৫৫. অর্জ্জুন-দুৰ্য্যোধন যুদ্ধ

৫৫তম অধ্যায়

অর্জ্জুন-দুৰ্য্যোধন যুদ্ধ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, নৃপবর! রাধেয় [কর্ণ] প্রস্থান করিলে পর দুৰ্য্যোধন-প্রমুখ বীরপুরুষগণ স্ব স্ব সৈন্য-সমভিব্যাহারে পাণ্ডবকে আক্রমণ করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। নির্ভীক বীভৎসু সহাস্যবদনে বেলার ন্যায় সাগরসদৃশ কৌরবসেনার বেগধারণ করিয়া দিব্যাস্ত্ৰসকল নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। যেমন মরীচিমালীর [সূৰ্য্যের] কিরণজালে মেদিনীমণ্ডল আচ্ছাদিত হয়, তদ্রূপ পার্থের গাণ্ডীবনিমুক্ত বিশিখ-সমূহে [বাণ] দশদিক আচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। অর্জ্জুন নিশিত শর দ্বারা বিপক্ষপক্ষের অশ্ব, রথ ও গজের শরীর সকল এমন বিদ্ধ করিলেন যে, তাহাতে দুই অঙ্গুলি মাত্রও অনন্তর রহিল না। কৌরবেরা অশ্বগণের অলৌকিক গতি-বৈচিত্ৰ্য, উত্তরের শিক্ষানৈপুণ্য, অস্ত্ৰশস্ত্রের প্রয়োগ-কৌশল এবং পার্থের দিব্য শক্তি ও অপ্ৰতিহত প্রভাব নিরীক্ষণে বিস্মিত হইয়া ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তাহাদিগের বোধ হইল যেন, প্রজ্বলিত কালগ্নি প্রজা-সকল দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছে। ফলতঃ তৎকালে অর্জ্জুন এরূপ প্ৰদীপ্ত হইয়াছিলেন, যে, শত্ৰুগণ তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেও সমর্থ হয় নাই।

সূৰ্য্যরশ্মি পর্ব্বতস্থ অভ্রপটলে [মেঘমণ্ডল] সংক্রান্ত হইলে যেমন চমৎকারিণী শোভা হয় এবং বিকশিত অশোককুসুমসুষমায় বনভূমি যেমন পরম দর্শনীয় হয়, তদ্রূপ কৌরববাহিনী অর্জ্জুনশরে বিদ্ধ হইয়া অনির্ব্বচনীয় শোভা পাইতে লাগিল। ছিন্নযুগ [যোয়াল—বর্ত্তমান কালের অশ্ববন্ধনের রথরজ্জু] অশ্বগণ ভীত হইয়া রথাঙ্গদেশ বহনপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। প্ৰকাণ্ড প্ৰকাণ্ড মাতঙ্গগণ অর্জ্জুনশরে ক্ষতবিক্ষত ও বিচেতন হইয়া সমরাঙ্গনে নিপতিত হইতে লাগিল। রণক্ষেত্রে সমরশায়ী গজযূথের শরীরে পরিব্যাপ্ত হইয়া মেঘাবৃত নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। রাজন! যেমন যুগান্তসময়ে কালাগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া সমুদয় স্থাবর-জঙ্গম নিঃশেষরূপে দগ্ধ করে, তদ্রূপ অর্জ্জুন ভয়ঙ্কর সমরানল উদ্দীপনপূর্ব্বক রিপুকুল ভস্মাবশেষ করিলেন।

