৭২. পুত্ৰবধুরূপে অর্জ্জুনের উত্তরা গ্ৰহণ

৭২তম অধ্যায়

পুত্ৰবধুরূপে অর্জ্জুনের উত্তরা গ্ৰহণ

বিরাটরাজ কহিলেন, ‘পাণ্ডবপ্রবর! আপনি কি নিমিত্ত আমার প্রদত্ত উত্তরাকে ভার্য্যাত্বে পরিগ্রহ করিতে অস্বীকার করিতেছেন?”

অর্জ্জুন কহিলেন, “মহাশয়! আমি নিরস্তর অন্তঃপুরে আপনার কন্যার সহিত একত্র বাস করিতেছি; তিনি কি রহস্য, কি প্রকাশ্য, সকল বিষয়েই আমাকে পিতার ন্যায় বিশ্বাস করিতেন; আমি তাঁহাকে পরম প্রযত্নসহকারে নৃত্যগীত শিক্ষা করাইতাম বলিয়া তিনিও আমাকে সম্মানভাজন আচাৰ্য্যের ন্যায় বোধ করিতেন। আমি এইরূপে সেই যুবতীর সহিত এক বৎসর একত্র বাস করিয়াছি; এক্ষণে যদি তাঁহার পাণিগ্রহণ করি, তাহা হইলে আপনার ও অন্যান্য ব্যক্তির সাতিশয় সন্দেহ জন্মিতে পারে। আমি নির্দোষ, জিতেন্দ্ৰিয় ও দান্ত হইয়া আপনার কন্যার বিশুদ্ধিসম্পাদন করিয়াছি। তিনি পুত্ৰবধু হইলে কেহ আপনার দুহিতার প্রতি, আমার পুত্রের প্রতি অথবা আমার প্রতি কোন সন্দেহ করিতে সমর্থ হইবে না। আমি অভিশাপ ও মিথ্যাপবাদকে অত্যন্ত ভয় করি, অতএব উত্তরাকে পুত্রবধুরূপে গ্ৰহণ করিতেছি। বাসুদেবের প্রিয়তম ভাগিনেয়, সাক্ষাৎ দেবকুমারসদৃশ, অস্ত্রকোবিদ [অন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী], আমার পুত্র অভিমন্যু আপনার জামাতা ও উত্তরার ভর্ত্তা হইবার একান্ত উপযুক্ত পাত্র।”

বিরাটরাজ কহিলেন, “হে কৌন্তেয়! আপনি নিতান্ত ধর্ম্মপরায়ণ; উত্তরার পাণিগ্রহণ অস্বীকার করা আপনার পক্ষে সম্যক উপযুক্তই হইয়াছে। এক্ষণে যাহা কৰ্তব্য, তাহাই করুন।

আমি যখন আপনার সহিত সম্বন্ধ করিলাম, তখন আমার সমুদয় কামনা সম্পন্ন হইল। অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহাদিগের পরস্পর সম্বন্ধ-বন্ধনে অনুমোদন করিলেন। উভয়ের মিত্ৰগণের নিকট চর প্রেরিত হইল। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অপর এক চর দ্বারা বাসুদেবকে এই সংবাদ অবগত করিলেন।

অভিমনুহ-সহ যাদবানয়নে দূত প্রেরণ

ত্ৰয়োদশ বর্ষ অতিক্রান্ত হইলে পাণ্ডবগণ বিরাটনগরে অবস্থান করিতেছেন, ইহা সর্ব্বত্র প্রচারিত হইল। অর্জ্জুন জনার্দ্দন, অভিমন্যু ও যাদবগণকে আনয়ন করিবার নিমিত্ত দূত প্রেরণ করিলেন। কাশীরাজ ও শৈব যুধিষ্ঠিরের নিতান্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁহারা প্ৰত্যেকে – অক্ষৌহিণী সেনা-সমভিব্যাহারে তথায় আগমন করিলেন। মহাবল দ্রুপদও অক্ষৌহিণী সেনা-সমভিব্যাহারে তথায় উপস্থিত হইলেন; দ্ৰৌপদীর পঞ্চ পুত্র, শিখণ্ডী ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহার সমভিব্যাহারে আগমন করিলেন; ইঁহারা সকলেই অক্ষৌহিণীনায়ক [এক অক্ষৌহিণী সৈন্যের অধিনেতা], যাগশীল ও বেদাধ্যয়নসম্পন্ন। পরমধার্ম্মিক বিরাট নানাদিগদেশাগত ভূপতিগণ ও তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারাদিগকে সমুচিত সম্মানপূর্ব্বক সৎকার করিলেন। অভিমান্যুকে কন্যা প্রদান করিবেন বলিয়া তাঁহার আর আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না।

