৬৭. অর্জ্জুনের যুদ্ধজয়

৬৭তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের যুদ্ধজয়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! বৃষভলোচন ধনঞ্জয় সংগ্রামে জয়লাভ করিয়া বিরাটরাজের গোধন সমস্ত আনয়ন করিলেন। তখন ভয়বিহ্বলচিত্ত, মুক্তকেশ, ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত কাতর কতকগুলি বৈদেশিক কুরুসৈন্য অরণ্যানী হইতে বিনিষ্ক্রান্ত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে অর্জ্জুনকে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক কহিল, “আমরা আপনার কি করিব অনুমতি করুন।” অর্জ্জুন কহিলেন, “আমি তোমাদিগকে আশ্বাসিত করিতেছি, তোমাদের কিছুমাত্র ভয় নাই; তোমরা পরমসুখে প্ৰস্থান কর, আমি কদাচ আর্ত্তব্যক্তির প্রাণহিংসা করি না।”

সৈনিকগণ অর্জ্জুনের অভয়বাক্য শ্রবণ করিয়া কীর্ত্তিবৰ্দ্ধন ও আয়ুঃপ্রদ আশীর্ব্বাদ-প্রয়োগে তাঁহাকে অভিনন্দন করিল। অনন্তর ধনঞ্জয় বিনিবৃত্ত শত্ৰুগণকে অতিক্রম করিয়া মত্ত-মাতঙ্গের ন্যায় নগারাভিমুখে গমন করিলেন। কৌরবগণ আর তাঁহাকে আক্রমণ করিতে সমর্থ হইলেন না।

এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন মেঘসঙ্কাশ কুরুসৈন্যগণকে অপসারিত করিয়া উত্তরকে কহিলেন, “তাত! পাণ্ডবগণ যে তোমার পিতার নিকট বাস করিতেছেন, তাহা তুমিই কেবল অবগত হইলে; কিন্তু নগরে প্রবেশ করিয়া উহা কদাচ প্ৰকাশ করিও না, তাহা হইলে অতিমাত্র ভয়াবশতঃ তোমার পিতার প্ৰাণনাশ হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। তুমি তাঁহার নিকটে কৌরবগণের পরাজয় ও গোধন-প্রত্যাহরণ আত্মকৃত বলিয়া প্ৰকাশ করিবে।”

উত্তর কহিলেন, “মহাশয়! আপনি যে কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়াছেন, আমি যে তাহা সম্পাদন করি, ঈদৃশ সামৰ্থ্য আমার নাই; তবে এইমাত্র অঙ্গীকার করিতে পারি যে, আপনি যাবৎ অনুমতি প্ৰদান না করিবেন, তাবৎ আপনার কথা পিতার সকাশে প্রকাশ করিব না।

কৌরবপলায়ন-অর্জ্জুন-সারথি উত্তরের প্রত্যাবর্ত্তন

এইরূপ কথোপকথনের পর শরবিক্ষতশরীর [বাণ দ্বারা ছিন্ন] ধনঞ্জয় শ্মশানবর্তী শমীতরুসমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন বহ্নিপ্রতিম মহাকপি ভূতগণ ও দৈবী মায়াসমভিব্যাহারে স্বর্গে গমন করিলেন; স্যন্দনে পুনরায় সিংহধ্বজ সংযোজিত হইল। রাজকুমার উত্তর পাণ্ডবগণের সমরবিবৰ্দ্ধন আয়ুধ, তূণ ও শরসমুদয় পূর্ব্ববৎ বিন্যস্ত করিলে মহাত্মা ধনঞ্জয় পূর্ব্বের ন্যায় বেণীবন্ধনপূর্ব্বক বৃহন্নলাররূপে রাজপুত্রের অশ্বরশ্মি গ্রহণ করিলেন। রাজপুত্ৰ উত্তর পার্থ-সারথি-সমভিব্যাহারে নগরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

পথিমধ্যে ফালগুন [অর্জ্জুন] উত্তরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র! অবলোকন কর, তোমার সমস্ত গোধন গোপালগণের সহিত সমানীত হইয়াছে। গোপালগণ তোমার অনুমতিক্রমে বাজিগণকে সলিল পান ও স্নান করাইয়া আশ্বস্তচিত্তে নগরে গমনপূর্ব্বক প্রিয়সংবাদ ও তোমার বিজয়ঘোষণা করুক। আমরা অপরাহ্নে গমন করিব।” উত্তর অর্জ্জুনের বাক্যে ত্বরমাণ হইয়া দূতগণকে আজ্ঞা করিলেন, “তোমরা নগরে গমনপূর্ব্বক শত্ৰুগণ পরাজিত ও গোধন প্রত্যাহত হইয়াছে, প্রচার কর।” অনন্তর বিজয়পরিতৃপ্ত উত্তর ও পার্থ পূর্বোৎকৃষ্ট [পূর্ব্বপরিত্যক্ত] স্ব স্ব অলঙ্কার পরিধান করিলেন এবং উত্তর রথী ও বৃহন্নলা সারথি হইয়া নগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। এ দিকে পরাজিত কৌরবগণ অতি বিষন্নবদনে দীনমনে হস্তিনানগরে গমন করিলেন।