অনন্তর দুৰ্য্যোধনসেনা মহাবল-পরাক্রান্ত কপিধ্বজের অস্ত্রপ্রভাব নিরীক্ষণ এবং গাণ্ডীবের নিম্বন ধ্বজাস্থিত ভূতগণের অলৌকিক শব্দ ও কপিবরের ভৈরব রব শ্রবণ করিয়া নিতান্ত ভীত হইল। শত্ৰুগণের রথ্যাঙ্গ পূর্ব্বেই ভগ্ন হইয়াছে, সুতরাং শীঘ্র পলায়ন করিতে পারিল না। অর্জ্জুন সাহসপূর্ব্বক সহসা তাহাদিগের পশ্চাদভাগে উপস্থিত হইয়া অনবরত শরবর্ষণ দ্বারা গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুনবাণ সূৰ্য্যকিরণের ন্যায় অতি তীক্ষ্ণ ও অসংখ্যেয়। ফলতঃ অর্জ্জুন যুগপৎ এত অধিক শর পরিত্যাগ করিয়াছিলেন যে, শক্ৰশরীরে তাহাদিগের স্থান পৰ্য্যাপ্ত হইল না এবং যুদ্ধাহত সৈনিকদিগের শরীর দ্বারা পথ রুদ্ধ হওয়াতে তাঁহার রথও শক্রমধ্যে প্রবেশ করিতে পারিল না। যেমন অনন্তভোগ ভূজগ মহার্ণবে ক্রীড়া করে, তদ্রূপ অর্জ্জুন অনবরত শরবর্ষণপূর্ব্বক সমরসাগরে ক্রীড়া করিতে লাগিলেন। ভূতগণ অশ্রুতপূর্ব্ব গাণ্ডীবনির্ঘোষ শ্রবণ করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইল। তিনি চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করিয়া সব্যদক্ষিণপার্শ্বে অবিশ্রান্ত বাণনিক্ষেপ করাতে সতত সায়কের আসনমণ্ডল লক্ষিত হইতে লাগিল। যেমন চক্ষু রূপশূন্য পদার্থে কদাচ পতিত হয় না, সেইরূপ অর্জ্জুনশর কোনক্রমেই অলক্ষ্যে পতিত হইল না। সহস্ৰ গজ এককালে বনমধ্যে গমন করিলে যেমন প্রশস্ত পথ হইয়া উঠে, আজি রণক্ষেত্রে পার্থের রথমাৰ্গও সেইরূপ হইল। শত্রুগণ পার্থশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, বোধহয়, দেবরাজ পার্থকে জয়ী করিবার মানসে অমরগণ সমভিব্যাহারে সমর সাগরে অবতীর্ণ হইয়া আমাদিগের সংহার করিতেছেন। কেহ কেহ মনে করিল, সাক্ষাৎ কৃতান্ত অর্জ্জুনরূপ পরিগ্রহ করিয়া প্ৰজা সকল সংহার করিতে উদ্যত হইয়াছেন। কৌরবসেনার মধ্যে যাহারা পার্থ কর্ত্তৃক আহত হয় নাই, তাহারও অর্জ্জুনের প্রভাবে আহতের ন্যায় অবসন্ন হইয়া রহিল।

এইরূপ অর্জ্জুনভয়ে কৌরবগণের বলবীৰ্য্য ক্রমশঃ হ্রাস হইতে লাগিল। অর্জ্জুনের সুতীক্ষ্ণ শরজালে তাহাদিগের কলেবর ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল; রুধিরধারায় ধরণী, আপ্লাবিত হইল; শোণিতলিপ্ত ধূলিপটল বায়ুবেগে নভোমণ্ডলে উড্ডীন হওয়াতে সূৰ্য্যদেবের রশ্মিজাল একান্ত রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। তৎকালে বোধ হইতে লাগিল যেন, গগনতল সন্ধ্যারাগে রঞ্জিত হইয়াছে।

অস্তকাল উপস্থিত হইলে দিবাকরও বিশ্রাম করিয়া থাকেন; কিন্তু মহাবীর অর্জ্জুন কদাচ সমরে নিবৃত্ত হয়েন না। তিনি সেই সমস্ত ধনুৰ্দ্ধর কুরুপ্রবীরদিগকে লক্ষ্য করিয়া অনবরত দিব্যাস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; দ্রোণাচাৰ্য্যের প্রতি ত্রিসপ্ততি ক্ষুরপ্রনিক্ষেপ [ফলকাকৃতি ক্ষুরধার অস্ত্ৰ—ক্ষুরপো] করিয়া দুঃসহকে দশ, অশ্বত্থামাকে অষ্ট, দুঃশাসনকে দ্বাদশ, কৃপাচাৰ্য্যকে তিন, ভীষ্মকে ষষ্টি ও মহারাজ দুৰ্য্যোধনকে একশত শরাঘাত করিলেন। তৎপরে কর্ণি [কণিকাকুসুমসদৃশ বাণ] দ্বারা মহাবীর কর্ণের কর্ণদ্বয় বিদ্ধ করিয়া তাঁহার সারথিকে সংহারপূর্ব্বক রথ ও অশ্বসকল চূৰ্ণ করিয়া ফেলিলেন। তদর্শনে তদীয় সেনাগণ নিতান্ত ভীত হইয়া চারিদিকে পলায়ন করিতে লাগিল।

