্রশাসক আর উলেমাদের কলহে তা করে উঠতে পারেনি। তাদের ঝগড়ার সুযোগে রাজা গণেশ গৌড়ের অধিপতি হয়েছিল। ইতিহাসের ব্যাখ্যা শেষে ঈশ্বরপুরী যে মোক্ষম বার্তা দিল, তা হল রাজা গণেশের মৃত্যুর আশি বছর পরে সুলতান হোসেন শাহের কানে সম্প্রতি সুলতানি দরবারের কোনও জ্যোতিষী, সম্ভবত তার নাম রব্বানি, গোপনে যে অদৃষ্টলিপি গণনার সিদ্ধান্ত হোসেন শাহকে শুনিয়েছে, তা সাংঘাতিক। জ্যোতিষার্ণব চারুমিহিরকে পাশ কাটিয়ে রব্বানি কৃতত্ত্বের ব্যাখ্যা, কৃষ্ণের একশত নাম, সেই একশ’ জনের আলাদা করে পরিচয়, কীর্তিকলাপ সবিস্তারে সুলতানকে জানিয়ে, তার শত্রু যে রাজা গণেশের বংশজাত কেউ, এই সিদ্ধান্ত হাজির করেছে। রাজা কৃষ্ণবল্লভ রায়ের ছেলে, জয়দেব রায়ের এক পৌত্র যার বয়স কুড়ি বাইশের বেশি নয়, গৌড়ের অজ্ঞাত কোনও অঞ্চলে, সে শক্তি সঞ্চয় করে, সুলতানি শাসন উচ্ছেদ করে গৌড়ের অধিপতি হওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। ভবিষ্যৎবাণী শুনে, ভয়ে সুলতান হোসেন শাহের চক্ষু চড়কগাছ। চক্রান্তকারীকে তখনই কোতল করার হুকুম জারি হয়ে গেলেও তাকে হদিশ করতে সিন্ধুকীদের দম ফুরিয়ে যাচ্ছিল। চক্রান্তকারীর বয়সের সঙ্গে গোরার বয়স মিলে যাচ্ছে দেখে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে পুরীগোঁসাই চিন্তিত হল। রাজা কৃষ্ণবল্লভ রায়ের ছেলে, জয়দেব রায়ের এক পৌত্র, নিজের সমবয়সি জেনেও গোরা বিচলিত হল না। ঈশ্বরপুরীর কাছে নিজেকে বাঁচানোর পথ জানতে চাইল না। হারানো দাদার খোঁজে তার দাক্ষিণাত্য, বিশেষ করে বিজয়নগর রাজ্য পরিভ্রমণের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে সঠিক পথনির্দেশ প্রার্থনা করল। গোরার দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের সঙ্কল্পে ঈশ্বরপুরী খুশি হল বললে কম বলা হয়, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অর্ধেক উদ্বেগের উপশম হল। গোরাকে সস্নেহে দাক্ষিণাত্য যাওয়ার সবচেয়ে নিরাপদ, সহজ পথের হদিশ দিয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে ঈশ্বরপুরী যাওয়ার আগে তার কাছে গোরা জানতে চেয়েছিল, জয়দেব রায়ের পৌত্র কি সত্যি বেঁচে আছে? সপরিবারে তার নবদ্বীপে বাস করার সম্ভাবনা কতটা সত্য?

গোরার প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব ঈশ্বরপুরী দিতে না পারলেও বলেছিল, রাজপুরুষ, সুলতান বংশের সন্তানসন্ততিদের পরমায়ু তাদের অমিতাচারী জীবনযাপনের জন্যে ভোগবিলাসে তাড়াতাড়ি জীর্ণ হয়ে যায়। নিজেরাই তাদের জীবনের পরপারে যাওয়ার রাস্তা সুগম করে দেয়। পরিবারের বেশিরভাগ পুত্রসন্তান, কৈশোর থেকে রাজরোগ, অর্থাৎ যক্ষ্মায় ভুগে পৃথিবীর মায়া কাটায়। যারা বেঁচে থাকে, তাদের অধিকাংশ মসনদ দখলের ষড়যন্ত্রমূলক হানাহানিতে ধরাধাম ছাড়তে বাধ্য হয়। ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে গিয়ে যারা নির্বাসিতের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে জীবনযাপনে বাধ্য হয়, তাদের আধমরা সাপের চেয়ে ভয়ঙ্কর ভেবে নিয়ে শাসকসম্প্রদায় গুমখুন করে দেয়। নিরীহ এই কাজের জন্যে প্রশাসনের তরফে মাইনে করা গুপ্তঘাতক পোষা হয়। গোরার সমবয়সি, রাজা কৃষ্ণবল্লভ রায়ের এক অথবা একাধিক প্রপৌত্র অদ্যাপি বেঁচে আছে কি না, তা ঈশ্বরপুরীর সুনিশ্চিভাবে জানা না থাকলেও, চন্দ্রদ্বীপের বিধবা যুবরানী, সুলক্ষা, তার শিশু সন্তান জয়দেব রায়, নিরাপদে রাঢ় বাঙ্গলায় কিছুকাল বাস করে, তারপর আশ্রয় পরিবর্তন করেছিল, এ তথ্য গুরু মাধবেন্দ্র পুরীর মুখে শুনেছিল ঈশ্বরপুরী, মাধবেন্দ্র শুনেছিল, তার গুরু লক্ষ্মীপতির কাছ থেকে। লক্ষ্মীপতির গুরু ব্যাসতীর্থ আবার পরিব্রাজনের পথে, একদা নবদ্বীপের কাছে, গঙ্গার উল্টোদিকে ফুলিয়ায় যে তরুণ গৃহস্থের বাড়িতে আতিথ্য ভিক্ষা করে একরাত কাটিয়েছিল, সেই গৃহস্থ যে রাজা কৃষ্ণবল্লভ রায়ের ছেলে জয়দেব রায়, ব্যাসতীর্থ জেনেছিল, নিজের গুরু ব্রহ্মণ্যঃ পুরুষোত্তমের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে। শিষ্য ব্যাসতীর্থকে, পরিব্রাজনের পথে কখনও সুযোগ মিললে, ফুলিয়ার এই গৃহস্থ বাড়িতে আতিথ্য ভিক্ষার নির্দেশ ব্রহ্মণ্যঃ পুরুষোত্তমের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে। শিষ্য ব্যাসতীর্থকে, পরিব্রাজনের পথে কখনও সুযোগ মিললে, ফুলিয়ার এই গৃহস্থ বাড়িতে আতিথ্য ভিক্ষার নির্দেশ ব্রহ্মণ্যঃ পুরুষোত্তম দিয়েছিল। গুরু পুরুষোত্তম ছিলেন রাজা রমাবল্লভের দীক্ষাদাতা। জয়দেব রায়ের উত্তরপুরুষের শাখা-প্রশাখা আজও গৌড়-বাঙ্গলায় থেকে গেছে, এ নিয়ে ঈশ্বরপুরীর সন্দেহ নেই। বলল, আমার মুখ থেকে এত ইতিবৃত্ত শোনার আগেই তুমি দাক্ষিণাত্য পরিভ্রমণের ছক করে বসে আছো জেনে আমি নিরুদ্বিগ্ন হলাম। তোমার যাত্রা শুভ হোক।

গোরার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে ঈশ্বরপুরী তাকে জানিয়ে গেল, দীর্ঘকাল বেয়াড়া কূটনীতিতে হাত পাকিয়ে বেপরোয়া হোসেন শাহ এখন যে কোনও কাজ করতে পারে। তাকে কিছুটা সামলে রেখেছে, তার বিশ্বস্ততম কয়েকজন মন্ত্রণাদাতা, জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির আর দুই হিদু সচিব, অমর আর সন্তোষ, যারা একদা কর্নাটক রাজবংশের ভরদ্বাজগোত্রীয় ব্ৰাহ্মণ, অধিপতি, অনিরুদ্ধর বংশধর হিসেবে সুপরিচিত ছিল। অমর, সন্তোষকে সুলতানি শিবিকায় তুলে প্রায় জোর করে একডালায় নিয়ে গিয়ে দু ভাইকে সাকর মল্লিক আর দবীর খাস, সরকারি দুই উচ্চপদে বসিয়ে ছিল হোসেন শাহ। সুলতানের প্রধান মন্ত্রী (দবীর খাস) পদে সন্তোষ আর ব্যক্তিগত সচিব (সাকর মল্লিক) পদে অমরের নিযুক্তির কিছুকালের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ব্রাহ্মণত্ব বর্জন না করলেও ধীরে ধীরে বর্ণান্তর ঘটছে, টের পেয়েও তা মানিয়ে না নেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর দেখল না। দরবারের আমীর, ওমরাহদের সঙ্গে বসে ‘কমা’ পড়তে বাধ্য হল। প্রকৃত নমাজী না হয়েও সপ্তাহে একদিন, জুম্মাবারে, পশ্চিমে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসে নমাজ পড়তে থাকল। পদের লোভে ধর্ম নষ্ট করে অনুশোচনায় দুই ভাই খুব মনোকষ্টে রয়েছে। বিধান অনুযায়ী আচার অনুষ্ঠান পালনের সুযোগ না থাকলেও, রাজধর্মের সঙ্গে কৌলধর্মের কিছুটা রফা করার প্রয়াস তারা চালিয়ে যাওয়ায়, বিপ্রবর্ণের মানুষ, এখনও যৎসামান্য মর্যাদা পাচ্ছে। সুলতানি শাসনের ধর্মীয় ধাক্কা শুধু বিপ্রবর্ণ ঠেকাতে পারবে না। সমাজের বিবিধ বর্ণের মানুষকে জড়ো করে মহাজোট বানাতে হবে। কাজ এগোচ্ছে। বৈদ্য, কায়স্থ সম্প্রদায়কে ব্রাহ্মণ্যবাদী জনগোষ্ঠী হিসেবে অনুমোদন দিয়ে ‘ব্রাবৈকা’ সংস্কৃতি গড়ে তোলার কাজ, রাজা বল্লাল সেনের আমল থেকে গত দুশ’ বছরে অনেকটা দানা বেঁধেছে। তাদের থেকে বৃহত্তর জনসম্প্রদায়, নিম্নবর্গের নবশাকগোষ্ঠী, ম্লেচ্ছ, শূদ্রদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে সুলতানকে তার মুসলিম পদস্থ পার্ষদরা পরামর্শ দিয়েছে, ব্রাহ্মণধর্মের ভেতর থেকে ভুঁইফোঁড় বিরোধী কোনও ধর্ম যদি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তাহলে তন্ত্রসাধক, স্মার্ত, ন্যায়শাস্ত্রীরা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। দাপট কমবে তাদের। সুতরাং এই বৃহত্তর জনসমাজ ও তাদের ভেতর থেকে উদ্ভিন্ন নতুন ধর্মমতকে শায়েস্তা করতে সুলতানের কাছে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যতই দরখাস্ত পাঠাক, সুলতান সেদিকে তাকাবে না। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অনুচর, মনুবাদীদেরও নখ দাঁত ভেঙে দেওয়া হবে।

সুলতানি দরবারে জ্যোতিষার্ণব চারুমিহির, দবীর খাস, সাকর মল্লিক, মুকুন্দদাস বৈদ্যের বিরোধী অহিন্দু আমীর, ওমরাহদের যে গোষ্ঠী রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর চেয়ে সংখ্যায় তারা যেমন বেশি, তেমনি তাদের হাঁকডাক। দরবারের অমুসলিম গোষ্ঠীকে কোণঠাসা রাখতে সুলতানকে নিভৃতে তারা পরামর্শ দিতে থাকল। বামুনদের ক্ষমতাভোগের বাসনা চৌপাট করার নানা কড়া দাওয়াই প্রয়োগ করতে, সুলতানের কাছে তাদের প্রথম প্রস্তাব ছিল, সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিতদের অং-বং-চং কচকচি, ফরমান দিয়ে বন্ধ করা উচিত। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রকে শায়েস্তা করতে এটাই হল কিস্তির চাল। সংখ্যাগরিষ্ঠ গৌড়বাসীর মুখের ভাষা, দরবারী কাজে বাধ্যতামূলক ব্যবহারের ফরমান বেরলেই ভাষার সেই প্রবল স্রোতে বৈদিক ভাষীদের কর্তৃত্বের ধ্বজা ভেসে যাবে। সুলতান হোসেন শাহ যতই রাজ্যসম্পদ, ক্ষমতালোভী হোক, সংস্কৃত ভাষাকে সমূলে নাকচ করার প্রস্তাব তখনই বাতিল করে দিতে উলেমা, মৌলবিরা বিকল্প যে প্রস্তাব দিল, তা ছিল রাজ্যের শূদ্র, ম্লেচ্ছ, যবন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সংস্কৃতের সঙ্গে সেই ভাষাকেও বেসরকারিভাবে মদত দেওয়া হোক।

সুলতান হোসেন শাহ এ প্রস্তাব মেনে নিতে দরবারের পৃষ্ঠপোষিত ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা বেড়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে সুলতান ইলিয়াস শাহের আমল থেকে বাংলাভাষাকে সংযোগ ভাষা হিসেবে চালু করার যে প্রস্তাব বারবার সামনে এসে আরবি, ফার্সি ভাষাভাষীদের সঙ্কেতে ধামাচাপা পড়েছিল, একশ’ বছর পরে তারাই এখন উদ্যোগী হয়ে বাংলাভাষাকে নিজেদের অজ্ঞাতসারে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে। ডোম, চণ্ডাল, চামারদের ভাষা এতদিনে শেকলমুক্ত হয়ে বিশাল জনসমাজে সসম্মানে গৃহীত হয়েছে। এ সবই তাঁর আসার শুভ লক্ষ্মণ।

ঈশ্বরপুরী কার আবির্ভাবের কথা বলছে, গোরা টের পেয়েও সে বিষয়ে প্রশ্ন করল না। অবতারতত্ত্বে অবিশ্বাসী গোরার ধারণা, আকাশ থেকে অবতার নেমে আসে না। হাজার হাজার মানুষের প্রার্থনায়, তাদের ভেতর থেকে স্বর্গীয় জ্যোতি আর মহত্তম সুগন্ধ নিয়ে অবতার আত্মপ্রকাশ করে। মর্ত্যের মাটির ঘরে ঘরে ছড়িয়ে থাকা হাজার লক্ষ কৃষ্ণের গুণাবলী আত্মস্থ করে তাদেরই একজন কৃষ্ণ পরিচয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে। কৃষ্ণ চরিত্রের অভিনেতা থেকে সে প্রকৃত কৃষ্ণের মূর্তি পরিগ্রহ করবে। গোরার কাঁধে হাত রেখে ঈশ্বরপুরী বলল, মুখের ভাষা যখন মুক্তি পেয়েছে, তখন সুর, গান খুব বেশিদিন নিষিদ্ধ রাখা যাবে না।

গোরার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার আশা প্রকাশ করে, তখনকার মতো ঈশ্বরপুরী বিদায় নিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *