পটল জিনিসটা যে কত মূল্যবান, তা বোঝা গেল প্যারিসে এসে। আমি খুব একটা তরিতরকারির ভক্ত নই, যা পাই তাই খেয়ে নিই। খাওয়ার পাতে মাছ-মাংস আসবার আগে শাক-চচ্চড়ি যেন প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে প্রেমিকার দাদার সঙ্গে পাড়া-পলিটিক্স নিয়ে আলোচনা। সৈয়দ মুজতবা আলি লিখেছিলেন, যেন পণ্ডিত মশাইয়ের হাতে বেত খাওয়ার আগে কানমলা।
পটলের সঙ্গে পটল-তোলার সম্পর্ক আছে বলে বরং ও জিনিসটা সম্পর্কে আমার মনে একটু বিরাগ ভাবই আছে। প্যারিসে বসে যে পটলের গুণগান শুনতে হবে, তা কোনওদিন কল্পনাই করিনি।
দেশ ছেড়ে বাইরে এলে টের পাওয়া যায়, বাঙালি যুবকরা রান্নায় কত পটু। যে-কোনও বাঙালি আড্ডায় রান্নার প্রসঙ্গ উঠবেই। তখন জানা যাবে যে অমুক ইঞ্জিনিয়ার কত ভালো মাছের ঝাল রান্না করেন, আর তমুক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ধোঁকার ডালনা বেঁধে কতজনকে মুগ্ধ করেছেন। এঁরা অবিবাহিত। আর যাঁরা মাঝখানে একবার দেশে গিয়ে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে এনেছেন, তাঁদের গিন্নিরাও কম যান না। ব্রেবোর্ন বা লোরেটোতে পড়া যেসব বাঙালি মেয়ে দেশে থাকতে কোনওদিন রান্না ঘরে ঢোকেননি, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন কিংবা ভারত নাট্যম নাচতেন, তাঁরাও বিদেশে এসে চিংড়িমাছের মালাইকারি কিংবা ডিম-সন্দেশ বানাতে শিখে যান।
এক বাঙালি আড্ডায় ডঃ দাস হঠাৎ আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করলেন সামনের শনিবারে। তা শুনে রায়বাবু বললেন, ঝিঙে-পোস্ত খাওয়াবেন তো? আপনার হাতে কিন্তু পোস্তর রান্না দারুণ খোলে।
দাসবাবু বললেন, ঝিঙে-পোস্ত তো অনেকবার খেয়েছেন, আসুন না। এই শনিবারে আপনাদের মোচার ঘণ্ট খাওয়াব!
তাই শুনে এক মুখার্জি বললেন, মোচা? আপনি মশাই মোচা কোথায় পেলেন? আমি তো কখনও দেখিনি!
যেন দারুণ একটা রহস্যের সন্ধান দিচ্ছেন, এইভাবে দাসবাবু বললেন, শুধু মোচা কেন, আমি থোড় পর্যন্ত পেয়েছি। কোথায় জানেন? ভিয়েতনামি বাজারে!
আমার মতন নতুন-আসা লোকের কাছে এসব কথা ধাঁধার মতন লাগে। ঝিঙে-পোস্ত, মোচার ঘন্টা, ঘোড়…এরপর কি নিম বেগুনের কথাও শুনতে হবে? এ যে আমার বিধবা দিদিমার রান্নার লিস্টি। প্যারিসের সব বিখ্যাত খাদ্যদ্রব্য ছেড়ে এসব কী?
রায়বাবু বললেন, আমি ভিয়েতনামি বাজারে যাই মাঝে-মাঝে কাঁচা লঙ্কা কিনতে। একদম আমাদের দেশের মতন কাঁচা লঙ্কা কিনতে পাওয়া যায়, দারুণ ঝাল!
সদ্য দেশ থেকে আসা আর একজন রায়বাবু বললেন, কাঁচা লঙ্কা? চলুন, চলুন, আজই কিনে আনি। কতদিন কাঁচা লঙ্কা খাইনি! আমি তো লঙ্কা ছাড়া কোনও জিনিসের স্বাদই পাই না।
আমি জিগ্যেস করলুম, ভিয়েতনামি বাজার ব্যাপারটা কী?