উত্তরসমীপে রণক্ষেত্রগত কৃপ প্রভৃতির পরিচয়

তখন বিরাটতনয় উত্তর মহাবীর পার্থের অভিপ্ৰায় সম্যক অবগত হইয়া কহিলেন, “হে মহাত্মন! এক্ষণে কোন সৈন্যগণের সম্মুখীন হইতে বাসনা করেন, আজ্ঞা করুন, আমি তাহাদের সমীপে রথ উপনীত করি।” অর্জ্জুন কহিলেন, “হে রাজকুমার! যিনি লোহিত অশ্বসংযুক্ত নীলপতাকা-পরিশোভিত রথে আরোহণ করিয়া রহিয়াছেন, উহার নাম কৃপাচাৰ্য্য; তুমি উঁহারই সৈন্যসমক্ষে আমাকে লইয়া যাও ; আমি উহার সমীপে স্বীয় শরপ্রয়োগনৈপুণ্যের সবিশেষ পরিচয় প্রদান করিব। যাহার ধ্বজদণ্ডে সুবর্ণনির্ম্মিত কমণ্ডলু পরিশোভিত হইতেছে, উনিই ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য মহাবলপরাক্রান্ত দ্রোণাচাৰ্য্য। ঐ মহাবীর আমার ও অন্যান্য শস্ত্ৰধারীদিগের মান্য ও পূজনীয়। এক্ষণে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া বিধানানুসারে উহাকে প্ৰদক্ষিণ করিতে হইবে। যদি আচাৰ্য্য অগ্রে আমাকে প্রহার করেন, তবে আমিও উঁহাকে প্রহার করিব; তাহা হইলে উনি আমার প্রতি রোষাবিষ্ট হইবেন না।

“যিনি দ্রোণাচার্য্যের অনতিদূরে অবস্থান করিতেছেন, যাঁহার ধ্বজদণ্ডে কোদণ্ড [ধনুঃ] লম্বমান রহিয়াছে উনি আচাৰ্য্যপুত্ৰ মহারথ অশ্বত্থামা। উনিও আমার এবং অন্যান্য শস্ত্ৰধারীদিগের মান্য ও পূজনীয়। তুমি উহার রথসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়াই প্রতিনিবৃত্ত হইবে। যিনি সুবর্ণবর্ম্ম ধারণপূর্ব্বক প্রধান প্রধান সৈন্যসমুদয়ে রক্ষিত হইয়া রথোপরি অধিরূঢ় রহিয়াছেন, যাঁহার ধ্বজাগ্রে হেমকেতনলাঞ্ছিত [সুবৰ্ণ-পতাকা-চিহ্নিত] মাতঙ্গ পরিশোভিত হইতেছে, উনি ধৃতরাষ্ট্রাত্মজ শ্ৰীমান দুৰ্য্যোধন। উনি নিতান্ত যুদ্ধদুর্ম্মদ এবং ক্ষিপ্ৰকারিতা-বিষয়ে দ্রোণাচাৰ্য্যের প্রধান শিষ্য বলিয়া পরিগণিত। তুমি উহার সমক্ষে রথ লইয়া যাইবে, আমি উহার নিকট স্বীয় ক্ষিপ্ৰকারিতা প্ৰকাশ করিব।

“যাঁহার ধ্বজাগ্রে রমণীয় নাগবন্ধন—রজ্জু [রজ্জু দ্বারা আবদ্ধ হস্তী] লম্বমান রহিয়াছে, উনি তোমার পূর্ব্বপরিচিত কর্ণ। উনি সততই আমার সহিত স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাকেন, তুমি উহার রথসন্নিধানে গমন করিয়া সংগ্রামে সাবধান হইবে। যাহার রথে সূৰ্য্যতারালাঞ্ছিত [সূৰ্য্যমুখ নামক উজ্জ্বল তারা দ্বারা চিহ্নিত] ধ্বজ ও মস্তকে পাণ্ডুরবর্ণ সুনির্ম্মল আতপত্র পরিশোভিত হইতেছে, যিনি জলধর সন্নিহিত প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় সৈন্যগণ-সমক্ষে অবস্থান করিতেছেন, যিনি চন্দ্রার্কসঙ্কাশ সুবর্ণ-শিরস্ত্ৰাণ [স্বর্ণখচিত উষ্ণীষ-পাগড়ী] ধারণ করিয়াছেন, 
উনি আমাদিগের পিতামহ শান্তনুনন্দন ভীষ্ম। ঐ মহাবীর দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের একান্ত বশংবদ। আমরা স
র্ব্বশেষে উহার নিকট গমন করিব। উনি আমার অনিষ্টসাধন করিতে পরিবেন না। আমি যখন উহার সহিত সংগ্রাম করিব, তৎকালে তুমি যত্নপূর্ব্বক অশ্বের রশ্মি সংযত করিয়া রাখিবে।” অনন্তর উত্তর যে স্থানে কৃপাচাৰ্য্য যুদ্ধ করিবার মানসে অবস্থান করিতেছেন, অর্জ্জুনকে লইয়া তথায় সমুপস্থিত হইলেন।