৫৮. অর্জ্জুন-দ্ৰোণ যুদ্ধ

৫৮তম অধ্যায়

অর্জ্জুন-দ্ৰোণ যুদ্ধ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! কৃপাচাৰ্য্য অপসারিত হইলে লোহিতবাহন [রক্তবর্ণ-অশ্ববাহিত রথারূঢ়] আচাৰ্য্য দ্রোণ শর ও শরাসন ধারণ করিয়া শ্বেতবাহনের [শ্বেতাশ্ববাহ্য অর্জ্জুনের] সম্মুখীন হইলেন। জয়শীল অর্জ্জুন কাঞ্চনরথারোহী আচাৰ্য্যকে সমীপে আগমন করিতে দেখিয়া উত্তরকে কহিলেন, “উত্তর! যাহার প্রকাণ্ড দণ্ডমণ্ডিত ধ্বজে বহুপতাকালঙ্কৃত কাঞ্চনবেদী সমুচ্ছ্রিত [উচ্চে উত্তোলিত] রহিয়াছে, যাঁহার রথে স্নিগ্ধ প্রবালসদৃশ শোণিবর্ণ প্ৰকাণ্ড তুরঙ্গ-সকল সংযোজিত আছে, যিনি যোদ্ধৃগণের মধ্যে সর্ব্বপ্রধান, রূপবান, বলবান, প্রতাপবান, শুক্রেরন্যায় বুদ্ধিমান ও বৃহস্পতির ন্যায় নীতিমান; বেদচতুষ্টয়, ব্ৰহ্মচৰ্য্য, ক্ষমা, দম, সত্য, আর্জ্জব প্রভৃতি গুণসমূহে বিভূষিত এবং সংহারসমবেত সমুদয় দিব্যাস্ত্র ও ধনুর্ব্বেদের একমাত্র আধার, উনি ভরদ্বাজনন্দন আচাৰ্য্য দ্রোণ। আমি উহার সহিত সংগ্রাম করিতে অভিলাষ করি। অতএব শীঘ্র রথচালনা করিয়া আমাকে আচাৰ্য্যসন্নিধানে লইয়া যাও।”

বিরাটনন্দন কুন্তীনন্দনের বাক্যানুসারে দ্রোণরথাভিমুখে হেমভূষণ অশ্বগণকে পরিচালনা করিলেন। যেমন কোন মত্তমাতঙ্গ অন্য মাতঙ্গের অভিমুখীন হয়, সেইরূপ দ্রোণাচাৰ্য্য সমীপগত মহারথ কৌন্তেয়ের প্রত্যুদগমন করিলেন। অনন্তর ভেরীশতনিনাদানুকারী শঙ্খধ্বনি সমুত্থিত হইল; সৈন্য উদ্ধৃত [উদ্বেলিত] সাগরের ন্যায় সংক্ষোভিত হইয়া উঠিল। শোণিতবর্ণ ও শ্বেতবর্ণ অশ্বসকল একত্ৰ হইলে সকলে বিস্মিত হইয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। গুরু ও শিষ্য উভয়েই মহাবীর; উভয়েই মহাবলপরাক্রান্ত, উভয়েই কৃতবিদ্য, উভয়েই দুর্জ্জয় এবং উভয়েই মহানুভব। ঈদৃশ উভয় বীর সংগ্ৰামমুখে পরস্পর সম্মুখীন হইয়াছেন দেখিয়া অতি মহতী ভারতী সেনা কম্পমান হইতে লাগিল। তখন মহাবাহু ধনঞ্জয় প্রীতিপ্ৰফুল্লবদনে দ্রোণাচাৰ্য্যকে অভিবাদন করিয়া মধুরবাক্যে বিনয়পূর্ব্বক কহিলেন, “হে সমরদুর্জয়! আমরা বনবাসী হইয়াছিলাম; এক্ষণে তাহার প্রতিবিধান করিতে উৎসুক হইয়াছি, অতএব আমাদিগের প্রতি জাতক্ৰোধ হইবেন না। আমি প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি, আপনি প্রথমে প্রহার না করিলে আপনাকে কদাচ প্ৰহার করিব না; এক্ষণে আপনি তাহা করুন।”

অনন্তর দ্রোণাচাৰ্য্য ধনঞ্জয়ের প্রতি শর নিক্ষেপ করিলে তিনি লঘুহস্ততানিবন্ধন দূর হইতে তাহা খণ্ড খণ্ড করিলেন। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্যও তৎক্ষণাৎ পার্থের কোপানল প্রজ্বলিত করিবার জন্যই যেন শরসহস্র দ্বারা তাঁহার রথ ও অশ্বগণ আচ্ছাদিত করিলেন। এইরূপে দ্রোণার্জ্জুনের সমকৃত্য সমারব্ধ হইল। তাঁহারা উভয়েই বিখ্যাতকর্মী, উভয়েই দিব্যাস্ত্ৰবিশারদ; অতএব উভয়ে শরজাল বর্ষণ করিয়া তত্রস্থ সমস্ত ভূপতি ও অন্যান্য যোদ্ধৃগণকে বিমোহিত করিলেন। তাহারা ধনঞ্জয়কে সাধুবাদ প্রদানপূর্ব্বক কহিতে লাগিল, “ধনঞ্জয় ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি দ্রোণাচাৰ্য্যের সহিত সংগ্ৰাম করিতে সমর্থ হইবে? ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্ম কি ভয়ানক! ধনঞ্জয় আচাৰ্য্যের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছেন!”

এদিকে বীরদ্বয় পরস্পর নিকটবর্তী হইয়া রোষাবেশে মরসমূহ দ্বারা পরস্পরকে আচ্ছাদন করিতে লাগিলেন। জাতক্ৰোধ ভারদ্বাজ দুদ্ধৰ্ষ শরাসন বিস্ফারিত করিয়া ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিলেন। তাঁহার নিক্ষিপ্ত নিশিত শরজালে দিবাকরের প্রভা আচ্ছাদিত হইল। যেমন ধারাধর [মেঘ] বৃষ্টিধারায় ধরাধরকে [পর্ব্বত] আচ্ছন্ন করে সেইরূপ মহারথ পাৰ্থ শাণিত শরসমূহে দ্রোণাচাৰ্য্যকে আচ্ছাদিত করিলেন। তিনি প্ৰফুল্লচিত্তে গাণ্ডীব গ্রহণপূর্ব্বক সুবর্ণখচিত বিচিত্র শরসমূহ নিক্ষেপ করিয়া ভারদ্বজের শরবর্ষণ নিবারণ করিলেন। তাঁহার চাপবিনির্মুক্ত শরজালে অদ্ভুত ব্যাপার উপস্থিত হইল। তিনি রথারোহণপূর্ব্বক বিচরণপূর্ব্বক যুগপৎ চতুর্দ্দিকে অস্ত্ৰজাল প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। গগনমণ্ডল যেন অবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া রহিল। দ্রোণাচাৰ্য্য যেন নীহারপরিবৃত হইয়া একেবারে অদৃশ্য হইলেন। প্রজ্বলিত পাবকপরিবৃত পর্ব্বতের যেরূপ শোভা হয়, ধনঞ্জয়ের শরসমূহে আচ্ছাদিত দ্রোণাচাৰ্য্যের রূপও সেইরূপ প্রতীয়মান হইতে লাগিল ।

রণবিশারদ দ্রোণাচাৰ্য্য স্বীয় রথ পার্থ-শরজালে। আচ্ছাদিত দেখিয়া শরাসন বিস্ফোরণ করিলেন; তখন তাঁহার আকৃতি অগ্নিচক্রের ন্যায় ও শব্দ মেঘধ্বনির ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তিনি যখন অর্জ্জুনের নিক্ষিপ্ত শরসমূহ প্রতিহত করেন, তখন তাহা হইতে দহ্যমান বংশের ন্যায় ঘোরতর শব্দ হইতে লাগিল। তিনি স্বচাপবিনির্গত কাঞ্চনময় শর-সমূহে সমুদয় দিক ও সূৰ্য্যের প্রভা আচ্ছাদিত করিলেন। তাঁহার কাঞ্চনপুঙ্খ নতপর্ব্ব শরসমূহ সংহত হইয়া গগনমণ্ডলে সমুত্থিত হইলে একমাত্র দীর্ঘশর [বাণের পশ্চাতে নিক্ষিপ্ত বাণী—এইরূপে বাণে বাণে মিলিত হইয়া দীর্ঘাকার] বলিয়া প্ৰতীত হইতে লাগিল।

এইরূপে তাঁহাদিগের কাঞ্চনপুঙ্খ শরসমূহে গগনমণ্ডলে উল্কাপারবৃতের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তখন তাঁহাদিগের কঙ্কপত্রবিভূষিত শরজাল আকাশবিহারী হংসপংক্তির ন্যায় শোভা ধারণ করিল। বৃত্ৰাসুরের সহিত পুরন্দরের যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, দ্রোণ ও ধনঞ্জয়ের যুদ্ধও সেইরূপ হইতে লাগিল। যেমন করিযুগল বিশাল দশনাগ্রভাগ দ্বারা পরস্পরকে আক্রমণ করে, সেইরূপ রণবিশারদ বীরদ্বয় রোষাবিষ্ট হইয়া দিব্যাস্ত্ৰ প্রয়োগপূর্ব্বক পরস্পরকে প্রহার করিতে লাগিলেন।”

দ্রোণাচাৰ্য্যের পরাজয়

জয়শীল অর্জ্জুন দর্শকগণের সমক্ষে শরজাল বর্ষণ করিয়া আচাৰ্য্যসমুৎসৃষ্ট শিলাশিত [প্রস্তরে শাণিত] শরসমূহ নিবারণপূর্ব্বক আকাশমণ্ডল আচ্ছাদিত করিলেন। আচাৰ্য্যপ্রধান ভরদ্বাজ উগ্ৰতেজাঃ অর্জ্জুনকে জিঘাংসাপরবশ নিরীক্ষণ করিয়া সন্নতপর্ব্ব শরসমূহ দ্বারা তাঁহার শর-সমুদয় নিবারণ করিতে লাগিলেন। এই যুদ্ধ দেবদানবযুদ্ধের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। দ্রোণাচাৰ্য্য, ঐন্দ্ৰ, বায়ব্য ও আগ্নেয় অস্ত্ৰ-সমুদয় নিক্ষেপ করিবামাত্র বীরবর ধনঞ্জয় স্বীয় অস্ত্ৰ দ্বারা তৎসমুদয় সংহার করিলেন। পর্ব্বতোপরি অনবরত বজ্রপাত হইলে যেরূপ শ্রবণবিদারণ অতি ভীষণ শব্দ সমুত্থিত হয়, অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত শরসমূহ সৈন্যগণের শরীরে নিপতিত হইয়া সেইরূপ শব্দ উৎপাদন করিতে লাগিল। তখন হস্তী, অশ্ব ও রথ সমুদয় শোণিতাক্ত হইয়া কুসুমিত কিংশুক-বৃক্ষের ন্যায় শোভমান হইতে লাগিল। সৈন্যগণ সংগ্রামে কেয়ূরবিভুষিত বাহু, বিচিত্র রথ, সুবৰ্ণময় কবচ ও ধ্বজসকল বিনিপাতিত এবং বীর-সকল নিহত হইয়াছে অবলোকন করিয়া একান্ত উদভ্ৰান্তচিত্ত হইয়া উঠিল। তখন তাঁহারা সেই ঘোরতর যুদ্ধে শরাসন কম্পিত করিয়া শরজাল দ্বারা প্ৰাণপণে পরস্পরকে সমাবৃত ও ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন।

অনন্তর অন্তরীক্ষে দ্রোণাচাৰ্য্যের প্রশংসাসূচক শব্দ সমুত্থিত হইল এই যে, “ভরদ্বাজ অতি দুষ্কর কর্ম্ম সম্পাদন করিতেছেন; যে অর্জ্জুন দেব ও দানবগণকে পরাজয় করিয়াছিলেন, ইনি সেই সেই মহাবীর দৃঢ়মুষ্টি দুৰ্দ্ধৰ্ষ ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধ করিতেছেন!” পরে দ্রোণাচাৰ্য্য ধনঞ্জয়ের অভ্রান্ততা, শিক্ষা, লঘুহস্ততা [শীঘ্রহস্তে বাণনিক্ষেপপটুতা] ও দূরদর্শিতা অবলোকন করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন।

অনন্তর কৌন্তেয় অমর্ষপরিপূরিত-চিত্তে গাণ্ডীবধনু সমুদ্যত করিয়া দুই হস্তে আকর্ষণ করিলেন। তখন সকলে শীলভশ্রেণীর ন্যায় তাঁহার বাণবর্ষণ অবলোকনে বিস্মিত হইয়া সাধুবাদ করিতে লাগিলেন। তিনি এরূপ অবিচ্ছিন্ন শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন যে, সমীরণও তাহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইল না। তিনি কোন সময়ে শর গ্রহণ করেন, তাহা কেহই অনুভব করিতে পারিল না। তাঁহার গাণ্ডীব হইতে যুগপৎ শত সহস্ৰ বাণ বিনির্গত হইয়া, দ্রোণাচাৰ্য্যের রথ-সামীপে নিপতিত হইয়া তাঁহাকে আচ্ছাদিত করিল। সৈন্যগণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে অর্জ্জুনশরে সমাচ্ছন্ন দেখিয়া হাহাকার করিতে লাগিল। পুরন্দর এবং তত্ৰস্থ গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরাগণ তাঁহার লঘুহস্ততার প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

অনন্তর রথযূথাধ্যক্ষ অশ্বত্থামা মনে মনে মহাত্মা অর্জ্জুনের বলবীৰ্য্যের প্রশংসা করিয়া, ক্রোধাভরে সহসা রথসমূহ দ্বারা তাঁহার গতিরোধপূর্ব্বক বর্ষণশীল পর্জ্জন্যের ন্যায় শরসহস্র নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুন অশ্বত্থামার গতিরোধ করিয়া দ্রোণাচাৰ্য্যকে প্রস্থান করিবার অবকাশ প্ৰদান করিলেন। ছিন্নবর্ম্ম, ছিন্নধ্বজ, ক্ষতবিক্ষতকলেবর দ্রোণাচাৰ্য্য বেগগামী তুরঙ্গের সাহায্যে সে স্থান হইতে প্ৰস্থান করিলেন।