৫৪. কর্ণের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ

৫৪তম অধ্যায়

কর্ণের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপে ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য ধনঞ্জয় স্বীয় অসাধারণ বলবিক্রমে শক্রসেনাগণকে পরাজয়পূর্ব্বক গোধন মুক্ত করিয়া যুদ্ধাভিলাষে পুনরায় দুৰ্য্যোধনের সমীপে গমন করিলেন। কৌরবগণ গো-সমুদয়সহ বেগে মৎস্যাভিমুখে গমন করিতেছে ও মহাবীর ধনঞ্জয় কৃতকাৰ্য্য হইয়া দুৰ্য্যোধনের সম্মুখীন হইতেছেন দেখিয়া সহসা তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। অরাতিনিপাতন অর্জ্জুন বহুলধ্বজপতাকাশালী প্রভূত কৌরবসৈন্য সন্দর্শন করিয়া উত্তরকে সম্বোধনপূর্ব্বক, কহিলেন, “রাজপুত্ৰ! সত্বর এই রথ চালনা কর, তাহা হইলে অনায়াসে কুরুবীরগণের মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে পরিবে। ঐ দেখ, সূতপুত্ৰ কৰ্ণ মত্তমাতঙ্গের ন্যায় আমার সহিত সংগ্রাম করিতে সমুদ্যত হইয়াছে! ঐ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের আশ্রয়বলে একান্ত দর্পিতা; তুমি সত্বর উহার নিকট আমাকে লইয়া চল।” বিরাটতনয় অর্জ্জুনের নির্দেশানুসারে সত্বর সুবৰ্ণকক্ষ [সুবর্ণনির্ম্মিত বর্ম্মস্থানীয় আচ্ছাদনে আবৃত] শ্বেতবর্ণ অশ্বসমুদয় চালনপূর্ব্বক শত্রুসৈন্য বিনাশ করিয়া রণস্থলে ধনঞ্জয়কে উপনীত করিলেন।

তখন চিত্ৰসেন প্রভৃতি বীরগণ কর্ণের সাহায্যবলে অর্জ্জুনের উপর শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল; মহাবীর ধনঞ্জয়ও শরাসননির্মুক্ত শরানল দ্বারা আরাতিকানন দগ্ধ করিতে লাগিলেন। এইরূপে তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইলে পর বিকর্ণরথারোহণপূর্ব্বক পার্থসমীপে সমাগত হইয়া তাহার উপর শর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। তখন অরাতিনিসূদন পার্থ সুবর্ণালঙ্কৃত দৃঢ়মৌকব্বীক [কঠিন ছিলাযুক্ত] শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক বিকর্ণকে ভূতলে পাতিত ও তাহার ধ্বজচ্ছেদন করিলেন। বিকৰ্ণ পতিত হইবামাত্র দ্রুতবেগে প্ৰাণ লইয়া পলায়ন করিল।

বিকৰ্ণ পলায়ন করিলে পর শক্ৰন্তপ আরাতিনিপাতন অর্জ্জুনের অলৌকিক কার্য্য অবলোকনে অতিশয় অমর্ষপরবশ হইয়া তাঁহার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিল। মহাবীর ধনঞ্জয় শক্রন্তপের শরাঘাতে সমধিক সংক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে পাঁচ বাণ ও তাহার সারথিকে দশ বাণ দ্বারা বিদ্ধ করিলেন। শক্রন্তপ ঐ পঞ্চশরাঘাতেই প্ৰাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পর্ব্বতাগ্র হইতে বিপতিত বাতভগ্ন পাদপের ন্যায় ভূতলে পতিত হইল। তখন অন্যান্য বীরপুরুষগণ অর্জ্জুনের শরাঘাতে জর্জরিত হইয়া বায়ুবেগে বিকম্পিত মহাবনের ন্যায় প্রকম্পিত হইয়া উঠিল। ইন্দ্ৰতুল্য প্রতাপশালী হিমালয়জাত মহাগজতুল্য পরাক্রান্ত সুবেশধারী বীরগণ পার্থশরে প্রাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পৃথীতলে শয়ন রহিল।

যেমন দাবানল নিদাঘসময়ে [গ্রীষ্ম] কানন দগ্ধ করিয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করে, তদ্রূপ বীরবরাগ্রগণ্য ধনঞ্জয় সমরে শক্রসঙঘ সংহারপূর্ব্বক রণস্থলে ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে লাগিলেন। যেমন সমীরণ বসন্তকালে পতিতপত্র ও মেঘ-সমুদয় ইতস্ততঃ বিদীর্ণ করে, তদ্রূপ মহাবীর অর্জ্জুন রণস্থলে অরাতিগণকে ছিন্ন ভিন্ন করিয়া সত্বর কর্ণের ভ্রাতার অশ্বগণ সংহারপূর্ব্বক এক বাণে তাহার মস্তকচ্ছেদন করিলেন।

কর্ণের পলায়ন

অনন্তর ব্যাঘ্র যেমন বৃষভের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ মহাবীর কৰ্ণ ভ্রাতাকে বিনষ্ট দেখিয়া ক্রোধাভরে অর্জ্জুনের সমীপবর্তী হইয়া দ্বাদশ বাণ দ্বারা তাঁহার অশ্বগণ, সারথি ও তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। গরুড় যেমন সৰ্পের উপর নিপতিত হয়, তদ্রূপ মহাবল-পরাক্রান্ত ধনঞ্জয় সহসা কর্ণের সম্মুখীন হইলেন। তথায় আগমন করিলে পর ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য ধনঞ্জয় ক্ৰোধাভরে মুহূৰ্তমধ্যে শর বর্ষণ দ্বারা কর্ণ এবং তাঁহার অশ্ব, রথ ও সারথিকে অন্তর্হিত করিলেন। ভীষ্ম প্রভৃতি অন্যান্য বীরগণ এবং তাঁহাদিগের রথ, অশ্ব ও গজ সমুদয়ও অর্জ্জুনের শরে সমাচ্ছন্ন হইল। তখন মহাবীর কৰ্ণ বহুতর শর-নিক্ষেপ দ্বারা পার্থের সমুদয় বাণ নিরস্ত করিয়া ধনুর্ব্বাণ ধারণপূর্ব্বক স্ফুলিঙ্গবাণ হুতাশনের ন্যায় নিঃশঙ্কচিত্তে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কৌরবগণ তদর্শনে সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া করতালি প্ৰদান ও শঙ্খ, ভেরী [জয়ঢাক] পণব [মাদল-বাদ্যবিশেষ] প্রভৃতি বিবিধ বাদ্যবাদনপূর্ব্বক কর্ণের প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিলেন; কৰ্ণ গাণ্ডীবধন্বা অর্জ্জুনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলে তিনি তখন ভীষ্ম, দ্রোণ, ও কৃপকে অবলোকনপূর্ব্বক কর্ণ এবং তাহার রথ, অশ্ব, ও সারথিকে লক্ষ্য করিয়া বাণ বর্ষণ করিতে লাগিলেন। কর্ণও বিবিধ সায়ক দ্বারা অর্জ্জুনকে আচ্ছাদিত করিলেন। তৎকালে সেই দুই বীরপুরুষকে মেঘমুক্ত রথারূঢ় চন্দ্ৰসূৰ্য্যের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল।

তৎপরে লঘুহস্ত [ক্ষিপ্ৰহস্ত] কৰ্ণ সত্বর অর্জ্জুনের অশ্বগণকে বাণিবিদ্ধ করিয়া তাঁহার সারথির প্রতি তিন শর ও ধ্বজের উপর তিন শর নিক্ষেপ করিলেন। সূৰ্য্য যেমন রশ্মি দ্বারা এককালে জগৎ ব্যাপ্ত করেন, তদ্রূপ মহাবীর ধনঞ্জয় সুপ্তোথিত সিংহের ন্যায় ক্ৰোধান্বিত হইয়া শরনিকর দ্বারা কর্ণের রথ আচ্ছাদনপূর্ব্বক তূণীর হইতে নিশিত ভল্ল নিষ্কাশিত করিয়া ত্বরায় তাঁহার গাত্র বিদ্ধ করিলেন। পরে সুশাণিত শরজাল দ্বারা সূতপুত্রের বাহু, শির, উরু, ললাট ও গ্রীবাদেশ ভেদ করিলে পর গজ যেমন অন্যগজ কর্ত্তৃক পরাজিত হইলে পলায়ন করে, তদ্রূপ তিনি তখন অশনিসন্নিভ শরপ্ৰহারে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিলেন।