৬২. অর্জ্জুনসহ কৌরবগণের তুমুল যুদ্ধ

৬২তম অধ্যায়

অর্জ্জুনসহ কৌরবগণের তুমুল যুদ্ধ

বৈশম্পয়ন কহিলেন, মহারাজ! তখন কৌরবপক্ষীয় সমুদয় মহারথগণ একত্র হইয়া অর্জ্জুনকে শরাঘাত করিতে লাগিলেন; মহাবীর ধনঞ্জয়ও শরজাল দ্বারা তাঁহাদিগকে আচ্ছাদিত করিলেন। অশ্বগণের হ্রেষা, করিকুলের বৃংহিত এবং ভেরী ও শঙ্খের নিনাদ একত্র হওয়াতে এক তুমুল শব্দ সমুপস্থিত হইল। অর্জ্জুন-নিমুক্ত শরনিকর অশ্ব ও করিসমুদয়ের দেহ এবং লৌহময় কবচ-সকল ভেদ করিয়া বিনিৰ্গত হইতে লাগিল। যেমন শরৎকালীন দিবাকর মধ্যাহ্নসময়ে স্বীয় প্রখর কিরণজাল নিক্ষেপ করেন, তদ্রূপ মহাতেজস্বী ধনঞ্জয় রণস্থলে অনবরত বাণবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। তদর্শনে কৌরবপক্ষীয় রথিসকল রথ হইতে ও অশ্বারোহিগণ অশ্ব হইতে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক ভয়চকিত-মনে পলায়ন করিতে লাগিলেন। পদাতিগণ প্রাণভয়ে ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। অর্জ্জুনের সুশাণিত শরনিকরে বীরপুরুষগণের তাম্র, রজত ও লৌহময় বর্ম্ম সমুদয় ছিন্নভিন্ন হওয়াতে কঠোর শব্দ সমুত্থিত হইতে লাগিল। গীতজীবিত গজারোহী, অশ্বারোহী ও রথোপান্ত হইতে নিপতিত জন-সমুদয়ের কলরবে রণক্ষেত্র একেবারে ব্যাপ্ত হইয়া উঠিল। তখন বোধ হইতে লাগিল মহাবীর ধনঞ্জয় শরাসন হস্তে করিয়া যেন নৃত্য করিতেছেন। বজ্রনির্ঘোষসদৃশ গাণ্ডীবনিনাদ শ্রবণে সমুদয় সৈন্য বিত্ৰস্ত হইয়ারণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল। কুন্তল ও উষ্ণীশোভিত৷ দিব্যমাল্যবিভূষিত মস্তক-সকল রণক্ষেত্রে নিপতিত হইল। বাণ দ্বারা ছিন্নকায়, দিব্যাভরণভূষিত, কামুকযুক্ত হস্ত ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গে রণস্থল পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সৈন্যগণের মস্তক-সমুদয় নিশিত সায়কে ছিন্ন হইয়া নিপতিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, আকাশমণ্ডল হইতে শিলাবৃষ্টি হইতেছে।

মহাবীর ধনঞ্জয় ইতিপূর্ব্বে ত্রয়োদশ বৎসর অবরুদ্ধ ছিলেন; এক্ষণে অবসর প্রাপ্ত হইয়া স্বীয় পরাক্রম প্রকাশপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্ৰতনয়ের উপর ক্রোধাগ্নি বিসর্জন করিতে লাগিলেন। মহাধনুৰ্দ্ধরগণ অর্জ্জুনের শরানলে সৈন্য সকল দগ্ধ হইতেছে দেখিয়া দুৰ্য্যোধনের সমক্ষেই ভগ্নোৎসাহ হইয়া উঠিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় এইরূপে মহারথগণকে ত্ৰাসিত ও বিদ্রাবিত করিয়া প্ৰভূত সৈন্যসংক্ষয় করিয়া রণক্ষেত্রমধ্যে কবচোষ্ণীসঙ্কুল, শ্বাপদগণনিনাদিত, ক্ৰব্যাদ [আমমাংসভোজী শৃগালাদি], নিষেবিত, অতি ভয়ঙ্কর শোণিত নদী প্রবাহিত করিলেন; দেখিলে বোধ হয় যেন, যুগান্তে কালকর্ত্তৃক উহা নির্ম্মিত হইয়াছে। তাহাতে অস্থিসকল শৈবালের ন্যায়, শরাসন-সকল ভেলার ন্যায়, মুক্তহারজাল উৰ্মিমালার ন্যায়, কেশকলাপ শাদ্বলের [শ্যামল তৃণ] ন্যায়, অলঙ্কারনিকর বুদবুদের ন্যায়, মাতঙ্গগণ কুর্ম্মের ন্যায়, তীক্ষ্ন শস্ত্ৰ-সকল গ্রাহের [কুন্তীরের] ন্যায়, শরসমূহ আবর্তের [জলঘূর্ণি] ন্যায় ও বৃহৎ বৃহৎ রথসমূহ মহাদ্বীপের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তৎকালে মহাবীর ধনঞ্জয় যে কখন শর গ্রহণ করিতেছেন, কখন শর-সন্ধান করিতেছেন, কখন শর নিক্ষেপ করিতেছেন এবং কখনই বা গাণ্ডীব আকর্ষণ করিতেছেন, ইহা কেহই অবগত হইতে পারিল না।