অনন্তর অনার্ত্তদেশ হইতে বাসুদেব, বলদেব, কৃতবর্ম্মা, হার্দ্দিক্য, যুযুধান, সাত্যকি, অনাবৃষ্টি, অক্রূর, শাম্ব এবং বলদেবানন্দন, নিশঠ, ইঁহারা অভিমন্যু ও সুভদ্রাকে সমভিব্যাহারে লইয়া আগমন করিলেন। ইন্দ্ৰসেন প্রভৃতি পাণ্ডবসারথিগণ এক বৎসরের পর তাঁহাদিগের সেই সমস্ত রথ লইয়া আগমন করিল। দশ সহস্ৰ হস্তী, দশ অযুত অশ্ব, অর্বুদ রথ, নিখর্ব্ব পদাতি এবং বৃষ্ণি, অন্ধক ও ভোজবংশীয় বহু ব্যক্তি বাসুদেব-সমভিব্যাহারে সমাগত হইলেন। বাসুদেব পাণ্ডবগণকে রাজোচিত অর্থ, স্ত্রীরত্ন ও পৃথক পৃথক পরিচ্ছদ প্রদান করিলেন।

উত্তরার সহিত অভিমন্যুর বিবাহ

অনন্তর যথাবিধি বিবাহকাৰ্য্য সমারম্ভ হইল। শঙ্খ, ভেরী, পনব প্রভৃতি বাদ্যসকল বাদিত হইতে লাগিল। উচ্ছাবচ মৃগ, মৎস্য ও মৈরেয় প্রভৃতি সুরাসকল সমাহৃত হইল। গায়ক, আখ্যায়ক, নট, বৈতালিক, সূত ও মাগধগণ তাঁহাদিগের স্তুতিপাঠ করিতে লাগিল। সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী মৎস্যনারীগণ মণিকুণ্ডল প্রভৃতি নানাবিধ আভরণ ধারণপূর্ব্বক ইন্দ্ৰসূতার ন্যায় অলঙ্কৃত উত্তরাকে লইয়া সুদেষ্ণা-সমভিব্যাহারে তথায় আগমন করিলেন; কিন্তু পাঞ্চালনন্দিনীর অসীম রূপলাবণ্য ও উজ্জ্বল কান্তি দর্শনে সকলেই পরাভূত হইলেন।

ধনঞ্জয় নিজপুত্র অভিমনুর নিমিত্ত বিরাটকন্যা উত্তরাকে গ্ৰহণ করিয়া দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির উত্তরাকে স্নুষাৰ্থ প্রতিগ্ৰহ করিয়া জনার্দ্দনকে পুরষ্কৃত করিয়া মাহাত্মা সৌভদ্রের [সুভদ্ৰানন্দন-অভিমন্যু] উদ্বাহক্রিয়া সম্পাদনা করিলেন। মৎস্যরাজ বিরাট প্রজ্বালিত হুতাশনে বিধিবৎ হোম দ্বিজগণকে অর্চ্চনা করিয়া জামাতাকে প্রীতিপূর্ব্বক সপ্ত সহস্ৰ অশ্ব, দ্বিশত হস্তী, ভূরি, ধন, রাজ্য, বল, কোষ ও আত্মা পৰ্য্যন্ত প্ৰদান করিলেন।

উদ্বাহক্রিয়া [বিবাহকাৰ্য্য] পরিসমাপ্ত হইলে রাজা যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদিগকে অচ্যুতপ্রদত্ত সমুদয় ধন, গোসহস্র রত্নজাত, বিবিধ বস্ত্র, ভূষণ, যান, শয়ন রমণীয় ভোজন ও নানাবিধ পানীয় প্রদান করিলেন। হৃষ্টজনাকীর্ণ [আহ্লাদিত—উল্লাস স্ফীত জনতাসঙ্কল] মৎস্যনগর মহোৎসবময় হইয়া অপূর্ব্ব শোভা পাইতে লাগিল।

বৈবাহিক-পৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।

বিরাটপর্ব্ব সম্পূর্ণ