তখন সবাই মিলে আমাকে বোঝালেন যে গত কয়েক বছর ধরে প্যারিসের শহরতলিতে প্রচুর ভিয়েতনামের শরণার্থী এসে বসতি নিয়েছে। এমনকী তারা নিজস্ব বাজারও বসিয়ে ফেলেছে এর মধ্যে। ভিয়েতনামিদের খাদ্য-অভ্যেসের সঙ্গে বাঙালিদের খুব মিল। দশ-পনেরো বছর ধরে যেসব বাঙালি এ দেশে আছেন, মাংস খেয়ে খেয়ে তাঁদের অরুচি ধরে গেছে, সেইজন্যই তারা বাঙালি খাবারের সন্ধানে ওই সব বাজারে যান।
আমি বেশ ছেলেবেলায় একবার এই সব বিলেত টিলেত দেশ ঘুরে গিয়েছিলুম। তখন আমার ধারণা হয়েছিল, বিদেশেও বাঙালিরা ভাত খায় বটে, আর ফুলকপি-বাঁধা কপি-ঢ্যাঁড়শ এইসব কিছু কিছু তরকারিও পায়, তবে দেশের মতন রুই-কাতলা-ইলিশ মাছ কিংবা পাঁঠার মাংস তো পায় না, কতগুলো বিদঘুঁটে নামের সমুদ্রের মাছ খেয়ে মাছের স্বাদ মেটায় আর পাঁঠার মাংসের বদলে ভেড়ার মাংস খায়, যাতে বেশ বোঁটকা গন্ধ। লন্ডন কিংবা নিউ ইয়র্কের মতন বড় শহরে, যেখানে অনেক ভারতীয়। সেখানে সিন্ধি বা গুজরাটিদের দোকানে পাঁপড়-আচার কিংবা মুসুরির ডাল পাওয়া যেত।
এবার এসে দেখছি সে সব কিছুই বদলে গেছে। এখন আর কিছুরই অভাব নেই, পাওয়া যায় সব কিছুই।
সদ্য দেশ থেকে আসা দ্বিতীয় রায়বাবু জিগ্যেস করলেন, কাঁকড়া? কাঁকড়া যদি পাওয়া যেত, আমি নিজেই রান্না করে আপনাদের খাওয়াতুম।
দাসবাবু বললেন, কেন পাওয়া যাবে না! আমার বাড়িতে টিনের কাঁকড়া আছে। আর যদি ফ্রেস চান তাও এনে দিতে পারি, আমাদের বাজারে প্রায়ই ওঠে।
কাঁকড়া পাওয়া যাবে শুনে দ্বিতীয় রায়বাবুর চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল।
এক মহিলা আমেরিকা থেকে ফেরার পথে প্যারিসে এসে থেমেছেন। তিনি বললেন, নিউ ইয়র্কে কী চমৎকার ইলিশ মাছ খেয়ে এলুম। বিশ্বাসই করা যায় না।
দ্বিতীয় রায়বাবু বললেন, ইলিশ? নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে নিয়ে গেছে। নাকি ঢাকা থেকে?
তখন দু-তিনজন মিলে প্রায় ধমকে উঠে বললেন, কলকাতা-ঢাকা থেকে কেন আনবে? এ দেশে পাওয়া যায় না? ইলিশ কি আপনাদের নিজস্ব। ইলিশ সমুদ্রের মাছ, নদীতে ঢুকলে তখন বাংলায় তার নাম ইলিশ।
আমেরিকা-ফেরত মহিলাটি বললেন, ও-দেশে বলে শ্যাড। অবিকল আমাদের ইলিশের মতন, তবে সাইজে আমাদের চেয়েও বড়। আমাদের দেশে কখনও আট-ন পাউন্ড ওজনের ইলিশ দেখেছেন? অত বড় ইলিশের স্বাদও কিন্তু খুব ভালো।
আমি জিগ্যেস করলুম, নিউ ইয়র্কে কোনও বাঙালি ইলিশের দোকান খুলেছে? মহিলাটি হেসে বললেন, বাঙালির দোকান কেন হবে? বাঙালিরা কোথাও দোকান খোলে না! সাহেবদের দোকান।
আমি একটু নিরাশই হলুম। সারা ভারতবর্ষে বাঙালি ছাড়া আর কেউ ইলিশ খায় না। আমার ধারণা ছিল ইলিশটা একেবারে বাঙালিদের নিজস্ব ব্যাপার। বাঙালি-সংস্কৃতি, বিশেষত বাঙাল সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ। কিন্তু নিউ ইয়র্কে সাহেবদের দোকানে যখন ইলিশ পাওয়া যায়, তখন নিশ্চয়ই সাহেবরাও খায়! হায়, হায়!
আমেরিকা ফেরত মহিলাটি বেশ মাছ-রসিক। তিনি বললেন, ওখানে বাফেলো বলে আর একরকম মাছ আছে, সেটা ঠিক কাতলা মাছের মতন। আর কাৰ্প মানে যে রুই, তা তো জানেনই। আর আছে ক্যাট ফিস, ঠিক আমাদের দেশের বড় আড় মাছ!
দ্বিতীয় রায়বাবু বললেন, মাছের নাম বাফেলো? ক্যাট? দরকার নেই আমার, আমি কোনদিন ওসব মাছ ছুঁয়েও দেখতে চাই না। তার চেয়ে আমার কাঁকড়াই ভালো।
মহিলাটি বললেন, বাফেলো একবার খেয়ে দেখবেন, কলকাতার রুই-কাতলার স্বাদ ভুলে যাবেন। আমার তো ইচ্ছে আছে একবার নিউ ইয়র্ক থেকে একটা পাঁচ কেজি শ্যাড মাছ নিয়ে যাব কলকাতায়, দেশের লোকদের দেখাব।
আমি বললুম, এসব দেশে ভালো-ভালো খাবার পাওয়া যায় জানি। কিন্তু আমাদের দেশের সব খাবারও যে পাওয়া যায়, তা জানতুম না।
তখনই উঠল পটলের প্রসঙ্গ।
দাসবাবু বললেন, শুধু একটা জিনিস খেতে চাইলেও খাওয়াতে পারব না। আলু-পটলের তরকারি!
প্রথম রায়বাবু বললেন, এত বছর ধরে অনেক খুঁজেও আমি পটল পাইনি কখনও।
চৌধুরীবাবু বললেন, দেশে গিয়ে সেই জন্যই আমি রোজ পটল ভাজা খাই!
সেনবাবু বললেন, কতদিন যে দেশে যাইনি!
তিনি যে দীর্ঘশ্বাসটি ফেললেন, সেটা দেশের জন্য, না পটলের জন্য তা ঠিক বোঝা গেল না। আমাদের দেশের আর সব তরকারি এই সব দেশে আসে, শুধু পটলের এই একগুঁয়ে গোয়ার্তুমি কেন? ভিয়েতনামিরাও কি পটল খায় না?
চৌধুরীবাবু বললেন, যাই বলুন, আমাদের দেশে শীতকালে পটল ভাজা এক অপূর্ব জিনিস। এখানে শীত পড়লেই আমার সেই কথা মনে পড়ে।
আমেরিকা-ফেরত মহিলাটি হার মানবার পাত্রী নন। তিনি বললেন, আমরা কিন্তু ওদেশে পটল পাই। ফ্রেস নয় অবশ্য, টিনের।
দাসবাবু বললেন, ও জিনিস আমিও খেয়েছি। আমি টিনের খাবার তেমন পছন্দ করি না, তা ছাড়া ও জিনিসটার স্বাদও ঠিক পটলের মতন নয়।
মহিলাটি বললেন, স্বাদ ঠিক আমাদের পটলের মতন নয় বটে, কিন্তু দেখতে পটলের মতন তো বটে। কলকাতায় যেরকম পটল পাওয়া যায়, নর্থ ইন্ডিয়াতেও তো সেরকম পাওয়া যায় না। আমরা ওই টিনের পটল দিয়েই তরকারি করে খাই।
চৌধুরীবাবু বললেন, আমেরিকা আজব দেশ, সে দেশে নিশ্চয়ই বাঘের দুধও পাওয়া যায়। আমরা ছেলেবেলায় শুনতুম, কলকাতায় নিউ মার্কেটে পয়সা ফেললে বাঘের দুধও পাওয়া যেতে পারে, সেটা কলকাতার ব্যাপারে সত্যি না হলেও নিউ ইয়র্কের ব্যাপারে নিশ্চয়ই সত্যি।
রায়বাবু বললেন, বাঘের দুধ পাওয়া যায় কি না খোঁজ করে দেখিনি, তবে হাতির মাংস পাওয়া যায় শুনেছি।
সবাই হেসে উঠলেও রায়বাবু সজোরে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে কথাটা সত্যি। এমনকী প্রমাণ হিসেবে তিনি একটা নিউজ উইক পত্রিকা এনে ছবি দেখালেন।
আমি বললুম, ফ্রান্সে যখন ঘোড়ার মাংস বিক্রি হয়, তখন আমেরিকায় হাতির মাংস তো পাওয়া যেতেই পারে!
দাসবাবু বললেন, আজকাল অনেক হাতির মতন চেহারার আমেরিকান দেখতে পাচ্ছি, বোধহয় ওই মাংস খেয়েই…।
চৌধুরীবাবু বললেন, আর একটা জিনিস পাই না, সেটা হচ্ছে পান। আমি অবশ্য পানের ভক্ত নই, কিন্তু গত বছর বাবা-মা বেড়াতে এসেছিলেন আমার কাছে, পান পাওয়া গেল না বলে মা তো বেশিদিন থাকতেই চাইলেন না।
রায়বাবু বললেন, পান বোধহয়, লন্ডনে পাওয়া যায়। ওখানে একটু যদি খোঁজ নিতেন …কিংবা আমি তো প্রায়ই লন্ডন যাই, যদি আমাকে বলতেন…
সেনবাবু বললেন, আমেরিকায় পান পাওয়া যায় না?
আমেরিকা-ফেরত মহিলা বললেন, খোঁজ করে দেখিনি, কিন্তু ক্যানাডায় পাওয়া যায়। টোরেন্টোতে জানেন তো রেডিয়োতে হিন্দি গান বাজে, হিন্দি সিনেমার হল আছে, তার সামনে পানের দোকান, ফুচকা, ঝাল মুড়ি…।
আর একজন মহিলা একটু দূরে বসে এক মনে একটা ছবির বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। এতক্ষণ একটিও কথা বলেননি। মহিলাটির রোগা পাতলা চেহারা, প্রথম বেড়াতে এসেছেন। ফরাসি দেশে।
এবার তিনি বললেন, এসব কী হচ্ছে বলুন তো? প্যারিসে বসে শুধু খাওয়া-দাওয়ার আলোচনা! প্যারিসে জগৎ বিখ্যাত সব আর্ট গ্যালারি, মিউজিয়াম সেসব বাদ দিয়ে শুধু খাওয়ার কথা! এই মুহূর্তে একজন ফরাসি ভদ্রলোক এ-ঘরে ঢুকে পড়লে বাঙালিদের সম্পর্কে কী ভাববে বলুন তো!
প্রথম রায়বাবু হাসতে লাগলেন।
দাসবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, কী ভাববে আপনি জানেন? ভাববে, বাঙালিরা সত্যিই রসিক। তক্ষুনি আমাদের এই আলোচনায় যোগ দেবে। ফরাসিরা দারুণ খেতে ভালোবাসে!
চৌধুরীবাবু বললেন, আমাদের দেশের অনেকের ধারণা, ফরাসিরা বুঝি সবাই কবি আর শিল্পী।
আমি বললুম, প্রথমবার আসবার সময় আমারও সেই ধারণা ছিল। এয়ারপোর্টে পা দিয়েই দেখলুম, দুটি ছেলে হাত-পা নেড়ে খুব কথা বলছে। আমার ধারণা হয়েছিল, ওরা কবি।
চৌধুরীবাবু বললেন, এয়ারপোর্টে কবি? খুব সম্ভবত তারা জোচ্চোর।
রোগা-পাতলা মহিলাটি ঝাঁজালো সুরে বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই আসল ফরাসিদের সঙ্গে মেশেন না, বাঙালিরা শুধু বাঙালি খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত। ফরাসিদেশ নিশ্চয়ই কবি আর শিল্পীদেরই দেশ।
রায়বাবু-দাসবাবুরা সমস্বরে হাসতে লাগলেন।
চৌধুরীবাবু বললেন, আমরা ইংরেজদের বেনে বলি, কিন্তু ফরাসিরাও কম বেনে নয়। আমেরিকার মতন বড় বড় ডাকাত এ দেশে না থাকলেও ঠগ-জোচ্চোর অসংখ্য। কবি-শিল্পী তো মাত্র হাতের এক মুঠো, বাকি সব ফরাসিরা বেশ স্বার্থপর ধরনের।
সেনবাবু বললেন, বেনেগিরি আর ডাকাতিতে ইংরেজরা যখন ওয়ার্ল্ডের টপ, সেইসময়ই সেদেশে শেক্সপিয়র জন্মায়। ফরাসিরাও যখন ব্যাবসা বাণিজ্যে খুব উন্নতি করে, তখনই এদেশের কিছু লোক ভালো কবিতা লেখে, ছবি আঁকে।
চৌধুরীবাবু বললেন, ফরাসিরা কলোনিগুলোতে যা অত্যাচার করেছে, সেই তুলনায় ইংরেজরা তো অতি ভদ্র! এখনও তো ফ্রান্স নির্লজ্জের মতন সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে ব্যাবসা করে।
প্রথম রায়বাবু বললেন, ওসব কথা ছেড়ে দিন। ফরাসিরা শিল্প-সাহিত্য সত্যিই ভালোবাসে বটে, তবে খেতেও খুব ভালোবাসে। ভালো-ভালো জিনিস খাওয়াও এদের কালচারের একটা অঙ্গ! চিজ আর ওয়াইন নিয়ে কত সূক্ষ্ম আলোচনা হয়..।
চৌধুরীবাবু বললেন, রাখুন মশাই কালচার। আমার অফিসের ফরাসিদের দেখছি তো, লাঞ্চের সময় হলেই ওদের আর জ্ঞান থাকে না। অমনি ছুটে গিয়ে গপগপ করে খাবে। অত বেশি খায় বলেই এদের অনেকেরই পেটের রোগ।
রোগা-পাতলা মহিলাটি আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, আমরা কি পঁপিদু সেন্টারে যাব না? বসে-বসে এইসব আলোচনাই শুনব?
আমি বললুম, যাক বাবা, আমার কী দোষ? সবাই গেলেই আমি যেতে পারি।
দাসবাবু বললেন, আজ ছুটির দিন, আজ সেখানে মস্তবড় লাইন হবে। দু-তিন ঘণ্টা দাঁড়াতে হবে।
মুখার্জিবাবু বললেন, চলুন, তবু যাওয়া যাক। এঁরা মাত্র কয়েকদিনের জন্য এসেছেন। সবক’টা আর্ট গ্যালারি দেখা হবে না। পপিদু সেন্টার তো অবশ্যই দেখা উচিত।
চৌধুরীবাবু বললেন, যাচ্ছেন যান। কিন্তু গুণে দেখবেন তো সেখানে কতজন ফরাসি আছে? দেখবেন, বেশিরভাগই বাইরের লোক।
যাওয়ার উদ্যোগ-আয়োজন করতে-করতেই বৃষ্টি এসে গেল। এই বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কারুর নেই। রোগা-পাতলা মহিলাটি বেশ মনমরা হয়ে গেলেন। আবার শুরু হল আড্ডা।
আড্ডাস্থলটি প্রথম রায়বাবুর বাড়ি। দুপুর বেশ গাঢ় হতে তিনি প্রস্তাব করলেন, আজ আর বেরিয়ে কী হবে? এখানেই খিচুড়ি-টিচুড়ি কিছু বেঁধে পিকনিক করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় রায়বাবু সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, আমি রান্না করতে রাজি আছি।
চৌধুরীবাবু বললেন, চলুন, তা হলে কিছু চিংড়িমাছ কিনে আনা যাক। আর ফুলকপি। খিচুড়ির সঙ্গে জমে যাবে!
ছোট একটা দল বাজারে যাবার জন্য তৈরি হতেই আমি জুটে গেলুম তাদের সঙ্গে। বাজারে যাওয়াও একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
বাজার মানে মার্কেট তো নয়, আজকালকার ভাষায় একে বলে শপিং মল। বিশাল জায়গা জুড়ে এক চমৎকার আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন। এখানে সূচ-সুতো থেকে মোটরগাড়ি পর্যন্ত সবই পাওয়া যায়। দোতলা-তিনতলায় ওঠবার জন্য সিঁড়ির বদলে এলিভেটর, চতুর্দিকে শুধু কাঁচের দেয়াল, তার মধ্যে আলাদা-আলাদা জিনিসের ঘর। ইন্দ্রপুরীর মতন ঝকঝক করছে সব কিছু। আমার ছেলেবেলায় দেখা ফরাসিদেশের সঙ্গে এখনকার ফরাসিদেশের যেন অনেক অমিল। সে বারে দেখেছি প্রাচীন ঐতিহ্য, এবারে অনেক কিছুই টাটকা-নতুন। মাঝখানের দু দশকে ফরাসিদেশ যেন হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেছে।
মাছ-মাংসের দোকানে গিয়ে চোখ একেবারে ছানাবড়া হবার জোগাড়। এত রকমের খাদ্য! চিংড়ি মাছই পাঁচ-ছ’রকম, বিরাট-বিরাট লম্বা বান মাছ, তা ছাড়া গোল-চ্যাপ্টা-মোটা কতরকমের যে নাম না জানা মাছ, তার ঠিক নেই। মাংসের দোকানের বাইরে আস্ত-আস্ত খরগোশ ঝোলানো। খাঁচার মধ্যে পায়রা রাখা রয়েছে, যেটা পছন্দ হবে, সঙ্গে-সঙ্গে সেটা কেটেকুটে ঠিক করে দেবে। সেসব এক-একটা পায়রার সাইজ আমাদের দেশের পায়রার তিনগুণ। তারপর হাঁস, ঘোড়া, হরিণ, ভেড়া, গরু, শুয়োর আরও যে কত ছাল ছাড়ানো জন্তু তার ঠিক নেই। এক সঙ্গে এত খাবার দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে। পাশের তরকারির দোকানও কম যায় না, রাবণের সাইজের ফুলকপি আর ভীমের গদার সাইজের বেগুন। তার পাশের দোকানে অন্তত একশো রকমের কেক আর দুশো রকমের চিজ। মনে হয় যেন এত খাবার এক অক্ষৌহিণী সৈন্যও খেয়ে শেষ করতে পারবে না।
আমি চৌধুরীবাবুকে চুপিচুপি জিগ্যেস করলুম, আচ্ছা, ফ্রান্সের অনেক দোকানেই এত থরে-থরে খাবার সাজানো দেখি। এত খাবার কে খায়? অথচ পাশের দেশ পোল্যান্ডে এখন দারুণ খাদ্যাভাব চলছে। কাগজে রোজই পড়ি, সেখানে মাংসের দোকানের সামনে লম্বা লাইন। তাও সবাই পায় না। বাচ্চাদের খাবারের পর্যন্ত শর্টেজ। ফ্রান্সের এত খাবার, এর কিছুটা এরা পোল্যান্ডে পাঠিয়ে দিলে পারে না?
চৌধুরীবাবু বললেন, নীললোহিতবাবু, আপনাকে আমি বেশি সরল বলব, না বোকা বলব? এরকম প্রশ্নের কোনও মানে হয়? বড়লোকের বাড়িতে কত খাবারদাবার থাকে, কত খাবার নষ্ট হয়, তা বলে কি বড়লোকরা সেইসব খাবার গরিবদের দিয়ে দেয়?
আমি থতমত খেয়ে চুপ করে গেলুম। সত্যিই আমি মাঝে-মাঝে বড় বোকার মতন কথা বলে ফেলি। সেইজন্যই আমার চেনাশুনো লোকেরা মাঝে-মাঝে বলে, নীললোহিতটা একটা হাবা গঙ্গারাম!